ডিম
লেখক: অদ্রীশ বর্ধন
শিল্পী: চিত্রচোর
ঘরে ঢুকেই দেখছিলাম পার্শেলটা।
হেঁট হয়ে জাপানী স্ট্যাম্পগুলো দেখছিলেন প্রফেসর নাট–বল্টু–চক্ৰ। আমি আসতেই লিকপিকে বপুটাকে সিধে করে বলেছিলেন—এসেছো?
পার্শেলটার দিকে তাকিয়ে শুধোলাম—এই জন্যেই কি ডেকে পাঠালেন?
হ্যাঁ।
কি আছে এতে?
ডিম।
ডিম নিয়ে আশ্চর্য এই উপাখ্যানের এই হল শুরু।
ডিমটা এসেছিল জাপান থেকে। প্রফেসর নাট–বল্টু–চক্রর এক শিষ্য চীন গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন এক কাজে, পাঠিয়েছিলেন ডিমটা। অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম পার্শেলের দিকে। একদিকে গোটাগোটা হরফে প্রফেসর নাট–বল্টু–চক্রর নাম ঠিকানা লেখা। রাশিরাশি জাপানী ডাকটিকিট লাগানো।
আর একদিকে লাল কালি দিয়ে হাতে লেখা ;
এগ, হাণ্ডেল উইথ কেয়ার
ভারী মজার ব্যাপার তো! পাৰ্শেলে করে ডিম পাঠানো! জোরে নাড়া দিলে পাছে ডিম ভেঙে যায়, তাই হুঁশিয়ার করেও দেওয়া হয়েছে। ডিম আছে। ভঙ্গুর ডিম। সাবধান!
কাঁচি দিয়ে নাইলন সুতো কেটে ফেললাম। ছিঁড়ে ফেললাম ব্ৰাউন পেপার। ভেতরে একটা টিনের বাক্স। লম্বায় ইঞ্চি দশেক, চওড়ায় ইঞ্চি দশেক, উচ্চতায় ইঞ্চি দশেক। আধালো ফিতে দিয়ে ডালাটা সাঁটা ছিল বাক্সর সঙ্গে। টান মেরে ফিতে খুলতেই ডালা উঠে এল।
ভেতরে দেখলাম কানায় কানায় ভরা করাতকুচো কাঠের গুঁড়ো।
তাড়াতাড়ি একটা খবরের কাগজ পাতলাম টেবিলে। বাক্সটা তার ওপরে বসিয়ে কাঠের গুঁড়োর মধ্যে হাত পুরতেই হাতে ঠেকলো একটা শক্ত বস্তু।
প্রফেসর সারস পাখীর মত লম্বা ঘাড় বাড়িয়ে দেখছিলেন। আমি হাত পুরে থমকে যেতেই আঁতকে উঠলেন—কি হল? বিছে নাকি?
না। শক্ত মত কি রয়েছে।
থাকবেই তো। আচ্ছা বোকা তো।
চটে গিয়ে বললাম— ডিম কখনো এত বড় হয়?
কত বড়?
মস্তুবড়। এক হাতেও ধরা যাচ্ছে না।
এক হাতেও ধরা যাচ্ছে না! বিমূঢ় চোখে তাকালেন প্রফেসর। বলো কি! ডিম না অন্য কিছু?
সেটাই ভাবছিলাম। ফট করে বোকা বলে দিলেন।
আচ্চ্ছা আর বলবো না। নাও, টেনে বার করে, জুলজুল করে তাকিয়ে রইলেন প্রফেসর।
ফেটে–মেটে যাবে না তো?
স্টুপিড। সাকুমাকু আমায় ভালবাসে। সে আমায় ডিমের নামে বোমা পাঠাবে কেন?
সাকুমাকু প্রফেসরের অতিপ্রিয় জাপানী স্যাঙাৎ। পার্শোলের ওপরে ওর নাম লেখা দেখেই প্রফেসরের এত উৎসাহ।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। আর একটা হাত পুরে দিলাম কাঠের গুঁড়োর মধ্যে৷ হাতে ঠেকলো একটা কাগজ।
দু’ আঙুলে ধরে সন্তৰ্পনে টেনে আনতে দেখা গেল একটা লেফাপা। ওপরে প্রফেসরের নাম। পাঠাচ্ছে সাকুমাকু—প্রফেসরের স্যাঙাৎ।
আবার হাত ঢুকিয়ে দিলাম কাঠের গুঁড়োর মধ্যে। দুহাতে বেশ করে ধরে তুলে আনলাম ডিমটা।
হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন প্রফেসর। আমিও দৃষ্টি ফেরাতে পারলাম না।
অদ্ভুত তো! শেষকালে বললেন প্রফেসর।
ডিম এত বড় হয়? বললাম আমি।
অস্ট্রীচের ডিম মনে হচ্ছে, বললেন প্রফেসর।
মোটেই না, বললাম আমি। অস্ট্রিচের ডিম মিউজিয়ামে দেখেছি। সে–ডিম আরো ছোট হয়, ম্যাড়মেড়ে চেহারার হয়। এ–ডিমের মত চকচকে নয় মোটেই। এত সুন্দর তো নয়ই। অস্ট্রীচের ডিম দেখলে মনে হয় যেন মরা ডিম।
আর এ–ডিম দেখে কি মনে হচ্ছে? জ্যান্ত ডিম? খোঁকিয়ে উঠলেন প্রফেসর।
আমি বললাম—মুক্তো ডিম বলতে পারেন। মুক্তোর মতই দ্যুতি বেরোচ্ছে যেন। কি সুন্দর! আলতো করে হাত বুলিয়ে নিলাম আমি।
প্রফেসরের চোখ পড়ল তখন লেফাপার ওপর। ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে ফ্যাঁস করে ছিঁড়ে ফেললেন। আমি পোর্সিলেনের বাটি জোগাড় করে তার মধ্যে কাঠের গুঁড়ো ফেলে ডিমটা তার ওপর চেপে বসালাম। ফিরে দেখি, চিঠি পড়া শেষ করে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন প্রফেসর।
হাত থেকে চিঠিটা টেনে নিয়ে পড়লাম আমি। বাংলা অনুবাদ নীচে দিচ্ছি।
কোবে, জাপান
মাই ডিয়ার প্রফেসর,
চিঠির সঙ্গে পাঠানো বস্তুটা নিশ্চয় আপনার মাথা ঘুরিয়ে দেবে। চীন দেশে বিদঘুটে পাখীর তো অভাব নেই। ডিমটাও ধরে নিতে পারেন সেই জাতীয় কোন পাখীৱ।
চীন উপকূল থেকে শ‘ খানেক মাইল দূরে একটা পাল ছেঁড়া মাস্তুল ভাঙা সামপান নৌকো ভাসতে দেখে অবাক হয়েছিলাম আমরা। আরো বেশী অবাক হলাম যখন দেখলাম হালভাঙা সামপানে যাত্রী বলতে মাত্র দু’জন। তাও এক জন মারা গেছে। আরেকজন ধুঁকছে।
প্ৰাণটা যার বেরিয়েও বেরোচ্ছিল না, তার শত ছিন্ন কোটের পকেটে তুলোয় মোড়া অবস্থায় লুকোনো ছিল ডিমটা। লোকটার কথা বলার শক্তি ছিল না। ডিমটাও হাতছাড়া করতে চাইছিল না। তখন অবশ্য বুঝিনি ওটা ডিম। ভেবেছিলাম, তুলোয় মুড়ে দামী মণি মুক্তো নিয়ে চলেছে মুমূর্ষু লোকটা।
চেষ্টার ত্রুটি করিনি। দিন যার ফুরিয়ে এসেছে, তাকে ধরে রাখতেও পারি নি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল বেচারা। মরার ঠিক আগের মুহুর্তে ডিমটা তুলো থেকে বার করে আমার হাতে দিয়ে তাকিয়েছিল অসহায়ভাবে। জিভ নড়েছিল। কাতর চোখে কি যেন বলতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।
ডিম দেখে কিন্তু আমার সঙ্গী বিজ্ঞানীরা তাজ্জব হয়ে গেছেন। কোন প্ৰাণী এতবড় ডিম পারতে পারে, তা নিয়ে জোর গবেষণা চলছে। কেউ কেউ ডিমটাকে নিয়ে এক্সপেরিমেণ্ট করতে চাইছেন। কিন্তু চীনেম্যানটির অন্তিম চাহনির কথা মনে করে কারও হাতে দিতে পারছি না। ও যেন চোখের দৃষ্টি দিয়ে বলতে চেয়েছিল—ডিমটাকে যত্নে রেখো।
তাছাড়া, কমনসেন্স বলছে, এ–ডিম সাধারণ ডিম নয়। সাধারণ ডিম কেউ বুকের কাছে তুলোয় মুড়ে লুকিয়ে রাখে না। মুক্তোর মত উজ্জ্বল অথচ মুক্তো নয় এ–কোন প্ৰাণীর ডিম?
জাহাজের দুলুনিতে আর উৎসুক সঙ্গীদের জ্বালাতনে ডিমটা হয়ত ফেটে যেতে পারে যে–কোন মুহুর্তে। তাই আপনার কাছে পাঠালাম। কারণ আপনি অসাধারণ বৈজ্ঞানিক।
ইতি—
গুণমুগ্ধ
সাকুমাকু
চোখ তুলে দেখি সস্নেহে ডিমটার ওপর হাত বুলোচ্ছেন প্রফেসর, আর জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করছেন।
খবরটা কিন্তু হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল।
প্ৰথমে এল পাড়া প্রতিবেশী। তারপর খবরের কাগজ থেকে রিপোর্টাররা। প্রত্যেকের মুখে এক প্রশ্ন—কার ডিম? আপনি দেখেননি। কার ডিম? সে কি? তবে পেলেন কোথায়? প্রাগৈতিহাসিক ডিম নয় তো? ডিম ফুটে টেরোড্যাকটিল বা ডাইনোসর বেরিয়ে আসবে না তো? কি বলছেন? চীনদেশের উপকূল থেকে পাওয়া গিয়েছে? ভাঙা সমপানের মধ্যে ছিল? সর্বনাশ! চোরাই মাল মনে হচ্ছে! চীনের জনগন কিন্তু এ খবর শুনলে রেগে টং হবে। করেছেন কি মশায়! ফেরৎ দিন! ফেরৎ দিন!
জিজ্ঞাসা আর জিজ্ঞাসা! উপদেশ আর উপদেশ! কান ঝালাপালা হয়ে গেল প্রফেসরের। হুজুগে দেশ এই বঙ্গ দেশ। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত কেবল দর্শনার্থীর ভীড়। তারা দেখতে চায় চীনদেশের অতিকায় ডিম, কথা বলতে চায় অসাধারণ বৈজ্ঞানিক প্রফেসরের সঙ্গে। সামাল দিতে দিতে আমার হল প্রাণান্ত। যত বলি, দেখুন মশায়, ডিমটা এসেছে পার্শেলে। পাঠিয়েছেন প্রফেসরের জাপানী শিষ্য। অমনি হাঁ–হাঁ করে ওঠে বাঘা রিপোর্টাররা—আরে! আরে! বলেন কি? কেসটা আরো সিরিয়াস দেখছি! জাপানী এজেণ্টাও আছে এর মধ্যে! চীনের সঙ্গে একটা বিবাদ না বঁধিয়ে ছাড়বেন না দেখছি।
ভীড়টা আরো বাড়ল এক অতুৎসাহী গল্পকারের গল্প লেখার পর। তিনি ডিম দেখে গিয়ে ‘ডিম–ডিম’ নাম দিয়ে জবড়জঙ একটা গল্প ফাঁদলেন। তাতে দেখা গেল, মস্ত পাহাড়ের মত একটা ডাইনোসর ডিম ফুটে বেরিয়েছে। প্রফেসর নাট–বল্টু–চক্রর মত শীর্ণকায় এক বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক ডাইনোসরের পিঠে বসে মুখে লাগাম এঁটে হ্যাট–হ্যাট করে তাকে চালনা করছেন। মনুমেণ্টের নীচে সামরিক বাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে ঘিরে ধরেছে প্রাগৈতিহাসিক দানবকে। কিন্তু ডাইনোসর পরম পুলকে ট্যাঙ্কের গোলা হজম করছে এবং ল্যাজের আছড়ানিতে লোহার ট্যাঙ্ককে টিনের ট্যাঙ্কের মত তালগোল পাকাচ্ছে।
সুতরাং দর্শনার্থীর ভীড় বাড়ৰে, এতে আর আশ্চর্য কি। সায়েন্স ফিকশান ফিল্ম দেখে আর বই পড়ে যারা ডিম–আতঙ্ক সম্বন্ধে অবহিত হয়েছেন, তারা বিজ্ঞের মত বললেন, বড় বেশী রিস্ক নেওয়া হচ্ছে না? ডিম নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট পাহাড়ে–পর্বতে–বনে–জঙ্গলে মানায়। কলকাতার মত লোক গিজ গিজ অঞ্চলে শেষ কালে একটা কেলেংকারী না হয়।
শুনে প্রফেসর তো ঘাবড়ে গেলেন। আমিও নার্ভাস প্ৰকৃতির মানুষ। ডিম নিয়ে পড়লাম শাঁখের করাতে। ফেলাও যায় না, সাকুমাকু রুষ্ট হবেন। রাখাও যায়না, দেশের শুভানুধ্যায়ীরা প্ৰাণান্ত করে ছাড়বেন।
তানে–না–না করতে করতে করতে গেল একটি মাস। এক মাসেও যখন ডিম ফুটে কিছু বেরোলো না, তখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ভাবলাম, বোগাস ডিম। মরা ডিম। ডিমের ডিমত্ব অনেক আগেই গেছে। এখন তা মিউজিয়ামে রাখার সামিল।
হাল্কা মনেই বিকেলের দিকে গিয়েছিলাম প্রফেসরের ল্যাবোরেটরীতে। ডিম নিয়ে বড় বেশী জ্বালাতন হচ্ছেন বলে ইদানীং উনি একটা বড়বড় তারের আলমারীতে রেখে দিয়েছিলেন ডিমটা। আলমারীর মধ্যে আরো অনেক শিশি বোতল ছিল। তাই দিয়ে আড়াল করা থাকত চৈনিক রহস্য।
রহস্য ফুটি ফাটা হল সেই দিনই বিকেলে।
ল্যাবোরেটরীতে ঢুকে দেখি প্রফেসর হেঁট হয়ে তাকিয়ে আছেন তারের আলমারীর ভেতরে। ডান হাতের তর্জনীতে ন্যাকড়ার ফেটি জড়ানো।
আমাকে দেখেই বললেন, বেশ উল্লাসিত কণ্ঠেই বললেন—দীননাথ, চিচিং–ফাঁক!
সন্দিগ্ধ চোথে তাকিয়ে বললাম—আঙ্গুলে কি হয়েছে?
ডিমের বাচ্ছা কামড়ে দিয়েছে।
বেরিয়েছে?
একগাল হেসে বললেন প্রফেসর – তা আর বলতে। কুট করে আমার হাতেই দিল কামড়ে।
কখন?
আমি কি ছাই জানি ডিম ফুটেছে কখন। বোতল পাড়তে গিয়ে হাত ঢুকিয়েছি, অমনি কুট করে আঙুল কামড়ে দিল কে। আমি ভাবলাম ইঁদুর ঢুকেছে বোধহয়। পরে বুঝলাম, ইঁদুর নয়—খোকা দানব।
বুঝলাম, ‘ডিম–ডিম’ গল্পটা ওঁর চোখেও পড়েছে।
শুধোলাম—দেখেছেন খোকা দানবকে?
কি করে দেখবো বলো? বোতলের মাথা দিয়ে কেবল দেখলাম লাল টকটকে দুটো চোখ। কটমট করে দেখছিল আমাকে। ভয়ের চোটে আলমারী বন্ধ করে দিয়েছি আমি। খুলবো?
দাঁড়ান, বলে এক জোড়া চামড়ার দাস্তানা পরে নিলাম দুহাতে। বেশ পুরু চামড়া।
তারপর আলমারীর পাল্লা খুলে ডান হাত ঢুকিয়ে দিলাম ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম ডান হাতের আঙুলের ডগায় ধারালো দাঁতের কামড়। চোখের পলক ফেলার আগেই বাঁ হাত ঢুকিয়ে দিয়ে খপ করে চেপে ধরলাম খোকা দানবকে।
দু’হাত লাগিয়ে নিমেষ মধ্যে টেনে বার করে আনলাম তাকে। রাখলাম টেবিলের ওপর।
শিরদাঁড়া বার করা পিঠটা কুঁজো করে প্রফেসর ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েছিলেন ক্ষুদে জীবটাকে। খোকা দৈত্যও লাল–লাল ভাঁটা চোখ মেলে দেখছিল প্রফেসরকে।
হঠাৎ আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার জন্যেই বোধহয় কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে হকচাকিয়ে গিয়েছিল দানোটা। সেই অবসরে ভালো করে তাকে দেখবার সুযোগ পেলাম।
হাত খানেক লম্বা গিরগিটির মতই তার গড়ন। সারা গায়ে চামড়ার ওপর আঁশ বসানো। আঁশের আকার অবশ্য বেশ বড়। কতকগুলো আঁশ কুণ্ডলী পাকানো এবং অনেকটা পাখনার মত ঠেলে ওঠা। মাথার আকারটা কিন্তু গিরগিটির ধরণে নয়—বরং বেশ গোলাকার। মুখের ফোকর দেহের অনুপাতে বড়ই বলতে হবে। নাকের ফুটো দুটো রীতিমত চওড়া; ঈষৎ বসানো ভাঁটার মত রক্ত চক্ষু দুটো কিন্তু সাপের চোখের মত হিমশীতল নয়—বরং বেশ প্রাণবন্ত। ঘাড়ের কাছে সিংহের কেশরের মত অদ্ভুত ভাবে ঠেলে উঠেছে খাঁজকাটা চামড়া। সারা গায়ে নীল রঙের প্রাধান্য, তাতে সবুজের ছিটে। পা যেখানে দেহে জোড়া লেগেছে, সেখানে জ্বলজ্বল করছে লোহিত আভা। হলদে থাবায় ধারালো নখের কাছেও রক্ত রঙের ছিটে। ঘাড়ের কেশরের নীচেও লাল রঙ। সব কিছুর ওপরে আশ্চর্য একটা চকচকে আভা। এ–আভা ইস্পাতের ওপর দেখা যায়। সব মিলিয়ে চেহারাটা এমন জমকালো, এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর যে চোখ সরানো যায় না।
আজব গিরগিটিটা কিন্তু নিজে থেকেই ছিটকে গেল চোখের সামনে থেকে। প্রথমে এমন ঝুঁকে পড়েছিল দেখে মনে হল এই বুঝি লাফিয়ে পড়বে টেবিল থেকে। তারপর দৌড় শুরু হল টেবিলময়। পালাবার পথ খুঁজছিল বোধহয়। না পেরে ফের ঝুঁকে পড়ল টেবিল থেকে। আমি দেখলাম লাফিয়ে পড়ল বলে। তাড়াতাড়ি দস্তানা পৱা হাত বাড়িয়ে খামচে ধরলাম ঘাড়টা।
তৎক্ষণাৎ ঘাড় ফিরিয়ে সে আমার হাত কামড়াতে গেল চৈনিক দানো। না পেরে একটা আশ্চৰ্য কাণ্ড করে বসল।
প্ৰথমে চেষ্টা করল। লাজ আছড়ে ঘাড় মুক্ত করার। ব্যৰ্থ হয়ে অকস্মাৎ স্থির হয়ে গেল সারা দেহ।
পরক্ষণেই, নেহাতই আচন্বিতে, নাসিকাগর্জন করল বিচিত্র গিরগিটি। নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে এল দু’দুটো আগুনের ঝলক আর খানিকটা ধোঁয়া।
ভয়ে ময়ে বিষম চমকে মুঠে আলগা করে পিছিয়ে এলাম আমি। প্রফেসর আঁউ করে চেঁচিয়ে উঠে লাফিয়ে গিয়ে উঠলেন টুলের ওপর।
ক্ষুদে দানো নিজেও বুঝি অবাক হয়ে গিয়েছিল নাক দিয়ে আগুনের হলকা বার করার ক্ষমতা দেখে। সেকেণ্ড কয়েক তাই শুধু মাথা নেড়ে আর দেহের মতই লম্বা ল্যাজ আছড়ে অবলোকন করল আমাদের। তারপর একটি মাত্র লাফে ছিটকে গেল পাশের টেবিলে। গুটিগুটি গেল জ্বলন্ত বুনসেন বার্ণারের নীলচে শিখার সামনে। জাঁকিয়ে বসল ল্যাজ মুড়ে।
প্রফেসর খাবি খেতে খেতে বললেন—দীননাথ, কিছু বুঝলে?
ডাইনোসরের নাক দিয়ে কি আগুন বেরোয়?
এই তো ধরেছো! কার নাক দিয়ে আগুন বেরোয় বলো তো?
ঢোক গিলে বললাম—বলবো?
আরে বলোই না।
ড্রাগনের।
রাইট। ড্রাগনের।
হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আমি। চীনের ড্রাগন আমার সামনে?
***
কিংবদন্তী কি সত্যি হয়? চীনের ড্রাগন কাহিনী তো চীনের উপকথায় পাওয়া যায়। উপকথার ড্রাগন বাস্তবে সম্ভব হয় কি করে?
এমনও হতে পারে পুরাকালে ড্রাগনের অস্তিত্ব ছিল চীনদেশে। চীনভূমির দুৰ্গম অঞ্চলে বিচরণ করেছিল বিচিত্ৰ ভয়াল এই সরীসৃপ জীব। ক্রমে ক্ৰমে কমে এসেছে তাদের সংখ্যা। তারপর হয়ত চীনভূমি থেকে মুছে গিয়েছে তাদের অস্তিত্ব। ড্রাগন কাহিনী তখন কিংবদন্তী–কাহিনী হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরাণ উপকথায় ঠাঁই পেয়েছে।
এ–ডিমটি হয়ত সর্বশেষ ড্রাগনের সর্বশেষ বংশধর। হয়ত প্ৰকৃতির বিচিত্র খেয়ালে জিয়োনো ছিল কোন পৰ্বত বন্দরে অথবা ড্রাগন–সমাধি অঞ্চলে। হয়ত দুঃসাহসী সেই চৈনিক অভিযাত্ৰী জীবন বিপন্ন করেও হানা দিয়েছিল দুৰ্গম সেই কেন্দ্রে। হয়ত দৈবাৎ ডিমটি হাতে এসে পড়েছিল তার। চীনের পবিত্র ড্রাগনের সর্বশেষ বংশধরকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছেল সামপানে।
আশ্চর্ষ! ফ্যানটাসটিক এই অনুমান বিশ্বাস করতে মন চায় না ঠিকই। কিন্তু চোখের সামনে ঐ তো চীনের ড্রাগন। চীনের শক্তি বীর্যের প্রতীক ভয়ংকর সুন্দর ড্রাগন। গ্যাস বাৰ্ণারের নীলাভ শিখার সামনে পরম আরামে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে হৃষ্টচিত্তে তাকিয়ে দেখছে অগ্নিনৃত্য। আগুন যেন তার খেলার সঙ্গী, তার শক্তির ফোয়ারা।
অদ্ভুত আবিষ্কারটা স্রেফ চেপে যাওয়াই মঙ্গল বিবেচনা করলাম। প্রফেসর আমার যুক্তি বুঝলেন। চীনের অতিকায় ডিম কাহিনী ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে–ঝামেলা পোহাতে হয়েছে—সে শিক্ষাও ভোলবার নয়। এরপর যদি আমরা ফলাও করে বলে বেড়াই, ডিম ভেঙে চীনের ড্রাগন বেরিয়েছে, তাহলে তো রক্ষে নেই। সারা এশিয়ার টনক তো নড়বেই। এমন কি চীনের ড্রাগনের জোর করে আটক রাখার অপরাধে চীন না চড়াও হয়ে বসে ভারতের ওপর।
সুতরাং দরকার কি অত কথা বলার! ডিম দেখতে যারা এল, তারা ডিমের জায়গায় দেখল একটা মস্ত গিরগিটি। ডাইনোসরের বাচ্ছা বলে যারা সন্দেহ করেছিল। তারাও হতাশ হল ড্রাগন–বাচ্ছার গড়ন দেখে।
ড্রাগনের আগুন নিঃশ্বাস কিন্তু কেউ দেখল না। না খোঁচা খেলে নাসিকাগর্জন করে না খোকা–ড্রাগন। তাই পাছে কেউ তাকে খুঁচিয়ে দেয়, আমরা একটা মস্ত জালের আলমারীতে ওকে রেখে ওপরে লেবেল সেঁটে দিয়েছিলামঃ দয়া করে বিরক্ত করবেন না।
প্রফেসর বলতেন—নেহাতই একটা গিরগিটি দেখছি। রঙচঙে গিরগিটি। তবে হ্যাঁ, চেহারাটা সেই অনুপাতে বড়।
বিজ্ঞান সম্পর্কিত সংবাদদাতারা তা সত্ত্বেও ভুরু কুঁচকে বলতেন—জন্মেই যে গিরগিটি এত বড় হয়, দু’ দিন বাদে সে তো অতিকায় গিরগিটি হবে মশায়।
প্রফেসর বলতেন—দেখা যাক।
দর্শনার্থীর ভীড় আস্তে আস্তে কমে এল উৎসাহে ভাঁটা পড়তে। হুজুগ বেশী দিন থাকে না। নতুন হুজুগ নিয়ে মাতলো পাড়া প্রতিবেশী এবং রিপোর্টাররা। চনমনে খবরের আশায় এসে একটা রঙচঙে গিরগিটি দেখে ক্ষুণ্ণ হবার পর কার আর আসতে সাধ যায় বলুন।
কাজেই, মাস খানেকের মধ্যেই প্রফেসরের ল্যাবোরেটরীতে আবার শান্তি ফিরে এল। আমরা তখন ছাদে কাঠ আর তারের জাল দিয়ে একটা ঘর বানালাম। চীনের ড্রাগনকে রেখে দিলাম তারের খাঁচায়। না রেখেও উপায় ছিল না। খাওয়ানোর সময়ে খাবার পছন্দ না হলেই দু’একবার আগুন–নিঃশ্বাস ছাড়তো খোকা–ড্রাগন। সে আগুনে ল্যাবোরেটরীর কত ফার্নিচার যে পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে, তার ইয়াত্তা নেই। অনেক রকম দাহ্য পদার্থও মজুদ থাকে বীক্ষণাগারে। আগুনের হালকায় শেষকালে একটা লঙ্কাকাণ্ড না বাঁধে। তখন তো বীমা কোম্পানীর এজেণ্ট আসবেই। জেরার চোটে ড্রাগন কাহিনী ফাঁস হয়ে যেতে পাৱে।
এই সব আশংকা করেই খোকা–ড্রাগনকে চালান করলাম ছাদের ঘরে।
রাত্রের উপদ্রব শুরু হল এর দিন কয়েক পরেই!
***
হঠাৎ একদিন প্রফেসর বললেন—দীননাথ, ড্রাগন ছোকরা তো বড় জ্বালাতন জুড়েছে হে।
সেকী! ছাদের জ্বালাতনে আপনার মাথা ব্যথা কিসের?
বলো কি! সমস্ত রাত ছাদে দুপদাপ আওয়াজ হলে ঘুমানো যায়? তার ওপর আছে গজরানি।
ক্ষিদে পায় বোধহয়।
আরে না। খাবার পড়ে থাকে। ভোরবেলা রোজই দেখি মড়ার মত ঘুমোচ্ছে। খাবার ছোঁয়নি। ব্যাপারটা কি বলো তো? রাত হলেই এত দামালপনা কেন?
কেন এ–প্রশ্নের জবাব পরে পেয়েছিলাম। চরমতম ফ্যানটাসটিক সে ক্লাইমাক্স আমাদের চক্ষু স্থির করে ছেড়েছিল। কিন্তু তার আগেই আর একটা আবিষ্কার করে বসলাম।
চীনের ড্রাগন নিয়ে খুব পড়াশুনা আরম্ভ করেছিলাম। চীনের উপকথা তো বটেই, এমন কি বিশ্বকোষ শুদ্ধ ঘেঁটে দেখেছিলাম। পড়াশুনার পর নিজেকে ড্রাগন–বিশেষজ্ঞ মনে করলাম।
বিজ্ঞের মত একদিন বললাম প্রফেসরকে—আমরা বোকা বনেছি।
কেন? টেস্টটিউবের সলিউশান নিরীক্ষণ করতে করতে বললেন প্রফেসর।
এটা ড্রাগন নয়।
কে বলল? সলিউশনে থার্মোমিটার ডোবলেন প্রফেসর।
বিশ্বকোষ আর চীনের উপকথা।
সিধে হয়ে দাঁড়ালেন প্রফেসর—কি বললে?
বললাম যে বিশ্বকোষ আর চীনের উপকথায় ড্রাগনের যে বৰ্ণনা পাচ্ছি, তার সঙ্গে আমাদের ড্রাগনের মিল নেই।
কোথায় মিল নেই?
ডানায়।
ডানায়?
আজ্ঞে হ্যাঁ। চীনের ড্রাগনের ডানা আছে। আামাদের ড্রাগনের ডানা নেই, হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন প্রফেসর—তাহলে এটা কি?
প্রাগৈতিহাসিক কোন সরীসৃপ দানব বলেই তো মনে হচ্ছে। এখনো হদিশ পান নি জীববিজ্ঞানীরা।
প্ৰাগৈতিহাসিক সরীসৃপা–দানো! মানে, ডাইনোসরের জ্ঞাতি ভাই! ওরে বাবা!
ভয় কিসের?
কিসের নয়? দীননাথ, এ–কি গেরোয় পড়লাম!
বুঝলাম ‘ডিম–ডিম’ গল্পের আজগুবি আতংক এখনো ওঁর মাথা থেকে যায় নি।
***
‘আজগুবি আতংক’ শব্দ দুটো আগের লাইনে লিখলাম বটে, কিন্তু লেখার পরেই হাসি পাচ্ছে। এ–গল্পটাই বা কম কিসে? আজগুবিকে দুই দিয়ে গুণ করলে যা হয়, এ গল্পটা বোধহয় তাই। বিশেষ করে এ–গল্পের উপসংহারকে চরমতম ফ্যানটাসি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
ছাদের উপদ্রবের কথা আগেই লিখেছি। প্রথম–প্ৰথম প্রফেসরের কথায় আত মাথা ঘামাইনি। তারপর মাথা না ঘামিয়ে পারলাম না।
প্রফেসর একদিন বললেন—ওহে দীননাথ, ছাদেৱ দাপাদাপি আর তো সহ্য হয় না। ঘুমের দফারফা করে ছাড়ল সে।
ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিলে হয় না?
আমাকে? আরে গেল যা—
না না, আপনাকে কেন? নকল ড্রাগনকে।
মতলবটো মনে ধরল প্রফেসরের। সেই দিনই রাতের খাবারে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেওয়া হল।
পরের দিন শুকনো মুখে প্রফেসর বললেন—হল না।
কি?
ঘুমের ওষুধে ঘুম হ’ল না মেকী ড্রাগনের।
আপনি গিয়ে দেখে এসেছিলেন?
তবে আর বলছি কি। ব্যাটা মটকা মেরে পড়েছিল। মাঝরাতে ফের শুরু করেছিল দামালি।
আপনি গিয়ে আবার একটা ঘুমের ডোজ দিয়ে এলেন না কেন?
ব্যাটা পাজীর পাঝাড়া। সঙ্গে সঙ্গে ছাদে উঠে দেখি হতচ্ছাড়া ঘুমিয়ে কাদা হয়ে রয়েছে। অত খোঁচালাম—উঠল না।
তারপর?
তারপর আবার কি। যেই নীচে নেমে ঘুমোতে যাচ্ছি, অমনি আবার ফোঁসফোঁস দুপদাপ ঝটপট শুরু হল।
একটু থেমে বললাম—আওয়াজগুলো কান খাড়া করে শুনেছিলেন?
কেন বলো তো?
এমনি জিজ্ঞেস করবে কেন?
বললেন কি না ফোঁসফোঁস দুপদাপ ঝটপট শুরু হল, তাই।
যা হল, তাই বললাম। অত জেরা কিসের?
চটে যাচ্ছেন কেন?
চটবো না? একে রাতে ঘুম নেই, তারপর কথা নিয়ে কচকচি।
ঝটপট আওয়াটা স্পষ্ট শুনেছিলেন?
না শুনে কি বলছি?
ফোঁসফোঁস আওয়াজ হয় নিঃশ্বেস ফেললে, দুপদাপ আওয়াজ হয় লাফালাফি করলে, কিন্তু ঝটপট আওয়াজটা হয় ডানা ঝাপটালে।
সঙ্গে সঙ্গে সেকি বিপুল পরিবর্তন দেখা গেল প্রফেসরের মুখাবয়বে। চোয়ালটা এমন ঝুলে পড়ল যে ফোকলা মাড়ি পর্যন্ত দেখা গেল স্পষ্ট। চামড়ার আড়ালে চোখ দুটো গেঁড়ির চোখের মত ঠেলে বেরিয়ে আসে আর কি।
দীননাথ! দীননাথ! অভিভূত কণ্ঠ প্রফেসারের, উফ! কি বিরাট গাড়ল ‘আমি। আওয়াজটা প্রতি রাত্রেই শুনেছি। অথচ, ধরতে পারিনি। উফ! আমার ব্রেন। আমার ব্রেনে আর কিছু নেই।
তারপর প্রফেসার যা বললেন, তাতে আমারই আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল।
বললেন—দীননাথ, ব্যাটা আমাদের দুজনকেই ফুল বানিয়েছে। ওকে আমরা নকল ড্রাগন ঠাউরেছি। আসলে ও আসল ড্রাগন, খাঁটি ড্রাগন, পাখাঅলা ড্রাগন।
পাখাদুটো কি তাহলে অদৃশ্য পাখা?
আরে না, না। ঘাড়ের কাছে কেশরের মত খাঁজকাটা যে চামড়া দেখেছো, ঐ খানে লুকোনো আছে পাখা। আমাদের দেখলেই লুকিয়ে ফেলে, রাত হলে বার করে।
অর্থাৎ গিরগিটি নয়—ছদ্মবেশী ড্রাগন।
ঠিক ধরেছো।
আমার বিশ্বাস হয় না। ড্রাগনরা কি ইনটেলেকচুয়াল হয়? আমাদের সামনে আসল রূপ ঢাকতে যাবে কেন?
একটা ড্রাগনকে ধীমান বলতে বোধহয় বিবেকে আটকালো প্রফেসরের। মাথা চুলকে বললেন—তাহলে?
আমিও মাথা চুলকে বললাম, তাহলে ঝটপট আওয়াজটা আসছে কোত্থেকে?
আমিও তো তাই বলছি।
আমিও তো তাই ভাবছি, বলে, ভাবনার বোঝাটা চাপিয়ে দিলাম আমার উর্বর মগজে। রেজাল্ট পাওয়া গেল সঙ্গে সঙ্গে। লাফিয়ে উঠে বললাম—প্রফেসর।
চেঁচিও না। বলো।
বলছি কি, আজ রাতে পাহারা দিলে হয় না?
চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন প্রফেসর, ড্রাগন মহাপ্রভুকে না জানিয়ে তো?
তা আর বলতে।
আমতা আমতা করলেন প্রফেসর—ক’রাত ঘুম হয়নি তো।
কুছ পরোয়া নেহি। আমি জাগবো। আপনি ঘুমোবেন।
***
সেই রাতেই দেখা গেল আশ্চর্য সেই ছায়াকে।
ছাদের দরজা বন্ধ করে নেমে গেলেন প্রফেসর। ড্রাগনের খাবারে বেশ করে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে এসেছিলেন। পরম সন্তোষে আমাদের সামনেই তাই ভক্ষণ করতে শুরু করেছিল উপকথার আতঙ্ক।
তারপর বন্ধ দরজার ফুটোয় চোখ লাগিয়ে বসে থেকেছি আমি। বসে বিড়ি খেয়ে ঘুম তাড়িয়েছি। গর্ত থেকে কিন্তু চোখ সরাইনি। মশার কামড়ে বিব্রত হয়েছি। কিন্তু চটাস শব্দে মশক–নিধন করতে পারিনি পাছে ড্রাগন মহাপ্ৰভু সচকিত হন।
ড্রাগন খোকা কিন্তু ঘুমোচ্ছিল। মড়ার মত ঘুমোচ্ছিল। মরে পড়েছিল কিনা জানিনা। কিন্তু ছাদ যখন জনশূন্য, তখন কষ্ট করে মটকা মেরে পড়ে থাকার কোন যৌক্তিকতা আছে কি? ড্রাগনের বুদ্ধি বিবেচনায় হয়ত আছে। তাই আমি আওয়াজ করিনি।
রাত যখন বারোটা। যখন বিড়ির কটুগন্ধে মশাগুলো শুদ্ধ সন্ত্রস্ত, ঠিক তখনি একটা ঝটপট আওয়াজ ভেসে এল কানে।
খড়খড়ে চোখে তাকালাম আমি ঘুমন্ত ড্রাগনের দিকে। কই, ঘাড়ের কাছে চামড়ার খাঁজ তো খুলে যায় নি। পক্ষীরাজের ডানার মত কোনো ডানা তো বিস্তৃত হয়নি।
অথচ ঝটপট আওয়াজটা স্পষ্ট ভেসে আসছে কানে। আসছে ছাদ থেকেই। ফুটোর মধ্যে দিয়ে গোটা ছাদটা দেখা যায় না। অথচ দৃষ্টিপথের আড়ালে রয়েছে ছাদের অনেকখানি। আওয়াজটা সেই দিক থেকেই আসছে না?
সাত তাড়াতাড়ি চোখ সরাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম দরজার ওপর। তাইতেই সাবেকী বাড়ীর নড়বড়ে দরজার ঝুলন্ত শিকল ঝনঝন করে উঠেছিল। রাত দুপুরে ঐ টুকু আওয়াজই যেন করতালের মত বেজে উঠেছিল।
নিমেষের মধ্যে স্তব্ধ হয়েছিল ঝটপট শব্দ।
সেকেণ্ড কয়েক পরেই আবার শোনা গিয়েছিল ডানার ঝটপটানি। আর, পলকের জন্য অবরুদ্ধ হয়েছিল দৃষ্টিপথ।
পরক্ষণেই সরে গিয়েছিল অবরোধ। চাঁদের আলোয় কেবল দেখা গিয়েছিল একটা বিশাল ছায়া সাঁ করে সরে গেল ছাদের ওপর থেকে।
মুখ চুন করে সকালবেলা প্রফেসরকে বললাম আমার ব্যর্থ অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী।
প্রফেসর আবার ব্যর্থতা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামালেন না। বিষম উত্তেজিত হয়ে বললেন—বলো কি, একটা ছায়া সৱে গেল ছাদ থেকে? কোথায় গেল?
আকাশে।
অ্যাঁ! আকাশে কেন?
মনে হল ডানা ঝেড়ে কি যেন আকাশে উড়ে গেল। দরজার ফুটোর সামনে দিয়ে গেল বলে দেখতেও পেলাম না চেহারাটা।
মুখ লম্বা করে বসে রইলেন প্রফেসর।
সেদিন থেকে পর পর তিন রাত ছাদে আর কোনো উপদ্রব হল না। তিন দিন ঠায় রাত জাগার পর মন ভেঙে গেল আমার। চতুর্থ দিন ঠিক করলাম প্রফেসরের সঙ্গেই নিদ্রাদেবীর আরাধনা করব। দুপদাপ ফোঁসফোঁস ঝটপট আওয়াজ শোনা গেলেই ছাদে উঠব।
তার পরেও তিনটি রাত গেল নিরুপদ্রবে।
সপ্তম দিন রাতে আবার আবির্ভূত হল উড়ন্ত ছায়া–রহস্য।
অঘোরে ঘুমোচ্ছিলাম। ঘুম ভাঙল প্রফেসরের গুঁতোয়।
দীননাথ, ও দীননাথ।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম আমি—কি হল? কি হল।
এসেছে! এসেছে! এসেছে! উস্কখুস্ক চুলে ফোকলা দাঁতে লুঙ্গি সামলাতে সামলাতে প্রায় নৃত্য জড়ে দিলেন বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক।
ছাদের ওপর শুনলাম ভীষণ দাপাদাপি। সেই সঙ্গে হাপর চলার মত ফোঁস ফোঁস শব্দ। ডানার ঝটপটানি তো রয়েছেই।
প্রফেসর বললেন—এত জোর আওয়াজ এর আগে কখনো হয়নি, দীননাথ। কেস খুব সিরিয়াস।
বাস্তবিকই, ছাদের ওপর যেন শুম্ভনিশুম্ভের লড়াই লেগে গিয়েছে। সে কি আওয়াজ!
জোরালো টর্চ মাথার কাছে নিয়েই শুয়েছিলাম। টান মেরে তাই নিয়ে ছিটকে গেলাম দরজার দিকে। পেছন পেছন লুঙ্গি সামলাতে সামলাতে দৌড়ে এলেন প্রফেসর।
এক এক লাফে তিন তিনটে ধাপ টপকে ছাদের দরজায় গিয়ে যখন পৌঁছোলাম শুম্ভ নিশুম্ভর লড়াইটা তখন যেন একটু ঝিমিয়ে পড়েছে।
তা সত্ত্বেও এক ঝটকায় দুহাট করে ধরলাম দরজা। পাঁচ ব্যাটারীর জোরাল টর্চ আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিল ছাদ।
দেখলাম একটা বিচিত্র দৃশ্য!
তার আর কাঠের খাঁচা প্ৰায় চূর্ণ–বিচূর্ণ। ড্রাগন মহাপ্ৰভু ভেতরে নেই। ছাদের ঠিক মাঝখানে আধ ঘুমন্ত অবস্থায় লুটোপুটি খাচ্ছেন তিনি। একানন। সঙ্গে রয়েছে আর একজন।
সঙ্গী জীবটি নিঃসন্দেহে ড্রাগন। অবিকল ঐ রকম ভাঁটার মত চোখ, রঙীন দেহ। দরজাটা দুহাট হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চমকে ঘাড় ফেরালো আগন্তুক। নিৰ্ঘোষধ্বনি শোনা গেল নাসিকারন্ধ্রে সেই সঙ্গে দেখা গেল আগুনের হলকা। নাকের দুই নল দিয়ে বেরিয়ে এল দুদুটো অগ্নিশিখা। প্রতিটির দৈর্ঘ্য কম করে এক গজ।
আগন্তুক ড্রাগন আকারে অনেক বড়। চাল চলনেও অনেক ভারিক্কি। এমন অগ্নি নিঃশ্বাসের কেৱদানিতেও টেক্কা মারতে পারে আমাদের পোষা ড্রাগনকে।
সমস্ত দৃশ্যটা দেখলাম এক লহমার মধ্যে। তার বেশী সময় পাওয়া গেলনা।
কেননা, পরক্ষণেই বিশাল গরুড় পাখীর মত দুদিকে ডানা বিস্তার করল নিশীথ রাতের আগন্তুক। দুবার ডানা ঝাপটিয়েই লাফিয়ে উঠল শূন্যে। চক্ষের পলকে ছিটকে গেল আরো উচুতে। তারপর অশ্চর্য ছন্দে পাখা নেড়ে নেড়ে মিলিয়ে গেল। অতীতের চায়না টাউনের দিকে।
উড়ন্ত ড্রাগন আর আসেনি। আসার আর দরকারও হয়নি।
কেননা; অনেকদিন পরে আমাদের পোষা ড্রাগনের! গৰ্ভ–যন্ত্রণা উপস্থিত হল এবং যথা সময়ে প্রসব করল মুক্তোর মত ঝিলমিলে অতিকায় একটি ডিম।
তখন বোঝা গেল, এটি ড্রাগনী। তাই ওর ডানা নেই। নিশীথরাতে তাই বারবার চায়না টাউনের দিক থেকে উড়ে এসেছে ডানাঅলা ড্রাগন।
যথা সময়ে ডিম ভেঙে বেরিয়ে এল একটি বাচ্ছা।
ডানাওলা ক্ষুদে…
Tags: অদ্রীশ বর্ধন, গল্প, ডিম, দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, পুনঃপ্রকাশিত গল্প, মূল প্রচ্ছদ
Khub valo laglo.. 😊😊😊😊😊
গল্প টি চমৎকৃত করল তাঁর সবকটি বিভাগে। বিষয়, কাহিনী বিন্যাস, শুরু আর শেষ সব কিছু নিপুন দক্ষতার সাথে। এমন নয় যে এই গল্প লেখার জন্য খুব দারুন কিছু কাগজ পত্র ঘাটতে হয়েছে । আমার ভালো লেগেছে শুরু আর শেষ টি আর সেই খানেই এই ফ্যান্টাসির ম্যাজিক টি।
চমৎকৃত হলাম। ধন্য হলাম।🙏
অপূর্ব লেখা।শেষ টা খুবই অপ্রত্যাশিত।সত্যজিৎ এর লেখন ভঙ্গির যোগ্য উত্তরসুরী।