এসো, মোরা মিলি একসাথ
লেখক: আইজ্যাক আসিমভ, অনুবাদ - সায়ক দত্ত চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
শতাব্দীব্যাপী থমথমে শান্তি ছেয়ে থাকায় মানুষ ভুলেই গিয়েছিল যে কখনো পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। ফলে যখন জানা গেল যুদ্ধ দোরগোড়ায় এসে পড়েছে, কি করা উচিত তা কেউ ভেবেই পাচ্ছিল না।
একই অবস্থা হল ব্যুরো অব রোবোটিক্সের প্রধান এলিয়াস লিন-এরও। দীর্ঘদিন বিকেন্দ্রীকরণের নীতি মেনে চলার ফলে এই ব্যুরোর প্রধান দপ্তর ছিল শায়ানে। তারই একটা ঝকঝকে ঘরে তিনি সন্দেহপ্রবণ মুখ করে এই দুঃসংবাদ বয়ে আনা ওয়াশিংটন থেকে আসা প্রতিরক্ষা দপ্তরের কমবয়সি অফিসারটির দিকে আড়চোখে চাইলেন।
এলিয়াস লিন বেশ বড়োসড় চেহারার মানুষ। তিনি সবসময়ই খুব শান্ত ও খোশমেজাজে থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সামান্য ঠেলে বেরিয়ে আসা নীল চোখের দৃষ্টির সামনে পড়লে প্রায় সকলেই অস্বস্তিতে ভোগে। অফিসারটির অবশ্য কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।
লিন ঠিক করলেন তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া অবিশ্বাসই হওয়া উচিত। হ্যাঁ, অবিশ্বাস। তিনি এখনো সংবাদটা হজম করতে পারছেন না।
আরামদায়ক চেয়ারে শরীর হেলিয়ে দিয়ে নিজেকে সামলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “খবরটা কতদূর সত্যি হতে পারে?”
তাঁর সামনে বসে থাকা তরুণ অফিসারটি নিজের নাম বলেছিল র্যালফ জি ব্রেকেনরিজ। প্রয়োজনীয় নথি এবং পরিচয়পত্রের সাহায্যে তার পদমর্যাদা ও অন্যান্য তথ্যের যাচাই হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। কম বয়সের লালিত্য এখনো তাকে ছেড়ে যায়নি। লালচে ঠোঁট, অল্প উত্তেজনাতেই লাল হয়ে যাওয়া ফোলা গাল, নির্দোষ চোখের নওজোয়ানটির পোশাক শায়ানের পোশাকবিধির সঙ্গে পুরোপুরি না মিললেও দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এসেছে প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রধান দপ্তর থেকে। এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও সেটা এখনো সম্পূর্ণ বাতানুকূল ওয়াশিংটনেই অবস্থিত।
প্রশ্নটা শুনে তার গাল রক্তিম হয়ে উঠল। “এ খবরের সত্যতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।” সে বলল।
“আপনারা নিশ্চয়ই ওদের সম্পর্কে সব খবরাখবরই রাখেন।” লিনের স্বরে একটা প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপের সুর খেলা করল। এর সঙ্গে তিনি ‘ওদের’ শব্দটাতে একটা বাড়তি জোর দিলেন। অনেকটা ইংরেজি লেখার সময় বড়ো হাতের বর্ণ ব্যবহার করার মতো। গত প্রজন্ম থেকে যে শব্দটার ব্যবহার শুরু হয়েছিল এই প্রজন্মে শত্রুদের সম্পর্কে সেটার ব্যবহার বহুল প্রচলিত হয়ে গেছে। এখন আর কেউ ‘পুব’ বা ‘লাল’ বা ‘সোভিয়েত’ বা ‘রাশিয়ান’ বলে না। এই শব্দগুলো বিভ্রান্তিরই জন্ম দেয় কেবল। কারণ এখন শত্রুদের অনেকেই পুবের নয়, লাল নয়, সোভিয়েতও নয়, রাশিয়ান তো নয়ই। তাই এখন ব্যবহৃত শব্দগুলো হচ্ছে আমরা আর ওরা। সহজ, সরল, সঠিক।
পান্থদের থেকে যা জানা যায়, ওদের দেশেও এখন এই শব্দদুটোই ব্যবহৃত হয়। অবশ্য ওখানে ওরা হল আমরা (অবশ্যই ওদের ভাষাতে।), আর এখানে যাদের আমরা বলে, তাদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয় ওরা।
অবশ্য এখন আর এসব নিয়ে কেউ খুব একটা চিন্তাভাবনা করে না। গোটা বিষয়টাই সাধারণ আর সহনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি পারস্পরিক ঘৃণা বোধটাও প্রায় উধাও হয়ে গেছে। প্রথম দিকে এটাকে ঠান্ডা যুদ্ধ বলে ডাকা হত। এখন যেন এটা একটা খেলায় পরিণত হয়েছে। নিয়মমাফিক চলতে থাকা একটা খেলা, যাতে যথেষ্ট শালীনতা আর সুস্থ প্রতিযোগিতা খুঁজে পাওয়া যায়।
লিন খানিকটা উদ্দেশ্যহীনের মতোই বলে উঠলেন, “ওরা এই পরিস্থিতিটাকে নষ্ট করতে চাইবে কেন?”
কথাগুলো বলে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দেওয়ালে ঝোলানো বিশাল বিশ্ব মানচিত্রটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সেটা এবড়োখেবড়ো রেখায় প্রধানত দুটো ভাগে বিভক্ত। বাঁ দিকের বেশির ভাগ অঞ্চল স্বচ্ছ হালকা সবুজ আর ডানদিকের প্রায় পুরোটা তেমনই হালকা গোলাপি রঙে রাঙানো। ‘আমরা’ আর ‘ওরা’।
গত এক শতাব্দীতে এ মানচিত্রের খুব একটা রদবদল ঘটেনি। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্যে ফরমোসাকে হারানো আর পূর্ব জার্মানির যোগদানই ঘটেছে কেবল। তাও প্রায় আশি বছর আগে। তারপর স্থিতাবস্থা।
অবশ্য আরেকটা পরিবর্তন এ মানচিত্রে ঘটেছে। দু প্রজন্ম আগে এই মানচিত্রের সামনে দাঁড়ালে ওদের অঞ্চলটা টকটকে লাল হত, আর ‘আমাদের’টা ধপধপে সাদা। এখন ব্যবহৃত রং দুটো অনেকটাই নিরপেক্ষ। এমনকি লিন ওদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, ওদের মানচিত্রেও এই রং দুটোই ব্যবহৃত হয়।
“নাঃ, ওরা এমনটা করবে না।” তিনি বললেন।
“ওরা এমনটাই করছে।” ব্রেকেনরিজ বলল। “যত তাড়াতাড়ি এটা মেনে নেবেন, ততই ভালো। যদিও আমি এটা বুঝতে পারছি স্যার, ওরা আমাদের থেকে রোবোটিক্সে অনেক অনেক এগিয়ে গেছে এটা স্বীকার করা খুবই কষ্টকর।”
তার দৃষ্টি আগের মতোই নিষ্পাপ, কিন্তু তার কথাগুলো একেবারে ধারালো ছুরির মতো বেঁধায় লিন ভিতরে ভিতরে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লেন।
অবশ্য সে জন্যেই রোবোটিক্সের প্রধান এত পরে ঘটনাটা জানতে পারলেন, তাও আবার প্রতিরক্ষা দপ্তরের একজন সাধারণ অফিসারের মাধ্যমে। সরকারের কাছে তিনি তাঁর গুরুত্ব হারিয়েছেন এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। যুদ্ধ যদি লাগে, আর তাঁর দপ্তর যদি সফল না হতে পারে, তাঁকে অবশ্যম্ভাবীভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। এবং তাঁকে নিশ্চিতভাবেই ক্ষমা করা হবে না।
“যদি ওরা আমাদের চেয়ে কিছুটা এগিয়েও থাকে,” লিন উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “খুব একটা বেশি কিছু এগিয়েছে বলে মনে হয় না। আমরাও কল-মানব বানানো শুরু করেছি।”
“করেছি নাকি স্যার?”
“হ্যাঁ, পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটা তো বানিয়েইছি।”
“ওগুলো ওরা দশ বছর আগেই বানিয়ে ফেলেছে। এক্ষেত্রে ওরা আমাদের চেয়ে দশ বছর এগিয়ে আছে।”
লিন অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, গোটা ব্যাপারটার প্রতি তাঁর যে এই অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তা কি তাঁর কাজ এবং খ্যাতি প্রশ্নের মুখে পড়বে বলে? এটা সত্যি হতে পারে ভেবে তাঁর খারাপই লাগল। তবুও তিনি নিজের পক্ষে যুক্তি সাজালেন।
“দেখুন অফিসার, ওদের আর আমাদের মাঝে এই যে স্থিতাবস্থা, এটা কখনোই তুল্যমূল্য ছিল না। ওরা হয়তো কোনো বিষয়ে কিছুটা এগিয়ে ছিল, আমরা অন্য কোনো বিষয়ে। ওরা যদি এখন রোবোটিক্সে এগিয়ে যায়, তার মানে হল ওরা সেটাতে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জোর দিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা অন্য বিষয়গুলোতে যতটা গুরুত্ব দিয়েছি বা অর্থব্যয় করেছি, সেটা ওরা করতে পারেনি। সে বিষয়গুলোতে আমরা ওদের চেয়ে এগিয়ে থাকব। যেমন ধরুন সেটা শক্তি ক্ষেত্র বা পারমাণবিকোত্তর বিদ্যার মতো কিছু হতেই পারে।”
স্থিতাবস্থা যে একেবারে নিখুঁত নয় তা বলতে গিয়ে লিনের মনে একটা কালো ধোঁয়ার মতো ভয় ছড়িয়ে পড়ছিল। কথাটা সত্যি, আর সেটাই এখন পৃথিবীর পক্ষে সবচেয়ে বড়ো বিপদের কারণ। এই অচলাবস্থা যত নিখুঁত হবে শান্তি ততই সর্বব্যাপী হবে। যে কোনো ধরনের অসাম্য যদি কোনোভাবে সীমারেখা ছাড়িয়ে যায় তাহলে…, লিন শিউরে উঠলেন।
ঠান্ডা যুদ্ধ যখন শুরু হয়েছিল, দু-পক্ষই তখন তাপ-পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরির দিকে নজর দেয়। ফলে পরিস্থিতি একেবারে অসহনীয় হয়ে ওঠে। সে সময় যুদ্ধের কথা ভাবতেই ভয় করত। ধীরে ধীরে লড়াইটা সামরিক ক্ষেত্র থেকে সরে অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্বিক সংগ্রামে পরিণত হয়।
দু-পক্ষই অবশ্য ভিতরে ভিতরে চেষ্টা চালিয়ে গেছে এই অচলাবস্থা ভেঙে জয় হাসিল করতে। দু-দলই প্রাণপাত করে গেছে কখনো কোন কাল্পনিক আক্রমণ আটকানোর বন্দোবস্ত করার জন্য, কখনো বা এমন কোনো আঘাত হানার চেষ্টায়, যা তাদের অনেকটা সুবিধাজনক জায়গায় রাখবে। তার মানে এই নয় যে তারা সবসময় যুদ্ধ চাইছিল। আসলে উভয় পক্ষই ভয় পাচ্ছিল তারা যদি চেষ্টা না চালায়, অপর পক্ষ ঠিক যুদ্ধজয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটা করে ফেলবে।
গত এক শতাব্দী ধরে উভয় পক্ষের এই প্রাণপাত প্রচেষ্টার ফলে যেমন অচলাবস্থা বজায় আছে, তেমনি বিজ্ঞানের অগ্রগতিও ঘটেছে অভূতপূর্ব। নিবিড় গবেষণার উপজাত হিসেবে পাওয়া গেছে শক্তি ক্ষেত্র, কাজে লেগেছে সৌরশক্তি, ক্ষতিকর পোকামাকড়দের নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, নানা কাজে রোবট এখন সহজলভ্য। দু-পক্ষই মনশাস্ত্রে উন্নতি করছে, যা আসলে চিন্তা সংক্রান্ত জীব-পদার্থবিদ্যা ও জীব-রসায়নের এক শাখা। চাঁদ আর মঙ্গলে উভয় পক্ষেরই উপনিবেশ আছে। এই রকম চাপের পরিস্থিতি থাকার দরুন মানব সভ্যতা লম্বা পদক্ষেপে দ্রুত বেগে এগিয়ে চলেছে।
এমনকি এ সময়ে সকলেই যতটা সম্ভব সহনশীল আর মানবিক থাকার চেষ্টা করেছে। আক্রমণ ও অত্যাচারের বদলে ভালোবাসা আর সহানুভূতি দিয়ে বিরোধী পক্ষের সহযোগীদের নিজের বন্ধু বানানোর চেষ্টা করে গেছে নিরন্তর।
এত সহজে এই স্থিতাবস্থা ভেঙে যুদ্ধ লেগে যাবে!
“আমি আমার একজন লোকের সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই।” লিন বললেন।
“তাঁকে কি বিশ্বাস করা যায়?”
“ওঃ ভগবান,” লিন বিরক্ত হয়ে বললেন। “কারো সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত না করে, তার নাড়িনক্ষত্র না জেনে কাউকে আপনারা রোবোটিক্সের দপ্তরে ঢুকতে দেন? আমি দিব্যি গেলে বলতে পারি ওকে বিশ্বাস করা যায়। হামফ্রে কার্ল লাজলোকে যদি ভরসা করতে না পারি, তাতে ওদের যে ধরনের আক্রমণের খবর আপনি দিচ্ছেন, সেটা আটকানো অসম্ভবই বলা যেতে পারে।”
“আমিও লাজলোর কথা শুনেছি।” ব্রেকেনরিজ বলল।
“তাহলে ওকে জানানো যায়?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে, আমি তাহলে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখি, রোবটরা আক্রমণ করে আমেরিকায় ঢুকে পড়তে পারে, এমন একটা বিষয় সম্পর্কে ওর কী মত।”
“আপনি দেখছি বিষয়টার গুরুত্ব এখনো বোঝেননি। ওরা ঢুকে পড়তে পারে নয়, ওরা ঢুকে পড়েছে।”
***
লাজলোর ঠাকুর্দা ছিলেন একজন হাঙ্গেরিয়ান। তিনি অনেক কষ্টে সেই সময়কার কুখ্যাত লৌহপ্রাকার পার করে এদেশে এসেছিলেন। সেজন্য লাজলো নিজেকে সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে ভেবে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করে থাকেন। মানুষটি মোটাসোটা, মাথার চুল খুব পাতলা হয়ে টাক পড়া শুরু করেছে, গম্ভীর মুখে বেশির ভাগ সময়েই বিরক্তির ছাপ দেখা যায়। কিন্তু মুখ খুললেই চোস্ত হার্ভার্ডের বুলি শোনা যাবে। খুবই মিষ্টভাষী তিনি।
লিন জানতেন প্রশাসনিক পদ সামলাতে সামলাতে তাঁর পক্ষে রোবোটিক্সের যাবতীয় সর্বাধুনিক জ্ঞান সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে লাজলো তাঁর তুরুপের তাস ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিই লিনের মনে প্রশান্তি এনে দিত।
সব বলার পর লিন জিজ্ঞেস করলেন, “কী মনে হচ্ছে?”
“যে ওরা রোবোটিক্সে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে?” লাজলো চোখ পাকিয়ে মুখ বেঁকিয়ে বললেন। “খুব আশ্চর্যের ব্যাপার! যা বলছেন তাতে তো ওদের পক্ষে এমন কল-মানব বানানো সম্ভব যাকে সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করে চেনাই যাবে না। এ তো রোবো-মনশাস্ত্রে সাংঘাতিক উন্নতি! অবিশ্বাস্য!”
“আমার মনে হচ্ছে বিষয়টা আপনি ব্যক্তিগতভাবে নিচ্ছেন।” ব্রেকেনরিজ ঠান্ডা গলায় বলল, “পেশাদারী গর্বকে পাশে সরিয়ে রেখে বলুন তো, আপনার কেন মনে হচ্ছে যে ওদের পক্ষে আমাদের চেয়ে এত এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব?”
“কারণ আমি এই সংক্রান্ত যাবতীয় গবেষণাপত্র পড়েছি। এমনকি ওদেরও। এর থেকে আমার মোটামুটি ধারণা হয়েছে যে ওরা এখন কী ধরনের কাজ করতে পারে।
“আপনার এই ধারণা হয়েছে কারণ ওরা চেয়েছে যে ওদের গবেষণাপত্রগুলো পড়ে আপনার এমনই ধারণা সৃষ্টি হোক। আপনি কি কখনো ওপারে গেছেন?” ব্রেকেনরিজ বলল।
“না, তা যাইনি বটে।” লাজলো বললেন।
“আপনি?”
“আমিও না।” লিন বললেন।
“গত পঁচিশ বছরে কোনো রোবোটিক্স বিশেষজ্ঞ কী ওদের দেশে গেছেন?” ব্রেকেনরিজ এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রশ্নটা করল যাতে বোঝাই গেল যে সে উত্তরটাও জানে।
গোটা ঘরে এক অস্বস্তিকর চিন্তার নীরবতা ছেয়ে গেল। লাজলোর মুখেও চিন্তার ছাপ। “সত্যিই; ওরা বহুদিন রোবোটিক্সের ওপর কোনো সম্মেলন করেনি।” তিনি বললেন।
“পঁচিশ বছর ধরেই করেনি।” ব্রেকেনরিজ বলল। “একটু অদ্ভুত নয় কি?”
“হতে পারে।” লাজলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন। “যেটা আমায় ভাবাচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে ওদিকের কোনো বিজ্ঞানীও এখানকার রোবো বিশেষজ্ঞদের সম্মেলনে আসেনি।”
“ওদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল?” ব্রেকেনরিজ জিজ্ঞেস করল।
“অবশ্যই।” লিন আড়চোখে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে সঙ্গে সঙ্গে বললেন।
“অন্য কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে ওরা কি যোগ দিয়েছিল?”
“তা আমি এখনি বলতে পারব না।” লাজলো মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন। “আমি এমন কোনো খবর রাখার চেষ্টা করিনি। আপনি জানেন নাকি চিফ?”
“না।” লিন বললেন।
“আপনাদের কি মনে হচ্ছে না যে ওরা ভয় পেয়েছিল এমন কোনো আমন্ত্রণে ওদের কেউ এলে কোনো আসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে? কম সে কম এমন কিছু কথাবার্তা কেউ বলে ফেলতেই পারে যাতে ওদের গোপন রহস্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়?” ব্রেকেনরিজ বলল।
বিষয়টা তেমনই দাঁড়াচ্ছে বটে। লিন খুব অসহায় বোধ করছিলেন। এই তরুণ অফিসারটি যা বলছে তা পছন্দ না হলেও অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
সত্যি, রোবোটিক্সের ক্ষেত্রে এতদিন ধরে জ্ঞানের কোনো উল্লেখযোগ্য আদানপ্রদান ঘটেনি কেন? সেই আইজেনহাওয়ার আর ক্রুশ্চেভের আমল থেকেই দুদিকে বিজ্ঞানীদের নিয়ন্ত্রিত যাওয়া আসা ছিল। একজন গেলে একজন আসবে, এমন নিয়ম মেনেই। এর পিছনে কয়েকটা ভালো উদ্দেশ্যও কাজ করে। প্রথমত সৎভাবে বিজ্ঞানের বিশ্বব্যাপী চরিত্রের মর্ম উপলব্ধি করা, দ্বিতীয়ত মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতাকে স্বীকৃতি দেওয়া যা এত বিদ্বেষের পরেও সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। এছাড়া অন্যদের আবিষ্কৃত নতুন ধ্যানধারণার সঙ্গে পরিচিত হওয়া আর নিজেদের বহু পুরোনো আবিষ্কারকে অপর পক্ষের কাছে পেশ করে নতুন আবিষ্কারের মতো আবার প্রশংসা লাভের ইচ্ছে তো কাজ করতই।
সরকারও চাইত এটা কড়া নজরদারির মধ্যে দিয়ে চলুক। অন্যদের সম্পর্কে যতটা সম্ভব জেনে নেওয়া আর নিজেদের সম্পর্কে যতটা কম জানানো যায় তা জানিয়ে, লাভবান হতে চাইত দু-পক্ষই।
কিন্তু রোবোটিক্সের ক্ষেত্রে এই আদানপ্রদান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এত ছোটো ব্যতিক্রমের জন্য কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে এতদিন পৌঁছানো যায়নি। ঘটনাটা এতদিন চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও। আমরা বোধহয় একটু বেশিই আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগেছি, লিন তেঁতো মুখে ভাবলেন।
যেহেতু ওরা এই বিষয়ে কোন উৎসাহ দেখায়নি, আর ওদের উন্নতির তেমন কোনো খবরও পাওয়া যায়নি, নিজেদের আবিষ্কারগুলো নিয়ে প্রচ্ছন্ন আত্মগরিমায় ভুগে আরাম করে থাকার একটা প্রবণতা এসে গিয়েছিল। এটা কেন একবারও মাথায় এল না যে ওরাও গোপনে গোপনে বহুদূর এগিয়ে যেতে পারে, আর ঠিক সময়ে আস্তিনে লুকোনো একটা তুরুপের তাস বের করে গোটা খেলাটা জিতে যেতে পারে!
লাজলো সামান্য কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে আমাদের কী করা উচিত?” তাঁর কথা শুনে বোঝা গেল, তিনিও লিনের মতো একই কথা ভাবছিলেন।
“সত্যিই কী করা যেতে পারে?” লিনও তোতাপাখির মতো একই প্রশ্ন করলেন। গোটা পরিস্থিতিটা তাঁর মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল। যে খবর তিনি পেয়েছেন তাতে মাথা খারাপ হওয়ারই কথা। দশটি কল-মানব নিজেদের মধ্যে একটা টি.সি বোমের বিভিন্ন অংশ নিয়ে আমেরিকায় এর মধ্যেই ঢুকে পড়েছে।
টি.সি। টোটাল কনভার্সন। পূর্ণ রূপান্তর। বোমা তৈরির দৌড় যে ভয়ংকরতম প্রান্তে এসে শেষ হয়েছে তার সবচেয়ে হাড় কাঁপানো আবিষ্কার। সূর্যকেও যার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। সেই বোমে ভরের পূর্ণ রূপান্তরের ফলে যে তেজ সৃষ্টি হয় তার পাশে সূর্যও মোমবাতির মতো নিষ্প্রভ।
দশটি কল-মানব। যখন তারা আলাদা আছে তখন একেবারেই সাধারণ, নিরাপদ। কিন্তু একসঙ্গে মিললেই তাদের মোট ভর একটা সংকট ভর অতিক্রম করবে, আর…।
লিন অন্ধকার মুখে উঠে দাঁড়ালেন। তার অসুন্দর মুখের চোখদুটির চারপাশে যে কালো ছাপ পড়ে থাকে তা আরও গাঢ় হয়েছে যেন কোন ভয়াবহ ভবিষ্যতের পূর্বলক্ষণ হিসেবে। “আমাদের ওই দশটা কল-মানবকে খুঁজে বের করতে হবে। এমন কোনো উপায় বের করতেই হবে যাতে দ্রুত আর সহজে ওদের সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা করে চেনা যায়।”
“কত দ্রুত?” লাজলো বিড়বিড় করলেন।
“ওরা কাছে আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে।” লিন গর্জন করে উঠলেন। “তবে কখন সেটা ঘটবে তা বলতে পারব না।”
ব্রেকেনরিজ ঘাড় নাড়ল। “আপনি যে বিষয়টার গুরুত্ব বুঝেছেন সেজন্য ধন্যবাদ স্যার। আপনাকে আমার সঙ্গে এখনি ওয়াশিংটনে আপৎকালীন সভায় যোগ দিতে যেতে হবে।”
“আচ্ছা!” লিন ভুরু কপালে তুলে বললেন।
তিনি ভাবলেন, তিনি যদি বিপদের গুরুত্ব বুঝতে দেরি করতেন, তাহলে তাঁকে আর বেশিক্ষণ প্রধানের পদে থাকতে হত না। তাঁর বদলে অন্য কেউ এই সভায় যোগদান করতে যেত। সেটা হলেই বোধহয় ভালো হত।
***
রাষ্ট্রপতির মুখ্য সহায়ক, বিজ্ঞান ও উন্নয়ন দপ্তরের মুখ্য সচিব, প্রতিরক্ষা দপ্তরের সচিব, লিন আর ব্রেকেনরিজ এই পাঁচজন গম্ভীর মুখে একটা বড়ো গোল টেবিল ঘিরে ওয়াশিংটনের এক দূর্গসম অতি সুরক্ষিত ভবনের মাটির নীচের ঘরে বসে ছিলেন।
মুখ্য সহায়ক জেফ্রি একজন শ্রদ্ধাজাগানো বুদ্ধিমান চেহারার সুদর্শন মানুষ। মাথার বেশির ভাগ চুল সাদা হয়ে গিয়েছে, চওড়া চোয়াল দৃঢপ্রতিজ্ঞ মানসিকতার পরিচয় দেয়। রাষ্ট্রপতির মুখ্য সহায়ক যেমন হওয়া উচিত তেমনই অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, রাজনৈতিক দূরদর্শী, বিচক্ষণ।
তিনি ধীর লয়ে বললেন, “যা দেখা যাচ্ছে আমাদের সামনে তিনটি প্রশ্ন উপস্থিত হয়েছে। এক, ওই কল-মানবেরা কখন মিলিত হবে? দুই, কোথায় মিলিত হবে? তিন, আমাদের পক্ষে কীভাবে ওদের এই সাক্ষাৎকার বন্ধ করা সম্ভব?”
বিজ্ঞান দপ্তরের মূখ্য সচিব অ্যাম্বারলি প্রবলভাবে মাথা নেড়ে সে কথা সমর্থন করলেন। এই পদ পাওয়ার আগে তিনি নর্থওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডিন ছিলেন। রোগা, তীক্ষ্ণ চেহারার মানুষটি তাঁর শীর্ণ আঙুল দিয়ে টেবিলের ওপর মন্থর গতিতে বৃত্ত আঁকতে আঁকতে বললেন, “কখন ওরা একসঙ্গে আসার চেষ্টা করবে, এই প্রসঙ্গে বলা যায়, এটা খুব শিগগিরই ঘটবে না।”
“কেন?” লিন জিজ্ঞেস করলেন।
“কারণ প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে যা খবর পাওয়া গেছে, ওরা একমাসের ওপরে আমেরিকাতে রয়েছে। ফলে বোঝাই যায় ওরা অপেক্ষা করছে।”
লিন ব্রেকেনরিজের দিকে তাকালেন। তাঁর তাকানো দেখে প্রতিরক্ষা দপ্তরের সচিব ম্যাকালাস্টার নিজে থেকেই বলে উঠলেন, “খবরটা সত্যি। ব্রেকেনরিজের সরল ছেলেমানুষ মুখ দেখে ভুল বুঝবেন না ড. লিন। ওটা আমাদের পক্ষে খুবই কাজের অস্ত্র। ওর বয়েস চৌত্রিশ আর ওর এই দপ্তরে দশ বছর কাজ করা হয়ে গেছে। এক বছরের ওপরে মস্কোতে ছিল ও। ও না থাকলে এই ভয়ানক বিপদের কথা আমরা জানতেই পারতাম না। আমরা ওদের সম্পর্কে অনেক তথ্যই এখন জানি।”
“কিন্তু সবচেয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলোই এখনো জানি না।” লিন তেঁতো গলায় বললেন।
ম্যাকালাস্টার ফ্যাকাশে মুখে হাসলেন। তাঁর মোটা চিবুক আর গভীর চোখের ছবি অতি পরিচিত হলেও তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। “আমরা সকলেই মানুষ ড. লিন, আমাদের সকলেরই সীমাবদ্ধতা আছে। এজেন্ট ব্রেকেনরিজ খুবই ভালো কাজ করেছে।” মন্দ্রস্বরে তিনি বললেন।
মুখ্য সহায়ক জেফ্রি মূল প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। “হ্যাঁ, এটা ধরে নেওয়া যায় যে আমাদের হাতে কিছুটা সময় আছে। ওরা দ্রুত আঘাত হানতে চাইলে এতদিনে যা ঘটার ঘটে যেত। মনে হচ্ছে ওরা একটা নির্দিষ্ট ক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা যদি জায়গাটা জানতে পারি তাহলে সম্ভবত সময়টাও নিজে থেকেই প্রকাশিত হয়ে পড়বে।
“ওরা যদি টি.সি ব্যবহার করতে চায়, অবশ্যই চেষ্টা করবে এক আঘাতেই আমরা যাতে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। কাজেই আক্রমণের লক্ষ্য কোনো প্রধান শহর হওয়াই স্বাভাবিক। অন্য কোথাও বোমাটা ফাটালে ততটা লাভ হবে না। আমার মনে হয় চারটে শহরের কথা ওদের মাথায় থাকবে। এক ওয়াশিংটন, দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র, দুই নিউ ইয়র্ক, দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রককেন্দ্র, তিন ও চার হল পিটসবার্গ ও ডেট্রয়েট, যে দুটো দেশের ব্যাবসা ও বাণিজ্যিক উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রন করছে।”
“আমার ভোট নিউ ইয়র্কের পক্ষে যাবে।” প্রতিরক্ষা সচিব ম্যাকালাস্টার বললেন। “প্রশাসন আর ব্যাবসা বাণিজ্যের কাজকর্ম অনেকটাই বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। একটা শহর ধ্বংস করে ওই সংক্রান্ত কাজ সম্পূর্ণ স্তব্ধ করা যাবে না।”
“তাহলে নিউ ইয়র্কই বা কেন?” বিজ্ঞান দপ্তরের প্রধান অ্যাম্বারলি তীব্র স্বরে বললেন, “অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণও তো হয়েছে যথেষ্ট।”
“কারণ ওরা কেবলমাত্র আমাদের বৈষয়িক ক্ষতিই করতে চাইবে না, চাইবে আমাদের নৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে দুমড়ে দিতে। আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করতে। নিউ ইয়র্কে বোমাটা ফাটালে শহর ও শহরতলীর ঘনবসতির ফলে যে পরিমাণ জীবন হানি হবে তাতে গোটা দেশে অবর্ণনীয় আতংক ছড়াবে। ফলে আমাদের লড়াইয়ের ইচ্ছাই হারিয়ে যাবে, ওদের এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক।”
“ঠান্ডা মাথায় অসংখ্য খুন।” লিন বিড় বিড় করলেন।
“হ্যাঁ, তাই। ওরা যদি এক আঘাতেই যুদ্ধ জয় চায়, তাহলে ওরা এমন কিছুই চাইবে। কিন্তু তারপরে…”
এইসময় নিজের কাঁচাপাকা চুলে আঙুল ডুবিয়ে হাত বুলোতে বুলোতে মুখ্য সহায়ক জেফ্রি বলে উঠলেন, “সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির কথাই ভাবা যাক। যদি শীতকালে প্রবল তুষারঝড়ের সময় নিউ ইয়র্ক ধ্বংস হয় তবে প্রাকৃতিক কারণেই ক্ষতিটা হবে সবচেয়ে বেশি। এটাকে আমরা ঠেকাবো কী করে?”
বিজ্ঞান সচিব অ্যাম্বারলি বললেন, “বাইশ কোটি লোকের মধ্যে থেকে দশজন মানুষকে খুঁজে বের করা, বিশাল বড়ো খড়ের গাদা থেকে একটা ছোট্ট ছুঁচ খুঁজে বের করার চেয়েও কঠিন।”
“বাইশ কোটি লোকের মধ্যে থেকে দশজন কল-মানবকে খুঁজে বের করা।” জেফ্রি শুধরে দিলেন।
“তাতে কোনো পার্থক্য হচ্ছে না।” অ্যাম্বারলি শুকনো মুখে বললেন। “আমরা জানি না কেবলমাত্র বাইরে থেকে দেখে কল-মানবদের আলাদা করে চেনা যায় কিনা। যায় কি?” প্রশ্নটা তিনি লিনের দিকে চেয়ে করলেন। সবার চোখ এখন তাঁর দিকে।
“শায়ানে আমরা এখনো এমন কিছু বানিয়ে উঠতে পারিনি যার হাবভাব অবিকল মানুষের মতো।” লিন শুষ্ক কণ্ঠে বললেন।
“কিন্তু ওরা পেরেছে।” ম্যাকালাস্টার বললেন। “মন শাস্ত্রে ওরা এতটাই এগিয়েছে যে মানব মস্তিষ্কের চিন্তাপদ্ধতির ছাপ ওরা নিখুঁতভাবে রোবটদের পজিট্রনিক মগজে বসিয়ে দিতে পেরেছে। ফলে কেবলমাত্র বহিরঙ্গে নয়, আচার ব্যবহারেও কল-মানবগুলো একেবারে মানুষের মতো হয়ে উঠেছে।”
লিন অবাক হয়ে চাইলেন, “তার মানে আপনি বলতে চাইছেন ওরা এমন কল-মানব বানিয়েছে যাদের নিজস্ব চিন্তাশক্তি, স্মৃতিশক্তি আছে?”
“হ্যাঁ, তাই বলতে চাইছি।”
“যা জানালেন তাতে তো মনে হচ্ছে একজন মানুষের পুরো ব্যক্তিত্বটাই একটা কল-মানবের মধ্যে পুরোপুরি আরওপিত করা যাবে।”
“একদমই তাই।”
“এ খবরও নিশ্চয়ই ব্রেকেনরিজই এনেছেন?”
“হ্যাঁ, একেবারে অকাট্য প্রমাণসহ।”
চিন্তার ভারে লিনের মাথা যেন নুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিনি বললেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দশজন নাগরিক তাহলে এখন কল-মানব। কিন্তু সেগুলো বানাতে গেলে তো ওদের আসল মানুষটাকে হাতে পেতে হবে। তাহলে ওরা প্রাচ্যের কাউকে বাছবে না। কারণ ওগুলো সহজেই নজরে পড়ে যাবে। ওদের পক্ষে সুবিধাজনক হবে পুব ইউরোপের কাউকে বাছা। যারা আমাদের মধ্যে মিশে যেতে পারে। তা না হয় হল। কিন্তু আমাদের সীমানা যেভাবে অত্যাধুনিক রেডার আর যন্ত্রপাতির সাহায্যে কড়া নজরদারির মধ্যে রয়েছে তাতে ওদেরকে ঢোকালো কী করে? মানব, কল-মানব যাই হোক না কেন, এমন অনুপ্রবেশকারীদের তো সহজেই ধরা পড়ে যাওয়ার কথা।”
প্রতিরক্ষা দপ্তরের ম্যাকালাস্টার বললেন, “এটা করা সম্ভব। আসলে সংখ্যায় কম হলেও কিছু লোকজন সীমানা পারাপার করতে পারে। ব্যবসায়ী, পাইলট এমনকি পর্যটক পর্যন্ত। অবশ্যই তারা কড়া নজরদারির মধ্যে থাকে। কিন্তু এটা কখনোই বন্ধ করা হয়নি। ওদের অঞ্চলে ঢোকার পর তাদের কাউকে কাউকে অপহরণ করাই যায়। তারপর তাদের মডেল হিসেবে ব্যবহার করে ওদের জায়গায় কল-মানবগুলোকে আমেরিকান হিসেবে এদেশে ঢোকানোতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমরা এমন কিছু ঘটতে পারে সেটা কখনোই ভাবিনি। ফলে তেমন কোনো পরীক্ষার মধ্যে দিয়েও ওগুলোকে যেতে হয়নি। ওদের কাছে গোটাটাই জলবৎ তরলং হয়ে গেছে।”
“এমনকী ওদের পরিবার, বন্ধুরা পর্যন্ত এই পার্থক্য বুঝতে পারেনি?”
“তাই তো মনে হচ্ছে। আমরা এখন অপেক্ষা করছি এদের কেউ রাতজাগা রোগে ভুগছে কিনা বা কারো ব্যবহারের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কিনা সে সংক্রান্ত খবর পাওয়ার। বেশ কয়েক হাজার মানুষের বিবরণ জোগাড় করতে হচ্ছে এই মুহূর্তে।”
নিজের আঙুলের ডগার দিকে চেয়ে অ্যাম্বারলিন বললেন, “আমার মনে হয় ওপর ওপর তেমন কিছু বোঝা যাবে না। এ সমস্যা সমাধানে আমাদের ব্যুরো অব রোবোটিক্সের ওপরেই পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে।”
স্বাভাবিকভাবেই সবার দৃষ্টি লিনের দিকে ঘুরে গেল।
লিনের অস্বস্তি চুড়ান্ত পর্যায়ে উঠল। তাঁর মনে হল এই জমায়েত ঠিক এজন্যেই ডাকা হয়েছে। এখানে এমন কোনো কথা উচ্চারিত হয়নি যা এর আগে বলা হয়নি। এঁরা সকলেই সবকিছু সম্পর্কে অবগত ছিলেন। আসলে একদল ভীরু, পরাজয়ের সম্মুখীন হওয়া দিশাহীন মানুষ জড়ো হয়েছেন অন্য কারো ওপরে দায় চাপিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে।
তবে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটা তো অস্বীকার করা যায় না যে তাঁর দপ্তর দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে বলেই আক্রমণটা এত ভয়ানক হতে পেরেছে। লিন এখন কেবল একজন ব্যক্তি বিশেষ নন। তিনি ব্যুরো অব রোবোটিক্সের প্রতিনিধি। সব দায়ভার তাঁকেই বহন করতে হবে।
“দেখা যাক কী করা যায়।” নিজের গলার তেঁতো সুরটাকে যতটা সম্ভব লুকিয়ে তিনি বললেন।
***
নির্ঘুম রাত কাটিয়ে পরের দিন যখন লিন আবার মুখ্য সহায়ক জেফ্রির সঙ্গে দেখা করতে এলেন তখন শরীরে মনে তিনি একেবারে বিধ্বস্ত। যথারীতি ব্রেকেনরিজও সেখানে উপস্থিত ছিল। যদিও লিন একেবারে একা জেফ্রির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন, তবুও তার উপস্থিতিটাকে তিনি অন্যায় কিছু বলতে পারলেন না। তার সফল গুপ্তচরবৃত্তির জন্য সে প্রশাসনের মধ্যে প্রবল প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। এটা অস্বাভাবিক নয়।
লিন বললেন, “স্যার, আমরা যেভাবে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে এখনি গেল গেল রব তুলেছি তা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না।”
“কেন?”
“দেখুন স্যার, সাধারণ মানুষ শত্রুদের নিয়ে যতই চেঁচামেচি করুক, বিরোধীরা এ বিষয়ে যতই বড়ো বড়ো বক্তৃতা দিক, আমাদের সরকার কিন্তু এই অচলাবস্থা নিয়ে কিছুটা স্বস্তিতেই আছে। ওদের সরকারও তাই। এ অবস্থায় দশটা কল-মানবের সাহায্যে একটা টি.সি বোম ফাটিয়ে গোটা পরিস্থিতিটাকে নষ্ট করে যুদ্ধ জেতার পরিকল্পনা কিন্তু বালখিল্যের প্রচেষ্টা বলে মনে হচ্ছে।”
“পনেরো লক্ষ মানুষকে খুন করার প্রচেষ্টা মোটেই বালখিল্যসুলভ নয়।”
“একবার যুদ্ধ লাগলে যা ঘটবে তার পাশে এটা খুব বড়ো ঘটনা নয়। কারণ এমন কিছু হলে আমাদের ধাক্কা লাগবে ঠিকই, কিন্তু আমরা একেবারে আত্মসমর্পণ করব না। ফলে আরও একটা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ লাগবে যা এতদিন ধরে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এড়ানো গেছে। আমাদের লড়াই শুরু করতে হবে একটা শহরকে হারিয়ে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা জিততে পারব না।”
“তাহলে আপনি কী বলতে চাইছেন?” জেফ্রি হিমশীতল কণ্ঠে বললেন। “আপনার কি ধারণা এদেশে দশটা কল-মানব ঢুকে পড়েনি? তারা কি একটা টি.সি বোম বয়ে বেড়াচ্ছে না?”
“আমি মেনে নিচ্ছি খবরগুলো সত্যি। কিন্তু আমার ধারণা প্রবল শীতে বোমা বিস্ফোরণের সাহায্যে একটা শহর ধ্বংস করার মতো পাগলামির চেয়ে বড়ো কোনো ফন্দি ওদের মাথায় আছে।”
“যেমন?”
“বোমাটা ফাটলে আমাদের ক্ষতি হবে ঠিকই, কিন্তু আরও বেশি হবে যদি আমাদের গোটা জাতি মানসিক দিক থেকে পঙ্গু হয়ে পড়ে। যদি আমাদের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি লোপ পায়। এজেন্ট ব্রেকেনরিজের কর্মক্ষমতার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এমন যদি হয় যে ওরা চেয়েইছিল যে আমরা জানি আমেরিকাতে দশটা কল-মানব একটা টিসি বোম সমেত ঘুরে বেড়াচ্ছে? এমন যদি হয় যে ওই দশজনের একসঙ্গে হওয়ার কোনরকম আশু সম্ভাবনা নেই? আমাদের মাথার ওপর একটা আতংকের বোঝা চাপিয়ে রাখাই ওদের প্রধান কাজ?”
“কেন?”
“বলুন তো, কল-মানবগুলোকে ধরার জন্য এর মধ্যেই কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। যারা সীমানার ওপারে গিয়েছিল, এমনকী যারা সীমানার এত কাছে গিয়েছিল যাতে তাদের অপহরণ করা যায়, তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব তথ্য জোগাড় করা হচ্ছে। সেগুলোকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা হচ্ছে কোনো অসঙ্গতি ধরা পড়ে কিনা। এছাড়া?”
“শহরের বিভিন্ন জায়গার ছোটো ছোটো এক্সরে ক্যামেরা লাগানো হচ্ছে, বিশেষত যেখানে বহু মানুষের সমাবেশের সম্ভাবনা থাকে। যেমন স্টেডিয়ামগুলোতে।” জেফ্রি বললেন।
“যেখানে মানুষের ভিড়ে মিশে দশটা কল-মানব ফুটবল বা এয়ার হকি ম্যাচ দেখতে ঢুকে পড়তে পারে, তাই তো?”
“একদম।”
“আর গানের জলসা, গির্জাগুলোর কী হবে?”
“কোথাও থেকে তো শুরু করতে হয়। একসঙ্গে সব ব্যবস্থা করা যাবে না। ধীরে ধীরে সব হবে।”
“তা ছাড়া যাতে আতংকের প্রবল ঢেউ ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে, তাই না?” লিন বললেন। “জনগন যেন এটা টের না পায় যে কোনো এক অজানা সময়ে এক হতভাগ্য শহর তার সব অধিবাসী সমেত হঠাৎ পৃথিবী থেকে মুছে যাবে।”
“সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?”
“এটাই যে, এর ফলে আমাদের রাষ্ট্রের নজর ঘুরে যাবে এমন একটা বিচ্ছিরি সমস্যার দিকে, যেটাকে অ্যাম্বারলি বলেছেন একটা অসম্ভব বড়ো খড়ের গাদা থেকে একটা অতিক্ষুদ্র সূঁচ খুঁজে বের করার মতো কঠিন। আমাদের অর্থ, বুদ্ধি ব্যয়িত হবে এক অজানা বিপদকে আটকানোর চেষ্টায়, আর ওদিকে ওরা নিজেদের অগ্রগতির রথ বিনা বাধায় ছুটিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। এরপর এমন একটা সময় আসবে, যখন উন্নতির দৌড়ে ওরা আমাদের চেয়ে এত এগিয়ে যাবে যে ওদের ধরা অসম্ভব হয়ে যাবে। তখন ওরা আক্রমণ করলে আমাদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
“কিম্বা ভাবুন, আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে বিপদটা কাটানোর জন্য নানারকম ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করলাম। ক্রমশ বহু মানুষ এতে সংযুক্ত হল। একসময় আমাদের কাজকর্ম দেখে জনগন সন্দেহ করা শুরু করল, কিম্বা এত বিশাল কর্মকাণ্ডের কোনো এক ছিদ্র দিয়ে খবরটা প্রকাশিত হয়ে পড়ল। তখন যে আতংক চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে তার ধাক্কা একটা টি.সি-র চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর হবে।”
মূখ্য সহায়কের ভুরু কুঁচকে গেল। বিরক্ত মুখে তিনি বললেন, “আপনি তাহলে চাইছেনটা কী? আমাদের কী করা উচিত?”
“কিচ্ছু না। এটাকে একটা গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া উচিত। ওদিকে নজর না দিয়ে আমাদের বিজ্ঞান গবেষণা ও অন্যান্য দিকে যা যা গুরুত্ব দেওয়ার দিতে হবে। এটা ধরে নিতে হবে কেবলমাত্র একটা টি.সি বোম ফাটানোর জন্য ওরা স্থিতাবস্থাটাকে ধ্বংস করতে চাইবে না।”
“অসম্ভব।” জেফ্রি চেঁচিয়ে উঠলেন। “এক্কেবারে অসম্ভব। আমাদের সকলের ভালো থাকা আমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল, আর তাই আমি কিচ্ছু না করে চুপচাপ বসে থাকতে পারব না। ওই এক্সরে ক্যামেরা বসানো বা অন্যান্য প্রাথমিক ব্যবস্থাগুলো যে সমস্যা সমাধানের গভীরে প্রবেশ করতে পারবে না, আপনার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু এগুলো নিতেই হবে। কারণ যদি বোমাটা ফাটে আমরা অন্তত বলতে পারব, বিপর্যয়ের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে। ওরা বোমা ফাটিয়ে স্থিতাবস্থা নষ্ট করবে না, এমন বিচিত্র ধারণার বশবর্তী হয়ে চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে ছিলাম না। আর সত্যি বলতে কী, এটাকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পালটা ব্যবস্থাও নিতে চলেছি।”
“কী ব্যবস্থা?”
মুখ্য সহায়ক জেফ্রি এবার ব্রেকেনরিজের দিকে তাকালেন। এতক্ষণ ধরে এই তরুণ অফিসারটি চুপ করে বসেছিল। সে এবার মুখ খুলল।
“ভবিষ্যতে স্থিতাবস্থা ভাঙবে কী ভাঙবে না ভেবে লাভ নেই, কারণ ইতিমধ্যেই তা ভেঙে পড়েছে। এটাও ভেবে লাভ নেই এই কল-মানবগুলো বিস্ফোরণ ঘটাবে কী ঘটাবে না। হতেই পারে এটা আমাদের নজর অন্যদিকে ঘোরানোর একটা টোপ মাত্র। কিন্তু এটাও ঠিক যে আমরা ওদের চেয়ে রোবোটিক্সে অন্তত পঁচিশ বছর পিছিয়ে রয়েছি যেটা মারাত্মক বিপদ ডেকে এনেছে। যদি যুদ্ধ শুরু হয় তবে ওরা আমাদের আর কোনো চমক দেবে কে জানে? কাজেই এক্ষুণি আমাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এ বিষয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে আমরা কল-মানবগুলোকে খুঁজে বের করতে পারি। তাই আমাদের রোবোটিক্সের উন্নতির জন্য যত দ্রুত সম্ভব একটা সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে অন্তত পনেরো লক্ষ নারী-পুরুষ আর শিশুর জীবন রক্ষা করা যায়।”
লিন অসহায়ভাবে মাথা ঝাঁকালেন। বললেন, “এটা করা একদম উচিত হবে না। ওরা ঠিক এটাই চাইছে। এভাবে আমরা অন্ধ গলিতে ঘুরপাক খেয়ে মরব আর ওরা সব দিকে অনেক এগিয়ে যাবে।”
জেফ্রি এবার অসহিষ্ণু হয়ে বলে উঠলেন, “ওটা আপনার ধারণা। ব্রেকেনরিজ তার ধারণাটা সরকারে সঠিক জায়গায় জানিয়েছে। সকলে সেটার গুরুত্ব অনুভব করে ঠিক করেছে যে যত দ্রুত সম্ভব একটা বিজ্ঞানের সব শাখার সম্মেলন ডাকা দরকার।”
“সর্ব বিজ্ঞান সম্মেলন!” হতাশ লিন বললেন।
ব্রেকেনরিজ বলল, “আমরা বিজ্ঞানের সব শাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের একটা তালিকা বানিয়েছি। ওঁরা সকলেই শায়ানে আসছেন। এই সম্মেলনে কেবল একটা বিষয়েই প্রধানত আলোচনা হবে, কীভাবে রোবোটিক্সে উন্নতি করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে জোর দেওয়া হবে এমন একটা পদ্ধতি আবিষ্কারে যার সাহায্যে মানুষের প্রোটোপ্লাজমীয় মস্তিষ্ক থেকে উৎপন্ন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আর কল-মানবদের পজিট্রনিক মগজ থেকে উৎপন্ন তরঙ্গকে আলাদা করে চেনা যায়।”
“আমাদের ইচ্ছে আপনি এই সম্মেলনের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে থাকুন।” জেফ্রি বললেন।
“আমার সঙ্গে এ বিষয়ে আগে কোনো আলোচনাই করা হয়নি।”
“সময় ছিল না। আপনি কি রাজি আছেন স্যার?”
লিন একটা ক্লিষ্ট হাসি হাসলেন। আবার একটা অপছন্দের কাজ। আবার এমন একটা দায়িত্ব যা রোবোটিক্সের প্রধান হিসেবে তাঁকে নিতেই হবে। যদিও তিনি বুঝতে পারলেন, সম্মেলনের সমস্ত কিছু আসলে ব্রেকেনরিজের নির্দেশ অনুযায়ীই চলবে, কিন্তু কীই-বা আর করার আছে?
“আমি রাজি।” তিনি বললেন।
***
ব্রেকেনরিজ আর লিন শায়ানে ফিরে এলেন। সেখানে তাঁদের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ কর্মসূচির সবকিছু শুনে লাজলো অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে ধাতস্থ হয়ে তিনি বললেন, “আপনি যাওয়ার পর আমরা তিনটে শিফটে লাগাতার কাজ করছি চিফ। প্রতিটি বিজ্ঞানী দিনে গড়ে বারো ঘণ্টা কাজ করছেন। আমরা এর মধ্যেই কল-মানবদের চারটে ধরণ তৈরির খসড়া করে ফেলেছি। সামনের কয়েকদিন অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। এখন যদি এই সম্মেলন হয় তাহলে সমস্ত কিছু ভিড়ের চোটে আর লালফিতের ফাঁসে আটকে পড়বে। সব কাজ স্তব্ধ হয়ে যাবে একেবারে।”
ব্রেকেনরিজ বলল, “সে তো মাত্র কয়েকদিনের জন্য। এতে আপনাদের ক্ষতির চেয়ে লাভই হবে বেশি।”
“শুনুন, একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী কিম্বা ভূপদার্থবিদ ইচ্ছে করলেও রোবোটিক্সের ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না।” লাজলো রেগেমেগে বলে উঠলেন।
“বিজ্ঞানের অন্য শাখার বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারলে তা কাজে আসতেই পারে।”
“আপনি নিশ্চিত? তারপর ধরুন মস্তিষ্ক থেকে নির্গত তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আদৌ সনাক্ত করা যায় কি? তর্কের খাতিয়ে যদি ধরে নি যে হ্যাঁ, যায়, তাহলে সেটা কল-মানবদের চিন্তা তরঙ্গের থেকে যে আলাদা হবেই একথা জানা গেল কীভাবে? কার মাথায় এসব কর্ম-পরিকল্পনা এসেছে?”
“আমার মাথায়।”
“আপনার মাথায়?” লাজলো থতমত খেয়ে বললেন। “আপনি রোবোটিক্স জানেন?”
“হ্যাঁ। আমি রোবোটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছি।” ব্রেকেনরিজ ঠান্ডা গলায় বলল।
“প্রতিদিন এই বিদ্যা এগিয়ে চলেছে। ওটুকুই যথেষ্ট নয়।” লাজলো বললেন।
“আমি রাশিয়ায় থাকাকালিন কেবলমাত্র এই বিষয়েই গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়েছি। ওদের গোপনতম আবিষ্কারের বিষয়ে জানতে পেরেছি, পড়াশোনা চালিয়েছি, তথ্য আদান-প্রদান করেছি। রুশ ভাষাতেই।”
“উনি এক্ষেত্রে সত্যিই আমাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন।” লিন স্বীকার করলেন।
“সেখান থেকে আমি যা জানতে পেরেছি তার ভিত্তিতেই আমি এই কর্ম-পরিকল্পনা করেছি।” ব্রেকেনরিজ বলে চললেন। “যদিও কোনো ব্যক্তিবিশেষের চিন্তাপদ্ধতির সম্পূর্ণ ছাপ কল-মানবদের মগজে ফেলা গেছে, কিন্তু একটা মানব মস্তিষ্কের সবকিছু এখনো আধুনিকতম, জটিলতম পজিট্রনিক কল-মানব মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারেনি। মানব মস্তিষ্ক এখনো কয়েকশো গুন বেশি জটিল। তার চিন্তাতরঙ্গের উপসুরে নিশ্চয়ই পার্থক্য থাকবে। আর আমাদের এটাই কাজে লাগাতে হবে।”
লিন আর লাজলোর মুখে একটা কষ্টের হাসি দেখা দিলেও ব্রেকেনরিজের কথায় তাঁরা কিছুটা প্রভাবিত না হয়ে পারলেন না। ব্রেকেনরিজকে, আর রোবোটিক্সের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নন এমন কয়েকশো বিজ্ঞানীর জমায়েতকে তাঁরা অপছন্দ করতে পারেন, কিন্তু এটা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই যে বর্তমান সমস্যাটা যথেষ্ট কৌতুহলোদ্দীপক। অনেক খারাপের মধ্যে এটাই একমাত্র ভালো দিক।
***
কোনো এক শান্ত মুহূর্তে হঠাৎ করেই সেটা এল।
আসলে লিনের তেমন কিছুই করার ছিল না, চুপচাপ নিজের দপ্তরের নির্দিষ্ট ঘরে বসে থাকা ছাড়া। পদাধিকার বলে তিনি তখনো রোবোটিক্সের প্রধান, কিন্তু বাস্তবে তিনি যেন এক কাঠের পুতুল। এই চুপ করে বসে থাকাটাই যেন তাঁকে শায়ানে এই অর্ধেক পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের সম্মেলনটা নিয়ে ভাবার সময় করে দিল।
সম্মেলনের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা ব্রেকেনরিজের নির্দেশেই হচ্ছিল। ঠান্ডা মাথায় অসম্ভব পারদর্শীতার সঙ্গে সে নানা দিক সামলাচ্ছিল। তার উদ্দীপনা ছিল চোখে পড়ার মতো। তার কথাবার্তার মধ্যে এক অসম্ভব আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ছিল। “আসুন, একসঙ্গে মেলা যাক। একসঙ্গে আমরা ওদের যাবতীয় চক্রান্ত গুঁড়িয়ে দেবো।”
আসুন, একসঙ্গে মেলা যাক।
ভাবনাটা লিনের মাথায় এত শান্তভাবে এল যেন এক শব্দহীন ভোরে ছড়িয়ে পড়ল সূর্যের আলো। সে সময় তাঁর দিকে তাকালে বড়োজোর বার দুয়েক তাঁর চোখের পাতা পড়া বা মণির নড়াচড়া দেখা যেত। এর বেশি কিছু না।
এরপর তিনি যত দ্রুত সম্ভব নিজের চিন্তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে যন্ত্রের মত যা যা করার করে গেলেন। এটা করতেই হত, নয়তো ভয়ানক চিন্তাটা তাঁকে পাগল করে দিত।
তারপর তিনি ব্রেকেনরিজকে খুঁজে বের করলেন। সে তখন একলা তার নিজের নতুন ঘরে বসে ছিল।
“কী হয়েছে স্যার? কোনো সমস্যা নাকি?” সে চিন্তিত লিনকে দেখে জিজ্ঞেস করল।
“না। এখন সব ঠিক আছে। আমি এখানে জরুরি অবস্থা জারি করলাম।”
“কী?” ব্রেকেনরিজ চেঁচিয়ে উঠল।
“হ্যাঁ। বিকেন্দ্রীকরণের এটাই সুবিধা। কারো অনুমতি না নিয়েই আমি আমার দপ্তরে জরুরি সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, স্বৈরাচারীর মতো সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিতে পারি।”
“আপনি এখনি এটা তুলে নেবেন।” ব্রেকেনরিজ তেড়েফুঁড়ে তাঁর দিকে এগিয়ে এল। “ওয়াশিংটন যখন এটা শুনবে, আপনার ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে।”
“আমার ভবিষ্যৎ এমনিতেই ধ্বংসের মুখে। এর মধ্যেই আমাকে জনগনের সামনে খলনায়ক হিসেবে দাঁড় করানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমার অপদার্থতার জন্যই এতদিনের স্থিতাবস্থা বিপর্যয়ের মুখোমুখি। তাই ভাবলাম, হারানোর তো কিছু নেই, বরং সাহস করে এগোলে পাওয়ার হয়তো অনেক কিছুই আছে।”
তিনি যেন পাগলের মতো হেসে উঠলেন।
“ব্যুরো অব রোবোটিক্সের প্রধান দপ্তর বোমা ফাটিয়ে ধ্বংস করার জন্য একেবারে আদর্শ, তাই না ব্রেকেনরিজ? একটা টি.সি বোমা ফাটালে তিন হাজার বর্গ কিলোমিটার শ্মশান হয়ে যাবে, হয়তো লাখখানেক লোকও মারা যাবে। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হল তাদের সঙ্গে মারা যাবে আমাদের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা। একটা দেশের শ্রেষ্ঠ মাথাগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে কী? আমাদের সামনেও আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না, তাই না? “
“কিন্তু এটা তো অসম্ভব। একেবারেই অসম্ভব। আমরা সন্দেহজনক কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছি না। সবরকম সুরক্ষা বলয় থাকবে। ওরা এখানে জড়ো হবে কী করে?” ব্রেকেনরিজ রুদ্ধশ্বাসে বলল।
“জড়ো হবে না, জড়ো হতে শুরু করেছে। আমরাই ওদের সাহায্য করছি। ওদের আসার নির্দেশ পাঠিয়েছি। আমাদের দেশের গবেষক, বিজ্ঞানীরা নিয়মিত ওদের দেশে গিয়েছেন। আপনিই বলেছিলেন ওরা আমাদের কোন রোবোটিক্স বিশেষজ্ঞকে কিন্তু ডেকে পাঠায়নি। কেন? আসলে অন্য শাখার বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যা করা যায় সেটা এখানে করলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমাদের দশজন বিজ্ঞানী ওখানে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের জায়গায় ফিরে এসেছে দশজন কল-মানব। তারাই এখন আমাদের ডাকে শায়ানে জড়ো হচ্ছে।”
“আপনার আন্দাজটা খুব হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে না?”
“তাই না কি? আমার কিন্তু তেমন লাগছে না। একবার ভাবুন, আমরা যদি না জানতে পারতাম যে দশজন কল-মানব আমাদের দেশে ঢুকে পড়েছে, আমাদের এই সম্মেলনের দরকার হত না। কি আশ্চর্যের বিষয় দেখুন, আপনি খবরটা নিয়ে এলেন, আপনিই বোঝালেন যে এই সম্মেলনের দরকার আছে, এখানে কী আলোচনা হবে সেটাও ঠিক করলেন, গোটা ব্যাপারটা আপনিই সামলাচ্ছেন, এমনকি কারা কারা আসবেন সেটাও ঠিক করেছেন সেই আপনিই। একেবারে ঠিকমতো ওই দশজনকে খবর পাঠিয়েছেন তো?”
“ডক্টর লিন!” রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে প্রচণ্ড একটা হুঙ্কার ছেড়ে ব্রেকেনরিজ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল।
“একদম চুপচাপ বসে থাকুন।” লিনের গর্জন ব্রেকেনরিজকে থমকে দিল। “দেখতেই পাচ্ছেন আমার ব্লাস্টার আপনার দিকে তাক করা রয়েছে। আমরা এখানে অপেক্ষা করব। অপেক্ষা করব সব বিজ্ঞানীদের আসার। ওরা এলে ওদের এক্সরে করা হবে। তেজস্ক্রিয় রশ্মির সাহায্যেও পরীক্ষা করা হবে। প্রত্যেককে এমনভাবে পরীক্ষা করা হবে যে ওদের কেউ কল-মানব হলে তার পালানোর কোনো উপায় থাকবে না। আমার ধারণা ওদের দশজনকেই আমরা ধরতে পারব। আর যদি দেখা যায় সব বিজ্ঞানীই মানুষ, আমার হাতের ব্লাস্টার আপনার হাতে তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করব আমি। ততক্ষণ আমরা এখানেই অপেক্ষা করব। আমি ক্লান্ত হয়ে গেলে লাজলো আপনাকে পাহারা দেবে। সুতরাং শান্ত হয়ে বসে থাকুন।”
তাদের অপেক্ষা শুরু হল।
***
প্রফেসর ম্যানুয়েলো জিমিনেজ সশব্দে বিস্ফোরিত হলেন। তাঁর প্লেন তখন অ্যামাজনের ওপরে শান্তমন্ডল দিয়ে চলেছে। একটা সাধারণ রাসায়নিক বিস্ফোরণ, কিন্তু তা প্লেনটাকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
এমআইটি-র ডক্টর হ্যেরম্যান লিবউইৎজ একটা মনোরেলের মধ্যে ফেটে পড়লেন। তার ফলে কুড়িজন নিহত এবং শতাধিক আহত হল।
মন্ট্রিলের লা’নস্তিতিউত ন্যুক্লিওনিকের ডক্টর অগুস্ত মারিন ও আরও সাতজন শায়ানে আসার পথে একইরকমভাবে মরলেন।
খবরটা পাওয়া মাত্র লাজলো ঝড়ের বেগে রক্তশূন্য মুখে তোতলাতে তোতলাতে ঘরে ঢুকলেন। মাত্র দু-ঘণ্টা ব্রেকেনরিজের দিকে ব্লাস্টার তাক করে লিন বসে রয়েছেন, তার মধ্যে এই কাণ্ড।
“আমি ভেবেছিলাম আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে চিফ। কিন্তু আপনি একেবারে ঠিক ধরেছেন। ওরা সব্বাই কল-মানব। হতেই হবে।” তিনি ব্রেকেনরিজের ঘৃণায় জ্বলতে থাকা চোখের দিকে তাকালেন। “ওদের নিশ্চয়ই সাবধান করা হয়েছিল। ও ওদের কোনোভাবে সাবধান করে দিয়েছিল। ইস্, পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর জন্য একটাকেও ধরা গেল না!”
“হে ভগবান, কী সর্বনাশ!” আঁতকে চেঁচিয়ে উঠে লিন তড়িৎ গতিতে ব্রেকেনরিজের দিকে তাক করে থাকা ব্লাস্টারের ট্রিগার টানলেন। মুহূর্তে অফিসারটির গলা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। ধড় আছড়ে পড়ল মাটিতে। আর প্রচন্ড অভিঘাতে তার মুণ্ডু বীভৎসভাবে মেঝেতে গড়াতে লাগল।
“আমি বুঝতে পারিনি প্রথমে। আমি ভেবেছিলাম ও একজন বিশ্বাসঘাতক। তার বেশি কিছু নয়।” লিন গুঙিয়ে উঠলেন।
গোটা ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে লাজলো বিস্ময়ের ধাক্কায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চোয়াল ঝুলে পড়েছে, মুখে কথা নেই।
লিন বন্য আক্রোশে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, ওই ওদের খবর পাঠিয়েছিল। কিন্তু ওর দেহের ভিতরে যদি রেডিয়ো সিগনাল পাঠানোর ব্যবস্থা না থাকে তাহলে এখানে, আমার সামনে বসে থাকা অবস্থাতেই ও ওদের সাবধান করে কীভাবে? বুঝতে পারছ না? ব্রেকেনরিজ মস্কোতে ছিল। আসল ব্রেকেনরিজ এখনো ওদেশেই। হে ভগবান, দশ নয়, ওরা মোট এগারো জন ছিল।”
“ও ফাটলো না কেন?” লাজলো একটা দমবন্ধ ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
“সম্ভবত অপেক্ষা করছিল খবর পাওয়ার জন্য যে বাকি দশটা নির্বিঘ্নে নষ্ট হয়েছে। তুমি খবরটা নিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাবনাটা আমার মাথায় আসে। ভগবান জানে কত ন্যানো সেকেন্ডের জন্য আমরা বেঁচে গেলাম।”
“অন্তত একটাকে পাওয়া গেল কিছুটা পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর জন্য।” লাজলো উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে পড়ে থাকা দেহটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন।
মুণ্ডহীন ধড় থেকে তখন যে তরল গড়িয়ে পড়ছে তা রক্ত নয়, অত্যুৎকৃষ্ট সোনালি কল-তেল।
Tags: অনুবাদ গল্প, অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, আইজ্যাক আসিমভ, সায়ক দত্ত চৌধুরী