গামানুষ জাতির কথা
লেখক: রাজশেখর বসু (পরশুরাম)
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
যে সময়ের কথা বলছি তার প্রায় ত্রিশ বৎসর আগে পৃথিবী থেকে মানবজাতি লুপ্ত হয়ে গেছে। তর্ক উঠতে পারে, আমরা সকলেই যখন পঞ্চত্ব পেয়েছি তখন এই গল্প লিখছে কে, পড়ছেই বা কে। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। লেখক আর পাঠকরা দেশ—কালের অতীত, তাঁরা ত্রিলোকদর্শী ত্রিকালজ্ঞ। এখন যা হয়েছিল শুনুন।
বড়ো বড়ো রাষ্ট্রের যাঁরা প্রভু তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য অনেক দিন থেকেই চলছিল। ক্রমশ তা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা দাঁড়াল যে মিটমাটের আর আশা রইল না। সকলেই নিজের নিজের ভাষায় দ্বিজেন্দ্রলালের এই গানটি ন্যাশনাল অ্যানথেম রূপে গাইতে লাগলেন—‘আমরা ইরান দেশের কাজী, যে বেটা বলিবে তা না না না সে বেটা বড়োই পাজী।’ অবশেষে যখন কর্তারা স্বপক্ষের জ্ঞানী-গুণীদের সঙ্গে মন্ত্রণা করে নিঃসন্দেহ হলেন যে বজ্জাত বিপক্ষ গোষ্ঠীকে একেবারে নির্মূল করতে না পারলে বেঁচে সুখ নাই তখন তাঁরা পরস্পরের প্রতি অ্যানাইহিলিয়ম বোমা ছাড়লেন। বিজ্ঞানের এই নবতম অবদানের তুলনায় সেকেলে ইউরেনিয়ম বোমা তুলো-ভরা বালিশ মাত্র।
প্রত্যেক রাষ্ট্রের বোমা-বিশারদগণ আশা করেছিলেন যে অপরাপর পক্ষের জোগাড় শেষ হবার আগেই তাঁরা কাজ সাবাড় করবেন। কিন্তু দুর্দৈবক্রমে সকলেরই আয়োজন শেষ হয়েছিল এবং তাঁরা গুপ্তচরের মারফত পরস্পরের মতলব টের পেয়ে একই দিনে একই শুভলগ্নে ব্রহ্মাস্ত্র মোচন করলেন।
সভ্য অর্ধসভ্য অসভ্য কোনো দেশ নিস্তার পেলে না। সমগ্র মানবজাতি, তার সমস্ত কীর্তি, পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ, গাছপালা, মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হল। কিন্তু প্রাণ বড়ো কঠিন পদার্থ, তার জের মেটে না। সাগরগর্ভে পবর্তকন্দরে জনহীন দ্বীপে এবং অন্যান্য কয়েকটি দুষ্প্রবেশ্য-স্থানে কিছু উদ্ভিদ আর ইতর প্রাণী বেঁচে রইল। তাদের বিস্তারিত বিবরণে আমাদের দরকার নেই, যাদের নিয়ে এই ইতিহাস তাদের কথাই বলছি।
লন্ডন প্যারিস নিউ ইয়র্ক পিকিং কলকাতা প্রভৃতি বড়ো বড়ো শহরে রাস্তার নীচে যে গভীর ড্রেন ছিল তাতে লক্ষ লক্ষ ইঁদুর বাস করত। তাদের বেশির ভাগই বোমার তেজে বিলীন হল, কিন্তু কতকগুলি তরুণ আর তরুণী ইঁদুর দৈবক্রমে বেঁচে গেল। শুধু বাঁচা নয়, বোমা থেকে নির্গত গামারশ্মির প্রভাবে তাদের জাতিগত লক্ষণের আশ্চর্য পরিবর্তন হল, জীববিজ্ঞানীরা যাকে বলেন মিউটেশন। কয়েক পুরুষের মধ্যেই তাদের লোম আর ল্যাজ খসে গেল, সামনের দুই পা হাতের মতন হল, পিছনের পা এত মজবুত হল যে তারা খাড়া হয়ে দাঁড়াতে আর চলতে শিখল, মস্তিষ্ক মস্ত হল, কণ্ঠে তীক্ষ্ন কিচ্কিচ্ ধ্বনির পরিবর্তে সুস্পষ্ট ভাষা ফুটে উঠল, এক কথায় তারা মানুষের সমস্ত লক্ষণ পেল। কর্ণ যেমন সূর্যের বরে সহজাত কুণ্ডল আর কবচ নিয়ে জন্মেছিলেন, এরা তেমনি গামারশ্মির প্রভাবে সহজাত প্রখর বুদ্ধি এবং ত্বরিত উন্নতির সম্ভাবনা নিয়ে ধরাতলে আবির্ভূত হল। এক বিষয়ে ইঁদুর জাতি আগে থেকেই মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল—তাদের বংশবৃদ্ধি অতি দ্রুত। এখন এই শক্তি আরও বেড়ে গেল।
এই নবাগত অলাঙ্গুলে দ্বিপাদচারী প্রতিভাবান প্রাণীদের ইঁদুর বলে অপমান করতে চাই না, তা ছাড়া বার বার চন্দ্রবিন্দু দিলে ছাপাখানার উপর জুলুম হবে। এদের মানুষ বলেই গণ্য করা উচিত মনে করি। আমাদের মতন প্রাচীন মানুষের সঙ্গে প্রভেদ বোঝাবার জন্য এই গামারশ্মির বরপুত্রগণকে ‘গামানুষ’ বলব।
এখন কিঞ্চিৎ জটিল তত্ত্বের অবতারণা করতে হচ্ছে। যাঁরা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা মোটামুটি পঁচিশ বৎসর মানুষের এক পুরুষ এই হিসাবে বংশ-পর্যায় গণনা করেন। অতএব ১৮০০০ বৎসরে ৭২০ পুরুষ। আমাদের ঊর্ধ্বতন ৭২০ নম্বর পুরুষ কেমন ছিলেন? নৃবিদ্যাবিশারদগণ বলেন, এঁরা পুরোপলীয় অর্থাৎ প্রাচীন উপল যুগের লোক, চাষ করতে শেখেননি, কাপড় পরতেন না, রাঁধতেন না, কাঁচা মাংস খেতেন, গুহায় বাস করতেন। ভেবে দেখুন, মোটে ৭২০ পুরুষে আমাদের কি আশ্চর্য উন্নতি হয়েছে। আমাদের যেমন পঁচিশ বৎসরে, ইন্দুরোদভব গামানুষদের তেমনি পনেরো দিনে এক পুরুষ, কারণ তারা জন্মাবার পনেরো দিন পরেই বংশরক্ষা করতে পারে। মানবজাতি ধ্বংস হবার পর যে ত্রিশ বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে সেই সময়ে গামানুষ জাতির ৭২০ পুরুষ জন্মেছে। অর্থাৎ গামানুষের ত্রিশ বৎসর আমাদের ১৮০০০ বৎসরের সমান। যদি সন্দেহ থাকে তবে অঙ্ক কষে মিলিয়ে দেখতে পারেন।
এই সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসরে গামানুষ অতি দ্রুত গতিতে সভ্যতার শীর্ষদেশে উপস্থিত হয়েছে। পূর্বমানব যে বিদ্যা কলা আর ঐশ্বর্যের অহংকার করত গামানুষ তার সমস্তই পেয়েছে। অবশ্য তাদের সকল শাখাই সমান সভ্য আর পরাক্রান্ত হয়নি, তাদের মধ্যেও জাতিভেদ, সাদা-কালোর ভেদ, রাজনীতির ভেদ, ছোটো-বড়ো রাষ্ট্র, সাম্রাজ্য, পরাধীন প্রজা, দ্বেষ-হিংসা এবং বাণিজ্যিক প্রতিযোগ আছে, যুদ্ধবিগ্রহও বিস্তর ঘটেছে। বার বার মারাত্মক সংঘর্ষের পর বিভিন্ন দেশের দূরদর্শী গামানুষদের মাথায় এই সুবুদ্ধি এল—ঝগড়ার দরকার কি, আমরা সকলে একমত হয়ে কি শান্তিতে থাকতে পারি না? আমাদের বর্তমান সভ্যতার তুলনা নেই, আমরা বিশ্বের বহু রহস্য ভেদ করেছি, প্রচণ্ড প্রাকৃতিক শক্তিকে আয়ত্ত করে কাজে লাগিয়েছি, শারীরিক ও সামাজিক বহু ব্যাধির উচ্ছেদ করেছি, দর্শন ও নীতিশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান লাভ করেছি। আমাদের রাষ্ট্রনেতা ও মহা মহা জ্ঞানীরা যদি একযোগে চেষ্টা করেন তবে বিভিন্ন জাতির স্বার্থবুদ্ধির সমন্বয় অবশ্যই হবে।
জনহিতৈষী পণ্ডিতগণের নির্বন্ধে রাষ্ট্রপতিগণ এক মহতী বিশ্বসভা আহ্বান করলেন। বিভিন্ন দেশ থেকে বড় বড় রাজনীতিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক প্রভৃতি মহা উৎসাহে সেই সভায় উপস্থিত হলেন, অনেক রবাহূত ব্যক্তিও তামাশা দেখতে এলেন। যাঁরা বক্তৃতা দিলেন, তাঁদের আসল নাম যদি গামানুষ ভাষায় ব্যক্ত করি তবে পাঠকদের অসুবিধা হতে পারে সেজন্য কৃত্রিম নাম দিচ্ছি যা শুনতে ভালো এবং অনায়াসে উচ্চারণ করা যায়।
আমাদের দেশে হরেক রকম সভায় কার্যারম্ভের আগে সংগীতের এবং কার্যাবলীর মধ্যে মধ্যে কুমারী অমুক অমুকের নৃত্যের দস্তুর আছে। পরাক্রান্ত গামানুষ জাতির রসবোধ কম, তারা বলে, আগে ষোলো আনা কাজ তারপর ফুর্তি। তাদের জীবনকালও কম সেজন্য বক্তৃতাদি অতি সংক্ষেপে চটপট শেষ করে। প্রথমেই সভাপতি মনস্বী চং লিং সকলকে বুঝিয়ে দিলেন যে এই সভায় যে কোনো উপায়ে বিশ্বশান্তির ব্যবস্থা করতেই হবে, নতুবা গামানুষ জাতির নিস্তার নেই।
সভাপতির অভিভাষণের পর একটি অনতিসমৃদ্ধ রাষ্ট্রের প্রতিনিধি কাউন্ট নটেনফ বললেন, জগতের সম্পদ মোটেই ন্যায়সম্মত পদ্ধতিতে ভাগ করা হয়নি সেই কারণেই বিশ্বশান্তি হচ্ছে না। দু-চারটি রাষ্ট্র অসৎ উপায়ে বড়ো বড়ো সাম্রাজ্য লাভ করে দেদার কাঁচা মাল আর আজ্ঞাবহ নিস্তেজ প্রজা হস্তগত করেছে, উপনিবেশও বিস্তর পেয়েছে। কিন্তু আমরা বঞ্চিত হয়েছি, আমাদের বাড়তে দেওয়া হচ্ছে না। যদি যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করতে হয় তবে বিশ্বসম্পত্তির আধাআধি বখরা আমাদের দিতে হবে।
বৃহত্তম সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি লর্ড গ্র্যাবার্থ বললেন, জগতের শান্তিরক্ষার জন্যই আমাদের জিম্মায় বিশাল সাম্রাজ্য থাকা প্রয়োজন, সাম্রাজ্য চালনার অভিজ্ঞতা আমাদের যত আছে তেমন আর কারও নেই। আমরা শক্তিমান হলে তোমরা সকলেই নিরাপদে থাকবে। কাঁচা মাল চাও তো উপযুক্ত শর্তে কিছু দিতে পারি। আমাদের হেফাজতে যেসব অসভ্য অর্ধসভ্য দেশ আছে তার উপর লোভ করো না, আমরা তো সেসব দেশবাসীর অছি মাত্র, তারা লায়েক হলেই ছেড়ে দিয়ে ভারমুক্ত হব। আমরা কারও অনিষ্ট করি না, বিপদ যদি ঘটে আমার বন্ধু কীপফ-এর প্রকাণ্ড দেশই তার জন্য দায়ী হবে। এঁর দেশে স্বাধীন শিল্প আর কারবার নেই, সবই রাষ্ট্রের অঙ্গ। যাঁরা সমাজে মস্তকস্বরূপ সেই অভিজাত আর ধনিক শ্রেণীই ওখানে নেই। এদের কুদৃষ্টান্তে আমাদের শ্রমজীবীরা বিগড়ে যাচ্ছে। দিনকতক পরেই দেখতে পাবেন এঁদের কদর্য নীতি আর সস্তা মালে জগৎ ছেয়ে যাবে, আমাদের সকলের সমাজ ধর্ম আর ব্যাবসার সর্বনাশ হবে। যদি শান্তি চান তো আগে এঁদের শায়েস্তা করুন।
জেনারেল কীপফ তাঁর মোটা গোঁফে পাক দিয়ে বললেন, বন্ধুবর লর্ড গ্র্যাবার্থ প্রচণ্ড মিছে কথা বলেছেন তা আপনারা সকলেই বোঝেন। ওঁর রাষ্ট্রই আমাদের সকলকে দাবিয়ে রেখেছে, ওঁরা ঘুষ দিয়ে আমাদের দেশে বারবার বিপ্লব আনবার চেষ্টা করেছেন। এর শোধ একদিন তুলব, এখন বেশি কিছু বলতে চাই না।
পরাধীন দেশের জননেতা অবলদাসজী বললেন, লর্ড গ্র্যাবার্থ যে অছিগিরির দোহাই দিলেন তা নিছক ভণ্ডামি। আমরা লায়েক কি নালায়েক তার বিচারের ভার যদি ওঁরা নিজের হাতে রাখেন তবে কোনো কালেই আমাদের দাসত্ব ঘুচবে না। এই সভার একমাত্র কর্তব্য—সমস্ত সাম্রাজ্যের লোপ সাধন এবং সর্বজাতির স্বাধীনতা স্বীকার। অধীন দেশই দ্বেষ-হিংসার কারণ।
মহাতপস্বী নিশ্চিন্ত মহারাজ চোখ বুজে বসে ছিলেন। এখন মৌন ভঙ্গ করে অবলদাসের পিঠে সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললেন, কোনো চিন্তা নেই বৎস, আমি আছি। আমার তপস্যার প্রভাবে তোমরা সকলেই যথাকালে শ্রেয়োলাভ করবে। গৌরীশঙ্কর-শিখরবাসী মহর্ষিদের সঙ্গে আমার হরদম চিন্তাবিনিময় হয়, তাঁরা সকলেই আমার সঙ্গে একমত।
কর্মযোগী ধর্মদাসজী বললেন, এসব বাজে কথায় কিছুই হবে না। আগে সকলের চরিত্র শোধন করতে হবে তবে রাষ্ট্রীয় সদবুদ্ধি আসবে। আমার ব্যবস্থা অতি সোজা—সকলে নিরামিষ খাও, সর্বপ্রকার বিলাসিতা বর্জন কর, এক মাস (মানুষের হিসাবে পঞ্চাশ বৎসর) নিরবচ্ছিন্ন ব্রহ্মচর্য পালন কর, এই সময়ের মধ্যে বুড়োরা আপনিই মরে যাবে, নূতন প্রজাও জন্মাবে না, তার ফলে জগতের জনসংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে, খাদ্যাদি প্রয়োজনীয় বস্তুর অভাব থাকবে না। যুদ্ধ দুর্ভিক্ষ মহামারী কিছুই দরকার হবে না, বিশুদ্ধ ধর্মসংগত উপায়ে সকলেরই প্রয়োজন মিটবে।
পণ্ডিত সত্যকামজী বললেন, আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি যুক্তিতর্কে বা অলৌকিক উপায়ে কিছুই হবে না। নিরামিষ ভোজন, বিলাসিতা বর্জন আর ব্রহ্মচর্যও বৃথা, এসব উৎকট ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃতিবিরুদ্ধ, আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা জোর করে চালানো যাবে না। আমাদের দরকার সত্যভাষণ। এই সভার সদস্যগণ যদি মনের কপাট খুলে অকপটচিত্তে নিজেদের মতলব প্রকাশ করেন তবে বিশ্বশান্তির উপায় সহজেই নির্ধারণ করা যেতে পারে। আমরা বিজ্ঞানে অশেষ উন্নতি লাভ করেছি কিন্তু গামানুষ চরিত্রের কিছুই করতে পারিনি। তার কারণ, বিজ্ঞানী যে পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা করেন তাতে প্রতারণা নেই, জড়প্রকৃতি ঠকায় না, সেজন্য তথ্যনির্ণয় সুসাধ্য হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রভুরা মিথ্যা ভিন্ন এক পা চলতে পারেন না। এঁদের গূঢ় অভিপ্রায় কি তা প্রকাশ করে না বললে শান্তির উপায় বেরুবে না। রোগের সব লক্ষণ না জানলে চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে কি করে?
লর্ড গ্র্যাবার্থ ওষ্ঠ কুঞ্চিত করে বললেন, কেউ যদি মনের কথা বলতে না চায় তবে কার সাধ্য তা টেনে বার করে। সত্য কথা বলাবেন কোন উপায়ে?
জেনারেল কীপফ বললেন, ওষুধ খাইয়ে। সোডিয়াম পেণ্টোথাল শুনেছেন? এর প্রভাবে সকলেই অবশ হয়ে সত্য কথা বলে ফেলে। আমাদের দেশে রাষ্ট্রদ্রোহীদের এই জিনিসটি খাইয়ে দোষ কবুল করানো হয়, তার পর পটাপট গুলি। আমরা মকদ্দমায় সময় নষ্ট করি না, উকিলকেও অনর্থক টাকা দিই না।
বিশ্ববিখ্যাত বিচক্ষণ বৃদ্ধ ডাক্তার ভৃঙ্গরাজ নন্দী বললেন, বোকা, বোকা, সব বোকা। পেন্টোথালে লোকে জড়বুদ্ধি হয়। সত্য কথা বলে বটে, কিন্তু বিচারের ক্ষমতা লোপ পায়। আমরা এখানে নেশা করে আড্ডা দিতে আসি নি, জটিল বিশ্বরাজনীতিক সমস্যার সমাধান করতে এসেছি। পেন্টোথালের কাজ নয়, আমার সদ্য আবিষ্কৃত ভেরাসিটিন ইনজেকশন দিতে হবে। গাঁজা থেকে উৎপন্ন, অতি নিরীহ বস্তু, কিন্তু অব্যর্থ। যতই ঝানু কূটবুদ্ধি হন না কেন, ঘাড় ধরে আপনাকে সত্য বলাবে, অথচ বুদ্ধির কিছুমাত্র হানি করবে না। স্থায়ী অনিষ্টেরও ভয় নেই, এক ঘণ্টা পরে প্রভাব কেটে যাবে, তার পর যত খুশি মিথ্যা বলতে পারবেন। ওষুধটি আমার সঙ্গেই আছে, সভাপতি মশায় যদি আদেশ দেন তবে সকলকেই এক মুহূর্তে সত্যবাদী করে দিতে পারি।
কাউন্ট নটেনফ প্রশ্ন করলেন, পরীক্ষা হয়েছে?
ভৃঙ্গরাজ উত্তর দিলেন, হয়েছে বইকি। বিস্তর ইঁদুর আর গিনিপিগের উপর পরীক্ষা করেছি।
জেনারেল কীপফ অট্টহাস্য করে বললেন, ইঁদুরের আবার সত্য মিথ্যা আছে নাকি? আপনি তাদের ভাষা জানেন?
নন্দী বললেন, নিশ্চয় জানি, তাদের ভঙ্গী দেখে বুঝতে পারি। যদি বাঁয়ে ল্যাজ নাড়ে তবে জানবেন মতলব ভালো নয়, উদ্দেশ্য গোপন করছে। যদি ডাইনে নাড়ে তবে বুঝবেন তার মনে কোনো ছল নেই। তা ছাড়া আমার এক শিষ্যের উপর পরীক্ষা করেছি, তার ফলে বেচারার পত্নী বিবাহভঙ্গের মামলা এনেছে।
সভাপতি চং লিং বললেন, সন্দেহ রাখবার দরকার কি, এইখানেই পরীক্ষা হ’ক না। কে ভলণ্টিয়ার হতে চান—বিজ্ঞানপ্রেমী কে আছেন—এগিয়ে আসুন।
ধর্মদাসজী ডাক্তার নন্দীর কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বললেন, আমি রাজি আছি, দিন ইনজেকশন।
নন্দী তখনই পকেট থেকে প্রকাণ্ড একটি ম্যাগাজিন-সিরিঞ্জ বার করে ধর্মদাসের হাতে ফুঁড়ে পনেরো ফোঁটা আন্দাজ চালিয়ে দিলেন। ওষুধের ক্রিয়ার জন্য দু-মিনিট সময় দিয়ে সভাপতি বললেন, ধর্মদাসজী, এইবারে আপনার মনের কথা খুলে বলুন।
ধর্মদাস বললেন, নিরামিষ ভোজন, খাদ্যে মসলা বর্জন, সর্ব বিষয়ে অবিলাসিতা আর নিরবচ্ছিন্ন ব্রহ্মচর্য। তবে আমিও মাঝে মাঝে আদর্শচ্যুত হয়েছি।
জেনারেল কীপফ সহাস্যে বললেন, এসব পাগলদের উপর পরীক্ষা করা বৃথা, এরা স্বাভাবিক অবস্থাতেও বেশি মিথ্যে বলে না, যা বিশ্বাস করে তাই প্রচার করে। আসুন, আমাকেই ইনজেকশন দিন, সত্য মিথ্যা কিছুতেই আমার আপত্তি নেই।
লর্ড গ্র্যাবার্থ অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে কীপফের হাত ধরে বললেন, করেন কি, ক্ষান্ত হন, এসব বিশ্রী ব্যাপারে থাকবেন না। যার আত্মসম্মানবোধ আছে সে কখনও এতে রাজি হতে পারে? অভিপ্রায় গোপনে আমাদের বিধিদত্ত অধিকার, একটা হাতুড়ে ডাক্তারের পাল্লায় পড়ে তা ছেড়ে দিতে পারি না। স্থূল মিথ্যা অতি বর্বর জিনিস তা স্বীকার করি, কিন্তু সূক্ষ্ম মিথ্যা অতি মহামূল্য অস্ত্র, ত্যাগ করে লাগাতে পারলে জগৎ জয় করা যায়, তা আমরা কিছুতেই ছাড়তে পারি না। পরিমার্জিত মিথ্যাই সভ্যসমাজের আশ্রয় আর আচ্ছাদন, সমস্ত লোকাচার আর রাজনীতি তার উপর প্রতিষ্ঠিত। আপনার লজ্জা নেই? এই সভার মধ্যে উলঙ্গ হওয়া যা, মনের কথা প্রকাশ করাও তা।
জেনারেল কীপফ নিরস্ত হলেন না, গ্র্যাবার্থের মুঠো থেকে নিজের হাত সজোরে টেনে বাড়িয়ে দিলেন, ডাক্তার নন্দীও তৎক্ষণাৎ সূচিপ্রয়োগ করলেন। তারপর কীপফ দুই হাতে গ্র্যাবার্থকে জাপটে ধরে বললেন, শীগগির, এঁকেও ফুঁড়ে দিন, একটু বেশি করে দেবেন। ডাক্তার ভৃঙ্গরাজ নন্দী ডবল মাত্রা ভেরাসিটিন চালিয়ে দিলেন। কীপফের স্থূল লোমশ বাহুর বন্ধনে ছটফট করতে করতে গ্র্যাবার্থ বললেন, একি অত্যাচার! আপনারা সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছেন। সভাপতি মশায়, আপনি একেবারে অকর্মণ্য। উঠুন, এখনই আমার রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কাছে টেলিফোন করুন।
কীপফ বললেন, বড়ো বেয়াড়া পেশেন্ট, হাড়ে হাড়ে রোগ ঢুকেছে, লাগান আরও দুই ডোজ। ডাক্তার নন্দী বিনা বাক্যবায়ে আর একবার ফুঁড়ে দিলেন। তারপর গ্র্যাবার্থ ক্রমশ শান্ত হয় মৃদুস্বরে বললেন, শুধু আমাদের দুজনকে কেন? ওই বজ্জাত গুণ্ডা নটেনফটাকেও দিন।
নটেনফ ঘুসি তুলে গ্র্যাবার্থকে আক্রমণ করতে এলেন। কীপফ তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, থামুন থামুন, সত্য বলতে এত ভয় কীসের? আমরা সকলেই তো পরস্পরের অভিসন্ধি বুঝি, খোলসা করে বললে কি এমন ক্ষতি হবে?
নটেনফ চুপি চুপি বললেন, আরে, তোমাদের আমি গ্রাহ্য করি নাকি? আমার আপত্তির কারণ আলাদা। আন্তর্জাতিক অশান্তির চেয়ে পারিবারিক অশান্তি আরও ভয়ানক।
এমন সময় দর্শকদের গ্যালারি থেকে কাউন্টেস নটেনফ তারস্বরে বললেন, দিন জোর করে ফুঁড়ে, কাউন্ট অতি মিথ্যাবাদী, চিরকাল আমাকে ঠকিয়েছে।
এই হট্টগোলের সুযোগে ডাক্তার নন্দী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে নটেনফের নিতম্বে ভেরাসিটিন প্রয়োগ করলেন। নটেনফপত্নী চিৎকার করে বললেন, এইবার কবুল কর তোমার প্রণয়িনী কে কে।
সভাপতি চং লিং বললেন, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, প্রণয়িনীরা পালিয়ে যাবে না, এখন আমাদের কাজ করতে দিন। লর্ড গ্র্যাবার্থ, কাউন্ট নটেনফ, জেনারেল কীপফ, এখন একে একে খুলে বলুন আপনাদের রাজনীতিক উদ্দেশ্য কী।
গ্র্যাবার্থ বললেন, আমাদের উদ্দেশ্য অতি সোজা, জোর যার মুলুক তার এই হচ্ছে একমাত্র রাজনীতি। পরহিতৈষিতা আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বেশ, কিন্তু আন্তর্জাতিক ব্যাপারে তার স্থান নেই। আমরা সভ্য অসভ্য শক্তিমান দুর্বল সকল জাতির কাছ থেকে যথাসাধ্য আদায় করতে চাই, এতে ন্যায়-অন্যায়ের কথা আসে না। দুধ খাবার সময় বাছুরের দুঃখ কে ভাবে? যখন মাংসের জন্য বা অন্য প্রয়োজনে গোরু ভেড়া বাঘ সাপ ইঁদুর মশা মারেন তখন, জীবের স্বার্থ গ্রাহ্য করেন কি? উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে, অহিংস হয়ে পাথর খেয়ে বাঁচতে পারেন কি? আমরা সর্বপ্রকার সুখভোগ করতে চাই, তার জন্য সর্বপ্রকার দুষ্কর্ম করতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমাদের নিরঙ্কুশ হবার উপায় নেই, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী আছে, নিজের স্বভাবগত কোমলতা আছে—যাকে মূর্খরা বলে বিবেক বা ধর্মজ্ঞান। তা ছাড়া স্বজাতি আর মিত্রস্থানীয় বিজাতির মধ্যে জনকতক দুর্বলচিত্ত ধর্মিষ্ঠ আছে, তাদের সব সময় ধাপ্পা দেওয়া চলে না, ঠান্ডা রাখবার জন্য মাঝে মাঝে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এই সভার যা উদ্দেশ্য তা কোনো কালে সিদ্ধ হবে না। প্রতিপক্ষের ভয়ে বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে যৎকিঞ্চিৎ স্বার্থত্যাগ করতে পারি, কিন্তু পাকা ব্যবস্থায় রাজি নই, আজ যা ছাড়ব সুবিধা পেলেই কাল আবার দখল করব। অভিব্যক্তিবাদ তো আপনারা জানেন, বেশি কিছু বলবার দরকার নেই।
নটেনফ বললেন, আমাদের নীতিও ঠিক ওই রকম। কর্মপদ্ধতির অল্প অল্প ভেদ আছে, কিন্তু মতলব একই। আমরা জাত্যাংশে সর্বশ্রেষ্ঠ, জগতের একাধিপত্য একদিন আমাদের হাতে আসবেই, ছলে বলে কৌশলে যেমন করে হোক আমরা মনস্কামনা সিদ্ধ করব।
কীপফ বললেন, আমরাও তাই বলি, তবে আপনাদের আর আমাদের পদ্ধতিতে বিলক্ষণ প্রভেদ আছে। ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশটি প্রকাণ্ড, এখনও অন্য দেশকে শোষণ করবার বিশেষ দরকার হয়নি, তবে ভবিষ্যৎ ভেবে আমরা এখন থেকেই হাত পাকাচ্ছি।
অবলদাসজী মাথাচাপড়ে বললেন, হায় হায়, এর চেয়ে মিথ্যা কথাই যে ভালো ছিল! তবু একটা আশা ছিল যে এরা এখন ক্ষমতার দম্ভে বুঝতে পারছে না, পরে হয়তো এদের ন্যায়বুদ্ধি জাগ্রত হবে। আচ্ছা লর্ড গ্র্যাবার্থ, একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আমরা অধীন জাতিরা একটু একটু করে শক্তিমান হচ্ছি। আপনারা যাই বলুন, জগতে সকল দেশে এখনও সাধু লোক আছেন, তাঁরা আমাদের সহায়। আমরা একদিন বন্ধনমুক্ত হবই। আমাদের মনে যে বিদ্বেষ জমছে তার ফলে ভবিষ্যতে আপনাদের কি সর্বনাশ হবে তা বুঝছেন? আমাদের সঙ্গে যদি এখনই একটা ন্যায়সংগত চুক্তি করেন এবং তার জন্য অনেকটা ত্যাগ স্বীকার করেন তবে ভবিষ্যতে আমরা আপনাদের একেবারে বঞ্চিত করব না। এই সহজ সত্যটা আপনাদের মাথায় ঢোকে না কেন?
গ্র্যাবার্থ বললেন, অবশ্যই ঢোকে। কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতে এক আনা পাব সেই আশায় উপস্থিত ষোল আনা কেন ছাড়ব? আমাদের অতিবৃদ্ধ প্রপৌত্রের জন্য মাথাব্যথা নেই।
অবলদাস দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বসে পড়লেন। নিশ্চিন্ত মহারাজ আর একবার তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ভয় কি, আমি আছি।
ধর্মদাস বললেন, ইনজেকশান দিয়ে কি ভালো হল? সবই তো আমাদের জানা কথা। আমাদের শাস্ত্রে অসুরপ্রকৃতির লক্ষণ দেওয়া আছে—
ইদমদ্য ময়া লব্ধমিদং প্রাপস্যে মনোরথম।
ইদমস্তীদমপি মে ভবিষ্যতি পুনর্ধনম।।
অসৌ ময়া হতঃ শত্রুর্হনিষ্যে চাপরানপি।
ঈশ্বরোহোমহং ভোগী সিদ্ধোহোং বলবান সুখী।।
আঢ্যোহোভিজনবানস্মি কোন্যোস্তি সদৃশো ম।
—আজ আমার এই লাভ হল, এই অভীষ্ট বিষয় পাব, এই আমার আছে, আবার এই ধনও আমার হবে। ওই শত্রু আমি হত্যা করেছি, অপর শত্রুদেরও হত্যা করব। আমি ঈশ্বর, আমি ভোগী, আমি যা করি তাই সফল হয়, আমি বলবান, আমি সুখী। আমি অভিজাত, আমার সদৃশ আর কে আছে।
সভাপতি সকলের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, বড়ো বড়ো রাষ্ট্রনেতাদের মতলব তো জানা গেল, এখন শান্তির উপায় আলোচনা করুন।
গ্র্যাবার্থ, নটেনফ, কীপফ সমস্বরে বললেন, আমরা বেশ আছি, শান্তি-টান্তি বাজে কথা, আমরা নখদন্তহীন ভালোমানুষ হতে চাই না, পরস্পর কাড়াকাড়ি মারামারি করে মহানন্দে জীবনযাপন করতে চাই।
এই সভার একজন সদস্য এতক্ষণ পিছন দিকে চুপচাপ বসে ছিলেন, ইনি আচার্য ব্যোমবজ্র দর্শন-বিজ্ঞানশাস্ত্রী, এক দিস্তা ফুলস্ক্যাপে এর সমস্ত উপাধি কুলয় না। এখন ইনি দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, বিশ্বশান্তির উপায় আমি আবিষ্কার করেছি।
ডাক্তার ভৃঙ্গরাজ নন্দী বললেন, আপনারও একটা ইনজেকশন আছে নাকি?
ব্যোমবজ্র উত্তর দিলেন, পৃথিবীর কোটি কোটি লোককে ইনজেকশন দেওয়া অসম্ভব। প্রকৃষ্ট উপায় হচ্ছে আমার আবিষ্কৃত বিশ্বব্যাপক শান্তিস্থাপক বোমা, তার প্রভাবে সর্বত্র শান্তি বিরাজ করবে। এই বোমা থেকে যে আকস্মিক রশ্মি নির্গত হয় তা কসমিক রশ্মির চেয়ে হাজার গুণ সূক্ষ্ম। তার স্পর্শে চিত্তশুদ্ধি, কাম ক্রোধ লোভাদির উচ্ছেদ এবং আত্মার বন্ধনমুক্তি হয়।
গ্র্যাবার্থ ধমক দিয়ে বললেন, খবরদার এখানে কোনো রহস্য প্রকাশ করবেন না। আমাদের টাকায় আপনি গবেষণা করেছেন। আপনার যা বলবার আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে গোপনে বলবেন।
নটেনফ লাফিয়ে উঠে বললেন, বাঃ, আমরাই তো ওঁর সমস্ত খরচ জুগিয়েছি! বোমা আমাদের।
কীপফ বললেন, আপনারা ড্যাম মিথ্যাবাদী। আমাদের রাষ্ট্র বহুদিন থেকে ওঁকে সাহায্য করে আসছে, ওঁর আবিষ্কার একমাত্র আমাদের সম্পত্তি।
ব্যোমবজ্র দুই হাতে বরাভয় দেখিয়ে বললেন, আপনারা ব্যস্ত হবেন না, আমার বোমায় আপনাদের সকলেরই স্বত্ব আছে, আপনারা সকলেই উপকৃত হবেন। অবলদাসজী, আপনাদেরও দলাদলি আর সকল দুর্দশা দূর হবে। এই বলে তিনি একটি ছোটো বোঁচকা খুলতে লাগলেন।
সভায় তুমুল গোলযোগ শুরু হল, গ্র্যাবার্থ নটেনফ কীপফ এবং অন্যান্য সমস্ত রাষ্ট্র প্রতিনিধি বোঁচকাটি দখল করবার জন্য পরস্পরের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে লাগলেন।
ধর্মদাস বললেন, ব্যোমবজ্রজী, আর দেরি করছেন কেন, ছাড়ুন না আপনার বোমা।
ব্যোমবজ্রকে কিছু করতে হল না, সদস্যদের টানাটানিতে বোমাটি তাঁর হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভুঁইপটকার মতন ফেটে গেল। কোনো আওয়াজ কানে এল না, কোনো ঝলকানি চোখে লাগল না, শব্দ আর আলোকের তরঙ্গ ইন্দ্রিয়দ্বারে পৌঁছবার আগেই সমগ্র গামানুষ জাতির ইন্দ্রিয়ানুভূতি লুপ্ত হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকবার পর গ্র্যাবার্থ বললেন, শাস্ত্রীর বোমাটি ভালো, মনে হচ্ছে আমরা সবাই সাম্য মৈত্রী আর স্বাধীনতা পেয়ে গেছি। নটেনফ, কীপফ তোমাদের আমি বড্ড ভালোবাসি হে। অবলদাস, তোমরাও আমার পরমাত্মীয়। একটা নতুন ইন্টারন্যাশনাল অ্যানথেম রচনা করেছি শোন—ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই। এস, এখন একটু কোলাকুলি করা যাক।
নিশ্চিন্ত মহারাজ অবলদাসের পিঠ চাপড়ে সগর্বে বললেন, হুঁ হুঁ, আমি বলেছিলাম কিনা?
সভায় বিজয়াদশমী আর ঈদ মুবারকের ভ্রাতৃভাব উথলে উঠল। খানিক পরে নটেনফ বললেন, আসুন দাদা, এখন বিশ্বের কয়লা তেল গম গোরু ভেড়া শুয়োর তুলো চিনি রবার লোহা সোনা ইউরেনিয়াম প্রভৃতির একটা বাটোয়ারা হক। জন-পিছু সমান হিসসা, কি বলেন?
ব্যোমবজ্র সহাস্যে বললেন, কোনো দরকার হবে না, আপনারা সকলেই নশ্বর দেহ থেকে মুক্তি পেয়ে নিরালম্ব বায়ুভূত হয়ে গেছেন। এখন নরকে যেতে পারেন, বা আবার জন্মাতে পারেন বা একদম উবে যেতে পারেন, যার যেমন অভিরুচি।
কীপফ বললেন, আপনি কি বলতে চান আমরা মরে ভূত হয়ে গেছি? আমি ভূত মানি না।
ব্যোমবজ্র বললেন, নাই বা মানলেন, তাতে অন্য ভূতদের কিছুমাত্র ক্ষতি হবে না।
মৃতবৎসা বসুন্ধরা একটু জিরিয়ে নেবেন তারপর আবার সসত্ত্বা হবেন। দুরাত্মা আর অকর্মণ্য সন্তানের বিলোপে তাঁর দুঃখ নাই। কাল নিরবধি, পৃথিবীও বিপুলা। তিনি অলসগমনা, দশ—বিশ লক্ষ বৎসরে তাঁর ধৈর্যচ্যুতি হবে না, সুপ্রজাবতী হবার আশায় তিনি বার বার গর্ভধারণ করবেন।
রচনাকাল – ১৩৫২ (১৯৪৫)
Tags: অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান গল্প, পরশুরাম, রাজশেখর বসু