নীল কমলের খোঁজে
লেখক: সুমন মিশ্র
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
এক
টিকলিদের গ্রামটা খুবই নিরিবিলি। পাহাড়ের গায়ে প্রকৃতির স্পর্শ মাখা একটা ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের নামটাও সুন্দর,নীল পোখরি। চারপাশে ঘন পাইনের বন। তার মাঝে মেঘের দল আনমনে খেলা করে বেড়ায়। আর ঢাল বেয়ে একটু নীচে নামলেই শুরু হয় চোখ জুড়ানো সান্যাল টি এস্টেট। সারা পাহাড়ের গায়ে শালের মতো জড়ানো মনোরম সবুজ চা বাগান।
টিকলির পরিবার বলতে সে ও তার ঠাম্মা। টিকলির বাবা-মা নেই। বছর সাতেক আগে, বর্ষাকালে নিউ জলপাইগুড়িতে যাওয়ার সময় যে বাসটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তিস্তায় পড়ে গিয়েছিল, তার মধ্যে গ্রামের আরও পাঁচজনের সঙ্গে নিখোঁজের তালিকায় টিকলির মা-বাবাও ছিল। টিকলির বয়েস তখন মাত্র তিন বছর। মা-বাবার কোনো কথাই তার আর মনে পড়ে না। এখন তার সমস্ত পৃথিবীটা শুধুই তার ঠাম্মাকে ঘিরে।
টিকলিদের বাড়িটা খুবই ছিমছাম। পাহাড়ের ঢালে কাঠের তৈরি ছোট্ট বাড়ি। দু-তিনটে ঘর। একটায় টিকলি আর তার ঠাম্মা থাকে। বাকি দুটো ঘর হোমস্টে হিসাবে ভাড়া দেওয়া হয়। আজকাল এসবের চল হয়েছে। পর্যটকরা কালিংপং, দার্জিলিংএর ভিড় এড়িয়ে শান্তিতে দু-দিন কাটানোর জন্য অচেনা, স্বল্প পরিচিত পাহাড়ি গ্রামে ঘুরতে আসে। টাইগার হিলের ভিড় এড়িয়ে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে সূর্যদয়ের আগুন রঙের খেলা দেখতে চায়। কিন্তু পাহাড়ি গ্রামে ঘুরতে এলেই তো হল না,পাহাড়ি গ্রামের জীবন যে বড়োই কঠিন। পর্যটকরা কি আর অত কষ্ট করে থাকতে পারেন। তাই স্থানীয় প্রশাসন থেকে গ্রামের মানুষদের আর্থিক এবং পরিকাঠামোগত সাহায্য প্রদান করা হয় যাতে তারা হোমস্টে তৈরি করতে পারে। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়ে এই ব্যাপারে।
টিকলিদের গ্রামে লোকসংখ্যা খুব বেশি নয়। বড়োজোর খান কুড়ি পরিবারের বাস। ভালো স্কুল, কলেজ বা হাসপাতাল কিছুই নেই। এসবের জন্যে দুই ঘণ্টা গাড়িতে করে দার্জিলিং যেতে হয়। গ্রামে ছোটো একটা স্কুল আছে বটে, টিকলি সেখানেই পড়ে।
এখানকার বেশির ভাগ মানুষেরই জীবিকা ছিল চা বাগানে শ্রমিকের কাজ। কিন্তু বছর তিনেক আগে মামলা মোকদ্দমায় জেরবার হয়ে কর্তৃপক্ষ চা বাগান বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তারপর থেকে হোমস্টে ব্যাবসাই একমাত্র ভরসা। যা উপার্জন হয় তাতে টিকলিদের মোটামুটি চলে যায়।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর টিকলি জানলার পাশে শুয়ে ছিল। বাড়ির মধ্যে এই জায়গাটাই তার সবচেয়ে প্রিয়। জানলার নীচে পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে পাকা রাস্তা অবধি। ঢালের গায়ে আছে ফুলের বাগান, এলাচ আর শাকসবজির খেত। এসব তার ঠাম্মার হাতেই তৈরি। টিকলিও সাহায্য করে সাধ্যমতো। অনেক নীচে পাহাড়ের পাদদেশে, যেখানে দৃশ্যপট ধুসর হয়ে যায় সেখানে পান্না রঙের তিস্তার জল রেখা দৃশ্যমান হয়। আজ আকাশে মেঘ প্রায় নেই বললেই চলে। সুনীল আকাশের বুকে দু-একটা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। চারপাশটা রোদে ঝলমল করছে। উত্তরে বহুদূরে ভুটানের শুভ্র পর্বতশ্রেণী মেঘ পরিবৃত হয়ে ধুসরভাবে দৃশ্যমান।
টিকলির মাথার কাছে ঠাম্মা বসে ছিল। ঠাম্মার কাছ থেকে গল্প না শুনলে টিকলির ঘুম আসে না। ঠাম্মা কত রকমের গল্প শোনাতে পারে। চিতাবাঘের গল্প, পুরোনো বৌদ্ধ মঠের গল্প, পাইনবনের দৈত্যদের গল্প।
“আমাদের গ্রামের নাম নীল পোখরি কেন হল সেটা জান দিদিভাই?” ঠাম্মা টিকলির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞাসা করল।
টিকলি মাথা নাড়ল। সে ছোটোবেলা থেকে নামটা শুনে আসছে, কিন্তু তার মনে কোনোদিন প্রশ্ন জাগেনি এই নিয়ে।
ঠাম্মা হেসে বলল, “সে অনেকদিন আগের কথা দিদিভাই, এই গ্রামে তখন বড়ো জোর পাঁচ-ছয়টি পরিবার থাকত, চা বাগানও তৈরি হয়নি। চারপাশে ঘন জঙ্গল। তার মাঝে মেঘের আনাগোনা। দিনের বেলায়ও একা পথ চলা যেত না। সবসময় একটা গা ছমছমে পরিবেশ। সদর বাজার যেতে হলে পুরো একদিনের পথ চলতে হত। সন্ধের আগেই যে যার ঘরে ঢুকে পড়ত, রাতের বেলা বাইরে বেরত না। অন্ধকার নামলেই হিংস্র পশুদের আনাগোনা শুরু হয়ে যেত।
সেইদিনটায় সকালবেলা থেকেই নীচের উপত্যকার মেঘ ভেসে এসে চারপাশটাকে ঢেকে দিয়েছিল। দিনের শেষে সন্ধেও নামল ঝুপ করে। চারপাশে কেমন আবছায়া। কিন্তু সন্ধের পরপরই মেঘ সরে গেল। পূর্ণিমার রাত, আকাশে হাজার হাজার তারা চিকমিক করছে। চারপাশটা জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে। যদিও তা উপভোগ করার জন্যে কেউ ঘরের বাইরে ছিল না। যা চিতাবাঘের উৎপাত।
গ্রামের সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে,এমন সময় চারপাশে কেমন গুড়গুড় শব্দ শুরু হল। প্রথমে মৃদু, তারপর ক্রমশ তার তীব্রতা বৃদ্ধি পেল। একটা সময়ে শব্দটা এতটাই বেড়ে গেল যে সবাই ভয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পরল। তারপর যা দেখা গেল সে ভাষায় বলা সম্ভব নয় দিদিভাই!”
“কেন? কী হয়েছিল?” টিকলি চোখ বড়ো করে জিজ্ঞাসা করল।
“সবাই আতঙ্কিত হয়ে দেখল আকাশের রং কেমন পালটে গেছে। আকাশ জুড়ে এক নীল রঙের খেলা। সেই আলোয় জ্যোৎস্নার আলো চাপা পড়ে চারপাশটা এত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে যে রাত্রি না দিন বোঝা দায়। আর সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার আকাশ থেকে একটা প্রকাণ্ড নীলচে আগুনের গোলা নীচে নেমে আসছে। আগে সেটা দূরে ছিল, যত কাছে আসতে থাকল তত তার তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল সকলের। তারপর ক্রমশ আরও কাছে এসে সেটা আছড়ে পড়ল আমাদের এই পাহাড়ের চূড়ায়। গোটা পাহাড়টা থরথর করে কেঁপে উঠল। একটা ধুলোর ঝড় যেন নেমে এল পাহাড়ের গা বেয়ে। সঙ্গে বড়ো বড়ো পাথর গড়িয়ে নেমে এল উপর থেকে। অগুনতি পাইন গাছ মরমর শব্দে ভেঙে পড়ল। ধসও নামল। সেই ধসে গ্রামের দুটো বাড়ি ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। সে রাতে ভয়ে পেয়ে সবাই সেই যে বাড়ির ভিতর ঢুকল, পরের দিন দুপুরের আগে কেউ সাহস করে বেরতে পারল না। ঘটনার রেশ কাটতে, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করে, ভাঙা ঘরবাড়ি মেরামত করতে আরও দুইদিন কেটে গেল। তারপর গ্রামের প্রধান তাশি গুরুং-এর নেতৃত্বে পাঁচজনের একটা দল গেল ঘটনাটা সরজমিনে খতিয়ে দেখতে। তাশির সঙ্গে গিয়েছিল তার ছেলে ভীমা। গায়ে তার খুব জোর ছিল। তবে একবার চিতাবাঘের আক্রমণে তার ডান পায়ে খুব চোট লেগেছিল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত সবসময়।
“তখনকার দিনে জঙ্গল আরও ঘন ছিল। গ্রাম থেকে পাহাড়ের চুড়োয় যাওয়ার পথ প্রায় একদিনের দূরত্ব। কিন্তু দশদিন কেটে গেল। কেউ ফিরে এল না। শেষে দ্বাদশদিনে ভীমা ফিরে এল।”
টিকলি ঝপ করে উঠে বসল,তারপর অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, “শুধু ভীমা ফিরল? তাশি গুরুং আর তার দল?”
ঠাম্মা গম্ভীর গলায় বললেন, “না দিদিভাই, শুধু সেই ফিরল, আর কেউ নয়। অবাক কাণ্ড, তার পায়ের সমস্যা যেন কোন মন্ত্রবলে সেরে গেছিল। কিন্তু তার বয়েস যেন এক ধাক্কায় বিশ বছর বেড়ে গেছে। মাথা ভরতি তার কাঁচাপাকা উসকোখুসকো চুল। উদ্ভ্রান্তের মতো চাহনি। কথাবার্তাও কেমন এলোমেলো। মাঝে মাঝে খালি হাসছে, আবার মাঝে মাঝে পাহাড়ের চুড়োর দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কেঁদে ফেলছে। এভাবেই বহুদিন কেটে গেল। ভীমা সারাক্ষণই এলোমেলো কথা বলে চলত। মাঝে মাঝে অবশ্য তার হুঁশ ফিরত। তখন আনমনে টুকরো টুকরো কথা বলত। বলত—মস্ত হ্রদ, নীল জল, তার মাঝে সারি সারি নীল কমল। নীল কমল হাতে নিয়ে যা চাইবে তাই পাবে। বাবার লোভ ছিল তাই মায়ায় বাঁধা পড়েছে। বাকিরাও তাই। আমি মায়ায় ভুলিনি, সাঁতরে গিয়ে নীলপদ্ম তুলে এনেছিলাম। নীল কমল আমার ইচ্ছে পূর্ণ করল। কিন্তু ওই হ্রদের নীলচে জল গায়ে লাগতেই হুহু করে বয়েস বেড়ে গেল।খবরদার ওদিকে যেও না, মায়ায় বাঁধা পরবে।
“এটুকু বলেই সে আবার উন্মাদের মতো হাসত। গ্রামের লোকেদের মুখে মুখে কল্পকথা ছড়িয়ে পড়ল যে পাহাড়ের উপরে মায়া ঝিল আছে, তাতে নীল কমল ফুটে থাকে। লোকে বলে শাপভ্রষ্ট কোনো এক দেবদূত নাকি সেইদিন নেমে এসেছিল স্বর্গ থেকে। সেই নাকি এই মায়া ঝিলের সৃষ্টি করেছে। ভয়ে কেউ সে পানে যেতে চাইত না। মাঝে মাঝে কেউ কেউ সাহস দেখিয়ে চলে গেলেও ফিরে আসত না। একবার এক সাহেব সেখানে গিয়েছিলেন। লোককথা বলে তিনি নাকি ফিরেও এসেছিলেন। নীল ঝিলকে ভয় পেলেও তার নাম থেকেই এই গায়ের নাম হয়ে গিয়েছিল নীল পোখরি।”
টিকলির নীল কমলের হ্রদ সম্পর্কে,সেই সাহেবের সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানার ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু ততক্ষণে দু-চোখের পাতা ঘুমে ভারি হয়ে এসেছিল। চোখ খুলে রাখতে পারছিল না আর। সে ঠাম্মার কোলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল।
দুই
ঘটনাটা ঘটল দুই মাস পরে। সেইদিন সকালবেলা টিকলি স্কুলে গিয়েছিল। এই সময়টায় ঠাম্মা বাড়ির কাজ যতটা পারে এগিয়ে রাখে। হোমস্টেতে কোনো অতিথি সেই সময় ছিলেন না, তাই কাজকর্মের চাপও কম ছিল। নয়তো টিকলি মাঝে মাঝে ঠাম্মাকে সাহায্য করার জন্য স্কুলে না গিয়ে বাড়িতেই থাকে। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রজাপতিদের পিছনে ছুটে, পাহাড়ি সারমেয়দের সঙ্গে খেলা করে টিকলি যখন বাড়ি ফিরল তখন সূর্য প্রায় মাথার উপর চলে এসেছে। বাড়িতে ঢুকেই টিকলি থতমত খেয়ে গেল। ঠাম্মা বাগানের পাশে সিঁড়ির উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। টিকলি কত করে ডাকল কিন্তু কোনো সাড়াই পেল না। সে ছোটোখাটো মানুষ, ঠাম্মাকে নিয়ে গিয়ে ঘরে যে শুইয়ে দেবে তারও উপায় নেই। কী করবে ভেবে না পেয়ে সে দুই পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে শুরু করল।
অভিরাজ তামাং-এর বাড়ি টিকলিদের বাড়ির লাগোয়া। টিকলি তাকে মামা বলে ডাকে। আগে টি-এস্টেটের বাঙালি ডাক্তারবাবুর কম্পাউন্ডার ছিল সে। নিজেও টুকটাক চিকিৎসা করতে পারে। চা-বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গ্রামের মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসা করে আর গ্রামের সানরাইজ পয়েন্টের পাশে ছোটো একটা খাবারের দোকান চালিয়ে তার চলে যায়। অভিরাজ তামাং বাড়িতে ছিল না, কিন্তু তার স্ত্রী মিনা বাড়িতেই রান্না করছিল। কান্নাকাটির শব্দ পেয়ে সে ছুটে এল টিকলিদের বাড়িতে। তার চিৎকারে আরও কয়েকজন জড়ো হল। ধরাধরি করে টিকলির ঠাম্মাকে ঘরে নিয়ে গেল সবাই। মুখে চোখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হল। টিকলির ঠাম্মার জ্ঞান ফিরল বটে, কিন্তু কোন কথাই তিনি বলতে পারলেন না। মুখ দিয়ে একটা চাপা গোঙানির শব্দ বেরচ্ছে, দৃষ্টিও কেমন ঘোলাটে। অন্যদের তো বটেই টিকলিকেও সেইভাবে চিনতে পারছেন না। শুধু চোখ থেকে জল ঝরছে আর তা মুখের অজস্র বলিরেখার শাখা প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়ছে। এইসব দেখে টিকলি আরও কাঁদতে শুরু করল। খবর পেয়ে অভিরাজও ছুটে এসেছে ততক্ষণে। সে পরীক্ষা করে ওষুধ দিল বটে, তবে সঙ্গে এও বলল যে ভালো একজন ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। বেশ কিছু টেস্ট না করালে বোঝা যাবে না কী সমস্যা হয়েছে, কী চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু সেই সবের জন্যে তো দার্জিলিঙয়ে নিয়ে যেতে হবে।
গ্রামের মোড়ল নাগেশ গুরুং বেশি দেরি করতে চাইল না। নিজের গাড়িতে অভিরাজ, টিকলি আর টিকলির ঠাম্মাকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল। সবকিছু সেরে, টিকলির ঠাম্মাকে ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালে ভরতি করিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। নাগেশ গুরুং পরামর্শ দিল যেন অভিরাজ আর তার স্ত্রী কয়েকদিন টিকলিকে নিজেদের সঙ্গেই রাখে।
সেকথা না বললেও চলত। অভিরাজ আর মিনা টিকলিকে নিজেদের মেয়ের মতো ভালোবাসে। টিকলি তার ঠাম্মার জন্যে খালি কাঁদছিল, মিনা তাকে জোর করে খাওয়ালো। রাতে মিনা তাকে পাশে শুইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টাও করল, কিন্তু টিকলির ঘুম এল না। মিনার দু-চোখে ঘুম নেমে আসতেই টিকলি নিঃশব্দে পাশ থেকে উঠে এল। অনেকক্ষণ জানলার ধারে বসে থাকল একমনে। আকাশে ঝিকমিক করছে অগণিত তারা। ডান দিকের পাহাড়ে জোনাকির মতো চিকমিক করছে বৈদ্যুতিক আলো। আজ কি পূর্ণিমা? সামনের উপত্যকা আলোয় আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সেই দৃশ্য দেখেও টিকলির মন ভালো হল না। খালি ঠাম্মার কথা মনে হতে লাগল। তার যে ঠাম্মা ছাড়া কেউ নেই। ঠাম্মা যদি টিকলির কাছে না ফেরে তাহলে কে তাকে খাইয়ে দেবে,কে তাকে গল্প শোনাবে? ভাবতে ভাবতেই সে আবার কেঁদে ফেলল। জানলার পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতেই সে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
রাতে সে স্বপ্ন দেখল,একটা অদ্ভুত জায়গায় এসে সে দাঁড়িয়েছে। চতুর্দিকে আকাশ ছোঁয়া পাইনের বন। চারপাশটা কেমন কুয়াশায় ঢাকা। সবকিছু যেন খুব মলিন, সাদাকালো। চারপাশে এক অসহ্য নিস্তব্ধতা। কোনো জন্তুর ডাক নেই, কোনো পাখির ডাক নেই। টিকলি চিৎকার করল, “অভিরাজ মামা, মিনা মামি, তোমরা কোথায়? ঠাম্মা তুমি কোথায়?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। চারপাশে খালি নিঝুম কুয়াশার আস্তরণ। হঠাৎ মনে হল সেই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি চলে গেল। কে? অভিরাজ মামা নাকি? টিকলি সন্তর্পণে সেই ছায়ার পিছু নিল। ছায়াটা চলেছে তো চলেছেই। পথ বলতে কিছুই নেই, এবড়ো খেবড়ো প্রস্তরময় পথের চিহ্নমাত্র। অনেকক্ষণ চলার পর হঠাৎ পথ শেষ হয়ে গেল একটা বিশাল হ্রদের ধারে। চারপাশে সুউচ্চ পাইনের জঙ্গল। হ্রদে টলটল করছে নীল জল। জলের থেকে যেন একটা নীলচে আভাও বেরচ্ছে। আর হ্রদের মাঝে ফুটে আছে অসংখ্য নীলপদ্ম। সেগুলি থেকেও একটা হালকা নীল আভা বেরচ্ছে। টিকলি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিল সেই দিকে। কী অপরূপ দৃশ্য। হঠাৎ কে যেন তার কানে বলল, “হাতে পেলে নীল কমল, মনের আশ পূর্ণ হবে সকল।” টিকলি চমকে চারপাশটা দেখল, কেউ কোথাও নেই। তখনই তার মনে পড়ল ঠাম্মার বলা নীল কমলের গল্প। আর সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘুম ভেঙে গেল। একটু ধাতস্ত হতেই সে চারপাশে চোখ বোলাল। কই গেল সেই নীল জলের হ্রদ, কোথায় গেল সেই নীল কমলের সারি। সে তো অভিরাজ মামাদের ঘরের জানলার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্নের ব্যাপারটা তার মাথার থেকে গেল না।
পরের দুই রাতও একই স্বপ্ন দেখল। প্রতিবারই কে যেন তার কানে কানে বলে যাচ্ছিল—“হাতে পেলে নীল কমল, মনের আশ পূর্ণ হবে সকল।”
ওদিকে ঠাম্মার অবস্থারও তেমন কিছু উন্নতি হচ্ছে না। নাগেশ গুরুং আর অভিরাজ মামা পালা করে ডিসট্রিক্ট হসপিটালে খোঁজখবর নিচ্ছে কিন্তু ডাক্তার তেমন আশার কথা শোনাতে পারছেন না।
সেদিন সন্ধেবেলা টিকলি ঘরে বসে খেলছিল হঠাৎ পাশের ঘর থেকে মিনা মামি আর অভিরাজ মামার কথা কানে ভেসে এল। টিকলি কান পেতে শুনল অভিরাজ মামা বলছে যে ডিসট্রিক্ট হসপিটালের ড. ডিসুজা বলেছেন টিকলির ঠাম্মার অবস্থার কোনো উন্নতিই হচ্ছে না। উনি কালিংপং-এ তাঁর সহপাঠী ড. মৃত্যুঞ্জয় ত্রিবেদীর কাছে রেফার করতে চাইছেন। টিকলির কানে আর কিছুই ঢুকছিল না। ঠাম্মা কি আর কখনও তার নাম ধরে ডাকবে না? একথা ভাবতে ভাবতেই তার নরম দুই গাল বেয়ে জলের ধারা নেমে এল। সেই রাতে সে আবার একই স্বপ্ন দেখল। ঘুম ভেঙে জেগে উঠে সে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল, তারপর মনে মনে ঠিক করে ফেলল, ঠাম্মাকে সুস্থ করে তুলতে সে নীল কমলের খোঁজে যাবে। কিন্তু সে কী করে যাবে, সে কি রাস্তা চেনে নাকি। আর একা যাবেই বা কী করে? সে তো এখনও ছোটো। তাহলে কি অভিরাজ মামা বা নাগেশ কাকাকে সঙ্গে নেবে। না, না গ্রামের কারোকে জানানো যাবে না। সবাই সেই জায়গাকে খুব ভয় পায়। আর নাগেশ কাকা তো তাশি গুরুং-এর বংশধর। সে যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে টিকলির মনের কথা, তাহলে টিকলিকে বাড়ি থেকেই হয়তো বেরতে দেবে না। টিকলি ঠিক করল কারওকে না জানিয়েই সে নীল কমলের সন্ধানে যাবে।
তিন
সারারাত উত্তেজনায় টিকলির ঘুম আসল না। সে অপেক্ষায় ছিল কতক্ষণে ভোর হবে। পাহাড়ি এলাকায় দিন শুরু হয় অনেক ভোরে। সবে তখন পুব আকাশে আলোর আভা ফুটেছে। চারপাশে শুধুই পাখিদের কিচিরমিচির। ভোরের সুবাস মাখানো একটা মিঠে স্নিগ্ধতা, একটা মায়াময় শীতলতা ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। মিনা মামি তখন মুরগিদের খাবার দিচ্ছিল, অভিরাজ মামা সবজির খেতের দেখাশোনা করতে গিয়েছিল। টিকলি গুটিগুটি পায়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল। উঠোনের পাশ দিয়ে একটা কাঁচা পথ এঁকেবেঁকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে খানিক উঠেছে। টিকলি চারপাশে একটু সতর্ক দৃষ্টি চালিয়ে নিল। তারপরে সন্তর্পণে সেই আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। কিছুটা উপরে উঠতেই ছোটো একটা সমতল জায়গা আছে। সেখান থেকে বহুদূর অবধি দেখা যায়। টিকলি মাঝে মধ্যেই সেখানে খেলতে খেলতে চলে আসে,তার বন্ধুরাও আসে। কিন্তু ওই পর্যন্ত আসারই শুধু অনুমতি আছে তার। এর থেকে উপরে বাচ্চাদের যাওয়া বারণ। কারণ এরপর থেকে ক্রমশ পাইনের বন ঘন হতে শুরু করে। সেখানে মাঝে মধ্যে চিতাবাঘের আনাগোনাও লেগে থাকে।
গ্রামের বড়োদের অবশ্য এই সমতল জায়গাটা ছাড়িয়ে আরও উপরে উঠে যাওয়ায় নিষেধ নেই। কাঠের সন্ধানে তাদের যেতেই হয়। তবে তাঁদেরও বেশিদূর যাওয়ার অনুমতি নেই। বেশ কিছুটা উপরে সাহেবটিলা বলে একটা জায়গা আছে। ঠাম্মা একদিন গল্পের ছলে বলেছিল, সেই যে এক সাহেব নীল কমলের হ্রদ থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলেন, তাঁকে নাকি এই টিলার পাশেই অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। গ্রামের সকলের ধারণা এরপরে আরও উপরে যে ওঠে নীল কমলের মায়া হ্রদ তাদের মায়ায় বেঁধে ফেলে।
কিন্তু টিকলিকে যে আরও এগিয়ে যেতে হবে। তাকে যে নীল কমল সংগ্রহ করে তার ঠাম্মাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। একবার নীল কমল হাতে পেলেই তার ঠাম্মা তার কাছে ফিরে আসবে ভাবতেই টিকলির মন ভালো হয়ে গেল। গত কয়েকদিন তার মুখে যেন পাহাড়ি মেঘ জমে ছিল,আজ প্রথমবার তা কেটে গিয়ে ঝলমলে হাসি ফুটে উঠল। সে একটা নেপালি গান গুনগুন করতে করতে এগিয়ে চলল।
ঘণ্টাখানেক চলার পর সে সাহেবটিলার কাছে পৌঁছল। বিশাল বড়ো একটা পাথর, কেমন যেন বাদামি, লালচে রঙের। তার পাশ দিয়ে একটা রাস্তা ডান দিকে ঘুরে চলে গেছে পাশের গ্রামে। আর একটা রাস্তা আরও উপরে উঠে গেছে। সেই রাস্তাটাই যে নীল কমলের হ্রদের দিকে গেছে তা সহজেই অনুমেয়। সেটাকে পথ না বলে এবড়োখেবড়ো পথের চিহ্ন বলাই ভালো। ওই পথে মানুষের পা পরেনি বহুকাল।
সেই পথে প্রথম পদক্ষেপ রাখার আগে টিকলি কয়েক মুহূর্ত ভাবল। যদি সে আর ফিরতে না পারে? যদি তার অবস্থাও তাশি গুরুং আর তার দলের মতো হয় তাহলে? তার চোখের সামনে মিনা মামি আর অভিরাজ মামার মুখটা ভেসে উঠল, নিশ্চয় এতক্ষণে তারা খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। মিনা মামি হয়তো তাকে কাছে দেখতে না পেয়ে কান্নাকাটিও শুরু করে দিয়েছে। এসব ভাবতেই টিকলির মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। সে একবার ভাবল ফিরে যাবে। পরক্ষণেই তার চোখের সামনে ঠাম্মার হাসি মুখটা ভেসে উঠল। না, ঠাম্মাকে সুস্থ করতে হলে তাকে নীল কমলের হ্রদ খুঁজে বের করতেই হবে।
সে মনে জোর নিয়ে সেই রাস্তায় প্রথম পদক্ষেপ রাখল। সঙ্গে সঙ্গেই তার বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করে উঠল। কোন এক নাম-না-জানা পাখি পাইন বনের ভিতর থেকে কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল। দূর, বহুদূর থেকে বন্য জন্তুর একটানা ডাক ভেসে আসতে লাগল। টিকলির হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। গা ছমছম করতে লাগল। সে একবার ভীত দৃষ্টিতে চারপাশটা দেখে নিয়ে সেই পথ ধরে ছুট লাগাল।
মিনা মুরগিদের খাবার দিয়ে, টিকলিকে ডাকতে এসে দেখল বিছানা ফাঁকা। উঠোনে, রান্নাঘরে কোথাও না তাকে খুঁজে না পেয়ে সে অভিরাজকে চিৎকার করে ডাকল। দুইজনে চারপাশটা তন্নতন্ন করে খুঁজল। এমনকি পাশে টিকলিদের হোমস্টেতেও খুঁজে আসা হল। সেখানেও টিকলিকে না পেয়ে অভিরাজ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কিছুটা উঠে সমতল জায়গাটাও দেখে এল। কোথাও টিকলির চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ততক্ষণে মিনা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। সেই শব্দে গ্রামের আরও অনেকে সেখানে জড়ো হল। সারা গ্রামে খোঁজা হল। কোথাও টিকলি নেই। শেষে নাগেশ গুরুং বলল, “এমন নয়তো, কোনো চিতাবাঘ গ্রামে ঢুকে পড়েছিল, আর…”
নাগেশ গুরুং-এর কথা শেষ হওয়ার আগেই মিনা আতঙ্কে চিৎকার করে সংজ্ঞা হারাল। অভিরাজও মাটিতে ধপ করে বসে পরে ডুকরে কেঁদে উঠল। সবাই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে নাগেশ একটা সম্ভাবনার কথা বলেছে মাত্র, এমনটা নাও হতে পারে। অভিরাজ একটু ধাতস্ত হতেই নাগেশের নেতৃত্বে একটা দল গেল সাহেবটিলা অবধি পুরো জায়গাটা খুঁজে দেখতে। যদিও ততক্ষণে টিকলি টিলা ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
চার
ভয় পেয়ে বেশ কিছুটা দৌড়ে এসে, একটা পাথরের উপরে বসে হাঁপাতে লাগল টিকলি। জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস পড়তে শুরু করেছে তার। সে চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে দেখল জঙ্গল যেন আরও ঘন হয়েছে। পাইনগাছগুলির মাথা দেখা যাচ্ছে না। চারপাশটা কেমন স্যাঁতসেঁতে বিবর্ণ। জঙ্গলের মধ্যে মেঘের দল খেলা করছে। চারপাশে সবকিছুই ধোঁয়াটে ধুসর। একটু দূরের জিনিসও স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না। টিকলির ভয় করতে শুরু করল। চারপাশটা খুব নিস্তব্ধ। পাখির ডাক, জন্তুর ডাক, পোকামাকড়ের ডাক কিছুই নেই। একটা অদ্ভুত নৈশব্দ। টিকলির গলা শুকিয়ে এল। সে একবার ভাবল ফিরে যাবে কিনা। কিন্তু সে ভালো করে লক্ষ করে দেখল সে যে পথে এসেছে সেই পথের তেমন চিহ্ন কিছুই নেই। ফিরে যাওয়াটা অত সোজা হবে না। সে বনের মাঝে পথ হারিয়েছে। এবার তার খুব কান্না পেল। চোখদুটো জল থইথই হয়ে উঠল। তারপর তা টপটপ করে গাল গড়িয়ে নেমে এল। কিন্তু এই জঙ্গলে কে তার কান্না শুনবে?
সকাল থেকে টিকলি কিছুই খায়নি, একটু জলও না। ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর ভয়ে তার করুণ অবস্থা হয়ে উঠেছিল। এমন সময় নিস্তব্ধতা ভেদ করে তার কানে এল জলের ছলছল শব্দ। সেই শব্দ অনুসরণ করে কিছুটা এগোতেই তার চোখে পরল একটা পাহাড়ি ঝোরা। টিকলি সেখান থেকে ভালো করে জল খেয়ে নিল। তারপর আবার সামনে এগিয়ে চলল। কিন্তু যাবে কোথায়? যেদিকে চোখ যায় শুধুই মেঘ, আর মোটা মোটা পাইনগাছ। দুইজন মানুষ মিলেও সেইসব গাছের গুঁড়ির বেড় পাবে না। তাদের কাণ্ডগুলি শতাব্দী প্রাচীন, মোটা শ্যাওলার প্রলেপে ঢাকা।
হঠাৎ টিকলির কানে ভেসে এল হালকা মিঠে একটা সুর। কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার! এই জায়গায় কে আবার বাঁশি বাজাবে। সে সেই সুর অনুসরণ করে এগিয়ে চলল। ক্রমশ সুরটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। কিছুটা এগোতেই মেঘ ধূসরতার মাঝে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি ফুটে উঠল। টিকলি আরও এগিয়ে যাওয়ায় সেই ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল। একটা পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে, মাথায় তার ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল, কপালে একটা লাল ফেট্টি বাঁধা, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, আদুল গায়ে একটা পাথরের উপরে বসে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছিল। টিকলি খানিকক্ষণ তার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকল। ভারী অদ্ভুত ব্যাপার, যে জায়গার নামে তার গ্রামের সবাই ভয়ে ভয়ে থাকে সেই এলাকায় এই ছেলেটি একা বসে বাঁশি বাজাচ্ছে! ভয়ডর নেই নাকি!
হঠাৎ ছেলেটি বাঁশি বাজানো থামিয়ে টিকলির দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে একগাল হেসে বলল, “এই ঘন বনের মধ্যে কোথায় চললে খুকু?”
খুকু কথাটা শুনেই টিকলির মাথাটা গরম হয়ে গেল। সে মোটেও খুকু নয়। সে গম্ভীর হয়ে বলল, “সেটা জানার তোমার কী প্রয়োজন খোকা?”
টিকলির উত্তর শুনে ছেলেটি হো হো করে হেসে উঠল, তারপর কৌতুক মেশানো গলায় বলল, “শুকনো মুখ, ছলছল চোখ। ঠিকই ধরেছি তাহলে, খুকু পথ হারিয়েছে।”
“মোটেই না।” টিকলি প্রতিবাদ করতে গেল কিন্তু গলায় জোর পেল না।
ছেলেটি বলে চলল, “তাই ভাবি এই দিকে তো কেউ ভয়েই আসে না। আর একা একা অমন পুঁচকে মেয়ে এখানে কেন আসবে?”
টিকলি রেগে গিয়ে বলল, “সে তো তুমিও একা বসে, চোখ বুজে বাঁশি বাজাচ্ছ। তা একটা চিতাবাঘ এসে ঘাড় মটকালে কী হবে?”
ছেলেটি এবার এমন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল যে হাসির চোটে পাথরের উপর থেকে তার প্রায় পরে যাওয়ার অবস্থা হল। হাসির দমকে তার সারা শরীর দুলে দুলে উঠল।
টিকলি বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি বসে হাসতেই থাক, আমার অনেক কাজ আছে। আমি চললাম।”
টিকলি পাথরের পাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে ছেলেটি একলাফে নীচে নামল,তারপর টিকলির পিছু পিছু যেতে যেতে বলল, “হাসব না? আরে এখানে কি চিতাবাঘ আছে নাকি? এখানে পাখি নেই, বন্যজন্তু নেই। কেউ ভয়ে এদিকে আসে না।”
টিকলি থমকে দাঁড়াল কথাটা শুনে।সন্দেহ মেশানো গলায় বলল, “কেন? কিসের ভয়?”
ছেলেটা ভ্রূভঙ্গি করে বলল, “হু, কিছুই যেন জানে না! আরে নীল কমলের হ্রদ আছে না। নীল কমল হাতে পেলে মনবাঞ্ছা পূর্ণ হয়, না পেলে মায়ায় বাঁধা পড়তে হয়।”
“সবাই ভয় পায়, আর তোমার কোনো ভয় নেই?” টিকলি বলল।
“আমি কি নীল কমলের খোঁজে এসেছি যে ভয় পাব?” ছেলেটা একগাল হেসে বলল।
“তুমি চেনো সেই হ্রদ?” টিকলির গলায় সন্দেহ ঝরে পড়ছে।
ছেলেটি কয়েক মুহূর্তের জন্যে টিকলিকে আপাদমস্তক জরিপ করে নিল, তারপর একটা গোবেচারা হাসি হেসে বলল, “ও, খুকুও তাহলে নীল কমলের খোঁজেই এসেছে? হাতে পেলে নীল কমল, মনের আশ পূর্ণ হবে সকল।”
টিকলি চমকে তাকাল। এই কথাটাই সে বারবার শুনেছে স্বপ্নের মধ্যে। সে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি জানো সেই হ্রদ কোন দিকে আছে?”
“সে তো জানবই, তা খুকুর হঠাৎ নীল কমলের খোঁজে আসা কেন?”
টিকলির বলার ইচ্ছে ছিল না। ঠাম্মা বলে অচেনা মানুষদের থেকে সাবধান। কিন্তু ছেলেটি হ্রদের রাস্তা চেনে তাই বাধ্য হয়েই বলতে হল। সে তার ঠাম্মার কথা, স্বপ্নের কথা, এতদূর কীভাবে এল সব বলল।
ছেলেটি সব শুনে খানিক চুপ করে থাকল তারপর মৃদু হেসে বলল, “দেখেছ খুকি, কথায় কথায় কখন যে নীল কমলের হ্রদে এসে গেছি খেয়ালই করিনি।”
টিকলি অবাক হয়ে দেখল চারপাশের মেঘ কেটে গেছে। পাইনের জঙ্গলও কিছুটা হালকা হয়ে গেছে আর তার ঠিক মাঝখানে বিশাল এক হ্রদ। ঠিক তার স্বপ্নের মতো। নীল জল টলটল করছে। জলের থেকে যেন নীল আভা ছড়িয়ে পড়ছে। আর হ্রদের ঠিক মাঝখানে সারি সারি নীল পদ্ম, সেগুলি থেকেও নীলচে আভা বেরচ্ছে। টিকলির বিস্ময় কাটতে বেশ কয়েক মুহূর্ত লাগল। কী অপরূপ দৃশ্য, কী মনোরম পরিবেশ। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই সে এক ছুট্টে হ্রদের দিকে যাবে বলে প্রস্তুত হচ্ছিল। এমন সময় ছেলেটি বলল, “তা খুকু? সাঁতার জানো?”
টিকলি হাঁ করে খানিক তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে জানাল সে সাঁতার জানে না।
“তা নীল কমল আনবে কী করে। সেগুলো তো হ্রদের মাঝে আছে। তা ছাড়া ওই হ্রদের জল গায়ে লাগলে বয়েস হুহু করে বেড়ে যায়।”
টিকলির মুখটা কালো হয়ে এল। এতদূর এসেও সে নীল কমল পাবে না?
ছেলেটি মুচকি হেসে বলল, “অত চিন্তার কী আছে। যা যা তুমি চাইতে নীল কমলের কাছে তা তো এখানেই পাবে।”
“এখানে?” টিকলি হাঁ হয়ে গেল।
ছেলেটি তার বাঁশিতে নতুন সুর বাজালো। টিকলি বিস্মিত হয়ে দেখল চারপাশটা একটা নীলচে কুয়াশায় ঢেকে গেল। কয়েক মুহূর্ত বাদেই সেই কুয়াশা কেটে গেল। টিকলি দেখল সে একটা মস্ত ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। কত রকমের খেলনায় সেই ঘর ভরতি। চারদিকে ছড়িয়ে আছে হরেক রকমের পুতুল। কাপড়ের পুতুল, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল। বাঘ, হাতি, সিংহ, গণ্ডার, কথা বলা পুতুল, বাজনা বাজানো পুতুল, আরও কত খেলনা। টিকলি ঘরময় ছুটতে থাকল। সে এত খেলনা জীবনে দেখেনি। প্রতিটা খেলনা হাতে নিয়ে, নাড়াচাড়া করে দেখতে লাগল। তার মনে হল এই ঘর ছেড়ে সে কক্ষনও কোথাও যাবে না। হঠাৎ সে পোলাওয়ের গন্ধ পেল। গন্ধটা পাশের ঘর থেকে আসছে। সে এক ছুট্টে চলে গেল পাশের ঘরে। হরেক রকম খাবারে সারা ঘর ভরতি। লোভনীয় গন্ধে চারদিক মম করছে। টিকলির মনে হল এই ঘর ছেড়েও সে কক্ষনও কোথাও যাবে না। সে যখন কী করবে,কী খাবে এইসব ভাবছে, ঠিক তখনই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তার ঠাম্মার মুখটা। তার মনটা কেমন হুহু করে উঠল ঠাম্মার জন্যে। সে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলল, “আমি কিছুই চাই না। আমায় নীল কমল এনে দাও। আমি আমার ঠাম্মাকে সুস্থ করতে চাই।
সে কাঁদতে কাঁদতে দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়তেই তার কাঁধে একটা হাতের ছোঁয়া অনুভব করল। মুখ তুলে তাকাতেই অবাক হয়ে দেখল চারপাশে অত খাবার, অত পুতুল সব ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে গেছে। তার বদলে ছেলেটি একটি নীল পদ্ম হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
ছেলেটি হেসে সেই পদ্মটি টিকলির হাতে দিয়ে বলল, “সবাই মায়া কাটাতে পারে না খুকু। যারা পারে, তারা নীল কমল পায়। এবার যা চাওয়ার চেয়ে নাও।”
টিকলি নীল কমল হাতে তার মনের ইচ্ছা বলতে শুরু করল। সেই সঙ্গে ছেলেটিও বাঁশিতে নতুন সুর ধরল। সেই সুর কানে যেতেই টিকলির চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সে ঘুমে ঢলে পড়ল।
ঘুম ভেঙে ধরপরিয়ে উঠে বসল টিকলি। একি সে যে অভিরাজ মামার বাড়ির বিছানায় শুয়ে ছিল। তাহলে সে এতক্ষণ যা যা দেখল পুরোটাই স্বপ্ন? সকাল সকাল টিকলির মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল।
এমন সময় মিনা মামি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে একগাল হেসে বলল, “ওরে ওঠ, ওঠ দারুণ খবর আছে। ডিসট্রিক্ট হসপিটালের ড. ডিসুজা ফোন করেছিলেন তোর মামাকে। একটা ম্যাজিক হয়ে গেছে। তোর ঠাম্মার উপর কাল অবধি কোনো ওষুধই কাজ করছিল না, অবস্থা একই রকম ছিল। অথচ আজ সকালে চেক আপ করতে গিয়ে সবাই অবাক। তিনি আবার কথা বলতে শুরু করেছেন, সবার কথা মনেও করতে পারছেন। তোকে বারবার দেখতে চাইছেন। তোর মামা এখুনি ডিসট্রিক্ট হসপিটালে যাবে, তুইও তৈরি হয়ে নে। ঠাম্মাকে দেখতে যাবি তো।”
টিকলি প্রায় লাফিয়ে উঠল। তার যেন কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। এটাও স্বপ্ন নয় তো, ঠিক কালকের রাতের স্বপ্নের মত। ঘুম ভাঙা চোখে সে বিছানা থেকে লাফিয়ে নামতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ সে ডান হাতের মুঠোয় কিছু একটা অনুভব করল। সে ধীরে ধীরে মুঠো খুলতেই দেখল এতক্ষণ একটা পাপড়ি সে মুঠোয় ধরে ছিল। একটা নীল কমলের পাপড়ি। সঙ্গে সঙ্গেই কোথা থেকে একটা মিঠে বাঁশির সুর খুব ক্ষীণভাবে তার কানে এসে পৌঁছল। পাপড়িটার দিকে তাকিয়ে টিকলির চোখদুটো আনন্দে ছলছল করে উঠল।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ফ্যান্টাসি, সুমন মিশ্র