বিবর
লেখক: সুমিত বর্ধন
শিল্পী: সুমিত বর্ধন
১
অতল বিবরের সঠিক ইতিহাস অজানা। কিংবদন্তীতে, জনশ্রুতিতে, দেবাসুরের সংগ্রাম থেকে আরম্ভ করে আকাশ থেকে নেমে আসা উল্কাপাত অবধি নানা ধরনের কাহিনি ছড়িয়ে থাকলেও ভূখণ্ডব্যাপী এই অতলান্ত গহ্বরের উৎপত্তি নিয়ে বিজ্ঞান এই যন্ত্রসভ্যতার যুগেও ধোঁয়াশায়।
কয়েক হাজার মাইল ব্যাসের দানবিক বৃত্তের মতো ভূখণ্ড জুড়ে ছড়িয়ে থাকা গহ্বর প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ নীলাভ কুয়াশায়। কুহেলিকার সেই নীল নিশ্ছিদ্র আস্তরণের মধ্যে থেকে ইতস্তত বর্শার মতো মাথা উঁচিয়ে থাকে অজস্র পাহাড় চূড়ো। শ্যাওলা আর গুল্মের সবুজ ছিটে লাগা তাদের রুক্ষ, ক্রকচ শিখরের নীচের অংশে কী আছে তা বোঝার কোনও উপায় নেই।
কোনও অতিকায় জীবাণুর শরীরের চারপাশে ছড়ানো তন্তুর মতো গহ্বরের কিনারা থেকে শিরা-উপশিরার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে অগুন্তি ফাটল। আর এইসব ফাটল আশ্রয় করে গহ্বর ঘিরে গড়ে উঠেছে একের পর এক শহর— আয়সনগর, খনিজাবাদ, শক্তিগড়।
অতীতে মানুষ ভয়ে ভক্তিতে সম্ভ্রমে এই মহাকূপকে এড়িয়ে চললেও এ যুগের যন্ত্রসভ্যতা তার ফাটলের তন্তুতে জড়িয়ে গেছে। তার কারণ একটাই।
বজ্রহিম।
গহ্বরের তলা থেকে উঠে আসা নীলচে কুয়াশা ফাটলের খাদের দেওয়ালে যে তুষারনীল ক্রিস্ট্যাল হয়ে থরে থরে জমে থাকে তার নাম বজ্রহিম। থমাটার্জিক প্রক্রিয়ায় এই বজ্রহিম থেকেই উৎপন্ন হয় এনার্জি, যন্ত্রসভ্যতার অপরিহার্য চালিকাশক্তি। এই বজ্রহিমের শক্তিতেই আয়সনগর হয়ে উঠেছে সভ্যতার অন্যতম উৎপাদন কেন্দ্র।
আয়সনগরের কালো পাথর বাঁধানো রাস্তার ওপর সন্ধে জমে আসে। পথচারীদের পায়ে পায়ে জড়ায় কুয়াশার তন্তু, মাথার ওপর বৃষ্টির মিহি গুঁড়ো ঝরে পড়ে স্লেট বর্ণের ধূসর আকাশ থেকে।
রাস্তার কালো পাথরের চৌকোনা টুকরোগুলো বৃষ্টির জল মেখে চকচক করে, তাদের ওপর পড়ে দু-পাশের গ্যাসলাইটের নীলচে আলো।
গ্যাসলাইটের আলো লেবারপাড়ার ঘিঞ্জি রাস্তার ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়া কদাকার ত্রিভঙ্গ বাড়িগুলোর ওপরেও পড়ে। তাদের নিচের তলায় মদের গুমটি, জুয়োর আড্ডা, বেশ্যাখানা আর সাহুকারের গদির সামনে সন্ধে আর মানুষের ভিড় একই সঙ্গে ঘন হয়। হাসির হররা, অশ্রাব্য গালাগালি আর অসংলগ্ন কথার টুকরো বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে।
মাঝে মধ্যে রাস্তা কাঁপিয়ে সদর্পে ছুটে যায় ঝকঝকে পালিশ তোলা ব্রুহ্যাম কিম্বা ল্যান্ডো গাড়ি। তাদের সামনে জোতা অস্থিসর্বস্ব কলের ঘোড়ার লৌহপিঞ্জরের ফাঁকে আর অক্ষিকোটরে দপদপ করে জ্বলে থমাটার্জিক ইঞ্জিনের নীল দ্যুতি। পথের ভিড় শশব্যস্তে ছড়িয়ে যায় এদিক সেদিক। তবে সে কেবল কিছুক্ষণের জন্যেই। একটু বাদেই দূরে সরে যায় গাড়ির সঘোষ উপস্থিতি, ভিড় ফিরে আসে নিজের জায়গায়।
লম্বা পায়ে ভিজে আলো মাড়িয়ে হাঁটেন ডক্টর সরকার। দু-হাত তাঁর ঢোকানো রেনকোটের পকেটে, চওড়া কপালের নিচে দু-জোড়া চোখের দৃষ্টি ভিড়ের ওপর, মাথার একরাশ চুলের ওপর মিহি জলের গুঁড়ো চকচক করে মুক্তোর মতো। লেবারপাড়া দিয়ে হেঁটে গেলে তাঁর কিছুটা ঘুরপথ হয় বটে, কিন্তু সভ্যতার ইমারত গড়ার মূল্য চুকিয়ে যারা সমাজের কাছে ব্রাত্য হয়ে পড়ে তাদের কথা নিজেকে মনে করাতেই তিনি এই পথ দিয়েই রোজ হাঁটেন তিনি।
গ্যাসলাইটের লোহার থামের গায়ে হেলান দিয়ে পথের ওপর পা ছড়িয়ে বসে একজন আপন মনে বিড়বিড় করে। তার একহাতে একটা সস্তা মদের বোতল, আর একটা খালি বোতল গড়াগড়ি যায় দু-পায়ের ফাঁকে। নিচু হয়ে তার পা-দুটোকে একপাশে সরিয়ে দেন ডক্টর সরকার। পায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চলে গেলে মানুষটা চিরজীবনের জন্যে খোঁড়া হয়ে যাবে।
একটু দূরেই ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা হল্লা ওঠে। একটা সাহুকারের গদির সামনে দুচারজন মিলে কাউকে মারধোর করছে। খুব সম্ভব সাহুকারের গুণ্ডারা কোনও পাওনাদারকে কিস্তি খেলাপ করার শিক্ষা দিচ্ছে। এ দৃশ্য এ পাড়ায় নতুন নয়, ঋণ আদায়ের আইন এখানে আলাদা।
মার খেয়ে লোকটা মাটিতে পড়ে যায়, তবুও তার ওপর লাথি ঘুঁষির বৃষ্টি অবিরাম পড়তে থাকে। রেনকোটের পকেটে ঢুকিয়ে রাখা মুঠো দুটো শক্ত হয়ে আসে ডক্টর সরকারের, কিন্তু তাঁর হাঁটার গতি শ্লথ হয় না। গুণ্ডাদের বাধা দেওয়ার মতো তাঁর দৈহিক ক্ষমতা নেই। লোকটার দেনা হয়তো তিনি চাইলে মিটিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু এভাবে তিনি কতজনকে সাহায্য করবেন? একজন দুজনকে সাহায্য নয়, তাঁর লক্ষ্য প্রযুক্তির ধাক্কায় সমস্ত ব্যবস্থাটাকে পালটে দেওয়া।
“স্যার সারাদিন কিছু খাইনি! দশটা টাকা দেবেন স্যার?”
চিন্তায় বাধা পড়ে ডক্টর সরকারের। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন তাঁর পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে। পরণে ময়লা পোশাক, বজ্রহিমের নীল গুঁড়ো মাখা অনাহারক্লিষ্ট মুখের ওপর বৃষ্টির জলের ডোরাকাটা দাগ।
বজ্রহিম খাদের লেবার।
ডান হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরে লোকটা “দিন না স্যার দশটা টাকা! মাইরি বলছি, সারাদিন কিচ্ছু খাইনি।”
এ দৃশ্যও নতুন নয় ডক্টর সরকারের কাছে। দ্বিরুক্তি না করে পকেট থেকে একটা নোট টেনে বের করে গুঁজে দেন বাড়ানো হাতের তালুতে। আড়চোখে দেখতে পান টাকাটা পেয়েই লোকটা উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় দেয় একটা জুয়াখানার দিকে।
একটা নিশ্বাস ফেলে লম্বা পায়ে হাঁটতে থাকেন ডক্টর সরকার।
২
অতল বিবরের একটা ফাটল অবধি এসে হঠাৎ করেই ফুরিয়ে যায় লেবারপাড়া। তার ওপরে বেছানো লোহার ব্রিজটা পার হন ডক্টর সরকার। ব্রিজের দু-পাশের গ্যাসলাইটের নিচে চড়া প্রসাধন মেখে দাঁড়িয়ে থাকে দেহপসারিণীরা, তাদের পাশ কাটিয়ে টলতে টলতে পথ চলে মাতালের দল। মাঝে মধ্যে দু-একটা কলের ঘোড়ায় টানা গাড়ি ছুটে আসে ব্রিজের লোহার কাঠামোয় আগুনের ফুলকি ছুটিয়ে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে বাতিস্তম্ভের পাশ থেকে রঙিন সাজপোশাকে মোড়া একটা শরীরকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েই আবার গর্জন তুলে মিলিয়ে যায় ব্রিজের অন্যপ্রান্তে।
কুয়াশা আরও গাঢ় হয়ে জমে পায়ের কাছে, পকেটে হাত রেখে কুয়াশা মাড়িয়ে ব্রিজ পেরোন ডক্টর সরকার।
ব্রিজের এদিকটা শিল্পাঞ্চল। রাস্তার একদিকে আকাশচুম্বী মিনারের মতো পরের পর দাঁড়িয়ে লোহার পাত আর নাটবল্টু আঁটা কারখানার লম্বাটে বহুতল বাড়িগুলো। তাদের ব্রোঞ্জের ফ্রেমে বাঁধানো জানলার মোটা কাচ পেছনের নীল আলোয় ঝকঝক করে হীরের টুকরোর মতো। ব্যস্ত পিঁপড়ের মতো বাড়ির গা বেয়ে ওঠা নামা করে তামা আর পেতলের পাতে বাঁধা মালবাহী লিফটের সারি। রাস্তার অন্যদিকে মাটির তলা থেকে মাথা উঁচিয়ে অবিরাম ব্যস্ততায় কাজ করে চলে ছোট বড় গিয়ার, শাফট, পিস্টন আর অন্য নানা বলযন্ত্র, ভূগর্ভের যন্ত্রশালার উপরিভাগ।
একটা উঁচু বাড়ির সামনে এসে হাঁটা থামান ডক্টর সরকার। এটা ভালকান ফাউন্ড্রির অফিস, তাঁর কর্মস্থল। দু-পাশে সিংহের মর্মর মূর্তি বসানো কয়েক ধাপ চওড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসেন তিনি দরজার সামনে। দরজার দু-দিকে দাঁড়ানো দুই মাস্কেটধারী বরকন্দাজ শশব্যস্তে ঠেলে খুলে ধরে তামা আর ব্রোঞ্জের নক্সা বসানো ভারী কাঠের দুই পাল্লা।
দরজার পার হয়ে বিশাল একটা হলঘর, তার উঁচু সিলিঙে বসানো বিশাল আকারের ঝাড়বাতি থেকে চারপাশে ছড়িয়ে দেয় বজ্রহিমের নীলাভ আলো। ঘরের একদিক থেকে অন্যদিকে ফাইল, ড্রয়িং কিম্বা কাগজের তাড়া হাতে লোকে দ্রুত পায়ে আনাগোনা করে, তাদের চোখেমুখে ব্যস্ততার ছাপ সুস্পষ্ট।
জোর কদমে হলঘর পেরোন ডক্টর সরকার, লোকে সসম্ভ্রমে তাঁর পথে ছেড়ে দেয়। তিনি এই কারখানার চিফ থমাটার্জিস্ট, কোম্পানিতে তাঁর স্থান ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পরেই।
হলঘর পার হয়ে কাচের ক্যাপসুলের মতো লিফটের সারি। তারই একটাতে পা রাখেন ডক্টর সরকার, চাপ দেন পেতলের বাঁকানো হাতলে। মৌমাছির গুঞ্জনের মতো শব্দ করে নীল আলোর দ্যুতি মাখা কাচের লিফট তাঁকে পৌঁছে দেয় বাড়ির একদম ওপরের তলায়।
এই তলাতেই ডক্টর সরকারের খাস অফিস। অফিস এবং ল্যাবরেটরি। ল্যাবরেটরি এবং লাইব্রেরি।
এবং প্রধানত লাইব্রেরি। আধুনিক সভ্যতা চলে থমাটার্জির ইন্দ্রজালতন্ত্রে। জগতের যেখানে থমাটার্জির যা বই পাওয়া যায়, বহু ব্যয়ে এবং বহু কষ্টে সে সমস্ত জোগাড় করে তিলতিল করে গড়ে তোলা লাইব্রেরি। ডক্টর সরকারের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।
“গুড ইভনিং স্যার!” ডক্টর সরকার লিফট থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর হাত থেকে ভিজে রেনকোটটা নিয়ে নেয় বসন্ত, তাঁর খাস অনুচর।
বসন্তর বয়স বেশি নয়, তিরিশের কোঠায় হবে। কিন্তু তার বসে যাওয়া গালে, আর শীর্ণ শরীরে অতীতের দুঃসময় বরাবরের জন্যে তার চিহ্ন রেখে গেছে।
বসন্ত দিকে তাকান ডক্টর সরকার। তাঁর মনে পড়ে যায়, বছর দশেক আগে এমনই এক বৃষ্টিভেজা সন্ধেতে তিনি লেবারপাড়া থেকে বসন্তকে একরকম কুড়িয়ে এনেছিলেন।
“গুড ইভনিং বসন্ত, কেউ এসেছিল?”
রেনকোটটা একটা ব়্যাকে টাঙিয়ে দিয়ে ডক্টর সরকারের হাতে একটা ধোঁয়া ওঠা কফির মগ ধরিয়ে দেয় বসন্ত, “না স্যার, তবে বীরেন স্যার বিকেলের দিকে একবার কল করেছিলেন, হেডিস মাইনিং-এর প্রজেক্টের কাজটার জন্যে তাগাদা দিচ্ছিলেন।”
কফির ঘ্রাণ বুকে ভরে টেনে নিয়ে কফিতে চুমুক দেন ডক্টর সরকার। বই বাদ দিলে তাঁর আর এই একটাই বিলাসিতা।
“আর স্যার—” গলা খাঁকারি দেয় বসন্ত, “ওঁকে বেশ বিরক্ত মনে হল। বলছিলেন, প্রজেক্ট শেষ করতে দেরি হচ্ছে, কোম্পানির লোকসান হচ্ছে।”
কফির স্বাদটা কেমন একটু বেশিই তেতো লাগে ডক্টর সরকারের মুখে।
“এই সব সামান্য ব্যপারে আমাকে বিরক্ত না করলেই নয়? এসব তো বিশ্বনাথের দেখার কথা। বীরেন বিশ্বনাথের সঙ্গে কথা বলেনি?”
“জানি না, স্যার! বলতে পারছি না।”
“ঠিক আছে! ডাকো বিশ্বনাথকে।”
একটু বাদে ঘরের বিশাল দরজার তামার পাত বসানো পাল্লা দুটো ঠেলে হাতে কয়েকটা ফাইল হাতে এসে ঢোকে বিশ্বনাথ।
“গুড ইভনিং স্যার! ডাকছিলেন?”
বিশ্বনাথের পোশাকে পারিপাট্যের অভাব নেই, ধপধপে সাদা শার্টের বুকের ওপর ঝলসায় ঘড়ির সোনার গার্ড চেন, আয়নার মতো চকচক করে জুতোর পালিশ। কোট আর প্যান্টের ভাঁজ এমন নিখুঁত যেন এই সবেমাত্র ইস্তিরি করা হয়েছে।
কিন্তু তার চেহারার সঙ্গে পোশাকের এই পারিপাট্য বড় একটা মানায়নি। খাটো দুটো পায়ের ওপর বসানো শরীরটা প্রায় বর্তুলাকার। চুল সযত্নে আঁচড়ানো হলেও তাতে ভালো করে মাথা ঢাকেনি। ভারী মুখের ত্বকের পরতে চোখ দুটো প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। তাদের চাহনি কেমন ঘোলাটে, শীতল।
“হ্যাঁ বিশ্বনাথ। বীরেনের সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে? বসন্ত বলছিল হেডিস মাইনিং-এর প্রজেক্টে নিয়ে কী সমস্যা হয়েছে।”
“হ্যাঁ স্যার। কথা হয়ে গেছে স্যার। ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না স্যার।”
“দেখো বিশ্বনাথ, আমি একটা বড় কাজে হাত দিয়েছি। এইসব খুঁটিনাটি জিনিস তুমি যদি ঠিক করে তদারক না করো, তাহলে আমি নিজের কাজ করি কী করে?”
“নিশ্চয়ই স্যার, নিশ্চই!” ঘামে ভেজা হাতদুটো কচলায় বিশ্বনাথ, “আমি সব সামলে নিয়েছি স্যার, কিছু ভাববেন না। আপনি খালি এই ফাইল দুটো একটু সই করে দিন স্যার।”
অন্যমনস্কভাবে বিশ্বনাথের বাড়িয়ে দেওয়া ফাইলে সই করতে থাকেন ডক্টর সরকার।
“তবে স্যার, এবারে বীরেন সাহেব একটু বেশিই রেগে ছিলেন মনে হল। বেশ কড়া কড়া কথা বলছিলেন।” ফের হাত কচলায় বিশ্বনাথ।
সই করতে করতে থেমে যায় ডক্টর সরকারের হাত, কপাল কুঁচকে তিনি তাকান বিশ্বনাথের দিকে, “কী বলছিল?”
জিভ কাটে বিশ্বনাথ, “সে স্যার আমি আপনাকে বলতে পারব না।”
চোয়াল শক্ত করে ফাইল ফেরৎ দেন ডক্টর সরকার, “দেখো বিশ্বনাথ, বীরেন ভালকান ফাউন্ড্রির জেনারেল ম্যানেজার হতে পারে, কিন্তু আমি চিফ থমাটার্জিস্ট।”
“নিশ্চয়ই স্যার! অবশ্যই স্যার!” বিশ্বনাথের চেহারা দেখে মনে হল সে পারলে একেবারে মাটিতে মিশে যায়।
চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে, ডক্টর সরকারের, “একটা ব্যাপার তোমরা ভুলে যেও না। থমাটার্জির ইন্দ্রজালতন্ত্র হল এই আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি। আর দুনিয়ায় আমার সমকক্ষ থমাটার্জিস্ট খুব কমই আছে। বীরেন হয়তো ব্যাবসা ধরে আনে, কিন্তু আমার আবিষ্কার, আমার রিসার্চ ছাড়া সে ব্যাবসা সম্পন্ন করার রাস্তা নেই। বুঝলে?”
“নিশ্চয়ই, স্যার! অবশ্যই স্যার! সে আর বলতে স্যার!” ডক্টর সরকারের অগ্নিদৃষ্টির সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচে বিশ্বনাথ।
আর এক মগ কফি এনে টেবিলে নামিয়ে রাখে বসন্ত, “এই কফিটা নিন স্যার, আগেরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।”
সস্নেহে বসন্তর দিকে তাকান ডক্টর সরকার, “তুমি না থাকলে আমি যে কী করতাম বসন্ত!”
একটা ম্লান হাসি ফুটে বসন্তর ঠোঁটে, “তা বলতে পারি না স্যার, তবে আপনি না থাকলে আমি কী করতাম জানি না। হয়তো খাদানেই ফুরিয়ে যেতাম এতদিন।”
“তুমি একা নও, বসন্ত।” একটা জানলার কাছে এগিয়ে গিয়ে শার্শিটা দু-হাতে খুলে দেন ডক্টর সরকার, “তোমার মতো অগুন্তি মানুষ আছে যাদের জীবন প্রতিদিন বজ্রহিমের খাদানে ফুরিয়ে যায়।”
জানলার বাইরে আঙুল তুলে দেখান ডক্টর সরকার। সেখানে অন্ধকারে হীরের কুচির মতো জ্বলে আয়সনগরের নানান ইমারত, মহল্লা, বাসগৃহ আর কারখানার আলো। যেন নক্ষত্রখচিত আকাশের একটা টুকরো কেউ কেটে এনে বিছিয়ে দিয়েছে জমিতে।
একটা দমকা হাওয়া খানিকটা বৃষ্টির গুঁড়ো ছিটিয়ে দেয় ঘরের মধ্যে। বাইরে থেকে নজরে ফিরিয়ে বসন্তর দিকে তাকান ডক্টর সরকার, “আয়সনগরের এই সভ্যতার উপাদান আসলে তিনটে। প্রথম দুটোর কথা সবাই জানে। থমাটার্জির জাদুশক্তি আর বজ্রহিম। একশো বছর আগেও যে সব কাজ মানুষে করত, সেই সব কাজ করে যন্ত্রে। আর যন্ত্র চলে বজ্রহিম আর থমাটার্জির মিলিত প্রয়োগে। কিন্তু এ দুটো ছাড়াও সভ্যতার তৃতীয় উপাদানটা কী জানো বসন্ত?”
নীরবে দু-পাশে মাথা নাড়ে বসন্ত।
আঙুলটা এবার বসন্তর দিকে তোলেন ডক্টর সরকার, “মানুষ। মানুষের জীবন। সভ্যতার তৃতীয় উপাদান মানুষের জীবন। তোমার মতো আরও হাজার হাজার মানুষের জীবন। সেই সব মানুষ, যারা খাদান থেকে বজ্রহিমের চাঙড় কেটে আনে। নাক, রোমকূপ দিয়ে শরীরে ঢুকে বজ্রহিমের গুঁড়ো যাদের জীবন বিষিয়ে দেয়। ক্ষয়রোগ, পঙ্গুত্ব, এবং আরও নানা রোগ যাদের জীবনকে নরক করে তোলে।”
একটা বইয়ের তাকের দিকে ইঙ্গিত করেন ডক্টর সরকার, “ওই ওপরের তাক থেকে মোটা বইটা পেড়ে টেবিলে রাখো। তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।”
নির্দেশ পালন করে বসন্ত। বইটা সযত্নে খোলেন ডক্টর সরকার, পরম মমতায় হাত বোলান পাতার ওপর।
বইটা দেখে বোঝা যায় দামি। চামড়ার পাতার ওপর রঙিন কালিতে হাতে আঁকা।
পাতায় আঁকা একটা ড্রয়িং আর তার পাশে দুর্বোধ্য লিপিতে লেখা কিছু সাংকেতিক চিহ্নের দিকে আঙুল তুলে দেখান ডক্টর সরকার, “এটা আমার সংগ্রহের সবচাইতে মূল্যবান বই। হিমশীতল লেঙ মালভূমির মরুমন্দিরের পুরোহিতরা থমাটার্জির ইন্দ্রজালতন্ত্রের এমন সব সূত্র সমাধান করে ফেলেছে যা আমাদের আজও অজানা। এই বইটা তাদেরই এক গোপন লাইব্রেরি থেকে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে, বহু কষ্টে, বহু ব্যয়ে জোগাড় করে আনা। এই ছবিটা দেখছ? যদি এই প্রযুক্তি আয়ত্ত করতে পারি তাহলে, মানুষ নয়, খাদান থেকে বজ্রহিম তুলবে মানুষের মতো যন্ত্র।”
কিছু না বুঝতে পেরে অবাক চোখে ডক্টর সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকে বসন্ত।
মৃদু হাসেন ডক্টর সরকার, “আসল ঘোড়ার বদলে যদি থমাটার্জিতে চলা কলের ঘোড়া এ যুগে গাড়ি টানে, তাহলে আসল মানুষের বদলে খাদানে কলের মানুষের কাজ করতে বাধা কোথায়?”
টেবিলের তলা থেকে একটা পালিশ করা কাঠের বাক্স তুলে আনেন ডক্টর সরকার। ঝকঝকে পেতলের লকগুলো খুলে তুলে ধরেন ডালা।
বাক্সের ভেতরটা কালো মখমলে মোড়া। তার ওপর বসানো ব্রোঞ্জের যন্ত্রাংশ, তামা আর কাচের প্যাঁচানো টিউব, আর জটপাকানো তারের মাঝখানে শোয়ানো একটা ন্যাসপাতির আকারের কাচের বল।
হাত তুলে বাক্সের দিকে দেখান ডক্টর সরকার। “ওই বই থেকে থমাটার্জির নানা অজানা থিয়োরি ব্যবহার গড়ে তুলেছি এটাকে। কলের মানুষ গড়ার প্রথম ধাপ।”
বাক্সের ভেতরে কলকবজার সঙ্গে মানুষের চেহারার সাদৃশ্য দেখতে না পেলেও কোনও প্রশ্ন করার সাহস দেখায় না বসন্ত। ডক্টর সরকার বাক্সের ভেতর বসানো কয়েকটা ডায়াল ঘোরান, দু-একটা তার এদিক সেদিক এঁটে দেন, তারপর একটা সুইচ অন করে দেন।
বাক্সের ভেতর থেকে ভেসে আসে থমাটার্জি শক্তির গুঞ্জন, নীলরঙের কোনও তরল ওঠানামা করে কাচের টিউবের ভেতর দিয়ে, আর তার একটু পরেই এক অপার্থিব নীল দ্যুতিতে ভরে ওঠে কাচের লম্বাটে বলটা।
বসন্ত দেখতে পায় এক অদ্ভুত আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ডক্টর সরকারের মুখ। যেন কোনও রাজ্য জয় করে ফেলেছেন তিনি।
বাক্সের ভেতরে একটা জাল বসানো চাকতির কাছে মুখ নিয়ে যান ডক্টর সরকার, উচ্চকণ্ঠে বলেন, “গুড ইভনিং, জেগে আছো?”
জালের মধ্যে থেকে ভেসে আসে একটা মিহি রিনরিনে কণ্ঠস্বর, “গুড ইভনিং, হ্যাঁ জেগে আছি।”
“আমাদের একজন বন্ধু এখানে আছে— বসন্ত। তাকেও গুড ইভনিং জানাও।”
“গুড ইভনিং বসন্ত।” উত্তর আসে জাল বসানো চাকতি থেকে।
ডাইনে বাঁয়ে সামান্য ঘাড় নাড়েন ডক্টর সরকার, “ঠিক হল না, আর একবার চেষ্টা করো। নিজের পরিচয়টা দাও।”
ফের চাকতি থেকে ভেসে আসে রিনরিনে কণ্ঠস্বর, “গুড ইভনিং বসন্ত, আমি মানিনী!”
বাক্সের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে দেন ডক্টর সরকার, “এই দেখো বসন্ত, মানিনী। এখনও অনেক কাজ বাকি, কিন্তু একদিন এই মানিনী একজন পূর্ণাঙ্গ কলের মানুষ হয়ে দাঁড়াবে।”
বাক্সের টুকরোটাকরা যন্ত্র আর কথা বলা চাকতির মধ্যে ভবিষ্যতের কলের মানুষের কোনও আগামী অবয়ব বসন্তর চোখে পড়ে না। কিন্তু ডক্টর সরকারের উচ্ছ্বাসে সে কোনও বাধা দেয় না।
কারণ তাঁর মুখের ঔজ্জ্বল্যে পিতৃগর্বের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পায় সে।
৩
বৃষ্টি সারারাত ধরে আয়সনগরকে ভিজিয়ে সকালে ক্ষান্ত হয়। কিন্তু আরও একবার বিরামহীন বর্ষণের হুঁশিয়ারি দিয়ে আকাশে ভারী হয়ে জমতে থাকে মেঘ। যেন বর্ষণদেবতা আসন্ন সংগ্রামের প্রস্তুতিতে আকাশে একত্রিত করেন তাঁর বারিদবাহিনীকে।
মেঘ জমে ডক্টর সরকারের ভাগ্যাকাশেও। বীরেন আর তাঁর উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ে দিয়ে শুরু হয় ভালকান ফাউন্ড্রির সকাল। তাঁদের দুজনের সম্মিলিত চিৎকারে কাঁপতে থাকে ডক্টর সরকারের লাইব্রেরি।
বীরেনের শরীরটি লম্বায় সাড়ে ছ-ফুটের কাছাকাছি হলেও সম্পূর্ণ মেদবাহুল্য বর্জিত। তার দামি কোটটা তার অস্থিসর্বস্ব কাঁধ থেকে প্রায় হ্যাঙারে রাখার মতো করে ঝোলে। করোটির মতো চওড়া কপালের একপাশে উত্তেজনায় দপদপ করে একটা মোটা ধমনী। তার সঙ্গে তাল রেখে ওঠা পড়া করে গলা থেকে পাথরের টুকরোর মতো উঁচিয়ে থাকা কণ্ঠমণি। দু-হাতের টেবিলের ওপর শরীরের ভরে রেখে চিৎকার করে সে।
“কলের মানুষ! কোম্পানির টাকা কি বাচ্ছাদের খেলনা বানানোর জন্যে? এদিকে একের পর এক প্রজেক্টে লোকসান হচ্ছে!”
“কোনওটা বাচ্ছাদের খেলনা, আর কোনওটা থমাটার্জির গবেষণা বোঝার মতো ক্ষমতা তোমার নেই!” টেবিলের উলটোদিকে গলানো লাভার মতন উত্তাপে উত্তর দেন ডক্টর সরকার, “ভুলে যেও না এই কোম্পানি চলে থমাটার্জির জোরে।”
“ভুল!” সজোরে টেবিলে কয়েকটা ফাইল আছড়ে ফেলে বীরেন, “কোম্পানি চলে লাভ লোকসানের খতিয়ানে। ভালকান ফাউন্ড্রি একটা ব্যাবসা। ধর্মশালাও নয়, খয়রাতখানাও নয়।”
হাত ঘুরিয়ে লাইব্রেরির চারপাশটা দেখায় বীরেন, “তোমার এই সখ মেটাতে হলে নিজের পয়সায় মেটাও। কোম্পানির লোকসান হলে তুমি কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য!”
“তোমাকে আমি কোনও কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য নই!” উত্তেজনায় টেবিলের ভর রেখে উঠে দাঁড়ান ডক্টর সরকারও, “কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মণিশঙ্কর। আমি মণিশঙ্করকে ছাড়া কাউকে কোনও উত্তর দেব না। তোমার যা ইচ্ছে তুমি করতে পারো।”
“বেশ! আমি ম্যানেজমেন্ট কমিটির মিটিং ডাকার সুপারিশ করছি তাহলে! মিটিং এই উত্তর দিও।” ফাইলগুলো টেবিল থেকে তুলে নিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে লাইব্রেরি ছেড়ে বেরিয়ে যায় বীরেন। তার পেছনে সশব্দে বন্ধ হয়ে যায় ভারী পাল্লাদুটো।
দুপুর গড়াতে না গড়াতেই ম্যানেজমেন্ট কমিটির মিটিং-এর জন্যে ডাক আসে।
একতলার মিটিং রুমে পা দিয়েই ডক্টর সরকার আঁচ পান কোথাও কোনও একটা কিছু ঠিক নেই। বিশাল লম্বা টেবিল ঘিরে বসে থাকা ভালকান ফাউনন্ড্রির উচ্চপদস্থ ম্যানাজেররা ঘাড় নিচু টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকে, কেউ তাঁর চোখে চোখ রাখে না। টেবিলের এক মাথায় বসে থাকা কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মণিশঙ্করও অন্যদিনের মতো হেসে তাঁকে সম্ভাষণ জানান না, বসতেও বলেন না।
নিজেই একটা চেয়ার টেনে বসে পড়েন ডক্টর সরকার।
টেবিলের এক পাশে উঠে দাঁড়ায় বীরেন, তার সামনে একটা উঁচু করে রাখা ফাইলের একটা স্তূপ, মুখে একটা বাঁকা হাসি।
“তোমার না বসলেও চলত সরকার, আমি বেশিক্ষণ সময় নেব না। আমি মিটিং ডেকেছি সবাইকে এই কথা জানানোর জন্যে যে গত ছ-মাসে কোম্পানির যা বিশাল লোকসান হয়েছে তার জন্যে একমাত্র তুমিই দায়ী। এইভাবে লোকসানের বোঝা ঠেলতে থাকতে হলে দু-দিন বাদে কোম্পানি বন্ধ করে দিতে হবে, আমরা সবাই পথে বসব।”
“মিথ্যে কথা! লোকসানের সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে তুমি আমায় বদনাম করতে চাইছ!” ক্রুদ্ধ স্বরে উত্তর দেন ডক্টর সরকার।
মুখের হাসিটা আরও বেঁকে যায় বীরেনের, “তাই? এই ফাইলগুলোই দেখো তাহলে! এতে সইগুলো তো তোমারই মনে হচ্ছে। নাকি বলবে ওটাও আমি জাল করেছি। এই নাও। হেডিস মাইনিং। প্রজেক্টের কাজ বেঁধে দেওয়া সময় ছাড়িয়েছে, কারণ তুমি বিনা কারণে পাম্প খুলিয়েছ আর বসিয়েছ।”
টেবিলের ওপর দিয়ে একটা ফাইল ঠেলে দেয় বীরেন। ফাইলের দুটো কাগজ উলটে দেখেই ডক্টর সরকার বুঝতে পারেন এটা সেই ফাইল যেটা আগের দিন বিশ্বনাথ তাঁকে দিয়ে সই করিয়েছিল। অবাক চোখে টেবিলের এক পাশে বসা বিশ্বনাথের দিকে তাকান ডক্টর সরকার, কিন্তু সে তখন মাথা নিচু করে বসে, চোখ তোলে না।
বীরেনের বলা তখনও শেষ হয়নি। আর একটা ফাইল সে ছুড়ে দেয় ডক্টর সরকারের দিকে, “এই নাও, মারক্যুরি ফর্জ। থমাটার্জি ইঞ্জিন বিগড়োনোর পর বারবার ডাকলেও তুমি দেখতে যাওনি। পরে তারা অন্য একটি কোম্পানিকে দিয়ে ইঞ্জিন সারিয়ে বিলটা আমাদের পাঠিয়ে দেয়। সেই বিলেও তুমি সই করেছে।”
ফাইলটা খোলার প্রয়োজন হয় না ডক্টর সরকারের, ওপর থেকে দেখেই তিনি বুঝতে পারেন এই ফাইলটাও বিশ্বনাথ তাঁকে দিয়ে মাসখানেক আগে সই করিয়েছে।
টেবিলের উলটোদিক থেকে ভেসে আসে বীরেনের কণ্ঠস্বর, “মিনার্ভা বিল্ডার্স। আমাদের কাছে যে সমস্ত যন্ত্রপাতি চাওয়া হয়েছিল আমরা তার অর্ধেক মাত্র দিতে পেরেছি।” আর একটা ফাইল এসে পড়ে ডক্টর সরকারের সামনে “অতএব চুক্তির শর্ত মাফিক আমরা তাদের মোটা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছি।”
একটা ঘামের স্রোত নেমে যায় ডক্টর সরকারের পিঠ দিয়ে। তিনি বুঝতে পারেন বেশ অনেকদিন ধরে তাঁর চারপাশে ষড়যন্ত্রের জাল বেছানো হয়েছে।
“জুপিটার পাওয়ার!”
“মার্স আর্টিলারি!”
“সেরেস কন্সট্রাকন্স!”
একেরে পর এক ফাইল এসে পড়তে থাকে ডক্টর সরকারের সামনে, আর তাঁর কাছে ষড়যন্ত্রের ব্যাপ্তিটা ক্রমশ পরিষ্কার হয়। লাইব্রেরি আর রিসার্চে মগ্ন থাকতে গিয়ে কাজের খুঁটিনাটি এড়াতে যে বিশ্বনাথের ওপর তিনি ভরসা করতেন সে বীরেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁর পিঠে আমূল ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।
শরীর কেমন অবশ হয়ে আসে ডক্টর সরকারের, দৃষ্টি কেমন ঘোলাটে হয়ে আসে। তবু তারই মধ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখা বিশ্বনাথের ঠোঁটের কোণে ধূর্ত হাসিটা তাঁর নজর এড়ায় না।
সব ক-টা ফাইল ডক্টর সরকারের সামনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কোমরে দু-হাত রেখে বিজয়ীর ভঙ্গীতে মণিশঙ্করের দিকে তাকায় বীরেন, “আমার যা অভিযোগ জানানোর ছিল জানিয়ে দিয়েছি। সরকারও এর কোনও প্রতিবাদ করেনি। বোঝাই যাচ্ছে স্বপক্ষ সমর্থনের জন্যে ওর কাছে কোনও প্রমাণ নেই। এই অভিযোগের ভিত্তিতে আমি এবার ম্যানেজমেন্ট কমিটির সামনে একটা প্রস্তাব আনতে চাই।”
প্রতিবাদে ডক্টর সরকার কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু একটা দুর্বল “আমি—” ছাড়া আর কিছু বেরোনোর আগেই তাঁর দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মণিশঙ্কর হাত তুলে তাঁকে মাঝপথেই থামিয়ে দেন।
“ডক্টর সরকার তাঁর দায়িত্ব পালন সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ!” মণিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে বলে বীরেন, “কমিটির কাছে আমার প্রস্তাব, তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে চিফ থমাটার্জিস্টের দায়িত্ব বিশ্বনাথকে দেওয়া হোক!”
মাথা সোজা করে বিশ্বনাথ। তার ঘোলাটে চোখ ধূর্তামিতে চকচক করে, মুখে প্রতিফলিত হয় বীরেনের হাসিটা।
নীরবে ওপর নিচে মাথা দোলান মণিশঙ্কর। তাঁর সঙ্গে তাল রেখে ঘাড় নাড়ায় টেবিলে বসা কোম্পানির বাকি ম্যানেজাররাও।
ডক্টর সরকারের মনে হতে থাকে তাঁর চারপাশে তাঁর চেনা দুনিয়াটা ভেঙে ধ্বসে পড়ে যাচ্ছে।
কিন্তু তাঁর হারা তখনও শেষ হয়নি, বীরেন আর বিশ্বনাথের দুরভিসন্ধিও নয়।
ডক্টর সরকারের পিঠে বেঁধা ষড়যন্ত্রের ছুরিটাকে আরও খানিকটা ঠেসে দেয় বীরেন।
“ডক্টর সরকারকে যখন তাঁর বর্তমান দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তাঁর আর এই অফিসে থাকার প্রয়োজন নেই। কমিটির কাছে আমার প্রস্তাব তাঁকে অবিলম্বে আমাদের খনিজাবাদের ব্রাঞ্চ অফিসে বদলী করে দেওয়া হোক।”
ফের মাথাটা সামান্য ওপর নিচে করেন মণিশঙ্কর। তাঁকে অনুসরণ করে টেবিলের চারপাশে বসা বাকিরা।
প্রতিবাদ করতে গিয়েও করতে পারেন না ডক্টর সরকার, তাঁর সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে।
বিশ্বনাথের মুখের হাসিটা আরও চওড়া হয়, “তাহলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, ওঁকে নতুন কর্মস্থলের উদ্দেশে রওয়ানা করিয়ে দেওয়া যাক।”
টেবিলে ছেড়ে উঠে দরজার দিয়ে মাথা গলিয়ে কাউকে ডাক দেয় বীরেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুজন বরকন্দাজ এসে ডক্টর সরকারকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে।
বাধা দিতে পারেন না ডক্টর সরকার, তাঁর দুর্দমনীয় ইচ্ছাশক্তি আজ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।
একতলার বিশাল হলঘর দিয়ে দিয়ে ডক্টর সরকারকে হাঁটিয়ে নিয়ে বরকন্দাজরা, পেছনে বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাঁটে বীরেন আর বিশ্বনাথ। নিজেদের রোজকার ব্যস্ততা ভুলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ভালকান ফাউন্ড্রির কর্মচারিরা। যেন নিজেদের চোখকে তারা বিশ্বাস করতে পারছে না।
সামনের দরজা নয়, বরকন্দাজরা ডক্টর সরকারকে নিয়ে আসে বাড়ির পেছনের দরজার দিকে।
দরজার বাইরেই একটা রুক্ষ মাঠ, আর মাঠ পেরিয়েই বিবর ফাটলের খাদ। ডক্টর সরকার দেখতে পান খাদের কিনারার জেটির পাশে হাওয়া দোল খায় একট বিবর বোট।
বিবর বোটের চেহারা প্রায় সাধারণ নৌকোর মতো, তবে জলের বদলে এ নৌকো ভাসে বিবর কুয়াশায়। বোটে বসানো থমাটার্জির ইঞ্জিন বিবরের কুয়াশা থেকে ঐন্দ্রজালিক শক্তি আহরণ করে বোটকে একই সঙ্গে ভেসে থাকার আর সামনে চলার শক্তি যোগায়। বিবরের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যেতে এই বোটের ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বরকন্দাজরা ডক্টর সরকারকে মাঠের ওপর দিয়ে প্রায় একরকম হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে বোটে তুলে দেয়। বাধা দিতে পারেন না তিনি, শুধু বিস্ফারিত চোখে বীরেন আর বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে জড়ানো স্বরে প্রশ্ন করেন, “কী করছ তোমরা? আমাকে বোটে তুললে কেন?”
ধূর্ত হাসি খেলে যায় বিশ্বনাথের মুখে, “এখান থেকেই সোজা আপনার নতুন কর্মস্থলে পৌঁছে যান, সময় অনেক বেঁচে যাবে!”
“এই বোট নিয়ে?”
ধূর্তামিতে ঝিলিক দেওয়া চোখ তুলে একজন বরকন্দাজকে ইঙ্গিত করে বিশ্বনাথ। সে বোটে উঠে ইঞ্জিনটা চালু করে দিয়ে বোট থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে।
“হ্যাঁ, অসুবিধে কোথায়? আপনি এত জ্ঞানী মানুষ, খনিজাবাদ অবধি বোট চালিয়ে নিয়ে যেতে নিশ্চই অসুবিধে হবে না?”
নিচু হয়ে জেটিতে বাঁধা দড়িটা খুলে দেয় বীরেন। দুলতে দুলতে বোট জেটি থেকে সরে যেতে আরম্ভ করে।
আর সেই মুহূর্তে মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে আসে বসন্ত, তার পিঠে একটা কাপড়ের বস্তা।
অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় বীরেন, “তোমার আবার কী চাই এখানে?”
“কিছু না। স্যারের কয়েকটা জামাকাপড় দিতে এসেছি খালি।”
বীরেন বা বিশ্বনাথ কোনওরকম আপত্তি করার আগেই বস্তাটা বোটে ছুড়ে দেয় বসন্ত।
সকাল থেকে আকাশে জমতে থাকা মেঘ এবার হঠাৎ বজ্রের স্বরে হুংকার দিয়ে ওঠে। একটা দমকা হাওয়ার ঝাপটা বোটকে জেটি থেকে ঠেলে নিয়ে যায় ফাটলের মাঝখানে।
৪
কিছুক্ষণ মুহ্যমান হয়ে বোটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকেন ডক্টর সরকার। তারপরে তাঁর খেয়াল হয় বোট হাওয়ার ঠেলায় দুলছে, হাল না ধরলে উলটে যেতে পারে। বোটের পেছনে বসানো থমাটার্জি মোটরের হালটা চেপে ধরেন তিনি।
বোটের দোলাটা কিছুটা শান্ত হয় বটে, কিন্তু ডক্টর সরকারের মনের ভেতরে অশান্ত ঝড় থামার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। মাত্র কয়েকটি ঘণ্টার ব্যবধানে তাঁর অতীত জীবন যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। কী করবেন তিনি খনিজাবাদ পৌঁছে? আবার নতুন করে সব শুরু করবেন? খনিজাবাদে কী অপেক্ষা করছে তাঁর জন্যে? বীরেন আর বিশ্বনাথ কি তার জন্যে আরও কোনও ফাঁদ পেতে রেখেছে?
একটা ভিজে হাওয়ার ঝাপটা লাগে তাঁর মুখে। মাথাটা একবার জোরে ঝাঁকিয়ে চিন্তার বিক্ষুদ্ধ তরঙ্গগুলোকে শান্ত করার চেষ্টা করেন তিনি। এসব কথা পরে ভাবলেও চলবে, আপাতত বোটটাকে খনিজাবাদ অবধি চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই তাঁর সর্বপ্রথম কাজ।
চারপাশে একবার তাকান ডক্টর সরকার। বোট বিবর ফাটল পার করে এসে পড়েছে মূল বিবরে, মাথার ওপরের আকাশে আরও গাড় হয়ে উঠেছে মেঘ।
হালের হাতলটাকে লক করে দিয়ে বোটের গায়ে বসানো একটা লকার খুলে ম্যাপ আর কম্পাস, সেক্সট্যান্ট ইত্যাদি যন্ত্রপাতি বের করে আনেন ডক্টর সরকার। অন্ধকার হয়ে আসার আগে তাঁকে দিক নির্ণয় করে ফেলতে হবে।
লকারটা বন্ধ করে হালের কাছে ফেরত যাচ্ছেন তিনি, হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ে বসন্তর ছুড়ে দেওয়া বস্তাটার ওপর। সে কী দিয়েছে জানার জন্যে কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে বস্তাটা খোলেন তিনি।
না, বস্তার ভেতরে তাঁর কোনও জামাকাপড় নেই। বসন্ত মিথ্যে কথা বলেছিল।
পরিবর্তে যা আছে, তা জামাকাপড়ের চাইতে কয়েকগুণ মূল্যবান – তাঁর থমাটার্জির ইন্দ্রজালের বইখানা আর কলের মানুষ তৈরির কাঠের বাক্সটা।
চোখের কোণটা ভিজে ওঠে ডক্টর সরকারের। অন্তত বসন্ত তাঁকে এই বিপদের দিনে ত্যাগ করে যায়নি।
বস্তাটা সরিয়ে রেখে ডক্টর সরকার ম্যাপটা তুলে নিয়ে ঝুঁকে পড়ার চেষ্টা করছেন, হঠাৎ বোট কিছুটা নিচের দিকে নেমে যায়, আর একই সঙ্গে তার গতিও কিছুটা শ্লথ হয়ে আসে।
হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে ওঠে ডক্টর সরকারের, থমাটার্জি ইঞ্জিনে কিছু গণ্ডগোল হল না তো? ইঞ্জিন বিগড়োলে এই কুয়াশায় ভাসা বোট এক মুহূর্তও টিকবে না, পাথরের টুকরোর মতো টুপ করে কুয়াশার নিচে তলিয়ে যাবে।
ম্যাপ রেখে দিয়ে বোটের পেছনের ইঞ্জিন বক্সের ঢাকা খোলেন ডক্টর সরকার। যা দেখতে পান তাতে তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়।
ইঞ্জিনের ফ্যানের মতো যে অংশটা ইঞ্জিনের ভেতরে বিবরের কুয়াশা টেনে আনে, তার একটা ব্লেড ভেঙে পড়ে গেছে। আর বাকি দুটো এমনভাবে মুচড়ে এসেছে যে দুটোই যে কোনও সময়ে ভেঙে পড়ে যাবে।
ডক্টর সরকারের অভিজ্ঞ চোখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে ব্লেডের গোড়া থেকে বেশ কিছুটা অংশ করাত বা ওই জাতীয় কোনও যন্ত্র দিয়ে অনেকখানি চিরে দেওয়া হয়েছে।
হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন কয়েকগুন বেড়ে যায় ডক্টর সরকারের। বীরেন আর বিশ্বনাথ তাঁর পেশাদারি জীবন ধ্বংস করে দিয়েই ক্ষান্ত হতে চায়নি। তিনি যাতে কোনওদিন, কোনওভাবে তাদের পথের কাঁটা হয়ে না দাঁড়ান, তা নিশ্চিত করতে তাঁকে এই বিবরেই সমাধি দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করে বোটে তুলে দিয়েছে।
একটু কেঁপে উঠে আরও কিছুটা নেমে যায় বোট। বোটের মাঝখানে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঘামতে থাকেন ডক্টর সরকার।
আর একবার জোলো হাওয়ার ঝাপটা লাগে তাঁর মুখে। এবার আরও জোরে। কপালে এসে পড়ে দু-একটা জলের ফোঁটা।
মাথা উঁচু করে ওপরের দিকে তাকান ডক্টর সরকার, হয়তো বা আকাশটাকে শেষবারের মতো দেখে নিতে। আকাশের গায়ের কালিমা তখন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে, ম্লান হয়ে এসেছে আলো, বেড়ে গেছে বাতাসের গতিবেগ।
ডক্টর সরকার দেখতে পান সেই কালোর প্রেক্ষাপটে দু-পাশে পাখা ঝাপটে উড়ে চলেছে একটা সাদা বকের মতো পাখি। ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কা তাকে দু-একবার ছিটকে দেয় বটে, কিন্তু সামলে নিয়েই সেটা আবার উড়তে থাকে নিজের গন্তব্যের লক্ষ্যে।
মিটিং রুমে ফেলে আসা তাঁর আত্মবিশ্বাসটা ডক্টর সরকার কালো আকাশের বুকে উড়তে থাকা পাখিটাকে দেখতে দেখতে যেন ফিরে পান। এই ঝড়ের মধ্যেও যেমন পাখিটা তার পাখা বন্ধ করেনি, তিনিও তেমনি লড়াই না করে হাল ছেড়ে দেবেন না। শেষ নিশ্বাস অবধি তিনি বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যাবেন।
চারপাশে তাকিয়ে নিজের অবস্থানটা বোঝার চেষ্টা করেন ডক্টর সরকারও। খনিজাবাদ তো দূরস্থান, আয়সনগরে ফেরার মতো সামর্থ্যও এই বোটের নেই। তাঁকে প্রাণ বাঁচাতে হলে বিবরের কুয়াশা থেকে করাতের দাঁতের মতো শ্যাওলা পড়া যে সমস্ত রুক্ষ পাহাড় মাথা উঁচিয়ে আছে তাদের কোনও একটাতে গিয়ে উঠতে হবে। এবং সেটাও কেবল ধুঁকতে থাকা থমাটার্জি ইঞ্জিনের ভরসায় করতে গেলে চলবে না, ঝোড়ো বাতাসের সাহায্য নিতে হবে।
বোটের মাস্তুলে জড়ানো পালটাকে খুলে টানটান করে টাঙিয়ে দেন ডক্টর সরকার, তারপরে হাল ঘুরিয়ে বোটকে নিয়ে আসেন হাওয়ার সামনে। ফুলে ওঠে পাল, দুরন্ত গতিতে ছুটতে আরম্ভ করে বোট।
হালের ওপর হাতের মোচড়ে দূরের একটা পাহাড়চূড়ো লক্ষ করে বোটকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন ডক্টর সরকার। শুরু হয় এক মরণপণ প্রতিযোগিতা – সামনে ছোটে বোট, সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অল্প অল্প করে নামতে থাকে নিচের দিকে।
বোট পাহাড়ের কিছুটা কাছে আসতেই হালটা লক করে দিয়ে, বোটের একদম সামনে চলে আসেন ডক্টর সরকার, বসন্তর দেওয়া বস্তাটা পিঠে বেঁধে অপেক্ষা করতে থাকেন রুদ্ধশ্বাসে। তারপর বোট যখন পাহাড় থেকে কয়েক ফুট দূরে, পাহাড় লক্ষ করে ঝাঁপ দেন তিনি, সঙীনের মতো উঁচিয়ে থাকা একটা পাথরের স্ল্যাব জড়িয়ে ধরেন দু-হাতে। তাঁর কয়েক হাত দূরে তাঁর ফেলে আসা বোট সজোরে ধাক্কা মারে পাহাড়ের গায়ে, তারপর ঝুপ করে ডুবে যায় কুয়াশার নিচে।
আর তার পরের মুহূর্তে সকাল থেকে থমকে আকাশ সগর্জনে ফেটে পড়ে বৃষ্টি হয়ে। ঘনঘোর বর্ষায় অন্ধকার হয় যায় চতুর্দিক, জলের শীতল ফোঁটা বর্শার ফলার মতো বেঁধে সর্বশরীরে, ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কা ছিটকে আসে ছুরির মতো ধারালো কাঁকর আর পাথরকুঁচি।
আর তারই মধ্যে দু-হাতে একটা রুক্ষ পাথরের উঁচিয়ে থাকা আঙুল জড়িয়ে সর্বশক্তি দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে থাকেন ডক্টর সরকার।
৫
বৃষ্টি মাঝরাত নাগাদ থামে। আকাশের কালো মেঘের পেছন থেকে রুপোলি আলোর ওড়না উড়িয়ে উঁকি মারে একফালি বাঁকা চাঁদ। অবশ হয়ে যাওয়া হাতদুটোকে পাথরের সঙীনের মতো আকার থেকে ছাড়িয়ে ক্ষতবিক্ষত শ্রান্ত শরীরটাকে কোনওমতে পাহাড়ের কিছুটা ওপরের দিকে টেনে নিয়ে যান ডক্টর সরকার, তারপর কিছুটা সমতল একটা জায়গা বেছে নিয়ে শুয়ে পড়ে তলিয়ে যান নিদ্রার গভীরে।
চোখ যখন খোলেন ডক্টর সরকার তখন সূর্য উঠে এসেছে দিগন্তের বেশ কিছুটা ওপরে। আগের দিনের মেঘের পাল তাদের রণাঙ্গন ত্যাগ করে বিদায় নিয়েছে, নির্মল আকাশ গায়ে মেখে নিয়েছে সকালের সোনালি রোদ।
আড়ষ্ট, বেদনাক্লিষ্ট শরীরটাকে কোনওমতে টেনে দাঁড় করান ডক্টর সরকার। আপাতত তিনি কোনওরকমে প্রাণে বেঁচেছেন বটে, কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো পর্বতশিখর থেকে বেরোতে না পারলে এখানেই তাঁকে ক্ষুধাতৃষ্ণায় প্রাণ দিতে হবে। বিবর বোট বিবরের এতটা ভেতর দিকে আসে না বটে, কিন্তু বিবর কিনারার এক শহর থেকে আর এক শহরে আকাশপথে এয়ারশিপের যাতায়াত আছে। তেমনি কোনও একটা এয়ারশিপের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে হয়তো তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও যেতে পারেন। তবে তার জন্যে তাঁর পাহাড়চূড়োর একদম ওপরে পৌঁছনো প্রয়োজন।
কিন্তু কাজটা ভাবা যতটা সোজা, করা ততটা নয়। পাহাড়ের মাথার দিকের অংশটা প্রায় খাড়া হয়ে উঠে গেছে ওপরের দিকে। উপুড় হয়ে শুয়ে দাঁতের মতো উঁচিয়ে থাকা পাথরগুলো আঁকড়ে ধরে তবেই শরীরটাকে কোনওমতে ওপরের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। সে পদ্ধতিও বড় একটা নিরাপদ নয়। পাথরের গায়ে জমে থাকা শ্যাওলার পরতে পড়া গত রাতের বৃষ্টির জল সেগুলোকে অতিশয় পিচ্ছিল করে তুলেছে।
প্রাণ হাতে করে শরীর হিঁচড়ে এইভাবে কিছুটা উঠতে না উঠতেই ডক্টর সরকার হাঁপাতে থাকলেন। তাঁর হাতের তালু দুটো তখন রুক্ষ পাথরে ঘষা খেয়ে জ্বলছে, শরীরের ভার টেনে কাঁধদুটো যেন অসাড় হয়ে পড়েছে। তিনি বুঝলেন একটানা এইভাবে তাঁর পক্ষে ওঠা অসম্ভব। গত রাতের ধকল আর ক্ষুধা তৃষ্ণায় তাঁর শরীর অবসন্ন হয়ে আছে। বিশ্রাম না নিলে তিনি উঠতে পারবেন না।
চারপাশে তাকিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার উপযুক্ত জায়গা খুঁজছেন ডক্টর সরকার, তাঁর নজরে পড়ে তাঁর মাথার কোনাকুনি কিছুটা ওপর দিকে একটা চ্যাটালো পাথর পাহাড়ের গা থেকে কার্নিশের মতো বেরিয়ে আছে। পাথরটা বেশ বড়, অনায়াসে তার ওপর উঠে বসা যায়।
কিছুটা কোনাকুনি বেঁকে শরীরটাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে কোনওমতে কার্নিশের মতো পাথরটার ওপর উঠে হাঁপাতে থাকেন ডক্টর সরকার। শরীরটা তাঁর আর চলতে চাইছে না। পাথরের কার্নিশ থেকে পা দুটোকে ঝুলিয়ে দিয়ে, একটু বাড়তি আরামের জন্যে পিঠটাকে পাহাড়ের গায়ে হেলিয়ে দেন তিনি।
এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ডিগবাজি খেয়ে হুড়মুড় করে গড়িয়ে এসে পড়েন একটা অন্ধকার জায়গায়।
শরীরের বেদনা আর মনের আতঙ্কের ধাক্কাটা কাটিয়ে নিয়ে হাঁটুতে দুহাতে ভর রেখে উঠে দাঁড়িয়ে কী হল বুঝতে চেষ্টা করেন ডক্টর সরকার।
তাঁর চোখটা অন্ধকারে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উঠলে তিনি বুঝতে পারেন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গে। সুড়ঙ্গের একপ্রান্ত দূরে মিলিয়ে গেছে অন্ধকারে। আর অন্যপ্রান্ত রয়েছে তাঁর থেকে ফুটদুয়েক দূরে। সেখানে পাথরের ওপরের খোদাই করা কয়েক ধাপ এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি উঠে গেছে সুড়ঙ্গের গায়ে একটা বড়সড় ফুটো অবধি। ফুটোর ওপর যেন একটা আবছা পর্দা টাঙানো রয়েছে, তার ভেতর দিয়ে তেরছাভাবে সুড়ঙ্গে এসে পড়ছে একফালি ম্লান আলো।
পর্দাটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে কী হয়েছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় ডক্টর সরকারের।
ইন্দ্রজালের ভেলকি।
পাহাড়ের গায়ে সুড়ঙ্গের প্রবেশপথে একটা ঐন্দ্রজালিক আবরণ বসানো আছে। বাইরে থেকে দেখলে তাকে পাহাড়ের থেকে আলাদা করে চেনা যায় না। দৈবের গতিকে না জেনে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিতেই তিনি মায়াপর্দার আবরণ পার করে সুড়ঙ্গের ভেতর উলটে পড়েছেন।
ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে যান ডক্টর সরকার, ভুলে যান শরীরের ব্যথাবেদনা, এমনকি দ্বীপ থেকে উদ্ধার পেতে যে তাঁর চুড়োয় ওঠার প্রয়োজনের কথাও তিনি ভুলে যান। আবিষ্কারের নেশায় তাঁকে পেয়ে বসে। বিবর পর্বতে কেবল সুড়ঙ্গ নয়, সুড়ঙ্গের মুখে ঐন্দ্রজালিক আবরণ খুঁজে পাওয়াটা অসম্ভব বললেও কম বলা হয়। দ্বীপ থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করার আগে তাঁকে সুড়ঙ্গের রহস্যের মর্মোদ্ধার করার চেষ্টা একবার করতেই হবে। তা ছাড়া এই সুড়ঙ্গে যদি মানুষের আনাগোনা থাকে তাহলে অন্তত তাঁর ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের একটা সমাধান হয়তো থাকবে।
সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে আসা অল্প আলোয় দেওয়ালে হাত রেখে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন ডক্টর সরকার।
অনেকটা এগোনোর পর পেছনের সুড়ঙ্গমুখের আলোটা ক্ষীণ হয়ে আসে, ঘন হয়ে আসে সুড়ঙ্গের সামনের অন্ধকার।
অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে কীভাবে সামনে যাবেন ডক্টর সরকার ভাবছেন, হঠাৎ দেওয়ালে রাখা তাঁর হাতে ধাতব কিছু একটা ঠেকে। তার শীতল স্পর্শে চমকে উঠে তিনি হাতটা টেনে সরিয়ে নিতে যাবেন, তার আগেই দেওয়ালের পেছন থেকে একটা মৃদু গুঞ্জন ওঠে, আর তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দপদপ করে মাথার ওপর পরের পর জ্বলে ওঠে নীলচে আলো।
বিস্মিত ডক্টর সরকার দেখতে পান তাঁর মাথার ওপরে সুড়ঙ্গের ছাদে বসানো নীল আলোর সারি চলে গেছে পেছনের সুড়ঙ্গমুখ অবধি, তাদের আলোয় সুড়ঙ্গ এখন আলোকিত। আর তাঁর সামনে কয়েক ফুট দুরেই পাথরে তৈরি একটা গোল দরজা আটকে রেখেছে সামনের পথ।
তাঁর হাতটা যেখানে ধাতব কিছু স্পর্শ করেছিল সেখানটা পরীক্ষা করেন ডক্টর সরকার। পালিশ করা তামার একটা চৌকো পাত বসানো সুড়ঙ্গের পাথরের দেওয়ালে, তার ওপরে খোদাই করা কিছু সাঙ্কেতিক অক্ষর।
সুড়ঙ্গের নীল আলোয় অক্ষরগুলোকে খুঁটিয়ে দেখেন ডক্টর সরকার। অক্ষরের লিপি খুব একটা প্রচলিত না হলেও তাঁর অপরিচিত নয়। কয়েকশো বছর আগে যখন থমাটার্জি বিজ্ঞানের বদলে আটকে ছিল গুপ্তবিদ্যার স্তরে, তখন সেই সময়কার ঐন্দ্রজালিকরা নিজেদের মধ্যে জ্ঞান আদানপ্রদানের জন্যে এই লিপি ব্যবহার করত।
অক্ষরগুলো এক এক করে উচ্চারণ করে পড়েন ডক্টর সরকার, ম-ন-মো-হি-নী।
মনমোহিনী!
মুহূর্তের মধ্যে একটা পুরোনো ইতিহাস মনে পড়ে যায় ডক্টর সরকারের। থমাটার্জির ক্ষমতা মানুষ যখন ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করছে, লোকচক্ষুর অন্তরালে গুপ্ত সভা সমিতিতে চলছে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা, সেই সময়ে এক ক্ষমতাবান মহিলা ঐন্দ্রজালিকের কথা লোকের মুখে শোনা যেতে থাকে।
মনমোহিনী!
আয়সনগরের উপকণ্ঠে এক বিশাল প্রাসাদে মনমোহিনী একাই থাকতেন। কিংবদন্তী বলে সে সময়ে তাঁর সমকক্ষ ঐন্দ্রজালিক খুব কমই ছিল। তাঁর গোপন গবেষণাগারও নাকি ছিল সমসাময়িক ঐন্দ্রজালিকদের ঈর্ষার বিষয়।
কিন্তু হঠাৎ তাঁকে নিয়ে একবার গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি নাকি মানুষের ওপরে নিষিদ্ধ এক্সপেরিমেন্ট করছেন। তাঁকে নাকি কেউ সচক্ষে কোনও গরিব মহল্লা থেকে বাচ্ছা চুরি করতে দেখেছে।
গুজব এ কান সে কান হতে হতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, ক্রুদ্ধ অশিক্ষিত জনতা সদলবলে এসে তাঁর বাড়ি ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়।
কিন্তু মনমোহিনীর খোঁজ আর পাওয়া যায় না, তিনি যেন সেদিনের পর থেকে হাওয়ায় উবে যান। খোঁজ পাওয়া যায় না তাঁর গোপন গবেষণাগারেরও।
ডক্টর সরকারের বুঝতে অসুবিধে হয় না তিনি দৈবক্রমে মনমোহিনীর হারানো গবেষণাগার খুঁজে পেয়েছেন।
সামনের দরজাটার দিকে তাকান ডক্টর সরকার। ওই দরজার পেছনেই যে লুকিয়ে আছে মনমোহিনীর গুপ্ত গবেষণাগার সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। কিন্তু ওই পাথরের ভারী গোলাকার দরজা খুলবেন কী করে?
দু-পা এগিয়ে দরজাটাকে কাছ থেকে ভালো করে খুঁটিয়ে দরজার খোলার উপায় বুঝতে চেষ্টা করছেন ডক্টর তিনি, এমন সময়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে দরজাটা একপাশে সরে যায়।
আর দরজার পেছনে সুড়ঙ্গের নীল আলোয় এসে দাঁড়ায় এক এমন এক অদ্ভুত প্রাণী যাকে দেখে আঁতকে ওঠেন ডক্টর সরকার।
চেহারাটা তার প্রায় একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতো হলেও, তার বুক আর কোমরের মাঝখানটা তৈরি তামা আর পেতলের নানা পাইপ, কয়েল, স্প্রিং আর তারের এক জটিল বুনটে। তাদের ফাঁকে পাক খায় দাঁত কাটা গিয়ার, ওঠা নামা করে শাফট আর পিস্টন, দপদপ করে ক্ষুদে পাম্প। আর এসবের পেছন থেকে উপচে পড়ে বজ্রহিমের অপার্থিব নীলচে দ্যুতি।
অদ্ভুত চোখে প্রাণীটি কিছুক্ষণ ডক্টর সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হাপরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা শুকনো হাওয়ার মতো কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন করে, “তুমি কে?”
নিজের হতচকিত ভাবটাকে নিয়ন্ত্রণে এনে ডক্টর সরকার উত্তর দেন, “আমি সরকার। তুমি কে?”
“আমি কলবান।” উত্তর আসে সেই শুকনো হাওয়ার মতো কণ্ঠস্বরে।
মনের মধ্যে ঘুরতে থাকা প্রশ্নটা নিজের অনিচ্ছাতেই উঠে আসে ডক্টর সরকারের গলায়, “মনমোহিনী?”
“মনমোহিনী। মা। নেই।” কিছুটা বিষাদের ছোঁয়া লাগে কি কলবানের চোখে? “এসো।”
কলবানের পেছেন মনমোহিনীর গোপন গবেষণাগারে পা রাখেন ডক্টর সরকার। তাঁর মনের মধ্যে তখন আর একটা চিন্তা ঘুরপাক করছে।
মনমোহিনীর শিশু চুরি করার গল্পটা তাহলে হয়তো মিথ্যে নয়।
৬
পাথরের দরজা পেরিয়ে আর একবার বিস্মিত হতে হয় ডক্টর সরকারকে। তিনি ভেবেছিলেন দরজা পেরিয়ে তিনি এসে পড়বেন আর একটা সুড়ঙ্গে। হয় অন্ধকার, কিম্বা বজ্রহিমের নীল আলোয় আলোকিত। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে তিনি দেখলেন, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটা চওড়া গোল চত্বরে। তার চারপাশ থেকে পাহাড়ের দেওয়ালে কোনাকুনি উঠে মিলেছে মাথার ওপর। আর সেই উচ্চতায় বসানো কয়েকটা রন্ধ্র দিয়ে নিচে নেমে আসছে সূর্যের তির্যক রেখা। তাদের দৌলতে দিবালোকের কোনও ঘাটতি নেই চত্বরে।
চত্বরের ঠিক মাঝখানটা গোল করে পাথরের পাড় দিয়ে বাঁধানো। তার মাঝখান থেকে শব্দ করে উঠে আসে জলের ঝরনা। তার জল বাঁধানো পাড়ের একপাশ দিয়ে উপচে পড়ে, চত্বরের মেঝে দিয়ে ক্ষীণ স্রোতে বয়ে যায় কোথাও। পাথরে বাঁধানো ঝরনার চারপাশ ঘিরে নানান ফল আর ফুলের গাছ। তাদের পাতার সবুজ সজীবতার আনাচেকানাচে ছোঁয়া লেগেছে কোনও অজানা শিল্পীর প্যালেটের সবকটি বর্ণের।
ঝরনার জলের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আকণ্ঠ জল পান করেন ডক্টর সরকার। তারপর তৃষ্ণা কিছুটা মিটতে, গাছ থেকে একটা ফল পেড়ে নিয়ে ক্ষুধার্ত কামড় দিতে থাকেন তাতে। কৌতূহলী দৃষ্টি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে কলবান।
ধাতব গিয়ারে ঘষাঘষি লাগার একটা কর্কশ শব্দ হয়। কিছু একটা যেন হেঁটে চলে যায় ডক্টর সরকারের পায়ের পাতার ওপর দিয়ে। চমকে উঠে পা টেনে নেন ডক্টর সরকার। তাঁর জুতোর ওপর থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গুবরে পোকার মতো দেখতে একটা প্রাণী। শরীর তার পেতল আর তামার কারিকুরিতে তৈরি, দুই বিন্দুর মতো চোখ জ্বলজ্বল করে বজ্রহিমের নীল দ্যুতিতে।
মাটিতে পড়ে প্রাণীটা থামে না, সরসর করে হেঁটে গিয়ে একটা গাছে উঠে পড়ে। ডক্টর সরকার খেয়াল করেন গাছটার ডালে আরও ওই রকম দু-একটা প্রাণী তাদের পেতলের দাঁড়া দিয়ে পাতা ছাঁটছে।
কলবানের দিকে তাকিয়ে প্রাণীটার দিকে ইঙ্গিত করেন ডক্টর সরকার, “কী এটা?”
“কল পতং।” হাপর থেকে বেরনো হাওয়ার শব্দের মতো গলায় উত্তর দেয় কলবান, “কাজ করে। সাফ করে। মা বানাল।”
তামা পেতলের পতঙ্গটার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকান ডক্টর সরকার। তাঁর জন্মেরও আগে থমাটার্জি বিদ্যায় যে চূড়ান্ত পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন মনমোহিনী তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কন্ঠস্বরে যতটা সম্ভব সহানুভূতির ছোঁয়া এনে তিনি প্রশ্ন করেন, “মনমোহিনী কোথায়?”
“মা। এসো।” যন্ত্রের গুঞ্জন তুলে প্রবেশপথের উলটোদিকে হাঁটে কলবান। তাকে অনুসরণ করেন ডক্টর সরকার।
জলের ঝরনার অন্য দিকে একটা গুহামুখ। গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে আসা রৌদ্রকিরণ তার প্রবেশপথে আলোছায়ার আলপনা এঁকে দিয়েছে। গুহার মুখ থেকে সিঁড়ির ধাপ ঢালু হয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। সিঁড়ির একপাশের একটা নালা দিয়ে তরতর করে নিচের দিকে বয়ে যাচ্ছে ঝরনার বাড়তি জল।
আলো ছায়ার আলপনা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামেন ডক্টর সরকার। এবং সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে পৌঁছে আরও একবার বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।
সিঁড়ির পরেই একটা বড় চত্বর। ঠিক একটু আগে যেখান থেকে ডক্টর সরকার নেমে এসেছেন, তেমনই। ছাদে বসানো বজ্রহিমের আলো আর দেওয়ালে বসানো কয়েকটা ফোকরের দৌলতে বড়সড়ো চত্বরে ভেতরে কোনও আলোর অভাব নেই। সে আলোয় স্পষ্ট বোঝা যায় চত্বরটা একাধারে লাইব্রেরি এবং ল্যাবরেটরি। গুহার একদিকে বই ঠাসা তাকের সারি। আর অন্যদিকে মাটিতে, তাকে, টেবিলে থরে থরে সাজানো নানা অদ্ভুত দর্শন যন্ত্র আর মেশিন। তাদের পেতল আর তামার কয়েল, স্প্রিং, গিয়ার আর ভালভের গায়ে পড়েছে আর্দ্রতার সবুজ ছাপ।
তবে তাদের ওপর নয়। ডক্টর সরকারের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে গুহার দেওয়ালের গায়ে কাচ বসানো একটা ফোকরের দিকে। ফোকরের ঠিক নিচে একটা চওড়া টেবিল পাতা। সেই টেবিলের ওপরের ধুলো মাখা কাচের ফ্লাস্ক, বিকার আর নোটবইয়ের থাকের মাঝে মাথা রেখে টেবিলের সামনের একটা চেয়ারে বসে একটা কঙ্কাল। তার করোটিতে লেগে থাকা লম্বা চুল আর পরনের বিবর্ণ নক্সাতোলা পোশাক থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে কঙ্কালটা কোনও মহিলার।
কঙ্কালটার দিকে আঙুল তুলে দেখায় কলবান, “মা। নেই।”
কঙ্কালটার কাছে গিয়ে পরীক্ষা করেন ডক্টর সরকার। টেবিলের ওপর রাখা হাতের অস্থির দৈর্ঘ্য বরাবর ছিট ছিট নীল রঙের ডোরাগুলো তাঁর নজর এড়ায় না। একটানা বজ্রহিমের সংস্পর্শে থেকে মনমোহিনীর শরীর বিষিয়ে গেছিল বোঝাই যাচ্ছে। এখানে বেশিদিন থাকলে তাঁরও হয়তো একই অবস্থা হবে।
মনমোহিনীর দেহাস্থির দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকেন ডক্টর সরকার। কী করবেন তিনি? তাঁর কাছে দুটো রাস্তা খোলা। এইখানেই ঘাঁটি গেড়ে মনমোহিনীর থমাটার্জির গুপ্তবিদ্যা আয়ত্ত করে তিনি তাকে কাজে লাগাতে পারেন তাঁর গবেষণায়, রূপ দিতে পারেন তাঁর কলের মানুষকে। কিন্তু তার জন্যে তাঁকে হয়তো জীবন দিয়ে মূল্য চোকাতে হবে, বিবরের মাঝখানে এই গিরিকন্দরে বেশিদিন অতিবাহিত করলে বজ্রহিমের ঐন্দ্রজালিক রসায়নে বিষিয়ে যাবে তাঁর শরীরও । অথবা তিনি কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে ফেরত যাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। ফিরে গিয়ে মানুষকে জানিয়ে দিতে পারেনে মনমোহিনীর এই ল্যাবরেটরির কথা। তিনি হয়তো কিছুটা খ্যাতির মুখ দেখবেন, কিন্তু মানুষ মনমোহিনীর বিদ্যা কুক্ষিগত করার জন্যে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করবে, হয়তো সেই বিদ্যা প্রয়োগ করবে কোনও অনৈতিক কাজে।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে মাটিতে পিঠের বস্তাটা নামিয়ে রাখেন ডক্টর সরকার। তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন। এখানেই থেকে যাবেন তিনি। তাতে যা মূল্য দিতে হয় তিনি দেবেন। তাঁর স্বপ্নের কলের মানুষ গড়ার এর চাইতে ভালো ল্যাবোরেটরি তিনি আর কোথাও পাবেন না। এইখান থেকেই তিনি কলের মানুষ সৃষ্টিতে তিনি পূর্ণোদ্যমে নিজেকে নিয়োজিত করবেন।
আর সেই সঙ্গে উপায় খুঁজবেন তাঁকে যারা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল তাদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার।
তবে তার জন্যে অনেক সময় আছে। আপাতত তাঁর বিশ্রাম দরকার।
বস্তাটা মাথায় দিয়ে মাটিতেই শুয়ে পড়েন ডক্টর সরকার। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তলিয়ে যান ঘুমের ঘোরে।
৭
ঘুমের মধ্যে ডক্টর সরকারের মনে হয় কে যেন কোথাও কাঁদছে। কোথাও দূর থেকে ভেসে একটা কান্নার শব্দ যেন তাঁকে তাঁর সুষুপ্তির গভীর উষ্ণ আবরণের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে বারংবার ডাক দিচ্ছে।
অতি কষ্টে চোখের পাতা দুটো খোলেন ডক্টর সরকার। টের পান অবসন্ন ভাবটা অনেকটা কেটে গেলেও তখনও শরীরের ব্যথাগুলো যায়নি। দেখতে পান গুহার ফোকর দিয়ে আসা আলোয় সামান্য সোনালি রং ধরেছে, বোঝাই যায় সূর্য মধ্যাহ্ন গগন পেরিয়ে নেমে এসেছে অনেকটাই।
চতুর্দিক নিস্তব্ধ, কোথাও মানুষের কোনও সাড়াশব্দ নেই। কান্নার শব্দটা তাহলে হয়তো স্বপ্নই ছিল।
চারপাশে তাকিয়ে কলবানকে কোথাও দেখতে পান না ডক্টর সরকার। তিনি ঘুমোচ্ছেন দেখে সে হয়তো অন্য কোথাও চলে গেছে। পোশাকের ধুলো ঝেড়ে একটা বইয়ের তাকের সামনে গিয়ে দাঁড়ান তিনি, একটা বই টেনে নিয়ে পাতা উলটোতে থাকেন অন্যমনস্কভাবে। এর পর তিনি কী কী করবেন, তার চিন্তা চলছে তখন তাঁর মনের মধ্যে।
হঠাৎ চিন্তার স্রোতে বাধা পড়ে তাঁর, আবার কানে ভেসে একটা কান্নার মতো শব্দ। কোন অজানা ভাষায় কে যেন কাকুতিমিনতি করছে। চমকে ওঠেন ডক্টর সরকার, হৃৎপিণ্ডের গতিবেগ বেড়ে যায় তাঁর, তিনি তাহলে স্বপ্ন দেখছিলেন না!
কান্নার শব্দটা চত্বরের একপাশ থেকে আসছে। বইটা তাকে ফেরত রেখে একরকম সেদিকে দৌড়ে যান তিনি। আগে দেখতে না পেয়ে থাকলেও একটা জং লাগা মেশিনের কাঠামোর আড়ালে একটা দরজা নজরে পড়ে তাঁর। কান্নার শব্দটা তার পেছন থেকেই ভেসে আসে।
দরজাটা ঠেলে খোলেন ডক্টর সরকার। দরজার পেছনে একটা লম্বা সুড়ঙ্গ, তার ছাদে বসানো বজ্রহিমের নীল আলোর সারি। গতিবেগ কমে না ডক্টর সরকারের, একরকম ছুটতেই থাকেন তিনি। আর তাঁর দৃষ্টি সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তের দিকে থাকলেও সেই ছোটার মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন যে সুড়ঙ্গটা প্রাকৃতিক নয়, চোখের কোণ দিয়ে যতটুকু দেখা যায়, তাতে বেশ বোঝা যায় সুড়ঙ্গের দেওয়াল সাজানো বিচিত্র সব আঁকিবুঁকিতে।
সুড়ঙ্গ শেষ হয় একটা চত্বরে। জায়গাটা তাঁর পেছনে ফেলে আসা চত্বরটা মতোই চওড়া। এখানেও সুড়ঙ্গের পেছনের চত্বরের মতোই দেওয়ালের গায়ের ফোকর দিয়ে এসে পড়ছে পড়ন্ত সূর্যের সোনালি আলো। তবে এই জায়গাটা একটা গুদাম বা মালখানার মতো। চারপাশে নানা আকারের কাঠের পেটি, বাক্স আর পিপে থাকে থাকে সাজানো প্রায় ছাদ অবধি। তাদের মাঝখানে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে দম নেন ডক্টর সরকার, তারপর কান্নার শব্দটা লক্ষ করে এগিয়ে যান চত্বরের এক দিকে। চত্ত্বরের এই অংশে আর একটা গুহামুখ, সেখান থেকে সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে নিচের দিকে। ডক্টর সরকার বুঝতে পারেন কান্নার শব্দটা উঠে আসছে সিঁড়ির নিচ থেকেই।
বজ্রহিমের নীল আলোয় আলোকিত সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকেন ডক্টর সরকার। ক্রমশ জোরালো হয় কান্নার শব্দ।
সিঁড়ির শেষ প্রান্তে একটা কপাটহীন দরজা। তার ফ্রেমের গায়ে বিচিত্র অক্ষর আর নক্সার আঁকিবুঁকি খোদাই করা। দরজার পেছন থেকে এবার স্পষ্টই শোনা যায় কান্নার আওয়াজ। একটা লম্বা নিশ্বাস টানেন ডক্টর সরকার, তারপর দরজা দিয়ে পা রাখেন ভেতরে।
দরজার অন্য দিকে একটা ছোট ঘর, দরজার ফ্রেমের মতো ঘরের দেওয়ালও খোদাই করা অদ্ভুত, অচেনা নক্সায়। আর ঘরের ঠিক মাঝখানে কাচের একটা মোটা থাম উঠে গেছে ঘরের ছাদ অবধি, তার ভেতর কুণ্ডলী পাকিয়ে পাক খায় নীল রঙের কুয়াশা।
ডক্টর সরকার বুঝতে পারেন কান্নার আওয়াজটা আসছে থামের ভেতর থেকে। অবাক হয়ে কাচের থামের ওপর দু-হাত রেখে ভেতরে কী আছে ভালো করে দেখতে চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু নীল রঙের ঘন কুয়াশার পেছনে কিছুই দেখতে পান না।
একটু ইতস্তত করে ডক্টর সরকার প্রশ্ন করেন, “ভেতরে কি কেউ আছে? কে কাঁদছে?”
কাচের পেছনে কুয়াশায় সহসা আলোড়ন ওঠা কুয়াশার রশি পরস্পরের সঙ্গে বিনুনী পাকিয়ে ঘনীভূত হয়ে কঠিন বস্তুর মতো হয়ে উঠতে থাকে। তারপর সহসা কুয়াশায় গড়া একজোড়া হাতের তালু আর একটা মুখ থামের ভেতর থেকে ধাক্কা মারে কাচের দেওয়ালে। একটা কান্না জড়ানো কণ্ঠস্বর চিৎকার করে ওঠে, ‘ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও! আর যে এই বন্দিদশা সহ্য করতে পারি না।”
সভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যান ডক্টর সরকার। কম্পিত কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন করেন, “কে তুমি?”
“আমি দেওসিং।”
“কে বন্দি করল তোমাকে এই কাচের থামে?”
“মনমোহিনী।” ছোট্ট উত্তর আসে থামের ভেতরে থেকে।
“কিন্তু কেন?” আবার প্রশ্ন করেন ডক্টর সরকার। তাঁর সহজাত বৈজ্ঞানিক কৌতূহল তখন ফের জেগে উঠেছে।
কান্না জড়ানো গলায় নীল কুয়াশায় গড়া দেওসিং শোনাতে আরম্ভ করে তার ইতিহাস।
দেওসিঙের কাহিনি শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান ডক্টর সরকার, বুঝতে পারেন এতদিন বজ্রহিম আর বিবর সম্বন্ধে মানুষ এতদিন যা ধারণা পোষণ করে এসেছে তার অধিকাংশই ভুল। বজ্রহিমের উৎপত্তি এই দুনিয়ায় নয়। বহুকাল আগে কোনও এক অজানা গ্রহের কয়েকটা টুকরো ধূমকেতুর ধাক্কায় উপড়ে এসে উল্কার মতো আছড়ে পড়ে এই জগতে, সৃষ্টি হয় বিশাল ক্রেটারের। নীল কুয়াশাই সেই গ্রহের স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডল, আর ইন্দ্রজাল সেই কুয়াশায় বাস করা সূক্ষ্মদেহী অধিবাসীদের স্বাভাবিক ক্ষমতা। গ্রহের টুকরোর সঙ্গে তারাও এসে পৌঁছয় এই জগতে, লোকচক্ষুর অন্তরালে, ক্রেটারের গহ্বরে অব্যাহত থাকে তাদের জীবন যাত্রা। থমাটার্জির গবেষণা করতে গিয়ে কোনওভাবে মনমোহিনী সন্ধান পায় তাদের। তারপর বন্ধুত্ব করার অছিলায় বন্দি করে ফেলে তাদের দলপতি দেওসিংকে। বন্দি দেওসিং-এর ক্ষতি হওয়ার ভয় দেখিয়ে দাস বানিয়ে ফেলে বিবরের সূক্ষ্মদেহী অধিবাসীদের। তারপর থেকে প্রায় এক শতাব্দী ধরে দেওসিং আটকে আছে মনমোহিনীর তৈরি এই কাচের কয়েদখানায়।
কাচের থামের ভেতর থেকে হাহাকার করে মুক্তি চেয়ে কাঁদে দেওসিং। সেদিকে তাকিয়ে নিজের মনে চিন্তা করেন ডক্টর সরকার। দেওসিংকে বন্দি করে রাখাটা অবশ্যই অনৈতিক। কিন্তু তাকে ছেড়ে দিলে সে যে এতদিনের বন্দিদশার প্রতিশোধ তাঁর ওপরেই নেবে না তাই বা কে বলতে পারে?
কিছুক্ষণ ভাবার পর মনস্থির করে ফেলেন ডক্টর সরকার। ঝুঁকি নিয়ে হলেও তিনি দেওসিংকে মুক্তি দেবেন। তা ছাড়া এই অজ্ঞাতবাসে দেওসিং-এর সাহায্যও তাঁর প্রয়োজন হতে পারে।
কাচের থামের গায়ে ফের হাত রাখেন ডক্টর সরকার, “দেওসিং!”
থেমে যায় দেওসিং-এর কান্না।
“দেওসিং, আমার যেটুকু জ্ঞান, তাই দিয়ে তোমাকে আমি এই কারাগার থেকে বের করতে চেষ্টা করব। কিন্তু তোমাকে কয়েকটা কথা দিতে হবে।”
“বলুন!”
“ছাড়া পেলে তুমি আমার কোনও ক্ষতি করবে না তো?”
“না করব না। কথা দিলাম।”
“আর একটা কথা। আমার কাজ শেষ হয়ে গেলে আমি এখান থেকে চলে যাব। তখন তুমি সম্পূর্ণ মুক্ত। কিন্তু তার আগে অবধি তুমি আর তোমার অনুচরররা বিনাবাক্যব্যয়ে আমার নির্দেশ পালন করবে। রাজি আছ?”
“রাজি।” কিছুক্ষণ নীরব থেকে উত্তর দেয় দেওসিং।
“তাহলে অপেক্ষা করো। দেখি তোমাকে মুক্ত করতে পারি কি না।”
ছুটতে ছুটতে না হলেও লম্বা পায়ে ডক্টর সরকার ফেরত যান মনমোহিনীর গবেষণাগারে। মনমোহিনীর কঙ্কালটাকে সযত্নে এড়িয়ে টেবিলে রাখা নোটবইগুলোর পাতা উলটোতে থাকেন এক এক করে।
বেশিক্ষণ লাগে না, একটা নোটবইতে সূক্ষ্মদেহী প্রাণীদের বন্দি করার ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া খুঁজে পান ডক্টর সরকার। পাতা হলদে হয়ে গেছে, শতাব্দী পুরোনো কালিও ঝাপসা হয়ে এসেছে, তবুও থমাটার্জির সেই সব গুঢ় তত্ত্ব আর ফর্মূলা বুঝতে তাঁর বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় না।
ল্যাবরেটরির ধুলো মাখা যন্ত্রপাতির মধ্যে থেকে কয়েকটা প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ খুঁজে বের করেন ডক্টর সরকার, তারপর সেই সব তামা আর পেতলের গিয়ার, স্প্রিং আর কয়েল জোড়া দিয়ে তৈরি করেন একটা ছোট্ট যন্ত্র। একটা কালি পড়া বিকারের তলা থেকে বজ্রহিমের কয়েকটা ক্রিস্টাল চেঁচে বের করে বসিয়ে দেন তার মাখখানে। তারপর যন্ত্রটা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ান দেওসিং-এর কাচের কারাগারের সামনে।
“দেওসিং, আমি তোমাকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি। আশা করি তোমার প্রতিজ্ঞা মনে আছে?”
“আছে!” সংক্ষিপ্ত উত্তর আসে কাচের থামের ভেতর থেকে।
হাতের যন্ত্রটাকে থামের কাচের ওপর বসিয়ে দেন ডক্টর সরকার, যন্ত্রের গায়ের একটা লিভার ঠেলে দেন একপাশে, তারপর সরে দাঁড়ান থাম থেকে কিছুটা দূরে।
একটা গুঞ্জন তোলে যন্ত্রটা, নীল দ্যুতি ছড়িয়ে যায় তাতে বসানো ক্রিস্ট্যাল থেকে, তারপর তাকে ঘিরে কাচের গায়ে চড় চড় আওয়াজ তুলে একের পর এক ফাটল ছড়িয়ে যেতে থাকে মাকড়সার জালের মতো। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে থামের ভেতরকার নীল কুয়াশা পাক খেতে থাকে ঘূর্ণিঝড়ের মতো।
হঠাৎই সশব্দে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়ে কাচের থামটা, আর তার ভেতরে পাক খেতে থাকা নীল কুয়াশার ঘূর্ণিটাও একই সঙ্গে ধ্বসে পড়ে। তারপর সেই ছড়িয়ে পড়া কাচ আর কুয়াশার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে একটা মানুষের অবয়ব, শরীর যেন তার নীল রঙের জমাট বাঁধা কুয়াশায় গড়া।
ঝুঁকে পড়ে ডক্টর সরকারকে অভিবাদন জানায় নীল বর্ণের মূর্তি, “আমি দেওসিং। আমাকে মুক্ত করার জন্যে আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব।”
৮
মাসখানেক কেটে যায়। প্রথম দর্শনের পর কলবান তাঁর ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাকে আর বিশেষ দেখতে পান না ডক্টর সরকার। তা ছাড়া বাইরে থেকে যাকে এতদিন বিবরের ডুবো পাহাড় বলে জেনে এসেছেন তিনি, আসলে তার সব ক-টাই ভেতরে উইঢিবির মতো ফাঁকা, এবং উইঢিবির মতোই পরস্পরের সঙ্গে সুড়ঙ্গ দিয়ে জোড়া। এই বিশাল পরিসরে দুটো প্রাণীর একটানা অনেকদিন মোলাকাত না হওয়াটা কিছু অস্বাভাবিক নয়।
দেওসিংকে মুক্ত করার পর তার সাহায্যে মনমোহিনীর দেহাবশিষ্ট বাইরে কবর দিয়ে তার ল্যাবরেটরি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে করে ফের চালু করে তুলেছেন ডক্টর সরকার। মনমোহিনীর যন্ত্রপাতি আর লেঙ মালভূমির পুরোহিতদের বইয়ের সাহায্যে এই কয়েক মাসেই তাঁর কলের মানুষ তৈরির কাজ এগিয়ে গেছে অনেকটাই। মানিনী আর এখন টুকরোটাকরা কয়েকটা কলকবজা নয়। তামা, আর ব্রোঞ্জের কলকবজা দিয়ে তৈরি তার চেহারাটা একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষের মতোই। তার তামার পাত দিয়ে গড়া মাথার ঠিক ওপরে একটা ন্যাসপাতির আকারের কাচের বল জ্বলে বজ্রহিমের নীলাভ দ্যুতিতে। ল্যাবরেটরির টেবিলে বসিয়ে ডক্টর সরকার তার নানা পরীক্ষা করেন।
“ওপর দিকে তাকাও মানিনী।”
একটা যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে ঘাড়টা পেছন দিকে হেলায় মানিনী, তার স্ফটিকে গড়া দুই চোখ আলো পড়ে ঝকঝক করে।
“কী দেখতে পাচ্ছো মানিনী?”
“আলো।” মানিনীর দুই অনড় ঠোঁটের ফাঁকের একটা জাল বসানো চাকতি থেকে বেরিয়ে আসে শব্দটা।
“কীসের আলো, মানিনী?” সস্নেহে প্রশ্ন করেন ডক্টর সরকার।
“রোদ আলো।”
“রোদ আলো নয় মানিনী, বলো সূর্যের আলো।”
“সূর্যের আলো।” রিনরিনে স্বরে ডক্টর সরকারের কথার পুনরাবৃত্তি করে মানিনী।
“এবার আমার দিকে তাকাও তো মানিনী, দেখি এইটা ধরতে পারো কি না?” একটা পেন্সিল মানিনীর দিকে বাড়িয়ে ধরেন ডক্টর সরকার।
তাঁর দিকে তাকিয়ে পেন্সিলটা নিতে চেষ্টা করে বটে মানিনী, কিন্তু তার ইস্পাত আর পেতলের আঙুলগুলো সেটা ঠিক করে আঁকড়ে ধরতে পারে না। আঙুলের ফাঁক গলে পেন্সিলটা মাটিতে পড়ে যায়।
মানিনীর হাতটা সযত্নে নিজের দু-হাতে তুলে নেন ডক্টর সরকার, আঙুলগুলো এক এক করে ভাঁজ করে পরীক্ষা করেন। তাঁর কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ে, “হুঁ, তোমার হাতের একটা স্প্রিং পালটাতে হবে, দাঁড়াও নিয়ে আসছি।”
ল্যাবরেটরির আর এক কোণে সরে যান ডক্টর সরকার। একটা মোটা তামার তারকে মাপজোপ করে মেশিনে বসিয়ে পেঁচিয়ে একটা স্প্রিং তৈরি করেন, তারপর লেঙ মালভূমির মরুমন্দিরের বইয়ের পদ্ধতি মাফিক তাতে প্রয়োগ করতে থাকেন থমাটার্জির ঐন্দ্রজালিক শক্তি। আধঘণ্টা বাদে নীলাভ দ্যুতি মাখা স্প্রিংটা একটা চিমটে দিয়ে ধরে নিয়ে আসেন ল্যাবরেটরিতে যেখানে মানিনীকে টেবিলে বসিয়ে এসেছেন, সেখানে।
এবং এসেই চমকে ওঠেন। মানিনী নেই।
উদ্ভ্রান্তের মতো চারদিকে তাকান ডক্টর সরকার, ছুটে যান ল্যাবরেটরির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, কিন্তু মানিনীকে কোথাও দেখতে পান না। সে যেন হাওয়ায় মিশে গেছে।
উৎকণ্ঠায় ডক্টর সরকারের বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি পড়তে থাকে। তিনি চিৎকার করে ডাক দেন, “দেওসিং! দেওসিং!”
বাতাসে একটা নীল বিন্দু ফুটে ওঠে। তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে আকার নেয় একটা নীল রঙের মানুষের। ডক্টর সরকারের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা ঝোঁকায় দেওসিং, “বলুন!”
“মানিনীকে দেখতে পাচ্ছি না! দেখো কোথাও গেল।”
উত্তর না দিতে ঘাড়টা একদিকে সামান্য হেলায় দেওসিং। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চারদিক থেকে বাতাসে ভেসে এসে তার পাশে জড়ো হয়ে এমন কয়েকটি প্রাণী, যাদের আকৃতি মানুষের মতো হলেও শরীর গড়া স্বচ্ছ, নীলাভ কুয়াশায়।
ফের ঘাড় সামান্য বেঁকায় দেওসিং, যেন কানে শোনা যায় না এমন কোনও তরঙ্গ কম্পনে সে কথা বলছে নবাগতদের সঙ্গে। ফের কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই সূক্ষ্মদেহীরা ছিটকে উড়ে যায় নানান দিকে।
তারা বিদায় নিতেই ডক্টর সরকারের দিকে তাকায় দেওসিং, “খুঁজতে পাঠিয়েছি। মানিনী যেখানেই থাকুক, ঠিক খুঁজে বের করবে।”
ফাঁকা ল্যাবরেটরিতে উৎকণ্ঠিত চেহারায় দেওসিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে সময়ের সেকেন্ড মিনিট গুনতে থাকেন ডক্টর সরকার।
মিনিট দশেক বাদে বাতাসে ভেসে আসে এক কুয়াশায় গড়া সূক্ষ্মদেহী। তার আর দেওসিং-এর মধ্যে নীরবে কী সংবাদ আদানপ্রদান হয় তা শুনতে পান না ডক্টর সরকার, কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে একটা হাতছানি দিয়েই দৌড়তে আরম্ভ করে দেওসিং। তার পেছনে পেছনে ছুটতে থাকেন তিনিও।
কয়েকটা লম্বা সুড়ঙ্গ আর সিঁড়ি পেরিয়ে দেওসিং এসে দাঁড়ায় একটা ছোট গুহার মতো জায়গায়। আর সেখানে যা দেখেন তাতে আর একবার চমকে উঠতে হয় তাঁকে।
আলো আঁধারী গুহাটাতে একদিকে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে মানিনী। আর তার উলটো দিকে মাটিতে বসে কলবান।
ডক্টর সরকারের উপস্থিতি টের পেয়ে তাঁর দিয়ে তাকায় কলবান। মানিনীর দিকে আঙুল তুলে ইঙ্গিত করে শুকনো হাওয়ার মতো শব্দে বলে “মানিনী। বন্ধু।”
কলবানের কথার পুনরাবৃত্তি করে মানিনী, “বন্ধু!”
ডক্টর সরকার বুঝতে অসুবিধে হয় না যে তাঁর অগোচরে কখন কলবান মানিনীকে তাঁর ল্যাবরেটরি থেকে তুলে এনেছে।
মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে ডক্টর সরকারের। এক হ্যাঁচকায় মানিনীকে মাটি থেকে টেনে তোলেন তিনি। জ্বলন্ত চোখে কলবানের দিকে তাকিয়ে বলেন, “তোর সাহস তো কম নয়! তুই একে চুরি করে এনেছিস! দূর হয়ে যা এখান থেকে। কখনো আর এখানে আসবি না।”
“বন্ধু!” হাওয়ার খসখসের মতো শব্দে বলা কলবানের কথাটা কেমন হাহাকারের মতো শোনায়।
আগের মতোই জ্বলন্ত চোখে দেওসিং-এর দিকে তাকান ডক্টর সরকার, “দেওসিং, দেখো এ যেন আর কখনো এদিকে না আসতে পারে।”
মানিনীকে পাঁজকোলা করে তুলে গুহার বাইরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ান ডক্টর সরকার। যন্ত্রের আওয়াজ তুলে তাঁর দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে কলবান।
কলবানের সামনে এসে দাঁড়ায় দেওসিং, তার দু-হাত সামনের দিকে বাড়ানো। দু-হাতের তালু থেকে বেরিয়ে আসে নীল আলোর স্রোত, তার ধাক্কায় পিছু হটে যায় কলবান।
মানিনীকে নিয়ে গুহার বাইরে বেরিয়ে আসেন ডক্টর সরকার। পেছন থেকে শুনতে পান হাহাকারের মতো সেই খসখসে শব্দ, “বন্ধু!”
৯
বছরখানেক পরের কথা। ল্যাবরেটরির টেবিলে ঝুঁকে পড়ে কাজ করছেন ডক্টর সরকার, দেওসিং পাশে এসে দাঁড়ায়।
“বলো দেওসিং। কিছু জানতে পারলে?” টেবিল থেকে মুখ না তুলেই প্রশ্ন করেন ডক্টর সরকার।
“আমার অনুচররা খবর এনেছে মণিশঙ্কর ভালকান ফাউন্ড্রির একটা পুরো দল নিয় এয়ারশিপে করে আয়সনগর থেকে শক্তিগড় গেছেন ব্যাবসার কাজে।”
“হুঁ।” এবার টেবিল থেকে মুখ তোলেন ডক্টর সরকার, “কারা কারা আছে মণিশঙ্করের সঙ্গে?”
“বীরেন, বিশ্বনাথ আর বসন্ত গেছে দলটার সঙ্গে।”
“বাঃ!” চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ডক্টর সরকারের, “মাথারা সবাই একসঙ্গে! এদের ছাড়া আর অন্য কেউ আছে?”
“হ্যাঁ আর কোম্পানির আরও দু-চারজন অফিসার।”
“কারা?” অস্থির ভঙ্গীতে আঙুল দিয়ে টেবিলে টোকা দেন ডক্টর সরকার।
“ভুবন আর বিকাশ।”
“হুঁঃ!” একটা তাচ্ছিল্যের আওয়াজ বেরিয়ে আসে ডক্টর সরকারের নাক দিয়ে। “অফিসার না ঘোড়াড্ডিম! মণিশঙ্করের মোসাহেব বললে ভালো হয়। একটা ভাঁড় আর অন্যটা মাতাল।”
“আর ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল ফেরার সময়ে ওদের সঙ্গে অরুণাংশু বলে কেউ থাকবে।”
“অরুণাংশু!” কপাল কুঁচকে আসে ডক্টর সরকারের। নামটা তাঁর চেনা চেনা লাগে, অথচ ওই নামে ভালকান ফাউন্ড্রির কাউকে তিনি মনে করতে পারেন না।
হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে যায়। মণিশঙ্করের ছেলে! অরুণাংশু মণিশঙ্করের ছেলে। কিন্তু তা ছাড়াও তার আর একটা পরিচয় আছে। অরুণাংশু মণিশঙ্করের মতো কেবল ব্যবসাদার নয়, সে নিজেও একজন তুখোড় থমাটার্জিস্ট। একবার তার একটা রিসার্চ পেপার পড়ে ডক্টর সরকার মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অভিজ্ঞতায় না হলেও বিদ্যায় সে বহু থমাটার্জিস্টকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
কপাল কুঁচকে চিন্তা করেন ডক্টর সরকার। কেবল অন্যায়ের প্রতিকার করা নয়, একই সঙ্গে তাঁর স্বপ্নকে সফল করার একটা চেষ্টাও তাঁকে করতে হবে। মাথায় একটা প্ল্যান খেলে যায় তাঁর, দেওসিং-এর দিকে তাকান তিনি, “এরা সব কবে ফিরবে জানতে পেরেছ?”
“দিনদুয়েক বাদে।” উত্তর দেয় দেওসিং।
চেয়ারটা দেওসিং-এর দিকে কিছুটা টেনে নেন ডক্টর সরকার, “ওরা যখন শক্তিগড় থেকে ফিরবে তখন কয়েকটা কাজ করতে হবে। ভালো করে শুনে নাও, তারপর তোমার অনুচরদের বুঝিয়ে দিও। দেখো যেন কোথাও কোনও ভুলচুক না হয়।”
১০
দু-দিন বাদে বিবরের ওপর দিয়ে শক্তিগড় আর আয়সনগরের মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত করে যে সব এয়ারশিপ, তাদেরই একটা আয়সনগর ফেরার পথে ভয়ানক ঝড়ের কবলে পড়ে। কালো মেঘের ওপর দিয়ে কড়কড় শব্দে ছুটে যায় বিদ্যুতের রেখা, উত্তাল বাতাসে টলমল করে দুলতে থাকে এয়ারশিপ। এয়ারশিপের সামনের দিকে কাচের জানলা ঘেরা কেবিনে সারেঙ হালের বিশাল চাকাটাকে দু-হাতে আঁকড়ে লড়াই করে এয়ারশিপটাকে সোজা রাখার। ঝোড়ো হাওয়ায় ঝাপটে পড়া বৃষ্টির দাপটে বাইরে সে তখন প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কেবিনের দেওয়ালে বসানো একটা ছোট ফোকর দিয়ে ভেসে আসে এয়ারশিপ মাস্টারের উদ্বেগ জড়ানো অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর, “মাল্লাদের রশিগুলোকে কষে রাখতে বলো, কিছু আলগা হয়ে গেলে এয়ারশিপ সামলাতে পারব না।”
হাতল লাগানো চাকাটাকে দু-হাতে শক্ত করে ধরে রেখেই একটা চোঙের মধ্যে প্রায় মুখ গুঁজে মাস্টারের নির্দেশমতো চিৎকার করে সারেঙ, “ওপরের ডেকে বল্টুগুলোকে টাইট কর। দেখ রশি যেন কোথাও আলগা না থাকে।”
এরই মধ্যে হঠাৎ হুড়মুড় করে কেবিনে এসে ঢোকে একদল যাত্রী। সে দলের সঙ্গে পুরোভাগে বীরেন, বিশ্বনাথ, বসন্ত আর মণিশঙ্কর, তাদের চোখে মুখে উদ্বগের ছাপ স্পষ্ট। কম্পিত স্বরে মণিশঙ্কর সারেঙকে বলেন, “কী হল ভাই, এয়ারশিপ তো ভয়ানক দুলছে। লোকজনকে দিয়ে একটু সামাল দাও!”
মাথা নাড়ায় সারেঙ, “এই সময়ে অনর্থক বিরক্ত করুবেন না স্যার। নীচে চলে যান। প্লীজ।”
চড়া গলায় বিশ্বনাথ বলে, “আমরা গেলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে নাকি? এই ঝামেলার মধ্যে তোমার এয়ারশিপ মাস্টারই বা কোথায় গেল?”
“কেন মাস্টারের গলা শুনতে পাচ্ছেন না?” রাগত স্বরে কথাটা বলে দেওয়ালের গায়ের বসানো ফোকরটার দিকে চোখ তুলে ইঙ্গিত করে সারেঙ, “একে এইরকম ঝড়, তার ওপর আপনারা আবার ঝামেলা বাড়াচ্ছেন। যান তো মশাই নীচে।”
হাত তুলে বাধা দেয় বসন্ত, “আরে ভাই শুধু শুধু মাথা গরম করছ কেন? মাথাটা ঠান্ডা রাখো।”
রাগ পড়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না সারেঙের। একই রকম রাগত স্বরে সে উত্তর দেয়, “ঝড় ঠান্ডা হলে আমিও ঠান্ডা হয়ে যাব। আপনাকে সে নিয়ে ভাবতে হবে না। চুপচাপ নীচে যান তো। একে দুর্যোগ, তার ওপর আপনারা কাজে বাগড়া দিচ্ছেন।”
গলার স্বর যথাসম্ভব শান্ত রেখে বসন্ত বলে, “বেশ তো। কিন্তু তোমার এয়ারশিপে কে আছে সেটা ভুলে যেও না।”
“সেই যেই থাকুক, আমার নিজের জীবনের দাম তাদের চাইতে কম নাকি?” সারেঙের সপ্তমে চড়ে থাকা মেজাজ কিছুটা নেমেছে মনে হল, “আপনাকে দেখে তো বুঝদার মানুষই মনে হচ্ছে। সবাইকে একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলুন না এখান থেকে যেতে। আমাদের শান্তিতে কাজ করতে দিলে আপনাদের লাভ বই ক্ষতি নেই।”
ফের মাথা নিচু করে চোঙের মধ্যে চিৎকার করে সারেঙ, “গ্যাসের প্রেসার চেক কর, ভাল্ভগুলো এক প্যাঁচ খুলে দে!”
একটা নিশ্বাস ফেলে যাত্রীদের ভিড়টার দিকে ফেরে বসন্ত, “এঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন, চলুন নিচে গিয়েই অপেক্ষা করি। অরুণাংশু আপনার বাবাকে নীচে নিয়ে যান।”
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন তরুণ এসে মণিশঙ্করের হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে বেরিয়ে যায় বাকি যাত্রীরাও।
তবে সবাই গেলেও নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে বীরেন আর বিশ্বনাথ। কিছুটা ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে পড়ে বসন্তও। চোঙ থেকে মুখ তুলে তাদের দেখতে পেয়েই আবার তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে সারেঙ, “আচ্ছা লোক তো মশাই! যেতে বলছি, তাও দাঁড়িয়ে আছেন এখানে! আমাদের না ডুবিয়ে ছাড়বেন না দেখছি! ”
এবার বীরেন তেড়ে ওঠে, “এই, কী ভাবিস কী নিজেকে? ভদ্রভাবে কথা বল! কাজের বদলে কেবল চিল্লিয়ে যাচ্ছে তখন থেকে।”
হালের চাকা থেকে হাত একটা হাত তুলে ইঙ্গিত করে সারেঙ, “আসুন, তাহলে আপনিই সামলান!”
বীরেনের সঙ্গে তাল মেলায় বিশ্বনাথ, “হ্যাঁ, এ মনে হচ্ছে আমাদের চাইতেও বেশি ভয় পেয়েছে। কুত্তা কোথাকার! কাজের চাইতে গলার জোর বেশি!”
উত্তর দেওয়ার সুযোগ পায় না সারেঙ, একটা ঝাঁকুনি দিয়ে অনেকখানি নীচে নেমে আসে এয়ারশিপ। চোঙের কাছে মুখ নামিয়ে সে চেঁচাতে থাকে, “ভাল্ভ খোল, ভাল্ভ খোল, আরও গ্যাস ছাড়!”
হয়তো বা তার চিৎকারের উত্তরেই আরও খানিকটা নেমে যায় এয়ারশিপ, এবং একই সঙ্গে কাত হয়ে যায় একদিকে। কেবিনের দেওয়াল আঁকড়ে কোনওমতে টাল সামলাতে চেষ্টা করে বসন্ত, বিশ্বনাথ আর বীরেন।
টলোমলো পায়ে ব্যালেন্স সামলাতে সামলাতে কেবিনে এসে ঢোকে একজন মাল্লা, “ঠাকুরের নাম নাও! আর কিচ্ছু করার নেই! বেলুন দু-তিন জায়গায় লিক হয়ে গেছে, হুহু করে গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে।”
একটা লম্বা নিশ্বাস টানে বসন্ত, “চলুন, নিচে যাই। মণিশঙ্কর সাহেব আর অরুণাংশুকে যদি কোনওভাবে সাহায্য করতে পারি।”
আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে আসে বিশ্বনাথের কুতকুতে দুই চোখ, “এই অপদার্থ মাতালগুলোর হাতে পড়ে প্রাণটা যাবে তাহলে?”
বীরেন কিছু একটা বলতে গিয়েও বলার সুযোগ পায় না, তার আগেই একদিকে পুরো টাল খেয়ে যায় এয়ারশিপ, হুহু করে পড়তে আরম্ভ করে নিচের দিকে।
১১
ল্যাবরেটরিতে মাথায় তামার কয়েল পরানো একটা মানুষ প্রমাণ কাচের বয়েমের মধ্যে নীল কুয়াশার কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে। তাতে ছবি ফুটে ওঠে ঝড়ের কবলে পড়া এয়ারশিপের। একটা চেয়ারে বসে তার দিকে তাকিয়ে থাকে মানিনী। বয়েমের কুয়াশার নীল আলো প্রতিফলিত হয় তার স্ফটিকের চোখে আর মুখের তামার পাতে।
“বাবা, তোমার ইন্দ্রজালের শক্তিতে কি এই ঝড় তুমি সৃষ্টি করেছ? এয়ারশিপটা ঝড়ে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। ওই এয়ারশিপে যারা আছে তারা সব যে মারা যাবে বাবা!”
টেবিলে রাখা লেঙ মালভূমির মরুমন্দিরের ইন্দ্রজালের বই থেকে মুখ তোলেন ডক্টর সরকার, “হ্যাঁ মানিনী। ঝড়টা আমার নির্দেশে দেওসিং আর তার অনুচররা সৃষ্টি করেছে। তবে ভয় পেয়ো না, কারোর কোনও ক্ষতি হবে না। যা দেখছ তার প্রায় সবটাই মায়াজাল, সত্যি নয়।”
বয়েমের কুয়াশার ছবিতে দেখা যায় আকাশ থেকে মাথা নীচে করে তীব্রগতিতে নিচে বিবরের দিকে পড়ে যাচ্ছে এয়ারশিপ। আতঙ্কের একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসে মানিনীর গলা থেকে।
একটা হালকা হাসি ফুটে ওঠে ডক্টর সরকারের ঠোঁটে, “বললাম না মানিনী, চিন্তা কোরো না। আমার সব ইতিহাস তুমি জানো না। ওই এয়ারশিপে এমন কয়েকজন আছে যারা একসময় আমার চরম সর্বনাশ করেছে। এমনকি প্রাণেও মারতে চেয়েছিল। কিন্তু শুধু প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যে আমি এই কাজ করছি না। এর পেছনে আমার অন্য পরিকল্পনা আছে।”
মানিনীর আশঙ্কা কেটেছে বলে মনে হল না, “কিন্তু বাবা, এয়ারশিপে তো অনেক লোক আছে, তারা মারা যাবে না?”
মাথা নাড়ান ডক্টর সরকার, “না মানিনী, বললাম না যা দেখছ তা কেবল মায়াজাল। কারোর বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। আমার শত্রুদের ষড়যন্ত্রে আমি এই বিজন গুহাজগতে এসে পড়ি বটে, কিন্তু তাদের সেই আক্রমণই আমার কাছে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। আমার স্বপ্নকে সফল করার একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছে, তাকে হাতছাড়া করাটা বোকামি হবে। যাক, এবার তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও, আমার অনেক কাজ আছে।”
বসে থাকা মানিনীর ঘাড়ের কাছে হাত ছোঁয়ান ডক্টর সরকার। নিভে আসে মানিনীর তামার মুখে বসানো স্ফটিক চোখের দ্যুতি, তার মাথাটা ঢলে পড়ে বুকের ওপর।
“দেওসিং!” ডাক দেন ডক্টর সরকার।
শূন্যে আবির্ভাব হয় একটা ছোট বিন্দুর, তারপর সেই বিন্দুটা ক্রমশ বড় হতে হতে আকার নেয় দেওসিং-এর।
“বলুন ডক্টর।”
“যা নির্দেশ দিয়েছিল তার সব পালন করা হয়েছে তো?”
“হ্যাঁ ডক্টর।” উত্তর দেয় দেওসিং, “মায়াজালের কুহক ছড়িয়ে সৃষ্টি করেছি ঝড়ের। আমার অনুচররা এয়ারশিপকে টেনে নামিয়ে এনেছে আকাশ থেকে। তাদের জাদুতে মনে হয়েছে ছিঁড়ে গেছে এয়ারশিপের দড়ি, ফুটো হয়ে গেছে বেলুন।”
একটা হাসি খেলে যায় ডক্টর সরকারের মুখে। “এমন বোধহয় কেউ ছিল না যে তোমার এই ইন্দ্রজালে বিশ্বাস করেনি?”
“একজনও না।” মাথা নাড়ে দেওসিং। “আতঙ্কে চিৎকার করেছে সবাই। কেউ পাগলের মতো ছুটোছুটি করেছে, কেউ কাঁদতে কাঁদতে ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছে।”
“বাঃ!” হাসিটা আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ডক্টর সরকারের, “কিন্তু কারোর কোনওরকম ক্ষতি হয়নি তো? সবাইকে নিরাপদে রেখেছ তো?”
“কারোর একগাছি চুলেরও ক্ষতি হয়নি।” উত্তর দেয় দেওসিং, “জামাকাপড়ে একটা দাগ পর্যন্ত লাগেনি। আপনি যেমন বলেছিলেন তেমনি ভালকান ফাউন্ড্রির লোকজনদের একসঙ্গে দু-তিনজন করে নানান জায়গায় সবাইকে ছড়িয়ে রেখে এসেছি। কেবল অরুণাংশুকে একা আলাদা একটা জায়গায় রেখে এসেছি।”
“বাঃ! আর এয়ারশিপের মাল্লা আর অন্য যাত্রীরা? তারাও সব ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ একটা বিশাল গুহায় এয়ারশিপটা লুকোনো আছে। যাত্রী আর মাল্লারা সব এয়ারশিপের কুঠুরিতেই মায়াঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।”
“দেওসিং, যা যা বলেছিলাম সব একেবারে ঠিকঠাক করেছ। এখন কটা বাজে বলো তো?”
“দুপুর গড়িয়ে গেছে।”
পকেট ঘড়িটা বের করে দেখেন ডক্টর সরকার, “হ্যাঁ। প্রায় দুটো বাজে। বেশি সময় নেই, সন্ধের আগেই যা যা করার করে ফেলতে হবে।”
কেমন তিক্ততার ছোঁয়া লাগে দেওসিঙের কণ্ঠস্বরে, “আরও কাজ করতে হবে? আপনার কাজের কি আর শেষ নেই!”
“তোমার আবার কী হল? হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল নাকি?”
“আমি মুক্তি কবে পাব বলতে পারেন?”
চোয়াল শক্ত হয়ে আসে ডক্টর সরকারের, “তোমার প্রতিজ্ঞা ভুলে যেও না দেওসিং। আমার কাজ হয়ে গেলেই তুমি ছাড়া পাবে। তার আগে নয়।”
কাঁধদুটো কেমন ঝুঁকে আসে দেওসিঙের, “আর পারছি না। এবার রেহাই দিন। আপনি যা বলেছেন সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। কোনও কাজে ভুল করিনি, কোনও প্রতিবাদ করিনি আপনি কথা দিয়েছিলেন এক বছরের মধ্যে আমাকে মুক্তি দেবেন।”
চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ে ডক্টর সরকারের, “তুমি কি ভুলে গেছে তোমাকে আমি কোন নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম?”
“না।”
“হ্যাঁ ভুলে গেছ। ভুলে গেছ আমি আসার আগে তুমি কেমন এক শতাব্দী ধরে হাহাকার করে কেঁদেছ। একমাত্র আমার থমাটার্জির বিদ্যার জোরেই মনমোহিনীর বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছ তুমি। বলো তো যেমন ছিলে তোমাকে সেই অবস্থাতেই আবার রেখে দিই।”
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে দেওসিং, “ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দিন।”
চোখের দৃষ্টি কোমল হয়ে আসে ডক্টর সরকারের, “আর মাত্র কয়েকটা কাজ বাকি আছে দেওসিং। কাল থেকেই তুমি পাহাড়ি বাতাসের মতো আবার স্বাধীন হয়ে যাবে। কিন্তু তার জন্যে যা বলব অক্ষরে অক্ষরে তোমাকে পালন করতে হবে।”
ডক্টর সরকারের আশ্বাসে হারানো উৎসাহ যেন নতুন করে ফিরে পায় দেওসিং, “আপনার ঋণ আমি জীবন দিয়েও মেটাতে পারব না। বলুন, আর কী করতে হবে!”
“রক্ষীর ছদ্মবেশ ধরে তোমাকে আর তোমার অনুচরদের কয়েকটা কাজ করতে হবে। মন দিয়ে শোনো।”
১২
ঘুমের মধ্যেই অরুণাংশু বুঝতে পারে তার পাঁজরে কেউ খোঁচা মারছে। ভারী হয়ে থাকা চোখের পাতা দুটো কোনওরকমে টেনে খোলার পর সে বুঝতে পারে যে শুয়ে আছে একটা প্রায় অন্ধকার গুহার মধ্যে, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন রুক্ষ চেহারার লোক, বেশভূষা তার আয়সনগরের রক্ষীদের মতো।
অরুণাংশু চোখ খুলতে না খুলতেই তার পাঁজরে বুটের খোঁচা মারে রক্ষী, “এই ওঠ!”
রক্ষীর বুটের পরের ঠোক্কর এড়াতে শরীরটা পেছনে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যায় অরুণাংশু। কোনওমতে উঠে বসে দু-হাতে ভর দিয়ে। জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের কথা মনে পড়ে যায় তার, মানুষের চিৎকার, কান্নাকাটি, তার বাবাকে দু-হাতে জড়িয়ে থাকা।
“আমার বাবা কোথায়?” কাতর স্বরে প্রশ্ন করে সে।
“যমের বাড়ি।” রক্ষীর কণ্ঠস্বরে কোনওরকম সহানুভূতির আঁচ পাওয়া যায় না। সে একরকম ঘাড় ধরে অরুণাংশুকে টেনে দাঁড় করিয়ে দেয়, “চল!”
অরুণাংশু খেয়াল করে তৃষ্ণায় তার গলা শুকিয়ে গেছে। তাও সে আবার প্রশ্ন করে, “আমি কোথায়? কোন জায়গা এটা?”
অরুণাংশুকে একটা ঘাড়ধাক্কা দেয় রক্ষী, “এটা যমের শ্বশুরবাড়ি। ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি, চল দেখবি চল।”
একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ দিয়ে অরুণাংশুকে টেনে নিয়ে চলে রক্ষী। ক্ষুধা তৃষ্ণায় অবসন্ন শরীরে তাকে বাধা দিতে পারে না অরুণাংশু।
সুড়ঙ্গটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে এসে অরুণাংশুকে সজোরে ধাক্কা দেয় রক্ষী। হুড়মুড় করে একটা ছোট গুহার মধ্যে গিয়ে পড়ে অরুণাংশু। গুহাটা অন্ধকার, খালি একটা দেওয়ালে চাক বেঁধে থাকা কোনও অজানা ছত্রাক ফসফরাসের মতো নিষ্প্রভ আলো দেয়। গুহার দেওয়ালে জমে রয়েছে বজ্রহিমের ক্রিস্ট্যাল, মাটিতে পাক খায় নীল কুয়াশা।
অরুণাংশুকে গুহার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গুহার মুখে একটা গরাদ দেওয়া লোহার দরজা সশব্দে বন্ধ করে দেয় রক্ষী।
দৌড়ে এসে দরজার গরাদ ধরে ঝাঁকায় অরুণাংশু, “আমাকে এখানে বন্ধ করলে কেন? কী চাও?”
উত্তরে গুহার মাটিতে পড়ে থাকা গাঁইতি, কোদাল আর ঝুড়ি আঙুল তুলে দেখায় রক্ষী, “দেওয়াল থেকে বজ্রহিম কেটে ঝুড়ি ভর্তি কর।”
আবার গরাদ ঝাঁকায় অরুণাংশু, “আমার শরীর চলছে না, গলা শুকিয়ে গেছে। অন্তত একটু জল দাও।”
“ঝুড়ি ভর্তি কর, তারপর জল, খাবার সব পাবি। তার আগে নয়।”
পেছন ফিরে হাঁটা লাগায় রক্ষী।
১৩
বসন্তর ঘুম সবার শেষে ভাঙে। চোখ খুলেই সে দেখতে পায় নিজের মাথাটা দু-হাতে চেপে ধরে মাটিতে বসে রয়েছেন মণিশঙ্কর, আর তাঁর দিকে তাকিয়ে একটু দূরেই বসে রয়েছে বিশ্বনাথ আর বীরেন।
উঠে বসে বসন্ত, চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে। বুঝতে পারে তারা রয়েছে একটা বড়সড়ো গুহার মধ্যে। গুহার এক দিকের দেওয়ালের গায়ে একটা ফোকর, সেখান দিয়ে আলো এসে পড়ে মাটিতে। তার উলটোদিকে একটা গরাদ বসানো দরজা।
দু-হাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে ঘষে মণিশঙ্করের কাছে সরে আসে বসন্ত, “স্যার, আপনি ঠিক আছেন?”
বসন্তর কথার উত্তর দেন না মণিশঙ্কর। মাথা থেকে দু-হাত তুলে প্রশ্ন করেন, “অরুণাংশুকে দেখেছ?”
বসন্ত দেখতে পায় মণিশঙ্করের দুচোখ জলে ভিজে রয়েছে, “না স্যার। আমি তো এইমাত্র জেগে উঠলাম। আপনাদের পরে। তবে চিন্তা করবেন না স্যার, আমরা যখন বেঁচে গেছি, অরুণাংশুও তখন নিশ্চই ঠিক আছে।”
বলতে বলতেই একবার বিশ্বনাথ আর বীরেনের দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকায় বসন্ত। কিন্তু দুজনেই মাথা নাড়ায়।
প্রসঙ্গ পালটাতে উঠে পড়ে বসন্ত, “আমরা কোথায় আছি সেটা বুঝতে পারলে ভালো হত। গরাদের কাছে গিয়ে ডাকলে হয়তো কেউ সাড়া দিতে পারে।”
আবার মাথা নাড়ায় বিশ্বনাথ, “লাভ নেই। গরাদ ধরে আমি অনেকক্ষণ চেঁচিয়েছি। কেউ আসেনি।”
তবু গরাদ ধরে প্রাণপণে ঝাঁকায় বসন্ত, ‘কেউ আছ’, ‘কেউ আছ’ বলে চিৎকার করে তারস্বরে। কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ আসে না।
হাল ছেড়ে দিয়ে গুহাটার চারপাশ একবার ঘুরে দেখে বসন্ত। গুহার এক কোণে একটা গেলাস চাপা দেওয়া কুঁজো নজরে পড়ে তার। কুঁজো থেকে কয়েক আঁজলা জল নিজে খেয়ে গেলাসটা জলে ভর্তি করে মণিশঙ্করের কাছে নিয়ে আসে সে, “নিন স্যার, জল খান।”
কাঁপা কাঁপা হাতে জলের গেলাসটা নেন মণিশঙ্কর।
“এয়ারশিপটা নিচের দিকে পড়ার সময়ে কী হয়েছিল কারোর কি মনে আছে?” প্রশ্ন করে বীরেন।
“না।” উত্তর দেয় বিশ্বনাথ “আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।”
“আমিও।” বসন্তও বলে।
“আমরা হয়তো তাহলে বিবরের মধ্যে পড়িনি। ঝড়ে হয়তো এয়ারশিপটাকে উড়িয়ে নিয়ে বিবরের পাড়ে এনে ফেলেছিল।”
“হতে পারে।” সায় দেয় বিশ্বনাথ, “কিন্তু আমাদের এয়ারশিপ থেকে এখানে বের করে আনলো কারা? আর আমাদের এভাবে বন্দি করেই রেখেছে কেন?”
“এটা হয়তো বেআইনী কোনও মাইনিং কোম্পানি হবে।” উত্তর দেয় বিশ্বনাথ, “আমরা যাতে ওদের কথা বাইরে বলতে না পারি তাই হয়তো আটকে রেখেছে।”
“তাহলে কি আর আমাদের ছাড়বে?” কেমন মুষড়ে পড়ে বীরেন।
“নিশ্চয়ই ছাড়বে!” বীরেনকে উৎসাহ যোগাতে চেষ্টা করে বিশ্বনাথ, “হয়তো মুক্তিপণ দাবি করবে বলে আমাদের আটকে রেখেছে।”
হঠাৎ ভারী বুটের শব্দ আসে বাইরে থেকে। গুহার গরাদের দরজা খুলে ভেতরে এসে ঢোকে দুজন লোক। পরনে তাদের রক্ষীদের মতো পোশাক, কোমরের বেল্টে আটকানো ব্যাটন।
“অ্যাই! তোমরা কারা? আমাদের আটকে রেখেছ কেন?” চোখ রাঙিয়ে উত্তর দাবি করার চেষ্টা করে বীরেন, কিন্তু পরিবর্তে তার ঘাড়ে রদ্দা কষিয়ে দেয় একজন রক্ষী।
বিশ্বনাথ কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বীরেনের পরিণতি দেখে সে চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
একটা ট্রে হাতে নিয়ে আরও দুজন এসে ঢোকে। প্রথমজন মণিশঙ্কর আর বসন্তর সামনে নামিয়ে রাখে দুটো ধোঁয়া ওঠা কলাই করা মগ, দ্বিতীয়জন বিশ্বনাথ আর বীরেনের সামনে নামিয়ে রাখে দুটো বাটি।
রক্ষীদের মধ্যে একজন ব্যাটন উঁচিয়ে খেতে নির্দেশ দেয়, তারপর গুহা ছেড়ে চলে যায় দলটা।
বাটিটা তুলে দেখে বিশ্বনাথ, “কী একটা ঘ্যাঁটের মতো খাবার রয়েছে।” একটু চেখে দেখে মুখ সিটকোয় সে, “অখাদ্য খেতে।”
বাটি তুলে নেয় বীরেনও, “যা আছে খেয়ে নাও। নাহলে আবার হয়তো মারবে।”
ধোঁয়া ওঠা মগে চুমুক দিয়ে মণিশঙ্করের দিকে তাকায় বসন্ত, “এটা স্যুপ মনে হচ্ছে। খুব একটা খেতে খারাপ নয়। খেয়ে নিন স্যার, অনেকক্ষণ খাননি।”
একহাতে চোখের জল মুছে মগটা তুলে নেন মণিশঙ্কর।
১৪
ল্যাবরেটরিতে মাথায় তামার কয়েল বসানো মানুষপ্রমাণ বয়েমটার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরের নীল কুয়াশায় অরুণাংশুর ছবি দেখে মানিনী।
“বাবা এ কি তোমার মতো মানুষ, না দেওসিং-এর মতো সূক্ষ্মদেহী?”
বয়েমের দিকে তাকান ডক্টর সরকার, “না মানিনী এ আমার মতোই মানুষ।”
সরকারের দিকে তাকায় মানিনী, “একে কাছে গিয়ে দেখতে পারি বাবা?”
“কাছে যাবে? আচ্ছা যাও!” যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও সায় দেন ডক্টর সরকার, “তাহলে যাওয়ার সময়ে এই বোতলটা নিয়ে যাও। এতে খাবার জল আছে।”
বোতলটা নিয়ে বেরিয়ে যায় মানিনী। তার যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে থাকে ডক্টর সরকার।
১৫
ভুবন আর বিকাশকে ভালকান ফাউন্ড্রির লোকজন আড়ালে মানিকজোড় বলে ডাকে। তার কয়েকটা কারণ আছে। দুজনেই ভালকান ফাউন্ড্রি শুরু হওয়ার সময় থেকে আছে, এবং দুজনেই সমান অকর্মণ্য। পুরোনো লোক বলে মণিশঙ্কর এদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করেননি বটে, কিন্তু এদের দিয়ে কোনও কাজ করানো প্রায় অসম্ভব। এর মধ্যে আবার বিকাশের অতিরিক্ত মদ্যপানের অভ্যেস আছে বলে মাতাল বলে তার একটা বাড়তি তকমাও জুটেছে।
একটা আধা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতো জায়গায় ভুবন আর বিকাশের ঘুম প্রায় একই সঙ্গে ভাঙে। সুড়ঙ্গের দেওয়ালে নানা বিচিত্র আঁকিবুঁকি, তাদের মাঝে দু-একটা বজ্রহিমের নীল আলো জ্বলে। চোখ রগড়ে সেসবের দিকে তাকায় ভুবন, “আমরা তো এয়ারশিপ শুদ্ধু ভেঙে পড়ছিলাম, তারপর এইটা কোথায় এসে পড়লাম?”
পকেট থেকে একটা পেতলের বোতল বের করে গলায় কিছু একটা ঢালে বিকাশ, “তাহলে আমরা হয়তো মরে গিয়ে স্বর্গে এসে পড়েছি।”
“স্বর্গ!” নাক কুঁচকোয় ভুবন, “স্বর্গ এত অন্ধকার হয় নাকি? এটা হয়তো নরক হবে।”
“উঁহু!” ঘাড় নাড়ে বিকাশ, “নরক হলে আগুন-টাগুন জ্বলত। সে সব দেখতে পাচ্ছিস?”
“হুঁ।” চিন্তিত দেখায় ভুবনকে, “তা ভুল বলিসনি, তাহলে হয়তো পাতাল হবে।”
“হ্যাঁ, পাতালই হবে।” ভুবনের কথায় আস্বস্ত হয় বিকাশ, “আমরা নিচের দিকেই পড়ছিলাম না? তাহলে পাতালেই পৌঁছে গিয়েছি।”
“শুনেছি পাতালে অনেক কিছু দেখার আছে।” দেওয়ালের বিচিত্র নক্সাগুলো দেখতে দেখতে বলে ভুবন।
পেতলের বোতল থেকে আবার গলায় তরল ঢালে বিকাশ, “তাহলে চল ঘুরে দেখি।”
লম্বা সুড়ঙ্গটা ধরে হাঁটতে থাকে দুজনে।
সুড়ঙ্গটা গিয়ে শেষ হয় একটা বিরাট গুহায়। সে গুহার দেওয়ালে আর ছাদে পুরু হয়ে জমে থাকা ছত্রাক ফসফরাসের মতো আলো দেয়। গুহার মাঝখানে একটা ছোট পুকুর, তাকে ঘিরে বেড়ে ওঠা ছোট ছোট গাছ আর ঝোপঝাড়ও জ্বলে ম্লান, নীলচে দ্যুতিতে। পুকুরের মাঝখানে বসানো একটা চারকোনা থাম, তার গায়ে খোদাই করা নক্সার ফাঁকফোকর থেকেও চুঁইয়ে পড়ে নীল আলো।
হাঁ করে সেই গুহার অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে থাকে ভুবন আর বিকাশ।
গুহার এদিক ওদিক কিছুটা ঘোরার পর, বিকাশের চোখ যায় একটা বড় পাথরের দিকে।
“হ্যাঁরে ওই পাথরে হেলান দিয়ে বসে কে একটা ঘুমোচ্ছে না?”
কাছে গিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে দুজনে। অল্প আলোতেও দেখতে অসুবিধে হয় না যে পাথরে ঠেস দিয়ে যে ঘুমোচ্ছে চেহারাটা তার প্রায় মানুষের মতো হলেও, তার বুক আর কোমরের মাঝখানটা যন্ত্রের মতো। সেই যন্ত্রের তামা আর পেতলের পাইপ, কয়েল, স্প্রিং আর তারের বুনটের ফাঁকে পাক খায় দাঁত কাটা গিয়ার, ওঠা নামা করে শাফট আর পিস্টন, দপদপ করে পাম্প।
হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে ভুবন, “এটা আবার কীরে ভাই? মানুষ না যন্ত্র?”
একটু ঝুঁকে দেখে বিকাশ, “না রে, মানুষ না। যন্ত্রই হবে, তবে পুরোনো যন্ত্র। কেমন একটা যন্ত্রপাতির মতো গন্ধ বেরোচ্ছে না?”
সায় দেয় ভুবন, “হ্যাঁ, বেশ পুরোনো যন্ত্রই তো মনে হচ্ছে। দেখতে মানুষের মতো, কিন্তু আসলে যন্ত্র।”
পেতলের বোতলে চুমুক দেয় বিকাশ, “আহা এটাকে যদি আয়সনগর নিয়ে যাওয়া যেত! তাহলে রংচং করে সাজিয়েগুজিয়ে নিয়ে দু-পয়সা কামানো যেত। গাঁটের কড়ি ফেলে লোকে দেখতে আসত এটাকে।”
দুজনের কথাবার্তায় পাথরে হেলান দিয়ে যে বসেছিল তার ঘুম ভেঙে যায়। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে, “ভূত। সরকারের পাঠানো ভূত।” গলার স্বর তার যেন শুকনো হাওয়ার মতো।
তার দিকে অবাক হয়ে তাকায় বিকাশ, “না রে, এ যন্ত্র নয়। এ মনে হচ্ছে এই পাতাল লোকের বাসিন্দা।”
মাথা নেড়ে সায় দেয় ভুবন, “হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। পাতালের অধিবাসী মনে হচ্ছে। দেখো বাপু, আমরা কোনও সরকারের ভূতটুত নই, মর্ত্যলোক থেকে এখানে এসে পড়েছি। কিন্তু তুমি কে?”
“আমি কলবান!” হাওয়ার মতো কণ্ঠে উত্তর আসে।
“আহারে।” সহানুভূতির কণ্ঠে বলে বিকাশ, “বেচারার গলাটা একেবারে শুকিয়ে গেছে। নাও, ভাই এক চুমুক খাও।”
ভুবন বাধা দেওয়ার আগে কলবানের মুখের কাছে পেতলের বোতলটা তুলে ধরে বিকাশ। আর হয়তো সে কী করছে না বুঝেই কয়েক ঢোক খেয়ে নেয় কলবান।
বিকাশের বোতলের তরল কণ্ঠস্থ করার পর কলবানের প্রতিক্রিয়া হয় অদ্ভুত। তার পেটে বসানো গিয়ারগুলো আরও জোরে ঘুরতে শুরু করে, পাম্পগুলো শব্দ তুলে দপদপ করতে থাকে। তারপর একটা ঝড়ের মতো চিৎকার বেরিয়ে আসে তার গলা দিয়ে।
“সরকার। বদমাস। ঘর। চলে যা।”
“কী বলছে রে এ?” বিকাশ কে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে ভুবন।
“বোধহয় বলছে এ দেশের সরকার ওকে ঘর থেকে চলে যেতে বলেছে।” বিজ্ঞের মতো উত্তর দেয় বিকাশ।
“মানে এ ঘর ছাড়া? উদ্বাস্তু?”
“তাই তো মনে হচ্ছে। এ দেশের সরকার বোধহয় খুব অত্যাচারী, একে ঘর ছাড়া করেছে।” কলবানের দিকে তাকিয়ে বলে বিকাশ।
“সরকার। অত্যাচারী।” বিকাশের কথার পুনরাবৃত্তি করে কলবান।
“ভাই তাহলে তো তোর তো খুব কষ্ট, নে আর একটু খা।” কলবানের মুখে পেতলের বোতলটা আর একবার তুলে ধরে বিকাশ।
আর এক চুমুক খেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ে কলবান। দুহাতে বুক চাপড়ায় নিজের। “-বান। -বান। ক-কলবান। সরকার। মানি না। আমার। আমার। সরকার। মারব। মুক্তি। মুক্তি।”
কলবানের দিকে তাকায় বিকাশ, “এ বোধহয় এই পাতাললোকের সরকারকে উৎখাৎ করতে চাইছে।”
“বুঝতে পেরেছি।” সায় দেয় ভুবন, “তাহলে তো আমাদের উচিৎ ওকে সাহায্য করা?”
“কেন?” কপাল কুঁচকে কলবানের দিকে তাকায় বিকাশ।
“দেখছিস না, এটার বিশেষ বুদ্ধিসুদ্ধি নেই?” চোখ টেপে ভুবন, “এটাকে সাহায্য করে যদি এই দেশের সরকার ফেলে দেওয়া যায়, তারপরে এর ঘাড়ে পা রেখেই আমরাই রাজা হয়ে বসবো।”
উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বিকাশের মুখ, “বাঃ, এইটা তো ভালো বুদ্ধি দিয়েছিস! এখানকার রাজা হতে পারলে তাহলে চাকরিটা ছেড়ে দেওয়া যায়। আমাদের কেউ দাম দেয় না, গালমন্দ করে, রেজিগনেশন লেটারটা মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে আসব!”
“হুঁ, তবে? ওইজন্যেই বলি আমার বুদ্ধির ওপর ভরসা রাখ। ও ভাই কলবান, বলো সরকার ফেলতে তোমাকে কী ভাবে সাহায্য করতে পারি।”
১৬
ক্ষুধা তৃষ্ণায় অবসন্ন শরীরটা আর চলতে চায় না অরুণাংশুর। তার ওপর গাঁইতির আঘাতে ওড়া বজ্রহিমের গুঁড়ো উড়ে তার নাক আর গলা যেন আগুনের মতো জ্বলে। আজন্ম সে বজ্রহিমের খাদানে মানুষকে কাজ করতে দেখে আসছে। বজ্রহিম ছাড়া আধুনিক সভ্যতা অচল, কিন্তু তার জন্যে যে এইরকম শারীরিক মাশুল দিতে হয় তা অরুণাংশুর আগে জানা ছিল না।
পায়ের কাছে রাখা ঝুড়িটার দিকে তাকায় অরুণাংশু। ঝুড়িটা অর্ধেকও ভর্তি হয়নি। ওটা ভর্তি না হলে তার কপালে যে জলটুকু জুটবে না সে কথা জানে বটে, কিন্তু ততক্ষণ তার শরীর চলবে কিনা সে বুঝতে পারে না।
কপালের ঘাম মুছে আবার গুহার দেওয়ালের গায়ে গাঁইতি চালাতে যাচ্ছে অরুণাংশু, গুহার গরাদের দরজাটা খোলার আওয়াজ হয়। মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে এমন চমকে ওঠে সে যে তার হাত থেকে গাঁইতিটা প্রায় খসে পড়ে।
গুহার দরজা দিয়ে যে প্রবেশ করে তার আকৃতি মানুষের মতো হলেও শরীর তার ধাতুর। মাথার ওপর একটা বজ্রহিমের নীল দ্যুতি মাখা কাচের গোলকের নিচে মুখটা তার তৈরি তামার পাতে। ব্রোঞ্জ আর পেতলের কলকবজার নক্সায় গড়া তার বিচিত্র দেহ।
মানুষের মতো দেখতে এমন যান্ত্রিক প্রাণী অরুণাংশু আগে কখনও দেখেনি। তৃষ্ণায় শুকিয়ে আসা গলা তার যেন আরও শুকিয়ে যায়।
পেতল আর ইস্পাতে তৈরি একটা হাত তোলে যন্ত্রের তৈরি মানুষ, তার সেই হাতে ধরা একটা বোতল। অরুণাংশুকে আর একবার চমকে দিয়ে তার ধাতব কঠিন ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে একটা রিনরিনে স্বর, “জল।”
“কে তুমি?” ভয়ার্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে অরুণাংশু।
“আমি মানিনী।” উত্তর আসে সেই রিনরিনে স্বরে, “নাও, জল।”
তৃষ্ণার প্রয়োজনে ভয় ভুলে যায় অরুণাংশু, বাড়িয়ে ধরা জলের বোতলটা টেনে নেয়।
আকণ্ঠ জল পান করার পর মুখ থেকে বোতলটা নামিয়ে অরুণাংশু লক্ষ করে মানিনী তার দিকে তাকিয়ে আছে স্ফটিকের দুই চোখ দিয়ে।
“তুমি কে? কোথায় থাকো?” রিনরিনে স্বরে প্রশ্ন করে মানিনী।
এক হাতে মুখের জল মোছে অরুণাংশু, স্বাদ পায় বজ্রহিমের তিক্ততার, “আমি অরুণাংশু। আয়সনগরে থাকি। তুমি কি এখানেই থাকো?”
“হ্যাঁ। আমি এখানেই থাকি। আমি আর বাবা।”
“বাবা?” কপাল কুঁচকোয় ফার্নান্ডো, “কে তোমার বাবা?”
“বাবা—” কিছুক্ষণের জন্যে থেমে যায় মানিনী, বোঝা যায় যে প্রশ্নটার উত্তর দিতে তাকে বেগ পেতে হচ্ছে। “বাবা। যে আমাকে বানিয়েছে।”
মানিনীর মাথায় বসানো বজ্রহিমের দ্যুতি মাখা কাচের বলটার দিকে তাকিয়ে কিছুটা আন্দাজ করতে পারে অরুণাংশু। মানিনী কোনও থমাটার্জিস্টের সৃষ্টি। কিন্তু কে সেই ওস্তাদ থমাটার্জিস্ট যে যন্ত্রের মানুষ সৃষ্টি করতে পারে। এই অজানা জায়গায় তাকে সে বন্দিই বা করে রেখেছে কেন?
মানিনীর দিকে তাকায় অরুণাংশু। বুঝতে পারে এই সব প্রশ্নের উত্তর তার কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে গাঁইতিটা তুলে নেয় সে। আপাতত উত্তর না পেলেও হবে, কিন্তু বজ্রহিমের ঝুড়িটা না ভরতে পারলে হয়তো খাবার জুটবে না।
দুর্বল হাতে গুহার দেওয়ালে গাঁইতি চালায় অরুণাংশু। দু-একটা বজ্রহিমের টুকরো ঝরে পড়ে মাটিতে। টুকরোগুলো কুড়িয়ে ঝুড়িতে ভরে অরুণাংশু। মাথাটা একপাশে হেলিয়ে তার কাজ দেখে মানিনী।
“তুমি কি ঝুড়িটা ভর্তি করতে চাও?”
“হ্যাঁ।” সংক্ষেপে উত্তর দেয় অরুণাংশু।
“তাহলে এত আস্তে আস্তে কাজ করছ কেন? অনেক সময় লেগে যাবে তো!”
মানিনীর দিকে তাকিয়ে আর একবার গাঁইতি তোলে অরুণাংশু, “এর চাইতে তাড়াতাড়ি আমি করতে পারি না।”
“তাহলে আমায় দাও।” অরুণাংশু কিছু বোঝার আগে তার হাত থেকে গাঁইতিটা একরকম ছিনিয়ে নেয় মানিনী। তারপর বিরামহীন ভাবে প্রায় বিদ্যুৎগতিতে তার গাঁইতি পড়তে থাকে গুহার দেওয়ালে। অরুণাংশুর মনে হয় গাঁইতিটা হাত নয়, যেন চালাচ্ছে দু-দুটো পিস্টন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই মাটিতে একটা স্তূপ জমে যায় বজ্রহিমের। গাঁইতি ফেলে কোদাল দিয়ে ঝুড়িতে বজ্রহিম তোলে মানিনী। ঝুড়ি ভর্তি হয়ে উপচে পড়ার পরও সে স্তূপের আয়তন খুব একটা কমে না।
বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অরুণাংশু। তার থমাটার্জিস্টের মস্তিষ্কে খেলতে থাকে অনেকগুলো সম্ভাবনার কথা। যে প্রশ্নটা সে আগে করতে গিয়েও করেনি এবার সেটা সে আর না করে থাকতে পারে না, “তোমার বাবা কে মানিনী? কে তৈরি করল তোমাকে?”
মানিনী কিছু বলার আগেই পায়ের শব্দ হয়, গুহায় এসে ঢোকেন ডক্টর সরকার, সঙ্গে একজন রক্ষী।
“আমি সৃষ্টি করেছি মানিনীকে। আমিই মানিনীর জনক।”
মাথায় ঘন চুল, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, মানুষটাকে কেমন চেনা চেনা লাগে সরকারের। তারপর তার হঠাৎ মনে পড়ে যায়। আয়সনগরে তার বাবার অফিসে ওই চেহারা সে দু-একবার দেখেছে।
“ডক্টর সরকার!” বিস্মিত কন্ঠে বলে ওঠে সে।
“হ্যাঁ, আমিই সেই।” উত্তর দেন ডক্টর সরকার।
বিস্ময় কাটে না অরুণাংশুর, “কিন্তু আপনি তো—!”
“মারা গেছি?” প্রশ্ন করে নিজেই জবাব দেন ডক্টর সরকার, “না মারা যাইনি। মেরে ফেলার সমস্ত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও মারা যাইনি।”
“ষড়যন্ত্র!” হতভম্বের মতো ডক্টর সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অরুণাংশু।
“কীসের ষড়যন্ত্র বাবা?” তার রিনরিনে স্বরে প্রশ্ন করে মানিনীও।
“বলছি, চলো।” রক্ষীর দিকে তাকিয়ে অরুণাংশুর দিকে ইঙ্গিত করেন ডক্টর সরকার, “একেও নিয়ে এসো।”
১৭
স্যুপটা শেষ করেই হাই তুলতে থাকেন মণিশঙ্কর, “বড্ড ঘুম পাচ্ছে। চোখ খুলে রাখতে পারছি না। একটু শুয়ে পড়ি।” স্যুপের মগটা নামিয়ে রেখেই মাটিতে শুয়ে পড়েন তিনি।
সন্দিগ্ধ চোখে হাতের মগটার দিকে তাকায় বসন্ত, “এ বাবা! আমারও দেখছি ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। স্যুপে কিছু ছিল, না কি?” কথা শেষ হতে না হতেই হাত থেকে মগটা খসে পড়ে তার, মণিশঙ্করের পাশে সেও শুয়ে পড়ে মাটিতে।
চোখ কপালে তোলে বীরেন, “কী হল এদের দুজনের? মারা গেল নাকি?”
উঠে মণিশঙ্কর আর বসন্তর কাছে গিয়ে তাদের নাকের নিচে হাত রেখে পরীক্ষা করে বিশ্বনাথ, “না, ঘুমিয়ে পড়েছে।”
বিশ্বনাথর দিকে তাকায় বীরেন, “তাহলে তো ওদের স্যুপে নিশ্চই কোনও ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল।” কপাল কুঁচকে আসে তার, “কিন্তু আমাদের রেহাই দিল কেন বলো তো?”
একটা ব্যঙ্গের হাসি খেলে যায় বিশ্বনাথের মুখে, “যারা আমাদের আটকে রেখেছে, তারা বোধহয় বুঝতে পেরেছে আমাদের মধ্যে কারা ওদের কাছে জরুরি।”
বীরেনের ঘাড়ে রদ্দার ব্যথাটা তখনও যায়নি, বিশ্বনাথের কথাটা তার খুব একটা বিশ্বাস হয়েছে বলে মনে হল না। অন্যমনস্ক ভাবে ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে সে বলে, “তাতে ওদের লাভ কী হবে?”
মুখের হাসিটা আরও একটু বেঁকে যায় বিশ্বনাথের, “আমরা ওদের ঘরে লাভ তুলে দিতে পারব।”
“বুঝলাম না।” মাথা নাড়ে বীরেন।
বীরেনের কাছে সরে আসে বিশ্বনাথ, “ধরো, কোম্পানি চালানোর ভার যদি তোমার মুঠোয় থাকে, তাহলে আমাদের যারা আটকে রেখেছে তারা যা দাবী করবে তুমি কি দিতে অস্বীকার করবে?”
মাথা নাড়ে বীরেন, “না তা করব না, কিন্তু কোম্পানি আমার হাতে আসবে কী করে? কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর তো মণিশঙ্কর। আর মণিশঙ্করের অবর্তমানে অরুণাংশু।”
জিভ দিয়ে একটা বিরক্তির শব্দ করে বিশ্বনাথ, “অরুণাংশু মারা গেছে। মণিশঙ্করের কোনও উত্তরাধিকারী নেই।”
“কিন্তু মণিশঙ্কর—?”
শীতল চোখে বীরেনের দিকে তাকায় বিশ্বনাথ, “মণিশঙ্করকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আমরা দুজনে মিলে সরকারকে ফাঁসিয়ে দিয়ে তারপর স্যাবোটেজ করা বিবর বোটে না তুলে দিলে আজকে আমরা কেউই এত পয়সা কামাতে পারতাম না। সরকার আর অরুণাংশু দুজনেই বিদায় হয়েছে। এবার মণিশঙ্করকে সরিয়ে দিতে পারলেই কোম্পানির বোর্ডের কাছে তোমাকে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদে বসানো ছাড়া কোনও রাস্তা থাকবে না।”
ধীরে ধীর ওপর নিচে মাথা দোলায় বীরেন। বুঝতে পারা যায় যে বিশ্বনাথের পরামর্শ তার মনে ধরেছে। কিন্তু তার সংশয় তবু যায় না, “সরকার বিবরে তলিয়ে গিয়েছিল, লোকে ভেবেছিল দুর্ঘটনা। কিন্তু এখানে কিছু করতে গেলে যদি জানাজানি হয়ে যায়?”
কপালে ভুরু তোলে বিশ্বনাথ, “কে জানবে? আমরা ছাড়া আর আছে কে এখানে?”
“যারা আমাদের আটকে রেখেছে?”
মুখে আবার বিরক্তির আওয়াজ তোলে, “তুমি কি মনে করো তাদের কিছু যায় আসে? আমাদের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যেই হয়তো ওরা ওদের দুজনকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে দিয়েছে।”
ওপর নিচে মাথা দোলায় বীরেন, “ঠিক। কিন্তু তাহলে বসন্তকেও তো—?”
“ঠিক।” সায় দেয় বিশ্বনাথ, “বসন্তকেও বেঁচে থাকতে দেওয়া যায় না। কোনও সাক্ষী রাখা চলবে না।”
“কিন্তু কাজটা করবে কী ভাবে?”
এদিক ওদিকে তাকিয়ে গুহার একটা কোণের দিকে নির্দেশ করে বিশ্বনাথ। সেখানে কয়েকটা বড় বড় পাথরের চাঁই পড়ে আছে।
“ওই পাথরগুলো দিয়ে।”
দুজনে মিলে দুটো বড় পাথর কুড়িয়ে এনে হাঁটু গেড়ে বসে ঘুমন্ত মণিশঙ্কর আর বসন্তের শরীরের পাশে।
দুহাতে মাথার ওপর পাথর তোলে বিশ্বনাথ, তাকে অনুসরণ করে বীরেনও।
চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় বিশ্বনাথ, “দুজনে একসঙ্গে পাথর নামিয়ে আনতে হবে, যাতে কেউ জেগে না ওঠে। রেডি থাকো।”
একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে গোনা শুরু করে বিশ্বনাথ, “এক, দুই—”
কিন্তু তিন পর্যন্ত গোনার সুযোগ পায় না সে। সশব্দে আছড়ে খুলে যায় গুহার দরজা, আর ছুটতে ছুটতে গুহাতে এসে ঢোকে প্রায় পাঁচ-ছজন রক্ষী। তারা প্রথমে বিশ্বনাথ আর বীরেনের হাত থেকে পাথড় কেড়ে নিয়ে, হিড়হিড় করে টেনে ফেলে দেয় গুহার এক কোণে। তারপর ঘুমন্ত মণিশঙ্কর আর বসন্তকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় গুহার বাইরে।
তাদের পেছনে ফের বন্ধ হয়ে যায় গুহার দরজা।
১৮
অনেকগুলো সুড়ঙ্গ, গুহাপথ পার হয়ে কলবান ভুবন আর বিকাশকে নিয়ে আসতে থাকে। ভুবন আর বিকাশের হাতে একটা করে লাঠি, আসার পথে এ দুটো তারা কুড়িয়ে এনেছে। আসার সময়ে কলবানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার ভাঙাভাঙা ভাষা থেকে দুজনে যা বুঝেছে তা হল এই যে পাতাল প্রদেশের সরকারের একজন মাথা আছে। তার কাছে একটা খুব দরকারি বই আছে। তাকে মেরেধরে তার কাছ থেকে সেই বইটা কেড়ে নিতে পারলেই সরকার পড়ে যাবে।
“বইটা এত দরকারি কেন বলত?” প্রশ্ন করে বিকাশ।
“বুঝতে পারলি না?” বিজ্ঞের মতো উত্তর দেয় ভুবন, “ওটা এই দেশের সংবিধান। ওটা হাতাতে পারলেই সরকার আর শাসন করতে পারবে না।”
ঠোঁটে আঙুল দিয়ে শব্দ করে কলবান, “শ্শ্শ্। সরকার। কাছে। শুনতে পাবে।”
কপালে ভুরু তোলে ভুবন, “কোথায়?”
আঙুল তুলে একটা গুহামুখ দেখায় কলবান।
পা টিপে টিপে গুহার ভেতরে ঢোকে ভুবন আর বিকাশ, তাদের পেছনে কলবান। জায়গাটা একটা বিশাল ল্যাবরেটরির মতো। তার দেওয়ালে উঁচুতে বসানো ফোকর দিয়ে আলো এসে পড়ে ভেতরে। সে আলোয় দেখতে পাওয়া যায় চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে নানা যন্ত্রপাতি আর মেশিন, সার বেঁধে দাঁড় করানো রয়েছে বইয়ের তাক।
আবার আঙুল তুলে দেখায় কলবান, “সরকার।”
মাথা বাড়িয়ে দেখে ভুবন আর বিকাশ। তাদের দিকে পেছন ফিরে ল্যাবরেটরির এক প্রান্তে টেবিলের ওপর ঝুঁকে মন দিয়ে একটা মোটা বই পড়ে কেউ একজন। তার ঘাড় অবধি নেমে আসা চুল, আর পরণের আলখাল্লা দেখে তাদের দুজনের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সে একটা হোমরাচোমরা কেউ।
“ওই বইটাই বোধহয় সংবিধান, না?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে বিকাশ।
“হ্যাঁ।” একটু বিরক্তির সঙ্গে ফিসফিস করে উত্তর দেয় ভুবন, “কথা বলিস না। শুনতে পাবে। আস্তে আস্তে চল। আমাদের দেখতে পাওয়ার আগেই মাথায় লাঠির বাড়ি মারব।”
লাঠি উঁচিয়ে ল্যাবরেটরির মধ্যে দিয়ে পা টিপেটিপে বইয়ে মুখ গুঁজে রাখা মানুষটার দিকে হাঁটে ভুবন আর বিকাশ। তাদের সঙ্গে কয়েক পা দূরত্ব রেখে হাঁটে কলবান। তাকে দেখে মনে হয় ল্যাবরেটরী অবধি আসতে আসতে তার সাহস অনেকটাই কমে গেছে।
কিন্তু তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। ল্যাবরেটরির অর্ধেকটা পেরোনোর পর ল্যাবেরটরির মেঝেতে আঁকা কয়েকটা সাঙ্কেতিক আঁকিবুঁকিতে তাদের পা পড়তেই একটা চড়চড় আওয়াজ করে তীব্র নীল আলোতে সেই নক্সাগুলো জ্বলে ওঠে। তিনজনেই বরফের মতো জমে যায়, আর নড়াচড়ার ক্ষমতা থাকে না তাদের।
টেবিলের বই ছেড়ে উঠে আসে লম্বা চুলের মানুষটা। তাকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে ভুবন আর বিকাশ দুজনেই।
“ডক্টর সরকার!” আতঙ্কের স্বরে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে ভুবন, “এই বিকাশ, তুই যে বললি সরকার মানে সরকার?”
হতভম্বের মতো ডক্টর সরকারের মুখের দিকে তাকায় বিকাশ, “হ্যাঁ কলবানের কথা শুনে তাই তো মনে হয়েছিল। কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনি যে বেঁচে আছেন আমরা জানতাম না। আমাদের কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না স্যার। সরকার মানে যে সরকার নয়, সরকার মানে আসলে যে সরকার স্যার সে কথা আমরা বুঝতে পারিনি। মানে স্যার, সরকার স্যার—”
একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলেন ডক্টর সরকার। বিকাশের মুখের কাছে মুখ নিয়ে কিছু শুঁকতে চেষ্টা করেন, “তোমার কথার মাথামুণ্ডু আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কতটা গিলেছ?”
“বেশি না স্যার। মাইরি বলছি।” ডক্টর সরকারের প্রশ্নে যেন আশ্বস্ত হয় বিকাশ, “তবে আসল শক্তিগড়ের জিনিস তো স্যার, খুব কড়া। বোতলে বোধহয় একটু পড়ে আছে এখনঅ। যদি স্যার আপনিও—”
“চোওপ!” ডক্টর সরকারের ধমকে বাক্যস্রোত বন্ধ হয়ে যায় বিকাশের, সে ঢোঁক গিলতে থাকে।
পেছন ফিরে কাউকে ডাক দেন ডক্টর সরকার, “এদেরকে নিয়ে যাও।”
একটা মেশিনের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে দু-তিনজন রক্ষী। ভুবন, বিকাশ আর কলবানকে হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় ল্যাবরেটরি থেকে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না।
১৯
চোখ খুলে আশ্চর্য হয় বসন্ত। সে তো ছিল একটা আধা অন্ধকার গুহায়, কিন্তু এখানে এত আলো আসছে কোথা থেকে? তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে ওপরদিকে তাকায় সে। বুঝতে পারে সে রয়েছে একটা চওড়া গোল চত্বরে। চত্বরের চারপাশ থেকে পাহাড়ের দেওয়ালে কোনাকুনি উঠে মিলেছে মাথার ওপর। সেখানে কয়েকটা ফোকর দিয়ে নেমে আসছে সোনালি রঙ লাগা সূর্যের রেখা।
দৃষ্টি মাথার ওপর থেকে নামিয়ে এনে তার চারদিকে তাকিয়ে বিস্ময় বেড়ে যায় বসন্তর, চত্বরের মাঝখানে একটা বাঁধানো পাড় উপচে নেমে আসে ঝরনার জল, তার চারদিকে শোভা পায় নানা ফল আর ফুলের গাছ।
একটু দূরে একটা গাছের নিচে মণিশঙ্করকে বসে থাকতে দেখে বসন্ত। তাঁর মুখের চেহারা দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে ঘুম থেকে উঠে তিনিও হতচকিত হয়ে গেছেন।
“স্যার, কোথায় রয়েছি আমরা?”
মাথা নাড়েন মণিশঙ্কর, “জানি না। প্রথমে ওই জেলের মতো গুহাটাতে, তারপর এখানে। কিছুই বুঝতে পারছি না।”
ঝরনার জলের দিকে তাকায় বসন্ত, “কে আমাদের এখান নিয়ে এসেছে কে জানে?”
“আমি!” একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে চত্বরের এক দিক থেকে। এতই অপ্রত্যাশিত সে কণ্ঠস্বর যে চমকে উঠে সে দিকে তাকায় বসন্ত।
একটা গাছের আড়াল থেকে সামনে এসে দাঁড়ান ডক্টর সরকার।
ছুটে গিয়ে তাঁর হাত নিজের দু-হাতে চেপে ধরে বসন্ত, “স্যার আপনি—”
“হ্যাঁ, বেঁচে আছি।” বসন্তর কথাটা সম্পূর্ণ করেন ডক্টর সরকার, ঠোঁটে তার একটা ম্লান হাসি।
চোখে জল চিকচিক করে বসন্তর, “স্যার যেদিন খবর পেলাম যে দুর্ঘটনায় আপনার বোট ডুবে গেছে, সেদিন সারারাত ধরে শুধু কেঁদেছি।”
“দুর্ঘটনা?” মাথা নাড়েন ডক্টর সরকার, “না, বসন্ত, দুর্ঘটনা না। স্যাবোটেজ। আমার বোটের মোটর বিগড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিছুদূর যাওয়ার পরেই বোট ডুবতে শুরু করে।”
বিষ্ফারিত দৃষ্টিতে মণিশঙ্করের দিকে তাকায় বসন্ত। পাংশু হয়ে যায় মণিশঙ্করের মুখ, “বিশ্বাস করো, আমি এর বিন্দুবিসর্গ জানি না। তোমাকে চিফ থমাটার্জিস্টের পদ থেকে সরানোর কথা যখন উঠেছিল তাতে আমি সায় দিয়েছিলাম। কিন্তু তার বাইরে আমি কিছু জানি না।”
অভিযোগের চাহনিতে মণিশঙ্করের দিকে তাকান ডক্টর সরকার, “তা হয়তো জানতেন না, কিন্তু আপনার কোম্পানির উন্নতির পেছনে আমার এত বছরের অবদান সত্ত্বেও, যখন বীরেন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ আনল, তখন আপনি আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগটুকু দিলেন না।”
ডক্টর সরকারের কঠিন চাহনির সামনে ভেঙে পড়েন মণিশঙ্কর, “আমার কোনও উপায় ছিল না। কোম্পানির অনেক টাকা লোকসান হয়ে গিয়েছিল। শেয়ারহোল্ডাররা চেঁচামেচি করছিল। বীরেনের কথামতো তোমাকে বরখাস্ত না করলে—”
“শেয়ারহোল্ডাররা মিটিং ডেকে আপনাকেই ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদ থেকে সরিয়ে দিত।” মণিশঙ্করের কথাটা ডক্টর সরকারই সম্পূর্ণ করে দেন, “আমার এত বছরের আনুগত্যের আর কাজের আপনি কোনও দাম দিলেন না। নিজের গদি বাঁচাতে আপনি আমাকে নেকড়েদের হাতে তুলে দিলেন।”
কান্নায় ভেঙে পড়েন মণিশঙ্কর, “ভুল করেছি ডক্টর সরকার, ভুল করেছি। যেদিন তোমার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি, সেইদিন থেকে অনুশোচনায় দগ্ধে দগ্ধে মরেছি। তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, সেই পাপেই আজ একমাত্র সন্তানকে হারানোর মতো এত বড় শাস্তি আমাকে পেতে হল।”
দৃষ্টি কোমল হয়ে আসে ডক্টর সরকারের। মণিশঙ্করের কাঁধে একটা হাত রেখে সান্ত্বনার স্বরে তিনি বলেন, “কাঁদবেন না। অরুণাংশুর কিছু হয়নি। সে সুস্থ শরীরেই আছে।”
কান্না থেমে যায় মণিশঙ্করের, বিস্মিত দৃষ্টিতে ডক্টর সরকারের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, “অরুণাংশু বেঁচে আছে? কোথায় সে?”
“আমার ল্যাবরেটরিতে। আসুন।” হাত তুলে চত্বরের এক দিকে একটা সিঁড়ির দিকে ইঙ্গিত করে ডক্টর সরকার।
মণিশঙ্কর আর বসন্তকে সঙ্গে করে সিঁড়ি দিয়ে ল্যাবরেটরিতে নেমে আসেন ডক্টর সরকার। একটা টেবিলে ছড়ানো নানা বই আর ড্রয়িং-এ মুখ গুঁজে থাকা অরুণাংশুকে আঙুল তুলে দেখান তিনি, “ওই যে অরুণাংশু।”
অরুণাংশুর দিকে ছুটে যান মণিশঙ্কর, তাকে জড়িয়ে ধরেন বুকে। তাঁর দু-চোখ বেয়ে তখন নামছে জলের ধারা।
ল্যাবরেটরির অন্য প্রান্তের দিকে হাতছানি দিয়ে কাউকে ডাকেন ডক্টর সরকার। “বসন্ত, আর একজনের সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দিই, দেখো কে চিনতে পার কি না?”
“কে স্যার?” বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে বসন্ত।
একটা বইয়ের তাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে মানিনী। তার ধাতব চেহারাটা দেখে সভয়ে দু-পা পিছিয়ে যায় বসন্ত।
একটা হাত তুলে তাকে স্বাগত জানায় মানিনী, “গুড ইভনিং বসন্ত, আমি মানিনী!”
মানিনীর গলার স্বর বসন্তকে বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়িয়ে দেয় বহুকাল আগের এক বৃষ্টিভেজা রাতে একটা জালের চাকতি থেকে ভেসে আসা আর এক রিনরিনে কণ্ঠস্বরের কথা। বিস্ফারিত নয়নে সে পালা করে একবার মানিনী আর একবার ডক্টর সরকারের দিকে তাকাতে থাকে।
“কলের মানুষ! কলের মানুষ! স্যার, আপনি সত্যিই কলের মানুষ বানিয়ে ফেলেছেন।”
একটা হাসি ফুটে ওঠে ডক্টর সরকারের মুখ, “হ্যাঁ, বসন্ত, সে রাতে তোমাকে আমি যা বলেছিলাম, সেই কাজ আমি সম্পূর্ণ করতে সফল হয়েছি। তবে বসন্ত…” বসন্তর কাঁধে হাত রাখেন ডক্টর সরকার, “আমার এই সফলতায় তোমার অবদানও কম নয়। মানিনীকে আমি সৃষ্টি করেছি বটে, কিন্তু সেদিন তুমি বোটে আমার বই আর বাক্সটা ছুড়ে না দিলে আমার পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব হত না।”
হতবাক মণিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে অরুণাংশু বলে, “ডক্টর সরকার অসাধ্য সাধন করেছেন বাবা, বজ্রহিম তুলতে আর মানুষকে কোনওদিন নিজের শরীর স্বাস্থ্য দিয়ে মূল্য চোকাতে হবে না। আমরা ফিরে গেলে ওঁর এই আবিষ্কার হুলুস্থূল ফেলে দেবে।”
“ফিরে গিয়ে?” কেমন মূষড়ে পড়েন মণিশঙ্কর, “কিন্তু ফিরব কি করে? আমাদের এয়ারশিপ নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় সবাই মারা পড়েছে।”
“আপনাদের এয়ারশিপও ভাঙেনি, কেউ মারাও পড়েনি।” মৃদু হেসে উত্তর দেন ডক্টর সরকার, “সত্যের সামনাসামনি আপনাদের দাঁড় করাতে আমি কিছুটা মায়াজাল বুনেছি মাত্র। আজ রাতটা এখানে কাটিয়ে নিন, কাল সকালে আপনাদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করব। তবে তার আগে আর একটা কাজ আছে।”
শূন্যের দিকে তাকিয়ে কাউকে নির্দেশ দেন ডক্টর সরকার, “দেওসিং, দুজনকে নিয়ে এসো।”
কিছুক্ষণ বাদে বিশ্বনাথ আর বীরেনকে ঠেলতে ঠেলতে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে আসে দুজন রক্ষী। ডক্টর সরকারকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে দুজনেই। কাগজের মতো সাদা হয়ে যায় বীরেন, দরদর করে ঘামতে থামকে বিশ্বনাথ।
বিহ্বল ভাবটা আগে কাটিয়ে ওঠে বিশ্বনাথ। কান এঁটো করা হাসি হেসে, হাত কচলাতে কচলাতে একেবারে বিনয়ের অবতার হয়ে প্রশ্ন করে, “ডক্টর সরকার স্যার, আপনি বেঁচে আছেন?”
একটা বাঁকা হাসি হাসেন ডক্টর সরকার, “হ্যাঁ, বিশ্বনাথ, তোমাদের দুজনের সমস্ত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও আমি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছি।”
“ষড়যন্ত্র, কীসের ষড়যন্ত্র স্যার?” বিশ্বনাথের কণ্ঠস্বর শুনে মনে হল সে আকাশ থেকে পড়েছে।
“তেমন বিশেষ কিছুর নয়। ধীরেসুস্থে বলছি।” মুখের বাঁকা হাসিটা মেলায় না ডক্টর সরকারের। মণিশঙ্করের দিকে ফিরে তিনি বলেন, “কাল সকাল হলেই আপনাদের আমি আয়সনগর ফেরার বন্দোবস্ত করে দেব। কিন্তু তার আগে আমার কয়েকটা দাবি আছে।”
“বলো, বলো, সরকার। তুমি যা বলবে আমি তাতেই রাজি আছি। তুমি আবার চিফ থমাটার্জিস্টের পদে বহাল হতে চাইলে আমার কোনও আপত্তি নেই। আরও কিছু প্রয়োজন থাকলে তাও তুমি নির্দ্বিধায় আমায় বলতে পারো।”
“না, যে জীবন পেছনে ফেলে এসেছি তাতে ফিরে যাওয়ার আমার বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় নেই। আমার কাছে আমার অতীত এখন আমার আগামী ভবিষ্যতের ভূমিকা মাত্র।” মাথা নাড়ান ডক্টর সরকার।
“তাহলে?”
“আমার প্রথম দাবি, চিফ থমাটার্জিস্টের পদে অরুণাংশুকে বসানো হোক।”
“অরুণাংশু!” বিস্মিত স্বরে বলেন মণিশঙ্কর। স্পষ্টতই ডক্টর সরকারের কাছে থেকে এইরকম অনুরোধ তিনি আশা করেননি।
“হ্যাঁ অরুণাংশু।” উত্তর দেন ডক্টর সরকার, “আমার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো মেধা একমাত্র অরুণাংশুরই আছে। মানুষের বদলে যন্ত্র দিয়ে বজ্রহিম তোলার পদ্ধতি অরুণাংশু যে বাস্তবায়িত করতে পারবে আমার সে বিষয় কোনও সন্দেহ নেই।”
“খুব ভালো প্রস্তাব!” সানন্দে উত্তর দেন মণিশঙ্কর।
“আমার দ্বিতীয় দাবি, ভালকান ফাউন্ড্রি এবার থেকে কিছু সামাজিক কাজের ভার নেবে। তার মধ্যে প্রধান হবে বজ্রহিম খাদের অসুস্থ লেবারদের চিকিৎসা আর পুনর্বাসন। আর এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হবে বসন্তকে।”
“বেশ।” একটু ভেবে উত্তর দেন মণিশঙ্কর, “বোর্ড আর শেয়ারহোল্ডারদের রাজি করানোটা সহজ হবে না, তবে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।”
“আর আমার শেষ দাবি। ভালকান ফাউন্ড্রি পুলিশে বিশ্বনাথ আর বীরেনের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের করবে।”
“এ সব ভুয়ো অভিযোগ।” গর্জ্জে ওঠে বীরেন, “কাকে খুন করার চেষ্টা করেছি আমরা?”
“সরকার স্যারকে!” অধিকতর উতপ্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে বসন্ত। “বোটের মোটর খারাপ করে দিয়ে স্যারকে মারতে চেয়েছিলে তোমরা।”
“মিথ্যে কথা।” শীতল চাহনিতে বিশ্বনাথ তাকায় বসন্তর দিকে, মুখে তার একটা ক্রুর হাসি, “এসবের কোনও প্রমাণ নেই।”
“ঠিকই বলেছ।” বসন্তর বদলে উত্তর দেন ডক্টর সরকার, “আমার বোটের মোটর যে আগে থাকতেই স্যাবোটেজ করে রাখা ছিল, তার কোনও প্রমাণ আমার কাছে নেই। কিন্তু—” এবার একটা কুটিল হাসি খেলে যায় তাঁর মুখেও, “—কিন্তু আমি আমাকে খুনের চেষ্টার কথা বলিনি।”
মাথার কাছে তামার কয়েল বসানো একটা মানুষ প্রমাণ বয়েমের সামনে গিয়ে হাত নাড়েন ডক্টর সরকার। পাকিয়ে ওঠে বয়েমের ভেতরের নীল কুয়াশা। ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে একটা ছবি। মাটিতে শুয়ে থাকা বসন্ত আর মণিশঙ্কর আর বসন্তর শরীরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বিশ্বনাথ আর বীরেন। দুজনেই দু-হাতে মাথার ওপর আঘাত করা ভঙ্গিমায় তুলে রেখেছে পাথরের চাঁই।
এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে ল্যাবরেটরিতে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে কয়েকজোড়া চোখ তাকিয়ে থাকে বিশ্বনাথ আর বীরেনের দিকে।
রক্ষীদের দিকে ইশারা করেন ডক্টর সরকার, “নিয়ে যাও।”
২০
একটা বিশাল গুহায় দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে এয়ারশিপের মাল্লারা। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের হাত পা নেড়ে তাদের অবস্থাটা ব্যাখা করতে চেষ্টা করে এয়ারশিপের সারেঙ।
“ঝড়ের ধাক্কায় মনে হয়েছিল আমার চারপাশে এয়ারশিপ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, হুহু করে নিচে পড়ে যাচ্ছি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু চোখ খুলে দেখি, এ বাবা, এ তো এয়ারশিপের ভেতরেই শুয়ে আছি। তারপর তাড়াহুড়ো করে নেমে দেখি এয়ারশিপ আস্তই আছে। ওই যে।”
আঙুল তুলে যেদিকে দেখায় সারেঙ সেদিকে একটা খোলা গুহামুখের পেছনে দেখা যায় ঝকঝকে আকাশ, আর সেই আকাশে ভাসতে থাকা এয়ারশিপ।
গুহার একদিকে মানিনীকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে ডক্টর সরকার। তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মণিশঙ্কর, অরুণাংশু আর বসন্ত।
হাত নেড়ে কাউকে ইশারা করেন ডক্টর সরকার। বিশ্বনাথ আর বীরেনকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসে দু-তিনজন রক্ষী। মাথা এয়ারশিপের দিকে আঙুল তুলে দেখান তিনি, “এয়ারশিপে তুলে দাও। আয়সনগর ফিরে গিয়ে ওদের বিচার হবে।”
মাথা নিচু করে রক্ষীদের সঙ্গে চলে যায় বিশ্বনাথ আর বীরেন, কোনও প্রতিবাদ করে না।
আর একবার হাতের ইশারা করেন ডক্টর সরকার। কয়েকজন রক্ষী হাঁটিয়ে নিয়ে আসে, কলবানকে, তার মুখে ভয়ের চিহ্ন সুপষ্ট। তার পেছনে আরও কয়েকজন নিয়ে আসে ভুবন আর বিকাশকে।
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কলবানের দিকে তাকায় অরুণাংশু, “এ কে?”
“মনমোহিনীর অনৈতিক এক্সপেরিমেন্টের ফসল।” উত্তর দেন ডক্টর সরকার, “ইন্দ্রজালতন্ত্রের অপপ্রয়োগের জ্বলন্ত উদাহরণ। অরুণাংশু, খেয়াল রেখ, যতই প্রলোভন আসুক, ভবিষ্যতে তোমার জ্ঞানচর্চা যেন মনমোহিনীর মতো নীতির সীমানা না লঙ্ঘন করে।”
“না, সে ভুল আমি করব না।” কলবানের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় অরুণাংশু, “আমি মানুষের আশীর্বাদ পেতে চাই। অভিশাপ কুড়োতে চাই না।”
তার কথা শেষ হতে না হতেই ভুবন হাঁউমাউ করে ওঠে, “স্যার সব দোষ কিন্তু ওর। ওই আমাদের বলেছিল সরকার ফেলে দিতে।”
ডক্টর সরকারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নের ভঙ্গীতে কপালে ভুরু তোলেন মণিশঙ্কর। একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে ডক্টর সরকার বলেন, “ওরা দুজনে ভেবেছিল, আমাকে পথ থেকে সরিয়ে দিতে পারলে ওরা এখানে রাজত্ব করবে।”
“না স্যার!” এবার আর্তনাদ করে ওঠে বিকাশ, “আমাদের বুঝতে ভুল হয়েছিল স্যার। আমরা ভেবেছিলাম সরকার মানে সরকার, কিন্তু স্যার, সরকার মানে যে সরকার স্যার সে কথা জানতাম না স্যার। জানলে স্যার সরকার ফেলে দিয়ে নতুন সরকার তৈরি করার কথা ভাবতামই না। সরকার স্যারের সরকার তো ভালোই—”
“উফফ!” দু-হাতে কপালে টিপে ধরে ধমক দেন মণিশঙ্কর, “মাথা ধরিয়ে দিল। যাও চুপচাপ এয়ারশিপে গিয়ে বসো। সারাদিন ধরে তোমারা দুজনে অফিসে কী কর আয়সনগর গিয়ে তার সব হিসেব নেবো।”
দ্বিরুক্তি না করে সুড়সুড় করে এয়ারশিপের দিকে চলে যায় দুজনে।
শূন্যের দিকে তাকিয়ে ডাক দেন ডক্টর সরকার, “দেওসিং!”
শূন্যে আবির্ভাব হয় একটা নীল রঙের ছোট বিন্দুর। অরুণাংশু, মণিশঙ্কর আর বসন্তর বিস্মিত দৃষ্টির সামনে সেই বিন্দুটা ক্রমশ বড় হতে হতে আকার নেয় একটা নীল কুয়াশায় গড়া মানুষের। তার দিকে ইঙ্গিত করে ডক্টর সরকার বলেন, “আপনাদের চেনার কথা নয়, তবে এ হল দেওসিং, এই গুহাজগতের আসল অধিকারী।”
দেওসিং-এর দিকে ফেরেন ডক্টর সরকার, “দেওসিং, আমার আর একটা ছোট্ট কাজ করে দাও। তারপর তুমি আর তোমার অনুচররা মুক্ত।”
“বলুন কী করতে হবে।” জানতে চায় দেওসিং।
“আমাকে আর মানিনীকে খনিজাবাদ পৌঁছে দাও। খনিজাবাদের বাইরে মনমোহিনীর একটা পরিত্যক্ত বাড়ির সন্ধান পেয়েছি। মানিনীকে নিয়ে সেখানেই নিয়ে উঠব। ফিরে এসে এই গুহাজগতের সব ক-টা প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিও। তাহলে ভবিষ্যতে তোমাদের আর কেউ বিরক্ত করতে পারবে না।”
“আর একটা কথা।” কলবানের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন ডক্টর সরকার, “ওর এই অবস্থার জন্যে কলবান নিজে দায়ী নয়। ওর ওপর অত্যাচার অনেক হয়েছে। কেবল মনমোহিনী নয়, আমিও ওর প্রতি অবিচার করেছি। ওকে এখানে শান্তিতে থাকতে দিও।”
“আমাদের জায়গার কোনও অভাব নেই। কলবানের এখানে থাকার কোনও অসুবিধে হবে না। কথা দিলাম।” উত্তর দেয় দেওসিং।
একটা নিশ্বাস ফেলেন ডক্টর সরকার, “আমাদের নাটক এখানেই শেষ। আমরা এখান থেকে বিদায় নিলে এই মঞ্চের অন্য কুশীলবরা মিলিয়ে যাবে কুয়াশায়। আর একদিন তাদের মতো আমরা আর আমাদের এই অতি প্রিয় দুনিয়াটাও বিলীন হয়ে যাবে কোনও চিহ্ন না রেখে। স্বপ্নের উপাদান দিয়েই যেন গড়া আমাদের সবার জীবনই। নিদ্রাই সে ক্ষুদ্র জীবনের শেষ পরিণতি কিন্তু তবু তারই মধ্যে কিছু দায়িত্ব থেকেই যায়।”
“অরুণাংশু”, তাঁর দুষ্প্রাপ্য বইটা অরুণাংশুর হাতে ধরিয়ে দেন ডক্টর সরকার, “এটা তুমি রাখো। বইয়ের পাতায় পাতায় আমি নোট লিখে রেখেছি, কলের মানুষ তৈরি করতে তোমাকে বেগ পেতে হবে না।”
বইটা নিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে অরুণাংশু প্রশ্ন করে, “আপনি আমাদের সঙ্গে আসছেন না?”
মাথা নাড়েন ডক্টর সরকার, “না অরুণাংশু। আমি যন্ত্র থেকে কলের মানুষ সৃষ্টি করেছিলাম। কিন্তু তার পরেও একটা বাকি কাজ রয়ে গেছে, কলের মানুষ থেকে মানুষ বানানো।”
মানিনীর কাঁধে সস্নেহে একটা হাত রাখেন ডক্টর সরকার, “আমি মানিনীকে মানুষ করতে চাই।”
বিস্ময় কাটে না অরুণাংশুর, “কিন্তু ইন্দ্রজালের বইটা তো আপনি আমাকে দিয়ে দিলেন। আপনার কাজের অসুবিধে হবে না?”
একটা মৃদু হাসি খেলে যায় ডক্টর সরকারের মুখে, “না অরুণাংশু। ওই কাজটা করতে ওই বইতে দেওয়া ইন্দ্রজালের প্রক্রিয়া কোনও কাজে লাগবে না। ওর চাইতে আরও শক্তিশালী এক ধরনের জাদুর প্রয়োজন হবে।”
“কী জাদু?” বিস্ময়ের পারা চড়ে অরুণাংশুর কণ্ঠে।
“ভালোবাসা।” উত্তর দেন ডক্টর সরকার।
***
ঋণস্বীকার: কাহিনিটি উইলিয়াম শেক্সপীয়ার রচিত ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকের স্টিমপাঙ্ক শৈলীতে পুনর্নির্মাণ। লেঙ মালভূমির কল্পনাটি লাভক্রাফটের কাহিনি থেকে সংগৃহীত।
শব্দার্থ:
১। থমাটার্জি – Thaumaturgy – জাদুবিদ্যা প্রয়োগের প্রক্রিয়া
সংযোজন: শেক্সপীয়ারের মূল নাটকটির কয়েকটি সংলাপ কাহিনিতে সরাসরি, বা কিছু পরিবর্তন করে ব্যবহার করা হয়েছে। তার মধ্যে আছে,
১.১ Our revels now are ended. These our actors,
As I foretold you, were all spirits, and
Are melted into air, into thin air;
And, like the baseless fabric of this vision,
The cloud-capped towers, the gorgeous palaces,
The solemn temples, the great globe itself,
Yea, all which it inherit, shall dissolve;
And, like this insubstantial pageant faded,
Leave not a rack behind. We are such stuff
As dreams are made on, and our little life
Is rounded with a sleep
১.২ What’s past is prologue.
১.৩ No more dams I’ll make for fish,
Nor fetch in firing
At requiring,
Nor scrape trencher, nor wash dish.
’Ban, ‘Ban, Ca-caliban
Has a new master. Get a new man.
Freedom, high-day, high-day, freedom,
১.৪ What have we here? A man or a fish? Dead or alive? A fish. He smells like a fish, a very ancient and fish-like smell, a kind of not-of-the-newest poor-john. A strange fish! Were I in England now, as once I was, and had but this fish painted, not a holiday fool there but would give a piece of silver.
১.৫ Thou shalt be free
As mountain winds: but then exactly do
All points of my command.
Tags: উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সুমিত বর্ধন
খনিজ সম্পদের প্রতি কর্পোরেট দুনিয়ার দুর্নিবার লোভ, প্রান্তিক মানুষকে শোষণ ও নিপীড়ন, অর্থ ও ক্ষমতার দ্বারা মেধা ও বিঞ্জানী মননকে দাসে পরিণত করার কাহিনী নিপুণ ভাবে উঠে এসেছে আপনার লেখনীতে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় সেই চিরন্তন ভালোবাসায় ও মনুষ্যত্বের জাগরণে। ধন্যবাদ।