রামমোহন রায় ও ফুটবল
লেখক: অমিতাভ মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
রামমোহন রায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল কলকাতার ময়দানে উনিশশো বিরানব্বই সালে। আরও স্পষ্ট করে বললে মোহনবাগান মাঠের আট আনার গ্যালারিতে। বছরটা মনে আছে কারণ কৃশানু দে ওই বছরেই ইস্টবেঙ্গল থেকে মোহনবাগান ক্লাবে ফিরে আসে বছর সাতেক ইস্টবেঙ্গলে খেলার পরে। আমার বাবা এবং ছোটোকাকা দক্ষিণ রেলে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে আমি ছিলাম সূর্য মেমোরিয়ালের একনিষ্ঠ সমর্থক। সূর্য মেমোরিয়াল ছিল দক্ষিণ রেলের বি টিম। ময়দানে ছোটো দলগুলোর মধ্যে বেশ সুনাম হয়েছিল অল্প দিনের মধ্যেই। ছোটো দলের তো নিজস্ব মাঠ নেই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল বা মহমেডানের মাঠে খেলা পড়ত। সেসময়ে ওইসব মাঠে আট আনার গ্যালারিতে ফুটবলের মরশুমে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই পা পড়ত আমার। তখন অবশ্য নতুন পয়সার যুগ ভালোমতোই শুরু হয়ে গেছে। আট আনা মানে নতুন পয়সায় পঞ্চাশ পয়সা। ময়দানে সাধারণ গ্যালারিতে আট আনা আর এক টাকা, এই দুটো ভাগ ছিল। দু-রকম টিকিট। পরে টিকিটের দাম দশ পয়সা করে বেড়েছিল। তাহলেও লোকের মুখে আট আনা আর একটাকার গ্যালারির কথাই ঘুরত। শিয়ালদা পর্যন্ত ট্রেনে, তারপর ট্রামে চেপে ময়দানে। টিকিটের জন্যে আট আনা জোগাড় করতে পারলেই রেফারির বাঁশি শোনার জন্যে মন আনচান করে উঠত। সেদিন ছিল মোহনবাগানের সঙ্গে সূর্য মেমোরিয়ালের খেলা।
ময়দানে পৌঁছে যখন মোহনবাগান মাঠে টিকিটের লাইনে দাঁড়ালাম, লাইন তখন অজগর সাপ। সেযুগে ফুটবলের মরশুমে বড়ো দলের খেলা থাকলে এরকম সাত আটটা লাইন পড়ত তিন প্রধানের মাঠে। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল আর মহমেডান—তিন প্রধান। কোনোদিনই লাইনের শেষের দিকের লোকেরা টিকিট পেত না। মাঠ ভরতি হয়ে গেলে গেটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হত। বড়ো বড়ো ঘোড়ায় চড়ে থাকা মাউন্টেড পুলিশেরা বাড়তি ভিড় হটিয়ে দিত। সেদিন অবশ্য টিকিট পেয়ে মাঠে ঢুকতে পেরেছিলাম। গ্যালারিতে বসে মনে হল কী যেন জয় করে ফেলেছি। সেদিনের খেলাটার মধ্যে অবশ্য আমার খুশি হওয়ার মতো উপকরণ মজুত ছিল না। হাফ টাইমের আগেই দু গোল দিল মোহনবাগান। গ্যালারিতে মোহনবাগান সমর্থকদের ফুরফুরে মেজাজ দখিনা হাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সেদিন দেখলাম মাঝমাঠে কৃশানুর বাঁ-পায়ের কাজ। তার ডান-পা তুলনায় সাধারণ ছিল। তা থাক, ওই বাঁ-পায়ের একটু ড্রিবলিঙ, একটু বল নাচানো যখনই সামনে আসছিল, মাঠে ছড়িয়ে পড়ছিল আহা-উহুর স্রোত। এইরকম সময়েই পাশের লোকটার দিকে নজর পড়ল।
সাধারণ একহারা চেহারা, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির মতো উচ্চতা। সাধারণ একটা বাদামি ট্রাউজার্স আর ঘিয়েরঙা টিশার্ট পরণে। বেখাপ্পা লাগছিল শুধু ওর চোখে লাগান সবুজ কাচের গগলসটা। এরকম গগলস পরা মানুষ ফুটবল মাঠে তো দূরের কথা, রাস্তাঘাটেও বিশেষ দেখা যায় না। মাঠের চিৎকারে লোকটা কখনই গলা মেলাচ্ছিল না। মাঝেমাঝে নিজের মনে কী যেন বিড়বিড় করছিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি বুঝতে পেরে আমাকে গগলস দৃষ্টিতে দেখল। তারপর ঠোঁটে একটু হাসির আভাস এনে বলল—আমি রামমোহন রায়। বিনা ভূমিকায় নামটা কানে এসে বিষম চমকে দিল আমাকে। ওই নামটার সঙ্গে বিশেষ রকম পাগড়ি আর সুপুরুষ চেহারার যে মেলবন্ধন মনে গেঁথে আছে আশৈশব, তার সঙ্গে এই চেহারার বৈপরীত্য এক লহমায় মনে এসে আমার মুখেও হাসি এনে দিল। হেসেই নিজের পরিচয় দিলাম, আমি সুজন বসু। মোহনবাগানের খেলা দেখতে এসেছেন নিশ্চয়ই। লোকটার হাসিমুখের দ্যুতি একটু যেন নিভে এল। বিড়বিড় করে বলল, ঠিক তা নয়, ঠিক তা নয়। আসলে আমি—। কথাটা অসমাপ্ত রইল। আমি ভাবলাম, হয়তো আমারই মতো মাঠে মুষ্টিমেয় সূর্য সমর্থকদের মধ্যে একজন। সেকথা জোর গলায় গ্যালারিতে বললে বিপদের সম্ভাবনা আছে। তাই হয়তো—, বেচারির জন্যে সহমর্মিতা অনুভব করলাম।
খেলা শেষ হল একসময়ে। মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে রামমোহন রায় আমাকে বললেন, চলুন না, বসি কোথাও, একটু কথা বলা যাবে। কৌতূহল বোধ করলাম। মাঠ থেকে বেরিয়ে শিয়ালদা স্টেশন। ট্রেন ধরে বাড়ি। এই ছিল বরাবরের রুটিন। তার অন্যথা করতে বলছে লোকটা। কী ভেবে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন, বলতে পারব না। ধর্মতলা স্ট্রিটের ফুটপাথে এক চায়ের দোকানে চা-বিস্কুটের সঙ্গে আমাদের আলাপচারিতা শুরু হয়েছিল। রামমোহন ওই পড়ন্ত বিকেলেও গগলস খোলেননি। সোজাসুজি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, টুইচিং মাস্ল আর এনডিওরেন্স মাস্লের তফাত বোঝেন সুজনবাবু? আমার তো চায়ে প্রায় বিষম খাওয়ার অবস্থা। কোনমতে জিজ্ঞেস করলাম সেটা কী?
—অ্যাথলেটদের পেশিগুলোকে দু-ভাগে ভাবা যায়। একধরণের পেশির রিফ্লেক্স বেশি, বেশি সংবেদনশীল। অন্য ধরণটায় সহনশীলতা বেশি। এই পেশি অনেক ধকল সইতে পারে।
—ঠিক বুঝলাম না।
—সহনশীলতার বিষয়টা তো সহজ। শক্তিমান পেশি বেশি পরিশ্রম করতে পারে অনেক সময় ধরে। ম্যারাথন দৌড়তে গেলে এমন পেশি বেশি সংখ্যায় থাকা দরকার। ফুটবলে ডিফেন্সের প্লেয়ারদের এমন পেশি বেশি থাকে। এটা এনডিওরেন্স মাস্ল।
—বুঝলাম। কিন্তু এই টুইচিং মাস্ল না কী যেন বললেন?
—হ্যাঁ, এই পেশিকে বলা যেতে পারে সহজাত। এর প্রতিবর্ত ক্রিয়া খুব দ্রুত। ধরা যাক একশো মিটারের রানারের কথা। পিস্তলের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে তাকে ছিটকে বেরোতে হবে স্টার্টিং ব্লক থেকে। শুরুতেই ফুল পিক আপ। পূর্ণ গতি। সেরা মোটর সাইকেলের মতো।
—কিন্তু এসব তো প্র্যাকটিস করে আয়ত্ব করা যায়।
—সবটা যায় না। টুইচিং মাস্ল বেশি না থাকলে খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়াই সম্ভব নয়। ফুটবলে ভালো ফরোয়ার্ডের এমন পেশি বেশি দরকার। গোল করতে বা ড্রিবলিঙে সেটা ভালো বোঝা যাবে।
—তার মানে বলতে চাইছেন আজ যে কৃশানুর খেলা দেখলাম, তার পেছনে টুইচিং মাস্লের কারিকুরি?
—অবশ্যই। বলের ওপরে নিয়ন্ত্রণ বা পেশির শক্তি অনুশীলনে বাড়ানো যায়। কিন্তু পেশির চরিত্র বিশেষ বদলায় না। আজকাল অবশ্য জাম্প ট্রেনিং, বিশেষ ডায়েট, শর্ট স্প্রিন্ট, এই সব করে টুইচিঙের ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। তাতে কিন্তু সবটা হয় না।
—কেন হবে না? আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে এটা অসম্ভব মনে হচ্ছে না।
—আরে মশাই, এখন পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানই সহজাত ক্ষমতার ওপরে কেরদানি দেখাতে পারেনি। যদি পারত, ইউরোপের ঘরে ঘরে পেলে, মারাদোনা, মেসি তৈরি হয়ে যেত। ডিস্টেফানো বা ক্রুয়েফ থাকত সব ক্লাবে। চুণি গোস্বামী ক’টা হয়েছে বলুন তো?
—তার মানে আপনি টুইচিং মাস্লকেই প্রতিভা বলতে চাইছেন?
—তা নয় অবশ্যই, তবে প্রতিভার পরিপূরক তো নিশ্চিত। প্রতিভা প্রকৃতিদত্ত, সহজাত পেশিপ্রবণতাও তাই। খুব বড়ো ফরোয়ার্ডদের দুটোই থাকে।
—আপনি ফুটবল নিয়ে এত ভাবেন? কোন ক্লাবের সমর্থক?
—আমি ঠিক কোন ক্লাবের সমর্থক নই। এই একটু খেলা দেখি আর কি। রামমোহনের মুখে কেমন একধরনের হাসি দেখলাম। অদ্ভুত লাগল আমার। এতকাল মাঠে আসছি, এমন দর্শক দেখিনি।
রামমোহন রায়ের সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল বি এন আর-এর বিপক্ষে আমাদের ক্লাবের খেলার দিনে। তার পরে মহমেডান মাঠে। একরকম বন্ধুত্বই হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। আগেই কথা বলে নিতাম, কখন ময়দানে আসব, কোথায় অপেক্ষা করব এই সব। একসঙ্গে টিকিটের লাইনে দাঁড়াতাম। মাঠে ঢুকতাম একসঙ্গে। ওর জামাকাপড় পালটাত মাঝে মাঝে, চোখের গগলস কিন্তু কখনো নামত না। সন্ধেতেও না। তবে আমি ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার ভেবে নিয়ে এবিষয়ে কথা তুলিনি কখনো।
খেলা দেখার পরে ময়দানি কোনো চায়ের দোকানে কিছুক্ষণের আড্ডাও আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়াল। মানে যেদিন খেলা দেখতাম সেই দিনে আর কি। আমি তো সূর্য মেমোরিয়ালের খেলা দেখতাম। ওর পাল্লায় পড়ে অন্য ক্লাবের কিছু বাছাই খেলাও দেখা শুরু করলাম। আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলাম, তুমি থেকে তুই। ফুটবলে ওর গভীর জ্ঞান দেখে অবাক হয়ে যেতাম। ওর কাছেই শিখলাম তিন ব্যাক আর চার ব্যাক প্রথার তফাৎ। উইথড্রয়াল ফরোয়ার্ড আর ফল্স নাইন, থার্ডম্যান মুভ, প্রেসিং ফুটবল এমন কত কি। খেলা দেখতে দেখতেও বুঝিয়ে দিত।
সূর্য মেমোরিয়াল আর কলকাতা ইন্টারন্যাশনালের খেলাটা দেখে আমরা সেদিন বসেছিলাম একটা ফুটপাথিয়া চায়ের দোকানে। মনে ফুর্তি ছিল আমার। খেলাটা জিতেছি আমরা। পুরো পয়েন্ট পাওয়া গেছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে রামমোহন হঠাৎ প্রশ্ন করল, —সুজন, ইটি সম্পর্কে তোর কী ধারণা?
আমার বিষম খাওয়ার মতো অবস্থা হল। বললাম, কী বলব, বিশেষ কিছুই জানি না। কাগজে মাঝে মাঝে দেখি আমেরিকার লোকজন নাকি ইটি দেখতে পায় এখানে ওখানে। একটা খটকা লাগে, ইটিরা শুধু আমেরিকাতেই আসে কেন!
—ইটি মানে এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল, ভিনগ্রহী। সেটা ঠিকই জানিস। কিন্তু ইটিরা শুধু আমেরিকায় আসে, এ তথ্য ভুল। ওরা আসে সব জায়গাতেই। তবে আমেরিকায় এসম্পর্কে সচেতনতা বেশি হওয়ায় খবরগুলো প্রকাশ পায় বেশি। কিছু হুজুগে গল্পও থাকে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না।
—এখানে আসে? এই কলকাতায়? আমার মুখে এক চিলতে অবিশ্বাসের হাসি রামমোহনের নজর এড়ায়নি নিশ্চিত।
—অতি অবশ্য। তারা এই ফুটবল মাঠেও আসে। জোর দিয়ে বলল সে।
এবারে আর শুধু অবিশ্বাস নয়, আমার মনে হল রামমোহনের মাথাটা গেছে। তবে সেকথা তো বলা যায় না। মুখে বললাম—তুই জানলি কী করে?
রামমোহনের ঠোঁটে সেই অনির্দেশ হাসির আভাসটুকু দেখলাম যেন। সরাসরি কোনো উত্তর দিল না ও। উলটে জিজ্ঞেস করল, মব সাইকোলজি নিয়ে ভেবেছিস কখনো?
—না। আবার হোঁচট খাওয়ার অবস্থা আমার।
আমার ব্যাখ্যার অপেক্ষা না করে ও বলে চলল, ভালো লাগা, খারাপ লাগা, রাগ, আনন্দ, এই সব আবেগে এক একজন মানুষের প্রতিক্রিয়া এক এক রকম। কিন্তু মানুষ যখন দলবদ্ধ হয়ে থাকে তখন সমবেত প্রতিক্রিয়ায় গা ভাসিয়ে দেয় বেশির ভাগ লোক। অনেক শিক্ষিত সম্বৃত মানুষও দলে থাকার সময়ে এমন আচরণ করতে পারে যার ব্যাখ্যা পরে তারা নিজেরাও দিতে পারবে না। দু-চার জন অবশ্য সেখানেও অন্যরকম থাকে। মব সাইকোলজির বিষয় এটাই। ইটিরা ইদানীং পৃথিবীর মানুষের মনস্তত্ত্বের এই দিকটা নিয়ে গবেষণা করছে। ফুটবল মাঠ একাজের চমৎকার জায়গা। চল, আজ আর বসা হবে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার সাড়া দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা না করেই উঠে পড়ল সে।
এরিয়ান্সের সঙ্গে খেলার দিন ওর সঙ্গে দেখা হল আবার। খেলার পরে আড্ডায় বসে আমি আগের দিনের কথার জের টানলাম—সেদিন মব সাইকোলজি নিয়ে যা বললি তা না-হয় বুঝলাম, কিন্তু এ নিয়ে ইটিদের নিয়মিত মাঠে আসার কী দরকার?
আবার ওর ঠোঁটে সেই অনির্দিষ্ট হাসি—তোকে বলা হয়নি, ইটিদের সভ্যতা পৃথিবীর চেয়ে অনেক এগিয়ে। তারা এমন অনেক কিছুই পারে, যা পৃথিবীর মানুষের ভাবনার বাইরে।
—অর্থাৎ?
—অর্থাৎ এক্ষেত্রে তারা ফুটবলারদের কখনো আংশিক নিয়ন্ত্রণ করে দেখতে চায় তার কী মানসিক প্রতিক্রিয়া হয়। দর্শকের, এমনকি ফুটবলারদেরও।
—এই নিয়ন্ত্রণ বিষয়টা কী?
—দ্যাখ, ইটিরা যে-কোনো খেলোয়াড়কে বা মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। তার শরীর বা মন বা দুটোই। যদিও সচরাচর সেটা করে না। গবেষণার খাতিরে যেটুকু, ব্যস। বেশ কিছু বছর ধরেই এটা চলছে।
—ফুটবলের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
—সরাসরি হয়তো নেই। তবে একজন প্লেয়ারকে দিয়ে হঠাৎ বিশেষ কিছু একটা করিয়ে নিয়ে মব সাইকোলজিতে তার তাৎক্ষণিক প্রভাব দেখা ইটিদের একটা প্রিয় বিষয়।
—যেমন?
—আচ্ছা তুই তো বিশ্বকাপের খবর মোটামুটি রাখিস। উনিশশো চৌত্রিশে একজন আর্জেন্টাইন প্লেয়ার ইটালির হয়ে খেলেছিল, মনে আছে?
—হ্যাঁ, রাইমুন্দো ওরসি। ফাইনালে চেকোশ্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে গোলও করেছিল।
—ঠিক। ওই গোলটা হয়েছিল অদ্ভুত এক বাঁক খাওয়া শটে। ওরসি সাংবাদিকদের বলেছিল, অমন শট প্র্যাকটিসে ও হামেশাই নিয়ে থাকে। কিন্তু পরে জুভেন্তাসের প্র্যাকটিসে সাংবাদিক ডেকে এনে সে ওইরকম শট আর একটাও করতে পারেনি।
—তাতে কী প্রমাণ হয়?
—হয়তো কিছুই না। তবে প্রকৃত কারণটা জেনে রাখ, আসল শটটায় একজন ইটির কারসাজি ছিল। মেক্সিকো বিশ্বকাপে পেলের যে হেডটা বাঁচায় গর্ডন ব্যাঙ্কস, সেখানেও ব্যাঙ্কসের পেছনে একজন ইটির কারিকুরি। তুই তো জানিস, ফুটবলের ইতিহাসে ওটাকেই সর্বকালের সেরা সেভ বলেন অনেকে।
—হাসালি তুই। এর পর তো মারাদোনার বল নিয়ে সেন্টারলাইন থেকে ইংল্যান্ডের পাঁচ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে করা শতাব্দীর সেরা গোলটাও ইটির খাতায় রাখবি।
—রাখতে তো হবেই। আরও অনেক অ-নে-ক আছে। দু হাজার তেরোয় প্রায় তিন মিটার লাফিয়ে রিয়েল মাদ্রিদের রোনাল্ডো হেডে একটা গোল করেছিল ম্যান ইউয়ের বিপক্ষে। সেই গোলও হিসেবে ঢুকবে। ইটিদের গবেষণা তোর চিন্তার পরিধির চেয়েও বড়ো সুজন।
—তা এই গবেষণা প্রায় একশো বছর ধরে চলছে?
—মানুষের একশো বছর ইটিদের গ্যালাক্সির হিসেবে বছর পাঁচেকের বেশি নয়।
মাথা ঝিমঝিম করছিল আমার। বিশ্বাস করার মতো কথাবার্তা এসব নয়। কিন্তু ওর প্রত্যয় দেখে উড়িয়ে দিতেও পারছিলাম না। সেদিনের মতো ওই পর্যন্তই।
বাটা অগ্রগামীর বিপক্ষে আমাদের খেলার দিনে আমার মনে জমে থাকা কিছু প্রশ্ন রামমোহনকে জিজ্ঞেস করার জন্যে সাজিয়ে রাখলাম। খেলাটা হল একপেশে। আমাদের ফরোয়ার্ড লাইনে কোনো শ্যাম থাপা, সুভাষ ভৌমিক, আকবর ছিল না। থাকলে বাটা অগ্রগামীকে গোলের মালা পরানো যেত। যা হোক, দুই অর্ধের দু গোলে জিতলাম আমরা। সেন্টার ফরোয়ার্ড ফয়জল আর ডান প্রান্তের মিডফিল্ডার অর্ণব গোলদুটো করল। চেনা চায়ের দোকানে বসলাম আমি আর রামমোহন খেলার পরে।
সেদিন চায়ের সঙ্গে গরম আলুর চপও ছিল। আলুর চপে কামড় দিয়ে রামমোহনকে বললাম, মনে আছে, কৃশানুদের খেলা দেখার পরে তুই আমাকে টুইচিং মাস্ল বুঝিয়েছিলি?
—হ্যাঁ, তো? হাসল রামমোহন।
—তা হলে পেলে মারাদোনা ব্যাঙ্কস সকলের সঙ্গে ইটি জুড়ে দিচ্ছিস কেন! ওদের প্রতিভার কি কোন দাম নেই? আমাদের চুণি গোস্বামীও কিছু নয়?
—তোকে হয়তো আমি ঠিক বোঝাতে পারিনি। ওদের অসামান্য প্রতিভা ছিল। অসাধারণ পেশির সমাবেশও ছিল। ইটিরা সেকারণেই ওদের পছন্দ করেছে এবং কখনো বা একটু সাহায্যও করেছে। তোকে বলা দরকার, ইটিরা যে গ্যালাক্সি থেকে এসেছে, সেখানে কিছু সূত্র আছে যা সর্বত্র মেনে চলতে হয়। এমনকি এই পৃথিবীতে এলেও।
—কীরকম সূত্র?
—সব কী করে বলি। একটা মূল সূত্র শোন। কোনো ইটি এমন কিছুই করবে না যা সহজ স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে যায়। একমাত্র গুরুতর অপরাধ রুখতেই এ সূত্রের অন্যথা হতে পারে। খেলার মাঠে ইটিরা যে আসে, তারা শুধু খেলার নিয়মকানুন জেনেই আসে না, খেলাটাকেও যতটা সম্ভব জেনে আসে। প্রকৃতির বিপরীতে কোনো ইটি কিছু করার চেষ্টা করবে না। করলে বিপর্যয় হতে পারে।
—ইটিদের নিয়ে এত কিছু তুই জানলি কী করে রামমোহন? নাকি তোর মনগড়া কল্পনা?
—খাঁটি সত্যি রে। আমি ইটিদের অনেককেই জানি।
আমি কোনো প্রতিবাদ করতে পারিনি। ওর বলার মধ্যে কেমন যেন একরকম গভীর প্রত্যয় মিশে ছিল। সেটাই আমার প্রতিবাদের স্বর কেড়ে রেখেছিল তখন।
ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলার দিনে মাঠে লোকে লোকারণ্য। এবছর চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইটে রয়েছে ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগানের সঙ্গে তীব্র লড়াই। সামান্য পেছনে মহমেডান স্পোর্টিং। তবে তারাও রয়েছে লড়াইতে। আমাদের ক্লাব পয়েন্ট টেবিলের মাঝামাঝি, যে-কোনো দিন যে কোনো ক্লাবের পয়েন্টভাগ্যে ভাগ বসাতে পারে। লিগের মাঝামাঝি লড়াকু দল হিসেবে সুখ্যাতি আছে। ভালো একটা খেলা দেখার আশায় আমি আর রামমোহন একটু আগেই এসেছিলাম। টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম একসঙ্গে। আগের দিনের কথাগুলোই ভাবছিলাম। একসময়ে ওকে বলেই ফেললাম—তোর কথাগুলো বিশ্বাস করা খুব কঠিন।
হেসে ফেলল ও। আমি মরিয়া হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, আজকের মাঠেও কি ওদের কেউ থাকতে পারে?
—অবশ্যই পারে।
—ওদের চেনার কোন উপায় আছে?
গম্ভীর হয়ে গেল রামমোহন। কেমন দায়সারাভাবে বলল—ইটিরা যে দেশে যে প্রাণীদের সমাজে যায়, সেখানে প্রচলিত রূপে সাধারণ হয়ে মিশে যায়। তাই আলাদা করে চেনা মুশকিল। তবে পৃথিবীতে ওদের চোখে থাকে সবুজ গগলস। কারণ পৃথিবীর সূর্যের আলোর স্পেকট্রামে সবুজ রংটা ওদের চোখে ঠিক সহ্য হয় না। এমনকি ডেলাইট ব্যালান্সড টিউবের আলোতেও অস্বস্তি। সবুজ কাচের গগলস ওই রংটাকে প্রতিফলিত করে চোখকে স্বস্তি দেয়। তাই ওরা সর্বদা সবুজরঙা গগলস পরে থাকে।
ভীষণ চমকে উঠলাম আমি। আরও কিছু জানার ছিল। কিন্তু ততক্ষণে পৌঁছে গেছি টিকিট কাউন্টারের সামনে। টিকিট কেটে গ্যালারিতে এলাম।
খেলা শুরু হতেই ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণ ঝাঁপিয়ে পড়ল সূর্য মেমোরিয়ালের সীমানায়। পুরীর সাগরের ঢেউয়ের মতো উথাল হয়ে আসছে, রক্ষণের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে। ফিরে যাচ্ছে যেন তখনই আবার ফিরে আসার জন্যেই। আমাদের ডিফেন্সে নেতৃত্বের রাশ বর্ষীয়ান অবতার সিং এর মুঠোয়। অবতার কলকাতায় খেলতে এসেছিল এগারো বছর আগে। তিন প্রধানের হয়ে মাঠ দাপিয়েছে অনেক কাল। ভারতের হয়ে খেলেছে। এখন পড়ন্ত বেলায় আমাদের ক্লাবে। খেলছে এখনও শুধু খেলাটার প্রতি ভালোবাসার টানে। অবতারের পাশে জেকব গোবিন্দ আর সুপ্রকাশ মানসই হয়ে উঠেছে। মিডফিল্ডাররা তো বটেই, ফয়জল শিশিররাও ফরোয়ার্ড থেকে নীচে নেমে আসছে রক্ষণকে সাহায্য করার জন্যে।
তার মধ্যেই বিকাশ পাঁজির থ্রু থেকে বল পেয়ে বক্সের মাথায় ডান কোণ থেকে কুলজিতের একটা গোলার মতো শট ক্রসবারে ধাক্কা খেয়ে ফেরত এল। উত্তম মুখার্জির একটা ঠিকানা লেখা ক্রস এগিয়ে আসা তরুণদের মাথার ওপর থেকে তুলে নিল আমাদের গোলকিপার নাসিম। নাসিমের আজ অক্টোপাস হওয়ার দিন। ডানে বাঁয়ে ওপরে নীচে সব শট চিপ হেড জমা পড়ছিল ওর হাতে। কীভাবে যেন কোন গোল না খেয়েই আমাদের প্রথম অর্ধটা কেটে গেল।
দ্বিতীয়ার্ধে সূর্য মেমোরিয়ালের পেনাল্টি বক্সের ঠিক বাইরে তাঁবু ফেলল ইস্টবেঙ্গল। দুই প্রান্তের ব্যাক কৃষ্ণেন্দু আর ইলিয়াস পাশা ঘন ঘন ওভার ল্যাপে উঠে আসছিল। সূর্যের বক্সে দু-প্রান্ত থেকে ভেসে আসছিল অগুন্তি ক্রস। শুধু স্বরূপ দাসকে নীচে রেখে তরুণ দে উঠে আসছিল কুলজিতের পাশে থেকে সেসব ক্রসে মাথা ছোঁয়ানোর আশায়। তুষার রক্ষিত মাঝমাঠে থেকে বলগুলো পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছিল ডানে বাঁয়ে। বিকাশ গোলের গন্ধ পেয়ে আঠেরোগজী বক্সের সীমানায়। গোল তবু হচ্ছিল না। নাসিম হারতে রাজি ছিল না। অবতার আজ অবতারত্ব পেয়েছে। মাটিতে বা আকাশে, বল ওকে পেরিয়ে যেতে পারছিল না। আমাদের এগারোজনই নিজেদের বক্সের আশপাশে। ইস্টবেঙ্গলের গোলরক্ষক দেবাশিসকে প্রায় হাফলাইনের কাছে দেখতে পাচ্ছি। খেলা প্রায় শেষের মুখে, দুয়েক মিনিট বাকি আছে। গ্যালারি অশান্ত। ইস্টবেঙ্গল জনতার আবেগ যেন হতাশায় মোড়া রাগ হয়ে ফেটে পড়তে চাইছে। আমার মতো অতি অল্প কয়েকজন সূর্য সমর্থক প্রান্তিক আশায় নীরব।
এই সময়েই আমার মনে অলৌকিক এক অঘটনের ইচ্ছে ভেসে এল। ম্যাচটা জেতার ইচ্ছে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম, রামমোহন একদৃষ্টে খেলায় মগ্ন। আঙুলের একটা খোঁচা দিয়ে নীচু স্বরে ওকে বললাম, রামমোহন, আজকের মাঠেও কি ওদের কেউ আছে? খেলা থেকে চোখ না সরিয়েই ও উত্তর দিল—আছে, কাছেই আছে। সেই মুহূর্তে কুলজিতের পা থেকে নিখুঁত স্লাইডিং ট্যাকলে প্রায় পেনাল্টি স্পটের কাছে একটা বল ক্লিয়ার করল অবতার। আলগা বলটা ধরে বক্সের বাইরে উঠে আসছিল সুপ্রকাশ। সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। আমি আশায় কাঁপা গলায় ওকে অনুরোধ করলাম, যদি সম্ভব হয় একটু বলে দ্যাখ না, এখন যদি একটা গোল হয়! মানে সুপ্রকাশের পায়েই তো বলটা রয়েছে। সবুজ গগলস ঘুরে গেল আমার দিকে—তুই কি সত্যিই তা চাইছিস? আমি ওর একটা হাত আঁকড়ে ধরে আকুল উৎকণ্ঠায় বলে উঠলাম, সত্যি সত্যি সত্যি।
সুপ্রকাশ বলটা নিয়ে উঠছিল নিজেদের আঠেরোগজী বক্সের বাঁ দিকের মাথায়। সামনে কিছুটা দূরে তুষার রক্ষিত। ওর ডান দিকে গজ পনেরো দূরত্বে উত্তম। দুলকি চালে উঠছিল সুপ্রকাশ। সম্ভবত উত্তমকে তাড়া করে এগিয়ে আসতে দেখেই মনের স্থিরতা হারাল, আজকের খেলায় এই প্রথমবার। বলটা মাঝমাঠের দিকে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারত। অথবা টাচলাইনের বাইরে। আর পাস নেওয়ার জন্যে জেকব তো কাছাকাছিই ছিল। সুপ্রকাশ এসব কিছুই না দেখে ব্যাকপাস করল নাসিমকে। পাসটা কোণাকুণি এবং একটু জোরের ওপরেই ছিল। নাসিম এরকম হঠাৎ গোলের তিনকাঠির মধ্যে জোরালো ব্যাকপাসের আশঙ্কা করেনি। একটু বাঁ-পাশে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ছিল ও। হঠাৎ ডান পায়ে ভর ফিরিয়ে এনে কোণাকুণি যাওয়া বলটায় হাত লাগাতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল। প্রসারিত হাতের নাগালের বাইরে দিয়ে ডান পোস্টের পাশ ঘেঁসে বল ঢুকল জালে। মাঠে বয়ে গেল রাহুমুক্তির আনন্দের সুনামি। আমি চোখ বুজলাম তীব্র শক ও শোকে। রেফারির খেলাশেষের বাঁশিটা খেয়াল করিনি। উল্লাসে মুখর ইস্টবেঙ্গল সমুদ্রে রামমোহনের ভেসে যাওয়াটাও নজরে আসেনি। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম কিছুক্ষণ। রামমোহন আমার সঙ্গে এরকম করতে পারল!
রাতটা কালো হয়েই কাটল। সকালের চায়ে চুমুক দেওয়ার আগেই মন শান্ত হয়ে এসেছে অনেকখানি। হঠাৎ খেয়াল হল, রামমোহন একটা মূলসূত্রের কথা বলেছিল—কোনো ইটি এমন কিছুই করবে না যা সহজ স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে যায়। কালকের খেলায় সহজ স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহ পুরোপুরি ইস্টবেঙ্গলের অনুকূলে ছিল। গোল হলে তা একশো ভাগ ওদের পক্ষেই যাওয়ার কথা। আমি গোল চেয়েছি। গোল হয়েছে। সুপ্রকাশ নয়, ইটি নয়, আমিই দায়ী! নাকি এটা নিছক সমাপতন, সুপ্রকাশেরই ভুল? রামমোহন নিজেই কি ইটি?
জানা হয়নি এসব প্রশ্নের উত্তর। কারণ রামমোহন রায়ের সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়নি।
Tags: অমিতাভ মুখোপাধ্যায়, অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, মজার কল্পবিজ্ঞান
There are a couple of anachronisms in the story; the editors could have given a bit more attention. The story starts in 1992, but the character Rammohan Roy mentions Messi, (Cristiano) Ronaldo and his goal against Man U scored in 2013. Messi and Ronaldo came into prominence in the mid 2000s. If for arguments sake we accept that the ET could time travel, then the narrator should have at least asked, Messi who? Ronaldo who?