ঝন্টুমামার ছিপি
লেখক: সিদ্ধার্থ ঘোষ
শিল্পী: মূল অলংকরণ
অপমানিত হয়েছেন ঝন্টুমামা।
তারপর থেকেই আমরা তাঁর আশ্রিত জীব হিসেবে বাস করছি। ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক যাঁর তোলা ফটো ছেপে কৃতার্থ হয়, এমন একটা মানুষ নিজের পাড়া ছেড়ে আমাদের ফ্ল্যাটে এসে উঠলে এ ছাড়া আর কি-ই বা বলা যায়।
ক-দিন ধরে ঝন্টুমামার হুকুমে পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের নানান রোমাঞ্চকর কাহিনি আউড়ে যাচ্ছি। কিন্তু তাঁর ভাষায় কোনওটাই এখনও ক্লিক করেনি। ঠিক কি জানতে চাইছেন জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই। তাহলেই শুনতে হবে, তাই যদি জানব তবে তোমাদের মতো বেতনভুক আধা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট করব কেন। সোজা চলে যাব স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরিতে বা…
কোনও দেমাক নেই ঝন্টুমামার। অকপটে স্বীকার করেন, পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে কোনও বিজ্ঞানের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ হয়নি কোনওদিন। তা বলে গোটাকয়েক ডিগ্রীর তকমা এঁটেছি বলে তিনি আমাদের গুণমুগ্ধ নন। বারবার মনে করিয়ে দেন, বিদ্যাকে কাজে লাগাবার বুদ্ধি নড়াচড়া করবে কোথায়? সে জায়গা আমাদের মাথায় নেই। ঝন্টুমামা তাই ওঁর মাথাটাকে কাজে লাগাবার সুযোগ দেবার জন্যেই মাঝে মাঝে আমাদের এখানে চলে আসেন।
—কার এত বড় দুঃসাহস যে আপনাকে পাড়া ছাড়া… রাগ এবং ক্ষোভ মিশিয়েই শুরু করেছিলাম, কিন্তু নিলয় বাধা দিয়ে বলে উঠল, না, মানে আমি তো ভাবতেই পারি না যে আপনাকে অপমান করা…
—অপমান তো করেনি।
ঝন্টুমামা নিবিকার কণ্ঠে বললেন। —তবে অপমান করার চেষ্টা করেছিল।
—কিন্তু অপমান করার চেষ্টাটাও তো কম অপমানকর নয়! কে—কে এত বড় আহাম্মক যার এত বুকের পাটা যে…
নিলয় রীতিমতো খেপে গেছে।
—আহাম্মকই বটে। তোমাদের সেই আদিদাস।
আদিদাস! এবার সত্যিই চমকে গিয়েছি। ঝন্টুমামা চম্পককুমারের নাম দিয়েছেন আদিদাস। কথাটা প্রথম কানে আসার পর থেকেই ভয়ে ভয়ে আছি। ভবানীপুরে এমন বাসিন্দা নেই যে চম্পককুমারে নাম শোনেনি! মঞ্চের ওপর ফ্লাডবাতির নিচে এসে দাঁড়ায় যখন মনে হয় এখনি বুঝি এক পুকুর তেলে ডুব দিয়ে উঠে এল। তারপর শুরু হয় হুশহুশ শব্দে দম নেওয়ার দমকে দমকে হাত পা নাড়া। সমস্ত দেহটা যেন কথা বলে। তবে কথাকলি না বলে কথা-গুলি আখ্যা দেওয়াই ভালো। কারণ আসলে চম্পককুমারের পেশি ওরফে গুলিরাই কথা বলে। এ-হেন চম্পককুমারকে ইংরেজিতে ‘adidas’ লেখা বাহারী টি-শার্ট পরতে দেখেই ঝন্টুমামার মাথায় ঢুকেছে, ব্যায়ামবীর মাত্রেই সত্যিকার আদিদাস। মানে, এরা সেই আদিম মানুষের মতো এখনও শুধু দৈহিক শক্তির দাসত্ব করেছে। ‘মাথার মধ্যে তো মগজ নেই, বুঝলে না, ওর মগজ এসে জমেছে মাসলের ডেলার মধ্যে।’—ঝন্টুমামার এই জাতীয় উক্তি আগেও শুনেছি। তবে কি চম্পককুমারের কানে…
—না না ঝন্টুমামা এই সব লোকের সম্বন্ধে কোনও মন্তব্য করা ঠিক নয়। যেচে হাঙ্গামা বাধানো। চম্পককুমার তো শুধু ভবানী পুরশ্রী নয়, একেবারে যাকে বলে মস্তান।
নিলয় ঘাবড়ে গেছে বোঝা গেল।
—খুব ভুল করছ। আদিদাসকে আমি কিছুই বলিনি। বরং গত বছর ওরাই আমায় খাতির করে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল মঙ্গলচক্র অভিযাত্রীর অ্যানুয়েল ফাংশনে। আসলে ভেবেছিল আমি যদি ছবি তুলি তাহলে খবরের কাগজে নিশ্চয় ছাপা হবে।
—তাহলে গেলেই তো পারতেন। ল্যাটা মিটে যেত। কি আর, একটা তো ছবি।
—গিয়েছিলাম, গিয়েছিলাম। ছবি তুলেছি খবরের কাগজে বেরিয়েওছে—উচ্চ প্রশংসাও লাভ করেছে বিদগ্ধ মহলে। তবে ওই আর কি, মাথাটা ছিল না। আর তারপর থেকেই আদিদাস ভাবছে কি করে আমার ওপর একচোট নেবে। দারুণ ছবি, ওদিকে মাথা নেই—আমাদেরই এবার মাথা বিগড়ে না যায়! এই রকম পরিস্থিতিতে মনে না পড়ে উপায় থাকে না যে ঝন্টু সেন ভারতের একমাত্র আলোগ্রাফার। ফটোগ্রাফার ঢের আছে কিন্তু আলোগ্রাফার এই একজন। বাংলার এই নতুন শব্দটি সৃষ্টি করার কৃতিত্বও তাঁর।
—এখনও বুঝতে পারছ না? আরে গত বছর মঙ্গলচক্র অভিযাত্রীর অ্যানুয়েল ফাংশানের প্রধান আকর্ষণ ছিল, লৌহমানব হাতে করে টেনে একটা জিপ গাড়ি থামাবে। রক্তমাংসের এমন সুন্দর শরীরটাকে লোহা বানাবার মতো বুদ্ধি বা বুদ্ধির অভাব কার হতে পারে বলার দরকার নেই নিশ্চয়। যাইহোক বলেছে অত করে, ক্যামেরা ঝুলিয়ে হাজির হলাম। দেখি রাস্তার মধ্যে তিনটে গোদা গোদা গজাল পুঁতে তার গায়ে ঠেসিয়ে রেখেছে একটা কাঠের তক্তা। সেই তক্তায় দু-পা চেপে আদিদাস জাঙ্গিয়া পরে খালি গায়ে রাস্তায় পিঠ রেখে শুয়েছে। হাতে একটা মোটা জাহাজ বাঁধা কাছি। কাছির অন্য দিকটা একটা জিপগাড়ির পিছন দিকের বাম্পারের সঙ্গে বাঁধা। রাস্তার দু-ধারে মেলাই লোক জমেছে। জিপ স্টার্ট দিতেই আমিও ক্যামেরা ফোকাস করে রেডি। ঘর ঘর শব্দে গর্জে উঠল ইঞ্জিন, লোকের জয়ধ্বনি—জিপটা একটু এগিয়েই আটকা পড়েছে আদিদাসের কাছির টানে। ইঞ্জিন যতই গর্জাক গাড়ি আর এগোয় না। শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। ততক্ষণে আমার ছবি তোলা হয়ে গেছে। বুঝলাম, সাধারণ মানুষের বিজ্ঞান চেতনার অভাবকে কাজে লাগিয়ে এখনও দিব্যি হাততালি কুড়নো যায়। কেউ লক্ষ করেনি যে জিপটা যতটুকু এগিয়েছিল, আদিদাসকেও ঠিক সেই পরিমাণে টেনে ধরেছে, ফলে শোয়া অবস্থা থেকে সে ধনুকের মতো ডোঙা হয়ে উঠেছে।
ঝন্টুমামাকে বাধা দিয়ে বললাম, আপনি বললেন না তারপরেও গাড়িটা এগোবার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি?
—এগোবার চেষ্টা মানে তো গরগর করা। তাই এগোতে না দেওয়াটা আদিদাসের কৃতিত্ব না জিপ-চালকের কৌশল… তবে সে যাইহোক, এসব কথা কিছুই লিখিনি। নিঃসংশয়ে প্রমাণ করতে পারব না এমন ঘটনা সত্য হলেও আমি বলতে চাই না। আমি শুধু ফটোটার তলায় একটা ক্যাপশন লিখে দিয়েছিলাম।
—আর সেই ফটোতে আদিদাসের মাথাটা কাটা পড়েছিল।
—তা তো পড়বেই। যে কাজে মাথার কোনও ভূমিকা নেই, সেখানে ছবির মধ্যে মাথাকে শুধু শুধু খানিকটা জায়গা ছেড়ে দেওয়া যায় না। ফটোটার মধ্যে আদিদাসের কব্জি অবধি অবশ্য ছিল। আর ছিল ধোঁয়া—প্রচুর ধোঁয়া—জিপগাড়ির মবিল-পোড়া ধোঁয়া। ও ভালো কথা, ছবিটা অবশ্য খবরের অংশ হিসেবে ছেপে বেরোয়নি। ইন্টারন্যাশনাল অটোমোবাইল হসপিটালের নাম শুনেছ? কলকাতার এক নামকরা গাড়ি সারাবার কারখানা। ওই কোম্পানিরই একটা বিজ্ঞাপনে ছবিটা ব্যবহার করা হয়েছে। ভালোই পয়সা দিয়েছে আমায়। কাটিংটা সঙ্গেই আছে। এই যে—
এক নজর দেখেই বুঝতে পারছি যে এরকম কাণ্ড ঘটলে মস্তিষ্কহীনদের পক্ষেও উত্তেজিত হওয়া সম্ভব। শুধু তো ছবি নয়, তার নিচে এই ক-টি লাইন, হৃদয় লোহার হলেও বিদীর্ণ করবে।
‘এ দৃশ্য আপনার অপরিচিত নয় নিশ্চয়! কিন্তু তা বলে এটিকে কি আপনি শুধু পরিবেশ দূষণের সমস্যা বলে মনে করছেন? না—এর থেকেই বোঝা যায় জিপের মতো গাড়িরও কম্প্রেশন ঢিলে হয়ে গেলে তার শক্তি কত কমে যায়। সময়মতো গাড়ির যত্ন নিন—ইন্টারন্যাশনালে আনুন।’
কাটিংটা ফেরৎ দিয়ে ঝন্টুমামার দিকে তাকিয়ে বসে আছি, কিন্তু ঝন্টুমামাকে দেখতে পাচ্ছি না। তাঁর প্রতিপক্ষ আদিদাসের চেহারাটাই চোখের সামনে ভাসছে। ঝন্টুমামার সরল স্বীকারোক্তি শুনে আমাদের রক্ত জমে গেছে। জিভের ডগাটা শুধু নিশপিশ করছে, কি দরকার এসব কাণ্ড বাধাবার যাতে ঘরছাড়া, পাড়া-ছাড়া হয়ে…
ঝন্টুমামার কথা এখনও শেষ হয়নি, মজা কি জানো, এ ঘটনা গত বছরের। ভাবতেও পারিনি আদিদাসের পক্ষে মনে মনে এতদিন রাগ পুষে রাখা সম্ভব। এবারে মঙ্গলচক্র অভিযাত্রীর রজত-জয়ন্তী হল। সেই উপলক্ষ্যে পাড়ার মানীগুণীদের সম্বর্ধনা দেবার জন্যে একটা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল। আমাকেও বলল, খুব বিনীত ভঙ্গিতেই—স্যার, আপনাকে কিন্তু আমরা সম্মানিত করতে চাই। আসতেই হবে—
—ইশ্—শেষ পর্যন্ত সবার সামনে আপনাকে, ছি ছি! না না, আপনার বোঝা উচিত ছিল।
হাহাকার করে উঠলাম। চরম পরিণতির কথাটা নিজের কানে শুনতে যেন আর ইচ্ছে নেই।
নিলয় বলল, সব তো ডেঁপো ছেলেদের কাণ্ড। গেলেন কেন? সম্মান দেওয়া মানে তো একটা লাঠি আর পাকানো ধুতি। সোজাসুজি এড়াতে না পারেন, বলে দিলেই হত পেটখারাপ হয়েছে কিংবা ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিকের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে চলে যেতেন না—হয় কঙ্গো কিংবা মোজাম্বিকে! যেচে অপমান…
—আবার ভুল করছ। অপমান নয়, অপমান করার চেষ্টা। বৃথা চেষ্টা অবশ্য। যাইহোক, ব্যাপারটা আগে শোনো। বক্তৃতাপর্ব শেষ হলে আমাকেই সবার আগে ডাকা হল পুরস্কার গ্রহণের জন্যে। উইংস পেরিয়ে মঞ্চে পা রেখেই মতলবটা বুঝতে পারলাম। আমার উচ্চতার অভাবকে ব্যঙ্গ করার ব্যবস্থা। উপহার হাতে সভাপতি এমন একটা টুলে উঠে দাঁড়িয়েছে যে হাত বাড়িয়ে দূরের কথা, লাফিয়েও তার নাগাল পাব না।
—কি কেলেঙ্কারি!
—শুধু তাই নয়, সভাপতি যেটার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল সেটা আকারে এতই ক্ষুদ্র, তার ওপরে উঠে উপহার নেব যে তারও উপায় রাখেনি। ওদিকে আদিদাস ততক্ষণে একটা পিঁড়ে হাতে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিবোধের হাসি—বাধা দিয়ে তো আটকানো যায় না, দাঁড়িয়ে রইলাম। হাসির দমক কমলে জমায়েতকে নমস্কার জানিয়ে একটা কথাই শুধু মনে করিয়ে দিলাম, বাঁশঝাড়ে ফুল ফুটলে একমাত্র বোকারাই কিন্তু আনন্দিত হয়!
ঝন্টুমামা থামলেন। তারপর সেই বিচিত্র অবর্ণনীয় হাসি যার প্রথম অর্থ হল, এবার বুঝে নাও। কিন্তু বুঝতে যে পারব না সেটাও ওই হাসিটাই বাতলে দিচ্ছে। এই রকম অবস্থায় চুপ করে দু-তিন মিনিট বসে থাকলে বোঝা যায় মহাশূন্যে ভারশূন্য অবস্থায় নভোচারীদের কি দশা হয়।
—এবার বুঝলে তো কেন বলেছি অপমান করতে পারেনি। এর চেয়ে বড় শাসানি আর কি হতে পারে বলো? কখন বাঁশঝাড়ে ফুল ফোটে জানো? কখনও সখনও, কালেভদ্রে! আর ওই ফুলই তার মৃত্যু-পরোয়ানা। ফুল ফোটার পর বাঁশঝাড় আর বেশিদিন বাঁচে না।
ঝন্টুমামার বাঁশ-তত্ত্ব ক-জন উপলব্ধি করে শঙ্কিত হয়ে দিনযাপন করছে জানতে চাইনি। এখন তার চেয়ে বড় সমস্যা, বাঁশঝাড়ে ফুল ফুটিয়েই চলে এসেছেন তিনি কিন্তু ফুল ফোটার পরিণামটা…
—আচ্ছা, ভালো কাচের বোতল কোথায় পাওয়া যায় বলতে পারো?
বাঁশঝাড় থেকে বোতলে সরে আসাটা যতই আকস্মিক হক, সেইসঙ্গে এটাও বুঝতে বাকী নেই যে ঝন্টুমামার মাথায় নিউরনগুলো এখন ভয়ংকরভাবে সজীব।
—বোতল মানে কাচের ছিপি দেওয়া বোতল। ওই তোমাদের কেমিস্ট্রির উচতাপ ও চাপ সহ্য করতে প্রস্তুত ওই মুখবন্ধ ফ্লাক্স আর কি। খুব হাইকোয়ালিটির জিনিস চাই, বুঝলে। তোমাদের কাছেই তো থাকা উচিত।
ঝন্টুমামার মতে বাড়িতে পরীক্ষাগার না স্থাপন করে কেউ বিজ্ঞানশিক্ষা দান করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। সবিনয়ে নিজেদের অযোগ্যতার কথা স্বীকার করেই বললাম, আমাদের কলেজে ল্যাবরেটরির যাবতীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে কন্টিনেন্টাল ইকুইপমেন্টস কোম্পানি। ওদের কাছে সিগকলের তৈরি সেরা জিনিস পাবেন। আমাদের নাম করলে ওখানকার মিস্টার লাহা নিশ্চয় কিছুটা কমিশনও দেবেন।
অবশেষে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ঝন্টুমামার প্রেস্টিজ রক্ষার জন্য আধ ডজন ফ্লাক্সের আনুমানিক দাম ধরে দেবার পর আমাদের নিরাশ্রয় করে বিদায় নিলেন স্বনামধন্য আলোগ্রাফার। অনেক আর্জি পেশ করেও তাঁর বোতল-তলবের উদ্দেশ্য জানা যায়নি। তবে সান্ত্বনা বলতে এইটুকুই যে ঝন্টুমামা স্বীকার করেছেন, কাল রাত্তিরে তন্দুরী রুটি যোগে মটন-চাপ সেবন করার পর ইজিচেয়ারে লম্বা হয়ে আমাদের মুখে বিজ্ঞানের একটি কাহিনি শুনতে শুনতে একটা আইডিয়া ক্লিক করেছে। তিন দিনে কয়েক হাজার গল্প শুনিয়েছি কিন্তু তাহলেও বোতল কেনার কথা শুনে আমরা যদি কিছু ধরতে না পারি, ঝন্টুমামার মতে সেটা একটা শোচনীয় ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু নয়।
ঝন্টুমামার বাড়ি থেকে এই তলবটা আসার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। বোতল-রহস্যের শেষ অঙ্কে যবনিকাপাত কিংবা বাঁশঝাড়ে ফুল ফোটার পরিণাম জানার জন্যে মানুষ অধৈর্য না হয়ে পারে!
ঝন্টুমামাদের গলিতে পা দিয়ে দেখি সারাটা পাড়া যেন ভেঙে পড়েছে। ‘মাথায় নিশ্চয় ছিট আছে’—ইত্যাদি নানান মন্তব্য কানে আসছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ঝন্টুমামার আবেদনেই এসেছে সকলে। পরশুদিন সন্ধ্যেবেলা মঙ্গলচক্র অভিযাত্রীর ক্লাবঘরে গিয়ে তিনি নাকি চম্পককুমারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। দারুণ বিপদে পড়েছেন। পারলে চম্পককুমারই এখন যদি পারে… চম্পককুমার প্রথমে কানই দিতে চায়নি কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাড়ার দাদাদের মধ্যস্থতায় রাজী হতে হয়েছে। যতই হোক ঝন্টু সেন বয়োজ্যেষ্ঠ। আন্তর্জাতিক খ্যাতি তাঁর। এই সুযোগে পুরানো বিবাদের জের মিটিয়ে নেওয়াই তো ভালো। অতঃপর সমস্যার কথাটা বুঝিয়ে বলেছিলেন ঝন্টুমামা। খোদ মার্কিন মুলুক থেকে অর্ডার দিয়ে কিছু কাচের ফ্লাক্স আনিয়েছিলেন তিনি আলোগ্রাফির পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে। টাকা বা ডলার গুণে এসব জিনিসের দাম যাচাই করা সম্ভব নয়। কিন্তু অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটেছে। ফ্লাস্কের ছিপিগুলো এমন আটকে যাচ্ছে…
বোতলের ছিপি খোলার জন্যে চম্পককুমার! ঝন্টুমামার দৈহিক শক্তির প্রতি এর পরে বেশ কিছু কটাক্ষ বর্ষণ হয়। কিন্তু সেসব অগ্রাহ্য করে চম্পককুমারকে রাজী করিয়েছেন তিনি।
তবে শুধু ছিপি আটকে যাওয়ার ব্যাপার হলে সারা পাড়া এভাবে ভেঙে পড়ত না। ঝন্টুমামা বোতল রহস্যকে প্রায় ভুতুড়ে গল্পের মতো জমিয়েছেন। নতুন অবস্থায় বোতলের ছিপিগুলো এতটুকু বেগড়বাঁই করে না। ছিপি লাগাতে বা খুলতে এতটুকু বাড়তি জোর লাগে না। কিন্তু তিনবার—গুণে গুণে ঠিক তিনবার ছিপি খোলার পর চতুর্থবার সে-টা এমন এঁটে বসে, এক্কেবারে নট নড়ন চড়ন। ছ-টা বোতলের মধ্যে পাঁচটার ছিপি ইতিমধ্যেই আটকে গেছে, একটা শুধু এখনও নতুন আছে। তার মানে সে-টার ছিপিটা তিনবার খোলা যাবে কিন্তু চারবারের বার…
নিলয় আমার কানে কানে বলল, একেবারে মোক্ষম অস্ত্র। লোক জমবে না মানে!
আশপাশের গুঞ্জন বুঝিয়ে দিল চম্পককুমার আসছে। আজকে সে ভিআইপি, তাই রীতিমাফিক পনের মিনিট লেট। বাতাসে যেন সাঁতার কাটতে কাটতে এল। হাত নাড়লেই মনে হয় গেল বুঝি জামার হাতাটা ফেটে, প্রত্যেকবার দম নেয় তার জামার বোতাম আঁটা সুতোগুলো চড়চড় করে।
—কই সে বিদকুটে বোতল, দেখি একবার।
দন্ত্য-স এর ওপর বেশ খানিকটা মাস্তানী ফলিয়ে বলল চম্পককুমার।
দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ঝন্টুমামা একটা বোতল বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই নাও। এটা এঁটে গেছে।
—হেঁঃ দু’ আঙুলে পিষে…
—না না, ভেঙে ফেললে তো সর্বনাশ। শুধু ছিপিটা খুলে দাও। বোতলটা নিয়ে ছিপিতে বার তিনেক টান দিল ব্যায়ামবীর। হল না। আশপাশের লোকের মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়েই তার বীরত্ব অপমানিত হল। কটমট করে ঝন্টুমামার দিকে তাকিয়ে বলল, স-ব বুঝি! আমায় টাইট দেবার চেষ্টা! মিথ্যে কথা—এ ছিপি জন্মে কোনওদিন খোলা যায়নি। হতেই পারে না। হ্যাঁ—এই আমি বলে দিচ্ছি। আসলে এটা হয়তো ছিপিই নয়, বোতলটার সঙ্গে জোড়া…
হাঁ হাঁ করে বাধা দিলেন ঝন্টুমামা।—কি বলছ তুমি! বিশ্বাস না হয় এই দ্যাখো—
সবাইকে থ’ বানিয়ে ঝন্টুমামা একই রকম চেহারার আরেকটা বোতলের মুখ থেকে ছিপি খুলে ধরলেন। কোনওরকম জোরাজুরির বালাই নেই। সবাই ঘিরে ধরেছে তাঁকে। ছিপিটা লাগিয়ে বোতলটা এবার বাড়িয়ে ধরলেন ঝন্টুমামা। অনেকগুলো হাত ছোঁ মারার চেষ্টা করেছিল, সভয়ে পিছিয়ে এলেন ঝন্টুমামা, করছেন কি! একজন—একজন—
দ্বিতীয়বারও ছিপিটা সত্যিকার ছিপির মতো লক্ষ্মী ছেলে হয়ে টানতেই খুলে এল।
—আহা, এমন ছিপি খুলেই আনন্দ। ঠিক যেন ঢলঢলে মোজা, তাই না?
ঝন্টুমামা নিজেই বর্ণনা দিলেন। তৃতীয়বার ছিপি খোলার তথাকথিত শেষ সুযোগ নিতে সবাই এত আগ্রহী যে ঝন্টুমামা আর রিস্ক নিলেন না। নিজেই ছিপি খুলে বললেন, ব্যস হয়ে গেল। কিন্তু এই শেষ।
ছিপিটা লাগিয়ে করুণ মুখে তাকালেন ঝন্টুমামা, এই জমিয়ে বসল আর উনি নড়বেন না। শেষ বোতলটাও গেল। আমি জানি আর খোলা যাবে না—
—কিসসু জানেন না!! চম্পককুমার ছিনিয়ে নিল বোতলটা। এবার আর আঙুলের ওপর ভরসা নয়। ছিপিটা দাঁতে কামড়ে দু-হাতে বোতলের গলা টিপে ধরে—মার টান—
—বা বা, চমৎকার। এই না হলে বুদ্ধি। হ্যাঁ ছিপিটাকে যত পারো কামড়ে ধরো। কোনও ভয় নেই। ওটা একেবারে নিরেট গ্রাউণ্ড গ্লাস। মানে ঘষা কাচ।
শক্তি প্রয়োগের নতুন কৌশলকে উৎসাহিত করলেন ঝন্টুমামা।
চম্পককুমারের চোখগুলো নিখুঁত বৃত্ত হবার চেষ্টা করছে, কপালে ঘাম—তবু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ছিপিটার এতবড় বেয়াদপি।
কারুর মুখে রা নেই। শেষ পর্যন্ত ফিরিয়েই দিতে হয়েছে বোতলটা। ঝন্টুমামা বিমর্ষ মুখে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, জানতাম হবে না। বিভীষণে পারবে না, তবু সবাই বলে তোমার মতো শক্তি নাকি কারুর নেই, তাই একবার শেষ চেষ্টা করলাম। যাকগে—তা আদিদাস এবার বুঝতে পারছ তো গায়ের জোরটাই শেষ কথা নয়?
ছিপির কাছে বেমক্কা পরাজয়ে চম্পককুমার এমন মিইয়ে গেছে যে ‘আদিদাস’ সম্বোধন শুনেও সে রুখে দাঁড়ায়নি।
শেষ খবর। আদিদাস এখন ঝন্টুমামার স্টুডিয়োয় কাজ শিখছে। বিনা পয়সার অ্যাপ্রেনটিসগিরি করছে। ঝন্টুমামা অবশ্য তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ডেভলপিং ও প্রিন্টিং এর কাজটা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারলে রহস্যময় বোতলের ভৌতিক ছিপির কি ও কেন বাতলে দেবেন।
গোল্লায় যাক আদিদাস। সে তার কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু আমাদের কেন ঝুলিয়ে রাখবেন ঝন্টুমামা? নিজেদের অজান্তে হলেও আইডিয়াটা তো আমরাই সরবরাহ করেছি!
—একটা ছবি মনে করার চেষ্টা করো। হ্যাঁ—ছবি। ষোলটা ঘোড়া হিমসিম খাচ্ছে। এদিকে আটটা। কিন্তু পারছে না। টেনে ফাঁক করতে পারছে না। কি, মনে পড়ছে না?
ঘোড়া, টেনে ফাঁক করা—কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কোথায় বোতল আর কোথায় ষোলটা ঘোড়া!
—দেখেছ, দেখেছ, এ ছবি দেখেছ। মাগ্ডেবুগের খোলা মাঠে মহামান্য সম্রাটের উপস্থিতিতে…
বুঝেছি, এবার বুঝেছি। ঝন্টুমামা অটো ভন গেরিকের পরীক্ষার কথা বলেছেন। তা অমন টিপেটিপে কথা বললে বোঝা যায় কখনও! ক্লাস এইটের ছেলেও জানে গেরিকের পরীক্ষার কথা। সমান মাপের দুটো টুকরো জুড়ে তৈরি করা একটা ধাতব গোলকের ভেতর থেকে হাওয়া টেনে বার করে নেওয়া হয়েছিল। তখন বলটার ভেতরে আংশিক বায়শূন্যতার জন্যে বায়ুমণ্ডলের চাপে টুকরো দুটো মুখে মুখে এমন এঁটে বসেছিল যে দু-ধারে আটটা করে ঘোড়া জুড়েও তাদের টেনে ফাঁক করা যায়নি। পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে এই প্রথম পরীক্ষা যা বায়ুমণ্ডলের চাপের কিংবা শূন্যতার শক্তির দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
—একই তো ব্যাপার!—ঝন্টুমামা জানালেন।
—একই ব্যাপার মানে? হ্যাঁ এটা মানছি যে বোতলের ভেতর থেকে কিছুটা বাতাস টেনে বার করে দিতে পারলে বায়ুমণ্ডলের চাপে ছিপিটা এঁটে বসবে। কিন্তু সবার চোখের সামনে বোতলটাকে বায়ুশূন্য করা হল কখন? কীভাবে? তিনবার তো দিব্যি খুলে গেল ছিপিটা, চারবারের বার হঠাৎ, আপনা থেকে…
—বিজ্ঞানে হঠাৎ, আপনা থেকে কিছুই ঘটে না। মনে আছে নিশ্চয় তৃতীয়বার ছিপিটা আমিই খুলেছিলাম। বন্ধ করার সময় শুধু হাতের কায়দায় ছোট্ট এক টুকরো লিথিয়াম ফেলে দিয়েছিলাম ভেতরে।
লিথিয়াম! এবার আর মনে না পড়ে উপায় নেই। সেদিন রাত্তিরে ঝন্টুমামার কাছে আমরা লিথিয়ামের অদ্ভুত রাসায়নিক সক্রিয়তার গল্প করেছিলাম। এই সক্রিয়তার জন্যেই বিশুদ্ধ লিথিয়ামকে রক্ষা করাই এক সমস্যা। ভেসলিন বা প্যারাফিন মাখিয়ে না রাখলে দেখতে না দেখতে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন—সব শুষে নেবে আশপাশের বাতাস থেকে।
হ্যাঁ, একটুকরো লিথিয়ামই বোতলের ভেতরটাকে আংশিকভাবে বায়ুশূন্য করেছিল। তবে ফেলার আগে আঙুলের ফাঁকে ঘষে ভেসলিনের আবরণটা সরিয়ে দিতে হয়েছিল। ও কিছু নয়—একটু অভ্যাস করলেই যে কেউ পারবে।
কিন্তু অন্যায়কে, অত্যাচারকে এমন বৈজ্ঞানিক শাস্তি দিয়েও ঝন্টুমামার মনে যেন শান্তি নেই মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা কি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝন্টুমামা বললেন, ঠিকই ধরেছ। আসলে আমি কিন্তু বিজ্ঞানকে এরকম ম্যাজিকের মতো, অলৌকিক ক্ষমতা হিসেবে ব্যবহার করতে ভালোবাসি না। কিন্তু কি করব বলো, বাঁশঝাড়ে ফুল ফুটলে—
ছিপি তো আটকে যাবেই।—আমরাই কথাটা শেষ করলাম।
ফ্যানট্যাস্টিক বার্ষিকী, ১৯৮৩
Tags: অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, মজার কল্পবিজ্ঞান, সিদ্ধার্থ ঘোষ