বঙ্কুবাবুর গল্প
লেখক: বিমলেন্দু মিত্র
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
পুরুষ্ট বেগুনিদের একাদশতমটিকে মুখে চালান করে বঙ্কুবাবু বললেন, ‘বেগুনি খাই বটে, তবে বেগুন আমি পছন্দ করি না। বেগুন দেখলেই আমাদের থার্ড মাস্টারমশাইয়ের গিন্নির কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায়, তাই শিউরে উঠি। আহা, বেগুন খেতে বড্ড ভালোবাসতেন!’
বৃষ্টির সন্ধ্যায় আড্ডা জমেছিল। বুড়ির জ্যেঠিমা ভেতর থেকে গরম বেগুনি আর মুড়ি সাপ্লাই করেছেন। চোখ বুজে আমরা তাই চিবুচ্ছি। এমন স্বৰ্গীয় মুহূর্তগুলি বঙ্কুবাবু যে বৃথা যেতে দেবেন না তা জানতুম। তপেশ চোখ পাকিয়ে কী-একটা বলতে যেতেই বিশু থামিয়ে দিলে তাকে। বুড়ি সোৎসাহে উঠে বসে জিজ্ঞাসা করলে, ‘থার্ড মাস্টারমশাইয়ের গিন্নির গপ্পোটা বলো জ্যেঠু, এক্ষুনি চা এসে পড়বে।’ বঙ্কুবাবু বললেন, ‘আমাদের বাহির শুঁড়োর হরমোহন উচ্চবিদ্যালয়ের থার্ড মাস্টারমশাই পড়াতেন ভূগোল আর বিজ্ঞান। আমরা যখন থার্ড কেলাসে, তখন বিজ্ঞানের পড়াশোনা খুব একটা হত না। একটু-আধটু বোটানি, সামান্য জীববিদ্যা, যৎসামান্য ভৌতবিজ্ঞান, আমরা বলতুম ভূতবিজ্ঞান। এঁদো-পড়া দুটো ক্লাসঘরে ছিল দুটি ছোটোখাটো ল্যাবরেটরি। বিকেলের আগেই ঘর দুটোতে গা ছম ছম করত, বায়োলজির ঝোলানো কঙ্কালটা মনে হত ফোকলা দাঁতদুটো ভরাট করে নিয়ে মুখ খিঁচিয়ে হাসছে।
থার্ড মাস্টারমশাই ছিলেন বড্ড ভালোমানুষ। পণ্ডিতমশাই প্রায়ই ওঁকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতেন। বলতেন, ‘ভূপেশচন্দর, তোমার মতো অজ্ঞানী কী করে বিজ্ঞান পড়ায় তা জানি না।’
ভূপেশবাবু মাথা চুলকে বলতেন, ‘কেন পোনমশাই, অজ্ঞানী কেন? আমি তো এমএসসি পাশ করেছি!’
সেকালের ইন্টার পাশ পণ্ডিতমশাই শশব্যস্তে বললেন, ‘আহা হা, সেজন্যে নয়। পাঁজিপুথি তো তুমি মানো না কিনা! মানলে ঠিকমতো বিজ্ঞানটিজ্ঞান শেখাতে পারতে। অমাবস্যায়, তেরো স্পর্শে কুষ্মাণ্ড আর বার্তাকুতে একরকম পোকামাকড় হয়, ওই জন্যে পাঁজিতে বার্তা কুভক্ষণ নিষেধ—এসব কথা কি তোমার ওই এমএসসি-র সিলেবাসে পড়তে হত?’
থার্ড মাস্টারমশাই অবাক হয়ে বললেন, ‘আহা, ওসব তো কুসংস্কার পোনমশাই! তিথিটিথির সঙ্গে পোকামাকড়ের সম্পর্ক কী? আর তাই যদি হত তবে কি আর সায়েন্টিস্টদের মাইক্রোস্কোপে তারা ধরা পড়ত না?’
পণ্ডিতমশাই ভুরুজোড়া কপালে তুলে বললেন, ‘বলো কী ভূপেশ! গ্রহসংস্থানের জন্য যেসব পোকা হয় ফলের মধ্যে তারা কি তোমার মাইক্রোস্কোপে ধরা দেবার জন্যে জন্মায়? দেখো, ভবিষ্যতে হয়তো ঠিকঠাক যন্তর আবিষ্কার হবে। আমি এখন থেকেই তার নাম দিয়ে রাখলুম মাকড়স্কোপ। তোমাদের নোবেল প্রাইজের দু-একখানা বই যেন আমাকেও দেয়। বেদ পুরাণ ঋষিবাক্য এদের চেয়ে বড়ো সায়েন্স আর কী হবে?’
এসব শুনে ভূপেশবাবুর প্যাঁচা-চশমা এমন আলোর ঝিলিক মারল যে পোনমশাই গলাখাঁকারি দিয়ে চটি ফট ফট করে কেলাস সেভেনের দিকে চলে গেলেন। ভূপেশবাবু নড়লেন না, বিড় বিড় করতে করতে ঝোলা গোঁফের দু-পাশ মুখের মধ্যে পুরে চিবোতে লাগলেন। হেডস্যার আসছেন দেখে আমি টুক করে সরে পড়লুম।
চারটেয় ছুটি। আমি গুটি গুটি বেরুচ্ছি, বীরু পেছন থেকে এসে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসে গলায় বললে, ‘ল্যাবরেটরিতে রোজ রাত্তিরে আলো জ্বলে। কালো ছায়া ঘোরাফেরা করে। তাদের কাউকে কাউকে ভূপেশবাবু স্যারের মতো দেখতে।’
আমি চমকে উঠে বললুম, ‘ভূতবিজ্ঞান-ল্যাবরেটরিতে?’
বীরু বললে, ‘জীববিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি, কঙ্কালের আশপাশে। আজ সাতটায় লুকিয়ে থেকে পাহারা দেব। রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার শেয়ার তোকেও দিতে চাই। সাহস থাকে তো ঠিক সাতটায়।’ তাই হল। ঠিক সাতটায় টুক করে পাঁচিল টপকে এসে জলের ঘরের ট্যাঙ্কের আড়ালে দুজনে লুকোলুম! সামনে ছবিরাজ দারোয়ানের কুঠুরিতে আলো জ্বলছে। দালানের ওপাশের ল্যাবরেটরি ঘর অন্ধকার। বীরুকে চিমটি কেটে যেই বলেছি মিথ্যুক, অমনি দেখি বন্ধ ঘরে দুম করে আলো জ্বলে উঠেছে। চমকানো শেষ করে নজর করে দেখি, ওমা, ও যে সত্যিকারের ভূপেশবাবু স্যার! একা একা জীববিজ্ঞানের ঘরে কী করছেন তা কে জানে? আমরা দুজন ট্যাঙ্কের পাশ থেকে বেরুতেই ছবিরাজ হাঁইমাই করে উঠল। ভূপেশবাবু বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে বললেন, ‘বঙ্কা! বীরু! তোরা কী করছিস এই রাত্তিরে?’ আমার গলা কাঠ। বীরু বললে, ‘আপনার ভৌতিক এক্সপেরিমেন্ট দেখব স্যার।’
ভূপেশবাবু আরও অবাক হয়ে বললেন, ‘ভৌতিক এক্সপেরিমেন্ট আবার কী? আমি বায়োকেমিস্ট্রির রিসার্চ করি ল্যাবরেটরি ঘরে। মাঝে মাঝে রাত্তির জেগে কাজ করি। হেডমাস্টারমশাই জানেন।’
রিসার্চ কেন রাত্তিরে করতে হবে তার বৃত্তান্ত জানতে চাওয়ার আগেই ভূপেশবাবু অভ্যাসমতো আমার জুলপি টেনে আর বীরুর ঘাড় খামচে ধরে ল্যাবরেটরিতে এনে ফেলেছেন। বললেন, ‘ভালোই হল, তোরা আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। নে, হামানদিস্তের কচুরিপানা কোট!’
বাস্তবিক, ল্যাবরেটরির মেঝেময় কচুরিপানার জঙ্গল। এরা সব এল কোথা থেকে? কচুরিপানা কুটে হবে কী? বায়োকেমিস্ট্রি কী চিজ তা তো তখন জানিই না, সুতরাং তার মধ্যে কচুরিপানা কোন পার্ট প্লে করবে তা আর আমরা কী বুঝব? হয়তো কোনো নতুন আচার টাচার বানাবেন। ভূপেশবাবু স্যারই সেদিন বলেছিলেন, দুর্বো ঘাসের চপ বানিয়ে নাকি সায়েন্স কলেজে তাঁরা খেয়েছিলেন তাঁদের স্যারের ফর্মুলা মতন। মন্দ লাগেনি, শুধু ঘণ্টাসাতেক পরে বার পাঁচেক বমি হয়েছিল।
ভূপেশবাবু সামনের টেবিলে বুনসেন বার্নার জ্বেলে সবজে-লাল কী কী সব লিকুইড গরম করছেন ততক্ষণে। জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কচুরিপানার কি চপ হবে না কাটলেট?’
উনি প্যাঁচা-চশমার ভেতর দিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘অত চপ-কাটলেটের নেশা ভালো নয় বঙ্কু। নিশ্চয় তোমরা গদাইয়ের রেস্টুরেন্টে কুকুরের চপ-ফপ খাও। খেয়ো না, কোলেস্টেরল বেড়ে গিয়ে হার্টে বাত ধরবে।’
বীরু বললে, ‘তাহলে কচুরিপানা কুটব কেন?’
চিবুনো গোঁফ ফুঁ দিয়ে বার করে ফেলে উনি বললেন, ‘এ থেকে নতুন একটা জিনিস তৈরি হবে। জিবারেলিন “বি”। নতুন একটা হরমোন।’
আমি হাঁ করে চেয়ে রইলুম। বীরু ঢোক গিলে বললে, ‘হারমোনিয়াম স্যার?’
টকাস করে ওর মাথায় গাঁট্টা লাগিয়ে স্যার বললেন, ‘বখা অর্জুনদের থিয়েটারের দলে মিশে খুব হারমোনিয়াম চিনেছ বীরু? আজ একটা বই দেব, রাত জেগে পড়ে ফেলবে। কাল ধরব, না-পারলে ফোর্থ পিরিয়ডে দাঁড়িয়ে থাকবে।’
তিন দিনের দিন ভূপেশবাবু আমাকে আর বীরুকে ধরলেন ছুটির সময়। বললেন, ‘বেলেঘাটার খালপারে শামুক পুড়িয়ে চুন তৈরি হয়। খালের জলে কচুরিপানা বোঝাই। দুজনে গিয়ে পোনের সেরের মতো তুলে আনবি। রথের মেলায় বেগুন চারা কিনেছি, খাঁটি মুক্তোকেশী।’ আমরা দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলুম। আমার মনে হল, ঘাসের চপের দু-এক ছিটে ওঁর মাথাতে এখনও নিশ্চয় রয়ে গেছে। ব্রেনের তো আর বার পাঁচেক বমি করে সুস্থ হবার উপায় নেই!’
সেই সন্ধ্যাবেলার শালতি বেয়ে খালের ওপারে জলা থেকে দু-বোঝা কচুরিপানা এনে ওঁকে দিলুম। বাড়ি ফিরতে রাত্তির হল। নেহাত আমাদের চুয়াল্লিশজনের জমজমাট বাড়িতে তেইশটা ছেলে-মেয়ের খোঁজখবর ঠিকমতো কেউই কোনোদিন রাখতে পারে না, তাই!
ভূপেশবাবু স্যারের সেকেলে বুক ছম ছম করা পেল্লায় থামওয়ালা মস্ত বাড়িতে চোরকুঠুরির মধ্যে গুপ্তধন যে লুকোনো নেই, তা জোর করে কেউ বলতে পারে না। তবে নাটমন্দিরের সামনের খোলা জমিতে কাঁচালংকা, পেয়ারা, বেগুন, সিম আর ঠাকুরদালানের চালে মোটকা মোটকা কুমড়ো লতা ভালোই হত। বাড়ির আঠাশখানা ঘরের ছাব্বিশখানা তালাবন্ধ থাকত, অন্য দু-খানায় ভূপেশবাবু স্যার আর তাঁর গিন্নি থাকতেন। গুরুমাকে ঠিক বড়োসড়ো পাকা কুমড়োর মতো দেখতে। ওইরকম লালচে রং, মাথায় এক ইঞ্চি চওড়া সিঁদুর। আমাদের ক্লাসের সব ছেলেদেরই উনি ভালোবাসতেন। উঠোনের পেছন দিকে বেড়া দিয়ে অনেক বেগুনচারা লাগিয়েছেন। বেগুন খেতেও বড্ড ভালোবাসতেন—ঝাল, ঝোল, অম্বল, সেদ্ধ, ভাজা, ভুজি, কোপ্তা, কারি—বেগুন দিয়ে বানাতেন খাসা! পাড়াপড়শিদের বিলোতেন আর হেসে বলতেন, ‘আমি হলুম বেগুনের পোকা!’
সেদিন বীরু আর আমাকে চারটে করে নারকেল নাড়ু দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁরে তোদের স্যার রাত জেগে ইশকুলে বসে কি করে তা জানিস?’
আমি বললুম, ‘কচুরিপানা থেকে হরমোহন তৈরি করেন।’ গুরুমা অবাক হয়ে চেয়ে থেকে দোক্তাপাতা মুখে ফেলে বললেন, ‘হরমোহন তো তোদের ইশকুল পিতিষ্ঠে করে কবেই মারা গেছে। তাকে আবার তৈরি করবে কী? তাও কিনা কচুরিপানা হয়তো ভূত নামানোর ওষুধ। তা হরমোহনের ভূতকে আবার জ্বালাতন করা কেন বাপু? তুমি বেগুনচারা নিয়ে আছো, তাই থাকো-না কেন?’
বীরু তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলে, ‘স্যারও কি বেগুনচারা লাগান?’
দোক্তায় পিক ফেলে উনি বললেন, ‘বলছে তো কী সব ওষুধ দিয়ে মুক্তোকেশীর গাছ থেকে আড়াইমণি বেগুন ফলাবে। মোটে তো দুটি প্রাণী। আড়াইমণি বেগুন দিয়ে আমি সুতো বাঁধতে পারব না তা বলে দিইচি। আমার বলে কুমড়োর ভয়েই প্রাণ আইঢাই করচে।’
কোনো ব্যাপারটাই বোঝা গেল না। ঠিক সাতদিন বাদে সাতসকালে বীরু হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘ভূপেশবাবু স্যারের রান্নাঘরের চাল ধসে পড়েছে। গুরুমার পিঠে কুমড়ো পড়ছে। তিনি অজ্ঞান। দেখতে যাবি তো চল।’
একদৌড়ে পৌঁছে দেখি সত্যি কথা। রান্নাঘর যেখানে থাকবার কথা সেখানে ইট আর টালির বোঝা। সামনের উঠোনে যেন কুমড়োর ফালির বৃষ্টি হয়েছে। বোধ হয় শ-খানেক কুমড়ো একসঙ্গে ফুটিফাটা হয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। চোখে-মুখে জল দিয়ে গুরুমার জ্ঞান আনা হয়েছে। ভূপেশবাবু স্যারকে পাশের বাড়ির জ্ঞানেশবাবু যাচ্ছেতাই করছেন, ‘তুমি নিশ্চয় লুকিয়ে লুকিয়ে কুমড়ো চালানের ব্যাবসা ধরেছ ভূপেশ। মাস্টার হয়ে মিছে কথা বোলো না। তা তুমি রান্নাঘরের চালে বিশ মণ কুমড়ো যদি চাপালেই চালটার কড়িকাঠ একটু পোক্ত করতে পারনি?’
পাহাড়প্রমাণ কুমড়োর ফালি সরানো টরানো হয়ে গেলে আর জ্ঞানেশবাবুর অফিসের সময় হওয়ায় উনি চলে গেলে গুরুমা মুখ খুললেন, ‘আমার পোড়াকপালে ওই হাতিকুমড়ো যদি ভেঙেই পড়ল তবে আমার মরণ হল না কেন? এখন আমি কোথায় বসে রান্নাবান্না করব? আর জন্মে কত পাপ করেছিলুম—’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
বীরু আর আমার দুজনের ডান হাত বাঁ-হাত ফস করে ধরে ফেলে ভূপেশবাবু স্যার খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে হন হন করে এগোতে বললেন, “চল রমেন ডাক্তারবাবুকে একটা কল দিয়ে আসি।’ ছাড়া হাতখানা দিয়ে চোখের সামনে প্রকাণ্ড ছাতার মতন সবুজ রঙের কুমড়ো পাতা তুলে ধরে কাঁপা গলায় বীরু বললে, ‘বিস্ফোরণে ফার্দাফাঁই হলেও এটা কুমড়োপাতা তো স্যার?”
ভূপেশবাবু মিনমিনে গলায় বললেন, “বোমাবাজদের দলে মিশছ নাকি বীরু, নইলে বিস্ফোরণ বললে কেন? “জিবারেলিন— বি” মানে “জিবারেলিন ভূপেশ”— দিয়ে ট্রিট করা কুমড়ো ব্যাটার ওজন হয়েছিল বাইশ মণটাক। মাধ্যাকর্ষণে খসে পড়ে ফুটিফাটা হল। সেইসঙ্গে রান্নাঘরের চালটা গেল। ভাগ্যিস ঠিক মাথা টিপ করে পড়েনি!’ তারপর চুপ করে হাঁটতে হাঁটতে ফের বললেন, ‘যাকগে, বেগুনগুলো আছে। গুপ্তপ্রেস দেখে রেখেছি, সামনের অমাবস্যার রাত্তিরে ন-টা থেকে দুটো পর্যন্ত বার্তাকু ভক্ষণ নিষেধ। তিন দু-গুণে ছ-কানের বেশি সাতকান না-হয়। লোককে বলবি ভূপেশবাবু স্যার কুমড়োর ব্যাবসা করবেন বলে একশো কুমড়ো চালে তুলেছিলেন—বাইশমণির কথা স্রেফ ঢোক গিলে যাবি। বুঝলি?’ আমরা দুজনে দু-দিকে ঘাড় নেড়ে জানালুম বুঝেছি। বাইশমণ কুমড়োর ফালি মাটিতে গর্ত করে পুতে ফেলা হল কারণ বিলিয়ে দিতে চাইলেও পড়শিরা ওই অলক্ষুণে কুমড়ো নিতে চাইলে না। শুধু গুরুমা চোখের জল মুছতে মুছতে সের খানেক একটা টুকরো ছক্কা করবেন বলে তুলে রাখলেন। আমাদের দুজনের নেমন্তন্ন বুদ্ধি করে কাটিয়ে দিলুম।
পরদিন ফিফথ পিরিওডটা হল না। লাইব্রেরিতে গিয়ে ভূপেশবাবু স্যারকে চেপে ধরলুম, ‘স্যার ওই হরমোহনের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেবেন?’
স্যার প্যাঁচা-চশমার ভেতর থেকে অবাক হয়ে চেয়ে কিছুক্ষণ গোঁফ চিবুলেন। তারপর বললেন, “হরমোহন বললে কেন বঙ্কু। ইশকুলের প্রতিষ্ঠাতার সম্বন্ধে শ্রদ্ধাভক্তি রাখবে। আমি বলেছিলুম হরমোন। হরমোন হল শরীরের বিশেষ রকমের কেমিক্যাল রসকষ, ঠিক ঠিক সময়ে ওইসব রস শরীরের যন্ত্রপাতিকে ঠিক ঠিক কাজ করবার জন্য যেন খবর নিয়ে টেলিগ্রাফের মতো হাজির হয়। ধরো, খাবার পর পাকস্থলীতে খাবারটা দলা পাকিয়ে যেই অন্ত্রে নামবে, অমনি “সেক্রেটিন” রক্তের সঙ্গে মিশে ছুটে এসে প্যাংক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়কে টেলিগ্রাফ বিলি করল, “ইমিডিয়েটলি ওখানে পিত্তরস ঢালো।” টেলিগ্রাফ পেয়েই প্যাংক্রিয়াস চনমন হয়ে উঠে তার কাজটি শুরু করল। শরীরের কত যন্তরপাতি, তাদের সব আলাদা আলাদা কাজ। সময়মতো এদিক থেকে ওদিক থেকে খবর নিয়ে ছোটাছুটি করছে বিভিন্ন হরমোন—ও যন্তরমশাই, তোমার কাজ শেষ করো! শরীরের এখানে-ওখানে তৈরি হয় ওইসব হরমোন। অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ড থেকে তৈরি হয় অ্যাড্রিনালিন। আরও কত হরমোন রয়েছে, যেমন ইনস্যুলিন; যেমন থাইরয়েড গ্ল্যান্ডকে কাজ করাবার হরমোন থাইরোক্সিন আর ট্রাই আইপয়োডো-থাইরোনিন। গ্রোথ হরমোন—বুঝলি তো? থাইরয়েড হরমোন ঠিকমতো খাওয়ালে তোদের প্যাঁকাটি শরীরের যন্ত্রপাতি চনমনে হয়ে তোদের স্যান্ডো কী ভীমভবানি করে দেবে।’
বীরুটার মাথায় নিশ্চয় বুদ্ধি জোগাবার হরমোন এক্ষুনি কাজ করল। ও বললে, ‘বুঝেছি। আপনি হরমোন খাইয়ে কুমড়ো গাছকে ভীমভবানী করে তুলেছিলেন, তাই না স্যার?’ ভূপেশবাবু স্যার গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ঠিক ধরেছিস। অ্যানিম্যাল হরমোনের মতো নানা রকমের প্ল্যান্ট হরমোনও আছে, ওদেরও কত কাজ, গাছগাছড়ার বাড়বৃদ্ধি দেখাশোনা করা, ফলটল ধরানো এইসব। তোরা অক্সিনের নাম শুনেছিস?’
দুজনেই চকাচক ঘাড় নাড়লুম। উনি বললেন, ‘অক্সিন হল মানুষের জানা প্ল্যান্ট হরমোন। ইশকুলের নর্দমার পাশেই একটা লেবু গাছ কীরকম ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে লক্ষ করেছিস?’
বীরু বললে, ‘হ্যাঁ স্যার, খুব বড়ো বড়ো লেবু হয়।’
‘হবেই তো! মানুষের প্রস্রাব থেকেই কোগল সাহেব প্রথম অক্সিন আবিষ্কার করেন। অক্সিন হল গাছেদের গ্রোথ হরমোন, মানে গাছের শরীর ওতে বাড়ে।’
আমি বললুম, ‘স্যার, তাহলে কচুরিপানা—’
স্যার বললেন, ‘কচুরিপানার বড্ড বাড়! বাড়তে দে, বাড়তে দে। আজ ফের খালপার থেকে সের দশেক তুলে আনবি। তোরা আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, একথাটা মনে মনে রাখিস। কচুরিপানা থেকে “জিবারেলিন” এক্সট্রাক্ট করি। এটা নতুন হরমোন, প্ল্যান্ট আর অ্যানিমাল—দু-এর ওপর কাজ হয়। নাম দিয়েছি জিবারেলিন ভূপেশ।’
ক-দিন নিয়ম করে বীরু আর আমি অঙ্কের পিরিয়ডে নিলডাউন হলেও ভূপেশবাবু ফোর্থ পিরিয়ডে আমাদের দুজনকে কিছু বলেননি। অন্য সবাইকে পড়া জিজ্ঞেস করেছেন আর জুলপি টেনেছেন।
পণ্ডিতমশাই খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ওঁকে বললেন, ‘কই হে ভূপেশচন্দর, আজও মাকড়স্কোপ বানাতে পারলে না? টিকি রাখো হে টিকি রাখো, তা হলে আকাশের বিদ্যুৎ শুষে নিয়ে মস্তিষ্কটা তোমার উর্বর হত আরও। আগামীকাল অমাবস্যা, রাত আটটার পর বার্তাকু ভক্ষণ নিষেধ। আমি বলছি, ওই সময়েই বার্তাকুর ভেতরে অষ্টপদী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাকড় জন্মাবার কথা। তেমন তেমন সূক্ষ্ম যন্তর থাকলে দেখতে পেতে।’ ভূপেশবাবু চিবুনো গোঁফের দু-পাশ ফুলিয়ে বললেন, ‘পোনমশাই, সূক্ষ্ম যন্তরের দরকার হবে না। এমন কারখানা করেছি, যে বার্তাকুর পোকামাকড় দেওয়ালের মাকড়সার মতন বড়ো বড়ো হয়ে উঠবে। মানে যদি তারা থাকে বার্তাকুর মধ্যে। আগামীকাল অমাবস্যায় বেগুনবলি দেব। খালি চোখেই মাকড় দেখতে পাবেন। মাকড়স্কোপ লাগবে না!’ পণ্ডিতমশাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, ‘দেওয়ালের মাকড়সা বেরুবে বলছ বার্তাকুর মধ্যে থেকে?’
ভূপেশবাবু বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। পরশু একাদশীতে আপনার নেমন্তন্ন রইল। কাল বেগুনবলি দেখবেন তো?’
পণ্ডিতমশাই ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘উঁহু কাল কালরাত্তিরও বটে! গৃহত্যাগ নিষেধ।’ বলেই ছবিরাজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। ওখানেই ওঁর হুঁকো থাকত।
ভূপেশবাবু ঢুলুঢুলু চোখে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে থেকে গোঁফের ফাঁকে ফিক করে হেসে বললেন, “তোদের গুরুমায়ের নাম হল মুক্তকেশী, তা জানিস? নিজে হাতে বেগুনবলি দিতে তাই ইচ্ছে নেই। কাজটা বঙ্কা সারবি।’
বীরু বললে, ‘স্যার, যদি সত্যিই পোকা বের হয়?’
ভূপেশবাবু গোঁফ কামড়াতে কামড়াতে দুশ্চিন্তা দুশ্চিন্তা মুখেই বললেন, ‘পোকা ধরবার জাল ফেলে ধরতে হবে। অমাবস্যা কেটে গেলেই তো তাদের ভ্যানিশ হয়ে যাবার কথা। তোরা নিরপেক্ষ সাক্ষী। সব ঠিকঠাক অবজার্ভ করবি। প্রবলেমটা বরাবরের মতো নেটল হয়ে যাক।’
তারপর ফের দুশ্চিন্তার মুখেই বললেন, ‘তোদের গুরুমার বাতের শরীর, একটু ফুলেছে মনে হয়। নতুন রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বেরুতে গিয়ে আজ আটকে গিয়েছিল। ওকে কিছু জানিয়ে কাজ নেই।’
পরের দিন রাত তখন ন-টা। স্যারের বাড়ির ভূতুড়ে উঠোনে যখন গিয়ে হাজির হলুম তখন বুকের ভেতরটা ধড়াধ্বড় লাফাচ্ছে। ভূপেশবাবু এসে বললেন, ‘ক-দিন বাগানে বেগুনগুলোকে দেখবার সময় পাইনি, মাঝারি দুটো চুরি হয়ে গেছে রে, আধমণ করে মাল নষ্ট। বড়ো দুটো রয়েছে। চল দেখি, তিনজনে মিলে একটাকে কায়দা করা যায় কিনা!’
হ্যাজাক হাতে, পাঁচিলে ঘুরে বাগানে ঢুকতেই চোখে পড়ল। মাটিতে লুটিয়ে পড়া পাঁচ ফুট ব্যাসের—হ্যাঁ, বেগুনই বলতে হবে! স্যারের বাগান না-হলে বলতুম রূপকথার দৈত্যের বাগানের পেল্লায় দু-খানা বেগুনি বেলুন।
আমাদের দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে ভূপেশবাবু শশব্যস্তে বললেন, ‘হাত লাগা, হাত লাগা, কাঁটা বাঁচিয়ে।’
স্যারের হাতে ওঁদের বংশের পাঁঠাবলির চকচকে খাঁড়া, সদ্য সান দেওয়া। তাই দিয়ে বেশ কসরত করে একটি অতিকায়কে গাছচ্যুত করে কোনোরকমে গড়িয়ে দালানে তুললুম। শিকেয় হ্যাজাকটা ঝুলিয়ে দিয়ে আর আমার হাতে স্যার খাঁড়া ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কালরাত্রি বার্তাকু ভক্ষণ নিষেধের মাঝটাইম। নে বঙ্কা জয় মা বলে মার কোপ! বীরু, অবজার্ভ কর!’
আড়াই কোপে দু-ফালা হল আড়াইমণি। ভেতরে নরম তুলতুলে সাদা শাঁস। পোকামাকড় কিচ্ছু নেই। পোয়াটাক চেহারার না-হোক, মাছি বা পিঁপড়ের মতোও কিছু নয়।
তিনজনেই যখন পণ্ডিতমশাইয়ের কথা ভাবছি, তখনই ভেতরের ঘর থেকে ভেসে এল মোক্ষম এক আওয়াজ। মড় মড় করে কী যেন ভেঙে পড়ল। চমকে উঠে তিনজনেই একছুটে ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখি স্যারের বাবার আমলের প্রকাণ্ড পালঙ্কখানা ভেঙে গিয়ে পায়াগুলো ঠিকরে পড়েছে। বিছানাসমেত মাটিতে পড়ে—প্রথমে মনে হল ঘরজোড়া ঢাউস পাকা কুমড়ো। তারপর দেখলুম, না, আমাদের গুরু মা। কোমরের বেড়, পরে মেপে জানা গিয়েছিল, ষোলো ফুট; হাত-পায়ের গোছ সাড়ে চার ফুট, মোট ওজন সতেরো মণ! পোস্টমর্টেম রিপোর্টে লিখেছিল স্রেফ দেহের ওজন বইতে না-পেরে শরীরের হাড়গুলো পটাপট ভেঙে গিয়েছিল।
বেগুন ভালোবাসতেন, বলতেন—আমি বেগুনের পোকা! জিবারেলিন ‘বি’ দিয়ে ট্রিট করা দুটি মাঝারি বেগুন চুরি যায়নি, গিয়েছিল ওঁর রান্নাঘরে। কিন্তু আশ্চর্য, স্যারের তো কিছু হয়নি! হাড় আর শামুকধোয়া জলের কচুরিপানা থেকে এক্সট্রাক্ট করা নতুন হরমোন দিয়ে বাড়িয়ে তোলা বেগুন কি তবে ‘বেগুনের পোকা’ ‘মুক্তকেশী’ নামের ওপরই বিশেষ করে কাজ করেছিল?
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান, বিমলেন্দু মিত্র
ডঃ বিমলেন্দু মিত্র (অধ্যাপক, পদার্থবিদ্যা বিভাগ, বসু বিজ্ঞান মন্দির, কলকাতা) ছিলেন আমার পি এইচ ডি গাইড (১৯৭৮ -১৯৮২) ৷ তিনি ‘বঙ্কুবাবুর গল্প’ সিরিজে অনেক কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক লেখা লিখেছিলেন, যেগুলি সেসময় বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল ৷ আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রতেও কয়েকবার তিনি ‘বঙ্কুবাবুর গল্প’ পড়েছেন ৷
উল্লেখ করা হয়েছে এই গল্পটি পুনঃর্মুদ্রিত ৷ এটি কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল বা প্রকাশের তারিখ জানতে পারলে ভালো হতো ৷ আমি নিশ্চিত এটি ৪০ বছরেরও বেশি আগে লেখা ৷ সেসময়েই তিনি বায়োকেমিষ্ট্রী ভিত্তিক এমন মনোজ্ঞ কাহিনী লিখেছিলেন !!