সময় সরণি, এক স্বপ্নের খোঁজ
লেখক: বামাচরণ ভট্টাচার্য
শিল্পী: সুমন দাস
১
– এমন অমঙ্গুলে কথা সাতসকালে কী না বললেই নয়, প্রফুল্ল! ছেলেটা আমাদের কতদিন হল বাইরে গেছে, ভালো চিন্তা কর। সেও ভালো থাকবে, তার সঙ্গে আমরাও। তার চেয়ে গোবিন্দ ভজ, হৃদয়ে শান্তি পাবে।
– তোমরা বাবারা বড্ড পাষাণ। মায়েদের হৃদয় তোমরা কী বুঝবে! বিদেশ যাওয়ার দুই বছরে ছেলেটা একবারও বাড়ি এসেছে? যাওয়ার আর জায়গা পেল না, এক্কারে বিদেশ। অনেক হয়েছে, আর না, এবারে তাকে বাড়ি আসতে বল।
– তোমাকে ফোন করলে তুমিই বল ফিরে আসতে। না না, প্রফুল্ল চোখে জল নয়। রক্ষে কর ভগবান; এখনও তুমি একটু ফুল-চন্দন পেলে না, অথচ অবুঝ মেয়েমানুষ কাঁদতে লাগল।
– বলবই, ফোন করুক একবার। আজ দু-দিন তো সে ফোনই করেনি। এবারে কান্নাটা একটু জোরেই হয়ে গেল। তার মাথায় হাত রেখে জনার্দন বললেন, শান্ত হও। ছেলে আমাদের ভালোই আছে। হয়তো কাজের ব্যস্ততায় ফোন করার সময় পায়নি। ধৈর্য ধর, ঠিক ফোন করবে। আমার পুজো দিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কথাগুলি বলে ফুলের সাজিটা হাতে করে জনার্দন হনহন করে হাঁটতে লাগলেন। কানে আসতে থাকল প্রফুল্লর ফোঁপানির আওয়াজ। মাথায় হাতটা ঠেকিয়ে জনার্দন অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, হে কৃষ্ণ।
তাদের ঠাকুরবাড়িটা তাদের ভিতরের বাড়ি থেকে প্রায় দুশো ফুট দূরে। অনেক আগেকার ঠাকুরবাড়ি। পাথরের বাঁধানো চাতাল। সাদা ধবধব করছে। ভিতরে গোবিন্দ বাঁশি বাজানোর ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন। মূর্তিটি দেখলেই প্রশান্তি আসে। পাশে রাখা একটা সিংহাসন, সেখানে রাখা একটা শালগ্রাম শিলা। যার রংটি দেখলে ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে হয়, এত কালোও কি সম্ভব?
ঠাকুরের ঘরের দরজাটা খুলতে খুলতেই জনার্দন দরাজ গলায় গাইতে লাগলেন, হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ , কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে…
গমগমে অথচ মিঠে সুরে ভোরের চরাচর ভরে উঠতে লাগল। দেখা গেল পূর্ব দিগন্তে দিবাকর। বাসি ফুলগুলো ফেলে জনার্দন নতুন ফুল দিয়ে গোবিন্দকে সাজাতে লাগলেন। মুখে চলতে থাকল, হরিনাম।
গোবিন্দবন্দনা, পূজা শেষ করেই তিনি প্রণামের জন্য মাথাটা মাটিতে ঠেকালেন।
– হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপতে।
গোপেশ গোপিকাকান্ত রাধাকান্ত নমোহস্তুতে।।
সব কিছু শেষ করে দরজাটা লাগিয়ে বাইরে আসতেই দেখলেন তাঁর বন্ধু গোপেশ দাঁড়িয়ে আছেন। জনার্দনকে বেরিয়ে আসতে দেখেই গোপেশ বললেন, কী হে ভায়া পুজো সারলে? তোমার পুজো হতে হতেই আমি মাঠে দু-চক্কর লাগিয়ে দিলাম। এমন সুন্দর পরিবেশে তোমার গলাটা ভারী মানানসই, ভাই। চল, দাঁড়িয়ে যখন গেলাম একবার সাধের গোবিন্দের চরণে মাথাটা ঠুকে নিই। বুড়ো বয়সে আর তো চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই, তবু এটুকু চাইতেই পারি, মরণ যেন সহজ হয়।
– এস গোপেশ, এস ভিতরে।
মন্দিরের ভিতরটা ধূপকাঠির গন্ধ আর ফুলের গন্ধে ভরে আছে। গোপেশ মাটি থেকে মাথাটা উঠাতেই জনার্দন বললেন, ‘নাও ভাই প্রসাদ নাও।’
– দাও, একটা নাড়ু সকাল বেলাতে খেয়েই নিই। তারপর ভায়া, আর কী খবর সব?
– খবর আর কী! চলছে। মন খুব খারাপ; ছেলেটা কতদূরে! তোমার বৌদি প্রায়ই কান্নাকাটি করছে। আমার মন অশান্ত হয়ে উঠছে।
– ভায়া, অত উতলা কেন? দৃঢ় চিত্ত হও। ছেলের সাফল্য প্রার্থনা কর, বৌদিকেও বোঝাও।
কিন্তু জনার্দনের একটা দীর্ঘশ্বাস অনেক কিছুই বলে দিল।
২
সাউথ পোলের নভেম্বর-ডিসেম্বরের সময়টাতে একটু গরম পরে। গরম মানে বাংলাদেশের ৪০ ডিগ্রী সে. নয়। এখানে গরম মানে, মাইনাসের দিকেই ঘোরাফেরা করা, শুধু সেটা থাকে -২০ ডিগ্রী সে. আশপাশে।
– এই যা, আজকেও ফোন করা হল না। সময় গড়িয়ে গেল, বাড়িতে এখন অনেকটা রাত। মা নিশ্চয় কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পড়েছেন। থাক, আজ আর জাগিয়ে লাভ নেই, কাল করব। দক্ষিণ গঙ্গোত্রীর রিফ্রেশ রুমে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে লরার উদ্দেশে কথাগুলি বলল কৃষ্ণেন্দু।
লরা কফি কাপটা নিয়ে এপাশ ওপাশ ঘোরাচ্ছিল। তার চোখ ছিল হাতে থাকা একটা ট্যাবে। কৃষ্ণেন্দু জানে একটা জটিল অঙ্কের সমাধান নিয়ে সে সারাক্ষণ ভেবে যাচ্ছে। কৃষ্ণেন্দুর কথাটা তার কানে ঢুকলই না। সে শুধু বলল, লুক ডিয়ার, হেয়ার ইজ দ্য মিসটেক।
– রাখ তোমার মিসটেক। আমার এখন ছুটি। গবেষণার চক্করে আমার ঘুম মাথায় উঠেছে, আজ স্রেফ আমি ঘুমাব।
তাদের বাথরুমে সব সময় গরম জলের প্রয়োজন হয়। গঙ্গোত্রীর বাইরে দেহের কোনও অংশ খোলা রাখা যায় না। সামান্যতম খোলা থাকলেই সঙ্গে সঙ্গেই ফ্রস্ট বাইট। স্নান করার কোনও অবকাশই নেই। দেহের দুর্গন্ধে যে কোনও সুস্থ সবল মানুষ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। কৃষ্ণেন্দুর ইচ্ছে হল বেশ করে স্নান করতে, কিন্তু উপায় নেই। কমোডের উপরে বসে কৃষ্ণেন্দুর মাথায় আসতে থাকল ছোট-বড় কত ঘটনা। ঠিক তখনই একটা রিনরিনে কণ্ঠ সে শুনতে পেল,
Near, far, wherever you are
I believe that the heart does go on
Once more, you open the door
And you’re here in my heart
And my heart will go on and on.
সে বুঝল লরা তার সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে। লরার সঙ্গে সম্পর্কটা গবেষণার সূত্রেই, ক্রমে ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা। তাদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াও বেশ ভালো। এই গঙ্গোত্রী গবেষণাগারের পাশাপাশি দুটো কামরা তাদের বরাদ্দ। তবে এদের কামরা না বলে খোপ বলাই ভালো। উঠে দাঁড়ানো যায় না। ওই খোপেই পাশাপাশি বসে তারা অনেকসময় ব্যক্তিগত অবসর কাটায়। হঠাৎই এমন এক অবসরে সে লরাকে বলল, আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলবে?
– কেন নয়? কবে বলাবে?
কথা বলাবে বলল বটে কৃষ্ণেন্দু, কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল এই ভেবে মাকে কী বলে লরার পরিচয় দেবে? আর কী কথায় বা লরা বলবে? মা একফোঁটা লরার ইংরেজি বুঝবে না, লরা মায়ের একফোঁটা বাংলা বুঝবে না।
বিছানায় পড়তেই ঘুম আসতে দেরি হল না তার। ঘুম এলেই বিশ্রী বিশ্রী ঘটনাগুলো মনে আসে। প্রথমেই মনে আসে ব্যর্থতা। স্বপ্নে সেগুলোর সব সমাধান থাকে কিন্তু চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে কথায় যেন হারিয়ে যায়। ফার্স্ট ফরোয়ার্ড ভঙ্গিতে স্বপ্নে আসতে থাকে অনেক কিছু। চোখ খুললেই সমস্যাগুলো থাকে কিন্তু সমাধানগুলো কোথায় হারিয়ে যায়। অথচ কৃষ্ণেন্দু একশো শতাংশ নিশ্চিত সে সমস্যাগুলোর সমাধান করে ফেলেছিল।
৩
ওয়ার্মহোলের ধারণা শুনে সে হেসেছিল, ভেবেছিল যতসব আজগুবি পরিকল্পনা। এমন আবার হয় নাকি! সময় পিছিয়ে যাবে, অল্প সময়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেওয়া যাবে, যাওয়া যাবে সমান্তরাল কোনও বিশ্বে, পিছিয়ে যাওয়া যাবে অতীতে। আইনস্টাইনের সূত্র তাহলে! আলোর চেয়ে বেশি বেগে কেউ ছোটে না, তার কী হবে?
তখন সে গ্র্যাজুয়েশনের ছাত্র। মনের অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বকে জয় করে জ্যোতি স্যারকে সে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলল, স্যার ওয়ার্মহোল কী?
– ধর, তুমি একটা তলের উপরের পৃষ্ঠের কোনও বিন্দু থেকে নীচের পৃষ্ঠের ঠিক ওই বিন্দুটার নীচে যাবে, কীভাবে যাবে?
– প্রথমে উপরের পৃষ্ঠের উপর বরাবর ধারে আসব, সেই ধার ঘেঁষে নীচের পৃষ্ঠে নামব। তারপর নীচের পৃষ্ঠ বরাবর যে বিন্দুতে যেতে হবে সেখানে যাব।
– ঠিক। এবারে, আমি যদি একটা উপরের পৃষ্ঠের বিন্দু থেকে নীচের পৃষ্ঠের ওই বিন্দুতে ফুটো করে দিই, তাহলে।
– সহজেই আমি নীচে ওই বিন্দুতে পৌঁছে যাব।
– সময় সাশ্রয় হবে। এই সুড়ঙ্গই হল ওয়ার্মহোল। বুঝলে?
– কম সময়ে বেশি পথের যাত্রা?
– হ্যাঁ। এটাও বটে আবার পিছিয়েও যাওয়া যাবে, অন্য বিশ্বেও যাওয়া যাবে।
কৃষ্ণেন্দু ঘাড় নেড়েছিল। একে একে সায়েন্সের যত পত্রিকা বের হয় সেগুলো কিনে ওয়ার্মহোলের যাবতীয় তথ্য পড়ে নিলেও তার যেন খেদ মেটেনি। মনে মনে ভেবে নেয় এই বিষয়টা নিয়ে এগোলেই বা কেমন হয়! ভিতরে ভিতরে একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করেছিল সেদিন, ধীরে ধীরে যেন প্রেমে পড়ে যায় যেন বিষয়টার; উপলব্ধি করে, এমন জিনিস আবিষ্কার হলে পৃথিবীর খোল-নলচেটাই বদলে যাবে।
এর মধ্যে তার গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট হয়েছে, দিল্লী আইআইটি থেকে মাস্টার্স। তারপরেই তো জুনিয়র সায়েন্টিস্টের পদের জন্য পরীক্ষা, তাতে পাশ। রঙ্গনাথনের অধীনে কাজ করার সুযোগ; তাঁর প্রজেক্ট, ‘ড্রিম ওয়ার্ক, দ্য রিয়েলিটি অফ ওয়ার্ম হোল।’ শুরু হয় কৃষ্ণেন্দুর স্বপ্নের দৌড়।
কিছুদিন পরেই একটা দুর্ঘটনা রঙ্গনাথন স্যারকে কেড়ে নেয়। অনেক টালবাহানার পরে প্রজেক্টটি স্থানান্তরিত হয় সাউথ পোলে, ভারতের গবেষণাকেন্দ্র দক্ষিণ গঙ্গোত্রীতে— সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ম্যাক তথা ক্রেগ ম্যাকমিলানের তত্ত্বাবধানে। এছাড়া বাকিরা কৃষ্ণেন্দু দাশ, লরা ইডেন, বরিস হেথমেয়ার।
প্রথমে সাউথ পোল শুনে সে একটু হলেও পিছিয়ে গেছিল, তারপরে ভেবেছিল যা হওয়ার হবে। চলে এসেছিল। এসে তো ঠাণ্ডাতে অভিযোজন হতেই একমাস লেগে গেছিল। তখন তো সে সারাক্ষণ হিটারের পাশেই বসে থাকত।
আজ সে জায়গা থেকে কতদিন হয়ে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয়, সব মরীচিকা। অবসাদ দেখলে ম্যাক বলেন, ‘নাথিং ইজ ইম্পসিবল ডিয়ার।’ সেও এখনও পর্যন্ত তেমনই ভাবে। লেগে থাকলে সাফল্য আসবে। কিন্তু কোথায় সাফল্য? অনেকগুলি সমস্যা তাদেরকে শেষ দৌড়ে পৌঁছাতে দিচ্ছে না। তার মধ্যে একটি অ্যান্টিগ্রাভিটিক ম্যাটার, অনুপম পদার্থ।
লরাও তার সহকারী গাণিতিক বিশেষজ্ঞ। গাণিতিকভাবে খুব ভালোভাবে কিছু সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। কিন্তু গণিত সমাধান করে দিলেও ফিজিক্স সেখানে পৌঁছাতে পারে না, কারণ ফিজিক্সে সমাধানই শেষ কথা নয়,তার বাস্তব প্রয়োগও থেকে যায়।
৪
– ব্যর্থতায় জীবনের পরাজয় নয়; তুমি এটাকে পরাজয় ভাবছ কেন, বিজয়? মানুষ কারও কেনা নয়, মনে রেখ। তোমার থেকে বেটার অপশন তারা পেয়েছে তাই তুমি হেরেছ। ব্যর্থতার গ্লানি দিয়ে পরাজয়কে মেপ না, নতুন উদ্যমে নেমে পড় আবার।
সঞ্জয়ের কথাগুলি শুনে উত্তর দিতে ইচ্ছে হল না বিজয়ের। সে ভাবছে সেই মানুষগুলোর কথা, বিজয় ব্যবস্থা না করে দিলে যারা খেতে পেত না তবুও সে হেরে গেল। তার চ্যালেঞ্জ এখন প্রশ্নের মুখে। মাথাটা নিচু করে একা একাই বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। কিছুদূর এগিয়ে গিয়েই কৃষ্ণেন্দুদের গোবিন্দের মন্দির। মন্দিরের মাধবীলতা গাছটা অনেকটা নীচে নেমে এসেছে। ঢুকতে গিয়ে বিজয়ের মাথায় হালকা করে হাত বোলানোর মত ছুঁয়ে গেল।
তখন মন্দিরে সন্ধ্যারতি চলছে। বিজয়ের সম্মুখে কেউ নেই। জনার্দন কাকা ডান হাতে পঞ্চপ্রদীপ, আর বাম হাতে ঘণ্টা নড়িয়ে নেচে যাচ্ছেন। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আরতি শেষ হলে মন্দিরের চাতালে এসে বসল।
মৃদু একটা হাওয়া নাকে এনে দিচ্ছিল মাধবীলতার সুমিষ্ট গন্ধ। পরিবেশ তাকে নিয়ে চলে গেছে কোনও এক সুদূর অতীতে। এর মধ্যে কত কিছুই সে ভাবতে লেগেছে। ইহজগৎ সীমাহীন, নিজের প্রত্যয় ভুলে সে কোনও অতীত ভ্রমণে বেরিয়েছে। ঠিক এই সময়ে জনার্দন কাকা এসে ঠিক পাশটাতে বসলেন। মাথায় হাত রাখতেই ধূসর অতীতকে পিছনে ফেলে সে ফিরে পেল বর্তমান। তিনি হাতে দিলেন গোবিন্দের প্রসাদ; মুখে প্রসাদটি নিয়ে মাথায় হাতটি বুলিয়ে নিল।
– কাকা কৃষ্ণেন্দু কেমন আছে? খবর কী তার? বাড়ি কবে আসবে? কিছু বলেছে?
– না রে বাবা, আমার সঙ্গে কথা কই হয়? ছেলেরা বড় হলে বাবারা দূরে সরে যায়। আমি তো গোবিন্দকে নিয়ে বেশ আছি। তবে তার মায়ের কাছে থেকে খবর পাই, ভালো আছে সে।
– সত্যিই কাকা, আমিও আজ কতদিন হল বাবাকে জিজ্ঞেস করিনি ভালো আছ? আমার ছেলেও একদিন এমন হবে। সেও এমন করবে। সেও হবে আজকের আমি বা কৃষ্ণেন্দু। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে বা কোন আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকবে। এর বাইরেও একটা জীবন আছে সেটাই হয়তো ভুলে যাবে। সেখানে কোনও পরাজয় নেই, আবিষ্কার নেই। একটা শান্তি আছে, একটা ছায়া আছে। যার তলে মাথা পেতে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকা যায়। ঘুম আসে সহজেই। আমরা যেন সেই ছায়াটা হারিয়ে ফেলছি নিজে নিজেই।
– হে গোবিন্দ, অবসাদ দূর কর। বাচ্চাদের ভালো রেখো গোবিন্দ। জীবন এত ছোট নয়, বিজয়। ধৈর্য ধর, সাফল্য আসবে। জীবনে কত ঝড়ঝাপটা আসবে, ভেঙে পড়লে হবে কী করে! পথচলার তো সবে শুরু। এগিয়ে যাও, বুঝতে শেখো মানুষকে, নতুনভাবে আবিষ্কার করো মানুষকে।
– আচ্ছা কাকা তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করব? জনার্দনের ঘাড় নড়ানো দেখে বিজয় আবার শুরু করল, এই যে কাকা আমি ছুটছি আমাকে জিততে হবে, মানুষের মন জয় করতে হবে। কৃষ্ণেন্দু ছুটছে তাকে আবিষ্কার করতে হবে, এর কী খুব প্রয়োজন আছে? এই সব না করলেও তো জীবনটা হেসে খেলে পেরিয়ে যেত। তোমরা তো খুব সাধারণ হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিলেন, আমরা পারি না কেন? কিসের আশায় ছুটছি?
– একেই তো বলে আত্মপ্রতিষ্ঠা। একটা বয়সের পরে সমস্ত জীবনের লক্ষ্য হয়ে যায় প্রতিষ্ঠা করা, সুনাম অর্জন করা। তোমরা এখন এর পিছনে ছুটছ; এর থেকে নিষ্কৃতি সহজ নয়।
বিজয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জনার্দন একটা গান ধরলেন। বিজয় যখন বাড়ির পথ ধরল তখন দূর থেকে আসা শেয়ালের ডাক এক প্রহরের ঘণ্টা দিল।
৫
মোড়টা ঘুরতেই একটা দোকান। দোকান ছেড়ে আরও মাইলটাক গেলে একটা সেলুন। সেখান থেকে বাঁ দিকে একটা গলি। সেই গলিটা পেরিয়ে গেলে শুরু হচ্ছে বড় রাস্তা। সেই রাস্তাতেই বিজয়ের বাড়ি। এছাড়াও রাস্তা আছে, তবে কৃষ্ণেন্দুদের মন্দির থেকে বিজয়দের বাড়ি যাওয়ার এটাই শর্টকাট। মন্দির থেকে উঠে বাড়ি যাওয়ার জন্য বিজয় এই রাস্তাটায় ধরল। কিছুদূর এগোতেই দেখল পকেটের ফোনটা গোঁ গোঁ করছে; বার করতেই দেখতে পেল, রত্না কলিং…। রিসিভ করতেই, হ্যালো—
– কোথায় তুমি? এত দেরি কর কেন? চিন্তায় মরে যাই।
– এই তো বাড়ি আসছি, এসে গেছি প্রায়।
– আচ্ছা, জলদি এস। দেরি হলে বাবুটা কাঁদে, ঘুমাতে চায় না, বোঝ না কেন?
– এই তো এলাম বলে।
ফোনটা কেটে যেতেই পকেটে আবার ফোনটাকে ঢুকিয়ে হন হন করে হাঁটতে থাকল বিজয়। রাস্তায় কুকুরগুলো অনবরত ডেকে চলেছে; বিরক্ত হয়ে বলল, হারামজাদারা সব চুপ কর। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আর কিছু না বলে ধীরে সুস্থে এগিয়ে গেল। সে জানে, তার এই রাজনীতি করা বাড়িতে কেউ পছন্দ করে না।
ছেলে হিসাবে কোনওকালেই খারাপ ছিল না বিজয়। কিন্তু গ্রাজুয়েশনে সে নিল পলিটিক্যাল সায়েন্স। তার স্যারেরা একটু অবাক হন, জিজ্ঞেস করেন, কেন? বিজয় উত্তর দেয়, আমি রাজনীতি করতে চাই। হ্যাঁ কলেজ লাইফ থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে সে। কলেজে জি. এস হয়। তারপর এখন তো গ্রাম্য রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
বাবা বলেন, কী দরকার? তুমি তো অন্য কিছুও করতে পারতে।
– সবাই অন্য কিছু করলে রাজনীতিটা করবে কে? গুণ্ডা, বদমাশরা?
– তাহলে তুমি কি ভাবো— একা দেশ পালটাবে?
– না, তবে আমি মাইলস্টোন হব। ভালো চাকরি নিয়ে বিদেশ গিয়ে নয়, রাজনীতির আঙিনায় ছাপ রেখে দেশ বদলাব। অনুপ্রেরণা দেব যুবসমাজকে। ভালো ছেলেরা তবেই তো আবার রাজনীতিতে আসবে। না হলে, সেই তো ব্রেন ড্রেইন।
বাবা আর কথা বাড়াননি। বাবার সঙ্গে এত কথার পরে রত্নাও কাছে আসেনি অনেকদিন। সেও ভীষণ অপছন্দ করত রাজনীতিকে। তার বংশ শেষ হয়ে গেছিল রাজনীতিতে। রাত্রিতে শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ হলেই কানে আসত রত্নার ফোঁপানির আওয়াজ। তখন চুপ করে ঘুমানোর ভান করা ছাড়া উপায় থাকত না। একসময় সকাল হয়ে যেত। উঠতেই দেখত রত্না কখন উঠে গেছে। সে তখন তাড়াতাড়ি উঠে, ছেলেটাকে ডাকত, ওঠ বাবা, বেলা হয়েছে।
এতসব ভাবতে ভাবতে সে গলির মুখটাতে চলে এসেছে। একটু দূরে তাকাতেই একটা টর্চের আলো যেন ইতস্তত করে সরে গেল। মনে হল কেউ যেন কিছুর সংকেত দিল। বিজয় চকিতে ঘুরে যেতেই একটা লোকে তাড়াতাড়ি একটা বাড়ির গলিতে ঢুকে গেল। তার সিক্সথ সেন্স যেন বলতে লাগল কিছু একটা হতে চলেছে। সে গলিটাতে না ঢুকে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। দাঁড়িয়ে যেতেই শুনতে পেল একটা শিসের আওয়াজ। সে পা-টা বাড়াতে গিয়েও আর বাড়ল না। এক পা এক পা করে পিছোতে লাগল। মস্তিষ্কে কাজ করছে না। ভাবল— কোথায় যাবে? কথায় আছে বিপদে বুদ্ধিনাশ; তার মনে কিছু আসছে না। গলির হালকা আলোয় সে দেখতে পাচ্ছে ছায়া মূর্তিগুলো বের হচ্ছে একে একে। ছায়া থেকে তারা যেন কায়া হচ্ছে।
আলোয় আসতেই সে দেখল, হাতে ধারালো কিছু চকচক করছে। সে বুঝে গেছে কী হতে চলেছে; ধরা পড়লে রত্নার বাবা, কাকা, ভাইয়ের মতো সেও… সে আর ভাবতে পারল না। চটিটাকে সে পা থেকে খুলে দিয়ে দৌড়াতে লাগল।
পিছন থেকে আওয়াজ আসতে লাগল, ধর শালাকে, মার শালাকে।
৬
তুষার পড়ার ক্ষেত্রে কোনও মাসের বাদ বিচার নেই এখানে। যে কোনও সময় আবহাওয়া বিগড়ে গেলেই তুষার ঝড়, তুষারপাত লেগেই থাকে। দৃষ্টিসীমা জুড়ে শুধু বরফ আর বরফ। হাফ বছর সূর্যদেবকে দেখায় যায় না। তবে আকাশে এই সময় বর্ণাঢ্য মেরুজ্যোতি দেখা যায়। এত সুন্দর রঙের মেলা পৃথিবীর আর কোনও জায়গায় দেখা যায় না। পেঙ্গুইনগুলোও মাঝে মাঝে তাদের গবেষণাগারের খুব কাছে চলে আসে। দামি ক্যামেরাটা নিয়ে খচাখচ ছবি তুলতে থাকে কৃষ্ণেন্দু; চিন্তা করে ওয়ার্মহোলটা যদি তারা করে ফেলতে পারত তাহলে এখনই মায়ের হাতে লাউঘন্ট আর গরম ভাত ঘি মেয়ে খেয়ে এসেই আবার কাজে যোগ দিত বা বাড়ি থেকেই ছোট্ট একটা এয়ারক্রাফটে করে প্রতিদিন যাতায়াত করত। এখানের শুকনো খাবার খেয়ে খেয়ে জিভ, পেট সবেই ঘেঁটা পড়ে গেল।
তাদের বৈষ্ণব পরিবার। মাছ-মাংস বাড়িতে ঢোকে না। কণ্ঠী বদল করে বিয়ে হয়। কৃষ্ণেন্দু অবশ্য ভেজিটেরিয়ান নয়। চিকেন, মাটন, বিফ, পর্ক সবই চলে। কিন্তু লরা পুরোপুরি ভেগান। কৃষ্ণেন্দু বলে, বৈষ্ণব আমি আর পালন করছ তুমি! বারে ভাই ধন্য। যাইহোক আমার মায়ের তোমাকে খুব পছন্দ হবে যখন জানবে তুমি মাছ-মাংস খাও না। আবার দুঃখও পাবেন যে তুমি প্রাণীজাত জিনিসও খাও না। মা হয়তো বলবেন, শুধু সেদ্ধ শাকপাতা খেয়ে কি বেঁচে থাকা যায়! তবে ওখানে গেলে বিয়ে করতে হবে। বিয়ে করবে তো? আমাদের কিন্তু কণ্ঠী বদল করে বিয়ে হয়।
লরা ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে বলে, কণ্ঠী বদল? সেটা আবার কী?
– লে হালুয়া, ওসব পরে বুঝবে। এখন শুধু ওয়ার্মহোল। এই বলে একটা প্রব্লেম লরার দিকে এগিয়ে বলে, সল্ভ ইট।
বরিস ওয়ার্মহোলের টেকনিক্যাল দিকটা দেখছে। ম্যাক অমায়িক হাসিখুশি ভদ্রলোক। গালে হালকা ব্রাউন দাড়ি। কোনওসময় খারাপ লাগা নেই, সর্বদা মুখে হাসি। কোনও কিছু করতে ইচ্ছে করলে ফেলে রাখা তার স্বভাবে নেই।
উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ডু ইট নাও। ফ্রেমলেশ চশমাটা তখন তার ধারালো নাকের ডগায় নেমে আসে।
আর বরিস একটু উলটো, চট করে হাসে না। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। সময়ের বাইরে একমুহূর্তও থাকে না। কাজের ব্যাপারে অত্যধিক সিরিয়াস।
কৃষ্ণেন্দুদের কাজটা অনেকটা এগিয়েছে। সেদিন ল্যাবে পরীক্ষামূলক ভাবে ওয়ার্মহোলটা তৃতীয়বার প্রায় তৈরি হয়ে গেছিল। ম্যাক আনন্দে যেই হাততালি দিয়ে উঠল অমনি সেটা ভেঙে গেল। বরিস একটা স্ল্যাং দিয়ে দিল।
ম্যাক হাসিমুখে বলল, ইটস ওকে, আমরা ওকে আবার দাঁড় করাব, ডোন্ট মাইন্ড।
কৃষ্ণেন্দু জানে গত দুই বছরে যে ক-বার তারা একটু হলেও ওয়ার্মহোলটা স্থায়িত্ব পেয়েছে তার মধ্যে আজকেরটা সবথেকে বেশি, প্রায় ২৫ সেকেন্ড। তাই মানে এই নয় যে ওয়ার্মহোল তৈরি হল আর মানুষ তাঁর মধ্যে দিয়ে যেখানে সেখানে ছুটতে লাগবে। এটা পরীক্ষামূলক, সর্বসাধারণের জন্য এই জিনিস তাদের জীবৎকালে আসবে না। তবে বলা যায় না আবিষ্কার হলেই বিভিন্ন কোম্পানি বরাত নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার ওয়ার্মহোলে পৃথিবীকে ছেয়ে ফেলবে। তখন একটা চুটকিতে এখান সেখান যাওয়া। তবে বার বার ব্যর্থতা মনকে বড় দূষিত করে তোলে। হতাশা গ্রাস করে, ক্লান্তি আসে। আক্ষেপে বেরিয়ে আসে নানা কথা,
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, বড় গল্প, বামাচরণ ভট্টাচার্য, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সুমন দাস