ট্রিগার
লেখক: শরণ্যা মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
এক
“ডাইনোসর বার্ড। এখন প্রায় বিলুপ্ত। আসল নাম শুবিল। পাখিটার কথা শুনেছো কখনও?”
তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকের তিন নম্বর মার্লবোরো থেকে অস্থির ধোঁয়া এলোমেলো পথে ঘরের বাইরে যেতে চাইছে। পুবদিকের জানালা খোলা। উত্তরদিকের খড়খড়িগুলো অর্ধেক নামানো অবশ্য। এখন সুপর্ণার কাল। জানুয়ারি সবে পড়েছে।
প্রাচীন অর্ধচন্দ্র টেবিলটার সামনের দুটো চেয়ার এই মুহূর্তে খালি। লালবাজারের এই চল্লিশ ইঞ্চি দেওয়ালের ঘরগুলো এমনিতেই বেশ ঠান্ডা। শীত হলে তো আর কথাই নেই। কিন্তু এ সব ঠান্ডা-গরমের কথা এখন স্মার্তের মাথায় উঠেছে। ক-দিন ধরেই লোকটা ভোগাচ্ছে। ক-দিন মানে, ঠিকভাবে বললে আজ নিয়ে তিনদিন হল। না, স্যার অ্যারেস্ট করে আনেননি, লোকটা নিজের থেকেই এসেছে। এসে যা দাবি করছে, তা শুনে সবাই হাঁ। স্মার্ত তার সাত বছরের পুলিস জীবনে এরকম কেস কখনও শোনেনি।
বিকেল চারটে বাজে। স্যার সেই দুপুর দুটো থেকে এক নাগাড়ে বসে আছেন। মাঝে একবার উঠে গিয়েছিলেন আর্কাইভে। নানা দেশের নানা সময়ের বিভিন্ন অপরাধের ইতিহাস ঘাঁটছিলেন। কী দেখছিলেন উনিই বলতে পারবেন, কারণ কেস সলভ না হওয়া পর্যন্ত, নিজের কাজের সময়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলা যায় না। বললে কুরুক্ষেত্র হয়। এ সব স্মার্ত এখন জেনে গেছে। নয় নয় করে স্যারের কাছে তার চার বছর হল। গোটা ডিপার্টমেন্ট স্যারের নামে এমনি এমনি থরহরি নয়।
তিনি রুদ্রেশ চ্যাটার্জি। ইতিমধ্যেই কতকগুলি অসম্ভব পর্যায়ের কেস সমাধান করে লালবাজারের ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে খ্যাতনামা! জটিল এবং আপাতভাবে অসমাধানযোগ্য কেসগুলি তাই, তাঁর সর্বসময়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্মার্ত দত্তের ভাষায় ‘ছাতারে পাখির ঝাঁকের’ মতো তাঁদের ঝুলিতেই এসে ওঠে। বয়স তিরিশের আশপাশে, আন্দাজ। টিকোল নাক, ফরসা রং, লম্বা, পেটানো চেহারা। ম্যাট্রিমনি সাইটে যার পোশাকি নাম অ্যাথলেটিক বডি। কথা কম আর কাজ বেশিই তাঁর মোটো। তবে এ কেসটা খানিকটা স্বেচ্ছাতেই তিনি নিজের হাতে নিয়েছেন বলা যায়। কারণ শুরুতে লোকটা ধরা দিয়েছিল টালিগঞ্জ থানায়। ওর বাড়ির কাছে। সেখান থেকে ওকে লালবাজারে আনা হয়েছে, কারণ এ কেস রাজ্য জুড়ে তোলপাড় ফেলেছে গত কয়েক মাসে।
এমনকি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে বলে শুনেছে স্মার্ত। রাজ্যের বাইরেও এ কিছু কীর্তিস্থাপন করেছে কিনা কে জানে। অবশ্য বাইরে কেউ কিছু বলেছে বলে সে শোনেনি। প্রাথমিকভাবে কেসটা দেওয়া হয়েছিল তাদের সিনিয়র সিনহা স্যারকে। কিন্তু সিপি ফোনে কথা বলেছেন স্যারের সঙ্গেই। তারপর তো স্যার… অন্য কোনো অফিসার হলে এ বিষয়ে নিজেকে জড়াতেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু তিনি রুদ্রেশ। বিন্দুতে সিন্ধু দেখতে পাওয়ার অভ্যাস আছে বলেই না আগের অতগুলো কেস এভাবে সামাল দিতে পেরেছেন! পুরস্কারে পুরস্কারে স্যারের একটা আলমারি ভরতি। দেখেছে স্মার্ত। তবে স্যার পুরস্কার বা তিরস্কারের কথা চিন্তা করে কেস দেখেন না। আর যা দেখতে শুরু করেন, তা শেষ অবধি না দেখে থামেন না। স্যারের দেখায় ভুল হতে আজ পর্যন্ত স্মার্ত দেখেনি। তাই স্যার কিছু নিয়ে মাথা ঘামালে সিনিয়ররাও তাঁর কথা মন দিয়ে শোনেন। প্রয়োজনে তলবও করেন। পরামর্শ চান। যেমন হয়েছে এই কেসটার বেলাতেও। কিন্তু দুপুর থেকে একের পর এক মার্লবোরো আর তিন কাপ ব্ল্যাক কফি খাবার পর স্যার এখন পাখি নিয়ে পড়েছেন! মাঝে মাঝে স্যারের কথাবার্তাগুলো সত্যিই বুঝতে পারে না স্মার্ত।
কিন্তু স্যারের কথা মানেই জ্ঞান। এমন জ্ঞান যেটা চট করে বই পড়ে বা ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা যাবে না। এমন জ্ঞান, যা দিয়ে কেস সলভ হয়। আর দেখতে যতই সম্পর্কহীন লাগুক না কেন, যখন এরকম কোনো হাই প্রোফাইল কেস চলে, তখন স্যারের প্রতিটি কথার পিছনেই কোনো না কোনো বিশেষ কারণ থাকেই, যেটা কেসের সঙ্গে যুক্ত। আগে স্মার্ত ‘কী বলছেন স্যার’, ‘কেন বলছেন স্যার’ করত, শুরুর দিকে। পরে সে বুঝেছে এই সময়টা স্যারের কথা থেকে শেখার। পরে সবটাই পরিষ্কার হবে। এখন শুধু শুনে যাওয়াটাই কাজ। সে সব ঠিক আছে। কিন্তু বাইরে যে পরিমাণ ভিড়! সকাল থেকে সব মিডিয়া কভারেজ দিচ্ছিল। একটা বড়ো জনতা প্রায় হামলাই করেছিল লালবাজারে, বলা যায়। সিপি তো গণগ্রেপ্তারের অর্ডারই দিয়ে ফেলছিলেন। স্যারই গিয়ে আটকালেন। কোনো সিরিয়াল কিলারের জন্য এরকম উন্মাদনা আগে কখনও দেখেনি স্মার্ত। অবশ্য তার কতদিনেরই বা কেরিয়ার। কিন্তু স্যারের কাছে আসার পর থেকে উৎকট কেসের অভিজ্ঞতায় সে অনেক সিনিয়র অফিসারকেও টেক্কা দিতে পারে। এ নিয়ে তার মনে একটা সুপ্ত গর্বও আছে।
“কী এত ভাবছ? বলতে পারলে না তো?”
এই পরিস্থিতিতে স্যার এখন পাখি নিয়ে চর্চা করছেন? স্মার্ত টেবিলের উলটোদিকের মেহগিনি চেয়ারের মাথাটা শক্ত হাতে চেপে ভুরু কুচকালো। যতই হোক ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতই লাগছে। হ্যাঁ, এত অভিজ্ঞতার পরেও। স্মার্ত আলতো করে মাথা নাড়ল।
“দত্ত, জ্ঞান বাড়াও। কাজ দেবে আখেরে। এই পাখি বিভিন্ন কারণে বিরল গোত্রের তার মধ্যে একটা হল এদের বিলুপ্তি। এরা কেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে জানো?”
এই তো সুযোগ পাওয়া গিয়েছে। এইবার স্যারকে নিজের জ্ঞানচর্চার ফল অল্প হলেও দেখানো যাবে।
“স্যার মানুষ। পোচার স্যার। চুরি, খুন। ক-দিন আগেই আমাদের আর্কাইভ পেপারস থেকে একটা কেস পড়লাম, যেখানে… ”
“দত্ত… ”
স্যার ডান হাতটা থামাবার ভঙ্গিতে তুলেছেন। এই রে! এগুলো তো কমন ব্যাপার। এগুলোই তো হয় সাধারণত। তাহলে কি সে কিছু ভুল করল?
“শোনো দত্ত। মাথা ঠান্ডা করে শুনবে। অপরাধীকে ধরতে গেলে তোমাকে অপরাধের বিজ্ঞান জানতে হবে। পৃথিবীর যে কোনো অপরাধেরই একটা হেরিটেজ আছে। আর সব ক্রিমিনাল হেরিটেজেরই একটা লজিক আছে। সে লজিক আমাদের কাছে যতই অদ্ভুত ঠেকুক না কেন। কোনো অপরাধই নতুন নয়। হয়তো টেকনিকটা বদলেছে। কিন্তু তার মূলে যেতে গেলে দেখবে বর্তমানের অপরাধ থেকে অতীতের দিকে একটা টানা লম্বা আলোর শেকল ছড়িয়ে রয়েছে। সেই শেকল ধরে যদি এগিয়ে যেতে পারো তাহলে তুমি মূলে পৌঁছে যাবেই। আর তখন দেখবে যে কোনো অপরাধ আসলে অতীতের পুনরাবৃত্তি অথবা অনুরণন অথবা প্রত্যুত্তর। তোমাকে অপরাধের লজিকে পৌঁছতে হবে। হবেই। সেটা না করলে অপরাধীকে ধরবে তুমি ঠিকই কিন্তু অপরাধ তোমার হাতছাড়া হয়ে থেকে যাবে।”
“স্যার… কী বলতে চাইছেন, যদি একটু সহজে… ”
“শুবিল আফ্রিকার দেশগুলোতে এখনও কিছু কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু এদের বিলুপ্তির মূল কারণ হল কেইনিসম।”
“কেইনিসম? মানে বাইবেলের সেই ভাই কেইনের মতবাদ? যে নিজের ভাইকে খুন করেছিল?”
“গুড!”
স্যার খুশি। যাক একটা পরীক্ষায় পাশ করা গেছে। চেয়ারে এবার ধপ করে বসে পড়া যায়। বেশ কিছুদিন আগেই স্যারের কড়া নির্দেশে বিভিন্ন দেশের মিথোলজি, পৌরাণিক গল্প, লোককথা ইত্যাদি নিয়ে চর্চা শুরু করেছে স্মার্ত। মিথোলজি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, এ সব পড়া ও পড়ানো স্যারের জন্য আবশ্যিক কর্তব্য। এতদিনে সে পড়া ফল দিতে শুরু করেছে তাহলে।
“এবার শোনো, এই পাখিদের একটা অদ্ভুত প্রবৃত্তি আছে। সেটা অবশ্য এই ধরনের বেশ কয়েকটা প্রিডেটরি পাখির ক্ষেত্রেই আছে। তবে শুবিলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভয়ংকর আকারে দেখা যায়। এদের মা পাখি দুটো করে ডিম দেয়। ডিম ফোটার পর বেশ কয়েক সপ্তাহ দুটি বাচ্চা ভালোভাবে একসঙ্গে থাকে। তারপর দেখা যায় একটি বাচ্চা একদিন অপর বাচ্চাটিকে আক্রমণ করে। কখন করে? যখন মা পাখি বা বাবা পাখিরা কাছাকাছি থাকে না। পাখির ছানাদুটির মধ্যে একটি অপরটিকে এত আঘাত করে যে সেই ছানা তখনই আধমরা হয়ে যায়। শক্তিশালী ছানাটি তার পালক ছিঁড়ে নেয়। তার চোখ খুবলে দেয়। তাকে শক্ত ঠোঁটের আঘাতে আঘাতে বিক্ষত করে দেয়। এরপর ফিরে আসে তাদের বাবা-মা। তখন কী হয় জানো?”
বোকার মতো মাথা নাড়ল স্মার্ত। এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হবে না, সেটা সে বুঝতে পারছে। স্যার তার দিকে একবার তাকিয়ে ধোঁয়ার একটা ফুল রিং ছাড়লেন। তারপর আবার শুরু করলেন।
“বাবা-মা এসে শক্তিশালী বাচ্চাটাকে সমর্থন করে। তারা ওই আহত বাচ্চাটিকে আরও টর্চার করে। করতে করতে তার বাঁচার ইচ্ছে বা অবস্থার হাইটেনশন রেখাটুকুকে পার করে দেয়। নিজের জন্মদাতা পিতা ও মাতা। বুঝলে? সে বাচ্চা নিজেই তখন আঘাতের প্রতিরোধ করা বন্ধ করে দেয়। এর মূল কারণ খাবারের প্রতিযোগিতা কমানো। ওদের ধারণা দুর্বল সন্তানদের বাঁচার অধিকার নেই। যে সবল হবে, সে-ই কেবল খাবে। এটাই ওদের চরিত্র। শক্তিশালীদের বাঁচাতে হবে। বাকিদের মুছে ফেলতে হবে।”
“কিন্তু, কেবল শক্তিশালীদের বাঁচাতে যদি এভাবে অর্ধেক পপুলেশন শেষ হয়ে যায়… ”
“কত সহজে বুঝলে কথাটা। তাই না?”
স্যার অদ্ভুত শান্ত একটা চোখে তাকালেন দত্তর দিকে। স্যারের চোখে একটা আলোছায়া খেলা করছে। মেঘ আর রোদ। জীবন আর মৃত্যু। কিন্তু সে ওই এক মুহূর্তই। তিন থেকে চার নম্বর মার্লবোরোটা ধরিয়ে স্যার আবার শুরু করলেন।
“এইভাবেই শেষ হয়ে যাচ্ছে শুবিল। দেখতে অনেকটাই ডাইনোসরের মতো। দু-পায়ে দাঁড়ালে প্রায় পাঁচ ফুট মানুষের মতো উচ্চতা হয়। এবার একটা কথা বলি। এদের মধ্যেও কোনো কোনো পাখি বেঁচে থাকে। কেইনের ভাই, সেই সব দুই-একটি অ্যাবেল জঙ্গলের আলাদা কোনো জায়গায় বাসা বাঁধে। বাবা-মা, পরিবার থেকে দূরে। নিজেদের মতো করে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে। এই প্রতিরোধী অ্যাবেলরা বেঁচে থাকে, বাঁচাতেও চেষ্টা করে যতদিন সম্ভব, তারপর… ”
“স্যার স্যার… ”
করিডর থেকে লম্বা দৌড়ে ঘরে ঢুকল কনস্টেবল রাহা।
দুই
“কতদিন ধরে কাজটা করছেন?”
“তিন বছর।”
“তিন বছর।” রুদ্রেশ নশ্বরের কথার প্রতিধ্বনি করলেন। স্যার কি কিছু ভাবছেন? কী ভাবছেন স্যার? স্মার্ত ভেবে পায় না। চার বছর ধরে লোকটা এই কাজ চালিয়ে গেছে অথচ কেউ কিছু জানতেও পারেনি? তাহলে আজকেই কেন হঠাৎ…
এই ঘরটা লালবাজারে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে স্যার আসার পর। স্যারের নির্দেশেই তৈরি হয়েছে। এটাই স্যারের নিজস্ব জিজ্ঞাসাবাদ ঘর। ঘরের দেওয়ালের রং ঘন লাল থেকে ক্রমশ কালো হয়ে উপরে সিলিং পর্যন্ত উঠে গেছে। মাঝে একটাই দানবাকার ল্যাম্প। হলুদ আলো লাল দেওয়ালে পড়লে একটা অদ্ভুত খুনখারাপি মায়া তৈরি হয়। স্যার শারীরিক অত্যাচার একদমই পছন্দ করেন না। উনি মানুষকে ভেতর থেকে ভাঙায় বিশ্বাসী। ওঁর থিয়োরি অনুযায়ী প্রথমে অপরাধটা ঘটে অপরাধীর মনে। তারপর সেটা বাইরের দুনিয়ায় আসে। তাই মনের দরজা খুলে একবার তাকে বুঝে নিতে পারলে সত্য নিষ্কাষণের আর কোনো উপায় লাগে না। তবে তার জন্য একটা বিশেষ আবহাওয়া লাগে। ঘরটাকে সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে। তার সঙ্গে আছে বসার পজিসন, শরীরের ভঙ্গি, গলার স্বর। স্যার এ সবে মাস্টার। এ ঘরে খুব বেশিক্ষণ কেউ থাকলে তার একটা মানসিক টলমলে ভাব তৈরি হয়, স্মার্ত দেখেছে।
কিন্তু এই লোকটা একেবারেই অন্যরকম।
বয়সে স্যারেরই কাছাকাছি হবে। ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ। মেদবর্জিত শরীর। শ্যামলা রং। তবে মুখটা বোধহয় রোদে পোড়ার জন্য একটু বেশি কালো হয়ে গিয়েছে। গালে হালকা চাপ দাড়ি। চোখে একটা কালচে খয়েরি ফ্রেমের বাঁধানো পুরোনো দিনের চশমা। নশ্বরের হাতদুটো ওঁর স্টিলের চেয়ারের দুই হাতলের সঙ্গে বাঁধা আছে। মেরুদণ্ড সোজা। পা স্বাভাবিক চেয়ারে বসার মতোই, শুধু চেয়ারের দুই পায়ার সঙ্গে নাইলনের দড়ি দিয়ে বিশেষ গিঁটে বাঁধা। এ অবস্থানে এক ঘণ্টার বেশি বসা খুব কষ্টকর। শরীর ছেড়ে দিতে চায়, কিন্তু বাঁধন ছাড়তে চায় না। তখন ভেতর থেকে যত প্রতিরোধ আসে ততই যন্ত্রণা বাড়তে থাকে। সে যত না শরীরের, তার থেকে বেশি মনের। খুব বেশিক্ষণ শরীর একই অবস্থানে থাকলে সেটাই তার জন্য স্ট্রেস পজিসন হয়ে যায়। সেটা শুয়ে থাকা হলেও। তার সঙ্গে বাইরে চলে অবিরাম প্রশ্ন।
এভাবে ভেতর আর বাইরের ভয়ানক টেনশনে অপরাধী হাল ছেড়ে দেয়।
কিন্তু এ কেমন লোক! বাইরে বাইরে ঘোরাফেরা করা রোদে পোড়া মুখ। গত ছিয়ানব্বই ঘণ্টা অন্ধকার ঘরে থাকার পরেও ভয়ের বা সমর্পণের ছাপ টের পাওয়া যাচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে যেন দুই বন্ধুর স্বাভাবিক কথোপকথন চলছে। স্যার একের পর এক প্রশ্ন করছেন। ও উত্তর দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে একই প্রশ্ন চারদিন ধরেই স্যার করে চলেছেন। ও কিন্তু একবারও বিরক্ত হয়নি। মেজাজ হারায়নি। হারাবে কেন। ও তো ধরা দিতেই এসেছে। আর সেখানেই সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন। বাইরের ঝামেলা সম্পর্কে ও কী কিছু জানে? আন্দাজ করেছে? এটা কি পুলিসকে অপমান করার কোনো বিশেষ চক্রান্ত? মিডিয়া কী চাইছে! প্রশ্ন অনেক। উত্তরগুলো বোঝা একান্ত জরুরি। স্যার সে চেষ্টাই করে চলেছেন গত চারদিন।
“আপনি একটা কলেজে পড়ান। তাই তো?”
“পড়াতাম। ইঞ্জিনিয়ারিং।”
“আপনার বিষয় মেকানিক্স।”
“ছিল।”
“আপনি সবই পাস্টটেন্সে বলছেন। কেন?”
“এ উত্তর কি আগেরদিনই আমি আপনাকে দিইনি অফিসার?”
“দিলেও আবার দিতে হবে। গত তিন দিনে আপনি আপনার মেথড, কাদের মেরেছেন এগুলো বলেছেন। এবার আমরা একটু অন্য দিকে যাব। আপনি এখনও পর্যন্ত পাওয়া হিসেব মতো বিয়াল্লিশ জন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। তারপর নিজেই এসে ধরাও দিয়েছেন গর্ব করে। এটুকু তো সহ্য করতেই হবে আপনাকে, তাই না।”
“আপনার তিনটে কথায় আমার আপত্তি আছে অফিসার। এক নির্মমভাবে শব্দটায়, দুই গর্ব শব্দটায়। আমি নির্মমভাবে কাউকেই মারিনি। ওরা মারা যাবার সময় একফোঁটাও কষ্ট পায়নি। পেইনলেস ডেথ। আর দুই, আমি গর্ব করিনি। যে কাজ করেছি সেটা স্বাভাবিক কাজ ছিল। অন্য কেউ সাহস করে করেনি, আমি করেছি। কাপুরুষ না হবার জন্য গর্ব করা তো মূর্খের কাজ। আমি মূর্খ নই।”
হঠাৎ করে দমকা কাশি এল। নশ্বর যেন বেঁকে গেল কাশির ধাক্কায়।
মাথার উপর হালকা দুলছে তিনশো ওয়াটের ক্ষুরধার দৈত্যাকার ইন্টারোগেশন ল্যাম্প। নিজের ছায়া পুলিসি দেওয়ালে আস্তে আস্তে ক্ষয়ে আসছে। কিন্তু এত শান্তভাবে কোন্ অপরাধী কথা বলে? সাইকোপ্যাথরাও এরকম হয় না। স্মার্ত অতীতে স্যারের সঙ্গে দুজন সাইকোপ্যাথকে নিয়ে কাজ করেছে। তারা এরকম ‘দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা, সুখেসু বিগতস্পৃহ’ টাইপ মোটেই ছিল না। স্মার্ত যত দেখছে ততই হতবাক হচ্ছে।
স্যারের গলায় অবশ্য কোনো তারতম্য নেই।
“আপনি যে মূর্খ নন সে কথা একশোবার মানি আমি। কিন্তু আপনি এখনও বলেননি যে আপনি কেন ধরা দিলেন। যেভাবে এগোচ্ছিলেন তাতে সেঞ্চুরি করতে খুব বেশি হলে আপনার আর বছর দুয়েক লাগত।”
স্যারের গলায় ওটা কি শ্লেষ? এত গম্ভীরভাবে, এমন সিরিয়াস মুখে স্যার কথাটা বললেন যেন… যেন…
নশ্বরের কাশি থামছে না এখনও।
“বিসমিল্লা!” দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডকে চড়া গলায় ডাকলেন স্যার।
“সাব!”
“ইনকে লিয়ে নিম্বুপানি লে আও।”
দু’বার করে খাবার আর চার বার জল। দিনে দু-বার বাথরুম—একবার সকালে একবার সন্ধ্যায়। এই রুটিনে রুদ্রেশ রেখেছেন ওঁকে। গত চার দিন। রাখতে পারার কথা নয় যদিও। কারণ একটা নয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ একটাই। জনতা ও মিডিয়ার বিপুল অ্যাটেনশন। কনকনে শীতের এই সন্ধ্যায় থানার বাইরে এখনও অন্তত শ’খানেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মোমবাতি। প্ল্যাকার্ড।
ছেলেটার মুখচোখ টানছে। জিব দিয়ে বার বার ঠোঁট চাটছে। সকাল থেকেই জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। মাঝে একটু বিশ্রাম ছিল। তারপরই ঘটনাটা ঘটল। এ ঘরে স্যার না থাকলে ভেতরে কারো থাকার পারমিশন থাকে না। দরজা বন্ধ থাকে, বাইরে গার্ড থাকে। দুপুরে খেতে দেবার সময় গার্ড ভেতরে ঢোকে একবার। আজ দুপুরে খাবার পর গার্ড থালা বার করতে এসে দেখে ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। সিভিয়ার সোডিয়াম ফল। এই শীতে! উত্তেজনাতেও হতে পারে। চার চারটে দিন এই ঘরে। বড়ো সহজ কথা নয়। তারপর থেকেই এক ঘণ্টা ছাড়া ওকে ও-আর-এস বা লেবুজল দেওয়া হচ্ছে।
বিসমিল্লা গ্লাস হাতে ঢুকল।
“এক ঢোঁক। তারপর প্রথমবারের গল্পটা শুনব।”
জলের গ্লাসটা ওর মুখের সামনে ধরলেন স্যার নিজেই।
“আমার হাতটা একটু খুলে দিন। আমি পালাব না,” শান্ত গলা। আবার।
স্যার কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হাতটা নিজেই খুলে দিলেন।
ঢক ঢক করে বেশ খানিকটা তরল গলায় চালান দিল সে।
তারপর বলল, আমি তখন দুর্গাপুরে। ওখানকার কলেজে পড়াই। বছর চারেক আগের কথা। ওখানেই সরকারি কোয়ার্টারে থাকি। মেয়েটা আমার কাছে এসেছিল অনেকটা রাতে। দরজা খুলতেই বিনা ভূমিকায় বলল তিনটে ছেলে ওকে র্যাগিং করেছে। র্যাগিং মানে নরম্যাল র্যাগিং নয়, যাতে ছোটোখাটো টাস্ক দেওয়া হয়। বা টিজ় করা হয়। ওরা মেয়েটার নগ্ন ছবি তুলেছে। ও ভরতনাট্যম শিল্পী। ওকে নাচতে বাধ্য করেছে। পোশাক ছাড়া। তারপর রোজ রাতে পালা করে ওর কাছে শুতে আসছে। শখ না মেটা পর্যন্ত এভাবেই ওরা আসতে থাকবে। সেটা জানিয়ে গিয়েছে। সেটা আমার দেখা প্রথম কেস ছিল না। এর আগেও বেশ কয়েকবার এই ঘটনা ঘটেছে। প্রিন্সিপালকে জানিয়ে লাভ নেই। এরা প্রভাবশালীদের ছেলে। হোস্টেলের ওয়ার্ডেনও তথৈবচ। কথা শুনবে বলে মনে হবার আদৌ কোনো কারণ নেই। তবে এর আগেরগুলো এই পর্যায়ে যায়নি। এটা গেছে। মেয়েটা আমাকে বলেছিল, ‘স্যার আমি মরতে যাচ্ছি। আমি ভদ্রঘরের মেয়ে ছিলাম। আমাকে ওরা বেশ্যা বানিয়ে দিয়েছে স্যার।’ সে রাতে ওকে নিজের কাছেই রাখলাম। পরদিন সকালে লোকাল গার্জেন ডাকিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থাও করলাম। ও কোনো লিখিত অভিযোগ করতে রাজি ছিল না। ওর শারীরিক এবং মানসিক দুটো চিকিৎসাই দরকার ছিল। ভাবলাম কিছুদিন যাক, সব ঠিক হবে হয়তো।
কিন্তু না। সেটাই ভুল ছিল আমার। মেয়েটার বাবা-মা সব জানার পর ওকে বাড়িতে থাকতে দিল না। সি ওয়াজ় প্রেগন্যাণ্ট। কলকাতায় মামার বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা হল। অ্যাবর্শন হবে। এটাও ও আমাকে জানাল। আমি বললাম, ‘এত কম বয়সে মা হওয়াটা সত্যিই ঠিক নয়। না তোমার জন্য, না বাচ্চার জন্য। কে কাকে দেখবে। তা ছাড়া বাবার পরিচয় নিয়েও একটা সমস্যা তৈরি হবে। সব মিলিয়ে’… ”
হঠাৎই ছোটো ঘরটা যেন গরম হয়ে উঠল। এরকম তো হবার কথা নয়। স্মার্ত চমকে স্যারের দিকে তাকালো।
“তারপর… ” স্যারের ভ্রুক্ষেপ নেই।
“মেয়েটা কলকাতা যাবার পথে বিষ খায়। তেথিটন।”
“মেকানিক্সের ল্যাবে যে তেল থাকে?”
“হ্যাঁ, ওটা বিষ।”
“তারপর?”
“ওর চার মাসের স্কলারশিপ পাওয়া বাকি ছিল। কলকাতা যাবার আগে ও আর একবারই আমার কাছে আসে। রাতে। নিজের বাচ্চা কুকুরটাকে আমার কাছে দিয়ে যায়। রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল। ওদের ফ্যামিলির অবস্থা সেরকম কিছু নয়। বাবার একটা দোকান আছে। ওর আরেক বোনও ছিল। আমি প্রিন্সিপালকে শান্তভাবে বলেছিলাম যে ওর টাকাটা ওর বাবা-মাকে যাতে দেওয়া হয়। এক মাস গেল, দু-মাস গেল, তিন মাস গেল। প্রতি মাসেই প্রিন্সিপাল বলতেন ‘দেখছি’। ষষ্ঠ মাসে গিয়ে আমি ঝাঁপালাম। বললাম আর কতদিন দেখবেন? প্রিন্সিপাল ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘ও টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে।’
“কীভাবে সম্ভব?”
“কীভাবে সম্ভব। খুব ভালো প্রশ্ন। টাকাটা ওই ছেলেদের ইউনিয়ন ফান্ডে দেওয়া হয়। কারণ ইলেকশনে ওরা জিতেছিল। নেতাদের তরফে ফিস্ট দেওয়া হয়েছিল।”
“একজন মেয়ের ব্যক্তিগত স্কলারশিপের টাকা ইউনিয়নের ফিস্টে?”
“হ্যাঁ। সেই তিনটে ছেলে। প্রিন্সিপালের ঘর থেকে বার হতেই তারা ধরল আমায়। “স্যার, খুব কষ্ট হচ্ছে? চিন্তা করবেন না, নতুন আইটেম দেব। আমরা জানি রাতে ও যেত আপনার কাছে। আমরা দেখছি, কী করা যায়।” বুঝলাম সে রাতে আমার কাছে ওর আসার কথা ওরা জেনেছে। সামলাতে পারলাম না। একটা থাপ্পড় মেরেছিলাম ছেলেটাকে।”
“তারপর?”
“আমি দু-দিনের মাথায় সাসপেন্সনের নোটিশ পাই। চারদিন পর চাকরি ছেড়ে দিই।”
“আর তার একমাসের মধ্যেই চারজন মারা যায়। তিনটি ছেলে আর প্রিন্সিপাল।”
“হ্যাঁ। হাই ডোজে তেথিটন মিশিয়ে দিয়েছিলাম ওদের খাবারে।”
“কী করে সন্ধান পেলেন ওদের খাবারের?”
“যারা বিবেকহীন হয়, আর যাদের নিষ্ঠুরতা কখনও শিক্ষা পায়নি, তারা একই সঙ্গে খুব কেয়ারলেস হয় অফিসার। ওদের বাড়িতে ব্রেক-ইন করার মতো সোজা কাজ আর একটাও পাইনি আমি।”
“সেই শুরু।”
“সেই শুরু।” এবার নশ্বর প্রতিধ্বনি করল।
“আপনি কলকাতায় যে কেসগুলি ঘটিয়েছেন সেগুলো নিয়ে আমার আগ্রহ আছে। একদিনে সব কেস দেখা হয়নি, কলকাতারগুলো দেখেছি। আমার এরিয়ার মধ্যেই পড়ে। রাজু চৌবে।”
“রাজু!” চোখ বুজল লোকটা। মানসচোখে একবার দেখে নিতে চাইল কী গল্পটা?
“রাজু ভালো ছেলে ছিল। বেড়াতে নিয়ে যেত লোককে। নিজের এজেন্সি খোলার চেষ্টা করছিল। সেবারে অরুণাচল যাবার জন্য ত্রিশ হাজার করে টাকা তুলেছিল। আমার এক বন্ধু, তার মাকে নিয়ে যাবে ঠিক করেছিল। ত্রিশ ত্রিশ ষাট হাজার টাকা। যেতে পারল না। রাজু বলেছিল গ্রুপে প্রয়োজন মতো লোক হয়নি। যে পাহাড়ে মদ চলে না, মেয়ে চলে না, সে পাহাড়ে লোক হয় না। রাজু সেটা জেনেও ওদের জানায়নি। তারপর থেকে এক বছর ধরে ওরা টাকাটা ফেরত চেয়ে গিয়েছে ওর থেকে। ও প্রতিদিনই বলত ‘দেখছি’। রাজুর মা হসপিটালে ভরতি হলেন। ওরা বড়োলোক নয়। ডিপোজ়িট মানি পঞ্চাশ হাজার চাইল হসপিটাল। রাজু সেদিন হসপিটাল থেকে ফোন করেছিল ওকে। ও বলেছিল…
“দেখছি… ” স্যার আর নশ্বর একই সঙ্গে শব্দটা বললেন।
নশ্বর কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেল। তারপর বলল, “রাজুর মা অ্যাডমিট হতে পারেননি। সে রাতেই মারা যান।”
তারপর আবার খানিকটা নৈঃশব্দ। সেটা ভাঙলেন স্যারই।
“আমার মনে তাও একটা প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।”
“বলুন।”
প্রত্যেকবার আপনি হত্যা করেছেন বিষপ্রয়োগে। খুব কাছ থেকে মেরেছেন আপনার ভিকটিমদের। তার জন্য তাদের জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি জানাটা খুব জরুরি। জরুরি তাদের কাছে পৌঁছে যাওয়া। এই সমস্ত কাজ গোছাতে এভারেজ যে সময় লাগার কথা, আপনার লেগেছে তার অর্ধেকেরও কম। কীভাবে?”
শান্ত, গভীর চোখ তুলে স্যারের দিকে তাকালো লোকটা।
“আপনি আর পাঁচজন পুলিস অফিসারের মতো নন। আপনার চোখ আছে। আপনাকে একটা অনুরোধ করব?”
“বলুন?”
“আমাকে নিমতলায় পোড়াবেন প্লিস।”
“আপনার ফাঁসিই হবে এটা ধরে নিচ্ছেন কেন? যাবজ্জীবন ও… ”
“কে বলল আপনাকে যে আমার ফাঁসি হবে?” লোকটার কথায় কিছু একটা ছিল। এমন কিছু্ যেটা সহজ নয়। ও গর্ব করেনি। ও যেন নিশ্চিত ছিল ওর সঙ্গে কী হবে সে বিষয়ে।
রুদ্রেশ যেন জেগে উঠলেন। “বাইরে অনেক লোক। বলা ভালো আপনার ফ্যান। আপনি যে ধরা দিচ্ছেন সেটা মিডিয়া জেনেছে। কীভাবে?”
“আমিই জানিয়ে এসেছি। এখানকার চারটে লিডিং খবরের কাগজে মেল করে এসেছিলাম, ধরা দেবার আগে।”
খর দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকালেন রুদ্রেশ। তারপর বললেন, আপনাকে একবার ওদের অ্যাড্রেস করতে হবে। ওদের এখান থেকে চলে যেতে বলতে হবে। না হলে সমস্যা হচ্ছে। একশো চুয়াল্লিশ ধারা বজায় রাখা যাচ্ছে না। দিনে রাতে লোক ভিড় করছে। মিডিয়া রোজ নাটক দেখাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে। ওদের বলুন আপনি নিজেই ধরা দিতে চেয়েছেন।”
“বেশ। চলুন।”
এক কথায় রাজি হয়ে গেল লোকটা?
ও যেন এটাই চাইছিল। স্মার্তের মন কু গাইছে। কিছু একটা ঠিক নেই। কী ঠিক নেই সেটা ও বুঝতে পারছে না। কিন্তু ওর পুলিসি সেন্স বলছে সামথিং ইস রং। এদিকে সিপির মুহুর্মুহু চাপ, লোক সরাতে হবে। মিডিয়াকে শান্ত করতে হবে। অপরাধীকে আদালতে পেশ করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আর এগুলোর একটাও বাহুবল দিয়ে করা চলবে না! স্মার্ত দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল গোপনে। ওরা নাকি পাথর, লাঠি চেইন, এ সবও এনে রেখেছে। যে কোনো মুহূর্তে একটা বিস্ফোরণ হতে পারে। তাহলে সরকারের বদনাম হবে। ঠান্ডা মাথায়, কূটবুদ্ধি দিয়ে কাজ করা দরকার। এটা গোটা রাজ্যের পুলিসের সদর দফতর। চালে সামান্য ভুল হলে দেশে আইনের শাসন বলে আর কিছু থাকবে না।
সবাই নশ্বরের পদ্ধতিটাকেই বেছে নেবে বিচার হিসাবে।
স্যার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা ভেবেই নিয়েছেন। জানে স্মার্ত।
পরিশিষ্ট
“নশ্বরকে ছেড়ে দাও। নশ্বরই নতুন আইন। আমাদের ঈশ্বর নশ্বর।”
বিক্ষোভকারীরা সামনের বড়ো উঠোনটার জায়গায় জায়গায় জটলা করছে। রাত ৯টা বাজে। এমন সময় লালবাজারে স্যারের ঘরের বাইরের বারান্দায় চড়া দুটো আলো জ্বলে উঠল। নশ্বরের রোগা, শক্ত হাতে মাইকটা দিলেন স্যার। পিছনে স্মার্ত, রাহা, বিসমিল্লা সহ আরও তিনজন কন্সটেবল।
“আপনারা আমার জন্য এখানে এসেছেন?”
“হ্যাঁ।”
জনকলরবে উল্লাসের ছোঁয়া টের পাওয়া গেল।
“আপনারা আমার মুক্তি চান?”
“হ্যাঁ।”
ওদের কি ম্যানিপুলেট করছে লোকটা? স্মার্তের হাত-পা শক্ত হল।
“কিন্তু আমি যে মৃতদের হাত থেকে মুক্তি চাই না।”
আনন্দের কোলাহল মুহূর্তে শ্মশাণের স্তব্ধতায় বদলে গেল। গাছে একটা পাতা পড়লেও শোনা যাবে। সেই আকাশ-বাতাস ভরা হা হা শূন্যতার মাঝখানে গমগম করে উঠল নশ্বরের স্বর।
“শুনুন, একটা গল্প বলি আপনাদের। আমার এক বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু পাঁচ বছর আগে একটা ড্রাগ তৈরি করেছে। সেটা সাধারণ জিনিস নয়। মিলিটারি ড্রাগ। গোপন জিনিস। সে জিনিস মানুষের ওপর টেস্ট করে দেখা চলছে এখনও।”
“স্যার! এ সব কী বলছে ও! স্যার! ওকে থামানো দরকার এখনই!”
স্মার্ত, রাহা একসঙ্গে কথা বলল। কনস্টেবলরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। জনতার মধ্যে কেউ কেউ ভিডিয়ো রেকর্ডিং শুরু করেছে।
“সিপিকে বলা আছে দত্ত। ওঁকে দশ মিনিট দেওয়া হয়েছে অ্যাড্রেস করার জন্য। ওঁকে বলতে দিতে হবে, যা উনি চান।”
“তো আমার বন্ধুর দৌলতে সেই ড্রাগটা পেয়ে গেলাম। কী করত এই ড্রাগ? সেটা জানার আগে চলুন ইতিহাসের ছোট্ট একটা গল্প জানি। মানুষের মনের একদম ভেতরে যে অন্ধকার সত্তা থাকে, ফ্রয়েডসাহেব যার নাম দিয়েছেন ইড, তাকে সহজে জাগানো যায় না। কিন্তু সে যদি একবার জেগে যায়, তাহলে ভারী বিপদ। কারণ ভেতরের এই মানুষটা বড়ো অদ্ভুত। ভয়ংকর, শক্তিশালী অনুশোচনাহীন। সে শুধু খিদে বোঝে। আর খিদের নিবৃত্তি বোঝে। এই খিদে কেবল খাবারের জন্য খিদে নয়। খিদের অনেক রকমফের আছে।”
এক মুহূর্তের জন্য দম নিল নশ্বর। ও কি ক্লান্ত বোধ করছে?
“আমার খিদে ছিল রক্তের। আমার বন্ধু আমাকে বারবার করে সাবধান করেছিল। এ ড্রাগ কেবল তারাই নিতে পারে যারা ভেতর থেকে বিষাক্ত। শক্তিশালী। না হলে এ ড্রাগ লোককে শেষ করে দেয়। আমার ভেতরে বিষ ছিল। তাই আমি নিতে পেরেছি। নিয়ে বেঁচেও থাকতে পারছি এতদিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি এরকম কিছু সৈন্য তৈরি করেছিল। বিশেষ কিছু শব্দ শোনালে তাদের ভেতরের ইড, তাদের আদিম জানোয়ারটা জেগে উঠত। ওই শব্দটাই তাদের ট্রিগার। তখন তারা পারত না এমন কোনো কাজ ছিল না। তাদের নাক স্নিফার কুকুরের মতো সজাগ হয়ে উঠত। তাদের হাত আর মাথা সাধারণ মানুষের চেয়ে দশগুন ক্ষুরধার হয়ে উঠত। লোকে যে কাজ করতে এক ঘণ্টা নেয় সেই লোক তখন সে কাজ দশ মিনিটে করতে পারত। ওটা দিয়ে সৈন্যবাহিনী গড়ে তুললে কী হবে, বুঝতে পারছেন তো?”
স্তব্ধ জনগণের ভেতর থেকে একটা সামান্য গুঞ্জন ভেসে উঠেই থেমে গেল।
“যাক, বুঝলে ভালো। না বুঝলে আমার কিছু না। তো যা বলছিলাম। এই ড্রাগটা ভেতরে গিয়ে কাজ করে বিশেষ একটা শব্দে। সেই শব্দ এক-একটা লোকের ক্ষেত্রে এক-এক রকম। যে শব্দে আপনার ভেতরে রাগ হয়, সেটা দিয়ে চেষ্টা করলেই সাফল্য আসবে। সেই শব্দটা বাইরে কারোর মুখে শুনলে সেটাই তখন হবে আপনার ট্রিগার। আমার ট্রিগার তৈরি করেছিলাম আমি নিজে। বারবার নিজের মধ্যে সেই শব্দের সঙ্গে যুক্ত ঘটনাগুলো মনে করে করে, মাথার ভেতরের শিরায় স্মৃতির আঁচড় বুলিয়ে বুলিয়ে ক্ষতগুলো গভীর করতে পেরেছিলাম। নিজের ভেতরের খিদেটাকে বাড়িয়ে ওই ড্রাগটাকে কাজে লাগাতে পেরেছিলাম। তাই আমি এতগুলো লোককে মারতে পেরেছি পোকামাকড়ের মতো।”
চারপাশের হাওয়া থমথম করছে।
“আমি পেরেছি। কিন্তু আপনারা পারবেন না। কারণ আপনাদের মধ্যে রাগ আর অবশিষ্ট নেই। রাগ পবিত্র জিনিস। আপনারা সেই লোক, যাঁরা কদিন আগে চপলার ভিডিয়ো শেয়ার করেছেন। কুসুম যখন পাশের বাড়িতে বরের হাতে মার খাচ্ছিল তখন আপনারাই বলেছেন ‘ওটা ওদের ব্যাপার’, আপনারাই শাজাহান আর কৃষ্ণার বিয়েটা ভেঙেছেন। আপনারাই নিজেদের এমপ্লয়িকে টার্গেট ফিলিং-এর নামে মানসিক চাপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন। কিন্তু আমি আপনাদের সবাইকে মারতে পারিনি। মারা উচিত ছিল। কিন্তু পারিনি। কারণ আমার একটা ট্রিগার আছে। আর আমার ক্ষেত্রে ওই শব্দ নামক ট্রিগারটা হল ‘দেখছি’। আপনারা সবাই দেখেন। আপনাদের বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবকে যখন সমাজ খেয়ে ঢেকুর তোলে, আপনারা দেখেন। তারপর শান্ত মনে মুখ মুছে বাড়ি চলে যান। আজ আপনাদের সকলের হাতে অস্ত্র তুলে দিলেও আপনারা কাউকে মারতে পারবেন না। প্রতিবাদ করতে পারবেন না। লিখে নিন সবাই। ড্রাগটার নাম শুবিল।
পারবেন না আপনারা। মিলিয়ে নেবেন।
আপনারা মৃত। আমি কেবল জীবন্ত কয়েকটা লাশকে পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়েছি। আপনারা আর কতদিন দেখবেন, আপনারাই ভাবুন। তবে এখানে থেকে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। ক্ষমতা থাকলে আপনাদের সবাইকে আমি… ”
প্রথম পাথরটা ছুড়েছিল একটা আঠারো বছরের ছেলে। জনতার মানসিকতা কীভাবে মুহূর্তে বদলায়, কী ভয়ংকরভাবে বদলায়, সেটা এভাবে দেখার দুর্ভাগ্য আগে কখনও হয়নি স্মার্তর।
…
“আমার টমি। আপনার তৃতীয় ভুল রুদ্রেশ। আমার টমি। বিয়াল্লিশ না। আমার হত্যার সংখ্যাটা তেতাল্লিশ। ওর মাংসটা ওদের মাংসের পাশেই রাখা ছিল সেদিন। আমার বেখেয়াল। কোনটায় বিষ মেশানোর কথা, আর কোথায় মেশালাম… । এই ড্রাগ আমার শরীর এমনিতেও আর বেশিদিন নিতে পারত না। আমার ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছিল। যা হল, ভালোই হল। ও আছে নিমতলায়। ওর সঙ্গে আমাকেও যেতে দেবেন প্লিস।”
শেষবারের মতো থেঁতলে যাওয়া কৃতজ্ঞ চোখ বোজবার আগে ওটাই ছিল রক্তাক্ত নশ্বরের শেষ কথা। ও কি কেইন ছিল? নাকি শুবিল পাখির দলের প্রতিরোধী অ্যাবেল? কিন্তু যে প্রশ্নটা স্মার্তের মনে মরা পাখির পালকের মতো ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে নামতে থাকে সেটা এটা নয়।
রুদ্রেশ কি নশ্বরকে বারান্দা থেকে সরাতে মিনিটখানেক দেরি করেছিলেন সেদিন?
পালকটা ধীরে ধীরে নামতে থাকে গভীরে, আরও গভীরে।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান, শরণ্যা মুখোপাধ্যায়