মরণের মুখে রেখে
লেখক: সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মানুষ চায় অনেক কিছু; কিছু পায়, কিছু পায় না; কেউ পায়, কেউ পায় না। কালিদাস বিদ্যা চেয়েছিল, পেয়েওছিল; রাধা কৃষ্ণকে চেয়েও পায়নি।
শুক্লাও পায়নি।
শুক্লা বসু, এম.এ. সেকেন্ড ইয়ার, সংস্কৃত। বয়স তেইশ।
বিকেল ফুরিয়ে আসছে। সূর্য ইতিমধ্যেই ডুবে গেছে দৃষ্টিসীমার ওপারে। বৈশাখের রিক্ত অপরাহ্ণে বাড়ি ফিরছে ক্লান্ত পাখির দল। ছাদের উপর দাঁড়িয়ে শুক্লা দূর থেকে দেখতে পেল দৃশ্যটা— শববাহকেরা নিয়ে যাচ্ছে মানুষটাকে তার শেষ যাত্রায়। —“বল হরি, হরিবোল।” —আওয়াজ আসছে বাতাসের স্রোতে এলোমেলো হয়ে।
কৃষ্ণেন্দুস্যার আর নেই।
শ্মশানযাত্রীর দল হারিয়ে গেল সূর্যাস্তের দিকে মেঠোপথের বাঁকে। এই মফস্বল শহরের শ্মশানে যেতে হলে যেতে হবে সেই নদীর চড়া পর্যন্ত।
মুখটা বিস্বাদ লাগছে শুক্লার। কিচ্ছু যেন আর ভালো লাগছে না। এতদিনের এত আশা— এক লহমায় সব শেষ।
কিন্তু না, আর একটা কাজ এখনও তার করা বাকি আছে।
শুক্লা বোকা নয়। সে বুঝতে পেরেছে, তার জন্যই আজ স্যারকে চলে যেতে হল। যা হয়ে গেছে, তা সে ফেরাতে পারবে না। কিন্তু তাই বলে এই কাজটা সে করতে পারবে না, তাও কি হয়?
তার আত্মসংযম ক্ষমতা যে অসাধারণ, সেকথা শুক্লা নিজে জানে খুব ভালোভাবে। আত্মসংযম না থাকলে আজই দুপুরে যখন তার পাকা কথা হয়ে গেল, তখন সে চুপটি করে রইল কী করে? তবে হ্যাঁ, এ ব্যাপারে সে তো বরাবর চুপ করেই থেকেছে। মুখ খুলতে গেলে শুনতে হয়েছে বাবার রাগী ধমক— “তুই এসবের কী বুঝিস? আমরা কি তোর জন্য খারাপ ছেলে পছন্দ করব?”
বাকসংযম তার করায়ত্ত, নয়তো সে হয়তো বলে ফেলত, বাবার পছন্দ করা ছেলে ভালো হতে পারে, কিন্তু তার নিজের পছন্দ করা ছেলেটাও ভালো হলে তার দাবি কম হয় না কোনও অংশেই। কিন্তু ওই যে— “তুই এসবের কী বুঝিস?”
আর সে জানে আরও একটা কথা— বাবার পছন্দ করা ছেলেটা ভালো নয় মোটেই।
অভিরূপ সরকার। বাপের বিরাট কাপড় মিল আছে। ছেলে স্বয়ং রাজনীতি করেন। এলাকায় বিরাট নাম। সে নাম ‘সু’ কী ‘দু:’ তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। সাহসই পায় না। রুলিং পার্টির উঠতি নেতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, এত বড় বুকের পাটা এ অঞ্চলে এখনও কারও হয়নি।
শুক্লার বাবার মতে, অভিরূপ তো ছেলে হিসেবে খারাপ নয়। আজেবাজে কথা যা দু-চারটে শোনা যায়, সেগুলো অপোজিশনের রংচড়ানো রটনা। আর পুরুষমানুষ— তার নামে কিছু বাজে কথা রটলেই বা কী? বাপের একমাত্র ছেলে, অগাধ টাকাপয়সা, হলেই বা উচ্চমাধ্যমিকে ব্যাক। দোষ যদি কিছু থাকেও, বিয়ে করলেই সব কেটে যাবে।
বাকসংযমী শুক্লা প্রশ্ন করতে পারেনি, “বাবা, আমি কি তোমার সৎ মেয়ে?”
অভিমান হয় না, তা নয়। কিন্তু সে জানে, বাবার উপরেও চাপ আছে। কৃষ্ণেন্দুস্যারের সঙ্গে যা হল, তার পরে অভিরূপের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে, এত ক্ষমতা কার? শুক্লার বাবা তার মায়ের কাছে বলেছেন, “তাও ভালো, বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ইচ্ছে করলে ওরা আরও খারাপ কিছু করতে পারত।”
শুক্লার মা মুখে হাত চাপা দেন। বাবা বলেন, “মেয়েকে বোঝাও। এছাড়া উপায় নেই।”
মা বোঝান, মেয়ে শোনে, কিন্তু কিছু বলেনা। ‘হ্যাঁ’ও নেই, ‘না’ও নেই। না রাম, না গঙ্গা।
বাবা ধরেন, মৌনতা সম্মতিরই লক্ষণ।
তারপর তো আজ পাকা কথা হয়ে গেল। না হয়ে উপায় আছে?
কাল রাতে কৃষ্ণেন্দুস্যারকে গুলি করে মেরেছে ওরা।
কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী। সংস্কৃতের অধ্যাপক। বয়স একত্রিশ। মৃত।
চোখে রিমলেস চশমা। তার পেছনে বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটি ঝকঝক করছে। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, অপূর্ব স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব। কৃষ্ণেন্দুস্যারের ক্লাস ছাত্রছাত্রীরা বোধহয় অগ্নিকাণ্ড হয়ে গেলেও ফাঁকি দেবে না।
এই শহরেই থাকতেন ভদ্রলোক একটা ভাড়াবাড়িতে। সঙ্গী ছিল একরাশ বইপত্র, একটা ল্যাপটপ আর একটা বেড়াল, তার নাম বাসবদত্তা। অমায়িক ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, কৃষ্ণেন্দুস্যার ছিলেন তাই।
আর তাঁর চোখদুটো…
যে দেখেছে কাছ থেকে, সে কোনওদিন ভুলবে না তাঁর চোখদুটোকে। ক্লাসের সময় তারা উজ্জ্বল হয়ে উঠত গভীর সাহিত্য আলোচনায়, আর ক্লাসের বাইরের আলাপে সে চোখ কোমল হয়ে যেত আন্তরিকতায়। ওই চোখ দেখেই তো ডুবেছিল শুক্লা।
আজ এত দুঃখের মাঝেও একটু হাসি পেল। ডুবেছে সে, আর তার ওঠার বাসনা নেই।
রাতের খাওয়া ভালো করে খেতে পারবে না, এটা প্রত্যাশিতই ছিল। তাই বাবা কিংবা মা, কারও সন্দেহ হল না। খাওয়ার পর মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল সে।
“স্যার, একটু দাঁড়ান, আমি আসছি।”
কাঁদতে পারল না সে; আয়নায় শেষবারের মতো নিজেকে দেখে নিল। চোখের কোণে একধ্যাবড়া কালি, উন্মাদিনীর মতো আলুথালু চুল, যেন একটা বাহাত্তুরে বুড়ির মুখ!
সিলিংফ্যানের উপর দিয়ে ওড়নাটা গলিয়ে ফাঁসটা চমৎকার তৈরি হয়েছে। —“‘উদ্বন্ধন’, তাই না স্যার?”
ও জানে, এটা ওর কল্পনা; তবু যেন শুনতে পেল, স্যার ওকে বলছেন, “একাজ কোরো না শুক্লা।”
শুক্লা আপনমনেই হেসে উঠল; সুর করে বলল, “ন কুরু নিতম্বিনী গমনবিলম্বনমনুসর তং হৃদয়েশম্।”
খাটের উপর টুল, তার উপরে উঠে গলায় ফাঁসটা পরতে যাবে, এমন সময় লোকটাকে দেখতে পেল সে।
কালো কোট, কালো টুপি, কালো চশমা পরা লোকটা বসে আছে তার খাটে, তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে যেন যুগযুগান্তর ধরে।
অনেকদিনের আত্মসংযম সত্ত্বেও চমকে উঠল শুক্লা। টুল থেকে নেমে এল সে, তাকাল দরজার দিকে।
“ঘর তো ভেতর থেকে বন্ধ!”
আত্মহত্যা একটুক্ষণ অপেক্ষা করুক; এই ব্যাপারটার ফয়সালা আগে করতে হবে।
শুক্লা তাকাল লোকটার দিকে। কালো চশমা ভেদ করে চোখদুটো দেখা যাচ্ছে না। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গা-টা যেন শিরশির করে উঠল। সে ভীতু নয়, তবু…
অদ্ভুত সুরেলা বাঁশীর মতো গলায় লোকটা বলল, “শুক্লা বসু? বয়স তেইশ বছর দু-মাস এগারো দিন? কিছু মনে করবেন না, আপনার আজ মরা হবে না।”
লোকটাকে হঠাৎ যেন খুব আপন মনে হয় শুক্লার। সিলিং ফ্যান থেকে সবুজ ওড়নার ফাঁসটা এখনও ঝুলছে। খাটের উপর অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে আছে কাঠের টুলটা। সে বসে পড়ল লোকটার পাশে; বলল, “কী ব্যাপার বলুন তো? কে আপনি? ঘরের মধ্যে ঢুকলেন কী করে? কী চান?”
কালো কোটপরা লোকটা বলল, “কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী। বয়স একত্রিশ বছর একমাস কুড়ি দিন। আপনি তাঁকে চিনতেন?”
অনেকক্ষণ সামলে রেখেছিল, আর পারল না। মুখঢাকা আঙুলগুলোর ফাঁক গলে হু হু করে নেমে এল বাঁধভাঙা জল।
***
কুরুক্ষেত্র নয়, ক্লাসরুম। কৃষ্ণ নয়, কৃষ্ণেন্দু। কিন্তু কথাগুলো বড় চেনা। —
“বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।।”
উজ্জ্বল চোখদুটো ছাত্রছাত্রীদের দেখছে উৎসাহভরে। কৃষ্ণেন্দুস্যারের ক্লাসে অতি বিচ্ছু ছেলেও চুপটি করে থাকে। ভয়ে নয়, মুগ্ধতায়। মন্ত্রমুগ্ধ ক্লাস, মন্ত্রদাতা গুরু।
স্যার বলছেন, “মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে অন্য নতুন বস্ত্র পরিধান করে, ঠিক তেমনই আত্মাও জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে…”
শুক্লা শুনছে, ক্লাস-নোট নিচ্ছে, কিন্তু বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ওই চোখদুটোর দিকে।
স্যার একটা প্রশ্ন করলেন, অমিত উঠে দাঁড়াল। ক্লাসের ভালো ছেলেদের একজন সে; স্যার ওকে খুব স্নেহ করেন।
স্যার সবাইকে স্নেহ করেন।
টীকা, অদ্বৈতবাদ ও শাঙ্করভাষ্য, স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা— কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তীর ভাণ্ডার থেকে একের পর এক আসতে থাকে ক্রস-রেফারেন্স। ছাত্রছাত্রীরা কেউ নোট নেয়, কেউ অন করে রাখে মোবাইলের রেকর্ডার।
শুক্লাও নোট নেয়। তাকায়, তাকিয়ে থাকে, একসময় চোখাচোখি হয়, উজ্জ্বল চোখদুটো যেন চুম্বকের মত আটকে রাখে ওর চোখজোড়াকে। তারপর চোখ সরে যায়, ক্লাসের খোলা জানালা দিয়ে বয়ে যায় একটা হালকা ঝিরঝিরে হাওয়া। সে হাওয়ায় খাতার পাতা ওড়ে, চোখের পাতা কাঁপে।
স্যার বলে চলেছেন, “ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।” আর শুক্লা ভাবছে আরও ক্ষুদ্র কোনও হৃদয়দৌর্বল্যের কথা।
ক্লাস শেষ হয়। স্যার বেরিয়ে যান। খোলা জানালাটার দিকে তাকিয়ে শুক্লা গুণগুণিয়ে গায়, “সখী ভালোবাসা কারে কয়?/ সে কি কেবলই যাতনাময়?”
***
তবে লোকটি বড় একগুঁয়ে ছিলেন। শুক্লার সঙ্গে যে তাঁর গুরুশিষ্যার সম্পর্ক ছাড়াও কিছু হতে পারে, এটা তিনি প্রথমে মানতেই চাননি। তার চোখের দৃষ্টি দেখে তিনি নিশ্চয়ই কিছু আন্দাজ করে থাকবেন। আন্দাজ যে করেছেন, সেটা সে টের পেয়েছিল সেইদিন সন্ধ্যায়, অনুষ্ঠানের পর।
গানের গলা মন্দ নয় শুক্লার। পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিল সে।
কৃষ্ণেন্দুস্যার বসেছিলেন দর্শকাসনের প্রথম সারিতে। তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করে সে গেয়েছিল, “কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া/ তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া।”
গাইতে গাইতে চোখ খুলতেই আবার চোখ আটকে গেল চুম্বকের গায়ে। উনি তাকিয়ে আছেন ওর দিকে।
“চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে সখা কত ভালোবাসি।”
উনি চোখ নামিয়ে নিলেন। শুক্লার মনে হল, উনি বুঝতে পেরে গেছেন। বুকটা একবার ধক্ করে উঠল।
বুঝুন উনি! “আত্মসংযম ধুয়ে জল খাবি তুই?” —নিজের মনটাই ধমকে দিল তাকে।
গান শেষ করে আবার চোখ খুলল সে। দর্শকরা হাততালি দিচ্ছে। কিন্তু স্যার কোথায়?
ওই যে উনি— বেরিয়ে যাচ্ছেন পেছনের দরজা দিয়ে।
হাততালি এখনও চলছে। শুক্লা আত্মসংযমী, নিজেকে সামলে নিয়ে শুরু করল দ্বিতীয় গান— “সেই ভালো সেই ভালো, আমারে না হয় না জানো।”
সেদিন অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। স্যার যাচ্ছিলেন মোটরসাইকেল স্ট্যান্ডের দিকে, সেখানেই তাঁকে পাকড়াও করল সে। — “কী স্যার, না হয় ভালো গাইতে পারি না, তাই বলে কি একটা হাততালিও আমার পাওনা হয় না?”
স্যার দাঁড়িয়ে পড়লেন, ওর দিকে তাকালেন। আজ উনি সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে এসেছিলেন। শুক্লা যেন এইমাত্র সজ্ঞানে বুঝতে পারল, মানুষটাকে আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আর তারও কিছুক্ষণ পর সে বুঝতে পারল, উনি এখনও কিছুই বলেননি, চুপ করে চেয়ে আছেন ওর দিকে।
কৃষ্ণেন্দুস্যার বললেন, “কিছু বলবে?”
শুক্লা শুরু করে, “গানটা ভালো নাই লাগুক, একটা হাততালি তো…”
ওকে থামিয়ে দেন উনি। —“না, ও কথা নয়। তুমি যা বলবে বলে এসেছিলে, তাই বরং বলো।“
শুক্লার মনে হয়, তার পাগুলো যেন হঠাৎ করে আর নিতে পারছে না শরীরটার ভার।
বুঝে ফেলেছেন উনি!
এতক্ষণ যে কথাটা পাক খাচ্ছিল ঠোঁটের গোড়ায়, ঠিক এই মুহূর্তে পেটের মধ্যে ডুবুরি নামিয়েও বোধহয় তার হদিশ পাওয়া যাবে না। সে কিছুই বলতে পারল না, মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
স্যার এগিয়ে আসেন, কোমল স্বরে ডাকেন, “শুক্লা।”
শুক্লা মুখ তুলল। কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তীর চোখে ওই দৃষ্টিটা কী স্নেহের, না প্রেমের? নাঃ, প্রথমটাই হবে।
স্যার বললেন, “নিজের মনকে শান্ত করো। কেন এমন পাগলামি করছ?”
উনি হয়তো অন্তর্যামী, কিন্তু তাই বলে কি সে চুপ করে থাকবে? কথাগুলো যেন হঠাৎ আবার জোয়ারের জলের মতো বেগে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
অনেক কষ্টে নিজের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর যথাসাধ্য স্বাভাবিক করে সে বলল, “পাগলামি করছি না স্যার।”
এর বেশি আর কিছু বেরল না মুখ দিয়ে। এত কথা বলার আছে, সবগুলো যেন একসঙ্গে জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
উনি বললেন, “তুমি আমার শিষ্যা। অর্জুন কেন উত্তরাকে বিয়ে করেনি বলো তো? ওই একই কারণে।”
এই শুরু হল পণ্ডিতি! কিন্তু আজ শুক্লা ছেড়ে দেবে না। সে কীরকম শিষ্যা, আজ সে গুরুকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবে। —“তাহলে মহাকাব্যের সব উদাহরণ আপনি মানবেন তো? মহারাজ পাণ্ডুর মৃত্যুর পর মাদ্রী সহমরণে যাননি? রামচন্দ্র স্ত্রীকে বনবাসে পাঠাননি? আজকের দিনে এই কাজগুলো…”
স্যার অধীরভাবে বললেন, “এভাবে কি মহাকাব্যের বিচার করতে হয়? তারা একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন সমাজব্যবস্থার প্রোডাক্ট। সমালোচনা করার আগে তুমি তাদের সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডটা মাথায় রাখবে না? তুমি নিজে, আমরা সবাই একদম অন্যধরনের সমাজের মানুষ। মহাকাব্যিক সমাজের সঙ্গে আমাদের বেশির ভাগ সামাজিক প্রথা না মেলাটাই স্বাভাবিক।”
শুক্লা হাসল। —“ওই একই যুক্তিতে অর্জুন-উত্তরার উদাহরণটাও কি বাতিল হয়ে যায় না স্যার?”
কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী চুপ করে থাকেন।
শুক্লা বলল, “কিছু মনে করবেন না স্যার। ভালো লাগা-না লাগা এগুলো নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে জোর চলে না, সেটা আমি বুঝি। শুধু একটা কথাই আর বলার আছে আমার।”
“বলো।”
“আপনার যা, তা আপনারই থাক। কিন্তু আমি যা আপনাকে দিয়ে ফেলেছি, তা তো আর আমি ফিরিয়ে নিতে পারব না। দয়া করে সে অনুরোধ আমাকে করবেন না।”
স্যার কী যেন ভাবছেন, চুপ করে তাকিয়ে আছেন। শুক্লা হঠাৎ ওঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। স্যার একটু অবাক হলেন।
চোখের জলটা বেরিয়ে আসতে চাইছিল, কিন্তু শুক্লা তাকে আটকে রেখেছে অসাধারণ সংযমে। সে বলল, “অনেক তর্ক করে ফেললাম, কিছু মনে করবেন না। আজ আসি। ভুল বুঝবেন না স্যার, কিন্তু আমি দত্তাপহারী নই।”
স্কুটিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল সে ঝড়ের বেগে। কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
“দত্তাপহারী!” শব্দটা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন তিনি।
‘দিয়েও ফিরিয়ে নেয় যে।’
আর ওই মেয়েটি যে ওঁকে কী দিয়ে বসে আছে, তা বুঝতে ওঁর বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি।
***
কিন্তু বরফ গলেছিল। সময় লেগেছিল গলতে, কিন্তু গলেছিল। স্যার অনেক চেষ্টা করেছিলেন ওকে বোঝাতে। পারেননি। যুক্তি, তর্ক সব হার মেনেছিল ওই একগুঁয়ে মেয়েটার জেদের কাছে। তার একটাই কথা— ওঁর কাছে সে কিচ্ছু চায় না, কিন্তু সে যদি মনে মনে তার সব কিছু ওঁকে দিতে চায়, সেটা উনি আটকাবেন কোন অধিকারে?
একদিন অনেকক্ষণ বোঝানোর পর শুক্লা মুখ নামিয়ে চলে গিয়েছিল। স্যার একটু অবাক হয়েছিলেন। কারণ শুক্লা তর্কের উত্তরে প্রতিতর্ক করে, উদাহরণের উত্তর দেয় উদাহরণ দিয়ে। কিন্তু আজ কী হল ওর?
সেদিন রাতে মেসেজটা এসেছিল শুতে যাওয়ার ঠিক আগে। দু-লাইন রবীন্দ্রনাথ:
“আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী দীর্ঘ বরষ মাস।”
পড়তে পড়তে অকারণেই হয়তো চোখটা একটু সজল হয়ে ওঠে কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তীর। কী এমন দেখেছে মেয়েটা তাঁর মধ্যে?
আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করেন তিনি; একটু হাসেন। ভালোবাসা বড় ছোঁয়াচে জিনিস!
ইচ্ছা হয়, হাতটা একবার ওর মাথায় রাখতে। ঘুম আসছে না, এ অবস্থায় আসেও না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেন তিনি; মোবাইলটা নিয়ে মেসেজটা বারবার পড়েন। গানের চেনা লাইনগুলো যেন নতুন অর্থ নিয়ে জেগে ওঠে।
তারপর তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। স্বপ্নে একটা মেয়ে এসে দাঁড়ায় তাঁর সামনে; বলে, “আমি না হয় দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি কি তাই বলে কিছু চেয়েছি আপনার কাছে? আপনি দিলেন কেন?”
তিনি প্রশ্ন করেন, “কে তুমি?”
সে হাসে। —“মহারাজ উদয়ন, আমি বাসবদত্তা।”
তারপর ঘুম ভেঙে যায়। বাসবদত্তা— না, মানুষ নয়, সাদা বেড়ালটা— ডেকে ওঠে মিহিসুরে, “মিঁয়াও।”
ভোরের পাখি ডাকছে বাইরে। ঘুমভাঙা চোখে অদ্ভুত একটা হাসি নিয়ে বসে থাকেন কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী।
ভালোবাসা বড় ছোঁয়াচে জিনিস!
***
এত কিছুর পরেও শুক্লা কিন্তু ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নামতে পারেনি। আর কিছুদিন পেলে হয়তো পারত। কিন্তু তার আগেই তো…
তাদের দুজনের সম্পর্কটা নিয়ে স্যারের ছাত্রমহলে আলোড়ন একেবারেই হয়নি, তা নয়। শুক্লার বান্ধবীরা হেসেছিল, কয়েকজন চোখ গোল্লা গোল্লা করেছিল, মনে বোধহয় ‘ব্যথা’ও পেয়েছিল বেশ কয়েকজন। “কী করে হল রে কেসটা?” একজন জানতে চেয়েছিল। শুক্লা হেসে উত্তর এড়িয়ে গিয়েছিল।
সেদিন সন্ধ্যায় নদীর ধারে ওঁরা দুজন বসেছিলেন বালির উপরে। বিপদের প্রথম আভাসটা পাওয়া গিয়েছিল তখনই।
সূর্য ডুবে গেছে, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় একটা আরামদায়ক শীতল হাওয়া আসছে নদীর বুক থেকে। আজকের শেষ খেয়া লোকজন নিয়ে চলেছে ওপারে।
স্যার কবিতা ভালোবাসেন। প্রচুর কবিতা ওঁর মুখস্থ। আর গল্প করার সময় কবিতার প্রসঙ্গ আসবেই। শুক্লা একবার বলেওছিল, “গল্প করতে করতেও ক্লাস নেবেন নাকি?”
স্যার হেসে বলেছিলেন, “এখন দেরি হয়ে গেছে বালিকে। আর কিচ্ছু করার নেই। দত্তাপহারী হতে তো তুমি পারবে না। আর আমার এই বদ্অভ্যাস যে অনেকদিনের। একে ছাড়া সোজা নয়।”
আজও কবিতার কথা বলছিলেন উনি। —“‘বলো শান্তি, বলো শান্তি,/ দেহসাথে সব ক্লান্তি/ পুড়ে হোক ছাই।’ মাঝে মাঝে মনে হয়, ওই পুড়ে ছাই হওয়াটার পরে কী আছে, জানতে পারলে খুব ভালো হত।”
শুক্লা জানে, সূর্য ডোবার সময়টা স্যার একটু দার্শনিক হয়ে পড়েন আর স্বগতোক্তি করেন। এই ক’দিনে মানুষটার অভ্যাসগুলোর সঙ্গে একটু একটু পরিচয় ঘটছে তার।
শুক্লা বলল, “ছাই হওয়ার আগে এই জীবনটাতে এত কিছু আছে যে পরের অবস্থাটা জানতে আমার ইচ্ছাই করে না।”
পেছন থেকে কে যেন ডাকল, “শুক্লা, শোনো।”
দুজনেই ওঁরা পেছনে ফিরলেন। আগন্তুককে স্যার চিনতে পারলেন না, শুক্লা পারল।
অভিরূপ সরকার। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। দাদাগিরিতে প্রবাদপ্রতিম খ্যাতি। আর তার চোখদুটো…
সেগুলোর কথা ভাবলে শুক্লার বমি পায়।
স্যারকে সে বলল, “আপনি বসুন, আমি এখুনি আসছি।” —এই বলে উঠে গেল সে। অভিরূপের আগমন মানে কখনও সুসংবাদ নয়। স্যারকে এসবের থেকে যতটা দূরে রাখা যায়, ততই ভালো।
উঠে দাঁড়িয়ে একটু এগিয়ে যেয়ে অভিরূপের মুখোমুখি হল সে। —“কী বলছিলেন বলুন?”
অভিরূপের চোখ সবসময় জবাফুল, এখনও তাই। ঈষৎ জড়ানো গলায় সে বলল, “এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকাটা তোমার ঠিক হচ্ছে না।”
মাথায় যেন দপ্ করে আগুন জ্বলে উঠল শুক্লার। কিন্তু আত্মসংযম বজায় রাখল সে। অভিরূপ সরকারের ছোঁকছোঁকানি আগেও তার নজরে পড়েছে। কিন্তু আজকের ঔদ্ধত্যটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের। চোয়াল শক্ত করে সে বলল, “তাই বুঝি? কিন্তু আপনাকে আমার অভিভাবকগিরি করার দায়িত্বটা কে দিয়েছে বলুন তো?”
অভিরূপ দাঁত বার করে হাসল। —“তোমার বাবার সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়ে গেছে একটু আগেই। আর ওই মাস্টারটার সঙ্গে তোমার মেলামেশা আমি পছন্দ করি না।”
বাক্সংযম নয়, শুক্লা যে কিছু বলতে পারল না, তার কারণ রাগে সে কথা হারিয়ে ফেলেছে।
অভিরূপ এগিয়ে এল স্যারের দিকে; উনি ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন, অভিরূপকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন।
অভিরূপ বলল, “এই যে মাস্টার। বলি, শুরু করেছ কী? এই রাতের বেলা নদীর ধারে মেয়েছেলে নিয়ে বেলেল্লাপনা! আমার এরিয়ায় আমি এসব বরদাস্ত করব না।”
শুক্লা স্পষ্ট দেখতে পেল, স্যারের চোখগুলো যেন জ্বলে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বললেন, “ভদ্রভাবে কথা বলুন। কে আপনি?”
অভিরূপ কুৎসিতভাবে হাসল। —“আমি কে, সেটা বরং শুক্লার কাছেই শুনে নিও। আর যদি নিজের ভালো চাও, মানে মানে কেটে পড়ো, হারামির বাচ্চা।”
শুক্লা চমকে উঠল, তার সঙ্গে অভিরূপও। কৃষ্ণেন্দুস্যার ওর কলার চেপে ধরেছেন।
সেই মুহূর্তেই শুক্লার মনে হয়েছিল, স্যার কাজটা ঠিক করলেন না। অভিরূপ সরকার লোক ভালো নয়।
কিন্তু এখন সে কেঁচো। রোগাপটকা শান্ত-শান্ত দেখতে লোকটার গায়ে এত জোর, কে জানত? রাগে স্যারের নাকের পাটা ফুলে উঠেছে, শরীরটা কাঁপছে। অভিরূপ ছটফট করছে, খিস্তির ফোয়ারা ছোটাচ্ছে, কিন্তু স্যারের হাত ছাড়াতে পারছে না।
স্যার ওর গালে সপাটে এক চড় মারলেন। অভিরূপ ছিটকে পড়ল মাটিতে।
গম্ভীরস্বরে স্যার বললেন, “গেট আউট রাস্কেল।”
কোনও কথা না বলে উঠে দাঁড়াল অভিরূপ। তারপর দ্রুতগতিতে হেঁটে চলে গেল। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছিল, এই অপমান সে ভুলবে না, বদলা নেবেই।
শুক্লা দৌড়ে স্যারের কাছে গেল। স্যার তখনও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন অভিরূপের অপস্রিয়মাণ শরীরটার দিকে। তিনি ওর দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে তাঁর দৃষ্টি কোমল হয়ে এল।
আবার ওঁরা বসলেন ওঁদের পুরনো জায়গায়। শুক্লা ওঁকে অভিরূপ সরকার সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করল। শেষে বলল, “ওকে চড় মারাটা বোধহয় রিস্কি হয়ে গেল। ওর গায়ে হাত দিয়ে একমাত্র বান্টি দাস ছাড়া আর কেউ বহাল তবিয়তে নেই।”
স্যার জানতে চাইলেন, “বান্টি দাসটা কে?”
শুক্লা জানাল, বান্টি দাসও রুলিং পার্টির আরেক মস্তান। ঘরের ভেতর ঘর, দলের ভেতর দল। এই অঞ্চলে রুলিং পার্টির ভেতরেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আছে। বান্টি দাস হল অভিরূপের বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা। দুই গোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে মারামারি লেগেই আছে। মাঝেমধ্যে দু-চারটে লাশও পড়ে। এই তো গত পরশুই বান্টি দাসের দলের লোক কার্তিক চোংদারের লাশ পাওয়া গেছে। কেউ স্বীকার করে না, তবে সবাই বুঝতে পারে, এটা অভিরূপের গ্যাংএর কীর্তি।
আজ ভাগ্যিস অভিরূপ একা এসেছিল এবং নিরস্ত্র অবস্থায় এসেছিল। নয়তো স্যার এত সহজে রেহাই পেতেন না।
স্যার সব শুনলেন চুপ করে। শুক্লা তার বলা শেষ করে দেখল স্যার তাঁর সেই চুম্বক-চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। কী যেন দেখছেন উনি।
“কী দেখছেন?” —শুক্লা প্রশ্ন করে।
“তোমাকে, হে তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা। সত্যি বলছি, দারুণ লাগছে তোমাকে।”
শুক্লা মনে মনে খুশি হয়, কিন্তু মুখে ছদ্মরাগ দেখিয়ে বলে, “এতক্ষণ ধরে যে আপনাকে অভিরূপের হিস্ট্রি শোনালাম, সে সম্বন্ধে আপনার বক্তব্যটা বলুন দেখি।”
“আমার বক্তব্য?” —স্যার হাসলেন। —“আমার বক্তব্য তো কবির কথা।” —এই বলে আবৃত্তি করে ওঠেন উনি।—
“সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রুপালি আগুনভরা রাতে।”
হুঁ, জীবনানন্দ। কী কথার কী উত্তর! অদ্ভুত মানুষ তো!
হঠাৎ ওর হাতটা টেনে নেন স্যার, দু-হাতের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরেন; বলেন, “কোনও অভিরূপ-শব্দরূপ-ধাতুরূপের কথায় ভয় পাইনা আমি। এইটুকু জেনে রাখো শুক্লা, কারও ক্ষমতা হবে না তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করার।”
অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, একটু দূরের হ্যালোজেন আলোতে নদীতীর যেন অপার্থিব সুন্দর। শুক্লা ঘন হয়ে বসেছে তার প্রাণের মানুষের সঙ্গে। স্যারের মুখে পৌরুষের এই অনভ্যস্ত আস্ফালনটি বড় মিষ্টি লাগল তার। তার মনে হল, সে যেন স্যারের গালের গন্ধ পাচ্ছে।
মুখ তুলে দেখল সে ওঁর দিকে। তার হাতটা মুঠিতে নিয়ে উনি চেয়ে আছেন নদীর দিকে। শুক্লার ইচ্ছা হল নিজের মুখটা একটু উঁচু করে তুলে ধরে যাতে একবার পাওয়া যায় ওঁর নিঃশ্বাসের স্পর্শ। খুব ইচ্ছা হল, অন্তত একবারটি…
আত্মসংযম, না কী সাহসের অভাব? কে জানে?
যা চেয়েছিল, তা আর হয়নি; পাওয়া হয়নি নিজের গালে ওই মানুষটার হাতের ছোঁয়া।
মানুষ চায় অনেক কিছুই; কিছু পায়, কিছু পায় না।
গতকাল রাতে স্যারকে গুলি করে মেরেছে ওরা। কে মেরেছে, সবাই জানে, কিন্তু কারও বলার সাহস নেই।
আর আজ শুক্লার পাকা কথা হয়ে গেল।
***
কালো কোট, কালো চশমাপরা লোকটা চেয়ে আছে ওর দিকে। শুক্লার কান্না থেমেছে, চোখ মুছছে সে। এত কথা লোকটাকে কিচ্ছু বলতে হয়নি। লোকটা সব জানে, শুক্লা সেটা বুঝতে পারছে। কিন্তু ওকে তার ভয় হচ্ছে না।
যদি খারাপ লোক-ও হয়, তাহলেই বা তার কী ক্ষতি হবে? সে তো মরতেই যাচ্ছিল।
চোখ মুছে শুক্লা বলল, “কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তীর কথা কী জানতে চাইছিলেন?”
লোকটা বলল, “আপনার ফোনে একটা মেসেজ এসেছে। সেটা একবার পড়ে দেখুন। সম্ভবত খারাপ খবর।”
খারাপ খবর? এখনও খারাপ খবর থাকতে পারে? শুক্লার হাসি পেল।
কিন্তু মোবাইলটা গেল কোন চুলোয়? ওড়নার ফাঁস টাঙানোর আগে সেটাকে সে কোথায় ছুড়ে ফেলেছিল?
ওই যে, লোকটা আঙুল দেখাচ্ছে। শুক্লা ঝুঁকে পড়ে ড্রেসিং টেবিলের তলা থেকে যন্ত্রটা উদ্ধার করে আনল।
সত্যিই একটা মেসেজ এসেছে। অমিত পাঠিয়েছে। “দাহ হয়ে গেল।”
অমিত তাহলে শ্মশানে গিয়েছিল।
কিন্তু এটাই ‘খারাপ খবর’? হিন্দুর শব দাহ হয়ে গেছে, এটার মধ্যে খারাপ কী আছে, সে ভেবে পেল না। আর লোকটাই বা জানল কী করে যে তার একটা মেসেজ এসেছে এবং তাতে একটা খারাপ খবর আছে?
শুক্লা অবশ্য অনেকক্ষণ বুঝতে পেরে গেছে যে কালো কোটপরা লোকটা মানুষ নয়, কিন্তু তার ভয় করছে না একটুও। মরতেই যে যাচ্ছে, সে আর কাকে ভয় করবে?
সে বলল, “পড়লাম, কিন্তু দাহ হয়ে যাওয়াটাকে আপনি খারাপ বলছেন কেন?”
লোকটাকে খুবই অপ্রস্তুত দেখাল। —“মানে, ব্যাপারটা কীভাবে ব্যাখ্যা করব, বুঝতে পারছি না। আপনি কি আমাকে একটু সময় দেবেন?”
শুক্লা সিলিংএর দিকে তাকাল। সবুজ ওড়নার ফাঁসটা তার জন্য শান্তভাবে প্রতীক্ষা করছে। হাসল সে; বলল, “বলুন, বলুন। আমার হাতে এখন প্রচুর সময়। গোটা রাতটাই তো পড়ে আছে।”
লোকটা বিনীতভাবে বলল, “আপনার আজ মরা হবে না।”
শুক্লা ভ্রূ তুলল। —“এ কথা আপনি আগেও একবার বলেছেন। কিন্তু কারণটা বলেননি এখনও। কী ব্যাপার বলুন তো? সুইসাইড করার জন্য পাঁজিতে ভালো ডেট নেই নাকি?”
লোকটা বলল, “আপনি ব্যঙ্গ করছেন।”
শুক্লা বলল, “আর আপনি কি রঙ্গ করছেন? সাফ জবাব দিন, এসবের মানে কী?”
লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। —“আপনাকে আমি সবকথাই বলছি। তার আগে বলি, এরকম দু-চারটে ঘটনার কথা নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন, যখন কোনও লোককে ডাক্তার ‘মৃত’ ঘোষণা করার পরেও সে লোক হঠাৎ করে বেঁচে উঠেছে, আর সবাই বলেছে, ‘মিরাকল’ ঘটে গেল।”
শুক্লা উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে। —“কী বলছেন? তার মানে, কৃষ্ণেন্দুস্যারকেও…”
লোকটা দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়ে। —“উঁহু। কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তীর তো দাহকার্য সমাধা হয়ে গেছে।”
শুক্লা স্পষ্টতঃই হতাশ হল। —“হ্যাঁ, তাই তো। …ঠিক আছে, কী বলছিলেন বলুন।”
লোকটা বলল, “মানুষের মৃত্যু বড় জটিল জিনিস। অন্তত আমার ক্ষেত্রে কাজটা আরও কঠিন করে দিয়েছে জনবিস্ফোরণ। প্রতি সেকেন্ডে কত সহস্র মানুষ মরছে বলুন তো। এত বিভিন্ন রকমের আয়ুর হিসাব করতে একটুআধটু গণ্ডগোল তো হতেই পারে। সব আত্মা, মানে আপনাদের উপনিষদের ‘আত্মা’র কথা বলছি না, মানে প্রেতদের নিয়ে আসার কাজটা কি কম জটিল, বলুন?”
শুক্লা চোখ বড় বড় করে বলল, “তার মানে, আপনি… আপনি…”
‘মৃত্যু’ ঘাড় নাড়ল। —“ওই জন্যই বলছিলাম, আজ আপনার মরা হবে না। আপনার আয়ু এখনও বাকি আছে।”
শুক্লা স্থির হয়ে বসে রইল। আজকের রাতটা বড় অদ্ভুত। জানালার বাইরে ঝকঝক করছে রূপালি তারাগুলো।
মৃত্যু বলে চলল, “যারা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে, তারা কেন প্রথমে মরেছিল জানেন? আমি স্বীকার করে নিচ্ছি, আমার হিসাবের গণ্ডগোলের ফলে। এত কোটি কোটি মানুষ— দু-চারটে কেস মাঝেমধ্যে গড়বড় তো হবেই। তবে কিনা, গড়বড়টা ধরা পড়তেও বেশি সময় লাগে না। তখনই মৃত আত্মাটাকে আবার তার শরীরে ফেরত পাঠিয়ে দিই। লোকে ভাবে, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে মানুষটা ফিরে এল।”
শুক্লা বুঝতে পারছে, লোকটা কী একটা কথা বলতে ইতস্তত করছে। নিশ্চয়ই ব্যাপারটার সঙ্গে স্যারের মৃত্যুর যোগ আছে। সে বলল, “কিন্তু কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তীর কথা কী বলছিলেন, সেটা তো বললেন না?”
মৃত্যু একটু চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আমারই হিসেবের গণ্ডগোল। কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তীর আয়ু আরও অনেক বাকি ছিল। কিন্তু…”
জীবনে এতখানি সংযমহারা কখনও হয়নি শুক্লা। বাঘিনীর মতো সে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার উপরে। —“হতচ্ছাড়া শয়তান! তোমার একটা ভুলের জন্য…!”
লোকটা দুঃখী দুঃখী মুখে চেয়ে রইল। পাঁচ মিনিট হাত-পা চালানোর পর শুক্লা বুঝতে পারল, তার চড়-থাপ্পড়গুলো ওর গায়ে পড়ছে না; ওকে ভেদ করে দেওয়াল আর বিছানায় এসে পড়ছে।
সে শান্ত হওয়ার পর লোকটা বলল, “আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু মৃত্যু হলেও যদি আয়ু বাকি থাকে, তাহলে আত্মাটাকে দেহের মধ্যে আবার ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।”
শুক্লা উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল। —“তাহলে তো স্যারকে এখনও বাঁচানো যায়।”
লোকটা আবার মাথা নিচু করল, আঙুল দেখাল মোবাইলটার দিকে। —“যেত, যদি না…”
শুক্লা বুঝতে পারল। অমিতের মেসেজটা। “দাহ হয়ে গেল।” দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল সে।
লোকটা বলল, “শরীরটা না থাকলে আত্মাটাকে ঢোকাব কোথায়?”
এত অসহায় শুক্লা কখনও অনুভব করেনি।
মৃত্যু বলল, “আমার সমস্যাটা ভেবে দেখুন। গণ্ডগোলটা ধরা পড়তে এবার একটু বেশি সময় লেগেছে, আর তার মধ্যেই দেহটা পোড়ানো হয়ে গেছে। আয়ু শেষ হওয়া আত্মাদের আমি নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আয়ু বাকি আছে, এমন আত্মাকে নিয়ে আমি কী করব? কোথায় যাব?”
এক মুহূর্তের জন্য তার উপর করুণা হল শুক্লার। আহা বেচারা! সত্যিই তো, বড় সমস্যায় পড়ে গেছে ও। তারপর মনে হল, ওর একটা ভুলেই তো স্যারের সঙ্গে সঙ্গে তার নিজের জীবনটাও নষ্ট হতে বসেছে। বেশ হয়েছে। এবার ঠেলা সামলাক হতচ্ছাড়া!
মৃত্যু মুখ তুলল। —“একটা উপায় আছে। কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী বুদ্ধিটা দিয়েছেন।”
“মানে?” —শুক্লা লাফিয়ে উঠল বিছানা থেকে। —“কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী আপনার সঙ্গে আছেন?”
সে মাথা নাড়ল। —“আছেন। উনি অনেকবার আপনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাও করেছেন, কিন্তু পারেননি। দেহহীন আত্মার পক্ষে দেহধারীর সঙ্গে যোগাযোগ করাটা বেশ কঠিন। তাও একবার আপনি সম্ভবত ওঁর কথা শুনতে পেয়েছেন।”
ওটা তাহলে কল্পনা ছিল না? “এ কাজ কোরো না শুক্লা।” —সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার।
“স্যার, কোথায় আপনি?”
উত্তর নেই। শুক্লা জানে, স্যার শুনছেন, কিন্তু তাঁর উত্তর ওর কাছ পর্যন্ত পৌঁছবে না। কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তীর ছাত্রী সে। তার মনে পড়ে যায় ওয়াল্টার ডে লা মেয়ার।
“Tell them I came, and no one answered.”
“স্যার, শুনতে পাচ্ছেন?”
এদিক ওদিক তাকায় শুক্লা। কালোকোট বসে আছে নিঃশব্দে, খাটের পাশে ড্রেসিংটেবিল, তার পাশে জানালা, খাটের উপর একটা টুল, সিলিং থেকে দুলছে সবুজ ওড়নার ফাঁস।
উজ্জ্বল চোখদুটো কোথাও নেই।
না, আছে; দেখা যাচ্ছে না।
মৃত্যুর দিকে তাকায় সে। —“কী বুদ্ধি আপনাকে দিয়েছেন উনি?”
কালোকোট বলল, “আমার একটা মৃত্যুতালিকা আছে। তাতে পৃথিবীর সব মানুষের মৃত্যুর দিনক্ষণ লেখা আছে। সেটা উনি পড়ছিলেন। উনি একটা বুদ্ধি বার করেছেন।”
“কী বুদ্ধি?”
“মাফ করবেন, আপনাকে তা বলতে পারব না। মৃত্যুতালিকার তথ্য জীবিত মানুষকে জানাতে নেই।”
“কে জানতে চায় আপনার অখদ্দে তালিকার তথ্য? আমাকে প্ল্যানটা বলুন।”
“পরিকল্পনাটি তালিকার সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত যে আপনাকে তা বলা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী আপনাকে একটা নির্দেশ দিচ্ছেন।”
“স্যার আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন? কী নির্দেশ?”
“উনি আপনাকে নির্দেশ দিচ্ছেন অভিরূপ সরকারকে বিবাহ করতে।”
শুক্লা থ হয়ে যায়। —“ইয়ার্কি মারছেন আমার সঙ্গে?”
মৃত্যু ম্লান হাসল। —“আপনি বিশ্বাস করুন শুক্লা বসু, ইয়ার্কি মারতে আমি কখনও পারি না। আমি মিথ্যাভাষণও করি না। আমি যা বললাম, কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তীর নির্দেশ তাই। তিনি বলছেন, এতে আপনার ও তাঁর দুজনেরই মঙ্গল হবে।”
“মঙ্গল?” —শুক্লা যে কীভাবে নিজেকে সংযত রেখেছে, সে নিজেই বুঝতে পারে না। —“আমি অভিরূপকে বিয়ে করলে একটাই মঙ্গল হবে। সেটা হল আমি শয়তানটাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তারপর নিজে মরতে পারব।”
মৃত্যু আবার হাসল। —“আপনি ওকে মারবেন? কিন্তু সেটা যে সঠিক সময় নয়। আয়ু নির্দিষ্ট যে।”
শুক্লা একটু রেগে গেল। —“তখন থেকে আয়ু নিয়ে লেকচার দিচ্ছেন। বলুন তো, আমি যদি এক্ষুণি ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ি, কী হবে আমার? মরব না?”
“আজ্ঞে না। চোট পাবেন, কিন্তু মরবেন না। সময় না হলে কেউ মরে না।”
“হ্যাঁ। ব্যতিক্রম কেবল কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী। থ্যাংক্স টু ইউ।”
“আপনি আবার ব্যঙ্গ করছেন। কিন্তু আমি তো স্বীকার করছি, ওটা একটা ভুল হয়ে গেছে, আর কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী স্বয়ং সেই ভুল সংশোধনের একটা উপায় বার করেছেন।”
“উপায়টা কী, বলুন আমাকে।”
“দয়া করে জানতে চাইবেন না, কারণ আগেই বলেছি জীবিত ব্যক্তিদের মৃত্যুতালিকা সম্পর্কিত কোনও তথ্যই জানানো যায় না। কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী বলছেন, আপনি যদি তাঁকে বিশ্বাস করেন, তাহলে অভিরূপ সরকারকে বিবাহ করুন। তিনি আরও বলছেন যে আপনাকে দেওয়া কথা তিনি রাখবেন।”
কথা? ওঃ হো, সেই “অভিরূপ-শব্দরূপ-ধাতুরূপ”? একচিলতে হাসি ফুটে উঠল শুক্লার ঠোঁটে। মনটা হঠাৎ হালকা লাগছে। না:, মরা তো পালিয়ে যাচ্ছে না। ডুবে যাওয়ার আগের মুহূর্তে হাতের মুঠোয় এসে লাগা খড়কুটোটা যত তুচ্ছই হোক, একবার সে শেষ চেষ্টা করে দেখবে না-ই বা কেন?
“উপায়ে সফলে রক্ষা” —স্যার যেন কানে কানে বলে ওঠেন।
পাদপূরণ করে শুক্লা, “নিষ্ফলে নাধিকং মৃতে।”
মৃত্যুর চেয়ে বেশি কিছু তো আর হবে না!
তাহলে চেষ্টা করতে দোষ কী?
টুলের উপর উঠে ওড়নাটা খুলে আনে সে, চুপ করে বসে তাকিয়ে থাকে জানালা দিয়ে। কালো কোটপরা মৃত্যু চলে গেছে। হয়তো স্যারও চলে গেছেন। তবু মনটা এখন একটু ভালো লাগছে।
বিয়ের এখনও মাসখানেক বাকি। হয়তো তার জীবনেরও।
শুক্লা চেয়ে রইল তারাগুলোর দিকে। স্যার তাকে এমন অদ্ভুত আদেশ দিলেন কেন?
হঠাৎ মনে হয়, ‘দেহসাথে সব ক্লান্তি’ পুড়ে ছাই হওয়ার পরের অবস্থাটা কি উনি জানতে পেরেছেন?
***
বিয়ের তখনও তিনদিন বাকি। শুক্লা দেখল, বাবা ঘরে ঢুকছেন উত্তেজিত মুখে। মা প্রশ্ন করেন, “কী হয়েছে গো?”
বাবা একবার ওর দিকে তাকিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে যান। অগত্যা মাকেও ঢুকতে হয় পিছুপিছু। উত্তেজিত কিন্তু চাপা কণ্ঠস্বর শোনা যায় বাবার।
শুক্লার একটু রাগ হল। সে তো সজ্ঞানে মাথা ঢুকিয়েই রেখেছে হাড়িকাঠে। তাহলে এত ঢাক-ঢাক-গুড়-গুড় কেন বাপু?
আধঘণ্টা পরে মা ডাকলেন, “শুক্লা, রান্নাঘরে একটু দেখ তো ভাতটা ফুটছে কিনা।”
শুক্লা রান্নাঘরে গেল, পিছুপিছু মা-ও হাজির। …আচ্ছা, এটা তাহলে মেয়েলি মন্ত্রণাসভার আয়োজন!
মা বলেন, “খবর শুনেছিস?”
“দিলে তো শুনব। হয়েছেটা কী?”
মা যে তথ্যটি সরবরাহ করেন, সেটি অভিনব। কাল রাতে নাকি অভিরূপকে কে বা কারা গুলি করেছে। এসব ব্যাপারে যেমন হয়, কেউ মুখ খুলছে না; কিন্তু সবার ধারণা, এ বান্টির গ্যাংএর কাজ। কার্তিক চোংদার খুনের বদলা।
এইজন্যই তাহলে স্যার ওকে আত্মহত্যা করতে বারণ করেছিলেন। মৃত্যুতালিকাটা উনি পড়েছিলেন। উনি জানতেন, শুক্লাকে বিয়ে করার দিন পর্যন্ত অভিরূপ টিকবে না।
কিন্তু পরের দিন সকালে আরেকটা খবর নিয়ে এলেন বাবা যাতে সবকিছু আবার গুলিয়ে গেল। অভিরূপ মরেনি, বহাল তবিয়তে আছে। গুলিটা নাকি ওর বুকের পাঁজর ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে।
শুক্লা শুনে মনে মনে বলল, “ইশ্শ্শ্!”
***
বিয়ের দিন সকাল থেকে ব্যস্ততা চরমে। গায়ে হলুদ, তত্ত্ব পাঠানো— কাজের কি শেষ আছে?
অমিতের মতো নির্ভেজাল বন্ধু আছে বলে কাজগুলো মসৃণ গতিতে হয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে দেখা করে আড়ালে অমিত সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে, “আর কী করবি বল্? কপালের লিখন!”
তার মুখের দিকে তাকিয়ে সে আর বেশি কিছু বলতে সাহস পায়নি; তার মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে “যাই কাকিমা” বলে কেটে পড়েছে।
বিয়ে হয়ে গেল। মালাবদল, সপ্তপদী। অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে হয়ে গেল শুক্লা বসুর সঙ্গে অভিরূপ সরকারের।
শুভদৃষ্টির সময় একবার একটু খটকা লেগেছিল শুক্লার। কিন্তু কেন, তা সে বলতে পারবে না।
ফুল দিয়ে সাজানো বাসরঘর। শুক্লার বন্ধুবান্ধবীরা একে একে বিদায় নিয়ে গেল। অভিরূপও বিদায় করে দিল তার অনুচরগোষ্ঠীকে, তারপর ঘনিষ্ঠভাবে বসল ওর পাশে।
রাঙা বেনারসী পরে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল শুক্লা, মনে মনে গাল দিচ্ছিল কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তীকে। তার জন্যই আজ এই জানোয়ারটা তার অঙ্গস্পর্শ করার সাহস পেয়েছে।
অভিরূপ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। শুক্লা মুখ নামিয়ে রইল। —ও একটা খুনী, একটা পশু!
অভিরূপ আলতো হাতে ঘোমটা তুলে দিল; বলল, “শুক্লা, তাকাও আমার দিকে।”
বুকটা ধক্ করে উঠল শুক্লার। এ কার কণ্ঠস্বর?
অভিরূপ বলল, “সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রুপালি আগুনভরা রাতে।”
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে শুক্লা। সে খুব ভালো করে জানে, অভিরূপ সরকার বাপের জন্মে একলাইন কবিতা পড়েনি; এক স্তবক জীবনানন্দ আবৃত্তি করা তো অনেক দূরের কথা!
অজান্তেই চোখ থেকে নেমে আসে অবিরল অশ্রুধারা; প্রশ্ন করা হয়ে যায়, “কে আপনি?”
অভিরূপ ওর একটা হাত তুলে নিয়ে ধরে রাখে নিজের দু-হাতের মধ্যে। —“চিনতে পারছ না, তন্বী শ্যামা বালিকে?”
দুম্ করে এক ঘুঁষি বসিয়ে দেয় শুক্লা ওঁর বুকে; তারপর ওই বুকেই মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে হাউ হাউ করে। সংযমের বন্ধনটা যেন এতদিন তার শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছিল। —“কেন আপনি এমন করলেন? কী করেছি আমি? কেন? কেন?”
ওর স্বামী চুপ করে থাকেন, হাত বুলিয়ে দেন ওর সজ্জিত চুলে। সব বলবেন তিনি, কিন্তু তার আগে ও কেঁদে নিক প্রাণভরে।
হালকা হওয়ার দরকার আছে বেচারী মেয়েটার।
***
একঘণ্টা কেটেছে।। জানালা দিয়ে মৃদু, ঝিরঝিরে বাতাস আসছে। সহস্র তারায় জেগে আছে কালো আকাশ।
চোখে আর জল নেই বটে, কিন্তু তার দাগ রয়ে গেছে গালে। শুক্লা তাকিয়ে দেখছে অবাক হয়ে ওই চোখগুলোর দিকে। নেশাগ্রস্ত, লাল চোখ নয়; উজ্জ্বল, মেধাবী, সহানুভূতিপূর্ণ দুই চোখ— যে চোখ দেখে ডুবেছিল সে। বাইরে শান্ত রাত্রি।
কৃষ্ণেন্দুস্যার বললেন, “এছাড়া উপায় ছিল না শুক্লা। মৃত্যুর তালিকা থেকে জানতে পারলাম, বিয়ের আগেই অভিরূপ তার বিরোধী গোষ্ঠীর হাতে গুলি খেয়ে মরবে। মৃত্যুও আমাকে কাঁধ থেকে নামাতে চাইছিল, কারণ তার কাজে গাফিলতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমি— একটা আয়ু শেষ না হওয়া প্রেত। ওকেও নাকি ওর উপরওয়ালার কাছে কৈফিয়ত দাখিল করতে হয়।”
শুক্লা রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল। স্যার থামতেই সে বলল, “তারপর?”
“তারপর অভিরূপ গুলি খেতেই ওর প্রেতটা বেরিয়ে এল শরীর ছেড়ে। আমাকে দেখতে পেয়ে প্রথমে একপ্রস্ত গালিগালাজ করল বটে, তবে তারপরেই মৃত্যুকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। …হ্যাঁ, ইচ্ছা করলে মৃত্যু অতি ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। সে যাই হোক, মৃত্যু আমার পরামর্শ মত বান্টির গ্যাং চলে যাওয়ার পর আমাকে অভিরূপের শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। গুলির ক্ষতটাও সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল।
“আরও একটা গোপন কথা বলি। শরীরটা অভিরূপের হলেও আত্মাটা যখন আমার, তখন শরীরটাও নাকি ধীরে ধীরে বদলাবে, মৃত্যু বলেছে। এটা নাকি আমার পুরোনো চেহারার মতো হয়ে যাবে অনেকটাই। “বাসাংসি জীর্ণানি” মনে আছে তো? আমার কেসটা অবশ্য একটু অন্য রকমের। নিজের পুরোনো পোশাক ছেড়ে আমি অন্যের পুরোনো পোশাকে ঢুকেছি। এইবার এই পোশাকে ভাঁজ পড়তে শুরু করবে আমার দেহের মাপে।”
শুক্লার মনে হচ্ছে, সে যেন স্বপ্ন দেখছে। এও কি হতে পারে? কিন্তু যা হয়েছে, যা সে প্রত্যক্ষ করছে, তাকে সে অস্বীকার করবে কী করে? অস্বীকার করতে সে চায়ও না। এটাই তার জীবন; এই জীবনেই সে সুখী।
কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী বলেন, “এখানে, এই শহরে আর থাকব না। বাইরে কোথাও চলে যাব। তাহলে অন্তত বান্টি-ফান্টি জাতীয় উৎপাতগুলোর হাত থেকে মুক্তি।”
শুক্লা ঘন হয়ে আসে, ওঁর বুকে মুখ রেখে চোখ বন্ধ করে।
উনি ওর মুখটা তুলে ধরেন, ওর মুখের উপর মুখ নামিয়ে আনেন; ফিসফিস করে বলেন, “আজ বাসররাত্রি। আজ ঘুমোতে নেই, জানো না?” —নিজের মুখে ওঁর গরম নিশ্বাসের স্পর্শ পায় শুক্লা, নিজের গালে ওঁর হাতের ছোঁয়া।
অদ্ভুত সুন্দর চোখদুটো মেলে উনি তাকিয়ে থাকেন ওর দিকে। নিজের মুখটা উঁচু করে তুলে ধরে শুক্লা; ফিসফিস কণ্ঠে প্রথমবার নামতে পারে ‘আপনি’র উচ্চতা থেকে ‘তুমি’র নৈকট্যে। —“তুমি কিচ্ছু জানো না। আমার মোটেই ঘুম পায়নি।”
স্নিগ্ধ রাত্রি, অজস্র প্রোজ্জ্বল তারা। ওদের ঘরটা যেন হঠাৎ আলোকিত হয়ে ওঠে সহস্র নক্ষত্রের রূপালি আগুনে।
Tags: ফ্যান্টাসি গল্প, বড় গল্প, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়
ভালো লাগল। লেখাটার প্লট তেমন নতুন নয় কিন্তু ট্রিটমেন্টটা এত সুন্দর যে একটানা পড়ে যেতে হয়। ভাষা ও উপস্থাপনাও যথাযথ।