সবুজ ট্রানজিস্টার
লেখক: অদ্রীশ বর্ধন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
এক নম্বর রহস্য: ভূতুড়ে প্রাসাদে লাল চোখ
দার্জিলিংয়ের নর্থপয়েন্টে এখন যেখানে রোপওয়ে হয়েছে, তার কিছু দূরে পাহাড়ের চূড়ায় একটা পুরোনো বাড়ি আছে। ভাঙাচোরা। দরজা-জানালা কোন্ কালে উধাও হয়েছে। পাথরের দেয়ালগুলোই কেবল খাড়া আছে বছরের পর বছর।
এ বাড়ি কে করেছিল, কেউ জানে না। ঝোপঝাড় আর পাইনের জঙ্গলে প্রায় ঢেকে এসেছে। দিনের বেলাতেও কেউ ও তল্লাট মাড়ায় না। লোকে বলে, ভূতের বাড়ি।
মাথু আর সাথু কিন্তু ভূত-ফুতকে থোড়াই কেয়ার করত। ছোটো ছোটো চোখ নাচিয়ে বলত, আরে দূর! ভূত আমার করবে কী? বোম্বাকাকু আছে না?
বোম্বাকাকু হল ওদের জাদুকর কাকু। অনেক-অনেক বছর আগে বোম্বাকাকু বাড়ি ছেড়ে চলে যায় ম্যাজিক শিখতে। তিব্বতে ছিল অনেক দিন। পাহাড়ি জাদুকরদের সঙ্গে থেকেছে বছরের পর বছর। এখন সে পাক্কা জাদুকর। বাড়ি আসে না। বন-জঙ্গলেই থাকে। কিন্তু মাথু আর সাথুকে বড্ড ভালোবাসে। ডাকলেই সাড়া দেয়। কীভাবে সেটা পরে বলছি।
তার আগে একটা কথা বলে নিই। মাথু আর সাথু দুজনেরই দার্জিলিংয়ে জন্ম। পাহাড় যেখানে ঢালু হয়ে অনেক দূর নেমে গিয়ে আবার উঠে গেছে, সেইখানে একটা ছোট্ট গ্রামে থাকে ওরা। বারোমাস ঠান্ডা খেয়ে গালদুটো ওদের বেশ টুকটুকে লাল—যেন আপেল। মাথুর বয়স দশ, সাথুর আট। মাথু পড়ে জলাপাহাড়ের সেন্টপল্সে্, সাথু নর্থপয়েন্টের সেন্ট জোসেফে।
মাথুর ইচ্ছে, বড়ো হয়ে বৈজ্ঞানিক হবে। তাই দিনরাত খুটখাট করে নানারকম যন্ত্রপাতি নিয়ে। স্কুল থেকে শিখে আসে, দার্জিলিং বাজার থেকে কিনে আনে। বাড়ির সবাইকে অতিষ্ঠ করে তোলে।
সাথুর কিন্তু বড়ো সাধ, বড়ো হয়ে মস্ত লেখক হবে। এই বয়সেই চোখে পেঁচার চোখের মতো বড়ো বড়ো গোল চশমা। মুখ-টুখ বেজায় ভারিক্কী। এক পকেটে চব্বিশ ঘণ্টা লজেন্স আর টফি থাকে। দাঁতের বারোটা বাজিয়ে বসে আছে মিষ্টি খেয়ে আর দাঁত না মেজে। ওর আর এক পকেটে থাকে কমিক বই।
আশ্চর্য এই গল্প যখন শুরু, হচ্ছে, তখন চাঁদনি রাত। দার্জিলিং ঝকঝক করছে চাঁদের আলোয়। দূরে দূরে পাহাড়গুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সুন্দর সেই দৃশ্য দেখতে ম্যাল ভরতি হয়ে গেছে টুরিস্টের ভিড়ে।
মাথু-সাথুদের বাড়ি থেকে অনেক উঁচুতে দেখা যায় আলো-ঝলমলে ম্যাল। মাঝে মাঝে কুয়াশা আর মেঘ এসে ঢেকে দিয়ে যায়। আবার কুয়াশা ফুঁড়ে মিটমিট করে জোনাকির মতো জ্বলে ওঠে আলোর পর আলো।
মাথু আর সাথু ঘরে বসে রয়েছে। সাথু বেতের চেয়ারে গুটিসুটি মেরে বসে কমিক বই পড়ছে। দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। এক পাগলা বৈজ্ঞানিক খেপে গিয়ে গোটা পৃথিবীটাকে জলে ডুবিয়ে দেবে প্ল্যান করছে—ইঁদুরের মতো জলে চুবিয়ে মারবে মানুষদের। কী ভয়ংকর! কী ভয়ংকর! দম বন্ধ করে সাথু পড়ে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত কী হয় জানবার জন্য। এই অবস্থাতেও কিন্তু ওর ডান হাতটা ঠিক কাজ করে যাচ্ছে। ডান পকেট থেকে টফি বার করছে লুকিয়ে-চুরিয়ে, যাতে মাথু দেখতে না পায়। দেখলেই তো চাইবে। বার করেই টুপ করে মুখে ফেলে গালে চালান করে দিচ্ছে।
মাথুর কিন্তু কোনো দিকেই নজর নেই। সে ব্যস্ত রেডিয়ো তৈরি নিয়ে। ইজিমেড রেডিয়ো। বেসবোর্ডে রং দিয়ে চিহ্ন দেওয়া আছে কোথায় কী বসবে। টুকরো পার্টসগুলোতেও সেই রং দেওয়া আছে। লাল প্লাগে বসবে লাল ট্রানজিস্টার, নীল প্লাগে নীল ট্রানজিস্টার, হলুদ লাগে হলুদ। এইভাবে এমন চমৎকারভাবে রঙের মাধ্যমে সব বোঝানো আছে যে, একটা বাচ্চা ছেলেও শুধু রং মিলিয়ে পার্টসগুলো বসিয়ে দিলেই ইজিমেড রেডিয়ো ট্রানজিস্টার তৈরি হয়ে যায়।
মাথু প্রায় শেষ করে এনেছে হাতের কাজ। কিন্তু খটকা লাগছে কেবল এক জায়গায়। লাল প্লাগে লাল ট্রানজিস্টার যাওয়া উচিত, কিন্তু লাল ট্রানজিস্টারটাই পাওয়া যাচ্ছে না বাক্সের মধ্যে, তার বদলে রয়েছে একটা সবুজ ট্রানজিস্টার।
সবুজ ট্রানজিস্টার!
অথচ সবুজ প্লাগ নেই বেসবোর্ডে।
এ তো মহা ঝামেলা! মাথা গরম হয়ে গেল মাথুর।
সাথু!
মাথুর ডাকে চমকে উঠল সাথু। ম্যাড সায়ান্টিস্ট তখন উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুর সব বরফ গলানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে—বরফ গলা জলে ডুবতে চলেছে সমস্ত পৃথিবী—এখন হাঁকডাক কেন?
বললে, কী হল?
—তোর মুণ্ডু! দোকানদারটা ঠকিয়ে দিয়েছে।
রেডিয়োর উপর চোখ পড়ল সাথুর। সামান্য ব্যাপার। পৃথিবী জলে ডুবতে চলেছে যখন, তখন তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। ও শুধু বললে, কী ঠকিয়েছে?
—লাল প্লাগে তো লাল ট্রানজিস্টার বসবে, তার বদলে দেখছি একটা সবুজ ট্রানজিস্টার।
—ওইটাই বসিয়ে দাও না। ঢুকছে তো?
—ঢুকছে। কিন্তু যদি দুম করে ফেটে যায়?
—দুটো তো মোটে ব্যাটারি, অত পাওয়ার কোথায়?
কথাটা ঠিক, দুটো ব্যাটারির এমন শক্তি নেই যে, দুমদাম করে রেডিয়ো ফাটবে ভুল জায়গায় পার্টস বসালে।
মাথুও আর দেরি করল না। “তবে এই বসালাম” বলে সবুজ ট্রানজিস্টার বসিয়ে দিল লাল প্লাগে।
কোঁ-ও-ও কোঁ-ও-ও পিঁক-পিঁক-পিঁক।
এ আবার কী আওয়াজ!
খটর-খট… … ..খটর খট… … ..খটর খট… … ..
মাথু সাত-তাড়াতাড়ি নব ঘুরিয়ে অ্যাডজাস্ট করতে গেল। কিন্তু আওয়াজ তাতে কমল না, আরও বেড়ে গেল।
সে কী বিতিকিচ্ছিরি আওয়াজ! কান ঝালাপালা হয়ে গেল। রেগেমেগে রেডিয়ো ছুড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছে মাথু, এমন সময় ফুস করে মিলিয়ে গেল বিকট আওয়াজ।
সে জায়গায় শোনা গেল চ্যাড়চেড়ে গলায় একটা ঘোষণা:
… টং রাজ্যের ভীষণ বিপদ। বিশ্বাসঘাতক ‘বিকট’ টং রাজ্যের সমস্ত মানুষ, সমস্ত জন্তু খতম করবে ঠিক করেছে। তার ওয়ার্জ বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করবে হুমকি দিয়েছে। যে যেখানে আছ, যুদ্ধের জন্যে তৈরি হও। আমরা… কোঁ-ও-ও… পিঁক… পিঁক… পিঁক…
আবার সেই কান-ঝালাপালা করা শব্দ। ঘোষণাটার বাকিটুকু শোনবার জন্যে মাথু-সাথু দুজনেরই প্রাণ তখন আকুলি-বিকুলি করছে। দুজনেই ঝুঁকে পড়ে ঘ্যাঁচ-ম্যাচ করে নব ঘোরাচ্ছে। কিন্তু টং রাজ্যের ভীষণ বিপদের আরও খবর আর শোনাই গেল না।
সাথু বললে, দাদা টং কোথায়?
মাথু জানে না টং কোথায়। নামও শোনেনি কোনোকালে। কিন্তু সে কথা বললে ভাইয়ের কাছে দাদাগিরি করা মুশকিল হবে। তাই কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, চল্, ইয়ং প্যালেসে যাই।
ইয়ং প্যালেস হল সেই ভূতের বাড়ি, যে বাড়ির ক-খানা দেয়াল কেবল তখনও খাড়া আছে।
—কেন দাদা?
—পাহাড়ের মাথায় উঠলে পরিষ্কার শোনা যাবে রেডিয়োতে। এত নীচে আছি বলেই এত আওয়াজ।
—কিন্তু এই রাতে?
—ভয় করছে নাকি? ভূত ধরবে? চল্ চল্।
সাথু আর কথা বলল না। ভয়-টয় তার নেই। রাতেও ইয়ং প্যালেসে গেছে কত বার! ওখান থেকে দার্জিলিংয়ের ম্যাল দেখা যায় ফ্রেমে-বাঁধানো ছবির মতো। দেখা যায়, দেশলাইয়ের বাক্সের মতো রোপওয়ের কেবিন পিছলে নেমে যাচ্ছে মোটা তারের দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে।
ভয় সাথুর মাকে। সামনের ঘরে বাবাকে নিয়ে বসে রয়েছেন। বেরোবে কী করে? মা জানেন, মাথু-সাথু ঘুমোতে এসেছে।
মাথুও সমস্যাটা ভেবেছিল। তাই জানলা খুলে দিয়ে টপ করে লাফ দিল বাইরে। সাথুকেও নামিয়ে নিল জানলা দিয়ে। দু-ভাই দৌড়োল পাকদণ্ডী বেয়ে ইয়ং প্যালেসের দিকে।
আধ ঘণ্টার মধ্যে ওরা পৌঁছে গেল পোড়ো প্যালেসে। চারিদিক নিঝুম, থমথমে। কোথায় যেন একটা পেঁচা ডেকে উঠল, সর-সর করে কী যেন উড়ে গেল ঝোপের মধ্যে। মাথার উপর কেবল জেগে রইল পাইনের একটানা সর-সর মর্মর।
চাঁদের আলোয় একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে নিয়ে দাঁড়াল দু-ভাই। রেডিয়ো বার করল মাথু। খুট করে নব ঘোরাতেই শোনা গেল ঘোষণাটা:
“বিপদ… বিপদ… বিপদ… টং রাজ্যের রাজপুত্রকে পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ধুগণ, যে যেখানে আছ, ছুটে এসো। বিকট হানা দিতে পারে যে কোনো মুহূর্তে।”
থামল ঘোষক। রেডিয়োতেও আর কোনো শব্দ শোনা গেল না। আর ঠিক সেই সময়ে একটা কাণ্ড ঘটল।
পাইনের ঝুপসি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল সাথু। কয়েক হাত দূরে মাথু। আচমকা গাল সুড়সুড় করে উঠল সাথুর। যেন পিঁপড়ে হাঁটছে গালের উপর দিয়ে। হাত দিয়ে ঝাড়তে গেল সাথু। সঙ্গে সঙ্গে সটাৎ করে কিলবিলে সাপের মতো একটা বস্তু পেঁচিয়ে ধরল মুখের উপর দিয়ে—টুঁ শব্দটাও বেরুল না সাথুর গলা থেকে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎবেগে আর একটা সাপের মতো কিলবিলে বস্তু পেঁচিয়ে ধরল সাথুর দু-হাত শুদ্ধ দেহটা এবং চোখের পলক ফেলবার আগেই পুরো দেহটাকে মাটি থেকে শূন্যে তুলে নিয়ে ঢুকিয়ে নিল ঝোপের অন্ধকারে।
চোখের নিমেষে ঘটে গেল এত ব্যাপার। এতটুকু শব্দও হল না।
—সাথু, রেডিয়ো তো থেমে গেল।
জবাব নেই।
—সাথু!
জবাব নেই।
—ইয়ার্কি হচ্ছে? মারব এক থাপ্পড়!
জবাব নেই।
মুখ তুলে চাইল মাথু। অন্ধকারের মধ্যে যেখানে সাথুর দাঁড়িয়ে থাকার কথা, সেখানে সে নেই।
রেডিয়োটা পকেটে ঢুকিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়াল মাথু। তার কারণও আছে। সাথু যেখানে দাঁড়িয়ে, তার পিছনে একটা ঝোপ। সেখানকার ঝুপসি অন্ধকারে জ্বলজ্বল কছে একজোড়া… একজোড়া লাল থালা!
হ্যাঁ, লাল থালা। গোলাকার। একবিঘত ব্যাস। কিন্তু ঠিক যেন গনগনে আগুন। লাল ভাঁটা অথবা আগুনের মালসা বললেও চলে।
ভয় কাকে বলে জানে না মাথু। কিন্তু সেও ভয় পেল। তার কেন যেন মনে হল, আগুনের মালসার মতো বিরাট গোলাকার ও দুটো জিনিস আসলে একজোড়া চোখ। এবং সে চোখ তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকেই।
মাথু নড়তে পারল না। অতবড়ো চোখ যার, তার দেহটা কত বড়ো ভাবতেই গা-হাত-পা তার অসাড় হয়ে এল।
সাথু কি ওর খপ্পরেই গেছে? এ কোন্ বিভীষিকা ঠাঁই নিয়েছে ইয়ং প্যালেসে? হিমালয়ের কোন্ ভয়ংকর ওঁত পেতে রয়েছে ঝুপসি অন্ধকারে?
মাথু নড়তে পারছে না।
কিন্তু মালসার মতো প্রকাণ্ড চোখজোড়া নড়ছে। মাছের চোখের পাতা পড়ে না, এরও তেমনি পাতাই নেই। নিশীথ রাতের এই আতঙ্কর চোখেও পাতা পড়ছে না, নিমেষহীন দৃষ্টি মেলে রয়েছে মাথুর দিকে। আর, হ্যাঁ, একটু একটু করে এগিয়ে আসছে।
সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে মাথু দেখল সেই ভয়াবহ দৃশ্য। অন্ধকারের মধ্যে থেকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে ভয়াল ভয়ংকর একজোড়া গণগনে চোখ—তার দিকেই।
মাথু পেছিয়ে এল এক পা… দু পা… তিন পা…
অন্ধকারের মধ্যে থেকে সচল আগুন ভাঁটাও শূন্যে ভাসতে ভাসতে এগোচ্ছে সামনে…
আচমকা পেছন ফিরেই ভোঁ দৌড় দিল মাথু। হাত-দশেক দূরেই খাড়া দেয়াল। দেয়ালের গায়ে কাঠের ফ্রেম। এককালে দরজা ছিল। এখন লুঠ হয়ে গেছে। কেবল ফ্রেমটা আছে। সেই ফ্রেমের ফাঁক দিয়ে তিরবেগে বেরিয়ে গেল মাথু।
ঠিক সেই সময়ে আকাশের চাঁদের মুখ ঢেকে গেল মেঘে। অন্ধকার হয়ে গেল সামনের ফাঁকা জায়গাটুকু। এতক্ষণ যেন চাঁদের আলোর জন্যে গুটিগুটি এগোচ্ছিল লাল-ভাঁটা চোখ; এবার বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এল খোলা জায়গায়।
ঘাড় ফিরিয়ে মাথু দেখল, মাটি থেকে কেবল দু-হাত ওপরে এক জোড়া টকটকে রাঙা থালা ধেয়ে আসছে তার দিকে। থালার নীচে কী আছে দেখা যাচ্ছে না ঘুটঘুটে অন্ধকার।
দেখার দরকারও নেই। ইয়ং প্যালেসের সমস্ত মুখস্থ ওর। কোথায় কী আছে সব জানে। কত দিন এসে চোর-পুলিশ খেলেছে এখানকার গলি-ঘুঁজিতে!
তাই সিন্দুকটার ডালার ঠিক ওপারে এসে দাঁড়াল মাথু। খুব ভারী কাঠের একটা সিন্দুক কবে কে যেন মাটিতে পুঁতে দিয়ে গেছিল। হয়ত এককালে সোনা-দানা মণি-মানিকে ঠাসা ছিল, এখন বেবাক ফাঁকা। তামার পাত মারা ভারী তালাটা ঝড়-জল-বৃষ্টিতেও গোটা আছে। মাথু-সাথু ডালা খুলে সিন্দুকের ভিতর সাফ করে নিয়েছিল। ভেতরটা যেন একটা ছোটোখাটো ঘর। ভেতরে বসে ওরা পাতাল-খেলা খেলেছে কত দিন!
অজানা ভয়ংকরকে সামনে দেখে এই সিন্দুকের কথাই আগে মনে পড়ল মাথুর। খরগোশের মতো দৌড়ে এসে তাই সে দাঁড়িয়েছে সিন্দুকের ডালার ওপর। তারপরেই পাশে সরে গিয়ে এক ঝটকায় ডালা খুলে লাফ দিল ভিতরে। সেইসঙ্গে ডালা টেনে বন্ধ করে দিল ভেতর থেকে। ভেতরে একটা ছিটকিনিও আছে। খটাং করে টেনে বন্ধ করে দিল, যাতে ওপর থেকে ডালা আর খোলা না যায়।
থালার মতো চোখ যার ভয়ংকর সেই আততায়ী ততক্ষণে এসে পড়েছে সিন্দুকের ডালার ওপর। একটা পাথর পড়ল যেন ডালায়, মচমচ করে উঠল পুরোনো কাঠের পেল্লায় ডালাটা। তামার পাত দিয়ে মজবুত করা ছিল বলে রক্ষে, নইলে তৎক্ষণাৎ মচমচাৎ করে ভেঙে ঢুকে আসত ভেতর দিকে।
ভয়ে কাঠ হয়ে এককোণে সিঁটিয়ে বসে রইল মাথু। এ কী বিপদ! ইয়ং প্যালেসে এ কী উৎপাত!
বিশ্রী একটা গন্ধ নাকে আসছে না? গা-গুলোনো আঁশটে একটা গন্ধ!
ঢক ঢক ঢক করে কীসের যেন বাড়ি পড়ছে তালায়। ভীষণ ভারী আর জোরালো এমন কিছু যার আঘাত বেশিক্ষণ সইতে পারবে না নড়বড়ে এই পাল্লা।
ঢক ঢক দমাস দমাস… ঢক ঢক দমাস দমাস… মচ… মচাৎ…
একটা কাঠের টুকরো ছিটকে এল ভেতরে।
আরও কোণের দিকে সিঁটিয়ে গেল মাথু।
ভাঙা কাঠের ফাঁকে এবার দেখা গেল উজ্জ্বলে সেই লাল চোখ। চোখের পাতা পড়ছে না। অপলক চেয়ে দেখছে মাথুকে।
সরে গেল চোখ। তারার আলোয় লিকলিকে সাপের মতো কী যেন একটা দেখা গেল। ভাঙা কাঠের ফাঁক দিয়ে ঢুকে এগিয়ে আসছে সেটা মাথুর দিকে।
কিন্তু একটু এগিয়েই আটকে গেল। ওইটুকু ফাঁকে অত মোটা জিনিস ঢুকতে পারে না।
আঃ, বাচা গেল।
কিন্তু পরক্ষণেই মুখ শুকিয়ে গেল মাথুর। মোটা শুঁড়ের মতো কিলবিলে জিনিসটা পুরো তালাটাকে জাপটে ধরে টান মারছে ওপর থেকে।
সে কী প্রচণ্ড ঝাঁকুনি! ঝনঝন করে কাঁপছে পলকা ছিটকিনি। ভাঙল বলে… পুরো ডালা কবজা-টবজা সমেত এক্ষুণি ছিটকে যাবে বাইরে… তারপর…
তারপরের কথা ভাবতে গিয়েই হাত-পা হিম হয়ে এল মাথুর। আর ঠিক সেই সময়ে মনে পড়ল বোম্বাকাকুর কথা।
একটা মন্ত্র শিখিয়েছিল বোম্বাকাকু। যেখানে যে অবস্থাতে থাকুক না কেন মাথু, মন্ত্র আওড়ালেই বোম্বাকাকু সাড়া দেবে। কীভাবে যে সেটা হবে, তা শুধু, বোম্বাকাকুই জানে।
ভীষণ এই বিপদে সেই মন্ত্রটা জিবের ডগায় এসে গেল মাথুর। বললে বিড়বিড় করে, কুকাম্বাবো! কুকাম্বাবো! কুকাম্বাবো!
আসলে ‘বোম্বাকাকু’ নামটিই উলটো করে উচ্চারণ করা।
বাইরের তুমুল দাপাদাপি একটু থেমে গেল না?
কুকাম্বাবো! কুকাম্ববো! কুকাম্বাবো!—মাথু পাগলের মতো মন্ত্র আউড়ে গেল আবার—কুকাম্বাবো! কুকাম্বাবো! কুকাম্বাবো!
হঠাৎ কানের কাছে শোনা গেল কর্কশ শুকনো অমানুষিক কণ্ঠস্বরে প্রচণ্ড এক ধমক—আঃ আঃ আঃ! এত চেঁচাচ্ছ কেন? একবার ডাকলেই তো হয়।
—বোম্বাকাকু!
—না না না। বোম্বাকাকু এখন মিটিং করছে। আমাকেই আসতে হল তোমার ডাক শুনে।
—কে তুমি?
অমানুষিক গলায় হেসে উঠল অন্ধকারের আগন্তুক।—আমি? আমি কালো প্যাঁচা।
—অ। কিন্তু ভাই প্যাঁচা, তুমি কি পারবে ওই ভয়ংকরের খপ্পর থেকে আমাকে বাঁচাতে?
—কোন ভয়ংকরের কথা বলছ?
—সিন্দুকের ডালা ভাঙছে যে!
আবার ঘূৎকার দিয়ে হেসে উঠল অন্ধকারের বন্ধু—কোথায় সে? কিছু বুঝতে পারছ না?
তাও তো বটে! ডালার ওপর দুমদাম আওয়াজ তো বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, মাথার ওপর ডালাটাও আর দেখা যাচ্ছে না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে গেছে সব। আর, আর পায়ের তলার মেঝে ভীষণবেগে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। যেভাবে লিফট নামে ওপর থেকে নীচে, অবিকল সেইভাবে যেন মাথু নেমে যাচ্ছে পাতালে।
—কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
—যাকে এত ডাকাডাকি করছিলে তার কাছে। এবার একটু দম বন্ধ কর, নইলে মাথা ঘুরে যাবে।
বলতে না বলতেই সত্যিই বোঁ করে মাথা ঘুরে গেল মাথুর। সিন্দুক-লিফট উল্কার মতোই হঠাৎ প্রচণ্ড বেগে নেমে গেল নীচের দিকে। মাথু জ্ঞান হারিয়ে ফেলল কিছুক্ষণের জন্যে।
দু নম্বর রহস্য: হিমালয়ের ভয়ংকর
চোখ খুলেই মাথু দেখল, মাঠের মধ্যে বসে রয়েছে সে। মাথার ওপর নীল আকাশ, তারা ফুটে রয়েছে।
ও হরি, পাতালে তাহলে পৌঁছোয়নি মাথু, সবটাই বোম্বাকাকুর ভড়কি! পাতাল দিয়ে পিট্টান দিয়েছে কালো প্যাঁচা মাথুকে নিয়ে।
কিন্তু বোম্বাকাকু কোথায়? মাঠের মধ্যে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে আছে যত রাজ্যের জন্তু-জানোয়ার, পাখি। সবগুলোর নামও কি ছাই মনে রাখতে পারে মাথু! গোল হয়ে প্রত্যেকে ঘিরে রয়েছে মাথুকে। মাথুর পাশেই একটা কাঠের গুঁড়ি পড়ে।
হঠাৎ খিকখিক করে হাসির আওয়াজ ভেসে এল সেই দিক থেকে, মানে, কাঠের গুঁড়ির দিক থেকে। মানুষের হাসি। অথচ এই মাঠে মানুষ কেউ নেই। সব জানোয়ার আর পাখি, প্যাটপ্যাট করে চেয়ে আছে মাথুর দিকে।
তবে কে হাসল?
আবার সেই হাসি। শুনলে গা-পিত্তি জ্বলে যায়।
ওপাশ থেকে একটা ইয়াব্বড় কালো প্যাঁচাও হু-হু করে হেসে উঠল।
সেই প্যাঁচাটা নিশ্চয়ই, মাথুকে যে উদ্ধার করে এনেছে ইয়ং প্যালেসের বিভীষিকার খপ্পর থেকে। প্যাঁচা বললে, চিনতে পারলে না? তোমার বোম্বাকাকুকে চিনতে পারলে না?
ঘোর সন্দেহ হল মাথুর। বোম্বাকাকু কত রকমের মজার ম্যাজিকই না জানে! এটাও কি তা-ই? বোম্বাকাকু হাসছে, অথচ তাকে দেখা যাচ্ছে না। মন্ত্ৰ ঝেড়ে অদৃশ্য হয়ে রয়েছে নাকি? হাসিটা মাথুর আগেই চেনা উচিত ছিল। বোম্বাকাকুই বটে। সে বলল গম্ভীর গলায়, চিনতে পারবে না কেন? ওই তো বোম্বাকাকু, দেখাই যাচ্ছে না।
অদৃশ্য বোম্বাকাকুর গলা শোনা গেল এবার—ভয় পেয়েছিলি কেন?
মাথু খুলে বলল সব কথা। সবুজ ট্রানজিস্টার লাগাতেই টং রাজ্যের বিপদের কথা রেডিয়োতে কীভাবে শুনেছে, কীভাবে ইয়ং প্যালেসে ওঠবার পর সাথু অদৃশ্য হয়ে গেল এবং লাল ভাঁটার মতো একজোড়া ভয়ানক চোখ মাথুকে তেড়ে এল—সব।
এতক্ষণ টুঁ শব্দ শোনা যাচ্ছিল না মাঠে। অত যে জানোয়ার আর পাখি, কেউ কোনোরকম আওয়াজ করছিল না। মাথুর কাহিনি যেই শেষ হল, অমনি একসঙ্গে একটা শব্দ সবার গলায় শোনা গেল বারবার: ওয়ার্জ!… ওয়ার্জ!… ওয়ার্জ!… ওয়ার্জ!… ওয়ার্জ!
ভ্যাবাচাকা হয়ে গেল মাথু। এত জন্তু-জানোয়ার গলা মিলিয়ে চেঁচাতে থাকলে আকাশের তারা পর্যন্ত খসে পড়তে পারে। সে কী ভীষণ হট্টগোল! মাথু তাড়াতাড়ি হাত চাপা দিল কানে। ওর মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল শব্দটা।
ওয়ার্জ! হ্যাঁ হ্যাঁ, রেডিয়োতে ঠিক এই শব্দটা শুনেছিল মাথু। বিকট তার ওয়ার্জ বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেছে টং রাজ্য।
কে এই বিকট? ওয়ার্জই বা কে?
মাথুর মনের কথা ধরে ফেলল জাদুকর বোম্বাকাকু। মন্ত্রের জোরেই যেন আচমকা ফের নিস্তব্ধ হয়ে গেল মাঠ আর ওদিককার জঙ্গল। বোম্বাকাকুর গলা শোনা গেল কাঠের গুঁড়ির ওপর থেকে—মাথু, সাথুকে ধরে নিয়ে গেছে ওয়ার্জ। তোকেও ধরত।
—ওয়ার্জ কে বোম্বাকাকু?
—বিকটের সৈন্য।
—বিকট! সে আবার কে?
—এই বনের ধারে অনেক বছর আগে কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল একটা বিতিকিচ্ছিরি ছানাকে। মানুষের ছানা নয়, জানোয়ারের ছানাও নয়। জঙ্গলের মধ্যে পড়ে কাঁদছিল সে। বিকট, ভয়ংকর, বীভৎস তাকে দেখতে। বনে কাঠ কাঠতে এসেছিল একজন কাঠুরে। অদ্ভুত ছানাটাকে দেখতে পেয়ে সে নিয়ে যায় বাড়িতে। বিকট দেখতে বলেই তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিকট’।
—সে মানুষ নয়, জানোয়ারও নয়, তাহলে কী?
—অন্য গ্রহের জীব।
অন্য গ্রহের জীব!—মাথু তো হতভম্ব।
—হ্যাঁ। কেউ তা জানে না এক আমি ছাড়া। বিকট নিজেও জানে না। আমি জেনেছি আমার সেই মন্ত্র দিয়ে। অনেক-অনেক বছর আগে একটা মহাকাশযান অন্য গ্রহ থেকে নেমেছিল এই মাঠে। বাচ্চাটা তখনই হারিয়ে যায় মহাকাশযানের ভেতর থেকে। একটি ভালুক চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিল নিজের বাচ্চার মতো মানুষ করবে বলে। কিন্তু খিদের জ্বালায় অতটুকু বাচ্চার ওইরকম বিকট কান্না দেখে তিতিবিরক্ত হয়ে রেখে চলে যায় বনের মধ্যে। আর ঠিক সেই সময়ে সেই কাঠুরে এসে পড়ে সেখানে।
তারপর?—গল্প শোনার নেশায় মশগুল হয়ে যায় মাথু।
—বিকট বড়ো হল চড়চড় করে। সে কী বাড়! মানুষের বাড় অমন হয় না। পৃথিবীর কোনো প্রাণী এত তাড়াতাড়ি বড়ো হয় না। কয়েক বছরের মধ্যেই ওই জাপানি পাইন গাছটার মতো লম্বা হয়ে গেল বিকট।
কোন্ জাপানি পাইন গাছটাকে কোম্বাকাকু আঙুল দিয়ে দেখাল, মাথু তা ধরতে পারল না। কী করে পারবে? বোম্বাকাকু তো অদৃশ্য। তবে মাঠটার চারধারে তো পাইন গাছেরই জঙ্গল। জাপানি পাইনই বটে। অত বড়ো হয়ে গেছিল বিকট? ভাবতেই গা শিরশির করে উঠল মাথুর।
—তারপরেই ঘটল সেই ভয়ংকর ঘটনা। একদিন দেখা গেল, কাঠুরে আর তার বউকে খুন করে পাহাড়ে পালিয়ে গেছে বিকট। বিশ্বাসঘাতক বিকট। যারা তাকে কুড়িয়ে এনে খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করল, কথা বলতে শেখাল, তাদেরকেই নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলে দূরের ওই পাহাড়ে পালিয়ে গেল সে।
বলতে বলতে গলা ধরে এল বোম্বাকাকুর। ভারী নরম মন তো! জাদুকর হলে কী হবে, বোম্বাকাকু কারও অনিষ্ট সইতে পারে না। দুনিয়ার পশু-পাখি তাই তার কথায় ওঠ-বোস করে। বনের বিপদ কি একটা? কিন্তু বোম্বাকাকু বাঁচায় তাদের সবরকমের বিপদ থেকে।
বিকট বোধহয় সর্বশেষ বিপদ। তাই এই বিরাট মিটিং।
জাদুকর বোম্বাকাকু মাথুর মনের কথাটা বুঝে নিয়ে বললে, ঠিক ধরেছিস। বিকট এখন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে বনের জন্তুদের কাছে। তাই এই মিটিং।
মাথু বললে, বিকট কি জন্তু খায়?
—তা খায়। না রেঁধেই খায়। তা খাক্। ঈশ্বরের নিয়ম, বাঘ হরিণকে খাবে। ব্যাং, পোকা-মাকড় খাবে। কিন্তু না খেয়ে শুধুমুধু মেরে ফেলাটা ঈশ্বরের নিয়ম নয়। বিকটের ওয়ার্জ বাহিনী ঠিক তা-ই করে।
—ওয়ার্জ কারা বোম্বাকাকু?
—ওয়ার্জারা এসেছে পাতাল থেকে। লক্ষকোটি বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষ এই পৃথিবীতেই দাপাদাপি করেছে। আগে ছিল জলে, পরে ডাইনোসর হয়ে ডাঙায় উঠেছে। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক যে জীবগুলো জলেই থেকে গিয়েছিল, তাদের একটা বংশ এই হিমালয়ের পাতালে ঠাঁই নিয়ে বেঁচে রয়েছে আজও। এদেরই কবজায় এনেছে বিকট। কীভাবে এনেছে কেউ জানে না। বিকটের হুকুম তারা মানে। বিকটের ডাকে পাতাল থেকে দলে দলে উঠে আসে। জন্তু-জানোয়ার-পাখি থেকে মানুষদের পর্যন্ত অকারণে মেরে ফেলে কিছু খায়, বাকি ফেলে যায়। ভয়ংকর এই ভয়ার্তদের খপ্পর থেকে জন্তুদের বাঁচাব বলেই ডেকেছি এই মিটিং, এমন সময়ে শুনলাম তোর কুকাম্বাবো মন্ত্র।
মাথু বললে, সাথু কি তাহলে আর বেঁচে আছে? এতক্ষণে ওয়ার্জের পেটে চলে গেছে!
বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল মাথুর।
—বোকা কোথাকার! বিকট সাথুকে নিয়ে গেছে আমাকে জব্দ করার জন্যে, ওয়ার্জ দিয়ে খাওয়ানোর জন্যে নয়।
—অ্যাঁ!
—আরে হ্যাঁ। আমি মিটিং ডেকেছি খবর পেয়েই ওয়ার্জ সৈন্য পাঠিয়েছিল বিকট, আমাকেই ধরে নিয়ে যাবার জন্যে। কিন্তু আমি তো অদৃশ্য, আমায় দেখতে পায়নি ওয়ার্জরা। তাই ধরেছে আমার ভাইপোকে। তবে…
—তবে কী?
—বেশি দূর যেতে পারেনি এখনও। প্যাঁচার কাছে খবর পেয়ে চর পাঠিয়েছিলাম আকাশে। ওই তো সাদা প্যাঁচা। বলো হে কী দেখে এলে।
ঝপঝপাস করে ডানা নেড়ে কাঠের গুঁড়ির ওপর উড়ে এসে বসল একটা ধবধবে সাদা প্যাঁচা। অনেক প্যাঁচা জীবনে দেখেছে মাথু—কালো, খয়েরি, সাদা, কিন্তু এত বড়ো প্যাঁচা কখনও দেখেনি। সাদা প্যাঁচা বললে, হু-হু-হু। ওয়ার্জ উড়ে চলেছে ঝড়ের মতো। ভোরের আগেই পৌঁছোতে হবে বিকটগড়ে। পিঠের ওপর বন্দি সাথু। জ্যান্ত। হু-হু-হু।
ঝপঝপাস করে ডানা মেলে উড়ে গিয়ে পাইনের ডালে বসল সাদা প্যাঁচা।
ঢোঁক গিলে মাথু বললে, ওয়ার্জ কি পাখি যে, উড়ে যাচ্ছে!
—তোর মুণ্ডু! হোভারক্র্যাফট কীভাবে চলে?
হোভারক্র্যাফটের নাম শুনেছে মাথু। জলের ওপর দিয়ে তা উড়ে যায় হাওয়ার গদিতে চেপে। ঢেউ কেটে ছোটে না, হাওয়ার গদি বানিয়ে নেয় জলের ঠিক ওপরে। তাই জল না ছুঁয়ে তিরবেগে পিছলে যায় জলের ওপর দিয়ে।
মাথু বললে, জানি।
বোম্বাকাকু ফের বললে, অক্টোপাস কীভাবে ছোটে?
এবার আমতা আমতা করে মাথু বললে, শুঁড় নেড়ে।
—তোর মুণ্ডু! জল ছুড়ে। ফানেলের মতো দেখতে সাইফনের মধ্যে দিয়ে জল টেনে নিয়ে ছুড়ে দিয়ে উলটো দিকে ছুটে চলে দৈত্যের মতো অক্টোপাসের দল। ওয়ার্জারাও সমুদ্রের দৈত্য। ডাঙায় উঠতে শিখেছে। ওদের ছুটে চলার কায়দাও অক্টোপাসের মতো। শরীরের তলায় ফানেল দিয়ে হাওয়া ছুড়ে দেয় মাটির দিকে, হাওয়ার গদির ওপর ভেসে উঠে ঝড়ের মতো ছুটে যায় সামনে হোভারক্র্যাফটের কায়দায়। বুঝেছিস?
—বুঝেছি। কিন্তু তোমার ওই সাদা প্যাঁচা বলল কেন ভোরের আগেই পৌঁছোতে হবে বিরাটগড়ে? কী হবে ভোরের পরে পৌঁছোলে?
—এতক্ষণে একটা প্রশ্নের মতো প্রশ্ন করেছিস। ওয়ার্জদের চোখ দেখেছিস তো?
—লাল ভাঁটার মতো।
—চোখের পাতা পড়ে?
—না।
—চোখের পাতা নেই বলেই পড়ে না। মাছের চোখের পাতা থাকে না, এদেরও তাই। এরাও একরকম মাছ। তাই অত আঁশটে গন্ধ পেয়েছিলি সিন্দুকে ঢুকে।
—খালি লেকচারই দিচ্ছ! ভোরের পর পৌঁছোলে কী হবে সেটা বলো না।
—তোর ব্রেনে ঘিলু কম আছে বলে এখনও বুঝতে পারছিস না। যাদের চোখে পাতা নেই চোখে রোদ লাগলে তারা সইতে পারে?
তাও তো বটে! লাফিয়ে ওঠে মাথু—এতক্ষণে বুঝেছি চাঁদের আলোয় ওয়ার্জ ব্যাটাচ্ছেলে কেন বেরুতে পারছিল না। অন্ধকার থেকে। যেই মেঘ এসে ঢেকে দিল, অমনি—
—সড়াৎ করে বেরিয়ে এল। এখনও তা-ই হচ্ছে। গাছের তলার অন্ধকার দিয়ে যেতে হচ্ছে ওয়ার্জকে চাঁদের আলোয় চোখ জ্বালা করে বলে। কিন্তু সূর্য উঠে পড়লে বাছাধনরা একেবারেই অন্ধ হয়ে যাবে। তাই ভোরের আগেই পৌঁছোতে হবে বিকটগড়ের পাতাল-অন্ধকারে। বুঝেছ মূৰ্খ?
মাথুর খুব রাগ হয়ে গেল এত জানোয়ারের সামনে তাকে মূর্খ বলায়। তেড়েমেড়ে বললে, সবই জানো তো, বসে বসে লেকচার ঝাড়ছ কেন? সাথুকে যদি বিকটগড়ে ঢুকিয়ে নেয়, তাহলে কি আর ওকে ফিরে পাবে?
সে ব্যবস্থাও হচ্ছে, সে ব্যবস্থাও হচ্ছে!—অদৃশ্য গলায় বলল বোম্বাকাকু, চৈতক!
টগবগ আওয়াজ শোনা গেল সাথুর পিছনে। ঘাড় ফিরিয়ে ও দেখল, ঘন নীল রঙের আশ্চর্য সুন্দর আর অদ্ভুত তেজালো একটা ঘোড়া ছুটতে ছুটতে আসছে কাঠের গুঁড়ির দিকে। দেখতে দেখতে খপাখপ শব্দ গুঁড়ির কাছে এসেই সামনের দু-পা শূন্যে তুলে শির-পা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল নীল ঘোড়া, চিঁ-হি-হি ডাক বেরিয়ে এল তার গলা দিয়ে, সেইসঙ্গে হেঁড়ে গলায় কথা—হুকুম করুন!
চৈতক,—অদৃশ্য গলায় বললে বোম্বাকাকু, মাথুকে পিঠে নিয়ে সিধে যা ওয়ার্জের পেছনে। সে যাচ্ছে গাছের ছায়া খুঁজে খুঁজে, দেরি হবে যেতে। তুই যাবি মাঠ-বন পেরিয়ে সোজা, যাবি তাড়াতাড়ি। ভোরের আগেই পৌঁছে যাবি।… ভোঁদড়, মোদড়, কোঁদড়!
শেষ হাঁকটা শুনে মানে বুঝতে দেরি হল মাথুর। অচম্বিতে গোঁফ নেড়ে তিনটে ভোঁদড় টপাটপ লাফ মেরে এসে দাঁড়াল কাঠের গুঁড়ির সামনে।
ভোঁদড়, মোদড়, কোঁদড়!—শোনা গেল বোম্বাকাকুর অদৃশ্য কণ্ঠস্বর—তোরা তিন ভাই মাছের যম। ওয়ার্জারাও আসলে ডাঙায়-ওঠা প্রাগৈতিহাসিক মাছ—তোদের খাদ্য। যা তোরা চৈতকের পিঠে।
টপাটপ লাফ দিয়ে ভোঁদড় তিনটে গিয়ে বসল নীল ঘোড়ার পিঠে, নাম যার চৈতক, রাণা প্রতাপের সেই বিখ্যাত ঘোড়া চৈতকের মতোই যার অপরূপ চালচলন। ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছে যায়। যেমন ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা, তেমনি পা ঠুকে কেশর ঝাঁকিয়ে ভেতরের তেজ বাইরে ফুটিয়ে তোলার আশ্চর্য ক্ষমতা। মুগ্ধ হয়ে গেল মাথু। ম্যালের পনি-স্ট্যান্ড থেকে টাট্টুঘোড়া ভাড়া করে ঘোড়ায় চড়া সে শিখেছে, কিন্তু এরকম তেজালো নীল ঘোড়ায় চড়ার স্বপ্নও কখনও সে দেখেনি। তাই বোম্বাকাকুর হুকুমের অপেক্ষা না রেখেই সে দৌড়ে গিয়ে টপ করে উঠে পড়ল চৈতকের পিঠে। ঝুঁকে পড়ে দু-মুঠোয় কেশর খামচে ধরে পায়ের গোড়ালি দিয়ে পেটে খোঁচা মেরে বললে কানে কানে, উড়ে চল চৈতক, পক্ষীরাজের মতো উড়ে চল।
গেলও তা-ই। শূন্যে ডানা মেলে না উড়লেও বাতাস কেটে বাতাসের চাইতেও বেগে ধেয়ে গেল নীল ঘোড়া। কানের কাছে তিন ভোঁদড় সমানে গেয়ে গেল ছুটে চলার গান। কেশর খামচে ধরে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল মাথু।
তিন নম্বর রহস্য: নিশীথ রাতের উড়ন্ত আতঙ্ক
মাথু তো আসছে ভাইকে বাঁচাতে, এখন দেখা যাক ভাইয়ের হালটা কী।
হঠাৎ সপাৎ করে সাপের মতো কনকনে ঠান্ডা একটা শুঁড় পেঁচিয়ে ধরল সাথুর মুখ, একই সঙ্গে পেঁচানো হয়ে গেল দু-হাত। দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে ধরলেও বুঝি এর চাইতে ভালো বাঁধা হত না। সেই অবস্থায় শূন্যে ঝুলিয়ে সাথুকে শুঁড়টা নিয়ে গেল ঝোপের অন্ধকারে।
সাথু সব দেখতে পেল, কিন্তু মুখ দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দটাও বার করতে পারল না। সে দেখল, দাদা তাকে ডাকছে, উত্তর না পেয়ে রেগে যাচ্ছে, এদিকেই তাকাচ্ছে, তারপরেই ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়ে কী যেন দেখছে। পরের মুহূর্তেই চোঁ-চা দৌড় মারল পেছন দিকে।
দেখে বড়ো কষ্ট হল সাথুর। দাদা তাকে ফেলে পালাল! কিন্তু কেন? প্রাণপণে বাঁধন ছাড়ানোর চেষ্টা করল সাথু কিন্তু ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে ফল হল উলটো—আলগা হওয়া দূরে থাকুক, আরও চেপে বসল বাঁধন। চাপের চোটে মাথুর মনে হল, বুকের পাঁজরাগুলো মড়মড় করে এবার ভেঙে না যায়! দম বন্ধ হয়ে এল তার, নাকে ভেসে এল একটা বিকট আঁশটে গন্ধ। শূন্যে তখনও ঝুলছে সাথু। ঝুলছে আর দুলছে। অজগর সাপের মতো বাঁধনটা নাকের তলা দিয়ে মুখের ওপর আরও শক্তভাবে চেপে বসায় দাঁতগুলোও, মনে হল, বুঝি গুঁড়িয়ে যাবে এবার।
এত কষ্ট সহ্য করতে পারল না সাথু। তার ওপর নিশ্বাসের কষ্ট। আস্তে আস্তে ঝাপসা আর অন্ধকার হয়ে গেল সামনের দৃশ্য। মাথুর মতো জ্ঞান হারাল সাথুও।
জ্ঞান ফিরে পেয়ে সাথু টের পেল, তার মুখের ও বুকের নাগপাশ অনেকটা আলগা হয়ে গেছে। সে চিত হয়ে শুয়ে আছে শক্ত মতো কিছু একটার ওপর। চোখে মুখে বাতাসের ঝাপটা লাগছে। তার জ্ঞান ফিরেছে এই বাতাসের ঝাপটাতেই। সাথু বুঝল, শনশন করে সে ধেয়ে চলেছে বাতাসের মধ্যে দিয়ে অত্যন্ত মসৃণ গতিতে।
শুয়ে রয়েছে সাথু যার পিঠে, ছুটছে সে। কিন্তু মাটির ওপর দিয়ে ছুটে চললে এত মোলায়েমভাবে ছুটে চলা তো সম্ভব নয়। তাও যদি হয় পথের ঝাঁকুনি থাকবেই।
কিন্তু আশ্চর্য যান ছুটেছে আশ্চর্য মসৃণ গতিতে। এ কোন্ ধরনের গাড়ি? এত জোরে যাচ্ছে, অথচ এতটুকু ঝাঁকুনি লাগছে না কেন? তবে কি শূন্যপথে উড়ে চলেছে মাথু? এরোপ্লেনে?
তা-ই বা কী করে হয়? মাথার ওপর গাছের অন্ধকার ডালপালা দেখা যাচ্ছে, তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশের তারা। তার মানে, গাছের তলা দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সাথুর বাহন। গাছের তলা দিয়ে তো এরোপ্লেন যায় না তবে?
মহা ধাঁধায় পড়ল সাথু। নাকে ভেসে এল সেই আঁশটে গন্ধ। কী বিশ্রী গন্ধ! মাছের বাজারে এমনি গন্ধ থাকে। এ যেন তার চাইতেও জঘন্য। দার্জিলিং বাজারে এরকম গন্ধ থাকলে বাজার ফাঁকা হয়ে যেত, লোকে মাছ কিনতেও যেত না। কিন্তু গন্ধটা আসছে কোত্থেকে? নিশ্চয়ই যার পিঠে সাথু চড়ে যাচ্ছে, তার গা থেকে। কিন্তু মাছের পিঠ কি এত শক্ত হয়? কচ্ছপের পিঠের মতো চ্যাটালো, এবড়োখেবড়ো কঠিন হয়? সবচেয়ে বড়ো রহস্য মাছ কি শূন্য দিয়ে উড়ে চলে বা মাছের কি অক্টোপাসের মতো শুঁড় থাকে?
উড়ন্ত মাছও যদি হয়, তাহলে সে ডাঙায় উড়ছে কী করে? মাছ তো জল ছাড়া থাকে না। শুধু কি তাই, গাছের তলা ছেড়ে কখনোই খোলা জায়গায় চাঁদের আলোয় আসছে না উড়ন্ত বিভীষিকা। ছুটছে প্রচণ্ড বেগে, কিন্তু এঁকেবেঁকে, ঘুরে-ফিরে। আলোয় ভরা খোলা জায়গা দেখলেই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে শুধু অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে।
চিত হয়ে শুয়ে এমনি হাজার ধাঁধা নিয়ে আকাশ-পাতাল ভেবেই চলল সাথু। খিদেয় তার পেট জ্বলে যাচ্ছে। পকেটভরতি টফি রয়েছে, কিন্তু হাত বাঁধা থাকায় পকেটে হাত দিতে পারছে না।
এইভাবে গেল অনেকক্ষণ। তারপর অনেক দূরে নিস্তব্ধ বনের মধ্যে শোনা গেল টগবগাবগ টগবগাবগ আওয়াজ।
ঘোড়া ছুটে আসছে। আসছে এই দিকেই।
অকস্মাৎ দ্বিগুণ হয়ে গেল উড়ে চলার বেগ। যেন নক্ষত্রবেগে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ধেয়ে চলল নিশীথ রাতের উড়ন্ত আতঙ্ক।
কাঠ হয়ে শুয়ে রইল সাথু। কান দিয়ে কেবল শুনল, দূর থেকে টগবগাবগ আওয়াজটা ক্রমশই এগিয়ে আসছে কাছে… আরও কাছে।
অনেকক্ষণ পরে আকাশ, মনে হল, আগের মতো অতটা অন্ধকার আর নেই। চাঁদের আলো ডুবিয়ে আকাশের গা সাদা হয়ে আসছে।
ভোর হচ্ছে।
উল্কার বেগও বুঝি এবার হার মেনে গেল। অসম্ভব বেগে ছুটে চলেছে রহস্যময় বাহন। পেছনে জেগে রয়েছে ঘোড়া ছুটে আসার শব্দ। আগে যা ছিল বনের গভীরে বহুদূরে, এখন তা অনেক কছে।
আচম্বিতে বন শেষ হয়ে গেল। গাছের তলা ছেড়ে খোলা জায়গায় এসে পড়েছে সাথু। মাথার ওপর আকাশ। চোখের কোণ দিয়ে দেখা যাচ্ছে, একটা বিরাট উঁচু পাহাড়। গাছপালা একদম নেই। রুখ্যু পাথর। কর্কশ। ধূসর। ভয়ংকর। রহস্যময় বাহন শূন্য দিয়ে রকেটের মতো ধেয়ে যাচ্ছে সেই পাহাড়ের দিকেই।
আচমকা পেছনে শোনা গেল একটা উল্লাসভরা চিৎকার—ওই তো সাথু! ওই তো সাথু! ওই তো সাথু!
দাদা চেঁচাচ্ছে।
চার নম্বর রহস্য: বিকটগড়ের অন্ধকার
ঝড়ের মতো বনের তলা ছেড়ে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল চৈতক।
অনেক আগে থেকেই আঁশটে গন্ধ পেয়ে তুরুক নাচ নাচতে শুরু করে দিয়েছে ভোঁদড়, মোঁদড় আর কোঁদড়। আর চেঁচাচ্ছে সমানে—ওয়ার্জের গায়ের গন্ধ! ওয়ার্জের গায়ের গন্ধ! ওয়ার্জের গায়ের গন্ধ!
চৈতক পর্যন্ত পশু-অনুভূতি দিয়ে বুঝেছে, ঠিক পথেই চলেছে সে। বিকটগড়ের নিশানা সে জানে। চলেওছিল সেই দিকে। এমন সময় বনের টাটকা হাওয়ায় ভেসে আসে একটা জঘন্য আঁশটে গন্ধ। ওয়ার্জ! ওয়ার্জই বটে! বেশি দূরে আর নেই। এমন সময় হঠাৎ শেষ হয়ে গেছিল বনতল। সামনেই একটুকরো খোলা মাঠ। তারপর খাড়াই পাহাড়—বিকটগড়! সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠেছিল মাথু—ওই তো সাথু! ওই তো সাথু! ওই তো সাথু!
সেই সঙ্গে ধুয়ো ধরেছে ভোঁদড়, মোঁদড়, কোঁদড়—মার! মার! মার!
বিকটগড় বিকট রাজার কেল্লা ঠিকই, কিন্তু মামুলি কেল্লা যেরকম হয়, তা নয়। বিকট রাজার নিবাস পাহাড়ের ভেতরে। ঢোকবার পথ কোথায়, তা কেউ জানে না—কেউ না।
জানে কেবল ওয়ার্জরা। তাদের রাজা বিকট। কাজেই পাহাড়ের কাছে গিয়ে পড়লে সাথুকে ফিরিয়ে আনা বোধহয় আর যাবে না। তাই দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে সামনে ধেয়ে গেল চৈতক।
ছুটছে চৈতক। পিঠে বসে মাথু দেখছে, পাহাড়ের তলায় একটা মস্ত গহ্বর। মুখটা এত বড়ো যে, পিঠে-পিঠে দাঁড়িয়ে চারটে হাতি গলে যেতে পারে। গহ্বরের মেঝে পরিষ্কার, এতটুকু উঁচু-নীচু নেই। পুরু বালি বিছোনো।
সাথুকে পিঠে নিয়ে ওয়ার্জ ছুটেছে সেই দিকেই।
চক্ষের পলকে ওয়ার্জের চেহারাটাও দেখে নিল মাথু দূর থেকে।
দীঘায় গিয়ে চিলড্রেন্স পার্কে সিমেন্টের তৈরি একটা পেল্লায় কচ্ছপ দেখেছিল মাথু। ফোয়ারার জলে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে অতিকায় একটা কচ্ছপ। দানব কচ্ছপটার পিঠে চড়ে কত খেলাই না খেলেছিল দুই ভাই! প্রায় সেইরকমই একটা দানব জীবকে মাটি থেকে একবিঘত ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখল মাথু। যেন মূর্তিমান কূর্ম-অবতার। বিশাল পিঠ—কুচকুচে কালো—কচ্ছপের পিঠের মতোই, কিন্তু চ্যাটালো, কচ্ছপের পিঠের মতো গড়ানে নয়। লম্বাটে কাটলেটের মতো গড়ন। চারপাশ দিয়ে ঝালর ঝুলছে এবং চলার বেগে হাওয়ায় উড়ছে সেই ঝালর। নিশ্চয়ই প্রচণ্ড বেগে হাওয়া বেরোচ্ছে ঝালরগুলোর আড়াল থেকে সারি সারি সাইফনের ভেতর দিয়ে। তাই ধুলো উড়ে যাচ্ছে মাটির ওপর থেকে উড়ে চলার পথে। ওয়ার্জের সামনের দিকটা দেখা যাচ্ছে না পেছন থেকে। তবে দুটো শুঁড় নিশ্চয়ই আছে সেইদিকে। তার একটা জাপটে রেখেছে সাথুকে বুকের ওপর দিয়ে, আর একটা শুঁড় জড়িয়ে রেখেছে তার মুখটা।
ওয়ার্জের সামনের দিকটা ভালো করে দেখা গেল এর পরেই। শিউরে উঠল মাথুর মতো ডানপিটে ছেলেও ভয়ংকর মুখ আর বিকট দাঁতের সারি দেখে।
চৈতক তখন লম্বা লম্বা লাফ মেরে নাগাল ধরে ফেলেছে হিমালয়ের ভয়ংকরের।
মার! মার! মার!—করে চেঁচাতে চেঁচাতে ভীষণ লাফ মেরে ভোঁদড়, মোঁদড় আর কোঁদড় গিয়ে পড়ল উড়ন্ত ওয়ার্জের পিঠে। পড়েই ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক করে ধারালো দাঁত বসিয়ে দিল পাইথন সাপের মতো মোটাসোটা শুঁড়দুটোয়।
ব্যস, আর যায় কোথায়! কুমিরের জিব নেই, মাছের গলাবাজি নেই। ওয়ার্জের স্বরযন্ত্র নেই নিশ্চয়ই, তাই অমন রামকামড় খেয়েও গলা থেকে এতটুকু শব্দ বেরোল না ওয়ার্জের। তা না বেরোলেও প্রচণ্ড ঝটকান মেরে ওয়ার্জ ছুড়ে ফেলে দিল সাথুকে গহ্বরের মধ্যে। ভাগ্যিস বালি ছিল, তাই তেমন চোট লাগল না। বালির ওপর পড়েই গড়িয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াল সাথু।
তড়াক করে চৈতকের পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে ভাইয়ের দিকে ছুটল মাথু।
ইতিমধ্যে দারুণ লড়াই লেগে গেছে তিন ভোঁদড় আর একা ওয়ার্জের মধ্যে। চিরশত্রু তারা। ভোঁদড়গুলো চটপটে, কামড় বসাতে ওস্তাদ। কিন্তু অসুরের শক্তি ওয়ার্জের গায়ে। তেমনি ভারী দেহ। এক-একটা ঝটকান মারছে, ভোঁদড় বেচারিরা ছিটকে ছিটকে পড়ছে এদিকে সেদিকে। মাথু সেই ফাঁকে তিরের মতো দৌড়ে গিয়ে দাঁড়াল সাথুর পাশে।
—দাদা!
—সাথু!
হঠাৎ হুড়মুড় আওয়াজ শোনা গেল গহ্বরের মধ্যে। ভোঁদড় তিনটেকে তিন দিকে আছড়ে ফেলে যন্ত্রণায় পাকসাট খেতে খেতে বালির ওপর দিয়ে গহ্বরের মধ্যে ধেয়ে এসেছে ওয়ার্জ। তার বড়ো বড়ো লাল চোখে যন্ত্রণা ফুটে বেরোচ্ছে। একে কামড়ের জ্বালা, তার ওপর আকাশের আলো। তাই দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ওয়ার্জ তিরের মতো ছুটে গিয়ে সাঁত করে ঢুকে পড়ল পাহাড়ের গায়ে একটা ফাটলে।
মাথু আর সাথু সেইদিকে যেই ফিরে তাকিয়েছে, অমনি গড়… গড়… গড়… গড়াম… গুম করে কানের পর্দা ফাটানো আওয়াজ শোনা গেল পেছনে। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে গেল গহ্বরের ভেতর।
চমকে ফিরে তাকাল দুই ভাই। বাইরের দৃশ্য আর দেখা যাচ্ছে না। ভোঁদড়-মোদড়-কোঁদড়-চৈতককে আর দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে না আকাশ, বন, মাঠ।
গহ্ববরের ওপর থেকে পাথরের দেয়াল নেমে এসে বন্ধ করে দিয়েছে ঢোকবার মুখ।
বাইরে বন্ধুরা, ভেতরে শত্রু।
বন্দি হয়েছে দুই ভাই বিকটগড়ের অন্ধকারে।
পাঁচ নম্বর রহস্য: সবুজ দৈত্যের খপ্পরে
ভয়াবহ অবস্থা।
যেমন অন্ধকার, তেমনি চুপচাপ। কোথাও কোনো আলো নেই। পাথরপুরীর বাইরে যে কী কাণ্ড চলছে, পাহাড়-কেল্লার ভেতরকার এই অন্ধকারে বসে থেকে তা বোঝবার কোনো উপায় নেই।
পাহাড়-কেল্লার ভেতরেও কী হতে পারে, তা-ই বা কে জানছে। আচমকা গড়-গড়-গড়-গড়াম-গুম শব্দে পেল্লায় পাথর ফেলে দিয়ে গহ্বরের মুখ যে বন্ধ করেছে, নিশ্চয়ই দূর থেকে সে দেখেছে মাথু আর সাথুকে। এখানে ওরা বন্দি হয়েছে তারই শয়তানিতে।
কে সে? বিকট স্বয়ং কী?
মাথু সাথুর হাত চেপে ধরল অন্ধকারে, সাথু দাঁড়িয়ে রইল দাদার গা ঘেঁষে। দাদার কাছছাড়া হয়েছিল বলেই একবার অন্ধকারের আতঙ্ক তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ইয়ং প্যালেস থেকে। সে আতঙ্ক এখানেও রয়েছে, পাহাড়ের ফাটলে ঢুকে বসে আছে। বেরিয়ে আসতে পারে যে কোনো মুহূর্তে।
দু ভাই বিষম ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল এদিক-সেদিক। মাথু দেখছে লাল থালার মতো চোখ-জোড়া, প্রতীক্ষায় রয়েছে তাদের নতুন করে আবির্ভাবের। এই অন্ধকূপে তারপর কী যে হবে, ভাবতেও রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে মাথুর।
সাথুর অবস্থাও তথৈবচ। দানব-বিভীষিকাকে এইমাত্র দেখেছে পিঠ থেকে ছিটকে পড়ার পর। বালির ওপর পড়েই গড়িয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে দেখেছে নরকের সাক্ষাৎ শয়তানকে। দেখেছে, অতিকায় কচ্ছপের মতো বিরাট এক প্রাণী, পিঠ তার চ্যাটালো, চারপাশে ঝিল্লীর ঝালর মাছের কানকোর মতো, সামনে দুটো ময়াল সাপের মতো কিলবিলে শুঁড়, দুটো শুঁড়ের ফাঁকে দু-হাত চওড়া মুখাবিবর, হাঙরের দাঁতের মতো সারি সারি ধারালো দাঁত সাজানো দু-পাটিতে, দাঁত তো নয়, ছোরার মালা বললেই চলে।
ভয়ংকর! সত্যিই ভয়ংকর! মূর্তিমান সেই ভয়ংকরের পিঠে সাথু উড়ে এসেছে এতটা পথ। বুঝতেও পারেনি। এখন এই অন্ধকারে যদি সে বেরিয়ে আসে? এমন সময় দেখা গেল আলোটা।
সবুজ আলো। মাথার ওপর অনেক উঁচুতে প্রথমে দেখা গেল একটা সবুজ আভা। ঘাড় বেঁকিয়ে দু-ভাই তাকাল ওপরে। ছাদ দেখা যাচ্ছে না। গোটা পাহাড়টাই ফোঁপরা নাকি?
অন্ধকারের মধ্যে সবুজ আলোর আভায় দেখা গেল কালো পাথর। তারপর আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল সবুজ আভা। পরিষ্কার দেখা গেল, একটা সবুজ বল দুলছে শূন্যে। সবুজ আভা ঠিকরে যাচ্ছে বলটার মধ্যে থেকে। আর সেই আভায় কী যেন টিকটিকির মতো সড়সড় করে নেমে আসছে দেয়ালের গা বেয়ে।
লোম খাড়া হয়ে গেল মাথু আর সাথুর, চুল পর্যন্ত শিরশির করে উঠল। মাথায় হাত দিলে ওরা টের পেত, খাড়া হয়ে গেছে মাথার চুলও। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রবেগে প্রায় তেলতেলে খাড়াই পাথুরে দেয়াল বেয়ে নেমে আসছে ও কোন্ বিভীষিকা?
সবুজ বলটা কিন্তু শূন্যেই ভাসতে ভাসতে নামছে। ঝুলছে না, কোথাও বাঁধা নেই, তার-টার কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না শুধু দেখা যাচ্ছে গোল একটা বল। অবিকল ফানুসের মতো, গ্যাসবেলুনের মতো ভেসে ভেসে নামছে নীচের দিকে। পাথুরে দেয়াল বেয়ে ভয়ানক যে প্রাণীটা নামছে টিকটিকির মতো, তাকে আলো দেখিয়ে নিয়ে আসছে যেন।
বিষম বিপদেই বোম্বাকাকুর নাম মনে পড়ে যায় মাথুর, মনে পড়ে যায় মোক্ষম সেই মন্ত্র, যে মন্ত্র উচ্চারণ করামাত্র জল-পাথর-হাওয়ার বাধা পেরিয়ে ডাক পৌঁছোয় জাদুকর খুড়োর কানে, সাহায্য আসে তৎক্ষণাৎ। ভয়ংকরকে নামতে দেখে সেই মন্ত্রই নতুন করে উচ্চারণ করল মাথু—কুকাম্বাবো! কুকাম্বাবো! কুকাম্বাবো!
কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। অন্ধকার থেকে ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে এল না কলো প্যাঁচা, নৈঃশব্দ্য খানখান করে অমানুষিক গলায় চেঁচিয়েও উঠল না কেউ।
কুকাম্বাবো! কুকাম্বাবো! কুকাম্বাবো!—এবার সাথুও গলা মেলাল দাদার সঙ্গে। প্রাণের ভয়ে গলা কেঁপে উঠল দুজনেরই। গমগম করে উঠল বিরাট মন্দিরের মতো শূন্য গহ্বর। পাথরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে মন্ত্রোচ্চারণ প্রতিধ্বনি পর প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে উঠে গেল উঁচুতে… আরও উঁচুতে… একসময় ক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে গেল দূরে।
তারপরেই বুকের রক্ত ছলকে উঠল দু-ভাইয়ের। নাঃ, বোম্বাকাকুর চর আসেনি। চোখের দেখা না দিতে পারলেও মুখের কথা যদি শোনাত, অনেকটা নিশ্চিত হতে পারত ওরা। তার বদলে ভেসে এল অমানুষিক অট্টহাসি।
মানুষের গলায় এমন রক্তজমানো স্বরে কেউ যে হাসতে পারে, ভাবতেও পারেনি মাথু আর সাথু। পাথরের দেয়াল থরথর করে কেঁপে উঠল সেই হাঃ হাঃ হাঃ অট্টহাসিতে।
মন্ত্র আউড়ে এমন হাসি শুনতে হবে কে জানত! সবুজ বল তখন আরও নীচে নেমে এসেছে। ভীষণ প্রাণীটাকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বোম্বাকাকুর কথা মনে পড়ে গেল মাথুর। বিকট নাকি পাইন গাছের মতো লম্বা। এ গ্রহের জীব সে নয়। দেয়াল বেয়ে যে নামছে, সেও পাইন গাছের মতো লম্বা। সারা শরীরে সবুজ আঁশ। হাত আর পায়ে ইগল পাখির মতো বাঁকানো আঙুল আর নখ। সবচেয়ে ভয়ংকর, কুৎসিত ও অমানুষিক তার মাথা। পৃথিবীর কোনো দু-পেয়ে বা চারপেয়ে জীবের মাথা এরকম হয় না। এ মাথা তাদেরই হয়, যাদের পা বলে কোনো প্রত্যঙ্গ নেই, যারা বুকে হেঁটে সরসরিয়ে যায় এঁকেবেঁকে। হ্যাঁ, সাপের মতোই চ্যাপটা সেই বীভৎস মাথা ষাঁড়ের মতো ঘাড়ে লাগানো। গলা বলে কোনো বস্তু নেই। চ্যাপটা মাথায় চুল বলেও কোনো পদার্থ নেই। ঘাড় ফিরিয়ে সাপের মতো সবুজ চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে বুককাঁপানো হাসির পর হাসি হেসে চলেছে অমানুষিক সেই জীব।
দেখতে দেখতে প্রায় মাথার ওপর এসে গেল সবুজ দৈত্য। অনেক উঁচু থেকেই দুম করে লাফ দিয়ে নামল ওদের সামনেই বালির ওপর। সঙ্গে সঙ্গে সবুজ আলোটিও লাফিয়ে শূন্যপথে নেমে এসে দুলতে লাগল বিচিত্র প্রাণীটার মাথার ওপর।
মাথু আর সাথুর সামনেই এখন দাঁড়িয়ে ভয়াবহ সেই দানব, মাথায় যে জাপানি পাইনের মতোই উঁচু। সারা গায়ে ঝকঝকে সবুজ আঁশ। মুণ্ডুটা সাপের মাথার মতো চ্যাপটা। ওদের দিকে ঝুঁকে পড়ল ভীষণ প্রাণী। এখন আর হাসছে না। শুধু চেয়ে আছে। সবুজ হিরের মতো ঝকঝক করছে দু-চোখ। যেন সবুজ স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে আসছে সবুজ মণি থেকে। নাক নেই, দুটো ফুটো আছে শুধু। গরম হলকা বেরুচ্ছে সেই ফুটো দিয়ে।
অন্য সময় হলে নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যেত মাথু আর সাথু। কিন্তু এখন অজ্ঞান হবার সময় নয়। তা ছাড়া বোম্বাকাকুর মন্ত্রে কাজ হল না কেন, এ চিন্তাটাও অস্থির করে তুলেছে মাথুকে।
কাজ তো হলই না, উলটে কিনা অমানুষিক ‘মানুষ’টা হা-হা করে হেসে উঠল মন্ত্ৰ শুনে! ছোটো ভাইয়ের হাত ধরে চোখ পাকিয়ে এমনভাবে বিকট প্রাণীর চোখের দিকে চেয়ে রইল মাথু, যেন ভয় কাকে বলে সে জানে না। আসলে তখন বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে কাটা ছাগলের মতো।
মস্ত দৈত্য মুণ্ডু নামিয়ে পান্না-চোখে সবুজ আগুন ছিটকিয়ে অনেকক্ষণ দেখল দু-ভাইকে। তারপর অসম্ভব হেঁড়ে গলায় বললে, অঃ। তোরাই তাহলে বোম্বার ভাইপো! দুটোকেই চাইছিলাম একসঙ্গে।
মাথু কেসে নিয়ে গলা সাফ করে বললে, তুমি বিকট?
—হাঃ হাঃ হাঃ! নামটা শুনেছিস দেখছি। কে বলল?
—বোম্বাকাকু, তোমার যম!
দপ্ করে দু-চোখ জ্বলে উঠল বিকটের। এক পা এগিয়ে মাথার ওপর আঁকশি-আঙুলওলা একটা হাত তুলেই সামলে নিল নিজেকে। হাজার বাজের মতো আকাশ-ফাটানো গলায় বললে, মুখ সামলে কথা বলবি। নইলে মুণ্ডু টেনে ছিড়ে ফেলব।
সাথু তখন ঠকঠক করে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতেই বলল, দাদা! এই দাদা!
ভয় পেয়েছে মাথুও। এ সময়ে উলটোপালটা কথা বললে বিপদ বাড়বে, প্রাণটাও যেতে পারে। তা ছাড়া বোম্বাকাকুর মন্ত্রে কাজ তো হচ্ছে না। মাথুর মনের কথা টের পেয়েই যেন আবার সেই অট্টহাসি হাসল বিকট। বললে, তোর বোম্বাকাকুর মন্ত্র এখানে খাটবে না। কেন জানিস?
কেন?—শুকনো গলায় বলল মাথু।
—ওর মন্ত্র ওর দেশেই চলে, অন্য দেশে চলে না। বিকটগড়ের বাইরে পর্যন্ত ওর জারিজুরি, ভেতরে নয়। এখানে আমার দেশ। বুঝেছিস?
হাড়ে হাড়ে বুঝেছে মাথু। এই জন্যেই এত আস্ফালন বিকট রাজার। পেয়েছে নিজের ডেরায়, বোম্বাকাকুর এলাকায় পড়লে বুঝতে পারত কত ধানে কত চাল! কিন্তু এসব কথা মুখে বলা ঠিক নয়। তাই চুপচাপ রইল মাথু।
বিকট বললে, তোদের ধরে এনেছি কেন জানিস?
কেন?—যেন জানে না, এমনি ভান করল মাথু।
—তোদের বোম্বাকাকুকে জব্দ করব বলে। টং রাজ্য আক্রমণ করব আমি, তা, তোদের বোম্বাকাকু নিজের চরকায় তেল না দিয়ে আমাকে ঘাঁটাতে আসছে কেন? তাই ওকে একটু শিক্ষা দেব।
বোম্বাকাকুর কাছে গিয়ে শিক্ষা দাও না।—বলেই ভয়ে কাঠ হয়ে গেল মাথু।
দপ করে ফের চোখ জ্বলে উঠেছে বিকটের। দাঁত কিড়মিড় করে বললে বাজের মতো চেঁচিয়ে, তোদের বোম্বাকাকুকে আমি ভয় করি ভাবছিস? যখন সময় হবে, ঠিক সামনে যাব। এখন একদম সময় নেই।
মনে মনেই বললে মাথু, সে চেষ্টাও তো করেছিলে বাছাধন! ওয়ার্জ পাঠিয়েছিলে, বোম্বাকাকু অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় হালে পানি পাওনি। ধরে এনেছ অসহায় দুটো ছেলেকে।
বিকট খুব ব্যস্ত মনে হল। দু-হাত সামনে বাড়িয়ে বালির ওপর রেখে বললে, উঠে আয়।
কোথায়?—ধারালো নখ আর বাঁকানো আঙুলের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললে মাথু।
—হাতে।
—কেন?
—ঘাড়ে চাপাব। নইলে উঠবি কী করে?
—কোথায় উঠব?
ওই হোথায়,—মাথার ওপর আঙুল তুলে দেখাল বিকট—আমার আস্তানা যেখানে। উঠে আয়।
আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। অবাধ্য হলে পাষণ্ড বিকট খামচে ধরে কাঁধে তুলে নেবে দু-ভাইকে।
সুড়সুড় নখের ওপর দিয়ে গিয়ে গাঁট খামচে ধরল দুজনে। আলতো করে মুঠো বন্ধ করে ঘাড়ের কাছে ওদের নিয়ে গেল বিকট। চ্যাটালো ঘাড়ে বসিয়ে দিয়ে বললে, চেপে ধর্।
দূর থেকে যেটা দেখতে পায়নি মাথু সেটা এবার দেখল কাছ থেকে। বিকটের ঘাড়ের কাছে শক্ত তারের মতো কতকগুলো রোঁয়া রয়েছে। এত শক্ত যে, হাতে জড়িয়ে ধরে টানলেও উপড়ে আসার সম্ভাবনা নেই।
দুই ভাই কষে ধরল কয়েকগাছি রোঁয়া। রোঁয়া না বলে স্টিলের তার বলাই উচিত, এত শক্ত। দেয়াল বেয়ে টিকটিকির মতো উঠতে লাগল বিকট। নখ দিয়ে খাঁজ আকড়ে ধরল বটে, থাবা চেপে ধরেও উঠতে লাগল টিকটিকির মতো। টিকটিকির পায়ের তলায় যেমন প্যাড থাকে—ভ্যাকুয়ম অর্থাৎ বায়ুহীন অবস্থায় দেয়াল আঁকড়ে ধরে, ঠিক সেইভাবেই ভ্যাকুয়ম হয়ে-যাওয়া থাবা দিয়ে খপাখপ করে দেয়াল ধরে ওপরে উঠে গেল বিকট।
সে যে কত উঁচুতে, তার হিসেব রাখার মতো মনের অবস্থা তখন নয় কারোই। মাথার ওপর ভাসতে ভাসতে সবুজ বলটাও ঠিক এল ওপরে। একটা আলসের মতো চওড়া চাতালে গিয়ে দাঁড়াল বিকট। কাঁধ থেকে আলতো করে ধরে দু-ভাইকে নামিয়ে দিল মেঝেতে। হেঁড়ে গলায় বললে, দেখলি তো, পালাবার চেষ্টা করিসনি। এক্কেবারে ছাতু হয়ে যাবি নীচে পড়লে।
মাথু আর সাথুর তখন মাথা ঘুরছে এত উঁচুতে ওঠায়।
টংকু!—হাঁক দিল বিকট।
কোনো সাড়া নেই।
—ওহো, টংকু তো আবার দরজা খুলতে জানে না। কেউ জানে না আমি ছাড়া। এদিকে আয়।
লম্বা লম্বা পা ফেলে তেলতেলে মসৃণ পাথুরে দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল বিকট। দু-হাত নাড়ল পাথরের সামনে অদ্ভুত কায়দায়। অমনি হড়হড় করে একটা চৌকোণা পাথর পিছলে ঢুকে গেল পাশের দেয়ালে। দরজার মতো ফোকর দিয়ে দেখা গেল একটা ঘর। টিমটিমে পিদিম জ্বলছে।
টংকু!
হুজুর।
বেরিয়ে এল একটা ছেলে। জংলী। মাথায় লম্বা চুল। খালি গা। চামড়ার কৌপীন। নেপালিদের মতো ছোটো ছোটো চোখ। গায়ের রং বেশ ফরসা। কিন্তু স্নান-টান না করার ফলে ভীষণ নোংরা।
—টংকু, এই দুটো ছোঁড়া তোর সঙ্গে থাকবে। তুই যা খাস, তা-ই খেতে দিবি। আমার তো কাঁচা মাংস নইলে চলে না, ওদের সইবে না। বুঝেছিস?
—বুঝেছি হুজুর।
—যা, ভাগ।
দু-ভাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল টংকু। আবার সেই রকম অদ্ভুত কায়দায় হাত নাড়ল বিকট। হড়হড় করে দেয়ালের মধ্যে থেকে পাথর সরে এসে বন্ধ করে দিল দরজা।
ছ নম্বর রহস্য: অন্ধকারে কে চেঁচায়
পিদিমের আলোয় টংকুর দিকে ফিরে দাঁড়াল মাথু আর সাথু। টংকুও ছোটো ছোটো চোখ মেলে তাকিয়ে রইল দু-ভাইয়ের মুখের দিকে। বলল, তোমরা কে?
মাথু সব বলল। সাথুর যা জানা ছিল না, মাথুর মুখে সব শুনে নিল সে। কাহিনি শেষ করে মাথু টংকুকে জিজ্ঞেস করল, এবার বল, তুমি কে?—আমি টং রাজ্যের রাজপুত্র।
—অ্যাঁ! তোমার কথাই তাহলে রেডিয়োতে শুনেছিলাম।
—হ্যাঁ, আমার কথাই শুনেছিলে। আমাকে চুরি করে এনেছে বিকট আমার বাবাকে জব্দ করবে বলে, যুদ্ধ না করেই টং রাজ্যকে ছারখার করবে বলে। যুদ্ধ করবার চেষ্টা করলেই আমাকে খুন করবে বিকট, এই হুমকি দিয়ে রেখেছে বাবাকে।
—একই হুমকি বোম্বাকাকুকেও দিয়েছে।
—হ্যাঁ।
তাহলে এখন কী করা?—মাথুর মাথা ঘুরছে।
সাথু অবশ্য এতক্ষণে সুস্থির হয়ে পকেট থেকে টফি বার করে মুখে পুরছে।
টংকু বললে, পালাতে হবে।
—পালাবে? এখান থেকে? কীভাবে?
—সেইটাই ভাবছি। তোমার ভাইয়ের, দেখছি, খুব খিদে পেয়েছে।
—আমারও খিদে পেয়েছে।
—তাহলে এসো, আগে খেয়ে নেওয়া যাক। আমার নিজের হাতের রান্না।
—রান্নাঘর কোথায়?
রান্নাঘর!—হেসে উঠল টংকু—এ কি তোমার বাড়ি পেয়েছ যে, রান্নাঘর, শোবার ঘর, বসবার ঘর আলাদা আলাদা থাকবে? সব এই ঘরে। ওই দেখ রান্না করার জায়গা।
একটা চ্যাটালো পাথরের বেদির ওপর উনুন পাতা রয়েছে। পাশে কাঠকুটো। ভুষো লেগে ওপরের পাথরে, সেখানে একটা ফুটো দেয়ালের মধ্যে ঢুকে গেছে।
মাথু বললে, রান্না করলে ধোঁয়া বেরোয় কোথা দিয়ে?
—ওই ফুটো দিয়ে। ওইটাই এ ঘরের চিমনি। ফুটোটার ভেতরে উঁকি দিল মাথু। আধ হাত ব্যাস, ভেতরে ঢোকাও যাবে না।
হাসল টংকু। বলল, পালাবার পথ নেই বন্ধু। ওখান দিয়ে শুধু ধোঁয়া যায়, মানুষ যেতে পারে না।
মাথু আর কথা বাড়াল না। খিদের চোটে নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত হজম হতে বসেছে! মোটা রুটি আর ডালই খেল গপাগপ করে। এমনকি যে সাথু কিনা খাওয়ার পদ নিয়ে রোজ অশান্তি করে মায়ের সঙ্গে, সে পর্যন্ত চাঁদমুখ করে গবগব করে খেয়ে নিল পোড়া রুটি আর আধসেদ্ধ ডাল!
জল খেয়ে আর একটা বেদির ওপর গিয়ে বসল তিনজনে। খড়ের বিছানা রয়েছে সেখানে। মন্দ ঘুম হবে না।
কিন্তু ঘুম পরে, আগে সলা-পরামর্শ। মাথু বললে, এখানে কথা বললে বিকট শুনতে পাবে না তো?
না।—বলল টংকু।
—তাহলে বল এখন কী করে পালানো যায়?
—বাইরে বেরিয়ে দেখে এসেছি মাথু পালানোর পথ নেই।
—বাইরে বেরিয়েছিলে? কীভাবে? দরজা তো বন্ধ।
হাসল টংকু, পিদিমের আলোয় ঝিকমিক করে উঠল সাদা দাঁত। বলল, ও দরজা আমি খুলতে জানি।
সে কী!—মাথু তো অবাক—তখন বিকট তোমায় ডাকল, দরজা বন্ধ ছিল বলে বেরোতে পারলে না। বিকটও বলল, দরজা খুলতে তুমি জানো না।
—ওসব আমার ভড়কি।
—ভড়কি!
—আরে হ্যাঁ। দরজা খুলতে শিখে ফেলেছি কিনা দেখবার জন্যেই ওইভাবে আচমকা হাঁক দেয় বিকট। ভয়ের চোটে দরজা খুলে যদি বেরিয়ে পড়ি, তাহলেই ধরবে ক্যাঁক করে। ওসব চালাকি আমার জানা আছে।
—কিন্তু তুমি দরজা খুলতে জানো তো পালাচ্ছ না কেন?
—পালাবার পথ নেই বলে।
চুপ করে রইল মাথু।
টংকু বললে, বিশ্বাস হল না? দেখবে নিজের চোখে?
মাথু বললে, হ্যাঁ, দেখব।
—তবে এসো।
পিদিম হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল টংকু। পাথরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললে, এদিকে এসো, দেখ কী করে দরজা খুলি।
—হাত নাড়বে কী করে? পিদিম নামিয়ে রাখ আগে।
—দূর বোকা! বিকট হাত নাড়ে ভড়কি দেওয়ার জন্যে।
—তুমি তো সব কিছুর মধ্যেই ভড়কি দেখতে পাও! নিজের চোখে দেখলাম, দু-হাত নেড়ে অদ্ভুত একটা ইশারা করল বিকট, আর তুমি বলছ ভড়কি!
—সত্যিই ওটা ভড়কি মাথু। কাছে এসো, দেখতে পাবে।
বলে পিদিমটা মেঝের কাছে নামিয়ে ধরল টংকু। বলল, কী দেখছ?
—পাথর।
—চৌকোণা ওই পাথরটা একটা আলাদা রকমের নয়?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ।
—এ-ই হল দরজা খোলার চাবি। এতে পা দিয়ে চাপ দিলেই স্প্রিংয়ের ধাক্কায় দরজা সরে যায়, হাতের ইশারায় নয়।
হাঁ করে চেয়ে রইল মাথু—তবে হাতের ইশারা করে কেন?
—যাতে আমরা তার পায়ের দিকে না তাকাই, হাতের দিকে তাকিয়ে থাকি। সবটাই ভড়কি।
‘ভড়কি’ কথাটা টংকুর কি খুব প্রিয়? হোক্গে ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান। সেন্টপলসে পড়েও মাথু যা বুঝতে পারেনি, নিরক্ষর জংলী ছেলেটা তা ঠিক জেনে ফেলেছে।
পিদিম নিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়াল টংকু। মেঝের চৌকোণা পাথরে পা রেখে বললে, এখন তোমায় বাইরে নিয়ে যেতে পারছি বিকট খেতে বসেছে বলে। আস্ত একটা গাধা নয়তো শুয়োর খাবে। সেই ফাঁকে ঝট করে চল, তোমাদের ঘুরিয়ে আনি।
বলেই টংকু চাপ দিল পাথরে। অমনি হড়হড় করে পাথর সরে গেল দেয়ালের ফাঁকে।
পিদিম হাতে হনহন করে বেরিয়ে গেল টংকু। যেন সবকিছুই তার চেনা। পেছনে মাথু আর সাথু ভয়ে ঢিপুস ঢিপুস করছে দুজনের বুক। বিকট ব্যাটা যদি এখন দেখতে পায়, গাধা আর শুয়োর ফেলে কাঁচা চিবিয়ে খাবে ওদের!
আলসের মতো চাতালটা চওড়া পনেরো ফুটের মতো, গোল বারান্দার মতো গোল হয়ে ঘিরে রয়েছে পুরো গহ্বরটা। গোল গম্বুজের ভেতরে যেন গোল-বারান্দা।
টংকু বললে, চাতালের ধারে অনেক ঘর—বিকটের শোবার জায়গা, খাবার জায়গা, মিটিং করার জায়গা।
মিটিং করার জায়গা! কাদের সঙ্গে মিটিং?—মাথুর কৌতূহল ফেটে পড়ে।
—ওয়ার্জদের সঙ্গে।
—ওয়ার্জদের মুখে কথা ফোটে? ভোঁদড়ের কামড় খেয়েও তো গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না!
—ওরা টেলিপ্যাথিতে পোক্ত।
—মন দিয়ে মনের কথা বোঝা?
—হ্যাঁ। বিকট নিজেও টেলিপ্যাথি জানে।
মাথুর মনে পড়ল নীচের ঘটনা। মাথুর মনের কথা বুঝে নিয়ে কেমন পটাপট উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল বিকট। তাই ঘাবড়ে গেল—তাহলে তো আমাদের পালাবার ভাবনা ও টের পেয়ে যাবে!
—ভড়কি দিলে টের পাবে না।
—তোমার তো সবেতেই ভড়কি! ভড়কিটা দেবে কী করে? মনকে ভড়কি দেওয়া যায়?
—খুব যায়। বিকট এলেই অন্য কথা ভাববে। তাহলেই ও কিছু টের পাবে না।
—ও। সে আর কী এমন! আমি ভাবব বাড়ির কথা। সাথু ভাববি—
স্কুলের কথা।—এই প্রথম কথা ফুটল সাথুর মুখে।
—হ্যাঁ, খুব ভালো করে ভাববি। কিন্তু ভাই টংকু, একটা জিনিস যে বুঝছি না।
—কী?
—ওয়ার্জরা এত উঁচুতে ওঠে কী করে? ঊড়ে?
—উড়ে তো বটেই, তবে পাটাতনের ওপর দিয়ে। নইলে ওদের ক্ষমতা কোথায়!
—কোন্ পাটাতন?
—এসো, দেখাচ্ছি।
একটু হেঁটেই একটা তক্তা দেখল টংকু। চওড়ায় প্রায় দশ ফুট। শ্যাওলায় হড়হড় করছে। পা রাখলেই হড়কে যায়। কস্মিনকালেও যে সে তক্তায় কেউ পা রাখেনি, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। অথচ ওয়ার্জরা উঠে আসে এই তক্তা বেয়ে কীভাবে?
পরক্ষণেই মাথুর মনে পড়ল বোম্বাকাকুর কথাগুলো। সাইফন দিয়ে জোরে হাওয়া ঠেলে হোভারক্র্যাফেটের মতো হাওয়ার কুশনের ওপর দিয়ে পিছলে যায় ওয়ার্জরা। এখানেও তাই পাটাতন—পাতাল থেকে সোজা উঠে আসার ব্যবস্থা।
আলসের ওপর ঝুঁকে দেখল মাথু, তক্তাটার যেন আর শেষ নেই, নামতে নামতে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
টংকু বললে পাশ থেকে, বন্ধু, বৃথা আশা। ও তক্তায় পা রাখলে সিধে পাতালে পৌঁছে যাবে! মানুষ ওখান দিয়ে নামতে পারবে না।
—তাহলে উপায়?
—উপায় নেই বলেই তো মুখ বুঁজে রয়েছি। এত উঁচু থেকে নামবার একটা পথ যদি পেতাম!
নিশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল টংকু। ওর শুকনো মুখ দেখে মাথুও আর কথা বলল না, হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল খোলা দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যে। নিজেই চাপ দিল দেবে-যাওয়া চৌকোনা পাথরে, আর অমনি হড়হড় করে দেয়ালের মধ্যে থেকে পাথর সরে এসে বন্ধ করে দিল দরজার মুখ। আর ঠিক সেই সময়ে একটা ঝুপ-ঝুপ-ঝপাস আর ঝটপট-ঝটপট আওয়াজ শোনা গেল ঘরের মধ্যে। দারুণ চমকে উঠে হাত থেকে পিদিম ফেলে দিল টংকু। ফস করে নিভে গেল পিদিম। নিঃসীম অন্ধকারে শোনা গেল একটা খটখটে শুকনো হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকির মতো কণ্ঠস্বর: সাবাস! এত ভয়?
সাত নম্বর রহস্য: কার পালক?
কাঠ হয়ে গেল মাথু, সাথু, টংকু। গলা দিয়ে টুঁ শব্দটিও বেরোল না। চুপি চুপি বেরিয়েছিল বাইরে। বিকট কি চেলা পাঠিয়েছে ঘরের মধ্যে সেই ফাঁকে?
ঘর নিস্তব্ধ। আচমকা আবার সেই ঝটপট শব্দ। তার পরেই সেই শুকনো ঘটঘটে হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকির মতো গলাবাজি—বলি, আক্কেলটা কী তোমাদের? শক্ত কাঠের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ কী? দেখতে পাচ্ছ না আমার অবস্থাটা?
গলার স্বরে শত্রুতা তো নেই। খ্যাঁকখ্যাঁক করছে ঠিকই, কিন্তু বন্ধুর মতো।
আরও আশ্চর্য, কালির মতো কালো এই অন্ধকারেও তাদের বেশ দেখতে পাচ্ছে, মনে মনে ভাবছে, ওরাও দেখছে তাকে।
তাই গলাখাঁকারি দিয়ে মাথু বললে, অন্ধকারে দেখব কী করে? আমরা কি প্যাঁচা?
—হু-হু-হু। তাও তো বটে! প্যাঁচা বলে আবার গালাগাল দেওয়া হচ্ছে। বলি, প্যাঁচা ছাড়া তোমাদের বারবার বাঁচাচ্ছে কে?
লাফিয়ে উঠল মাথু—তুমি!
—হ্যাঁ, আমি। বোম্বাকাকুর চর, তোমাদের উদ্ধার-কর্তা।
—এখানে এলে কী করে?
—চিমনির ফুটো দিয়ে গলে।
—কী করে বুঝলে ওখান দিয়ে আমাদের ঘরে আসা যায়?
—পাহাড় তন্নতন্ন করে দেখতে দেখতে দিনের আলো ফোটার আগেই একটা গর্তে ঢুকে বসে ছিলাম। জানোই তো, দিনের আলো আমার পছন্দ নয়। এমন সময়ে শুনি, অনেক দূরে কারা যেন কথা বলছে। কান খাড়া করতেই বুঝলাম, তোমরা কথা বলছ।
—তারপর?
—গর্তের বাইরে ভোঁদড়, মোঁদড়, কোঁদড়কে খবর দিলাম। ওরা খবর দিল পায়রাকে। পায়রা খবর দিল বোম্বাকাকুকে। বোম্বাকাকু পায়রা দিয়ে খবর পাঠিয়েছে চিমনি দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ার। খোঁজখবর নিতে হবে, তোমাদের সাহায্য করতে হবে, তার মন্ত্র তো অন্য রাজ্যে খাটবে না।
—তা জানি। কিন্তু তুমি কী সাহায্যটা করবে আমাদের? ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিস্সু তো দেখতে পাও না, তারার আলোয় ইঁদুর ধরো।
রেগে গেল প্যাঁচা—এখন দেখছি কী করে?
—আন্দাজে বুঝে নিচ্ছ।
—আজ্ঞে না। শুনে।
—শুনে! মানে?
—মানে, স্তন্যপায়ী জীবদের মতো আমাদেরও কান আছে মাথায়, যা আর কোনো পাখির নেই, ওদের আছে কেবল ফুটো। তাই আমরা যখন চেঁচাই, ভয় পেয়ে ইঁদুর, ছুঁচোরা পালায়। সেই আওয়াজ পেয়ে ছোঁ মারি ঠিক সেইদিকে। এই কান আছে বলেই তোমাদের নিশ্বাসের আওয়াজ শুনে বুঝতে পেরেছি কোথায় দাঁড়িয়ে তোমরা ভয়ে কাঁপছ।
—মোটেই না। ভয়ে কাঁপবার পাত্র আমরা নই। হঠাৎ ঝটপট করে উঠলে তো, তাই ভাবছিলাম আবার কে এল ঘরে। অথচ ওড়বার সময় একদম শব্দ করো না বলে তোমাদের আর এক নাম ‘উড়ন্ত বেড়াল’।
—শব্দ কি আর করছি সাধে? চিমনির ভূষোয় মাখামাখি হয়ে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে আমার!
চুপ! চুপ!—হঠাৎ ফিসফিস করে উঠল টংকু।
হড়হড় করে শব্দ হল দেয়ালে। পাশে সরে গেল পাথর। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা গেল, খোলা দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে জাপানি পাইন গাছের মতো লম্বা অসুর-সমান বিকট-রাজা।
সবুজ আলোটা কিন্তু এখন আর ভাসছে না মাথার পেছনে। তাই স্পষ্ট কিছু দেখা গেল না। শুধু শোনা গেল হেড়ে গলা—ঘুমোলি নাকি রে ছোঁড়ারা?
মাথুর গা টিপে দিয়ে টংকু বললে, আজ্ঞে না।
—তবে কী করছিস? ঘর অন্ধকার কেন?
—পিদিমটা হাত থেকে পড়ে গেল।
—অ। জ্বাল্ তাড়াতাড়ি।
খুটখাট আওয়াজ হল অন্ধকারে। চকমকি ঠোকার আওয়াজ। একটু পরেই জ্বলে উঠল পিদিম।
মিটমিটে আলোয় দেখা গেল বিকটকে। ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে। ডাইনোসরদের আমলে পৃথিবীতে ঢুঁ মারামারি করত এক জাতের ডাইনোসর। কিম্ভুতকিমাকার এই ডাইনোসরদের মাথার খুলিগুলো হত অবিকল ক্র্যাশ হেলমেটের মতো পঁচিশ সেন্টিমিটার পুরু। ঢুঁ মারামারির সময়ে পুঁচকে ব্রেনটা রক্ষে পেয়ে যেত হাড়সর্বস্ব এই খুলির জন্যে। মাথার সামনে নাকের জায়গায় থাকত বেশ কয়েকটা খড়্গ—গণ্ডারদের থাকে একটা—এদের থাকত অনেকগুলো।
বিকটকে কাছ থেকে দেখতে গিয়ে ঠিক এই ধরনের কতকগুলো খড়্গ মাথু দেখল। মাথার সামনের দিকে ছোটো ছোটো গজালের মতো ঠেলে রয়েছে। খুলিতে চুল নেই, হাড়ের ওপর কর্কশ চামড়া। কিন্তু এই খড়্গগুলোর জন্যে বড়ো ভয়ানক লাগছে সাপের মতো চ্যাপটা অদ্ভুত মুণ্ডুটা।
বিকটের দু-চোখের পাতা বন্ধ হয়ে খুলে গেল পরপর কয়েকবার। গভীর সন্দেহ যেন ঠিকরে আসছে সবুজ চোখ থেকে। কাজের মতো কড়কড়াৎ গলায় বলল, কী করছিলি?
মাথু আর সাথু তখন আড়ষ্ট। সাথু প্রাণপণে ভাবছে স্কুলের কথা, মাথু ভাবছে বাড়ির কথা। বিকট যে মনের কথা টের পায়!
বিকটের প্রশ্নের উত্তরে টংকু বললে, গল্প।
গল্প!—বিশ্বাস হল না বিকটের। হাত থেকে পিদিমটা নিয়ে ঘরময় ঘুরে এসে দাঁড়িয়ে গেল চিমনির তলায়, বললে, এ কী! এখানে এত পালক এল কেন?
দূর থেকেই দেখা গেল পালকগুলো। কালো কুচকুচে। নিশ্চয়ই সেই কালো প্যাঁচার। চিমনির ভেতর থেকে ঝপ করে নীচে পড়ে ডানা ঝাপটানোর সময় পালক খসিয়েছে।
একটা পালক তুলে নিয়ে পিদিমের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল বিকট। বললে, হুম! ভুষো লেগেছে দেখছি।
বলেই তাকাল উনুনের ঠিক ওপরে চিমনির দিকে। ঘাড় বেঁকিয়ে ফুটোর মধ্যে দিয়েও তাকাল ওপর দিকে।
প্যাঁচাটা কিন্তু ঘরের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া যা অন্ধকার, অন্ধকারে গা ঢেকে কোথায় যে লুকিয়ে আছে, তা কে বলবে!
ঘুরে দাঁড়াল বিকট। বলল, কার পালক?
মাথু ভাবছে বাড়ির কথা, সাথু স্কুলের।
টংকু বলল, জানি না তো।
—তোর উনুনে পালক পড়ে অথচ তুই জানিস না?
—সত্যিই জানি না।
—ফের মিথ্যে কথা! মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলব।
সটান আছড়ে পড়ে বিকটের বিকট পা জড়িয়ে ধরল টংকু—হুজুর, বিশ্বাস করুন, আমি জানি না অন্ধকারে চিমনির ফুটো দিয়ে কখন্ খসে পড়েছে জানতেও পারিনি।
অ।—একদৃষ্টে লুটিয়ে পড়া টংকুর দিকে চেয়ে রইল বিকট। তারপর চাইল মাথু আর সাথুর দিকে।
মাথুর মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল তক্ষুণি, সাথুর হাত ধরে এক টান মেরে সটান আছড়ে পড়ল বিকটের আর এক পায়ে। বললে কান্নাজড়ানো গলায় হুজুর, আমরাও জানি না।
—অ।
কিছুক্ষণ আর সাড়াশব্দ নেই।
একসময় পা-জোড়া ওদের মাথার তলা থেকে টেনে নিয়ে ধুপধাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বিকট, একটা কথাও আর বলল না।
হড়হড় করে একটা শব্দ হল তারপরেই। পায়ের চাপে বন্ধ হয়ে গেল পাথরের পাল্লা।
আট নম্বর রহস্য: কালো প্যাঁচা গেল কোথায়?
উঠে বসল টংকু। বলল, প্যাঁচাটা গেল কোথায়?
সাড়া নেই।
মাথুও ডাকল অন্ধকারের দিকে চেয়ে—কই গো, কোথায় গেলে তুমি? সাড়া দাও।
সাড়া নেই।
টংকু বললে, ভোজবাজি নাকি! বিকট যখন ঘরে, প্যাঁচাও তখন ঘরে। কিন্তু এখন গেল কোথায়?
মাথু বললে, ধুত্তোর প্যাঁচা! ওর জন্যেই প্রাণটা আর একটু হলেই যেতে বসেছিল। কী দরকার ছিল পালকগুলো খসানোর?
বিকট কিন্তু আঁচ করেছে।—বললে টংকু।
—নিশ্চয়ই করেছে। চোখের চাউনিটা দেখলে না?
—বুঝেছে, বোম্বাকাকুর চর এসেছে এখানেও।
—বুঝুক। আমাদের মনের কথা কিন্তু ধরতে দিইনি। তা-ই না সাথু?
ঘাড় নেড়ে সায় দিল সাথু।
টংকু কী বলতে যাবে, এমন সময়ে আবার হড়হড় করে খুলে গেল পাথরের পাল্লা।
দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বিকট।
সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে কাঠ হয়ে গেল তিনটে ছেলেই।
দাঁত কিড়মিড় করে বিকট বললে, কী গুজুর গুজুর করছিলিস রে?
বাড়ির কথা বলছিলাম।—বোকা-বোকা মুখ করে বলল টংকু।
বাড়ির কথা বলছিলি? বলাচ্ছি ভালো করে। সারাদিন কাজ কর্। এই নে কাঠ।—বলে চাতাল থেকে লম্বা লম্বা অনেকগুলো গাছের গুঁড়ি আর ডাল টেনে এনে ঘরের মধ্যে ছুড়ে দিল বিকট।
আর এই নে ঘাস।—বলে চাতাল থেকে রাশি রাশি ঘাসের বাণ্ডিল ধপাধপ ছুড়ে দিল ঘরের আর এক কোণে। বললে, এই ঘাস পাকিয়ে দড়ি তৈরি কর্ সারাদিন। সেই দড়ি দিয়ে ঘাসের আঁটিগুলো ভালো করে বাঁধ্ লম্বা লম্বা কাঠের মাথায়। আজকেই চাই বিকেলের মধ্যে বুঝেছিস?
ঘাড় কাত করে সায় দিল তিনজনে। কটমট করে সবুজ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বিকট বললে, কী কী হবে এ-ই নিয়ে জানতে ইচ্ছে করছে না?
ফস করে টংকু বললে, মশাল।
—সাবাস! মশালই হবে। তারপর কী করব মশাল দিয়ে জানতে চাস না?
—না।
তোর বাবার রাজ্যপাট পুড়িয়ে ছারখার করব।—হঠাৎ যেন ঢাক বেজে উঠল বিকটের গলায়—তোর বাবার এখনও শিক্ষা হয়নি। তোকে ধরে এনেছি, তবু আক্কেল হয়নি। তাই আজ রাতেই আক্রমণ করব টং রাজ্য। ওয়ার্জরা ধেয়ে যাবে পালে পালে, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, ওদের পথ আটকায়। বাকি কাজটা সারব আমি নিজে।
একটু থেমে পৈশাচিক উল্লাসে সারি সারি ছোরার মতো দাঁতের ঝিকিমিকি দেখিয়ে বিকট বলল, একটার পর একটা মশাল জ্বালব আর তোদের রাজধানীর পাঁচিলের ওপর দিয়ে ছুড়ে দোব। পুড়বে বাড়ি-ঘর-দোর-মন্দির-বাজার—সব! হাঃ হাঃ হাঃ। দেখি, তোদের বোম্বাকাকুর দৌড় কদ্দূর! হাঃ হাঃ হাঃ!
হাসতে হাসতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বিকট। হড়হড় হড়াস করে বন্ধ হয়ে গেল পাথরের পাল্লা।
অমনি হু-হু-হু-হু-হু করে কে যেন হেসে উঠল অমানুষিক গলায়।
প্যাঁচা!—একটুও না চমকে সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল মাথু।
নিঃশব্দে অন্ধকারের মধ্যে থেকে উড়ে এসে উনুনের উপর বসে পড়ল কালো প্যাঁচা।
টংকু বললে, ছিলে কোথায় এতক্ষণ?
—বিকটের পেছনে।
—বিকটের পেছনে?
—আরে হ্যাঁ। ও যেখানে গেছে, অন্ধকারে গা ঢেকে ঠিক পেছন পেছন উড়ে গেছি।
—ডানার আওয়াজ শুনতে পেল না!
—এমন উজবুকের মতো কথা বল!
—আমি উজবুক!
—আলবত তুমি উজবুক।
তাড়াতাড়ি মাথু বললে, আহা, ব্যাপারটা কী খুলে বলবে তো?
—একটু আগে তুমিই বললে না, আমাদের উড়ন্ত বেড়াল বলা হয়?
—তা বলেছি।… ও হ্যাঁ, উড়ন্ত বেড়াল। মানে, বেড়াল যেমন পা টিপে টিপে আওয়াজ না করে হাঁটে, তোমরাও তেমনি ডানার আওয়াজ না করে উড়ে বেড়াও, কেমন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। নইলে মাঠে ঘাটে খেত-খামারের ইঁদুর ধরব কী করে?
—তা বেশ কর। বিকটের পেছনে পেছনে উড়ে এলে এতক্ষণ, অথচ বিকট হন্যে হয়ে খুঁজছে তোমাকে!
—হু-হু-হু! একেই বলে লুকোচুরি খেলা।
—খেলা পরে হবে খন। এখন বল, কী দেখে এলে?
—তোমাদের পালানোর পথ।
পালানোর পথ!—লাফিয়ে উঠল টংকু—কোথায়, কোথায়?
—আস্তে, আস্তে। পথ পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু পালানোর ব্যাপারটা তোমাদের হাতে।
—সে আবার কী?
—এখান থেকে নীচে নামতে হবে। একটা কুণ্ড আছে, যার জলের মধ্যে থেকে ওয়ার্জরা উঠে আসে বিকটের হুকুমে। কুণ্ডের পাড়ে এক জায়গায় পাহাড়ের গায়ে একটা ঘুলঘুলি আছে বালিমাটি দিয়ে ঢাকা। সেখান দিয়ে সটকাতে হবে। হু-হু-হু!
এখান থেকে নামব কী করে?—মুখ শুকিয়ে গেল মাথুর।
—সেই জন্যেই তো বললাম, সব নির্ভর করছে তোমাদের হাতে।
—আমাদের হাতে!
—হ্যাঁরে, বাবা, হ্যাঁ। বিকট নিজে পালানোর জিনিস তুলে দিয়ে গেছে তোমাদের হাতে। এখন তাকে কাজে লাগাও।
বোকার মতো চেয়ে রইল মাথু। টংকু আমতা আমতা করে বললে, প্যাঁচাভাই, সবাই বলে, তোমাদের মগজে নাকি বুদ্ধি অনেক। আমি তা মানছি। ব্যাপারটা যদি একটু খুলে বল…
খুশি হল প্যাঁচা। মুখখানা তার এমনিতেই পণ্ডিতমশাইয়ের মতো গম্ভীর, এখন তা আরও উৎকট গম্ভীর করে বললে, ওই ঘাসের আঁটিগুলো কী দিয়ে বাঁধা?—ঘাসের দড়ি দিয়ে।
—বিকট বলে গেল ঘাস পাকিয়ে আরও দড়ি পাকাতে, তা-ই তো?
জয় মা কালী! জয় মা কালী!—বলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে তাথৈ তাথৈ নাচ আরম্ভ করে দিল মাথু—বুঝেছি প্যাঁচাদাদা, সব বুঝেছি। তুমি যদি সেন্ট পলসে পড়তে, জেনারেল নলেজে নির্ঘাত ফার্স্ট হয়ে যেতে।… সাথু।
—দাদা।
—খোল দড়িগুলো। ওগুলো বিকটের নিজের হাতে পাকানো দড়ি, দারুণ শক্ত।… টংকু।
—বল ভাই মাথু।
—এসো, দুজনে ঘাস পাকিয়ে আরও দড়ি পাকাই, মশাল বানাই, বিকেলের আগেই বিকটকে খুশি করে ভাগাই। তারপর বিকটেরই দড়ি গিঁট বেঁধে বেঁধে নামব নীচে।
—কথাটা শেষ করল টংকু।
ন নম্বর রহস্য: আশ্চর্য লেকে অদ্ভুত ঘূর্ণি
ঘাস নিয়ে দড়ি পাকাতে বসল মাথু, আর টংকু। সাথু, মনের আনন্দে গিঁট দিচ্ছে আঁটিতে বাঁধা ইয়া মোটা দড়িগুলোয়। গিঁট দিচ্ছে আর লম্বা দড়ি কুণ্ডলী পাকিয়ে রেখে দিচ্ছে খড়ের বিছানার তলায়।
প্যাঁচাও বসে নেই। চিমনির ফুটোয় মুখ ঢুকিয়ে হু-হু-হু-হু করে কত সাংকেতিক কথাই না বলে গেল সে! জবাব ভেসে এল ফুটো দিয়ে ওপর থেকে। কান খাড়া করে শুনল প্যাঁচা। তারপর বললে ছেলেদের, খবর পাঠিয়ে দিলাম ইগলকে। বোম্বাকাকুর অর্ডারও পেয়ে গেলাম।
কী, কী অর্ডার?—চোখ গোল গোল করে চেয়ে রইল তিনজনেই।
—বিকট দলবল নিয়ে বেরোবে সন্ধ্যায়। আমরা পালাব তখন। কিন্তু রাত কাটাব পাহাড়ের মাথায়।
—কেন, কেন, কেন?
—রাতেই ওয়ার্জরা দেখতে পায়, কাজেই বন-জঙ্গল-পাহাড়ে কোথাও নিরাপদ থাকব না আমরা। কিন্তু বিকটগড়ের মাথায় আমাদের খুঁজে দেখবার কথা মনেও হবে না বিকটের।
—তারপর?
—সকাল হলেই আসবে চৈতক। তার পিঠে চেপে যাবে ডিংলু ডাইনির কাছে।
—কেন?
—ওয়ার্জদের জব্দ করার মন্ত্র সে জানে।
—কোথায় থাকে সে?
—চৈতক জানে।
সারাদিন ঘাস পাকিয়ে দড়ি বানাতে গিয়ে হাতের ছাল-চামড়া উঠে গেল বেচারিদের। রাত হতে না হতেই হড় হড় হড়াম করে খুলে গেল পাথরের পাল্লা। ঘরে ঢুকল বিকট। হুঙ্কার দিয়ে বললে, বানিয়েছিস মশাল?
আজ্ঞে হ্যাঁ।—বলে একধারে ডাঁই করা পেল্লায় মশালগুলো দেখিয়ে দিল টংকু।
দেখে খুশি হল বিকট। দু-হাতে গাদা গাদা মশাল নিয়ে গিয়ে ফেলল বাইরে। খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেল, অন্ধকার চাতালে জ্বলছে জোড়া জোড়া লাল ভাঁটা। গোল বারান্দার মতো গোল চাতাল ঘিরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে অগুনতি ওয়ার্জ। উৎকট আঁশটে গন্ধে নিশ্বাস নেওয়া দায়।
আশ্চর্য শিখিয়েছে বটে বিকট। কিচ্ছু বলতে হল না ওয়ার্জদের, মশালগুলো শুঁড় দিয়ে তুলে নিয়ে পাচার করে দিল প্রত্যেকের কাঁধে। অনেকদূরে গম্বুজের মাথার কাছে ভাসন্ত সবুজ আলোয় এর বেশি কিছু দেখা গেল না। ওয়ার্জরাও সবুজ আলোয় বেশ মানিয়ে নিয়েছে, বোঝা গেল।
দরজার কাছেই পাশাপাশি দাঁড়ানো একজোড়া ওয়ার্জের পিঠে দু-পা রেখে সিধে হয়ে দাঁড়াল বিকট। দু-হাতে ঘোড়ার লাগামের মতো ধরল দু-জোড়া শুঁড়। তারপরেই তার খেয়াল হল, দরজা খোলা রয়েছে। লাফ দিয়ে নেমে এসে দরজার সামনে হাতের ইশারা (না, ভড়কি!) করে বন্ধ করে দিল দরজা।
ঘরে বসেই বাকি দৃশ্যটা কল্পনা করে নিল মাথু—ঝড়ের বেগে শ্যাওলা-ঢাকা ঢালু তক্তা বেয়ে নেমে যাচ্ছে একটার পর একটা ওয়ার্জ।
কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলল টংকু। নিঃশব্দে উড়ে গেল প্যাঁচা। একচক্কর দিয়ে এসে বললে, রাস্তা পরিষ্কার। ঝোলাও দড়ি।
সঙ্গে সঙ্গে দড়ির একদিকে বাঁধা হল একটা কাঠ। সেই কাঠ ঘরের ভেতরে রেখে দড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হল চাতালের ওপর দিয়ে নীচের দিকে। এর পর দরজা বন্ধ করে দিতেই কাঠ আটকে গেল ভেতরে। একে একে দড়িতে ঝুলে ছেলে তিনটে নেমে গেল নীচে। টান-পড়া সত্ত্বেও দড়ি খুলে এল না দরজার ফাঁক দিয়ে।
আলকাতরার মতো কালো জলে ভরা একটা কুণ্ডর পাড়ে এসে নামল তিনজনে। কালো প্যাঁচা নিঃশব্দে উড়ছে মাথার ওপর। সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল একদিকে। সত্যিই বালিমাটি দিয়ে ভরাট করা একটা গর্ত রয়েছে সেখানে। তিনজনে হাত চালিয়ে সরিয়ে ফেলল বালিমাটি। তারপরেই হামাগুড়ি দিয়ে সুড়ঙ্গপথে বেরিয়ে এল বাইরে।
কালো প্যাঁচা উড়ছে ঠিক মাথার ওপর। বলছে, চল, চল। ওপরে চল।
ওপরে চল বললেই কি যাওয়া যায়? ওই তো পাহাড়। খাঁজ-টাজ তেমন নেই। গাছপালার শেকড় পর্যন্ত নেই। হাঁচড়পাঁচড় করে উঠতে প্রাণ বেরিয়ে গেল ছেলে-তিনটের।
পাহাড়ের মাথায় ওঠবার পর কিন্তু সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল সুন্দর একটা হ্রদ দেখে। টলটলে জল হ্রদের। চাঁদের আলোয় চিকমিক করছে। পুরো পাহাড়টার মাথায় এত বড়ো একটা লেক যে রয়েছে, নীচে থেকে কল্পনাও করা যায় না। লেকের পাড়ে পা ঝুলিয়ে বসে গা-হাত-পায়ের বালিমাটি ধুয়ে নিল তিনজনে। এই সময়ে একটা ব্যাপার খেয়াল হতে খটকা লাগল মাথুর। পাহাড়ের মাথায় লেকে জল জমছে কোত্থেকে? নিশ্চয়ই বৃষ্টির জল। কিন্তু বাড়তি জল তো ঝরনার আকারে বেরিয়ে যাবার কথা। সেরকম কোনো ঝরনা তো দেখা যাচ্ছে না পাড়ে।
পুরো লেকটা পাক দিয়ে এল মাথু। নাঃ, কোথাও কোনো ঝরনা নেই, জল বেরিয়ে যাবার মতো পাড়ভাঙা খাঁজও নেই কোনো। অদ্ভুত ব্যাপার! শুধু চোখে পড়ল ছোটো ছোটো কয়েকটা ঘূর্ণি। পাড়ের গা ঘেঁষে তিন-চার জয়গায় জল যেন পাক দিয়ে দিয়ে নীচের দিকে ছুটছে।
কোথায় ছুটছে?
চাঁদের আলোয় দেখা গেল, জলের তলায় পাথরের গায়ে নলের মতো পরিষ্কার কয়েকটা ফুটো। জলে ঘূর্ণি উঠছে সেই কারণেই। জল ঢুকছে সেইসব ফুটোয়।
কীসের ফুটো ওগুলো?
ভাবতে ভাবতে মাথা হেঁট করে ফিরছে মাথু, এমন সময় কানে একটা আওয়াজ ভেসে এল—ফর-র-র ফর-র-র ফর-র-র… কোথাও কোনো শব্দ নেই। হ্রদের জলে ঢেউ নেই, আকশে হাওয়া নেই। অথচ ফর-র-র ফর-র-র আওয়াজটা শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। বিকটের নতুন কোনো কেরামতি নয় তো এটা? ভাবতেই আড়ষ্ট হয়ে গেল মাথু। হ্রদের ওপড়ে বসে সাথু অর টংকু। নিঃশব্দে পেছন পেছন উড়ছে কালো প্যাঁচা, সত্যিই উড়ন্ত বেড়াল যেন। মাথুর বডিগার্ড। চরকি-পাক দিচ্ছে মাথার ওপর। শুনেছে সে, অদ্ভুত আওয়াজটা সেও শুনেছে।
আচমকা নিস্তব্ধ রাতকে চমকে দিয়ে তীক্ষ, গলায় ডেকে উঠল কালো প্যাঁচা—হুউ-উ-উ-উ-উ হুউ-উ-উ-উ-উ হুউ-উ-উ-উ-উ!
ধড়ফড় আওয়াজ শোনা গেল তৎক্ষণাৎ। মাথুর প্রায় পায়ের কাছের একটা গর্ত থেকে শোনা গেল একটা ঘুম-জড়ানো বিরক্ত স্বর—কে রে অসভ্য চ্যাংড়া ছোঁড়া? নিশ্চিন্তে দু-দণ্ড ঘুমোতেও দিবি না?
তোর যম!—শূন্যে পাক দিতে দিতে বললে কালো প্যাঁচা—হুউ-উ-উ-উ!
মাথু চমকে গেছিল গর্তের মধ্যে কথা শুনে। এক পা সরে এসে সে হেঁট হয়ে দেখল, একজোড়া বিরাট লম্বা কান বেরিয়ে আসছে গর্তের মধ্যে থেকে, সেইসঙ্গে একটা মাথা।
খরগোশ! বুড়ো থুত্থুড়ে! গর্ত থেকে মুখ বাড়িয়ে উড়ন্ত প্যাঁচাকে দেখে বুড়ো বললে, আ মর্! হাড়হাভাতে রাতজাগা অকম্মার ধাড়ি কোথাকার! দিলি তো আমার ঘুমটা চটিয়ে।
—হুউ-উ-উ-উ! বোম্বাকাকুর হুকুম তোর এখন জেগে থাকার। ঘুমোচ্ছিস কোন্ আক্কেলে? মারব ছোঁ, দেখবি?
—আরে যা!
তবে রে!—বলে কলো প্যাঁচা সাঁত করে নিঃশব্দে গর্তের ওপরে নেমে আসতেই সুরুৎ করে গর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল সাদা খরগোশ। মাথু বলে উঠল, আহা, এ-ই কি মারামারির সময়?
কালো প্যাঁচা তখন রেগে গেছে—ওকে জ্যান্ত খাওয়া উচিত! ঘুমকাতুরে বুড়োহাবড়া কোথাকার! পইপই করে বোম্বাকাকু বলে দিয়েছে তোমাদের জন্যে জেগে বসে থাকতে, তবু ঘুমোচ্ছে? এতটুকু চোখের পর্দা নেই গা!
গর্তের মধ্যে থেকে মুখ বাড়িয়ে বুড়ো খরগোশ বললে, তোর মতো কি নিশাচর? ঘুম পেলে করবটা কী?
—ফের কথা!
মাথু সাত-তাড়াতাড়ি বললে, হয়েছে, হয়েছে। নো ঝগড়া। খরগোশদাদা, বেরিয়ে এসো লক্ষ্মীটি।
দাদা, বলতেই যেন গলে জল হয়ে গেল খরগোশ। বললে, ভারী ভালো ছেলে তো তুমি। সব্বাই আমাকে মুখনাড়া দেয় বুড়ো হয়েছি বলে। কিন্তু জানো ভাই, এই বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখাবার জন্যে বোম্বাকাকু পর্যন্ত তলব করে আমায় যখন-তখন।
—তা-ই নাকি? তা, কী কী ভেলকি তুমি জানো?
সে অনেক। আপাতত আমি ওয়ার্জদের নিয়ে গবেষণা করছি।—বলে হাই তুলল খরগোশ।
গবেষণ করছ?—চোখ নাচিয়ে বলল মাথু। ওর হাসি পেল মনে মনে। এইটুকু খরগোশ, এখনও মুখ টিপলে খুদ বার হয় তার আবার গবেষণা! মাথু বললে, কী গবেষণা খরগোশদাদা?
সে অনেক।… আমার এখন ঘুম পাচ্ছে, সব ভুলে যাচ্ছি।—বলে ফের হাই তুলল খরগোশ। তার চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে এল, ঘুমিয়ে পড়ে আর কি!
তাড়াতাড়ি মাথু বললে, কিন্তু ওয়ার্জরা যে আক্রমণ করতে গেছে টং রাজ্য। বোম্বাকাকুর সঙ্গেও টক্কর লেগেছে। বল না কী গবেষণা?
বোম্বাকাকুর নাম শুনেই যেন ঘুমের ঘোর একটু কাটল খরগোশের। আবার একটা হাই তুলে সে বললে, ওয়ার্জদের দফারফা করার মন্ত্র আমি আবিষ্কার করেছি।
—কী করে?
—রোজ রাত্রে ওদের চাল-চলন লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখে।
—কী মন্ত্ৰ?
—নেই যখন, পড়বে তখন।
—কী বললে?
নেই যখন, পড়বে তখন।—বলতে বলতে গলা জড়িয়ে এল খরগোশের।
—মানে কী?
মানে… ফর-র-র-র! ফর-র-র-র!—ফের নাকডাকা আরম্ভ হয়ে গেছে খরগোশের। গর্তের খরগোশের। গর্তের মধ্যে ঢুকে যাওয়ায় হাত বাড়িয়ে ধরে তাকে টেনে আনাও আর সম্ভব নয়।
মহাধাঁধায় পড়ল মাথু। ‘নেই যখন, পড়বে তখন’—এটা কি একটা মন্ত্র হল? ওয়ার্জদের মতো দুর্ধর্ষ প্রাগৈতিহাসিক আতঙ্কদের শুধু এই মন্ত্র আউরে কি খতম করা যায়?
ধুত্তোর! ঘুমের ঘোরে আবোল তাবোল বকেছে নিশ্চয়ই। গবেষণা না কচু! দানব ওয়ার্জদের গায়ে আচড় কাটাও যাবে না উদ্ভট এই মন্ত্র পড়ে।
‘নেই যখন, পড়বে তখন’ মন্ত্রটা কিন্তু তবু ঘুরঘুর করতে লাগল মাথুর মাথায়।
দশ নম্বর রহস্য: ডিংলু ডাইনির দানব-বাহন
ভোরের তখন সামান্য বাকি। পুবের আকাশ একটু একটু করে ফরসা হচ্ছে। এমন সময়ে অনেক নীচের জঙ্গল দেখিয়ে টংকু বললে, ওই দেখ।
সবার অগে জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল পাশাপাশি একজোড়া অতিকায় ওয়ার্জ। দু-পা দুটোর পিঠে রেখে দাঁড়িয়ে বিকট। শুঁড় ধরে রেখেছে লাগামের মতো। পেছনে পিলপিল করে বেরোচ্ছে ওয়ার্জবাহিনী। যেন পিঁপড়ের সারি। শেষ নেই।
বিকটগড়ের তলায় এসে ওয়ার্জ বাহনগুলোর পিঠ থেকে লাফিয়ে নামল বিকট। তরপর কী যেন করল পাহাড়ের গায়ে। বিরাট পাথর প্রচণ্ড শব্দে উঠে গেল ওপরের দিকে, খুলে গেল বিকটগড়ের সিংদরজা।
পিলপিল করে ওয়ার্জরা ঢুকল সেই দরজা দিয়ে। সবশেষে ঢুকল বিকট নিজে। পাহাড় কাঁপিয়ে প্রচণ্ড শব্দে পাথরের দরজা ওপর থেকে নেমে এসে বন্ধ করে দিল প্রবেশপথ।
কালো প্যাঁচা উড়ে এল মাথার ওপর। বললে, মাথু এবার তৈরি হও। চৈতক আসবে।
—তুমি?
—আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে।
—তুমি তো দিনে দেখতে পাও না।
—মূর্খ! ওসব তোমাদের ভুল ধারণা। ইচ্ছে করলে চোখের মণি ছোটো করে এনে দিনের বেলাতেও শিকার খুঁজতে পারি আমরা। চোখে কম আলো ঢোকালেই হল। কিন্তু অত ঝামেলা করব না। ডিংলু ডাইনির ডেরায় দিনটা কাটাব, রাত্তিরে দেখা হবে সেইখানে।
—কোন্খানে?
—যেখানে লড়াই হবে ওয়ার্জ আর বিকটের সঙ্গে।
কথা শেষ না হতেই বনের মধ্যে শোনা গেল টগবগ আওয়াজ। নীল ঘোড়া চৈতক ঘাড় বেঁকিয়ে কেশর ঝাঁকিয়ে শির-পা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল খোলা মাঠে। ওপরে তাকিয়ে সামনের দুপা নেড়ে হাঁক দিল চিঁহি-হি-হি-হি করে—কই হে, নেমে এসো।
যাই।—চিৎকার করে সাড়া দিল মাথু।
আধ ঘণ্টা পরে দেখা গেল, ঝড়ের মতো মাঠ-বন পেরিয়ে ছুটছে চৈতক। পিঠে ছেলেতিনটে পেছন-পেছন বসে কোমর জড়িয়ে ধরে। মাথু সবার সামনে, দু-হাতে ধরে রেখেছে কালো কেশর। মাথার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে উড়ে যাচ্ছে কালো প্যাঁচা।
এক ঘণ্টা পরে সূর্য ওঠার আগেই পাহাড়ের গায়ে দেখা গেল একটা কাঠের বাড়ি। দরজায় দাঁড়িয়ে এক বুড়ি, মুখে মিষ্টি-মিষ্টি হাসি। দুনিয়ায় সব ডাইনিরা তো পাজি হয় না, অনেক ভালো ডাইনিও থাকে। ডিংলু নিশ্চয়ই সেই ভালো ডাইনি।
চৈতক সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বুড়ি এগিয়ে এসে মাথুকে কোলে করে নামিয়ে নিল। সাথু আর টংকু নামল টপাটপ লাফ দিয়ে। একগাল হেসে ডিংলু বললে, আগে ঝটপট কিছু খেয়ে নে। এই ছেলে, তোর তো, দেখছি, খুব খিদে পেয়েছে।
কথাটা বলল সাথুকে, তার পকেটের টফির ভাঁড়ার তখন শেষ। ঘাড় কাত করে সে বললে, বড্ড!
—চল্। চৈতক, তুই আস্তাবলে যা। তোর আর দরকার নেই।
ঘাড় বেঁকিয়ে পা ঠুকে চৈতক বললে, সে কী, ছেলেদের নিয়ে যেতে হবে না টং রাজ্যে?
—ওয়ার্জ নিয়ে যাবে।
—ওয়ার্জ!
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। একব্যাটা ওয়ার্জকে পাকড়াও করে ঠুলি পরিয়ে কেমন পোষ মানিয়েছি দেখবি আয়।
কাঠের বাড়ির পেছনদিকে একটা অন্ধকার খুপরি ঘরে ডিংলু নিয়ে গেল সবাইকে। সেখানে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে একটা ওয়ার্জ বাঁধা, তার শুঁড়দুটো দিয়েই বাঁধা হয়েছে গুঁড়িতে। বড়ো বড়ো ভাঁটার মতো চোখজোড়ায় দুটো মস্ত ডেকচি উপুড় করে বেঁধে দেওয়ায় চোখে আলো লাগছে না। কিন্তু ফাঁক দিয়ে যেটুকু আলো যাচ্ছে, তাইতেই শিউরে শিউরে উঠছে ওয়ার্জটা।
ডিংলু বললে, দেখলি? গর্তের মধ্যে এই ব্যাটাকে পেয়েছি কাল সকালে। গর্তের মধ্যে থেকে চালিয়ে এনে বেঁধে রেখেছি তোদের বাহন করব বলে।
মাথু বললে, চালাব কী করে?
—খুব সোজা। ওর চোখ খুব নরম। একটু ছোঁয়া লাগলেই টনটন করে, আলো লাগলে যন্ত্রণা আরম্ভ হয়। তুই ওর পিঠে দাঁড়াবি। দু-পা দুটো চোখের কিনারায় রাখবি, চেপে রাখবি ডেকচিদুটো। তারপর ঠিক যেভাবে ঘোড়ার লাগাম টেনে ঘোড়া চালায়, সেইভাবে ওর শুঁড়দুটো ধরে চালাবি। দেখবি, ঘোড়ার চাইতেও জোরে ছুটবে।
বললেই হল!—চিঁহি-হি-হি করে বলে উঠল চৈতক।
—আরে, ওটা বললাম কথার কথা। মোট কথা ওদের চোখের ধার থেকে পা সরাবি না, বেয়াড়াপনা করলেই চোখে চাপ দিবি। বুঝলি?
কালো প্যাঁচা হাই তুলে বললে, তাহলে আমার এখন ছুটি?
হ্যাঁ।—বললে ডিংলু।
খেয়ে-দেয়ে নিয়ে ওয়ার্জের পিঠে চাপল তিন বন্ধু। ডিংলু ডাইনি দাঁড়িয়ে শিখিয়ে দিল কীভাবে চালাতে হবে ভয়ংকর ওয়ার্জকে। দু-হাতে শুঁড় বাগিয়ে ধরে মাথু বললে, তাহলে চলি ডিংলুমাসি?
—আয়, বাবা, আয়। জিতে আয়। আর হ্যাঁ, খরগোশ তোদের মন্ত্র শিখিয়েছে?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, অদ্ভুত একটা মন্ত্র।
—কী?
—‘নেই যখন, পড়বে তখন’।
—আর কিছু না?
—না।
—মানে কী?
—কিচ্ছু বলল না। ঘুমিয়ে পড়ল।—
গজগজ করতে লাগল ডিংলু—বুড়ো-হাবড়া কোথাকার! বোম্বার গুঁতো খেলে তবে বুঝবে।
—তাহলে চলি মাসি?
—আয়। ওরে চৈতক, তুই পথ দেখিয়ে নিয়ে যা।
কয়েক ঘণ্টা পরে দূর থেকে দেখা গেল উঁচু পাঁচিল। টং রাজ্যের রাজধানী। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা শহরের বাইরে গ্রামগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বহু মড়াও পড়ে রয়েছে। কাল রাতে বিকট হানা দিয়েছিল, তারই ফল।
পাঁচিলের ওপর পাহারাদার দাঁড়িয়ে। দূর থেকে পাহারাদার দেখতে পেল, বনের মধ্যে থেকে টগবগিয়ে বেরিয়ে আসছে নীলরঙের ভারী সুন্দর একটা ঘোড়া, আর ঠিক তার পেছনেই মূর্তিমান যমদূতের মতো একটা ওয়ার্জ।
ওয়ার্জ! হইহই আরম্ভ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। দিনের বেলায় ওয়ার্জ! কিন্তু একা, পালে পালে নয়, পিঁপড়ের মতো, পঙ্গপালের মতো অগুনতি নয়, শুধু একটা ওয়ার্জ মাটি থেকে একবিঘত উঁচু দিয়ে নক্ষত্রবেগে ছুটে আসছে নীল ঘোড়ার পেছন পেছন। এ আবার কী কাণ্ড!
ভালো করে দেখতে গিয়ে তাজ্জব হল টং-সৈন্যরা আরও একটা দৃশ্য দেখে। চোখ কপালে উঠে গেল স্বয়ং টং রাজারও।
ছুটন্ত ওয়ার্জের পিঠে দাঁড়িয়ে তিনটে ছেলে! একদম পিছনে তারই ছেলে—টংকু! হাত নাড়ছে বাবাকে দেখে।
এগারো নম্বর রহস্য: ওয়ার্জ-নিধনের বৈজ্ঞানিক মন্ত্র
পুরো রাজধানীটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। একদিকে সিংহদরজা। রাজার হুকুমে খুলে গেল সেই দরজা।
নীল ঘোড়ার পেছন পেছন ওয়ার্জ ঢুকল চত্বরে।
সে কী চিৎকার! খবর পেয়ে রাজধানীর সমস্ত লোক ভিড় করে এল টংকুর কাণ্ড দেখতে। তাদের হারানো রাজপুত্র শুধু ফিরেই আসেনি, এসেছে মহাশত্রু ওয়ার্জেরই পিঠে চেপে!
চত্বরের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল নীল ঘোড়া, তার পেছনে ওয়ার্জ। তখন রোদ উঠেছে। ডেকচি চাপা থাকলেও রোদের আঁচ লাগছে ওয়ার্জের চোখে। তার ওপর অত লোকের চেঁচামেচি, এতটা পথ দৌড়ে আসা, চোখের ওপর মাথুর পায়ের খোঁচা। কাঁহাতক আর সওয়া যায়! তিন বন্ধু পিঠে থেকে নেমে দাঁড়িয়ে শুঁড়দুটো নিয়ে যেই একটা খুঁটিতে বাঁধতে গেছে, অমনি এক ঝটকায় একদিকে ছিটকে বেরিয়ে গেল ক্লান্ত ওয়ার্জ।
যেদিকে গেল, ঠিক সেইদিকেই রয়েছে একটা বিশাল পাতকুয়ো। রাজধানীর ঠিক মাঝখানে বিরাট উঠোনের মাঝে এই কুয়োর ওপরে কোনো ঢাকনা নেই, ভেতরে জলও নেই। বিশাল একটা গর্ত, মুখের ফাঁদটা ছোটোখাটো একটা ডোবার মতো।
রাগে, অবসাদে, যন্ত্রণায় দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ওয়ার্জ ছুটে গেল সেই দিকেই, চোখে আলো লাগায় দেখতেও পেল না কী আছে সামনে।
কুয়োর এদিকের পাড় ডিঙিয়ে মাঝামাঝি ছিটকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটল কাণ্ডটা। ওপাড় পর্যন্ত পৌঁছোল না ওয়ার্জ, তার অগেই টুপ করে তলিয়ে গেল শুকনো কুয়োর তলায়। দুম-ধপাস করে একটা আওয়াজ শোনা গেল কয়েক সেকেন্ড পরেই। তারপর আর কোনো শব্দ নেই।
সবার আগে দৌড়ে গেল মাথু। উঁকি মারল কুয়োর ভেতরে। দেখল, তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে ওয়ার্জ। অক্কা পেয়েছে। এত উঁচু থেকে আছাড় খেয়ে কেউ বেঁচে থাকে না।
কিছুক্ষণ হাঁ করে সেইদিকে চেয়ে রইল মাথু। তারপরেই যা করল, তা দেখে প্রত্যেকেই ভাবল, ছেলেটা বুঝি এবার পাগল হয়ে গেছে।
দু-হাত মাথার ওপর তুলে মাথু, ধেইধেই নেচে নেচে ঘুরতে লাগল উঠোনময়, সেইসঙ্গে তারস্বরে চিৎকার—পেয়েছি! পেয়েছি! খরগোশের বৈজ্ঞানিক মন্ত্রের মানে পেয়েছি!
টংকু আর সাথু, দু-দিক থেকে দৌড়ে এসে মাথুর দু-হাত ধরে ঝুলে তার নাচ থামাল কোনোমতে। হাঁপাতে হাঁপাতে টংকু বললে, কী মানে, কী মানে মন্ত্রের?
—নেই যখন, পড়বে তখন।
—সেটা তো মন্ত্র! মানেটা কী?
—‘নেই যখন’ মানে, ওয়ার্জের দেহের নীচে মাটি নেই যখন, পড়বে তখন। দেখলে না, ওয়ার্জটা কুয়োর ওপরে ছিটকে যেতেই দেহের তলায় আর মাটি না পেয়ে আছড়ে পড়ল কুয়োর তলায়? নেই যখন, পড়বে তখন! নেই যখন, পড়বে তখন! নেই যখন, পড়বে তখন!
—কেন, কেন? মাটি না থাকলে আছড়ে পড়বে কেন?
—ডিংলু ডাইনি গর্তের মধ্যে ওয়ার্জকে বাগে পেয়েছিল ঠিক এইজন্যেই। ওয়ার্জ উড়ে চলে কীভাবে?
সাথু চট করে বললে, বোম্বাকাকু বলেছে, সাইফন থেকে হাওয়া ঠেলে দিয়ে হোভারক্র্যাফটের মতো হাওয়ার গদির ওপর দিয়ে।
—ঠিক, ঠিক, ঠিক! হাওয়ার গদিটা হবে কী করে শরীরের তলায় জমি না থাকলে?
টংকু তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললে, এই ব্যাপার!
—হ্যাঁ, এই ব্যাপার। আজ রাতেই ওয়ার্জ বাহিনীকে খতম করব ঠিক একই কায়দায়।
—কী করে মাথুভাই, কী করে?
—গেট খোলা থাকবে। সেখানে বিরাট একটা গর্ত খোঁড়া হবে। গর্তের এপাড়ে মশাল জ্বালানো থাকবে। ওপাড়ে ওয়ার্জারা পৌঁছোলে তাদের চোখে ধাঁধা লেগে যাবে, গর্ত আছে, দেখতে পাবে না। ফলে ঝপাঝপ পড়বে গর্তে? জয় মা কালী, পাঁঠাবলি! জয় মা কালী, পাঁঠাবলি!
এই দাদা, বল্ ওয়ার্জ বলি।—শুধরে দিল সাথু।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, জয় মা কালী ওয়ার্জ বলি!
টং রাজ্যের রাজার নাম কিংটং। যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। ফরসা ধবধবে। চোখদুটো ছোটো। চওড়া চোয়াল। থ্যাবড়া নাক। একমাথা চুল পিঠ পর্যন্ত এসে পড়েছে। টংকুর মতোই আদুর গা। কোমরে কেবল একটা কৌপীন গাছের ছালের।
এ রাজ্যের সব্বারই পোশাক এইরকমের। খালি গা, কোমরে কৌপীন। এ ব্যাপারে রাজা-প্রজায় তফাত নেই।
টংকু দুই বন্ধুর হাত ধরে নিয়ে গেল বাবার কাছে। বিশাল দু-হাত বাড়িয়ে তিনটি ছেলেকেই একসঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন কিংটং। প্রথমেই বললেন, পালালি কী করে?
টংকু তখন বললে সব কথা। কিংটং শুনে চোখ লাল করে বললেন, শয়তান বিকট কাল রাত্রে এসেছিল। জ্বলন্ত মশাল ছুড়ে, ওই দেখ না, বাড়ি-ঘর-দোর পুড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানীর ভেতরে ঢুকতে পারেনি দরজা বন্ধ ছিল বলে, ভাঙতে পারেনি আমরা পাঁচিলের মাথা থেকে তির ছুড়েছিলাম বলে। আজ রাতেও হারামজাদা আবার আসবে।
হ্যাঁ, আসবে।—বললে টংকু।
আসুক।—বললে মাথু, আমি যা বললাম ঠিক তা-ই করুন। ওয়ার্জ বাহিনী ধ্বংস হবে।
এখুনি করছি।—বলেই হাঁকডাক আরম্ভ করে দিলেন কিংটং।
বারো নম্বর রহস্য: আসছে বিকট, আসছে ওয়ার্জ! তারপর?
সন্ধের আগেই সব হয়ে গেল।
বিশাল ফটক খুলে ফেলা হল। বিশ হাত চওড়া আর একশো হাত গভীর খাড়াই গর্ত কাটা হল সেখানে। চৌকোণা গর্ত। সে গর্তে একবার পড়লে টিকটিকি ছাড়া আর কেউ উঠতে পারবে না।
গর্তের এদিকে রাজধানীর মধ্যে সারি সারি খুঁটি পোঁতা হল। খুঁটির মাথায় রইল রজন, ধুনো, গালা ইত্যাদি দাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি বাঁধা পুঁটলি। প্রত্যেকটা খুঁটির গোড়ায় চকমকি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একজন জংলী।
রাত একটু গভীর হতেই পাঁচিল থেকে প্রহরী বললে চেঁচিয়ে—সাবধান! আসছে বিকট!
খোলা ফটক দিয়ে দেখা গেল সেই দৃশ্য। গর্তের ওপাশে বেশ বড়ো একটা মাঠ। তারপর জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে ওয়ার্জ। মাটি ছেয়ে গেছে। যেদিকে দু-চোখ যায় সেইদিকেই দেখা যাচ্ছে তাদের কিলবিলে ময়াল সাপের মতো সর্বনাশা শুঁড়ের আন্দোলন। মাটি ছুঁয়ে নেই কেউ, মাটি থেকে ইঞ্চিছয়েক ওপর দিয়ে বায়ুবেগে ছুটে আসছে খোলা ফটক লক্ষ করে। চারপাশের ঝিল্লী-ঝালর উড়ছে হাওয়ায়। উড়ছে তলার শুকনো ধুলোবালি। মেঘের মতো ধুলো উড়ছে জঙ্গল ছাড়িয়ে মাথার ওপর।
ওয়ার্জ বাহিনীর মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে বিকট নিজে। দু-পা দুটো বিরাট ওয়ার্জের পিঠে রেখে শুঁড় দুটো লাগামের মতো বাগিয়ে ধরে বুক চিতিয়ে ছুটে আসছে সে ডাকাবুকো দৈত্যের মতো। তারার আলোয় এর বেশি কিছু দেখা গেল না। কোনো শব্দও শোনা গেল না। কেন না বিকট ওয়ার্জদের হুকুম দিচ্ছে টেলিপ্যাথিতে। মনোবিজ্ঞানের জনক সিগমন্ড ফ্রয়েডও বলেছেন, মনে হয়, যেন সেকালে মানুষে মানুষে ভাব-বিনিময় ঘটত টেলিপ্যাথির মাধ্যমে। বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দূর থেকে মনে মনে সংযোগ-সাধনের এই ক্ষমতা লোপ পেতে বসেছে। প্রাগৈতিহাসিক ওয়ার্জদের তাই টেলিপ্যাথির দৌলতে নিঃশব্দে চলনা করে আনছে টেলিপ্যাথির মাস্টার বিকট—ভিন্নগ্রহের বিস্ময় বিকট—পৃথিবীর বিভীষিকা বিকট!
মাথুই টং রাজ্যের সাময়িক সেনাপতি। রাজা কিংটং কড়া হুকুম দিয়েছেন, মাথু যা বলবে, প্রত্যেকটা সৈন্য তা-ই শুনবে। সৈন্যরা ভয় পেয়েছে গেট খুলে ফেলার পর। গত রাতে এই গেট বন্ধ ছিল বলেই রক্ষা পাওয়া গেছে। কিন্তু একফোঁটা ছেলেটা তাথৈ তাথৈ নেচে নিয়ে রাজা কিংটংকে এমন এক মন্ত্র ঝেড়েছে যে, রাজা নিজেই এখন তার কথায় ওঠবোস করছেন।
মাথু হুকুম দিয়েছে, ওয়ার্জ বাহিনী ফটকের মাঝের গর্তের কাছকাছি আসার আগে যেন মশাল জ্বালানো না হয়। ওয়ার্জরা গর্ত থেকে যখন প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরে, চেঁচিয়ে সংকেত দিল মাথু—জ্বালাও!
সঙ্গে সঙ্গে খুঁটির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা জংলীরা খটাখট চকমকি ঠুকে একইসঙ্গে জালিয়ে দিলে সবকটা মশাল।
কুচকুচে কালো অন্ধকারে অকস্মাৎ অতগুলো মশাল দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠার পরিণামটা হল বিস্ময়কর। টং রাজ্যের মানুষদের পর্যন্ত চোখ ধাঁধিয়ে গেল সেই আলোয়। গর্তের ওপরে ঝড়ের মতো আগুয়ান ওয়ার্জ বাহিনীরও চোখ ধাঁধিয়ে গেল এবং যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠল তারা।
কিন্তু থামবার উপায় নেই, পেছন ফেরবার উপায় নেই। স্বয়ং বিকটের সবুজ চোখ পর্যন্ত ধাঁধিয়ে গেছে মশালগুলো আচম্বিতে জ্বলে ওঠায়। ফটকের ফাঁকে যে বিরাট ফাঁদ পাতা, তা সে দেখতে পাচ্ছে না তালঢ্যাঙা হওয়া সত্ত্বেও। দেখতে পাচ্ছে না বলেই সে ধরে নিয়েছে, ভীত জংলীগুলো প্রাণের ভয়ে মশাল জালিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে চাইছে ওয়ার্জদের, ভাবছে, বুঝি আলো দেখে ঘাবড়ে গিয়ে পিট্টান দেবে দুর্ধর্ষ ওয়ার্জ বাহিনী। তাই টেলিপ্যাথিতে হাজার হাজার ওয়ার্জকে হুকুম দিল বিকট—এগিয়ে চল! এগিয়ে চল! চোখে বাঁধা লাগলেও এগিয়ে চল! আলো জেলে ধোঁকা দিচ্ছে ওরা, ভুলো না ধোঁকায়। এগিয়ে চল! ঝাঁপিয়ে পড় দু-পেয়ে মানুষগুলোর ওপর। দাঁতের সুখে কামড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেল হারামজাদাদের, লণ্ডভণ্ড করে ছাড় টং রাজ্যকে। আজ আমাদের সুদিন। টং রাজ্যের পতনের পরেই পৃথিবীকে জয় করব অমি, তোমরাই শাসন করবে পৃথিবীর সমস্ত দেশ। আবার ফিরিয়ে আনব প্রাগৈতিহাসিক রাজত্ব!
এই যে রণ-হুঙ্কার—কুটিল-করাল ওয়ার্জদের প্রতি এগিয়ে চলার নির্দেশ, তার একটা কথাও শুনতে পেল না টং রাজ্যের কোন মানুষ। শুধু দেখল—প্রাণ হাতে নিয়ে দেখল—বিষম আতঙ্কে চোখ ছানাবড়ার মতো করে দেখল, ময়াল সাপের মতো জোড়া জোড়া শুঁড় মাথার ওপর পতাকার মতো লকলকিয়ে হাজারে হাজারে ওয়ার্জকে চারপাশে নিয়ে নরক-থেকে-উঠে-আসা মূর্তিমান রাক্ষসের মতো ভীমবেগে ধেয়ে আসছে বিকট।
তারপরেই ঘটল সেই ঘটনা। ওয়ার্জ বাহিনীর প্রথম সারি তলিয়ে গেল একশো হাত গভীর গর্তের তলায়। একটা প্রচণ্ড হুড়মুড় আওয়াজ শোনা গেল বটে—অত উঁচু থেকে পড়ার ফলে নিশ্চয়ই ছাতু হয়ে গেল কয়েকশো ওয়ার্জ—বিকট কিন্তু থামল না। আসলে সে দেখতেই পায়নি চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায়। কী হচ্ছে সামনে, কিচ্ছু, ঠাহর করতে পারছে না সে। ফলে প্রথম সারির ওয়ার্জরা তলিয়ে যাওয়ার পর ঝপাং করে আছড়ে পড়ল দ্বিতীয় সারি… তারপর তৃতীয় সারি… চতুর্থ সারি… সারির পর সারি।
তখন আর থামবার উপায় নেই। ওদিকে দম বন্ধ করে টং রাজ্যের লোকজন এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আচমকা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল বিষম উল্লাসে—জয় মাথুর জয়! জয় টংকুর জয়!
চিৎকার শুনেই ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল বিকট। কিন্তু কিছু, বোঝবার আগেই ঠিক সেই সময়ে শূন্যেপথে ছুটতে ছুটতে ওর ওয়ার্জ বাহনদুটো এসে পড়ল খাদের পাড়ে।
চক্ষের নিমেষে ব্যাপারটা বুঝে নিল বিকট। একপলকের জন্যে দেখল, ঠিক সামনেই হাঁ করে রয়েছে বিরাট একটা গর্ত, অনেক নীচে অন্ধকারে কাতারে কাতারে ছটফট করছে হাড়গোড়ভাঙা অজেয় ওয়ার্জ বাহিনী। এইটুকু দেখার সঙ্গে সঙ্গেই মশালের-আলোয়-চোখ-ধাঁধিয়ে যাওয়া ওয়ার্জ দুটো ঝাঁপ দিল গর্তের ওপর। ঠিক তার আগেই বিকট নিজেই বিরাট এক লাফ মেরে ওয়ার্জদের পিঠ থেকে ঠিকরে গিয়ে পড়েছে গর্তের গায়ে। একশো হাত নীচে পড়লে ছাতু হয়ে যেত বিকট। কিন্তু এখন সে চার হাত-পায়ের নখ আর থাবা দিয়ে খপ করে সেঁটে গেল গর্তের দেয়ালের গয়ে।
সেকেন্ড কয়েক ওইভাবে থাকার পরে বিকট অবিকল টিকটিকির মতোই সর সর করে দেয়াল বেয়ে উঠে এল ওপরে। ওর ঘাড়-মাথার ওপর দিয়ে তখনও বিরাট বিরাট সব ওয়ার্জ আছড়ে পড়ছে গর্তের মধ্যে। তাই একেবারে পাড়ে উঠতে পারল না বিকট, পাছে সে ধাক্কার চোটো ঠিকরে পড়ে গর্তে।
দেখতে দেখতে ওয়ার্জ বাহিনীর শেষ সারিটাও ঝাঁপ দিল মৃত্যু-গহ্বরে। আর একটা ওয়ার্জও অবশিষ্ট নেই!
এদিকে ভীষণ চেঁচাতে চেঁচাতে তির ছুড়ছে টং রাজ্যের সৈন্যরা, কিছুতেই পাড়ে উঠতে দেবে না বিকটকে, গর্তের মধ্যেই মারবে তির বিঁধিয়ে। কিন্তু শক্ত আঁশে তির বিঁধবে কেন? ঘাড়ে যা দু-একটা বিঁধল, টান মেরে উপড়ে অনল বিকট। তারপর পাড়ে উঠে জ্বলন্ত চোখে একবার তাকাল রাজধানীর দিকে। দু-চোখে যেন সবুজ আগুন জ্বলছে। দু-হাত মাথার ওপর তুলে তীব্র হুঙ্কার দিয়ে বললে, আমি আবার আসব। দেখি এবার তোদের কে বাঁচায়!
বলেই টলতে টলতে এগিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে।
তের নম্বর রহস্য: বিকটগড়ের কলকবজা
রাজা কিংটং বললেন, যাচ্ছে কোথায় হতভাগা?
টংকু বললে, বিকটগড়ে। আর থাকার জায়গা কোথায়?
মাথু কিছু বলল না। ঠোঁট কামড়ে চুপ করে কী যেন ভাবছে সে।
কিংটং বললেন, কী ভাবছ সেনাপতি?
মাথুকে রাজা সেনাপতিই করবেন ঠিক করেছেন। এইটুকু ছেলের এত বুদ্ধি! কিন্তু সেনাপতির আসল বুদ্ধির খেলা তখনও দেখেননি রাজা। দেখলেন এর পরেই। আচমকা লাফিয়ে উঠে ‘চৈতক! চৈতক!’ বলে চেঁচাতে লাগল মাথু।
কী হল? কী হল? চৈতককে কেন?—রাজা কিংটং তো হতভম্ব! তবে কি সেনাপতির অযত্ন হচ্ছে?
মাথুর কোনো দিকে খেয়াল নেই, ‘চৈতক! চৈতক!’ করে চেঁচিয়ে চলেছে সে।
কাছেই ছিল চৈতক। কেশর ঝাঁকিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে টগবগিয়ে এসে দাঁড়াল মাথুর সামনে। বললে, কী হুকুম সেনাপতি? বোম্বাকাকুর কাছে যাবে?
—আরে না! চল বিকটগড়ে। সাথু, টংকু, উঠে আয় পিঠে।
সাথু দাদার কথার অবাধ্য হয় না কখনও, হাঁচড়-পাঁচড় করে উঠে পড়ল চৈতকের পিঠে। টংকু মাথুর হাত টেনে ধরে বললে, মরতে চলেছ নাকি? বিকট এখন ভয়ংকর। একা ওর কাছে যাওয়া মানেই মৃত্যু।
মাথু এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে গিয়েই একটিমাত্র লাফ মেরে উঠে পড়ল চৈতকের পিঠে। বললে, তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি! বিকট কেল্লায় পৌঁছানোর আগেই আমাদের পৌঁছোতে হবে!
মাথু!—চিৎকার করে বললে টংকু, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? বিকটগড়ে ঢুকতে চাও?
—না, না, না! বিকটগড়ের মাথায় উঠতে চাই। যেতে যেতে বলব আমার প্ল্যান। চলে এসো। রাজা কিংটং, আপনার সৈন্যসামন্ত নিয়ে আপনিও আসুন আমার পেছনে। আমি চললাম সবার আগে বিকটগড়ের দরজা বন্ধ করতে!
টংকু ততক্ষণে চৈতকের পিঠে উঠে পড়েছে। উল্কাবেগে গর্তের পাশে সামান্য একহাত চওড়া জমির ওপর দিয়ে ফটক পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল নীল ঘোড়ার পিঠে তিন সওয়ার।
বিকটগড়ের দরজা বন্ধ করতে চাও?—ছুটন্ত চৈতকের পিঠে বসে মাথুকে জিজ্ঞেস করল টংকু।
হ্যাঁ।—বলল মাথু।
হাতে তার চৈতকের কেশর, চোখ সামনে, উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে, হাওয়ায় চুল উড়ছে।
—কীভাবে?
—কলকবজা বিগড়ে দিয়ে।
—কীসের কলকবজা?
—যে কলকবজা দিয়ে পাথরের পাল্লা বন্ধ হয় আর খোলে।
—কোথায় আছে তা?
—কোথায় আছে জানি না, তবে যে শক্তি দিয়ে কলকবজা চলছে, সেটার হদিস জানি।
—কোথায়?
—পাহাড়ের মাথায়।
—বিকটগড়ের মাথায়?
—হ্যাঁ।
—সেখানে তো কিছু নেই।
—কিচ্ছু নেই?
—লেক ছাড়া কিচ্ছু নেই।
—লেকটাই কলকবজা চালায়।
—লেক কলকবজা চালায়! বলছ কী!
—ঠিকই বলছি টংকু। পাথরের অত ভারী পাল্লা কোনো সাধারণ স্প্রিংয়ে চলে না।
—তবে কীসের স্প্রিংয়ে?
—জলের চাপে।
—জলের চাপে?
—হ্যাঁ। জলের চাপের জোর কত, তা তো জানো না। পাহাড়ের মাথার জল বেরিয়ে যাবার পথ পায় না দেখেই খটকা লেগেছিল। এখন অল ক্লিয়ার।
—মানে?
—জলে কতকগুলো ঘূর্ণি দেখেছিলে?
—ছোটো ছোটো ঘূর্ণি?
—হ্যাঁ।
—দেখেছি। কিন্তু সেগুলো তো ছোটো ছোটো ফুটো দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছিল বলে—
—টংকু, ওই ফুটোগুলো স্বাভাবিক ফুটো নয়, পাথরের নল। ওই নলের মধ্যে দিয়ে অত উঁচু থেকে জল টেনে নিয়ে সেই চাপ দিয়ে পাথরের পাল্লা খোলার কলকবজা বানিয়েছে বিকট।
—অ্যাঁ! বল কী!
—আমি সেই কলকবজা বিগড়ে দেব। দরজা আর খুলবে না, বিকট আর কেল্লায় ঢুকতে পারবে না।
—ফুটো বন্ধ করে?
—না, লেকের জল খালি করে দিয়ে।
—অসম্ভব।
—কেন অসম্ভব?
—তিনজনে কেন, তিনশো লোকও বিকট ফিরে আসার আগে লেকের জল খালি করতে পারবে না।
—বুদ্ধি থাকলে এই তিনজনেই পারব।
—কী করে পারবে?
—সেটা গিয়েই দেখবে।
নক্ষত্রবেগে বিকটগড়ে পৌঁছে গেল চৈতক। তখন চাঁদ উঠেছে। পাহাড়ের মাথায় উঠে গেল তিন বন্ধু। শোনা গেল সেই শব্দ—ফর-র-র-র!… ফর-র-র-র! বুড়ো খরগোশ ঘুমোচ্ছে। মাথু তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাল না। বলল, লেকের পাড়ে আলগা পাথর আছে, দেখতে পাচ্ছ?
—আছে।
—বড়ো বড়ো গোল পাথর। তিনজনে মিলে ঠেলা মারলেই গড়িয়ে পড়বে জলে। কেমন?
তা তো পড়বেই।—বললে টংকু।
—তাহলে এসো, হাত লাগাই। পাথর ফেলে জল উপচে ফেলে দিই। তাহলেই নলের মধ্যে দিয়ে জলের চাপ কমে যাবে, পাথরের পাল্লা আর উঠবে না।
কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল টংকু। তারপর দু-হাতে মাথুকে জড়িয়ে ধরে বললে, তোমার এত বুদ্ধি!
চোদ্দো নম্বর রহস্য: ভোঁ দৌড় দিল কে?
ভোরের আলো যখন পুবের আকাশে, পাহাড়চূড়ো থেকে দেখা গেল, জঙ্গলের মধ্যে থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে আসছে বিকট। শ্রান্ত, ক্লান্ত, রক্তাক্ত।
টলতে টলতে এসে বিকটগড়ের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়ালের পাথরে চাপ দিল বিকট। ঘড়ঘড় ঘড়াংঘট করে একটা শব্দ হল, পাল্লা উঠল না। আবার জোরে চাপ দিল বিকট। আবার ঘড় ঘড় ঘড়াং ঘট করে শব্দ, পাল্লা এক ইঞ্চি উঠেই ফের পড়ে গেল দড়াম করে।
সাপের মতো চ্যাপটা মুণ্ডু ঘুরিয়ে পাহাড়ের মাথার দিকে তাকাল বিকট। চেয়ে রইল সেকেন্ড কয়েক। অত উঁচু থেকেও পাথরের আড়লে দাঁড়িয়ে ভয়ের চোটে ঘেমে গেল মাথু, সাথু আর টংকু। দেখল, বিকটের সবুজ চোখে যেন পাতা পড়ছে না। সবুজ চোখের মণি দিয়ে যেন সবুজ রোশনাই ছিটকে আসছে। একটু একটু করে দারুণ সন্দেহ ঘনিয়ে উঠল দু-চোখের মণিতে।
মাথু, সাথু আর টংকুকে দেখতে পেয়েছে কি বিকট? ভগবান জানেন। কিন্তু সন্দেহ যে একটা করেছে, তা ঠিক। তাই আচমকা দৌড়ে এসে খাড়াই পাহাড় বেয়ে টিকটিকির মতো ওপরে উঠতে লাগল সে। ওপর থেকে তার আঁশওলা গা আর চ্যাপটা হাড়-সর্বস্ব মাথা দেখে মনে হল, প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোনো বিদঘুটে ডাইনোসর উঠে আসছে পাহাড় বেয়ে। বিচিত্র এই সরীসৃপ-দানবের চার হাত-পা চলছে ভীষণ বেগে, পাহাড়ের মাথায় উঠতে তার বেশি সময় লাগবে না।
ঠিক এই ভয়টাই করেছিল মাথু। তৈরিও হয়েছিল। পাহাড়চূড়োর লেকে চারপাশের পাড় থেকে পাথর গড়িয়ে ফেলবার পরেও অনেক পাথর থেকে গিয়েছিল পাড়ের ওপর। এইরকম খানকয়েক গোল পাথর এমন আলগা যে, আঙুল দিয়ে ঠেলা দিলেও গড়িয়ে যায়। এই ধরনের তিন-তিনটে পেল্লায় পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বিকটের কীর্তি দেখছিল ছেলেতিনটে।
এখন যেই দেখল বিকট সরসর করে উঠছে পুরাকালের সরীসৃপদানবের মতো, সঙ্গে সঙ্গে চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল তিনজনের মধ্যে। তিনজনেই একইসঙ্গে গায়ের জোরে ঠেলা মারল পাথর তিনটেতে।
হাওয়াতেই দুলছিল পাশাপাশি তিনটি গোল পাথর, এখন রামধাক্কা খেতেই গড়গড় গড়াম গড়াম করে পাহাড়ের মাথা থেকে সোজা নীচের দিকে ছিটকে গেল পাশাপাশি তিনটে পাথর।
পাহাড়ের ঠিক মাঝামাঝি উঁচুতে তখন পৌঁছেছে বিকট। আচমকা প্রচণ্ড শব্দ শুনে চাইল ওপর দিকে। একটা পাথর এলে সাঁ করে সরে যেতে পারত একপাশে, পাশ কাটিয়ে বেঁচে যেত। কিন্তু পাশাপাশি তিনটে পাথরকে পাশ কাটানোর সময় সে আর পেল না। দড়াম করে একটা পাথর তার পুরু হাড়ের খুলিতে লেগে ঠিকরে গেল বাইরের দিকে।
অন্য প্রাণীর খুলি হলে নির্ঘাত চুরমার হয়ে যেত। কিন্তু বিকটের খুলি নিশ্চয়ই বেশ কয়েক ইঞ্চি মোটা হাড় দিয়ে তৈরি, তাই গুঁড়িয়ে গেল না। তবে তার মাথা ঘুরে গেল, হাত ফসকে গেল দেয়াল থেকে। টলমলিয়ে উঠেই ঠিকরে পড়ল অত উঁচু থেকে একদম নীচে পাহাড়ের গোড়ায়।
মাথু, সাথু, টংকু হইহই করে উঠল পাহাড়ের ওপর থেকে। বিকট বাবাজি এবার নিশ্চয়ই অক্কা পেয়েছে!
কিন্তু হায় রে, এত সহজে পরলোক যাওয়ার প্রাণী নয় বিকট। লেগেছে খুবই, হয়ত হাড়গোড়ও ভেঙেছে। কিন্তু মরেনি।
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে পড়ে থাকার পর তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বেশ কয়েকটা বড়ো সাইজের পাথরের ঢিল তুলে নিয়ে দমাদম ছুড়তে লাগল পাহাড়ের চূড়ো লক্ষ্য করে।
সে কী টিপ! প্রত্যেকটা পাথর অতিকায় বিকটের ভয়ানক হাতের জোরে এসে পড়তে লাগল মাথু, সাথু, টংকুর আশপাশে। একটা পাথর গায়ে লাগলেই আর রক্ষে নেই, থেঁতলে যেতে হবে!
প্রমাদ গণল মাথু, সাথু, টংকু। কিন্তু ভগবান বুঝি মুখে তুলে চাইলেন ঠিক এই সময়ে। একটা হইহই-রইরই চিৎকার শোনা গেল জঙ্গলের মধ্যে। থমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল বিকট। কিন্তু সে কিছু দেখবার আগেই পাহাড়ের মাথা থেকে ছেলেতিনটে দেখে নিল কারা আসছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দামামা বাজাতে বাজাতে।
হ্যাঁ, আসছেন রাজা কিংটং আর তাঁর সৈন্যসামন্ত!
বিকট দেখতে পেয়েছে এবার সৈন্যদের। দু-হাতে বড়ো বড়ো পাথর নিয়ে সে রুখে দাঁড়াল সামনা-সামনি যুদ্ধ করবে বলে। সে একাই একশো। হাজার মানুষ-সৈন্যকে পিষে মেরে ফেলার শক্তি সে রাখে।
কিন্তু হাজার সৈন্য তো নয়, জঙ্গলের মধ্যে থেকে দুম-দুম-দুম-দুম করে ঢাক পিটতে পিটতে বেরিয়ে আসলে লাখে লাখে সৈন্য। টং-রাজ্য ভেঙে পড়েছে পলাতক অসুর বিকটকে খতম করার জন্যে। মেয়েরা এসেছে বঁটি নিয়ে, ছেলেরা গুলতি নিয়ে, পুরুষরা তির-ধনুক-সড়কি নিয়ে। আসছে পালে পালে কুকুর, জিব লকলক করছে তাদের রক্তের নেশায়। বিকট তাদের অনেক জাতভাইকে খতম করেছে, আজ বিকটের মাংস টুকরো টুকরো করে তারা কাটবে দাঁত দিয়ে।
দেখে কয়েকপা পেছিয়ে এল বিকট। ভীষণ রাগে বিকট হয়ে উঠল বিকটের মুখ, আগুন বেরতে লাগল যেন দু-চোখ দিয়ে। কিন্তু সে বোকা নয়। একে সারা রাত হেঁটে ক্লান্ত, তার ওপর পাহাড়ে উঠতে গিয়ে মাথায় পাথরের চোট পেয়েছে, আছড়ে পড়েছে পাহাড় থেকে, এই অবস্থায় লক্ষ লক্ষ মানুষ আর কুকুরের সঙ্গে কি লড়া যায়? তাই দু-হাতের দুটো পাথর বিষম আক্রোশে আগুয়ান টং-সৈন্যদের দিকে ছুড়ে দিয়ে ভোঁ দৌড় দিল বিকট।
পেছন পেছন মার-মার করে দৌড়োল টং-সৈন্যবাহিনী আর কুকুরের পাল।
পনেরো নম্বর রহস্য: বিকট কেন বিকট হল?
বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, ওদেরও পেছনে নীল ঘোড়ার পিঠে চড়ে নক্ষত্রবেগে ধেয়ে আসছে তিনটে ছেলে।
সন্ধে হল। আরও গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে বিকট। টং-সৈন্যবাহিনী আর কুকুরের পালও সারাদিন দৌড়ে ক্লান্ত।
ক্লান্ত নয় কিন্তু চৈতক। অচমকা একটা বিরাট ইগলপাখি উড়ে এল মাথায়। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে বললে, টং-রাজা, ফিরে যাও দেশে। নেকড়ের পাল এখন তাড়িয়ে নিয়ে যাবে বিকটকে–বোম্বাকাকুর হুকুম।
মাথু বললে, আর আমরা?
মাথার ওপর উড়তে উড়তেই ইগল বললে, এইখানে জিরিয়ে নাও আজকের রাতটা। ভোর হলেই চৈতক নিয়ে যাবে তোমাদের তিনজনকে, বিকটকে যেখানে নেকড়েরা ঘিরে থাকবে, সেইখানে।
ভোর হল। আবার ঝড়ের বেগে বন-জঙ্গল পেরিয়ে ছুটে চলল নীল ঘোড়া, পিঠে তার ডানপিটে তিন বন্ধু। সারা দিন ছুটল ঘোড়া। বিকেল নাগাদ বনের শেষে দেখা গেল বিরাট একটা মাঠ। মাঠের পর মস্ত একটা খাদ। টং-রাজ্যের শেষ সেইখানে। অনেক দূরে নীলচে পাহাড়। খাদ আর বনের মাঝখানের বিরাট মাঠ ভরে গেছে ধূসর রঙের নেকড়েতে। শুধু নেকড়ে আর নেকড়ে। সংখ্যায় যে তারা কত, তা হিসেব করা সম্ভব নয়। কেউ ছোটো, কেউ বড়ো। কিন্তু প্রত্যেকের জিব ঝুলছে লকলক করে, ঝকঝক করছে ধারালো দাঁতের সারি, ক্রূর চাহনি আটকে আছে চিৎপাত হয়ে শুয়ে থাকা একটা বিপুল প্রাণীদেহের ওপর। খাদের ধারে শুয়ে আছে সে—বিকটরাজা। নেকড়ের দল তাকে আধখানা চাঁদের আকারে ঘিরে রেখেছে তিনদিক থেকে। পালাবার পথ বন্ধ। যেতে হলে তাকে খাদের মধ্যে লাফাতে হবে। তার মানে মৃত্যু। বিকট তাই শুয়ে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। খিদে, তেষ্টা, পথের ক্লান্তি এবং অসংখ্য তিরের খোঁচায় রক্তপাত—এইসবের ফলে বিকটের মন ভেঙে গেছে, শরীর ভেঙে পড়েছে। সে আর পারছে না। নেকড়ের দল তাকে তাড়িয়ে এনেছে সমস্ত রাত জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে টং-রাজ্যের সীমান্তে।
টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে এই দৃশ্যই দেখল মাথু, সাথু, আর টংকু। ঘোড়ার পায়ের আওয়াজে নেকড়ের দল তক্ষুণি পথ ছেড়ে দিলে, তেড়ে এল না মাথুদের দিকে। কেন আসবে? বোম্বাকাকু যে তাদের রাজা! নেকড়েরা পর্যন্ত যমের মতো ভয় পয় আবার ভগবানের মতো ভক্তি করে বোম্বাকাকুকে। তাই তারা যেন পথ চেয়েই ছিল মাথুদের। ঘোড়ার আওয়াজ পেয়ে সসম্মানে সরে গেল দু-পাশে। মাঝের পথ বেয়ে চারপায়ে ধুলোর ঝড় তুলে উল্কাবেগে বিকটের বিশ হাত দূরে গিয়ে শির-পা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল চৈতক। খাড়াই পিঠ থেকে পিছলে নেমে এল তিন বন্ধু।
বিকট কিন্তু নড়ল না। পাশ ফিরে চেয়েও দেখল না। বেঁচে আছে কিন্তু সে, চোখ মেলে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। চৈতক বললে মাথুর কানের কাছে ফিসফিস করে, যাও, বন্দি কর বিকটকে।
মাথু আমতা আমতা করে বললে, আ-আমি বন্দি করব?
—হ্যাঁ, তুমিই করবে। তোমরা মানুষ, বিকটও অন্য গ্রহের মানুষ, অমানুষিক মানুষ। বোঝাপড়া হবে মানুষে মানুষে। আমরা তোমাদের মধ্যে থাকব না। আকাশের পাখি, আর বনের জন্তুরা তোমাদের সাহায্য করেছি, কোণঠাসা করে রেখেছি বিকটকে। কিন্তু তাকে শাস্তি দেওয়ার ভার, তার বিচার করবার ভার, তাকে বন্দি করবার ভার আমাদের নয়, তোমাদের। যাও, কর সেই কাজ।
বলে তেজালো ঘাড় বেঁকিয়ে কয়েক পা পেছিয়ে গেল চৈতক। অদ্ভুত সুরে একসঙ্গে ডেকে উঠল হাজার হাজার নেকড়ে। গায়ের রক্ত জল হয়ে যায় সেই ডাক শুনলে।
বিকট কিন্তু নড়ল না। হাতের একটা আঙুলও নাড়ল না।
কয়েকপা এগিয়ে গেল মাথু। পেছন থেকে সাথু তার জামা খামচে ধরে বললে, দাদা, যেও না! মেরে ফেলবে!
টংকু মাথুর হাত ধরে বললে, ভাই রে, কী দরকার? আমাদের কোনো শক্তিই নেই ওর সঙ্গে লড়বার। হাজার মানুষ হাজার অস্ত্র নিয়েও যার সঙ্গে পারে না, তুমি একা যাচ্ছ তাকে বন্দি করতে?
ফিরে দাঁড়ল মাথু। দু-চোখে তার অদ্ভুত দৃষ্টি। মাথুর চোখে এমন চাহনি এর আগে সাথুও কখনও দেখেনি। টংকু তো নয়ই। মাথু বললে আস্তে আস্তে, অস্ত্র আমারও আছে।
কিচ্ছু নেই।—বললে টংকু।
আছে।—জোর দিয়ে বললে মাথু, সে অস্ত্রের নাম ভালোবাসা।
—ভালোবাসা!
—হ্যাঁ। হিংসা দিয়ে শত্রু, জয় করা যায় না, কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে যায়।
—বিকটকে ভালোবাসবে?
—বিকটও জীব। ঈশ্বরের সৃষ্টি।
—মাথু!
—ভয় পেও না। আমার মন বলছে, বিকটকে জয় করা যায় কেবল একটা অস্ত্র দিয়ে, নাম তার ভালোবাসা।
বলেই ফিরে দাঁড়িয়ে বিকটের দিকে এগিয়ে গেল মাথু। হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে নরম গলায় ডাকল—বিকট।
ঘাড় না ফিরিয়ে চোখের কোণ দিয়ে না তাকিয়ে, একটা আঙুলও না নাড়িয়ে বিকট বললে, মাথু, এইমাত্র যা বললে ছেলেদুটোকে, আমি সব শুনেছি।
—শুনেছ?
—হ্যাঁ। আর শুনেছি বলেই এখনও তোমাকে নখে করে ধরে ছিঁড়ে ফেলিনি। আমার হাতের কাছে এভাবে কোনো শত্রু দাঁড়ায় না, দাঁড়াতে সাহস পায় না।
—বিকট, তুমি চল।
—কোথায়?
—আদালতে।
—কী হয় আদালতে?
—বিচার।
—কার বিচার করবে?
—তোমার।
—শুধু আমার কেন?
—তুমি অকারণে অনেক জীব হত্যা করেছ বলে।
—কেন করিছি আগে শুনবে না?
—শুনব। তারপর যাবে তো আমার সঙ্গে?
—আগে শোন।… মাথু আমি সত্যিই এ গ্রহের জীব নই। এই পৃথিবীতে আমার বাবা, মা, ভাই, বোন, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। আমাকে তারা ফেলে গেছিল এই পৃথিবীতে। কেন, তা আজও জানি না। হয়তো হারিয়ে ফেলেছিল। আমাকে জঙ্গল থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে যারা মানুষ করল, তারা আমাকে দু-বেলা পেট ভরে খেতে দিত না। শুয়োরদের সঙ্গে খোঁয়াড়ে রেখে দিত। আমাকে অদ্ভুত বীভৎস দেখতে বলে লোকজনদের কাছে পয়সা নিয়ে আমাকে দেখাত। তারা এসে খোঁচা মারত, আগুনের ছ্যাঁকা দিত, বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে রক্ত বার করে দিত। তাও আমি সহ্য করেছিলাম মাথু। কিন্তু আমার এই শরীরটা, দেখছ তো, তোমাদের মতো ছোটো নয়। আমার খিদেও বেশি। তাই খিদের জ্বালায় লুকিয়ে একদিন মাঠ থেকে একটা ভেড়া চুরি করে খেয়েছিলাম। আমাকে সেইজন্যে ডাণ্ডা দিয়ে প্রচণ্ড মারা হয়, সারা গায়ে আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে ফোসকা ফেলে দেওয়া হয়। মাথু, তাও আমি সহ্য করেছিলাম। কিন্তু আমাকে যখন সাত-সাতটা দিন না খাইয়ে রাখল, শেকল দিয়ে বেঁধে রাখল, তখন আর পারলাম না সহ্য করতে। শেকল ছিঁড়ে পালিয়ে গেলাম জঙ্গলে। লুকিয়ে থাকতাম সারাদিন, রাত্রে এসে গোরু-ভেড়া যা পেতাম, চুরি করে খেতাম। তখন একদিন গায়ের সব লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাড়া করল আমাকে, কুকুর লেলিয়ে দিল আমার পেছনে। ওদের চোখে, দেখলাম, আমাকে খুন করার সংকল্প। মাথু, সেইদিন, হ্যাঁ, সেইদিন থেকেই আমি অন্য মানুষ হয়ে গেলাম। আমি মানুষের সঙ্গে মিলে-মিশে থাকতে চেয়েছিলাম, মানুষ আমাকে মানুষের মতো বাঁচতে দেয়নি। আমি মানুষের মতো পেট ভরে খেতে চেয়েছিলাম, মানুষ আমাকে পেট ভরে খেতে দেয়নি। আমার আপনজন কেউ নেই, তবু কেউ আমায় কাছে টেনে নেয়নি, না খাইয়ে, মেরে খুন করার চেষ্টা করেছে। মাথু, বল, তুমিই বল, সবটাই কি আমার দোষ?
এতক্ষণ আকাশের পানে তাকিয়ে কথা বলছিল বিকট, কথা শেষ করে এতক্ষণ পরে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মাথুর দিকে। দেখল, মাথুর দু-চোখ জলে ভরে উঠেছে। টসটস করে দু-গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তার। সবুজ চোখে আশ্চর্য চাউনি মেলে চেয়ে রইল বিকট। একসময় বলল অদ্ভুত নরম গলায়, তুমি কাঁদছ?
মাথু কথা বলল না।
বিকট বললে, পৃথিবীতে এই প্রথম একজন চোখের জল ফেলল আমার দুঃখে।
মাথু তবু কোনো কথা বলল না।
বিকট বললে, আর পৃথিবীর ওপর আমার রাগ নেই। ভেবেছিলাম, এই পৃথিবীর মানুষ, পশু, পাখি—সব শেষ করব। কিন্তু আর না… আর না… আর না!
এতক্ষণ পরে মাথু, বললে, চল বিকট, দেশে চল।
আমার দেশ ওই আকাশে।—আকাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে বিকট।
—আমার দেশ তোমারও দেশ, বিকট।
—মাথু, এই পৃথিবীর সব মানুষ যেদিন তোমার মতো মানুষ হতে পারবে, সেদিন, জানবে, এই পৃথিবীতে আর লড়াই হবে না। তুমি ঠিকই বলেছ, ভালোবাসাই সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র। তুমি সেই অস্ত্র দিয়ে আমাকে জয় করলে। তাই আমি চললাম।
—কোথায়?
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল বিকট। সঙ্গে সঙ্গে রক্ত-জল-করা স্বরে ডেকে উঠল হাজার হাজার নেকড়ে।
শুনেও শুনল না বিকট, ফিরেও দেখল না। বললে, এইখানে।
বলেই পেছন ফিরে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাতালের মতো গভীর সেই খাদে।
উপসংহার রহস্য: সবুজ ট্রানজিস্টারটাই কি তাহলে… ?
এর পরের ঘটনা খুব ছোট্ট।
বিকট চলে গেল জন্মের মতো। এই পৃথিবীর প্রাণীদের কাছ থেকে ক্রমাগত ঘৃণা পেয়ে পেয়ে সে বুনো, বর্বর হয়ে গিয়েছিল, একজনের ভালোবাসায় শুদ্ধ হয়ে গিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল পরলোকে।
মাথু একপাও নড়েনি। তার দু-চোখ তখন জলের ধারায় ঝাপসা। পাশে এসে দাঁড়াল টংকু আর সাথু। ওদেরও চোখে জল। মাথুর দু-পাশ থেকে দু-হাত ধরে তাকে ওরা টেনে নিয়ে গেল চৈতকের কাছে।
মানুষ ছাড়া কোনো প্রাণী কাঁদে কি? সেদিন দেখা গেল, চৈতকের চোখেও জল। তিন বন্ধু, উঠে বসল চৈতকের পিঠে। দেখল, নেকড়ের পাল কখন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। প্রান্তর ফাঁকা। একরাশ কালো মেঘ ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসছে ওদের দিকে।
ঝড় উঠল—প্রচণ্ড ঝড়। সেই ঝড়ে গাছ নুয়ে পড়ল, ধুলোয় চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। নীল ঘোড়া যেন পক্ষীরাজের মতো উল্কাবেগে ধেয়ে গেল শূন্যপথে। মাথার মধ্যে সব যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে টংকু, সাথু, মাথুর। একেবারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে মাথুর কানে ভেসে এল বোম্বাকাকুর ফিসফিসে গলা—মাথু, তোর মা ডাকছেন।
জ্ঞান ফেরার পর মাথু দেখল, ভোর হয়েছে। মা দুধের গেলাস হাতে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে দু-পা ছুড়ছে সাথু।
তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে মাথু দেখল, ইজিমেড রেডিয়োটা পড়ে রয়েছে মাথার কাছেই। পেছনের ডালাটা খোলা। কিন্তু…
কিন্তু সবুজ ট্রানজিস্টারটা নেই। সে জায়গায় রয়েছে একটা লাল ট্রানজিস্টার।
Tags: অদ্রীশ বর্ধন, অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান