নোবেল দিলেন ঘনাদা
লেখক: রুদ্র দেব বর্মন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
১
কলকাতা শহরের দক্ষিণে একটি কৃত্রিম জলাশয় আছে, করুণ রসিকতার সঙ্গে আমরা যাকে হ্রদ বলে অভিহিত করে থাকি। জীবনে যাদের কোনও উদ্দেশ্য নেই অথবা উদ্দেশ্যের একাগ্র অনুসরণে যাঁরা পরিশ্রান্ত, উভয় জাতের সকল বয়সের স্ত্রী-পুরুষ নাগরিক প্রতি সন্ধ্যায় সেই জলাশয়ের চারিধারে এসে নিজের নিজের রুচিমাফিক স্বাস্থ্য অর্থ কাম মোক্ষ এই নব্য চতুর্বর্গের সাধনায় একা-একা বা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় বা বসে থাকে।
এই জলাশয়ের দক্ষিণপাড়ে জলের কাছাকাছি এক-একটি নাতিবৃহৎ পর্কটি বৃক্ষকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বৃত্তাকার আসন পরিশ্রান্ত বা দুর্বল পথিক ও নিসর্গদৃশ্য-বিলাসীদের জন্য পাতা আছে।
ভালো করে লক্ষ করলে এমনই একটি বৃত্তাকার আসনে আবহাওয়া অনুকূল হলে প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় পাঁচটি প্রাণীকে একত্র দেখা যাবে। তাঁদের একজনের শিরোশোভা কাশের মতো শুভ্র, একজনের মস্তক মর্মরের মতো মসৃণ, একজনের উদর কুম্ভের মতো স্ফীত, একজন মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল আর একজন উষ্ট্রের মতো শীর্ণ ও সামঞ্জস্যহীন। প্রতি সন্ধ্যায় এই পাঁচজনের মধ্যে অন্তত চারজন এই বিশ্রাম-আসনে এসে সমবেত হন এবং আকাশের আলো নির্বাপিত হয়ে জলাশয়ের চারিপার্শ্বের আলো জ্বলে ওঠার পর ফেরিওয়ালাদের ডাক বিরল না হওয়া অবধি, স্বাস্থ্য থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও বাজার-দর থেকে বেদান্ত দর্শন পর্যন্ত যাবতীয় তত্ত্ব আলোচনা করে থাকেন।
ঘনশ্যামবাবুকে এ-সভার প্রাণ বলা যেতে পারে, প্রাণান্তও অবশ্য তিনিই। এ-আসর কবে থেকে যে তিনি অলংকৃত করেছেন ঠিক জানা নেই, তবে তাঁর আবির্ভাবের পর থেকে এ-আসরের প্রকৃতি ও সুর একেবারে বদলে গেছে। কারণ সকল বিষয়ে শেষ কথা তিনিই বলে থাকেন এবং তার কথা যখন শেষ হয় তখন আর কারো কিছু বলবার থাকে না।
গ্রীষ্ম চলে গিয়ে বর্ষা সবে ঢুকেছে। পনেরোই জুন কেরালায় মৌসুমি বায়ু ঢুকে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই পূর্ব প্রান্তেও এবার বর্ষা শুরু হয়েছে। গত চৈত্র-বৈশাখে কালবৈশাখীর তেমন দেখা না পাওয়া গেলেও এই বর্ষার শুরুতেই গোলদারবাবুর ভবিষ্যৎবাণীগুলোকে যথাসম্ভব ওলটপালট করে দিতেই যেন ঝড় আর বৃষ্টি তাদের যৌথ প্রচণ্ড তান্ডব এমন চালিয়ে ছিল যে পর্কটি বৃক্ষের নিচের এই আসর বেশ কিছুদিন বন্ধই ছিল বলা চলে। তবে এই গত কয়েকদিন ধরে আবার না বৃষ্টি না ঝড়। আর সেই সঙ্গে একটা প্যাচপেচে গরম। যদিও ঝড়-বৃষ্টি বন্ধ হতেই অবশ্য এই বৈকালিক আসরে আবার জমায়েত শুরু হয়েছে। আজ এরকমই একটা দিন।
সেদিন নিতান্ত নির্দোষভাবেই আলোচনাটার সূত্রপাত হয়ে ছিল।
সূত্রপাত মর্মর-মসৃণ যাঁর মস্তক সেই শিবপদবাবুকে নিয়ে। ঝড় বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগের কিছুদিন ধরেই এ আসরে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তবে আজ উপস্থিত হয়েছেন, শুধু তাঁর মধ্যে একটা অন্যমনস্কতার হাবভাব সকলের নজরে পড়েছে। আপনাদের নিশ্চিত মনে আছে সেই যে গত বছর ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার কারণে মাথায় কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু তখন কয়েকদিন অনুপস্থিত থাকায় ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক এই শিবপদবাবু কীভাবে তাঁকে পরিহাস করেছিলেন। আজও সেটা হরিসাধনবাবু মনে করে রেখেছেন। আর আজ সুযোগ পেয়েই তাই পালটা দিলেন। “কী মশাই, কোথায় ডুব মেরেছিলেন? গুয়াতেমালায় না গুমখানায়?”
“না, না। কোথাও যাইনি। এই এখানেই ছিলাম!” সেদিনের হরিসাধনবাবুর মতো শিবপদবাবুকেও আজ যেন অস্বাভাবিক কুণ্ঠিত মনে হয়েছে।
“এখানেই ছিলেন! ঝড়-বৃষ্টি তো বেশ কয়েকদিন ধরেই বন্ধ! অসুখবিসুখ করে ছিল নাকি?” মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই ভবতারণবাবুর জিজ্ঞাসা।
“না, না, অসুখবিসুখ কিছু নয়” শিবপদবাবুকে আরও বেশি লজ্জিত মনে হয়।
এবার সভার সকলেই কিঞ্চিৎ বিস্মিত। কোনও অসুখবিসুখ ছাড়াই পঞ্চরত্নের একজন স্বেচ্ছায় এই সান্ধ্য-আসরে অনুপস্থিত! এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
“তাহলে কি আপনিও এবার ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা শুরু করলেন নাকি?” প্রশ্নটা কুম্ভের মতো উদরদেশ যাঁর স্ফীত সেই ভোজনবিলাসী রামশরণবাবুর। প্রশ্নের মধ্যে ঔৎসক্যের চেয়ে পরিহাসের সুরটাই বেশি বলে উপস্থিত সবার মনে হয়েছে।
ভূতপূর্ব ইতিহাসের অধ্যাপক শিবপদবাবু যদি উপন্যাস লেখেন তবে ঐতিহাসিক উপন্যাস তো লিখতেই পারেন। কিন্তু ভোজনবিলাসী কুম্ভের মতো স্ফীতোদর রামশরণবাবুর পরিহাসের কারণ হরিসাধনবাবুকে গত বছরের এই শিবপদবাবুরই করা পরিহাসের উত্তর দেওয়ার জন্যেই করা বলে বোধ হয়েছে সবার।
“আর ইতিহাসের বই লেখা তো খুব সোজা।” নিরীহ নির্বিবাদী ভবতারণবাবুর মন্তব্য করে বসেছেন, “ইতিহাসের একটা সময় ধরো, একজন লড়াকু বীর কাউকে নায়ক বানাও। তারপর অশ্বপৃষ্ঠে তরবারি হস্তে রণভূমিতে পাঠিয়ে দাও – টগবগ টগবগ আর ঠনাৎ ঠং – ব্যাস। সঙ্গে রুপবতী রাজকন্যা বা শাহাজাদী ঘটিত ট্র্যাজিক রোমান্স জুড়িতে পারলে তো সোনায় সোহাগা!”
“ইদানিং ঐতিহাসিক উপন্যাসের কাটতিও ভালোই হচ্ছে।” আরেকজন উৎসাহ দিয়েছেন।
“আমি যা লিখছি তার কিন্তু কাটতি বাংলায় তেমন নেই। ইংরেজিতে লিখতে পারলে অবশ্য অন্য কথা হত!” শিবপদবাবু তাঁর দুঃখের কথা কিন্তু বেশ উৎসাহভরেই জানিয়েছেন।
“কী লিখছেন কী তাই শুনি না!” এবার প্রশ্নকর্তা স্বয়ং ঘনশ্যামবাবুই।
“সায়েন্স ফিকশন, মানে এই কল্পবিজ্ঞান আর কি!”
সকলেই স্তম্ভিত ও নীরব।
শিবপদবাবু সকলের বিস্মিত বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করেছেন।
“সেই যে সেদিন কৃত্রিম উপগ্রহ আর্যভট্টের উড়ান নিয়ে কথা হচ্ছিল না? এই তো, বোধহয় গত এপ্রিলের মাঝামাঝি, সম্ভবত উনিশ বা কুড়ি তারিখ হবে। সেদিন আমাদের আর্যভট্ট উপগ্রহ পাঠানো নিয়ে হরিসাধনবাবু বলেছিলেন না যে ভারী তো কৃত্রিম উপগ্রহ তাও যদি রকেটটা অন্তত নিজেদের হত, সেই তো রাশিয়ানদের হাত ধরে ওড়া! ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর আফসোস করলেন কবে যে আমরা চাঁদে মানুষ পাঠাতে পারব! সেদিন থেকেই এই সব নিয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছিলাম। তাই করতে গিয়েই কেমন যেন নেশা চেপে গেল। বাস্তবে কবে চাঁদে যাব তা এখনও যদিও বুঝতে পারিনি, তবে আমার উপন্যাসে আমি নায়িকাকে চাঁদে হাঁটিয়েই ছাড়লাম!” বলতে বলতে নিজের বক্তৃতাই শিবপদবাবুকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছে।
ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠে তিনি বলে চললেন, “হলফ করে বলছি আপনাদের কল্পবিজ্ঞানের মতো সুখ আর অন্য কিছু লিখে নেই। আপনি চাইলেই আপনার নায়ককে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে পাঠিয়ে দিতে পারবেন। জুতোর তলায় জেট লাগিয়ে বিনা এরোপ্লেনে চেপে আফ্রিকা বা অ্যান্টার্কটিকা থেকে ঘুরিয়ে আনতে পারবেন। এই তো আমার নায়ক আর নায়িকা নিজেদের মধ্যে একটা যন্ত্র দিয়ে দুটো ভিন্ন মহাদেশ থেকে চলতে ফিরতে সারাক্ষণ কথা বলে চলেছে। আমি যন্ত্রটার নাম দিয়েছি ‘চলোযোগ’। কেমন দারুণ না?”
কপালে চোখ তুলে ধরা-গলায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ভবতারণবাবু, “দূর! কলকাতা থেকে হাওড়ায় চিঠি পৌঁছতেই সাত দিনের বেশি লেগে যাচ্ছে, তো ‘চলোযোগ’! মশাই, ভাবনার একটা সীমানা থাকা উচিত। কল্প হলেও বিজ্ঞান বলেই তো বলছেন না কি! এর চেয়ে জলযোগ নিয়ে লিখলেই পারতেন!”
শিবপদবাবুকে এবার নিজেকে নিজের হয়ে ওকালতি করতে হয়েছে। “কী বলছেন কি? জানেন ক-দিন আগেই সাগান সাহেব কী বলেছেন? সামহোয়্যার, সামথিং ইনক্রেডিবল ইজ ওয়েটিং টু বি নোন। শুধু আমাদের জানতে পেতেই যা দেরি।”
“ও সব পুরোটাই ফরেনের ব্যাপারস্যাপার মশাই। সেই কোন ঊনসত্তরে আমেরিকানরা চাঁদের মাটিতে পা রেখে ফেলেছে। আর আমাদের আর্যভট্ট এই পঁচাত্তরে সবে মহাকাশে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। চাঁদ তো এখনও বহুদূর।” নিরীহ নির্বিবাদী ভবতারণবাবুর এটা হতাশা না আত্মসমালোচনা তা বোঝার আগেই—
“আকৃষ্টিশক্তিশ্চ মহীতয়া যৎ স্বস্থং গুরুং স্বাভিমুখং স্বশক্ত্যা। / আকৃষতে তৎ পততীব ভাতি সমে / সমন্তাৎ ক পতত্বিয়ং খে।।”
কেউ আর কিছু বলে ওঠার আগেই আবার—
“সবিতা যন্ত্রৈঃ পৃথিবীমরামদক্ষম্ভলে সবিতা দ্যমদৃংহত্। / অশ্বমিবাদুক্ষদ ধুনিম অন্তরীক্ষ মতুর্তে বদ্ধং সবিতা সমুদ্র।।”
তারপর আবার—
“আ কৃষ্ণেণ রজসা বর্তমানো নিবেশ্যম্নমৃতং মর্ত্যং চ। / হিরণ্যেন সবিতা রথেনা দেবো যাতি ভুবনানি পশ্যান।।”
ঘনশ্যামবাবু এবার থামলেন। বোধহয় একটু দম নিয়ে নিতে।
পঞ্চরত্নের চার রত্ন এতক্ষণে সুযোগ পেয়েই একসঙ্গে বলে ওঠেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান। মানে কী এই সব সংস্কৃত মন্ত্রের?”
ঘনশ্যামবাবু নির্বিকার। শুধু বললেন, “যজুর্বেদ আর ঋগ্বেদ। শ্লোক নম্বরগুলো বলতে হবে?”
চারজনেই একসঙ্গে তড়িঘড়ি, “না, না। নম্বর চাই না। কিন্তু মানে কী এই সবের?”
“বুঝলেন না তো! আচ্ছা এটা দেখুন তো— এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে এবং এই আকর্ষণ বলের মান বস্তু কণাদ্বয়ের ভরের গুনফলের সমানুপাতিক, এদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক এবং এই বল বস্তুদ্বয়ের কেন্দ্র সংযোজক সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে। এটা মনে পড়ছে?”
চার রত্নেরই কণ্ঠস্বর আবার একসঙ্গে বেজে ওঠে। “হ্যাঁ। এটা তো নিউটনের অভিকর্ষের সূত্র!”
সকলের দিকে চেয়ে একটু অনুকম্পার হাসি হেসে ঘনশ্যামবাবু বলেছেন, “সেটাই তো কথা। নিউটন সাহেব অভিকর্ষের কথা বলেছেন সেটা আপনারদের জানা আছে। আর আমাদের মুনিঋষিরা যে বহুকাল আগেই এই অভিকর্ষের কথা বলে গিয়েছেন তো আপনারা আর সে-কথা জানবেন কী করে?”
আহত অভিমানে স্ফীতোদর রামশরণবাবু কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আর সকলের চোখের ইশারায় নিজেকে তিনি সামলে নিলেন। ঘমশ্যামবাবুর এই উক্তি নিঃশব্দে হজম করে উৎসুকভাবে সকলে তাঁর দিকে তাকালেন।
ঘনশ্যামবাবুর কথার প্রতিবাদ পারতপক্ষে কেউ আজকাল করেন না। কেন যে করেন না তা যারা ঘনশ্যামবাবুর প্রকৃত পরিচয় আর এই বিশেষ আসরটি সম্পর্কে একটু হলেও জানেন তাঁদের আর নতুন করে কিছু বলে দেওয়ার দরকার মনে হয় না আছে।
অবশ্য যারা জানেন না তাদের জন্য একটু বোধহয় না বললেই নয়। ধরুন ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ তিনি আজকাল আর ইতিহাসের কোনও বিষয় নিয়ে কোনও কথাই তুলতে চান না। হয়তো কখনও হুমায়ুনের বিষয়ে কিছু একটা বলেছেন অমনি ঘনশ্যামবাবুর কোনও এক তস্য তস্য পূর্বপুরুষের কথা জানা যাবে যাঁর কথামতো সেই লাইব্রেরি ঘরে চড়ার সিঁড়িটা সারাই না করানোতেই নাকি ওই অতবড় ভয়ংকর দুর্ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল।
কুম্ভের মতো উদরদেশ যাঁর স্ফীত সেই রামশরণবাবু আগেকার মতো তাঁর ভোজন-বিলাসের কাহিনি নির্বিঘ্নে সবিস্তারে বলার সুযোগ পান না, ঘনশ্যামবাবু তার মধ্যে ফোড়ন কেটে সমস্ত রস পালটে দেন।
রামশরণবাবু হয়তো সবে আনারসের চাটনির কথা তুলেছেন, ঘনশ্যামবাবু তারই মধ্যে পর্তুগীজ আনানস থেকে কীভাবে অতিরিক্ত রসের জন্য নামটা আনারস হয়ে গেল অথবা বর্ধমানের রাজা মহতাব চাঁদ কোন তস্য তস্যের প্রভাবে বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কার ভট্টাচার্যকে দিয়ে ‘পাক রাজেশ্বর’ লেখালেন তার কাহিনি এনে ফেলে সমস্ত প্রসঙ্গটার মোড় ঘুরিয়ে দেন।
আসল কথা এই যে, সব বিষয়ে শেষ কথা ঘনশ্যামবাবু বলে থাকেন। তাঁর কথা যখন শেষ হয় তখন আর কিছু বলবার সুযোগ কারও থাকে না। তাঁর ওপর টেক্কা দিয়ে কারও কিছু বলাও কঠিন। কথায় কথায় এমন সব অশ্রুতপূর্ব উল্লেখ ও উদ্ধৃতি তিনি করে বসেন, নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ পাবার ভয়েই যার প্রতিবাদ করতে কারও সাহসে কুলোয় না।
ভবতারণবাবু একবার কি কুক্ষণে গাড়ি কেনার কথা তোলায় আর গাড়িতে কী কী আরামদায়ক সুবিধা ইত্যাদি থাকার আবশ্যিক প্রয়োজন তাই নিয়ে কথা ওঠায় যেভাবে ঘনশ্যামবাবু হকিং সাহেবের হুইল-চেয়ারের ডিজাইনে তাঁর যোগদান এবং একই নিশ্বাসে টেসলা সাহেবকে তাঁর ভবিষ্যতের চালকহীন ইলেকট্রিক কারের পরামর্শ দানের যা যা ফিরিস্তি ধরিয়ে ছিলেন তাতে ভবতারণবাবু গাড়ি কেনার উচ্চবাচ্চ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
ঘনশ্যামবাবু এই সান্ধ্য-আসরের প্রাণস্বরূপ হলেও তাঁর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু কারো জানা নেই। কলকাতার কোনও এক মেস-এ তিনি থাকেন ও ছেলে-ছোকরাদের মহলে ঘনাদা-রূপে তাঁর অল্পবিস্তর একটা খ্যাতি আছে এইটুকু মাত্র সবাই জানে। শীর্ণ পাকানো চেহারা দেখে তাঁর বয়স অনুমান করা কঠিন আর তাঁর মুখের কথা শুনলে মনে হয় পৃথিবীর এমন কোনও স্থান নেই যেখানে তিনি যাননি, এমন কোনও বিদ্যা নেই যার চর্চা তিনি করেন না। প্রাচীন নালন্দা তক্ষশিলা থেকে অক্সফোর্ড কেমব্রিজ হার্ভার্ড, চিনের প্রাচীন পিপিন থেকে ইউরোপের সালো প্রাগ হিডেলবার্গ লাইপজিগ পর্যন্ত সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলে স্বীকার করতেই হয়। তাঁর পাণ্ডিত্যে যত ভেজালই থাক, তার প্রকাশে যে মুনশিয়ানা আছে এ-কথা মানতেই হবে। তাঁর কথার প্রতিবাদ না করে সবাই আজকাল তাই নীরবে তাতে সায় দিয়ে দেয়।
কোথায় শিবপদবাবুর কল্পবিজ্ঞান লেখার ধরতাই থেকে শুরু করে আলোচনা যখন আর্যভট্ট উপগ্রহ হয়ে বিদেশ আর স্বদেশের মহাকাশ দৌড়ের মোড়ে পৌঁছেছে, এবার বেশ গরমাগরম আলোচনা শুরু হবে, ঠিক তখনই একগাদা অংবংচং দিয়ে শুরু করে তারপর নিউটন আর তাঁর অভিকর্ষের সূত্রের সঙ্গে মুনি-ঋষিদের লড়াইয়ের ময়দানে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে জিভের উদ্যত বিদ্রোহ সবাই কোনওরকমে সামলে নিলেন।
মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল ভবতারণবাবু কোনওরকমে শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার কোনও তস্য তস্য মুনিঋষিও ছিলেন নাকি?”
একটু রহস্যময় ভাবে হেসে ঘনশ্যামবাবু বললেন, “থাকতেই পারেন। তবে আমি যে শ্লোকগুলো বললাম ওগুলো সব বেদেই আছে।”
মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু এবার বুঝি না বলে আর পারলেন না, “ব্যাদে বুঝি সবই আছে?”
এইবার সেই পেটেন্ট নাসিকাধ্বনি শোনা গেল।
সকলে সচকিত হয়ে ঘনশ্যামবাবুর দিকে চেয়ে থাকেন।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বিষাদক্লিষ্ট সুরে বলেছেন, “সাহাদার সঙ্গেও এই নিয়ে একদিন কথা হয়েছিল। ব্যঙ্গ করে হলেও উনি কথাটা কিন্তু খুব ভুল কিছু বলেননি। এই যে আজকাল একদল লোকে বলে যাচ্ছে মহাভারতে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার হয়েছিল বা গণেশের মাথা প্রথম প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ, এগুলো সত্যিই মানা যায় না!”
সবাই নীরব হতভম্ব! ঘনশ্যামবাবু এত সহজে পেনাল্টি মিস করবেন এমনটাতো সাধারণত ঘটে না! প্রাক্তন ইতিহাসের অধ্যাপক, বর্তমানে কল্পবিজ্ঞান লেখক শিবপদবাবু সুযোগ ছাড়তে চাইলেন না। গোলকিপারকে একা পেয়ে সটান ফ্রি-কিক মেরে বসেছেন, “তো এই যে সব অংবংচং দিয়ে যে নিউটনের গ্র্যাভিটেশনাল ল’ বোঝাতে চাইছেন, সেটা তবে কি?”
শিবপদবাবু কথার সুরে হুলটুকু বেঁধানোর সুযোগ ছাড়েন না।
হুলের বদলে ছোবলই বুঝি আসবে এবার ঘনশ্যাম দাসের দিক থেকে।
সবাই যখন সেই ভয়ে সন্ত্রস্ত তখন সকলকে অবাক করে ঘনশ্যাম দাস একটা মিষ্টি হাসি হাসলেন। যদিও শীর্ণ মার্কা মারা হাড় সর্বস্ব মুখে হাসির মিষ্টত্ব ততটা ফুটে উঠল না।
শিবপদবাবুর কথার সুরের হুলটুকু যেন টেরই পাননি এমনভাবে বললেন, “না, ওই সব শ্লোকের মধ্যে কোথাও গ্র্যাভিটেশনাল ল’ নেই। ওটা বের করার কৃতিত্ব নিউটন সাহেবেরই। তবে ওই শ্লোকের মধ্যে রয়েছে অভিকর্ষের নির্যাসটুকু। যদি আমরা ব্যাদে সবই আছে এই ভাবনা না ভেবে সত্যি সত্যি ওই নির্যাসটুকু নিয়ে আরও গবেষণা করতাম তবে হয়তো নিউটনের অনেক আগে আমরাই কেউ ওই গ্র্যাভিটেশনাল ল’-টা লিখে ফেলতাম। সাহাদাকে তো আমি সেটাই বোঝাতে চাইলাম।”
উদর যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত সেই রামশরণবাবু জানতে চাইলেন, “উনি বুঝলেন?”
একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো একটা শব্দ করে ঘনশ্যাম দাস বলেছেন, “না। পুরোপুরি আর বুঝতে চাইলেন কোথায়! তাহলে তো গোটা কয়েক নোবেল এ দেশেই চলে আসত। অন্তত সময় ভ্রমণের উপরেও যদি কিছু কাজ করতেন! বোসদা আর সত্যেনকেও এ ব্যাপারে বলেছিলাম। আরে এটা তো শুধু আমাদের বেদ-পুরাণ বা রামায়ণ মহাভারতের ব্যাপার নয়। এ আমার নিজের অভিজ্ঞতার ব্যাপার। সে কী আর করা যাবে। তবে আমি নিশ্চিত যে তেমন গোলমাল কিছু না হলে দু-হাজার বত্রিশে সময়-ভ্রমণ নিয়ে ফিজিক্সে একটা নোবেল এ দেশে আসছেই।”
২
মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু এবার না বলে আর পারলেন না, “নোবেল আসছেই! আর দু-হাজার বত্রিশেই আসছে! সেটাও আসছে ফিজিক্সে এবং সময় ভ্রমণের ওপর! আপনি কি এবার জ্যোতিষ শাস্ত্র নিয়ে পড়েছেন নাকি?”
“জ্যোতিষ শাস্ত্র এর মধ্যে আসছে কোথা থেকে?” ঘনশ্যাম দাসের কণ্ঠস্বরে বিরক্তির আভাস দেখা গিয়েছে এবার।
তড়িঘড়ি ব্যাপারটা ম্যানেজের চেষ্টা করেছেন মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই ভবতারণবাবু, “না, মানে… ওই দু-হাজার বত্রিশের কথা বললেন কিনা। সে তো এখনও বহুদূরে। এই পঁচাত্তরে বসে অত দূর ভবিষ্যতের ব্যাপারে জ্যোতিষবিদ্যা ছাড়া তো বলা একটু কঠিন কিনা! তাই আর কি।”
এইবার আবার সেই পেটেন্ট নাসিকাধ্বনি শোনা গিয়েছে। “জ্যোতিষবিদ্যা ছাড়াও ভবিষ্যতের ঘটনা জানার আরেকটা উপায় আছে। সেটা আপনাদের জানা আছে কি?”
উদর যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত সেই রামশরণবাবু আমতা আমতা করে বলেই ফেলেছেন, “বর্তমানের বিভিন্ন ঘটনার পর্যালোচনা করে আগামী দিনের একটা আন্দাজ তো করা যেতেই পারে। করাও হয়। কিন্তু স্থির নিশ্চিত করে বলা কি সম্ভব?”
“যায়। যদি আপনি ভবিষ্যতে গিয়ে ঘটনাটা দেখে আসতে পারেন। আপনাকে জ্যোতিষ বিদ্যাও জানতে হবে না বা বর্তমানের পর্যালোচনা করে আন্দাজও লাগাতে হবে না।” ঘনশ্যামবাবু থেমেছেন। এমনভাবে থেমেছেন যেন শেষ কথা বলা হয়ে গিয়েছে। এদিকে বিস্ময় বিহ্বলতায় কারও মুখে যেন আর কথা নেই।
বিহ্বলতার ঘোর ভেঙে মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল ভবতারণবাবু শেষমেশ বলে উঠেছেন, “আপনি বলতে চান যে আপনি নিজে ভবিষ্যতে গিয়ে ঘটনাটা দেখে এলেন? ইয়ে… মানে এ কোনও তস্য তস্য বা ওই জাতীয় কোনও ব্যাপার তাহলে নয়!”
মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু চুপ। কিছু একটা বলতে চেয়ে একবার যেন মুখ খুলতে চাইলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। উদরদেশ যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত সেই রামশরণবাবু কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, “কিন্তু আপনি দু-হাজার বত্রিশে গেলেন কী করে?”
“কেন? সময় ভ্রমণ করে।” শ্রীঘনশ্যাম জবাব দিয়েছেন।
এবার মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবুর কণ্ঠ যেন একটু বেসুরে বেজে উঠেছে। অবিশ্বাস আর বিদ্রূপের রেশটুকু গোপন না করেই তিনি বলেছেন, “আপনি সময় ভ্রমণ করে ভবিষ্যতের দু-হাজার বত্রিশে গেলেন? অথচ বলছেন সময় ভ্রমণ নিয়ে নোবেল আসবে সেই দু-হাজার বত্রিশেই। এ যে রাম জন্মাবার আগেই রামায়ণ লেখা হয়ে গেল! যেটা আসবেই গিয়ে দু-হাজার বত্রিশে, সেটা আপনি এখানে এখন পেলেন কোথায়?”
“সেটাই তো বলছি।” ঘনশ্যাম দাস অবোধকে যেন বোঝাতে বসেছেন, “প্রথম কথা সময় ভ্রমণ আমাদের দেশে কোনও নতুন কথা নয়। বেদ পুরাণ তো ছেড়েই দিন মহাভারতেও সময় ভ্রমণের প্রমাণ আছে। আর দ্বিতীয় কথা যারা দু-হাজার বত্রিশে সময় ভ্রমণ যন্ত্র আবিষ্কার করবে তারা তো অতীতে এসে শুধু আমার সঙ্গে কেন চাইলে আপনাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারে। হ্যাঁ, যদি অবশ্য তারা আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন অনুভব করে!”
উপস্থিত সকলের ঘূর্ণ্যমান মাথা স্থির করতে বেশ একটু সময় লেগে গিয়েছে। মাথার কেশ যার কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবুই প্রথম একটু সামলে উঠে দু-বার ঢোক গিলে, তাঁর বিমূঢ় বিহ্বলতাকে ভাষা দিয়েছেন, “মহাভারতে আবার কে সময় ভ্রমণ করেছিল? আর কে বা কারা দু-হাজার বত্রিশ থেকে এসে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করল? কেনই বা করল?”
“পারবেন। সবই জানতে পারবেন।” দাসমশাই এবার একটু গুছিয়ে বসলেন বলে মনে হয়েছে। কলকাতা শহরের দক্ষিণের লেকের কিনারায় এই বিশেষ পর্কুটি বৃক্ষের নিচের আসরের বাকি চার রত্নই শ্রী ঘনশ্যাম দাসের এই গুছিয়ে বসার হাল-হকিকত সম্পর্কে রীতিমতো ওয়াকিবহাল। এর ওপরে ইতিমধ্যেই সেই প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতের আর কোনও এক ভবিষ্যতের দু-হাজার বত্রিশের নোবেল প্রাপ্তির আভাস এসে গিয়েছে। সূর্য ওদিকে গঙ্গার পশ্চিমে অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সন্ধ্যার স্নিগ্ধ হাওয়া লেকের বুকের ওপর থেকে একটা শীতলতার আমেজ এনে সারাদিনের গুমোট ভাবটা কাটিয়ে দিতে শুরু করেছে।
আগের কথার রেশ ধরেই যেন ঘনশ্যামবাবু শুরু করেছেন, “আমি জানালেই জানতে পারবেন। কিন্তু তার জন্যে ধৈর্য্য ধরে একটু অপেক্ষা করতে হবে। সেই কোন অতীতে সত্যযুগের কুশস্থলী নামের এক সমৃদ্ধশালী রাজ্য থেকে সৌরজগৎ ছাড়িয়ে ব্রহ্মলোক হয়ে দ্বাপর যুগের দ্বারকা হয়ে তারপরে ঘুরে আসতে হবে এই কলকাতা শহরে। তাও আজকের সময়ে নয়— একবার পিছিয়ে যাবো যখন কলকাতা শহর তার শৈশবে হামাগুড়ি দিচ্ছে, তারপর আবার এগিয়ে যাবো দু-হাজার বত্রিশের কলকাতায়, যা এই শ্রী ঘনশ্যাম দাস ব্যতীত আর কেউ এখনও স্বচক্ষে দেখেনি। কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাসদেবের লিখিত তথ্য থেকে কমলাকান্তের দপ্তর হয়ে এই শ্রীঘনশ্যাম দাসের চাক্ষুষ ধারাবিবরণী পুরোটা শোনা পর্যন্ত আপনাদের ধৈর্য্য রাখতে হবে। আর তারপরেই আপনারাও জানতে পারবেন কবে এবং কীভাবে নোবেল আবার এই বঙ্গদেশে আসতে চলেছে। তাই—”
দাসমশাইকে থামতে হয়। বাধাটা এলো মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবুর কাছ থেকে। “দাঁড়ান, দাঁড়ান। এর মধ্যে আবার কমলাকান্তের দপ্তর আসছে কোথা থেকে জানতে পারি কি?”
“পারেন বইকী!” দাসমশাইকে যেন খানিক অনুকম্পা ভরেই বললেন, “কমলাকান্তের দপ্তর না থাকলে অনিলিখারা নিউ দিল্লীর চাঁদনীচক মার্কেটের পাশে ছোটি মসজিদের বাঁ-হাতের রাস্তার দু-দিক ভরা ঘিঞ্জি দোকানপাটের ভেতরে প্রায় লুকিয়ে থাকা রহমত মিঞার পুরোনো অ্যান্টিকের দোকানে ওই দপ্তরখানার খেরোর খাতার ছেড়া পাতাটা খুঁজে পেত না। আর না পেলে আঠেরোশো সাতষট্টির লেতস্ সন এন্ড কোম্পানি, লন্ডনের ছাপা কলকাতার ম্যাপ জোগাড় করে ওদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হত না। আর তা যদি না হত তবে ওই আঠেরোশো সাতষট্টির সেপ্টেম্বরে মিসেস পেগীর বেকারি শপে অনিলিখাকে খুনে হারানচন্দ্রের পাল্লায় পড়তে হত না। সেক্ষেত্রে আবার বিশু আর সীতেকে বাহাত্তর নম্বর বনমালী রোডে আমার খোঁজেও আসতে হত না। আর ওরা না এলে আমাকেও আর দু-হাজার বত্রিশের কলকাতার চেহারা দেখতে যেতে হত না। তবে আমি গিয়েছিলাম বলেই কমলাকান্ত ওই দু-হাজার বত্রিশেও কলকাতায় বসে ওঁর খেরোর খাতার পাতায় লিখে যেতে পেরেছেন।”
দাসমশাই থামতেই হরিসাধনবাবু তাঁর সন্দিগ্ধ বিস্ময় জ্ঞাপন করেছেন, “বলেন কী! সেই ‘কমলাকান্তের দপ্তরের’ কমলাকান্ত চক্রবর্তী মহাশয় দু-হাজার বত্রিশে বসে খেরোর খাতায় লিখে চলেছেন! ওঁর তখন বয়স কত হতে পারে তার আন্দাজ আছে?”
“বয়স তো শুধুই সময় রেখার উপর কয়েকটা দাগ!” ধৈর্য্য ধরে বোঝাতে থাকেন ঘনশ্যাম দাস, “টাইম ওয়ার্প বা সময় বিকৃতির ব্যাপারটা একটু বোঝার আছে। এর সঙ্গে টাইম ডায়লেশন জিনিসটাও আবার জুড়ে আছে। তার আগে ওয়ার্ম হোলের কথা ব্যাখ্যা করা দরকার। তবে সেটা সাধারণত স্থান-ভিত্তিক হয়। কালভিত্তিক নয়। ধরুন একটা পোকা একটা আপেলের একদিক থেকে খেতে খেতে সরাসরি উলটোদিকে বেরিয়ে গেল। এবার ওই আপেলটার একদিক থেকে অন্য দিকে যাওয়ার জন্য একটা পিঁপড়ের সামনে দুটো রাস্তা থাকবে। পোকায় খাওয়া ফুটোটা খুঁজে পেলে খুব সহজেই এপার থেকে ওপারে পৌঁছে যাবে। মানে অনেক কম সময়ে অনেকটা বেশি পথ পেরোতে পারবে। তো, এটা হল স্থানিক-মাত্রার ব্যপার। সময়-মাত্রার ব্যাপারটা অন্যরকম।”
লেকের আসরের সবার একেবারে চক্ষুস্থির। শুধু চক্ষুস্থির বললে অনেকটাই কমিয়ে বলা হয়। বলা যায় স্তম্ভিত এবং মস্তকের চরকি-পাক। মর্মর-মসৃণ শিরোদেশের শিবপদবাবুই প্রথম বোধহয় চরকি-পাক থেকে মাথাটি স্থির করতে পেরে জিহ্বা সঞ্চালনে সক্ষম হয়েছেন। বলেছেন, “কিন্তু এই পোকায় খাওয়া ফুটোর সঙ্গে কমলাকান্তের বয়সের কী সম্পর্ক? মানে উনি কি ওইরকম কোনও ফুটো দিয়ে উনিশ শতক থেকে একুশ শতকে পৌঁছে গিয়েছেন? তাই বয়েস বাড়তে পায়নি?”
শিবপদবাবুর গলার সুরে ঠাট্টার খোঁচাটা আগের চেয়েও একটু বেশি তীক্ষ্ণ।
তা তীক্ষ্ণ হওয়ার আর দোষ কী!
কোথায় কথা হচ্ছিল তাঁর সায়েন্স ফিকশন লেখা নিয়ে, সেখান থেকে হঠাৎ অং বং চং দিয়ে শুরু করে নোবেল আর কমলাকান্ত কাকে কাকে টেনে এনে এখন আবার যদি কোনও সময়-ফুটো নিয়ে কথা চলে তো কার মেজাজ আর ঠিক থাকে!
“ফুটোই, তবে একটু অন্য রকমের,” দাসমশাই নিজের সংক্ষিপ্ত উক্তি বিস্তারিত করলেন, “বিজ্ঞান বলে যে সময়ের গতি একমুখী— গতকাল থেকে আজ হয়ে আগামীকাল। উলটোটার কোনও তাত্ত্বিক প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। সময় যেন একটা তির-ধনুকের জ্যা-থেকে বেরিয়ে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এবার যদি প্রয়োজনীয় শক্তির নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগে সেই সময়ের তিরটাকে বেঁকিয়ে বা ভাঁজ করে ফেলা যায় তো কী হবে?”
মেদভারে যিনি হস্তীর মতো বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবু যেন দাসমশাই-এর কথা শেষ হবার জন্যে মুখ বাড়িয়ে ছিলেন। দাসমশাই থামতেই তিনি নিজেই যেন ধন্য হবার ব্যাকুল উৎসাহে গদগদ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হবে?”
“সময়ের একটা ভাঁজ থেকে আরেকটা ভাঁজে একলাফে সহজেই পৌঁছে যেতে পারবেন। যেমন ধরুন একটা রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছতে আপনার এক বছর সময় লাগে। আর শিবপদবাবু সেটা একটা লাফ মেরে এক সেকেন্ডে পৌঁছে গেলেন। তো যে রাস্তাটা পেরোতে আপনার বয়স এক বছর বেড়ে গেল সেই রাস্তায় শিবপদবাবুর বয়স বাড়ল এক সেকেন্ড। কুশস্থলীর রাজকন্যা রেবতীর গল্পটা শিবপদবাবুর নিশ্চয়ই জানা আছে?”
প্রশ্নটা দাসমশাই যে সুরে ছুড়ে মেরেছেন শিবপদবাবুর দিকে তাতে লেকের আসরের বাকি কারোরই বুঝতে অসুবিধা হল না যে আজ দাসমশাই ইতিহাসের অধ্যাপকের উপর রীতিমতো ক্ষেপেছেন।
শিবপদবাবুরও সেটা বুঝতে একটুও দেরি হয় না। কিন্তু এইমাত্র সময়-লম্ফন থেকে লাফ মেরে কুশস্থলীর রাজকন্যার সন্ধান করাটা তাঁর পক্ষে একটু বেশিই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমতা আমতা করে শুধু বলে উঠতে পেরেছেন, “ইয়ে, কুশস্থলীর কোন রেবতীর কথা বলছেন?”
“কুশস্থলীর ক-জন রেবতীর কথা ইতিহাসে আছে?” করুণাভরে সংশোধন করে দিয়েছেন দাসমশাই, “বলছি মহাভারতটা পড়া আছে তো, নাকি? সত্যযুগে কুশস্থলীর মহারাজ রৈবতের কন্যা রেবতীর কথাই বলছি। সকন্যা মহারাজের ব্রহ্মলোক যাত্রার কথা জানেন কিছু?”
মর্মর-মসৃণ শিরোদেশের শিবপদবাবু এবার একটু আমতা আমতা করেছেন। “শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরামের এক স্ত্রীর নাম রেবতী ছিল বলে তো জানি। তবে তিনি কবে ব্রহ্মলোকে গিয়েছিলেন সেটা ঠিক মনে পড়ছে না।”
দাসমশাই এবার যেন অবোধের প্রতি করুণার হাসি হেসে বলেছেন, “সেটা না জানলে তো উনবিংশ শতাব্দী থেকে গিয়ে কীভাবে একবিংশ শতাব্দীতে কমলাকান্ত তাঁর দপ্তরখানা চালাচ্ছেন, কিংবা কেনই বা আমি স্থির নিশ্চিত যে দু-হাজার বত্রিশে এই কলকাতায় আরেকটা নোবেল আসতে চলেছে তা তো পরিষ্কার হবে না।”
উপস্থিত সকলের ঘূর্ণমান মাথা স্থির করতে একটু সময় লেগেছে। মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবুই প্রথম একটু সামলে উঠে, দু-বার ঢোক গিলে, তাঁর বিমূঢ় বিহ্বলতাকে ভাষা দিয়েছেন, “মানে আপনি বলতে চাইছেন রেবতী যেভাবে ব্রহ্মলোকে গিয়েছিল সেভাবেই কমলাকান্ত দু-হাজার বত্রিশে পৌঁছে গিয়েছে? কিন্তু তার সঙ্গে কলকাতার নোবেল প্রাপ্তির সম্পর্ক কী?”
“সম্পর্ক আছে বইকি,” ঘনশ্যাম দাস যেন সকলের মূঢ়তা ক্ষমার চক্ষে দেখে বলেছেন, “আর সেটা বুঝতে গেলে আপনাদের আগে জানতে হবে সেই সত্যযুগের কুশস্থলীর রাজকন্যা কীভাবে দ্বাপরযুগের বলরামের স্ত্রী হতে পারলেন ও তার সঙ্গে ব্রহ্মলোক যাত্রার কী সম্পর্ক আর সেভাবে যদি কমলাকান্ত দু-হাজার বত্রিশে যেতে পারেন তো কেনইবা কলকাতার আরেকটা নোবেল পাওয়া শুধুই এখন সময়ের অপেক্ষা।”
মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু নিজের কোর্টেও কেঁচো হয়ে থাকতে হওয়ায় এতক্ষণ বোধহয় মনে মনে গজরাচ্ছিলেন। এবার ভুরু কপালে তুলে একটু ঝাঁঝাল গলাতেই জিজ্ঞাসা করেছেন, “পুরাণ-মহাভারতের গল্পকথা দিয়ে কমলাকান্ত উনবিংশ থেকে একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে গিয়ে কলকাতাকে নোবেল এনে দিচ্ছেন?”
শিবপদবাবু যেভাবে প্রশ্নটা করলেন, তাতে ‘গঞ্জিকা পরিবেশনের আর জায়গা পেলেন না!’ – কথাটা খুব যেন উহ্য রইল না।
দাসমশাই তবু যেন অবোধের প্রতি করুণার হাসি হেসে বলেছেন, “না জানলে একটু আজগুবিই লাগে অবশ্য। তবে শুনুন, সেই সত্যযুগে রৈবত নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর রাজ্যের নাম ছিল কুশস্থলি। মহারাজ রৈবতের রেবতী নামের এক সুন্দরী রাজকন্যা ছিল। রেবতী যে শুধু রূপেই শ্রেষ্ঠ ছিল তা নয় বরং বলা চলে বিভিন্ন গুণাবলীর বিষয়ে কোনও দিক থেকেই তাঁর কোনও প্রতিদ্বন্দী ছিল না। মহারাজ রৈবত তাঁর সেই গুণবতী ও রূপবতী মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত মহারাজ রৈবত অন্য আর কোনও উপায় না দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রহ্মার সঙ্গে দেখা করার। দেবগুরু ব্রহ্মা নিশ্চয় কোনও না কোনও উপায় বলে দেবেন। তাই তিনি রাজকন্যা রেবতীকে নিয়ে ব্রহ্মলোকে রওনা হলেন। কিন্তু ব্রহ্মলোকে পৌঁছে দেখলেন ব্রহ্মা তখন গান্ধর্বদের সঙ্গীত শুনতে ব্যস্ত। অনোন্যপায় তিনি বাধ্য হয়ে সঙ্গীত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলেন। সঙ্গীত শেষ হবার পর মহারাজ যখন ব্রহ্মাকে ব্রহ্মলোকে আসার সব কথা খুলে বললেন তখন ব্রহ্মা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। ব্রহ্মা বললেন, হে রাজা, তুমি ও তোমার কন্যা যখন সঙ্গীত শুনছিলে, এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে কেটে গেছে শত সহস্র বছর। তোমার যুগের রাজপুত্রেরা তো গত হয়েছেই, এমনকি তাদের পুত্র-প্রপৌত্র এবং তস্য তস্য পুত্ররাও গত হয়েছে কয়েক সহস্র বছর আগেই। একথা শুনে মহারাজ রৈবত তো অবাক হয়ে গেলেন। তিনি এখানে বসে মাত্র গোটা কয়েক সঙ্গীত শুনলেন আর এর মধ্যেই কয়েক সহস্র বছর কী করে কেটে যেতে পারে! হতভম্ব রৈবতের মনের এই অবস্থা দেখে ব্রহ্মা ব্যাখ্যা করে বোঝালেন, মহাবিশ্বে বিভিন্ন স্থানে সময়ের গতি ভিন্ন। পৃথিবীতে সময় যে গতিতে বয়ে চলেছে, মহাবিশ্বের সমস্ত স্থানে সময় সেই একই গতিতে চলে না। প্রত্যেক গ্রহ নক্ষত্রের সময়ের গতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর ব্রহ্মলোকের কয়েক মুহূর্তে পৃথিবীর সহস্র বছর পার হয়ে যায়। ইতিমধ্যে পৃথিবীতে ত্রেতা যুগ শেষ হয়ে এখন দ্বাপর যুগে শেষ পর্যায় চলছে। মহারাজ রৈবত ও তার কন্যা রেবতী যখন পৃথিবীতে ফিরে এলেন তখন সত্যি সত্যিই দেখলেন যে পৃথিবীতে সত্য যুগ ও ত্রেতা যুগ পার হয়ে দ্বাপর যুগের শেষভাগ চলছে। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছে। পরে ব্রহ্মার কথামতো রাজা রৈবত তাঁর কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরামের সঙ্গে।”
একটানা বলে শ্রীঘনশ্যাম দাস একটু থামতেই সেই সুযোগে মর্মরের মতো মসৃণ যাঁর মস্তিষ্ক সেই শিবপদবাবু ঈষৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞাসা করেছেন, “একদিকে কয়েকটা গান শুনতে শুনতেই কয়েক সহস্র বছর পেরিয়ে গেল। আরেকদিকে আপনি ভবিষ্যতে গিয়ে দেখে এলেন যে কলকাতায় নোবেল চলে এসেছে!”
“না, ঘনশ্যাম দাস শুধু দেখেই চলে আসেনি। দ্বিতীয় নোবেলটা যাতে কলকাতার বাঙালির হাতে দু-হাজার বত্রিশেই আসে তার জন্য যা যা করার সেগুলোর সব ব্যবস্থা করেই এসেছে।”
উদর যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত সেই ভবতারণবাবু কোনও রকমে বলে উঠতে পেরেছেন, “দু-হাজার বত্রিশে কলকাতার বাঙালির হাতে যাতে নোবেল আসে আপনি তার ব্যবস্থা করে এলেন?”
ইতিমধ্যে পার্কের সমস্ত আলোক স্তম্ভের বিজলী বাতি জ্বলে উঠেছে। প্রাত্যহিক সান্ধ্যভ্রমনেচ্ছুক স্বাস্থ্য-সন্ধানীদের ভিড় এবার কমে এসেছে। একটু আগেই রোজকার চিনাবাদামওয়ালা প্রত্যেককে একটা করে বাদাম ভাজার ঠোঙা ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছে। উষ্ট্রের মতো শীর্ণ ও সামঞ্জস্যহীন চেহারার ঘনশ্যামবাবু খোলা ভেঙে বাদামের কোয়া মুখে ফেলে চিবোতে চিবোতে বলেছেন, “হ্যাঁ, এলাম। যদিও যাওয়ার উদ্দেশ্য সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে সেটা শুরুতে নোবেল বিষয়ে ছিল না। গিয়েছিলাম কারণ আমি না গেলে অনিলিখাকে সেই আঠেরোশো সাতষট্টিতেই মরতে হচ্ছিল আর সেটা হলে বিশুর পক্ষে তা সহ্য করা মুশকিল হত। ও, বিশু-কে তো আপনারা আবার চিনবেন না। শিবুকে চেনেন তো? বিশু আমাদের শিবুর-ই নাতি। ওই একপ্রকার ধরে বেঁধে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল বলতে পারেন। তবে আমাকে বিশেষ কিছু করতে হয়নি, শুধু একটা অঙ্কের হিসেব মিলিয়ে দেওয়া ছাড়া। আর তাতেই বাকি সব কিছু। অনিলিখাকে তো ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া গেলই, সেই সঙ্গে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কমলাকান্ত চক্রবর্তী মশায়-ও বেঁচে গেলেন। আর অনিলিখাকে বাঁচানো গেল বলেই দু-হাজার বত্রিশের নোবেলটা নিশ্চিত হয়ে গেল।”
৩
দাসমশাই এবার একটু থামতেই মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু একটু যেন বাঁকা হাসির সঙ্গে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শ্রীঘনশ্যাম দাস সে-সুযোগ তাকে দিলেন না।
শিবপদবাবুর মুখের হাসিটা বাঁকা থেকে সোজা করে একেবারে বিমূঢ়তায় পৌঁছে দিয়ে দাসমশাই বলেছেন, “আপনি যা বলতে চাইছেন, তা জানি। রেবতীর ব্রহ্মলোক যাত্রা বা বলরাম-রেবতীর বিবাহ কিংবা অনিলিখার অতীতে গিয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা, সেখান থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসবার মধ্যে কমলাকান্তই বা কোথা থেকে আসছেন অথবা এই এত কিছুর সঙ্গে নোবেল প্রাপ্তির নিশ্চয়তাই বা আমি কোথা থেকে পাচ্ছি, তাই তো? এগুলো সব কিছু জানতে হলে আপনাকে আরও কয়েকটা বছর অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না বিশু আর অনিলিখার ওদের রিসার্চ পেপার প্রকাশ করছে। অবিশ্যি তার জন্যে আপনাকে আরও গোটা পঞ্চাশ-ষাট বছর এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হবে। তবে সেই রিসার্চ পেপার প্রকাশিত হলে শুধু যে নোবেল আসবে তা-ই নয়, সেই সঙ্গে আমাদের প্রাচীন বেদ-উপনিষদ নিয়ে-ও যে গোটা পৃথিবীতে শোরগোল পড়ে যাবে সেটাও এখন থেকেই জেনে রাখুন।”
শিবপদবাবুকে নির্বাক করে দিয়ে শ্রীঘনশ্যাম আবার শুরু করেছেন, “তখন আমি পৃথিবীর উচ্চতম শহর যার উচ্চতা ১১,৯৭৫ ফুট সেই লাসা থেকে ১০০ কিলোমিটার মতো দূরে গোবি মরুভূমির প্রাণঘাতী বালির সমুদ্র পেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। যাবো একটা গোপন অভিযানে। এতটাই গোপন সেই অভিযান যে আমি বাহাত্তর নম্বরের কাউকে কোনওরকম আভাস মাত্র না দিয়েই বেরিয়ে পড়েছি। ক-দিন আগেই ইন্টারপোলের রবার্তো পিয়েরঘনি গোপনে জানিয়ে দিয়ে ছিলেন যে আমার উপর সেই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর অন্তত সাত-সাতটা শক্তিধর রাষ্ট্রের তরফে সরকারি নজরদারি চলছে। শুধু ইন্টারপোলই না, কেজিবি, সিআইএ আর মোসাদ-ও বাহাত্তর নম্বরের উপর শ্যেনদৃষ্টি মেলে বসে আছে। প্রত্যেকের নজর তখন আমার প্রতিটি পদক্ষেপে। নটোভিচের প্রপৌত্রী আর তার বর যে আমার সঙ্গে কোনওভাবে যোগাযোগ করেছে সেটা ওই প্র-নাত-জামাইয়ের একটা ছোট্ট বোকামোর জন্যই গোটা দুনিয়ার সামনে ততক্ষণে ফাঁস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেই আমার সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার তা নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। ম্যাক্সমূলারের উপদ্রবে অতীষ্ট হয়ে কিছুটা শান্তিতে বাঁচার জন্য আর কিছুটা আমারই কথাতেই তো নিকোলাস একদিন বিশ্বের বাঘা বাঘা সব রিপোর্টারদের ডেকে জানিয়ে দিয়েছিল যে হেমিস মনাস্টারিতে সে নিজে কোনও দিন যায়নি এবং জিশুর সঙ্গে ভারতের নিবিড় সম্পর্কের কথার পুরোটাই তাঁর মনগড়া গল্প। তখনও পর্যন্ত অবশ্য হাতেনাতে পশ্চিমের ক্রিশ্চান সমাজে দেখানোর মতো কোনও অভেদ্য প্রমাণ নটোভিচ জোগাড় করে উঠতে পারেনি। ব্যাপারটা নটোভিচের জন্য যথেষ্ট অপমানজনক হলেও ওভাবেই তখনকার মতো রোমান হইচই থামানো গিয়েছিল। ঠিক করেছিলাম পরে আমি নিজেই একবার গিয়ে প্রমাণ সংগ্রহ করে নিয়ে আসব। তা সে নটোভিচের অকাল মৃত্যুর কারণে আর অন্যান্য বিভিন্ন জরুরি কাজের চাপে সে ইচ্ছেটা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। যতই হোক জিশু ভারতে এসেছিল না আসেনি তার চেয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা ওই জাতীয় ঘটনা সবসময়ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। তবে এবার নটোভিচের প্রপৌত্রীর অনুরোধ যা আবার সে করেছে তাঁর প্রমাতামহের আত্মার শান্তির উদ্দেশে তা আর আমি ফেলতে পারলাম না। দুনিয়ার তাবড় তাবড় গুপ্তচর সংগঠনের চোখে ধুলো দিয়ে প্রথমে সোজা চলে গেলাম ব্রাজিল, সেখানে আমাজনের বোটহাউসে কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়েই অস্ট্রেলিয়া হয়ে বেইজিং ঘুরে সবে লাসাতে দিনদুয়েক হল তখন পৌঁছেছি। তারপর এদিকে ওদিকে খানিক ঘোরাফেরা করে যেখানে যেখানে যোগাযোগ করার দরকার সেগুলো সেরে তখন অপেক্ষা করছি শেষ গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হওয়ার। রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়ব। ডিনারের পর একটু হাঁটাহাঁটি করে গুরুভোজনের চাপটা একটু কমিয়ে নেবো পরিকল্পনা তেমনই করেছিলাম। ধড়াচূড়ো পড়ে তৈরি হয়ে আছি, তুষারপাতের প্রচণ্ডতা একটু কমলেই ওভারকোটের উপর বর্ষাতিটা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ব ভাবছি, ঘটনাটা ঘটে গেল ঠিক তখনই।
প্রথমে তেমন খেয়াল হয়নি, তবে একটু পরেই অবশ্য বুঝে গেলাম। বাইরে তখনও তুষারপাত হলেও হোটেলের রুমের মধ্যে ফায়ার প্লেসের আগুনের জন্য ঠান্ডাটা একটু আগে পর্যন্ত-ও তেমন বোধ হচ্ছিল না। তাই হঠাৎ করেই যখন রুমের ভেতরে বাতাসের চাপ কমে গিয়ে ঠান্ডা কনকনে ভাবটা বেড়ে গিয়েছিল তখনই বুঝে গিয়েছি কোনও বিশেষ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। ঠিক তারপরেই ছেলে দুটোকে দেখতে পেয়েছি। তবে দেখতে পেয়ে অবশ্য প্রথমেই একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছি। ভুলটা হওয়ার কারণ আর কিছুই না। রুমের বন্ধ দরজার ভেতরে আবির্ভূত মানুষদুটোকে আমি ভেবেছি নিশ্চিত কোনও না কোনও দেশের গুপ্তচর হবে। যদিও মনের একটা কোণে ইলুমিনান্তিদের ওপরেও সন্দেহ বাসা বেঁধেছিল। তাই সঙ্গে সঙ্গে যুযুৎসুর প্যাঁচ মেরে এক ঝটকায় দুটোকে একসঙ্গে চিৎ করে ফেলে ওদের বুকের ওপর উঠে বসে যখন মুখ দুটো দেখেছি তখনই বু্ঝে গিয়েছি যে এরা আর যাই হোক গুপ্তচর হতেই পারে না।
তখন ছেড়ে দিয়ে উলটে ওদের উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছি। ছেলে দুটোর বয়স কুড়ি বাইশের বেশি হবে না। পড়নে আধুনিক শহুরে পোশাক। আকাশি-নীল জিনস আর ক্যাজুয়াল টি-শার্ট। দুজনেরই মুখ দুটো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। ব্রান্ডির বোতল থেকে দু-ঢোক করে খাইয়ে খানিক ধাতস্থ করার পর জেনেছি ওদের একজনের নাম বিশু আর অন্যজন সীতু। বিশেনজিৎ আর সীতাংশুর মধ্যে বিশেনজিৎই প্রথম কথা বলে উঠতে পেরেছে, “ঘনাদা, আমি বিশু। বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনের মেসবাড়িতে আমার ঠাকুরদা আপনার সঙ্গে থাকতেন, ইয়ে মানে, থাকেন। ওঁকে অবশ্য আপনি শিবু নামে চেনেন। আমাদের পারিবারিক পুরোনো জিনিস ঘেটে পাওয়া ওঁর ব্যাক্তিগত একটা ট্রাঙ্কের বেশ কিছু বইপত্র থেকে আপনার সঙ্গে ঠাকুরদার সম্পর্ক সমন্ধে আমি জেনেছিলাম। তাই আজ আর অন্য কোনও উপায় না পেয়ে আপনাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছি। আপনি অনিলিখাকে বাঁচান।”
তাকে শান্ত করার জন্য তখনকার মতো বলেছি, “অত ঘাবড়ানোর কিছু নেই। পুরো ঘটনা আগে খুলে বলো। অনিলিখা কে এবং তাঁর কী হয়েছে যে তাঁকে বাঁচানোর দরকার পড়ছে সেটা তো আগে জানতে হবে।”
পরের ঘণ্টাখানেক ধরে বিশু আর সীতু দুজনে মিলে যে ঘটনা জানিয়েছে তাতে আবার আমাকে জিশুর ভারত-পর্বের রহস্য উদ্ধার মাঝপথে ছেড়ে আবার কলকাতায় ফিরতে হয়েছে। যতই হোক বিশু হচ্ছে আমাদের শিবুর নাতি আর তা ছাড়া এর মধ্যে আবার জুড়ে গিয়েছে আরেকটা নোবেল কলকাতার বাঙালির হাতে তুলে দেওয়ার সম্ভাবনা।”
নটোভিচ আর তাঁর প্রপৌত্রী হয়ে শিবুর নাতির আবির্ভাব ঘটিয়ে নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনা উস্কে দিয়ে শ্রীঘনশ্যাম এবার চুপ করে বাদামভাজা খেতে শুরু করেছেন। খানিক অপেক্ষা করেও যখন ওদিক থেকে বাদামের খোলা ভাঙার আওয়াজ ছাড়া আর অন্য কোনও আওয়াজ পাওয়া গেল না, তখন মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ মস্তিষ্কের সেই প্রাক্তন ইতিহাসের অধ্যাপক এবং বর্তমানে কল্পবিজ্ঞানের নবীন লেখক শিবপদবাবুই বাকিদের প্রতিনিধি হয়েই যেন বলে উঠেছেন, “আপনি সেই লাসা ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন আর অমনি সব ঠিক হয়ে গেল? অনিলিখা না কে একটি মেয়ে যে মারা পড়তে যাচ্ছিল সেও বেঁচে গেল আর কলকাতার বাঙালির হাতে নোবেল আসা নিশ্চিত হয়ে গেল? মানে আপনি কলকাতায় ছিলেন না বলেই এত কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল?”
“না, না। তা কেন হতে যাবে?” দাসমশাই আরও গোটা কয়েক বাদামের দানা মুখে ঢুকিয়ে এবার নিজের বক্তব্য বিস্তারিত করেছেন, “পুরো ব্যাপারটা খুলে বললে আপনাদের হয়তো বুঝতে সুবিধা হবে। আমাদের শিবুর নাতি বিশেনজিৎ ওরফে বিশু হচ্ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের নবীন অধ্যাপক এবং গবেষক। তাঁর গবেষণার বিষয় হচ্ছে ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটারের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে। ওখানে ওর সহকর্মী এবং সহ-গবেষক হচ্ছে অনিলিখা বলে আরেক নবীন অধ্যাপক। ওরা দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনি পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটরের মাধ্যমে অ্যান্টিম্যাটারের বিষয়ে গবেষণা করে। আর সেই করতে গিয়ে অনিলিখার মাথাতেই ব্যাপারটা প্রথম আসে। একসময় ওর মনে হয় যে ম্যাটার এবং অ্যান্টিম্যাটারের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত সংঘর্ষ ঘটিয়ে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হতে পারে সেটা ব্যবহার করে চতুর্থ মাত্রা সময়ের একমুখী গতিকে পরিবর্তন করা যেতে পারে। তখন দুজনে মিলেই এই ধারণার ভিত্তিতে কাজ শুরু করে। তারপর কীভাবে মিনি পার্টিকল অ্যাকসিলারেটরের সাহায্যে অ্যান্টিম্যাটার তৈরি হয় আর তারপর নিজেদের আবিষ্কার করা অন্য আরেকটা যন্ত্রে কীভাবে সেই অ্যান্টিম্যাটারের সঙ্গে ম্যাটারের নিয়ন্ত্রিত সংঘর্ষ ঘটিয়ে সময়ের গতিমুখ পরিবর্তন করাটা ওরা বাস্তব করে তোলে সেটা আরেক লম্বা গল্প। তবে ঘটনা হল এই যে ওই পদ্ধতি ব্যবহার করে ওরা প্রথমে অল্প আর তারপর যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ সময়ের জন্য কখনও অতীতে কখনও ভবিষ্যতে ঘুরে আসায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ঠিক এই সময়ে অনিলিখার হাতে দুটো জিনিস হঠাৎ করেই চলে আসে। সেবার দুজনে একই সঙ্গে গিয়েছিল দিল্লি আইআইটিতে একটা সেমিনারে ‘বিজ্ঞানে ভারতের ভবিষ্যৎ’ নিয়ে একটা পেপার পড়তে। তখনই একদিন দিল্লিতে ঘোরাঘুরি করার সময় ওদের হাতে হঠাৎ করেই চলে আসে পুরোনো কলকাতার একটা মানচিত্র আর সমকালীন কলকাতা আরক্ষাবাহিনীর একটা দস্তাবেজ। সঠিক করে বললে দস্তাবেজের কোনও একটা পাতা। আর সেটাই ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে একসময় ওরা বুঝতে পারে যে আঠেরোশো সাতষট্টি থেকে আঠেরোশো ঊনসত্তরের মধ্যে কলকাতায় ঘটে যাওয়া চুরি-ডাকাতি আর খুনেরই বিভিন্ন ঘটনা তারিখ হিসেবে পর পর তালিকার মতো করে লেখা রয়েছে ওই দস্তাবেজের পাতাটায়। ওটা দেখার পর পুরোনো কলকাতার যে মানচিত্রটা ওরা পেয়েছিল সেটার সঙ্গে মিলিয়ে কলকাতার বর্তমান একটা ম্যাপে ওই সমস্ত ঘটনার অকুস্থলগুলো দাগাতে শুরু করে শুধু এটা বোঝার জন্য যে ঠিক কোন কোন এলাকার মধ্যে ওই ঘটনাগুলো ঘটেছিল। এদিকে ঠিক এই সময়েই এমন একটা কাকতালীয় ঘটনা ওদের সঙ্গে ঘটে যায়, যার জের ধরেই একের পর এক ঘটনা বিপর্যয় ঘটতে থাকে। আরও পরে সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই আমাকে একদিন ওদের পুরো ব্যাপারটার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হবে। শুরুটা হয় সীতাংশু রঞ্জন ঘোষ ওরফে সীতুকে নিয়ে। ও হচ্ছে আবার ওদের দুজনেরই কমন কলেজ ফ্রেন্ড। ওরা যখন কলেজ থেকে পাশ করার পরে ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করছে ততদিনে সীতু তাঁদের পারিবারিক ব্যবসায় ঢুকে গিয়ে পুরো দস্তুর একজন বিজনেসম্যান। মাঝেমধ্যেই সে আড্ডা মারতে চলে আসে, আর এরকম একদিন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে আড্ডা চলছে, সেই সময় কথায় কথায় সীতু হঠাৎই ওদের বংশের একটা গোপন কথা বলে ফেলে। এমনিতে সীতাংশুরা সেই সুতানটির প্রাচীন ঘোষ বংশের সঙ্গে সম্পর্কিত। নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার খাস লোক ছিল ওদেরই কোনও এক পূর্বপুরুষ। বংশপরম্পরায় ওদের মধ্যে নাকি সিরাজউদ্দৌল্লার গুপ্তধনের বিষয়ে একটা গুপ্তকথা চলে আসছে। যেটা ও নাকি নিজেও ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে। পলাশীর যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর মূর্শিদাবাদ ছেড়ে পালাবার সময় নবাব নাকি তাঁর নবাবী খাজানা বিভিন্ন অংশে ভাগ করে তাঁর বিভিন্ন বিশ্বাসী লোকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কথা ছিল ফিরে এসে তিনি বা তাঁর কোনও বংশধর সেই খাজানা দাবি করলে তাঁদেরকে অর্ধেক অংশ ফিরিয়ে দিতে হবে। সীতাংশুর এক পুর্বপুরুষও নাকি সেই নবাবী খাজানার একটা ভালো অংশ লুকিয়ে রাখার দায়িত্ব পেয়ে ছিল। তবে ঘটনা তো তারপর অন্য খাতে বয়ে গেছিল। মীরজাফর পুত্র মীরণের হাতে নবাব তো মোটামুটি সপরিবারে নিহত হলেন। যাঁরা যাঁরা বেঁচে গেল প্রাণ বাঁচাতে তাঁরা কে যে কোন ছদ্মবেশে আর কোন ছদ্মনামে কোথায় গিয়ে লুকিয়ে রইল তার খবর আর কেউ পেল না। এদিকে এক এক করে মীরজাফর মীরকাশেম হয়ে ক্ষমতায় বৃটিশরা যখন এসে পড়লো তখন প্রাণ বাঁচাতে ঘোষ বংশের তৎকালীন কর্তারা সেই নবাবী খাজানার তাঁদের ভাগের অংশটা কোনও এক গুপ্ত স্থানে লুকিয়ে ফেলেন। ঠিক হয়েছিল পুরুষানুক্রমে পরিবারের কর্তা মৃত্যুর আগে জৈষ্ঠ পুত্রকে গুপ্তধনের সন্ধান জানিয়ে দেবে। যদিও ঘোষ বংশে এই জানিয়ে দেওয়ার প্রথাটা-ও খুব বেশি দিন ধরে চলেনি, মানে প্রয়োজন পড়েনি। ১৮৬৭ সালে তৎকালীন কর্তা রামসদয় ঘোষ হঠাৎ করেই মারা যান। মারা যান অর্থে তাঁকে হত্যা করা হয়। হত্যার দায়ে ইংরাজ পুলিশ আবার গ্রেফতার করে রামসদয় ঘোষের নিজেরই জামাতাকে। ওদের বংশের মধ্যেই অবশ্য কানাঘুষো রয়েছে যে সেই মৃত্যুর কারণও নাকি সেই নবাবী গুপ্তধন। আর সেই গল্পের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দিক হচ্ছে ইংরাজ পুলিশের নাকি হত্যার তদন্তের সেরকম কোনও দরকারই হয়নি। ওরা নাকি কোথাও থেকে জানতে পেরে সরাসরি এসে জামাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তবে আসল ব্যাপার হল রামসদয় ঘোষ তাঁর হঠাৎ মৃত্যুর কারণে সেই গুপ্তধনের ঠিকানা জৈষ্ঠপুত্র তো দূরের কথা কাউকেই জানিয়ে যেতে পারেননি। তখন থেকেই ঘোষ বংশে সেই গুপ্তধনের গুপ্তকথার আর কোনও অর্থই বেঁচে নেই। যদিও ভাগ্যক্রমে পরে আর কখনওই সিরাজউদ্দৌল্লার কোনও বংশধর ফিরে এসে সেই খাজানার অংশ দাবিও আর করেনি। আর ওদের বন্ধু সীতাংশু হচ্ছে সেই রামসদয় ঘোষ মহাশয়ের-ই জৈষ্ঠ পুত্রের দিকের তস্য তস্য বংশধর।
সীতাংশুদের পারিবারিক ইতিহাস জেনে অনিলিখা আর বিশু সময় ভ্রমণ নিয়ে বহু পুরোনো একটা প্যারাডক্সের ওপর একটা এক্সপেরিমেন্ট করার পরিকল্পনা করে। অবশ্যই ওদের তৈরি সময় ভ্রমণ যন্ত্রের মাধ্যমে। ওরা ঠিক করে সীতাংশুদের বংশের ওই দূর্ঘটনা নিয়ে গ্র্যান্ড ফাদার প্যারাডক্সের বাস্তবতা যাচাই করে দেখবে।” এই পর্যন্ত বলে শ্রীঘনশ্যাম যেন দম নিয়ে নেওয়ার জন্যেই একটু থেমেছেন। তারপর উষ্ট্রের মতো শীর্ণ ও সামঞ্জস্যহীন মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখে শিবপদবাবুর মর্মরের মতো মসৃণ মস্তকের দিকে যেন কটাক্ষপাত করছেন এমনভাবে জিজ্ঞাসা করেছেন, “কল্পবিজ্ঞান নিয়ে যখন লেখালেখি শুরু করেছেন তখন আশা করি গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স জিনিসটা কী তা ভালো করেই জানেন?”
শিবপদবাবু যেন এতক্ষণে একটা লোপ্পা ক্যাচ পেয়েছেন এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। “না জানার কি আছে? এ তো বাচ্চারাও জানে। এটা তো ওই অতীতে গিয়ে নিজের ঠাকুরদাকে তাঁর শৈশবে বা কৈশোরেই হত্যা করে আসার ব্যাপারটা। যা কিনা বাস্তবে কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না। কেননা সেক্ষেত্রে তাঁর নিজের জন্মাবার সম্ভাবনাই যে শূন্য হয়ে যাবে।” এবার শিবপদবাবুকে বেশ গর্বিত মনে হতে থাকে। যা হোক এতক্ষণে ঘনশ্যামবাবুকে একটা জবাব দেওয়া গিয়েছে।
ঘনশ্যামবাবু যেন মনে হল একটু দমে গিয়েছেন। বলেছেন, “বাঃ, বেশ বেশ। তাহলে প্যারালাল ইউনিভার্সিটি বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব সমন্ধে নিশ্চয়ই কিছু শুনেছেন? এই গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের বিষয়ে বলা হয় যে, আপনি আপনার ঠাকুরদাকে যে মহাবিশ্বে তাঁর শৈশবেই হত্যা করছেন সমান্তরাল আরেক মহাবিশ্বে হয়তো আপনার সঙ্গে আপনার ঠাকুরদার দেখাই হল না। কাজেই সেই মহাবিশ্বে আপনার জন্মের কোনও অসুবিধা হবে না। সে যাক গে, আচ্ছা, আপনার লেখাটা ঠিক কী বিষয়ে?”
“কেন? ডিস্টোপিয়ান ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং-এর ওপরে…”, শিবপদবাবুকে এবার কেমন যেন একটু সন্দিগ্ধ মনে হয়েছে।
আলোচনা অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু আর উদর যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত ও শরীর মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল সেই ভবতারণবাবু এবার একসঙ্গে হা হা করে উঠেছেন। “আরে, ছাড়ুন আপনার ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং ফিল্ডিং। ঘনশ্যামবাবু আপনি অনিলিখা আর বিশুর নোবেল পাওয়ার গল্পটা আগে শেষ করুন।”
“এক নম্বর এটা কোনও গল্প নয়, আর দু-নম্বর নোবেল এখনও ওরা পায়নি। পাবে দু-হাজার বত্রিশে। যাকগে, অন্ধকার অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে। কাল তাহলে আবার দেখা হচ্ছে।” ঘনশ্যামবাবু যেন আসর ছেড়ে উঠে পড়ার উপক্রম করেন।
এবার হাল ধরতে হয় মর্মরের মতো মসৃণ যাঁর মস্তিষ্ক সেই শিবপদবাবুকেই। হঠাৎ যেন কাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ডাকেন, “এই, ঘটি-গরম-ওয়ালা, ইধার আও। চারঠো বড়া ঠোঙা বানাও।”
“হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম,” আড়চোখে শিউশরন ঘটি-গরম-ওয়ালার দ্রুতগতির হাত চালানোর দিকে নজর রেখে ঘনশ্যামবাবু ততক্ষণে আবার শুরু করেছেন, “অনিলিখা আর বিশু কলকাতার একটা পুরোনো মানচিত্র আর কলকাতা পুলিশের কোনও এক দস্তাবেজের আঠেরোশো সাতষট্টি-ঊনসত্তরের একটা পাতা হাতে পাওয়ার পর যখন কাকতালীয়ভাবে সীতাংশুদের পারিবারিক ঘটনা জানতে পায়, তখনই ওদের, বিশেষ করে অনিলিখার মাথাতেই ব্যাপারটা আসে। এর আগে সময় ভ্রমণের যন্ত্রটা তৈরি করার পর থেকে ছোট ছোট সময়-সীমার মধ্যে অতীতে বা ভবিষ্যতে বেশ কয়েকবার, কখনও একা বা কখনও দুজনে মিলে, ঘুরে এলেও সেগুলো ছিল শুধুই ঘুরে আসা। এবার সীতাংশুর পূর্বপুরুষদের ঘটনা জেনে যাওয়ার পর অনিলিখা পরিকল্পনা করে যে ওরা ওই আঠেরোশো সাতষট্টি সালের কলকাতায় গিয়ে রামসদয় ঘোষের হত্যার ঘটনা আটকাতে চেষ্টা করবে— আর সেটা যদি ওই গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের ধাক্কায় কোনও কারণে সম্ভব নাও হয়, সেক্ষেত্রে নবাব সিরাজউদ্দৌলার নবাবী খাজানার সন্ধানও অন্তত যদি পেয়ে যাওয়া যায় তো অতীত ভ্রমণের একটা বিশেষ সাফল্যের কথা পৃথিবীকে জানানো যাবে। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গিয়েই যত সমস্যার শুরু। আঠেরোশো সাতষট্টির কলকাতায় অনিলিখা পৌঁছে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়া, তারপর ওর কোনও খোঁজখবর না পেয়ে শেষে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে বিশু আর সীতাংশুর লাসায় আমার কাছে পৌঁছানো, নাটোভিচের পথ ধরে হেমিস মনাস্টারিতে আমার যাওয়াটা স্থগিত রাখা আর অনিলিখাকে বাঁচাতে আমার ভবিষ্যৎ ভ্রমণ আর সেই সঙ্গে অতীতের কমলাকান্ত চক্রবর্তীর ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া।” ইতিমধ্যে বড় বড় থাবার মতো হাত চালানোয় শ্রীঘনশ্যামের হাতের বিশাল ঠোঙা খালি হয়ে গিয়েছে। ঠোঙাটা মুচড়ে বেঞ্চের পেছনে ফেলে দিয়ে এবার যেন চুপ করে গেলেন।
উদর যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত ও শরীর মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল সেই ভবতারণবাবু এদিকে ওদিকে তাকিয়ে একটা ঝালমুড়িওয়ালাকে হাঁক মেরে ডেকে আনিয়েছেন। তারপর একটা বেশ বড় সাইজের ঝালমুড়ির ঠোঙা হস্তান্তরিত হতে না হতেই শ্রীঘনশ্যামকে খেই ধরিয়ে দেওয়ার জন্যেই বোধহয় মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু বলে উঠেছেন, “নোবেল তো বোধহয় ওই সময় ভ্রমণ নিয়ে, কিন্তু এর মধ্যে কমলাকান্ত কোথা থেকে আর কীভাবে চলে এলেন সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না!”
ঝলমুড়ি চিবোতে চিবোতে একটু যেন বিরক্তই মনে হয়েছে এবার ঘনশ্যামবাবুকে। নারকোলের সরু ফালিটায় একটা কামড় বসিয়ে বলেছেন, “কমলাকান্ত চক্রবর্তীর সমন্ধে আপনারা কতটা কী জানেন?”
এবার এগিয়ে এসেছেন ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক শিবপদবাবু, “যতদূর জানি মাসিক বঙ্গদর্শনে পত্রিকায় ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ নামে একটা লেখা মাসিক কিস্তিতে বাবু ভীষ্মদেব খোসনবীসের নামে ছাপা হত। যদিও আবার পরে বঙ্গদর্শনেই চিঠিপত্র লিখে স্বয়ং শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্তী জানিয়েছিলেন যে লেখাগুলো আসলে ওঁরই। তবে ক-জন সেটা বিশ্বাস করেছিল কে জানে! ওই লেখা থেকে যতটুকু যা জানা যায় ভদ্রলোকের সাবেক নিবাস শ্রীশ্রীনসিধাম। গাঁজা খেতে আর ফিলজফি আওড়াতে ভালোবাসতেন। ভীষ্মদেব মশায়ের বাড়িতেই থাকতেন আর মোসাহেবি করতেন। একদম হঠাৎ করেই একদিন উধাও হয়ে যান। আবার কিছুদিন উধাও হয়ে থাকার পর হঠাৎ করেই উদয় হয়ে সেই বঙ্গদর্শনেই কিছু চিঠিপত্রও লেখালেখি করেন। ওঁকে শেষ দেখা পাওয়া যায় প্রসন্ন গোয়ালিনীর গরু চুরির মামলার কোর্টে এক সাক্ষী হিসেবে। তারপর থেকেই একদম উধাও। বঙ্গদর্শনে বা অন্য কোথাও পরে আর কোনও দিনই ওঁর টিকির দেখা পাওয়া যায়নি।”
দু-হাত নেড়ে এবার বাধা দিয়েছেন শ্রীঘনশ্যাম। “ব্যাস, ব্যাস। পুরোপুরি না জানলেও অনেকটাই জানেন দেখছি। এবার সেই প্রথমবার উধাও হয়ে কোথায় কী করছিলেন সেটা বললেই বুঝতে পারবেন এই নোবেল প্রাইজের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক ঠিক কোথায় আর কেনই বা তারপর হঠাৎ একদিন বঙ্গদর্শনে চিঠি লিখে তাঁকে তাঁর প্রাপ্য রয়্যালটির দাবি করতে হয়েছিল।”
মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু বলে উঠেছেন, “ও ভবিষ্যতে গিয়ে সেগুলোই আপনি জেনে এসেছেন? ঠিক আছে, বলুন আপনি। আমরা শুনছি।”
“হুম,” ঘনশ্যামবাবু যেন খানিকটা বাধ্য হয়েই বলেছেন, “তাহলে আপনাদের আরও একটু ধৈর্য ধরতে হবে। ভীষ্মদেব খোসনবীস মশায়ের বাড়ি ছাড়ার পরের পুরো বৃত্তান্ত আমি শুনেছি স্বয়ং চক্রবর্তী মহাশয়ের কাছ থেকেই। খানিকটা শুনেছি ওঁর থেকে আর খানিকটা জেনেছি ওঁর খেরোর খাতার থেকে—”
“কখন? ওই আঠেরোশো সাতষট্টি না ঊনসত্তর বললেন যেন, সেই তখন? আপনি ওখানে ছিলেন?” মস্তিষ্ক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু আর চুপ করে আর বোধহয় থাকতে পারছেন না।
উদর যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত সেই ভবতারনবাবু কিছু বলে শিবপদবাবুকে আটকাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ঘনশ্যামবাবু ভ্রু কুঁচকে একবার শুধু তাকিয়ে তারপর তাঁর সেই পেটেন্ডেড নাসিকাধ্বনি করে শিবপদবাবুকে প্রায় যেন উড়িয়েই দিয়ে বলেছেন, “না। আঠেরোশো সাতষট্টিতে আমি ছিলাম না। এমনকি অতীত ভ্রমণও আমি করিনি। আমার সঙ্গে চক্রবর্তীবাবুর দেখা হয় দু-হাজার বত্রিশেই— আর তাও এই কলকাতার বুকেই। সীতাংশুদের কলকাতার পৈতৃক বাড়িতে। অনিলিখাকে আঠেরোশো সাতষট্টি থেকে সেবার ফিরিয়ে আনার পরে ক-দিন বিশ্রামের থাকার পরে একটু সুস্থ হয়েই ও আবার দ্বিতীয় বারের জন্য অতীতে যায়। এবার আঠেরোশো ঊনসত্তর। সেখান থেকে মৃত্যুর নির্দিষ্ট দিনের ঠিক আগেই কমলাকান্ত চক্রবর্তীকে দু-হাজার বত্রিশে নিয়ে চলে আসে। আমি তখনও ওখানেই ছিলাম। ঠিক করেছিলাম কয়েকদিন থেকে গিয়ে ভবিষ্যৎ-কলকাতার হাল-হকিকত দেখে নেব। তখনই চক্রবর্তীবাবুর কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা জানতে পারি। সেই আঠেরোশো সাতষট্টির শুরুর দিকেই খোসনবীস মশায়ের বাড়ি থেকে উনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। চাটুজ্যে মশাইয়ের সাহায্য পেয়ে তারপর থেকেই উনি অন্য এক বিশেষ দপ্তর চালাচ্ছিলেন। এখনকার ভাষায় বলতে গেলে তখন তিনি ছিলেন লালবাজারের টিকটিকি। তবে আগের মতো লেখালেখির অভ্যাস তিনি ছাড়তে পারেননি। তাই প্রতিদিনকার তদন্ত আর ঘটনাপঞ্জি রোজ নিয়ম করে লিখে রাখতেন। অবশ্য ওটা ওঁর চাকরির একটা অবশ্য-কর্তব্য কর্ম-ও ছিল। উনি তখন আরক্ষাবাহিনীর আলেখ্যদার। ওঁর ওই ঘটনাপঞ্জিরই একটা পাতা দিল্লির এক কিউরিও-শপ থেকে অনিলিখারা পেয়ে যায়। সেখান থেকেই এই ঘটনার শুরু। সে যাই হোক, ঘটনা হচ্ছে সেই আঠেরোশো সাতষট্টির সেপ্টেম্বরে, একদিন কমলাকান্ত সকাল সকাল তাঁর দপ্তরে গিয়েছেন। কাজকর্ম তেমন কিছু নেই, মানে তেমন কিছু ঘটনা না ঘটলে কাজকর্ম কিছু থাকেও না। তাই সেই সকালে অফিসে বসে বসে নিজের জীবনেই ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার জাবর কাটছেন, এমন সময়ে… আচ্ছা, ওঁর সেই দপ্তরের খেরোর খাতায় যেমন যেমন পড়ে ছিলাম আর ওঁর নিজের ভাষ্যে যেমনটা শুনেছিলাম, সেভাবেই ওঁর ভাষ্যেই বলি, শুনুন আপনারা—”
৪
কমলাকান্তের আরেক দপ্তর
কমলাকান্ত দপ্তরে বসিয়া ছিল। এ দপ্তর তাহার সে দপ্তর নহে, যাহার কথা বাবু শ্রী ভীষ্মদেব খোসনবীস খোলসা করিয়া ছিলেন। মসী চিত্রিত, জীর্ণ, বস্ত্র খণ্ডে বাঁধা যে কাগজগুলির কথামালা বঙ্গদর্শনে একদা দর্শিত হইয়াছিল, এ দপ্তর সে দপ্তর নহে। এ দপ্তরের হাল-হকিকত খাসনবীস মহাশয়ের জানা নেই। বাবু ভীষ্মদেব মহাশয়ের গৃহত্যাগের পরবর্তীকালে যে চাটুজ্যে মহাশয়ের কৃপায় এই দপ্তর-প্রাপ্তি, তাহার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করিবার অসুবিধা আছে। এইটুকু শুধু বলিতে পারা যায় যে, যে যুগে বঙ্গীয় যুবকগণ কপোত-কপোতীর বিবাহ লইয়া মস্তিষ্কের কর্ম সম্পাদন করিয়া জীবনপাত করিতেছিল, সেই যুগে ইনি আপন শিক্ষা যোগ্যতায় রাজকীয় বিচার বিভাগের অন্যতম কর্তাব্যক্তি হইয়া উঠিয়া ছিলেন। ইনি বাবু শ্রী ভীষ্মদেব খোসনবীস মহাশয়ের মিত্র-স্থানীয় ছিলেন। তদুপরি সাপ্তাহান্তিক সান্ধ্য আড্ডা সূত্রে ইনি কমলাকান্তের ছেঁড়া কাগজের দপ্তরের সাক্ষী ছিলেন। যখন প্রসন্ন এবং মঙ্গলার সহিত সম্পর্ক পরিত্যাগ করিবার সময় উপস্থিত হইল সেই সময় একদিন প্রাতে উঠিয়া ব্রহ্মচারীর মতো গেরুয়া-বস্ত্র পরিয়া কমলাকান্ত গৃহত্যাগ করিয়াছিল বলিয়া খাসনবীস মহাশয়ের যে ধারণা হইয়াছিল তাহা এই চাটুজ্যে মহাশয়েরই মস্তিষ্ক-প্রসূত “আইডিয়া”।
গোপনে সেই দিন হইতেই কমলাকান্ত এই দপ্তরে দাখিল হইয়া ছিলেন। এই দপ্তরের কথামালা পূর্বে প্রকাশিত হয় নাই। চাটুজ্যে মহাশয়ের ইচ্ছা ছিল না এই দপ্তরখানা কমলাকান্ত খুলিয়া প্রকাশ করে। রাজ-সরকারের বাধ্য-বাধকতাই তাহার কারণ সম্ভবত। যদিও নিন্দুকেরা অন্যবিধ বহু কারণও দর্শাইয়া থাকে।
কমলাকান্তকে অনেকেই পাগল বলিত। সে কখন কি বলিত, কি করিত, তাহার স্থিরতা ছিল না। লেখাপড়া ভয়ানক না জানিলেও মোটের উপর জানিত। কিছু ইংরেজি, কিছু সংস্কৃত জানিত। একবার পে-বিল ঘটিত ঘটনা ক্রমে তার চাকরি নট হইয়া যায় বলিয়া কথিত আছে।
এই সমস্ত বহুবিধ কারণ এবং সরকারি এই দপ্তরের কার্যক্রমের যে গোপনীয়তা তাহা যাতে আফিমের প্রভাবে প্রচারিত না হয়, তাহার উদ্দেশ্যেই চাটুজ্যে মহাশয়ের এই সিদ্ধান্ত বলিয়া ধারণা করা যাইতে পারে।
আজ অবিশ্যি আর এই সমস্ত গোপনীয়তা কোনও প্রয়োজন নাই। সেই রাম এবং সেই অযোধ্যা— উভয়েই আজ ইতিহাস। তাই আজ এই দপ্তরখানা প্রকাশ পাইলে চাটুজ্যে মহাশয়ের চাকুরি ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা সৃষ্ট হইবে না।
দপ্তরটি খোদ কলকাতা শহরের মধ্যেই আলিপুরে অবস্থিত। লালবাজার হইতে অধিক দূরত্ব নহে। চাটুজ্যে মহাশয় এখন এই অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেকটর। উহারই সুপারিশে কমলাকান্তের এই দপ্তরে অধিষ্ঠান।
তো কথা হইতেছে যে কমলাকান্ত দপ্তরে বসিয়া ছিল। সন ১৮৬৭। সেপ্টেম্বর মাস। শরৎকাল এবং দূর্গাপূজা আসিয়া পড়িয়াছে। যদিও গ্রীষ্মের উৎপাত কিছুমাত্র কমে নাই। প্রসন্ন গোয়ালিনীর নির্জলা দুগ্ধের অনুপস্থিতিতে আজিকাল জল-মিশ্রিত দুগ্ধের মাধ্যমেই দিনাতিপাত হইলেও ভরি দুই আফিমের মৌতাত কিছুমাত্র কমে নাই। কেদারাতে বসিয়া কমলাকান্ত আমেজ উপভোগ করিতে ছিল। এই সকাল দশ ঘটিকায় দপ্তর এখোনো জমিয়া ওঠে নাই। চাপরাসী ধীর গতিতে পাংখা টানিতেছিল। আমেজে কমলাকান্ত চক্ষু মুদিয়া কেদারাতে হেলান দিয়া বসিয়া আছে।
আকৃতগতভাবে কমলাকান্ত নাতিদীর্ঘ। ইদানিং মস্তিষ্কের উপরিভাগের কেশরাশি উধাও হইয়া শুধুমাত্র চারিপাশে যে কয়েকগুচ্ছ ঝুলিয়া রহিয়াছে তাহারা সম্ভবত অতীতের প্রমাণ হিসেবেই বর্তমানে বিরাজমান। আফিমের মৌতাত না থাকিলে চক্ষুদ্বয় চড়াই পক্ষীর ন্যায় দ্রুত সঞ্চরনশীল। নাসাগ্র তীক্ষ্ণ এবং বঙ্কিম। বয়সজনিত কারণে একটু ঝুঁকিয়া পড়িয়াছেন, যদিও এখনও দন্ড ধরিতে হয় নাই। তবে একটি হস্তী-দন্ত নির্মিত হাতল-বিশিষ্ট দন্ড সর্বদা বহন করেন। নিন্দুকেরা বলিয়া থাকে দন্ডটা সাধারণ নহে— গুপ্তি জাতীয় এক বিশেষ যন্ত্র। তবে পরিবর্তন আর যাহাই হউক, আজিও তাহার পোশাক হইতে সর্বদাই আফিমের সুগন্ধ বিতরিত হইতে থাকে।
“সুপ্রভাত, চক্রবর্তী মহাশয়। বড় সাহেব এত্তেলা দিয়েছেন।”
আফিমের আমেজ ভাঙ্গিবার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু উপায় কি! বড় সাহেবের এত্তেলা!
চক্ষুদ্বয় খুলিয়া একবার দেখিলেন। সহকারী বিধুবিনোদ সম্মুখে দন্ডায়মান। পুনরায় চক্ষু মুদিয়া প্রশ্ন করিলেন, “এবার কী? হত্যা না সিন্দুক ভঙ্গ?”
পাঠক, অধিক অগ্রসর হইবার পূর্বে এই দপ্তরের কিছু বিবরণ আবশ্যিক। ১৭০৪ সনে কলিকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের দৈনন্দিন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে যে রক্ষীদল গঠিত হয় তা শহর বর্ধিত হইতে থাকিলে একসময় ক্রমশ বর্ধিত হইয়া এক সংগঠিত পুলিশ বাহিনীতে পরিবর্তিত হয়। ১৮৫৬ সালের ১লা নভেম্বর চিফ ম্যাজিস্ট্রেট এস ওয়াওচোপ হইলেন কলিকাতার প্রথম পুলিশ কমিশনার। তাঁহার পূর্বে যাহারা ছিলেন তাঁহারা সবাই ছিলেন সুপারিটেন্ডেন্ট। অতঃপর চিফ ম্যাজিস্ট্রেট এস ওয়াওচোপ এর ইচ্ছানুযায়ী এই বিশেষ দপ্তরের প্রতিষ্ঠা হইয়া ছিল। প্রাথমিক লক্ষ্য রাখা হইয়াছিল কলিকাতা শহরে অনুষ্ঠিত সকল প্রকার চুরি ডাকাতি হত্যা ইত্যাদির ইতিহাস রচনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ। ভাগ্যক্রমে কিংবা দূর্ভাগ্যক্রমে কমলাকান্ত এই দপ্তর মধ্যে স্থান পাইয়াছিল এবং পরবর্তীকালে নিজ কর্মকুশলতায় এই বিভাগের এক সিনিয়র আলেখ্যদারের পদে বিরাজমান হইয়াছে।
এই দপ্তর মধ্যে তাহার একটি নিজস্ব দপ্তর ছিল। কমলাকান্তের বহুবিধ বদ-অভ্যাসের একটি ছিল তাহার কাছে ছেড়া কাগজ পড়িতে পাইত না ; দেখিলেই তাহাতে কি মাথা মুণ্ড লিখিত, কিছু বুঝিতে পারা যাইত না। বুঝিতে না পারলেও তাহাতে বিবিধ মূল্যবান দর্শন ইত্যাদি লিখিত ছিল। কখন কখন বাবু ভীষ্মদেব খাসনবীস পড়িবার চেষ্টা করিয়া নিদ্ৰাভিভূত হইলেও যৎকালে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হইলে বাংগালী সমাজে যথোপযুক্ত আদর পাইয়াছিল।
ম্যাজিস্ট্রেট এস ওয়াওচোপ কতৃক প্রতিষ্ঠিত এই দপ্তর অভ্যন্তরে কমলাকান্ত তাহার নিজস্ব আরেক দপ্তর খুলিয়া ফেলিয়াছিল। দুইটা বাঁধানো বহি খাতা ছিল তাহার নিজস্ব দপ্তরের একান্ত আগ্রহের বিষয়। একটিতে বিবিধ তদন্ত বিষয়ে লিপিবদ্ধ করিত এবং অন্যটিতে কলিকাতা নগর এবং পারিপার্শ্বিক অঞ্চলের বিবিধ হত্যাকাণ্ডের লিখিত তালিকা সে দৈনিক প্রস্তুত করিত। প্রথম বহি-খাতাটিকে কমলাকান্ত খেরোর খাতা আর দ্বিতীয়টিকে তালিকা-লিপি বলে নামকরণ করিয়াছে। কেন করিয়াছে তা সে নিজেই জানে! তবে পুষ্প আপনার জন্যে ফুটে না। দপ্তরী আপনার জন্য দপ্তর লিখে না। পরের জন্য দরকারি ইতিহাস লিপিবদ্ধ হইত। আশা রাখি ভবিষ্যতে যথোপযুক্ত সময়ে এই নবতর বহি খাতা প্রকাশিত হইলে তৎকালীন বঙ্গসমাজ বিবিধ বিষয়ে উপকৃত হইবে।
যাহা হউক, সেদিন ২২-শে সেপ্টেম্বর, ১৮৬৭, বড় সাহেবের এত্তেলা পাইয়া কমলাকান্ত সহকারী সমভিব্যহারে অকুস্থলের উদ্দেশে যখন রওয়ানা হইল তখনও দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রাম দুই ঘণ্টা দূরে। এত্তেলার কারণ সহকারীর বহন করা সংবাদ অনুযায়ী একটি পরিচিতিহীন মৃতদেহ, যাহা আবিষ্কৃত হইয়াছে দি গ্রেট বাংলো রোডের পার্শ্ববর্তী বাজারের একটি বিপনীতে।
৫
কমলাকান্তের দপ্তরের খেরোর খাতার অন্য একটা পাতা
কমলাকান্ত দেখিলেন মৃতদেহটি একটি যুবকের। মৃতদেহের মস্তকের বাম দিক ঘেঁষিয়া বাম চক্ষুর চারি আঙ্গুলির উর্ধে একটি ক্ষুদ্র হাতল বিশিষ্ট রামদা আমূল প্রোথিত। যুবকের বাবরি কেশ রক্তে সম্পূর্ণ সিক্ত। রক্ত মস্তক হইতে নির্গত হইয়া যুবকের মুখের বাম পার্শ্ব ভাসাইয়া চারিপাশে বিস্তৃত। হাতলটি শুধুমাত্র প্রকাশিত। সাধারণ, কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্যবিহীন হাতল। তবে বৈশিষ্ট্য রহিয়াছে যুবকের পোশাকে। এ এক অদ্ভুত পোশাক। এমন পূর্বে কখনও দেখা যায় নাই। কমলাকান্ত জন্ম ইস্তক এ পোশাক দেখে নাই। ইংরাজগনের পোশাক হইতে বাংগালীর পোশাক ভিন্ন। চাটুজ্যে মহাশয়ের সুবাদে ইদানিংকালে ইংরাজ কমলাকান্ত কম দেখে নাই। কিন্তু এরূপ পোশাক অদ্যাবধি কাহাকেও পরিধান করিতে দেখা যায় নাই। উর্ধাঙ্গের পোশাক এবং নিন্মাঙ্গের পোশাক উভয়েই দুটি ভিন্ন রং-এর এবং পোশাক আশ্চর্যজনকরূপে শরীরকে যেন আঁকড়াইয়া রহিয়াছে। উর্ধাঙ্গের পোশাক এমন যে স্কন্ধ হইতে শুরু করিয়া হস্তের প্রান্ত পর্যন্ত এক টুকরা কাপড় যেন মুড়াইয়া রাখা হইয়াছে। আবার বক্ষস্থলের মধ্যভাগ হইতে বস্ত্রটি যেন দুই ভাগে বিভক্ত অথচ জুড়িয়া রহিয়াছে। আকৃতিগতভাবে ইংরাজের জ্যাকেটের সহিত যেন কিছু সাদৃশ্য রহিয়াছে। নিন্মাঙ্গের পোশাকটিও তদরুপ। হস্তের ন্যায় পদদ্বয় একইরকমভাবে একটি আসমানী নীল মোটা বস্ত্র দ্বারা এমনভাবে মুড়াইয়া রহিয়াছে যে না জানি খুলিতে হইলে কী রূপে খোলা যাইবে! এই বস্ত্রটির প্রকৃতি এমন যেন চটের বস্তার নিকট আত্মীয়। দুই পায়ে দুটি অদ্ভুত দর্শন জুতা। এবং জুতাদ্বয় রঙিন। এ জুতা সাধারণ বাংগালীর পাদুকা হইতে বহুদূরে এবং ইংরাজ রাজপুরুষের জুতার ভ্রাতা-স্বরূপ হইলেও অবশ্যম্ভাবী রূপে দূর সম্পর্কের ভ্রাতা। “কি ইংরেজি কি বাঙ্গালা যে সম্বাদ-পত্র, সাময়িক পত্র, স্পীচ, ডিবেট, লেকচর, যাহা কিছু দেখি, পড়ি বা শুনি, তাহাতে এই রূপ পোশাকআশাক কখনও দেখিতে, পড়িতে বা শুনিতে পাই নাই।”
যাহা হউক যুবকটি যে মৃত সে বিষয়ে কমলাকান্ত নিঃসন্দেহ। যে রামদাটি যুবকটির কপালের উপরে প্রোথিত তাহাও নিঃসন্দেহে বলিতেছে যে ইহা কোন সুকর্ম প্রণোদিত কর্ম নহে। কমলাকান্ত কি আনন্দিত হইবে? কেন না হইবে। বৎসর প্রায় অতিক্রান্ত হইতে যাইতেছে এই কমলাকান্ত শর্মা, বাবু খাসনবীস মশায়ের বাটিকা পরিত্যাগ করিয়াছে। চাটুজ্যে মশায়ের সুপারিশে এই চাকুরি জুটিয়াছে। সেই অবধি শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়া, এই জাতীয় রহস্য সন্ধানে মন সারাক্ষণ ব্যাস্ত থাকিতে চায়। “হয় আধভরি আফিমের জোগাড় হউক। খাইয়া ঝিমাইতে থাকি। নতুবা রহস্য চাই— মস্তিষ্কের খোরাক নহিলে মন অশান্ত হইয়া উঠে। পূর্বে বাবুর বৈঠকখানায় আফিম চড়াইয়া মোসাহেবি ধরনের বসিয়া থাকতাম আর চাট্টি রসিকতা করিয়া পরের দিনের আফিমের জোগাড় রাখিতাম। আজ আর আফিমের সন্ধানে রসিকতা করিতে প্রয়াস পাই না, কিন্তু মনে মনে বুঝিয়াছি যে, এ সংসারে রহস্য বিনা আমার মন কোথাও নাই। রহস্য ছাড়িয়া, সত্য কথা বলিতেছি, কিছুতে আমার আর মন নাই। শারীরিক সুখ স্বচ্ছন্দতায় মন নাই, যে রহস্যালাপের আমি প্রিয় ছিলাম, সে রহস্যালাপে আমার মন নাই। আমার কতকগুলি ছেড়া পুঁথি ছিল— তাহাতে আমার মন থাকিত, তাহাতে আজিকাল আমার মন নাই। বাবুর গৃহত্যাগের সময় তাহা চিরকালের জন্য ছাড়িয়া আসিয়াছি। অর্থসংগ্রহে মন কখনও ছিল না— এখনও নাই। কিছুতে আমার মন নাই। আমার মন কোথা গেল?” মন আপাতত রহস্য সন্ধানে নিমজ্জিত।
রহস্য এই স্থানে বিবিধ। কে এই অভূতপূর্ব পোশাক পরিহিত যুবক? সাকিন কোথা? এ স্থলে কোথা হইতে আসিল? হত্যাকারী কে? কি তাহার মোটিফ? অর্থ ধনম্পত্তি? নাকি একটি পুষ্প দুইটা ভ্রমর? এই রামদাটি কোথা হইতে আসিল? হত্যাকারী স্বয়ং বহন করিয়া আসিয়াছিল?
কমলাকান্ত মৃতদেহের উপর ঝুঁকিয়া নিষ্পলক চক্ষুদ্বয় দ্বারা হত্যার অস্ত্রটি পর্যবেক্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। ইতিমধ্যে স্থানীয় দারোগা অকুস্থলে হাজির হইয়াছে।
৬
কমলাকান্তের খেরোর খাতার অন্য আরেকটা পাতা
“একদা লিখিয়াছিলাম যে আফিমের একটু বেশি মাত্রা চড়াইলে আমার বোধহয়, মনুষ্যসকল মায়াবৃন্তের ফলবিশেষের ন্যায় সংসার-বৃক্ষের শাখাপরি ঝুলিয়া রহিয়াছে, পাকিলেই টুপ করিয়া খসিয়া পড়িবে। যে সকলগুলি পাকিতে অবকাশ পায় না— কতক অকালে ঝড়িয়া পড়িয়া যায়। কোনটি পোকায় খায়, কোনটিকে পাখিতে ঠোকরায়। কোনটি শুকাইয়া ঝরিয়া পড়ে। কোনটি সুপক্ক হইয়া, আহরিত হইলে গঙ্গাজলে ধৌত হইয়া দেবসেবায় বা ব্রাহ্মণভোজনে লাগে— তাহাদিগেরই ফলজন্ম বা মনুষ্যজন্ম সার্থক। কোনটি সুপক্ক হইয়া, বৃক্ষ হইতে খসিয়া পড়িয়া মাটিতে শায়িত থাকে, উহাদিগকে শৃগালে ভক্ষণ করে। তাহাদিগের মনুষ্যজন্ম বা ফলজন্ম বৃথা। কিন্তু আমার ভাগ্যদোষ, কপালে এমনি চাকুরি জুটিল যাহাতে আমার পূর্বতন ‘থিয়োরি’ আজিকাল কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করিতে হইয়াছে এবং তাহা আফিমের মৌতাত বিনা। কত যে দেখিলাম! বুঝিলাম যে মনুষ্যসকল মধ্যে কিছু ফল সুপক্ক হইবার পূর্বেই মহাকালের শাপে শুকাইয়া যায়। সেই সব অকাল শুষ্ক ফলের অকাল-শুষ্কতার খানামসরা করিয়া লিপিবদ্ধ করাই আমার বর্তমান জীবিকা।”
মৃতদেহটি আবিষ্কৃত হইয়াছে যে স্থলে সেটি একটি কেক-পেস্ট্রির বেকারি। মালকিন মিসেস পেগী। কলিকাতা শহর মধ্যে এটি একটি সুবিখ্যাত বেকারি। এস্থলে বসিয়া ভোজন এবং পারসেল উভয়েরই সুবন্দোব্যাস্ত রহিয়াছে। সাধারণত দিবসের এই কালে স্থানটি জনাকীর্ন থাকে না। তদুপরি আজি সম্ভবত হত্যার সংবাদ প্রচারিত হওয়ায় নাগরিকদের ভিড় বাড়িয়া গিয়াছে। দারোগা বাতা-বন্দির আদেশ জারি করিয়াছে। অধিক না হইলেও ভিড় তাহাতে কিঞ্চিৎমাত্র দমিত হইয়াছে। চারিপার্শের বিভিন্ন বিপনীর ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়পক্ষের জমায়েত এখন এই স্থলে। কয়েকজন কনেস্টবল এবং চাপরাসীতে মিলিয়া লাঠি হস্তে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করিতে ব্যাস্ত।
কমলাকান্ত ঝুঁকিয়া মৃতদেহটি মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করিতেছিল। যুবকের বাবরি চুল সহ মস্তকের অধিকাংশ স্থান রক্তলিপ্ত হইলেও মুখাবয়ব পরিষ্কার বোধগম্য। বয়স বোধকরি বিংশতি বর্ষের কিছু এদিক ওদিক হইবে। গৌর বর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসা। মুখাবয়ব আশ্চর্যজনক পেলব। বর্তমান বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে এইরূপ পেলবতা আর কমনীয়তা দূর্লভ। বুঝিলেন যুবকের পরিচয় নির্নয় সহজ হইবে না। সম্ভবত বহিরাগত। পোশাক এবং মুখাবয়ব উভয়েই সেইদিকই নির্দেশ করিতেছে। অপর আরেকটি বিশেষ কথা হইল যুবকের মুখাবয়ব দেখিয়া বোধ হইতেছে যে মৃত্যুকালে তাহার মধ্যে ভীতির অধিক বিস্ময়ের ভাগ প্রবল ছিল। মৃত্যু যে তাহার শিয়রে উপস্থিত তাহার বিষয়ে যেন কোনও উপলব্ধি হয় নাই। শারীরিক গঠন বলিতেছে এই যুবক পেশিবহুল বলবান নহে। হত্যাকারীর হত্যা করিতে বিশেষ বলপ্রয়োগ করিতে হয় নাই। তবে সর্বাপেক্ষা আশ্চর্যজনক হইতেছে হত্যার অস্ত্র। বাংলাদেশে সাধারণত তিনটি হত্যার পদ্ধতি অধিক প্রচলিত। ফাঁস দিয়া বা কণ্ঠ নিস্পেষন করিয়া কিংবা বিষ-প্রয়োগের হত্যা যে দেখা যায় নাই তাহা নহে। তবে সাধারণত তাহা গৃহবিবাদ বা পরিচিত জনের হত্যার ক্ষেত্রেই অধিক ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এই হত্যাকর্ম ছুরিকাঘাত জাতীয় হইলেও ব্যবহৃত অস্ত্রটি অভূতপূর্ব। রামদা জাতীয় অস্ত্র সহজ বহনযোগ্য নহে। কমলাকান্ত নিশ্চিত হইলেন অস্ত্রটি তাহাকে হত্যাকারীর নিকটে সহজে পৌঁছাইবে।
কমলাকান্ত এতদক্ষণে উঠিয়া দারোগাকে তলব দিলেন। বিধুবিনোদ পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছিল। বলিল, “চক্রবর্তী মহাশয়, বোধ হইতেছে যুবক বিদেশি।”
কমলাকান্ত হাসিলেন। জবাব করিলেন না। দারোগা আসিলে তাহাকে বলিলেন নিকটবর্তী যতগুলি কষাইখানা রহিয়াছে তাহাদের অস্ত্র সকল তদন্ত করিয়া দেখিতে। হত্যার অস্ত্রটি সম্ভবত কোনও একটি কষাইখানা হইতে আসিয়াছে। হয় কষাই স্বয়ং হত্যাকারী অথবা কোনও চতুর হত্যাকারী সেইস্থান হইতেই অস্ত্র সংগ্রহ করিয়াছে। হয় চৌর্যকর্ম অথবা কষাই স্বয়ং কোনওভাবে সংযুক্ত। আর উপস্থিত ভিড়ের মধ্যে কেহ কোনও অসংলগ্ন ব্যাপার চাক্ষুষ ঘটিতে দেখিয়া থাকিলে তাহার মুআয়না করিয়া দেখিতে হইবে।
বিধুবিনোদ পশ্চাতে আসিয়া অপেক্ষা করিতেছিল। বোধহয় কিছু বলিবার আকাঙ্ক্ষা ছিল। বলিতে সাহস করিয়া উঠিতে পারিতেছিল না।
কিন্তু যখন কমলাকান্ত তাহার পানে তাকাইয়া স্বগোতক্তির ন্যায় বলিয়া উঠিল, “বোধ হইতেছে ইহা কোনও সাধারণ হত্যা নহে। রহস্য গভীর।”
তখন বিধুবিনোদ মুণ্ড কাত করিল। তারপর বলিল, “হুম। অস্ত্রটি সত্যই আশ্চর্যজনক। মানুষ খুন করিবার পক্ষে রামদা অস্ত্র হিসাবে যথেষ্ট সুবিধাজনক নহে।”
কমলাকান্ত শুনিল কিনা বোঝা গেল না। আপনমনে যেন নিজেকেই শুনাইতেছে এরূপ ভঙ্গিতে বলিল, “মৃত যুবকের চেহারা পত্র আশ্চর্য লাবণ্যযুক্ত। তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ এবং ত্বক আশ্চর্যজনক পেলব। হাত দুটি দেখিয়া মনে হইতেছে না যে কদাপি কখনও কায়িক শ্রমের কর্ম করিয়াছে। গন্ডদ্বয় দেখিয়া মনে হইতেছে না যে কদাপি শুশ্রু বা গুম্ফ কামাইয়াছে। তথাপি মুখখানি পরিস্কৃত এবং চকচক করিতেছে। বয়সজনিত পেশিবাহুল্য শরীরখানিতে অদৃশ্য। সর্বাধিক আশ্চর্য হইল পোশাক। ফাইন সুতি নহে, বরং চট জাতীয়। অথচ কোমল এবং বোধ হইতেছে আরামদায়ক। পোষাকের গঠন-ও অদ্ভুত। দেশীয় অপেক্ষা অধিক ইউরোপিয়ান বোধ হইতেছে। অথচ যুবকটি বিদেশি নহে তাহা একপ্রকার নিশ্চিত। না হে, বিধুবিনোদ। অস্ত্র অবশ্যই রহস্যময়, তবে তাহা অপেক্ষা স্বয়ং যুবকটি অধিক রহস্যময়।”
অতঃপর কমলাকান্ত খানিক নীরব রহিয়া সম্মুখের জমায়েত লক্ষ করিল। দারোগা তখনও দাঁড়াইয়াছিল । কমলাকান্ত তাহাকে আদেশ করিল মৃতদেহটি গোশকটে চড়াইয়া আফিসের মরচুরিতে পাঠাইয়া দিতে। ইহা কমলাকান্তের এক নব্য আন্দোলন। পঞ্চবিংশতি বর্ষ পার হইয়াছে বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজের প্যাথোলজি মিউজিয়ামে অ্যালান উব সাহেব মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করিতেছেন। চাটুজ্যে মহাশয়ের সুবাদে কমলাকান্ত সে স্থান বেড়াইয়া আসিয়াছেন। উব সাহেব লিখিত একটি ইংরেজি পুস্তক “প্যাথোলজিয়া ইন্ডিকা” এবং দুইটি সংস্কৃত পুস্তক – সুশ্রুত এবং চরক সংহিতা লইয়া কিঞ্চিদধিক ছয় মাস হইবে কমলাকান্ত এই আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছে। সহকারী হইয়াছে বেঙ্গল মেডিক্যালের হরি ডোম। বিধুবিনোদ সর্বদাই নিজেকে একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিমত্তার অধিকারী বলিয়া দাবি করলেও আজিও বুঝিতে পারে নাই মৃতদেহ কাটিয়া ছিড়িয়া কমলাকান্তের কী মোক্ষলাভ হইতেছে। মধ্য হইতে বরং হরি ডোমের কিঞ্চিৎ অর্থাগম হইতেছে। কমলাকান্তের আশা একদিন অবশ্যই ফল মিলিবে। কোনও একটি হত্যার মীমাংসা মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করিয়াই হইবে। বিধুবিনোদ প্রতিবাদ করে না। সাহেবের পেয়ারের লোক বলিয়া কথা! চাকুরি রক্ষার্থে তাহাকে কমলাকান্তের হাঁ-তে হাঁ এবং না-তে না মিলাইতেই হইবে। আপাতত কমলাকান্তের পিছে পিছে একটি টাঙ্গায় চড়িয়া পুনরায় অফিস উদ্দেশে রওয়ানা হইল।
প্রধান অফিস বাটিকার ঠিক পশ্চাতে মরচুরি। উহার সম্মুখের কক্ষটি নাতিবৃহৎ এবং কক্ষের ঠিক মধ্যস্থলে একটি কৃষ্ণ গ্রানাইট প্রস্তর নির্মিত উচ্চ টেবল। কক্ষটিতে এই মুহূর্তে তিনজন জীবিত মনুষ্য এবং একটি মৃতদেহ উপস্থিত। মৃতদেহটি গ্রেট বাংলা রোডের কেক বিপনীতে আবিষ্কৃত যুবকের এবং এই মুহূর্তে প্রস্তর নির্মিত টেবিলে শায়িত। মনুষ্য তিনজনের একজন বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজের হরি ডোম। উব সাহেবের সুপারিশে এই স্থলে বহাল হইয়াছে। সার্জেন অবর্তমানে ব্যবচ্ছেদ বিষয়ে তাহার জ্ঞান যথোপযুক্ত। কমলাকান্ত ভবিষ্যতে একজন সার্জেন নিয়োগের উদ্দেশ্যে চাটুজ্যে মহাশয়ের নিকট তদবির করিবার প্রয়াস করিতেছে। আপাতত কমলাকান্ত হরি ডোমের ঠিক পশ্চাতে দাঁড়াইয়াছিল। সামান্য দূরত্ব রাখিয়া বিধুবিনোদ উহাদের কর্ম পদ্ধতিতে নজর করিতেছে। সময়ের অপব্যবহার হিসাব করিয়া তাহার বিরক্তি উৎপাদিত হইতেছিল। ইতিমধ্যে উক্ত দারোগা সংবাদ পাঠাইয়া ছিল যে নিকটবর্তী এক কষাইখানা হইতে হত্যার অস্ত্রটি কেহ চুরি করিয়াছিল, খবর পাইয়া তিনি কষাইটিকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন। কিন্তু বিধুবিনোদ আশ্চর্য হইয়া গেল যখন দেখিল সংবাদ পাইয়াও কমলাকান্ত তাহার জবানবন্দি লইতে উৎসাহ প্রদর্শন করিল না। বরং হরি ডোমকে লইয়া এই কক্ষে সময় বরবাদ করিতে রহিল।
কমলাকান্ত তাহার দপ্তরখানায় কিছু লিপিবদ্ধ করিতে করিতে বলিল, “ইহার নাম-ধাম বিষয়ে জানিবার উপযুক্ত কিছুই মৃতদেহের সহিত নাই। কোনওরূপ পরিচয় চিহ্নিত করিবার মতো কিছুই বহন করিতেছে না। অকুস্থলে কেহই ইহার পরিচয় জানে এরূপ দাবি করে নাই। এখন প্রশ্ন হইতেছে যুবকটি কলিকাতায় আসিল কোথা হইতে? পোশাক এবং চেহারা দেখিয়া সাকিন সম্পর্কে কোনওরূপ ধারণা করা অসম্ভব। বাংলাদেশ শুধু নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে এই জাতীয় পোশাক কেহ দর্শন করে নাই। তবে কি যুবক বিদেশি? বিধুবিনোদ, এই যুবক স্বয়ং একটি রহস্য। কষাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবার পূর্বে ইহার পরিচয় বিষয়ে কিঞ্চিৎ জ্ঞান আহরণ প্রয়োজন। বুঝিলে, বিধুবিনোদ!”
বিধুবিনোদ বলিল, “আমি নিশ্চিত যে এই যুবক অবশ্যই কোনও গ্রামদেশের জমিদারনন্দন। বাপের পয়সায় বিদেশ হইতে পোশাক আমদানি করিয়াছে। এখন কলিকাতার নিষিদ্ধ জীবন উপভোগ করিতে আসিয়া কোনওরূপে কিছু শত্রু উৎপাদন করিয়া ফেলিয়াছে এবং সেই শত্রু মধ্যে কেহ বা কাহারা কষাইখানা হইতে অস্ত্র সংগ্রহ করিয়া হত্যা করিয়াছে। হয়তো কষাই স্বয়ং হত্যাকারী। কোনও বেশ্যাপল্লীতে উভয়ের কোনও পূর্ব-সাক্ষাৎকারে কোনওভাবে কিছু মনোমালিন্য নিশ্চিত হইয়াছিল। দারোগা সহজেই কেস সল্ভ করিয়া ফেলিবে। আপনার কোনও প্রয়োজন হয়তো দরকার হইবে না।”
কমলাকান্ত তাহার খেরোর খাতায় লিপিবদ্ধ করিবার কর্ম স্থগিত রাখিয়া মনোযোগ সহকারে হরি ডোমের সহিত মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করিতে ব্যস্ত ছিল। এক্ষনে বিধুবিনোদ চুপ করিলে বলিল, “হইতে পারে। তবে আমার ধারণা ভিন্ন। জমিদারনন্দনেরা ইয়ার-দোস্ত সঙ্গ বিনা ভিন্ন রস আহরনে বাহির হয় না। তাহাদের সহিত লেঠেল দেহরক্ষী থাকারও সম্ভাবনা প্রবল। না থাকিলেও ইয়ার-দোস্ত কেহ না কেহ থাকিত। হয় আরও এক-আধটি মৃতদেহ কিংবা অন্তত হত্যার চাক্ষুষ সাক্ষী পাওয়া যাইত। কিন্তু তাহা হয় নাই। সুতরাং রহস্য ভিন্ন। হরি, দেখো দিকি ওটি কি? মনে হইতেছে জ্যাকেটের কলারের নিম্নে কিছু সেলাই করিয়া রাখা রহিয়াছে। যেরূপ খচখচ করিতেছে বোধকরি কিছু কাগজপত্র হইবে।”
হরি ডোম নিঃশব্দে হস্তের তিক্ষ্ণধার ছুরিকাঘাতে জ্যাকেটের কলারের নিম্নপ্রান্ত কাটিতে শুরু করিল। ইহা হরি ডোমের একটি বিশেষ গুণ এবং অধিক কথা না বাড়াইয়া কর্ম সম্পাদন করিবার এই অভ্যাস তাহাকে কমলাকান্তের প্রিয়পাত্র করিয়া তুলিয়াছে। কলার কাটিয়া হরি একগুচ্ছ কাগজ বাহির করিয়া কমলাকান্তের হস্তে সমর্পণ করে।
“কিম্ আশ্চর্যম!” এইসব হইতে নিশ্চিত বহু কিছু জানা যাইবে। হরি, তুই মৃতদেহটির পোশাক ছাড়াইয়া ব্যবচ্ছেদ আরম্ভ কর। আমি ততক্ষণ এই কাগজগুলি পরীক্ষা করিয়া দেখি। ”
দ্বিপ্রাহরিক আহারাদির পর মরচুরিতে অনুসন্ধান পর্ব শুরু হইয়াছিল। সূর্য এক্ষনে পশ্চিমে ঢলিতে শুরু করিয়াছে। কমলাকান্ত কাগজগুলি লইয়া পশ্চিমের গবাক্ষের নিকটে গিয়া দেখিতে শুরু করিল। প্রথম কাগজটি একটি মানচিত্র বিশেষ। ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিয়া কমলাকান্ত বুঝিল মানচিত্রটি কলিকাতা নগরীরই। তবে একটু অন্যরকম। প্রথমত এটি কাঠখোদাই পদ্ধতিতে ছাপা হয় নাই। এমনকি এই জাতীয় ছাপার পদ্ধতি কমলাকান্তের অন্তত অপরিচিত। ঠিক করিলেন বউবাজারস্থিত ছাপাখানাগুলিতে এই বিজাতীয় পদ্ধতির সন্ধান করিতে হইবে। দ্বিতীয়ত, একদা কলিকাতা শহরের বুকে পদব্রজে দিনের পর দিন ঘুরাইয়া বেড়ানো এই কমলাকান্ত শর্মাও মানচিত্রের বহু স্থান চিনিতে পারিতেছে না। মানচিত্রে গঙ্গা বক্ষে কলিকাতা হইতে হাওড়া মধ্যে চার-চারটি সেতু দেখা যাইতেছে। এদিকে ময়দানের দক্ষিণ প্রান্তে একটি বিশাল স্থাপত্য দেখা যাইতেছে। আরও বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে যেটি প্রধান তাহা হইল পথের সংখ্যাধিক্য। এত শত পথ তো কলিকাতায় নাই! আরেকটি হইল নামের বাহার— বেশির ভাগই অপরিচিত। যে স্থলে লালদিঘি অবস্থিত সে স্থানে লিখিত রহিয়াছে এসপ্ল্যানেড । একি কোনও জ্যোতিষার্ণবকৃত ভবিষ্যতের কলিকাতা? কমলাকান্ত আরও লক্ষ করিল সম্পূর্ণ মানচিত্রের মধ্যে শত’খানেক স্থানে গোলাকৃতি লাল দাগ দেওয়া রহিয়াছে। দাগগুলি ছাপা নহে। কেহ যেন লাল রং-এর পেনসিল দিয়া গোল গোল দাগগুলি অঙ্কন করিয়াছে। বেশ কতকগুলি গোলকের মস্তক তারকা চিহ্ন মার্কা করা রহিয়াছে। আরও কিয়ৎক্ষণ লক্ষ করিবার পশ্চাতে সহসা কমলাকান্তের হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়িয়া উঠিল। একটি লাল গোলক রহিয়াছে মিসেস পেগীর কেক বিপনী যে স্থানে অবস্থিত সেই স্থানেই। তদুপরি এই গোলকটির মস্তকে খচিত রহিয়াছে একটি তারকা চিহ্ন। এবং সেই স্থানে আজ একটি মৃতদেহ আবিষ্কৃত হইয়াছে। আর সেই মৃতদেহেরই পোশাকে লুক্কাইত মানচিত্রের মধ্যে দেখা যাইতেছে সেই অকুস্থলটি তারকা চিহ্নিত অবস্থায় মার্কা করা রহিয়াছে। অতি আশ্চর্য! কমলাকান্তের এক্ষণে মনে হইল যে তবে কি কোনও ভয়ংকর হত্যাকারী পূর্বপরিকল্পনা করিয়া কলিকাতা শহরে দূষ্কর্ম করিতে আসিয়া দূর্ভাগ্যক্রমে স্বয়ং নিহত হইয়াছে! যুবকটি কে দেখিয়া তো সেরূপ মনে হইতেছে না। অবিশ্যি বহিরাবরণ দেখিয়া কেই বা কবে মনুষ্য চরিত সম্যক আন্দাজ করিতে পারিয়াছে!
হরি ডোমের কণ্ঠ কর্ণে আসিলে কমলাকান্ত গবাক্ষের দিক হইতে সরিয়া আসিলেন। হরি বলিতেছে, “সাহেব, এদিকে একটু দেখেন দিকি।”
হরি ইতিমধ্যে ছুরিকাঘাতে মৃতদেহের উপরিভাগের পোশাক কাটিয়া খুলিয়া ফেলিয়াছে। জ্যাকেট, জামা ইত্যাদি যাহা কিছু পরিধান ছিল সকল পোশাক মৃতদেহ হইতে খুলিয়া ফেলিয়াছে। এখন কমলাকান্তের উদ্দেশে ডাক ছাড়িয়াছে। কণ্ঠস্বরের কম্পন কমলাকান্তের কর্ণ এড়াতে পারে না। বিধুবিনোদ উহার দীর্ঘ গ্রীবা লম্বিত করিয়া দেখিতেছিল। চক্ষুদ্বয় রসবড়ার ন্যায় বিষ্ফারিত। কিঞ্চিৎ উত্তেজিত। বলিল, “তাই বলি, দাড়ি গোঁফ কামায়নি, অথচ অমন পেলব গন্ড পাইল কোথা!” হরি ডোমের অঙ্গুলি অনুসরণ করিয়া কমলাকান্ত দেখিতে পায় মৃতদেহের বক্ষে দুটি সুবর্তুল স্তন। কমলাকান্ত একমুহূর্ত কিছু ভাবিল। তৎপশ্চাৎ হরি ডোমকে পুনরায় অগ্রসর হইতে ইশারা করিল। হরি ডোম কম্পিত হস্তে মৃতদেহের নিন্মাঙ্গের পোশাক কাটিতে শুরু করিল। আর প্যান্টালুন ইত্যাদি কাটিবার পর নিরাবরন মৃতদেহের সকল স্ত্রী অঙ্গ স্পষ্ট দেখিয়া কমলাকান্ত নিশ্চিত হইল মৃতদেহটি প্রকৃতপক্ষে কোনও স্ত্রীলোকের। রহস্য আরও ঘনীভূত হইল। এ যদি জমিদার বংশধর হইবে তো একাকী পুরুষের ছদ্মবেশে অকুস্থলে কী করিতে ছিল?
বিধুবিনোদ বলিল, “শাস্ত্রানুযায়ী পুরুষের পোশাক নারীর পক্ষে পরিধান করা তো নিন্দনীয়।”
কমলাকান্ত একবার বিধুবিনোদের দিকে তাকাইয়া প্রশ্ন করিল, “কোন শাস্ত্রানুযায়ী?” বিধুবিনোদ চুপ করিয়া রহিল। মনে মনে ভাবিতেছিল হইবে না কেন, এরূপ দুষ্টা নারীর সঠিক শাস্তি হইয়াছে। তবে তর্ক অধিক করিল না।
কমলাকান্ত অগ্রসর হইয়া এইবার মৃতদেহটি পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে নিরীক্ষণ করিল। ইতিমধ্যে দেহ মধ্যে রাইগার মরটিস আরম্ভ হইয়াছে। হরি ডোমের সহায়তায় অনুসন্ধান সম্পূর্ণ হইলে পর আদেশ করিল মৃতদেহটি একটি সাদা কাপড়ে ঢাকিয়া দিতে। হরি ডোম কর্ম সমাধা করিয়া ছুটি করিয়া বাহির হইলে কমলাকান্ত বিধুবিনোদকে বলিল, “আইস, দ্বিতীয় কাগজটি অনুসন্ধান করিয়া দেখা যাউক।”
হরি ডোম জ্যাকেটের কলার কাটিয়া যে ভাঁজকৃত কাগজ গুচ্ছ বাহির করিয়াছিল ইতিমধ্যে কমলাকান্ত লক্ষ করিয়াছিল উহাতে দুইটি পৃথক কাগজ রহিয়াছে। উপরেরটি একটি মানচিত্র। যাহা কমলাকান্ত ইতিমধ্যে দেখিয়াছে। এবং মানচিত্রে অকুস্থল সহ আরও শতাধিক গোলাকৃতি দাগ দেখিয়া আশ্চর্য হইয়াছে। তবে মানিতেই হইবে সে কিছুই আশ্চর্য নহে। কারণ এইবার কমলাকান্ত যখন দ্বিতীয় কাগজটি দেখিল তখন যেরূপ আশ্চর্য হইল তাহা সে তাহার ইতিপূর্বের জীবনে কদাপি হয় নাই। তাহার মুখ হইতে হইতে শুধু নির্গত হইল একটি শব্দ। “একি!”
বিধুবিনোদ গ্রীবা অগ্রসর করিয়া দেখিল। কিন্তু আশ্চর্য হইল না। বলিল, “এ তো আপনার তালিকা লিপির পাতা। একটু আগেই আপনি লিখিয়াছেন। আমি দেখিয়াছি।”
“লিখিতে দেখিয়াছ সত্য। তবে সে আমি লিখিয়াছি আমার খেরোর খাতায়। ওই তো এখনও রহিয়াছে টেবিলের উপরে। আমার দ্বিতীয় দপ্তর তালিকা নামা। আর এই কাগজটি বাহির হইয়াছে মৃতদেহের জ্যাকেটের অভ্যন্তর হইতে। সুতরাং এইটি আমার দপ্তরের নকল নিশ্চিত। তবে আশ্চর্যজনকরূপে একদমই এক। নকল হইলেও সম্পূর্ণ এক রকম। কাগজটিই শুধু অন্যরকম। অথচ আমার লিখিত অংশের কালি বোধকরি এখনও পর্যন্ত শুকায় নাই। তথাপি তাহার নকল ঘণ্টাকতক পূর্বে প্রাপ্ত মৃতদেহের নিকটে কীরূপে যাইতে পারে?”
কমলাকান্ত দুই অঙ্গুলিতে হস্তধৃত কাগজটি পুনরায় ঘষিয়া নিশ্চিত হইল। কাগজটি এক নহে। তাহার খেরোর খাতার কাগজের তুলনায় এই কাগজটি অধিক শুভ্র এবং অধিক শীর্ণ। আরও কিয়ৎক্ষণ নজর করিতে আরও কিছু পার্থক্য খেয়াল হইল। কমলাকান্ত আপনার খেরোর খাতার যে পাতাটিতে আজিকার হত্যার ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করিয়াছে তাহাতে ইহা লইয়া সবেমাত্র পাঁচটি ঘটনা লিপিবদ্ধ হইয়াছে। আর এই মুহূর্তে হস্তে যে কাগজটি রহিয়াছে তাহাতে আজিকার ঘটনার নিম্নে আরও কতকগুলি ঘটনা লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। সাধারণত কমলাকান্ত একটি পাতায় অনধিক বিংশতি ঘটনা লিপিবদ্ধ করিয়া থাকে। হস্তলব্ধ নকল কাগজটিতেও সেইরূপ রহিয়াছে। লিপিরূপ সম্পূর্ণ এমন যেন তাহারই হস্তে লিখিত হইয়াছে। প্রথম চারটি তালিকাভুক্ত লিখন যেন তাহার খেরোর খাতা হইতে উঠিয়া আসিয়াছে। নিহতের নাম-ধাম, অকুস্থল এবং তারিখ সহ যেস্থলে তদন্ত নিরূপিত হইয়া হত্যাকারীর পরিচয় লিখিত রহিয়াছে – সমস্ত এই কাগজটিতেও রহিয়াছে। এমনকি যে স্থলে কমলাকান্ত লিখিবার সময় হয়তো কাটিয়া ছিলেন, নকল কাগজটিতেও সেইরূপ কাটিবার চিহ্ন রহিয়াছে। পার্থক্য শুরু হইয়াছে তালিকার পঞ্চম লেখনী হইতে। কমলাকান্ত তাহার খেরোর খাতায় আজিকের তারিখে পঞ্চম ক্রমে লিখনটি কিয়ৎক্ষন পূর্বেই লিখিয়াছে। লিখিয়াছিল যে অদ্যকার তারিখে গ্রেট বাংলা স্ট্রিটের একটি কেক বিপনীতে একজন অপরিচিত যুবক কোন হত্যাকারীর রামদার আঘাতে নিহত হইয়াছে। সম্ভবত সে লিখনের কালি এখনও শুষ্ক হয় নাই। যদিও কমলাকান্ত ইতিমধ্যে জানিয়াছে মৃতব্যক্তি কোন যুবক নহে। যুবতী। কিন্তু ইহাও সত্য যে এখনও কমলাকান্ত তাহার খেরোর খাতায় নিহতের লিঙ্গ পরিচিতি পরিবর্তন করে নাই। তথাপি তাহার হস্তধৃত কাগজটিতে দেখা যাইতেছে পঞ্চম ক্রমের লিখনটি কাটিয়া পুনরায় লিখিত হইয়াছে। তাহারই হস্তাক্ষরে! কমলাকান্ত যে লিখন এখনও লিখে নাই সেই লিখন সে স্বচক্ষে দেখিতেছে। ইহা যদি আশ্চর্য না হয় তো আশ্চর্য আর কি হইতে পারে? কল্য রজনীতে সে আফিম খাইয়া ছিল অবশ্যই। কিন্তু তাহার মৌতাত এতক্ষণ রহিয়াছে তাহাও অবিশ্বাস্য। কমলাকান্ত পুনর্বার দেখিল। সত্য-সত্যই পঞ্চম ক্রমের লিখন কাটিয়া তাহারই হস্তাক্ষরে পুনরায় লিখিত হইয়াছে যে অদ্যকার তারিখে গ্রেট বাংলা স্ট্রিটের একটি কেক বিপনীতে রামদার আঘাতে এক যুবক নিহত হইয়াছে এইরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হইবার পর তদন্ত শেষে নিরূপিত হইয়াছে যে কোনও রূপ হত্যাকাণ্ড সেস্থানে সংঘটিত হয় নাই। অভিযোগকারী দিবাভাগেই মদিরার প্রভাবে নেশাগ্রস্ত হইয়াছিল। তবে যে স্থলে মৃতদেহ দেখিয়াছিল বলিয়া অভিযোগ আসিয়াছিল সেই স্থানে সত্যই রক্তপাতের চিহ্ন দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। সম্ভবত তাহা কাহারও পড়িয়া যাওয়ার কারণে সম্ভব হইয়াছে। খানা-মসরার পরবর্তীতে কেস খতম-রিপোর্ট সাবিদ হইয়াছে।
কমলাকান্তের মস্তক ঘূর্ণিত হইতেছিল। ইহা কীভাবে সম্ভব? ফিরিয়া দেখিল পশ্চাতের প্রস্তর নির্মিত টেবিলে ‘জলজ্যান্ত’ মৃতদেহটি এখনও একটি শ্বেত বস্ত্রে আচ্ছাদিত অবস্থায় শায়িত রহিয়াছে। অথচ তাহারই খেরোর খাতার নকল কাগজে তাহারই নিজস্ব হস্তের লিখনীতে অন্যরূপ ঘটনা লিপিবদ্ধ করা রহিয়াছে!
বিধুবিনোদ পশ্চাৎ হইতে গ্রীবা লম্বিত করিয়া নকল কাগজে লিখিত ভাষ্যটি পড়িয়া ফেলিয়াছে। এখন কাঁপিতে লাগিল। রাম নাম সহকারে কম্পিত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “মহাশয়, এই নারী অবশ্যই কোনও প্রেতিনী হইবে। আমাদিগের শীঘ্রই কালীঘাটে মায়ের নিকট পূজা দিতে হইবে। বলেন তো কল্যই ব্যবস্থা করি। আর আপনি শীঘ্রই এই ব্যবচ্ছেদ কাণ্ড বন্ধ করেন। মৃতদেহ চিড়িয়া-ফাড়িয়া তদন্ত উব সাহেবকেই করিতে দেন। আমাদিগের উহার প্রয়োজন নাই।”
কমলাকান্ত বিধুবিনোদের কথায় একবার ক্ষণিক থমকাইল। তাহার পর কঠিন দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিল। বিধুবিনোদ চুপ করিয়া গেল। কমলাকান্ত এইবার তালিকার ষষ্ঠ ক্রমের লেখনী পড়িতে শুরু করিল। আশ্চর্য হইয়া দেখিল যে তালিকার ষষ্ঠ ক্রমেও আজিকার তারিখ। চীৎপুর অঞ্চলের একটি ঠিকানা। কোন এক রামসদয় ঘোষ তাহার জামাতার হস্তে নিহত হইয়াছে এইরূপ বিবরণ লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। তাহারই হস্তের লেখা। যদিও কমলাকান্ত নিশ্চিত যে এ ঘটনা এখনও তাহার দপ্তরখানায় লিপিবদ্ধ হয় নাই। এইমাত্র খেরোর খাতা খুলিলেই তাহা প্রমাণিত হইবে। খুলিয়া সত্যই একবার দেখিবে কিনা ভাবিতেছিল। এমতাবস্থায় সহসা সম্মুখের দ্বারপ্রান্তে একটি গোলযোগ শুরু হইল। কমলাকান্ত বহির্দ্বারে পৌঁছাইয়া দেখিল দ্বাররক্ষীর পার্শ্বে একজন চাপরাসী উপস্থিত হইয়াছে। তাহার পশ্চাতে একজন সংবাদদাতা দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।
কমলাকান্ত প্রশ্ন করিবার পূর্বেই চাপরাসী বলিয়া উঠিল, “মহাশয়, চীৎপুর হইতে একটি হত্যাকাণ্ডের সংবাদ লইয়া একজন সংবাদদাতা আসিয়াছে।”
সহসা কমলাকান্তের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে যেন এক বিষ্ফোরণ হইল। চকিতে একবার হস্তধৃত কাগজটিতে চক্ষু বুলাইয়া সংবাদদাতাকে জিজ্ঞাসা করিল, “নিহতের পরিচয় কি রামসদয় ঘোষ? উহার জামাতাকে কি অকুস্থলেই আটক করা হইয়াছে?”
সংবাদদাতা তড়িঘড়ি বলিল, “আমার পূর্বেই কেহ সংবাদ লইয়া আসিয়াছে না কি? না মহাশয়, নিহতের পরিচয় রামসদয় ঘোষ হইলেও তাহার জামাতা অকুস্থলে ছিল না।”
কমলাকান্ত পিছন ফিরিয়া দেখিল বিধুবিনোদ এক্ষনে বংশপত্রের ন্যায় কাঁপিতেছে। কমলাকান্ত নিজের মধ্যেও এইবার একপ্রকার কাঁপুনির লক্ষণ অনুভব করিল। মন শক্ত করিয়া একবার পুনরায় মৃতদেহটি দেখিয়া লইয়া সংবাদদাতার উদ্দেশ্যে বলিল, “হাঁ, একজন ইতিপূর্বেই সংবাদটি বহন করিয়া লইয়া আসিয়াছে। তুমি চীৎপুরের দারোগাকে গিয়া সংবাদ দাও এই মুহূর্তে যেন ঘোষ মহাশয়ের জামাতাকে গ্রেফতার করা হয়। শীঘ্র যাও।”
সংবাদদাতা দ্রুত রওয়ানা হইলে পর কমলাকান্ত পুনরায় কক্ষমধ্যে ফিরিয়া আসিল।
কক্ষের দৃশ্যপটের কোনরূপ পরিবর্তন হয় নাই।
কমলাকান্ত ইতিমধ্যে খানিক ধাতস্থ হইয়াছে। কুঞ্চিত চক্ষে বিধুবিনোদকে লক্ষ করিয়া কী ভাবিয়া সিন্দুক খুলিল। এক ভরির মতো আফিম সিন্দুক হইতে বাহির করিয়া বিধুবিনোদকে দিল। বলিল, “বিধু, তোমার আজিকের পরিশ্রম অনেক হইয়াছে। এক্ষনে তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। গৃহে ফিরিয়া যাও। স্নানাদি এবং আহারাদির পর আফিম সেবনান্তে বিশ্রাম লহ। কল্য প্রভাতে শরীর সঙ্গ দিলে আসিও।”
বিধুবিনোদ সম্ভবত এইরূপ সুযোগ খুঁজিতেছিল। বিনা বাক্যব্যায় করিয়া আফিম সংগ্রহ করিয়া তৎক্ষণাৎ রওয়ানা হইল। কমলাকান্ত পশ্চাৎ হইতে আবার ডাকিল। বলিল, “আর হ্যাঁ। আজিকার এই হত্যাকর্ম বিষয়ে কাহারও সহিত কোনও রূপ বার্তালাপ করিও না। এমনকি গৃহিনীর সহিতও নহে। কথাটি মনে রাখিবে।”
বিধুবিনোদ মস্তক হেলাইয়া চলিয়া যাইলে কমলাকান্ত আরেকবার বস্ত্রাবৃত মৃতদেহটি কিয়ৎক্ষণ লক্ষ করিল। এইবার কমলাকান্ত স্বয়ং আফিমের প্রয়োজন অনুভব করিল। সেই কোন প্রাতে আফিসে আসিবার পর হইতেই একাদিক্রমে এমনতর ঘটনা একের পর এক ঘটিয়া চলিতেছে যে এইবার অল্প বিশ্রাম এবং অহিফেনের আমেজ বিনা আর চলিতেছে না। কমলাকান্ত মানচিত্র এবং তালিকা লিপিটি সিন্দুকে রাখিয়া দেরাজ হইতে আধভরি খানেক আফিম বাহির করিল। অতঃপর চাবি দিয়া সিন্দুক বন্ধ করিয়া বিশ্রাম গৃহ অভিমুখে চলিল। দ্বার বন্ধ করিবার প্রয়োজন নাই। দিবাভাগে মরচুরির দ্বারে প্রহরী মোতায়েন থাকে।
বিশ্রাম অন্তে (পাঠক পড়িবেন অহিফেন সেবনান্তে) কমলাকান্ত যখন পুনরায় মরচুরি গৃহে ফিরিয়া আসিল, দিবাকর ততক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করিতেছেন। গোধুলির আকাশে পক্ষীরা সকল কূলায় ফিরিয়া যাইতেছে। মরচুরির পশ্চাতে একটি প্রাচীন তিন্তীড়ি বৃক্ষে যাবৎ বায়সকূল কর্কশ কণ্ঠে বিশ্রম্ভালাপে ব্যস্ত। দ্বাররক্ষী দ্বার খুলিয়া দিলে কমলাকান্ত প্রবেশ করিল। কক্ষটির অভ্যন্তর ভাগের অবস্থা একই রূপ রহিয়াছে। সেই কৃষ্ণ গ্রানাইটের টেবিলে মৃতদেহটি তেমনি শ্বেত বস্ত্রাবৃত পড়িয়া রহিয়াছে। কক্ষের অন্য প্রান্তে তালাবন্ধ সিন্দুক এর পার্শ্বে একখানি কেদারা এবং একটি কাষ্ঠ নির্মিত টেবিল। কতকগুলি বহি-খাতার সহিত দোয়াত, কলম এবং কমলাকান্তের নিজস্ব দপ্তরের খেরোর খাতা দুইটি পড়িয়া রহিয়াছে। বাতায়নের পাল্লা খুলিতেই আশ্বিনের সন্ধ্যার শীতল বাতাস কক্ষে প্রবেশ করিল। কমলাকান্ত টেবিলের উপর রক্ষিত লম্ফটি ধরাইলে কক্ষ মধ্যকার অন্ধকার দূর হইল। অতঃপর আরেকটি লম্ফ ধরাইয়া দ্বারের নিকটে পিলসুজে রাখিল। এখন সিন্দুক খুলিয়া সেই মৃতদেহের জ্যাকেটের অভ্যন্তরে প্রাপ্ত কাগজ দুটি লইয়া কেদারাতে আরাম করিয়া বসিল। প্রথমেই মানচিত্রটির এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত খুঁটিয়া দেখিতে শুরু করিল। মানচিত্রটি অবশ্যই কলিকাতা নগরীর। নিঃসন্দেহে। কিছু স্থান অপরিচিত লাগিলেও অধিকাংশই কমলাকান্তের পরিচিত। নামাঙ্কনে কিছু অসঙ্গতি রহিয়াছে। কিছু স্থানের নাম পরিবর্তন করিয়াছে। কিছু নুতন স্থাপত্য যুক্ত হইয়াছে। কমলাকান্ত যে স্থানগুলি শূন্য জনমানবহীন বলিয়া জানে সেগুলিও মানচিত্রে দেখা যাইতেছে স্থাপত্যময় এবং বিভিন্ন পথ চিহ্নিত। আর বিভিন্ন স্থানের কতই না নামের বাহার! সল্টলেক, এসপ্ল্যানেড, ইত্যাদি ইত্যাদি। আশ্চর্যজনকরূপে মা গঙ্গার বক্ষে চার চারটি সেতু চিহ্নিত করিয়াছে। চীৎপুরে একটি রেলের স্টেশন দেখাইয়াছে। শেয়ালদা স্টেশনের জন্মইতো কিয়ৎকাল পূর্বে হইল! এই কলকাতা নামক স্টেশনটি আবার কোথা হইতে আসিল? আর পাতালরেল বস্তুটি কী রকম রেল? পাতালে যাইবার পথ তৈয়ারি হইয়াছে নাকি! মানচিত্রের নিম্নে দক্ষিণ দিকে ক্ষুদ্র অক্ষরের কিছু লিখা আছে। লম্ফের আলোতে পড়িতে অসুবিধা হইতেছে। দেরাজ হইতে একটি আতসকাঁচ বাহির হইল। চক্ষুর সম্মুখে রাখিতে অক্ষর গুলি বৃহৎ হইয়া ফুটিয়া উঠিল। কমলাকান্ত পড়িল “নিউ দিল্লী, ২০৩২”। দিল্লী তো পরিচিত। মোগলদিগের সাম্রাজ্যের রাজধানী রহিয়া ছিল বহুকাল। এই নিউ দিল্লী আবার কোন রাজ্যে? আর এই চারিটি সংখ্যা কি অর্থ বহন করিতেছে? কাগজটি সম্ভবত কোন বৃহৎ মানচিত্র পুস্তকের ২০৩২-তম মানচিত্র। অথবা অন্য কিছু বোঝাইতেছে? কমলাকান্ত কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া মানচিত্রটি টেবিলের উপর রাখিয়া দ্বিতীয় কাগজটি দেখিতে শুরু করিল। আশ্চর্য! তাহারই হস্তাক্ষরে লিখিত প্রতিটি লিখন। প্রথম হইতে শেষাবধি আরেকবার দেখিয়া লইয়া তৎপরে পুনরায় পশ্চিমের গবাক্ষের কিনারায় গিয়া হস্তধৃত কাগজটিতে লিপিবদ্ধ প্রতিটি লেখনী এক-এক করিয়া দেখিতে লাগিল। ষষ্ঠ ক্রম পর্যন্ত লিখন দেখা পূর্বেই সমাপ্ত হইয়াছে। সম্ভবত মৃত রামসদয় ঘোষের জামাতা ইতিমধ্যেই দারোগা হস্তে ধৃত হইয়া হাজতে ঢুকিয়াছে। কমলাকান্ত এইবার সপ্তম ক্রমের লিখন হইতে দেখিতে শুরু করিল। সপ্তম হইতে দ্বাবিংশতি ক্রম পর্যন্ত একাদিক্রমে বিভিন্ন ঘটনার তালিকা। তারিখগুলি সবই আগামী দিনের। মনে হইতেছে যেন কমলাকান্ত কোন এক বিশেষ শক্তির প্রভাবে জ্যোতিষার্ণব হইয়া ভবিষ্যতে ঘটতব্য ঘটনাগুলি পর্যায় ক্রমে লিখিয়া ফেলিয়াছে। তালিকার ব্যাপ্তি দেখিয়া বোধ হইতেছে যে আগামী কিছুকাল তাহার ব্যস্ততা ভালোই রহিবে। শুধুমাত্র বোধ হইবার অবশ্য আর প্রয়োজন নাই, বরং কিয়ৎক্ষণ পূর্বের চীৎপুরের ঘটনার ফলশ্রুতিতে কমলাকান্ত এক্ষণে একরূপ নিশ্চিত যে সত্যই ব্যস্ততা তাহার রহিবে। ঘটনাগুলির তারিখ অনুযায়ী দেখিলে দেখা যাইতেছে এই কাগজের শেষ লিখন অর্থাৎ দ্বাবিংশতিতম ঘটনাটি আজি হইতে দুই বৎসর পশ্চাতে ঘটিবে। অহো! আরেক আশ্চর্য। শেষের সেই ঘটনাটির লিখন কিন্তু তাহার হস্তাক্ষরে লিখিত হয় নাই। কমলাকান্ত উৎসুক হইয়া উঠিল। তাহার নিজস্ব খেরোর খাতায় অন্য কাহারও হস্তাক্ষর কীরূপে আসিল? তবে কি কমলাকান্ত আগামী দুই বৎসরের পূর্বেই অবসর লইবে? নাকি বরখাস্ত হইবে? যাহাই হউক না কেন পরবর্তী আলেখ্যদারের লিখিত লিখনটি কমলাকান্ত পড়িতে শুরু করিল। কিন্তু পড়িবার পর তাহার হৃৎপিণ্ডের গতি যেন রুদ্ধ হইয়া গেল। কমলাকান্ত দ্বিতীয় বার পড়িল। তৃতীয় বার পড়িল। অতঃপর কাগজটি টেবলের উপর রাখিয়া চুপটি করিয়া কেদারাতে হেলান দিয়া চক্ষু মুদিয়া বসিয়া রহিল। দ্বাবিংশতিতম ক্রমে লিখিত রহিয়াছে তাহারই নাম। অর্থাৎ সেটি আলেখ্যদার কমলাকান্ত চক্রবর্তীরই হত্যার ঘটনা এবং তাহা অন্য কাহারও হস্তে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। এবং লিপিবদ্ধ হইয়াছে কমলাকান্তের দপ্তরের তাহারই নিজস্ব খেরোর খাতায়। এবং কমলাকান্ত হতবুদ্ধি হইয়া ইহাও দেখিতে পাইল তালিকার দ্বাবিংশতিতম লিখন অনুযায়ী আলেখ্যদার কমলাকান্ত চক্রবর্তীর মৃতদেহ অনাবিষ্কৃত!
৭
ঘনশ্যামবাবু এবার যখন থামলেন ততক্ষণে সবার হাতেই ঝালমুড়ির ঠোঙা খালি হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ সবাই নিশ্চুপ। কমলাকান্তের দপ্তরের ধাক্কায় চারমূর্তির মুখেই যেন আর কথা নেই। মর্মরের মতো মসৃণ যাঁর মস্তিষ্ক সেই শিবপদবাবুকেই দেখা গিয়েছে সবার আগে ঘোর কাটিয়ে উঠেছেন। কিছু বলবার জন্য মুখ খুলতে গিয়েও কী যেন ভেবে এদিক ওদিক তাকিয়ে আর অন্য কোনও খাবারওয়ালাকে না দেখতে পেয়ে আবার সেই ঝালমুড়িওয়ালাকেই ডাক দিয়েছেন। এই মুহূর্তে মুখ-গহ্বরে চালান করার মতো কিছু জোগাড় না করতে পারলে নোবেল প্রাপ্তির জন্য আবার কাল বিকেলের দিকে হা-পিত্যেস করে বসে থাকতে হবে। সবার হাতে হাতে ঝালমুড়ির ঠোঙা চলে আসতেই আর একটুও দেরি না করেই এবার জিজ্ঞেস করেছেন, “ওই বাইশ নম্বরে নিজের নাম দেখে কমলাকান্ত কী করলেন? আর সামনের টেবিলের ওপর তো তখনও অনিলিখারই মৃতদেহ, ইয়ে মানে, শরীরটা, সেটা তো তখনও ওখানেই ছিল নাকি?”
শ্রীঘনশ্যাম একমুঠো ঝালমুড়ি মুখের ভিতরে চালান করে আয়েশ করে চিবোতে চিবোতে বলেছেন, “দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আগে দিই। হ্যাঁ, ওই শরীরটা অনিলিখারই। তখনও ওখানেই ছিল সেটা। তবে আজকের হিসেবে মৃতদেহ না বললেও সেদিনের হিসেবে ওটা তখন মৃতদেহই ছিল। অবিশ্যি আজকের হিসেবে অনিলিখার তো এখনও জন্মই হয়নি। তবে ওর মা-বাবার বিয়েটা এখনও হয়েছে কিনা সেটা অবশ্য আমি হিসেব না করে সঠিক বলতে পারব না। আর প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলি কমলাকান্ত চক্রবর্তী ঠিক ঘাবড়ানোর মতো মানুষ নন। অনেকটা আমার মতোই কিনা! বরং উনি তখন ওঁর পেশাগত দায়িত্ব আর মানবিক কর্তব্যের মধ্যে একটা দ্বিধার সমাধানের চেষ্টা করছিলেন।”
মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু বলেছেন, “দ্বিধা! কীসের? কেন?”
“দ্বিধা কীসের এবং কেন ধরতে পারলেন না তো?” দাসমশাই যেন রহস্যটা উদঘাটন করছেন এমনভাবে বলেছেন, “কমলাকান্তের হাতে তখন তাঁর নিজের হাতেই লেখা একটা তালিকা যাতে আগামী দু-বছরের মধ্যে ডজনেরও বেশি খুনের ঘটনা লেখা আছে। খুনের দিনক্ষণ, নিহতের নামধাম এবং হত্যাকারীর নাম – সব কিছুই রয়েছে তাতে। একমাত্র বাইশ নম্বরে, যেটা অন্য কারো লেখা বলে মনে হচ্ছে, সেটাতেই শুধু দেখা যাচ্ছে খুনির নামধাম কিছু নেই। অবশ্য সে সব পরের পাতাতেও লেখা হয়ে থাকতে পারে যেটা অনিলিখার কাছে পাওয়া যায়নি। তবে ওটা ছাড়া বাকি আর যে সমস্ত ঘটনাগুলো লেখা আছে, লেখা রয়েছে ওর নিজের হাতের লেখাতেই, যেগুলো এখনও ঘটেনি, কিন্তু ঘটবে তো অবশ্যই। আর রামসদয় ঘোষ মশায়ের ঘটনা থেকে সেটা তো ততক্ষণে একরকম নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গে কাগজটা থেকে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই তিনি হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে এবং ধরতে সক্ষম হবেন। এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু কমলাকান্ত সেই কারণেই এবার দ্বিধাগ্রস্ত। উচিত অনুচিতের দ্বন্দ্ব তখন তাঁর মনের মধ্যে। একদিকে নিহতের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাঁদের আগেই সাবধান করে দেওয়া যেতে পারে। তাতে তাদের প্রাণ বাঁচানো যেতে পারে। আবার হত্যাকারী হিসেবে যাঁদের নাম রয়েছে তাঁদেরকেও আগেই গ্রেফতার করা যেতে পারে। তাতেও তাদের প্রাণ বাঁচবে। কিন্তু সেটা করা হবে কী অভিযোগে? খুন করার আগে তো আর খুনের অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করা যেতে পারে না! আর তা যদি না করা হয় তবে তো তাঁরা তাঁদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করেই ফেলবে। নাকি ঘটনাস্থল বলে যেটা উল্লেখ করা আছে সেখানে আগে থেকেই সেপাই মোতায়েন করে দিলেই সুবিধা হবে? অথবা ঘটনা ঘটতে দিয়ে তারপর কাগজটায় লেখা হত্যাকারীকে গ্রেফতার করে কমলাকান্ত আরক্ষাবাহিনীতে নিজের সুনাম এই সুযোগে বাড়িয়ে নেবে?”
মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল ভবতারণবাবু উদগ্রীব স্বরে জিজ্ঞাসা করেছেন, “কী করলেন কমলাকান্তবাবু?”
উদাসভাবে মুড়ি চিবোতে চিবোতে শ্রীঘনশ্যাম বললেন, “কিছুই না। তস্মাত্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব / জিত্বা শত্রূন্ ভুঙ্ক্ষ্ব রাজ্যং সমৃদ্ধম্। / ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচি।। মারে হরি রাখে কে? যা হওয়ার তা তো হবেই, কমলাকান্ত নিমিত্ত মাত্র। কাজেই হাতের কাগজটা, যেটা হরি ডোম অনিলিখার তখনও-পর্যন্ত-মৃত দেহের জ্যাকেটের লাইনিং থেকে উদ্ধার করে দিয়েছিল, সেটা সামনের টেবিলের উপর রেখে দিয়ে চুপ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে যেমন বসে ছিলেন তেমনি বসে রইলেন। অন্তত যতক্ষণ না বিশু আর সীতু ওখানে গিয়ে পৌঁছালো।”
মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করেছেন, “ওরা তো একটু আগেই লাসায় আপনার কাছে গিয়েছিল। এখন আবার কমলাকান্তের ওখানে পৌঁছে গেল?”
আরও কয়েক মুঠো ঝালমুড়ি মুখের গহ্বরে ঢুকিয়ে নারকোলের ফালিটায় একটা কামড় বসিয়ে যেন বাচ্চাদের পড়া বোঝাচ্ছেন তেমন একটা ভঙ্গিতে ঘনশ্যামবাবু বলেছেন, “এছাড়া আর অন্য উপায় তো আমি খুঁজে পেলাম না। তাই ওদের ওখানে যেতেই হল।”
মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু বলে উঠেছেন, “ও, লাসা থেকেই ওরা সরাসরি কমলাকান্তের দপ্তরে চলে গেল?”
“না, না। লাসা থেকে প্রথমে আমরা এলাম কলকাতায়। এলাম না বলে গেলাম বলাই উচিত। গেলাম দু-হাজার বত্রিশের কলকাতায়। সোজা ইউনিভার্সিটির পার্টিকল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে। ওখানে বসেই পুরো ব্যাপারটা দেখলাম, শুনলাম আর বুঝে নিলাম প্রথমে। যন্ত্রটা এমন কিছু জটিল আর বিশাল কিছু নয়। কাচ আর স্টিলের তৈরি উপড়-নীচ চাপা একটা গোলক। তাতে প্লেনের পাইলটদের চেয়ারের মতো চারটে চেয়ার। একসঙ্গে চারজন সময় ভ্রমণে যেতে পারবে সেই হিসেবে বানানো। গোলোকটার ভেতরে আর বাইরে মিলিয়ে একগাদা যন্ত্রপাতি। আর বেশ কিছু কম্পিউটার আর তার মনিটর। পাশেই আরেকটা কংক্রিট আর দস্তার ছোট্ট একটা রুম। সেটা থেকে ওই সেই ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটারের মধ্যে পরিকল্পিত সংঘর্ষের মাধ্যমে উৎপন্ন এনার্জি নাকি সাপ্লাই হয় সময় ভ্রমণের যন্ত্রটাতে। যন্ত্রটার এছাড়া আছে আরেকটা অংশ। যে সময় ভ্রমণ করতে যাচ্ছে সে সেটা সঙ্গে নিয়ে যাবে। এই অংশটা একটা দেশলাইয়ের বাক্সের চেয়ে আকারে অল্প একটু বড়। এটা ফেরার সময় আসল যন্ত্রের সঙ্গে ভ্রমণকারীকে যুক্ত করে দেয়। এটা অতীত বা ভবিষ্যতে গিয়ে হারিয়ে ফেললেই মুশকিল। তখন তাঁর টাইম লাইন থেকে যদি অন্য কেউ সাহায্য না করে তবে আর সে ফিরে আসতে পারবে না। এসজিপিএস বলে একটা স্যাটেলাইট বেসড সিস্টেম দিয়ে ভ্রমণকারীকে টাইম আর স্পেস কন্টিয়ামে বেসক্যাম্প থেকে ট্র্যাক করা যায়। অনিলিখাকেও বিশু ট্র্যাক করছিল। কিন্তু হঠাৎ একসময় যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। বিশু বহু চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করে উঠতে পারে না। সীতাংশুকেও বিশু ডেকে পাঠায়। কিন্তু কোন লাভ হয় না। সীতাংশুর কাছে পুরো ব্যাপারটাই হায়ারোগ্লিফিক্সের মতো না হলেও কাছাকাছি। বিশু ঠিক করে উঠতে পারে না কী করবে। শেষে ওর মনে পড়ে আমার কথা। ছোটবেলা থেকেই ও আমার বহু গল্প বাড়িতে শুনেছে। যে সমস্ত সমস্যার সমাধান কেউ করতে পারে না সেখানেই যে আমার ডাক পড়ে এটা ওর জানা ছিল—”, ঘনশ্যামবাবু হঠাৎ কেন যেন চুপ করে গেলেন। একটা খুকখুকে কাশির আওয়াজ যেন ভেসে উঠেছিল, ঘনশ্যামবাবু চুপ করে যেতেই সেটা ডুবে গেল।
মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল যাঁর শরীর সেই ভবতারণবাবু তাড়াতাড়ি এক ঝলক শিবপদবাবুর দিকে তাকিয়ে নিয়ে যেন ঝাঁঝিয়েই উঠেছেন বলে মনে হল, “আপনার মনে হচ্ছে ঠান্ডা লেগে গিয়েছে। রাতে শোওয়ার আগে তিন-চার ড্রপ ব্রায়োনিয়া থার্টি নিয়ে নেবেন বরং। ঘনশ্যামবাবু আপনি বলে যান, এই সব ছোটখাটো ব্যাপারে নজর দিতে হবে না।”
ঘনশ্যামবাবু ভ্রু কুঁচকে একবার শিবপদবাবুর দিকে তাকিয়ে তাঁর পেটেন্টেড ফোৎ ফোৎ নাসিকা-ধ্বনি করে ভবতারণবাবুকে যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে জিজ্ঞেস করেছেন, “হ্যাঁ, আমরা কোথায় ছিলাম যেন? ও হ্যাঁ, বিশু তখনই ঠিক করলো ওকে বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনেই যেতে হবে। সেই মতো ও আর সীতাংশু পৌঁছে যায় বাহাত্তর নম্বরে। যদিও ওখানে পৌঁছেই জানতে পারে যে আমি তখন ওখানে নেই। তার ঠিক আগেই কাউকে কিছুই না জানিয়ে আমি তখনকার মতো বাহাত্তর নম্বর থেকে উধাও। তবে এই সুযোগে শিবুর নাতির অবশ্য একটা বিশাল লাভ হয়। ওর আগে আর কেউ নিজের অবিবাহিত ঠাকুরদাকে দেখেছে বলে আমার তো জানা নেই। অবশ্য শিবুর দিক দিয়েও ব্যাপারটা সেরকমই। যদিও বিশু ব্যাপারটা খোলসা করে না জানানোয় শিবু সেটা জানতেও পারে না। তবে সবাইকে অবাক করে দেখা গেল শিবু যেন কোনও এক অজ্ঞাত কারণে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিচ্ছে হঠাৎ আসা অনাহুত দুই যুবককে। যেটা বাহাত্তর নম্বরে সচরাচর দেখা যায় না। অন্তত ব্যাপারটা যদি ঘনাদা বিষয়ে হয় তো কদাপি নয়। তবে সেটা হল বলেই অবশ্য বিশুরা লাসায় এসে আমাকে ধরতে পেরেছিল। বিশু অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। নাটোভিচের নাতনীর মেয়ে-জামাই এসেছিল দেখা করতে, শুধুমাত্র এইটুকু খবরের উপর ভর করে দুই আর দুইয়ে চার করে সীতেকে নিয়ে সোজা লাসায় আমার কাছে এসে পৌঁছে গিয়েছিল। আর তারপরে আমার দু-হাজার বত্রিশের কলকাতায় যাওয়ার ঘটনা তো বললাম একটু আগেই। যতই হোক শিবুর নাতি বলে কথা। নাটোভিচকে দেওয়া কথা রাখতে অবশ্য লাসা আমাকে তারপরে আবার যেতেই হয়েছিল – তা সে দু-হাজার বত্রিশের কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর। সেবার অবশ্য সঙ্গে—”
শ্রীঘনশ্যামকে অন্য প্রসঙ্গে যেতে দেখে চারজনেই একসঙ্গে রে রে করে উঠেছেন। মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল যাঁর শরীর সেই ভবতারণবাবুতো ওই ভারী শরীর নিয়ে প্রায় লাফিয়েই উঠেছিলেন, তবে তার আগেই অবশ্য মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু বলে উঠেছেন, “লাসার ঘটনা কাল শুনব আমরা। আগে আপনি অনিলিখাকে কীভাবে ফিরিয়ে আনলেন সেটা আগে বলুন।”
“ওঃ! সেটা তে বলা বাকিই রয়ে গেল!” শ্রীঘনশ্যামের গলার সুর এবার যেন একটু অপ্রসন্ন মনে হয়েছে, “যদিও তাতে আমার সরাসরি তেমন কোনও ভূমিকা ছিল না। যা যা করার সব ওই বিশু আর সীতাংশু মিলেই করল। আমি শুধু ওদের কয়েকটা অঙ্ক বুঝিয়ে দিলাম আর পুরোনো কলকাতার কোথায় কী কী ছিল সেগুলো ওদের দু-হাজার বত্রিশের একটা ম্যাপে দাগিয়ে দিলাম। তাও তো পুরোনো ম্যাপট্যাপ সব ওরাই জোগাড় করে রেখেছিল।”
বাধা দিয়ে মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু বলে উঠেছেন, “তাঁর মানে আপনি বলতে চান, আপনি ওই অঙ্কগুলো বুঝিয়ে না দিলে বিশুরা সেটা করে উঠতে পারত না আর অনিলিখাকে ফিরিয়ে আনতে পারত না।”
“না,” ঘনশ্যাম দাস যেন অনুকম্পা ভরে বলেছেন, “আগেই তো বললাম যে বিশু যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং রিসার্চ স্কলার। কাজেই না পারার কোনও কারণই নেই। তবে ওই যে, আর কিছুটা দেরি হলেই হয়তো কমলাকান্ত অনিলিখার দেহটা বেওয়ারিশ মড়া বলে শ্মশানে পাঠিয়ে দিত। আর সেটা যদি একবার হয়ে যেত তবে আর অনিলিখাকে দু-হাজার বত্রিশে ফিরিয়ে আনা যেত না। আর সেক্ষেত্রে কলকাতার বাঙালির হাতে দ্বিতীয় নোবেল আসবার সম্ভাবনাও ওখানেই শেষ হয়ে যেত।”
“কমলাকান্ত অনিলিখাকে বেওয়ারিশ মড়া বলে পুড়িয়ে দিত!” আবার শ্রীঘনশ্যামকে বাধা দিয়ে মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবুই তীক্ষ্ণ স্বরে তাঁর সংশয় প্রকাশ করেছেন, “তা কী করে হয়? আপনি তো বললেন যে—”
“হ্যাঁ,” মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবু তাঁকে বাধা দিয়ে বলেছেন, “অনিলিখা কি সত্যিই মরে গিয়েছিল? আর সত্যি সত্যিই মরে গিয়ে থাকলে শুধু আপনার থেকে অঙ্ক বুঝে নিয়ে বিশু তাহলে ওকে বাঁচাল কী করে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”
“পারবেন। সবই বুঝতে পারবেন।” দাসমশাই উদারভাবে আশ্বাস দিয়েছেন, “তার জন্যে আর খুব বেশি অপেক্ষা করতেও হবে না। অঙ্কের ব্যাপারেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এ আমাদের কেশবের সেই কোনও বাঁদরের তৈলাক্ত দন্ডে ওঠা-নামা বা চৌবাচ্চায় জলের একদিক দিয়ে ঢোকা আর আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মতো জটিল কিছু অঙ্ক নয় কিংবা ক্যালকুলাসের ডেলটা-সিগমার মতো কোনও কঠিন ব্যাপারও এর মধ্যে ছিল না। অত্যন্ত সহজ সরল ব্যাপার। তবে কিনা যাঁরা বিজ্ঞানের ওপরের স্তরে ঘোরাফেরা করে অনেক সময় সহজ সরল জিনিসগুলো তাঁদের মাথায় আসেই না।”
“হ্যাঁ, ঠিক ঠিক!” রামশরণবাবু বিচক্ষণতা দেখিয়ে বলেছেন, “ওই জুতা আবিষ্কারের মতো ব্যাপার আর কি!”
“ভাষা! ভাষা সামলান রামশরণবাবু!” ভবতারণবাবু সাবধান করেছেন, “কাকে কী বলছেন! আমাদের ঘনশ্যামবাবু জুতার মতো সামান্য জিনিস আবিষ্কার করবেন! যিনি কিনা ফার্মির প্যারাডক্সের সমাধান করেও দুনিয়াকে জানালেন না শুধু এই কারণে যে তাতে বিজ্ঞানের প্রকৃত সাধকদের অপমান করা হবে। যাঁর কাছে স্বয়ং টেসলা সাহেব গোপনে এসে শলাপরামর্শ করে যান, তিনি কিনা জুতার মতো সাধারণ একটা পায়ের নীচের জিনিস আবিষ্কার করবেন!”
দাসমশাই খানিকক্ষণ নীরবে ঈষৎ হাস্যকুঞ্চিত মুখে সভাসদদের আলোচনা শুনছিলেন, এবার যেন ব্যাখ্যা করছেন এমন ভাবে বলেছেন, “না, না। কোনও আবিষ্কার-টাবিষ্কারের প্রয়োজন পড়েনি। খুবই সহজ সরল ব্যাপার ছিল। বিশু শুধু খেয়াল করেনি তাই আমাকে খোলসা করতে হল। তাতেই হয়ে গেল। আমি ওদের কন্ট্রোল রুমে বসে রইলাম। বিশু আর সীতে ওদের সময় ভ্রমণ যন্ত্রে ঢুকে অনিলিখা যে টাইম লাইনে গিয়েছিল সেই একই টাইম লাইনে রওনা হল। কলকাতার পুরোনো ম্যাপটায় আমার মার্কা করে দেওয়া দু-তিনটে জায়গায় পৌঁছেই অনিলিখাকে খুঁজে পেয়ে গেল। তারপর আমার বলে দেওয়া একটা কথা বলতেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। ব্যাস ওরা অনিলিখাকে নিয়ে ওঁদের নিজেদের টাইম-লাইনে ফিরে এল। অনিলিখা বেঁচে উঠল। এতদিনে বোধহয় ওরা ওই যন্ত্রটাকে আরও ঘষামাজা করে যেমন যেমন বলে এসেছিলাম তেমনটা বোধহয় করেও ফেলেছে।”
“দাঁড়ান! দাঁড়ান!” সমস্বরে দাসমশাইকে থামিয়ে বলে উঠলেন শিবপদ আর রামশরণবাবু, “এভাবে হয় নাকি? এ তো কী করিয়া কী হইল বুঝা গেল না, মোহন মাঝ নদীতে ভাসিয়া উঠিলোর মতো হয়ে গেল। কী কথা আপনি বলে দিয়েছিলেন যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল? অঙ্কটাই বা কী ছিল? অনিলিখা আবার বেঁচেই বা উঠল কী করে?”
“আমি তখনই বলেছিলাম না,” রামশরণবাবু নিজের বিচক্ষণতাকে নিজেই তারিফ করেছেন, “যে ঘনশ্যামবাবু নিশ্চয়ই দারুণ কিছু আবিষ্কার করেছেন। শেষ পর্যন্ত সেটা দিয়েই সব হল, তাই না ঘনশ্যামবাবু?”
“না, নতুন কোনও আবিষ্কারের দরকার হয়নি। প্রাচীন জ্ঞান দিয়েই কাজ হয়েছে। প্রথমত বিশু আর সীতাংশু ম্যাপে আমার দাগিয়ে দেওয়া জায়গা মতো পৌঁছে মিসেস পেগীর বেকারিতে খবর নিয়ে জানতে পারে কমলাকান্তের কথা। তারপর সেই ম্যাপ-মাফিক কমলাকান্তের অফিসে পৌঁছে যেতেই অনিলিখাকে খুঁজে পায় আর কমলাকান্তকে আমার বলে দেওয়া কথাটা বলতেই ওই প্রথম সমস্যাটা মিটে গিয়েছিল। আর অঙ্কটা? ওটা তো একটা সহজ ব্যাপার। অনিলিখা তো মরেছিল আঠেরোশো সাতষট্টিতে। ওই সময়ে তো তখনও ওর জন্মই হয়নি। যে এখনও জন্মায়নি সে কীভাবে মরতে পারে? জন্মিলে মরিতে হইবে এটা যেমন সত্য, তেমনি উলটোটাও তো সত্যি, নাকি? ফেরার পথে শুধু অনিলিখাকে তাঁর জন্মের টাইম-লাইন ঘুরিয়ে দু-হাজার বত্রিশে ফিরিয়ে আনতেই ও বেঁচে উঠল। ওকে তো এবার আবার মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে যে ও মরে নাই!”
“আর সেই কথাটা কী ছিল?” উদরদেশ যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত, ভোজনবিলাসী সেই রামশরণবাবু এবার বাধা না দিয়ে বুঝি পারলেন না, “যেটা বলাতে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছিল?”
“সেটা একটা গোপন কথা, বললেন ঘনশ্যাম দাস, “ওটা কমলাকান্তের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আপনারা বুঝতে পারবেন না বলেই বলছিলাম না। একান্তই যখন শুনতে চাইছেন তো শুনুন— বিশুকে বলে দিয়েছিলাম অসুবিধা হলে জানিয়ে দিতে যে ওরা চাটুজ্যে মশাইয়ের বুজুম ফ্রেন্ড ঘনশ্যামবাবুর নিজের লোক। তাতেই কাজ হয়ে গিয়েছিল। না হলে অবশ্য আমাকেই আবার কষ্ট করে ওখানে যেতে হত। কমলাকান্ত এমনিতে অবশ্য সহজ লোক নন। তবে কিনা অনিলিখার কাছ থেকে পাওয়া লিস্টের শেষ নম্বরে নিজের নামটা দেখার পর থেকেই মনটা তাঁর এমনিতেই বোধহয় একটু নরম হয়ে গিয়েছিল। কে জানে ততক্ষণে কয়েক ছিলিম চড়িয়ে নিয়ে ছিল কিনা! তবে কাজ হয়ে যাওয়ায় বিশুরা আর কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা ফেরার রাস্তা ধরেছিল বলে সেটা আর জানা যায়নি!”
শ্রীঘনশ্যাম দাসকে থামতে হয়েছে। উদরদেশ যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত সেই রামশরণবাবুর গলা থেকে জলে কুম্ভ নিমজ্জনের মতোই একটা খাবি-খাওয়া গোছের আওয়াজ ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। আওয়াজটা এমনিতে এমন কিছু মারাত্মক নয়, বোধহয় শ্রীঘনশ্যামকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও দ্বিধায় সংকোচে আটকে গিয়ে ওরকম শোনা গিয়েছে।
দাসমশাই অস্ফুট বক্তব্যটা সঠিক অনুমান করে নিয়ে বলেছেন, “ও আপনারা তো আবার শুধু চাটুজ্যে মশাই শুনে কিছুই বুঝতে পারবেন না। বঙ্কিমচন্দ্রকে আমি চাটুজ্যে মশাই বলেই সম্বোধন করতাম সেই—”
দাসমশাইকে আবার থামতে হয়েছে! এবার বাধা দিয়েছেন মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু। দাসমশাইয়ের খানিক আগে করা উন্নাসিক কৃপা কটাক্ষগুলো এখনও ভুলতে না পেরে শিবপদবাবু জিজ্ঞাসা করেছেন, “মানে?, বঙ্কিমচন্দ্র আবার এর মধ্যে কোথা থেকে এলেন? ওঁর সঙ্গেও আপনার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল নাকি?”
“এলেন মানে?” দাসমশাই অনুকম্পাভরে চেয়ে বলেছেন, “আঠেরোশো সাতষট্টিতে উনিই তো তখন আলিপুরের অস্থায়ী ডেপুটি কালেকটর ছিলেন। আর সাক্ষাৎ পরিচয় এর কথা যদি বলেন তো শুধু এইটুকুই বলব যে তা না থাকলে আঠেরোশো ছেষট্টিতে কপালকুন্ডলা আর নবকুমারের মধ্যে দেখাই হত না।”
শিবপদবাবু সামলে ওঠবার আগেই মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠেছেন, “ওসব জেনে কী হবে, আপনি বরং বলুন চাটুজ্যে মহাশয়ের নাম শুনেই কমলাকান্ত কেন অনিলিখার মৃতদেহটা বিশুদের হাতে ছেড়ে দিল?”
“ছেড়ে কেন দিল?” দাসমশাই-এর মুখে সহিষ্ণুতার মৃদু হাসি এবার দেখা গিয়েছে, “প্রথম কারণ – ভীষ্মদেব খোসনবীসের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যখন কমলাকান্ত ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখন এই চাটুজ্যে মশাই-ই তাঁকে আরক্ষাবাহিনীতে আলেখ্যদারের চাকরিটার ব্যবস্থা দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় কারণও আরেকটা ছিল যেটা একটু আগেও বলেছি। নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণ জানতে পারলে আপনি হয়তো অনিলিখা তো দূরের কথা শোভরাজকেও হয়তো ছেড়ে দেবেন।”
“সে না হয় ছেড়ে দেওয়া যাবে, কিন্তু অনিলিখা মরতে ওই মিসেস পেগী বেকারিতে খামোখা গেলই বা কেন আর ওই খুনে হারানচন্দ্র না কে, সে ওকে খুন-ই বা করল, ইয়ে মানে, খুন করতে চেষ্টাই-বা করল কেন সেটা তো পরিষ্কার হল না!”
শিবপদবাবুর বিস্মিত মন্তব্যে বিদ্রূপের খোঁচা নিশ্চয়ই খানিক ছিল, কিন্তু দাসমশাই-এর নির্বিকার প্রশান্তি তা ভেদ করতে পারল না।
বরং এরকম একটা উপযুক্ত প্রশ্নে যেন খুসি হয়ে তিনি ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন, “ওটা ঘটেছিল দুটো কারণে। প্রথম কারণ অনিলিখা নিজেই। আঠেরোশো সাতষট্টি-তে ওর যাওয়ার পিছনে বিশেষ দুটো উদ্দেশ্য ছিল সেটা তো বলেইছি। এক – গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের সমাধান আর দুই – মৃত্যুর পূর্বেই রামসদয় ঘোষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নবাবী খাজানার সন্ধান জোগাড়। সাতষট্টিতে পৌঁছেই ও ঠিক করে এক ঢিলে দুই পাখি মারবে। রামসদয় ঘোষের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে তাঁর হত্যার দিনক্ষণ আর খুনির পরিচয় জানিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে নবাবি খাজানার সন্ধান চেয়ে নেবে। এতে রামসদয় ঘোষের মৃত্যু না হলে তাঁর জামাইয়ের তো আর ফাঁসি হবে না। ওই রক্তধারায় বংশ-পরম্পরা চালু থাকবে। তাতে প্রথম উদ্দেশ্য – গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের পুরোটা না হলেও আংশিক পরিবর্তন হবে। আর হারিয়ে যাওয়া নবাবি খাজানার খোঁজ স্বয়ং সত্ত্বাধিকারীর কাছ থেকে পেয়ে গেলে সেটা ওদের রিসার্চ পেপারে অতীত ভ্রমণের ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রমাণ হিসেবে দেওয়া যাবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে রামসদয় ঘোষের মৃত্যুর দিন সকাল সকালই তাঁর কাছে অনিলিখা পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু লাভ কিছু হয় না। কেননা রামসদয় ঘোষও তেমন সহজ লোক ছিলেন না। থাকার কথাও না। ইংরেজদের সঙ্গে ব্যাবসা করে খাচ্ছেন, সেই যুগেও সহজ লোক হলে সেটা সম্ভব হত না। তা ছাড়া হঠাৎ অপরিচিত কেউ এসে তাঁকে জানাবে যে সেই দিনই তাঁর মৃত্যু হবে এবং মৃত্যুর কারণ আর সেটা থেকে বাঁচার উপায় জানানোর বিনিময়ে বংশ-পরম্পরায় রক্ষা করে আসা নবাবি খাজানার সন্ধান দাবি করবে আর রামসদয় ঘোষ সেটা গলগল করে বলে দেবেন এটা উনি কেন আর যে কেউ হলেও হয়তো সম্ভব হত না। হলও না। অনিলিখাকে ব্যর্থ হয়েই ফিরে যেতে হয়েছিল। এদিকে অনিলিখা চলে যেতেই ঘোষ মশায়ের দরবারে ডাক পড়েছিল তাঁর নিজস্ব লেঠেল দলের প্রধান হারানচন্দ্রের। তখনকার কলকাতায় প্রায় সব বড় মানুষদেরই নিজস্ব লেঠেল বাহিনী থাকত। পোষা খুনেও থাকত কারো কারো। হারানচন্দ্র ছিল তেমনই এক পোষা খুনে। ঘোষ মশায়ের ব্যবসা ঘটিত রেষারেষির যাবতীয় খুনখারাপির কাজকারবার সেই দেখা শোনা করত। বংশ-পরম্পরায় রক্ষা করে আসা নবাবি খাজানার সংবাদ জেনে যাওয়া অপরিচিত কাউকেই বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে ঘোষ মশায়ের ছিল না। আর হারানচন্দ্রের তো মালিকের ইচ্ছেই তার ইচ্ছে। তো অনিলিখাকে অনুসরণ করে হারানচন্দ্র পৌঁছে গিয়েছিল মিসেস পেগীর বেকারিতে। তারপর সুযোগ বুঝে… ব্যাস।”
মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু যেন উত্তেজনা আর রাখতে পারছেন না। দাসমশাই থামতেই বলে উঠেছেন, “কিন্তু এত জায়গা থাকতে অনিলিখা ওই মিসেস পেগীর বেকারিতেই বা কেন গিয়েছিল?”
“কেন গিয়েছিল?” দাসমশাই-এর মুখে সহিষ্ণুতার মৃদু হাসি এখনও দেখা যাচ্ছে। মুখের সেই হাসি ধরে রেখেই বলেছেন, “একে তো নয়া দিল্লির কিউরিও শপে পাওয়া সেই লিস্টে মিসেস পেগীর বেকারিতে ওই দিনের তারিখে এক অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ ছিলই। যেখানে প্রত্যক্ষদর্শী কৃত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের তদন্ত শেষে আরক্ষাবাহিনী জানতে পেরেছিল যে প্রকৃত অর্থে সেদিন সেখানে কোন হত্যাকাণ্ড ঘটেইনি। তা ছাড়াও সকাল সকাল খিদে পেলে আর সেই সঙ্গে কাছেই কোনও বেকারি দেখতে পেলে আপনি কী করতেন? অনিলিখা আবার এমনিতেই কেক খেতে খুবই ভালোবাসে। তাই এমনও হতে পারে খিদের মুখে সামনে বেকারি পেয়েই ঢুকে পড়েছিল। তবে এমনিতেই পরিকল্পনা অনুযায়ী অনিলিখাকে ওখানে যেতেই হত। খানিক আগে বা পরে।”
“ঠিক, ঠিক,” হঠাৎ উত্তেজিত উচ্ছ্বাস শোনা গেছে, “অনিলিখাকে তো ওখানে যেতেই হত। খানিক আগে বা পরে।” অন্য আর কারো কণ্ঠে নয়, ওই উচ্ছ্বাস শোনা গেছে মেদভারে যিনি হস্তীর মতো বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবুর কণ্ঠে।
দাসমশাই কি বিরক্ত হয়েছেন?
সান্ধ্য-আসরের প্রত্যেকেই প্রায় তটস্থ হয়ে চেয়েছেন তাঁর দিকে। এ ধরনের মূঢ় বেয়াদবির ফল কী হতে পারে, তাঁদের অজানা নয় সেটা। দাসমশাই মুখে একেবারে তালাচাবি দিতে পারেন। মাঝপথে পূর্ণচ্ছেদ পড়তে পারে কাহিনির ধারায়।
বাধা পেয়ে দাসমশাই একটু ভ্রুকুটিভরে তাকাতে বেশ একটু অপ্রস্তুত হলেও ভবতারণবাবুর তাঁর পরের বক্তব্যটা না বলে শেষ করতে পারেননি।
কুণ্ঠিত ভাবে দুবার ঢোক গিলে এবার বলেই ফেলেছেন, “কিন্তু সেক্ষেত্রে রামসদয় ঘোষ মশাইকে তাঁর জামাই হঠাৎ সেদিনই খুন করতে গেল কেন?”
বলে ফেলে ভবতারণবাবুর কাঁচুমাচু, সভার অন্য সবাই একটু দিশাহারা।
ঈষৎ কুঞ্চিত চোখে ভবতারণবাবুর দিকে চেয়ে তিনি বলেছেন, “বিজ্ঞান জগতে যারা যারা এই সময় ভ্রমণ নিয়ে কাজ করছেন আমি তাদেরকে সবাইকেই এই একটা ব্যাপারে সবসময়ই সাবধান করে থাকি। এই জানুয়ারিতেই হকিং সাহেবের সঙ্গেও এই নিয়ে আলোচনা করে এলাম। ওঁর খুব ইচ্ছে আজ না হলেও কাল ওই সময় ভ্রমণের সাহায্যে উনিশশো পঁয়তাল্লিশের ছয়ই আগস্ট সকালে এনোলা গে প্লেনটাকে হিরোসিমায় পৌঁছোনোর আগেই কোনওভাবে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়ার। ওই নিয়েই আলোচনা ছিল। আমি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলাম যে সময় ভ্রমণ যত খুশি করুন ইতিহাসের সময় রেখায় ঘটে যাওয়া ঘটনাকে পালটে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। ফল অতি মারাত্মক। অনিলিখার চেষ্টাটাই দেখুন। সেদিন সকালে ওর রামসদয় ঘোষের সঙ্গে দেখা করে ওই সামান্য ঘটনা পরিবর্তনের চেষ্টা কী বিপদ না ডেকে আনল! হয়েছে কি যে সেদিন সকালেই ওঁর মেয়েজামাই বাড়িতে এসেছিল। আর তখনই কোনওভাবে পর্দার আড়াল থেকে শ্বশুরমশাই আর অনিলিখার মধ্যে হওয়া গুপ্তধন সম্পর্কে আলোচনা জামাইয়ের কানে চলে আসে। অবশ্য ওঁর জামাইও আরেক ঘোড়েল মানুষ। পরে সুযোগ পেতেই সম্ভবত শ্বশুরমশাইকে চেপে ধরে গুপ্তধনের খবরের ব্যাপারে। সেই নিয়ে তর্কাতর্কি আর শেষে খুন। জানি না জামাই বাবাজীবন গুপ্তধনের খোঁজ বের করতে পেরেছিল কিনা। তবে লাভ কিছু নিশ্চয়ই হয়নি। সেদিনই তো কমলাকান্তের কাছে সংবাদ পেয়ে পুলিশ ওকে গ্রেফতার করে। পরে তো ফাঁসিই হয়ে যায়।”
“সবই তো বুঝলাম!” শিবপদবাবু যেন কিছুতেই আজ আর নীরব থাকতে পারছেন না, “কিন্তু আসলে ব্যাপারটা ঠিক কী হল? বিশুরা যদি অনিলিখাকে নিয়ে দু-হাজার বত্রিশেই ফিরে গেল তো কমলাকান্ত কীভাবে ওখানে গিয়ে পৌঁছোলেন যে ওঁদের রিসার্চ পেপার লেখালেখি করতে শুরু করলেন?”
“সেটা জানতে হলে তো আপনাদেরকে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।” দাসমশাই সকলকে যেন তৈরি হবার সুযোগ দিতে একটু থেমে হঠাৎ নাটকের যবনিকা তুললেন, “অনিলিখা ফিরে এসে পুরো ঘটনাটা জানবার পর আর ওর সেই লিস্টে দু-বছর পরেই কমলাকান্তের মৃত্যুর দিনক্ষণ নির্দিষ্ট রয়েছে জেনে ও আবার ওখানে ফিরে যায়। তবে এবার টাইমলাইনটা একটু পালটে নিয়েছিল। আঠেরোশো সাতষট্টি নয়, আঠেরোশো উনসত্তর থেকে কমলাকান্তকে তাঁর মৃত্যুর নির্দিষ্ট দিনের ঠিক আগেই অনিলিখা নিয়ে চলে আসে দু-হাজার বত্রিশে। আমার সঙ্গে অবশ্য আলোচনা করেই নিয়েছিল। চাটুজ্যে মশাই ততদিনে অবশ্য আবার আলিপুর থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে গিয়েছেন। কাজেই কমলাকান্তকে রাজি করানোটাও সহজ হয়েছিল। ওদিকে আমার সমর্থন পেয়ে যাওয়ায় বিশুরা অনিলিখাকে আবার অতীত ভ্রমণ করা থেকে আটকাতেও পারেনি। আমি অবশ্য অনিলিখাকে কমলাকান্তকে নিয়ে ফেরত আসার আগেই এখানে ফিরে আসি। নটোভিচের সমস্যা সমাধানের একটা তাড়া তো ছিলই। তাই আমার সঙ্গে কমলাকান্তের আর দেখা হয়নি। তবে এটা জানি যে রিসার্চ পেপার রেডি হচ্ছে আর নোবেলটা নিশ্চিত আসছেই।”
শ্রীঘনশ্যাম চুপ করলেন। এবার বোধহয় উঠে পড়বেন। শিবপদবাবু গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছিলেন। “হুঁ,” ওঁর মুখে একটা কেমন যেন রহস্যময় হাসি ফুটেছে বলে সবার মনে হয়েছে, “কিন্তু কমলাকান্ত চক্রবর্তী মহাশয় যদি দু-হাজার বত্রিশেই চলে গেলেন তো “কমলাকান্তের পত্র” আর “কমলাকান্তের জোবানবন্দী” কীভাবে অত দিন আগে লেখা হয়ে ছিল? আর আলেখ্যদার হিসেবে ওঁর লেখা সেই নতুন দপ্তরখানাটাই বা কোথায় গেল?”
“সেটাই যদি বুঝবেন তো ডিস্টোপিয়ান ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং-এর মতো সোনার পাথরবাটি লেখার চেষ্টা কেনই বা করবেন! দু-হাজার বত্রিশের কলকাতায় অন্য আর যা কিছু উন্নতিই হয়ে থাকুক না কেন গঞ্জিকা নামক বস্তুটা জোগাড় করা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। আর সিগারেট জিনিসটা কমলাকান্তের কিছুতেই ঠিক পোষালো না। ওদিকে নেশার ওই সামান্য জিনিসটুকু আর মঙ্গলা গাইয়ের দুধটুকু না পেলে ওঁর আর দিন চলছিল না। কাজেই ব্যাক টু প্যাভেলিয়ন। যদিও অনিলিখাকে রাজি করাতে ওঁকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। শেষমেশ হাতের পাঁচ আলেখ্যদারের দপ্তরখানার খেরোর খাতা দুটো জমা রেখে আবার পরে ফিরে আসবার কড়ারে অনিলিখাকে রাজি করিয়ে ফেরত যান। ওদিকে ফিরে গিয়ে দেখেন আরক্ষাবাহিনীর চাকরিটাও আর তখন নেই। তাই তখন বঙ্গদর্শনে আবার চিঠিপত্র লেখালেখি করে দু পয়সা আয়ের একটা চেষ্টা অবশ্যই করেছিলেন। ঠিক সেই সময়েই বোধহয় একবার প্রসন্ন গোয়ালিনীর কোনও কেসে সাক্ষীর কাঠগড়াতেও উঠেছিলেন। তবে সে অন্য ঘটনা।”
শ্রীঘনশ্যাম দাস মহাশয় উঠেই পড়লেন এবার। ঠিক এই সময়ে মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু বলে উঠেছেন, “আচ্ছা, ওই যে লিস্টে আরও একগাদা যে খুনের আর খুনীর তালিকা ছিল সেগুলো নিয়ে কমলাকান্ত ঠিক কী করেছিলেন? মানে খুনগুলো হতে দিয়েছিলেন না আটকে দিয়েছিলেন?”
চলে যেতে যেতে একটুখানি দাঁড়িয়ে শ্রীঘনশ্যাম ওদের দিকে তাকিয়ে যেন হালকা হেসে বলেছেন, “সে আরেক বৃত্তান্ত। সেটা বোঝাতে হলে আবার প্রথমে বুটস্ট্র্যাপ প্যারাডক্স বোঝাতে হবে। সে অনেক সময়ের ধাক্কা। আরেক দিন বলা যাবে।” আর দেরি না করে লম্বা লম্বা পা ফেলে রওনা হলেন শ্রীঘনশ্যাম। আর এর পরেও চোখগুলো যদি সভাসদদের চড়কগাছ না হয় তাহলে সে কি তাঁদের চোখের দোষ?
Tags: উপন্যাস, ঘনাদা, রুদ্র দেব বর্মন, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
বেশ ঘনাদা ঘনাদা সুগন্ধ পাওয়া গেল কাগজটার মধ্যে – যদিও এই কাগজটা খেরোর খাতার দ্বিতীয় কাগজের থেকেও অনেক সূক্ষ! এমনকি এর মধ্যে কাগজের নামগন্ধ খুঁজে পাওয়াই বেশ কষ্টসাধ্য। নির্ঘাত বউবাজারে ছাপানো!