সত্য
লেখক: সুমিত বর্ধন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
দশদিকে যেন যুদ্ধ শেষের নিঃশব্দ প্রহর। যেদিকে তাকাই সেদিকে কেবল রাত্রির প্রকাণ্ড নিকষ সরোবর।
কোথায় আমি? কে নিয়ে এল ভ্রষ্ট এই অন্ধ মৃত্যুজপ।
কিছু কথা যেন আবছা মনে পড়ে।
***
ইউনিভার্সিটির বিশাল অডিটরিয়ামে আমার কথাগুলো গমগম করে ছড়িয়ে যায়। নিঃশব্দে শোনে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা।
“আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো কি আমাদের বাস্তবের বস্তুনিষ্ঠ সত্যটা দেখায়? না বংশ পরম্পরায় টিকে থাকার জন্যে আমাদের জিনের তথ্যভাণ্ডারের পুঁজিটাকে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে যতটুকু দরকার ততটুকুই দেখায়। আমরা বহু দূরের জিনিস দেখতে পাই না, অতি ক্ষুদ্র জিনিস দেখতে পাই না, বাতাসের অতি সূক্ষ্ম কম্পন শুনতে পাই না। পাই না, কারণ আমাদের জিনরাশি বিস্তারের জন্যে বিবর্তন ওই ক্ষমতাগুলোকে আমাদের জন্যে প্রয়োজন মনে করে না।”
***
আমার পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ শুনি যেন। রক্তে যেন জল ছলছল করে। শরীরটা মনে হয় যেন জলজ গুল্মের ভারে ভরে উঠেছে।
***
“আমাদের অনুভূতিগুলো দিয়েই তো আমরা জগৎটাকে বুঝতে পারি।” মৃদু আপত্তি করে একজন ছাত্রী।
মাথা ঝাঁকিয়ে খারিজ করে দিই তার আপত্তি। “শৈত্য, উষ্ণতা, কটুতা, মিষ্টতা, আমাদের এইসব অনুভূতিগুলো কি সত্য? নাকি আমাদের আবিষ্কৃত কিছু প্রথা, জটিল জগৎটাকে সহজে বোধগম্য করে তোলার জন্যে তার বিভিন্ন অংশে এঁটে দেওয়া কিছু প্রতীকের লেবেল?”
***
আমি আছি। এই মাত্র শুধু। আমার কি কখনও কোনো কথা ছিল? কথা নয়, বাঁচা দিয়ে সমূহ প্রবাহ পাবো বলে অন্ধ দুই চোখ ভেজাই অন্ধকারে। ধমনী শিথিল জলে ভরে দেয় ঘূর্ণমান তারা।
***
আমার পেছনের দেওয়াল জোড়া প্রোজেকশন স্ক্রিনের দিকে দেখাই। সেখানে ফুটে উঠেছে আমার ল্যাপটপ স্ক্রিনের প্রতিচ্ছবি।
“এই কম্পিউটারের স্ক্রিনটা দেখছ? এই যে বাঁদিকের ওপরের কোনে একটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের ছবি রয়েছে, তলায় ‘রিসাইকেল বিন’ লেখা? ওটা একটা প্রতীক। কোনো ফাইল কম্পিউটার থেকে ডিলিট করলে ওই বাস্কেটের ভেতর তাদের দেখা পাওয়া যাবে। ওই রিসাইকেল বিনের বাস্কেটটা মিথ্যে নয়, আবার সম্পূর্ণ সত্যও নয়। আসল সত্য ওই ছবিটা নয়, যে পিক্সেলগুলো দিয়ে স্ক্রিনে ছবিটা আঁকা হয়েছে, সেগুলো নয়, এমনকি শূন্য আর একের বাইনারি কোডের সমষ্টিতে কম্পিউটারের ডিস্কে কোথাও ও বাস্কেটটার চাল-চরিত্র বর্ণনা করা আছে সেটাও নয়। একের পর এক স্তর পেরিয়ে দেখা যাবে সত্যটা হয়তো রয়েছে ডিস্কের কোনো চৌম্বকিয় বা বৈদ্যুতিক চরিত্রে, কিম্বা তার চাইতেও গভীরে। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন কাজের জন্যে সম্পূর্ণ সত্যটার প্রয়োজন নেই। রিসাইকেল বিন নামের ওই প্রতীকটার ব্যবহার জানলেই যথেষ্ট।”
***
বাতাসে ধাতুর ভার। আকাশে ক্ষতের উজ্জ্বলতা। ডানা মেলে ঝেঁপে আসে অশরীরী ছন্দে কালো ঝাউ। করোটির মধ্যে তার শব্দ ওঠে।
***
“কিন্তু জগতের সম্পূর্ণ সত্যটা জানতে না পারলে আমরা বেঁচে থাকব কী করে?” আবার আপত্তি করে ছাত্রীটি।
উত্তরে মৃদু হাসি আমি। “এককালে যখন শহরের রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি চলত তখন ঘোড়াটার চোখে একটা ঠুলি বেঁধে দেওয়া হত। যাতে ঘোড়াটা আশপাশের কিছু না দেখে শুধু যেদিকে যাওয়ার কথা সেদিকেই দেখতে পায়। বিবর্তনও আমাদের সঙ্গে ঠিক একই ব্যবহার করেছে। ঠুলি পরিয়ে দিয়েছে আমাদের ইন্দ্রিয়ের ওপর। যাতে আমরা যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি জানতে না পারি। ওটুকুতেই আমাদের দিব্যি চলে যায়।”
***
স্থির অমাবস্যা, আমি শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে দিগন্তের ধারে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে আমার শরীর যেন আকাশের মূর্ধা ছুঁয়ে আছে।
***
“তাহলে ম্যাডাম, চমস্কির মতো আপনিও বলতে চান যে মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণ সত্যকে জানা সম্ভব নয়?” ডিন অফ রিসার্চের প্রশ্নে ব্যাঙ্গের ছোঁয়াটা বেশ টের পাই।
টেবিলের উলটো দিকে বসা রিসার্চ প্যানেলের প্রতিনিধিদের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ ঝাঁঝালো স্বরে উত্তর দিই, “সত্য? বাস্তবের সত্য স্বরূপ জানতে চান? বিবর্তনের সত্য জানানোর কোনো দায় নেই। সত্য জানাতে গেলে আমাদের প্রজাতি লুপ্ত হয়ে যেত। বিভিন্ন সূত্র থেকে চোখের কোশে আলোর ফোটন এসে পড়ে। মস্তিষ্ক সেই সমস্ত ইনপুট থেকে গণনা করে একটা প্রতীকী ছবি খাড়া করে। সে ছবির সত্যতা ততটুকুই যতটুকু আদিম মানবের টিকে থাকার জন্যে প্রয়োজন ছিল। প্রতীকটা ফলরূপী আহার্যের না বিপদরূপী চিতাবাঘের জানতেই পারলেই তার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। ইনপুট থেকে সম্পূর্ণ সত্যটা গণনা করতে গেলে মগজের সময় আর এনার্জি লাগত বেশি। খরচা হয়ে যেত শরীরে তিলতিল করে একত্রিত করা ক্যালরি। বিবর্তনের কাছে সেটা বৃথা অপচয়। সত্য নয়, প্রজাতির ধারা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে বিবর্তনের সৃষ্টি করা ইন্দ্রিয়গুলো তাই আমাদের প্রতীকের আংশিক সত্য দিয়ে ক্ষান্ত থাকে, সম্পূর্ণ সত্যটা আমাদের জানতে দেয় না।”
“এই যে আমরা আকাশের দিকে তাকালে চাঁদ দেখতে পাই, ওটা তাহলে চাঁদ নয়?” ডিন অফ রিসার্চের প্রশ্নে ব্যাঙ্গের সুরটা আরও চড়া হয়।
“যেটাকে আমরা চাঁদ বলে জানি, সেটা একটা আংশিক সত্য। চাঁদের বদলে ওই জায়গায় যা আছে আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় আর মস্তিষ্কের করা তার সরল ভাবানুনাদ।”
***
বুক থেকে খুলে নিয়েছি পাঁজর আর তালে তালে নাচে সেই হাত। গ্রহ-নক্ষত্রের দল ঝমঝম শব্দে বেজে ওঠে। স্তূপ হয়ে অন্ধকারে সোনারঙা সুর ওই উঠে যায় আর উঠে ঝরে পড়ে।
***
টেবিলের ওপর দিয়ে একটা পুরু কাগজে প্রিন্ট করা চিঠি আমার দিকে বাড়িয়ে দেন ডিন অফ রিসার্চ। চিঠিটার ওপরে এক বিশাল ট্র্যান্সন্যাশানাল টেক কোম্পানির লোগো। নীচে তার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের নাম আর সই।
ডিন অফ রিসার্চকে আজ একটু নার্ভাস দেখায়। “ম্যাডাম আপনার কয়েকটা পেপার এঁর নজরে পড়েছে। উনি আপনার রিসার্চের জন্যে আমাদের একটা গ্রান্ট দিতে চান। আপনার রিসার্চের বিষয়বস্তুটা আমাকে একটা ছোটো সামারি করে বলবেন? একটা উত্তর দিতে হবে।”
মুখে ফুটে উঠতে চাওয়া হাসিটাকে গোপন করে বলি, “দেখুন দেশ, কাল, জড় বস্তু, যা আমরা প্রত্যক্ষ করি, এসব কোনোটাই বস্তুনিষ্ঠ সত্য নয়। আমাদের অনুভূতি মাত্র। এগুলো সত্যের প্রতিনিধিত্ব করা প্রতীক, কম্পিউটার স্ক্রিনে ফুটে থাকা ছবির মতো। সত্যকে এরা আবরিত করে রেখেছে। দেশ কিম্বা কাল এই ব্রহ্মাণ্ডের ভিত্তি নয় , দেশ কালের গভীর মূলে আছে আরো মৌলিক কিছু। বিষ্ণুর নাভি থেকে উত্থিত কমলের মতো দেশ আর কালও উৎপন্ন হয়েছে সেই মূল থেকেই। বিবর্তনের কামারশালায় তৈরি পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে তাকে বোঝা সম্ভব নয়। একে বুঝতে পারার পদ্ধতি খুঁজে বের করা নিয়েই আমার রিসার্চ।
***
ঝাঁপ দিয়ে উঠে আসে কয়েক বিন্দু রক্তিম জল। আমার বুকের কাছে নিশ্চিন্ত শকুন ডানা ঝাড়ে।
***
“আপনার লক্ষ্যে কীভাবে পৌঁছবেন সে নিয়ে কিছু চিন্তাভাবনা করেছেন?” ওয়েটারের নামিয়ে রাখা কফির কাপটা আমার দিকে ঠেলে দেন টেক কোম্পানির প্রতিনিধি।
কাপটা তুলে নিই। প্রাসাদের মতো হোটেলের কফি শপটা এই দুপুরে নির্জন, আমরা ছাড়া বিশেষ আর কেউ নেই। ধোঁয়া ওঠা সুগন্ধি কফিতে হালকা চুমুক দিয়ে বলি, “লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনে গড়ে ওঠা আমাদের মেধা দিয়ে আমাদের পক্ষে সত্যের মূলে পৌঁছোন সম্ভব নয়। কিন্তু অন্য কোনো প্রকারের মেধা, বিবর্তন যার সীমা নির্ধারণ করে দেয়নি, হয়তো এই সত্যের আরও কাছাকাছি যেতে পারবে।”
“কী ধরনের মেধা?”
“সেটাই বুঝতে পারার চেষ্টা করছি।”
***
আমার মজ্জায় মজ্জায় যেন আলস্যমথিত অন্ধকারে জেগে ওঠে দীর্ঘ শাল, আজানুলম্বিত বটঝুরি। প্রতিটি মুহূর্ত যেন লেগে থাকে প্রাচীন স্ফটিক।
***
“আপনার পদ্ধতি তাহলে ঠিক করে নিয়েছেন ম্যাডাম?” কফির কাপটা তুলে নিতে নিতে বলেন টেক কোম্পানির প্রতিনিধি।
চারপাশে একবার তাকাই। অফি শপটা আজকেও প্রায় খালি বটে, কিন্তু টের পাই যারা বসে আছে তাদের মধ্যে অনেকেই আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। প্রেসে কল্যাণে আমার রিসার্চের কথা আর গোপন নেই।
“হ্যাঁ। ব্রহ্মাণ্ডের মূল সত্যের কাছাকাছি পৌঁছতে হলে আমাদের লক্ষ্য হবে একটা অতি শক্তিশালী আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর মানুষের নিউরনগুচ্ছের মিলনে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের এক মেধা তৈরি করা। মানব-ধী আর মানব সৃষ্ট ধীশক্তি সংমিশ্রণের এক যৌগ, যার গুণগত চরিত্র সম্পূর্ণ আলদা।”
“শুধু আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে কাজটা হবে না?”
“না। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সত্যটা হয়তো ধরতে পারবে, কিন্তু মানুষের ভাষায় মানুষকে সেটা বুঝিয়ে উঠতে পারবে না। কিন্তু কাজটা সফলভাবে করার রাস্তায় দুটো সমস্যা আছে।”
“যেমন?”
“প্রথমটা হল মানুষের মস্তিষ্ক আর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করা প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ—”
“এই সমস্যাটা আপনি স্বচ্ছন্দে ভুলে যেতে পারেন।” মৃদু হেসে বাধা দিলেন প্রতিনিধি, “আমাদের আর একটা প্রজেক্টে আমরা মস্তিষ্কে বসানোর জন্যে নিউর্যাল চিপ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছি। এই প্রজেক্টটাকে আপনার রিসার্চের সঙ্গে জুড়ে দেব। আর অন্য সমস্যাটা?”
“মানুষের মগজের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে দেওয়ার আইনি জটিলতা—”
“এটাও আপনি স্বচ্ছন্দে ভুলে যান।” ফের হেসে বাধা দিলেন প্রতিনিধি, “আমাদের হাত অনেক লম্বা। কোনো আইনই আমাদের কাছে বাধা নয়। কিন্তু একটা সমস্যার বোধহয় আপনি ভুলে গেছেন। আপনার এই কাজের জন্যে একজন স্বেচ্ছাসেবক লাগবে। আপনার এই এক্সপেরিমেন্টের সাবজেক্ট কে হবে?”
“এই সমস্যাটার কথা আপনি স্বচ্ছন্দে ভুলে যান।” এবার আমার হেসে বাধা দেওয়ার পালা। “এই এক্সপেরিমেন্টটা আমি নিজের ওপরেই করব।”
“কাজটা ঝুঁকির হয়ে যাবে না?” ভুরু কুঁচকোলেন প্রতিনিধি।
“হয়তো হবে। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের মূল সত্যটা জানতে পারার চাইতে বড়ো প্রলোভন কোনো বিজ্ঞানীর কাছে আর কী থাকতে পারে?”
***
আপনি আপনি একটা বৃত্ত আঁকা হয়ে যায়। বৃত্তের মধ্যে জল আঁকা হয়। জলের ভেতরে আমি, আমার ওপর উঠে আসে জল। ছোটো ছোটো ঘাত লাগে, বৃত্ত ভেঙে বৃত্ত বেড়ে যায়। আচমকা জলস্রোতে অবসান হয় সমস্ত বৃত্তের। কোন অতল গভীর থেকে কেউ প্রশ্ন করে,
নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ।
কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্গহনং গভীরম্।।
যখন অস্তিত্ব ছিল না, অথচ অনস্তিত্বও ছিল না। জগৎ ছিল না, ছিল না মহাকাশ, তখন কি আবরিত করে রেখেছিল সে কুয়াশাকে? কার ছিল সেই আবরণ? কী ছিল সেই গূঢ় তমসার গভীর গহনে?
সেই অতল থেকেই উত্তর আসে,
ইয়ং বিসৃষ্টির্যত আবভূব যদি বা দধে যদি বা ন।
যো অস্যাধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্সো অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ॥
কোথা থেকে উদ্ভূত হয়েছে এই সৃষ্টির? তাকে কি কিছু ধারণ করে আছে? কিম্বা তাকে কি কিছুই ধারণ করে নেই?
এসবের উত্তর হয়তো কেবল পরম আকাশের নিয়ন্তা জানেন।
অথবা হয়তো বা তিনিও জানেন না।
ঋণস্বীকার:
শঙ্খ ঘোষ/ পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ
Hoffman, Donald D. / The Case Against Reality
নাসদীয় সুক্ত / ঋগ্বেদ
Tags: science fiction, অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান, সুমিত বর্ধন
হতাশ হলাম। এত সুন্দর সূচনা হয়ে এত তাড়াতাড়ি শেষ?