রহস্য-দ্বীপের কাহিনী
লেখক: ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চারের পরিবেশ নেই, বাঙালী ছেলের জীবনে অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ নেই—এমনি একটা কথা আমরা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি। বোধ হয় এই জন্যই সেকালের অ্যাডভেঞ্চার–গল্পের লেখকেরা তাদের টেনে নিয়ে যেতেন আফ্রিকার দুৰ্ভেদ্য জঙ্গলে, অষ্ট্রেলিয়ার জনমানবহীন প্ৰান্তরে কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের বন্য পরিবেশে। ক্কচিৎ আসামের জঙ্গলেও তাদের নিয়ে যাওয়া হ’ত না এমন নয়, কিন্তু হিমালয়ের কথা বড় একটা কারো মনে পড়ত না। যাই হোক, গল্পের ভিতর স্বাভাবিকতা আনবার জন্যই যে এ–রকমটা করা হ’ত তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু আমাদের চোখে তাই হয়ে দাঁড়াত অস্বাভাবিক, এমনকি হাস্যকরও বলা যেতে পারে। কারণ ঐ রকম পটভূমিকায় বাঙালী ছেলেদের আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না।
কিন্তু দিন–কাল বদলে গেছে। এখন যে কোন দুৰ্গম জায়গায় বাঙালী যেতে দেখলে আমরা অবাক্ হই না। আগেকার দিনে যা গল্পচ্ছলেও অবিশ্বাস্য ছিল এখন তা বাস্তব জীবনেই সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার এ কাহিনীর অবতারণাও সেই প্রসঙ্গেই বলা যেতে পারে।
গত কয়েক বছর থেকেই বাংলাদেশে মাছের যেন দুৰ্ভিক্ষ লেগেছে। দুধ আর মাছ এই দু’টিই ছিল বাঙালী পরিবারের খাবারের বৈশিষ্ট্য। প্রথমটির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, দ্বিতীয়টির আকাল যেন কিছুতেই বরদাস্ত করা যাচ্ছে না। তাই গভর্নমেণ্টেরও টনক নড়েছে, তাঁরা মাছের জন্য খালবিল, নদী–পুকুর চষে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু মাছ কই? অবশেষে নজর পড়েছে সমুদ্রের দিকে। টাটকা জলের মাছ যদি না–ই পাওয়া যায় নোনা জলে তো মাছের অভাব নেই।
কিন্তু ধরে কে? আর কি করেই বা ধরে? বাংলাদেশের তলা দিয়ে টল টল করে সমুদ্রের স্রোত বয়ে গেলেও সমুদ্রে মৎস্যশিকারে বাঙালী তেমন অভ্যস্ত নয়। সাজসরঞ্জামেরও অভাব প্ৰচণ্ড।
এই অসুবিধা দূর করার জন্যই গভর্নমেণ্ট কয়েকটি চালাক–চতুর ছেলে বেছে নিয়ে এ ব্যাপারে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন ঠিক করলেন।
সমুদ্রে মাছ ধরার ব্যাপারে এশিয়ার মধ্যে জাপানীরাই বোধ হয় সবচেয়ে অগ্রসর জাত, তাই ঠিক হ’ল এই ছেলেদের কয়েক মাসের জন্য জাপানে পাঠানো হবে।
প্ৰশান্তও ছিল এই ছেলেদের মধ্যে একজন। সে জুয়লজি অর্থাৎ জীববিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে বি. এস–সি পাস করে কি করবে কি করবে ভেবে ঠিক করতে পারছিল না। হঠাৎ কাগজে সরকারী বিজ্ঞাপন দেখে একখানা দরখাস্ত ছেড়ে দিল আর প্রথম চোটেই তার ডাক পড়ল। তারপর একদিন শুভদিনে শুভক্ষণে (কিংবা হয়তো অশুভদিনে অশুভক্ষণে) আর কয়েকটি সঙ্গীর সঙ্গে যাত্রা করল সুদূর জাপানে।
অদ্ভুত দেশ জাপান। দেশটাও যেমন বিচিত্র, লোকগুলোও তেমনি। প্রশান্তদের শিক্ষার ভার যাঁর ওপর পড়ল তাঁর নাম ডক্টর কারিকুরা। অত্যন্ত অমায়িক ভদ্রলোক। তা ছাড়া জীববিজ্ঞানে এবং সমুদ্রবিজ্ঞানে তাঁর অসম্ভব জ্ঞান। বহুদিন ধরে সামুদ্রিক মাছদের নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। সাধারণ লোকে খবর রাখে না এমন দুৰ্গম জায়গায় অভিযান চালিয়েছেন, সমুদ্রের আনাচে–কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা ভাঙ্গা ইংরেজীতে প্রায়ই গল্প করতেন তিনি প্রশান্তদের কাছে।
প্রথম কয়েকদিন ডাঙ্গাতেই ক্লাস চলল। তারপর শুরু হ’ল ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে শিকারযাত্রা। প্রথমে ছোট ছোট ট্রলারে চেপে উপকূলভাগেই ঘুরে বেড়ানো হ’ত। কোথায় মাছেদের থাকার সম্ভাবনা, কি করে তাদের সন্ধান পেতে হয়, কি করে নজর এড়িয়ে তাদের ধরা যায়—এ সব বিষয়ে অল্পদিনের মধ্যেই দলের সবাই পোক্ত হয়ে উঠল। প্ৰশান্ত মনে মনে ভাবল, দেশে গিয়ে সুন্দরবনের আশপাশটা কি করে চষে ফেলতে হয় তা দেখিয়ে দেবে। মাছের অভাব রাখতে দেবে না সে বাংলাদেশে।
সপ্তাহ তিনেক ঐভাবে ঘোরার পর কারিকুরা বললেন, “এবার আমাদের আরও বড় জাহাজ নিতে হবে—আরও বড় ট্রলার। কারণ, এবার আর আমরা উপকূলের কাছে ঘুরব না—পাড়ি দেব মাঝ–সমুদ্রে। সমুদ্রের এক–একটা জায়গা আছে যেখানে বিশেষ বিশেষ মাছ ঝাঁক বেঁধে ঘোরে। কোন কোন ঝাঁকে বিশ হাজার—পঞ্চাশ হাজার—এমন কি লক্ষাধিক মাছও থাকতে পারে। এইরকম একটা ঝাঁকের সন্ধান পেলে আর ভাবনার কারণ থাকে না। ধর আর তোল। তবে সব মাছই অবশ্য মানুষের খাবার উপযোগী নয়। তা ছাড়া ভারী সেয়ানা ওরা। সমুদ্রে ওদের দুষমণ বড় বড় জলজীবের তো অভাব নেই। হাঙ্গর আছে, তিমি আছে, আরও কত কি হিংস্ৰ জানোয়ার আছে। তার ওপর আজকাল আবার মানুষেরাও সেই হিংস্র শিকারীদের দল ভারী করছে। কাজেই কি করে আত্মরক্ষা করতে হয় সে বিষয়েও ওরা খুব সজাগ। খুব হুঁশিয়ারীর সঙ্গে এগোতে না পারলে সমস্ত পরিশ্রমই পাণ্ড হয়ে যাবে।”
প্ৰশান্তের এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। অনন্ত সমুদ্রের মাঝখানে ছোট্ট একটা মোচার খোলার মত ভাসছে ওরা। ডক্টর কারিকুরা তাঁর যন্ত্রপাতি নিয়ে নানান রকম পরীক্ষা চালাচ্ছেন। কখনও তীব্র আলো ফেলছেন জলে, কখনও ওজন–বাঁধা ধাতুর তার নামিয়ে দিচ্ছেন। কানে হেডফোন লাগিয়ে পরীক্ষা করছেন শব্দ—যেন অতল জলের মর্মবাণী বুঝে নিতে চান। শিক্ষার্থীরাও একে একে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। অস্বাভাবিক কিছু ঘটলেই ছুটে এসে খবর দিচ্ছে তাঁকে।
কাল রাত্রে ছোট একটা মাছের ঝাঁক ধরা পড়েছিল। ছোট হলেও হাজার দু’–তিন মাছ ছিল সেই ঝাঁকে। জাল দিয়ে যখন তোলা হ’ল তখন সে কী উত্তেজনা সবাইকার! কিছু মাছ অবশ্য বেরিয়ে চলে গিয়েছিল, কিন্তু যা পাওয়া গেল তারও দাম বড় কম হবে না।
ভারি ভালো লাগছিল প্ৰশান্তর। কলকাতায় বন্ধুরা তাকে ঠাট্টা করে ‘জেলে’ বলে ক্ষ্যাপালে কি হবে, আসলে সে এখন একজন ‘ফিশারি–এক্সপাট’। বাংলায় ‘ধীবর–রাজ’ উপাধি হতে পারে তার। দলের মধ্যে একমাত্র সে–ই বাঙ্গালী। এ ছাড়া তাদের সঙ্গীরা সকলেই প্ৰায় দক্ষিণ ভারতীয়। কেউ এসেছে কেরালা থেকে, কেউ তুঁতকরি থেকে, কেউ বা তামিলনাদের একেবারে তলার দিক্কার বাসিন্দা। একজন সিংহলীও আছে। বাদবাকি সবাই জাপানী—ডক্টর কারিকুরারই সাক্ষাৎ শিষ্য তারা। তা যে যে দেশেরই হোক, তারা নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিল ভালোই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়ে হৈ–হল্লা, খাওয়াদাওয়া, স্ফূর্তি চলতে লাগল সমানে। এরই মধ্যে একটু ফাঁক পেলে ডক্টর কারিকুরাও এসে জুটতেন। শুরু হ’ত তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত নানা অভিজ্ঞতার কাহিনী—যা নাকি উপন্যাসের মতই রোমাঞ্চকর।
বেশ চলছিল সব কিছু। জাপানের মূল ভূভাগ থেকে ওঁরা তখন অনেকটা চলে এসেছেন। কারিকুরার ইচ্ছা আরও সপ্তাহখানেক এইভাবে ঘুরবেন। প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে কয়েকটা সামুদ্রিক রেখা,—যাকে বলা হয় ‘বেণ্ট’, — ওঁরা পার হয়ে এসেছেন। আরও কয়েকটা পার হবার ইচ্ছা, এবং এরই একটা নাকি নানা জাতের মাছের আড্ডা—প্ৰায় ‘সাংচুয়েরীই’ বলা যেতে পারে।
কিন্তু সেদিন বিকেলের দিকে কারিকুরাকে কেমন একটু যেন উদ্বিগ্ন মনে হল। বারবার ডেকে আসছেন, আবার কেবিনে ঢুকে কি সব নক্সাটক্সা ঘাঁটছেন, ফের আবার আসছেন ডেকে।
প্ৰশান্ত ব্যাপারটা প্ৰথমে লক্ষ করে নি, লক্ষ করেছিল শেষাদ্রি আর অরুণাচলম্। দু’জনেই এসে প্রশান্তকে ফিস্ ফিস্ করে জানাল।
ডক্টর কারিকুরা তখন দূরবীণ দিয়ে দূর আকাশে কি যেন দেখতে ব্যস্ত। মুখের ভাব তাঁর প্রসন্ন নয় মোটেই। একটু পরেই তিনি ওদের কাছে এসে বললেন, “আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। মনে হচ্ছে খুব বড় একটা ঝড় আসছে।”
শেষাদ্রি ভয়চকিত কণ্ঠে বলল, “টাইফুন?”
“সম্ভবতঃ তাই। এ অঞ্চলে ঐটেরই উৎপাত বেশি আর ঐটেই সবচেয়ে মারাত্মক৷”
প্রশান্তও শুনল। চীন সমুদ্রে, জাপান সমুদ্রে ভয়াবহ টাইফুন–ঝড়ের কাহিনী সে ছেলেবেলায় ভূগোলের বইতে পড়েছে। কিন্তু নিজেকে যে কোনদিন তার খপ্পরে পড়তে হবে এ কল্পনা সে কোনদিনই করতে পারে নি।
সত্যি সত্যি টাইফুন এসে গেল সমুদ্রে।
ওঃ, সে কি ঝড় ! ঢেউগুলো সব পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে পরমুহুর্তে যেন হাজার হাজার টুকরো হয়ে ফেটে পড়ছে। ভূমিকম্পের প্রচণ্ড দোলায় দুলছে চারিদিক্। কান–ফাটানো বাতাসের শব্দে আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। এ যেন সেই বাইবেলের মহাপ্লাবনেরই পুনরাবৃত্তি। সেই মহাদুৰ্যোগে প্ৰশান্তদের জাহাজখানা যে কোথায় ভেসে চলল তা কারো বুঝবার উপায় রইল না। জাহাজের যাত্রীরা আত্মরক্ষার জন্য খোলের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল, অনেকেই সেখানে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল।
দু‘দিন দু’রাত্রি এইভাবে কাটবার পর ঝড়ের বেগ কমে গেল। আকাশ যদিও তখনও মেঘলা হয়ে রয়েছে, বৃষ্টিও পড়ছে থেকে থেকে, কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডব থেমে গেছে।
সকলের আগে ডক্টর কারিকুরা জাহাজের খোলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। পেছন পেছন প্ৰশান্ত, শেষাদ্রি—এরাও কয়েকজন উঠে এল।
জাহাজ আর সমুদ্রের ওপর ভাসছে না। একটা ছোট দ্বীপের গায়ে এসে কাৎ হয়ে পড়েছে। জাহাজের ওপরকার অনেক কিছুই ভেসে গেছে। মেরামত করে আবার কবে জাহাজ ভাসানো যাবে তার কিছু ঠিক নেই।
অদ্ভুত ধৈৰ্য ডক্টর কবিকুরার। তাঁর মুখে ভাবনার চিহ্ন ফুটে উঠলেও চালচলনে কোন বিচলিত ভাব বোঝা গেল না। দলের সবাইকে সাহস দিয়ে তিনি যন্ত্রপাতি নিয়ে তন্ময় হয়ে গেলেন।
এ কোথায় এসেছেন তাঁরা? প্ৰশান্ত সাগরের এদিকটায় তো কোন দ্বীপটিপ থাকার কথা নয়। আরও দক্ষিণ দিকে গেলে হয়তো ২/৪টে প্রবাল দ্বীপ চোখে পড়তে পারত; কিন্তু অতটা দূরে যে এই দু’দিনে তাঁরা ভেসে এসেছেন তা মনে হয় না।
যাই হোক, দ্বীপে যখন এসে পড়া গেছে। আপাততঃ জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। বিশেষ করে খাদ্য ও পানীয়ের অনুসন্ধান করাটা হ’ল প্রধান কাজ। জাহাজে যে খাবার জল ভরা ছিল তার অল্পই বাকি আছে, খাবারও যা ছিল তা দিয়ে বেশি সময় চলবে না। কিছু সমুদ্রের জলে ভেসে গেছে, কিছু ঝড়ে বাতাসে নষ্ট হয়ে গেছে। দ্বীপে কোন খাবার পাওয়া যায় কিনা তাও দেখতে হবে। বুনো ফলমূল, নারকেল গাছ এসব থাকলেও তবু কিছুটা সুরাহা হতে পারে। শিকারযোগ্য কোন জন্তু থাকলে তো কথাই নেই। অবশ্য কাছাকাছি জলে মাছ আছে কিনা তাও দেখতে হবে।
ডক্টর কারিকুরা ধীরে ধীরে জাহাজ থেকে নেমে এলেন, প্ৰশান্তকে বললেন, “তোমাদের মধ্যে থেকে দু–তিনজন বরঞ্চ আমার সঙ্গে এস, বাদবাকি জাহাজেই থাক। অজানা জায়গা, সবাই একসঙ্গে চলে আসা ঠিক হবে না। যতটা সম্ভব সাবধান হওয়াই ভালো।”
কিন্তু দ্বীপের চেহারা দেখে তাঁরা হক্চকিয়ে গেলেন। একটা লালচে ধুলোর আবরণে সমস্ত দ্বীপ ভর্তি। বড় গাছ বলতে একটিও চোখে পড়ে না—শুধু এধারে ওধারে কতকগুলো শ্যাওলা জাতের কি ছড়িয়ে আছে। তাদেরও গায়ে সবুজের আভা সামান্যই চোখে পড়ে—সমস্ত রং জলে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
ডক্টর কারিকুরা কয়েক মুঠো ধুলো খুবলে তুলে নিয়ে রুমালে জড়িয়ে পকেটে রেখে দিলেন।
এই সময় হঠাৎ খুব জোরে বৃষ্টি এল, সবাই তাড়াতাড়ি জাহাজে ফিরে এলেন। ডক্টর কারিকুরা যতটা সম্ভব বৃষ্টির জল ধরে রাখবার জন্য নির্দেশ দিয়ে আবার নিজের ঘরে চলে এলেন ধুলোগুলি পরীক্ষা করার মতলবে।
ট্রলারে মাছ ধরার সরঞ্জাম ছাড়াও কিছু যন্ত্রপাতি সব সময়েই মজুত রাখেন। তিনি। নতুন কোন জিনিস পেলেই তা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পরীক্ষা করে দেখা তঁর চিরকালের স্বভাব। যন্ত্রপাতির মধ্যে তাই একটা মাইক্রস্কোপও ছিল এবং ঝড়ে সেটা নষ্ট হয় নি।
মাইক্রস্কোপের নীচে এক চিমটি ধুলো রেখে গভীর আগ্রহে পরীক্ষা করতে লাগলেন তিনি। যা দেখলেন তাতে অবাক হয়ে গেলেন। প্রত্যেকটি ধুলোর কণার গায়ে অসম্ভব সুন্দর সব কারিকুরি। যেন কোন অজানা শিল্পী তুলি দিয়ে দিয়ে নিখুঁতভাবে সূক্ষ্ম আলপনা এঁকে রেখেছে ওদের গায়ে। অত ছোট জিনিস,—যা মাইক্রস্কোপ ছাড়া দেখাই যায় না,—তার গায়েও এই রকম কারিকুরি কি করে এল ভাবলেও বিস্ময় লাগে।
একটু পরে বৃষ্টিটা ধরে এল। ডক্টর কারিকুৱা তার সেই সঙ্গী কয়েকটিকে নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লেন। না বেরিয়ে উপায়ও ছিল না। যা হোক কিছু খাবার খুঁজে বার করতেই হবে। যদি কোন গাছটাছ পাওয়া যায়। তাই কাটবার জন্য একটা ছোট কুড়ুলও নেওয়া হল সঙ্গে!
কিন্তু সেই লাল ধুলোর মত মাটি আর ফ্যাকাশে শ্যাওলা ছাড়া বিশেষ কিছুই চোখে পড়ল না।
শ্যাওলাগুলো কি খাওয়া যায়? শেষাদ্রি একগাছা শ্যাওলা হাত দিয়ে তুলতে গিয়ে চমকে উঠল। বৈদ্যুতিক শক্ খেলে যেমনটা হয় শ্যাওলা তাকে ঠিক তেমনি এক শক্ খাইয়েছে। শুধু তাই নয়, ওর মনে হ’ল শ্যাওলার তলা থেকে যেন আলোর মত কি চিড়বিড় করছে। ডক্টর কারিকুরাকে এসে বলতেই তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। কিছু একটা অশুভ সম্ভাবনার কথা হয়তো তাঁর মনে উঁকি দিয়ে থাকবে।
প্ৰশান্ত অরুণাচলম্কে নিয়ে একটু দূরে এগিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ দেখা গেল তারা প্ৰাণপণে ছুটে আসছে। কি ব্যাপার? কি ব্যাপার? তারা নাকি একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেয়েছে, তাই খবর দিতে এসেছে।
“চল, চল, দেখে আসি।” কারিকুরার কণ্ঠে ভয়মিশ্রিত কৌতুহল।
চারজন সন্তৰ্পণে এগিয়ে চললেন। সত্যি, এমন অদ্ভুত কোন জিনিস যে থাকতে পারে তা তারা কল্পনা করতে পারেন নি। প্ৰায় দশ–বিশ হাত জায়গা জুড়ে একটা বিরাট ফুল পাপড়ি খোলা অবস্থার পড়ে আছে। টকটকে লাল তার রং, পাপড়িগুলো ঝুমকো লতার মত চারদিকে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এক–একটা লতা প্ৰায় দড়ির মত মোটা।
কোন ফুল যে এত বড় হতে পারে তা কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু এ যে চোখের সামনে ফুটে রয়েছে, বিশ্বাস না করে উপায় কি? কিন্তু আশ্চৰ্য, ফুলটা মাটির ওপরেই ছড়িয়ে রয়েছে—কোন গাছ বা পাতাটাতার বালাই নেই। তবে কি কাছে–পিঠে অন্য কোন দ্বীপ থেকে জলে ভেসে এসেছে?
ডক্টর কারিকুৱা বাধা দেবার আগেই প্রশান্ত একটু ভালো করে দেখবার জন্য আরও কাছে এগিয়ে গেল। দু’টো পাপড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করতে লাগল ফুলটাকে। পরক্ষণেই তার আর্ত চীৎকারে সকলে চমকে উঠল। ফুলের পাপড়িটা প্রশান্তকে সাপের মত জড়িয়ে ধরেছে—তারপর ক্রমাগত টেনে নিয়ে চলেছে মাঝখানে। অজগর জড়িয়ে ধরলে যেমন অবস্থা হয় প্রশান্তরও সেই অবস্থা।
প্রথমটা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন, কি করবেন ভেবে না পেয়ে। পরমূহুর্তে ডক্টর কারিকুরা হাতের কুড়ুলটি দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন প্রশান্তকে জড়িয়ে ধরা পাপড়ির গায়ে। পাপড়িটা দু’টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ল। প্রশান্ত তার আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য পা বাড়াল।
কিন্তু কোথায় পালাবে ? সঙ্গে সঙ্গে বাকি পাপড়িগুলো প্ৰায় একসঙ্গে জড়িয়ে নিল তাকে৷ প্ৰশান্তর সাধ্য কি তাদের হাত থেকে উদ্ধার পায়? ডক্টর কারিকুরা এবার মরি–বাঁচি হয়ে ডাইনে বাঁয়ে ক্ৰমাগত কুডুলের কোপ চালাতে লাগালেন। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল পাপড়িগুলি। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভিতর থেকে একটা হাল্কা রস বাতাসের বুদ্ধদের মত বেরিয়ে আসতে লাগল। প্রশান্ত কোন রকমে ছুটে বেরিয়ে এল তার মধ্য থেকে।
দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে সকলে দৌড় লাগালেন। এবার দেখা গেল–ও রকম ফুল একটা নয়, আরও গোটা ৩/৪ এদিক্ ওদিক্ ছড়িয়ে রয়েছে। সবগুলো দেখতে এক রকম নয়। রঙ্গিনও আছে, সাদা ফুলও আছে, কিন্তু আকারে সবগুলিই ওই রকম বিরাট। কোনটাই বেড়ে ১০/১৫ হাতের কম হবে না। বহু কষ্টে ওদের হাত এড়িয়ে সবাই এসে জাহাজে উঠলেন। প্ৰশান্ত তখন থরথর করে কাঁপছে। তার সারা গা জ্বলে যাচ্ছে যেন! ডক্টর কারিকুৱা তাড়াতাড়ি একটা তোয়ালে নিয়ে ওষুধে ভিজিয়ে ওর গা মুছিয়ে দিলেন তারপর শুইয়ে দিলেন বিছানায়।
বৃষ্টিটা আবার ঝেঁকে এল, মেঘে আকাশ রইল ঢেকে। তারপর সন্ধ্যা হয়ে এল। সে রাত্রে আর কারও জাহাজ থেকে নামবার সাহস হ’ল না।
কিন্তু পরদিনই দেখা গেল আকাশের অবস্থা বদলে গেছে। মেঘ কোথায় উড়ে গেছে, তার জায়গায় জ্বলন্ত সূর্য ঝলমল করছে আকাশে। তার আলোয় সাগরের জল আলোয় আলোময় হয়ে গেছে।
আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ডক্টর কারিকুরা আবার বেরিয়ে পড়লেন কয়েকজনকে নিয়ে। প্ৰশান্ত আজ আর সঙ্গে গেল না। সুস্থ হলেও ডেকেই বসে রইল সে।
ভিজে ধুলোগুলো এরই মধ্যে প্রখর সূর্যের তাপে শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। আরও লাল দেখাচ্ছে সেগুলিকে। সূর্যের আলো সে ধুলোর গায়ে পড়ে ঠিক্রে আসছে যেন। ওঁরা সেই ধুলো পার হয়ে এগিয়ে চললেন কালকের দেখা সেই বিরাট ফুলের সন্ধানে।
কিন্তু গিয়ে দেখেন এ কি কাণ্ড! সমস্ত ফুল কুঁকড়ে–মুকড়ে একেবারে শুকিয়ে গেছে। কোথায় বা তার সেই রঙের বাহার, আর কোথায় বা সেই লালিত্য! বহুদিনের শুকনো ঝরে–পড়া বাসি ফুলের মতই মনে হচ্ছে ফুলটাকে। তা ছাড়া ছিঁড়ে–ফিড়ে লণ্ডভণ্ডও হয়ে গেছে। যেটুকু আছে তাও যেন আকারে অনেক ছোট হয়ে গেছে।
ডক্টর কারিকুরা আজ একটা লোহার ডাণ্ডা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। মাথার কাছটা তার আঁকশির মত। তাই দিয়ে সন্তৰ্পণে তিনি একটা পাপড়ি টেনে দেখলেন। না, কালকের মত সেই আঁকশিকে আর কেউ জড়িয়ে ধরল না। নিষ্প্রাণ দড়ির মতই পাপড়িটা আঁকশির টানে উঠে এল। এবারে সাহস পেয়ে ডক্টর কারিকুরা আরও কাছে চলে গেলেন ফুলটার। খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলেন ওটাকে। তারপর সবাই ফিরে এলেন জাহাজে।
এদিকে জাহাজ মেরামতের কাজও শুরু হয়ে গেছে। যে ভাবেই হোক, জাহাজ ভাসিয়ে এই দ্বীপ থেকে উদ্ধার পেতে হবে তো! নইলে এই জনপ্ৰাণিহীন মরা দ্বীপের মধ্যে আর কতদিন টিকে থাকা যায়? সারেঙ্রা প্ৰাণপণে কাজ চালিয়ে যেতে লাগল।
আরও দিন দুই এইভাবে কাটল। তৃতীয় দিন মনে হ’ল দূরে জলের ওপর কি একটা ভেসে আসছে। কারিকুরা দূরবীণ দিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলেন। আবার আনন্দে মুখটা ভরে উঠল তার। মাল–টানা জাহাজই বটে। একজন গিয়ে তাড়াতাড়ি মাস্তুলে নিশান টাঙ্গিয়ে দিল। যাতে মাল–টানা জাহাজটা নিশান দেখে তাদের উদ্ধার করতে আসতে পারে।
মনে হ’ল ওরাও ওঁদের দেখতে পেয়েছে। কারণ জাহাজ ফিরিয়ে তারা এইদিকেই আসতে লাগল।
আধঘণ্টার মধ্যেই ওরা এসে ওদের উদ্ধার করল। ট্রলারটাকে আপাততঃ গাদাবোটের মত পেছনে বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়াটাই ঠিক হ’ল। কাছাকাছি যে বন্দর পাওয়া যাবে সেইখানেই ওকে ভাল করে মেরামত করে নিতে হবে।
এই ঘটনার পর প্রায় এক বছর কেটে গেছে। প্রশান্তরা যথাসময়ে দেশে ফিরে এসেছে এবং পরিকল্পনার মত ট্রলার নিয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার কাজেও লেগে গেছে। এরই মধ্যে আর একবার পরামর্শ নেবার জন্য তাকে জাপানে যেতে হ’ল।
ডক্টর কারিকুরার সঙ্গে দেখা হতেই তিনি সাদরে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। ওঁরই অতিথি হয়ে দিন দুই থেকে যেতে বললেন। এবং সেই সময়েই একদিন ওকে শুনিয়ে দিলেন সেই অজানা দ্বীপের রহস্যের কথা।
“ব্যাপারটা আমি কিছুটা ওখানেই আঁচ করেছিলাম, কিন্তু সমস্ত প্ৰমাণাদি সংগ্ৰহ না করে কাউকে কিছু বলি নি। দেশে ফিরে এসে কিছুদিন আমি ঐ নিয়ে খুব মেতে গেলাম।”
“প্ৰশান্ত মহাসাগরের ওই অঞ্চলে যে ওরকম কোন দ্বীপ আগে ছিল না সে বিষয়ে আমি প্ৰায় নিঃসন্দেহ ছিলাম। যে মাল–টানা জাহাজটা আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে তার ক্যাপটেনও সেই কথাই বলেছিলেন। তিনি ও–পথে আরও অনেকবার পাড়ি দিয়েছেন, কিন্তু ওখানে ও–রকম কোন দ্বীপ কখনও দেখেন নি। সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়েছিল আমার কাছে।”
“আমার মনে যে সন্দেহ এসেছিল, সেটা নিতান্তই অলৌকিক বলে মনে হবে কিন্তু ওছাড়া ও রহস্যের আর কোন মীমাংসা হতে পারে বলে আমার মনে হ’ল না।”
“সমুদ্রে যখন টাইফুন শুরু হ’ল তখন সঙ্গে সঙ্গে প্ৰচণ্ড ভূমিকম্পও শুরু হয়েছিল। ভূমিকম্প না বলে সাগরকম্প বলাই উচিত, কেননা ভূমি আর ওখানে কোথায়? তবে, হ্যাঁ, ভূমি ছিল। সাগরের অতল তলে। জলের স্তর যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে নিশ্চয়ই মাটি ছিল; কিন্তু সে মাটি তো আমাদের ডাঙ্গার মাটি নয়। তা হলে কি রকম মাটি? যুগ যুগ ধরে সমুদ্রের ওপরে বা ভিতরে যে সব জীবজন্তু মারা পড়েছে তাদেরই দেহাবশেষ অতি সূক্ষ্ম ধুলোর কণার মত গুড়ো গুড়ো হয়ে থিতিয়ে জমছে গিয়ে সমুদ্রের তলায়। আর তাই দিয়েই তৈরি হচ্ছে ওখানকার মাটি। ডায়াটমের নাম শুনেছ তো, ও হচ্ছে তাই—বা সেই জাতীয় জিনিস।”
“ভূমিকম্প শুরু হতেই সাগরের তলায়ও জেগে উঠল সেই কাঁপুনি। হয়তো একসময়ে কাঁপুনিটা অতি প্রবলভাবেই হয়েছিল, যার ফলে সমুদ্রের তলার খানিকটা অংশ, কে জানে কত নীচেকার, হঠাৎ ঠেলে উঠল জলের ওপরে। আর তারই ফলে হঠাৎ সেখানে গজিয়ে উঠল একটা ছোট্ট নতুন দ্বীপ।”
“তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে ও দ্বীপের মাটি সাধারণ মাটির মত ছিল না—লালচে ধুলোর মত ছিল সেই মাটি, যা দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তাই খানিকটা মাটি বা ধুলো, যাই বল, আমি খুবলে তুলে নিয়ে এসেছিলাম আর জাহাজে বসেই মাইক্রস্কোপ দিয়ে তা পরীক্ষা করে দেখেছিলাম, আমার অনুমান ঠিক। ধুলোর গায়ে আশ্চর্য কারিকুরি—যা কেবল ডায়াটম জাতীয় ধুলোর গায়েই দেখা যায়। তা হলে এই ধুলো বা মাটি নিশ্চয়ই অতি হালে সমুদ্রের তলা থেকে উঠে এসেছে। পুরোনো হলে জীবাণুদের অত্যাচারে তা নিশ্চয়ই অন্যরকম, অর্থাৎ সাধারণ মাটিতে পরিবর্তিত হ’ত। সমুদ্রের তলাকার শ্যাওলাও আমরা দেখেছিলাম—ফ্যাকাশে রং। হবেই তো, বেশি নীচে আর কতটুকু সূৰ্যালোক যায়? তাই ওই শ্যাওলায় সবুজ কণা কম হবেই।”
“তারপর সেই অদ্ভুত ফুল। গাছ নেই, ডাল নেই, পাতা নেই, হঠাৎ মাটির ওপর একটা বিরাট টাটকা ফুল আসবে কোখেকে? তখনই বুঝলাম ওটা ফুল নয়, কোন সামুদ্রিক জীব—যা ভূমিকম্পের সময় গভীর সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে। সী–অ্যানিমোন নামে এক রকম সামুদ্রিক জীবের কথা তুমি নিশ্চয়ই জান, যাকে চলতি কথায় বলা হয় সমুদ্রের ফুল। দেখতে অবিকল ফুলের মত, চারদিকে সুতোর মত পাপড়ি–ঝোলা এই অদ্ভুত জীবটি এমন কিছু দুষ্পাপ্য নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে সী–অ্যানিমোন অতি ছোট জীব–ফুলেরই মত ছোট। এত বড় দশ–বিশ হাত বেড়ের সী–অ্যানিমোনের কথা তো কখনও শুনি নি!”
“কিন্তু একটু চিন্তা করতেই এ ব্যাপারটারও একটা ব্যাখ্যা পেয়ে গেলাম। সমুদ্রের নীচে প্ৰচণ্ড জলের চাপ। এই জীবগুলো হয়তো খুবই নীচেকার স্তরে বাস করত। সেখানে ওই রকম চাপে টিকে থাকতেই ওরা অভ্যস্ত। যখন ভূমিকম্পের ঠেলায় ওপরে উঠে এল তখন ওদের ওপরকার জলের চাপ একেবারে কমে গেছে। কোন জিনিস প্রবল চাপের মধ্যে রেখে হঠাৎ চাপ ছেড়ে দিলে কি হয়। তার ভেতর যদি বাতাস বা গ্যাস, এমন কি কোন রসও থাকে তাও আয়তনে হঠাৎ ভীষণ বেড়ে যায়। আর ওপরকার আবরণটা যদি ইলাস্টিক বা স্থিতিস্থাপক হয় তা হলে সেটা ফেটে না গিয়ে আকারে অনেকটা ফেঁপে ওঠে। এখানেও নিশ্চয়ই তাই হয়েছিল। ওই সী–অ্যানিমোন জাতীয় জলজীবগুলো তো এমনিতেই একটু বড়সড় ছিল, ওপরে উঠে হঠাৎ চাপ কমে যাওয়ায় তাদের ভিতরটা ফেঁপে উঠল; ফলে ছোট্ট জন্তুটা আকারে ফুলে ফেঁপে বিরাট হয়ে উঠল।”
“জলের জীব ডাঙ্গায় উঠে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ঐ দিন আকাশ অসম্ভব মেঘলা হয়ে থাকায় সূর্যকিরণ ছিল না বললেই চলে, আর থেকে থেকে ক্রমাগত বৃষ্টিও হয়তো ওদের খানিকক্ষণ টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল। এখন, বেঁচে থাকতে হলেই কিছু খাওয়া দরকার। এই জন্তুগুলোর খাবার পদ্ধতি ভারি অদ্ভুত। ঐ যে ফুলের পাপড়ির মত সুতোগুলো চারপাশে ঝোলে সেগুলিই হচ্ছে ওদের শিকার সংগ্রহের অস্ত্ৰ। বিজ্ঞানীরা ওকে বলেন টেন্ট্যাক্ল্স্। কোন ছোট্ট জলজীব ওর কাছাকাছি এলেই ওর ওই টেন্ট্যাক্ল্স্ দিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরে, তারপর ভিতরে টেনে নিয়ে খেয়ে ফেলে। আকৃতি বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে ওদের ওই শুড় বা টেন্ট্যাক্ল্স্গুলোও সেই রকম মোটা হয়ে গিয়েছিল, হয়তো তদনুযায়ী শক্তিও বেড়ে গিয়েছিল তাদের। তুমি যখন পাপড়ি ভেবে ওগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে গেলে তখনই পড়ে গেলে ওদের খপ্পরে, আষ্টেপৃষ্ঠে তোমায় জড়িয়ে ধরল অক্টোপাসের মত ওই শুঁড়। ভাগ্যিস আমার হাতে কুড়ুলটা ছিল, তাই সে যাত্ৰা তোমাকে রক্ষা করা গেল। অবশ্য জন্তুটা যে তোমাকে খেয়ে ফেলতে পারত এমন সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু জখম করতে পারত। তা ছাড়া ওর বিষাক্ত রসও হয়তো মানুষের পক্ষে দারুণ ক্ষতির কারণ হতে পারত।”
ডক্টর কারিকুরা একটু চুপ করলেন। প্রশান্ত সেদিনের কথা মনে করে নিজের অজানতেই একটু কাঁপতে শুরু করেছিল। ডক্টর কারিকুরা হেসে বললেন, “হ্যাঁ, ভাবলে কাঁপুনিই আসে বটে! তবে এখন আর ও নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। কারণ পরদিনই রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওই জলজীবগুলির মৃত্যু ঘটে। সূর্যের আলোয় দেহের রস শুকিয়ে দেহ কুঁকড়ে–মুকড়ে ফেটে যায়, আকারেও আবার ছোট হয়ে আসে। সেদিন তো আর তুমি দেখতে যাও নি, গেলে নিজের চোখেই দেখতে পেতে।”
“সত্যি, পৃথিবীতে কত কীই যে হতে পারে, তার কতটুকুই বা আমরা জানি!” বলল প্ৰশান্ত।
“ঠিক বলেছ। সমূদ্র আরও রহস্যময়। তবে ওর সম্বন্ধে হয়তো আমরা আর একটু বেশি জানি অর্থাৎ এইটুকু জানি যে আমরা কিছুই জানি না।”—চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে মন্তব্য করলেন ডক্টর কারিকুরা।
সম্পাদকের কথাঃ গল্পটি সংকলিত হয়েছিল লেখকের বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্পের সংকলন “রোমাঞ্চকর” বইতে। পুনঃপ্রকাশের সময়ে বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। গল্পটি ওসিয়ার করে সাহায্য করেছেন সুদীপ দেব।
অসাধারণ
দারুন গল্প