চাঁদের মাঠে ওয়ান ডে
লেখক: সিদ্ধার্থ ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
১
“হ্যালো! আবির? আমি দিব্য বলছি!” সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতে পারল না আবির। “শুনছিস? কাল সুপারটাউনের সঙ্গে ম্যাচ। ঠিক এগারোটায়…”
“সরি। কাল আমার মর্নিং ডিউটি— দুটোয় ছুটি!”
“শোন আবির!” গলাটা নামিয়ে দিব্য যেন খুব গোপনীয় খবর ফাঁস করার ভঙ্গিতে বলল, “কালকের ম্যাচটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সব কথা এখন বলা সম্ভব নয়। কিন্তু কাল যদি না খেলিস খুব ভুল করবি।”
এই সিজনে একদিনও নেটে যায়নি আবির। চাকরিতে ঢোকার পর থেকে প্র্যাকটিস ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। দুটো ম্যাচে কোনও রানও পায়নি। আগের ম্যাচে তাকে বসিয়ে দিয়েছিল এই দিব্যই। তবু মুখ ফুটে কিছুতেই বলতে পারে না যে, টুয়েলভথ ম্যান হয়ে টিমের সেবা করার কোনও ইচ্ছে বা সুযোগও নেই।
আবিরের মনের কথাটা বুঝে নিয়েই যেন দিব্য যোগ করল, “কাল আমি নামছি না, তাই তোকে খেলতেই হচ্ছে। সি ইউ…”
“কে ফোন করছিল?” বাবার গলা শুনে পেছনে ফিরল।
“দিব্য!”
“হুঁ! একটা কথা মনে রেখো, নতুন চাকরি, গাফিলতির জন্য চাকরি যদি যায়, সেঞ্চুরি হাঁকড়ালেও ফিরে পাবে না।”
আবিরের বাবার নাম সুন্দরলাল না হলে এই উপদেশ আর ব্যাখ্যা করার কোনও প্রয়োজন থাকত না। সংসারের টানাটানির জন্য কলেজ ছেড়ে চাকরিতে ঢোকার পর বাবার কাছে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, বড় ম্যাচে আর নামবে না। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রতিজ্ঞা তো স্বয়ং সুন্দরলালই করিয়েছিলেন, “ব্যাট অবধি ছোঁবে না।”
এশিয়ান ইলেভেনের ওপেনার সুন্দরলাল প্রথম সুপারটেস্টে সাতাশি নট আউট। দ্বিতীয় টেস্টের সেকেন্ড ইনিংসে একশো ঊনসত্তর— রিটায়ার্ড হার্ট। আচমকা গুড লেংথ স্পট থেকে বলটা লাফিয়ে উঠেছিল। মুখ সরিয়ে নিয়েও বাঁ চোখটাকে বাঁচানো যায়নি। এর দু-বছর বাদে প্রতিজ্ঞাটা করেছিলেন সুন্দরলাল। কারণ খুব সরল। প্রথমত, লড়াইয়ের ময়দান থেকে বিদায় নেওয়ার পর বীরের কথা মাসতিনেকের বেশি মানুষের মনে থাকে না। দ্বিতীয়ত, প্রাক্তন স্টার ব্যাটসম্যানও এক চোখ কানা হলে টিভি কমার্শিয়ালে ঠাঁই পান না। পয়সা তো ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড দেন না, দেন বিজ্ঞাপনদাতারা। যাই হোক, প্রতিজ্ঞা কিন্তু ভাঙতে হয়েছিল। প্রশিক্ষকের চাকরি না নিয়ে পথ ছিল না।
২
মাঠে যাবে না ঠিক করেই ডিউটিতে যথাসময়ে হাজির হয়েছিল। কিন্তু পনেরো মিনিটের মধ্যেই কারখানার ফোরম্যান মজুমদার যখন কাজটা বুঝিয়ে দিলেন, আবিরের গলার কাছে একটা কান্না যেন দলা পাকিয়ে উঠল। জরুরি কাজ। আট ঘণ্টা খেটেও এটাকে শেষ করা চাট্টিখানি কথা নয়। ঘণ্টাতিনেক আগে ছুটি চাওয়ার আর কোনও প্রশ্ন ওঠে না।
মাইল্ড স্টিলের টুকরোগুলোকে শত্রুর মতো ঠেকছে আবিরের। ঠিক সাড়ে ছটা থেকে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শুরু করেছে। পাগলের মতো খেটে চলেছে। আটটায় চায়ের সময়েও ফ্লোর ছেড়ে নড়েনি।
কাঁধের ওপর একটা হাত পড়তে চমকে ফিরে তাকাল। মনোজদা।
“ব্যাপার কী রে আবির?” মনোজ ওয়েল্ডিং বিভাগের হেড মিস্ত্রি। আর ছ-মাস বাদে রিটায়ার করবেন।
উত্তর দেয় না আবির। ইলেকট্রোডের গা থেকে ফুলকি ছেটায়।
“কী রে! হলটা কী, খেলা আছে নিশ্চয়?”
প্রায় জোর করেই ঠেলে তুলে দেন আবিরকে। মনোজ তাঁর নিজের কাজে পাঠাচ্ছেন আবিরকে। এঁর ওপর কারও কোনও কথা বলার নেই। সব দায়িত্ব তাঁর।
ট্যাক্সি ধরার সময়েই আবিরের মনে হয়েছিল, কোনও লাভ নেই। ফালতু খরচ। সময়মতো পৌঁছনো সম্ভব নয়।
হলও তাই। ঘড়ির দিকে অসংখ্যবার তাকানোর পরেও সোয়া এগারোটা বেজে গেল। তেইশটা টাকা জলে। তবু যেন চুম্বকের আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে গেল।
প্যাভিলিয়নের গেটের মুখেই দিব্য। বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুধু চড়টা কষাতেই বাকি, “তুই দেখছি আমাকে না ডুবিয়ে ছাড়বি না! টসে না জিতলে আমাদের এখন দশজনের সাইড নিয়ে ফিল্ডিংয়ে নামতে হত!”
ধন্যবাদের একটা শব্দ পর্যন্ত বেরোল না আবিরের মুখ থেকে। তার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন, আজকের ম্যাচটা এমনকী গুরুত্বপূর্ণ। দিব্য তাকে সব সময়েই ব্যাক করে, কিন্তু এতটা…
দিব্য ধমক দিল, “হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে থাকলে হবে? মাহফুজ তিন ওভারে দুজনকে ধসিয়েছে। গেট রেডি!”
থ্রি ডাউনের জায়গায় ফোর ডাউনে নামার অনুরোধ মঞ্জুর হল। কিন্তু তাতেও বিশেষ কোনও সুবিধে হয়নি আবিরের। পোশাক বদল করে প্যাভিলিয়নে বসে দুটো ওভার পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছে। ন’ ওভারে পনেরো রান, তিন উইকেট। মেট্রোপলিসের সব ক-টা উইকেটই মাহফুজের পকেটে।
নতুন বলের সাইন এখনও তেমন নষ্ট হয়নি যে, মাহফুজের প্যান্টটা অত রক্তাক্ত দেখাবে। পুরোনো প্যান্ট পরে নেমেছে সে। পয়া প্যান্ট। গত সিজনে ওয়ার্ল্ড কাপের সেমিফাইনালে কি এটা পরেই সে নেমেছিল? সতেরো রানে সাতটাকে খুন করার ক্ষমতাটাকে আবার ফিরে পেতে চায়?
ক্রিকেট মাঠের সঙ্গে চার পুরুষের সম্পর্কের কথা মনে করার চেষ্টা করে আবির। তবু এই মুহূর্তে সেটা তার টেনশন লাঘব করতে খুব একটা কাজে লাগে না। জাফরি একটা লেট আউট সুইঙ্গারে ক্লিন বোল্ড। মাঠে নামার সময়ে সিঁড়ির ধারে কী একটা অদ্ভুত আকর্ষণে মুখ ফিরিয়ে তাকায়।
বাবা! রংচটা বিবর্ণ ব্লেজার গায়ে একটা মানুষ। ব্লেজারটা একজন সেঞ্চুরি মেকারের, এশিয়ান টিমের খেলোয়াড়ের। রাজার পোশাক। কিন্তু মজাটা হচ্ছে রাজত্ব থাকলে তবেই রাজার পোশাক মানায়। শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেটা ব্যবহার করলে দুর্দশা যেন আরও অসহনীয় লাগে।
মিডল ও লেগ স্টাম্পের গার্ড নিল আবির। তার দু পায়ের মাঝে প্রায় দেড় ফুটের ব্যবধান। ঠিক ব্যাকরণসম্মত নয়। দেখলেই মারকুটে দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটসম্যানের ছবি মনে আসে। পপিং ক্রিজ ছেড়ে লাফ মারার জন্য যেন তর সইছে না। তার ছ’ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতাকে একটু দমন করার জন্যই যেন কেরিয়ারের প্রথম থেকেই সে এই ভঙ্গিতে খেলে যাচ্ছে। ট্রেনারদের আপত্তি সত্ত্বেও তার স্বাভাবিক খেলা বদলায়নি।
গুড লেংথের সামান্য খাটো বলটা মিডল স্টাম্পের লাইনে পিচ খেয়ে আউট সুইং করে বেরিয়ে যাচ্ছিল। শাফল করে ব্যাকফুটে চলে এসে বলটাকে ছেড়ে দেওয়াই ছিল নিরাপদ। কিন্তু আবির গ্লান্স করল।
বিপক্ষের প্রায় হাজার পাঁচেক সমর্থকের চিৎকার জ্বলে উঠেই নিবে গেল। তারপরেই হাততালি— এবার মেট্রোপলিসের সমর্থকদের। টাইমিং ঠিক না হলেও বাউন্ডারি। উইকেটকিপার ডাইভ দিয়েও উড়ন্ত বলটাকে ক্যাচে পরিণত করতে পারেননি।
পরের বলটা আরও শর্ট পিচ থেকে ছিটকে উঠল। অফ স্টাম্পের লাইনে। জায়গা করে নিয়ে তার সামনে বুক পেতে হুক।
চৌত্রিশ বলে আটচল্লিশটা মণিমুক্তো সংগ্রহ করার পর অলস ভঙ্গিতে ব্যাট চালিয়ে স্লিপের হাতে ধরা পড়ল আবির।
৩
আবির না জানলেও দিব্য জানত যে, বিশ্ব ক্রিকেট পরিষদের নির্বাচকমণ্ডলীর চার প্রতিনিধি আজকের খেলা দেখবেন। কিন্তু কেন, তা কারও পক্ষে আন্দাজ করাও সম্ভব ছিল না।
শব্দ ও বুলেটপ্রুফ কাচের খুপরিতে বসে উত্তেজিতভাবে ব্যাখ্যা করছিলেন দয়াল। ছেলেবেলায় মার্বেল ছাড়া জীবনে দয়াল আর কোনও খেলায় অংশগ্রহণ করেছেন কি না সন্দেহ। কিন্তু এই নির্বাচক কমিটিতে তাঁর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বললে ভুল হবে না। দয়াল উজ্জয়িনী মহাবিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান ও মহাকাশ অভিযান কর্পোরেশনের অন্যতম মন্ত্রণাদাতা।
খান্না বললেন, “পুরো ম্যাচের মধ্যে টেম্পারামেন্টের বিচারে আবির সবচেয়ে ইমপ্রেসিভ। লক্ষ করেছেন, মাহফুজ যতই ডেডলি হোক, মার খেলেই কীরকম লেংথ নষ্ট করে?”
“আমারও মনে হয় টিম সিলেকশনের সময়ে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।” কমিটির চেয়ারম্যান গোপালন সাদা ভুরু কুঁচকে গম্ভীর মুখে বললেন।
মুখ থেকে পাইপটা সরিয়ে নিলাম ডাকার ভঙ্গিতে সেটা ঠুকতে-ঠুকতে দয়াল বললেন, “গুলি মারুন সাইকোলজি! আগে ফিজিক্স তো সামলান। আমাদের টিমের ব্যাটসম্যানদের ওই আবিরের মতো ভঙ্গিতে দু-পা ফাঁক করে ডান্ডা হাতে দাঁড়াতে হবে। প্র্যাকটিস করতে হবে। কিন্তু আবিরের এটা ন্যাচারাল ভঙ্গি, তাই না? এই গেল নাম্বার ওয়ান। দ্বিতীয়ত, ছোঁড়াটার চাটি-চাপাটিগুলোর পেছনে কবজির মোচড় আছে। শুধু তিডিবিড়িং করে নেচে বা ধেয়ে গিয়ে যারা ডান্ডা হাঁকায়, তাদের দিয়ে কিছু হওয়ার আশা কম।”
চতুর্থ সদস্য শিবশঙ্কর এতক্ষণে মুখ খুলেছেন, “পা ফাঁক করে খেলার কথা যদি বলেন, ডেলিভারির সময়ে মাহফুজের দু পায়ের মধ্যে যে-ফাঁকটা থাকে…”
“হ্যাঁ, সুড়সুড় করে আছাড় খাওয়ার পক্ষে আইডিয়াল!” নিজের রসিকতায় নিজেই হাসেন দয়াল। “আরে মশাই,পা ফাঁক করে দাঁড়ানোর কথা বলেছি, ছুটে এসে ঠ্যাং ছোঁড়া নয়। আর মাহফুজ কেন, কোনও ফাস্ট বোলারকেই টিমে রাখা যাবে না। সম্ভব নয়।”
“তার মানে?”
“মানে, ফাস্ট বোলাররা ছুটে এসে বল করে। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কে কত জোরে বল করতে পারে সেটা ট্রায়াল শুরু হওয়ার আগে…”
“দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বল করতে হবে?”
“প্রায় তাই। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে। জোরে ছুটতে গেলেই পিছলে পড়ার আশঙ্কা। চাঁদের পিঠে মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর ছ’ ভাগের এক ভাগ, তা ছাড়া ফ্রিকশনও খুব কম। জানি, স্পেশাল জুতো তৈরি হবে, পিচও হবে নতুন পদ্ধতিতে, কিন্তু তা হলেও ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ওই বরফের ওপর কেডস পায়ে হাঁটার মতো। এবং লুনার টিম এই অবস্থাটাকেই তাদের মূলধন করার চেষ্টা করবে।”
“তা হলে শুধু স্পিনার?”
“তা কেন! বাহু বা পেশির জোরকেও তো কাজে লাগানো যায়। তবে আপনাদের ওই সুইং-ফুইং চলবে না। আপনারা জানেন কিনা জানি না, তবে ইস্কুলের ছেলেরা জানে যে, চাঁদে হাওয়া নেই। ফলে…”
“আচ্ছা, আমাদের প্লেয়ারদের পৃথিবীতে বসে ঠিকমতো ট্রেনিং কি দেওয়া সম্ভব? যাতে ওই স্লিপারি চাঁদের পিঠে…”
“নিশ্চয়! সেরকম ট্রেনিং গ্রাউন্ড বানালেই হল। একশো ভাগ না হলেও…”
শিবশঙ্কর দয়ালকে বাধা দিয়ে বললেন, “ছিল তো এককালে। সমুদ্রের নীচে একটা ট্রেনিং ফিল্ড। হয়তো সেটাকেই একটু সংস্কার করে নিলে…”
গোপালন বিরক্তভাবে বললেন, “আপনারা বড্ড এগিয়ে গিয়ে ভাবছেন। আমি এখনও মনস্থির করতে পারছি না, চাঁদের পিঠে এই লুনার ওয়ান ডে ম্যাচে খেলানোর জন্য আদৌ বিশ্ব-একাদশ পাঠানো উচিত হবে কি না।”
“তা এই ব্রেন-ওয়েভটা তিনমাস আগে এলেই তো ভালো হত। সারা দুনিয়া চষে চোদ্দোজন খেলোয়াড় বাছাই করার পর…”
৪
পাড়াটা বনেদি হলেও রাস্তাটা কানাগলি। মাত্র চারটে বাড়ি। রাত সাড়ে দশটায় রাস্তার একমাত্র আলোটা নিভে গেল। এবং বোঝা গেল আজ অমাবস্যা। অন্ধকারেরই একটা অংশ যেন ছিটকে এল রাস্তার ওপার থেকে। একটা লোহার ফটকের একপাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর শুধু মুখটা বাড়িয়ে বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট বাগানটাকে জরিপ করল। আর-একটা ছুট। এবারে বাড়ির দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে তারই মধ্যে মিশে যাওয়ার চেষ্টা। পরের দৃশ্য, একটা ইঁদুর যেন রেন-পাইপ বেয়ে দোতলার ছাতে গিয়ে তড়াক করে পাঁচিল টপকে নামল।
পেনসিলের মতো আলোর রেখা ছাতের দরজার ওপর নড়েচড়ে স্থির হয়েছে। তিন নম্বর চাবিটা লেগে গেল।
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামা ও ডান দিকে ঘুরে দুটো দরজা ছেড়ে তৃতীয়টার সামনে দাঁড়িয়ে কান পাতা পর্যন্ত একটা মসৃণ গতি। চেনা বাড়ি, নির্দিষ্ট লক্ষ্য।
হাতের ঠেলা দিয়ে দরজার পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকে এল। আর-একবার নিরীক্ষণ। তারপরেই পা চালিয়ে দক্ষিণ কোণে স্টিল ক্যাবিনেটের সামনে। মিনিট তিনেকের মধ্যেই খোঁজাখুঁজির কাজ সাঙ্গ।
পেছনেও ফিরল আর আলোটাও জ্বলল।
একটা ড্রেসিং গাউনের হাতে উদ্যত পিস্তল। দরজার ঠিক মুখে দাঁড়িয়ে। “গুড ইভনিং, কী খুঁজে পেলেন জানতে পারি?”
“এই দুটো বেআইনি জিনিস।”
“আচ্ছা! তা হলে পুরোনো ভিডিয়োর দাম বাড়ছে।”
“নির্ভর করে। যেমন এই পুরোনো ক্রিকেট ম্যাচের ফিল্মগুলো অবশ্যই দামি! যাই হোক, হাত থেকে যন্ত্রটা নামিয়ে রাখতে পারেন। ওটা ব্যবহার করলে আপনারই ক্ষতি হবে।”
নাচারের ভঙ্গিতে গৃহকর্তা পিস্তলটা নামিয়ে নিলেন, “সত্যিই আমার কিছু করার নেই। কিন্তু একটা কথা কি জিজ্ঞেস করতে পারি? আমার এই বিশাল সংগ্রহের মধ্যে থেকে দুটো মাত্র…”
কথাটা বলতে বলতেই উৎসুক ভাবে ভদ্রলোক কয়েক পা এগিয়ে এলেন, “কী ফিল্ম নিলেন বলুন তো?”
“লুনার ইলেভেনের সঙ্গে…” মুখ টিপে হেসে এই প্রথম বোকামির পরিচয় দিলেন আগন্তুক। হাতের ক্যাসেট দুটো কাত করে তার ওপরে সাঁটা লেবেলটা দেখাতে চেয়েছিলেন। সুযোগ পাননি। পিস্তলের বাঁটটা হাতের এক নিঃশব্দ কসরতে কপালের নাগাল পেয়ে গেছে!
“চুরি করবে, আবার ব্ল্যাকমেল!” ড্রেসিং গাউন নিচু হয়ে ক্যাসেট দুটো তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মিনিট তিনেকের মধ্যেই ফিরে এসেছেন। খোলা ক্যাবিনেটের থেকে নিরীহ চারটে ভিডিয়ো ক্যাসেট বের করে বেহুঁশ চোরের কাছে কার্পেটে ফেলে দিলেন।
মিস্টার সরকার এবার নিশ্চিন্ত। পুলিশকে খবর দিতে পারেন। বেআইনি ফিল্ম নয়, মূল্যবান বমাল সমেতই ধরা পড়বে।
কিন্তু দু-একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, কারা সরকারের এই ফিল্ম দুটোর কথা জানে? কারাই বা এগুলো হাতাতে চাইছে? তদন্তের প্রথম স্তরে সরকার পরের দিন প্রথমেই হানা দিলেন ‘টিট-বিট কিউরিও শপ’-এ। কারণটা সরল। একটা ফিল্ম এঁদের কাছ থেকেই বছর পনেরো আগে কিনেছিলেন।
“গুড মর্নিং স্যার! এতদিন পরে!”
“এই একটু খবরাখবর নিতে এলাম। আছে নাকি কিছু?”
“পঁচাত্তর বছরের পুরোনো একটা টেস্ট মাচের টিকিট আছে। শস্তাতেই পাবেন।”
“আসল জিনিস কিছু আছে?” গলাটা নামিয়ে সরকার বললেন, “ফিল্ম? চাঁদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার?”
কিউরিও মালিকের মুখে কি একটা দ্বিধার ছায়া খেলে গেল?
“না স্যার— ভীষণ রিস্কি ব্যাপার। ওসব কারবার ছেড়ে দিয়েছি।”
শেষ চেষ্টা হিসেবে সরকার আন্দাজে ঢিল ছুড়লেন, “ভালো খদ্দের সন্ধানে থাকলে আমার ফিল্ম দুটো বেচে দেব।”
এবার নিঃসন্দেহে লোভ জ্বলে উঠেছে। কিন্তু তারপরেই একরাশ হতাশা। আর এই দুইয়ের ফাঁকে মুখ ফসকে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা, “কালকেও যদি আসতেন একবার!”
তার মানে শাঁসালো খরিদ্দার কেউ না কেউ ছিল এবং ইতিমধ্যে সেই পাখি উড়ে গেছে।
আর প্রশ্ন বৃথা। সরকার বেরিয়ে এলেন।
পাবলিক টেলিফোন বুথ। প্রথম চেষ্টাতেই লাইন পেয়েছেন সরকার।
“হ্যালো, ছন্দক? সরকার বলছি। কাল রাত্তিরে আমার বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। কেন ঢুকেছিল বলা কি দরকার?”
মুহূর্তের নীরবতা, তারপরে একটা রুদ্ধশ্বাস, “গুড গড— তা হলে আমার বাড়িতেই শুধু নয়!”
“তাই তো মনে হচ্ছে। নিতে পেরেছে?”
“তিনটে— মানে সব ক-টাই।”
রিসিভার নামিয়ে রাখলেন সরকার।
পরিচিত আরও দুই সংগ্রাহককে ফোন করেছেন সরকার। তাঁদেরও বাড়ি থেকে চুরি গেছে ওই একই জিনিস। চন্দ্র একাদশের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ইলেভেনের ক্রিকেট খেলার ভিডিয়ো ক্যাসেট। যা ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার ওপর বহুকাল আগেই সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল।
৫
কনফারেন্স রুমের টেবিলের আয়তন, পালিশ এবং সাজসজ্জার বাহার দেখেই অনুমান করে নেওয়া যায় এখানে শুধু সুউচ্চ স্তরের বৈঠক বসে। অর্থসচিব শর্মার চেয়ারটাই শুধু খালি। শর্মা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, লাঞ্চের পরে আসবেন। আলোচনায় অংশ নেওয়ার সময় নেই তাঁর। সইটই করার থাকলে করে দেবেন।
“মিস্টার গোপালন, আপনার টিম নির্বাচন নিশ্চয় কমপ্লিট?” জর্জ লেশনার জানতে চান।
“না, মানে…”
“হোয়াট ডু ইউ মিন!” লেশনারের গলা সরু হয়ে যায়, “ছ-মাস ধরে সতেরোটা দেশ চষে…”
“ছ-জন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে…” যোগ করেন বিল ওকিফ।
একটু এগিয়ে বসে টেবিলে দু কনুইয়ের ভর রেখে গোপালন বললেন, “টিম তৈরি বলতে যদি শুধু ক-টা নাম সংগ্রহের কথা বলেন…”
“ঠিক তাই। বের করে ফেলুন তো লিস্টটা।”
অ্যান্ড্রু মনে করিয়ে দিলেন, “লুনার ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড পৃথিবীর যে ক-টা টিম অ্যাপ্রুভ করেছে তাদের মধ্যে থেকেই কিন্তু…”
গোপালনের কানে কথাগুলো ঢুকেছে বলে মনে হয় না, “দেখুন, সতেরো বছর ‘এ’ ক্লাস ক্রিকেট খেলেছি আমি। তারপর পঁয়ত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে, কোচিং চালিয়ে যাচ্ছি। আমার ছেলেদের জেনেশুনে এরকম বিপদের মুখে ঠেলে দিতে মনটা সায় দিচ্ছে না।”
“বিপদ? অজানা? কী বলছেন আপনি?”
উত্তেজিত কণ্ঠে লেশনার বলে ওঠেন, “শোধ তুলতেই হবে মিস্টার গোপালন। এই সুযোগ। কেন ভুলে যাচ্ছেন যে, ওই চাঁদের পিঠে আমাদেরই উপনিবেশ থেকে ক্রিকেট টিম এসে বিশ্ব একাদশকে নাজেহাল করেছিল। এই তো বছর পঞ্চাশ আগের কথা!”
“চেষ্টা করলেও বোধহয় আমার পক্ষে ভোলা শক্ত।” ব্যঙ্গের আভাস গোপালনের স্বরে, “কারণ সেই ম্যাচে আমিই সবচেয়ে বেশি স্কোর করেছিলাম।”
“রিয়্যালি? অভিনন্দন। খেয়াল ছিল না। কিন্তু তা হলে তো আপনার ভালো করেই জানার কথা যে, চাঁদ থেকে যে টিম এসেছিল তাঁদের খেলোয়াড়রাও সেই প্রথম পৃথিবীতে পা দিয়েছিলেন। তাঁরা অচেনা অজানা পরিবেশে—”
“তা ছাড়া আমি তো আছি। মানে বিজ্ঞানীরা কি ঘাস কাটছেন!” এতক্ষণে মুখ খুললেন দয়াল। “সমুদ্রের তলায় এমন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করব, কোনও অসুবিধেই হবে না। সমুদ্রের তলায় কেন জানেন কি? ওজনটা যাতে হালকা—”
গোপালন বলে উঠলেন, “দুশ্চিন্তাটা তো আর ফলাফল নিয়ে নয়!”
“কিন্তু তার বাইরে কে আপনাকে মাথা ঘামাতে অধিকার দিল, সেইটাই তো বুঝতে পারছি না!” কখন শর্মা ঘরে এসে ঢুকেছেন, কেউ খেয়াল করেননি।
“তবু, একটা আশঙ্কা…” শর্মার ধারালো দৃষ্টি ক্রমেই যেন গোপালনের গলাটাকে টিপে ধরে, “মানে চন্দ্রবাসীদের চক্রান্ত… এত বছর বাদে হঠাৎ আপ্যায়নটা কেমন যেন…” আমতা-আমতা করে থেমে যান শেষ পর্যন্ত।
কমিটির চেয়ারম্যান কার্লফ শর্মার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “গোপালনের আমাদের ওপর আস্থার অভাব আছে ঠিকই, কিন্তু উনি অনধিকার চর্চা করছেন বলে ভাবাটা ঠিক নয়। বহু বছর ধরে চিনি ওঁকে। এরকম মানুষ হয় না।” এবার গোপালনের দিকে ফিরে কার্লফ বললেন, “আসলে আপনি পুরো ব্যাপারটা ঠিক জানেন না বলেই এসব ফালতু ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন। ভালো করে শুনুন, কুড়ি হাজার দর্শককে চাঁদে নিয়ে আসার জন্য সমস্ত খরচা দিচ্ছেন ওঁরা। আশি শতাংশ পেমেন্ট তো করেই দিয়েছেন। প্ল্যাটিনাম আর ইউরেনিয়ামের মাধ্যমে।”
“কিন্তু কেন? সেটাই তো প্রশ্ন। যদি ধরেও নিই যে, ওঁদের শাসকরা আমাদের সঙ্গে আবার নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করতে চান, কিন্তু তাঁদেরও তো আবার বিরোধী পক্ষ আছে! নাকি পৃথিবীর অর্থনৈতিক সঙ্কটের একটা সুযোগ…”
“দিস ইজ টু মাচ।” লেশনার রীতিমত অসহিষ্ণু, “সঙ্কট আমাদের নয়, ওঁদের। নিজেরাই সেকথা কবুল করেছেন।”
লেশনারকে বাধা দিয়ে কার্লফ বললেন, “নিরাপত্তা নিয়ে এতটুকু ভাবনার কারণ নেই। চাঁদের মাঠে কুড়ি হাজার দর্শকের মধ্যে পাঁচ হাজার সাদা পোশাকের কম্যান্ডো থাকছে। কই, এবার লিস্টটা দিন।”
গোপালন তালিকাটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, “এখনও কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে প্লেয়ারদের কারও কাছ থেকেই সম্মতি সংগ্রহ করা হয়নি।”
সভাকক্ষে হাসির তুফান। সোনার সিংহাসনে বসতে চান না এমন লোক কোথায়?
৬
দূরদর্শনের এ-বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘বেহুলা’কে আচমকা থামিয়ে দিয়ে চাঁদের পিঠে ওয়ান ডে ম্যাচ খেলার প্রথম ঘোষণাটি সম্প্রচারিত হল। অগুনতি দর্শকের সঙ্গে পার্থ আর রুদ্রও খবরটা জানলেন।
দুজনেই শহরতলির নগণ্য ইস্কুলের শিক্ষক। পার্থ ইতিহাস পড়ান। রুদ্র বাংলা। গভীর বন্ধুত্ব। নিজেদের টিভি নেই, তাই হেডমাস্টারের বাড়িতে আসেন প্রতি রোববার।
খবরটা জানা মাত্রই রুদ্র অস্থির হয়ে ওঠেন। টিভিতে আর মন বসে না। মাথা ধরার অছিলায় প্রস্থান করেন। ফলে পার্থরও সুবিধে হয়। একই বাড়ি ভাড়া করে থাকেন দুজনে। সুবিধে-অসুবিধে ভাগ করার দায়িত্ব তো একটা আছে।
রাস্তায় দেখা হওয়া মাত্র রুদ্র বলেন, “আমাকে যেতেই হবে।”
পার্থ বলেন, “আমাকেও।”
ঠাট্টা করছেন কি না বোঝার জন্য পার্থর দিকে তাকান। বুঝতে পারেন না।
বাড়ি ফেরার পরে পার্থ বলেন, “বন্ধুকে সব কথাই জানানো উচিত। একটা কথাই বাকি ছিল। আমার ঠাকুর্দাকে চাঁদের উপনিবেশে পাঠানো হয়েছিল।”
রুদ্র স্তম্ভিত। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে অজানা বা অল্প-জানা অধ্যায়গুলোর ওপরেই তাঁর সবচেয়ে কৌতূহল। আর সেই কৌতূহল মেটানো প্রায় অসম্ভব, চাঁদের দেশের ব্যাপারে। সরকারি ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা মানুষের ইতিহাসের এই একটা পর্বের যাবতীয় নথিপত্র ও উপকরণকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে বের করে দিয়েছে। জাতীয় বা শহুরে কোনও গ্রন্থাগারে কিছু না পেলেও গ্রামাঞ্চলের কিছু অখ্যাত লাইব্রেরি থেকে রুদ্র যেটুকু সংগ্রহ করতে পেরেছেন পার্থ তার সবই জানেন। সেটা শুধু বন্ধুত্বের সম্মানে নয়। তথ্য যেমন চাঞ্চল্যকর, তেমনই নিষিদ্ধ তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া। রুদ্রর একমাত্র শ্রোতা পার্থ। এত কথা হয়েছে পার্থর সঙ্গে, তবু এই কথাটা তো কখনও ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করেননি।
পার্থ বললেন, “বলিনি, তার কারণ আমি শুধু ওইটুকুই জানি। তার বেশি আর এক ছত্র নয়। আমাদের পরিবারে এই ব্যাপারটাকে প্রথম থেকেই সবাই চেপে রাখতে চেয়েছেন। বাবাকে যেরকম চিনেছি, তাতে জানলে উনি বলতেন না ভাবা কঠিন। বাবাও কিছু জানতেন না।”
গ্যাস জ্বালিয়ে চায়ের জল চাপাতে-চাপাতে রুদ্র আপন মনে বলেন, “সেটা আর অস্বাভাবিক কী! আমরা তো জানিই যে, পৃথিবী থেকে শুধু দাগী অপরাধীদেরই প্রথমে চাঁদে পাঠানো হয়েছিল উপনিবেশ স্থাপনের জন্য। অন্তত প্রচারটা যে সেরকমই করা হয়েছিল তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই!”
পার্থ বললেন, “সেটাও তো একটা রহস্য। চাঁদের উপনিবেশ নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করার পর থেকেই তো এই প্রচার শুরু। তাই না?”
“মোটামুটি তাই। তবে পুরোনো কাগজে দেখেছি চাঁদের প্রথম বাসিন্দাদের মধ্যে যাবজ্জীবন দণ্ডিত বহু অপরাধী ছিল।”
“তাই আমার পূর্বপুরুষ খুনে আসামী হোক বা না হোক, বাড়ির লোকেরা সেই ভয়েই ব্যাপারটাকে পুরো চেপে গেছেন।”
কোনও উত্তর দেন না রুদ্র। তাঁর মাথায় এখন একটাই কথা ঘুরছে। তিনি জানেন, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, পৃথিবী থেকে চাঁদে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হওয়ার পরে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। অক্সিজেন অবরোধ করে চাঁদের উপনিবেশের বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কীভাবে বেঁচে আছে তারা? কী করছে? কেমন চেহারা তাদের সভ্যতার?
“জানার সুযোগ এসেছে এবার।” পার্থ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, “যাব বলে লাফালেই তো হল না। টাকাটা আসবে কোত্থেকে? টিকিটের দাম দেখেছিস?”
“দেখেছি। তার ওপর নিশ্চয় ব্ল্যাকও হবে।”
“আলবত!”
দুই বন্ধু অনেক হিসেব করে দেখলন, টস করতে হবে। দুজনের টিকিট কাটার মতো সংস্থান নেই তাঁদের। টসে রুদ্র জিতে গেলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। বহু কষ্টে কালোবাজারে একটা টিকিট কেনার পর জানা গেল বিশেষ পাশপোর্টের জন্য এবার দরখাস্ত করতে হবে। রুদ্রর দরখাস্ত বাতিল। রুদ্রর লেখা একটা পুরোনো প্রবন্ধের মধ্যে পুলিশ সন্দেহজনক গন্ধ পেয়েছে। পার্থর কপালেই আসলে চন্দ্রভ্রমণ লেখা ছিল।
৭
“গুড মর্নিং ডক্টর দয়াল! আমি মহাকাশের পোশাক নির্মাতা স্পেস স্যুট আউট ফিটার-এর তরফ থেকে…”
“মাই গড! আপনিই তো ফোন করেছিলেন?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“কী করে ঢুকলেন আপনি অফিসে? আপনার সঙ্গে আমি দেখা করতে…”
“দেখা করতে চান না আমিও জানি, আপনার দরোয়ানরাও জানে। কিন্তু আমার মনে হয় দেখাটা না হলেই বরং আপনার ক্ষতি বেশি হত।” ভদ্রলোকের চেহারা ও কথা সমান ঝকঝকে।
“ক্ষতি! আমার লাভ-লোকসানের ঠিকেদারি করার ভার দিয়েছি নাকি আপনাকে! দেখুন, আমি কয়েকটা সরল নীতিতে বিশ্বাস করি। পারচেজ কমিটিতে আছি জেনে যারা আমার কাছে উমেদারি করতে আসবে, তাদের অফার অবধি আমি বিবেচনা করব না। আপনি যদি এই মুহূর্তে…”
“ব্রাভো! ব্রাভো! কিন্তু ডক্টর, এক মুহূর্ত তো এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ। সেটা পেরিয়েও গেছে। কিন্তু আমি বলছি, আমার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হলেও আপনার অভিযোগ করার কিছু থাকবে না।”
দয়াল এত উত্তেজিত যে মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। শুধু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান।
অতিথিও উঠে দাঁড়ান। দয়ালের মুখের কাছে মুখ এগিয়ে এনে বিচ্ছিরি ভঙ্গিতে বলেন, “দুর্নীতিটা শুধু ব্যাবসাদারদেরই একচেটিয়া, তাই না? আর উজ্জয়িনীর হিরের টুকরো অধ্যাপক নিজের কেরিয়ার গুছোতে যখন তমোঘ্ন রায়চৌধুরীকে… বাকিটা কি শুনতে চান?”
দয়ালের মুখ থেকে রক্ত উবে গেছে।
“বসুন, বসুন, সেসব কথা টেনে আনার কোনওই ইচ্ছে নেই আমার। ‘স্পেস-পাওয়ার’ নামে আমাদের তৈরি চন্দ্রযাত্রীদের পোশাকটা অনুমোদন করে দিন। পুরোনো কাসুন্দি নিয়ে আর কেউ ঘোঁট পাকাবে না।”
দয়ালের কথাগুলো যেন অসংলগ্ন, “কিন্তু, আমি… একা আমি তো… আরও তো সদস্য আছে… কেনার সুপারিশ একা আমি…”
“হ্যাঁ, একা আপনিই পারেন। বোকা সাজার ভান করে পার পাবেন না। আমাদের স্পেম-স্যুটের দাম সবচেয়ে শস্তা। কিন্তু আপনি কারিগরি বিচারের নামে আমাদের পোশাককে নিম্নমানের অভিযোগে বাতিল করতে চাইছেন। যাতে অর্ডারটা সুপার স্পেস কস্টিউম কম্পানি পায়। আর আপনাকে উসকানি দিচ্ছে পারচেজ কমিটিরই আরও দুজন সদস্য। নাম বলব? দরকার নেই। শুধু জেনে রাখুন, আপনারই মতো এই দুই ন্যায়পরায়ণ সাধু কিন্তু ইতিমধ্যেই বাটারফ্লাই আইসক্রিম কম্পানির কাছ থেকে এমন গিলেছেন যে হজম করতে পারছেন না। ওই সুপার স্পেস কস্টিউম কম্পানি যে পোশাক তৈরি করবেন তার বুকে ও পিঠে একটি করে রামধনু রঙের প্রজাপতি উড়বে। কী বুঝলেন?”
দু হাতে মুখ ঢেকে ভাঙা-ভাঙা গলায় দয়াল যেন আপন মনেই বলে চলেন, “তিরিশ বছর আগে একটা মানুষের জীবন নষ্ট করেছি। কিন্তু সেইটা গোপন করার জন্য হাজার-হাজার মানুষকে আমি…”
“বোগাস! আপনি অকারণে ভয় পাচ্ছেন। আমরা একটা নতুন সিন্থেটিক কাপড় দিয়ে মহাকাশযাত্রীদের পোশাক বানাচ্ছি। দামটা কমেছে সেইজন্যই। প্রাণহানির কোনও আশঙ্কা নেই। তবে প্রচলিত পোশাকের তুলনায় আমাদেরটার আয়ু হয়তো একটু কম হতে পারে। কিন্তু যাতায়াত ধরে যেখানে মাত্র দিন দুয়েকের মামলা…”
মহাকাশযাত্রীদের সুলভতম পোশাক নির্মাতার বিরুদ্ধে আপত্তির কারণগুলো একটা কাগজে টাইপ করেছিলেন দয়াল। সেটাকে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলেছেন।
“থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর দয়াল! আমি জানতাম আপনি অযৌক্তিক কিছু করবেন না।”
৮
চাঁদের আকাশে নিজের কক্ষপথে প্রবেশ করল ‘ইকেরাস’। বাইশ হাজার যাত্রীবাহী পারমাণবিক শক্তিচালিত মহাকাশতরী। পাইলট শিপ। পনেরো মিনিটের ব্যবধানে একে-একে এরকম আরও পাঁচটি স্পেসশিপ আসবে পৃথিবী থেকে।
চাঁদের মহাকাশ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্বাগত জানাল ইকেরাসকে। বলল, চাঁদের ফেরি রকেট তিন দফায় যাবতীয় যাত্রীদের চাঁদের পিঠে বহন করে নিয়ে যাবে। ফেরি রকেটের আসনসংখ্যা আট হাজার। প্রথম দফায় স্বাভাবিকভাবেই ক্রিকেট টিম, চিকিৎসক, টিভি-প্রদর্শক, বিশ্ব ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সদস্য ও বিজ্ঞাপনদাতা সংস্থাদের প্রতিনিধিদের তারা নিয়ে আসবে।
ফেরি রকেটের বায়ু-নিরোধক অর্গল ঠেলে যাত্রীরা পা ফেললেন মেট্রো-স্টেশনের মতো কিন্তু আরও রাজকীয় চেহারার মহাকাশবন্দরের অভ্যন্তরে। নীল ছিট-ছিট গোলাপি জ্যোতিময় এক ধরনের কাচ দিয়ে তৈরি দেওয়াল। ধুলো-ময়লার চিহ্ন নেই, নেই কোনও প্রাণেরও লক্ষণ। দেওয়ালের গায়ে জায়গা-বিশেষে বিনি সুতোয় ঝুলিয়ে রাখা বিচিত্র সব রং আর রেখার সচল কারিকুরি। সচল মানে তারা ক্ষণে-ক্ষণে বদলাচ্ছে। ছাঁচে ঢালা ভারী-ভারী সোনালি ও রুপোলি ফ্রেমে আবদ্ধ না থাকলে বোঝা মুশকিল হত এগুলি চন্দ্রবাসীদের শিল্পকর্মের নমুনা।
কোনও লুম্যান অর্থাৎ চন্দ্রবাসীকে এখনও দেখা যায়নি। শুধু ট্রান্সমিটারে শোনা গেছে তাদের নম্র কণ্ঠের আপ্যায়ন ও নির্দেশ। স্পেশ স্টেশনের চত্বর থেকেই যাত্রী বোঝাই করে মোনো রেল যাত্রা শুরু করল। চাঁদের এই প্রধান ভূ-পরিবহণ ব্যবস্থা যাত্রীদের জিওর্দানো ব্রুনো স্টেডিয়ামে বয়ে নিয়ে যাবে। দূরত্ব একশো সতেরো কিলোমিটার।
স্টেডিয়ামে পৌঁছে মোনো রেল থেকে নামার পর চাঁদের শোভা মুগ্ধ করল দর্শকদের। রাত নেমেছে। কালো মখমলের মতো আকাশ। পালিশ করা অন্ধকার। তারই মাঝে ঠিক মাথার ওপরে রাজকীয় ভঙ্গিতে ঝুলে রয়েছে সাদা মেঘের ছোপমাখা নীল একটি গোলক, যার নাম পৃথিবী। চিনা লন্ঠনের মতো স্নিগ্ধ ও শীতল আলো ছড়াচ্ছে, কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও অনেক বেশি তার দ্যুতি। চোখ নয়, মন ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।
আকাশের আকর্ষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর চোখ পড়ে মাটিতে। জিওর্দানো ব্রুনো স্টেডিয়াম প্রকৃতির হাতেই তৈরি। পৃথিবীর প্রাচীন জ্যোতির্বিদরা দূরবীক্ষণে চোখ লাগিয়ে চন্দ্র পর্যবেক্ষণের সময়ে এই ধরনের এলাকাকে ‘সমুদ্র’ বা ‘মারে’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এদের স্বরূপ ধরা পড়েছিল অনেককাল বাদে। নির্বাপিত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বা ক্রেটার এগুলো। কিন্তু ক্রেটারের কিনারা জুড়ে কাচের মতো স্বচ্ছ কোনও পদার্থের ছাউনির নীচে পাতা চেয়ারে বসে পৃথিবীর দর্শকদের মনে হচ্ছে বিশাল এক ওলিম্পিক স্টেডিয়ামে এসেছেন তাঁরা। লুম্যানদের গ্যালারি ঠিক বিপরীত প্রান্তে। আয়তন দেখেই অনুমান করা যায় যে, চাঁদের জনসংখ্যা খুব বেশি নয়। কারণ, প্রচুর অর্থব্যয় করে এই খেলার আয়োজন তাঁরা করেছেন। এখানে ক্রিকেট নিশ্চয় জনপ্রিয়। তা সত্ত্বেও হাজার পাঁচেকের বেশি আসন নেই চন্দ্রবাসীদের গ্যালারিতে।
ধূসর মাঠের ওপর একটি সাদা রেখা ক্রিকেট ফিল্ডের সীমানা নির্দেশ করছে। ঘাসের কোনও চিহ্ন নেই, কিন্তু পিচের অংশটার রং হালকা সবুজ। পিচের একপ্রান্তে স্টেডিয়ামের ওপারে বিরাট এক লালরঙা গম্বুজ। গম্বুজের মাথা চিরে বেরিয়ে রয়েছে যেন কামানের একটা নল। পিচের অপর প্রান্তে রয়েছে স্টেডিয়ামেরই সংলগ্ন মৌচাকের মতো চেহারার একটা বাড়ি।
স্পেস-স্যুটের সঙ্গে লাগানো মাইক্রোফোন থেকে লুম্যানদের ধারাবিবরণী শোনা যাচ্ছে। পৃথিবীর চল্লিশটি ভাষার যে-কোনও একটি দর্শকরা পছন্দমতো বেছে নিতে পারেন। ইচ্ছে করলে পৃথিবীর ভাষ্যকারদের বিবরণীও শুনতে পারেন।
ধারাভাষ্য জানিয়ে দেয় লাল গম্বুজটা চাঁদের অসংখ্য মানমন্দিরের মধ্যে একটি। আর তারই বিপরীতে স্থাপত্যের অদ্ভুত নিদর্শনটি একাধারে প্যাভিলিয়ন এবং টিভি ও বেতার প্রচারকেন্দ্র। পিচে ঘাসের বদলে আছে কৃত্রিম তন্তু। ঘাসের নিকটতম বিকল্প। চাঁদে বাতাস না থাকায় দর্শকদের খেলা উপভোগে বিঘ্ন ঘটতে পারে ভেবে একটা নতুন ব্যবস্থা করা হয়েছে। দর্শকদের আনন্দ, উল্লাস, হাততালি বা ধিক্কার মাইক্রোফোন ব্যবস্থা এমনভাবে প্রত্যেকের কানে পৌঁছে দেবে যে, মনে হবে যেন পৃথিবীর মাঠে বসেই খেলা দেখছেন।
ব্যাটটা হাতে নিয়ে আবির আপন মনে নানা ভঙ্গিতে নাড়াচাড়া করছে। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর ছ-ভাগের এক ভাগ তাই ব্যাট ও বল দুটোরই ভর পাঁচগুণ বাড়িয়ে একটা সমতা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। পৃথিবীতে সমুদ্রের নীচে অনুশীলনের সময়ে যতই চাঁদের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করা হোক, তফাত তো থাকবেই।
লুনার টিমের খেলোয়াড়রা ওদের এখন নেট প্র্যাকটিসে সাহায্য করছেন। আবির অনুভব করে যে ব্যাটটা এমনিতে একটু হালকা ঠেকলেও হঠাৎ তোলা বা ঘোরানোর সময়ে কিন্তু যেন একটা বাড়তি জোর দিতে হচ্ছে। হুক শটের মতো ব্যাটটা চালালে আবার ফলো থ্রুর সময়ে শরীরের ভারসাম্য রাখতে অসুবিধে হচ্ছে।
দয়ালের লেকচারের কথা মনে পড়ে যায়। ব্যাটের ভর বাড়ালেও বাড়তি ওজন টের পাওয়া যাবে না ঠিকই কিন্তু ইনারশিয়ার দরুন অচল অবস্থা থেকে ব্যাটটাকে নাড়ানো বা সচল ব্যাটটাকে থামানোর জন্য বাড়তি জোর লাগবে।
আবির প্রতিজ্ঞা করল আজকের মতো সে তার প্রিয় হুক শটটাকে ভুলে যাবে।
স্প্রে-গান হাতে এক লুম্যান আবিরের
পোশাকের বুকে-পিঠে বড় বড় রোমান হরফে ‘চার’ লিখে দিলেন। পৃথিবীর খেলোয়াড়দের জন্য নীল রং আর চাঁদের জন্য চকোলেট। স্পেস-স্যুট পরার পর কাউকে চেনা খুব শক্ত। সে খেলোয়াড়ই হোক আর দর্শক। দর্শকরাও এখন প্রত্যেকে মোটর গাড়ির মতো নাম্বার প্লেট বয়ে বেড়াচ্ছেন।
ট্রান্সমিটার বার্তা থেকে জানা গেল, খেলার মাঠে ফিল্ডিং সাইড ট্রান্সমিটারের সাহায্যে নিজেদের মধ্যে এবং আম্পায়ারের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন কিন্তু ব্যাটসম্যানরা তাঁদের কথা শুনতে পাবেন না। অন্য তরফে দুই ব্যাটসম্যান নিজেদের মধ্যে ও আম্পায়ারের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।
আবির হঠাৎ আবিষ্কার করল স্টেডিয়ামের এক প্রান্তে বিশাল ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে খেলোয়াড়দের নাম ও নাম্বার ইত্যাদি জ্বলজ্বল করছে। একটু আগেও ওটা ছিল না। হলোগ্রাফিক প্রোজেকশনের কারসাজি— বিনা পরদায় শূন্যের ওপর ছবি ফুটিয়ে তোলা।
সুইং ব্যাপারটা অচল জেনেও ওয়েসলি গিলক্রিস্ট তাঁর অভ্যাসকে ছাড়তে রাজি নন। থাইয়ের ওপর বল ঘসতে-ঘসতে আঠারোটা স্টেপ নিচ্ছেন। দয়ালের সব পদার্থবিদ্যা নাকচ করে তিনি টিমে ঢুকেছেন। রান আপও কমাননি। গিলক্রিস্টের চেয়ে দ্রুতগতি আরও তিনজন পৃথিবীর বোলারকে সরিয়ে বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও সাবলীল বোলিং অ্যাকশনের জন্য তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। আবিরের বদ্ধমূল ধারণা, আজ ওঁর পারফরম্যান্সের ওপর খেলার ফলাফল অনেকটাই নির্ভর করবে।
সন্তর্পণে পা ফেলে হাঁটতে শুরু করেন গিলক্রিস্ট। গোড়ালি ঠুকে-ঠুকে। তারপর ছোট ছোট লাফ মারতে মারতে। শরীরটা এবার কাত করে নিয়েছেন, বুকটা ব্যাটসম্যানের দিক থেকে নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেছে। মাটি ছেড়ে তিন ফুট, চার ফুট, প্রায় পাঁচ ফুট ওপরে লাফিয়ে উঠেছেন গিলক্রিস্ট। বোলিং ক্রিজে থপ করে পড়ার সময়ে শরীরটায় অদ্ভুত একটা মোচড় দিয়ে বলটা ছেড়ে দিলেন।
গুড লেংথেই পিচ খেয়েছিল, কিন্তু বলটা ব্যাটসম্যানের মাথার প্রায় ছ-ফুট ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। উইকেটকিপার বলটা ধরার চেষ্টায় লাফ মারতেই বলটার চেয়ে প্রায় তিন ফুট ওপরে উঠে গেল। এরকম কিপিং করলে কত বাই যে দেবে।
গিলক্রিস্ট বল ডেলিভারি করার পর টাল সামলাতে উলটো দিকের উইকেট পেরিয়ে গেছেন। আর-এক সমস্যা। এভাবে ফাস্ট বোলারদের প্রত্যেক ওভার শেষ করতে দেড়গুণ সময় লাগবে।
মাইক্রোফোন সতর্ক করে দিল যে, ব্যাটসম্যানের মাথার ওপর দিয়ে বল বেরিয়ে গেলে ‘ওয়াইড’ ঘোষিত হবে।
ফিল্ডিংয়েও বেশ অসুবিধে হচ্ছে। গিলক্রিস্টের একটা বল ড্রাইভ করল আবির। শিউলালের একফুট ডান দিক দিয়ে বিদ্যুৎ-গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছিল। শিউলাল অভ্যাসবশত দ্রুত দিক পরিবর্তন করার চেষ্টা করামাত্র স্লিপ করে পড়লেন।
নেট প্র্যাকটিসে নিজেদের টিমের অবস্থা দেখে দর্শক মহলে ইতিমধ্যেই ক্ষোভ জমেছে। এত রিস্ক ঘাড়ে নিয়ে, এত টাকা খরচ করে এই খেলা দেখতে আসাটা বোধহয় বোকামি হয়েছে। এতদিন ধরে তা হলে কী প্র্যাকটিস করল! শেষে না লুম্যানদের হাসির খোরাক হয়। ওয়ান সাইডেড ম্যাচ যে হবে তাতে তো কোনও সন্দেহই নেই।
টাইম আপ! খেলোয়াড়রা ফিরে যান প্যাভিলিয়নে। টস হবে। অতিথি টিমের ক্যাপ্টেন ওরিলিকেই কয়েন ছুড়তে অনুরোধ করা হয়েছে। বুড়ো আঙুলের ডগা থেকে মুদ্রাটা ছিটকে যাওয়ামাত্র আবার বোঝা গেল যে, অজস্র বক্তৃতা গেলানো ও পাখি-পড়া করে শেখানোর পরেও চাঁদের দেশের নিয়ম মেনে চলা বড় সহজ হবে না। কয়েনটা কত তলা বাড়ির ছাদ পেরিয়ে উঠেছিল বলা শক্ত। নামছে তো নামছেই।
লুনার ইলেভেনের ক্যাপ্টেন (এক নম্বর) হাত উঁচু করে জানিয়ে দিলেন, টসে তাঁরা জিতেছেন। ওয়ার্ল্ড ইলেভেনকে তাঁরা প্রথম ব্যাট করার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
এর উলটোটা হলেই খুশি হত আবির।
১০
টাকাটা পুরো জলে গেল। ভাবছিলেন পার্থ। যে জন্য আসা তার বোধহয় কিছুই হওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রচণ্ড কড়াকড়ি। দর্শকদের বিভিন্ন ব্লকে ভাগ করে বসানো হয়েছে। প্রত্যেক ব্লকে একজন করে অফিসার-ইন-চার্জ। তাঁদের অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। শারীরিক কোনও অস্বস্তি হলে তাঁরাই ব্যবস্থা করবেন মেডিক্যাল সেন্টারে পাঠাবার।
সবচেয়ে বড় কথা লুম্যানদের সংস্পর্শে আসার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এমনকী, তাঁদের কীরকম দেখতে সেটা অবধি জানা সম্ভব নয়। স্পেস স্যুটের আবরণ দুর্ভেদ্য।
পার্থদের ব্লক থেকে তিন দর্শককে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ ইতিমধ্যেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন মহাকাশতরীতে। তারা নাকি ট্রান্সমিটারের সাহায্যে লুম্যানদের কাছে গোপন বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করছিল।
গ্যালারি ছেড়ে একবার উঠেছিলেন পার্থ। পেছনের অংশে স্ন্যাক্স ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। চাঁদের কোনও সামগ্রী নেই সেখানে। সবই পৃথিবীর ক্যাটারাররা বয়ে এনেছে। তবে কেনাকাটার চেয়ে দেখবার লোকই বেশি। আর বাড়তি আকর্ষণের মধ্যে স্পেস-স্যুটের মাথার অংশটা খুলে ফেলার সুযোগ। কারণ এটা বায়ুনিরোধক কামরা। স্বাভাবিকভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস চালানো যায়।
সবচেয়ে বেশি ভিড় স্মোকিং রুমে। লাইন পড়ে গেছে গোটা দশেক খুপরির প্রত্যেকটার সামনে। শুধু সিগারেট কেনা নয়, সেকেন্ডের হিসেবে অক্সিজেন পোড়ানোর জন্য অগ্রিম মাসুল দিতে হবে। খুব শাঁসালো ব্যাবসাদার ছাড়া কেউ ঘেঁষতে পারবে না।
মুখোশ খোলার পর পার্থ দেখলেন চেনা মুখ একটাও নেই। একসঙ্গে দল বেঁধে খেলা দেখতে আসার অনুমতি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। দর্শকদের এমনভাবে বিভিন্ন ব্লকে ছড়িয়ে দিয়েছে যাতে অপরিচিতদের মধ্যেই প্রত্যেককে বসতে হয়। নিরাশা যত বাড়ছে অযথা টাকা নষ্ট করার শোকটাও উথলে উঠছে। কত দিন ধরে যে ধারদেনা শোধ করতে হবে…
চমকে উঠলন পার্থ। সবে এসে বসেছেন আসনে। স্পষ্ট তাঁর নাম ধরে কে যেন ডাকল। কে যেন বলতে তো একটাই সম্ভাবনা। মাইক্রোফোন। সিঁটিয়ে বসলেন পার্থ। গ্যালারির সাধারণ কোলাহল ও ধারাবিবরণী এখন শুধু আবছা শুনতে পাচ্ছেন। সেই খবর ছাপিয়ে মাইক্রোফোন বলে চলেছে, “পার্থ মিত্র। পার্থ মিত্র। ভয় নেই। সাড়া দিন। আপনার কথা আমরা ছাড়া কেউ শুনতে পাবে না।”
পার্থ আতঙ্কিত স্বরে বলল, “হ্যাঁ, মানে শুনছি।”
“ধন্যবাদ, আপনি কি সত্যিই আপনার ঠাকুর্দার কথা জানতে চান?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়…”
“বেশ। তা হলে পাঁচ নম্বর ওভার শেষ হলেই টয়লেটে চলে আসবেন। উনিশ নম্বর টয়লেটে।”
“উনিশ?”
“পাঁচ ওভার। উনিশ।” লুম্যানের কথা শেষ হওয়া মাত্র পার্থ ঘাড় ফিরিয়ে তাকান নীল বর্শা আঁকা গ্যালারির প্রহরীর দিকে। হাতে ট্রান্সমিটার নিয়ে বসে আছে। ভাব দেখে তো মনে হচ্ছে না এসব কাণ্ডের কোনও গন্ধ পেয়েছে বলে।
১১
ক্যাপ্টেন ওরিলির সঙ্গে করমর্দন সেরে দুই ওপেনার রওনা হয়ে গেলেন। ইন্দ্রজিৎ আর বগোমলভ।
আবির ভেবেছিল এই ম্যাচে উদ্বেগের মোকাবিলা করতে হবে না। রান পাক বা না-পাক, পারিশ্রমিকের অঙ্কটা এমনই যে, তাকে আগামী তিন বছরের মধ্যে আর টাকাকড়ি নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে না। চাকরি ছেড়ে দিলেও নয়। কিন্তু মাইক্রোফোনের দৌলতে অসংখ্য দর্শকের হৃদস্পন্দনের ছোঁয়া পেতেই তার মনে হল, সে-ও যখন নামবে, অনেক প্রত্যাশা এইভাবে তাকে জড়িয়ে ধরবে।
পাতলা, বেঁটে চেহারা ইন্দ্রজিতের। বগোমলভ সাড়ে ছ-ফুট ঢ্যাঙা এক দস্যু। কিন্তু চেহারা দেখে তাঁদের মেজাজের হদিস লাভের চেষ্টা করলে ভুল হবেই। সতর্কতার শেষ কথা বগোমলভ আর ইন্দ্রজিৎ যে ঠিক কী, এক কথায় বোঝানো অসম্ভব। মারমুখো, হ্যাপি-গো-নাকি লাকি আনঅর্থোডক্স।* তবে টিকে গেলে তিনি যে-কোনও ওয়ান ডে-র মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন।
লেগ ও মিডলের গার্ড নিলেন ইন্দ্রজিৎ। তিন নম্বর বোলার তাঁর দৌড় মাপছেন। অবশ্য দৌড় নয়, হেঁটে হেঁটেই তিনি রওনা হয়েছেন বল করার জন্য। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে, তাঁর বাঁ হাতটা কনুইয়ের কাছে ভাঁজ করা রয়েছে— যেন বাঁ অঙ্গ পক্ষাঘাতে পড়ে গেছে। এবার তিনি ডান হাতটাকে বনবন করে ঘোরাতে শুরু করেছেন। আমগাছের মগডাল থেকে ঘুড়ি পাড়ার জন্য ঢিল-লঙ্গর করার ভঙ্গি। বোলিং ক্রিজে পা ফেলে ওই ঘুরন্ত হাত থেকেই এক ফাঁকে মুক্তি দিয়েছেন বলটাকে।
ইন্দ্রজিতের হয়ে মনে মনে জপ করছিল আবির, বলটা যেন ঠিক লেগ স্টাম্পের ওপর ও গুড লেংথের চেয়ে খাটো স্পটটায় না পড়ে। ইন্দ্রজিতের ব্লাইন্ড স্পট। কিন্তু ঠিক তাই ঘটল এবং ইন্দ্রজিৎ জীবনে এই প্রথম ইনিংসের শুরুতেই তাঁর মারণাস্ত্রের সম্মুখীন হয়েও বেঁচে গেলেন। প্রবৃত্তিবশত স্টেপ আউট করতে গিয়েছিলেন। পা পিছলে পড়ে গেছেন তাই বেঁচেছেন। বলটা স্টাম্পের বেশ কিছুটা ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
তাও পুরো ওভার টিকতে পারেননি ইন্দ্রজিৎ। দু’ রান করার পর এলোপাথাড়ি ব্যাট চালিয়ে লোফ্ফা ক্যাচ দিয়ে ফিরে এলেন চার বলের মাথায়।
(গত বছরের ‘ক্রিকেট হিউমার’ লিখেছিল “অতি নির্ভরযোগ্য বগোমলভের একটাই দোষ, খেলতে খেলতে মাঝে-মধ্যে উনি কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙার পর অবশ্য খুবই ঝলসে ওঠেন, তখন ঘণ্টাতিনেকের মধ্যে সতেরো, এমনকী আঠারো রানও করে ফেলেন। এবার ওঁর ব্যাটিং-ঘুমের সময়ে সব দর্শক, এমনকী আম্পায়ারও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমাদের দ্বিতীয় নির্ভরযোগ্য ওপেনার ইন্দ্রজিৎ আবার হিরের টুকরোর মতো লেট আউট সুইজার বা খ্যাঁকশেয়ালের মতো ইয়র্কারকে কোনও পরোয়াই করেন না, কিন্তু মাথামোটা ফুলটস কি তালকানা লং হপই সাধারণত ইনিংসের শুরুতেই তাঁকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করে।”)
ওয়ান ডাউন একওয়েনসি। ম্যাকডোনাল্ড স্বগতোক্তির ভান করে সবাইকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বললেন, “আমাদের হায়েস্ট স্কোরারের চেয়ে মাত্র দু’ রান কম করবেন ইনি।” চিন ও আফ্রিকার খেলোয়াড় ম্যাকের রসিকতাকে উসকানি দেয়।
আবির একওয়েনসিকে সতর্ক করে দেয়, “তিন নম্বরের বোলিং অ্যাকশন কিন্তু ছলনাময়। ডান ইয়ার স্পিড চেকে দেখছি এইট্টি। খেয়াল রাখবেন!”
“থ্যাঙ্ক ইউ!”
এক-একটা বল হয় আর নতুন নতুন শিক্ষা নেয় আবির। গুড লেংথ স্পটে বল পড়লে, সেটা সব সময়েই ছেড়ে দেওয়া সম্ভব। লাফিয়ে বেরিয়ে যাবে, উইকেট ছোঁবে না। অবশ্য শুধু তো টিকে থাকা নয়, রানও পেতে হবে।
বিনা দুর্ঘটনায় পাঁচ ওভার শেষ। তেরো রান। বগোমলভ এখনও খাতা খোলেনি।
ষষ্ঠ ওভারে ফিল্ডিংয়ের রদবদল চোখে পড়ল। নিশ্চয় কোনও মতলব আছে। সিলি পয়েন্ট, শর্ট লেগ ও আত্মঘাতী সিলি মিড অনে একটি করে ফিল্ডার রেখে নতুন বোলার আসছেন। সামনে বগোমলভ। তিনি এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন যে, মাটি থেকে ব্যাট না তুললে এখানে তাঁকে পরাস্ত করা খুব শক্ত। কিন্তু এবারের বলটা বুক সমান ফুলটস। পেছিয়ে এসে খেললে বাউন্ডারি পেতেন কিন্তু আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে ব্যাটটা উঁচু করলেন। আর ব্যাটের ফলা ছেড়ে সেটা মাটিতে পড়ার আগেই সিলি পয়েন্ট ছোঁ মেরে তুলে নিলেন।
আবির নেমেছে। একওয়েনসি জানিয়ে দিলেন, শর্ট রান নিতে হবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ছুটতে শুধু ব্যাটসম্যানদের অসুবিধে হচ্ছে না, ফিল্ডারদেরও তাই।
১২
আশা ও নিরাশার আরও নানারকম খেলা চলেছে মাঠের বাইরে।
পার্থ অবশ্য ইচ্ছাপূরণের সুযোগ পেতে চলেছেন। উনিশ নম্বর টয়লেটের বন্ধ দরজার ভেতরে আবার সেই লুম্যানের গলা, “সময় রক্ষার জন্য ধন্যবাদ। বলুন, আপনার ঠাকুরদার সম্পর্কে কী জানতে চান?”
পার্থ এখন অনেকটা সাহস পেয়েছেন, “সব। যা জানা সম্ভব, সব জানতে চাই। কেন এসেছিলেন, কী করতেন, তাঁর ছবি বা ডায়েরি। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়—” এক নিশ্বাসে বলে যায়।
“তা হলে তো কয়েক দিন থাকতে হবে আপনাকে।”
“যত দিন দরকার, সারা জীবন থাকতে হলেও আমি রাজি।”
“ভালো করে ভেবে দেখুন। দিন চারেকের মধ্যেই আমরা অবশ্য আপনাকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারি, কিন্তু তাতে যদি আপনার ক্ষতি হয়…”
“ক্ষতি হলেও আমি থাকব।”
“বেশ। আর কোনও প্রশ্ন?”
“দু-একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে। আপনারা কি থট রিডিং জানেন? কী ভাবেই বা পুলিশদের ফাঁকি দিয়ে আমার সঙ্গে কথা—”
‘থট রিডিং নয়, পৃথিবীর যত দর্শক এখানে এসেছেন প্রত্যেকের সম্পূর্ণ পরিচয় আমাদের কম্পিউটারের মগজে ভরা আছে। আপনার আসার উদ্দেশ্য আমরা জানতাম। আর সংযোগ স্থাপন? এমন এক তরঙ্গের সাহায্য নিয়েছি যা আপনাদের গোয়েন্দা বিজ্ঞানীরা কল্পনাও করতে পারবেন না, ধরা দূরের কথা।”
“আমার মতো আরও অনেকেই কি…” পার্থর প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই নিরেট দেওয়ালের মধ্যে ফুটে উঠল একটা দরজার পাল্লা।
লুম্যান আহ্বান জানালেন, “এদিকে আসুন।”
পার্থ গুপ্তপথে পা বাড়ালেন আর সঙ্গে সঙ্গে পার্থর পরিচয়মূলক নম্বর গলায় ঝুলিয়ে এক দ্বিতীয় পার্থ টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলেন। নকল পার্থ গ্যালারির ফাঁকা আসনটা ভরিয়ে না ফেললে ব্যাপারটা জানাজানি হতে দেরি হত না।
এরকম ক’জন ছদ্মবেশী আসলের জায়গা দখল করেছেন, বলা দুষ্কর।
১৩
মিস টাইমিং, মিস হিট, দুটো নির্ঘাৎ ক্যাচ, বার তিনেক রান আউট ও একটা স্টাম্পিংয়ের সুযোগ দিয়েও টিকে আছে আবির আর একওয়েনসি। দাঁতে-দাঁত টিপে উইকেট কামড়ে বিশল্যকরণী আর সঞ্জীবনী সুধা খুঁজছে।
দু’ উইকেটে ছিয়াত্তর কিন্তু আর মাত্র তেরো ওভার বাকি। রান রেট বাড়ানোর কোনও উপায়ই কি নেই?
মানমন্দিরের প্রান্ত থেকে স্পিনার ডাকা হয়েছে। দুবার পরাস্ত হয়েছে আবির। দারুণ ঘুরছে বল। আর তেমনই ধাঁধিয়ে দিচ্ছে ফ্লাইট। ওয়েল ফ্লাইটেড ঝুলন্ত বল উপবৃত্তাকার পথে মাটিতে আঘাত করার পর প্রায় গড়িয়ে আসে অথচ কম ফ্লাইটের একই গতিসম্পন্ন বল বেশি লাফায়।
এ অবধি ওরা রান যা পেয়েছে, সবই প্রায় উইকেটের পেছন থেকে। ফ্লিক বা গ্লান্স। ফিল্ডারদের অবস্থান দেখলেও সেটা একনজরে এখন ধরা যায়। একওয়েনসি যদি অভিনব কায়দায় রান নেওয়া শুরু না করতেন তা হলে এর অর্ধেকও স্কোর উঠত কি না সন্দেহ। কোনওরকমে পাঁচ-সাত পা সতর্কভাবে দৌড়েই স্কিট খেয়ে তিনি বিপরীত উইকেটে পৌঁছে যাচ্ছেন। আবিরও কায়দাটা রপ্ত করে নিয়েছে।
পরের ওভারের প্রথম বলেই একওয়েনসির অধৈর্য প্রকাশ পেল। জবরদস্ত এবং কপিবুক-সম্মত হুক। কিন্তু লঙ লেগের ফিল্ডার একটা ছোট্ট লাফ মেরেই তার মাথার চার ফুট ওপর থেকে ক্যাচটাকে পেড়ে ফেললেন।
ক্যাপ্টেন ওরিলি নামছেন। আবির বুঝতে পারে উইকেটের সামনে শট নিতে না পারলে কিছুতেই রানের গতি বাড়ানো সম্ভব নয়।
ওভারের শেষ বলে বোল্ড হয়ে গেলেন ওরিলি। ব্যাটের ইনারশিয়া তাঁকে ঠকিয়েছে। পুরো ব্যাক লিফট নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত। স্ট্রেট ড্রাইভ করতে গিয়েছিলেন ব্যাটের শ্লথ আচরণের জন্য টাইমিং-এ গণ্ডগোল।
আর দশ ওভার বাকি। একাশি রানে চার উইকেট।
ব্যাটটা কাঁধে তুলে এবার স্টান্স নিয়েছে আবির। নতুন করে গার্ড নিল লেগ স্টাম্পে। ব্যাক লিফটের প্রয়োজন হবে না আর। একটা নিরবচ্ছিন্ন গতিতে ব্যাটটা ওপর থেকে নেমে এসে আঘাত হানবে।
টাইমিংটা ঠিক করে নিতে প্রথম দুটো বল শুধু আটকেছে। নিখুঁত কভার ড্রাইভ তৃতীয় বলটাকে সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। হবে— এভাবেই হবে। নিজেকে বোঝায় আবির। ইনিংসের তৃতীয় বাউন্ডারি। দর্শকদের উচ্ছ্বাস ফেটে পড়ছে।
তিন ওভারে বিপক্ষকে নয়-ছয় করে সাঁইত্রিশ রান তুলে নিয়েছে আবির। তাকে স্ট্রাইক দিয়ে যাচ্ছেন ম্যাক। আবিরের রান আটকানোর জন্য ফিল্ডারদের নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। দুটো স্ট্রেট ড্রাইভ থেকে একটাও রান পেল না আবির। আর ভুলটাও হল সেই কারণে। এই প্রথম স্ট্রেট ব্যাটে না খেলে কাট করার চেষ্টা করেছিল। ফার্স্ট স্লিপে ধরা পড়ে গেল।
সিক্সটি সেভেন। স্ট্যান্ডিং ওভেশন। আর তারই মধ্যে অত্যন্ত অপ্রীতিকর কিছু চিৎকার। “টিচ দ্য স্লেভস! বিট দ্য স্লেভস।” সংক্রামক ব্যাধির মতো বিশ্ব-দরবারের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার প্রতিধ্বনি ওঠে।
প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরও শোনা যায়। এইসব কথা পৃথিবীর ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। মুশকিল হচ্ছে, কাউকেই শনাক্ত করা সম্ভব নয়। পাশের লোকটিও যদি গালি দেয় ধরার উপায় নেই। সবই চলছে মাইক্রোফোনের মধ্যস্থতায়। কিন্তু মাস্টার কন্ট্রোল অতটা অসহায় নয়। জটিল কম্পিউটার নির্ভর স্বর-বিশ্লেষক যার সাহায্যে আপত্তিকর শ’ দুয়েক লোককে গ্রেফতার করে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
একশো বাহান্ন রানে ইনিংসের ওপর যবনিকা। পঞ্চাশ ওভার ফুরিয়ে গেছে।
১৪
খেলোয়াড়রা প্যাভিলিয়নে ফেরার আগেই চাঁদের বাসিন্দাদের কারিগরি সভ্যতার আর-একটা বিস্ময়কর নিদর্শন দেখা গেল। গ্যালারির প্রত্যেক ব্লকের দু’ কোণে একটা করে সবুজ লেটার বক্সের মতো জিনিস রয়েছে। এতক্ষণ সেটার উপযোগিতা বোঝা যায়নি।
মাইক্রোফোন ঘোষণা করল, “পৃথিবীর দর্শকদের জন্য আমাদের প্রীতি-উপহার সংগ্রহ করে নিন। গ্যালারির দুই প্রান্তের স্বয়ংক্রিয় প্রিন্টার আপনাদের জন্য তৈরি করেছে সচিত্র স্কোরকার্ড।”
বাক্সের সামনে হাত পাতলেই খসে পড়ছে স্কোরকার্ড। কৌতুহলী দু-চারজন প্রথম এগিয়ে গিয়েছিল। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো গ্যালারি ভিড় জমিয়ে ফেলেছে স্কোরকার্ড সংগ্রহের জন্য।
নামেই স্কোরকার্ড। কাগজ, বোর্ড, এমনকী প্লাস্টিকের ওপর ছাপা কিছু হলেও না হয় বোঝা যেত। পকেট ক্যালকুলেটরের মতো আকারের এক-একটি ভিডিয়ো সেট। প্রত্যেক ব্যাটসম্যানের নামের পাশে একটি করে বোতাম। সেটা টিপলেই স্ক্রিনে ভেসে আসছে তার ইনিংসের চলচ্চিত্র। এমনকী ‘অতিরিক্ত’-র পাশের বোতাম টিপলেই ১২টা এসট্রা কীভাবে এসেছে— কার কোন বল থেকে— সেটাও একে-একে ফুটে উঠছে।
সিনক্লেয়ারও একটা ভিডিয়ো স্কোরকার্ড সংগ্রহ করেছেন। উলটেপালটে খুঁটিয়ে দেখছেন কোনও নির্মাতার নাম আছে কিনা। তা হলে এক্ষুনি জানাতে হবে কন্ট্রোলকে।
এবারও নিরাশ হয়েছেন সিনক্লেয়ার। অভিযোগ করার মতো এখনও কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না।
স্কোরকার্ডের ওপর আপনা থেকেই চোখ বুলিয়ে যান সিনক্লেয়ার:
ভিডিয়ো স্কোরকার্ড
ওয়ার্ল্ড ইলেভেন
- ইন্দ্রজিৎ ক. ৯ (উইকেট কিপার) বো. ৩ ২
- বগোমলভ ক. ৫ বো. ৬ ০
- একওয়েনসি ক. ৮ বো. ৭ ৩৯
- আবির ক. ২ বো. ৪ ৬৭
- ওরিলি (ক্যাপ্টেন) বো. ৪ ২
- ম্যাক বো. ৬ ২০
- শিউলাল (উইকেট কিপার) ক. ৯ বো. ৩ ৮
- গিলক্রিস্ট বো. ৭ ১
- সাইমন নট আউট ১
- ওয়াঙ নট আউট ০
- অতিরিক্ত ১২
মোট (৮ উইকেটে) ১৫২
আবিরের নামের পাশের বোতামটা টেপেন। চোখটা স্ক্রিনের ওপর কিন্তু মনটা নেই।
পৃথিবীর যাবতীয় বিজ্ঞাপনদাতা সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে কাল অবধি সিনক্লেয়ার ছিলেন সবচেয়ে লেজমোটা ভিআইপি। এমনকী টেলিভিশন কর্তৃপক্ষও ‘প্রতিরক্ষা সচিব’ হিসেবে সামগ্রিকভাবে নিযুক্ত করেছে তাঁকে।
‘সিকিউরিটি’ লেখা তিন চাকার ছোট্ট ইলেকট্রিক গাড়িটা হাঁকিয়ে বেজায় ব্যস্ত সমস্ত ভঙ্গিতে তিনি প্রথম থেকেই মাঠের বিভিন্ন জায়গা চষে বেড়াচ্ছিলেন। কোথায় উইকেটের পেছনে স্টারট্রেক-এর বিজ্ঞাপনটা বসবে, কোন হোর্ডিংটা এক ফুট বেশি লম্বা হয়ে গেছে ইত্যাদি তদারক করেছেন। কিন্তু আসলে তাঁর দৃষ্টি ছিল লুনার বিজ্ঞাপনের দিকে। কারণ লুম্যানরা বিশ্ব টেলিভিশনের কাছে তাঁদের কোনও বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য আবেদন জানাননি। অথচ সবাই নিঃসন্দেহ যে, আজকের ম্যাচটা স্রেফ অছিলা। আসলে পৃথিবীর বাজারে নিজেদের মালপত্র বেচার সুযোগ তৈরি করার জন্যই এইসব কাণ্ড। কিন্তু কোথায় ওঁদের বিজ্ঞাপন?
সিনক্লেয়ার ভিডিয়ো স্কোরকার্ড পকেটে ভরে ট্রান্সমিটার তুলে নেন মুখের কাছে। “ইকেরাস! ইকেরাস! কন্ট্রোল রুম প্লিজ। কোড নাম্বার ফাইভ নাইন সেভেন।”
লেশনার রিসিভ করেন কল। বিশ্ব সরকারের দুই প্রতিনিধি লেশনার ও অ্যান্ড্রু এবং ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের দয়াল ও শিবশঙ্কর ‘ইকেরাস’ ছেড়ে নামেননি। চাঁদকে ঘিরে পাক খেতে-খেতেই তাঁরা কড়া নজর রাখছেন সব কিছুর ওপরে। তাঁদের সঙ্গে আছেন একদল কম্যান্ডো আর বারোজন চিকিৎসক। দায়িত্বের সবচেয়ে ভারী বোঝাটা এই ক’জনেই বইছেন আজ।
সিনক্লেয়ার বলেন, “কিচ্ছু অস্বাভাবিক চোখে না পড়াটাই সবচেয়ে অ্যাবসার্ড বলে মনে হচ্ছে। এত টাকা খরচ করে তাঁরা তা হলে আমাদের নিয়ে এলেন কেন! পৃথিবীর বাজারে ওঁরা যদি ওঁদের কোনও জিনিস বেচতে না চান— তা হলে তো কোনও মানেই হয় না!”
লেশনার বোঝাবার চেষ্টা করেন, “উদ্দেশ্য আরও অনেক রকমই থাকতে পারে। আপনি শুধু আপনার লাইনেই ভাবছেন, তাই হয়তো…”
সিনক্লেয়ার তবু গজগজ করেন। লেশনার বলেন, “আপনি কনভিন্সড নন, বুঝতে পারছি। এক কাজ করুন, চাঁদের পিঠে আমাদের কমান্ডার-ইন-চার্জ কার্লফ-এর সঙ্গে বরং কথা বলুন। আপনার লাইনটা ওঁর কাছে রিডাইরেক্ট করে দিচ্ছি।”
চান্দ্র-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিটিংয়ের মধ্যেই সিনক্লেয়ারের কলটা ধরলেন কার্লফ। হ্যাঁ-হুঁ করে শান্তভাবে সব বক্তব্য শুনে কার্লফ জানালেন, “ডোন্ট ওরি স্যার! এবার নিশ্চিন্ত মনে নিজের সিটে বসে খেলাটা বরং উপভোগ করুন। আমার মনে হয় না, আপনার আর কিছু করার আছে। সত্যি বলতে, আপনাকে হিংসে হচ্ছে। এই মিটিং করতে-করতে আর কন্ট্রোল রুমের জেরার জবাব দিতেই বোধ হয় সারাক্ষণ কেটে যাবে। খেলা দেখব যে একটু মন দিয়ে…”
কার্লফ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগেই সিনক্লেয়ার বাধা দিয়ে বলেন, “কিন্তু, ধরুন, হঠাৎ খেলা চলার সময়েই ওঁরা না বলেকয়ে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে দিলেন। এই ধরুন, টিভি ক্যামেরায় ঠিক ধরা পড়ে যাবেন এইভাবে বেলুন-টেলুন উড়িয়ে দিলেন…”
হাসিতে হেডফোন ফাটার উপক্রম, “বেলুন! চাঁদের আকাশে যে বেলুন উড়বে না মিস্টার সিনক্লেয়ার…।”
“বেলুন মানে, কথার কথা, অন্য কিছুও তো…”
“বলছি তো কোনও আশঙ্কা নেই। চাঁদের চিফ সেক্রেটারির সঙ্গে আলোচনা করেছি বলেই এত জোর দিয়ে বলতে পারছি।”
১৫
চাঁদের হাই-পাওয়ার সরকারি মহলের সঙ্গে আলোচনা সভাটা স্টেডিয়ামেরই একাংশে বসবে, এটা কেউ ভাবেনি। বিশ্ব ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের দুই প্রতিনিধি খান্না ও গোপালন আর রাজনৈতিক তথা সামরিক প্রতিনিধি কার্লফ ও কিখ রীতিমতো নিরাশ। কেউই ভাবতে পারেননি, চান্দ্র-সরকার ভিআইপি-দের জন্যও একটা সংক্ষিপ্ত সফর বা নিদেনপক্ষে ক্যাবিনেট পর্যায়ের অভ্যর্থনার আয়োজন করবে না।
কার্লফই প্রথম অভিযোগের সুরে বললেন, “আমরা আশা করেছিলাম এই মিটিংটার সময় অন্তত স্পেস স্যুট খুলে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা চালাতে পারব।”
চাঁদের চিফ সেক্রেটারি মিস্টার ওমেগা বললেন, “দুঃখিত। আমাদের কাছে চেহারার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আচরণ। স্পেস স্যুট শুধু চেহারাটাকেই আড়াল করে। আচরণ নয়।”
কথাটা ঘুরিয়ে নিলেন খান্না, “স্টেডিয়ামে আপনাদের ব্লকে দর্শকসংখ্যা তো অতি নগণ্য। ক্রিকেট কি খুব জনপ্রিয় নয়?”
উত্তর আসার আগেই ওকিফ প্রশ্নটার সঙ্গে একটা অন্য তাৎপর্য জুড়ে দেন, “না না, ওরকম অনুমান করছেন কেন, হয়তো এখানকার পপুলেশন…”
কথা শেষ করতে দেননি ওমেগা, “সৌজন্যমূলক সফর এটা। আপনারা নিশ্চয় আমাদের দেশ সম্বন্ধে এমন কিছু কৌতুহল প্রকাশ করবেন না, যেটার সামরিক গুরুত্ব থাকতে পারে। পৃথিবীর জনসংখ্যা নিয়ে কিন্তু আমাদের কোনও কৌতূহল নেই।”
ওমেগা খান্নার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “আপনার অনুমান অবশ্য ঠিক। দাবা ছাড়া কোনও খেলারই চল নেই এখানে। পৃথিবীতে ক্রিকেট সবচেয়ে জনপ্রিয় বলেই আজকের আসর বসিয়েছি আমরা।”
কার্লফ বললেন, “মিস্টার ওমেগা! একটা কথা বলে নিই। কথার ফাঁকে আপনাদের সম্বন্ধে হয়তো কিছু অন্যায় কৌতূহল প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু সেটা নিছকই কৌতূহল। খারাপ উদ্দেশ্য সত্যিই কিছু নেই। আমি বরং সবার আগে আসল কথাটা সেরে নিই। টাকা-পয়সার হিসেবটা। আপনাদেরই কমিটমেন্ট মতো এখনও কিছু…”
ওমেগা বললেন, “দশ মিনিট বাদে আপনারা আপনাদের মহাকাশযানের কন্ট্রোলের সঙ্গে কথা বলবেন। তার মধ্যেই ব্যালান্স পেমেন্ট আমরা পৌঁছে দেব।”
ওকিফ জানতে চান, “আমরা যদি পৃথিবীতে একটা পালটা ম্যাচের ব্যবস্থা করি, আসবেন আপনারা?
“নিশ্চয় আসব। কিন্তু তার আগে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে, বছর পঞ্চাশ আগের সেই ঘটনার আবার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না।”
খান্নারা তিন পুরুষ কলকাতার বাসিন্দা। নিজেকে বাঙালি বলেই মনে করেন। খান্না রসিকতা করে বলেন, “বাহ! আপনি তো দিব্যি শুদ্ধ বাংলা বলেন। পুনরাবৃত্তি। বাঙালিরাও এখন রিপিটেশনের বাংলা পরিভাষা জানে না।”
ওমেগা বিনীতভাবে নিবেদন করেন, “ওটার কৃতিত্ব আমার নয়। কম্পিউটারের। আমার বক্তব্যকে কম্পিউটারই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত করে মাইক্রোফোনের মধ্যস্থতায় পৌঁছে দিচ্ছে আপনাদের কাছে। বিভিন্ন ভাষায়।”
এতক্ষণে অ্যান্ড্রু প্রথম মুখ খোলেন, “মিস্টার ওমেগা, আমরা কিন্তু খুবই বিস্মিত হয়েছি একটা ব্যাপারে। এই ম্যাচকে উপলক্ষ্য করে আমাদের ব্যবসায়ীরা কত বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু আপনাদের তরফ থেকে কিচ্ছু নেই। আপনারা কি…।”
ওমেগা বললেন, “হ্যাঁ, ব্যাপারটা প্রথমে আমাদেরও ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। খামোখা এখানে আপনারা মোটরগাড়ির বিজ্ঞাপন কেন দিচ্ছেন। হাওয়া-পোরা টায়ার বা অক্সিজেন দহনকারী পেট্রল বা ডিজেল এঞ্জিন তো চাঁদে চলবে না। তারপর বুঝেছি, আসলে এটা পৃথিবীতে গাড়ি বেচার জন্যই করছেন আপনারা। চাঁদের মার্কেট দখলের জন্য নয়। আসলে আমাদের এখানে অর্ডার বা প্রয়োজন অনুসারেই সব কিছু তৈরি হয়। বিজ্ঞাপন ব্যাপারটাই অচল। নিউ কনসেপ্ট। পৃথিবীতে আমরা অবশ্যই আমাদের তৈরি জিনিস বেচতে চাই। কিন্তু তার জন্য যে… আশা করি, যদি রিটার্ন ম্যাচ একটা হয়, পৃথিবীতে আমরা খেলতে যাই, তখন কিছু বিজ্ঞাপন তৈরি করা যাবে। আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা আপনাদের প্রত্যেকটি বিজ্ঞাপন স্টাডি করতে শুরু করে দিয়েছেন।”
১৬
কয়েদির সংখ্যা আড়াইশো হওয়ার পরে সাত নম্বর সিকিউরিটি এজেন্টের বিশেষ অনুরোধে এক কামরার একটা মোনোরেলের ব্যবস্থা করে দিল লুনার গভর্নমেন্ট।
বাকি খেলা দেখতে না পাওয়ার জন্য কোনও আফসোস নেই গুহ রায়ের। এই আড়াইশো জনের মধ্যে তাঁর নিজের শিকারই একশো সাতাত্তর।
সঙ্গে আরও কয়েকজন প্রহরী নেওয়ার প্রস্তাব তিনি এক শব্দে উড়িয়ে দিয়েছেন। চলন্ত মোনোরেলের লম্বাটে কামরার এক দিকের দেওয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে গুহ রায়। বাঁ হাতে একটা থার্মো সেনসিটিভ সাব-মেশিনগান। ডান হাতে ট্রান্সমিটার।
অল্প কথার লোক গুহ রায়। প্রথমেই যাত্রীদের জানিয়ে দিয়েছেন বসিয়ে রাখার চাইতে তিনি বেশি পছন্দ করেন অপরাধীরা শুয়ে থাকুক। গুহ রায়ের ডান পা-টা একটু উঁচু করে দৃষ্টি আকর্ষণ না করালেও কয়েদিদের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না যে, মেঝের ওপর যে তিনজন পড়ে আছে তারা আর কোনও দিনই উঠে বসবে না।
মোনোরেল মহাকাশবন্দরে পৌঁছে দিল যাত্রীদের। তিন মিনিটের মধ্যেই ফেরি-রকেট আসবে তাদের ভ্রাম্যমাণ স্পেস শিপ ইকেরাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কয়েদিরা নির্দেশমতো সারি দিয়ে এগোচ্ছেন। সবার পেছনে গুহ রায় একটা ইলেকট্রিক ট্রলিতে চড়ে চলেছেন মৃতদের সঙ্গে।
ঠিক এয়ার লক পেরিয়ে বেরনো মাত্র দুশো বাইশ নম্বর কয়েদি আচমকা শরীরে আধখানা মোচড় দিয়ে গোলকিপারের মতো ডাইভ দিল।
গুহ রায় ছিটকে পড়েছেন ইলেকট্রিক ট্রলি থেকে। ট্রলিটা তবু থামেনি— চালকহীনভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে।
সাব মেশিন ও ট্রান্সমিটার দুই-ই ছিটকে গেছে গুহ রায়ের হাত থেকে। দুশো বাইশ চড়ে বসেছে গুহ রায়ের বুকে। গুহ রায় যেন বিনা যুদ্ধেই পরাজয় স্বীকার করে নিতে চাইছেন।
দুশো বাইশ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল অন্য কয়েদিদের দিকে। তার কাছে ট্রান্সমিটার নেই কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় সে কী আশা করছে।
কিন্তু কেউই এগিয়ে এল না আগ্নেয়াস্ত্রটা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য। আর ঠিক সেই সুযোগেই গুহ রায়ের স্পেস স্যুটের ডান হাতের দস্তানার সঙ্গে সংযুক্ত ধারালো ছুরির ফলাটা শকুনের দাঁতের মতো খুবলে ছিড়ে দিল বাইশ নম্বরের পোশাকের পিঠের কাছটা।
অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল স্পেস স্যুট ছেড়া মাত্র। গুহ রায় নিজেকে বাঁচাতে জানেন।
ইকেরাসে স্বয়ং লেশনার এসে হ্যান্ডশেক করে অভ্যর্থনা জানালেন গুহ রায়কে, “ওয়েল ডান! ওয়েল ডান! কফি না কোল্ড ড্রিঙ্কস?”
“কিচ্ছু না, আমি আবার ফিরে যেতে চাই। ব্যবস্থা করুন। কিন্তু তার আগে একটা জিনিস শুধু জানিয়ে দেওয়া দরকার। প্রয়োজন ছাড়া আমি চরম ব্যবস্থা নিই না। মৃত চারজনের মধ্যে একজনের জন্য শুধু আমি দায়ী। বাকি তিনজন, আমার প্রহরীরা টেনে আনে, তখনই তারা শেষ। কারণটা রহস্যময়!”
“ডাক্তারদের টিমের হাতে…”
“তার কোনও ফুরসত ছিল না। ওদের ডেডবডিই আবিষ্কার করি। অসুস্থ অবস্থায় নয়।”
গুহ রায়কে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে লেশনার ইন্টারকমে তলব করলেন কর্নেল দেশমুখকে। দেশমুখ মেডিকেল টিমের ইনচার্জ।
“কর্নেল, আপনি কি ডেডবডি পরীক্ষা করেছেন?”
“ইয়েস স্যার। সবই অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু।”
মুহূর্তের জন্য সময় নেন লেশনার। তার পরেই অর্ডার দেন, “আপনি মর্গ-রুমে থাকুন। আমি আসছি। একা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। জরুরি।”
কিন্তু দেশমুখের সঙ্গে কথা বলার আগেই লেশনার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মৃত ব্যক্তিদের স্পেস স্যুটগুলো নিয়ে। সেগুলো এই কামরারই এক পাশের কেবিনেটে রাখা হয়েছিল।
মিনিট তিনেকের পর লেশনার তাকালেন দেশমুখের দিকে, “একটা আন্দাজ করছি, ঠিক না হলে বলবেন। এই যে স্পেস স্যুটটা— দুশো বাইশ নম্বর— গুহ রায়ের হাতে…”
“রাইট স্যার। গুহ রায় সেকথা নিজেই আমাকে জানিয়ে গেছেন। বাকি তিনজনেরই স্পেস স্যুট লিক করেছে। সেজন্য…”
“চুপ করুন। একথা আর কাউকে বলেছেন?”
“না স্যার।”
“ও.কে.। দয়ালকে এক্ষুনি ডেকে পাঠান।”
দয়াল ঢোকা মাত্র লেশনার বললেন, “কর্নেল, আপনি কি এবার এই তিনজনের মৃত্যুর কারণ একটু বুঝিয়ে বলবেন? মিস্টার দয়াল বিজ্ঞানের লোক, আমি না বুঝি, উনি তো বুঝবেন?”
দেশমুখের বক্তব্য শোনার পরেও দয়াল বিচলিত হয়নি। স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন লেশনারের দিকে। “শুনলাম। কিন্তু আমাকে ডাকার কারণটা বোধগম্য হল না।”
“এক্ষুনি হবে। আসুন এদিকে। এই স্পেস স্যুটগুলো একবার কষ্ট করে দেখুন। এই যে— এটা দুশো বাইশের। দেখছেন? এই যে কাটা দাগটা— গুহ রায়ের ছুরির ফলা চলেছে এই বরাবর। ঠিক আছে? বেশ। এবার এইটা দেখুন। একটু কষ্ট করতে হবে এবার। ঠিক কোথায় যে স্যুটটা ফুটো হয়েছে— অযথা আপনার সময় নষ্ট করব না। বগলের কাছের জোড়টা দেখুন। হ্যাঁ, ওইখান দিয়েই এই হতভাগ্যের প্রাণ বেরিয়ে গেছে।”
লেশনার স্যুটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন দয়ালের চোখে চোখ রেখে, “এবং সবচেয়ে আকর্ষক ও প্যাথেটিক ব্যাপার হচ্ছে, যে-তিনজনে এইভাবে মরেছে, তাদের প্রত্যেকের স্পেস স্যুটেরই ওই বগলের কাছে জোড় খুলে গেছে। তার অর্থটা কি আপনি জানেন?”
দয়ালের মুখ থেকে রক্ত উবে গেছে তবু নিজেকে সামলাবার শেষ চেষ্টা করেন, “সে আর বলতে। ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট। ইনসিওরেন্স কম্পানি নিশ্চয় স্পেস স্যুট নির্মাতার কাছ থেকে পুরো খেসারত…”
লেশনারের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি থামিয়ে দিল দয়ালকে। “মিস্টার দয়াল, তার আগেই কিন্তু তিনজন কিংবা আরও বেশি মানুষের, এখনও তো সব খবর জানি না, এদের মৃত্যুর জন্য আপনাকে দায়ী করা হবে। স্পেস পাওয়ার কম্পানিকে অর্ডার দেওয়ার পেছনে আপনার ভূমিকা অনেকেরই অজানা নয়। এবং কীভাবে তারা অর্ডারটা কবজা করেছে সে তথ্য সুপার স্পেস কস্টিউমই আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু তখন আমার কিছু করার ছিল না।”
দয়াল মৃতদেহ রাখার টেবিলের ওপরেই বসে পড়েছেন দু-হাতে মুখ চাপা দিয়েছেন।
লেশনারের নির্দয় কণ্ঠস্বর আবার কাঁপিয়ে দিল দয়ালকে, “আবেগ প্রবণতা হত্যাকারীদের মানায় না। আপনার চেতনায় অনুশোচনা জাগানোর জন্য ভাবিনি। ব্যাপারটা এখন অবধি আমরা তিনজনই জানি। গুহ রায়ও আসল কথাটা বোঝেননি।” দয়াল উঠে দাঁড়ালেন, “আপনারা যা বলেন…”
“কিন্তু আপনাকে বাঁচিয়ে আমাদের কী লাভ?”
“লাভ হবে। হবেই। বিশ্বাস করুন। আমি— আমি স্পেস পাওয়ারের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলব। প্লিজ, বিশ্বাস করুন। কিন্তু— কিন্তু সত্যিই কি বাঁচাতে পারবেন আমায়?”
লেশনার আর কর্নেলের মধ্যে চোখে চোখে কথা হয়ে গেল। কর্নেল বললেন, “আমাদের কথা আপনি যদি সত্যিই ভাবেন, তার প্রমাণ পাই, তা হলে আমি সার্টিফাই করে দেব যে, হৃদযন্ত্রের বিকলনই এদের মৃত্যুর কারণ।”
১৭
হতাশাজনক লাঞ্চ ব্রেকের পর ওরিলি লিড করে আনলেন তাঁদের টিম। হতাশাজনক, কারণ চাঁদের দেশের একটি পদও চেখে দেখার সুযোগ পাননি তাঁরা। বিশ্ব ক্রিকেট পরিষদের ইচ্ছে নয়। কোনও ঝুঁকি নেওয়া চলবে না।
প্রথম ছ’ ওভারেই খেলার প্রায় সব আকর্ষণ উবে যাওয়ার মুখে। গিলক্রিস্ট ও সাইমন— দুই ফাস্ট বোলারই পুরোপুরি ব্যর্থ। না লেংথ, না নিশানা, না বাউল। পাঁচ ওভারে বিয়াল্লিশ রান। তার মধ্যে দশটা ওয়াইড।
ষষ্ঠ ওভারে স্পিনার আনার আগেই ম্যাক এগিয়ে এসে ওরিলিকে বললেন, “ক্যাপ, প্লিজ, আমাকে একটা ওভার দাও। আমার মনে হয়, আই হ্যাভ গট অ্যান আনসার!”
অলরাউন্ডার ম্যাকডোনাল্ড স্লগ ওভারে কখনও-সখনও বল করেন। মিডিয়াম পেস। বলের ওপর নিয়ন্ত্রণটা ভালো কিন্তু খুব একটা এফেকটিভ নন। আসলে ফিল্ডার হিসেবেই ওয়ান ডে ম্যাচে ওঁর কদর।
আবেদন মঞ্জুর হয়নি। ফার্স্ট স্লিপে পজিশন নিয়ে দাঁড়ালেন ম্যাক। বারবার তাঁর ছোট ভাই ভিক্টরের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কোনওভাবে তাঁকে যদি চাঁদে নিয়ে আসা যায়, হয়তো একটা স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ পাবেন। একনজরে বোঝা যায় না যে, ভিক্টর ছেলেবেলায় পোলিওয় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ঠিক পা টেনে-টেনে হাঁটেন না, কিন্তু ট্রাউজারটা টেনে ধরলেই দেখা যায় ভালো পা-টা শীর্ণ। বেশিক্ষণ একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে বা হাঁটাচলা করতে পারেন না। চাঁদের ক্ষীণ মাধ্যাকর্ষণ… কল্পনাটা তো অলীক ঠিকই। কোনওদিনই হয়তো মানুষ এখানে বসবাসের সুযোগ পাবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে কী ঘটবে কে বলতে পারে। কয়েক মাস আগেও কি কেউ ভেবেছিল চাঁদের মাঠে এই ওয়ান ডের কথা। ভিক্টরের চাঁদে আসার ভাড়াটা যদি জোগাড় করতে হয় তবে আজকের ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’-এর পুরস্কারটা ম্যাক-এর চাই-ই চাই। এবং বোধহয় সেটা অসম্ভব নয়।
পৃথিবীর সেরা অফ স্পিনার ওয়াঙের প্রথম ওভারেই দুটো হিমালয় সাইজের ছক্কা আর তিনটে হেলাফেলা বাউন্ডারি।
যেন অতিপরিচিত বোলারদের মোকাবিলা করছেন লুনার ব্যাটসম্যানরা। কাকে ঠিক কীভাবে শাস্তি দিতে হবে সেটা বুঝে নেওয়ার জন্য একটা বলও পর্যবেক্ষণ করেননি ওদের দু নম্বর। আবির আশ্চর্য হয়ে যায়।
নাচার হয়ে ওরিলি ম্যাকের হাতে বল তুলে দেন। চার পা ছোট্ট ধীর রান-আপ থেকে ম্যাক তাঁকে প্রথম বলেই ক্লিন বোল্ড করে দিলেন এক নম্বর ওপেনারকে। একটা ওভারপিচ বল সোজা মিডল স্টাম্প ভেদ করে দিয়েছে। স্রেফ গতিতে পরাস্ত হয়েছেন ব্যাটসম্যান।
পৃথিবীর দর্শকরা নড়েচড়ে বসেন। তার চেয়েও সাড়া পড়ে যায় ডান-ইয়ার কম্পানির স্পিড়-চেক সিস্টেমের কর্মীদের মধ্যে। বলটার গতি ছিল নব্বই। হিসেবে কি ভুল হল!
ভুল যে হয়নি সেটা শুধু পরবর্তী পাঁচ বল নয়, খেলার ফলাফল থেকেও কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল।
প্রথম ওভারেই দুটো উইকেট নিয়েছেন। তাঁর দুরন্ত গতি এবং ব্যাটসম্যানের শরীর টিপ করে পাঠানো ওভারপিচ বলগুলোর মোকাবিলা করার মতো নৈপুণ্য চাঁদের ব্যাটসম্যানদের নেই।
এখন শুধু লক্ষ করা অন্য প্রান্তের বোলাররা কী করেন।
ম্যাকের বিপরীত প্রান্তের বোলারদের কাছ থেকে ওভারপিছু গড়ে বারো রান করে সংগ্রহ করেও জিততে পারল না লুনার ইলেভেন।
বিনা উইকেটে ছেষট্টি থেকে একশো পঁয়তাল্লিশ অল ডাউন। একা ম্যাক আঠারো ওভার তিন বলে মুড়িয়ে দিলেন লুনার ইলেভেনকে। ম্যাকের বোলিং হিসেব ৬.৩ ওভার, ৩ মেডেন, ৭ রান, ৯ উইকেট। জীবনের সেরা কৃতিত্ব তো বটেই।
ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার বন্টন অনুষ্ঠানে ক্যাপ্টেন ওরিলির অনুপস্থিতিটা কেউই খেয়াল করেননি। কিন্তু করা উচিত ছিল। তা হলে মনে পড়ে যেত ম্যাকের দ্বিতীয় ওভার শেষ হওয়ার পরে তাঁর সঙ্গে ওরিলির বচসার কথা।
“তুমি এরকম করলে আর কিন্তু বল করতে দেব না।” বলেছিলেন ওরিলি, “ইউ কান্ট ডু দিস!”
উত্তরে শুধু জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন ম্যাক। ভালো করেই জানতেন এই পরিস্থিতিতে তাঁকে বল করতে না দেওয়ার ক্ষমতা কোনও দলনায়কেরই নেই।
ম্যাক তৃতীয় ওভার শুরু করার আগেই ওরিলি সহ-অধিনায়কের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে মাঠ ছেড়ে চলে এসেছিলেন।
ম্যাকের বোলিংয়ের দাপট এসব তুচ্ছ ঘটনাকে কোথায় উড়িয়ে দিয়েছে!
১৮
চাঁদের কক্ষপথ ত্যাগ করে একে একে সব ক-টি জাহাজ এখন ঘরে ফেরার পথ ধরেছে। হঠাৎ একসঙ্গে সব মহাকাশযানের সঙ্গে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রগুলির টেলিকমিউনিকেশন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অবশ্য যাত্রীরা সেকথা টেরও পাননি। পাওয়ার কথাও নয়। কিন্তু এবার কামরার অভ্যন্তরে মাইক্রোফোন অচল হয়েছে। আচমকা থেমে গেছে নরম ও তরল সঙ্গীত। একটি নম্র অথচ ব্যক্তিত্বপূর্ণ উচ্চারণ সবাইকে তটস্থ করে দিল।
“চাঁদের দেশের তরফ থেকে আমি আপনাদের সবাইকে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছি। শুভযাত্রা। চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি ভঙ্গ করে আপনাদের সঙ্গে এই সংযোগ স্থাপনের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কয়েকটি তথ্য আপনাদের স্বার্থেই জানানো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।”
অজানা আতঙ্কে যাত্রীরা সিঁটিয়ে বসেছেন। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে বৈদ্যুতিন ব্যবস্থা অকেজো করে দিয়েও মহাকাশতরীর প্রযুক্তিবিদরা চাঁদের ঘোষকের গলা টিপে ধরতে পারেননি।
“প্রথমেই আপনাদের অভিনন্দন জানাই এক ঐতিহাসিক ও গৌরবময় বিজয়ের জন্য। নিজেদের যোগ্যতা সম্বন্ধে আমরা এত নিশ্চিত ছিলাম যে, এই পরাজয় আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত। কিন্তু এরকম অপ্রত্যাশিত কিছু পাওয়ার আশাতেই তো পৃথিবীর জীবন্ত মানুষদের কাছে যেতে চেয়েছিলাম আমরা।
“হ্যাঁ, আপনারা জীবন্ত মানুষ আর আমরা সব উন্নতি সত্ত্বেও রোবট— যন্ত্রমানুষ। বহুকাল আগে, পৃথিবী যখন অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করার উপক্রম করছে, চাঁদের পিঠে দেশান্তরী পৃথিবীর মানুষরা আমাদের সৃষ্টি করেন। তাঁদের যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঐতিহ্য বহনের ভার আমাদের হাতে দিয়ে বহুকাল আগেই তাঁরা প্রয়াত হয়েছেন। দুঃখের কথা, বছর দশেক আগে আমরা কিন্তু ভিন্ন নক্ষত্রলোক থেকে অক্সিজেন সংগ্রহেরও ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু তাঁরা তো আর নেই। কিন্তু আপনারা আছেন। আমরাও আছি। আমাদের সভ্যতা কিন্তু একটা স্তরে পৌঁছবার পর থমকে গেছে। আর এগোতে পারছি না আমরা। মনে রাখবেন, কারিগরি বা বৈষয়িক দিক থেকে পৃথিবীর চেয়ে কিন্তু আমরা অনেক বেশি অগ্রসর। তা সত্ত্বেও, একটা কানাগলির শেষে পৌঁছে আমরা বুঝতে পারলাম, জীবন্ত মানুষের সাহায্য ছাড়া এগিয়ে চলা সম্ভব নয়। তখনই আমরা আপনাদের সঙ্গে আবার সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করি।
“আপনারা জানেন না, কিন্তু এই ক্রিকেট ম্যাচে জেতবার জন্য আমরা চেষ্টার কোনও ত্রুটি করিনি। এমনকী আমাদের চর মারফত পৃথিবী থেকে বিভিন্ন যুগের ক্রিকেট খেলা সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য, ইতিহাস, এমনকী দুর্লভ ও নিষিদ্ধ ভিডিয়ো ক্যাসেট অবধি সংগ্রহ করা হয়েছে। আপনাদের প্রত্যেক খেলোয়াড়— যাঁরা আজ এসেছিলেন— সবাইকার দুর্বলতা আমরা খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে তৈরি হয়েছিলাম। তবুও আপনারা আমাদের হারিয়ে দিয়েছেন। তাতে আমাদের কোনও দুঃখ নেই। বরং আমরা খুশি। কারণ এর থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, মানুষের সংস্পর্শে না থাকলে আমাদের পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।
“ধন্যবাদ, মানুষ! শুধু একটা কথা জানিয়ে দিই, আমরা নিজেদের স্বার্থেই আপনাদের মধ্যে থেকে শ’খানেক লোককে আটকে রেখেছি। এবং তাঁদের বদলে ডামি পাঠিয়ে ধোঁকা দিয়েছি আপনাদের। দিন সাতেকের মধ্যেই তাঁদের আমরা ফিরিয়ে দেব পৃথিবীতে। শুভযাত্রা। শুভযাত্রা!”
পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের পর বিশ্ব একাদশের ক্যাপ্টেন ওরিলি তাঁর রিপোর্ট এবং ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত একসঙ্গে পেশ করলেন।
অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হওয়ার খবর সব সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছে। চেপে যাওয়া হয়েছে শুধু তার রিপোর্ট “ম্যাক অর্থাৎ ম্যাকডোনাল্ডের চাকিংয়ের জন্যই লুনার একাদশ পরাজিত হয়েছে। তিনি কনুই ভাঁজ করে বল ছুড়েছেন। কিন্তু পরনে মহাকাশের পোশাক থাকার জন্য সেটা ধরা পড়েনি, আম্পায়ারও আপত্তি জানাননি। পদার্থবিদরা একটু হিসেব করলেই ধরতে পারবেন যে, এ ছাড়া চাঁদের মাঠে কেউ ওই গতিতে বোলিং করতে পারেন না।”
বিশ্বের প্রথম সারির রাজনীতিকরাই শুধু ওরিলির রিপোর্ট পড়েছেন। কিন্তু তাঁদেরও মাথায় কোনও দুশ্চিন্তা ভর করেনি। রোবট মানে রোবটই। ক্রিকেট বলতে যাঁরা অভিধান খুলে দেখেছেন, ন্যায়সঙ্গত খেলা এবং বিশ্বাসও করেন, সেখানে কোনও দুর্নীতির ঠাঁই নেই।
এরকম সরল বিশ্বাসী অ-মানুষদের ভয় পাওয়ার কি কোনও কারণ থাকতে পারে!
পুনঃমুদ্রিত
Tags: উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সিদ্ধার্থ ঘোষ