চোখ
লেখক: প্রলয় সরকার
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
আমার কথা
“নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।”
এ ধরনের একটা কথা বাংলা বাক্যালাপে মাঝে মধ্যেই ব্যবহার করা হয়। কোনও কিছু ‘নিজের চোখে’ না দেখলে তা যদি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, তবে এ যাবৎকাল অবধি আমার সজ্ঞানে দেখা সব কিছুই ভুল, ভ্রান্ত। কারণ? কারণ, বরাবর আমার জগৎ দেখা অন্য মানুষের চোখে। না, কাব্যিক ভণিতা নয়, আক্ষরিক অর্থেই! দাঁড়ান, শুরু থেকে বলি।
আমার বয়েস কত-তা আমার মনে নেই; আমার অনুমান হাজারের কাছাকাছি। বিগত সাতশো বছরের ইতিহাস আমার স্পষ্ট মনে আছে। এই সাতশো বছরে সহস্র শক্তির উত্থান-পতন, দেশ-মানুষ-ধর্ম-পরিবেশের লক্ষ চড়াই-উতরাই, সময়প্রবাহের অসংখ্য অগুনতি বাঁকের জলজ্যান্ত সাক্ষী এই আমি। তবে তার আগের ঘটনা আমি কিছু মনে করতে পারি না। কয়েক দশক আগেও তার ঝাপসা স্মৃতি ছিল, এখন নিশ্চিহ্ন। আমি কে, কোথা থেকে এসেছি; এ সবই আমার অজানা।
আমি দেখতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মানুষের মতো, শরীরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকার ও অবস্থান বলছে ‘বায়োলজিক্যালি মেল’। আমার দেহগঠন বলিষ্ঠ, এফ.পি.এস. পদ্ধতিতে উচ্চতার পরিমাপ ছয় ফুট দশ ইঞ্চি। মাথা থেকে শুরু করে পা অবধি, আমার গোটা দেহ সম্পূর্ণরূপে লোম-শূন্য। সবটুকুই মানুষের মতো, একটু বড়সড় দশাসই চেহারার মানুষের মতো আর কি। এ শরীরে খামতি বলতে একটাই…
আমার কোনও চোখ নেই!
তবে তাতে আমার অসুবিধে হয় না বিশেষ। কারণ আমার বাকি ইন্দ্রিয়গুলো ভীষণরকম সজাগ। আমার ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত প্রখর; মেপে দেখেছি আফ্রিকান হাতির থেকেও খানিকটা বেশি। ঠিক সেরকমই জোরালো আমার শ্রবণশক্তিও। বাদুড় কিংবা কতিপয় সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীদের মতো দুরন্ত ইকোলোকেশনের ক্ষমতা রয়েছে আমার।
শুধু চোখটাই যা নেই। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, চোখের কোটর দুটো থাকলেও তাতে কোনও অক্ষিগোলক নেই, ফাঁকা। তাই আমায় চোখ সংগ্রহ করতে হয়! কারণ, বাকি ইন্দ্রিয় আমার যতই সজাগ থাকুক, দু-চোখ দিয়ে দেখার মজাই আলাদা।
চোখ সংগ্রহের পদ্ধতিটা ঠিক কীরকম? সবার প্রথমে লোকালয়ে গিয়ে খেয়াল রাখি পথচলতি মানুষের উপর। পাহাড়-গঞ্জ ছেড়ে ব্যস্ত লোকালয়েই, কারণ ক্রেতাদের ভাষায় লোকালয়ে ‘বিকল্প বেশি’। তবে অবশ্যই গা ঢাকা দিয়ে। আমায় দেখতে পেলে মানুষের ভিরমি খাওয়ায় সম্ভাবনা। আর তা ছাড়া জানাজানি তো আর হতে দেওয়া যায় না। তাই একবার আমায় কেউ দেখে ফেললে, পরবর্তী ব্যাপারটা মোটেই সুখকর হবে না, তার জন্যে। আমি তাই লক্ষ রাখি দূর থেকে আর শহরের সমুদ্র-প্রমাণ মানুষের ভিড়ে একজন সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষ মানুষ বেছে নিই। একবার শিকার শনাক্তকরণ হয়ে গেলে সন্তর্পণে পিছু নিই তার। কিছুক্ষণের লুকোচুরি, তারপর সুযোগ পেলেই হামলে পড়ি তার উপর আর চোখদুটো এক ঝটকায় খুবলে নিই। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, জ্যান্ত মানুষের চোখই আমার কাজে লাগে। কারণ, চোখের সঙ্গে চক্ষু-দাতার চেতনাও আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। যে মৃত, সে চেতনাহীন, তার চোখ ‘বুজে গেছে’ আগেই। দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষের চোখও আমার কাজে লাগে না। তা অবশ্য সংগত বৈজ্ঞানিক কারণেই। চোখ সংগ্রহের পর তা জীবাণুশূন্য বোতলে পুরে চটজলদি বাসায় ফিরে আসি। একটা সময় ছিল, যখন কোনও চোখ সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গেই তা ব্যবহার করে ফেলতে হত। পরে আমি সংরক্ষণ করতে শিখেছি। শুরুতে ফরম্যালিন বা ৭০% আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহলে সংরক্ষণ করতাম। এখন আইসোটনিক দ্রবণে হিমায়িত করে রাখি। এই পদ্ধতিটা নিয়ে অবশ্য আরও পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছি। তা ছাড়া যে কোনও সংরক্ষক মিশ্রণেই আরেকটা গোপন উপাদান আমাকে মেশাতেই হয়। বস্তুত এই উপাদানটির দৌলতেই, চোখের কোশগুলি রক্তপ্রবাহ ছাড়াও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। এটার নাম আমি দিয়েছি ‘জীবন-রস’। জীবন-রসের প্রসঙ্গে আসছি পরে।
চোখগুলি আমি খুব যত্ন করে সাজিয়ে রাখি। সংগ্রহের তারিখ, সময়, সংগ্রহ কালে চক্ষু-দাতার বয়েস ইত্যাদি নথিবদ্ধ করে রাখি নিয়ম করে। তারপর যখন ইচ্ছে হয়, পছন্দমতো এক জোড়া চোখ বেছে নিয়ে, আঙুল দিয়ে চেপে কোটরে ঢুকিয়ে দিই। ব্যাস! তাহলেই আমি দেখতে পাই!
শুনে অবাস্তব লাগছে? স্নায়ুর গল্পটা মিলছে না? চিকিৎসাশাস্ত্র-জীবনবিজ্ঞানের নিয়ম লঙ্ঘন হচ্ছে মনে হচ্ছে? হতেই পারে। এসবের উত্তর আমার কাছেও নেই। কারণ আমি মানুষের মতো দেখতে হলেও, মানুষ নই। অন্য কিছু একটা। সেটা কী? জানি না, মনে নেই!
মানুষের মতো আমার কোনওপ্রকার জৈবিক চাহিদা নেই। আমার খিদে পায় না। শ্বসন, রেচন ইত্যাদি কোনওপ্রকার শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ আমার শরীরে ঘটে না। হৃৎস্পন্দন অবধি হয় না। আমি বেঁচে আছি কীভাবে, তার সম্যক ধারণাই আমার কাছে নেই। তবে মানুষের মতো না হলেও, বেঁচে আছি তো বটেই। তাও অনেক, অনেকগুলো বছর ধরে। এর কারণ খুব সম্ভবত, সেই জীবন-রস। আমার ধারণা এই জীবন-রসই আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে অনন্তকাল ধরে। আমার শরীরে অতিরিক্ত একটা গ্রন্থি আছে, যার থেকে এই রস নিঃসৃত হয়। এর উপাদান, কার্যকরিতা সম্পর্কে জানতে গবেষণা চালিয়েছি বেশ, খুব বেশি কিছু উদ্ধার করতে পারিনি। এটুকুই জানি, শরীরের ভেতরে আমার কলাকোশের কোনও মৃত্যু নেই। আর বাইরের চোট আঘাত, তা সে যতই গুরুতর হোক না কেন, এই রস মাখিয়ে দিলে সেরে যায় কয়েক সেকেন্ডে। দাগ অবধি মিটিয়ে যায়। শরীর থেকে নিঃসৃত জীবন-রস আমি সংগ্রহ করে রাখি। একটু গলা খাঁকারি দিলেই মুখ দিয়ে লালার মতো বেরোয়। সেটাকে পাত্রে ধরে রাখি, পরে ব্যবহার করব বলে। যেরকম বলেছিলাম, এই জীবন-রস দিয়েই পরবর্তীকালে চোখের নমুনা সংগ্রহ করা শুরু করি।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কোনও একজোড়া চোখ লাগানোর পর আমি জগৎটাকে তার মতো করে দেখতে পাই। প্রত্যেক জোড়া চোখ অন্য জোড়ার থেকে আলাদা, স্বতন্ত্র। প্রত্যেকেরই আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, চাহিদা আছে। অদ্ভুত লাগছে না শুনতে? হিসেব মতো তো এইগুলি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যার নিয়ন্ত্রক মানুষের মস্তিষ্ক। চোখের সঙ্গে তো এর সম্পর্ক থাকার কথা নয়। তবে? আসলে এর উত্তরও আমি ঠিক জানি না। হয়তো হ্যানিম্যানের হোমিয়োপ্যাথিক ডাইলিউশন তত্ত্বের মতোই, মস্তিষ্কের নির্যাস চোখ ধরে রাখে। এ তত্ত্ব আমি জানতে পেরেছি এক হোমিয়োপ্যাথিক ডাক্তারের কাছে। সরাসরি তার থেকে নয় অবশ্য, তার চোখদুটো লাগানোর পর।
চোখ লাগিয়ে আমি প্রাণভরে পৃথিবী দেখি। বিভিন্ন দিক থেকে, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে, বিভিন্ন উদ্দেশ্যে। তাই যে কোনও বিষয়, একজন গড়পড়তা মানুষের থেকে শতগুণ দৃষ্টিভঙ্গিতে যাচাই করার সুযোগ পাই। কোনও চোখ সাম্যবাদের দৃষ্টিতে পৃথিবী দেখে, কোনও চোখ মনু-বাদের দৃষ্টিতে। কোনও চোখ প্রকৃতির বুকে ধনেশ পাখি খোঁজে, কোনও চোখ কাগজের পাতায় জীবনানন্দ ছেড়ে উঠতেই চায় না। কোনও চোখ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে উৎফুল্ল, তো কোনও চোখকে নোটের বান্ডিল থেকে সরানোই যায় না। একেক চোখ একেক রকম। তবে মানুষ বড় জটিল প্রাণী, নির্দিষ্ট কয়েকটা গণ্ডিতে তার চোখকে আটকে রাখা যায় না। প্রত্যেক চোখের দৃষ্টিকোণের একাধিক জটিল স্তর রয়েছে। সেসবের তল পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়, অনেক সময় পাওয়াও যায় না।
তবে একটা মিল প্রায় সব পুরুষ চোখের মধ্যেই পেয়েছি। অধিকাংশ পুরুষ চোখই আর কিছু দেখুক না দেখুক, নারী শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।
আমার শরীরে বা মনে রাগ, ঘেন্না, আনন্দ, দুঃখ ইত্যাদি আবেগের কোনও জায়গা নেই। আমি কোথা থেকে এসেছি জানি না, কোথায় চলেছি তাও জানি না। আমার শুরু-শেষ কিছুই নেই, শুধু পথচলা আছে, আদি অনন্তকাল ধরে। তাই মানুষের চোখ আমার পথচলার রসদ জোগায়। আমার সাদা-কালো জীবন রঙিন করে তোলে। আমার প্যাতপ্যাতে সরল তরঙ্গহীন দিনগুলো জটিলতার ভীষণ ঝড়ে ভাসিয়ে দেয়। আমার সংগ্রহে তাই সতেরশো রকমের চোখ আছে। তার মধ্যে এই মুহূর্তে ব্যবহারযোগ্য প্রায় দেড়শো জোড়া। ব্যবহারযোগ্য, কারণ আসল মালিকের শরীর থেকে উপড়ে নেওয়ার পর সে চোখ কয়েক বছরের বেশি আমার শরীরেও ব্যবহার করা যায় না। হয়তো জীবন-রস আমার নিজস্ব অঙ্গের বাইরে বেশিদিন কাজ করে না। তাই অকেজো চোখগুলোকে আমি ঘরসজ্জার কাজে লাগিয়ে দিই।
অনীশের কথা
এই পৃথিবীটাকে অনীশের দেখতে ইচ্ছে করে না! আর তাই, নিজের চোখদুটো অনীশ দীর্ঘদিন ধরে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। তবে পিছিয়ে এসেছে প্রত্যেকবার। আসলে ইচ্ছে থাকলেও এ কাজ বোধহয় নিজের হাতে করা যায় না। সামান্য চোখে আঙুল ঢোকাতে গেলেই পলক পড়ে যায় প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়।
অনীশ অঙ্গচ্ছেদ-কামী। ‘ট্রান্সেবল্ড্’-এর বাংলা করলে বোধহয় এরকমই কিছু একটা দাঁড়ায়। অনীশের যখন সাত-আট বছর বয়েস, তখন থেকেই ওর মনে হয়েছে যে চোখদুটো ওর শরীরে ঠিক মানাচ্ছে না। চারপাশটা আর কিছুতেই দেখতে ইচ্ছে করছে না। সে সময়, কড়া রোদের দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করত অনীশ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চাইত, যাতে অন্ধকার হয়ে যায় সব কিছু। নিজের চোখের প্রতি এরূপ অনীহার কারণ কী, অনীশ তা পরিষ্কার করে বুঝতে পারেনি। বাড়ির কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারেনি। এ পৃথিবীতে, কিছু মানুষের নিজের শরীর বুঝতেই অনেক সময় লেগে যায়। পরবর্তীকালে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হাতে এসেছে আন্তর্জাল, বিপুল তথ্যভাণ্ডার হয়েছে সহজলভ্য। অনীশ জানতে পেরেছে এই পৃথিবীতে ও একা নয়, ওর মতোই সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ট্রান্সেবল্ড্-রা। রয়েছে তাদের সংগঠনও! অবশ্য, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মতে এঁরা অসুস্থ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরিভাষায় নেহাতই ‘বডি ইন্টিগ্রিটি ডিসফোরিয়া’-র রুগী। তবে অনীশের মতো কিছু মানুষের কাছে এটাই যাপন। নিজের শরীরের মালিক তারা নিজেই; তাই সে শরীরখানা কীরকম হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার কেবলমাত্র তাঁদের।
বিষয়খানা স্বাভাবিক কি নয়, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। তবে অঙ্গচ্ছেদ-কামীরা আছেন, বাস্তবিকেই। আর তাঁরা নানার ধরনের মানুষ, বিচিত্র তাঁদের অঙ্গহানির বাসনা। কেউ একটা বা দুটো পা বাদ দিয়ে পঙ্গু হতে চান, কেউ জিব কেটে মূক হতে চান, কেউ বা কান কেটে বধির। অনেকে আবার খানকয়েক আঙুল বাদ দিয়েই সুখী। নানাবিধ মানুষ, তাঁদের নানাবিধ ইচ্ছের রকমফের। যেরকম অনীশ অন্ধ হতে চায়। অন্ধত্ব-কামী শব্দটা এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে বোধহয়, এঁরা অঙ্গচ্ছেদ-কামীদের মধ্যেই আরেক বিশেষ দল। সচরাচর এঁরা বিষপ্রয়োগে নিজেদের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দেন। তবে অনীশ চোখদুটো একেবারে উপড়েই ফেলতে চায়। দু-একজন ডাক্তারকে সাহস করে সেধেওছিল। তাঁরা অনীশকে হয় তাড়িয়ে দিয়েছেন, নয় মনরোগ বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হতে উপদেশ দিয়েছেন। কিছু স্থানীয় গুণ্ডা-মস্তানের কাছেও প্রস্তাব পেড়েছিল অনীশ। পাগল-ছাগল ভেবে তারাও তোয়াক্কা করেনি। অবশ্য তাদের ভরসায় না থাকাই ভালো। তাঁরা শারীরবিদ্যা বোঝে না, শেষে চোখ ওপড়াতে গিয়ে আবার কী কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে। সংক্রমণ, রক্তক্ষরণের দিকগুলো খেয়াল রাখা জরুরি। উদ্দেশ্যটা চোখ বাদ দেওয়া, মরে যাওয়া তো নয়!
হাতে বেশ কিছু পয়সা জমিয়ে, কিছুদিন হল নতুন এলাকায় উঠে এসেছে অনীশ। এটা দরকার ছিল। এই মুহূর্তে চোখ বের করে নেওয়া সম্ভব নাই হতে পারে; অন্ধ সেজে থাকা তো যায়! আর এ দুটোর কোনওটাই নিজের চেনা পরিচিত জায়গায় করা যায় না। এখানে এসে বাড়িওয়ালার কাছে অনীশ পরিচয় দিয়েছে অন্ধ হিসেবেই। নতুন পাড়ার সকলেই জেনেছে যে ও অন্ধ। আর অনীশ, চোখের উপর দিয়েছে আটার পুরু প্রলেপ তার উপর পরেছে কালো চশমা। হাতে একটা লাঠি নিয়েছে, তারপর রাস্তাঘাটে টহল মেরেছে, বাজারহাট করেছে। আর এসব করতে গিয়েই একটা ব্যাপার অনীশের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। অন্ধ সে আজ হোক বা কাল, নাক-কান ইত্যাদি বাকি ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রশিক্ষিত করা ভীষণ জরুরি। তাই আগেভাগেই সে কাজে খানিকটা জুত করে রাখা ভালো।
ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণের জন্যে নিজের মতো করে একটা অদ্ভুত রুটিন ঠিক করেছে অনীশ। রোজ একইভাবে চোখে কালো চশমা আর হাতে লাঠি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। তারপর উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটা দেয়। মাঝেসাঝে উঠে পড়ে গন্তব্য না জানা অটো কিংবা বাসে। খেয়ালমত আচমকাই গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে যায়। এই করে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা জায়গায় এসে পড়ে। আর তারপর, সেখান থেকে বাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করে। কখনো পারে, কখনো পারে না। যখন পারে না, বাধ্য হয়ে চোখের ঠুলি খুলতে হয়। তবে অনীশ দিন দিন আরও পোক্ত হচ্ছে। সঙ্গে দূরত্বটাও বাড়িয়ে দিচ্ছে উত্তরোত্তর। সেদিন তো বহুদূর চলে গেল এভাবেই, আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিল। আর গণ্ডগোলটা ওইদিনই হল।
অনীশ বুঝতে পেরেছিল খুব শুনশান একটা জায়গায় এসে পড়েছে। এরপরে বাড়ি ফেরা মুশকিল হয়ে যাবে। কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা লাগছিল ভীষণ, তাই জায়গাটা ছেড়ে নড়ছিল না। নাকে একটা উটকো গন্ধ পাচ্ছিল অনীশ। গন্ধটার উৎস উদ্ধার করতে পারছিল না কিছুতেই। এখন বলে নয়, খানিকক্ষণ আগে যখন ভিড় রাস্তায় ছিল, তখন থেকেই। রাস্তাঘাটে লোকজনকে জিজ্ঞেসও করেছিল, সদুত্তর মেলেনি। প্রথমে খেয়াল করেনি, পরে বুঝেছিল শুধু গন্ধই না, সঙ্গে কানে হালকা শব্দও আসছিল একটা। অদ্ভুত রকম শব্দ, কতকটা ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো, কতকটা ঘণ্টা বাজার মতো, আর কতকটা গোঙানির মতো। একসঙ্গে জোরালো হচ্ছিল দুটোই। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, চশমা খুলে ফেললে কোনওটাই আর পাওয়া যাচ্ছিল না।
রহস্যজনক ব্যপারটার উদ্ঘাটনের জন্য তাই অপেক্ষা করছিল অনীশ। শব্দ-গন্ধটা সমান তালে জোরালো হতে হতে একসময় নাক কান ঝালাপালা করে দিল। আর তারপরেই কারো বিকট চিৎকার শুনতে পেল অনীশ।
সর্বনাশ! সামনে কারো দুর্ঘটনা ঘটল নাকি? কিন্তু গাড়িঘোড়ার শব্দ তো কিছু পেল না অনীশ। তাহলে কী খুন? হতেই পারে। এতটা শুনশান জায়গায় এসে পড়া ঠিক হয়নি। হয়তো গুণ্ডাবদমায়েশের আখড়া। কী করবে? পালাবে? নাকি অন্ধ সেজে দাঁড়িয়ে থাকাই ভালো? তাতে যদি প্রাণে বাঁচে। ভয় আর সিদ্ধান্তহীনতায় অনীশ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। সেই গন্ধটা কিন্তু যায়নি তখনও, শব্দটাও না। বরং কাছে এসেছিল আরও খানেকটা। ওদিকে চীৎকারটাও থামেনি।
তারপর একসময়, শব্দ আর গন্ধ, দুটোই কম হতে হতে মিলিয়ে গেল। শুধু রয়ে গেল সমানে চীৎকার করে যাওয়া সেই গলাটা। এরপর সেটাও নেতিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ বাদে ভয়ে ভয়ে চোখের চশমা খুলল অনীশ। তারপর যে দৃশ্য দেখল, তাতে শিউরে উঠল। কিছুক্ষণ আকাশপাতাল ভাবল, তারপর ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে পড়িমরি করে ছুটে পালাল। অন্ধ সাজার বিলাসিতা সে সময় আর করে উঠতে পারল না।
আমার কথা
আজ নতুন চোখ আনতে বেরোনোর কথা। আমার সাধের আস্তানাটা লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে। জন-মানবহীন পাহাড়ি জঙ্গল এলাকায় ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে। দশ-পনেরো বছর অন্তর অন্তর আমি বাসা বদল করি। এখানে এসেছিলাম বারো বছর আগে। মাটি খুঁড়ে গোটা বাঙ্কারটা আমার নিজের হাতে বানানো। বাসার মধ্যে ছোটখাটো লাইব্রেরি, খেলাধুলার সরঞ্জাম, রেকর্ড প্লেয়ার, কিছু বাদ্যযন্ত্র, রেডিয়ো, অতিক্ষুদ্র গবেষণাগার… অনেক কিছুই রয়েছে। এ সবই বিভিন্ন সময়ে কোটরে লাগানো বিভিন্ন চোখের দৌলতে, তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী জোগাড় করা। নতুন করে বলার কিছু নেই, বাসায় আমি একাই থাকি। তবে বাসার উপর এক সঙ্গী থাকে আমার। তার কথায় আসছি পরে।
যদিও শিকার ধরার জন্যে আমার বাকি ইন্দ্রিয়গুলোই যথেষ্ট, তবু বেরোনোর আগে প্রায়ই আমি চোখ লাগিয়ে বেরোই। এতে কিছু অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে তীরন্দাজ বা বিমানচালকের চোখ বেশ উপযোগী। রাতের দিকে বেরোলে রড কোষ সংখ্যায় বেশি, এরকম কোনও চোখ লাগাই। তাতে অন্ধকারে একটু পরিষ্কার দেখা যায়।
আজকেও লাগিয়ে নিলাম একজোড়া। তারপর শহরের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
শহরে পৌঁছতে সতেরো মিনিট লাগল আমার। কেউ গাড়ি করে আসলে এ রাস্তা সাড়ে তিনঘণ্টা মতো লাগার কথা। সুবিধে মতো এক বহুতল অফিসের ছাদে চড়লাম তরতর করে। তারপর বিপুল জনসমুদ্রে মন নিক্ষেপ করলাম। কত সহস্র মানুষ, তাদের কতরকম আকার, রং, শব্দ, গন্ধ। আমি আক্ষরিক অর্থেই খড়ের গাদায় সুচ খুঁজে ফেলতে পারি। তাই যেরকম নমুনা আজকে চাইছিলাম, খুঁজতে খুঁজতে সেরকমই একজনকে পছন্দ করে ফেললাম নিমেষে। মনস্থির করে ফেললাম, এই তবে আজকের শিকার!
ভিড়ের মধ্যেই লোকটার গতিবিধির উপর নজর রাখলাম। লোকটা প্রথমে বড় রাস্তা ধরে এগোচ্ছিল। তারপর একসময় রাস্তা ছাড়িয়ে অন্ধকার গলিতে ঢুকল। এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে টপকে আমিও পিছু নিলাম। গলিটা আসলে শর্টকাট, খানেক পর গিয়ে রেল কলোনিতে মিশেছে। সুবিধা হল রেল কলোনি ফাঁকা জায়গা, ভিড়ভাট্টা কম। বেড়া টপকে কলোনির ফাঁকা রাস্তায় উঠল লোকটা, ফের চলতে লাগল হনহনিয়ে। তাকে অনুসরণ করতে আমিও একলাফে মাটিতে নেমে পড়লাম। সামনে একটা বড় মাঠ দেখতে পাচ্ছি। লোকটা ওদিকেই এগোচ্ছে। এগোক। আমি বরং একটু অপেক্ষা করে যাই।
আমার থেকে কমবেশি আধা কিলোমিটার দূরত্বে, মাঠের ধারে নির্জনে দাঁড়িয়ে লোকটা একটা সিগারেট ধরাল। মার্লবোরো! আমি এখান থেকেই গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারি। আমার চেতন বলছে, এই মুহূর্তে লোকটার এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনও জন-মনিষ্যি নেই। অর্থাৎ, এই সুযোগ! আমি ক্ষিপ্রগতিতে লোকটার পিছনে এসে দাঁড়ালাম পরমুহূর্তেই। সে তখন নিরিবিলিতে সুখটান দিচ্ছে। এত বড় চেহারা নিয়ে আমি যে ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছি, তা ও টের পায়নি। পাওয়ার কথাও না, কেউই পায় না। আমার চেহারা দানব-প্রায়, গতিও ভয়ংকর। কিন্তু গমনপ্রকৃতি নিঃশব্দ ছায়ার মতো। আমার গতিবিধি ঠাহর করতে পারবে, সাধারণ মানুষের সে সাধ্য নেই।
তার সিগারেট টানা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করব ভাবছিলাম। তবে বড্ড সময় নিচ্ছে। অগত্যা লোকটার কাঁধে আলতো টোকা মারলাম। সে প্রথমে স্বাভাবিক প্রতিবর্তে ঘুরে তাকাল। তারপর বিস্ময়ে মাথা ওঠাল আমার মুখখানা দেখবার জন্যে। আর দেখতে পাওয়ার আগেই…
খচ করে একটা শব্দ! আর তারপরেই তার গগনভেদী চিৎকারে শান্ত রেল কলোনির সে রাতের ঘুম ছুটে গেল।
এ চিৎকার আমায় বিচলিত করে না। আমার অতিদীর্ঘ জীবনে এরকম চীৎকার আমি বারবার শুনেছি, শুনে আসছি। তাছাড়া খুব সম্ভবত, এ জাতীয় আবেগের ধারণ বা প্রদর্শনে আমি প্রাকৃতিকভাবেই সক্ষম নই। তাই লোকটা যখন মাটিতে পড়ে দারুণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, আমি তার মুখ থেকে সদ্য খুবলে নেওয়া চোখদুটো পরখ করতেই মন দিলাম।
যাচাই হয়ে গেলে, চোখদুটোকে জীবাণু-শূন্য বোতলে পুরে ফেললাম। দেড় কিলোমিটার দূরত্বে পাঁচজন মানুষের হেঁটে আসার শব্দ পাচ্ছি। এবার বাড়ি ফিরবার পালা, সে উদ্যোগই নিলাম। কিন্তু ফিরতে গিয়ে, কতকটা ভূত দেখার মতোই, আমার দৃষ্টি হঠাৎ কিছুতে আটকে গেল।
আমার থেকে দশ হাত দূরে ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে, আরেকটা লোক!
আমার অন্তত সাতশো বছরের জীবনে এই প্রথমবার, আমি তাজ্জব বনে গেলাম। আরও অবাক হলাম বুঝি এই ভেবে, যে আমিও অবাক হতে পারি! এরকম তো হওয়ার কথা নয়। এরকম মোটেই হওয়ার কথা নয়! আমার এতখানি কাছে দাঁড়িয়ে ছিল একটা মানুষ, অথচ তার অস্তিত্ব আমি অনুভব করতে পারিনি? আমি? শব্দ, গন্ধ কিচ্ছুটি পায়নি? বলা ভালো, এখনও পাচ্ছি না? আর আমায় দেখে লোকটা ঘাবড়ে অবধি যায়নি!
বেশি চিন্তাভাবনা করার সময় ছিল না। আমায় দেখে যখন ফেলেইছে, একে আর বাঁচতে দেওয়া যায় না। লোকটাকে মারবার জন্যে অগ্রসর হলাম, আর তারপরেই খেলাম দ্বিতীয় ধাক্কাটা। লোকটার চোখে কালো চশমা, হাতে লাঠি। অন্ধ! এ লোকটা নাকি অন্ধ!
মাথার মধ্যে গুলিয়ে যাচ্ছিল সব, মেলাতে পারছিলাম না কিছুই। এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন আমি কোনওকালে হইনি। আর এই প্রথমবার, নিজেকে বড্ড দুর্বল লাগছিল।
পায়ের আওয়াজগুলো জোরালো হচ্ছিল, সময় থাকতে কেটে পড়লাম।
অনীশের কথা
সেদিনের ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা অনীশ প্রথম কিছুদিন ভুলতেই পারছিল না। বীভৎস মুখটা ঘুরে ফিরে আসছিল বারবার। চোখ থাকার নানান ঝঞ্ঝাটের মধ্যে এই আরেকটা। সেদিন চশমা না খুললেই পারত। উপরওয়ালা বলে যদি কেউ থেকে থাকে, এই তবে তার ইঙ্গিত। ওরে অনীশ, কালো চশমা তুই খুলিস না। অন্ধ হওয়া তোর ভবিতব্য।
কিন্তু পরে ব্যপারটা তলিয়ে দেখেছে অনীশ। আর তাতেই সেদিনের ভয়ঙ্কর স্মৃতি, হঠাৎ করে সুখকর হয়ে গিয়েছে। লোকটার চোখদুটো খুবলে নিয়েছে কেউ। ঠিক এটাই তো অনীশ নিজের জন্যে চাইছিল! নয় কি?
কে খুবলেছে? মানুষে? না কোনও জন্তু-জানোয়ার?
যেই হোক, তার সঙ্গে ওই উটকো গন্ধ আর বিশ্রী শব্দটার যোগ আছে কিছু। যা আবার চোখ খুলে রাখলে পাওয়া যায় না! মজাটা হল, গোটা শরীর থাকতে শুধু চোখ খুবলেছে। একে পাকড়াও করতে হবে। অনীশের স্বপ্ন-পূরণ এর হাত ধরেই। অনীশ মনস্থির করে ফেলল, অবশেষে শরীরের আপদ বিদেয়ের দিন এসেছে। টাইম টু অ্যাক্ট!
এলাকাটা আগেরবার চিনে এসেছে অনীশ। এবার নিয়মিত যাতায়াত করতে লাগল। রেল কলোনি, আশপাশের বাজার এলাকা। এর মধ্যে ক’দিন, গন্ধটা আবার পেয়েছে অনীশ। কিন্তু আগের মতোই, কিছুতেই তার উৎস বের করতে পারেনি। গন্ধ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলেছে। কিচ্ছু সন্দেহজনক দেখতে পায়নি। চোখ খোলার কারণে শব্দ-গন্ধ উবে গিয়েছে আবার, অগত্যা আবার ঠুলি লাগিয়েছে। এই করে গেছে খালি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তবে সহজে হাল ছাড়েনি। জীবনের বলে কথা! খুঁজে গেছে, খুঁজেই গেছে। তবে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একদিন ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল।
একদিন আচমকাই, শব্দ-গন্ধের দিক নির্ণয় করতে পারল অনীশ। খুব হালকা, তবে স্পষ্টতই উত্তর দিক থেকে আসছে। যদিও চোখ খুলে আবারও কিছু দেখতে পেল না।
যা হোক। পথ জানা গেছে, এবারে বাকিটা অনুসরণ।
আমার কথা
একটা জিনিস মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সেদিন থেকেই। ওই অন্ধ লোকটাকে দেখতে পাওয়ার আগে, ওর উপস্থিতি আমি অনুভব করতে পারলাম না কেন? ইন্দ্রিয় আমার সজাগ ছিল, এখনও আছে। লোকটার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হল কেন? গন্ধ নিবারক কিছু মেখেছিল কি? মাখতেই পারে। তবে সেটা হলেও, শব্দ তো অন্তত পাওয়ার কথা। আর এ সবের সঙ্গে লোকটার অন্ধ হওয়ার কোনওরকম যোগ আছে কী? লোকটা কি বিপজ্জনক কেউ? ক্ষতি করতে পারে আমার? নাকি নেহাতই ছাপোষা, আমারই ইন্দ্রিয়সমূহেই কিছু সাময়িক ব্যাঘাত ঘটেছিল?
উত্তর মিলছিল না। এটুকু বুঝতে পারছিলাম, লোকটা আমার চিন্তাভাবনার পরিসরের পুরোটাই গ্রাস করে বসেছে। ওকে খুঁজে বার করতে হবে, নয়তো আমি শান্তি পাব না। নতুন রকমের আবেগ বোধ করলাম, এটাকে বোধহয় উৎকণ্ঠা বলে! লক্ষ করলাম, যত সময় যায় এই আবেগের প্রকাশ বাড়ে।
উৎকণ্ঠা যখন চরমে পৌঁছে আমায় একপ্রকার মরিয়া করে তুলল, ঠিক করলাম খুঁজতে বেরোব। প্রথমে ওই রেল কলোনির মাঠে যাব। তারপর প্রয়োজন হলে গোটা শহর খুঁজব। খুঁজতেই পারি, সে ক্ষমতা হয়তো আমার রয়েছে।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। সূর্য ডুবলেই এক ছুটে পৌঁছলাম শহর। একজোড়া চোখ এবারেও লাগিয়ে নিলাম। আমার নিজস্ব ইন্দ্রিয় ওই লোকটার উপর পাকাপাকিভাবেই কাজ করে না— এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই চোখ লাগিয়ে গেলাম। খুঁজলাম। কিন্তু হায়! সারা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও লোকটার হদিশ আমি পেলাম না।
জীবনে তাই প্রথমবার, হতাশ হয়ে ফিরে এলাম বাসায়।
একটু ভুল হিসেব করে ফেলেছিলাম। লোকটার ক্ষেত্রে আদপেই হয়তো আমার কান, নাক কার্যকরী নয়। তাই ভরসা বলতে কেবল অন্যের চোখ। আর সে চোখের ক্ষমতা সীমিত, কারণ তা সাধারণ মানুষের চোখ। সেই চোখ দিয়ে লক্ষ কোটি মানুষের ভিড়ে তাকে আমি খুঁজব কেমনে?
তবুও একেবারে দমে গেলাম না। পরের সপ্তাহে আরও চারদিন গেলাম। পঞ্চম দিনের মাথায় হতাশা, উৎকণ্ঠা, রাগ, বিরক্তি— অনেকরকম নতুন পুরনো আবেগ আমাকে একসঙ্গে চেপে ধরল। একসঙ্গে এত আবেগ নিতে আমার শরীর অভ্যস্ত নয়, তাই বোধহয় বিচ্ছিরি রকমের প্রতিক্রিয়া দিল। গলায় অস্বস্তি হচ্ছিল, সেদিন প্রথমবার গলা ঝেড়ে কেশে ফেললাম। তারপর গোটা রাস্তা কাশতে কাশতে বাড়ি ফিরলাম।
অনীশের কথা
অনীশ ভোরবেলা বেরিয়েছিল। এখন সন্ধে। কালো চশমা আর তার ভেতরের আটার প্রলেপ নামিয়ে অনীশ সামনে দেখল বিশাল অরণ্য। ভুল করেনি, গন্ধটা বনের ভেতর থেকেই আসছে। শব্দটাও। ঘন জঙ্গল, তাও এত রাতে। ঢোকা ঠিক হবে? বিপজ্জনক তো বটেই! এদিকে এতদিনের স্বপ্ন-সন্ধানের ফল আজ হাতেনাতে পাওয়ার কথা, সেটাও তো কম কথা নয়।
অনীশ মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবল কিছুক্ষণ, তারপর চশমা পরে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
আমার কথা
পাইনের ঘন জঙ্গলের মধ্যিখানে একখানা বুড়ো ওক গাছ। সে গাছের গোঁড়ায় আশ্রয় নিয়েছে একলা এক রাজগোখরো। ঘাস-মাটি-পাথর-পাইনকাঁটা সহযোগে তৈরি তার বাসা, দেখতে অনেকটা মাঝারি মাপের খড়ের গাদার মতো। অভিজ্ঞরা জানেন, কেবল স্ত্রী রাজগোখরোয় বাসা বাঁধে, তাও দাম্পত্য-কালে ডিম পাড়ার সময়। তাই একলা সাপের বাসায় কোনও কাজ নেই। আসলে এ বাসা আমি বানিয়েছি। চট করে দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু সে বাসার নীচের দিকে ঘাসপাতার ফাঁকে, আংটা লাগানো এক দরজা আছে। সেই দরজা খুললে মাটির নীচে সরু অন্ধকার সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করা যায়। এই সুড়ঙ্গই আমার বাঙ্কারে ঢোকার প্রবেশপথ।
জঙ্গলের এ দিকটায় মানুষ ঢোকে না। দূরদূরান্ত অবধি কোনও জনবসতিও নেই। তাই আমার গোপনীয়তা এখানে নিরাপদ। কালেভদ্রে পথ ভুলে কেউ এসে পড়লেও, গোখরোর দাপটে গাছের দিকে অন্তত ঘেঁসে না। তবে এসেছিল, চোরা-শিকারি! হাতে দিশি রাইফেল নিয়ে। তাক করেওছিল বন্দুক, চালানোর সুযোগ পায়নি। সে বীরপুঙ্গবের কঙ্কালখানা আমার বাসায় সাজিয়ে রাখা আছে এখনও, তাকে আমি এভিয়েটর সানগ্লাস পরিয়ে রেখেছি। তার চোখজোড়া অবশ্য কাজে লাগানো যায়নি। কারণ, চোখের আগে তার হৃদপিণ্ডটা বের করে নিয়েছিলাম।
রাজগোখরোটির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অদ্ভুত। আমার হৃৎস্পন্দন নেই, শরীরের তাপমাত্রাও নির্ধারণ করা যায় না। তাই আমার অস্তিত্বই হয়তো ওর কাছে পরিষ্কার নয়। বা হতে পারে পরিষ্কার, কিন্তু আমায় ভয় পায়। বা ভালোবাসে। জানি না, জানার প্রয়োজন বোধ করিনি। স্নেহ, মায়া, মমতা ইত্যাদি আবেগ ধারণ ক্ষমতা নেই আমার। তবে জেনে অথবা না জেনে আমার সে আমার গোপনীয়তা রক্ষায় সাহায্য করে। পরিবর্তে আমি ওর আশ্রয়, সুরক্ষা সুনিশ্চিত করি।
তবে সেদিন তাকে অন্যরূপে দেখলাম। সে কথাতেই আসছি।
গতবার অন্ধ লোকটাকে খুঁজতে বেরিয়ে হাল খারাপ হয়ে গেছিল। তবে খানেক বিশ্রাম নিয়ে চাঙ্গা হতে বেশি সময় লাগেনি। তাই সুস্থ হতেই শেষ একবার অন্ধ লোকটাকে খুঁজে বের করার মতলব করলাম। এটা জেদ। নিশ্চিত নই ঠিক, তবে বোধহয় এটাও একপ্রকার আবেগ।
ভাগ্যের এমন খেল, সে সন্ধান আমায় আর করতে হল না। বাঙ্কারের সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠলাম যখন, দেখি আমার ঘরের দোরগোড়াতেই সাক্ষাত…
সেদিনের সেই অন্ধ লোক!
আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল যেন। কী করে? কীভাবে? এতগুলো বছর যা কেউ সজ্ঞানে খুঁজে পায়নি, লোকটা খুঁজে পেল কী করে?
এদিকে লোকটাকে আমি দেখতে পাচ্ছি বটে, কিন্তু আমার বাকি ইন্দ্রিয় কোনোভাবেই তাকে শনাক্ত করছে পারছে না। পরখ করার জন্যে চটজলদি একবার চোখদুটো খুলে নিলাম। ঠিকই ধরেছি। চোখ ছাড়া এ মানুষের অস্তিত্ব নির্ণয় করা আমার পক্ষে কার্যত অসম্ভব।
দু-পা পিছিয়ে এলাম। একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে, এটা বোধহয় ভয়। লোকটা কী আমায় মেরে ফেলতে এসেছে? সেরকম হলে তো আত্মরক্ষার্থে ওকেই আগে মেরে ফেলতে হয়।
তার পায়ের কাছে ভয়ঙ্কর বিষধর রাজগোখরো পোষ্যের মতো জড়িয়ে আছে। অপরিচিতের সঙ্গে তার এরকম ব্যবহার করতে আমি আগে দেখিনি। লোকটা আমার সামনেই কালো চশমা খুলে ফেলে দিল। তারপর সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকালো। আর তখনই আবিষ্কার করলাম,
লোকটা অন্ধ নয়!
মানে? অন্ধ যখন নয়, সেজে আছে কেন?
মাথা কাজ করছে না বিশেষ। তবে মনে হচ্ছে বাঁচতে গেলে এই লোকটাকে মেরে ফেলতে হবে। তবে তার আগে লোকটার চোখদুটো চাই। আমি লোকটাকে জানতে চাই। জানতে চাই ওর ক্ষমতার উৎস। ওর চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখতে চাই।
এগিয়ে গেলাম, সে বাধা দিল না। শুভস্য শীঘ্রম! ওর চোখদুটো খুবলে নিলাম সঙ্গে সঙ্গে। কয়েক পশলা রক্ত মুহূর্তে ছিটকে এল মুখে। যেটুকু লেহ্য রক্ত ছিল ঠোঁটের কাছে, জিভ দিয়ে মুছে দিলাম। আর তারপর আমার সব হিসেব নিকেশ গুলিয়ে দিয়ে সেই লোকটা…
মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ অবধি বের করল না!
আমার জীবদ্দশায়, এই প্রথমবার। ধীর, স্থির, শান্ত, যন্ত্রণাহীন। তার চোখ আমি খুবলে বার করে নিয়েছি, তবু সে অস্বাভাবিকরকম নিরুত্তাপ! সেই ফাঁকা কোটর দিয়ে সে আমার দিকে ঠায় চেয়ে রইল। সে কোটরে আর চোখ নেই, কিন্তু মনে হল তাতেই তার দৃষ্টি আমায় এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে। আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। আমি জ্যান্ত কিনা জানি না, কিন্তু প্রাণভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেলাম। বাঁচার তাগিদে একপ্রকার উত্তেজনার বশেই লোকটার ঘাড়ে আঘাত করলাম, সে ছিটকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ল। লোকটাকে পুরোপুরি শেষ করে দেওয়ার জন্যে একটা ভারী পাথর হাতে তুলে নিলাম। ছুড়তে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার দীর্ঘদিনের সঙ্গী রাজগোখরো বাধ সাধল। কোনও সতর্কবার্তা ছাড়াই, প্রচণ্ড গর্জন করে আমার কোমরে সে মারনছোবল বসিয়ে দিল। পাথর আর রইল না হাতে। চারপাশে অন্ধকার নেমে আসছিল। দৌড় লাগালাম। ভীষণ দৌড়, আমার সর্বশক্তি দিয়ে। একবারের জন্যেও পিছনে ফিরে চাইলাম না।
অনীশের কথা
অনীশের যখন জ্ঞান ফিরল, তখন রাত পেরিয়ে ভোর হচ্ছে। অবশ্য দিন কী রাত, অনীশের আর বোঝার কথা নয়। অনীশ এটা অনুমান করল, ভোরের পাখির ডাকে হয়তো! মাথার পিছনে একবার হাত দিল অনীশ, যে জায়গাটা চোট লেগেছিল। এখন আর সেরকম ব্যথা করছে না। এরপর চোখ-বিহীন কোটর দুটোয় আঙুল বুলিয়ে দেখল। প্রাণভরে ছুঁয়ে দেখল। অবশেষে! এতদিন পর! অনীশ তবে অন্ধ! চোখ বের করে নিলেও, অশ্রু-গ্রন্থি বুঝি নিজের জায়গায় ঠিকই ছিল। আনন্দে কেঁদে ফেলল অনীশ, সে চোখের জল জমা হল ফাঁকা কোটরে। তবে একটা চিন্তা মাথার থেকে গেল না। জ্ঞান হারানোর পর অনেকটা সময় কেটে গেছে। এতক্ষণে তো রক্তক্ষরণে মৃত্যু হওয়ার কথা। সংক্রমণের কোনও লক্ষণও বোঝা যাচ্ছে না। তা ছাড়া, নূন্যতম ব্যথাটুকু অবধি কি থাকার কথা নয়? এসবই ভাবছিল অনীশ।
তারপর সেই বিকট গন্ধটা আবার নাকে এল।
আমার কথা
নতুন বাসায় উঠেছি দু-দিন হল। প্রত্যন্ত এলাকার এক পরিত্যক্ত গুদামঘরে। তবে এটা সাময়িক আস্তানা। যতক্ষণ না বাঙ্কার বানানোর উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছি একখানা, এটাই আমার ঠাঁই। ও জঙ্গলে আমি আর ফিরে যাইনি। সাহস হয়নি। হয়তো পরে কোনওদিন যাব। আমার সংগ্রহের সব চোখ ওখানেই পড়ে রয়েছে। শুধু দু-জোড়া সঙ্গে করে আনতে পেরেছি। একটা যেটা লাগানোই ছিল, আরেকটা আমার যমদূতস্বরূপ মৃত্যু-বাহকের। সেই লোকটার, যার ভয়েই আমি ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছি।
তবে আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেছে একখানা। ওই নতুন চোখজোড়া লাগিয়েছিলাম গতকালকেই। আজ অবধি এত মানুষের চোখ লাগিয়ে দেখেছি, বিশ্বাস করুন এইরকম আর একটিও পায়নি। কত চোখের কত রকম দৃষ্টিভঙ্গি হয়। কিন্তু এ চোখের কিচ্ছু নেই। কোনও চাহিদা নেই, ইচ্ছে নেই, লোভ নেই, ক্ষোভ নেই, মত নেই, মতবিরোধও নেই। সাদা পাতার মতো। যেন সারাজীবনে কিচ্ছুটি দেখেনি। কিচ্ছুটি দেখতেও চায় না।
তবে এর চেয়েও আশ্চর্যের ব্যপার হল, চোখটা কোনও কারণে আমি আর খুলতে পারছি না। কিছুতেই পারছি না। অবশ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি একটানা, দেখা যাক।
ওদিকে বিষক্রিয়া আমার শরীরে না হলেও, বিশ্বাসঘাতক রাজগোখরোর কামড়ের জায়গাটায় দাগ হয়ে রয়েছে। ওটারও কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।
Tags: গল্প, প্রলয় সরকার, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, হরর গল্প
আপনার গল্প বেশ ভালই লাগল। বেশ কয়েকটা স্তর পাওয়া গেল মনে হচ্ছে। নিরপেক্ষ চোখে প্রকৃতিকে দেখতে শিখলে হয়ত অনেক কিছু অন্যরকম ভাবে অনুভব করতে পারব। হয়ত আমাদের অমরত্ব ওখানেই। আশা করি আরও লেখা দেখতে পাব।