লুব্ধক: ১৮
লেখক: এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“অনুপলাল?”
“কল হোনেওয়ালা টেলি-কনফারেন্স কা খবর লিয়া?”
খচমচ খচমচ করতে করতে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল হৃষ্টপুষ্ট চেহারার অনুপলাল। পেশার চেয়ে নেশাই তাকে বেশি বিখ্যাত করেছে। তার প্রিয় নেশা খাদ্য। পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা তাকে দেখলেই ‘মোটে মাল’ বলে খ্যাপায়, ছড়া কাটে:
মোটে মাল খাস্তা
পুরি কচৌরি নাশতা
পুরি কচৌরি ঘট গিয়া (কমে গেছে)
মোটে মাল উলট গিয়া।
এখন কিন্তু অনুপলালের মাথা থেকে খাবার চিন্তা উবে গেছে। জবরদস্ত মামলা চলছে। ভারতের একাশি নম্বর উপগ্রহ লুব্ধক-১৮-কে মহাকাশের যে কক্ষপথে তোলা হবে, সেই অবস্থান নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে জাম্বিয়া। তার সঙ্গে ম্যাও ধরেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এগারো নম্বর পঞ্চবার্ষিকী যোজনায় এই উপগ্রহের খুব জরুরি ভূমিকা। তাই ভারত থেকে বাঘা বাঘা সব উকিল আন্তর্জাতিক আদালতে নিজেদের পক্ষ সমর্থন করে লড়ে যাচ্ছেন। অনুপলালের সাহেব হেমন্তকুমার বাগচি তাঁদের মধ্যে একজন। মামলার প্রস্তুতি চলেছে জোর কদমে। কাল একটা আলোচনা বসবে পাটনার বাগচি, দিল্লির সেন আর বোম্বাইয়ের তারাপুরওয়ালার সঙ্গে। অথচ কেউ কারও জায়গা ছেড়ে নড়বেন না। এখন কেউ আর প্লেনে যাতায়াত করে সময় নষ্ট করেন না, সব মিটিং উপগ্রহ মারফত ব্যক্তিগত টেলিভিশনে হয়। হেমন্তবাবু সকালবেলা চেম্বারে নেমে এসে সেই খোঁজটাই করছিলেন।
বয়স সত্তর পেরিয়েছে হেমন্ত বাগচির বেশ কিছুদিন, কিন্তু খেলাধুলো করা শরীর, একসময় কলেজ টিমে ক্রিকেট খেলেছেন— তাই বয়স খুব একটা কাবু করতে পারেনি। এখনও রোজ সকালে খালি হাতে ব্যায়াম করেন, সন্ধেবেলা নিয়ম করে গান্ধী ময়দানে এক চক্কর মেরে আসেন। কাজ বেশি থাকলে এক চক্কর হয়তো হয় না, তবু অন্তত আধ চক্কর হেঁটে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের সামনে তাঁদের ময়দানের ক্লাবের অন্য সদস্যদের সঙ্গে একটু খোশগল্প করে তবে গাড়িতে ওঠেন। উর্দু শায়রি থেকে শুরু করে প্রবাসী বাঙালিদের মাতৃভাষাচর্চা, উপনিষদ, তুলসীদাস, খেলাখুলো সব বিষয়ে তরুণ যুবকের মতো টগবগে আগ্রহ। খোলা মন নিয়ে ছেলে-ছোকরা সকলের সঙ্গেই তিনি মিশতে পারেন। বাগচিসাহেব তাই শহরসুদ্ধু লোকের হেমন্তদা। আন্তর্জাতিক মহলে নামডাক থাকা সত্ত্বেও তাঁর চেম্বার যে কোনও স্তরের লোকের কাছে অবারিত দ্বার। বাইরে ডাকসাইটে আইনজীবী এই ভদ্রলোকের কালো কোটের তলায় ঢাকা আছে অতি নরম স্নেহশীল একটি হৃদয়। তা না হলে খচমচে অনুপলালকে কবেই বিল্বিপত্তর শোঁকানো হয়ে যেত।
অনুপলালের কাজকর্মে গাফিলতি লেগেই থাকে। অন্য উকিলেরা এর প্রতি হেমন্তবাবুর প্রশ্রয়ের মনোভাব দেখে আশ্চর্য হন। কিন্তু হেমন্তবাবু জানেন, সাতটি ছেলেমেয়ের বাবা অনুপলাল অন্য কোথাও কাজ করতে গেলে অনেক রকম ঝামেলায় পড়বে। ওই সাত ছেলেমেয়ের ব্যাপারটা কেউ রিপোর্ট করে দিলেই তো প্রমোশন বন্ধ। কী দরকার। তার চেয়ে উকিলের মুনশি হিসেবে দু-পয়সা রোজগার করছে করুক না।
অথচ জরুরি মামলা পড়লে অনুপলালের ওপর পুরো বিশ্বাস রাখা যায় না। মাঝখান থেকে দুই জুনিয়র সচ্চিদা আর জয়রামের দায়িত্ব বেড়ে যায়। আজ অবশ্য আসন্ন টেলি-কনফারেন্সের প্রস্তুতির জন্যে হেমন্তবাবু ওদেরও ডেকেছেন। বিশাল জটিল মামলা, আইনগুলো নতুন হলেও এই নিয়ে অন্য দেশে বিচারকরা কোথায় কী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তার সম্পূর্ণ রেফারেন্স হাতের কাছে রাখতে হবে। টেলি-কনফারেন্সের বাঁধা সময় দেড় ঘণ্টা। হঠাৎ সেন কিংবা তারাপুরওয়ালা জানতে চাইলে পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করে সময় নষ্ট করা তো সম্ভব নয়। এ তো সেই যুগ নয় যে, অঢেল সময়, শলা-পরামর্শ করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে থেকে রাত, মাঝে মাঝেই ট্রে-তে করে চা আর শিঙাড়া আসছে। আসছে পান আর জরদা, পুড়ছে দেদার সিগারেট। সেসব হেমন্তবাবুর বাবার আমলে ছিল। এখন সিগারেট কবেই বেআইনি হতে গেছে, কারও পকেটে সিগারেটের প্যাকেট পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আর সময় এখন অনেক বুঝেসুঝে খরচ করতে হয়। অন্য অনেক দিকে সেই গোরুর গাড়ির গতি হলে কী হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে, তা আজ থেকে বিশ বছর আগে স্বপ্নেও আন্দাজ করা যায়নি। জীবনের প্রথমদিকে ট্রেনে আর প্লেনে চড়ে কত অমূল্য সময় বাজে খরচ হয়ে গিয়েছে, ভেবে হেমন্তবাবুর মাঝে মাঝে আপশোশ হয়।
কিন্তু আপশোশ নিয়ে বিলাসিতা হেমন্তবাবুর চরিত্রে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এমনটা আগে হলে বেশ হত, যাক গে, এখন যখন হয়েই গিয়েছে, তাঁকে মেনে নিতেই হবে। এই হল তাঁর মনোভাব। তবে দ্রুত গতির সঙ্গে সকলেই কি আর পাল্লা দিতে পারে! মাঝে মাঝে কীরকম অসুবিধে দেখা দিতে পারে, তার মূর্তিমান প্রমাণ তাঁর অনুপলাল। মোটে মাল খাস্তা মনে মনে বলেই হেমন্তবাবু নিজেকে এক ধমক দিলেন। এ কী ছেলেমানুষি!
‘অনুপলাল!’ আর-একবার হুংকার ছাড়লেন উনি।
শব্দ হল খচমচ খচমচ। শুধু জুতো নয়, অনুপলালের সর্বশরীরে নতুন চামড়ার খচমচানি। হাঁপাতে হাঁপাতে এ ঘরে ঢুকে সে বইয়ের আলমারি খোলার উদ্যোগ করতে লাগল।
কড়া চোখে তাকিয়ে হেমন্তবাবু বললেন, ‘এটা কী হচ্ছে?’
‘মানে, স্যার, ওই এয়ারোস্পেস ভায়োলেশন কেসটার…’
‘এতক্ষণে আপনি বই খুঁজতে শুরু করেছেন? কাল ক-টার সময় কনফারেন্স? তার মধ্যে সব রেফারেন্স খুঁজে বার করতে পারবেন আপনি? চারবার তো চা আর কচুরি খাবার জন্য দৌড় লাগাবেন তার মধ্যে।’
অনুপলাল মাথা চুলকোতে লাগল। ইশ্, আটটা বেজে গিয়েছে। রাজিন্দরের দোকানে এখন গরম গরম সমোসা ভাজা হচ্ছে। বেঞ্চি পেতে বসে গিয়েছে বিড়লা মন্দির দেখতে-আসা পুণ্যার্থীরা। আর অনুপলালকে কিনা চার পয়সার জন্যে এই জাম্বিয়া, তানজানিয়া আর ভগবান জানে, কোন কোন সব মুলুকের মামলা নিয়ে মাথা খারাপ করতে হচ্ছে। উকিলসাহেব একবার কাজে ডুবে গেলে তাঁর আর খিদে-তেষ্টা বলে কিছু থাকে না। ভগবান কী ধাতু দিয়ে তাঁকে বানিয়েছেন, তিনিই জানেন। কিন্তু রক্তমাংসের শরীর তো ঘোড়ার মতো, তাকে মাঝে মাঝে দানাপানি না দিলে সে ছুটতে পারে কখনও?
‘গুড মর্নিং, স্যার।’ লম্বা লম্বা পা ফেলে জয়রাম শর্মা ঘরে ঢুকল। তাকে দেখে খুশি হলেন হেমন্তবাবু। এবারে তাহলে কাজকর্মে স্পিড আসবে।
প্রথমেই অনুপলালকে আলমারির সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে জয়রাম বলল, ‘ছোড়িয়ে, ছোড়িয়ে, হমকো দেখনে দিজিয়ে।’ তারপর হেমন্তবাবুর দিকে তাকিয়ে ঈষৎ অনুযোগের সুর জুড়ে দিল, ‘কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনার এইসব জার্নালের আলমারি অনুপলালের মতোই এ যুগে অচল।’
হেমন্তবাবু স্পষ্টবক্তা এই যুবকটিকে খুবই ভালোবাসেন। তাই তার সমালোচনাও হাসিমুখে সহ্য করেন। জয়রামের বহুদিন থেকেই ইচ্ছে, পুরোনো আইনের কেতাব ও পত্রিকার আলমারিগুলো বাতিল করে অতি আধুনিক আইনের ক্যাসেটের লাইব্রেরি চালু হোক। কম্পিউটারের বোতাম ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব রেফারেন্স পর্দায় ফুটে উঠবে। কত অল্প আয়াসে হয়ে যাবে সবটা।
স্মিতমুখে চুপ করে রইলেন হেমন্তবাবু। তাহলে অনুপলাল বেচারার অন্ন উঠবে। উনি যে এরকম পরিবর্তনের কথা ভাবেননি তা নয়। কিন্তু অনুপলালের পক্ষে কম্পিউটার চালানোর বিদ্যা আয়ত্ত করা বোধহয় পশ্চিমদিকে সূর্য ওঠার মতো ঘটনা। মুখে অন্যরকম কথা বলেন তিনি।
‘বাপ-দাদার আমলের এইসব আলমারি আর আইনের বই। এ কি বললেই বাতিল হয়ে যায়, জয়রাম! আমার প্রপিতামহের সই-করা সব বই, সন ১৮৮৫। এর মূল্য আমার কাছে তোমার ওই কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি।’
‘সে মানছি, স্যার,’ চটপট উত্তর দেয় জয়রাম, ‘কিন্তু সেন্টিমেন্ট ধুয়ে জল খেতে থাকলে আমরা উপোস করে মারা পড়তাম, টেকনোলজির দৌড় শুরু হবার আগেই হেরে বসে থাকতাম। এই একাশি নম্বরকে আর মহাকাশে তুলতে হত না।’
হেমন্তবাবু বললেন, ‘দাঁড়াও, একাশি নম্বর আগে উঠুক। তারপর বোলো।’
‘কেন উঠবে না, স্যার? আশিটা উপগ্রহ যখন বনবন করে ঘুরছে, খারাপ হলে এখান থেকে পার্টস পাঠিয়ে মেরামত করাও চলছে ইচ্ছেমতন, তা ছাড়া বলুন স্যার, আর ক-টা দেশের এতগুলো উপগ্রহ আছে—ভারত ছাড়া?’
হেমন্তবাবু বললেন, ‘কারণও আছে। আজ থেকে বিশ বছর আগে স্টার ওয়ার নিয়ে মাতামাতি করে সবরকম দরকারি রিসার্চ তো বন্ধ করে বসেছিল তারা, যাদের হাতে তখন টেকনোলজির সোনার কাঠি। নিজেদের সুযোগ নিজেরা হেলায় হারালে, নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারলে এইরকমই হয়।’
জয়রাম বললে, ‘আর এখন অন্যের সমৃদ্ধি দেখে চোখ টাটাচ্ছে। একে-ওকে ওসকাচ্ছে। লাগাও মামলা। বুদ্ধির প্যাঁচে হারাও। কিন্তু স্যার, ওখানেও তো ফক্কা।’
হেমন্তবাবু মুচকি হাসলেন। ইতিমধ্যে একটু ধীরেসুস্থে তাঁর অন্য জুনিয়র সচ্চিদানন্দ চৌধুরীর প্রবেশ। এই দুজন তাঁর ডান হাত ও বাঁ হাত। এদের নিয়ে যখন তিনি আদালতে প্রবেশ করেন, তখন অপর পক্ষের উকিলদের হৃৎকম্প শুরু হয়। এতকাল শুধু দেশের চৌহদ্দির মধ্যে এঁর পসার সীমাবদ্ধ ছিল, সম্প্রতি মহাকাশ আইন নিয়ে বেশ কয়েকটি মামলা জিতে আন্তর্জাতিক আদালতেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
মহাকাশের যে অংশে নানা দেশ থেকে তোলা উপগ্রহের ভিড়, সেখানে মোটামুটিভাবে ভারতের প্রাধান্য স্বীকৃত। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক অবধি প্রতিযোগিতা ছিল তীব্র, কিন্তু একটা নতুন সংকর ধাতু তৈরি করে ভারতের মহাকাশবিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা একলাফে অনেকটা এগিয়ে গেলেন। তারপর একের পর এক যোগাযোগ উপগ্রহ উঠতে লাগল, প্রায় মাসে একটা করে। আগে অন্য দেশের হাতে-পায়ে ধরে উৎক্ষেপণের ব্যবস্থা করতে হত, এখন সেদিক দিয়েও অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। সব মিলিয়ে পাঁচটি উৎক্ষেপণকেন্দ্র আছে পূর্ব উপকূলে, আর কন্যাকুমারীর গা ঘেঁষে আরও একটি। তা ছাড়া ত্রিঙ্কোমালি, চট্টগ্রাম এবং পেশোয়ারে ভারতেরই সঙ্গে সহযোগিতায় শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মহাকাশকেন্দ্রগুলি চলছে। তাদের নিজেদের লোকজনের একটু অভাব, তাই ভারত বিশেষজ্ঞদের ধার দিয়েছে, কোনওরকম পূর্বশর্ত ছাড়াই। তা ছাড়া একসময়ে যেসব দেশ মহাকাশবিজ্ঞানে এগিয়ে ছিল, তারা প্রয়োজনমতো ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের ধার চায়। যুদ্ধ-যুদ্ধ করে নাচানাচি না করে তারা যদি সত্যিকার ভালো ভালো কাজের জন্য টেলি-যোগাযোগ আর উপগ্রহ প্রযুক্তিব্যবস্থাকে কাজে লাগাত, তাহলে তাদের আর এই দুর্দশায় পড়তে হত না। তবু একসময় যারা মহাকাশে একচেটিয়া রাজত্ব করেছে, মাঝে মাঝে তাদের অহংবোধে আঘাত লাগে। তারা চেষ্টা করে, কী করে ভারতের অপ্রতিহত গতিকে কোনওমতে ঠেকানো যায়। মারামারি-কাটাকাটির দিন এখন গত। তার জন্যেও ভারতকেই প্রধান ভূমিকা নিতে হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট অশোকের (অনেকে তাঁকে গোপনে সম্রাট দ্বিতীয় অশোক বলে ডাকেন) দূরদৃষ্টি, কূটনীতি ও মানবপ্রেমের ফলে সমস্ত পৃথিবীর যত যুদ্ধবিগ্রহ ছিল, সব একেবারে থেমে গিয়েছে। এখন যা ঝগড়া-বিবাদ, তার নিষ্পত্তি হয় অতিশয় সুসভ্য কায়দায়—আইন-আদালতের সাহায্য নিয়ে। সুতরাং বলাই বাহুল্য, আইনজ্ঞদের প্রতিপত্তি এখন প্রায় আগেকার কালের রাজনৈতিক নেতাদের মতো। তফাত এই যে, তাঁদের সকলে শ্রদ্ধা করে, গালমন্দ করে না। তাঁদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে, কারণ ভালো আইনজীবী হতে গেলে কারও কাছে হাতজোড় করতে হয় না, খোশামুদি করতে হয় না কারও।
উপগ্রহ সংক্রান্ত ব্যাপারে মামলা-মকদ্দমা একটু বেশিই হয়, আগে যেমন জমিজমা নিয়ে হত। দুই ভাইয়ের মধ্যে তুচ্ছ একটু অংশ নিয়ে লাঠালাঠি, হয়তো আচমকা এক লাঠির ঘায়ে একজনের মাথা ফাটল, মৃত্যু হল। তারপর অপরাধীর সাজা, যাবজ্জীবন আন্দামানে কারাভোগ, আন্দামান অবশ্য পরে ভারতের উপগ্রহ উৎক্ষেপণের প্রশিক্ষণ ঘাঁটি হয়েছে, মহাকাশ গবেষণার বড় কেন্দ্রও সেখানে। দেশ-বিদেশের প্রযুক্তিবিদদের প্রশিক্ষণ চলে, সুবিধে হল, দু-চারটে রকেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যদি পড়েও যায়, কারও মাথায় পড়বে না, বঙ্গোপসাগরের জলে গিয়ে আছড়াবে। তবে এখন পরিচালন আর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যেরকম নিখুঁত হয়েছে, তাতে লক্ষ্যভ্রষ্ট বস্তুকে ফিরিয়ে আনা বা ইচ্ছেমতো নির্জন সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া খুবই সহজ হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ বিকল হয়ে কোনও মহাকাশচারী যন্ত্র পৃথিবীর বুকে ভেঙে পড়বে, এমন আশঙ্কা কোটিতে একটি।
ভারত একসময়ে পরমাণুশক্তি নিয়ে খুব মাথা ঘামিয়েছিল, পরে তার ভালো ভালো বিজ্ঞানী চলে এলেন মহাকাশবিজ্ঞানে। বুদ্ধিমান লোকেরা বুঝেছিলেন, এইদিকেই আছে ভবিষ্যতের সীমাহীন সম্ভাবনা, বিশেষ করে এরকম ছড়ানো দেশে, যেখানে সকলের মধ্যে মনের মিল বজায় রাখা মস্ত সমস্যা। ভৌগোলিক দূরত্বকে অতিক্রম করার চমৎকার রাস্তা এই উপগ্রহ যোগাযোগ। তাই আজ পাটনায় নিজের অফিসঘরে বসে হেমন্ত বাগচি পরামর্শ করতে পারছেন দিল্লি সুপ্রিম কোর্টের পারিজাত সেন আর বোম্বাই হাইকোর্টের হোমি তারাপুরওয়ালার সঙ্গে। মক্কেলের পয়সার সাশ্রয় হচ্ছে, যদিও মক্কেল এখানে ভারত সরকার। তবু টাকা তো টাকাই। আর সরকারের টাকা তো সাধারণ মানুষেরই গচ্ছিত ধন।
সচ্চিদা চৌধুরী উত্তেজিত হলেই পকেট থেকে শুকনো পানের গুলি নিয়ে টপ করে মুখে পুরে ফ্যালে, তবে এমনিতে মানুষটি ঠান্ডা প্রকৃতির, কেউ তাকে কখনও রাগতে দেখেনি। অফিসে ঢুকেই সে একটি পানের গুলি মুখে পুরে নোটবই বার করল। হেমন্তবাবু ভাবলেন, ভাগ্যিস, এখন পান টেকনোলজিতে বিপ্লব এসেছে, তা না হলে এইসব পানরসিকের পিক ফেলার ঠেলায় আমার একটিও ফুলগাছের পাতা সবুজ থাকত না।
একফোঁটাও সময় নষ্ট না করে সচ্চিদা বলল, ‘লাস্ট তিন বছরের রিপোর্ট সব উলটেছি, স্যার, আমার মনে হয়, এই তিনটে পয়েন্ট এই কেসে আমাদের কাজে লাগতে পারে।’
‘কই দেখাও।’ হেমন্তবাবু চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন। রিডিং গ্লাস একটা আছে, তবু খালি চোখেই সুবিধে হয়। তা ছাড়া ছেলে একটা অটো ম্যাগনিফায়ার কিনে দিয়েছে, তার সামনে যে-কোনও চিলতে কাগজে লেখা খুদে খুদে অক্ষরও গোটা গোটা হয়ে ফুটে ওঠে। হেমন্তবাবু পারতপক্ষে সেটি ব্যবহার করেন না। ভগবানের দেওয়া চোখ যখন রয়েছে, তার সদ্ব্যবহার করাই ভালো। যখন পারা যাবে না, তখন দেখা যাবে।
সচ্চিদা বলল, ‘এই যে দেখুন, তিন বছর আগে চিন বনাম ভারতের এই মামলার রায়…’
হেমন্তবাবু একনজর দেখেই বললেন, ‘ও হ্যাঁ, স্যাটেলাইট সিলিং অ্যাক্টের তিনের চার ধারা। জজ এই অ্যাক্টের সম্পর্কে কটাক্ষ করেছিলেন, পয়েন্টটা তুমি ভালো ধরেছ, সচ্চিদা। মনে হয়, ওটা এই কেসে আমাদের শক্ত খুঁটি হবে।’
২
পারিজাত সেনের চুল ছেলেদের ধরনে ছাঁটা, কাঁচায়-পাকায় মেশানো। কথা বলেন জলপ্রপাতের মতো, তার অর্ধেক ইংরেজি, বাকিটা হিন্দি আর বাংলায় খিচুড়ি। সারাজীবন দিল্লিতে থাকার ফলে বাংলা ক্রিয়াপদের প্রয়োগ করেন উলটো-পালটা। কিন্তু তিনি অকুতোভয়। যত জটিল অবস্থাতেই পড়ুন, সামলে দেবার আশ্চর্য ক্ষমতা এবং আইনের জ্ঞান তাঁকে এই বিয়াল্লিশ বছর বয়সেই অ্যাডভোকেট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আন্তর্জাতিক, বিশেষ করে মহাকাশ আইনের বেশ কিছু মামলায় পারিজাত হেমন্তবাবুর সঙ্গে কাজ করে বুদ্ধিকে আরও শানিত করেছেন। এই মামলায় তারাপুরওয়ালাই একমাত্র নতুন লোক—তাঁর ক্ষেত্র টেকনোলজি-সংক্রান্ত আইন। যে সংস্থাটি লুব্ধক-১৮-র সবরকম যন্ত্রাংশ নির্মাণের দায়িত্বে আছে, ইনি তাদের তরফের উকিল। শুধু কোম্পানির স্বার্থ দেখা ছাড়াও এঁকে এই মামলায় নিযুক্ত করার প্রধান কারণ, লুব্ধক-১৮-র কলাকৌশল এত খটমট যে, কেবলমাত্র আইনবিদের পক্ষে সব দিক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা সম্ভব নয়।
হোমি তারাপুরওয়ালার এক পূর্বপুরুষ ছিলেন আদি যুগে পরমাণুশক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান, ভারতের যা কিছু পারমাণবিক প্রযুক্তিগত উন্নতি, তার অনেকটাই তাঁর ব্যক্তিত্ব, কল্পনাশক্তি ও কর্মক্ষমতার গুণে। বোম্বাই অঞ্চলে এই পরিবারের প্রবল প্রতাপ। এঁদের সকলেই নানা দিকে ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন, কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ ব্যাবসা, কেউ আইনে। এঁদের জীবনযাত্রার ধরনধারণও খুব বিলাসবহুল। এই মামলায় তারাপুরওয়ালার কোম্পানি চেয়েছিল, অন্তত হপ্তাখানেকের জন্য এই তিন আইনজীবীকে মহাবালেশ্বরের কাছে তাদের বিশেষভাবে তৈরি জঙ্গলের বাংলোতে নিয়ে গিয়ে রাখতে। সেই জঙ্গলের নাম থিংক ফরেস্ট, চিন্তারণ্য। সেখানে বুদ্ধিমান ও প্রতিভাশালী ব্যক্তিরা পায়চারি করতে করতে চিন্তা করেন, সবরকম ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা থেকে দূরে, কেউ সেখানে তাঁদের বিরক্ত করার অনুমতি পায় না। এই চিন্তারণ্যে কয়েকদিন কাটাবার আমন্ত্রণ খুবই সম্মানের ব্যাপার, ডাকসাইটে লোকেরাও এর জন্য লালায়িত হয়ে থাকেন। এমনকী, প্রেসিডেন্ট অশোকও উনিশশো অষ্টআশির শেষ লড়াইয়ের সময় এখানে পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা কাটিয়ে তিন সেনাধ্যক্ষের সঙ্গে রণকৌশল ঠিক করেন। কিন্তু হেমন্ত বাগচি আর পারিজাত সেন এই আমন্ত্রণ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন।
বাগচি বলেছিলেন, ‘থ্যাংক ইউ তারাপুর, কিন্তু আমার একটু তাড়া আছে যে।’
‘কীসের তাড়া?’ তারাপুর তো অবাক।
‘ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাব।’
‘ক্রিকেট!’ তারাপুর এরপরে সম্পূর্ণ বাক্যহারা। তা ছাড়া আজকাল আর মাঠে গিয়ে খেলা দ্যাখে কোন মূর্খ?
হেমন্তবাবু তাঁর অবস্থাটা হৃদয়ঙ্গম করে মনে মনেই হাসলেন। মুখে বললেন, ‘দ্যাখো, নাতিকে কথা দিয়েছি, যেতেই হবে।’
‘তা বেশ তো, নাতিকে সঙ্গে নিয়ে আসুন। এখান থেকেই দেখবেন।’
‘কিন্তু ম্যাচটা হবে যে কলকাতায়।’
‘আপনি নিশ্চয়ই কলকাতায় গিয়ে হাজির হয়ে ম্যাচ দেখার কথা ভাবছেন না?’
‘ঠিক তা-ই। এখান থেকেই বুলেট ট্রেনে কলকাতা পাঁচ ঘণ্টা। ফেরাও তা-ই। একদিন থাকতে হবে, কেননা খেলা শুরু হচ্ছে সকাল ন-টায়। চলবে বিকেল পাঁচটা অবধি।’
‘অল রাইট। আমার কোম্পানিকে বলে যদি ওই ম্যাচটা ওয়াংখেড়েতে খেলার ব্যবস্থা করে দিই!’
‘তা কী করে হবে? কলকাতার ওই স্টেডিয়ামে যত লোক আঁটে, তার অর্ধেকও যে ওয়াংখেড়েতে ধরবে না।’
‘মি. বাগচি, আপনাকে আমি যত শ্রদ্ধা করি, বোধহয় পৃথিবীতে আর কাউকে তা করি না। আপনি তো জানেন, এ কথা যে-কোনও লোক, একজন পাগলও জানে যে, আজকাল স্টেডিয়ামে টিকিট বিক্রিতে টিকিট ছাপার পয়সাও ওঠে না।’
‘মি. তারাপুর, এটা বিশেষ ম্যাচ। আপনি একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। তবে আই অ্যাম সরি, আপনার থিংক ফরেস্টের নেমন্তন্নটা এবার থাক। আপাতত আমরা যে যার জায়গা থেকেই আলোচনাটা সেরে ফেলি।’
‘যেমন আপনার ইচ্ছে,’ চুপ করে গেলেন তারাপুর। ‘তাহলে আলোচনার দিন আর সময়টা ঠিক করতে বলে দিই। তবে এখনও ভেবে দেখুন, সময় থাকতে থাকতে ওয়াংখেড়েতে ম্যাচটা খেলিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
ফোন নামিয়ে রেখে হেমন্তবাবু স্মিতমুখে চুপ করে রইলেন। মনে পড়ে গেল তাঁর দাদুর মুখে শোনা গল্প। আউধের নবাবকে নিয়ে গিয়েছেন ইংরেজ রেসিডেন্ট ফুটবল ম্যাচ দেখাতে। কোম্পানির হোমরাচোমরা অফিসারদের মধ্যে দুই দলে খেলা। দারুণ উত্তেজনা। ধুলোকাদা মেখে ঘর্মাক্ত কলেবরে যখন খেলোয়াড়রা মাঠ ছাড়ছেন, রেসিডেন্ট নবাবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন দেখলেন?’
নবাব মাথা চুলকে বললেন, ‘হ্যাঁ, বেশ ভালোই তো। তবে এত কষ্ট করে ধুলো-ময়লা মাখার কী দরকার ছিল—চাকরদের দিয়ে খেলিয়ে নিলেই হত। বলেন তো ওয়াংখেড়েতে খেলিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দিই! হাঃ।’
পারিজাত সেন তাঁকে বলেছিলেন, ‘আরে, তারাপুরের কথা ছাড়ুন দাদা। একবার হয়েছিল কী—গিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। বসার ঘরের মাঝখানে একটা ফোয়ারা। বলে কী, আই লাভ দ্য সাউন্ড অব রানিং ওয়াটার। ছ্যাঃ। ক্যাসেটে জলের শব্দ শুনলেই পারে। আমাকেও বিরক্ত করে মারছিল। থিংক ফরেস্ট, থিংক ফরেস্ট। আরে ছোড়িয়ে সাব—আমার মাথায় এখন একাশিটা মামলার ভূত সওয়ার আছে।’
‘বলো কী, প্রত্যেকটা উপগ্রহের জন্য একটা?’
‘কী যে বলছেন দাদা, ওটা বাত কি বাত। কিন্তু আমাদের তাহলে একসঙ্গে বসার দিনটা একটু অনুপলালকে বলুন ঠিক করতে। আপনার খেলা দেখতে যাবার দিনটা বাঁচিয়ে।’
পারিজাত নিজে তেমন ক্রিকেটের ভক্ত না হলেও ভালো জিনিসের মর্ম বোঝেন। আর সত্যি বলতে কী, কম্পিউটারকরণের পর থেকে ক্রিকেটের আর সেই মজা নেই। বল করার সঙ্গে সঙ্গে যদি তার গতিপথ, অ্যাঙ্গল, ইমপ্যাক্ট, ফোর্স—সবই জানা হয়ে যায়, তাহলে ব্যাটসম্যান বেচারার অবস্থা হয় অনেকটা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো। তারাপুর কিছু ভুল বলেননি। খেলিয়ে দেওয়াই বটে। সেই অনিশ্চয়তা, কোথা দিয়ে কী হয়ে যাবে উত্তেজনা—এসব বাদ দিলে তাকে কি আর ক্রিকেট বলা যায়? আজকালকার ছেলেমেয়েরা অবশ্য এই নিয়েই মত্ত। তাঁর নাতি জিবু একজন মস্ত ক্রিকেট ফ্যান। তাকে নিয়েই কলকাতা যাবার পরিকল্পনা আছে। তবে এই লুব্ধক-১৮ নিয়েই হয়েছে যত গণ্ডগোল। অন্য বিশেষ কারণটা ছাড়াও রিটায়ার করার আগে রবি শাস্ত্রীর এটাই হবে শেষ খেলা। যতই গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবী-কাঁপানো মামলা হোক, তার জন্যে কি এরকম একটা ঘটনা বাদ দেওয়া যায়!
অনুপলালকে ডাকতে গিয়ে দেখেন, যথারীতি তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। লোকটা আরও কত মোটা হতে চায়? নির্ঘাত রাজিন্দরের দোকানে বেঞ্চি টেনে পুরি-তরকারি সাঁটাতে বসে গিয়েছে। সাধে কি ছেলেরা ওর পিছনে লাগে, পুরি-কচৌরি ঘট গিয়া, মোটে মাল উলট গিয়া। কিন্তু হঠাৎ পাশের ঘর থেকে হুড়মুড় দুড়দাড় শব্দ। খচমচ আওয়াজ তুলে হাঁপাতে হাঁফাতে দরজার সামনে উদয় হল অনুপলাল। মুখ-চোখ দেখে মনে হয়, ভূমিকম্প হয়ে মাথার ওপর ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে বুঝি।
‘গজব হো গিয়া, সাব, গজব হো গিয়া,’ বহু কষ্টে কথাগুলো উচ্চারণ করল সে।
‘হয়েছেটা কী?’ একটু বিরক্ত হলেন হেমন্তবাবু, ‘বাত ক্যা হ্যায়?’
‘রাষ্ট্রপতি ভবনসে আর্জেন্ট কল। ক্যা করেঙ্গে, সাব, গজব হো গিয়া,’ অস্থির হয়ে হাত-পা ছুড়তে লাগল সে। জিবু মানে হেমন্তবাবুর নাতি এইজন্যেই আড়ালে এর নামকরণ করেছে খাঁচু মুনশি।
হেমন্তবাবু একেবারেই অবাক হলেন না। উনি জানতেন, লুব্ধক-১৮-র মামলায় রাষ্ট্রপতি ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহ নিচ্ছেন। আগ্রহ কে নিচ্ছে না? পথেঘাটে অফিসে-বাড়িতে দোকানে-বাজারে স্কুলে-কলেজে কারখানায় সর্বত্র এই একই আলোচনা। ভারতের পরবর্তী পঞ্চবার্ষিকী যোজনার প্রধান ভিত্তি লুব্ধক-১৮-র মহাকাশে পাঠানো বন্ধ করার জন্য যারা উঠেপড়ে লেগেছে, সেইসব দুশমন জব্দ হোক। বিকেলে আজান দেওয়ার সময় তার সঙ্গে ইকসবি সদিকে চিরাগ যেন উজ্জ্বল থাকে, দীর্ঘায়ু হয়, তার জন্য আল্লার কাছে দোয়া করা হয়। গালিবকে সাক্ষী মেনে সভাসমিতিতে বলা হচ্ছে, তুমি জিও হজার বরস/ অউর হর বরসকে দিন হো পচাস হজার।
তুমি হাজার বছর বেঁচে থাকো। প্রত্যেক বছর যেন থাকে পঞ্চাশ হাজার দিন। এই উপগ্রহের সঙ্গে ভারতের একশো কোটির ভাগ্য এক সুতোয় জড়িয়ে আছে। কাজেই প্রেসিডেন্ট যে আগ্রহ প্রকাশ করবেন, তাতে চমকে যাবার কিছু নেই।
হেমন্তবাবু নির্বিকার গলায় বললেন, ‘তা ঘাবড়াবার কী হয়েছে? এ ঘরে লাইনটা দিতে বলুন।’
অনুপলাল আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘অঙ্গরেজিমে ইয়া হিন্দিমে?’
‘তামিলমে,’ বলেই সুইচ অন করলেন হেমন্তবাবু। পর্দায় সৌম্যকান্তি মুণ্ডিতমস্তক প্রেসিডেন্ট অশোকের চেহারা ফুটে উঠল। দু-হাতে নমস্কার জানিয়ে তিনি বললেন, ‘গুড মর্নিং, মি. বাগচি। আপনাদের শলাপরামর্শ কবে নাগাদ হচ্ছে? সব ঠিকঠাক আছে তো?’
‘গুড মর্নিং, রাষ্ট্রপতিজি। হ্যাঁ, সব তো ঠিকই এগোচ্ছে। আজই আমরা পরবর্তী আলোচনার সময় ঠিক করব। পারিজাতের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে। তারাপুর এখনও সময় দেয়নি।’
‘উড ইউ মাইন্ড, আমি যদি সে আলোচনায় উপস্থিত থাকতে চাই?’
‘উপস্থিত থাকতে?’ একটু বিস্মিত হলেন বাগচি।
প্রেসিডেন্ট একটু ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বললেন, ‘মানে হুক আপ করে নিতে চাইছি—আমি শুধু দেখব, শুনব, আপনাদের কী কথাবার্তা হচ্ছে।’
‘আমার তো মনে হয় না তাতে কোনও লাভ হবে। তবে আপনি যদি তা-ই চান…’
‘না, না, না। ডু নট টেক ইট আদারওয়াইজ। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আমরা কীরকম টেনশনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।’
‘আশা করছি, শিগগির তার অবসান হবে এবং বেশ সন্তোষজনকভাবে। নমস্কার।’
পর্দা থেকে ছবি মিলিয়ে গেল। মিলিয়ে যাবার আগে রাষ্ট্রপতির প্রসন্ন কান্তিতে একটু হতাশার আলগা ছায়া ফুটে উঠেছিল। বাইরে থেকে খচমচ শব্দে দৌড়ে এসে অনুপলাল জিজ্ঞেস করল, ‘লাইন কট গিয়া সাব?’
‘না, আমিই কেটে দিলাম। আপনি কি এতক্ষণ নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন? বোম্বাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এক বছর লাগিয়ে দেবেন মনে হচ্ছে।’
ঘাড় চুলকে নিজের ঘরে ফিরে গেল অনুপলাল। তিন মিনিট পরে ফিরে এসে জানাল, ‘তারাপুরওয়ালা আমাদের দেওয়া টাইমে রাজি আছেন।’
‘বাঃ বাঃ। এবার তাহলে জয়রাম আর সচ্চিদাকে খবর দাও।’ কাগজপত্র খুলতে খুলতে হেমন্তবাবু ভাবলেন, প্রেসিডেন্ট হঠাৎ মাথা কামালেন কেন? এটাও কি লুব্ধকের মঙ্গল কামনা করে? কে জানে! আর হুক আপ করতে চাওয়ার অনুরোধ? সে তো উনি ইচ্ছে করলেই পারেন।
৩
চশমাটা নামিয়ে রেখে সোজাসুজি তাকালেন তারাপুরওয়ালা। হেমন্তবাবুর টিভি পর্দায় তাঁর ক্লোজ আপে দেখা গেল চোখের তলায় ক্লান্তির ছোপ। চুলটাও আঁচড়ানো হয়নি ভালোভাবে। মনে হয়, সারারাত জেগেছেন।
তিনি বলছিলেন, ‘আমি আপনার দৃষ্টি ১৯৯১-এর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল মেটিরিয়ালস স্টক পাইলিং অ্যাক্টের দিকে আকৃষ্ট করতে চাইছি। এতে বলা হয়েছে, দেশের সুরক্ষা, অর্থব্যবস্থা এবং শিল্প উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ভাঁড়ার যেন এমন থাকে, যাতে পরবর্তী দশ বছরে উন্নয়নের পথে কোনও প্রতিবন্ধক সৃষ্টি না হয়।’
পারিজাত সেনের গলা বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘পরবর্তী দশ বছরের গুনতিটা কীরকম হচ্ছে? ইজ দ্য টাইম পিরিয়ড ওভার অর নট?’
বক্তৃতায় বাধা পেয়ে তারাপুর চশমাটা চোখে দিয়ে বক্তার দিকে তাকালেন, পর্দার অর্ধেক অংশ জুড়ে এবারে পারিজাত, তিনি ইতিমধ্যেই লম্বাহাতা সাদা ব্লাউজ ও কালোপাড় শাড়ি পিন দিয়ে কাঁধে এঁটে কোর্টে বেরোবার জন্যে তৈরি। তারাপুর একটু কেশে নিয়ে বললেন, ‘আপনি যদি দয়া করে দেওয়ালে ঝোলানো শতাব্দীর ক্যালেন্ডারের দিকে তাকান, তাহলেই আমার কিছু বলার দরকার হবে না।’
মুচকি হেসে পারিজাত বললেন, ‘কিন্তু স্যার, আপনি বোধহয় ভুলে গিয়েছেন, শতাব্দী সবে শুরু। আমি আমার ডেস্কে গত শতাব্দীর ডেটা ভরতি করে ভিড় বাড়াই না। দেওয়ালে লটকানো ক্যালেন্ডার! সে হয়তো আপনাদের ওদিকে এখনও চালু আছে।’
আবহাওয়া অনর্থক গরম হয়ে উঠছে দেখে এবার হেমন্ত বাগচি এগিয়ে আসেন। তাঁর পর্দায় অবশ্য তাঁকে দেখা যাবে না, বাকি দুজন দেখবেন তাঁর চেহারা। বাগচি বললেন, ‘অনর্থক সময় নষ্ট করা কেন? মি. তারাপুর, আমাকে অনুগ্রহ করে বলুন, এই অ্যাক্ট চালু হয় ১৯৯১-এর কোন মাস থেকে?’
‘এপ্রিল। টু বি প্রিসাইস, ১৮ এপ্রিল।’
‘চমৎকার। এবার তাহলে আমার দুই সম্মানিত বন্ধুকে আমি আজকের তারিখটার দিকে মনোযোগ দিতে বলব।’
বাকি দুজন সমস্বরে বললেন, ‘১৮ এপ্রিল। গুড গুড।’
পারিজাত চেয়ার ছেড়ে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে এক পাক নেচে নিলেন, তারপর বাংলায় বললেন, ‘হেমন্তদা, আপনার কোনও তুলনা নেই।’
তারাপুর কটমট করে তাকিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর অর্থ কী?’
হেমন্তবাবু বললেন, ‘যেতে দিন, যেতে দিন।’
পারিজাত বললেন, ‘যেতে দেব কেন? এর অর্থ, আমি আপনাকে টুপি তুলে সেলাম জানাচ্ছি।’
তারাপুর বললেন, ‘হুঁ। তার মানে অ্যাক্টের মেয়াদ আজই শেষ হচ্ছে। আগামীকাল থেকে কোনও আদালতেই এই অ্যাক্ট প্রয়োগ করা যাবে না।’
বাগচি বললেন, ‘থ্রি হেডস আর বেটার দ্যান ওয়ান। তাহলে আসুন, আমরা চিন্তা করে দেখি, পরবর্তী দশ বছরে যেন উন্নয়নের প্রতিবন্ধক সৃষ্টি না হয়, এই কথাগুলি সম্পর্কে। লুব্ধক-১৮ উৎক্ষেপণের কথা ছিল কবে?’
তারাপুর তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘জাম্বিয়া ইনজাঙ্কশন নেওয়াতে উৎক্ষেপণ তিন মাস পিছিয়ে গেল। ডেট ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ, সেই তারিখটা ভালোভাবেই ওই দশ বছর সময়সীমার মধ্যে থাকছিল, এই তো?’
‘মোস্ট সার্টেনলি।’
‘তাহলে তো আমরা বলতে পারি, এই ইনজাঙ্কশনের ফলে আমাদের সুরক্ষা, অর্থব্যবস্থা ও শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি বাইরের শক্তি দ্বারা প্রতিবন্ধক সৃষ্টি হয়েছে।’
পারিজাত দ্বিধাভরে বললেন, ‘বাইরের শক্তির ওপর এই আইন প্রযুক্ত হবে কি না, সেটাও বিবেচ্য।’
‘এই আইন না হলে অন্য আইনের সাহায্য নিতে হবে।’ গম্ভীর গলায় বললেন হেমন্তবাবু।
‘যেমন?’ জিজ্ঞেস করলেন তারাপুরওয়ালা। তাঁর গলায় আত্মপ্রত্যয়ের কিছুটা অভাব।
‘যেমন, এই হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে মানুষের মৌলিক অধিকার আইনের চোদ্দো ধারা।’ খসখস শব্দ হল। ‘তারপরে দেখুন, আমরা আসছি উন্নয়নমূলক কাজে বাধা না-দেবার অঙ্গীকার-সংক্রান্ত চুক্তিতে—খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটা…’
তারাপুর জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কি আমাদের বর্তমান কেসটার ব্যাপারে প্রয়োগ করা যাবে? তা ছাড়া চুক্তি তো চুক্তি—অ্যাক্ট নয়। আদালতে টিকবে বলে মনে হয় না।’
বাগচি বললেন, ‘ওটাকে আমরা অধিকারের বৃহত্তর আওতার মধ্যে টেনে আনতে পারি।’
‘কী করে?’ তারাপুর সন্দেহ প্রকাশ করলেন।
‘এটা আমার দাদার বহস করার কায়দার ওপর ছেড়ে দিতে পারি, মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে, ফলানা ফলানা।’
বাগচি বললেন, ‘কী উলটো-পালটা বকছ! রবীন্দ্রনাথ ভালো করে পড়লে না কোনওদিন, তোমার কী হবে বলো তো?’
তারাপুর বললেন, ‘হোয়াট ওয়াজ দ্যাট?’
বাগচি বললেন, ‘কোটেশন ফ্রম টেগোর। কিন্তু এক্ষেত্রে এটা প্রয়োগ করা যাবে না।’
‘ভেরি স্ট্রেঞ্জ!’ তারাপুর বিস্ময় প্রকাশ করলেন, ‘টেগোর অতদিন আগে এইসব অ্যাক্টের কথা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, আমি যতদূর জানি, তখন, মানে টেগোরের টাইমে মহাকাশ নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথাই ছিল না।’
হেমন্তবাবু বললেন, ‘সেটার জন্যেই তো টেগোরকে নিয়ে এত হইচই। যাক গে, আমাদের আগেকার পয়েন্টে ফিরে আসা যাক।’
পারিজাত বললেন, ‘প্রথমেই মনে হয়, জাম্বিয়ার আপত্তির কারণটা আমরা বিচার করে দেখি। তারপর তাদের যুক্তিগুলো কী করে ছিন্নভিন্ন করা যায়, সেটা হবে পরবর্তী পদক্ষেপ।’
তারাপুর বললেন, ‘ওদের প্রধান পয়েন্ট স্যাটেলাইট সিলিং অ্যাক্ট। আমরা এই একাশি নম্বর দিয়ে যে-কোনও একটি রাষ্ট্রের মহাকাশে উপগ্রহ স্থাপনের ঊর্ধ্বসীমা পেরিয়ে যাচ্ছি।’
‘যে-কোনও একটি রাষ্ট্র—কথাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করা যাক,’ বললেন পারিজাত।
হেমন্তবাবু বললেন, ‘তুমি বলে যাও, আমরা শুনছি।’
‘যে-কোনও একটি রাষ্ট্র কথাটা এখানে একটু মিসলিডিং। যে-কোনও রাষ্ট্র নয়, যেসব দেশের মহাকাশ টেকনোলজি উঁচু দরের, মানে যারা উপগ্রহ চালানোর ক্ষমতা রাখে, তারাই। যাদের কোনওরকম এক্সপার্টিজই নেই, তাদের আবার ঊর্ধ্বসীমা কী! তাদের বেলায় ঊর্ধ্ব, নিম্ন, দক্ষিণ, বাম কোনও সীমাই অর্থহীন। যেমন ধরুন জাম্বিয়া। তাদের আশি তো দূরের কথা, আধখানা উপগ্রহও মহাকাশে দেখতে পাওয়া যাবে না।’
‘সত্য কথা,’ এই প্রথম পারিজাত সেনের সঙ্গে একমত হলেন তারাপুর, ‘আধখানাও নেই।’
‘সে তো অনেক দেশেরই নেই। যার যেমন প্রয়োজন, সেই অনুযায়ী তো টেকনোলজির ব্যবহার,’ হেমন্তবাবু বললেন।
‘কিন্তু তারা প্রতিবাদ করছে। যাদের উপগ্রহ নিয়ে মাথাব্যথা নেই, তাদের কি প্রতিবাদ বা প্রতিবন্ধক সৃষ্টির অধিকার আছে?’ তারাপুর টেকনোলজি বিষয়ক আইন যতটা বোঝেন, মানবাধিকার বিষয়ের আইন ততটা নয়।
হেমন্তবাবু এবারে সরাসরি তাঁদের মূল পয়েন্টে চলে এলেন। বললেন, ‘দেখা যাচ্ছে, জাম্বিয়ার আপত্তির এক নম্বর কারণ, ভারত উপগ্রহ পাঠানোর ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করছে।’
পারিজাত হঠাৎ হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’
তারাপুর কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘প্লিজ, মি. বাগচিকে কথাটা শেষ করতে দিন।’
লম্বা জিব কেটে পারিজাত বললেন, ‘সরি, সরি।’ বলে মুখের ওপর আঙুল চেপে রইলেন।
‘আপনি বলুন, মি. বাগচি।’
‘হ্যাঁ, দু-নম্বর হল, এই উপগ্রহ জাম্বিয়ার মহাকাশসীমার মধ্যে ঢুকে পড়ছে, অর্থাৎ তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা হচ্ছে।’
পারিজাত সেন আঙুলের ফাঁক দিয়ে টিপ্পনী কাটলেন, ‘হ্যাঃ, উপগ্রহই নেই, মহাকাশ। আচ্ছা বাবা আচ্ছা, এই চুপ করলাম।’
হেমন্তবাবু বললেন, ‘মি. তারাপুর, আমি আপনার কাছে জানতে চাইছি—প্রযুক্তিগত কোনও উপায় দিয়ে কি এই আইনকে এড়ানো যেতে পারে?’
‘মানে, জাম্বিয়ার মহাকাশ-সীমা? হ্যাঁ অবশ্যই। কক্ষপথ সরিয়ে নেওয়া অসম্ভব নয়, তবে সেটা নিয়ে আবার অন্য কোনও দেশ আপত্তি করে কি না দেখতে হবে।’
‘না, মানে, যদি ধরুন, ওটা আরব সাগর বা অতলান্তিকের মহাকাশে নিয়ে যাওয়া যায়?’
‘সেসব কক্ষপথে তো ইতিমধ্যেই ট্রাফিক খুব বেশি। তবে আপনি যা বলছেন, সেটা হিসেব করে দেখছি। অল্প কয়েক ডিগ্রি সরিয়ে দিলেই হল, যাতে ওদের আর আপত্তির কারণ না থাকে, হোল্ড অন এ মিনিট।’ তারাপুর মুখ ফিরিয়ে দ্রুত কিছু নির্দেশ দিলেন তাঁর সহকারীদের। এদের টিভি-র পর্দায় দেখা গেল না।
হেমন্তবাবু বললেন, ‘টেকনিক্যাল ডিটেলের দরকার নেই, আপনি শুধু জানিয়ে দিন, এটা করতে খরচ কত বেশি পড়বে এবং একদম অসম্ভব কি না। এই বদলটা করতে সময়ই বা লাগবে কত?’
তারাপুর আবার সহকারীদের দিকে ফিরলেন। হেমন্তবাবু বললেন, ‘বলো পারিজাত, কী তোমার মাথায় খেলছিল তখন?’
‘দেখুন দাদা, ঊর্ধ্বসীমা মানে তো আশিটা উপগ্রহ। মানে উপগ্রহের সংখ্যা হরেদরে আশিটা থাকতে হবে। তাহলে একাশি নম্বর যখন ওপরে উঠছে, ততক্ষণে একটাকে যদি নামিয়ে আনা যায়, তাহলে তো কারও পাকা ধানে মই দেওয়া হল না। মামলাটাও চুকে গেল। আর আমাদের এই ঝামেলায় ফেলার জন্য মোটারকম ক্ষতিপূরণও আদায় করা যাবে। সেই খরচায়…’
‘সেই খরচায় একটা উপগ্রহকে নষ্ট করা যাবে, কী বলেন…’ বলে উঠলেন তারাপুর।
‘কী সর্বনাশ, আমি কি ভেঙে ফেলবার কথা বলছিলাম নাকি?’
‘তাহলে কী বলছিলেন? ফেরত আনার কথা, অক্ষত অবস্থায়। তাতে যা খরচ আর হাঙ্গামা, তার চেয়ে অনেক সহজ সেই উনিশশো বাহাত্তরে রাশিয়ানরা যা করত, উচ্চতা কমিয়ে নীচের কক্ষপথে নামিয়ে এনে চুরমার করে দেওয়া। ওদের অ্যান্টি স্যাটেলাইট সিস্টেমটা অত্যন্ত এলেবেলে গোছের ছিল। আমরা ওর থেকে বেটার সিস্টেমের কথা ভাবতে পারি।’
‘আমার আইডিয়াটা আপনাদের কেমন লাগছে?’ জিজ্ঞেস করলেন পারিজাত।
‘ওটা তো প্রকারান্তরে হার স্বীকার করা,’ বললেন হেমন্তবাবু, ‘তাহলে আর অধিকারের লড়াই শুরু হচ্ছে না। শুরুর আগেই শেষ।’ আইনজীবী হিসেবে এত সহজ সমাধানে তাঁর মন সায় দিতে চাইছিল না। আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। পর্দায় সময়ের লাল অক্ষর জ্বলজ্বল করে তাঁদের জানিয়ে দিল, তাঁদের দেড় ঘণ্টা কাবার হতে চলেছে।
হেমন্তবাবু বললেন, ‘যাবার আগে একটা ছোট্ট প্রশ্ন, প্রেসিডেন্টের মাথা কামানো দেখলাম যেন?’
পারিজাত অবাক হয়ে বললেন, ‘কে, অশোক দ্য সেকেন্ড? বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছেন বোধহয়।’
তারাপুর বললেন, ‘তিরুপতিতে গিয়েছিলেন তো সম্প্রতি—উৎক্ষেপণ দেখতে। এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন আর কী।’
৪
এরপর চারটি মেগাপলিস, আটটি মেট্রোপলিস আর শ-খানেক ছোটবড় শহরে দিন কাটে তো রাত কাটে না। কী হবে যদি ভারত এই মামলায় হেরে যায়? গ্রামে গ্রামে অবশ্য কাজকর্ম যেমন চলছিল, তেমনই চলতে লাগল। সেখানে বৃহত্তর পৃথিবীর পাঞ্জা-কষাকষির খবর পৌঁছোলেও তাদের শান্ত জীবনযাত্রার ছন্দে কোনওরকম আলোড়ন জাগায় না। তারা শুধু বোঝে খালের জলের সরবরাহ, জ্বালানি অরণ্যের গাছপালা আর ফসলের বেড়ে ওঠা, জৈব গ্যাসের কারখানা অষ্টপ্রহর চালু থাকা, যেখান থেকে তাদের হাসপাতাল, খাদ্য-সংরক্ষণকেন্দ্র আর দূরদর্শন বিদ্যালয়গুলির বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় থাকে। তাদের চিন্তা, তাদের বাণিজ্যের ধমনি হাইওয়েগুলিতে যেন ট্রাকের চলাচল বন্ধ না হয়। এই সব কিছুর জন্য কোনও-না-কোনওভাবে যে উপগ্রহ প্রযুক্তির কাছে তারা ঋণী—এই বোধ তাদের মধ্যে কারও কারও আছে, কারও নেই। গ্রামের যারা মধ্যবয়স্ক বা বুড়ো, তারা মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে বলে, কী ছিল আর কী হল। আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোটবেলার শেখা ছড়া আওড়ায়:
এক তারা নারা পারা
দুই তারা জলের ধারা
তিন তারা কাঁঠালের কোশ
চার তারাতে নেইকো দোষ।
আর এখন চার কুড়ি তারা, তার সব চেনাও যায় না, সব চোখেও দেখা যায় না, তাদের সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে রেখেছে। এই নিয়ে দূরদর্শনের ইস্কুলে ছড়াটা আরও লম্বা করে শেখানো হয়। তবে ছোটরা এসবের মর্ম বোঝে না। তারা জ্ঞান হয়ে অবধি এইরকমই দেখে আসছে, তারা কী জানবে অনাবৃষ্টি-খরা, বন্যা আর বিনা চিকিৎসায় আধমরা হয়ে টিকে থাকার কথা? সেরকম আবার হয় নাকি!
গ্রামে তাই আর-একটি নতুন ‘সিতারা’ জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর সঙ্গে যুক্ত হওয়া তেমন কোনও বড় খবর নয়। সেই সিতারা যাতে না উঠতে পারে, তার জন্যে কারা কী প্যাঁচ কষছে। না উঠলে অসুবিধে কোন কোন দিকে দেখা দেবে, কোন দিক দিয়ে অর্থনীতি ধাক্কা খাবে—এসব নিয়ে চুল সাদা করার জন্য লোক আছে। তারাই ভাবুক। যার যা কাজ। হাথিয়া নক্ষত্রে বৃষ্টি হওয়া নিয়ে একসময় চাষিরা আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। সে এক জমানা ছিল। এখন আর আবহাওয়ার দেবদেবীদের দয়ার পরোয়া কে করে। বেঁচে থাক চার কুড়ি নকল সিতারা। আসলের চেয়ে নকল অনেক ভালো, অনেক উপকারী।
তাই পৃথিবী ঘুরে যায়, রোদ চড়চড়ে হয়, আবার ঘন হয়ে রাত্রি নামে, আবার ভোরবেলা যে যার কাজে বেরিয়ে পড়ে, এরই মধ্যে কখন বিশ্বের বৃহত্তম রণক্ষেত্রে ভাগ্যের পাশা উলটে যায়, একদা পরাক্রমশালী দেশগুলি পথভ্রষ্ট হয়। যারা পিছন সারিতে ছিল, তারা এগিয়ে আসে। কেউ ধাক্কা দিয়ে এগোতে চায়, কেউ সকলের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে—এসব তারা জানতেও পারে না। তারা জানতে পারে না চারটি মেগাপলিস, আটটি মেট্রোপলিস আর শত শত শহরে চলছে বিজয়োল্লাস, তুবড়ি ফাটানো হচ্ছে, রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে চলেছে শোভাযাত্রা। তাদের হাতে নানারকম ছবি, যার যা ইচ্ছে ছবি এঁকে তারা এই বিরাট জয়কে স্বাগত জানাচ্ছে, কেউ কেউ হাঁক দিচ্ছে জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ, লুব্ধক-১৮ জিন্দাবাদ। এখন আর মানুষের নামে কেউ জয়জয়কার করে না। করলে যার নামে করত, তার বাড়ির সামনে তখন বিরাট জনতা। জনতার মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে অনুপলাল। তার এক হাতে একটি ঠোঙা, পাশে রাজিন্দরের চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে রাখা বিশাল ঝুড়ি ভরতি কচুরি আর শিঙাড়া। একটা নড়বড়ে টুলে দাঁড়িয়ে জনতার অভিনন্দন গ্রহণ করছে অনুপলাল। তার মুখের ভাব দেখে মনে হয়, এই মামলা জেতার কৃতিত্ব যদি কারও প্রাপ্য থাকে, তবে তা শুধু তারই।
‘আপনারা তো সকলেই দেখেছেন, নিজের চোখেই দেখেছেন আমার সাহেবের সেই জবাব। আহা, তুলনা নেই, তুলনা নেই, লা-জবাব, লা-জবাব।’
সামনের সারি থেকে একটি ছোট ছেলে বলে উঠল, ‘অনুপলালজি, আবার বলুন, আমি শুনতে চাই।’
পাশ থেকে আর-একটি দশ-বারো বছরের বালক বলে উঠল, ‘আমি দেখিনি, আমি দেখিনি। অনুপলালজি, ভালো করে বলুন।’
অনুপলালের হাত ঠোঙার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল। সে মহা আশ্চর্য হবার ভান করে বলল, ‘কে বলছে, দেখোনি। কে সে ছোকরা, সামনে আও।’
কাঁচুমাচু মুখ করে এগিয়ে এল একটি ছেলে, তার নাম মুন্না। তার বাবা রাধেশ্যামের মুদির দোকান। বাবা তখন তাকে দোকানে বসিয়ে নিজে টিভি দেখতে চলে গিয়েছিল।
অনুপলাল ব্যাপারটা আন্দাজ করে রাধেশ্যামের উদ্দেশে একটা কড়া মন্তব্য করে বলল, ‘আরে রাধেশ্যাম, তু আদমি হ্যায় ইয়া পজামা হ্যায় রে? ছোটা বচ্চেকো ইতনা শানদার সওয়াল-জবাব দেখনে নহি দিয়া। ফির মিলেগা কভি অ্যায়সা মওকা?’
সকলের সাগ্রহ অনুরোধে অনুপলাল পুরো ঘটনাটার সবচেয়ে নাটকীয় অংশটি হাত-পা নেড়ে খচমচ শব্দ করে অভিনয় করে দেখাতে লাগল: ‘ওদের পক্ষের উকিল প্রশ্ন তুললেন, ‘‘আমার মাথার ওপরে ২২,৩০০ মাইল উঁচুতে যে মহাশূন্য, তার ওপরে খবরদারির অধিকার কার—এটাই আমি ধর্মাবতারকে জিজ্ঞেস করছি। বলুন, এই অংশের ওপর সার্বভৌম অধিকার আমার, না অন্য কোনও মহাদেশের কারও?’’
‘আমাদের দিক থেকে পারিজাতদিদি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে জবাব দিলেন, ‘‘হ্যাঁ, সেই উচ্চতায় যদি কোনও চড়াই পাখি কিংবা ঘুড়ি ওড়ে, তাহলে অবশ্যই আপনাদের তাদের গোলি মারকে উড়া দেনেকা রাইট আছে।’’
‘ওদিকের উকিল চেয়ারের ওপর জোরে থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘‘এই মন্তব্য সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এবং মানহানিকর।’’
‘জজসাহেব মুচকি হেসে বললেন, ‘‘আপত্তি গ্রাহ্য হল না। আর মানহানির প্রশ্ন কোথায় আসছে?’’
‘ওদের তরফের উকিল বললেন, ‘‘ওঁরা কটাক্ষ করছেন আমাদের উপগ্রহ প্রযুক্তির ওপর।’’
‘পারিজাতদিদি ভালোমানুষের মতো মুখ করে বললেন, ‘‘কই, তা কোথায় বললাম? আমি তো বলেছি শুধু চড়াই পাখি আর ঘুড়ি ওড়াবার কথা। আপনারা কি তাতেও অক্ষম?’’
‘‘ধর্মাবতার?’’
‘এবারে হাকিম বললেন, ‘‘হ্যাঁ, চড়াই পাখি এখানে আমাদের বিচারের আওতায় আসছে না।’’
‘আমাদের তরফের তারাপুর সাহেব বললেন, ‘‘আর আসবেই বা কী করে? আসা অসম্ভব। পৃথিবী থেকে ২২,০০০ তো বাদ দিন, মাত্র ১৬০ কিলোমিটার ওপরে বায়ুর চাপ পৃথিবীর তুলনায় ১০০ কোটি ভাগ কম, মানে দশমিকের পরে ন-টা শূন্য।’’… ’
জনতার মধ্যে হাসির রোল উঠল। অনুপলাল বলল, ‘লিখে নাও মুন্না, লিখে নাও। পরীক্ষায় পাস করার সময় কাজে দেবে। আমাদের তারাপুর সাহেবের হিসাব একদম পাক্কা। দশমিক বিন্দুর পরে দশ বারো স্থান অবধি। যদি প্রশ্ন আসে, বাইশ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় যদি একটা চড়াই পাখি পৌঁছোয় তাহলে তার কী অবস্থা হবে? তোমার উত্তর হবে…’
অধৈর্য জনতা আসল কথাটা শোনার জন্য ব্যস্ত। ‘তারপর কী হল? তারপর কী হল?’
অনুপলাল ততক্ষণে দুটি শিঙাড়া গলাধঃকরণ করে রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে। ‘আরে ভাইলোগ, বহনিয়ালোগ, কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা বলি। কোনখানটা ছেড়ে কোনখানটা বতাব, তা-ই তো ভেবে পাচ্ছি না।’
একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই ক্যানিউট সাহেবের ব্যাপারটা, ওখানটা বলুন।’
অন্য একজন শ্রোতা পাশের লোককে প্রশ্ন করল, ‘ক্যানিউট সাহেবটি কাদের দিকের উকিল?’
উত্তরদাতা সবজান্তা ভাব করে বলল, ‘ছিলেন, ছিলেন। একসময়ে দারুণ নামকরা উকিল ছিলেন। তাঁর নামে সবাই ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপত।’
অনুপলাল ততক্ষণে আগের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়েছে, ‘আমার সাহেব যখন মুখ খুললেন, মনে হল, একসঙ্গে বিশখানা রকেট ছুটে গেল। সে কী আওয়াজ। চারদিক কেঁপে উঠল, প্রতিধ্বনি উঠতে লাগল গম্ম্ গম্ম্ গম। তারপরেই সব শুনশান। কান পেতে শুনতে লাগল সবাই।
‘সাহেব বললেন, ‘‘আমাদের টেকনোলজির অ্যাডভান্টেজ আছে। স্বীকার করতে ভালো লাগুক আর না লাগুক, আছে। আমাদের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি ঝড়ের বেগে এগিয়ে গিয়েছে। তবে হ্যাঁ, এই অ্যাডভান্টেজ আমরা লাগিয়েছি পুরোনো শিল্পের ভোল পালটে দেবার কাজে, নতুন উপায়ে খাদ্য উৎপাদনে, মানুষের স্বাস্থ্য ভালো করার কাজে। আমরা নতুন নতুন অস্ত্র তৈরির নেশায় এই প্রযুক্তিকে বাজে খরচ করিনি। এটাই হয়ে গিয়েছে আমাদের দোষ। আমরা প্রযুক্তির সুফল সকলের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টায় মহাকাশকে ব্যবহার করেছি।’’
‘অপর পক্ষের উকিল এই সময় তেড়েফুঁড়ে উঠে বলতে গেলেন, ‘‘দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, ভারতের মান্যবর উকিল মহাশয়কে, আপনারা মহাকাশকে ব্যবহার নয়, একচেটিয়া করে ফেলেছেন, মনোপলি ব্যাবসা করে ফেলেছেন।’’
‘‘কথাটা আপনি ভেবে বলেছেন আশা করি,’’ হেমন্তবাবুকে তখন থামায়, তার সাধ্য কার। ‘‘মনোপলির অর্থ সম্ভবত আমাদের চেয়ে আপনাদের কিছু বিশিষ্ট বন্ধুর ভালো করে জানা আছে। আপনার ও তাঁদের সকলের অবগতির জন্য বলি, আমরা মনোপলি ব্যাবসা চালাইনি, আমরা মনোপলি ভেঙেছি।’’
‘অপর পক্ষের উকিল এই সময় সুর পালটালেন। ‘‘ধর্মাবতার, উপগ্রহ সিলিং অ্যাক্টের তিনের চার সূত্র অনুযায়ী ভারত আশির পরেও আরও উপগ্রহ পাঠাবার পরিকল্পনা করছে, অপর দেশের আকাশে ভিড় বাড়াচ্ছে, সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে।’’
‘হেমন্তবাবু উত্তরে বললেন, ‘‘মানবাধিকার ও বিজ্ঞানের সীমানা সংক্রান্ত আইন খুলে দেখুন, আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থাকে ছড়িয়ে দেবার অধিকার সর্বজনীন, এর থেকে কেউ কাউকে বিরত করতে পারে না। আপনি বলতে পারেন না এই অবধি চলুক যোগাযোগের সূত্র—তারপর থেমে যান। এইখানে আপনার সীমানা শেষ, তারপরে আমার ভূখণ্ড, আমার আকাশ, আমার জমিদারি, আজ সমস্ত পৃথিবী একটি ছোট্ট বল, সেখানে কোথায় কার সীমানা? মহাকাশ কি আপনার কুঁড়েঘরের উঠোন, যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আলাদা করে রাখবেন? আপনি কি ক্যানিউটের মতো সমুদ্রের ধারে সিংহাসন পেতে আঙুল তুলে হুকুম করবেন, ওই অবধি থাকো, আর এগিয়ো না। সমুদ্রের স্রোত কি রাজা ক্যানিউটের কথা শুনেছিল, শোনেনি। শোনেনি। আপনারা রাজা ক্যানিউট হতে চাইছেন, এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে।’’…’
সমবেত জনতার মধ্যে করতালিধ্বনি উঠল। অনুপলাল গর্বভরে আর-একবার মুখ মুছে নিল।
ঠিক সেই সময় গাড়িবারান্দার ওপরের ছাদে ইজিচেয়ারে লম্বা হয়ে বিশ্রাম করছিলেন হেমন্ত বাগচি। সচ্চিদাবাবু পাশের চেয়ারে। ‘শুনছেন আপনার অনুপলালের ভাষণ? লোক জড়ো করে ফেলেছে।’
হেমন্তবাবু মৃদু হাসলেন। সে হাসিতে প্রশ্রয় আর ভালোবাসা। ‘দিক ভাষণ। কিছু তো ছুটোছুটি ওকেও করতে হয়েছে। খানিকটা প্রশংসা ওরও প্রাপ্য নিশ্চয়ই।’
সচ্চিদা কোনও তর্কে গেল না। যুদ্ধক্লান্ত সৈনিকের অবস্থা আজ সকলের। শুধু বললেন, ‘ওর শিঙাড়ার ঝুড়ির সাইজটা যদি দেখতেন।’
‘লোকজনকে বিলোচ্ছে মনে হল।’
‘হ্যাঁ, তা দিচ্ছে। কত উদারতা, আজ তো মুনশিজি অন্য মানুষ। যাক সে কথা। আপনি বিশ্রাম করুন। আমি আজ উঠি।’
সচ্চিদা চলে গেল। আকাশের দিকে মুখ করে হেমন্তবাবু মনটাকে বিস্তৃত করে দিলেন। আজানের সুর শোনা যায় অস্পষ্টভাবে, উদাস-করা যোগিয়া রাগে। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ জুড়ে ঝাঁক ঝাঁক পাখির বাসায় ফেরা। তারপর একটি-দুটি করে আলোর ফুলকি ফুটবে। আজ আমরা আর-একটি বিন্দু ওই ঊর্ধ্বাকাশে পাঠাবার ব্যবস্থা করে এলাম। এই পৃথিবীর নীড়টা আর-একটু সুখের হবে। পাখিদের মতো আমরাও চেষ্টা করছি, চেষ্টা করে চলেছি। একজনের জীবনের মেয়াদ আর কতটুকু? কিন্তু পরম্পরা চলতে থাকবে।
কঙ্কর চুন চুন মহল বনায়া
অব কহতা ঘর মেরা হ্যায়
না ঘর তেরা, না ঘর মেরা।
চিড়িয়া রৈন বসেরা হ্যায়।
একরাতের বই তো নয়। আমার তো রাত কেটে এল। প্রগাঢ় তৃপ্তি অনুভব করেন তিনি। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মাদকতা, কঠিন কর্ম সুচারুরূপে সমাধা করার আনন্দ, কাজের জন্যই কাজ করে যাওয়া, এই সুখের কাছে লোভের আশা তুচ্ছ।
‘দাদু, দাদু, দাদু, তুমি কই?’ ছুটতে ছুটতে ওপরে আসছে জিবু। পরের ছুটির জন্যে দাদুর সঙ্গে প্ল্যান করতে হবে, কত কাজ!
পুনঃমুদ্রিত
Tags: এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, কল্পবিজ্ঞান গল্প, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা