ভূত নয়
লেখক: অলোক চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
হালকা হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে সদর রাস্তার থেকে বাঁ দিকে ঘুরে গিয়ে রতন বলল— দেখ তো রাস্তাটা চিনতে পারছিস কিনা? তারপর দেবুর ঘাড় নাড়া দেখে নিজেই বলল— চিনতে পারার কথাও অবশ্য নয়। এই কুড়ি বছরে শহর এদিকটাতেই বেশিটা বেড়ে গেছে। নতুন ইন্ডাস্ট্রিগুলোও এদিকটাতেই এসেছে। ফলে সেই সরু মোরামের রাস্তাটা এখন ফোর লেন হাইওয়ে। পার্ক, মল, কর্পোরেট হাসপাতাল— সবটাই প্রায় গড়ে উঠেছে এ দিকেই। তা ছাড়া রাজগড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে যাবার এইটাই প্রধান সড়ক।
—চেনার তো কোনো উপায়ই নেই। খানিকটা স্বগতোক্তির মতোই বলল দেবু। —কোথায় সেই মাইলের পর মাইল বাঁজা জমি আর জঙ্গল। মাঝে মাঝে নিচু জলা জমি। সেখানে এই পরপর হাউসিং কমপ্লেক্স, মল আর দোকানপাট-বাজার।
দেবু অবাক চোখে রাস্তার দু-দিকে দেখছিল। বছর কুড়ি বাদে তার ছেলেবেলার এই শহরে সে এসেছে। তাও অফিসের কাজে। রেলের সেই ছোট্ট স্টেশন থেকে শহরের সবকিছু বদলে গেছে। আর এদিকটাতো একেবারে নতুন করে গড়ে উঠেছে। আগেকার সেই গাছপালা ভরা সবুজ শ্যামলীমা উধাও। এর ভেতর মাঝেমধ্যে দু-একবার এলে হয়তো তার এতটা আশ্চর্য লাগত না। কিন্তু তার বাবা-মা তিন-চারবার এলেও কোনও না কোনও কারণে দেবুর আর আসা হয়নি। ছেলেবেলার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে সকলেই প্রায় বাইরে, বড় শহরে চাকরিসূত্রে চলে গেছে। রতনই একমাত্র এখানে আছে। ওদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক ব্যাবসা। ওর সঙ্গে যোগাযোগও অবিচ্ছিন্ন। তবু আসা হয়নি। রতন অবশ্য কলকাতায় গেলে এখনও একটা দিন অন্তত ওদের বাড়িতেই কাটায়। ছেলেবেলার ওদের সেই বন্ধুত্ব এখনও অক্ষুণ্ণ।
আগের থেকে কথা হয়েই ছিল। ভোরবেলা ট্রেন থেকে নেমেই দেবু দেখল রতন ওকে নিতে স্টেশনে হাজির। ইউনিক ইন্ডাস্ট্রির থেকেও একজন ইঞ্জিনীয়ার এসেছিলেন ওকে রিসিভ করতে। তার কাছ থেকে ওদের গেস্টহাউসের জায়গাটা জেনে নিয়ে রতন ওঁকে জানিয়ে দিল আপাতত ওঁদের অফিস গেস্ট তার হেফাজতেই থাকবে। আজ রবিবার, রতনের ইচ্ছে ছিল রাতটাও দেবু ওদের কাছেই থাকুক। কিন্তু দেবুই বলল সন্ধের পরেই ও কোম্পানির অতিথিশালায় চলে আসবে। কালকের ইন্ডাস্ট্রি ভিজিটের আগে একটু হোমওয়ার্ক করে নিতে হবে।
সারাটা দিন কেটেছে নিরবচ্ছিন্ন আড্ডায়। বছর কয়েক আগে রতনের বিয়ে হলেও ওর বউ পর্ণার সঙ্গে দেবুর ভালো করে আলাপই হয়নি। বিয়েটা কলকাতায় হয়েছিল। সেখানে গেলেও বউভাতে এখানে আসা হয়নি অফিসের কাজের জন্যে। পর্ণা অবশ্য ওদের সম্পর্কের গাঢ়তার কথা রতন এবং তার বাবা-মা’র কাছ থেকে শুনে শুনে দেবুর ব্যাপারে সব কিছু জেনে গেছে। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে রীতিমতো রাগারাগি করেছে, দেবুর বউকে না নিয়ে আসায়। দেবু জানিয়েছে হঠাৎ আসা ঠিক হওয়ায় আনা সম্ভব হয়নি। কথা দিতে হয়েছে পরের বার নিয়ে আসবেই। সারাদিন পর্ণা ওদের স্মৃতিচারণায় ভাগ নিয়েছে। ঠাট্টা করে বলেছে— মনে হচ্ছে একটা টাইম মেশিন জাতীয় কোনও যন্ত্রের ব্যবস্থা থাকলে তোমরা আবার সেই ছেলেবেলার আড্ডায় পৌঁছে গিয়ে ওখানেই থেকে যেতে।
—আহা, তেমনটি যদি হত। দেবু আর রতন একসঙ্গে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছে।
দুপুরে খেতে বসে হঠাৎ কথাটা মনে হল দেবুর। —হ্যাঁ রে, তুই তো ইউনিকের ওই ভদ্রলোকের থেকে ওদের গেস্টহাউসের ডিরেকশনটাও নিলি না। জায়গাটা চিনবি কী করে?
—যখনই বললেন চিল্ড্রেন্স পার্কের পাশের বাড়ি তখনই বুঝে গেছি। তুইও চিনিস জায়গাটা। পাল সাহেবের বাংলো মনে আছে? সেই যেখানে আমরা ভূত দেখেছিলাম?
ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি ছবির মতো মনে থেকে যায়। এটাও সেরকম। তবে দেবু সেকথায় না গিয়ে প্রতিবাদের সুরে বলল— আমরা দেখেছিলাম মানেটা কী? দেখেছিলাম তো আমি। তুই তখনও ওটা ‘আমাদের’ ভূত দেখা বলে চালাবার চেষ্টা করতিস।
আগেকার দিন হলে এটা নিয়ে একটা ঝগড়ার সূত্রপাত হতে পারত, কিন্তু এতদিন বাদে দেখা বলেই হোক বা পর্ণার উপস্থিতির জন্যেই হোক, রতন তর্কের দিকে গেল না। —আহা, ওটা গৌরবে বহুবচন। আর তা ছাড়া শব্দটব্দগুলো তো আমিও শুনেছিলাম। তুই ভয় পেয়ে ওরকম অজ্ঞান মতন না হয়ে গেলে আমিও ফুটোয় চোখ রেখে ভূতটাকে দেখতে পারতাম।
—কি করে দেখতিস? দেবু বলল। —সেটা তো আমার চোখের সামনেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ে মিলিয়ে গিয়েছিল।
ভূতের গল্পের গন্ধ পেয়ে পর্ণা ওদের থামাল। —ঠিক আছে দেবুদা, তোমার জন্যেই ও না হয় একটু ভূতের গুঁড়োও দেখতে পায়নি। কিন্তু ঝগড়া থামিয়ে গল্পটা একটু শোনাবে কি?
—ভূত আবার কি? রতনের বাবা বললেন। —সারাদিন সমানে দৌড়ঝাঁপ আর হইচই করে ক্লান্তির চোটে ভুলভাল কিছু দেখেছিল। দৃষ্টিবিভ্রম। তবে পর্ণা ছাড়বার পাত্রী নয়। যেমনই হোক, একটা ভূতের গল্পের গন্ধ পেয়ে সে ছাড়তে রাজি নয়। খাবার টেবিলেই তাই গল্পটা বলতে হল দেবুকে।
সত্যিই ঘটনাটা বড় অদ্ভুত ছিল। দেবুর বাবার এই শহর থেকে ট্রান্সফার হয়ে কলকাতা চলে যাবার বছর দুয়েক আগের ঘটনা। দেবু-রতনদের বয়েস তখন দশ বা এগারো। প্রবাসি বাঙালি কয়েকটা পরিবার একসঙ্গে মিলে ছুটির দিনে, বিশেষ করে শীতের দিকে, শহরের আশপাশে কোনও বনবাংলো বা পি.ডাব্লু.ডি. বাংলোতে সারাদিন পিকনিক করতেন। ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে ডিনার অবধি সেরে ফেরা। নিজেদের গাড়িতেই যাতায়াত, কাজেই ফেরার তাড়াও থাকত না। সব পরিবারেই দু-একটি নানা বয়সের বাচ্চাকাচ্চা। তাদের কাছে ওই আউটিংগুলোর দারুণ আকর্ষণ ছিল। সেবারে আর কোথাও সরকারি বাংলো ফাঁকা না থাকায় কেউ একজন পাল সাহেবের বাংলোতে ব্যবস্থা করেন। সেটা যদিও শহরের কাছে কিন্তু জায়গাটা চমৎকার। বিরাট বাড়ি। পাল সাহেবরা বিদেশে থাকতেন। কখনও এলে দু-তলা বাড়ির ওপরের তলাটায় থাকতেন বলে সেই অংশটা বন্ধ থাকত। মস্ত বাড়ির একতলার পুরোটা কেয়ারটেকার খুলে দিত অতিথিদের জন্যে। পাশে বিশাল বাগান, পুকুর নিয়ে অনেকটা জায়গা। সারাদিন সেখানে হইচইয়ের পর সন্ধেবেলা সবাই বাড়ির মধ্যে। সামনের হলঘরে বড়রা টিভিতে সিডি প্লেয়ার জুড়ে সিনেমা দেখার ব্যবস্থা করেছে। হলের লাগোয়া একটা ছোট ঘরে ছ-সাতজন বাচ্চা নিজেদের মতো খেলায় ব্যস্ত। সেই ঘরটার আর একটা দরজা খুলত সামনের করিডরে ওপরে যাওয়ার সিঁড়ির সামনে। সে দরজাটাও বাইরে যাবার দরজা, তাতে একটা ম্যাজিক আইও লাগানো, তবে বাইরের দিক থেকে তালাবন্ধ। ওদের খুব পছন্দের খেলা ছিল ডার্ক রুম। একজন চোর হবে, বাকিরা অন্ধকার ঘরে যে যার মতো লুকোবে। চোরের কাজ হল অন্ধকারের মধ্যে সোফার পেছন, খাটের তলা কিংবা আলমারির পাশ থেকে কাউকে খুঁজে বার করে তার নাম বলা। ঠিকমতো বলতে পারলে দান শেষ। পরের জন চোর হবে। এমনিতে বেশ শান্তিপূর্ণ খেলা কিন্তু চোর কাউকে ধরে ফেললে সমবেত চিৎকারে কানের পর্দা ফাটার উপক্রম হত। বড়দের কাউকে ধমক দিতে হত সেই শোরগোল থামানোর জন্যে।
সে রকমই খেলা চলছিল। বয়সে একটু বড় সোনাদিদি সবেমাত্র শুভমের ঠ্যাং ধরে সোফার পেছন থেকে বার করে জয়ের উল্লাসে চ্যাঁচাচ্ছে এমনি সময়ে হঠাৎ ওপর তলাতে ঝনঝন করে কাচ ভাঙার শব্দ। সবাই চ্যাঁচানি বন্ধ করে চুপ। সিঁড়ি দিয়ে কে বা কারা যেন ধুপধাপ শব্দ করে নেমে আসছে। সোনাদিদি হাতের শিকার ছেড়ে সোজা বড়দের আসরে গিয়ে ঘটনাটা জানাল। তবে বড়রা কেউ ওরকম কোনও আওয়াজ পায়নি। ওপর তলায় কেউ থাকে না, সিঁড়ির দরজাও তালাবন্ধ। ওরা নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে। কাজেই সোনাদিদিকে ক্ষুন্ন মনে ফিরে এসে আবার চোর হতে হল কারণ যাকে ধরেছিল তার নাম বলার সুযোগ পায়নি।
পরেরবার রতনকে প্রায় ধরেই ফেলেছিল, এমন সময়ে ওপরের তলা থেকে স্পষ্ট শোনা গেল কে যেন ঘড় ঘড় শব্দ করে ভারী ফার্নিচার জাতীয় কিছু সরাচ্ছে। সোনাদিদি কাঁপা গলায় বলল— ভূত না-কিরে? তারপরেই সোজা বাইরের ঘরে। তার পেছনে বাকিরাও। অন্ধকারে শুধু বসেছিল দেবু আর রতন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর দেবু বিরক্ত গলায় বলেছিল— ভূত না হাতির মাথা। মাঝখান থেকে খেলাটা ভন্ডুল। চল আলোটা জ্বালিয়ে নিই।
রতন সুইচে হাত দেবার আগেই হঠাৎ আলো চলে গেল। হলঘরেও নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। একজন কেউ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল। নির্ঘাৎ সোনাদিদি। বড়দের কেউ ধমকেও উঠলেন। তবে তারই মধ্যে দেবু আর রতনের কানে এল একটা অন্য আওয়াজ। কারা যেন কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। —এসব কী হচ্ছে বলতো? রতনের গলাটাও যেন কেঁপে উঠল। দেবু ছিল বাইরের দরজার পাশেই একটা টুলের পেছনে। কী যেন হল, সে হঠাৎ টুলের ওপর উঠে সোজা চোখ রাখল দরজার ম্যাজিক আইতে। সেখানে অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।
ঠিক সেই সময়ে বাগানের গেটের কাছে ওদেরই কোনও একটা গাড়ির ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে হেড লাইট জ্বালিয়েছিল। কিছুটা আলো এসে পড়েছিল বাড়ির করিডরে, সিঁড়ির সামনে। সেই আলোতে দেবু দেখতে পেয়েছিল দুজন লোক সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। ল্যান্ডিং-এ একটু দাঁড়িয়ে তাদের একজন এগিয়ে আসছিল তাদের ঘরের দরজার দিকেই। দেবু শরীরের ভেতর একটা প্রচণ্ড ভয়ের অনুভুতিতে তখন চিৎকার করতেও ভুলে গেছে। অন্য লোকটা কী ভেবে যেন এগিয়ে আসা লোকটার হাতটা ধরে তাকে আটকালো। সেই মুহূর্তে যেমন আচমকা আলো চলে গিয়েছিল তেমনই হঠাৎই আলো চলে এল। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে দেবুর বিস্ফারিত চোখের সামনে লোকদুটো কেমন যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আতঙ্কে গলা দিয়ে কোনও শব্দই বেরোচ্ছিল না দেবুর। সারা শরীর কাঁপছিল। ওর অবস্থা দেখে রতন তক্ষুনি বড়দের ডেকে আনে। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে কিছুটা সুস্থ করার পর দেবুর মুখে ঘটনাটা শুনে কয়েকজন বেরিয়ে গিয়ে খোঁজ করে দেখে দোতলার সিঁড়িতে আগের মতই তালা ঝুলছে। চৌকিদারও জানিয়েছিল ওঁরা ছাড়া আর কেউ বাইরে থেকে আসেনি বা বাইরে যায়নি। রতনদের ড্রাইভার জানায় ওরা কয়েকজন গেটের পাশে খাটিয়ায় বসে খাবার খাচ্ছিল, হঠাৎ আলো চলে যাওয়ায় গাড়ির হেডলাইট চালু করেছিল সেগুলো গুছিয়ে তোলার জন্যে। কাজেই ওই সময়ে কেউ বেরোলে তারা ঠিকই দেখতে পেত।
রহস্যটা রহস্যই থেকে যায়। কেউ কেউ বলেছিল সারাদিন হুল্লোড় করার পর হয়তো হঠাৎ ঘুমের ঝোঁক এসে গিয়ে দেবু স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু রতন বলেছিল দেবু একটুও ঘুমিয়ে পড়েনি। ম্যাজিক আইতে চোখ লাগিয়েই থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছিল। তবে সেই ঘটনার পরে আর কখনও ওরা পাল সাহেবের বাংলোয় পিকনিক করতে যায়নি।
রাস্তার বাঁ দিকে একটা আলো ঝলমলে পার্ক। তার পরেই বাঁদিকে চওড়া গেট। সেই বাড়িটাই কি? স্মৃতির সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করল দেবু। সামনের বড় বড় গাছওয়ালা মস্ত বাগানটা বদলে গিয়েছে হেজ দিয়ে ঘেরা হাল ফ্যাশানের ঘাসে ঢাকা লনে। পাশের জঙ্গল পুকুর সমেত জায়গাটা পাঁচিল দিয়ে ঢেকে ওদিকটাতেই চিলড্রেন্স পার্ক তৈরি হয়েছে। তবে বাড়ির চেহারাটা মোটামুটি একই রকম রয়েছে। লন পেরিয়ে চওড়া কোলাপসিবল গেট। ভেতরে ঢুকেই চওড়া করিডোর। ডান হাতে ওপরে যাবার সিঁড়ি। আগের মতোই সেখানেও কোলাপসিবল গেট, তবে খোলা। বাঁ দিকে ওদের সেই খেলার ঘরটার দরজা। ওপরে লেখা— অফিস। তালাবন্ধ। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেই সেই বিশাল হলঘরটা। ওরা ঢুকতেই পেছন দিকের কিচেন থেকে কেয়ারটেকার বেরিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানাল। জানা গেল শোবার ঘরগুলো ওপরতলায়। গার্ড গাড়ি থেকে দেবুর সুটকেশটা নিয়ে সোজা ওপরেই চলে গিয়েছিল। এখন কেয়ারটেকারের সঙ্গে ওরাও উঠল ওপরে। ছিমছামভাবে সাজানো ঘর। একপাশে পর্দা ঢাকা টানা জানলা। তার সামনে দুটো সিংগল সোফা, মধ্যে নিচু স্টুলে পোর্সিলিনের বড় ফুলদানিতে নকল গোলাপের গুচ্ছ। অন্যপাশে সাইড টেবিল লাগানো খাট। পাশে ছোট অফিস টেবিল। একটা চাকা লাগানো চেয়ার। তাতে বসে রতন বলল— নাঃ, বন্দোবস্ত ভালোই। সামনের জানলাটা খুলে দিলেই পার্কের ভিউ পাবি। হাওয়াও আসবে।
দেবু মনে মনে ভাবছিল এই ক’বছরে কী বিপুল পরিবর্তন। সেই নিঝুম পরিবেশ এখন ট্রাক আর বাসের শব্দে ভরপুর। কোথাও লাউড স্পিকারে গান বাজছে। সম্ভবত পাশের পার্কের থেকেই বাচ্চাদের সমবেত উল্লাসধ্বনি ভেসে আসছে মাঝে মাঝেই। ভাবতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেলল। চেঁচামেচি তারাও কি কম করছিল নাকি? সঙ্গে সঙ্গে মনে হল রাত প্রায় ন’টা বাজে। চিলড্রেন্স পার্ক কি এখনও খোলা?
একজন বেয়ারা এল জলের বোতল আর সাবান তোয়ালে ইত্যাদি নিয়ে। তাকেই দেবু বলল পার্কের দিকের জানলাটা খুলে দিতে। সেটা খুলতে যেতেই বিপত্তি। বেয়ারার পা লেগে পোর্সিলিনের দামী ফুলদানিটা উলটে পড়ে খান খান হয়ে ভেঙে গেল। সে তো অপ্রস্তুতের একশেষ। তাড়াতাড়ি নিচে ছুটল ঝাড়ু আনতে।
—ভাবছিলাম জানলা দিয়ে দেখব এত রাতে পার্কে কোনও বাচ্চারা খেলছে। দেবু বলল। —আমাদের সময়ে ভেবে দেখ, স্ট্রিট লাইট জ্বলে গেল মানেই বাড়ি ফেরা। আর এখন?
—এখন পরিষ্কার না করা পর্যন্ত ওদিকে যাস না। চারদিকে ভাঙা টুকরো ছড়ানো। বলতে বলতে ঘড়ি দেখল রতন। —আরে, ন’টা বেজে গেছে প্রায়। আমি চলি।
—একটু দাঁড়া। ঘরটা সাফ করে গেলে আমিও তোর সঙ্গে নীচে যাব।
বেয়ারাটি ফেরত এল ঝাড়ু, মোছার বালতি ইত্যাদি নিয়ে। সোফা দুটো ঘড় ঘড় করে টেনে সরিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে দিল জানলার সামনেটা। সে যেতেই রতন উঠে পড়ল, সঙ্গে দেবুও উঠে জানলার সামনে দাঁড়াল। উঁকি মেরে পার্কের দিকে দেখে বলল— এদিকটায় তো বাচ্চা ছেলেমেয়ে কেউ নেই।
—চলে গেছে হয়তো এর মধ্যে। রতন বলল। —চল, নামা যাক।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মাঝের ল্যান্ডিং পেরিয়ে সামনের ঘরের তালাবন্ধ দরজাটার দিকে দেখিয়ে রতন বলল —ওই দেখ, সেই ম্যাজিক আইটা এখনও রয়েছে। দু-একটা সিঁড়ি নামা তখনও বাকি, এমন সময়ে রতনের কথার মধ্যেই হুট করে সব আলো নিভে গেল।
—সাবধানে নাম। এক্ষুনি লাইট এসে যাবে। কোনও কারণে ট্রিপ করেছে। রতন বলল। নেমে এসে কী ভেবে যেন দু-পা এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দরজাটার দিকে। অন্ধকারটা একটু ফিকে। রাস্তার দিক থেকে একটুকরো আলো এসে পড়েছে। মনে হয় বাইরের রাস্তায় কোনও গাড়ি ব্যাক করছে।
আচমকা দেবুর সারা শরীরে যেন হাজার ওয়াটের বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রতনের একটা হাত ধরে আটকালো তাকে। —কোথায় যাচ্ছিস?
—কোথায় আবার? ওই দরজার ম্যাজিক আইটা দিয়ে হঠাৎ আমাদের খেলার ঘরটাতে একটু উঁকি মারার ইচ্ছে হল। বলল রতন। কিন্তু ওর হাত শক্তভাবে ধরে দেবু টেনে আনল ওকে।
—কী হল? রতন অবাক। অনুভব করল ওর হাত ধরে থাকা দেবুর হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে।
—আগে বাইরে চল, সব বলছি। দেবু চাপা গলায় বলল। আলোটাও ফিরে এল সেই মুহূর্তেই।
রতনের গাড়িটার সামনে এসে তারপর কথা বলল দেবু। —তুই কিছু বুঝতে পেরেছিস?
—কী বুঝব? রতনের গলায় কৌতুহল।
—পর পর ঘটনাগুলো সাজা। আমরা ওপরের ঘরে বসে কথা বলছিলাম। কোত্থেকে যেন অনেক বাচ্চার চেঁচামেচির শব্দ আসছিল। একটু পরে হলেও দেখেছি পার্কে সে সময়ে বাচ্চাকাচ্চা কেউ ছিল না।
—হ্যাঁ। তাতে হয়েছেটা কী?
—তারপর ফুলদানিটা পড়ে গিয়ে ভাঙ্গল। দেবুর গলা চাপা উত্তেজনায় যেন কাঁপছে। —বেয়ারাটা তক্ষুনি ধুপধাপ শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
—হ্যাঁ, কিন্তু—
—তারপর ফিরে এসে সোফাদুটোকে টেনে সরাল। মাঝে পরিষ্কার করার জন্যে। আমরা কথা বলতে বলতে নিচে নামলাম। শেষ কয়েকটা ধাপে আসতেই আলোটা হঠাৎ নিভে গেল। তোর কিছু মনে হচ্ছে না?
—কী মনে হবার কথা বলছিস?
—বাইশ বছর আগের সেই সন্ধেটার কথা মনে কর। আমরা ওই ঘরটাতে খেলছিলাম। হঠাৎ ওপরের খালি ঘর থেকে কাচের মতো কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ। সিঁড়িতে ধুপধাপ করে কারো নেমে আসার আওয়াজ। তারপর ফার্ণিচার সরানোর শব্দ। কারা যেন সিঁড়ি দিয়ে কথা বলতে বলতে নামছিল। আলো নিভে গেল। আমি লাফিয়ে উঠে ম্যাজিক আইতে চোখ রাখলাম। দুজন লোক। গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে পড়েছে। একজন অন্যজনের হাত ধরে টেনে নিল।
—কী বলছিস এসব, রতনের গলাও যেন একটু কেঁপে গেল এবার।
—সায়েন্স ফিকশনে টাইম লুপের কথা পড়েছি। দেবুর গলার স্বর এখন অনেকটা স্বাভাবিক। —সময় তার সোজা পথে একমুখো চলতে চলতে মাঝে মাঝে নাকি ঘুরে যায়। একটা গিঁটের মতো পাকিয়ে যায় কোথাও কোথাও। সময়ের একটা বিন্দুতে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ আলাদা কিছু থাকে না। আমরা বোধহয় এক্ষুনি সেই রকম একটা মুহূর্ত পেরিয়ে এলাম।
—তার মানে তুই বলতে চাইছিস…
রতনের কথাটা শেষ হবার আগেই দেবু বলল— বলতে চাইছি, বাইশ বছর আগে সেই সন্ধেবেলায় আমি ভূত নয়, ভবিষ্যৎ দেখেছিলাম।
Tags: অলোক চট্টোপাধ্যায়, কল্পবিজ্ঞান গল্প, টিম কল্পবিশ্ব, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা