পাষাণী
লেখক: দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: সৌরভ দে
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? এই! এই যে! শুনতে পাচ্ছো না? তোমাকে বলছি! কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাদের?”
একটা তীব্র রিনরিনে কণ্ঠস্বর দেওয়ালের গায়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফিরে আসছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার এই সুড়ঙ্গ পথটা ভীষণ ঠাণ্ডা। বাইরের পৃথিবীর কোনও আওয়াজ এখানে কোনওদিন ঢুকেছে বলে মনে হয় না। শুধুমাত্র কয়েক জোড়া পায়ের মৃদু শব্দ আর অস্পষ্ট ফোঁপানি। বহুক্ষণ সামনের চলমান পাহাড়ের মতো লোকটাকে অনুসরণ করছে তারা, কিন্তু এবার যেন সশব্দে বিদ্রোহ করে উঠল তাদের মধ্য থেকে একটা গলা। যাকে উদ্দেশ্য করে এই প্রশ্ন, সে অবশ্য মানুষ নয়, যন্ত্র। যদিও তাকে দেখে সেকথা বোঝার উপায় নেই। কাঁধের ওপর বিশাল এক কাঁটাওয়ালা মুগুর ফেলে দৃপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে সে। তার ভারী থামের মতো পা দুটো প্রতিবার মাটি ছোঁয়া মাত্রই যেন ছোটখাটো কম্পন উঠছে চারদিকে। আপাতত তার ওপর নির্দেশ আছে এই ছেলেমেয়েগুলোকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার। তাই মেয়েটার চিৎকারে কোনওরকম পরিবর্তন দেখা গেল না তার মধ্যে, শুধু বন্দিদের কোমরে বাঁধা শেকলের শেষ প্রান্ত টানতে টানতে এগিয়ে চলল। অসহায়ের মতো তার পেছন পেছন হাঁটছিল আরও বেশ কয়েকটা ভীতসন্ত্রস্ত দুর্বল পা। চিৎকার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল মেয়েটাও। সেই যন্ত্রপাতি ভরা ঘরটা থেকে বেরিয়ে ইস্তক হাঁটছে। এ যেন এক গোলকধাঁধা! প্রত্যেকটা মোড় যেন তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আবার সেই ফেলে আসা রাস্তায়। এর শেষ কোথায়? আশপাশের ফিসফিসানিগুলোও কমে এসেছে, বাকিরাও বুঝি তার মতোই অবসন্ন। এখন পা মেলানো ছাড়া উপায় নেই। শিকলের ঝঙ্কারের তালে তালে মোহগ্রস্তের মতো হাঁটতে থাকল সেও।
একসময় শেষ হল পথ। দম দেওয়া পুতুলের মতো কতক্ষণ হেঁটেছে জানে না,তবে ধীরে ধীরে সেই দমও এখন তলানিতে। তবু হঠাৎ যেন একটা সমবেত চিৎকারে সচকিত হয়ে উঠল তাদের কানগুলো। মাথা তুলে দেখল খানিক দূরে দেখা যাচ্ছে একটা খোলা মুখ। সেই মুখ দিয়ে একটা মেঘলা আলো লাফিয়ে পড়ছে সুড়ঙ্গ পথের ভেতর, কমিয়ে দিচ্ছে অন্ধকারের ঘনত্ব। সভয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ছেলেমেয়েগুলো। ও কীসের শব্দ? যেন একদল বীভৎস জীব মহাউল্লাসে চিৎকার করছে! ধীরে ধীরে আরও এগিয়ে আসতে থাকল সেই জান্তব গর্জন। একসময় সেই বিরাট হাঁ দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল তারা। সামনে ঘটে চলা অদ্ভুত দৃশ্যপট দেখে থমকে গেছিল সবাই, ওদের সঙ্গে আসা সেই মুশকো মতো লোকটা কোমরের শিকল খুলে একে একে বসিয়ে দিল তাদের। একটা বিশাল খোলা ময়দানে এসে পড়েছে তারা। বেশ কিছুটা নীচে একটা চারকোণা জায়গা, যার চারটে দিক ঘেরা আছে জাল দিয়ে। সেই জালঘেরা জায়গাটার গা দিয়েই ধাপে ধাপে উঠে গেছে বেশ কিছু সিঁড়ি, যার ওপর বসার ব্যবস্থা করা আছে। আর সেই জালের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে দুটো মানুষ। অবাক চোখে খুঁটিয়ে দেখছিল সেই নিষ্পাপ কিশোরী। যে ভয়ঙ্কর শব্দটাকে কোনও পশুর বিকট চিৎকার মনে হয়েছিল, তা আসলে অনেক মানুষের সমবেত সোল্লাস ধ্বনি! গোল হয়ে ছড়িয়ে থাকা ধাপ গুলোয় বসে আছে হাজার হাজার মানুষ। নিজেদের চলমান আসনগুলোকে ওপর নীচে যেমন খুশি চালিত করে তুলে নিচ্ছে বিভিন্ন ধাপে রাখা নানারকম খাদ্য ও পানীয়। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, খাদ্য আর পানীয়ের জোগান যেন শেষই হচ্ছে না! প্রতি মুহূর্তেই নতুন নতুন রসদ এসে উপস্থিত হচ্ছে। সমস্ত জায়গা জুড়ে নজর রাখছে কাঁধে কাঁটার মুগুরওয়ালা কিছু রাক্ষসের মতো জীব, সবাই একই রকম দেখতে। তাদের এখানে নিয়ে এল বোধহয় এদেরই একজন। ওর সঙ্গে আসা বাকিরা কেমন ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে। ওর নিজের অবশ্য তেমন ভয় করছে না,কিন্তু কৌতূহল হচ্ছে খুব। ওই জালের মধ্যে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে কেন? হঠাৎ কানের কাছে শুনতে পেল একটা গম্ভীর পুরুষালি গলা, “কি? কেমন লাগছে?” মাথা ঘোরাল। একটা চলমান আসনে চেপে ওপর থেকে নীচে নামছে একটা লোক। চওড়া সুগঠিত দেহ, ন্যাড়া মাথা, শরীরের অনাবৃত অংশ জুড়ে একের পর এক চোখ আঁকা। লোকটাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। ভুরু কুঁচকে ভাবার চেষ্টা করল মেয়েটা। নাহ্, কিচ্ছু মনে পড়ছে না। লোকটা তো দূর, নিজের নাম, কীভাবে এখানে এল, কোথায় তার বাড়ি… কিছুই মনে করতে পারছে না। “দেখো! ভালো করে দেখে নাও। তোমাকেও তো এরকম লড়তে হবে! নাও, খাবে?” হাতে ধরা সবুজ পানীয়ের পাত্রটা ওর দিকে এগিয়ে দিল লোকটা। কেমন অদ্ভুত জ্বলজ্বলে চোখগুলো। মাথা নেড়ে সামনের দিকে ঘুরল ও, আর ঠিক তক্ষুনি বিকট ঢং আওয়াজ করে একটা ঘণ্টায় হাতুড়ি পেটাল সেই মুশকো লোকগুলোর একজন। ঘণ্টায় আওয়াজ হওয়া মাত্রই যেন একটা ভয়ঙ্কর হুলুস্থুল বেঁধে গেল পুরো জায়গাটা জুড়ে! দর্শকদের গর্জন যেন চার গুন হয়ে আছড়ে পড়ল ময়দানে, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই খ্যাপা ষাঁড়ের মতো একে অপরের দিকে ছুটে গেল জালের মধ্যে অপেক্ষারত মানুষ দুটো! এতটা ওপর থেকে ওদের ঠিক দেখা যাচ্ছে না। ইস্, যদি আরেকটু সামনে থেকে দেখা যেত! ভাবতে ভাবতেই অবাক হয়ে দেখল, তার আসনটা নীচের দিকে ভেসে ভেসে নামতে শুরু করেছে। পলকের মধ্যেই জালের প্রায় সামনে চলে এল সে। ভীষণ রণ-হুঙ্কার করে ততক্ষণে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে মানুষ দুটো। প্রবল বিস্ময়ে সে দেখল, সেই দুই মানুষের মধ্যে একজন মেয়ে! মনে হয় তার চেয়ে কিছুটা বড়ই হবে। পুরুষের মতো পেশিবহুল শরীর, চোখ দুটোতে হায়েনার হিংস্রতা ফুটে উঠছে! তার হাতে ধরা একটা অদ্ভুত দর্শন তরবারি। মালকোঁচা মারা খাটো ধুতি আর কাঁচুলি জড়ানো শরীরটা যেন বিদ্যুৎ-শিখার মতো বারবার আছড়ে পড়ছে প্রতিপক্ষের ওপর। পুরুষটিও অবশ্য নিরস্ত্র নয়। পাথর কুঁদে তৈরি করা যেন তার অবয়ব, লোমশ দুই হাতে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চালাচ্ছে অজস্র ধারালো ফলা খোদাই করা বিশাল এক গদা। আসনে বসা বাকি জনতার প্রবল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছিল মেয়েটার মধ্যেও। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল সে। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকল দানবাকৃতি লোকটার সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে কীভাবে লড়ে চলেছে সেই নারী! কিন্তু যত সময় গড়াচ্ছিল, ধীরে ধীরে বোধহয় শক্তি হারাচ্ছিল সে, আর ততই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠছিল বিনোদনকামী মানুষের দল। শেষপর্যন্ত বিশাল গদাটার একটা সূচালো ফলা এসে বিঁধে গেল তার পেটে, আর রক্তের ফিনকি তুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটা! চরম আতঙ্কে দাঁড়িয়ে পড়ল দর্শকাসনে বসা কিশোরী। কী হল? মেয়েটা কি মরেই গেল? চারদিকে মানুষের সোল্লাস চিৎকার যেন টাইফুনের মতো আছড়ে পড়েছে ময়দানের ওপর। সেই উত্তেজিত জনতার দিকে হাত নাড়তে নাড়তে মাটিতে পড়ে থাকা বিপক্ষের দিকে এগিয়ে গেল বিজয়ী পুরুষটি, আর তারপরই শুরু হল এক নৃশংস খেলা! একটানে বিবস্ত্র করে ফেলল অর্ধমৃত মেয়েটাকে, ক্ষুধার্ত বাঘের মতো দুই পা চিরে প্রবেশ করালো নিজের পুরুষাঙ্গ! জনতার সহর্ষ ধ্বনিতে তখন চাপা পড়ে গেছে মেয়েটার মর্মান্তিক আর্তনাদ। এরপর সবল পুরুষাঙ্গ দিয়ে তার যোনিপথ ছিন্নভিন্ন করে গদা হাতে তুলে নিল দানবটা। বারবার আঘাত করে কসাইয়ের মতো কোপাতে থাকল মেয়েটার সারা শরীর, খুবলে বের করে আনতে লাগল চোখ, নাক, পেটের নাড়িভুঁড়ি। সেই বীভৎস হত্যা-লীলার সাক্ষী হয়ে যেন উত্তেজনায় পাগল হয়ে উঠেছে জনতা! উন্মত্তের মতো লাফাতে ঝাঁপাতে লাগল বেশ কয়েক জন, কেউ বা জালের ধারে গিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চেষ্টা করল সেই মৃতদেহের রক্ত-মাংস-রস। কেউ খেয়াল করল না ততক্ষণে জালের ধারেই একটি আসনের ওপর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে সদ্য ফোটা ফুলের মতো এক কিশোরী।
শুধু অনেক ওপরে, নিজের সিংহাসনে বসে পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে তাকে দেখছিল একটা ন্যাড়া মাথা লোক। অনন্ত কামনায় যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল তার শরীর জোড়া চোখগুলো।
***
“আহ্! কী করছিস!,” বিরক্ত গলায় বলে উঠল পাষাণী। চুল বাঁধতে থাকা দাসী থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি সামলাতে লাগল গিঁট পড়ে যাওয়া চুলের গোছা। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে ঠোঁটে গাঢ় লাল রং লাগাচ্ছিল পাষাণী। সুরমা লাগাতে গিয়ে কিছুটা বোধহয় চোখে ঢুকে গেছে, ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে মাঝে মাঝেই। উদাস নয়নে গরাদের বাইরে তাকাল। এই শহরে সবসময়ই আকাশ মেঘলা, কেমন একটা মন খারাপ করা আলো ছড়িয়ে থাকে সারাদিন জুড়ে। আচ্ছা, সে কি একাই, যে আকাশ দেখে? তাড়াতাড়ি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ধারাটা মুছে নিল। কেন আকাশের দিকে বারবার চোখ চলে যায় তার? ওই ধূসর মেঘের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কেন নিজেকে খুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়? আজও চোখ বুজলে প্রথম স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে সেই যন্ত্রপাতি-রাসায়নিক ঠাসা ঘরটা, বড় বড় চোখ ঝলসানো আলো আর মুখোশ পরা কিছু মানুষ। কিন্তু কেন মনে হয় তার আগেও যেন কিছু ছিল? কাকে পেছনে ফেলে এসেছে সে? কিন্তু নাহ্, কিচ্ছু মনে পড়ে না। শুধু এই কৃত্রিম আবরণ ঘেরা ভোগবিলাসের শহরে দম বন্ধ হয়ে আসে তার।
“পা-আ-ষা-আ-ণী-ঈ!” একটা গগন-ভেদী হুঙ্কারে চটকা ভেঙে গেল তার। ওই শুরু হয়ে গেছে! শুরু হয়ে গেছে দর্শকদের হিংস্র উচ্ছ্বাস! সময় আর বেশি বাকি নেই। আবার হবে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। বিনোদনের নামে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হবে একজন মানুষকে, আর তাই দেখে উল্লসিত হবে আরও কিছু উচ্চবর্গের মানুষ! এই ২৩৮০ সালের পৃথিবীতে মানব প্রজাতির মধ্যে খুব পরিষ্কারভাবেই টানা হয়ে গেছে একটা বিভাজন রেখা। একদল মানুষের হাতে আছে খাদ্য-পানীয়-বাসস্থান ইত্যাদির মতো ন্যূনতম চাহিদাগুলোর অফুরন্ত জোগান। তাই এখন তাদের একমাত্র চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিনোদন। বিনোদনের অজুহাতে তারা কখনও ‘শিকার’ করে নিম্নবর্গের মানুষদের, কখনও দর্শক হয়ে উপভোগ করে তাদের মল্লযুদ্ধ। অপরদিকে শহরের প্রান্তে পড়ে থাকা নিম্নবর্গের মানুষদের, যাদের পশুর থেকেও অধম মনে করে এরা, তাদের নিয়োজিত করা হয় দাস হিসেবে, মল্লযুদ্ধের যোদ্ধা হিসেবে, বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। তেমনি এক ক্রীতদাসী সে নিজে! আজকের এই যুদ্ধেও তো হয় অপরকে হত্যা করে অথবা নিজে মৃত্যুবরণ করে আমোদিত করতে হবে দর্শকদের! কে জানে সে আজ ফিরতে পারবে কিনা। আর তা নাহলে… হঠাৎ ভীষণ কান্না পেল পাষাণীর। ফরসা গাল বেয়ে নামতে থাকা অবাধ্য স্রোত পেরিয়ে যেতে থাকল তার লৌহ-কঠিন চিবুককে। না, আজ কিছুতেই পারবে না সে। তাতে মরতে হয় হোক। পুরন্দরকে জানিয়ে দেবে কিছুতেই সে আর হত্যা করতে পারবে না প্রতিপক্ষকে। দাসী কখন যেন চুল বেঁধে দিয়ে চলে গেছে। কালনাগের মতো সেই লম্বা বিনুনি নেমে গেছে তার কোমর বেয়ে। উঠে দাঁড়াল পাষাণী। দেরাজ খুলে বের করল তার অস্ত্র। ছুঁচলো পাথরটার তীক্ষ্ণ আগায় না জানি লেগেছে কত রক্ত! বার বার ধুলেও আজকাল যায় না সেসব, লেগে থাকে তার চোখে মুখে অন্তরে। এই কয়েক মণ ওজনের পাথরের অস্ত্রটা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আজকাল কোনও অসুবিধেই হয় না ওর। অত্যাধুনিক নানারকম ওষুধ আর ইনজেকশনের প্রভাবে তার শরীরও হয়ে উঠেছে পুরুষদের মতো পেশিবহুল ও শক্তিশালী। সে আর এখন সেই ছোট্ট মেয়েটা নেই, যে প্রথম বারের জন্য এই লড়াই দেখে মূর্ছা গেছিল। সেই মুহূর্তটার পর থেকে প্রতিনিয়ত তাকে গড়ে তোলা হয়েছে একজন যোদ্ধা হিসেবে। একজন যোদ্ধা, যন্ত্রের মতোই যার নেই কোনও আবেগ, যন্ত্রণা; যার কাজ শুধুমাত্র রক্তপিপাসু দর্শকদের বিনোদন দেওয়া। আজ এই পাষাণই তার পরিচিতি, পাষাণী তার নতুন নাম। ভারী পাথরের দণ্ডটা হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে কানে এল এক কাঁপা কাঁপা মৃদু কণ্ঠস্বর, “ওষুধটা খেয়ে নাও মা।”
হাতে একটা তামার পাত্র নিয়ে সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে এক ক্ষীণকায় বৃদ্ধা। পাত্রের মধ্যে টলটল করছে গাঢ় সবুজ রঙের তরল। এই সেই তরল, যা পাকস্থলীতে প্রবেশ করা মাত্র সারা শরীর জুড়ে বইতে থাকে এক প্রচণ্ড অস্থির ঝড়। শরীরের প্রত্যেকটা কোশ যেন উন্মত্ত খুনির মতো নাচতে থাকে। মাথার ভেতর দ্রিমি দ্রিমি বাজতে থাকে একটাই অনুভূতি, ‘রক্ত চাই রক্ত!’ প্রতিবার ময়দানে নামার আগে এখানকার প্রত্যেক যোদ্ধাকে পান করানো হয় এই নেশা ধরানো পানীয়, আর তারা মন্ত্রপূত জীবের মতো আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে উলটোদিকের মানুষটাকে। তারপর একসময় তাকে হত্যা করে নৃশংসভাবে ছিন্নভিন্ন করতে থাকে তার দেহ। অস্ত্রের কোপ যত গভীর হয়ে বসতে থাকে মৃতদেহের শরীরে, তত উল্লাস বাড়তে থাকে উত্তেজিত জনতার। ওই বীভৎস হত্যা সামনাসামনি দেখা, ওটাই এই শহরের সবচেয়ে বড় বিনোদন! তাই বিজয়ী যোদ্ধা প্রতিপক্ষকে শুধুমাত্র মেরে ফেললেই আশ মেটে না তাদের। শিউরে উঠল পাষাণী। ওই পানীয়ের প্রভাবে সে নিজেও তো হত্যা করেছে কত মানুষকে! কাটাছেঁড়া করেছে তাদের শরীরটা নিয়ে! কিন্তু নেশার ঘোর কাটার পর প্রত্যেকবার ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ওই মৃতদেহগুলোর মতোই। কিন্তু আর না। আজ বরং তার মৃতদেহ নিয়ে উল্লাস করুক কেউ। “আমি খাব না। নিয়ে যাও এখান থেকে!” বলে একহাতে বৃদ্ধাকে সরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল পাষাণী।
পেছন থেকে পানীয়ের পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে শুধু আকুল নয়নে তাকিয়ে থাকল বুড়ো মানুষটা।
***
চাপ বাঁধা জমাট অন্ধকার। যেন একতাল থকথকে কাদা। তার মধ্যে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে সে। শরীরের প্রত্যেকটা কোশে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা, ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে আসা রক্তের ধারাটাও কখন যেন শুকিয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করেই একবার পাশ ফেরার চেষ্টা করল, নাহ্, হাত-পা যেন কয়েক মণ পাথরের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। গলার কাছটা খসখসে, একটু জল পেলে বড় ভালো হত। কিন্তু সবার আগে চাই ইনজেকশন। ওটা দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। খেঁকুড়ে বুড়িটা কই? এখনও আসছে না কেন? ওহ্, মাথার ভেতরের শিরাগুলো যেন ফেটে যাবে এবার!
কট্। কে যেন আলো জ্বালল। ভারী চোখের পাতাগুলো সামান্য ফাঁক করার চেষ্টা করল বিছানায় পড়ে থাকা মানুষটা। একটা ছোট্ট নাইট বাল্ব জ্বলেছে। ঠাণ্ডা লাল আলোটার মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত নৃশংসতা আছে, ঘরটাকে ঠিক নরকের মতো লাগছে। ওর দিকে পেছন ফিরে পোশাক খুলছে একটা দৈত্যের মতো লোক। দৈত্য নাকি যমরাজ? ঘোলাটে চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল সে। ধীরে ধীরে সমস্ত আবরণ সরিয়ে রক্তের মতো সেই লাল আলো গায়ে মেখে ঘুরল লোকটা। সুগঠিত নগ্ন পেশিগুলো ইস্পাতের ফলার মতোই চকচকে, আর তাদের ওপর খোদাই করা শয়ে শয়ে চোখ যেন লোভী কুকুরের মতো মেপে নিচ্ছে তার শরীরটাকে। পুরন্দর। এই একটা নামকে যমের মতোই ভয় করে এখানকার সবাই। অবশ্য ওর মনে ভয়-ভীতি কিছুই নেই। পুরন্দরের নাম শুনলে, ওকে দেখলে শরীরে পাক দেওয়া যে মারাত্মক বিবমিষার অনুভূতি হয় তার, সেটাকে বোধহয় ঘৃণা বলে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে মরা মাছের মতোই পড়ে থাকল সে। এরপরে ঠিক কী কী হবে তার জানা। শিকারি হায়নার মতোই পা টিপে টিপে তার দিকে এগিয়ে এল পুরন্দর, ঠোঁটের কোণে একটা নোংরা হাসি। লালা জড়ানো ঘড়ঘড়ে গলায় সুর করে বলে উঠল, “পাষাণী?”
তার ভাস্কর্যের মতো মুখটাতে কয়েকটা রেখা কেঁপে উঠল থিরথির করে। এই নির্লজ্জ ডাকটা প্রত্যেকবার যেন গরম শলা ঢুকিয়ে দেয় তার কানের ভেতর। জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস টেনে পেটের ভেতরের তোলপাড়টা সামলানোর চেষ্টা করল। ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠছে তার শরীর। তাতে অবশ্য কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই পুরন্দরের। প্রতিদিনের অভ্যেস মতোই পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর ভঙ্গিতে খুলে নিল তার নিম্নাংশের কাছা করে পরা ধুতি, হাত রাখল বক্ষবন্ধনীতে। কামার্ত আঙুলগুলো তার নরম পিঠের ওপর সাপের মতো কিলবিল করতে করতে আলগা করে ফেলল বাঁধন, একটানে সরিয়ে দিল বুকের কাপড়। আবার আঁধার নামছিল তার চোখের পাতায়, ধীরে ধীরে সে ঢুকে পড়ছিল তার চির চেনা খোলসের ভেতর। এবার তার এই পাথুরে খোলসটা নিয়ে আঁচড়ে কামড়ে দাপাবে পুরন্দর। আর প্রতিদিনের মতোই পাথর হয়ে পড়ে থাকবে সে। কিন্তু আজ যেন সব কিছু অন্যরকম! চমকে চোখ মেলল যুবতী। স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে গলার কাছে পুরন্দরের গরম নিশ্বাসের হলকা! আস্তে আস্তে সেই হলকা যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে তার চামড়া, হিংস্র দাঁত কামড়ে ধরেছে উন্মুক্ত স্তনবৃন্ত। হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর আগ্নেয়গিরি জেগে উঠল ওর মাথার ভেতর! একটা প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা যেন লাভার মতো ঠেলে উঠে আসতে চাইছে। কিন্তু কী করবে সে? লড়াইয়ের ময়দানে যতই অপ্রতিরোধ্য সে হোক না কেন, এ যে পুরন্দর! দাঁতে দাঁত চেপে বুকের ভেতরের আগুনে পাহাড়টাকে সামলানোর চেষ্টা করল। বৃথা এ অগ্নুৎপাত! এই আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে ফেলবে তাকেই, তবুও এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি হবে না! চোখের কোণ দিয়ে গরম জল গড়িয়ে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল বিছানা, সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রবল হয়ে উঠছিল পুরন্দর। বুঝতেও পারল না, কখন যেন শক্ত মুঠোয় পরিণত হয়েছে ওর শরীরের নীচে নিষ্পেষিত হওয়া হাতদুটো। উন্মত্ত শীৎকার করতে করতে তপ্ত কঠিন পৌরুষ দিয়ে আঘাত করল কোমল জঙ্ঘাদেশ। আর সঙ্গে সঙ্গেই…” আহ্! আচমকা চাবুক হয়ে ওর চোয়ালের ওপর আছড়ে পড়ল বিরাট এক চড়! পলকে শুকনো খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়ে কার্পেটে আছড়ে পড়ল অত বড় শরীরটা। ততক্ষণে খাটের ওপর উঠে বসেছে সেই নগ্ন নারীমূর্তি, চোখে অসীম বিভ্রান্তি। একরাশ বিস্ময় নিয়ে জরিপ করছে নিজের হাতদুটো কে। এ আজ কী হল তার!
হঠাৎ যেন হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে ঘরের ভেতর। অদৃশ্য শীততাপ যন্ত্রের কৃত্রিম রিনরিন আর নেই, শোনা যায় না ঘরের ভেতরের মানুষ দুটোর নিশ্বাসের শব্দও। তড়িতাহতের মতো কিছুক্ষণ বসে থাকার পর টকটকে লাল দুই চোখ তুলে তার দিকে তাকাল পুরন্দর। সমুদ্রমন্থনের সমস্ত গরল যেন জমেছে সেই চোখে! প্রচণ্ড আক্রোশে থরথর করে কাঁপতে লাগল শরীরের সমস্ত মাংসপেশি! গর্জন করে শিকারি শ্বাপদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল, বিছানার ওপর ফেলে দশটা আঙুল দিয়ে সজোরে মতো চেপে ধরল গলা! জালে পড়া পাখির মতো তখন ছটফটিয়ে উঠেছে মেয়েটা, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবে প্রায়… হাঁ করে কোনওমতে শ্বাস নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করতে লাগল। চাপ বাড়াতে লাগল পুরন্দর, আঙুলগুলো যেন তীক্ষ্ণ ফলার মতো চামড়া ভেদ করে ফেলবে। গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে করতে ধীরে ধীরে ঘোলাটে হয়ে আসছিল মেয়েটার দৃষ্টি, ছটফট করতে থাকা শরীরটা নেতিয়ে পড়ছিল মরা পাতার মতো। তার সেই বিস্ফারিত চোখ, লাল হয়ে যাওয়া ফর্সা মুখ, বেরিয়ে আসা জিভ দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ক্রূর হাসি খেলে গেল পুরন্দরের ঠোঁটে। আলগা করে দিল হাতের বাঁধন। উঠে দাঁড়াল নিথর হয়ে যাওয়া শরীরটাকে ছেড়ে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে আহত সরীসৃপের মতো হিসহিসিয়ে বলে উঠল, “এত সহজে মরবি না তুই! তাণ্ডব! তাণ্ডব অপেক্ষা করবে তোর জন্য!”
***
প্রহর কাটে। ঘোলাটে মেঘের বুক চিরে একটা বিষণ্ণ মলিন আলো ছড়িয়ে পড়ে অমরাবতী শহরের ওপর। আলো এসে পড়ে দুধ-সাদা নরম বিছানায়, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে পাষাণী। জোরে জোরে শ্বাস টানার চেষ্টা করে। ঘাড়ের কাছটা এখনও প্রচণ্ড ব্যথা, সারা শরীর জুড়ে যেন যন্ত্রণায় পিন ফুটছে। মাথার ভেতরের শিরাগুলো ফেটে পড়বে মনে হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেঁচে গেছে সে! কাল রাতে ওই জানোয়ারটা ওকে মারতে মারতেও মেরে ফেলেনি! কিন্তু ওর বলে যাওয়া শেষ কথা ক-টা এখনো কানে বাজছে। কেঁপে উঠল পাষাণী। তাণ্ডব! তাণ্ডব নামটা শুনলেই ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুকের মধ্যে চিরকালের জন্য খোদাই হয়ে যাওয়া সেই প্রথম দিনের স্মৃতি। সেই কদর্য রক্তাক্ত স্মৃতি তাকে ঘুমোতে দেয়নি বেশ কিছু রাত। কিন্তু কেন? শূন্যদৃষ্টিতে আকাশের ময়লা আলোটার দিকে চেয়ে থাকে পাষাণী। ঠিক কীভাবে ঘটে গেল গতরাতের ঘটনাটা? এখানে তার প্রত্যেকটা দিন শুরু হয় ওষুধ, ইনজেকশন আর শরীরচর্চা দিয়ে। তারপর সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এসে যখন শহরের কোণে কোণে ঝলমলিয়ে ওঠে স্বয়ংক্রিয় বাতিদান, তখন সে নামে লড়াইয়ের ময়দানে। আর আশ্চর্যভাবেই প্রতিদিন জিতে ফেরে, বলা ভালো বেঁচে ফেরে! বাকিদের বলাবলি করতে শুনেছে, সে নাকি সি-ক্যাটাগরির সবথেকে ভালো ফাইটার। পাষাণী বোঝে না সেসব। শুধু জানে যে পাথর দিয়ে সে মেরে চলে একের পর এক বিপক্ষ প্রতিযোগীকে, সেই পাথরের আবরণ থেকে মুক্তি নেই তার। যেমন মুক্তি নেই পুরন্দরের হাত থেকে। ময়দান থেকে ফেরার পর যখন ব্যথানাশক ইনজেকশনটা মিশে যেতে থাকে তার স্নায়ুর কোশগুলোতে, অনুভবহীন জ্যান্ত মড়ার মতো পড়ে থাকে সে। আর ঠিক তখনি তাকে ধর্ষণ করে পুরন্দর। রোজ, প্রতি রাতে। সেই প্রথম দিন থেকেই। পাথরের মূর্তির মতোই পুরন্দরের নীচে পিষতে থাকে সে, কিন্তু অদ্ভুত এক শীতঘুমে চলে যায় তার পেশিগুলো। একের পর এক দুর্দান্ত প্রতিযোগীকে খতম করা পাষাণী যেন নাড়াতে ভুলে যায় একটা আঙুলও। আনমনে ভেজা গাল দুটো মুছল। সে তো মেনেই নিয়েছিল। বাধ্য হয়েছিল মেনে নিতে, যে এই বর্বরতা তাকে সহ্য করতে হবে আমৃত্যু। কিন্তু কেন গতকাল এল না সেই বুড়ি? কেন তাকে দিল না ইনজেকশনটা, আর নিজের অজান্তেই বিদ্রোহ করে বসল তার হাত-পা! ভাবতে ভাবতেই ওর উন্মুক্ত পিঠের ওপর কে যেন একটা খসখসে হাত রাখল। নরম গলায় ডাকল, “মা?”
চমকে উঠে তাড়াতাড়ি নিজেকে ঢেকে নিল সে। তারপর পিছনে ঘুরে দেখল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই বৃদ্ধা। “তুমি! তুমি এখন এসেছ! কোথায় ছিলে গতকাল!” পাষাণীর মুখ দিয়ে অগ্নি বৃষ্টি শুরু হল। কিন্তু ওর গলার আগুনটা আস্তে আস্তে কেমন যেন পালটে যাচ্ছিল দলা পাকানো কান্নায়। সজল দুটি চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল বুড়ি। কী যেন বলতে গিয়ে সামান্য কেঁপে উঠল তার শুকনো ঠোঁট জোড়া, কোনও আওয়াজ বেরোল না। কত দিন এমন গেছে, যেদিন পুরন্দরের অত্যাচারের পর কিংবা ময়দান থেকে একজনকে খুন করে জিতে ফেরার পর বাঁধভাঙা কান্নায় সে আছড়ে পড়েছে এই বৃদ্ধার কোলে। কোনওদিন কিছু জানতে চায়নি সে, দেয়নি কোনও প্রবোধ বাক্যও। শুধু এগিয়ে দিয়েছে নিজের কাঁধ, মমতাভরা হাত রেখেছে ওর মাথায়। কিন্তু আজ আর নিজেকে উজাড় করে কাঁদতে পারল না পাষাণী। সে তো জেনেই গেছে তার পরিণতি। শুধু অবরুদ্ধ গলায় বলল, “চলে যাও, বুড়ি। আর এসো না কোনওদিন।”
ছলছলে চোখে তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল বৃদ্ধা। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে সাবধানে কোঁচড় থেকে বের করল একটা শিশি। টলটলে স্বচ্ছ এক অদ্ভুত নীল তরল তাতে, মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ চমকের মতো কী যেন ঝিলিক মারছে তার ভেতর থেকে। বোতলটা পাষাণীর মুঠোর মধ্যে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এটা খেয়ে নিও। তাণ্ডব তোমাকে হারাতে পারবে না মা। তুমিই জয়ী হবে!”
***
ঘরটার সব কিছুই সাদা। হালকা বাতাসে উড়তে থাকা স্বচ্ছ সুদৃশ্য পরদা, গভীর সফেন বাথটব। তাতে গা ডুবিয়ে বসেছিল পুরন্দর। শুধু তার ডান হাতে ধরা সুরাপাত্রটা রক্তবর্ণের। সামান্য সাদা কাপড় জড়ানো এক স্বল্প বসনা যুবতী সুগন্ধি তেল মালিশ করছিল তার কাঁধে। ন্যাড়া মাথাসহ শরীর জুড়ে আঁকা চোখ-ট্যাটুগুলো যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। অন্যান্য দিন এইসময় আরামে চোখ বুজে আসে তার, যুবতীর আঙুল শরীর বেয়ে নীচে নামতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠতে থাকে তার পৌরুষ, আর শেষ পর্যন্ত মেয়েটির সঙ্গে মেতে ওঠে কামোন্মাদ এক খেলায়। প্রায় প্রতি দিনই একজন নতুন যৌবনবতী নারী আসে তার এই খেলার সঙ্গিনী হতে। কিন্তু আজ যেন কিছুতেই উপভোগ করতে পারছিল না পুরন্দর। আগুনের ভাঁটার মতো দু-চোখ মেলে তাকিয়েছিল দূরের দিকে, আর মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছিল গ্লাসে। গতরাতের ওই ঔদ্ধত্যের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে! সে পুরন্দর, এই “অমরাবতী সিটি” র একচ্ছত্র অধিপতি, আর তাকেই নাকি প্রত্যাখ্যান করার, আঘাত করার সাহস পায় ওই মেয়েটা!
মদের গ্লাসটা আপনমনে একবার গালে বুলিয়ে নিল। সেই প্রথম দিন থেকেই মেয়েটা অন্যরকম। শহরের শেষ প্রান্তে, নিচু লোকেদের নোংরা বস্তিটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ যেদিন তার চোখে পড়ে গেছিল, সেদিন দেখেই বুঝেছিল এ অন্যরকম। তারপর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এনে ল্যাবরেটরিতে স্মৃতি মুছে দেওয়া থেকে শুরু করে লড়াইয়ের ময়দানে তার নাম, অস্ত্র কী হবে সব কিছুই নিজে ঠিক করে দিয়েছিল পুরন্দর। যখন ক্রুদ্ধ কালনাগিনীর মতো ছোবলে ছোবলে সে অস্থির করে ফেলত প্রতিপক্ষকে, সেই সুনিপুণ অস্ত্রচালনা দেখতে দেখতে জেগে উঠত তার উত্তেজিত পৌরুষ। আর তাই প্রতি রাতে ইনজেকশন দেওয়ার পর সে খুঁড়ত ওই অসাড় হয়ে থাকা শরীরটাকে। খুঁড়ে দেখতে চাইত কী আছে ওর ভেতরে যা ওকে সবসময় চুম্বকের মতো টানে? কিন্তু দুঃসাহস দেখিয়েছিল পাষাণী, যেখান দিনকয়েক আগে প্রথমবার গলা তুলে কথা বলেছিল তার সামনে। “অমরাবতী সিটি” র সমস্ত বাসিন্দার দেখ-ভালের দায়িত্ব তার কাঁধে। এই চতুর্বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে প্রযুক্তি সম্ভবত তার উন্নতির চূড়ায় গিয়ে ঠেকেছে। না, খাদ্য-পানীয় কিংবা রোগ জ্বালার বিষয়ে মানুষকে আর চিন্তা করতে হয় না। শুধুমাত্র নীচুতলার কিছু মানুষ বাদ দিলে এই শহরে প্রায় সবাই অজর, অমর। কিন্তু ভোগবিলাস, বিনোদন? তার জোগান যথাযথভাবে পূর্ণ করার গুরুভারই তো পুরন্দরের ওপর। আর এখন বিনোদনের সবথেকে বড় খেলা হচ্ছে মানুষে মানুষে যুদ্ধ। সেখানে যত বেশি রক্ত ঝরে, যত বেশি নৃশংসতার প্রদর্শন হয়, তত আমোদিত হয় দর্শকরা। হাজার হাজার বছর আগেও নাকি এই ধরনের লড়াইয়ের চল ছিল, শুনেছে পুরন্দর। অথচ এ মেয়েটা তার মুখের ওপর বলে দিল সে আর একটিও নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে পারবে না! মানুষ আবার নিরীহ কীসের? সে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা না করলেও প্রতিদ্বন্দ্বী কি তাকে ছেড়ে দেবে? কিন্তু না, তার সেই এক রা। সে নিজে মরে যাবে তাও ভালো, কিন্তু কাউকে হত্যা করতে পারবে না। আর তার কথা মতো কাজ করলও পাষাণী। গতকালের লড়াইয়ে উলটোদিকের লোকটাকে ভীষণভাবে ঘায়েল করেও তাকে ময়দানে জীবিত ফেলে রেখে ফিরে এসেছিল। মাথায় খুন চড়ে গেছিল পুরন্দরের! বাকিরাও এই বিদ্রোহীর পথ অনুসরণ করলে তো সমূহ বিপদ! রক্ত, মৃত্যু দেখতে না পেলে তো অস্থির হয়ে উঠবে দর্শকরা, এমনকী সে নিজেও! তাই মেয়েটাকে শিক্ষা দিতে ওর বুড়ি ধাইকে বারণ করে দিয়েছিল ব্যথানাশক ইনজেকশনটা না দিতে। সেই রাতে ওর কান্না, ওর চিৎকার, বাঁচার আর্তনাদ শুনতে চেয়েছিল সে। কিন্তু… পাষাণীর সেই চড়টা যেন আবার আছড়ে পড়েছে তার গালে!
একটা জান্তব আওয়াজ করে হাতের গ্লাসটা ছুড়ে ফেলল পুরন্দর। কাচ ভাঙার তীক্ষ্ণ শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই সভয়ে ছিটকে উঠল সেবায় নিয়োজিত দাসী। গত রাত থেকে এই চড়টা যেন প্রতি মুহূর্তে ব্যঙ্গ করছে তাকে! যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে ওই মেয়েটার ক্ষমতা কতদূর! এরপর তো আর ওকে বাঁচতে দেওয়া যায় না! “চলে যাও এখান থেকে!” হিংস্র পশুর মতো গর্জন করতে করতে উঠে দাঁড়াল পুরন্। তার সেই ভয়াল উলঙ্গ মূর্তি দেখে আঁআঁ করতে করতে পালিয়ে গেল মেয়েটা। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কাঁটার মুগুর হাতে দৌড়ে এসেছে যন্ত্র-ভৃত্য। “তাণ্ডবকে পাঠিয়ে দাও আমার ঘরে”, পোশাক পরতে পরতে গুরুগম্ভীর গলায় আদেশ দিল অমরাবতীর রাজা। এই মেয়ের মৃত্যু যেন এই ময়দানের বীভৎসতম অধ্যায় হয়, এবার সেটাই সুনিশ্চিত করবে সে।
***
একটা কালচে আলো। ময়লা কাপড়ের ভেতর দিয়ে একটা কালিঝুলি মাখা দিনকে দেখার চেষ্টা করলে মনে হয় এরকমই লাগে। সব কিছু অস্বচ্ছ, সমস্ত অবয়ব ছায়া ছায়া। চোখগুলোকে টেনে বড় করার চেষ্টা করছিল পাষাণী। নাহ, চোখের সামনের এই তেলচিটে পরদাটা সরছে না কিছুতেই। বরং জ্বলুনিটা বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। ময়দানে ঢোকার মুখটাতে এসে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে সে, কোনওমতে পাথরটায় ভর করে। চারপাশে দর্শকদের চিৎকার বোধহয় শুরু হয়েছে, তবে ঠিক ঠাহর করতে পারছে না। একটা ভোঁতা শব্দ শুধু দুম দুম করে হাতুড়ির বাড়ি মারছে তার মাথার ভেতর। নিশ্চয়ই তার মৃত্যুর আনন্দ সঙ্গীত গাইছে ওরা। মরতেই তো চেয়েছিল সে, কিন্তু মরণ যে এভাবে গুপ্ত শত্রুর বেশে আসবে তা তো কখনও ভাবেনি! তার জীবনের যেটুকু সুন্দর, যেটুকু মায়ার ছিল, সেটুকুও ঝলসে পুড়ে গেল বিশ্বাসঘাতকতার গরলে। এই নরকের মতো অমরাবতীতে একমাত্র যে মানুষটাকে ভরসা করেছিল, আপন ভেবেছিল, সেইই তাকে পেছন থেকে ছুরিটা মারল এভাবে! তার চেয়ে তো লড়াইয়ের ময়দানে বীরের মতো মৃত্যু কাম্য ছিল তার। ওই বুড়ির দিয়ে যাওয়া নীল রঙের বিষ প্রতি মুহূর্তে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে তার শরীরের ভেতরটা, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি, অবশ হয়ে আসছে প্রতিটা অঙ্গ। এই শহরে প্রত্যেকটা মানুষ আসলে পুরন্দরের চর, ওই বুড়িও শুধু অভিনয় করে তার সরলতার সুযোগটুকু নিয়েছে। চারদিকের বিকট আওয়াজে সম্বিৎ ফিরল পাষাণীর। কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে ময়দানের মাঝখানে। ওই তো সামনে আবছা পাহাড়ের মতো লোকটা তাণ্ডব, দাঁড়িয়ে আছে তার বিশাল গদা নিয়ে। ঘষটে ঘষটে টেনে আনা নিজের পাথুরে অস্ত্রটা তুলে ধরার চেষ্টা করল সে, দুর্বল আঙুলের ফাঁক গলে পড়ে গেল দণ্ডটা। তা দেখে বোধহয় বিশেষ উৎসাহ পেল তাণ্ডব, লোহার ঘণ্টায় হাতুড়ি পড়তেই সবলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। ভারী শাবলের মতো একের পর এক কিল ঘুষি আছড়ে পড়ছিল তার ওপর, আটকানোর ক্ষমতা টুকুও ছিল না পাষাণীর, প্রত্যাঘাত তো দূরের কথা।
বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না লড়াই। দর্শকদের মধ্যেও উচ্ছ্বাস কমে আসছিল। মরণাপন্ন মানুষের মৃত্যু দেখায় তো সেই আনন্দই নেই! মুখ নাক ফেটে রক্ত পড়ছে পাষাণীর, ডান হাঁটুটা দুমড়ে গিয়ে মাটিতে ঘষটাচ্ছে। ওর মনে পড়ছে প্রথম দিন দেখা মেয়েটার কথা। মেয়েটার মতোই এবারে ওকে ধর্ষণ করবে তাণ্ডব, তার পর তাকে কুপিয়ে কুপিয়ে তার টুকরো টুকরো দেহাংশ ছুড়ে দেবে মাংসের আশায় থাকা অভুক্ত কুকুরের মতো দর্শকদের উদ্দেশে। এটাই তার স্বভাব। চেতনার চরম সীমায় পৌঁছে পৃথিবীটাকে শেষ বারের মতো দেখে নেওয়ার আশায় ঘোলাটে চোখে তাকাল পাষাণী। ওকে মাটিতে ফেলে ওর বুকের ওপর চেপে বসেছে তাণ্ডব, টেনে ছিঁড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে ওর কাপড়। হয়ত কিছুটা জৈবিক প্রবৃত্তিতেই বাঁচার তাগিদে শরীরের সব শক্তি এক করে তাকে ঠেলে সরানোর একটা অন্তিম চেষ্টা করল। তার এই স্পর্ধা দেখে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল তাণ্ডব! হাত দুটো পেছন দিকে মুড়ে একের পর এক ঘুষি মারতে লাগল তার মুখের ওপর। একটা গভীর কুয়োর মধ্যে যেন তলিয়ে যাচ্ছিল পাষাণী। প্রত্যেকটা ঘুষি নেমে আসছিল তার ওপর আর এক ধাপ করে ডুবে যাচ্ছিল সে। মাথার ওপর কালচে নীল আকাশটা যেন ছোট হচ্ছিল একটু একটু করে। একটা ছোট বৃত্ত, সেটা আরও সঙ্কুচিত হতে হতে পৌঁছে যাচ্ছিল বিন্দুর কাছাকাছি। শেষমেশ যখন তার চোখে ভেসে থাকা সেই নীল বিন্দুটাও প্রায় মুছে যাবে, এমন সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল!
সেই অনন্ত বিন্দুর ভেতর থেকে একটা নীল তিরের মতো কী যেন ধেয়ে এল তার দিকে! যেন একখানা নীল হাত সজোরে জাপটে ধরল তাকে, টেনে তুলতে লাগল কুয়োর ভেতর থেকে। যেন অনেক দূর নেমে গেছে সে, আর নামা যাবে না। এবার ওঠার সময়। তার শরীরটা পালকের মতো হালকা হয়ে আসছিল, সে ভাসছিল পাখির মতো, তারপর একসময় ভুস করে জেগে উঠল অবচেতনের গভীর খাত থেকে!
দু-চোখ মেলে তাকাল পাষাণী। তার চোখের সামনের সমস্ত অস্পষ্ট জাল কেটে গেছে। পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখল সে শুয়ে আছে ময়দানে। তার সামনে দর্শকদের দিকে দু-হাত তুলে বিজয়ীর অভিবাদন কুড়োচ্ছে তাণ্ডব। কিন্তু খেলা তো শেষ হয়নি! এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল সে। উল্লাসরত দর্শকদের মধ্যে হঠাৎই যেন নেমে এল অখণ্ড নিস্তব্ধতা। যেন একটা পিন পড়লেও আওয়াজ শোনা যাবে। এমন অদ্ভুত দৃশ্য কোনওদিন দেখেনি কেউ! অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাণ্ডবও। তার লাল চোখ দুটোয় বিস্ময়, অবিশ্বাসের সঙ্গে মিশে আছে কিছুটা ভয়ও। তবে এক মুহূর্তেই নিজেকে সামলে পুরো উদ্যম নিয়ে আবার তেড়ে এল শিকারি বাঘের মতো।
পূর্ণ মনোযোগে তার দিকে তাকাল পাষাণী। আর তখনই ঘটে গেল অভাবনীয় ব্যাপারটা।
একটা নীলচে ঘন কুয়াশা তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে ঘিরে ফেলল তাণ্ডবকে, তারপর কোনও এক অদৃশ্য শক্তি যেন আস্তে আস্তে মাটিতে গেঁথে ফেলতে লাগল তার প্রকাণ্ড শরীরটাকে! অসহায়ের মতো নিজের পায়ের দিকে তাকাল তাণ্ডব, ছটফটিয়ে যেন কাটার চেষ্টা করল কোনও অদৃশ্য বাঁধন, কিন্তু এক অলৌকিক জাদুবলে তার দেহ তখন জমে পরিণত হতে শুরু করেছে পাথরে! নীলাভ-সাদা সেই পাথর একটু একটু করে দখল করছে তার পেট, বুক; একটা জান্তব গোঙানি উঠে আসছে তার গলা দিয়ে। অবশেষে ধীরে ধীরে সেই আওয়াজ বুজিয়ে দিয়ে তার পুরো শরীর পরিণত হল এক প্রস্তর মূর্তিতে!
বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেছে দর্শককুলও। ওই অবিশ্বাস্য ঘটনার অভিঘাতে তারা যেন পরিণত হয়েছে মন্ত্রপূত পুতুলে, ওইভাবেই স্থির হয়ে বসে আছে আজন্ম কাল। হঠাৎ একটা প্রবল আক্রোশ উঠে এল পাষাণীর ভেতর দিয়ে! আকাশ ফাটানো এক প্রবল গর্জন করতে করতে ভীষণ ক্রোধে সে সামনের দিকে ছুড়ে মারল তার পাথরের অস্ত্রখানা। আর তার ধাক্কায় মুহূর্তের মধ্যে খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে পড়ে ধুলোয় মিশে গেল তাণ্ডবের প্রস্তরমূর্তি! তার মাথার মধ্যে বেজে উঠল একটা পাগলাঘণ্টি, “পালাতে হবে! পালাতে হবে এখান থেকে! এই সুযোগ!” পাথুরে অস্ত্রটা তুলে নিয়ে লাগাম ছেঁড়া ঘোড়ার মতো পাষাণী দৌড়ল ময়দানের বাইরে যাওয়ার রাস্তার দিকে। তূণ থেকে বেরোনো একটা তির যেন শনশন করে হাওয়া কেটে এগিয়ে যেতে থাকল ময়দানের শেষ প্রান্তে। যন্ত্রের মতো বসেছিল জনতা। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে হঠাৎ একটা ভাসমান আসন থেকে লাফ দিয়ে নেমে ওর রাস্তা আটকালো কেউ। পুরন্দর! দু-হাত দু-পাশে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাঁধানো রাস্তা জুড়ে, চোখে পাশাপাশি বিরাজ করছে ভয় ও সতর্কতা! বাইরের তোরণের প্রায় কাছে পৌঁছে গেছিল পাষাণী, আকস্মিক বাধা পেয়ে পূর্ণ মনোযোগে তাকাল সামনে চলে আসা তার বহুদিনের অত্যাচারী প্রভুর দিকে। ঝলসে উঠল দুই চোখ।
আবার সেই অলৌকিক জাদুর খেলা! এক ময়দান বিস্মিত জনতার সামনে দুর্দান্ত ঘূর্ণিঝড়ের মতো দিগন্তের দিকে মিলিয়ে গেল সেই যোদ্ধা নারী । শুধু পেছনে পড়ে থাকল সর্বাঙ্গে নারীর যোনির মতো চোখ খোদাই করা বিস্ফারিত দৃষ্টির এক প্রস্তরমূর্তি।
***
একটা নরম মায়াবী আলোয় ভরে আছে রাজপথ। শূন্যে ভাসমান ছোট ছোট স্বচ্ছ বলের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ কামরাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তার দুই পাশে, তাতে নিশ্চিন্তে বিশ্রামরত মানুষেরা দেখতেও পেল না রাজপথ দিয়ে ঝড়ের বেগে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছে চোখে কালো কাপড় বাঁধা এক নারী। মুক্তির আনন্দকেও ছাপিয়ে একটা করাল আতঙ্ক উঠে আসছিল পাষাণীর ভেতর থেকে। এ কী হল তার? কী ছিল ওই তরলে যা জন্ম দিল এই অদ্ভুত ক্ষমতার! সে কি নিজেই পরিণত হল মূর্তিমান শয়তানে? নোনতা জলের ধারা কাপড়ের আড়াল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল গাল বেয়ে। ময়দান পেরোনোর পরই নিজের এই পরিবর্তনে শঙ্কিত হয়ে কাপড় ছিঁড়ে চোখ ঢেকে ফেলেছে, তা সত্ত্বেও কীভাবে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সব কিছু, জানা নেই তার। গন্তব্যহীনভাবে পথ চললেও নিজের অজান্তেই ত্রিস্তরীয় অমরাবতী শহরের সর্পিল রাস্তা ধরে ক্রমশ নীচের দিকে নামছিল সে, মস্তিষ্কের এক অজানা সঙ্কেতে এগিয়ে যাচ্ছিল শহরের সবচেয়ে নিচু ধাপে থাকা নোংরা বস্তিটার দিকে। একসময় রাস্তার ধারে চোখ পড়তেই হঠাৎ যেন কেউ মাটিতে গেঁথে দিল তার পা দুটো।
অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ন্যাড়া মাঠ, অবহেলায় পড়ে আছে শহরের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে। গাদাগাদি করে থাকা কিছু প্রাগৈতিহাসিক যুগের মাটির বাড়ি, তাদেরই একটার সামনে মশালের আলোয় মাথা নিচু করে কী যেন করছে একজন। প্রচণ্ড ক্রোধে মাথার সব শিরা দপদপ করে উঠল পাষাণীর। সেই বুড়ি! যার জন্য তছনছ হয়ে যাচ্ছে সবকিছু!
তার পায়ের আওয়াজে মুখ তুলে তাকিয়েছে বুড়িও। মশালের আলোয় চকচক করে উঠল সর পড়া চোখ দুটো। আনন্দ বিস্ময় আবেগ সব যেন মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে সে চোখে! ধরা গলায় বলে উঠল, “আমি জানতাম! আমি জানতাম তুই আসবি! ওর স্পর্শেই তুই মুক্ত হবি ওই পাথুরে নরক থেকে!” দু হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে গেল তাকে।
এক ঝটকায় বৃদ্ধাকে ঠেলে দিয়ে আহত বাঘিনীর মতো গর্জন করে উঠল সে, “চুপ কর ডাইনি! কে তুই? কী চাস? কোন বিষ দিয়েছিস আমাকে?”
থমকে গেল বৃদ্ধা। অবিশ্বাস ভরা দুই চোখ নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর কান্নাভেজা গলায় আস্তে আস্তে বলল, “তুই… তুই সত্যিই আমায় চিনতে পারছিস না, মা? কিচ্ছু মনে পড়ছে না তোর?”
বৃষ্টিভেজা টুকরো টুকরো কিছু মুহূর্ত ফুটে উঠল পাষাণীর চোখের সামনে। সেই জলের তোড়ের পেছনে যেন লুকিয়ে আছে কিছু অবয়ব, কিন্তু স্পষ্ট নয় তারা। ঘষা কাচের আবরণ তাদের সর্বাঙ্গে। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে যেন অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল, “না! কিচ্ছু মনে পড়ছে না! ওই বিষ… ওই বিষ সর্বনাশ করে দিয়েছে আমার!”
বাঙ্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ মুছল বুড়ি। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্পষ্ট স্বরে বলল, “না, কোনও বিষ নয়। ওতে ছিল আশীর্বাদ। তোমার জন্য, আমাদের জন্য… সমগ্র মানবজাতির জন্য এক আশীর্বাদ। আজ থেকে বহুযুগ আগে এসেছিলেন তিনি, সেই সুদূর সরযূ নক্ষত্রমণ্ডলী থেকে। নিজের দিব্যদৃষ্টির বলে দেখতে পেয়েছিলেন আমাদের ভবিষ্যতের এই দুরবস্থার কথা, আর রেখে গেছিলেন এই অমৃত। কেউ বলে তিনি ছিলেন এক অসীম প্রতিভাধর বিজ্ঞানী, কেউ বা বলে পরমপূজ্য দেবতা। নোংরা কীটের মতো শহরের বাইরে যাদের ছুড়ে ফেলেছে উচ্চবর্গের লোকেরা, সেই আমাদের সঙ্গে মিশেছিলেন তিনি। শুনেছিলেন যন্ত্রণাময় জীবনের কথা। আর বলেছিলেন একদিন আমাদের মধ্য থেকেই উঠে আসবে কিছু অসাধারণ বীর যোদ্ধা, যারা বদলে দেবে সব কিছু। মুক্তি দেবে আমাদের এই বঞ্চনার শেকল থেকে। আবহমানকাল ধরে এই অমৃত অপেক্ষা করেছে সেই যোগ্যতমদের জন্যই! আমার দায়িত্ব ছিল সেটা সঠিক ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়ার, আমি তা পালন করেছি মাত্র। তুমি তাদের মধ্যে একজন।”
বৃদ্ধার কথাগুলো যেন প্রবল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছিল পাষাণীর মাথার মধ্যে। মন মানতে চাইছে না এই রূপকথার গল্প। কিন্তু একটু আগের ঘটে যাওয়া অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো? একরাশ ক্লান্তি ভারী শেকলের মতো জড়িয়ে ধরছে তার হাঁটু দুটোকে। কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল পাষাণী, বন্ধ করল কালো কাপড়ে ঢাকা চোখ দুটো। সেই ময়দানে দেখা অদ্ভুত স্বপ্নটা আবার ঘিরে ধরছে তাকে। সেই ঘুটঘুটে কালো গভীর কুয়োটা, যার মধ্যে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে সে। সমস্ত জগতের ক্লেদ, হিংসা, নারকীয়তার লোলুপ অন্ধকার যেন নিজের মধ্যে গিলে নিতে চাইছে তাকে। ঠিক এমন সময় এগিয়ে এল একটা বলিষ্ঠ নীলাভ হাত, জড়িয়ে ধরল পরম মমতায়। একটা কোমল স্পর্শে চোখ মেলল। মমতা ভরা হাত তার মাথায় রেখেছে বুড়ো মানুষটা, ফোঁটা ফোঁটা কান্নায় ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে।
আচমকা একটা কর্কশ আওয়াজে কেঁপে উঠল চারদিক! চমকে উঠল বুড়ি! ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল, “ওই! ওই বেরিয়ে পড়েছে পুরন্দরের পোষা রাক্ষসেরা তোমাকে খুঁজতে! আর দেরি করা যাবে না, বেরিয়ে পড়ো তুমি। তাঁর কথা মিথ্যে হতে পারে না, বাঁচতেই হবে তোমাকে! পালাও!”
“কিন্তু কোথায় যাবো আমি?” অসহায়ের মতো ছটফট করে উঠল পাষাণী, “আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না…”
“এখান থেকে বেরিয়ে সোজা বিন্ধ্য পর্বতের দিকে রওনা হবে তুমি,” চারদিক দেখে নিয়ে সন্ত্রস্ত গলায় বলল বুড়ি, “তিনি বলে গেছেন, বিন্ধ্য পর্বতের পশ্চিম ঢালে এক গোপন গুহায় অপেক্ষা করে থাকবে তোমার নিয়তি, এক দ্বৌসজ। তাকে গিয়ে বলো নিজের আসল নাম, বাকি সব কিছু সেই ঠিক করে দেবে।”
ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল সে। দ্রুতপায়ে এগোতে গিয়েও যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর বিভ্রান্তের মতো বুড়ির দিকে ঘুরে বলল, “আসল নাম! আমার নাম তো পাষাণী!”
বিকেলের শেষ আলোর মতো একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল বুড়ির মুখে। পুরনো দিনের গন্ধ মাখা একটা মৃদু অথচ দৃঢ় স্বর যেন বহুদূর থেকে ভেসে এল।
“না, পাষাণী নয়। তোমার নাম অহল্যা।”
Tags: দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়, ফ্যান্টাসি গল্প, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সৌরভ দে
বাঃ, বেশ ভাল লাগল আপনার এই নতুন রূপকথাটা।