মহিমবাবুর আতান্তর
লেখক: পার্থ দে
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
বাজার থেকে শুধুমাত্র এক আঁটি নটে শাক কিনে আনতে ভুলে গেছেন বলে মহিমবাবুকে আজ কি হেনস্থাটাই না হতে হল। গিন্নি তাঁকে আটান্নতেই বাহাত্তুরে ধরেছে বলে যাচ্ছেতাই অপমান করলেন। অফিস আসার আগে সকালের বরাদ্দ চা-টা পর্যন্ত দিলেন না। ছেলে তো বরাবর মায়ের পক্ষে, দুজনে যুক্তি করে তাঁকে বহুকাল খরচের খাতায় ফেলেই রেখেছে। ছেলে আড়ালে তাঁকে ‘ওল্ড হ্যাগার্ড’ বলে। কিন্তু যে মেয়ে এতকাল বাবা-অন্ত প্রাণ ছিল সেও আজ কলেজ যাওয়ার সময় নাক কুঁচকে বলল, বাবা, তুমি এটা কী করলে! এক আঁটি নটেশাক তাও মনে করে আনতে পারলে না! মা তোমাকে ঠিকই ‘বাহাত্তুরে বুড়ো’ বলে। আমি তোমার হয়ে ওদের সঙ্গে কত লড়ব বলো তো!
মেয়ের এ হেন বাক্যবাণ মহিমবাবুকে পুরোপুরি ঘায়েল করে দিল। এই বাড়িতে একদণ্ড মন খারাপ করে বসে থাকার জায়গা নেই। সর্বত্র মহিমবাবুর গিন্নি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি তাই মন খারাপ হলেই বাথরুমে সেঁধিয়ে যান। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দুঃখের কথা নিজেকেই বলেন। নিজের দুঃখকষ্ট, শোকতাপ যা হয় নিজেকে বলেই বুকের ভার লাঘব করেন। এই দুনিয়ায় যে তিনি বড় একা এই সারবস্তুটি তিনি এতদিনে দিব্য অনুধাবন করেছেন।
আজ বাথরুমে সময়টা বোধহয় কিঞ্চিৎ বেশিই লেগে গেল। অমনি বাইরে থেকে বাথরুমের দরজায় গিন্নির মুহুর্মুহু করাঘাত হল, বলি হলটা কী, অ্যাঁ? ভেতরে কি কমোডে বসে ধ্যান করছ নাকি মুচ্ছো গেলে, অফিস টফিস যেতে হবে না নাকি!
গিন্নির দরজা ধাক্কানোর তাড়নায় মহিমবাবু বিরক্ত হয়ে বাথরুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। সত্যি, এই বাড়িতে বুঝি আয়নার সামনে একটু একলা কাটানোরও ফুরসত নেই। তিনি কথা না বাড়িয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
অন্য দিনের চেয়ে আজ বোধহয় অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। অফিসে সময়মত না পৌঁছতে পারলে বড়সাহেব খুব রাগারাগি করেন। উনি বলেছেন, এবার থেকে তিন দিন দেরি হলেই অ্যাটেনডেন্সে ঢ্যাঁড়া দিয়ে একটা ছুটি কেটে নেবেন। আজ হচ্ছে সেই তৃতীয় বিলম্বের দিন, মনে হচ্ছে বড়সাহেবের হাত থেকে আর নিস্তার নেই।
মহিমবাবু রাস্তায় বেরিয়ে দেখলেন পৌনে দশটার গড়িয়া-বিবাদী বাগের মিনিবাসটা তাঁর নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অফিস টাইমের এই মিনিবাসটার পর বাসগুলি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। মহিমবাবু এক মুহূর্ত বাসটার দিকে করুণ চোখে তাকালেন, পরমুহূর্তেই তাঁর শরীরে যেন এক বিদ্যুৎ তরঙ্গের সঞ্চার হল, আচমকা দুরন্ত গতিতে লাফিয়ে বাঁ হাতে বাসটার হ্যান্ডেল ধরে শরীরটাকে চাগিয়ে পাদানিতে তুলে ফেললেন। কন্ডাকটর দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ও দাদু, মরার তাল করছ নাকি, তাও আমার বাসের তলায়!
মুহূর্তের ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মহিমবাবু নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। এমন একটা দুঃসাহসিক কাজ তিনি কীভাবে করে ফেললেন, মাথায় ঢুকছে না। মিনিবাসটা চলে যাচ্ছে দেখে তিনি মরীয়া হয়ে উঠেছিলেন সে কথা ঠিক, কিন্তু হঠাৎ তাঁর মোটাসোটা খর্বকায় শরীরে এমন গতির সঞ্চার হল কেমন করে সেটাই বুঝতে পারছেন না। আর তাঁর বাঁ হাতটাই বা অমন সক্রিয় হয় কী করে! বাসের ভেতর চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলেন সব যাত্রীর চোখেমুখেই তাঁকে ঘিরে অপার বিস্ময় আর হাজার প্রশ্ন। মহিমবাবু যে সিটে বসলেন, তার পাশের যাত্রীটি বলল, ও মশাই, এমন ঝুঁকি কেউ নেয় নাকি! প্রাণটা চলে গেলে কি আর ফিরে পাবেন?
সত্যিই তো এত বড় ঝুঁকি নিলেন কেন তিনি, যদি প্রাণটা চলে যেত! মহিমবাবু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। তিনি মরে গেলে সত্যিই কি কারও কিছু যায় আসে। তাঁর গিন্নি, পুত্র, এমন কি আদরের কন্যা, কারও কিচ্ছু যায় আসে না! মহিমবাবু একটু দুঃখিত হলেও খানিক আগের দুঃসাহসিক ঘটনাটা নিয়ে তাঁর মনের ধন্দটা রয়েই গেল।
মহিমবাবুর অফিসটা বিবাদীবাগের একটা মার্কেন্টাইল বিল্ডিংয়ের চারতলায়। নেভিল অ্যান্ড প্যাটারসন প্রাইভেট লিমিটেড। অফিসের বড়কর্তা মুখার্জি সাহেব এক জাঁদরেল মানুষ। বাঙালি হলেও তাঁর সব কিছু একেবারে খাঁটি সাহেবদের মতো। কাঁটায় কাঁটায় দশটার সময় অফিসে ঢোকেন, একমিনিট নড়নচড়ন হয় না, সাড়ে দশটায় তাঁর খাস আর্দালি লক্ষ্মণ চিনি ছাড়া লিকার চা দিয়ে যায়, বারোটায় তাঁর বাড়ি থেকে ড্রাইভার লাঞ্চবক্স নিয়ে আসে। বেলা তিনটেয় ফের চিনি ছাড়া কালো কফি। কাজের বিষয়েও মুখার্জি সাহেব অত্যন্ত খুঁতখুঁতে মানুষ। পান থেকে চুন খসলে খাঁটি বিদেশি ডালকুকুরের মতো গম্ভীর গলায় অধস্তন কর্মচারীদের উপর চেঁচামেচি শুরু করেন।
কিছুটা তটস্থ হয়েই মহিমবাবু অ্যাটেন্ডেন্সের খাতায় সই করতে মুখার্জি সাহেবের ঘরে ঢুকলেন। সাহেব দাঁড়িয়েছিলেন জানলা ঘেঁষে, তাঁর ফরসা মুখটা রাগে পাকা টম্যাটোর মতো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে, এই বুঝি ফেটে পড়বে। মহিমবাবু দেরিতে আসার কারণ হিসেবে মনে মনে একটা অজুহাত খাড়া করে এনেছিলেন, কিন্তু তার আগেই মুখার্জি সাহেব ফেটে পড়লেন, আজ আপনার অজুহাতটা কী, মহিমবাবু? বাড়িতে ঝি আসেনি, রাস্তা অবরোধ, নাকি আপনার কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়নি বলে বাথরুমে বেশি সময় কাটাতে হল?
মহিমবাবু প্রমাদ গুনলেন। আজ বুঝি সাহেবের রোষাগ্নিতে তিনি ভাজা ভাজা হবেন। তবু তিনি আমতা আমতা করে বাজার থেকে নটে শাক আনতে ভুলে যাওয়া এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়িতে হেনস্থা হওয়ার কাণ্ডটা সাহেবকে খুলে বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঘটনাটার বয়ান করলে সাহেবের মেজাজ যে কোথায় গিয়ে পৌঁছত এবং তাঁর নিজের ঘাড়ে মাথাটা স্বস্থানে টিকে থাকত কিনা তা দেখা হল না। মাঝপথেই একটা অত্যাশ্চর্য কাণ্ড ঘটল, যাকে মির্যাকল বললেও ভুল হবে না।
ঠিক সেই সময়ই মুখার্জি সাহেবের জামার বুকপকেটে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল আর ফোনটা তড়িঘড়ি বের করে কানে ধরতে গিয়ে তাঁর হাত থেকে ফসকে গেল। মুহূর্তের মধ্যে সাহেব ফোনটাকে ধরার জন্য দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় শূন্যে হাতটা খামচালেন। ফোনটা তাঁর হাতের নাগালের মধ্যে আসার বদলে তালুতে ধাক্কা খেয়ে খোলা জানলার দিকে এগিয়ে গেল। মহিমবাবু দেখলেন মুখার্জি সাহেবের পঁচাত্তর হাজার টাকার সুদৃশ্য আইফোন টুয়েলভ একটু একটু করে খোলা জানালার বাইরের দিকে এগিয়ে চলেছে। তিনি আর থাকতে পারলেন না, প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় শরীরটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বাঁ হাতে ফোনটাকে তালুবন্দি করলেন। ফোনটা ধরার পর অপূর্ব দক্ষতায় মেঝে থেকে তড়াক করে উঠে গা থেকে ধুলো ঝেড়ে বললেন, এই নিন, স্যার।
বিস্ময়ে মুখার্জি সাহেবের চোয়াল তখনও ঝুলে আছে, অপলক দৃষ্টি মহিমবাবুর দিকে। বোঝাই যাচ্ছে তিনি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। প্রায়-অশ্রুত স্বরে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ মহিমবাবু। আচ্ছা… আপনি সই করে এবার সিটে গিয়ে বসুন। আর কখনও দেরি করবেন না, কেমন।
সেই মুহূর্তে মুখার্জি সাহেবের ঘরে সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং ডিভিশনের হৃষীকেশ দত্ত ঢুকেছিল। পিছন ফিরতেই মহিমবাবু দেখলেন ছোকরার মুখখানার দশাও মুখার্জি সাহেবের মতো। হাঁ-করে থাকা মুখের ভেতর দিব্যি বড়সড় সাইজের একটা মাছি ঢুকে যেতে পারে। হৃষীকেশ স্পোর্টস কোটায় নেভিল এন্ড প্যাটারসনের চাকরিটা পেয়েছে, কিন্তু ওর শরীরের ফিটনেসও যে আটান্ন বছরের মহিমবাবুর মতো নয় বুঝতে পেরে একেবারে হতবাক হয়ে গেছে।
হতবাক তো মহিমবাবুও কিছু কম হননি। সাহেবের ঘরে সই করে এসে সিটে বসে দরদর করে ঘেমেই চলেছেন। উফ, কি কাণ্ডটাই না ঘটালেন তিনি! কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না, তিনি মানে মহিম মিত্তির এমন একটা কাণ্ড ঘটাতে পারেন! আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটার পর একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেই চলেছে।
খানিক পরেই সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অফিসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হৃষীকেশ দত্ত গোটা ঘটনাটা রাষ্ট্র করে দিল। ঘটনাটায় আরেকটু রং চড়িয়ে বলল, আরে সবাই শুনুন, আজ মুখার্জি সাহেবের ঘরে মহিমদা যে কাণ্ডটা ঘটালেন নিজের চোখে না দেখলে তো আমি বিশ্বাসই করতাম না! স্যারের দামি আইফোনটা অসাবধানতায় জানলা দিয়ে বাইরে পড়ে যাচ্ছিল, মহিমদা নিমেষের মধ্যে পুরো রবীন্দ্র জাডেজার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁ হাতে মোবাইলটা ক্যাচ করে নিলেন। উফ, আমি তো ভাবতেই পারছি না, এই আটান্ন বছর বয়সেও দাদার এমন বডি ফিটনেস!
আশপাশের টেবিল থেকে সবাই হাঁ করে মহিমবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকল। পারচেজের প্রদীপ, সিস্টেমসের সুরঞ্জন, এইচআরের হৃষিতা বসু, এমনকী বড়বাবু গম্ভীর প্রকৃতির বারীন মল্লিক— সবার চোখে বিস্ময় আর বিস্ময়।
মহিমবাবু একটু লজ্জাই পেলেন। ইদানীং তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের তেমন খবরটবর রাখেন না, তাই রবীন্দ্র জাডেজাকে ঠিক চিনতে পারলেন না। কিন্তু কৈশোরকালে যখন তিনি ক্রিকেটের খবরই শুধু রাখতেন তাই নয়, ক্রিকেট খেলতে যথেষ্ট ভালোও বাসতেন, তখনকার কথা মনে পড়ে গেল। আহা, একনাথ সোলকার, কী ফিল্ডিংটাই না করতেন! আর কীসব একেকটা ক্যাচ নিতেন বাঁ হাতে, সব তাঁর মনে পড়ে গেল। বলতে গেলে ছোটবেলায় ক্রিকেটার হওয়ার একটা বাসনা তৈরি হয়েছিল তাঁর মনে। ইস্কুলের মাঠে বাঁ হাতে বেশ জোরেই বল করতেন। সেই সময় বাঁহাতি বোলার কারসন ঘাউরি তাঁর প্রিয় খেলোয়াড় ছিল। কিন্তু ষোলো-সতেরো বছরে পৌঁছেও যখন মহিমবাবুর উচ্চতাটা পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চিতে আটকে রইল তখন তিনি বড় ক্রিকেটার হওয়ার আশা ত্যাগ করলেন।
লাঞ্চ টাইমের আগেই নেভিল অ্যান্ড প্যাটারসনের দুটো ফ্লোর জুড়ে যত কর্মী আছে তাদের সবার কানেই মহিমবাবুর শারীরিক কেরামতির অত্যাশ্চর্য খবর পৌঁছে গেল। লাঞ্চ টাইমে সবাই এসে একবার করে মহিমবাবুর সিটের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখে যাচ্ছে। এমনকি যে হৃষিতা বসু ও নীলাঞ্জনা সেন বাড়ি থেকে ক্যাসারোলে করে সুস্বাদু সব খাবার বানিয়ে এনে লাঞ্চের সময় কোণের টেবিলে বসে একা একা খেত, তারাও মিষ্টি গলায় ডাক দিলেন, ও মহিমদা, শুনছেন। আজ একটু আমাদের সঙ্গে বসে খাবেন?
নীলাঞ্জনা বলল, মহিমদা, প্লিজ আসুন না, আজকাল আপনি আমাদের দিকে একটু তাকানও না।
হৃষিতা বলল, ও মা, মহিমদা আপনি ডান হাতে ঘড়ি পরেছেন! ছেলেরা ডান হাতে ঘড়ি পরলে আমার কী ভালো লাগে। বম্বের নায়ক সোনামন খানও ডান হাতে ঘড়ি পরে! উফ, ফাটাফাটি দেখায়!
মহিমবাবু বম্বের নায়ক সোনামন খানকে চেনেন না কিন্তু নিজের ডান হাতের কবজির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। ইস, এত বড় ভুল করে ফেলেছেন! সঙ্গে সঙ্গে কবজি থেকে হাতঘড়িটা খুলে ট্রাউজার্সের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে হৃষিকা বসু আর নীলাঞ্জনা সেনের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। দুই অফিস কলিগ তরুণীর দয়ায় মহিমবাবু লাঞ্চে গিন্নির বানিয়ে-দেওয়া আটার রুটি আর ঢেঁড়স-আলু ভাজার বদলে হাক্কা চাউমিন আর চিলি চিকেন খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন। এখানেও একটা বিপত্তি ঘটতে যাচ্ছিল, তাঁর হঠাৎ সক্রিয়-হয়ে-ওঠা বাঁ হাতটা অজান্তেই খাবারের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু হৃষিতা বসু আর নীলাঞ্জনা সেনের চোখে পড়ার আগেই তিনি বাঁ হাত গুটিয়ে ডান হাতে খেতে শুরু করে দেন।
ঘণ্টাখানেক বাদে হৃষীকেশ ফের তিন-চারজন সহকর্মীকে নিয়ে মহিমবাবুর টেবিলের সামনে হাজির হল। মহিমবাবু চোখ তুলে দেখলেন হৃষীকেশ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা সকলেই অফিসের ক্রিকেট টিমের সদস্য। হৃষীকেশ নতুন আবদার জুড়ে বলল, মহিমদা, সামনেই অফিস লিগ আসছে, আমরা পরপর তিনবার রবার্টসন ইন্টারন্যাশনালের কাছে ফাইনালে হেরে গেছি, শুধুমাত্র খারাপ ফিল্ডিংয়ের জন্য। এবার তাই আমরা ঠিক করেছি আপনাকে আমাদের ক্রিকেট টিমের ফিল্ডিং কোচ করব।
কথাটা শুনে মহিমবাবু আঁতকে উঠলেন। হৃষীকেশ ছোকরা বলে কি! সে না হয় কোন কৈশোরকালে একনাথ সোলকার আর কারসন ঘাউরি নামে দুই বাঁহাতি ক্রিকেটার তাঁর আইডল ছিলেন, এমনকি তাঁদের মতো তিনি হতেও চেয়েছিলেন, তাই বলে ছোকরা তাঁকে ক্রিকেট টিমের ফিল্ডিং কোচ বানিয়ে ছাড়বে! মহিমবাবু প্রবল আপত্তি জানিয়ে হৃষিকেষদের প্রস্তাবটি নাকচ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই আর্দালি লক্ষ্মণ এসে বলল, মহিমবাবু, আপনাকে বড় সাহেব ওঁর চেম্বারে ডাকছেন।
খানিকটা ভয়ে ভয়ে মহিমবাবু মুখার্জি সাহেবের কেবিনে ঢুকলেন। সাহেবদের মেজাজ-মর্জি দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের মতো। এই হয়তো বৃষ্টি পড়ছে, পরক্ষণেই রোদ উঠল। সকালে মহিমবাবুর অসাধারণ শারীরিক দক্ষতায় দামি ফোনটা রক্ষা পাওয়ায় সাহেব যে এত খুশি হয়েছিলেন, বলা তো যায় না, লাঞ্চের পরে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেই খোশমেজাজ বিগড়ে গেল!
অবিশ্যি সেসব কিছুই হল না। মুখার্জি সাহেব সহাস্যবদনে বললেন, আরে আসুন আসুন মহিমবাবু, আপনার জন্য দুটি সুখবর আছে।
মহিমবাবু দুরুদুরু বক্ষে তাকালেন। সাহেব বললেন, বুঝলেন মশাই, আপনার ফোন-বাঁচানোর দুঃসাহসিক ঘটনাটা ফোনে শুনে আমার মিসেস তো হাইলি ইমপ্রেসড, বলল, সেই বীরপুরুষটিকে একবার দেখতে চাই যিনি প্রাণের তোয়াক্কা না করে তোমার আইফোন বাঁচিয়েছেন! তাই আগামী রবিবার সন্ধেয় মিসেস আপনাকে সস্ত্রীক চায়ের নেমন্তন্নে আমাদের বাড়িতে ডেকেছেন। কি মশাই আসছেন তো আমাদের বাড়ি? ১৫/৬বি বেলভিডিয়ার রোড, আলিপুর, আমার বাড়ির ঠিকানা।
মহিমবাবু হাঁ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তাঁর মুখে একটি বাক্যিও জোগাল না। আজ কি সূর্য সত্যিই পশ্চিমদিকে উঠেছে! নাকি আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রেরা একত্রিত হয়ে তাঁর পক্ষ নিয়ে এমন একটা মিষ্টি ষড়যন্ত্র রচনা করছে!
আরে মশাই, অত কী ভাবছেন, চলে আসুন সামনের রবিবার, আপনি না এলে কিন্তু মিসেসের কাছে আমার ইজ্জত বলে আর কিছু থাকবে না। মুখার্জি সাহেব তখনও বলে চলেছেন, আপনাকে এবার দ্বিতীয় সুখবরটা দিই, এ বছর থেকেই বেস্ট এমপ্লয়ি অব দ্য ইয়ার পুরস্কারটা চালু করছে আমাদের কোম্পানি। আমি আপনার নামটা সাজেস্ট করেছি। বম্বের হেড অফিস থেকে ওঁরা মেনেও নিয়েছেন। পুরস্কার হিসেবে ডিসেম্বর মাসে আপনি দু-হপ্তার জন্য পরিবার সহ রাজস্থান ভ্রমণের একটা ফ্রি প্যাকেজ পাবেন। কি মশাই খুশি তো?
সাহেবের কথা শুনে মহিমবাবু থ’ বনে গেলেন। বুকের ভিতর খুশির তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে, আবার কথাটা যেন ঠিক বিশ্বাসও হতে চাইছে না। হলটা কী! আজ গোটা নেভিল অ্যান্ড প্যাটারসনের যত কর্মচারী আছে সবাই কি তাঁর প্রেমে পড়ে গেল নাকি!
তিনি সিটে ফিরে আসার আগেই লক্ষ্মণ দরজার আড়াল থেকে কথাটা শুনে অফিসের মধ্যে চাউর করে দিয়েছিল। সবাই সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাচ্ছে। কেউ কেউ তাঁকে এসে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছে, কেউ আবার করমর্দন করছে বা পিঠ চাপড়ে দিয়ে যাচ্ছে। আনন্দে তাঁর বুকের মধ্যে খুশির বুদ্বুদ উঠছে। তাঁর মতো সাধারণ মানুষের মনে জমা এতদিনের সব গ্লানি আর হীনমন্যতা মুছে যাচ্ছে।
তাঁর অ্যাকাউন্ট সেকশনের বড়বাবু বারীন মল্লিক বেশ মুরুব্বিগোছের মানুষ। তিনি বহুক্ষণ চুপচাপ বসে সব লক্ষ করছিলেন। আচমকা গম্ভীর গলায় ডাকলেন, এই মহিম, এদিকে শুনে যাও তো।
অফিসে মুখার্জি সাহেবের পরেই যদি কেউ দাপুটে মানুষ থাকে, সে হল এই বারীনবাবু। অফিসের সব কর্মচারীর পার্সোনাল ফাইল, সার্ভিস বুক আর যা যা কোষ্ঠী ঠিকুজি আছে— সব এই লোকটার হাতে। অফিসের সবাই মানুষটাকে সমঝে চলে। তা ছাড়া লোকটার নাকি অনেক ইনফর্মার রয়েছে, অফিসের কর্মচারীদের হাঁড়ির খবরও নাকি তাঁর কানে ঠিক পৌঁছে যায়। মাত্র বাইশ বছর বয়সে চাকরিতে ঢুকে জীবনের ছত্রিশটা বছর তিনি নেভিল অ্যান্ড প্যাটারসনে কাটিয়েছেন। কত বড় বড় সাহেব নাকি তাঁর রাজত্বকালে এসেছে আর গেছে। তিনি অনড় রয়েছেন। কোম্পানি নাকি তাঁকে বহুবার সেকশন অফিসারের প্রমোশন দিতে চেয়েছে কিন্তু উনি নেননি। আড়ালে তাঁর পারিষদদের বলেন, দূর দূর, সেকশন অফিসার হল কাগজের বাঘ, ফুঁ দিলে উড়ে যাবে।
বড়বাবুর ডাক শুনেই মহিমবাবু কিছুটা ভয়ে ভয়ে তাঁর সিটের সামনে গিয়ে বসলেন। তাঁকে পাক্কা পাঁচ মিনিট সামনে বসিয়ে রেখে অবশেষে বারীনবাবু ফাইল থেকে মুখ তুলে বললেন, কি হে মহিম, তুমি তো এখন অফিসে ফেমাস হয়ে গেছ। আজ সারাদিন যাকেই দেখি তার মুখেই মহিম মিত্তিরের প্রশংসা, এমনকি আমাদের মুখার্জি সাহেবও… তাই ভাবলুম, আমিও যদি তোমার মতো বড় মানুষের জন্য কিছু করতে পারি, তাহলে কৃতার্থ হব।
কী যে বলেন বারীনদা, আমি আবার বড় মানুষ হলাম কবে! কথাটা বলে মহিমবাবু বারীন মল্লিকের কথার প্যাঁচটা ধরার চেষ্টা করছিলেন।
বলি, তোমার রিটায়ারমেন্টের আর তো মাত্র দুটি বছর। আমি আবার তোমার চার মাস আগে রিটায়ার করছি, জানোই তো।
মহিমবাবু ঘাড় কাত করেন কিন্তু ভেতরের প্যাঁচটা তখনও কিছুতেই বুঝতে পারেন না।
আমি থাকতে থাকতে তোমার রিটায়ারমেন্টের কাগজপত্র সব রেডি করিয়ে নাও। তোমার লিভ ব্যালেন্স, পিএফ, গ্র্যাচুইটির হিসেবগুলো বুঝে নাও… তারপর তোমার সার্ভিস বুকটা… এই দাঁড়াও দাঁড়াও, তোমার মুখটা একটু ডানদিকে ঘোরাও তো।
বড়বাবুর হাতের মুদ্রা লক্ষ করে মহিমবাবু মুখটা ঘোরালেন।
আশ্চর্য! তোমার ডান চোখের পাশে এই ছোট্ট কাটা দাগটা কবে হল? যতদূর মনে পড়ছে তোমার কাটা দাগটা বাঁ দিকে ছিল। ইয়েস, তোমার সার্ভিস বুকেও তাই এন্ট্রি আছে, আমার খুব ভালো করেই মনে আছে। তাহলে কি আমি ভুল এন্ট্রি করেছি, কে জানে! কিন্তু তাই বা হবে কী করে… এত বড় ভুল তো আমার হওয়ার কথা নয়। তবু ভুল যখন হয়েছে, আমাকেই সেটা সংশোধন করতে হবে।
বলতে বলতে বড়বাবু চিন্তিত মুখে ঘন ঘন মাথা নাড়তে শুরু করলেন।
সেই সুযোগে মহিমবাবু চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। তিনিও ঘাবড়ে গেছেন। নিজেই ধন্দে পড়ে গেলেন, তাঁর কাটা দাগটা তো বরাবর বাঁ দিকেই ছিল, সেটা ডান দিকে আসবে কেমন করে! এ নির্ঘাত বারীন মল্লিকের কোনও চাল। অথচ এমন একটা প্রশ্ন অফিসের কাউকে করা যায় না, করলেই লোকে তাঁকে পাগল ভাববে। নিজের কপালে একবার হাত বুলিয়ে ধন্দটা আরও বেড়ে গেল। একবার যেন মনে হল কাটা দাগটা বোধহয় ডান দিকেই আছে। তাঁর মাথার ভেতর আরও গোলমাল পাকিয়ে গেল। এবার তিনি দিব্যি বুঝতে পারছেন বারীন মল্লিকের আসল উদ্দেশ্যটা। অফিসের সবার মুখে তাঁর গুণকীর্তন শুনে লোকটা ঈর্ষাকাতর হয়ে তাঁকে জব্দ করার জন্য এমন চাল চেলেছেন। তবে যাচাই করে নেওয়ার উপায় তো একটা আছেই, যাতে সব ধন্দ মিটে যাবে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিনি পকেট থেকে তাঁর মোবাইল ফোনটা বের করে সেলফি মোড ওপেন করে মুখের সামনে ধরলেন। যা ভেবেছিলেন, ঠিক তাই। তাঁর মাথায় কূট চিন্তাটা ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা বারীন মল্লিকের মস্তিষ্কপ্রসূত। তাঁর কাটা দাগটা যথাস্থানে অর্থাৎ বাঁ দিকেই আছে। তাই বারীন মল্লিকের চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিয়ে মহিমবাবু তাঁর সারাদিনের অর্জিত গৌরবের মৌতাতে ডুব দিলেন।
অফিস ছুটি হওয়ার পর ধর্মতলায় গিয়ে মহিমবাবু কিছু বাজে খরচ করে ফেললেন। তা হোক বাজে খরচ! অফিসের বেস্ট এমপ্লয়ি অব দ্য ইয়ার হওয়া, মুখার্জি সাহেবের বাড়িতে সস্ত্রীক চায়ের নেমন্তন্ন পাওয়া আর ডিসেম্বর মাসে রাজস্থান ট্রিপ— এসব সুখবর কি বাড়িতে খালি হাতে দেওয়া যায়! তিনি গিন্নির জন্য একটা দামি চামড়ার ব্যাগ, কন্যার জন্য তিনটে বিদেশি পারফিউমের সেট আর ছেলের জন্য একটা সুদৃশ্য টিশার্ট কিনলেন। সব শেষে ধর্মতলার বিখ্যাত আমিনিয়া থেকে চার প্যাকেট মাটন বিরিয়ানিও কিনে ফেললেন। সন্ধেবেলার বিশ্রী যানজট পেরিয়ে যখন মিনিবাসে করে দক্ষিণ শহরতলির নিজের বাড়ির কাছে পৌঁছলেন তখন ঘড়ির কাঁটা ন’টা ছোঁব ছোঁব। দেরি দেখে নিজেই তড়িঘড়ি খালের ধারের স্টপেজে নেমে পড়লেন। আসলে এদিক থেকে তাঁর বাড়ি হাঁটাপথে অনেকটা কম সময় লাগে। কিন্তু নেমেই মহিমবাবু বুঝতে পারলেন বড্ড ভুল কাজ করে ফেলেছেন। খালপাড়ের রাস্তাটা খুব নির্জন। রাতের দিকে এই পথে যত মাতাল আর চোরের উপদ্রব। একেবারে শুনশান রাস্তা, তাই বেশ ভয় করে। ভয় কাটাতে মহিমবাবু গান ধরলেন। শ্যামাসংগীত। তাঁর প্রিয় গান— ডুব দে রে মন কালী বলে / হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।
কয়েক পা এগোতে না এগোতেই একটা ভয়ংকর চেহারার দাড়িওয়ালা লোক তাঁর পথ আগলে দাঁড়াল। পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে চাপা ঘষঘষে গলায় লোকটা বলে উঠল, পকেটে যা রেস্ত আছে সব চুপচাপ দিয়ে দাও, আর হাতের প্যাকেটগুলোয় যা আছে দিয়ে দাও…
মহিমবাবুর গলা শুকিয়ে শ্যামাসংগীত মাঝপথেই থেমে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তিনি থমকে দাঁড়ালেন। লোকটার কাঁধের উপর দিয়ে দেখলেন অন্তত এক মাইলের মধ্যে কোথাও কোনও জনমনিষ্যি নেই। তাঁর বুকটা ঢিবঢিব করে উঠল।
লোকটা ফের অধৈর্য গলায় বলল, কী হল? কথা কানে যাচ্ছে না। চটপট মালকড়ি দিয়ে কেটে পড়, চেঁচানোর চেষ্টা করলে এই ছুরি তোর বুকে বসিয়ে দেব। ওই প্যাকেটে কী আছে, দেখি?
লোকটা প্যাকেটের দিকে হাত বাড়াতেই মহিমবাবুর মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। এত সাহস! তাঁর প্রিয়জনদের জন্য কেনা উপহার লোকটা হাতিয়ে নিতে চায়! মুহূর্তের মধ্যে তাঁর মাথার আগুন যেন শরীরের পেশিতে সঞ্চারিত হল। তিনি আচমকা তাঁর বাঁ পা-টা তুলে লোকটার হাতে একটা দুরন্ত লাথি কষালেন। লোকটার হাত থেকে ছিটকে পড়ল ছুরিটা। অপ্রত্যাশিত আঘাতে হতভম্ব হয়ে তাঁর দিকে তাকাল, পরক্ষণেই একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। সে দ্রুততার সঙ্গে নিচু হয়ে ছুরিটা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতেই মহিমবাবুর দ্বিতীয় কিক্টা এসে পড়ল লোকটার চোয়ালে। প্রায়ান্ধকার রাস্তার উপর ছিটকে পড়ল সে। লোকটার মুখের কষ বেয়ে রক্ত ঝরছে। তার মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে স্পষ্টতই ভয় পেয়েছে সে। অবিশ্যি নিজের আকস্মিক শারীরিক সক্রিয়তার নমুনা দেখে মহিমবাবু নিজে আরও বেশি ভয় পেয়েছেন। তাঁর চোখের সামনে একটা লোক রাস্তায় চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে, প্যাকেটে রাখা খাবারের কন্টেনার খুলে চারদিকে বিরিয়ানি ছড়িয়ে পড়েছে। সে এক ভয়ানক দৃশ্য! এসব দেখে মহিমবাবু উপহারের প্যাকেটগুলো নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করলেন। কি ভয়ংকর কাণ্ডটাই না তিনি ঘটিয়ে ফেলেছেন! একেবারে বম্বের সিনেমার কায়দায় ঝাড়পিট করে তিনি লোকটাকে কাবু করে ফেললেন! এ তো একেবারে তাঁর যৌবনের প্রিয় নায়ক অবিনাশ বল্লভের মতো ন্যাটা একশন। এক সময় অবিনাশের একটা ছবিও তিনি মিস করতেন না। এমন দিনও গেছে, তিনি অবিনাশ বল্লভের সিনেমা লাইন দিয়ে টিকিট কেটে ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শোয়ে দেখেছেন। বাঁ হাত বাঁ পায়ের অ্যাকশন হিরো অবিনাশ যেমন দীর্ঘকায় তেমনই জলদগম্ভীর তাঁর গলার স্বরটি। তবে কি আজ অবিনাশের ভূত চাপল তাঁর উপর। কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব, অবিনাশ বল্লভ বৃদ্ধ হয়েছেন ঠিকই কিন্তু মারা তো যাননি!
ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে মহিমবাবু সোজা বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি লাগালেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বেসিনের কল থেকে আঁজলা ভরে মুখে, চোখে, ঘাড়ে জল দিয়ে মুখ তুলে আয়নাটার দিকে তাকালেন। আর তাকিয়েই তাঁর ভির্মি খাওয়ার জোগাড়! আয়নায় তাঁর প্রতিবিম্ব কই! আয়নায় নিজেকে আর দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। তার মানে কি তিনি আর বেঁচে নেই! শুনেছেন মৃত মানুষের প্রতিবিম্ব পড়ে না আয়নায়। তবে কি সকালে মিনিবাসে ওঠার সময়ই কোনও দুর্ঘটনায় তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে!
তিনি ঠিক দেখছেন তো? নিজের ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতে একটা চিমটে কাটতেই দেখলেন তাঁর শরীর থেকে অজস্র নীল আলোর স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে আয়নার মধ্যে ঢুকে পড়ল। পরক্ষণেই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলেন। কিন্তু মহিমবাবুর প্রতিবিম্বের মুখে কৌতুকের হাসি লেগে আছে যেন! অথচ তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন এখনও তাঁর মুখখানা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে আছে।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই তুমি কে?
আমি মহিম মিত্তির, তোমার প্রতিবিম্ব। আয়নার ভিতর থেকে উত্তর এল।
তাহলে খানিক আগে কীভাবে তুমি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলে?
অদৃশ্য হইনি তো। আজ শুধু তোমার জায়গায় আমি গিয়েছিলাম। প্রতিবিম্ব বলে ওঠে।
মানে?
আচ্ছা, পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলি, তোমার ধন্দটা মনে হয় এখনও কাটেনি। আমি হলাম তোমার প্রতিবিম্ব, মানে মহিম মিত্তিরের প্রতিবিম্ব। তবে তোমার দুনিয়ায় থাকি না। আমার ঠিকানা হল প.প.প।
প.প.প! সে আবার কী? মহিমবাবু অবাক হয়ে বললেন।
প.প.প হল ‘পার্শ্ব পরিবর্তিত পৃথিবী’ অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ল্যাটারালি ইনভার্টেড ওয়ার্ল্ড’। আমাদের দুনিয়াটা হল কোটি কোটি আয়না দিয়ে তৈরি। তবে আমরা কিছুটা স্লেভের মতো, মানুষ ডাকলেই, মানে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালেই আমাদেরও ছুটে এসে তার মালিকের সামনে দাঁড়াতে হবে। এই যেমন আমি তোমার সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছি।
কিন্তু এই যে বললে আজ আমার জায়গায় তুমি এসেছিলে? প্রতিবিম্বের কথা শুনে মহিমবাবু মুখের হাঁ বন্ধ করতে ভুলে গেছেন।
ঠিকই শুনেছ। দেখ, আজ প্রায় পঞ্চান্ন বছর ধরে তুমি আমার সামনে দাঁড়াচ্ছ, মানে যবে থেকে তুমি আয়না চিনতে শিখেছ, এই গোটা পঞ্চান্ন বছর ধরে তুমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিরুচ্চারে নিজের মনের কথা আমাকে বলেছ। দুঃখের কথা, আনন্দের কথা, তোমার স্বপ্নের কথা, তোমার হতাশার কথা। আর শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছে যদি একদিনের জন্যও তোমার কষ্ট কমাতে পারি। আসলে তুমিই যে আমার একমাত্র বন্ধু। তবে একটা সমস্যা রয়েছে, তোমার ডান হাত মানে কিন্তু আমার বাঁ হাত…
এটা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি।
আচ্ছা, তুমি নার্সিসাসের নাম শুনেছ?
মহিমবাবু সোজা প্রশ্ন পেয়েছেন এতক্ষণে, জানব না কেন? প্রাচীন গ্রিসের কাহিনি। নার্সিসাস নিজের সৌন্দর্যে এতটা মোহিত ছিল যে সারাক্ষণ স্থির জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখত।
আরে ধুর, ওটা তো বানানো গল্প। আসলে নার্সিসাসই প্রথম ব্যক্তি যিনি মানুষের প্রতিবিম্বের যে স্বাধীন অস্তিত্ব আছে সেটা ধরতে পেরেছিলেন। তাই জলের সামনে বসে প্রতিবিম্বের সঙ্গে কমিউনিকেট করতেন।
ইয়ে মানে, নার্সিসাসের পরেই কি আমি দ্বিতীয় ব্যক্তি যে…
এবার মহিমবাবুর প্রতিবিম্ব হেসে ফেলল, না না মহিমবাবু, আপনি ছাড়াও অনেকেই, বিশেষত যাদের…
ঠক ঠক ঠক!
প্রতিবিম্ব যেন আরও কী একটা বলছিল, কিন্তু বাথরুমের দরজায় গিন্নির করাঘাতের তাড়নায় মহিমবাবুর চটকা ভেঙে গিয়ে প্রতিবিম্বের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হল। তিনি শুনলেন দরজার বাইরে থেকে গিন্নি তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন, বলি হলটা কী, অ্যাঁ? ভেতরে কি কমোডে বসে ধ্যান করছ নাকি মুচ্ছো গেলে, অফিসটফিস যেতে হবে না নাকি!
মহিমবাবু তড়িঘড়ি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন বেলা অনেক হয়েছে। আজ অফিসে তৃতীয় দিনের বিলম্ব হলে মুখার্জি সাহেবের কাছে তাঁকে অশেষ গঞ্জনা সইতে হবে। তাড়াহুড়ো করে নাকেমুখে চাট্টি গুঁজে তিনি বেরিয়ে পড়লেন, আর কি আশ্চর্য, বিনা ক্লেশে সাড়ে ন-টার মিনিবাসটা পেয়েও গেলেন। বিবাদী বাগের মিনিবাস টার্মিনাসে নেমে যখন তিনি নিজের অফিসের দিকে যাচ্ছেন তখন গোলদিঘির ধারে একটা চেনা মুখ দেখে তিনি চমকে উঠলেন। তাঁর বাল্যবন্ধু নানু একটা খাতা-পেন হাতে নিয়ে গোলদিঘির ঘেরাটোপের ভিতর বসে আছে। গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, গালে দিন সাতেকের না-কামানো দাড়ি। কিন্তু নানু তো বড় বহুজাতিক সংস্থার এক্সিকিটিভ ছিল, ধোপদুরস্ত জামা পড়ত, জাপানি গাড়ি ড্রাইভ করত। একি অবস্থা হয়েছে নানুর, শরীরটরির ঠিক আছে তো!
মহিমবাবু গোলদিঘির ধারে নানুর পাশটিতে গিয়ে বসলেন। কিন্তু নানু ওরফে নয়নের মুখেচোখে এক অসম্ভব উজ্জ্বলতা। একটুও দুঃখকষ্টের ছাপ নেই। সে হাসি মুখে বলল, ও, মহিম, তুই এসেছিস, একটা নতুন কবিতা লিখেছি, শুনবি।
মহিমবাবুর সেই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল কলেজে পড়ার সময় নয়ন বড় ভালো কবিতা লিখত।
সেই সঙ্গে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়াতে তাঁর শিরদাঁড়া টানটান হয়ে উঠল। মহিমবাবুর প্রতিবিম্ব বলেছিল, যাদের নামের মধ্যে প্যালিনড্রোম আছে তারাও ‘পার্শ্ব পরিবর্তিত পৃথিবীর’ সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারে!
***
(বাংলা জঁর সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য)
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, পার্থ দে, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
খুব ভালো লাগল। ছোটবেলায় এই মেজাজের গল্প পড়তাম, এখন আর বিশেষ দেখি না। এটা পড়ে সেই কথা মনে পড়ে গেল।
ভাল লিখেছ, পার্থ। যদিও, আমার মতে, শেষদিকে কনসেপ্টটা আরেকটু খোলতাই করা যেত, মাথার দিকটা একটু বেশি ভারী হয়ে গেছে গল্পটা– ওখান থেকে মেদ ছেঁটে মূল কনসেপ্টের উন্মোচনের অংশে আরেকটু ফোকাস দিলে পাঠক হিসেবে আমি বেশি খুশি হতাম। মতামত ব্যক্তিগত, বলা বাহুল্য।
পড়লাম, বেশ লাগল। প প প আরেকটু প্রাঞ্জল হলে জমে যেত
খুব ভাল লাগল। পার্শ পরিবর্তনের জগতের ধারণাটা বেশ অন্যরকম। গল্পটার ট্রিটমেন্টও ভাল হয়েছে।
অপূর্ব, টানটান, চিত্তাকর্ষক কাহিনী। ঝরঝরে, নির্মেদ লেখনী। প্রাপ্তি একরাশ অনাবিল মুগ্ধতা।।
একরাশ মুগ্ধতা রেখে গেলো গল্পটি।
মহারাজের জন্ম শতবর্ষে এর থেকে ভালো ট্রিবিউট বোধকরি হতে পারে না।
খুব ভাল লাগল পার্থবাবু। চমৎকার কল্পনা।