ববক
লেখক: ফিওদর দস্তয়েভস্কি, বাংলা অনুবাদ - সিমরনজিৎ চক্রবর্তী
শিল্পী: নীপাঞ্জলি রায়
কোনো একজনের ডায়রির পাতা থেকে
সেমিয়ন আরদালিওনোভিচ হঠাৎ গতকাল আমাকে বলল, “কেউ কখনও কেন সংযমী হবে ইভান ইভানোভিচ? দয়া করে বলো আমাকে।”
অদ্ভুত একটা দাবী। যদিও আমি এতে রেগে গেলাম না, এমনিতে আমি ভীতু মানুষ; কিন্তু এখানে এরা আমাকে আস্ত উন্মাদ ভেবে নিয়েছে। বস্তুত এই কথা বলে আমার ছবি এঁকেছে একজন শিল্পী: “যতই হোক, আপনি একজন সাহিত্যিক মানুষ বলে কথা।” সে বলল; আমি সোজা হয়ে বসলাম, সে সেটাকে তুলে ধরল ক্যানভাসে। যেন বলল, “নাও দেখে নাও, পাগলামি ফুটিয়ে তোলা বিষাদগ্রস্থ এই মুখটাকে।”
হয়তো সেটা এমনই, কিন্তু এতটা নীরসভাবে সেটার ছবি আঁকার কী প্রয়োজন! ছবিতে সবকিছু সুন্দর হওয়া উচিত, সেখানে থাকা উচিত কল্পনা, কিন্তু তার বদলে…
অন্তত ঘুরিয়েই বলুক: সেজন্যই তো শিল্পের বিভিন্ন শৈলী আছে। কিন্তু না, এসব ঘুরিয়ে করতে ইচ্ছুক সে নয়। আজকাল শ্রদ্ধা এবং ভালো শৈলী হারিয়ে যাচ্ছে এবং অপমানকে ধরে নেওয়া হচ্ছে উদ্ভাবন বলে। এসবের কিছুতেই যদিও আমি রেগে যাই না; কিন্তু ঈশ্বর জানেন মাথা খারাপ হওয়ার মতো যথেষ্ট একজন সাহিত্যিক আমি নই। একটা উপন্যাস লিখেছিলাম, যেটা ছাপা হয়নি। প্রতিবেদনও লিখেছি—সেগুলো বাতিল হয়ে গেছে। সেই প্রতিবেদনগুলো নিয়ে এক সম্পাদকের কাছ থেকে আরেক সম্পাদকের কাছে ঘুরেছি; সর্বত্র সেগুলোকে তারা প্রত্যাখান করেছে। বলেছে আমার লেখায় নাকি কোনো রস নেই। “কেমন রস চান আপনারা?” ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সরস?”
তারা বুঝতেও পারেনি। সাধারণত, বই বিক্রেতাদের জন্য ফ্রেঞ্চ থেকে অনুবাদ করি আমি। বিজ্ঞাপনও লিখি দোকানদারদের জন্য: “বিশেষ সুযোগ! আমাদের নিজস্ব জমিতে চাষ করা চমৎকার চা…” সদ্য পরোলোকে যাওয়া মহান পিতর মাতভেয়িচ-এর উপর স্তুতি লিখে বেশ কিছু টাকা আমি আয় করেছি। “নারীদের সুখ প্রদানের কায়দা” নামক বই পর্যন্ত সংকলিত করেছি, একজন বই বিক্রেতার দেওয়া কমিশনের কাজ ছিল। এযাবৎকাল এইরকম প্রায় ছয়খানা কাজ আমি করে ফেলেছি। ভলতেয়ারের বাণীগুলোর একটা সংকলন করার কথাও ভেবেছিলাম, যদিও আমার আশঙ্কা আমাদের দেশের লোকজনের কাছে সেটা একটু ম্যাড়মেড়ে মনে হবে। ভলতেয়ার এখন আর চলে না: আজকাল ভলতেয়ার নয়, আমরা চাই মুগুর। যাইহোক, এই হল আমার গোটা সাহিত্যকর্মের ব্যাপ্তি। তবুও সত্যি বলতে এখনও সার্কুলার চিঠি আমি পাঠাই সম্পাদকমণ্ডলীদের, মাগনায় এবং পূর্ণ স্বাক্ষরের সঙ্গে। নানা রকমের উপদেশ এবং পরামর্শ তাদের দিই, সমালোচনা করি এবং সঠিক রাস্তা দেখাই। আগের সপ্তাহে সম্পাদকের অফিসে যে চিঠিটা পাঠিয়েছি গত দু-বছরে সেটা চল্লিশতম। শুধুমাত্র সেগুলোর স্ট্যাম্প কিনতে গিয়েই চার রুবল নষ্ট করেছি। আমার মেজাজ এখন তলানিতে।
আমার বিশ্বাস, যে শিল্পী আমার ছবি এঁকেছে, আমার সাহিত্যের কারণে সেটা সে করেনি, করেছে আমার কপালের উপর বসে থাকা দুটো প্রতিসম মাংসপিণ্ডের কারণে, তার মতে এদুটো নাকি একটা প্রাকৃতিক বিস্ময়। কল্পনা বলে কিছু নেই তাদের মনের ভিতর, তাই সমস্ত বিস্ময় তারা হারিয়েছে। আমার মাংসপিণ্ড অবশ্য ছবিতে ফুটিয়ে তুলতেই শুধু সে সক্ষম হয়নি, বরং একেবারে জীবন্ত করে তুলেছে। এটাকে তারা বলে রিয়েলিসম।
আর পাগলামির বিষয়ে বলতে গেলে, আমাদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক লোককে গত বছর পাগল বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর সেটা করা হয়েছিল ঠিক এইরকম ভাষা ব্যবহার করে! “এত সুন্দর জন্মগত প্রতিভা”… “এবং তারপরেও, শেষপর্যন্ত, মনে হচ্ছে”… “যাইহোক, অনেক আগে থেকেই আন্দাজ করা উচিত ছিল” এইটা বরং কৌশলী; তাই কেবল শিল্পের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়তো কেউ সত্যিই এই পদ্ধতির প্রশংসা করতেই পারে। যদিও, শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে এই পাগলেরাই আসলে সবথেকে বেশি চালাক। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সমালোচকেরা পাগল বললেও তাদের চেয়ে ভালো কাউকে তুলে ধরতে পারছে না কিন্তু।
আমার মতে, সবথেকে বুদ্ধিমান হল সেই, যে মাসে অন্তত একবার, নিজেকে বোকা বলতে পারে—একটা গুণ যা আজকাল আর দেখা যায় না। আগেকার দিনে, যেকোনো হারে বছরে একবার হলেও বোকা মানুষেরা স্বীকার করত যে তারা বোকা, কিন্তু আজকাল এর ছিঁটেফোঁটাও নেই। এবং ওরা এতটাই তালগোল পাকিয়েছে যে একজন বুদ্ধিমান মানুষের থেকে একজন বোকাকে আলাদা করার উপায় নেই। ইচ্ছাকৃতভাবেই ওরা এটা করেছে।
আমার মনে আছে, আড়াইশো বছরের পুরনো একটি মজাদার স্পেনীয় বচন, ফরাসিরা তখন তাদের প্রথম পাগলাগারদ তৈরী করেছে: “সমস্ত বোকাদের তারা একটা আলাদা বাড়িতে বন্ধ করে রেখেছে এটা নিশ্চিত করতে যে তারা নিজেরা বুদ্ধিমান।” আলবাত: অন্যকে পাগলাগারদে বন্ধ করে দিয়ে কেউ বুদ্ধিমান হতে পারে না। “ক-এর মাথা খারাপ হয়ে গেছে মানে আমরা সবাই সুস্থ।” না, তার মানে এখনও মোটেই এটা নয়।
এই এক মিনিট, এভাবে বাজে বকে যাচ্ছি কেন? নাহ্, বেশিই গজগজ করছি আজকাল। এমনকী চাকরবাকরগুলোও ইদানিং আমার প্রতি বিরক্ত। গতকাল এক বন্ধু এসেছিল দেখা করতে। “তোমার লেখার ধরন বদলে যাচ্ছে” সে বলছিল; “সবকিছু খাপছাড়া হচ্ছে একেবারে: লেখার মধ্যে তুমি কেবল বিরতির পর বিরতি নিয়ে যাও—তারপর একটা প্রথম বন্ধনী, প্রথম বন্ধনীর মধ্যে তারপরে আরেকটা প্রথম বন্ধনী, তারপরে বন্ধনীর মধ্যে অন্য কিছু গুঁজে দাও, তারপর আবার সেই ছোটো ছোটো বাক্য লিখতে শুরু করো।”
সঠিক কথাই সে বলেছে। অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে আমার সঙ্গে। লেখবার রীতি বদলে যাচ্ছে আমার, মাথা ধরে আসছে। অদ্ভুত জিনিসপত্র দেখতে এবং শুনতে পাচ্ছি, ঠিক স্পষ্ট গলার স্বর নয়, যেন আমার পাশে কেউ বিড়বিড় করে চলেছে, “ববক, ববক, ববক।”
এই ববক আসলে কী? এর মানেটাই বা কী! নাহ্, মাথাটাকে একটু সাফ করতেই হবে।
উদ্দেশ্য সাধনে বাইরে বেরিয়ে গেলাম আমি, গিয়ে পড়লাম এক শবযাত্রার কাছে। যতই হোক, কলেজের একজন উপদেষ্টা—এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়। একজন বিধবা এবং পাঁচজন মেয়ে রয়েছে, তারা প্রত্যেকেই বিবাহযোগ্য তরুণী। না জানে কী লেগেছে তাদের পায়ে এই জুতোর ব্যবস্থা করতে। এতদিন তাদের বাবা চালিয়েছে, কিন্তু এখন কেবল অতি সামান্য পেনশন। কুড়িয়ে বাড়িয়ে খেতে হবে এখন। আমার প্রতি কখনই ওরা খুব একটা সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার করেনি। আর অবশ্যই এই শবযাত্রায় আমি যেতাম না, যদি না আমার এই কেমনতর অবস্থা হত। বাকিদের মতো শবযাত্রার পিছন পিছন আমিও গেলাম কবরস্থানে; ওরা দূরে আলাদা দাঁড়িয়েছিল। আমার জামাকাপড় যে তুলনামূলক জীর্ণ ছিল, এতে কোনো সন্দেহই নেই। প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেছে শেষবার আমি এই কবরস্থানে আসার পর থেকে; উফ্, কী হতভাগ্য জায়গা!
শুরুই হয় গন্ধটা দিয়ে। পনেরো রকমের শববাহী যান আছে এখানে, দাম অনুযায়ী পর্দা লাগানো; শবাধার রাখার মঞ্চ আছে দু-খানা। একটায় একজন জেনারেল, আর একটায় একজন মহিলার দেহ। বেশকিছু শবানুযাত্রী ছড়িয়ে রয়েছে এদিক-ওদিক, প্রচুর লোকদেখানো শোক আর খোলাখুলি ফূর্তির ধুম লেগেছে। পাদ্রীদের যদিও এতে অসুবিধার মতো কিছু নেই, এখান থেকে তাদের ভালোই আয় হয়। কিন্তু ওই গন্ধ, বিকট গন্ধ…! আমি বাবা কোনোদিনও এখানে পাদ্রী হতে পারব না।
শুধু সতর্কভাবে মরদেহগুলোর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম বারবারই, নিজের সংবেদনশীলতাকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারও কারও মুখে হালকা হাসি, কারও মুখের অবস্থা অপ্রীতিকর। সচরাচর হাসি বিষয়টা সামঞ্জস্যহীন মনে হয় আমার, কিছুক্ষেত্রে একটু বেশিই। আমি একদমই পছন্দ করি না; জিনিসটা দুঃস্বপ্নের কারণ।
প্রার্থনার সময়টায় বাইরে খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে এলাম গির্জা থেকে: দিনটা মেঘলা, কিন্তু শুকনো। অক্টোবর মাস, ঠান্ডাও পড়েছে। কবরগুলোর কিছুটা মাঝখান দিয়ে দিয়ে হাঁটলাম। সব বিভিন্ন শ্রেণীর। তৃতীয় শ্রেণীর দাম তিরিশ রুবল; ঠিকঠাক, খুব একটা ভালো নয়। প্রথম দুটো শ্রেণী হল গির্জা আর দেউরির নীচের কবরগুলো; ওগুলোর অনেক দাম। এই মুহূর্তে ছ-জন মানুষকে তৃতীয় শ্রেণীর কবরে মাটি দেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে ওই জেনারেল আর মহিলাটিও আছেন।
গর্তগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম—ভয়ানক অবস্থা: জলে ভরতি! একেবারে সবুজ রং এবং কিন্তু, ওই বিষয়ে আর কথা বলে কী লাভ! মাটি খোঁড়ার লোকটা প্রতি মিনিটে জল তুলে তুলে ফেলছিল। প্রার্থনা চলাকালীনই বেরিয়ে গেছিলাম, এবার হেঁটে গেটের বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি। কাছেই দেখলাম একটা লঙ্গরখানা রয়েছে, আর একটু এগিয়েই দেখতে পেলাম একটা রেস্তোরাঁ। দুপুরের খাবার ইত্যাদি সবই ছিল; ছোটো নিকৃষ্ট মানের কোনো রেস্তোঁরা এটা নয়। অনেক শবানুগামী এখানে রয়েছে দেখলাম; বেশ ভালো পরিমাণে উল্লাস এবং নিখাদ আন্তরিকতা লক্ষ করতে পারলাম। কিছু খাবার আর পানীয় টেনে নিয়ে বসলাম খেতে।
ফিরে গিয়ে এরপর গির্জা থেকে কবর পর্যন্ত কফিন বয়ে নিয়ে আসার কাজে কাঁধ লাগালাম। ভাবছিলাম, এত ভারী কেন হয় কফিনের ভিতরের মৃতদেহগুলো? লোকে বলে এর কারণ নাকি কোনো এক ধরনের জড়তা, শরীর নাকি আর তার মালিকের দ্বারা পরিচালিত হয় না… বা ওরকমই কিছু, সাধারণ জ্ঞান এবং বস্তুর নিয়মের বিরুদ্ধাচারণ করা আজগুবি কথা। সেসব মানুষের কথা শুনতে আমি পছন্দ করি না যাদের সাধারণ শিক্ষা ছাড়া কিছু নেই অথচ এমন প্রশ্নের সমাধান করার চেষ্টা করে যার জন্য প্রয়োজন বিশেষ জ্ঞানের; আর আমাদের সঙ্গে এইরকম ঘটছে অহরহ। সাধারণ মানুষেরা এমন এমন বিষয়ে মতামত দিতে ভালোবাসে যা সৈন্য বা হয়তো ফিল্ড মার্শালের আওতায় পড়ে; এদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া মানুষেরা সারাদিন অর্থশাস্ত্র আর দশর্ন নিয়ে আলোচনা করে চলেছে।
আত্মার শান্তি কামনা করার জন্য আয়োজিত সমবেত প্রার্থনায় আমি যাইনি। কিছুটা আত্মসম্মান আমার আছে, আর কিছু বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া যদি সেই বকেয়া প্রাপ্ত না হয় তাহলে, তাদের নৈশভোজে নিজে থেকে যাবই বা কেন? হলই বা শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ। একটাই জিনিস কেবল বুঝতে পারছি না যে এখনও এই কবরস্থানে আমি কেন বসে আছি; একটা সমাধির উপরে বসে গভীর চিন্তায় যেন ডুবে গেছিলাম।
শুরু করেছিলাম মস্কোর প্রদর্শনী দিয়ে আর শেষ করলাম বিমূর্তের বিস্ময়বিমূঢ়তা দিয়ে। বিস্ময়বিমূঢ়তা তত্ত্ব থেকে আমার যা কিছু সিদ্ধান্ত তা হল এই:
“সবকিছুর প্রতি বিস্মিত হওয়া নিশ্চিতভাবেই বোকামি, কোনোকিছুর প্রতিই বিস্মিত না হওয়াটা একটা বেশ বড়ো বিষয় হয়ে উঠছে এবং কোনো কারণে ভালো চোখেই দেখা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা আসলেই এমন নয়। আমার মতে, কোনোকিছুর প্রতিই বিস্মিত না হওয়া সবকিছুর প্রতি বিস্মিত হওয়ার থেকেও বেশি বোকা বোকা। আর, তা ছাড়াও, কোনোকিছুর প্রতিই বিস্মিত না হওয়াটা কোনোকিছুর প্রতি সম্মানবোধ না থাকারই সমান। এবং বাস্তবিকই একজন বোকা মানুষ কারও প্রতি সম্মানবোধ করতে অক্ষম।”
“সবথেকে বেশি আমি যা চাই তা হল কেবল সম্মান পেতে। সম্মানিত বোধ করার জন্য আমার আকাঙ্খা তীব্র,” আমার এক পরিচিত সেদিন বললেন আমায়।
সম্মানিত বোধ করার জন্য নাকি তিনি ব্যাকুল! ভাবলাম, কী কাণ্ডটাই না হবে যদি আজকাল এইসব ছাপানো হয়?
এইসব ভাবতে ভাবতেই আমি সেই মুহূর্তে বিস্মৃতির অতলে ডুবে গেলাম। এপিটাফের খোদাই করা লেখা আমি পড়তে বিশেষ পছন্দ করি না: অনন্তকাল ধরে সব একই কথা লিখে রেখেছে। পাশের সমাধিস্তম্ভের উপরে একটা আধখাওয়া স্যান্ডউইচ পড়েছিল; বেকুব এবং বেমানান একটা কাণ্ড। মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিলাম, কেননা ওটা ঠিক সেই অর্থে রুটি ছিল না, কেবল স্যান্ডউইচের টুকরো ছিলো। যদিও আমি মনে করি না রুটি ছুড়ে ফেলা কোনো পাপ, যদি না সেটা ফেলা হয় পাথরে বাঁধানো মেঝেতে। সুভোরিনের পঞ্জিকায় দেখতে হবে বিষয়টা।
সম্ভবত অনেকক্ষণ ধরে ওখানেই বসেছিলাম আমি—এতটাই সময় ধরে যে, মার্বেলের কফিনের মতো দেখতে একটা পাথরের উপরে হয়তো শুয়েই পড়েছিলাম। কীভাবে যে তা হল জানি না, তবে হঠাৎই বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার শব্দ শুনতে পেলাম। চাপা চাপা স্বর শুনলাম, যেন বক্তার মুখের উপরে কেউ বালিশ চাপা দিয়ে রেখেছে। তারপরেও আওয়াজগুলো যেন ছিল স্পষ্ট এবং খুব কাছেই কোথাও থেকে আসছিল। ধাতস্থ হয়ে উঠে বসলাম এবার আমি, এবং মন দিয়ে শুনতে লাগলাম।
“হে মহামান্য, এটা একেবারেই অসম্ভব। আপনি হরতন দিয়ে খেলা শুরু করলেন, আমি আপনার খেলা অনুসরণ করলাম, এখন আবার আপনি রুহিতনের সাত খেলে দিলেন। আপনার উচিত ছিল আমাকে রুহিতনের ব্যাপারে ইঙ্গিত দেওয়া।”
“কী, বাঁধাধরা নিয়মে খেলতে হবে? ওতে মজাটা কোথায়?”
“আপনাকে এমনভাবে খেলতেই হবে, মহামান্য। কী করতে হবে সেটা না জেনে কেউ কিছু করতে পারে না। আমাদের একটা ডামি খেলতেই হবে, যাতে এই হাতটা নষ্ট না হয়।”
“আচ্ছা, কিন্তু এখানে তুমি কোনো ডামি পাবেন না।”
কী দাম্ভিক কথাবার্তা! আর ঘটনাটা অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিতও ছিল বটে। একজনের গলার স্বর গুরুগম্ভীর, আরেকজনের নরম ভদ্রতাপূর্ণ; নিজে না শুনলে কখনই এসব বিশ্বাস করতাম না। মনে করতে পারছি যে আমি শ্রাদ্ধের জমায়েতে যাইনি। কিন্তু তারপরেও এরা আমার কাছাকাছি কোথাও প্রেফারেন্স খেলছে কীভাবে, আর এই জেনারেলই বা কে? কোনো সন্দেহই নেই যে আওয়াজটা এসেছে সমাধিস্তম্ভের নীচ থেকে। আমি ঝুঁকে সমাধিফলকটা পড়লাম:
“এখানে বিশ্রাম নিচ্ছেন মেজর-জেনারেল পেরভয়িদেভ… পদমর্যাদার একজন বীর অশ্বারোহী” হুঁ! “দেহ রেখেছেন এই বছর আগস্ট মাসে… সাতান্ন… ঘুমাও প্রিয় দেহাবশেষ, আনন্দময় ফজর পর্যন্ত।”
হুঁ! ধুত্তেরি, এ তো সত্যিই দেখছি একজন জেনারেল। আরেকটা কবরে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ ছিল না যে সেখান থেকে ওই তোষামুদে আওয়াজ আসতে পারে, শুধুমাত্র একটা সমাধি ছিল। নিশ্চয়ই সদ্য তাকে আনা হয়েছে। আওয়াজ শুনে মনে হল সে একজন নিম্ন আদালতের উপদেষ্টা ছিল।
“হিঁক্-হিক্-হিক্-হিক্!” নতুন একটা গলার স্বর শুনতে পেলাম, জেনারেলের কবর থেকে বারো গজ দূরে তাজা কবরটা থেকে আওয়াজটা আসছে। শুনে মনে হল, আওয়াজটা সম্ভবত একজন নীচু শ্রেণীর পুরুষের, ধর্মীয় উচ্ছাসের প্রতি যার অনুরাগ ভীষণই বিরক্তিকর। “হিক্-হিক্-হিক্-হিক্!”
“উফ্! এই ব্যাটা আবার হেঁচকি তুলছে!” অহংকার এবং তাচ্ছিল্য ভরা একটা চিৎকার করে উঠল একজন অতিষ্ট মহিলা, সম্ভবত সমাজের উচ্চতম অংশের কেউ। “এই দোকানির পাশে থাকা একেবারে একটা দূর্ভাগ্য।”
“আমি হেঁচকি তুলিনি; কেনে তুলব, আমি কিছুই খাইনি যে। এটি তো আমার মুদ্রাদোষ। সত্যি ঠাকরুন, আপনি দেখছি আপনার খামখেয়ালিপনা ছাড়তে পারছেন না গো।”
“তাহলে হতচ্ছাড়া এখানে এসে শুয়েছিসই বা কেন?”
“আমাকে তো হেথাকেই কবর দেওয়া হইছে, বউ আর ছেলেমেয়েরা এনে ফেলেছে। নিজে হেথাকে আসিনি কো। মরাটা হওয়ার জ্বালা আর কী! আর আমি কক্ষনো আপনার পাশে এসে শুতাম না গো, আমাকে একটা বস্তা ভরে টাকা দিলেও না: এখানে শুয়েছি আমার ভাগ্যের ফেরে, টাকাপয়সার বিচার করলে। যা জো—একটা তৃতীয় শ্রেণীর কবর।”
“তুই টাকা কামিয়েছিস বুঝি? লোকজনকে ঠকিয়েছিস?”
“আপনাকেই তো ঠকিয়েছি গো ঠাকরুণ! আপনার টাকার টিকিটিও দেখতে পাইনি, সেই জানুয়ারি মাস থেকে। দোকানের খাতায় আপনার ছোট্ট একটি দেনা আছে।”
“এটা খুবই বোকা বোকা কাজ: এইখানে এসে পাওনা আদায় করাটা আমার মতে ভীষণই বোকামি! যা, মাটির উপরে যা। আমার ভাইঝিকে গিয়ে বল—ওই এখন আমার উত্তরাধিকারী।”
“এখন আর কাউকে কিচ্ছু বলার নেই গো ঠাকরূণ, আর কোথাও যাওয়ারও নেই। আমরা সব্বাই নিজের নিজের শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি কো, ঈশ্বরের আদালতে আমরা দুজনেই আমাদের পাপের ভারে সমান।”
“এহ্! আমাদের পাপের ভারে সমান,” মহিলাটা তাকে অপমানজনকভাবে ভ্যাঙালো। “আমার সঙ্গে একদম কথা বলবি না, কত সাহস!”
“হিক্-হিক্-হিক্-হিক্!”
“দেখছেন, মহামান্য, দোকানদারটা মহিলাটিকে সম্মান করে।”
“করবে নাই বা কেন?”
“কারণ মহামান্য, আমরা প্রত্যেকেই জানি এখানে সব কিছু আলাদা।”
“আলাদা? কীভাবে?”
“আজ্ঞে, বলতে গেলে, আমরা সবাই এখানে মৃত, মহামান্য।”
“ওহ্, হ্যাঁ! কিন্তু তবুও…”
এ যে একেবারে বিনোদন, চমৎকার রঙ্গ, বলতেই হবে! নীচেই যদি এইসব হয়ে থাকে, উপরে না জানি কীসব হয়েছে? যদিও ভীষণই অদ্ভুত ব্যাপার! আমি সব শুনে যেতে লাগলাম, যদিও এদের প্রতি চরম ধিক্কারের নিয়ে।
“জিন্দেগির এক টুকরা সোয়াদ আমাকে পেতে হবে! জ্বি জনাব… জিন্দেগির এক টুকরা সোয়াদ পেতেই হবে আমাকে।” এবারে আরও একটা নতুন স্বর শুনতে পেলাম, জেনারেল আর ওই অতিষ্ঠ মহিলার কবরের মাঝের কোনো একটা জায়গা থেকেই আওয়াজটা আসছে।
“আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন মহামান্য, আমাদের সেই বন্ধু আবার ওই এক পাগলামি শুরু করেছে। তিন দিন ধরে টানা সে চুপ থাকে, তারপর সে চিৎকার করে ওঠে, ‘জিন্দেগির এক টুকরা সোয়াদ আমাকে পেতে হবে, জ্বি, জিন্দেগির এক টুকরা সোয়াদ।’ একেবারে করুণ সুরে, হি-হি!”
“এবং একেবারে ছেলেমানুষের মতো।”
“এসব ওর দুঃসাহসের পরিচয় দেয়, আর মহামান্য, আপনি কি জানেন ও ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছে, ভীষণভাবেই ঝিমোচ্ছে—সেই এপ্রিল থেকে ও এখানে রয়েছে: আর তারপর হঠাৎই মাঝেমধ্যে একদিন, ‘জিন্দেগির এক টুকরা সোয়াদ আমাকে পেতে হবে!’”
“বড়ই বিষণ্ণ ব্যাপার যদিও।” মহামান্য অনুভব করলেন।
“ঠিকই বলেছেন, মহামান্য। যাইহোক, আমি কি আরেকবার অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা-কে ক্ষেপিয়ে তুলব, হিহি!”
“না, না, রক্ষা করুন আমাকে, দয়া করুন। ওই ঝগড়ুটে মহিলাকে আমি সহ্য করতে পারি না।”
“আর আমি আপনাদের দুজনকেই সহ্য করতে পারি না,” তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে উঠল স্ত্রীলোকটি। “আপনারা দুজন মিনষে, আপনাদের ভেতরে কোনো রস নেই, কোনো আদর্শের কথা আপনারা বলতে পারেন না। একটা ছোট্ট গল্প শুনেছি আপনারে ব্যাপারে, মহামান্য—না, না, উপরের দিকে তাকাবেন না—একদিন সকালবেলা আপনাকে নাকি এক দম্পতির বিছানার তলা থেকে ঝাঁট দিয়ে বের করে এনেছিল তাদের এক চাকর!”
“উফ্! নোংরা মেয়েছেলে একটা,” দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে উঠল জেনারেল।
“অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা দিদিমণি” দোকানদারটি হঠাৎই এদিকে আবার হাহাকার করে উঠল, “প্রিয়, রাগ করো না কো, কেবল আমাকে বলো, আমি কি কঠিন যন্ত্রণাটা সহ্য করবার পরীক্ষা দিচ্ছি নাকি?”
“আরে্, এই উচ্চিংড়ে আবার শুরু করছে দেখছি, যা ভেবেছিলাম। হতভাগার গা থেকে কী একখানা গন্ধ বের হচ্ছে, যার জন্য শালা একেবারে পাগল হয়ে গেছে।”
“আমি পাগল হইনি গো, আর আমার গা থেকে কোনো গন্ধও আসছে না। যখন আপনি নেশার উপরে চড়ে থাকতেন, আমি তখন নিজের শরীরটাকে পরিস্কার রেখেছি কিনা ঠিকমতো, হুঁ। এইরকম একটা জায়গাতেও কী ভয়ানক লাগছে গো গন্ধটা। আমি নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরে এই ব্যাপারে কিছুটি বলি না।”
“আরে নচ্ছার, কীভাবে আমায় অপমান করছে দেখো! ওই হারামজাদার নিজের গা থেকে দূর্গন্ধ বেরোয় আর বলছে কিনা আমাকে!”
“হিক্-হিক্-হিক্-হিক্! কবে যে আমার শ্রাদ্ধের দিনটা আসবে গো: ওরা আমার কবরের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কান্না জড়ানো গলায় কথাগুলা বলবে, বউটা কান্নাকাটি করবে আর ছেলেমেয়েগুলো নরম আঙুল দিয়ে চোখ মুছবে গো!…”
“ও একটা বিরক্ত হবার মতো জিনিস বটে! সব শালা শ্রাদ্ধের ভাত গিলবে গপ্গপ্ করে আর তারপর বাড়ি ফিরে যাবে… ইস্, নতুন কেউ যদি এইসময় একটু জেগে উঠত!”
“অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা” টিপ্পনী কাটল সরকারী কেরানিটি, “একটু অপেক্ষা করুন, আগন্তুকেরা কথা বলবে।”
“এই, তাদের মধ্যে কি কোনো অল্পবয়সি কেউ আছে?”
“হ্যাঁ, আছে, অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা। বেশ কিছু ছেলে-ছোকরা আছে তাদের মধ্যে।”
“উফ্, আমার যে কী আহ্লাদই হচ্ছে!”
“তারা কি এখনও কথা বলতে শুরু করেনি?” খোঁজ নিলেন মহামান্য।
“গত পরশু যারা এসেছিল মহামান্য, এমনকী তারাও এখনও জেগে ওঠেনি। আপনি জানেনই, আগন্তুকরা কখনও কখনও এক সপ্তাহ পর্যন্ত কিছু বলে না। ওরা একটা কাজের কাজ করেছে, আজ, গতকাল আর গত পরশু বেশ কিছু নতুনকে নিয়ে এসে। হিসেবমতো, আশপাশের সত্তর ফুটের মধ্যে সবাই গত বছরের।”
“হ্যাঁ, বেশ জব্বর হবে তবে ব্যাপারটা।”
“হ্যাঁ, মহামান্য, ওরা আজকেই প্রাইভি কাউন্সিলর তারাসেভিচ-কে কবর দিয়েছে। আমি গলার আওয়াজগুলো শুনে বুঝতে পেরেছি। ওর ভাইপোকে আমি চিনি, একটু আগেই কফিন নীচে নামাতে হাত লাগিয়েছিল।”
“হুম্, তাহলে উনি কোথায় এখন?”
“আপনার থেকে পাঁচ কদম দূরে, মহামান্য, বাঁ দিকে… প্রায় আপনার পায়ের কাছেই। মহামান্য, আপনার উচিত ওনার সঙ্গে আলাপ করা।”
“হুম্, না—আমার আগ বাড়িয়ে কিছু করাটা ঠিক হবে না হে।”
“ওহ্, উনি নিজেই কথা বলা শুরু করবেন, মহামান্য। তার মোসাহেবি করা হবে কিনা। বিষয়টা মহামান্য আপনি আমার উপরে ছেড়ে দিন, আমি….”
“ওহ্, ওহ্!… এ কী হচ্ছে আমার সঙ্গে!” এক আগন্তুক ভীত স্বরে কর্কশ চিৎকার করে উঠল।
“আগন্তুক, মহামান্য, একজন আগন্তুক, অশেষ ধন্যবাদ হা ঈশ্বর! কত তাড়াতাড়ি কথা বলেছে! মাঝেমধ্যে এরা এক সপ্তাহ পর্যন্ত কথা বলে না।”
“আরে, মনে হচ্ছে যেন একটা কচি মাথা!” খ্যানখ্যানে গলায় প্রায় চিৎকার করে উঠল অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা।
“ব… ব… ব্যাপারটা খুব জটিল ছিল, আর হঠাৎ করেই কেমন জানি সব হয়ে গেল।” আমতা-আমতা করে আবার বলে উঠল ছেলেটা। “আগেরদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাকে শুলৎজ বলল, ‘গোলমাল হয়ে গেছে,’ আর তারপর হঠাৎ সকাল হওয়ার আগেই আমি একেবারে ঘুমিয়ে পড়লাম। ওহ্! উফ্!”
“এ বিষয়ে আর কিছু করা যাবে না, বাছা” সান্ত্বনা দিয়ে বললেন জেনারেল, স্পষ্টতই খুশি হয়েছেন নতুন একজনের আগমনে, “তোমার ভালো করে আপ্যায়ন করতে হবে। আমাদের এই জায়গাটাকে আমরা বলি যিহোশাফাত-এর রাজ্য, তোমাকে এখানে স্বাগত। সবাই আমরা সহৃদয় লোকজন, তুমি আমাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরই বুঝতে পারবে। মেজর ভাসিলি ভাসিলিচ পেরভয়িদেভ তোমার সেবায়।”
“আরেহ্, না, না! এসব একেবারেই না! আমি তো শুলৎজ-এর কাছে গিয়েছিলাম। আমার একটা সমস্যা হয়েছিল, জানেন, প্রথমে আমার বুকে আর কাশি, তারপর আমার ঠান্ডা লেগে গেল; আমার ফুসফুস, ইনফ্লুয়েঞ্জা… আর তারপরেই হঠাৎ করে, বেশ অপ্রত্যাশিতভাবে… সবথেকে খারাপ ব্যাপার হল যে আচমকাই সব ঘটে গেল।”
“তুমি বলছ এসব শুরু হয়েছিল তোমার বুক থেকে,” আগন্তুককে আশ্বস্ত করার জন্য তার কোমল স্বরে বলে উঠল সরকারি কেরানিটা।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, প্রথমে আমার বুক আর শ্লেষ্মা, তারপরে আর শ্লেষ্মা ছিলো না, কিন্তু বুকে তখনও সমস্যা ছিল, আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না… জানেন?”
“জানি, জানি। কিন্তু যদি এসব তোমার বুক থেকে শুরু হয়ে থাকে, তাহলে তোমার উচিত ছিল শুলৎজ-এর বদলে য়েক-এর কাছে যাওয়া।”
“জানেন, আমি ভাবছিলাম বটকিন-এর কাছেই যাব একেবারে…”
“বটকিন-এর কাছে যাওয়ায় বেশ বাধা আছে হে, সবাইকে দেখতে চান না” বলে উঠলেন জেনারেল।
“আরে না, না, তিনি কোনোরকম বাধা দেন না। আমি শুনেছি তিনি ভীষণই মনোযোগী রোগীদের প্রতি এবং সবকিছু আগেভাগে বলে দেন।”
“আসলে, মহামান্য তাঁর পারশ্রমিকের কথা বলছিলেন,” কেরানি শুধরে দিলো আগন্তুককে।
“আরে না, না, তিনি মাত্র তিন রুবল পারিশ্রমিক নেন, আর ভালোভাবে পরীক্ষা করেন, প্রেসক্রিপশনও দেন…সব কিছু শুনে, আমার খুবই ইচ্ছে ছিল তাঁর কাছে যাওয়ার… বলুন মহোদয়েরা, য়েক নাকি বটকিন, আমার কার কাছে যাওয়া উচিত ছিল?”
“কী? কার কাছে?” স্নেহশীল হাসিতে জেনারেলের মৃতদেহ কেঁপে উঠল। কেরানির কৃত্রিম স্বরেও দেখা গেল তার প্রতিফলন।
“প্রেয় তরুণ, প্রিয়, রমণীয় জওয়ান, তোমাকে যে আমার কী পছন্দ হয়েছে!” আনন্দের সঙ্গে চিৎকার করে উঠল অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা। “কী ভালোই না হত যদি তোমার মতো কাউকে আমার পাশে রাখত।”
না, একেবারে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবার! এই মৃতেরা নাকি সবাই আমাদেরই সময়ের! তবুও, আমার মনে হয় ফয়সালা করার জন্য এত তাড়াহুড়ো না করে আরও কিছুক্ষণ শোনা উচিত। ওই চোখের-নাকের জল ফেলা আগন্তুকের—মনে আছে আমার, একটু আগেই কফিনের ভিতর—মুখটা ছিল জবাই হওয়ার অপেক্ষায় থাকা ভয়ার্ত মুরগির মতো, দুনিয়ার সবথেকে বেশি বিতৃষ্ণা জাগানো সেই মুখভঙ্গি। যাইহোক, আরও একটু অপেক্ষা করে দেখি।
কিন্তু এরপর এমন এক হট্টগোল শুরু হয়ে গেল যে আমি কিছুতেই সবকিছু মনে রাখতে পারলাম না। একসঙ্গে অনেকজন জেগে উঠল; একজন আমলা—সিভিল কাউন্সিলর—জেগে উঠেই আলোচনা করতে শুরু করল সরকারি দপ্তরের নতুন উপ-আয়োগের প্রকল্প এবং সেই উপ-আয়োগের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন কর্মীদের সম্ভাব্য বদলির বিষয়ে—যেটা মহামান্য জেনারেলের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করল। স্বীকার করতেই হবে আমি এমন অনেক আশ্চর্য জিনিস শিখলাম যেগুলো আমার কাছে ছিল নতুন, আমি বিস্মিত হলাম জেনে যে মহানগরের কোন গলিতে প্রবেশ করলে মাঝেমধ্যে সরকারি খবর জানা যায়। এরপর এক ইঞ্জিনিয়ার অর্ধেক জেগে উঠল এবং অনেকটা সময় ধরে কেবল বিড়বিড় করে আবোল-তাবোল বকে গেল, তাই আমাদের বন্ধুরা যতক্ষণ না সে পুরোপুরি তৈরি হচ্ছে কথা বলার জন্য ততক্ষণ তাকে আর বিরক্ত করবে না ঠিক করে সরে গেল। অবশেষে, সেই খানদানি মহিলা যিনি সকালবেলায় শবাধার স্থাপনের মঞ্চের নীচে কবরস্থ হয়েছিলেন, তিনি সমাধির উপরে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার লক্ষণ দেখাতে শুরু করলেন। লেবেজিয়াৎনিকভ (দেখা গেল, সেই যাকে আমি নিম্ন আদালতের উপদেষ্টা বলে চিনতে পেরেছিলাম, যে কিনা জেনারেল পেরভয়েদেভ-এর পাশে শুয়ে আছে, তার নাম আসলে লেবেজিয়াৎনিকভ) উত্তেজিত আর বিস্মিত হয়ে উঠল এই দেখে যে তারা সবাই এবারে তাড়াতাড়িই জেগে উঠছে। আমাকে মেনে নিতেই হবে আমি নিজেও কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম; যদিও যারা জেগে উঠছিল তাদের মধ্যে বেশির ভাগই তিন দিন ধরে কবরস্থ থেকেছে, যেমন, একটি ষোলো বছরের তরুণী, খিলখিল করে হেসে চলেছে… ভয়ঙ্করভাবে, ক্ষুধার্ত শিকারীর মতো।
“মহামান্য, প্রাইভি কাউন্সিলর তারাসেভিচ জেগে উঠছেন!” ব্যস্ততার সঙ্গে ঘোষণা করল লেবেজিয়াৎনিকভ।
“এহ্! কী?” হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে, বিরক্তি নিয়ে বলল তারাসেভিচ, অস্পষ্টভাবে। একটা বদমেজাজি প্রভুত্বব্যঞ্জক সুর ছিলো তার গলায়।
কৌতূহল নিয়ে শুনতে থাকলাম। গত কয়েকদিন ধরে তারাসেভিচের ব্যাপারে আমিও বেশ কিছু কথা শুনেছি—জঘন্য এবং চরম বিরক্তিকর সেসব।
“এই কেবল আমি, মহামান্য, আমি।”
“কী তোমার আর্জি? তুমি কী চাও?”
“মহামান্যের স্বাস্থ্যের বিষয়ে জানতে চাইছিলাম মাত্র; এই অনভ্যস্ত পরিবেশে অনেকেরই প্রথম প্রথম এইরকম একটু মনে হয়, যেন, তারা পায়ের তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে… জেনারেল পেরভয়িদভ আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে সম্মানিত হতে চান, এবং তিনি আশা করেন…”
“তার নাম আমি কখনও শুনিনি।”
“নিশ্চয়ই, মহামান্য! জেনারেল পেরভয়িদভ, ভাসিলি ভাসিলিচ…”
“তুমি কি জেনারেল পেরভয়িদভ?”
“না, মহামান্য। আমি অতি সামান্য লোয়ার কোর্টের কাউন্সিলর, লেবেজিয়াৎনিকভ, আপনার সেবায়, কিন্তু জেনারেল পেরভয়েদভ…”
“যত্তসব! আমি তোমাকে মিনতি করছি, আমাকে একা থাকতে দাও।”
“ওঁকে নিজের মতো থাকতে দিন।” অবশেষে জেনারেল নিজেই কবরের মধ্যে মর্যাদার সঙ্গে তাঁর বিরক্তিকর চ্যালাটিকে আটকালেন।
“উনি এখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেননি, মহামান্য, আপনাকে অবশ্যই এইটা বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে; এইসব কিছুর অভিনবত্ব আর কী। যখন উনি পুরোপুরি জেগে উঠবেন, তখন নিশ্চয়ই বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখবেন তিনি।”
“ওঁকে নিজের মতো থাকতে দিন।” পুনরাবৃত্তি করলেন জেনারেল।
“ভাসিলি ভাসিলিচ! এই যে, মহামান্য!” অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনার ঠিক পাশ থেকে একেবারে একটা নতুন জোরালো ও উপর-পড়া গলার আওয়াজ ভেসে এল। ভদ্রজনোচিত ঔদ্ধত্যের স্বর, সঙ্গে জড়তা মেশানো উচ্চারণ যেটা আজকাল বেশ কেতাদুরস্ত, এবং এক আত্মপ্রত্যয়ের ঢং। “গত দু-ঘণ্টা ধরে আমি আপনাদের দেখছি। আপনার কি আমাকে মনে আছে, ভাসিলি ভাসিলিচ? আমার নাম ক্লাইনেভিচ, ভোলোকনস্কিসের ওখানে দেখা হয়েছিল, সেখানে আপনিও ছিলেন অতিথি হিসেবে, যদিও জানি না কেন ছিলেন।”
“কী, কাউন্ট পিতর পেত্রোভিচ নাকি?… না, এ আপনি হতে পারেন না… এত অল্প বয়সে? খুবই দুঃখ পেলাম শুনে।”
“ওহ্, আমি নিজেই দুঃখিত, যদিও আমার ওতে খুব একটা আগ্রহ নেই, তা ছাড়া আমি নিজেকে যতটা সম্ভব খোশমেজাজে রাখতে চাই সর্বত্র। আর আমি কাউন্ট নই, ব্যারন, শুদ্ধ ব্যারন। মরামাসে ভরা ব্যারনের দল আমরা, চাপরাশি থেকে পদোন্নতি পেয়েছি, কিন্তু কেন পেয়েছি তা জানি না, আর জানতেও চাই না। এই ভুয়ো কুলীন সমাজের আমি এক বজ্জাত, আর আমার পরিচিতি “একজন মনোমুগ্ধকারী ভাঁড়” হিসেবে। বাপ হল এক হতভাগ্য সামান্য জেনারেল, আর আমার মা একবার আমন্ত্রিত হয়েছিল উ লিয়ে-তে। ইহুদী জিফেল-এর সাহায্য নিয়ে গত বছর পঞ্চাশ হাজার রুবল নকল নোট ছাপিয়েছিলাম, তারপর ওর বিরুদ্ধেই খবর পাচার করে দিই, এই ফাঁকে জুলি শাপঁতিয়ে দে লুসিনিয় সেই টাকাগুলো নিয়ে চলে যায় ব্যোদো-য়। আর শুধুমাত্র খেয়ালপনায়, আমি একবার বিয়ে করার জন্য বাগদত্ত হয়েছিলাম—স্কুল পড়ুয়া একটি মেয়ের সঙ্গে, ষোলো হতে তখনও তার তিন মাস বাকি ছিল, সঙ্গে নব্বই হাজারের পণ। অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা, তোমার মনে আছে কীভাবে তুমি পনেরো বছর আগে আমাকে পটাতে চেষ্টা করেছিলে, সেই যখন আমি ক’ দে পেস মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে চোদ্দো বছরের একজন কিশোর ছিলাম?”
“ও রে বদমাশ, ওটা তুমি ছিলে? যাইহোক, একজন সাক্ষাৎ দেবদূত তুমি, অন্তত এখানের জন্য…”
“তোমার প্রতিবেশি, ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটি, ওকে গন্ধের জন্য সন্দেহ করে ভুল করছ… কিছু বলিনি এতক্ষণ, কেবল হাসছিলাম। আসলে দুর্গন্ধটা আসছে এখান থেকে। ওরা আমাকে পেরেক-মারা কফিনে পুরে কবর দিয়েছে।”
“আহ্! শালা একেবারে জঘন্য জানোয়ার! তবুও, আমি খুব খুশি তোমায় এখানে পেয়ে। ভাবতেও পারবে না জীবন আর রসের কী পরিমাণে অভাব এখানে।”
“ঠিকই, সত্যিই তাই, আর আমি এখানে নতুনত্ব আনতে চাই। মহামান্য—আপনাকে না পেরভয়িদেভ—আরেকজনকে ডাকছি। তারাসেভিচ, প্রাইভি কাউন্সিলর! জবাব দিন! আমি ক্লাইনেভিচ, যে আপনাকে মাইল-এ নিয়ে গেছিল। আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন, ফুরিএ এন লেন?”
“পাচ্ছি, ক্লাইনেভিচ, এবং আমি পরমানন্দিত হয়েছি, আর বিশ্বাস করো…”
“আপনার হাতে কানাকড়ি দিয়েও আপনাকে আমি বিশ্বাস করব না, আর আমার কোনো আগ্রহও নেই আপনার বিশ্বাসে। আমি শুধু আপনাকে একটা চুমু দিতে চাই, বুড়ো সোনা, কিন্তু ঘটনাচক্রে সেটা পারছি না। মহোদয়েরা কি জানেন, এই দাদাজি কী খেলা খেলে এসেছেন? তিন-চারদিন হল মারা গেছেন, বললে বিশ্বাস করবেন না আপনারা, বিধবা আর অনাথ শিশুদের তহবিলে চার লক্ষ সরকারি টাকার ঘাটতি রেখে গেছেন উনি। কোনো এক কারণে এই সমস্ত কিছু একমাত্র উনিই দেখতেন, তাই গত আট বছরে ওঁর অ্যাকাউন্টের কোনো হিসাবনিকাশ করাও হয়নি। আন্দাজ করতে পারছি যে তাদের সকলের মুখই এখন কেমন গোমড়া হয়ে গেছে, আর ওঁকে কীসব গালাগালই না তারা দিচ্ছে। ভাবলেই কেমন মজা আসে, তাই না? গত একবছর ধরে আমি ভাবছি যে কীভাবে সত্তর বছরের এক অপকৃষ্ট বুড়ো, গেঁটেবাতে কাবু হয়েও, লাম্পট্যের জন্য শারীরিক ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিল! এখন বুঝতে পারছি—ওই বিধবা আর অনাথ শিশুদের কথা ভেবেই নিশ্চয়ই এতদিন ধরে উৎসাহ পেয়েছেন। অনেকদিন আগে থেকেই আমি এসব জানতাম, আর একমাত্র আমিই জানতে পেরেছিলাম; জুলি ব্যাপারটা গোচরে আনে, আর জানার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ইস্টারের সপ্তাহে ওঁকে হাল্কা করে চেপে ধরি: ‘পঁচিশ হাজার আমাকে দিন, না হলে আগামীকালই ওরা আপনার অ্যাকাউন্টের হিসাব দেখতে আসবে।’ আর কেবল ভাবুন, ওঁর কাছে তখন পড়েছিল মেরেকেটে তেরো হাজার, অতএব বোঝাই যায় যে ওঁর এখন মারা যাওয়াটা যথাযথ। দাদাজি, ও দাদাজি, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?”
“প্রিয় ক্লাইনেভিচ, আমি বেশ খানিকটাই একমত, এবং কোনো প্রয়োজন ছিলো না… এরকম গভীরে যাওয়ার। আমাদের জীবন কায়ক্লেশ এবং তীব্র যন্ত্রণায় ভরা আর এর প্রতিদান এতই অল্প… যে শেষপর্যন্ত আমি শান্তিতে থাকতে চেয়েছিলাম, আর, যা দেখতে পাচ্ছি, এখান থেকেও আমি যতটা পারব নিংড়ে নেব।”
“হলফ করে বলতে পারি এর মধ্যেই উনি কাটিচ বেরেস্তফ-এর গন্ধ শুঁকে নিয়েছেন।”
“কে? কী কাটিচ?” বুড়োটার গলায় লেভাতুর কাঁপুনি শোনা গেল।
“আ-হাহ্, কে কাটিচ? কেন, এই যে এখানে বাঁদিকে, সাড়ে বারো ফিট দূরে আমার থেকে আর আপনার থেকে পঁচিশ। গত পাঁচদিন ধরে এখানে রয়েছে, আর যদি আপনি জানতেন, দাদাজি, কী এক অভাগা সে! ভালো বনেদী পরিবারের, কিন্তু ভীষণই শয়তান, রাক্ষুসী একেবারে! ওখানে কারও সঙ্গে ওর পরিচয় করাইনি, একমাত্র আমিই ওকে চিনতাম… কাটিচ, সাড়া দাও!”
“হি-হি-হি!” মেয়েটা সাড়া দিল কর্কশ হাসির সঙ্গে, যার মধ্যে যেন এক সূঁচের ডগার মতো ধারালো এক সুর ছিল, “হি-হি-হি!”
“এক ক্ষুদে পিঙ্গলকেশী?” দাদাজি আমতা আমতা করে উঠল, ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল শব্দগুলো।
“হি-হি-হি!”
“আমি… অনেকদিন ধরে… অনেকদিন ধরে আমি,” বুড়োটা ঊর্দ্ধশ্বাসে আমতা-আমতা করে উঠল, “ঠিক এইরকম পরিবেশেই বছর পনেরোর এক ছোট্ট পরী-র স্বপ্ন, যত্নে আগলে রেখেছি।”
“ওয়্যাক্, দানব একেবারে!” চিৎকার করে উঠল অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা।
“যথেষ্ট হয়েছে!” ক্লাইনেভিচ মীমাংসিত করল। “আমি এখানে একটা চমৎকার আধিভৌতিক অবস্থা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের শীঘ্রই সবকিছু আরও ঠিকঠাক করতে হবে। শেষ সময়টুকু আনন্দের সঙ্গে কাটানোই হল গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু কোন সময়? এই যে, আপনি, সরকারি কেরানি, লেবজিয়াৎনিকভ না কী যেন আপনার নাম শুনলাম!”
“সেমিওন ইয়েভসেয়িচ লেবজিয়াৎনিকভ, নিম্ন আদালতের উপদেষ্টা, আপনার সেবায়, খুব, খুব, খুবই আনন্দিত আপনার সঙ্গে পরিচত হয়ে।”
“আপনি আনন্দিত কি না সে বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই, কিন্তু আপনি এখানের সবকিছু জানেন বলে মনে হয়। সবার আগে বলুন যে আমরা কথা বলতে পারছি কীভাবে? আমি গতকাল থেকে ভেবেই চলেছি। আমরা মৃত এবং তারপরেও আমরা কথা বলছি আর মনে হচ্ছে নড়াচড়াও করছি—অথচ এদিকে আসলে আমরা কথা বলছি না, নড়াচড়াও করছি না। এ কী ধরনের ভেলকিবাজি?”
“আপনি যদি ব্যাখ্যা চান, ব্যারন, প্লাটোন নিকোলায়েভিচ আমার থেকে ভালো উত্তর দিতে পারবে আপনাকে।”
“প্লাটোন নিকোলায়েভিচটা আবার কে? মূল প্রসঙ্গে কথা না বলে অবান্তর বকবেন না।”
“প্লাটোন নিকোলায়েভিচ হল আমাদের নিজস্ব দার্শনিক, বিজ্ঞানী এবং মাস্টার ইন আর্টস্। দর্শনসম্বন্ধীয় প্রচুর কাজ করেছেন, কিন্তু গত তিন মাস ধরে উনি কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন, এবং ওঁকে ক্রিয়াশীল করে তোলার কোনো উপায় নেই এখন। সপ্তাহে একদিন করে খালি কিছু খাপছাড়া কথা বিড়বিড় করে বলে যান।”
“প্রসঙ্গে আসুন, প্রসঙ্গে আসুন।”
“এই সমস্ত রহস্যের উত্তর তিনি দেন সহজতম সত্যের মাধ্যমে, যেমন, এই যে আমরা যখন উপরে বেঁচে ছিলাম তখন ভাবতাম যে ওখানে মৃত্যু মানে কেবল ওখানেই মৃত্যু। শরীর পরে পুনরায় জেগে ওঠে, উপরে যেমন ছিল, তেমনই এখানেও, জীবনের যা-কিছু অবশিষ্ট থাকে সেসব কেন্দ্রীভূত হয়, যদিও কেবল চেতনা হিসেবে। আমি জানি না ঠিক কীভাবে বোঝাব, কিন্তু জীবন চলতে থাকে, আগের মতোই, জড়তার কারণে। তাঁর মতে, সবকিছু এসে চেতনার মধ্যে কোথাও জমা হয় আর টিকে থাকে তিন-চার মাস পর্যন্ত… কখনও কখনও প্রায় ছয় মাস…। এই যেমন এখানে একজন আছেন, ওঁর দেহ প্রায় পচে গলে গেছে, কিন্তু প্রতি ছয় সপ্তাহ অন্তর তিনি একটাই কথা উচ্চারণ করেন, বেশ অর্থহীন কথা যদিও, কোনো এক ববক নিয়ে, ‘ববক, ববক’, কিন্তু দেখুন জীবনের সূক্ষ্ম কণা এখনও তাঁর অন্তরে প্রাণবন্ত হয়ে আছে।”
“এটা নিঃসন্দেহে কেমন একটা বোকা বোকা ব্যাপার। আচ্ছা, এটা বলুন, আমার তো ঘ্রাণশক্তি নেই, কিন্তু তবুও আমি কীভাবে বুঝতে পারছি যে এখানে দূর্গন্ধ রয়েছে?”
“ও ওইটা… হি-হি… ওই বিষয়ে আমাদের দার্শনিক মহাশয় একটু জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। গন্ধের প্রসঙ্গে, তিনি বলেন, যে এখানে যে দুর্গন্ধটা টের পাওয়া যায়, বলতে গেলে সেটা, চারিত্রিক, হেঁ-হেঁ। এটা নাকি আত্মার দুর্গন্ধ, তিনি বলেন, এই দুই-তিন মাস তাদের সুযোগ থাকে নিজেদের মুক্ত করার… আর এ হল, বলতে গেলে, শেষ অনুকম্পা…। একমাত্র, আমিই মনে করি, ব্যারন মশাই, যে এগুলো গুপ্তরহস্যপূর্ণ বিদ্রুপ যা বোঝা তাঁর ক্ষমতায় কুলোয় না…।”
“যথেষ্ট হয়েছে; বাকি এর সবটাই, আমি নিশ্চিত, অর্থহীন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে আমাদের আর দু-তিন মাস মতো জীবন রয়েছে, আর তারপরেই—ববক! আমি প্রস্তাব করছি এই দুই মাস যতটা সম্ভব মিলেমিশে কাটানোর, আর সবকিছু নতুনভাবে সাজানোর। মহোদয়গণ, আমি সমস্ত লজ্জা দূরে সরিয়ে রাখবার আহ্বান জানাচ্ছি।”
“আহা, এসো সমস্ত লজ্জা আমরা ত্যাগ করি, এসো সকলে!” অনেকগুলো কণ্ঠ সমবেত স্বরে বলতে শোনা গেল; আর অদ্ভুতভাবে, শোনা গেল একাধিক নতুন কণ্ঠস্বর, নিশ্চিতভাবেই যেগুলো ছিল সদ্য জেগে ওঠা মৃতদের। ইঞ্জিনিয়ারটা, অবশেষে পুরোপুরি জেগে উঠে, অদ্ভুত আনন্দে গর্জন করে সম্মতি প্রকাশ করল। খুশিতে খিলখিল করে উঠল কাটিচ নামের মেয়েটা।
“ওহ্, সমস্ত লজ্জা ত্যাগ করার যে কি সাধ আমার!” উচ্ছসিত হয়ে চিৎকার করে উঠল অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা।
“আমি বলি কী, অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা যদি সমস্ত লজ্জা দূরে সরিয়ে রাখতে চায়…”
“না, না, না, ক্লাইনেভিচ, উপরে আমি একইরকম লজ্জিত ছিলাম, কিন্তু এখানে আমি সেগুলো সব ঝেড়ে ফেলতেই চাই। ভয়ঙ্করভাবে ঝেড়ে ফেলতে চাই।”
“আমি জানতে পেরেছি, ক্লাইনেভিচ” উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল ইঞ্জিনিয়ার, “আপনি এখানের সামাজিক অবস্থা যৌক্তিক নীতির উপরে ভিত্তি করে নতুনভাবে সাজাতে চাইছেন।”
“ওতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ওসবের জন্য আমরা অপেক্ষা করব কাদেইয়ারভ-এর, যাকে গতকালই নিয়ে আসা হয়েছে। যখন সে জেগে উঠবে, এই বিষয়ে সমস্তকিছু সে বলবে তোমাদের। এক লোক বটে সে, বিশাল তার ব্যক্তিত্ব। আগামীকাল ওরা আরও একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানীকে নিয়ে আসবে। আমার ধারণা, একজন আধিকারিককেও আনবে নিশ্চিতভাবেই, আর তিন-চারদিন পরে একজন সাংবাদিককে, আর মনে হয়, সঙ্গে ওর সম্পাদককেও। কিন্তু তাদেরকে শয়তানে নিক, আমাদের এই একটা ছোট্ট দল এমনিও থাকবে, আর সবকিছু নিজে থেকেই ঠিক গোছানো হয়ে যাবে। যদিও ইতব্যসরে, আমি চাই না আমাদের মধ্যে কেউ মিথ্যে কথা বলুক। এতেই আমার আগ্রহ, সবকিছু মধ্যে এটারই একমাত্র গুরুত্ব আছে। উপরে মিথ্যে না বলে কেউ থাকতে পারে না, কারণ জীবন আর মিথ্যা হল সমার্থক, কিন্তু এখানে আমরা আনন্দ করব মিথ্যে না বলেই। গোল্লায় যাক সব, কবরের কিছু মান আছে যতই হোক! আমাদের প্রত্যেকের গল্প আমরা চিৎকার করে বলব, আর কোনো বিষয়ে লজ্জিত হব না আমরা। প্রথমে আমারটা বলছি। আমি বেশ ঠকবাজ ধরনের একজন, জানেন তো! উপরে আমার সবকিছু আবদ্ধ আর নিয়ন্ত্রণে থাকত পাশব কাণ্ডের দ্বারা। গোল্লায় যাক কাণ্ড এবং চলুন এই দুই মাস আমরা কাটাই লজ্জাহীন সত্যতার মধ্যে। চলুন সবকিছু উন্মুক্ত করি আর নগ্ন হই।”
“নগ্ন হই, চলো নগ্ন হই!” সমস্ত গলার স্বর একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল।
“আমি নগ্ন হতে চাই, হতে চাই!” অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা উগ্র হয়ে উঠল।
“আহা…আহা, এখানে বেশ মজা হতে চলেছে দেখছি; অবশেষে আমার আর য়েক-এর দরকার নেই।”
“না, আমি আপনাকে বলছি জনাব, জিন্দেগির এক টুকরা স্বাদ আমাকে পেতে দিন।”
“হে-হে-হে!” খিলখিল করে উঠল কাটিচ।
“ভালো বিষয় হল এই যে কেউ আমাদের বিষয়ে নাক গলাতে পারবে না, আর যদিও আমি দেখতে পাচ্ছি পেরভয়িদভ খচে আছেন, উনি ওঁর হাত দিয়ে আমায় ছুঁতে পারবেন না, দাদাজি, আপনি কি সহমত?”
“আমি সম্পূর্ণ সহমত, সম্পূর্ণভাবে, আর পরম সন্তুষ্টির সঙ্গে, কিন্তু এই শর্তে যে সবার আগে কাটিচ তার জীবনের গল্প খুলে বলবে।”
“আমি প্রতিবাদ করছি, আমার পুরো মন থেকে এইসব কাজকর্মের বিরোধিতা করছি।” জেনারেল পেরভয়িদভ দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন।
“মহামান্য!” ইতর লেবজিয়াৎনিকভ ব্যস্তবাগীশ উত্তেজনা নিয়ে তাঁকে বোঝালো, “মহামান্য, সহমত হলে আমাদেরই লাভ। এখানে, দেখতেই পাচ্ছেন, এই মেয়েটার… আর ওদের সবার ছোটোখাটো প্রণয়ঘটিত ব্যাপারস্যাপার।”
“মেয়েটা আছে, সেটা সত্যি, কিন্তু…”
“এতে আমাদেরই লাভ, মহামান্য, মাইরি বলছি। পরীক্ষামূলকভাবে হলেও, দেখা যাক…”
“কবরেও ওরা আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না।”
“প্রথমত, জেনারেল, আপনি কবরে শুয়ে প্রেফারেন্স খেলছিলেন, আর দ্বিতীয়ত আমাদের কোনো আগ্রহ নেই আপনাকে নিয়ে।” ধীর গতিতে পুরোটা বলে গেল ক্লাইনেভিচ।
“মহাশয়, দয়া করে নিজের পরিচয় ভুলে যাবে না।”
“কী? কেন, আপনি আমার কিছুই করতে পারবেন না। আমি এখানে শুয়ে থেকেই জুলির পোষা কুকুরটার মতোই আপনাকেও ক্ষেপিয়ে তুলতে পারি। আর আরও একটা বিষয়, মহোদয়গণ, উনি এখানেও কীভাবে একজন জেনারেল! ওখানে তিনি জেনারেল ছিলেন ঠিকই, কিন্তু এখানে নিছক আবর্জনা মাত্র।”
“না, মোটেই নিছক আবর্জনা না… এখানেও…”
“এখানে আপনি কবরে পচে মরবেন, আর আপনার বলতে পড়ে থাকবে শুধু ওই ছয়টা পেতল-এর বোতাম।”
“শাবাশ, ক্লাইনেভিচ, হা-হা-হা!” তারস্বরে চিৎকার করে উঠল সবাই।
“আমি আমার সার্বভৌমের সেবা করেছি… তরোয়াল আছে আমার…।”
“আপনার তরোয়াল কেবল নেংটি ইঁদুরের গায়ে খোঁচা মারার যোগ্য, আর আপনি এমনকী সেটার জন্যেও কোনোদিন ওটা বের করেননি।”
“তাতে কিছু যায় আসে না; আমি অংশসমূহ-এর একটা অংশ পূরণ করেছি।”
“অংশসমূহের মধ্যে অনেকরকম অংশ থাকে।”
“সাবাশ, ক্লাইনেভিচ, সাবাশ! হা-হা-হা!”
“আমি বুঝতেও পারছি না তরোয়ালটা আসলে কিসের প্রতীক!” স্বভাবত গর্জন করে বলল ইঞ্জিনিয়ার।
“প্রুশিয়ানদের সামনে থেকে নেংটি ইঁদুরের মতো পালাতে হবে, আমাদের পাউডারের মতো গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলবে ওরা।” অজানা একটা জায়গা থেকে ভেসে এল একটা চিৎকার মেশানো স্বর, স্পষ্টতই আনন্দ মেশানো।
“তরোয়ালটা, মহাশয়, একটা সম্মান।” চেঁচালো জেনারেল, কিন্তু কেবল আমিই তাঁর কথা শুনতে পেলাম। শুরু হয়ে গেল এক দীর্ঘ এবং ক্ষিপ্ত গর্জন, তুমুল কোলাহল, আর হুল্লোড়, আর কেবল শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল অভদোত্যা ইগ্নাতেভ্যেনা-র উন্মাদভাবে করে চলা অধৈর্য চিৎকার।
“কিন্তু তাড়াতাড়ি করা যাক! উফ্, কখন আর আমরা সমস্ত লজ্জা দূরে সরিয়ে রাখব!”
“হিঁক্-হিঁক্-হিঁক!… আত্মা সত্যিই কঠিন যন্ত্রণাটার মধ্যে দিয়ে যায় গো!” চেঁচিয়ে বলল সেই হীনজাত, “আর …”
আর এইসময়েই আমি হঠাৎ হেঁচে ফেললাম! হল বেমক্কা আর অনিচ্ছাকৃতভাবে, কিন্তু প্রভাব পড়ল লক্ষনীয় পর্যায়ের; যতটা একটা সমাধিক্ষেত্রে আশা করা যায়, ততটাই নিশ্চুপ হয়ে গেল সবকিছু, মিলিয়ে গেল স্বপ্নের মতো। কবরের শব্দহীনতা জাঁকিয়ে বসল আদতেই। মনে হয় না ওরা আমার উপস্থিতির কারণে লজ্জা পেয়েছে; ওদের সমস্ত লজ্জা ওরা দূরে সরিয়ে রাখবে বলে মনস্থির করেছিল। আমি আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করলাম—না কোনো শব্দ, না সাড়া। এমনটা হওয়া সম্ভব নয় যে ওরা এই ভেবে ভয় পেয়ে গেল যে আমি পুলিশকে জানিয়ে দেবো; পুলিশ ওদের কী-ই বা করতে পারবে? আমাকে তাহলে এই ভেবেই ইতি টানতে হবে যে ওদের কাছে এমন কিছু ছিলো যা জীবিতদের কাছে অজানা, যা ওরা সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে প্রত্যেক নশ্বর মানুষের কাছ থেকে।
“…প্রিয়জনেরা,” মনে মনে বললাম, “আমি আবারও ফিরে আসব আপনাদের কাছে।” আর এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে আমি কবরস্থান ত্যাগ করলাম।
না, এটা আমি মানতে পারব না; না, কিছুতেই পারব না! যে এই ববক ঘটনাটা আমাকে অস্বস্তি দেয় না (তাহলে ববক বলতে সেটাই বোঝাচ্ছে!)
এইরকম একটা জায়গায় নৈতিক বিকৃতি, শেষ ইচ্ছার নৈতিক বিকৃতি, সপসপে ভেজা আর পচা মৃতদেহের নৈতিক বিকৃতি—এবং ছাড় পাচ্ছে না চেতনার শেষ মুহূর্তগুলোও। সেই মুহূর্তগুলো তাদেরকে মঞ্জুর করা হয়েছে, প্রদান করা হয়েছে, আর… আর, সবথেকে খারাপ বিষয় হল, এইরকম একটা জায়গায়! না, সেটা আমি মানতে পারব না।
আমি অন্য কবরগুলোয় যাব, সর্বত্র শুনব। কোনো ধারণা পোষণ করার আগে নিশ্চিতভাবেই, শুধু একটা নয় বরং সব জায়গায় গিয়ে শোনা উচিত। হয়তো আশ্বস্ত জাগানো কিছু পাওয়া যাবে।
কিন্তু আমি ওদের কাছেও ফিরে যাব। ওরা ওদের জীবনী আর নানা ধরণের মজার গল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। থুতু ছেটালাম আমি শয়তানের উদ্দেশ্যে। তবুও আমি যাব, নিশ্চিতভাবেই যাব; এটা একটা বিচারবুদ্ধির প্রশ্ন!
এই কাহিনি আমি নিয়ে যাব “নাগরিক”-এর কাছে; এর সম্পাদকও তাঁর ছবির প্রদর্শনী করিয়েছেন দেখলাম। হয়তো তিনি এটা ছাপাতে পারেন।
লেখক পরিচিতি: বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিত ফিওদর দস্তয়েভস্কি (১৮২১-১৮৮১) এর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আইরিশ সাহিত্যিক জেমস জয়েস বলেছিলেন: “আমি জানি কেউ কেউ মনে করেন যে উনি উদ্ভট ছিলেন, এমনকী পাগলও, কিন্তু হিংস্রতা ও কামনার মতো যে বিষয়বস্তুগুলো তিনি তার কাজে ব্যবহার করেছেন, তা হল সাহিত্যের প্রকৃত প্রাণ।” অনুপ্রাণিত করেছেন কাফকা, হেমিংওয়ে-সহ আধুনিক সাহিত্যের অসংখ্য লেখকদের। তাঁর লেখায় উঠে আসে মানব সমাজ ও সত্ত্বার বিভিন্ন অস্থিরতা, দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা।
Tags: অনুবাদ গল্প, অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ফিওদর দস্তয়েভস্কি, সিমরনজিৎ চক্রবর্তী