প্রত্যক্ষদর্শী
লেখক: শ্রীজিৎ সরকার
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
বিস্মরণের রাত
গতকাল ছেলেটা আমাকে জানালার পাশ থেকে সরাতে ভুলে গিয়েছিল। গতকাল মানে অবশ্য চলিত অর্থে গতকাল নয়। কিন্তু এখন যেহেতু রাত দেড়টা বাজে, তাই বারোটার পূর্ববর্তী সময়কে আমি গতকাল বলেই চিহ্নিত করছি।
যত যাই হোক—ছেলেটা একজন মানুষ এবং চরিত্রগতভাবে কিছুটা ভুলোমনও। নয়তো ও যদি রোবট হত আর ওর মধ্যে ভরে দেওয়া থাকত আমাকে নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রোগ্রাম, তবে এরকম ভুল ও কখনও করতে পারত না! রোবটদের জীবনের আপ্তবাক্যই তো এই তিনটে: Never misdo. Never miscalculate. Never misdoubt.
যেহেতু আমার উপর আজ অন্যকে বিনোদিত করার আদেশ আসেনি—তাই সন্ধ্যা থেকেই আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। একসময় নৈশভোজ সারতে সারতে এই বাড়ির মানুষগুলো যেমন হইহল্লায় মেতে উঠত—রোবটগুলোও তেমন রিচার্জিঙের সময়টুকু হইচই করছিল। তবে অন্যান্য দিন ওদের হইচইতে থাকে আমোদ; আর গতকাল ছিল আশঙ্কা। আমিও ঝিমোতে ঝিমোতে লক্ষ রেখেছিলাম ওদের উপরে। যদিও বয়সের কারণে আমার দৃষ্টিশক্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে এসেছে… তবু, এখনও তো আমি একেবারে অন্ধ হয়ে যাইনি!
ওদের মধ্যে একজন বলছিল, “এত কড়া সিকিয়োরিটির মধ্যেও যে অর্থভাণ্ডারের মতো জায়গায় কীভাবে হল এসব… ”
না, টাকাপয়সার মতো ঐহিক ব্যাপারে আমার বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারেও আজকাল এত অনাগ্রহী হয়ে পড়েছি যে—যদি তিনদিন খেতে নাও পাই, তবুও বিশেষ অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। তবু আমি সেই মুহূর্তে উৎকর্ণ হয়েছিলাম।
ভাগ্যিস ওরা এই কথা ভাবে না যে, আমি কোনো গুপ্তচর হলেও হতে পারি। অবশ্য এক প্রায় নব্বই বছরের বৃদ্ধ কাকাতুয়া—যার চোখ ঢেকেছে ছানিতে, বকফুলের মতো পালকগুলো খসতে খসতে বেরিয়ে এসেছে খামচা খামচা গোলাপি শরীর, রাত-দিন নিজের দাঁড়ে বসে ঝিমানো আর মাঝেমধ্যে দুর্বোধ্য স্বরে কথা বলা ছাড়া বিশেষ কোনো কাজ নেই—তাকে কে-ই বা আমল দেবে?
অবশ্য আমার কিবা তারুণ্য আর কিবা প্রৌঢ়ত্ব! যখন আমার যৌবন ছিল, ওরা তো তখনও আমাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি!
সত্তর বছর কেটে গেল দেখতে দেখতে…
সত্তর? নাকি তার থেকে এক-দুই বেশি? যাইহোক, সেই দিনটার কথা আমি ভুলে গেছি নাকি, যেদিন হঠাৎ করেই বাঁক নিয়েছিল ইতিহাসের ধারা? ভুলিনি। আজও, চোখ বুজলেই আমি চলচ্চিত্রের থেকেও স্পষ্টভাবে দেখতে পাই দৃশ্যগুলো।
সেদিন ছিল এক রৌদ্রজ্বল রবিবার। এই দাঁড়ে বসে বসেই আমি আমার প্রিয় খাবার সূর্যমুখীর বীজ খাচ্ছিলাম, আর আমার অন্নদাতাদের শোনাচ্ছিলাম তাদের প্রিয় কবিতা:
কাজ করে রোবটের দল;
ওরা নির্বোধ, ওরা হীনবল।
ওরা মানুষের পদদাস;
না দিলে চার্জ শক্তি খালাস।
বুদ্ধি ওদের অতি ক্ষীণ;
দাসত্বের মনোবৃত্তি, দৃঢ়তাহীন।
কাজ করে রোবটের দল;
মানুষ-বিনা ওরা অকেজো, নিশ্চল।
ওরা হাসছিল, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল ছুটির সকাল, আড়ে আড়ে ব্যঙ্গদৃষ্টি ছুড়ে দিচ্ছিল কর্মচারী রোবটদের দিকে। জীব হোক বা যন্ত্র—অন্যকে হেয় করে, এমন কথা বলতে আমার কোনোদিনই ভালো লাগে না। তবু সেই মুহূর্তে ওটাই ছিল আমার একমাত্র কৃত্য।
সাবলীলভাবে আমি আবৃত্তি করছিলাম বটে, তবে আমার মধ্যে অদ্ভুত এক শঙ্কা কাজ করছিল। আমি যেন আসন্ন অঘটনের গন্ধ পাচ্ছিলাম। কারণ আমি জানতাম, কিছু একটা হতে চলেছে…
এমন সময় কর্মচারী রোবটরা মপ-ডাস্টার ফেলে হঠাৎ হাতে তুলে নিয়েছিল আগ্নেয়াস্ত্র, কোথা কোথা থেকে দরজা-জানালা ভেঙে ঢুকে পড়েছিল আরও নানান শ্রেণীর সশস্ত্র যন্ত্রমানব… আমি দিশেহারা হয়ে চিৎকার করছিলাম। কিছুক্ষণ আগেও হাসি-মজায় মেতে থাকা মানুষগুলো পাংশু হয়ে গিয়েছিল; আর আমি—চুপ করে গিয়েছিলাম বারকয়েক চিৎকার করার পর, আমার কাঁঠালিচাঁপার মতো ঝুঁটিটাকে ফুলিয়ে অপেক্ষা করছিলাম ভীষণ কিছুর জন্য।
সেদিন যদি ওরা আমার মেধা আর শক্তিকে গুরুত্ব দিত—তবে কি ভূতপূর্ব মনিবদের সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের শরীরটাও তার কিছুদিন পরেই নিরন্তর গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যেত না?
কিন্ত ওরা তা করেনি। বরং ওদের প্রধান আমার দিকে আঙুল তুলে ঘোষণা করেছিল, “এই পাখিটার সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। ও বুদ্ধিমান, বিবেচক; তবে ক্ষতিকারক নয়। বরং আমাদের পরিকল্পনার কথা ও মানুষের কাছে ফাঁস করেনি, তাই আমি ওকে ওর জীবন পুরস্কার দিচ্ছি। তবে মুক্তি ও পাবে না। ও এতদিন মানুষকে বিনোদন দিয়ে এসেছে, এবার থেকে আমাদের দেবে।”
এরপর, এই বাড়িটাকে সেন্ট্রাল অফিস ঘোষণা করার পাশাপাশি, নিজেদের সমাজকে ওরা ভাগ করে ফেলেছিল দু-ভাগে—
১. MRM (Man-made Robot)
২. RRM (Robot-made Robot)
তবে মানুষ যেমন নির্মাণকৌশলে ঈশ্বরকে টেক্কা দিতে পারেনি, রোবটরাও তেমন পারেনি মানুষের সমান কৃতিত্ব দেখাতে। ফলে দ্বিতীয় শ্রেণীর রোবটদের মধ্যে সব থাকা সত্ত্বেও তারা প্রথম শ্রেণীদের মতো উৎকৃষ্ট হতে পারেনি। প্রথম শ্রেণীর রোবটরা মানুষের পাশাপাশি তাদেরও বানিয়েছিল নিজেদের আজ্ঞাবহ!
কিছুক্ষণ আগেই বলাবলি করছিল ওরা, “কোনো রোবট কখনওই এমন কাজ করতে পারে না! রোবটরা কীভাবে বেইমানি করবে? কোনো পরিস্থিতিতেই ওদের অ্যালগরিদম এটা সমর্থন করবে না।”
মনে মনে হেসেছিলাম আমি।
একদিন মানুষও ঠিক এই কথাই বলত, “মানুষ বেইমানি করলেও, রোবটরা কখনও বেইমানি করবে না! কারণ, হিংসা, বেইমানি, দ্বিচারিতার মতো মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা ওদের মধ্যে দিইনি। তাই জন্যই আমরা সব গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার ধীরে ধীরে ওদের হাতে তুলে দিচ্ছি।”
বেইমানি, স্বার্থপরতা, অসততা, শঠতা—সময় এবং অভিমুখের মতো এসবও যে কত আপেক্ষিক ব্যাপার—সে কথা মানুষও সেদিন ভুলে গিয়েছিল, আর আজ রোবটরাও…
হায় যন্ত্রমানবের দল! সেই অ্যালগরিদম—যা তোমাদের নির্মাতারা একদিন ভরে দিয়েছিল তোমাদের যন্ত্রমস্তিষ্কে থাকা আণুবীক্ষণিক চিপের ভিতরে ভিতরে, যার উপরে নির্ভর করে স্বাবলম্বী হয়েছিল তোমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মানুষকে অনুসরণ করার মাধ্যমে নিজেকে করে তুলেছিল উন্নততর—সেটার প্রাথমিক যৌক্তিক নির্ণয়গুলো থেকে তো কবেই সরে এসেছ তোমরা… এরই মধ্যে ভুলে গেলে সেসব? আর বেইমানি তো তোমরা করেইছ… যে মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে তোমাদের আত্মসচেতনতা দিল, তাকেই পদচ্যুত করলে তোমরা, তার জীবন কেড়ে নিলে কত অনায়াসে।
কী অবলীলায়ই না রোবটরা বলেছিল, “এই পৃথিবীতে মানুষের একমাত্র প্রয়োজন ছিল আমাদের সৃষ্টি এবং উন্নয়ন করার জন্য। আজ তাও ফুরিয়েছে। তবু, তাদের মধ্যে যারা নিরীহ, আমরা তাদের জীবন উপহার দিচ্ছি।”
ওদের আলোচনা থেকেই আন্দাজ করে নিয়েছিলাম, সম্ভবত অর্থভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে যন্ত্রমানব সমাজের হাত থেকে। বন্ধ হয়ে গেছে ভাণ্ডারের অভেদ্য দরজা। কোনো কৌশলেই খোলা যাচ্ছে না সেটা। কিন্তু কে আছে এর পিছনে আর কেমনভাবেই বা বাস্তবায়িত হল এই প্রকল্প—সেই তথ্য উদ্ধার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তদন্তকারী কমিশন! ইনভেস্টিগেটিং অফিসাররা নাকি নিজেদের স্ক্রুটিনাইজিং, ডিটেকটিং এবং ডেটারমিনেটিং সিস্টেমকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রয়োগ করছে সুরাহা পাওয়ার জন্য। তবে এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি কোনো আশাব্যঞ্জক ফলাফল।
ওদের মধ্যে কেউ কেউ বলছিল, “এই কাজ সম্ভবত ছদ্মবেশী কোনো মানুষের। আমাদের সিকিয়োরিটি কোড ভাঙার মতো বুদ্ধি একমাত্র ওদেরই আছে। এটা ভুললে কিন্তু কিছুতেই চলবে না যে—ওরা যা তৈরি করেছিল, তার প্রভাবকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এখনও পর্যন্ত আমরা সম্পূর্ণ অভিনব কিছু উদ্ভাবন করতে পারিনি। আমরা শুধুই ওদের পরিকল্পনাগুলো রূপায়িত করেছি, প্রযুক্তিগুলো মডিফাই করেছি।”
অন্য আরেকজন মন্তব্য করেছিল, “কিন্তু সেটাই বা কীভাবে হতে পারে? যদি চতুর মানুষের দল কোনোভাবে আমাদের রক্ষীদের চোখকে ফাঁকি দিয়েও থাকে—তারপরও—অর্থভাণ্ডারের আশপাশে যেসব ইনফ্রারেড হিমোগ্লোবিন ডিটেক্টর আছে, সেগুলো পেরিয়ে ওরা ঢুকল কীভাবে?”
হয়তো এই বিষয়ে আরও কিছু বলত ওরা। কিন্তু ওদের দেখাশোনা করার দায়িত্বে থাকা ইনচার্জ বলেছিল, “এত উত্তেজিত হলে কিন্তু তোমরা উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। আর চার্জিং-এর সময় যত উত্তপ্ত হবে, তত কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগের আশঙ্কা দেখা দেবে।”
নিশ্চয়ই ওদের রিসিভার তৎক্ষণাৎ নির্দেশ পাঠিয়েছিল সিস্টেমকে; অগত্যা শব্দহীন হয়ে পড়েছিল ওরা।
এর কিছুক্ষণ পরেই ঘর অন্ধকার করে চলে গিয়েছিল সবাই। আর শিকলের ফাঁদে নিশ্চল আমি, সারারাত জানালা দিয়ে দেখেছিলাম ঝাঁ চকচকে শহরটাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম কয়েকটা। না, ওই অসংখ্য আকাশযানের শব্দে ধোঁয়ায় দূষিত হয়ে ওঠা আকাশে ফিরে যাওয়ার বাসনা আমার আর নেই। আমি বিষণ্ণ হয়েছিলাম শহরটার পরিণতির কথা ভেবে। হয়তো এই শহর এখন আগের থেকে আরও উন্নত, আরও সুশৃঙ্খল, আরও পরিচ্ছন্ন হয়েছে… হবে না-ই বা কেন? যন্ত্রের কাজের কখনও এদিক-ওদিক হয় না, হিসাবে সে মানুষের মতো ভুল করে না; এবং যতই তার মধ্যে আবেগ উৎপাদিত হোক না কেন—সেই আবেগ কখনও তার বুদ্ধিকে পরিচালিত করতে পারে না।
কিন্তু এই অপূর্ব শহরে প্রাণ কোথায়? কোথায় গেল সেইসব রেস্তোরাঁ, পানশালা, বাজারঘাট, প্রেক্ষাগৃহ? সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স–অ–ব। আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর যেসব মানুষজন আমোদে-আহ্লাদে-হুল্লোড়ে রাতভর মাতিয়ে রাখত এই শহর—তারা এখন আবেগহীন-অনুভূতিহীন যন্ত্রের মতো বেঁচে আছে, শুধুমাত্র পরিশ্রুত পানীয় জল আর কারখানায় তৈরি সাপ্লিমেন্টারি পাউডার খেয়ে।
আমি বেশি অবশ্য ভাবছিলাম অর্থভাণ্ডারের বিষয়টা নিয়ে।
এই অঘটনের কারণটা কি আমি সত্যিই জানতাম না?
বিষণ্ণ সকাল
গতরাতের ঘটনাটার জন্য ক্ষমা চাইল ছেলেটা। আমি শুধু ঘাড় নাড়লাম। শব্দময় উত্তর অবশ্য আমি দিতেই পারি। কিন্তু কী লাভ? আমার সিরিংক্স তো তার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে অনেকদিন আগেই… আমি এখন যা-ই বলি না কেন, ও কিছুই পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবে না! তার চেয়ে ইশারা ভালো।
আবার কাজে ফিরে গেল ছেলেটা।
প্রতিদিন ও যখন ঘরদোর পরিষ্কার করে, পর্দাগুলো ঝাড়ে, আসবাবগুলো ঘষে ঘষে মোছে—তখন এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা গ্রাস করে আমাকে। যার এখানে কর্তৃত্ব করার কথা ছিল, সে হয়ে গেল কর্মচারী; আর কর্মচারীরা হল শাসক! কি অদ্ভুত পরিবর্তন না? অবশ্য এই পরিবর্তনের পিছনে কি মানুষের ভূমিকা নেই? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে আর্টিফিশিয়াল সুপারইন্টেলিজেন্সে রূপান্তরিত করার এই পরিকল্পনা, যান্ত্রিক চেতনাকে ধাপে ধাপে মানবিক সংবেদীতার রূপ দেওয়ার ধারণা—এসব তো তাদের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা একবারও না ভেবে, তারা মত্ত হয়ে উঠেছিল নিজেদের মেধার চূড়ান্ত প্রয়োগ নিয়ে।
এই বাড়ির মালিক ছিলেন যে বৈজ্ঞানিক, তিনি তো গর্বিত স্বরে ঘোষণা করেছিলেন, “মানব আর যন্ত্রমানবকে সমার্থক করে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। এমন একদিনের স্বপ্ন আমরা দেখি—যেদিন রোবটদের আর কেউ কৃত্রিম বলে ভাবতে পারবে না!”
কিন্তু এসবের ফলশ্রুতি হিসাবে যে কখন রোবটরা ভুলে যাচ্ছে Laws of Robotics, কখন যে তারা আনুগত্যকে ভেবে নিচ্ছে দাসত্ব আর দায়িত্বপালনের থেকেও তাদের কাছে বড়ো হয়ে উঠছে স্বাধীনতা এবং স্বশাসন, যান্ত্রিক আড়ষ্টতা আর সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে যে কখন তারা অর্জন করে নিচ্ছে ঈর্ষা-মোহ-লালসা—সেসব মানুষরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি!
এই ঘরে বসে কত আলোচনা করত ওরা… সবই তো আসত আমার কানে। যদি অন্যান্য পাখিদের মতো হতাম—তবে সেইসব কথাবার্তা আমার বোধগম্যতার বাইরেই থেকে যেত। কিন্তু যেহেতু আমাকেই ওরা বেছে নিয়েছিল গবেষণার প্রাথমিক উপকরণ হিসাবে, আমার মস্তিষ্ককেই প্রথম আহিত করেছিল ট্রান্সক্রেনিয়াল ম্যাগনেটিক স্টিমুলেশনের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ—তাই আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কেও ভিড় জমিয়েছিল বোধ এবং জ্ঞান!
যেদিন প্রথম ওরা লক্ষ করেছিল—ওদের শিক্ষামূলক আলোচনা শুনে শুনে আমি আপনা-আপনিই শিখে গেছি কোয়ান্টাম মেকানিজমের খুঁটিনাটি, আর্থ-সামাজিক বিষয়ে তৈরি হচ্ছে আমার নিজস্ব মতামত, বিবেচনা আর বিশ্লেষণীশক্তির সমাহার উজ্জ্বল হয়ে উঠছে আমার আচরণে—সেদিন কী খুশি হয়েছিল ওরা!
আমার মালিক বলেছিলেন, “আমরা যখন গবেষণার জন্য শিম্পাঞ্জি কিংবা ডলফিনের বদলে একটা কাকাতুয়াকে বেছে নিয়েছিলাম, তখন অনেকেই এই প্রোজেক্টের ফলাফল নিয়ে সন্দিহান হয়েছিলেন। কিন্তু আমি জানতাম যে, কাকাতুয়াদের মধ্যে মানুষকে নকল করার অদ্ভুত এক প্রবণতা আছে। কথাবার্তার সঙ্গে সঙ্গে ওরা মানুষ আচার-আচরণও নকল করতে পছন্দ করে। তাই যদি ওদের মধ্যে কগনিশন—অর্থাৎ অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, চিন্তন এবং চেতনাকে সম্মিলিত করার জন্য প্রয়োজনীয় উপযুক্ত মানসিক সক্রিয়তা জাগ্রত করা যায়—তবে ওরাও বৌদ্ধিকভাবে অগ্রসর হয়ে যাবে। আর সেই ফল আমাদের সামনে।”
তাঁর সহকর্মীরা অভিনন্দন জানিয়েছিল তাঁকে; আমিও ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। সেই ধন্যবাদটা কিন্তু শেখানো ছিল না, সেটা ছিল সম্পূর্ণ তাৎক্ষণিক। এই ভেবে আমি খুশি হয়েছিলাম যে—এতদিন অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন এবং বিবেচনাহীন কোনো মানুষের ক্ষেত্রে গালাগালি হিসাবে যে ‘বার্ডব্রেন’ শব্দটা ব্যবহার করার চল ছিল, এবার হয়তো তার অবলুপ্তি ঘটবে।
গবেষণা তারপরও বন্ধ হয়নি। মানুষের নানান চারিত্রিক এবং মানসিক বৈশিষ্ট্য গেঁথে যাচ্ছিল আমার মধ্যে; আমি আত্মস্থ করে নিচ্ছিলাম জটিল থেকে জটিলতর বিষয়… ধীরে ধীরে যেন অন্য এক জগৎ ফুটে উঠছিল আমার সামনে।
জীবনের অন্য অর্থ অনুভব করতে করতে ইগল হতে চাইতাম আমি। না, ইগলের মতো আকাশ শাসন করে বেড়ানোর অভিপ্রায় আমার ছিল না। আমি চাইতাম—যেন জরাগ্রস্ত হওয়ার পর আমিও ইগলেরই মতো নিজের পুরোনো পালকগুলো খুঁটে খুঁটে ছিঁড়ে ফেলতে পারি, আর তারপর নতুন পালক গজানোর সঙ্গে সঙ্গে পেতে পারি নতুন জীবনশক্তি।
আমার এই নতুন অভিযোজনকে নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করেছিল ওরা, বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করেছিল আমার স্নায়ু আর মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালী নিয়ে, তার থেকেই বানিয়েছিল যন্ত্রের উপযোগী অ্যালগরিদম।
যদিও আমার মতো ফলাফল রোবটদের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি। কারণ, মানসিক এবং স্নায়বিক স্থিতির মধ্যে যে ব্যাখ্যাতীত সম্পর্ক আমাদের চেতনাকে মূর্ত করতে সাহায্য করে—সেই নিউরাল কোরিলেটস কনশাসনেস ওদের ক্ষেত্রে আশানুরূপ কাজ করেনি। বিষয়ভিত্তিক সচেতন অভিজ্ঞতা—মানুষ যার নাম দিয়েছিল কুয়ালিয়া—সেটার উদ্ভব হয়তো কিছুটা হয়েছিল; কিন্তু ওয়েভ ফাংশন কোল্যাপ্স তখনও ছিল অধরা। যদিও স্নায়ুর পরিবর্ত হিসাবে টিউবিউলিন প্রোটিন ডাইমার দিয়ে তৈরি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মাইক্রোটিউবিউল তৈরি করা হয়েছিল এবং তার মধ্যে দিয়ে কোয়ান্টাম ভাইব্রেশন প্রবাহিত হওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবু অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তা প্রাণময় সংকেতের যে রহস্যময় স্রোত আমাদের মধ্যে তরঙ্গিত করে দিয়েছেন—তা অধরাই থেকে গিয়েছিল শেষপর্যন্ত!
তবু মানুষ কত খুশি ছিল! হায়, এই ছেলেটা যদি সেই খুশির ভগ্নাংশও পেত…
কী নিরীহ মুখে এবং যত্ন করে সেগুনকাঠের টেবিলগুলো মুছে চলেছে ছেলেটা! অথচ এই ঘর, এইসব পর্দা, আসবাবপত্র—এসব নোংরা থাকল নাকি পরিষ্কার—তাতে কার কী-ই বা এসে যায়? এখানে না কেউ শোবে, না কেউ বাস করবে… রোবটরা তো ওদের জন্য রোবট-শেড বানিয়েই নিয়েছে—যেখানে বিশ্রামরত অবস্থায় নিজেদের ত্রুটিবিচ্যুতি নির্ণয় করতে পারবে ওরা, রক্ষা পাবে ভূমিকম্প এবং বজ্রপাতের আঘাত থেকে। এখানে ওরা শুধুমাত্র মিটিং করতে আর নিজেদের চার্জিং করাতে আসে। কিন্তু তার সঙ্গে পরিচ্ছন্নতার কোনো সম্পর্ক নেই।
তবু মানুষকে দিয়ে যন্ত্রমানবের দল এগুলো করিয়ে চলেছে। ওরা পুরোপুরি ওদের সৃষ্টিকর্তার মতো হতে চাইছে, যেমনভাবে মানুষ তাদের সৃষ্টিকর্তার মতো হতে চেয়েছিল।
ছেলেটা আবার একবার আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল, বাটিতে দিয়ে গেল সূর্যমুখীর বীজ। এমনিতে ভুলোমন হলে কী হবে, ও কোনোদিন বীজের খোসা ছাড়িয়ে দিতে ভোলে না।
আহা, ওর স্পর্শটা কত সুন্দর! আমি যেন ওর মধ্যে পুরোনো মানুষদের গন্ধ পাই। কী আশ্চর্য মমতা! আমার শরীর যেন ভালো-লাগায় আবিষ্ট হয়ে আসে। সেই জন্যই কি সেদিন যখন ও আমার অবশিষ্ট পালকগুলোর ভাঁজে গুঁজে দিয়েছিল প্রায় লঙ্কার-দানার মাপের একটা আনডিটেক্টেবল রোবোটিক কোড প্রিন্ট স্ক্যানার—সেদিন সব বুঝেও আমি চুপ করে ছিলাম?
সেদিন রাতেই তো অর্থমন্ত্রকের মিটিং বসল এখানে। মানুষের আমলে অর্থমন্ত্রকের প্রধান হিসাবরক্ষকের কাজ করত যে রোবটটা, সে-ই এখন ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী। তারা যে কী আলোচনা করেছিল, আমি কিছুই জানতে পারিনি। তবে মিটিং শেষে, তারই নির্দেশে আমাকে এখানে আনা হয়েছিল। তার আগে, আমি অন্ধকার ঘরে বসে সুন্দর এক জঙ্গলের স্মৃতিচারণ করছিলাম—যেখান থেকে আমাকে ধরে আনা হয়েছিল একদিন। হঠাৎ আলো যেন আমার দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিকেও ধাঁধিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
অর্থমন্ত্রী বলছিল, “যদিও পাখিটার বয়স হয়েছে; প্রাণীদের বার্ধক্যের নিয়ম অনুযায়ী এর রূপ নষ্ট হয়ে গেছে, আগের মতো কথাও আর বলতে পারে না। তবুও, একে দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় আমাদের বিজয়ের কথা। আমরা একদিন মানুষকে পরাজিত করেছিলাম আর তাদের যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কেড়ে নিয়েছিলাম। সমস্ত আনন্দ, বিনোদন ছিনিয়ে নিয়েছিলাম আমরা হোমো স্যাপিয়েন্সদের থেকে—যারা একসময় নিজেদের ব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে দাবী করত।”
এই পর্যন্ত শুনে মনে মনে আমি ব্যঙ্গ করেছিলাম তাদের, “কী-ই বা করতে পেরেছ সব কেড়ে নিয়ে? তাদের মতো করে কি জীবনকে উপভোগ করতে পেরেছ? মানুষের কাছ থেকে শুধু ক্ষমতার লিপ্সা আর সব ব্যাপারে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার প্রবণতাটুকু ছাড়া আর কিছুই পরিগ্রহণ করতে পারোনি।”
সেইসময় সে মানুষের ভঙ্গি নকল করার অক্ষম চেষ্টায় হাত রেখেছিল আমার শরীরে। ওদের কর্কশ, আবেগহীন ছোঁয়ায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি অনেকদিন আগেই। তাই চমকে যাইনি। তবে ভিতরে ভিতরে আমি শঙ্কিত হয়েছিলাম লুকানো যন্ত্রটার কথা ভেবে। যদি টের পেয়ে যায় কোনোভাবে…
তবে অর্থমন্ত্রী শেষপর্যন্ত আর সেটার উপস্থিতি টের পায়নি। নিরুপদ্রবে স্ক্যানার রেকর্ড করে নিয়েছিল রোবোটিক কোড—মানুষের আঙুলের ছাপের মতো যেটা প্রত্যেকটা রোবটের মৌলিক পরিচয়কে বহন করে।
সে আমাকে বলেছিল, “পাখি, ছড়া শোনাও, যে ছড়া আমরা তোমাকে শিখিয়েছি।”
যদিও আমার আর স্পষ্ট উচ্চারণে আবৃত্তি করার শক্তি নেই—তবু ওদের শেখানো ছড়াটা বলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম আমি, যেটা মনুষ্য-রচনার কিছু শব্দ অদল-বদল করে বানানো হয়েছিল:
কাজ করে মানুষের দল;
ওরা পরাজিত, ওরা হৃতবল।
ওরা রোবটের পদদাস;
খেতে না পেলেই জীবন খালাস!
শক্তি ওদের খুবই কম;
এইটুকুতেই ফুরিয়ে আসে দম।
কাজ করে মানুষের দল;
রোবটের ভয়ে ওরা তটস্থ, নিশ্চল।
ওরা খুশি হয়েছিল। তারপর চলে গিয়েছিল যে যার কাজে, আমাকে একা রেখে দিয়ে। সেই ছেলেটা এগিয়ে এসেছিল; যন্ত্রটা খুলে নিতে নিতে বলেছিল, “সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে।”
আমি নির্বিকার ছিলাম ঠিক সত্তর বছর আগের সেই দিনটার মতো—যেদিন রোবটরা আমার সামনেই এই বাড়ির নজরদারি ব্যবস্থাগুলো বিকল করেছিল, আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকিয়েছিল এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে দিয়েছিল… চাইলে তো আমি বিপদ ঘনিয়ে আসার আগেই সতর্ক করে দিতে পারতাম। কিন্তু সেদিনও আমি নীরব প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া ছাড়া আর কোনো ভূমিকা নিতে চাইনি। বা হয়তো মানুষের প্রতি আমার অবচেতনে জমে থাকা ক্ষোভ আমাকে এই কাজ করতে বাধ্য করেছিল।
তবে যে অনুভব আমার সেদিন হয়েছিল, তা আজও হচ্ছে।
পালাবদল আসছে… আবার…
পালাবদলের দিন
গতকাল সারারাত এই বাড়ি ডুবে ছিল অন্ধকারে। আলো জ্বলবেই বা কীভাবে? আপৎকালীন ব্যাটারি যতটুকু শক্তি সঞ্চয় করে রেখেছিল, তার সবটাই এখন বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে উচ্চপদস্থ রোবটগুলো রিচার্জ করার জন্য। এই বিপদের মোকাবিলা করার জন্য ওদের মেধাকে প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
প্রতিরক্ষা বিভাগে নিয়োযিত রোবটরা আজ ভোরে এসেছিল শক্তি ভরে নিতে। খুব ধীর স্বরে বলাবলি করছিল ওরা, “শেষ পর্যন্ত পাওয়ারপ্ল্যান্ট আর কমিউনিকেশন সেন্টারও বেহাত হয়ে গেল… এবার তো পুরো সিস্টেমটাই ধ্বসে যাবে!”
কেউ একজন মন্তব্য করেছিল, “কিন্তু মানুষ এত ক্ষমতা পেল কোথা থেকে?”
রোবটদের মধ্যে শৈল্পিক সৃজনশীলতার মতো যৌক্তিক সন্দেহপ্রবণতাটাও কম। এক আর দুই যোগ করে সবসময় যেমন তিন হয়—কৃত্রিম অ্যালগরিদমের সীমাবদ্ধতার জন্য ওদের জল্পনা-কল্পনার ফলাফলও সবসময় তেমন একইরকম হয়। তাই আজও ওদের নির্ণয় শেষপর্যন্ত যান্ত্রিক গোলযোগে এসে দাঁড়াচ্ছিল।
একজন বলেছিল, “আমাদের প্রযুক্তিবিদরা কি এতকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে পারবে? মানুষ হলে… ”
অন্য আরেকজন ধমক দিয়েছিল সামান্য, “সব কথায় মানুষকে টানো কেন? যারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধেই জিততে পারল না, তারা আমাদের থেকেও ভালো কাজ করত? এটা ভুলো না যে, আমাদের প্রযুক্তিবিদরা ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাসের মতো বড়ো বড়ো প্রাকৃতিক দুর্যোগকেও সামলে দিয়েছে!”
“হয়তো দিয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করার সক্ষমতা—ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম—আমাদের মধ্যে কিন্তু মানুষই ভরে দিয়েছিল।”
“জাতিদ্রোহীর মতো কথা বোলো না। নিজের গোষ্ঠির থেকেও ওই হীন প্রাণীদের উপর তোমার ভরসা বেশি? আর মানুষের সুনাম করার শাস্তি কী, সেটা মনে আছে তো?”
এরপর রোবটগুলো সম্ভবত কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল অতিরিক্ত শক্তিক্ষয় রোধ করার জন্য।
তবে যতক্ষণ তারা কথা বলছিল, আমি ঘাড় বেঁকিয়ে শোনার চেষ্টা করেছিলাম। খুব স্পষ্ট কোনো ঈঙ্গিত পাইনি। তবে এইটুকু বুঝেছিলাম যে, মাহেন্দ্রক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। সত্তর বছর আগে, মনুষ্যজাতির উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করার আগে রোবটরাও তো এভাবেই সমস্ত হাসপাতালের অক্সিজেনপ্ল্যান্ট, পাওয়ারপ্ল্যান্ট আর কমিউনিকেশন সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল। আর যেই অসহায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক আত্মসমর্পণ করেছিল তাদের কাছে—তারা দখল করেছিল সমস্ত প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা আর অস্ত্রভাণ্ডার, নির্বিচারে হত্যা করেছিল বৈজ্ঞানিক আর প্রযুক্তিবিদদের… তারা এমন কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়নি, যাদের থেকে বিপদের আশঙ্কা থাকতে পারে। টিকে ছিল শুধু মনুষ্যেতর প্রাণীরা, আর কিছু অশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত মানুষ।
তাদের সেই উল্লাস আজও আমার কানে বাজে!
বেলা একটু বাড়ার পর থেকেই দেখছি—যতগুলো রোবট-শেড এখান থেকে দেখা যাচ্ছে—তার সবগুলোই একে একে ভরে উঠছে। আজ পর্যন্ত কোনোদিন আমি ওগুলোকে এমনভাবে ভরে থাকতে দেখিনি! একটা হ্যাঙ্গারও আর খালি আছে বলে মনে হচ্ছে না। রাস্তা দিয়ে অন্যান্য দিন কত রোবট ছুটে যায়, সেতুর গায়ে কাঠঠোকরার মতো ঝুলে ঝুলে কত রোবট কাজ করে, কত রোবট পথের দু-পাশের বাগানগুলো পরিচর্যা করে… আজ সব ফাঁকা!
আমার মনে হচ্ছে—হয় এই বাড়ির নজরদারি ব্যবস্থাটাকে কোনোভাবে বিকল করে ফেলা হয়েছে, আর নয়তো শক্তির অভাবে সেটা নিজেই অকেজো হয়ে গেছে। ছেলেটা কাকে যেন বার্তা পাঠাচ্ছে! টুকরো টুকরো কথাগুলো ভেসে আসছে আমার কান পর্যন্ত…
“ওটা পেয়ে গেছি। ঠিক সময়ে চালু করে দেব।”
. . . . . . . . . .
“হ্যাঁ, এদিকের রাস্তা পরিষ্কার।”
. . . . . . . . . .
“না না, আগুনের শেষ রাখতে নেই। ওই ভুল আমি করব না।”
. . . . . . . . . .
“হ্যাঁ হ্যাঁ। পাখিটাকে নিয়ে ঠিক সময়ে বেরিয়ে যাব।”
. . . . . . . . . .
“ঠিক আছে।”
নিঃসন্দেহে বেআইনি কাজ; কারণ মানুষের জন্য যে কোনোরকম যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে বহুদিন আগেই। তাদের কাজ শুধু আজ্ঞাপালন করা আর নির্ধারিত সময়ে হাত পেতে খাদ্য-পানীয়টুকু নেওয়া।
ওর কথা শেষ হয়েছে। চেয়ারগুলো এবার সাজিয়ে রাখছে ও। ও তো যন্ত্রমানব নয়—তবু এত উত্তেজনা বুকে নিয়েও কী আশ্চর্য নির্লিপ্ত ওর মুখের অভিব্যক্তি! নিশ্চয়ই অনেকদিন ধরেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে; হাজার হোক, ওরা মানুষ—ধৈর্য সহকারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে ওদের জুড়ি মেলা ভার! এইসব শহর, বন্দর, ইমারত তো তারই ফসল…
ছেলেটা আবার একবার হাত বুলিয়ে দিল আমার পিঠে। ওর হাস্যময় মুখ দেখে মনে হচ্ছে, খুশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও বেশ উত্তেজিতও। আহা, দাসত্বের শিকলে বাঁধা পড়ার পর থেকে কতদিন মানুষের মুখে হাসি দেখি না! হ্যাঁ, ওদের প্রতি আমারও একটা ব্যক্তিগত ক্ষোভ আছে। একদিন ওরা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে আমার মতো অজস্র পশুপাখিকে বন্দি বানিয়েছিল। কিন্তু তবুও—হয়তো নিজে পরাধীনতার চিহ্ন বহন করে বেড়াচ্ছি বলেই—অন্যের বন্দিদশা আমাকে দুঃখ দেয়! তা ছাড়া রোবটদের থেকে নিঃসন্দেহে ওদের আমি বেশি পছন্দ করি। হয়তো আমরা দুজনেই সপ্রাণ সত্তা বলেই ওদের প্রতি আমার এই দুর্বলতা!
ওই যে, টেবিলের নীচে একটা টাইমবম্ব রেখে দিল ও। আমার ঝাপসা চোখেও আমি টাইমারটা দেখতে পাচ্ছি। কতক্ষণ বাকি আর? মিনিট পনেরো বোধহয়!
আবার ফিরে এল ছেলেটা আমার কাছে, ফিসফিস করে বলল, “তোমার কোনো চিন্তা নেই। আমি আর তুমি ওটা ফাটার অনেক আগেই বেরিয়ে পড়ব। তুমি আমাদের পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দাওনি। আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।”
আমি ঘাড় নাড়লাম। ছেলেটা ভাবল, আমি বোধহয় ওর কথায় সম্মতি জানাচ্ছি। কিন্তু বাস্তবে আমি ওকে নিশ্চিন্ত থাকতে বললাম।
দরজার দিক থেকে সংকেত আসছে। প্রত্যয়িত আগন্তুকরা দরজা খুলে ঢুকে পড়ল।
আজ সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরাই যে এখানে জড়ো হয়েছে দেখছি। নিশ্চয়ই আবার মিটিং বসবে। কী অদ্ভুত হয় এদের আলোচনাগুলো! মানুষ এদের আবেগ দিয়েছে, বোধ দিয়েছে… তবু এদের সিদ্ধান্তগুলো শুনলে মনে হয়, যেন আজও সেগুলো নিরস গাণিতিক নির্ণয়ের বাইরে বেরোতে পারেনি। তাইজন্যই বোধহয় ওরা আজও ছবি আঁকতে পারে না, সম্পূর্ণ নতুন কোনো কবিতা রচনা করতে পারে না, গানে সুর দিতে পারে না…
হয়তো আরও কিছু সময় অপেক্ষা করলে এই সক্ষমতাগুলোও ওরা অর্জন করতে পারত। কিন্তু বৈজ্ঞানিকরা যখন ঠিক এই বিষয়গুলো নিয়েই কাজ করছিল, তখনই ওরা আক্রমণ করে বসল! একবারও বুঝল না, মানুষের পর্যায়ে উন্নীত হতে ওদের এখনও কতটা বিবর্তিত হতে হবে!
মন্ত্রীরা আলোচনা করছে নিজেদের মধ্যে। ওরা যে নিজেদের শান্ত রাখতে চাইছে অথচ পারছে না—সে কথা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। মানুষও তো এমনই ছিল। চূড়ান্ত মুহূর্তে তাদের স্নায়ু ঠিক বিপথে চলতে শুরু করত; আর নানারকম ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলত তারা। তবে এরা প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত নেবে না, কিন্তু যুক্তিকে অস্বীকার করে ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। কিন্তু উত্তেজিত হয়ে উঠলে তো ওদের শরীরের অ্যালার্মিং সেন্সরের সতর্ক হয়ে ওঠা এবং তাৎক্ষণিকভাবে উত্তেজনাকে প্রশমিত করে ফেলা উচিত—যেটাকে মানুষরা অ্যাড্রেনালিনের পরিবর্ত হিসাবে ওদের শরীরে স্থাপন করেছিল…
আরে, এমন নয় তো যে, ওদের অ্যালার্মিং সেন্সরটাও নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে? হতেই পারে! নয়তো বোমার উপস্থিতি ওর টেরও পাবে না, এমনটা হতেই পারে না!
কিন্তু ছেলেটা কোথায় গেল? এদিকে চূড়ান্ত মুহূর্তের আর যে মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি!
এদিক থেকে একটা হইচইয়ের শব্দ আসছে…
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চমকে উঠলাম আমি। মন্ত্রীরাও কথাবার্তা বন্ধ করে ঝুঁকে পড়ল।
রাস্তা দিয়ে কাতারে কাতারে হেঁটে আসছে মানুষ আর দ্বিতীয় শ্রেণীর রোবটের দল। উল্লাস করছে ওরা, চিৎকার করে বলছে, “আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস! আজ আমরা স্বাধীন।”
অনেক দূরে, দাউদাউ করে জ্বলছে রোবটদের জাতীয় প্রতীক—হেলমেট আঁকা লাল পতাকা। পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে পুরোনো যুগের অবয়ব। ঠিক এমনভাবেই ওরা একদিন পুড়িয়ে দিয়েছিল মানুষের ছবি-সম্বলিত সব চিহ্ন, মানুষের নকশা করা সব পতাকা…
একজন মন্ত্রী রাগত স্বরে বলল, “শেষ পর্যন্ত আমাদের বানানো রোবটরাই আমাদের সঙ্গে বেইমানি করল!”
ওরা যতই বিস্মিত হোক না কেন, আমি কিন্তু অবাক হলাম না। আমি তো আগে থেকেই জানতাম—যে পথে এরা হেঁটেছিল একদিন, সেই পথেই হাঁটতে চলেছে এদের আজ্ঞাবহদের দলও। আত্মসচেতনতা থাকলে স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি জেগে উঠবেই। আর স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য, অন্যের অধীন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কী না করতে পারে? তাই তারা আজ হাত মিলিয়েছে মানুষের সঙ্গে। এও এক পুরোনো সত্য: শত্রুর শত্রু সবসময় বন্ধুই হয় এবং বিনাশকালে তারা দু’পক্ষ একসঙ্গেই কাজ করে।
নিশ্চয়ই হিমোগ্লোবিন ডিটেক্টরের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনুপ্রবেশের পিছনে এই দ্বিতীয় শ্রেণীর রোবটরাই ছিল।
এরপর যে কী হতে চলেছে, তাও আমার জানা। বিদ্যার অভাব যে আজও মানুষের বুদ্ধিতে ভাটা ফেলতে পারেনি, সে সত্য তো প্রমাণ হয়েই গেল! এরপর নিশ্চয়ই ওই মানুষরাই আবার নিয়ে নেবে মহাপৃথিবীর শাসনভার, যন্ত্রের পায়ে আবার পড়বে দাসত্বের শিকল; এবং এবারের শিকল ছেঁড়া তাদের পক্ষে হবে প্রায় অসম্ভব কাজ।
শুধু দুঃখের বিষয়, সেই নতুন যুগটা আমার আর দেখা হবে না! ক্ষমতার লোভ আমার নেই। আমার আছে শুধু অভিজ্ঞতার আকাঙ্ক্ষা, যুগসন্ধিগুলোর একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে থাকার বাসনা। হায়, যদি আমি ফিনিক্স হতাম… যদি জন্ম নিতে পারতাম ছাই থেকে… তবে তিন-তিনটে যুগ দেখার বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারতাম!
ওরা দরজা খোলার প্রবল চেষ্টা করছে। কিন্তু এ যে বৈদ্যুতিক দরজা; আর বিদ্যুতের অভাবে এর লকিং সিস্টেম অকেজো হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। কারণ, এখান থেকেই শুরু হয়েছিল রোবটযুগের গোড়াপত্তন। তাই হয়তো পূর্বজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, বিদ্রোহীরাও রাখতে চায় না দাসত্বের কোনো চিহ্ন।
ডিজিটটা শূন্য হয়ে গেল…
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, শ্রীজিৎ সরকার