ড্রাগন প্রেয়সী
লেখক: অদ্রীশ বর্ধন
শিল্পী: সুমন দাস
কয়েক হপ্তা হয়ে গেছে, ঘর ছেড়ে বেরোয়নি বাসুকি। প্রত্যেক দিন যথাসময়ে দরজার বাইরে খাবার–দাবার রেখে গেছে কলিঙ্গ–সুত বীরভদ্র। মাঝে মাঝে বীরভদ্র চলে যাবার পরেই দরজা খুলেছে বাসুকি। আবার কখনো কখনো ভুলেই গেছে। সবাই জানে জরুরী কাজ নিয়ে দারুণ ব্যস্ত বাসুকি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা শেষ করতে হবে বলেই খাওয়া দাওয়া ভুলেছে ও। সেই জন্যই সে চায় না বাইরের কেউ এখন ওকে বিরক্ত করুক। বীরভদ্র ছাড়া আর কেউ জানেও না ও এখন কোথায়। কাজেই দিব্বি নিরিবিলিতে আছে বাসুকি।
বাসুকি কিন্তু কোন কাজই করছে না। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকে একটা লাইনও আজ পর্যন্ত লিখতে পারেনি সে। ড্রাগন–প্রেয়সীর প্রতীক্ষায় রয়েছে বাসুকি। ও জানে আজ হোক, কাল হোক, ড্রাগন–প্রেয়সী ওর কাছে আসবেই। সে জন্য এতটুকু ভয়–ডর নেই ওর মনে। ও জানে, সে যখন আসবে, তখন স্বমূর্তি ত্যাগ করেই আসবে। নৃত্যপরা অগ্নিশিখার মধ্যে থেকে পিছলে বেরিয়ে আসবে সেই নারীমূর্তি – তারপর? তারই ঘনিষ্ট নিষ্ঠুর আলিঙ্গনের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে বাসুকি। আবার এমনও হতে পারে, নিজ মুর্তিতেই আবির্ভূতা হবে ড্রাগন–প্রেয়সী। এতটুকু ফণিণীর মত একটা কিলবিলে গিরগিটি। নিরীহ অথচ ভয়ঙ্কর দ্যুতিময় তার বিচিত্র চর্মদেহ। বাসুকির দিকে একবার মাত্র অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপ করেই আবার সে গুট গুট করে সেঁধিয়ে যাবে গনগনে অঙ্গারের ঠিক কেন্দ্রে।
এসব কথা বাসুকি জেনেছে বর্মার সেই ফুঙ্গির মুখে। বহু ইতিহাস আর কিংবদন্তী জড়ানো বাংলার গ্রামে গ্রামে পরিভ্রমণ করছিল ব্রহ্মদেশীয় সেই সন্ন্যাসী। দুই চোখে যার নিতল রহস্যের ব্যঞ্জনা। কিন্তু কি এক যাদু ছিল তার চাপা ঠোঁট আর ভাঙা ভাঙা বাংলার মধ্যে। সম্মোহিতের মত সেই ফুঙ্গির মুখে বাসুকি শুনেছিল চির–অশান্ত,চির–দুরন্ত, চির–ভয়ঙ্কর ড্রাগনের ভয়ঙ্করী প্রিয়তমার বিচিত্র কাহিনী।
ঐতিহাসিক ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের ধ্বংসস্তূপে ক্যামেরা নিয়ে বাসুকি গিয়েছিল নতূন লেখার উপাদান সংগ্রহ করতে। এই সেই রাজ্য, যা নিদারুণ হিন্দু– বিদ্বেষী কালাপাহাড়ের অত্যাচার হতে রক্ষা পেয়েছিল শুধু তার জন্মভূমি বলে। এইখানেই মঙ্গলাকীর্ণ এক মন্দিরের ভয়ঙ্করী ভৈরবীমূর্তির সামনে তির্যক–চক্ষু ফুঙ্গির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বাসুকির।
ড্রাগন–প্রেয়সীর বেশির ভাগই বাসুকির কল্পনা–প্রসূত। জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী থাকার সময়ে এবং রোগমুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে সেরে ওঠার সময়ে অনেক সময়ে অনেক কিছুই ঠাঁই পেয়েছে তার কল্পনার রাজ্যে। ও জানে, প্রথম আবির্ভাবেই ড্রাগন–প্রেয়সী তাকে যা উপঢৌকন দেবে, তা এককণা তীব্র অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়। অলৌকিক তেজে প্রদীপ্ত সেই স্ফুলিঙ্গ এখন থেকেই যেন ঝিকমিকিয়ে উঠছে তার মগজের কোষে কোষে। মগজের নিগূঢ় কন্দরে ধূমায়িত হচ্ছে এতটুকু একটা আশ্চর্য–সুন্দর অগ্নিকণা। ফনিণীর বিষ নিশ্বাসের স্পর্শ লাভ করেই যা মূহুর্তে ফেটে পড়বে – দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে নিখাদ বিশুদ্ধ মরাল–শুভ্র লেলিহ অগ্নিশিখা।
মাঝে মাঝে নিঃসীম বেদনায় টনটনিয়ে উঠেছে তার মাথা। অগুন্তি নক্ষত্রের মত জ্বলন্ত বিন্দু–সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠেছে তার বিহ্বল চোখের সামনে। যখনই এ কাণ্ড ঘটেছে, অদ্ভুত কারসাজি দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তার মগজ। প্রাচীন রোমান অ্যাম্ফি থিয়েটারের মত গ্যালারিবেষ্টিত সুবিশাল রঙ্গ–প্রাঙ্গণে পরিণত হয়েছে তার করোটির অভ্যন্তর ভাগ। ঠিক কেন্দ্রে একটা বিচিত্র কারুকাজ করা তিনপায়া পাত্রের মধ্যে মিট মিট করে উঠেছে একটা ক্ষুদ্র অগ্নিশিখা – তার আত্মা। এই তেপায়ার সামনেই মরণ–মল্লযুদ্ধে বাঁধা পড়েছে দুটি বীর – একজন নারী আর একজন একটি সরীসৃপ। মেয়েটির উজ্জ্বল উলঙ্গ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে উজ্জ্বলতর তৈলাক্ত আঁশযুক্ত নাগকুন্ডলী। মোচড় খাচ্ছে, আছড়ে পড়ছে–তবুও শেষ নেই সেই মৃত্যু–যুদ্ধের…নারী আর সর্প…ভ্রান্তি আর প্রজ্ঞা…উন্মত্ততা আর প্রতিভা…তারই মৃত্যুহীন আত্মার পরিতৃপ্তির জন্যে মগজের সসীম অ্যাম্ফি থিয়েটারে মেতেছে আমৃত্যু মল্লযুদ্ধে।
সব সময়ে কিন্তু এ ধরণের ফ্যানটাসি চিন্তায় আক্রান্ত হয়নি সে। অধিকাংশ সময়েই যুক্তি স্বচ্ছ অনাবিল থাকত ওর মন। তখন শুধু ধৈর্য, তিতিক্ষা, আর সহিষ্ণুতার পালা, প্রতীক্ষার পালা। ড্রাগন–প্রেয়সী ওই এলো বলে! তখনই সার্থক হবে নিয়তির লিখন।
তাই তো প্রত্যেক রাত্রে তোলা উনুনের গনগনে আগুনের সামনে সারারাত বসে থেকেছে বাসুকি। ভোরের আলোয় আগুনের আভা যখন মিলিয়ে এসেছে, উদাস হয়ে উঠেছে শুকতারার মুখ, ধূসর আভা নিয়ে ফুটে উঠেছে ছাইয়ের স্তর, তখনই সে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিয়েছে নিভাঁজ শয্যায়।
এই রকমই এক ভোর রাতে আগুনের তেজ যখন ক্ষীণ হওয়ার পথে, ঠিক তখনই ড্রাগন–প্রেয়সীকে দেখতে পেল সে। সেই প্রথম। কিন্তু আশ্চর্য! আগুনের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এলো না তো ড্রাগনের প্রিয়তমা!
অত্যন্ত প্রাচীন আমলের এক ভগ্নপ্রায় প্রাসাদেরই একটি ঘরে শুরু হয়েছে ওর এই অজ্ঞাতবাস। নবাবী আমলে তৈরী সে প্রাসাদের খিলানে, গম্বুজে, মিনারে এখনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় বিলাসব্যসনের, মিনা করা ফুল লতাপাতা আর প্রায় নগ্না–নর্তকীদের। অধিকাংশ স্থানেই পলেস্তারা উঠে গিয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে সুপ্রাচীন ভবনের বিকট দ্রংষ্ট্রা। পুরু ধূলোর স্তর জমে উঠেছে যুগ যুগ ধরে। শরিকে শরিকে বিভক্ত এখনও কয়েকটি অংশে টিমটিম করে জ্বলছে জীবনের দীপ, মানবের প্রদীপ। কালের মলিন হস্তক্ষেপ আর স্থানে স্থানে মানুষের সংস্কৃতির স্বাক্ষর বহন করেও বনেদিয়ানা বজায় রেখেছে কারুকাজ করা পেল্লায় দরজা, কড়িকাঠ আর জানলার ঝিলিমিলি। এমনি একটি ঘরে পরিচিতদের অগোচরে আস্তানা নিয়েছিল বাসুকি। এ ঘরের দেওয়ালেও অগুন্তি দাগ থাকা সত্ত্বেও ঘরের সিলিং বেজায় উঁচু, আধুনিক যে কোন প্রকোষ্ঠের চাইতে তা উঁচু। দৈর্ঘ্য প্রস্থেও ঘরটি বেশ বড়।
দীর্ঘক্ষণ ধরে একনাগাড়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বাসুকি। উঁচু উঁচু জানালার রঙীন ঝিলিমিলি দিয়ে ঊষার অরুণ–মুখ সবে উঁকি দিতে শুরু করেছিল। বাসুকি ভাবলে, আর কি, আজ রাতেও এলো না ড্রাগন–প্রেয়সী। তাই বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে ঘরের ছাদের দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে দেখছিল রঙ–চটা ফুললতাপাতার ওপর কেমন ঝিকমিকিয়ে উঠছে আগুনের ম্লান আভা। ঠিক এমনই সময়ে আচম্বিতে একটা কুন্ডলি পাকানো লতা কি এক অপার্থিব দ্যূতি বিচ্ছুরণ করতে লাগলো। খুব ম্লান – তবুও তা মুহূর্তে ধরা পড়ে গেল বাসুকির ক্লান্ত আঁখির পর্দায়। তারপরেই আস্তে আস্তে কুন্ডলি খুলে গিয়ে সরল হয়ে এল লতাটা – আর পরক্ষণেই একটা আলোকময় গিরিগিটি যেন মহানিদ্রা ঝেড়ে উঠে নড়েচড়ে উঠল। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল বাসুকি – পল অনুপলের হিসাব হারিয়ে ফেলেছিল সে – তারপরেই পলক ফেলার আগেই অন্তর্হিত হয়ে গেল সেই প্রদীপ্ত সরীসৃপ। কিন্তু সে দেখেছে। না, কোনও ভুলই নেই। মরীচিকা নয়, ভ্রান্তি নয়, বিভীষিকা নয় – সে দেখেছে। কিন্তু ড্রাগন–প্রেয়সী তাকে দেখেছে কিনা, তা বুঝতে পারল না বাসুকি। ব্যস, এরপর উল্লেখযোগ্য আর কিছুই ঘটল না।
নভেম্বরের সেই শীত–মেদুর ভোরে বিনিদ্র চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে সিলিংয়ের পানে তাকিয়ে রইলো বাসুকি। এ কি নিছক চোখের ভুল, না তার চাইতে আরও করাল কিছু? হয় সিলিংযের ঐ কারুকাজের আড়ালে ড্রাগন–প্রেয়সী লুকিয়ে আছে, আর না হয় তার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গিয়েছে! তবে একটা জিনিষ সেদিন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। ড্রাগন–প্রেয়সী যদি সত্য সত্যই ওপরে ঐ লতাকুণ্ডলির অন্তরালে আত্মগোপন করে থাকে, তবে আর তাকে আগুনের মধ্যে খুঁজে লাভ নেই। কিন্তু তারই বা নিশ্চয়তা কি? নেংটি ইঁদুরের মত নিতান্ত সাধারণ প্রাণী না হলে না হয় ড্রাগন–প্রেয়সীকে তার গোপন গহ্বর থেকে প্রলোভন দেখিয়ে বাইরে টেনে আনা যেত… চাই কি ফাঁদেও ধরা যেত…আর, ধরাই বা যাবে না কেন? খুবই সম্ভব… যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে এ ব্যাপারে যদি এগোনো যায়, তাহলে…
অচিরেই সর্বসন্তাপহারী নিদ্রার করস্পর্শে সব চিন্তার অবসান ঘটেছিল তার। ঘুমের কি ছাই নিস্তার আছে? আধা–ঘুম আধা–জাগরণের মধ্য দিয়ে সারি সারি স্বপ্নদৃশ্য ভেসে গিয়েছে তার মগজের মধ্যে দিয়ে… সে দৃশ্য ফাঁদ পেতে ড্রাগন–প্রেয়সীকে পাকড়াও করার।
সেইদিন বিকেলের আগেই বেরিয়ে পড়ল বাসুকি। দীর্ঘ একমাস পর এই প্রথম বাইরে বেরোল সে। ফিরে এল কাগজে মোড়া তিনটে প্যাকেট নিয়ে। সবচেয়ে বড় প্যাকেটটা একটা ইঁদুরের খাঁচা। তারের খাঁচা; বাক্সর মত দেখতে। একপাশে একটা গোলাকার প্রবেশপথ। ভেতর দিকে শাণিত সূচ্যগ্র তারের খোঁচা দিয়ে তৈরি একটি বৃত্ত। ফলকগুলো এমনভাবে সাজানো যে ভেতরে আসার সময়ে কোন বাধা নেই, কিন্তু বেরোতে গেলেই যত গোলমাল। সমস্ত দেহটাই তখন গেঁথে যায় ফলক বৃত্তের মধ্যে। অপর দুটো মোড়কের একটায় ছিল তুলোর বাক্স, আরেকটায় স্পিরিটের শিশি।
সেদিন রাত্রে তোলা উনুনে আর আগুন দিল না বাসুকি। তার বদলে তারের খাঁচাটা বসিয়ে দিলে ঘরের ঠিক মাঝখানে মেঝের ওপর। স্পিরিটে তুলো ভিজিয়ে তৈরি হল অভিনব টোপ। আগুন ধরিয়ে দিতেই আলকাতরার মত কুচকুচে কালো অন্ধকারের মধ্যে জ্বলে উঠলো নীলচে শিখা। ক্ষণেক নিস্পলক চোখে ও তাকিয়ে রইল নিলাভ নিষ্কম্প শিখাটির পানে। তারপর শয্যা আর খাঁচার মধ্যে পর্দাটা টেনে দিলে ও। ঘরের এ–দেওয়াল থেকে ও–দেওয়াল পর্যন্ত টাঙানো তারের পর্দা খাটিয়ে একটা ঘরকেই দ্বিধা বিভক্ত করে নিয়েছিল বাসুকি। তারপর পা টিপে টিপে ও এগিয়ে গেল শয্যাপানে। ক্লান্ত দেহভার এলিয়ে দিলে শয্যার পরে। সারাটা দিন অবদমিত উত্তেজনার জ্বরে আচ্ছন্নের মত ঘুরে বেরিয়েছে ও। খাবার কথাও মনে ছিল না। কিন্তু এখন আশ্চর্য হয়ে গেল বাসুকি। মাথাটা দারুণ হালকা হয়ে গেছে তো! শরীরে অবশ্য অবসাদের পাহাড় নেমেছে ঠিকই। শুয়ে শুয়ে মনে হতে লাগল ঠিক যেন দিকহীন সীমাহীন মহাশূন্যে গতিহীন হয়ে ভাসছে ওর দেহ–না আছে শক্তি, না আছে আঙুল নাড়ার ক্ষমতা। এবার ওর মনও ভেসে চলেছে…শান্ত…পালকের মত হালকা…ভাসছে…নিঃসীম মহাকাশ আর নৈঃশব্দের মধ্যে ভেসে চলেছে তার মন…
একটা তীক্ষ্ণ তীব্র শব্দে জেগে উঠলো বাসুকি–একটা আর্ত চিৎকার। পর্দার ওপার থেকে কেমন জানি একটা আবছা রক্তাক্ত আভা এসে পৌঁছোচ্ছে এপারে। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল ও। সরিয়ে দিলে পর্দা। ঘরের ঠিক মাঝখানে পড়েছিল তারের খাঁচাটা। রক্তাভ দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে এই খাঁচা থেকেই। কিন্তু একি! খাঁচাটা তো এত বড় ছিল না! কি এক মন্ত্রবলে বিশাল হয়ে উঠেছে খাঁচাটা। আর ভেতরেই গুটিশুটি মেরে বন্দী হয়ে আছে এক অলোকসামান্যা রুপসী। সুতীক্ষ্ণ তারের শলাকাগুলো দৃঢ়ভাবে চেপে রয়েছে তার সুকোমল দেহে। গোলাপফুলের বর্ণ তার পেলব দেহনিকেতনের, কিন্তু তা আলোকময়। বিচিত্র এক আলো পদ্মরাগরশ্মির মতই বিচ্ছুরিত হচ্ছে তার সর্বদেহ থেকে। তারগুলো তাকে এমন ঘিরে ধরে চেপে রেখেছে যে, নড়াচড়াও পরম বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছিল বেচারীর পক্ষে। করুণ স্বরে গুঙিয়ে গুঙিয়ে উঠছিল সে, যন্ত্রণাকরুণ মধুক্ষরা কন্ঠে কাকুতি মিনতি করছিল মুক্তির জন্যে। এক পা এগিয়ে গিয়েছিল বাসুকি – কিন্তু পরক্ষণেই থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখে–সুন্দরীর পীনোন্নত বক্ষে গেঁথে গিয়েছে সূচীমুখ শলাকাগুলো। আর, ক্ষতমুখ থেকে রুধিরের পরিবর্তে গড়িয়ে পড়ছে আগুনের ধারা! মানবী নয় – ও দানবী! বাসুকী জানে, এ নারীকে মুক্তি দিলেই সঙ্গে সঙ্গে তার অগ্নি–আলিঙ্গনে প্রাণ বলি দিতে হবে তাকে। এ দানবীকে যেমন করেই হোক হত্যা করতেই হবে, বাসুকি জানে, পিঞ্জরাবদ্ধ থাকা অবস্থাতেই শেষ করতে হবে এই নিধন–পর্ব। তখনও ধস্তাধস্তি করছিল মেয়েটি –প্রাণপণে নবনীত তনু চেপে ধরছিল ধারালো বর্শার মত ফলকগুলোর ওপর। আর দেরী নয় –চটপট হাত চালাতে হবে! টেবিলের ওপর একটা কাগজ–কাটা লম্বাটে ছুরি আছে না? ক্ষিপ্রপদে ছুরির সন্ধানে এগিয়ে যায় ও। কিন্তু বড় দেরী হয়ে গিয়েছে! খাঁচার তারগুলো এর মধ্যেই রক্তরাঙা হয়ে উঠেছিল। বেঁকে যাচ্ছে পিঞ্জরের তার…ভেঙে যাচ্ছে একে একে…মুক্ত… মুক্ত… মুক্তি পেয়েছে সুন্দরী দানবী ড্রাগন–প্রেয়সী!
সিধে হয়ে উঠে দাড়ালো সেই বিচিত্র–সুন্দর তন্বী–মুর্তি…ভয়ঙ্কর, নগ্ন অথচ অপরূপ–সুন্দর সেই দেহ–বক্ষ হতে দরদর ধারে প্রবাহিত সরু সরু অগ্নিস্রোত–দুই হাত সামনে প্রসারিত করে এগিয়ে এল সে। উঃ, অগ্নিবিষে জর্জরিত সেকি ভয়ানক নিশ্বাস তার, সমস্ত অঙ্গ দিয়ে অগ্নিজিহ্বার মত সেই নিদারুণ নিশ্বাস অনুভব করে বাসুকি…সর্পিল দুই বাহু–বন্ধনে নিপীড়িত হতে শুরু করেছে ওর দেহ…এর মধ্যেই অগ্নিশিখা, নেচে নেচে উঠছে ওর সারা দেহে… আর, তারপরেই সুন্দরীর জ্বলন্ত অধরোষ্ঠের স্পর্শে শিউরে ওঠে বাসুকির প্রতিটি অণুপরমাণু তন্তু…
অগ্নিময় বিকট বীভৎস এক স্বপ্নদৃশ্য থেকে কাঁপতে কাঁপতে জেগে উঠেছিল বাসুকি…ঘামে ভিজে গিয়েছিল ওর সর্বদেহ। নিদারুণ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল আপাদমস্তক। যেন মেরুপ্রদেশের তুহিনতা নেমে এসেছিল ঘরের মধ্যে। সব কিছুই তলিয়ে গিয়েছিল নিবিড় নিশ্চিদ্র তমিস্রার নিচে। পর্দার ওদিক থেকে এতটুকু আলোর চমকও প্রতিফলিত হল না ওর অক্ষিপটে। অন্ধের মত হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে গেল ঘরের অপর দিকে। দেশলাইতে হাত ঠেকাতেই মোমবাতি জ্বলতে বিশেষ দেরি হল না। মেঝের ঠিক মাঝখানে তারের ছোট্ট খাঁচাটা পড়েছিল। শূন্য। তুলোর বর্তুলটা পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল! ঘরের শিলিংয়ের সেই হিমশীতল, শ্বেতশুভ্র, নিস্পন্দ লতাকুন্ডলিতে কোনদিন অলৌকিক প্রাণতরঙ্গিনীর কল্লোল উঠেছিল বলে মনেই হয় না।
পরের দিন সকালেও ওর জ্বরের ঘোর কাটল না। প্রলাপের আবিল নিষ্পেষণে আড়ষ্ট হয়ে রইল মগজের কোষগুলো। তা সত্ত্বেও কিন্তু ওর মনে হল আশ্চর্যরকম ভাবে পরিস্কার হয়ে গিয়েছে ওর মাথা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সাতপাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে মনে হল, হয়তো ওর ভুলই হয়েছে। ঘরের কড়িকাঠে নিশ্চয় কোন ড্রাগন–প্রেয়সী নেই; দানব–নারীও নেই। হয়তো সব কিছুই ওর বিকৃত মনের উদ্ভট বিভ্রান্তি। হয়তো ড্রাগন–প্রেয়সী বলে আদতে কিছুই নেই। অলৌকিক স্ফুলিঙ্গেরও নেই কোন অস্তিত্ব।
মগজের লক্ষকোটি কোষের একটির স্মৃতিতে ধরা বহুদিন আগেকার একটি কথা তখন অণুরণিত হতে শুরু করেছে। করালবদনা ভৈরবীর সামনে নিগূঢ় বটের নিচে ফুটিফাটা দাওয়ায় বসে আনেক বছর আগে রহস্যময় সেই ফুঙ্গি তেরছা চোখ নাচিয়ে সবশেষে বলেছিল – ‘বাপ, আমার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। বহু দেশ আমি ঘুরলাম, বহু পুঁথি পড়লাম, বহু জ্ঞান অর্জন করলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত ড্রাগন–প্রেয়সীকে আমি দেখিনি। সেই জন্যই বলি, ড্রাগন–প্রেয়সী একটা নেহাতই কল্পকথা – বাস্তবে তা অলীক।’
চিৎ হয়ে শুয়ে বিড়বিড় করে প্রায়–বিস্মৃত এই কথা ক’টি আওরাতে থাকে বাসুকি। পরক্ষণেই অপরিসীম ক্রোধের দমকে থরথর করে কেঁপে ওঠে ওর সারা দেহ। আতীক্ষ্ণ আর্তস্বরে চিৎকার করে ওঠে সে, ‘গোল্লায় যাক তোমার দেশ ভ্রমণ, জ্ঞান আর পুঁথি! ড্রাগন–প্রেয়সীর অস্তিত্ব যদি আর না–ই থাকে, তাহলে মানুষই হত্যা করেছে তাকে!’
আবেগের এই প্রচন্ড বিস্ফোরণের পর নিথর হয়ে পড়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। মাথার মধ্যে হু–হু করে বয়ে চলল চিন্তার স্রোত। ঘরের সিলিংয়ে সত্যিই কি লুকিয়েছিল ড্রাগন–প্রেয়সী? যেমন করেই হোক, তা জানতে হবে। কিন্তু কি করে? এখন যে সুস্থ মস্তিষ্কেই চিন্তা করছে বাসুকি, এ সম্বন্ধে কোন অবিশ্বাসই ছিল না ওর মনে। দেখতে দেখতে একটা গোটা পরিকল্পনা গজিয়ে উঠল মাথায়–অত্যন্ত সবল সে পরিকল্পনা–কিন্তু তা ব্যর্থ হবে না…হতে পারে না।
সেদিন বিকেলে আবার বেরিয়ে গেল বাসুকি। ফিরে এল দুটিন ভর্তি কেরোসিন নিয়ে। ও জানতো, কোন সময়ে বীরভদ্র পেছনের পুকুরে যায় বাসনকোসন ধুতে। ঠিক ওই সময়তেই সুট করে বেরিয়ে গিয়ে সওদা করে এল বাসুকি। তাই ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া বা ফিরে আসা সবারই চোখ এড়িয়ে গেল। বাড়ির কোনখানে কয়লা আর চেলাকাঠ জমা করা থাকে, তা ও জানে। যদি আসবাবপত্রে না কুলোয়, কিছু কিছু নিয়ে এলেই চলবে’খন। ইতিমধ্যে চুপচাপ শুয়ে বিশ্রাম নেওয়া দরকার। শরীরের ওপর ধকল্টা তো কম যায়নি। বড় শ্রান্ত সে। অসুস্থও বটে।
প্রদোষের অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসার একটু পরেই উঠে পড়ল বাসুকি। উনুনটা আগে থেকেই ধরানো ছিল। এখন কয়লা ফেলে বাতাস দিয়ে চাঙ্গা করে তুলতে বেশি সময় গেল না। মনে মনে একচোট হেসে নিলে বাসুকি। বীরভদ্র জানে শীতের কামড় থেকে ঘরটা গরম করার জন্যই উনুন জ্বালায় প্রতি রাত্রে। মুর্খ বীরভদ্র! কি করে বুঝবে সে কি সাধনায় মেতেছে বাসুকি। সব আয়োজন শেষ করতেই রাত বারোটা বেজে গেল। যা ভেবেছিল, তার চাইতেও দ্রুত লেলিহ হয়ে উঠল আগুন। সেকি ভয়ানক অগ্নিকান্ড। আগুনের চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য আর সোঁ–সোঁ গর্জনে প্রথমটা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল বাসুকি। কিন্তু ঘাবড়াবার মত দুর্বল স্নায়ু তার নয়। তাই পরক্ষণে বাহু মুড়ে মুখের নিচের অংশটা আড়াল করে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল সিলিংয়ের লতাকুন্ডলির পানে। লকলকে রসনা মেলে দেওয়াল স্পর্শ করছে আগুন…তারপর ঘরের সিলিং…অগ্নি চুম্বনের চিহ্ন পড়ছে সর্বত্র। এবার বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠেছে লতাকুন্ডলি–দীপ্ত হয়ে উঠেছে– জ্বল জ্বল করতে শুরু করেছে…অকথ্য যন্ত্রণায় সঙ্কুচিত সজল হয়ে আসে ওর চোখ–উত্তপ্ত ধোঁয়ার পুঞ্জ যেন তপ্ত লৌহশলাকার মতই উৎপীড়ন করতে শুরু করেছে উদ্বেলিত ফুসফুস–জোড়াকে। মাথা ঘুরছে, কুয়াশার সমুদ্র দুলছে চোখের সামনে। বেশ বুঝতে পারে বাসুকি, আর একটু পরেই ভূমি আশ্রয় করতে হবে তাকে। কিন্তু ওই তো… ওই তো…ওইতো দপদপ করে রোশনাই বিচ্ছুরণ করছে লতাকুন্ডলি…দ্যুতিময় পত্রপুস্পের মধ্যে থেকে, অগ্নিশিখার হৃদয় কন্দর বিদীর্ণ করে স্বমূর্তি পরিগ্রহ করছে ড্রাগন–প্রেয়সী…বেরিয়ে আসছে শুধু তার জন্যে–সফল করে তুলতে তার এতদিনের আকুল প্রতীক্ষা। যন্ত্রণাবিকৃত ঝলসানো মুখে দুই হাত সামনে প্রসারিত করে সে এগিয়ে গেল তার শোণিতরাঙা স্বপ্নের সার্থক রূপায়ণে।
Tags: অদ্রীশ বর্ধন, গল্প, ড্রাগন প্রেয়সী, দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, পুনঃপ্রকাশিত গল্প, সুমন দাস