অ-মানবী
লেখক: প্রদীপ কুমার দাস
শিল্পী: সুমন দাস
পিসিকে আবছা মনে পড়লেও পিসেমশাইকে একদমই মনে পড়ে না অমিতাভর। আসলে পিসেমশাই চাকরি করতেন বাংলা থেকে অনেক দূরে সেই মধ্যপ্রদেশে। কালে-ভদ্রে বাংলায় আসতেন। বাবা-মাও কোনওদিন তাঁদের বাড়ি গিয়েছিলেন কিনা সন্দেহ। অমিতাভ তো কখনওই যায়নি। পিসেমশাইকে অমিতাভ হাতে গোনা দু-একবারের বেশি দেখেনি। তাও ছোটবেলায়। পিসিমা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন বছরে এক-আধবার ফোন করতেন। তিনি মারা যাবার পরে গত দু’বছরে সেটাও বন্ধ। তাদের তরফ থেকেও যোগাযোগ রাখার খুব তাগিদ ছিল না। তাই পিসেমশাইয়ের কথা অমিতাভ ভুলেই গিয়েছিল।
সেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে তাই যখন শুনল যে সেই পিসেমশাই ফোন করেছিলেন তখন সে অবাক হয়ে গেল। আরও অবাক হল শুনে যে পিসেমশাই তার খোঁজখবর করছিলেন। বলেছেন আবার ফোন করবেন। এত বছর পরে হঠাৎ তার খোঁজ নেবার কারণ কী তা অমিতাভ ভেবে উঠতে পারল না। মা অবশ্য দিব্যি একটা কারণ বের করে ফেলল, “আহা রে! বয়স্ক মানুষ। দেশ ছেড়ে এত দূরে একা পড়ে রয়েছেন। দিদিও নেই। ওঁদের কোনও ছেলেমেয়েও নেই। এখন যদি একমাত্র শালার ছেলের কথা মনে পড়ে তাতে অবাক হওয়ার কী আছে?”
বাবা বলল, “জামাইবাবুকে যতদূর চিনি তাতে ইমোশনাল হওয়ার মতো লোক তিনি নন। বরং উলটোটা। ওঁর মতো প্রাকটিক্যাল লোক খুব কমই হয়। সারাজীবন কাজ-কাজ করেই কাটালেন। নিজেও ফিরলেন না, দিদিকেও ফিরতে দিলেন না।” বাবার শেষের কথাগুলো কেমন ভারী শোনাল।
মা বলল, “যাই হোক। কালকে তো আবার ফোন করবেন। তখন অমিত কথা বলে নিবি।”
অমিতাভ শুনেছে পিসেমশাই অজিতেশ সান্যাল বেশ পণ্ডিত লোক। খুব গুরুত্বপূর্ণ পদে সরকারি চাকরি করতেন। যদিও ঠিক কী করতেন, সে সম্বন্ধে তার কোনও ধারণা নেই। বাবাও খুব ভালো জানে না। শুধু এটুকু জানে যে তাঁর কাজকর্মে একটা রাখঢাক ছিল। দিদিও তাঁকে কোনও দিন খোলসা করে কিছু বলেনি।
অমিতাভ এমবিবিএস পাশ করে এখন মেডিক্যাল কলেজে মেডিসিনে এমডি করছে। কলকাতায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা আদ্যন্ত আধুনিক ঝকঝকে তরুণ। বন্ধুবান্ধব, সোশ্যাল মিডিয়া, হাসপাতাল, পেশেন্ট এই নিয়ে নিজের জগতে মশগুল।
পরদিন সকালে মায়ের ডাকে তার ঘুম ভাঙল। মা বলল, “তাড়াতাড়ি ওঠ। তোর পিসেমশাই ফোন করেছেন।”
অমিতাভ ঘুম জড়ানো চোখে মোবাইলে সময় দেখল। সকাল সাতটা। তারপর বিছানা ছেড়ে নেমে ল্যান্ড লাইনে আসা ফোনটা রিসিভ করল।
ওপাশ থেকে যে গলাটা ভেসে এল সেটাকেই বোধহয় জলদ-গম্ভীর স্বর বলে। অমিতাভর “হ্যালো”র উত্তরে পিসেমশাই বললেন, “আমাকে তোমার মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু আমি তোমাকে ভালো করে চিনি। তোমার স্বর্গত পিসির কাছে তোমার কথা শুনেছি। তুমি ভালো স্টুডেন্ট, ভালো খেলাধুলো কর এসব জানি। তুমি যে ডাক্তারি পাশ করেছ সেটাও আমার জানা আছে। আমার সাবজেক্টও বায়োলজি রিলেটেড। এখন অবশ্য রিটায়ার করেছি। যাই হোক, তুমি যদি কিছুদিনের জন্য আমার এখানে আসতে পার তাহলে খুব ভালো হয়। এখানকার প্রকৃতি তোমার ভালো লাগবে। আমার কাজকর্ম সম্বন্ধেও জানতে পারবে। হাসপাতাল থেকে দিন সাতেকের ছুটি ম্যানেজ করে চলে এস। আমি তোমার মা-বাবাকে বলে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, আসার সময় তোমার ডাক্তারির ইনস্ট্রুমেন্টস আর কিছু ওষুধপত্র যদি সঙ্গে আনো তো ভালো হয়।”
পিসেমশাইয়ের প্রস্তাবে অমিতাভ অবাক হলেও তার মনটা আনন্দে নেচে উঠল। সে ঘুরতে ভালোবাসে। প্রতি বছর দল বেঁধে ট্রেকিং করতে যায়। কিন্তু মধ্যপ্রদেশ যাওয়া হয়নি। সে শুনেছে মধ্যপ্রদেশ পাহাড়, জঙ্গল আর ঐতিহাসিক নিদর্শনে পরিপূর্ণ। তাই পিসেমশাইয়ের কাজের সম্বন্ধে জানার চেয়ে নতুন জায়গা দেখার আকর্ষণটাই প্রবল হয়ে উঠল।
বাবা-মাও আপত্তি করল না। মা বলল, “দ্যাখ যদি তোকে দেখে জামাইবাবুর দেশে ফেরার মন হয়!”
বাবা বলল, “ওষুধপত্র নিয়ে যেতে বললেন কেন কে জানে। তাহলে কি ওঁর শরীর খারাপ? সেরকম বুঝলে জোর করে এখানে নিয়ে আসবি।”
দিন-তিনেক পরে অমিতাভ মধ্যপ্রদেশ এসে পৌঁছল। পিসেমশাই যেখানে থাকেন সেটা নাকি আশ্চর্য সুন্দর জায়গা। চারপাশে ছোটখাটো পাহাড়ে ভর্তি। পাহাড়ের বুকে বুকে জঙ্গল। মাঝে মাঝে ছোটবড় লেক। জঙ্গল তেমন ঘন নয়। স্টেশন থেকে গাড়িতে আসতে আসতে অমিতাভ জানতে পারল এই জঙ্গলে ভালুক আছে, বুনো শুয়োর আছে, হরিণ আছে। এমনকি মাঝে মধ্যে চিতাবাঘও দেখা যায়। ড্রাইভার ছেলেটা তরুণ। সে পিসেমশাইকে চেনে। এদিকেই কোনও গ্রামে তার বাড়ি। তাই আসতে রাজি হয়েছে। নাহলে তো কোনও গাড়িই এদিকে আসতে চাইছিল না।
নির্জন পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পিসেমশাইয়ের বাংলোয় পৌঁছাতে প্রায় ঘণ্টা-দুয়েক লাগল। আসার পথে বেশ কিছু আদিবাসী গ্রাম চোখে পড়ল। এসব অঞ্চলে এখনও নগর-সভ্যতার থাবা এসে পড়েনি।
বাবা পিসেমশাইকে ফোনে অমিতাভর আসার কথা জানিয়ে দিয়েছিল। পিসেমশাইয়ের বাংলোয় পৌঁছে অমিতাভ দেখল পিসেমশাই নিজে গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। অমিতাভকে দেখে বললেন, “এসো। ঠিকমতো গাড়ি পেয়েছিলে?”
অমিতাভ পিসেমশাইকে প্রণাম করে বলল, “কেউ এদিকে আসতে চাইছিল না। শেষে এই ড্রাইভারটা রাজি হয়। ওর বাড়ি এদিকের কোনও গ্রামে।”
“হুম। আমি সেটাই আশংকা করছিলাম। আসলে আমার গাড়ির দরকার পড়ে না বলে রাখিনি। নাহলে আমি নিজেই তোমাকে আনতে যেতাম।”
অমিতাভ তাড়াতাড়ি বলল, “না না, ঠিক আছে।”
পিসেমশাই অমিতাভকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। একটা সুন্দর পশ্চিম-খোলা ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে। অমিতাভর দেখেই পছন্দ হয়ে গেল। পিসেমশাই বললেন, “এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। আমার জেনারেটর আছে। তবে সেটা সবসময় চালাই না। তোমার একটু অসুবিধে হবে।”
এর উত্তরেও অমিতাভ “না না” বলল।
ইলেক্ট্রিসিটি না থাকলেও গরম খুব বেশি লাগছিল না। তা ছাড়া একটা সুন্দর ঠাণ্ডা হাওয়া আসছিল। বোধহয় কাছেপিঠে কোনও জলাশয় আছে।
অমিতাভ বাথরুমে গিয়ে স্নান করে নিল। পিসেমশাই একা থাকলেও তাঁর তিনজন সহকারী আছে। এরাই ঘরের সব কাজ, রান্নাবান্না করে। তাদেরই কেউ কুয়ো থেকে জল তুলে বাথরুমে রেখে দিয়েছিল।
দুপুরে খেতে বসে পিসেমশাই বললেন, “এখানে প্রথমে তোমার একটু লোনলি লাগবে। তুমি শহুরে ছেলে। কিন্তু তোমার যদি বনজঙ্গল ভালো লাগে তাহলে এর মতো জায়গা আর পাবে না।”
অমিতাভ বলল, “আপনি এরকম একটা লোকালয়ের বাইরে একা একা থাকেন কেন? এই বাংলোটাই বা কী করে পেলেন?”
“তোমার প্রথম প্রশ্নটার জবাব যথাসময়ে পাবে। দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর হল, এটা ছিল ইংরেজ আমলের একটা পরিত্যক্ত ফরেস্ট বাংলো। আমি চাকরি সূত্রে এই অঞ্চলে অনেকবার এসেছি। তখন এই বাংলোটা দেখে ভালো লেগে যায়। বাংলোটায় অবশ্য তখন কেউ থাকত না। যাই হোক, রিটায়ারমেন্টের পর তোমার পিসিমা আর আমি সিদ্ধান্ত নিই যে শহর থেকে দূরে কোথাও থাকব। তখন এই বাংলোটার কথা মনে হয়। সরকারি বাংলো পাওয়া অবশ্য সহজ ছিল না। কিন্তু আমার কিছু চেনা-পরিচিতি ছিল। সেটা কাজে লাগিয়ে আমি বাংলোটা পঁচিশ বছরের জন্য লিজ নিই। সরকারি খাতায় এটা এখন আমার বন্যপ্রাণী গবেষণা কেন্দ্র।” বলে পিসেমশাই একটু হাসলেন।
অমিতাভ জিজ্ঞেস করল, “কিছু মনে করবেন না, আপনি ঠিক কী চাকরি করতেন?”
পিসেমশাই বললেন, “সবটা তোমাকে খুলে বলতে পারব না। ভাবতে পারো ভারত সরকারের কোনও গোপন গবেষণায় যুক্ত ছিলাম।”
অমিতাভ আর কোনও প্রশ্ন করল না।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে অমিতাভ ঘুরতে বেরিয়েছিল। বাংলোর পাশে সত্যিই একটা লেক আছে। সেই লেকের জল ঘন নীল। অমিতাভ ঠিক করল একদিন এই লেকে ছিপ ফেলে মাছ ধরবে। পিসেমশাই বলেছেন এদিকে এমনিতে কোনও বিপদ নেই একমাত্র সাপ ছাড়া। সন্ধের আগে বাংলোয় ফিরতে বলে দিয়েছেন।
সন্ধে নামার ঠিক আগে অমিতাভ বাংলোয় ফিরে এল।
পিশেমশাইয়ের কাজের লোকেরা সবাই আশপাশের গ্রামে থাকে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে আবার সূর্যাস্তের আগে ফিরে যায়। তার আগে অবশ্য তারা বাথরুমে জল রেখে, রাতের রান্না করে দিয়ে গেছে। জেনারেটরটাও চলছে।
অমিতাভ ফিরতে পিসেমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন ঘুরলে?”
অমিতাভ হেসে বলল, “খুব ভালো।” জায়গাটা সত্যিই তার ভালো লেগেছিল।
“এসো, চা খেয়ে নাও। আমি বানিয়ে রেখেছি।”
অমিতাভ একটু ইতস্তত করে বলল, “আমার চা না হলেও চলত। আপনি কেন কষ্ট করলেন?”
পিসেমশাই হেসে বললেন, “না হে না। সন্ধেবেলায় আমি চা নিজেই বানিয়ে খাই। তুমি একটুও সংকোচ করো না।”
চা খাওয়া শেষ হলে পিসেমশাই বললেন, “এবার তোমাকে একটু কষ্ট দেব। তোমাকে একজন পেশেন্ট দেখতে হবে।”
অমিতাভ অবাক হয়ে বলল, “কোথায়?”
“এই বাংলোতেই।”
“এখানে আপনি ছাড়া আর কেউ থাকে নাকি?”
“হ্যাঁ, থাকে।” তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, “আমাদের মেয়ে জয়া থাকে।”
“কিন্তু আমি তো জানতাম যে আপনাদের…!” অমিতাভ কথাটা সম্পূর্ণ না করে বোধহয় সঙ্কোচে থেমে গেল।
পিসেমশাই বললেন, “আমি জানি তুমি কী বলতে চাইছ। না, আমাদের কোনও সন্তান নেই। জয়া আমাদের পালিতা কন্যা।”
“কোথায় সে? এতক্ষণ তাকে দেখিনি কেন?”
“সে অসুস্থ। তার ঘরে শুয়ে আছে। তুমি এতটা দূর থেকে এসেছ। তাই সকালে তোমাকে বিরক্ত করিনি।”
অমিতাভ ব্যস্ত হয়ে বলল, “এতে বিরক্ত করার কী আছে। চলুন, এখুনি আমি দিদিকে দেখছি।”
পিসেমশাই অমিতাভকে বাংলোর পিছন দিকে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। সেটা খোলার আগে পিসেমশাই অমিতাভর দিকে ঘুরে তাকালেন। তারপর বললেন, “ঘরের ভিতরে তুমি যা দেখবে সেটা হয়তো তোমাকে অবাক করতে পারে। কিন্তু আমি তোমাকে পরে সব খুলে বলব। এখন তুমি জয়াকে একবার দেখ।”
ঘরের ভিতরে একটা অল্প পাওয়ারের বাতি জ্বলছিল। তার আবছা আলোয় অমিতাভ দেখল একজন ওপাশ ফিরে গলা পর্যন্ত চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে। পিসেমশাই বললেন, “জয়া মা ওঠো। দেখো, তোমার এক দাদা এসেছে।”
জয়া এপাশ ফিরে উঠে বসল। চাদরটা গলা থেকে খসে কোমরের কাছে নেমে এল। অমিতাভ হেসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার কথা মুখেই রয়ে গেল। এ কী দেখছে সে? বিছানার উপরে যে বসে আছে সে কি মানুষ না অন্য কিছু? না মানুষ নয়। একটা বাঁদর-জাতীয় প্রাণী বিছানায় বসে আছে। অমিতাভকে দেখে সে মুখে যে ভাবটা করল মানুষ হলে সেটাকে হাসি বলা চলত। তারপর মুখ থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বের করল। যেটার অর্থ না বোঝা গেলেও সেটা যে আনন্দের প্রকাশ সেটা বুঝতে অমিতাভর অসুবিধে হল না।
পিসেমশাই বললেন, “হ্যাঁ মা। এ তোমার দাদা। তোমাকে একবার পরীক্ষা করবে।”
জয়া নামের প্রাণীটি তার একটা হাত সামনে বাড়িয়ে দিল। পিসেমশাই সেই হাতটা নিজের হাতে ধরলেন। তারপর অমিতাভকে বললেন, “আমি জানি তুমি প্রচণ্ড অবাক হয়েছ। কিন্তু তুমি ভয় পেয়ো না। জয়া খুব শান্ত মেয়ে।”
অমিতাভ এতক্ষণ কথা বলতেও ভুলে গিয়েছিল। এবার সে কোনও রকমে মুখ খুলল, “কিন্তু পিসেমশাই, আমি মানুষের ডাক্তার। এর চিকিৎসা আমি কীভাবে করব?”
“আমি সেটা জানি অমিতাভ। কিন্তু বিশ্বাস করো এর ফিজিয়োলজি মানুষের খুব কাছাকাছি। আমার বিশ্বাস তুমি একে পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবে অসুবিধেটা কী।”
“কিন্তু…!”
“অমিতাভ আমি নিতান্তই নিরুপায় হয়ে তোমাকে এতদূর থেকে ডেকে নিয়ে এসেছি। এ ছাড়া আমার আর উপায় নেই। তোমাকে অনুরোধ করছি তুমি একবার জয়াকে পরীক্ষা করে দেখ।”
এত বড় মাপের একজন মানুষের এরকম অসহায় অনুরোধ শুনে অমিতাভ আর কিছু বলতে পারল না। সে পকেটের স্টেথোটা হাতে নিয়ে বিছানার পাশে এসে বসল। জয়া খুব শান্তভাবে বিছানায় বসে ছিল। এবার সে তার আর-একটা হাত অমিতাভর দিকে বাড়িয়ে দিল। একটু ইতস্তত করে অমিতাভ হাতটা ধরল। একটা লোমশ হাত। অমিতাভর মনে হল হাতটা একটু গরম।
সে বলল, “ওর অসুবিধেটা কী সেটা যদি বলেন…।”
“বলছি। আজ থেকে দিন পনেরো আগে ও আমাদের আর-এক সন্তান বিজয়ের হাতে ইনজিউরড হয়েছিল। দেহের অনেক জায়গায় কেটে ছড়ে গিয়েছিল। আমার জানা অ্যান্টিবায়োটিক মলম লাগিয়ে ঘাগুলো শুকিয়ে এসেছে। কিন্তু দিন-সাতেক হল জ্বর ছাড়ছে না। এই কদিনে খাওয়াদাওয়াও কমিয়ে দিয়েছে। কয়েকবার বমিও করেছে।”
অমিতাভ এতক্ষণে অনেকটা সামলে নিয়েছিল। সে বলল, “চাদরটা একবার সরান।”
পিসেমশাই জয়ার শরীর থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলেন। অমিতাভ দেখল জয়া কোমরের নিচে একটা ঘাগরা মতো পোশাক পড়ে আছে।
অমিতাভ প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা করল। গায়ে জ্বর আছে। বুকেও একটু কফ জমেছে। আঘাতের চিহ্নগুলো অবশ্য শুকিয়ে এসেছে। পরীক্ষা শেষ করে সে বলল, “এর ওজন কত?”
“প্রায় ত্রিশ কিলো।”
অমিতাভ মনে মনে ওষুধের ডোজ হিসেব করে নিল। তারপর বলল, “আমার সঙ্গে একটা ইনজেকশন আছে। সেটা দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু কালকে শহর থেকে আরও কিছু ওষুধপত্র আনতে হবে।”
পিসেমশাই বললেন, “ঠিক আছে। তুমি লিখে দিও, আমি লোক পাঠিয়ে আনানোর ব্যবস্থা করব।”
অমিতাভ ইনজেকশন দিয়ে দিল। ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দেখে জয়া একটু ভীত হয়েছিল। কিন্তু পিসেমশাই যেই বললেন, “না জয়া, ভয় পায় না। একটুও ব্যথা লাগবে না।” অমনি সে শান্তভাবে ইনজেকশন নিয়ে নিল। তারপর তার লম্বা হাতটা বাড়িয়ে অমিতাভর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। পিসেমশাই বললেন, “এখন তুমি ঘুমাও। আমি পরে এসে তোমাকে খাইয়ে যাব।”
জয়া বিছানায় শুয়ে পড়ল। পিসেমশাই তার গায়ে আবার চাদরটা টেনে দিলেন। দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
বসার ঘরে এসে বসেছিল অমিতাভ। তার মনে হাজার প্রশ্নের ভীড়। সে জানে অনেক মানুষ তাদের পোষ্যকে সন্তানের মতো ভালোবাসে। তার এক মামিমা তাদের পোষা কুকুরকে ছেলে বলে ডাকেন। পিসি-পিসেমশাইয়ের সেরকম ব্যপার থাকতেই পারে। কিন্তু সে অবাক হয়েছে পোষ্য প্রাণীটিকে দেখে। প্রাণীটা যে একটা শিম্পাঞ্জি সেটা সে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু পিসেমশাই শিম্পাঞ্জি পেলেন কোথায়? তাকে পোশাক পরিয়ে রেখেছেন কেন? বিজয়টা কে? সে কি আর-একটা শিম্পাঞ্জি? পিসেমশাই তাকে এতদূর থেকে ডেকে না এনে কোনও ভেটেরিনারিকে ডাকলেন না কেন? প্রশ্ন অনেক। তাছাড়া শিম্পাঞ্জিটার আচরণও তাকে অবাক করেছে। কোনও বাঁদর-জাতীয় প্রাণী এত শান্ত, এত বুঝদার হতে পারে সেটা তার জানা ছিল না।
পিসেমশাই সামনের সোফায় বসে। তার হাতে ধরা হুইস্কির গ্লাস। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তার মনেও অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের ঝড় চলছে। শেষ পর্যন্ত তিনি গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, “আমি দুঃখিত অমিতাভ তোমাকে এরকম একটা সিচুয়েশনে এনে ফেলার জন্য। কিন্তু বিশ্বাস করো, জয়া আমাদের নিজের সন্তানের মতোই প্রিয়। ওর ভালোর জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। তোমার পিসিমা বেঁচে থাকলে তিনিও একথাই বলতেন।”
“ঠিক আছে পিসেমশাই। আপনি আমাকে সব কথা খুলে বলতে পারেন।”
“হ্যাঁ, তোমাকে বলতেই হবে।” পিসেমশাই তাঁর মনকে স্থির করলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, “তোমার হয়তো জানা নাও থাকতে পারে, তাই প্রথমে কয়েকটা তত্ত্বকথা বলে নিই। মানুষের সবচেয়ে কাছের সমগোত্রীয় প্রাণী হল গোরিলা, শিম্পাঞ্জি আর ওরাং ওটাং, যাদের একত্রে বলা হয় গ্রেট এপস্। এদের মধ্যে আবার শিম্পাঞ্জির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল লক্ষ করা যায়। মানুষ আর শিম্পাঞ্জির উৎপত্তি বিবর্তনের একই কমন পূর্বপুরুষ থেকে। প্রায় সত্তর লক্ষ বছর আগে দুটো ধারা আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু দুটি প্রজাতির মধ্যে মিল বিস্ময়কর। মানুষের শরীরে তেইশ জোড়া ক্রোমোজোম। শিম্পাঞ্জি আর গোরিলার চব্বিশ জোড়া। পার্থক্য কেবল দ্বিতীয় ক্রোমোজোমে যেটা মানুষের ক্ষেত্রে একজোড়া আর মহাকপিদের দু-জোড়া। মানুষ আর শিম্পাঞ্জির রক্তের হিমোগ্লোবিনের গঠন হুবহু এক। এরকম আরও মিল রয়েছে। অবশ্য পার্থক্যও প্রচুর। তুমি নিশ্চয়ই হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের কথা জানো। যেখানে মানুষের সমস্ত জিনের পূর্ণ তথ্য আছে। সেরকম শিম্পাঞ্জিরও সম্পূর্ণ জিন ভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির একটা প্রধান পার্থক্য হল কথা বলার জিন। মানুষের ক্ষেত্রে যেটা খুবই শক্তিশালী। অর্থাৎ মানুষ এবং মহাকপিদের একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হল কথা বলার ক্ষমতায়।
এ তো গেল তত্ত্ব কথা। এবার আমার কাজ নিয়ে তোমাকে কিছু কথা বলি। সব কথা দেশের নিরাপত্তার খাতিরে তোমাকে বলতে পারব না। যাই হোক, আমি চাকরি করতাম ডিআরডিও-র অধীনে অ্যানিম্যাল রিসার্চ ফেসিলিটিতে। যেহেতু আমার বিষয় ছিল জেনেটিক্স তাই আমার উপরে দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন প্রাণীর জেনেটিক স্ট্রাকচার নিয়ে কাজ করার। আমাদের প্রয়াস ছিল কীভাবে প্রাণীদের সাহায্যে বিভিন্ন রোগ-জীবাণু সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা যায়, উন্নততর ওষুধ, ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা যায়। এই রকম রিসার্চ করতে করতে আমরা পরীক্ষাগারে শিম্পাঞ্জির জেনেটিক মডিফিকেশন শুরু করি। আমাদের কাছে দুটো শিম্পাঞ্জি ছিল শিবা এবং গৌরী। তাদের জিনে পরিবর্তন এনে আমরা নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা চালাই। স্বভাবতই জিনে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আচার ব্যবহারেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আমরা লক্ষ করি শিবা আর গৌরী ক্রমশ আমাদের পরীক্ষানিরীক্ষায় বাধা দিতে শুরু করে। অর্থাৎ তারা বুঝতে শুরু করেছিল যে আমরা ওদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করছি। যাই হোক, ক্রমাগত পরীক্ষানিরীক্ষার ফলে ওরা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। অবশেষে এক সময় কিছুদিনের ব্যবধানে দুজনের মৃত্যু হয়।
ইতিমধ্যে শিবা আর গৌরীর দুটো সন্তান হয়েছিল। ওরা যখন মারা যায় তখন তারা নিতান্তই ছোট। এদিকে আন্তর্জাতিক চাপে ও অন্যান্য নানা কারণে বড় বাঁদর বা বিগ এপদের উপরে পরীক্ষানিরীক্ষা ক্রমশ কমে আসছিল। গত দশকের মাঝামাঝি তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
চাকরি সূত্রে আমরা রিসার্চ ফেসিলিটির মধ্যেই বাস করতাম। শিবা আর গৌরী আমার এবং তোমার পিসিমার খুব প্রিয় ছিল। ওরা মারা যাবার পর এবং সরকার শিম্পাঞ্জির উপর পরীক্ষানিরীক্ষা বন্ধ করার পর তাদের বাচ্চা দুটোকে আমরা আমাদের কোয়ার্টারে নিয়ে আসি। সেখানে তারা বড় হতে থাকে। তোমার পিসিমা তাদের নিজের সন্তানের মতো যত্ন নিতেন। আমারও প্রাণী দুটোর উপরে মায়া পড়ে গিয়েছিল। তাই রিটায়ারমেন্টের সময় আমি উপর মহলে আবেদন করে ওদের আমাদের কাছে রাখার অনুমতি আদায় করি। ব্যপারটা হয়তো সহজ হত না। কিন্তু আমার চাকরি জীবনের গুড রিপোর্ট আমাকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু সরকার থেকে আমাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যেন কোনওভাবেই প্রাণী দুটোর খবর বাইরে না বেরোয়। যাই হোক, রিটায়ারমেন্টের পরে আমরা ঠিক করি লোকালয় থেকে দূরে কোনও নিরিবিলি জায়গায় থাকব। কারণ লোকালয়ের মধ্যে থাকলে শিম্পাঞ্জি দুটোর কথা গোপন রাখা যাবে না। তখন এই বাংলোটা আমি লিজ নিয়ে চলে আসি। সেটাও প্রায় দশ বছর আগের কথা। সেই শিম্পাঞ্জি দুটোও আমাদের সঙ্গে আসে। আমরা তাদের নিজেদের সন্তানের মতো বড় করতে থাকি। তাদের নামকরণ করি জয়া আর বিজয়। বিজয় জয়ার চেয়ে দু-বছরের বড়। এখানে বাইরের লোক প্রায় আসে না বললেই চলে। জয়া-বিজয়ের কথা তাই বাইরে বেরোনোর সম্ভাবনা ছিল না। আমরা ওদের কোনওদিন বাংলোর বাইরে যেতে দিইনি। যে সব আদিবাসী মানুষগুলো আমাদের কাজকর্ম করে দেয় তারা অবশ্য ওদের কথা জানে। কিন্তু তারাও ওদের খুব ভালোবাসে এবং আমাদের অনুরোধে তাদের কথা বাইরে কাউকে বলেনি। আমরাও কোনওদিন ওদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারিনি বা কাউকে আমাদের বাংলোয় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারিনি।
এদিকে জয়া-বিজয় বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কতগুলো অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করি। এমনিতে শিম্পাঞ্জি বুদ্ধিমান প্রাণী। তারা খাদ্যের সন্ধানে ছোটখাটো যন্ত্রপাতি যেমন গাছের ডাল বা পাথর সূচালো করে ব্যবহার করতে জানে। তারা নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করতেও পারে, যদিও সেই ক্ষমতা খুবই সীমিত। কিন্তু জয়া আর বিজয় আমাদের জানা যে কোনও প্রাণীর থেকে বেশি বুদ্ধিমান। ওরা আমাদের সমস্ত কথা বুঝতে শিখে যায়। এমনকি অঙ্গভঙ্গি ও মুখের আওয়াজ করে আমাদের তাদের কথা বোঝাতেও শুরু করে। বিজয় একটু আধটু দুষ্টুমি করলেও জয়া খুবই শান্ত আর বেশি বুদ্ধিমান। জয়া তোমার পিসিমার খুব ন্যাওটা হয়ে পড়ে। সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকত। এমনকি রান্নাঘরে তোমার পিসিমাকে সাহায্য পর্যন্ত করত। আমাদের একটা টেলিভিশন সেট আছে দেখেছ। যদিও তাতে ন্যাশনাল চ্যানেল ছাড়া আর কোনও চ্যানেল আসে না। তোমার পিসিমা সন্ধেবেলায় টিভিতে প্রোগ্রাম দেখত। জয়া তার পাশে বসে টিভি দেখত। তাকে দেখে বুঝতে পারতাম সে টিভির অনুষ্ঠানগুলো বোঝার চেষ্টা করছে। হয়তো বুঝতেও পারত। আমাদের একটা মিউজিক প্লেয়ার আছে। তাতে গান শুনত। আমি ওদের বিভিন্ন রং, আকার বা শেপ এবং ছোটবড়র ধারণা শেখাতে চেষ্টা করি। জয়া অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সাতটা রং, গোল-চৌকো-ত্রিকোণ এসবের প্রভেদ শিখে যায়। বিজয়ও শিখেছে কিন্তু ওর আরও বেশি সময় লেগেছে। একদিন দেখি জয়া আমার খাতা কলম টেনে নিয়ে আঁকিবুঁকি কাটছে। আমি তখন ওকে ছবি আঁকা শেখাতে শুরু করি। এক বছরের মধ্যে জয়া দিব্যি ছবি আঁকতে শিখে যায়। দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি।” পিসেমশাই উঠে গিয়ে শেলফ্ থেকে একটা খাতা নিয়ে এসে অমিতাভকে দিলেন। অমিতাভ খাতাটা খুলে দেখল তার পাতায় পাতায় পেন্সিলের আঁচড়ে নানা আকার ফুটে উঠেছে। যেন একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা লেখা শিখছে। প্রথম দিকের আঁকাগুলো বেশ এলোমেলো। কিন্তু যত দিন গেছে আঁকাগুলো পোক্ত হয়ে উঠেছে। শেষদিকের গোল বা ত্রিভুজ আঁকাগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই এটা মানুষের আঁকা নয়।
পিসেমশাই তাঁর গ্লাসে আর-এক পেগ হুইস্কি ঢেলে নিলেন। তারপর বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই জানো ছবি আঁকা মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার আদিমতম ইতিহাসের একটা বড় পদক্ষেপ। মানুষ কথা বলতে শেখার আগেই ছবি আঁকতে শিখেছিল। তাই জয়ার ছবি আঁকার চেষ্টা দেখে আমরা বুঝতে পারি এই দুটো প্রাণী কোনও মন্ত্রবলে বিবর্তনের ধারায় এদের প্রজাতির তুলনায় কয়েক লক্ষ বছর এগিয়ে গেছে।”
অমিতাভ এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। এবার সে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? বিবর্তনের পথে এরকম লাফ দেওয়া কি সম্ভব?”
পিসেমশাই একটু ভেবে বললেন, “আমিও এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। বিবর্তনের পথে বড় লাফ দেওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব। কিন্তু সেটা হয় একটা গোটা প্রজাতি ধরে। এরকম একটি-দুটি প্রাণী নিয়ে নয়। অতএব জয়া-বিজয়ের এই উন্নতির পিছনে একটাই কারণ থাকতে পারে। সেটা হল ওদের মা-বাবা অর্থাৎ শিবা আর গৌরীর উপরে চালানো পরীক্ষানিরীক্ষা। আমরা ওদের উপরে অনেক রকম ওষুধ প্রয়োগ করে ছিলাম, রেডিয়েশন দিয়েছিলাম। তোমাকে তো আগেই বলেছি ওদের বুদ্ধি সাধারণ শিম্পাঞ্জির চেয়ে বেশি ছিল। হয়তো তাদের এই ট্রেট বা গুণ বংশধারার মাধ্যমে জয়া আর বিজয়ের মধ্যে এসেছে। শুধু তাই নয় প্রকৃতি তাকে নিজের ক্ষমতায় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।”
অমিতাভ সম্মতি-সূচক মাথা নাড়ল। এছাড়া এই ঘটনার আর কিই বা ব্যাখ্যা হতে পারে?
পিসেমশাই বললেন, “যতই বুদ্ধি বেশি হোক এবং আমরা ওদের সন্তানের মতো ভালোবাসি না কেন তখনও পর্যন্ত ওদেরকে আমরা পশু হিসেবেই ভাবতাম। কিন্তু আমাদের সব ধারণা পালটে গেল যখন জয়ার দশ বছর বয়স হল। একদিন দেখলাম জয়া আমাদের কাছে আসতে চাইছে না। ঘরের কোণাটোণায় লুকিয়ে থাকছে। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ও বোধহয় খেলা করছে। কিন্তু তোমার পিসিমা বুঝতে পারল জয়া কোনও কারণে বিব্রত। আমাদের জানালা থেকে যে বড় পর্দা ঝুলছে সেটার পিছনে লুকানোর চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত বুঝলাম জয়া লজ্জা পাচ্ছে। কারণ সে প্রথম ঋতুমতী হয়েছে। তোমার পিসিমা তার একটা কাপড় এনে দেওয়ায় সে কাপড়টা জড়িয়ে পরার চেষ্টা করে। যেরকম সে তোমার পিসিমাকে পড়তে দেখেছে। তখন তোমার পিসিমা তাকে কাপড়টা পরিয়ে দেয়। তখন তার সংকোচ কিছুটা কমে। পরদিন তোমার পিসিমা নিজের হাতে জয়ার জন্য ঘাগরা আর বিজয়ের জন্য প্যান্ট বানিয়ে দেয়। বিজয় অবশ্য প্রথমে প্যান্ট পড়তে রাজি ছিল না। তখন জয়াই তাকে বুঝিয়ে রাজি করায়।”
পিসেমশাই একটু থেমে বললেন, “এই ঘটনা আমাদের ধারণাকে একদম নাড়িয়ে দিয়েছিল। তুমি বুঝতে পারছ কগনিটিভ লেভেলে কতটা অগ্রসর হলে কোনও প্রাণী লজ্জা পেয়ে তার গোপনাঙ্গ ঢাকার চেষ্টা করতে পারে? সেই থেকে আমরা বুঝতে পারি ওরা আর সাধারণ শিম্পাঞ্জি নেই, বরং মানুষের মতোই হয়তো তার চেয়ে একটু কম বুদ্ধিমান কোনও প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে।”
পিসেমশাই এই পর্যন্ত বলে থামলেন। অমিতাভর মনে হচ্ছিল সে বোধহয় কোনও রূপকথার গল্প শুনছে। কিন্তু সে নিজে জয়াকে দেখেছে। পিসেমশাইয়ের কথা সে অবিশ্বাস করে কীভাবে?
অমিতাভ একটু ভেবে বলল, “বিজয় কোথায়? তাকে তো দেখছি না।”
পিসেমশাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সে পালিয়েছে। হয়তো এই বাংলোর আশপাশেই কোনও গাছে আছে। কারণ তার জন্য বাইরে যে খাবার রাখা থাকে সেটা সে রোজ খেয়ে যায়।”
“সেকি! কীভাবে পালাল?”
পিসেমশাই বললেন, “আমরা কোনওদিনই জয়া-বিজয়কে বেঁধে রাখিনি। তার প্রয়োজনও পড়েনি। তোমার পিসিমা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন আমরা দুজনে মিলে ওদের দেখাশোনা করতাম। কিন্তু বছর দুয়েক আগে তোমার পিসিমা দু-দিনের জ্বরে চলে গেল। তারপর থেকে আমার একার পক্ষে ওদের দেখাশোনা করা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। হয়তো সময় মতো ওদের খেতে দিতে পারতাম না। তাতে জয়া কিছু না বললেও বিজয় অসন্তুষ্ট হত। আমার কাজের লোকেরা যদিও আমাকে সাহায্য করে কিন্তু রাতের বেলা তো ওরা থাকে না। তখন অসুবিধা হয় বেশি। তা ছাড়া বিজয় বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু দামাল প্রকৃতির হয়ে উঠেছিল। সে আর এই বাংলোর মধ্যে থাকতে চাইত না। ওর মধ্যে যে আদিম প্রাণীটা বাস করে সে হয়তো চাইত মুক্ত জঙ্গলে স্বাধীন জীবন। দিন পনেরো আগে, সেদিন বিকেলে ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল ওদের রাতের খাবার দিতে আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন রাতের খাবার নিয়ে যাই তখন বিজয় আমাকে আক্রমণ করে।” পিসেমশাই দম নেবার জন্য একটু থামলেন। চোখ বুজে হয়তো ঘটনার ভয়াবহতাকে আরেকবার স্মরণ করলেন। তারপর বললেন, “আমি খুবই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বিজয় যে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে এটা আমি কোনওদিন ভাবতে পারিনি। কিন্তু জয়া আমাকে রক্ষা করে। সে আমাকে আগলে দাঁড়ায়। বিজয় তখন তাকে আঁচড়ে-কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে খোলা জানালা দিয়ে বাইরে পালিয়ে যায়। সেই থেকে আর ফেরেনি। যদিও রাতে বাংলোর আশপাশে ওর অস্তিত্ব আমি বুঝতে পারি। কিন্তু ওর মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার আর হয়নি। যদি আবার অ্যাটাক করে! আমার একটা রাইফেল আছে। কিন্তু নিজের সন্তানের উপর কি কেউ গুলি চালাতে পারে?”
অমিতাভ জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। বাইরে ঘন অন্ধকার। ওই অন্ধকারের মধ্যে কোনও গাছে বসে হয়তো বিজয় এখন তাদের লক্ষ করছে।
পিসেমশাই বললেন, “এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ জয়ার চিকিৎসার জন্য ভেট না ডেকে তোমাকে কেন কষ্ট দিয়েছি? ভেট ডাকলে জয়ার কথা আর গোপন থাকবে না। হয়তো সরকার থেকে ওদের ফেরত নিয়ে যাবে। সেটা আমি হতে দিতে চাই না।”
পরদিন দুপুরেই অমিতাভ তার প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র পেয়ে গেল। তার একটা সন্দেহ হয়েছিল। এখন পরীক্ষা করে সে নিশ্চিত হল। পিসেমশাইকে বলল, “চিন্তা করবেন না। জয়া ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু একটা কথা আপনার জানা দরকার।”
“কী কথা?”
“জয়া প্রেগন্যান্ট।”
পিসেমশাই কথাটা শুনে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর বললেন, “তাহলে এবার কী হবে? আমি কী করে সব কিছু ম্যানেজ করব?”
অমিতাভ একটু ইতস্তত করে বলল, “জানি না আমার বলা ঠিক হচ্ছে কিনা। কিন্তু আমার মনে হয় জয়া আর বিজয়কে আপনার আটকে রাখা ঠিক নয়। ওরা যদি বিবর্তনের পথে এগিয়েই গিয়ে থাকে ওদের থাকার ব্যবস্থা ওরা নিজেরাই করে নিতে পারবে। বিজয় সেই জন্যই ফিরে আসছে না। জয়াও হয়তো তাই চায়। কিন্তু আপনাকে সে পিতার মতোই ভালোবাসে। তাই আপনাকে ছেড়ে যেতে চাইছে না। কিন্তু ওর আসল জায়গা বাইরের প্রকৃতির মাঝে বিজয়ের পাশে।”
পিসেমশাই একটু ভেবে বললেন, “তুমি হয়তো ঠিকই বলছ। একটা প্রজাতির দুটি মাত্র প্রাণীকে শিক্ষিত করে আমরা সেই প্রজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব না। হয়তো প্রকৃতির সেটা পছন্দও নয়।” তারপর একটু থেমে বললেন, “কিন্তু বিজয় ফিরে না এলে জয়া কীভাবে ওর সঙ্গে যাবে?”
অমিতাভ বলল, “কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন। জয়ার জ্বরটা কমুক। তারপর ওকে ছেড়ে দিন। আমার বিশ্বাস জয়া ঠিক বিজয়কে বুঝিয়ে নিয়ে আসবে। তারপর আপনি ঠিক করুন কী করবেন। ওদের এখানে রাখবেন, নাকি সরকারকে জানিয়ে ওদের কোনও সুরক্ষিত জায়গায় পুনর্বাসন করবেন।”
পরের কটা দিন অমিতাভর খুব আনন্দে কাটল। সে প্রকৃতির কোলে ঘুরে বেরাল, লেকে মাছ ধরল, আদিবাসী গ্রামে ঘুরে এল। কিন্তু তার সবচেয়ে ভালো লাগল জয়ার সান্নিধ্য। এই কদিনেই সে বুঝতে পারল পিসেমশাই কোনও মিথ্যে কথা বলেননি। জয়া সত্যিই অনন্য। সে অমিতাভর মোবাইলে বাবা-মার ফোটো দেখে আনন্দ প্রকাশ করেছে, মোবাইলে গান শুনে নেচেছে, অমিতাভর সঙ্গে খুনসুটি করেছে। তিন দিনেই জয়ার জ্বর সেরে গিয়েছিল। অমিতাভ তার পরে আরও দু-দিন ছিল। এর মধ্যে একবার সে বিজয়েরও দেখা পেল। লম্বা চওড়া সুগঠিত চেহারা। অমিতাভকে দেখে অদ্ভুত শব্দ করে দূরে সরে গিয়েছিল। পিসেমশাই ঠিক করলেন সরকারকে চিঠি লিখবেন। এই জঙ্গলে জয়া-বিজয় থাকতে পারবে না। ওদের আরও সঙ্গী দরকার। তাই ওদের কোনও অভয়ারণ্যে, যেখানে শিম্পাঞ্জি আছে সেখানে ছেড়ে আসতে হবে। আসলে পিসেমশাই হয়তো বুঝেছিলেন এভাবে একা তিনি জয়া-বিজয় এবং তাদের সন্তানের দেখাশোনা করতে পারবেন না।
অমিতাভ বলল, “জয়া চলে গেলে আপনি একা একা এখানে পড়ে থাকবেন সেটা হবে না। আমি এসে আপনাকে কলকাতায় নিয়ে যাব। বাবা-মাও সেটাই চায়।”
ফেরার দিন জয়া অমিতাভর হাত ধরে বসে রইল। কিছুতেই ছাড়বে না। শেষে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে ছাড়া পেল। ট্রেনে যেতে যেতে অমিতাভ ভাবছিল কোনও দূর জঙ্গলের কথা। যেখানে একদল বন্য শিম্পাঞ্জির মাঝে জয়া আর বিজয় মিলে মিশে রয়েছে। নিশ্চয়ই তারাই দলটার নেতা হয়েছে। তারা হয়তো চেষ্টা করছে দলের অন্য শিম্পাঞ্জিদের ‘শিক্ষিত’ করে তুলতে। কিন্তু তারা কোনওদিনই বুঝতে পারবে না যে মানুষ নামের এই গ্রহের অন্য আর-একটি প্রজাতির কারসাজিতে তারা তাদের দলের বাকি সদস্যদের থেকে আলাদা। যদি বুঝতে পারে তাহলে কি তারা তাদের পালক মা-বাবাকে ধন্যবাদ দেবে নাকি তাদের এরকম দলছুট করার জন্য ঘৃণা করবে? কে জানে!
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, প্রদীপ কুমার দাস, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা