ইচ্ছেপূরণ
লেখক: সন্দীপ চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
চোখ খুলেই আবার বন্ধ করে নিলেন অমলবাবু। এত আলো! একটু পরে আবার সাবধানে চোখ খুললেন। হাসি হাসি মুখে একটা মেয়ে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে। ওর পোশাক দেখে চিনতে পারলেন অমলবাবু। নার্স। এবং তিনি হাসপাতালে। তার মানে এখনও উনি বেঁচে আছেন? কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। নাকি তিনি স্বপ্ন দেখছেন?
‘সব ঠিক আছে তো?’ আরও একটা মহিলার গলা কানে এল। গলায় উদ্বেগের ছাপ।
‘পারফেক্ট,’ বলেই নার্স ওঁর পা ধরে একরকম ঝুলিয়েই হাতে তুলে নিল। তারপর দুই হাতে ধরে এগিয়ে নিয়ে গেল।
বেশ ঘাবড়ে গেলেন অমলবাবু। এটা কী হচ্ছে? একটা রোগা পটকা নার্স কিনা ওঁকে…
ইতিমধ্যে ওঁকে এক ক্লান্ত, অবসন্ন অথচ হাসিমুখি মহিলার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে নার্স। অমলবাবু কিছু একটা বলতে গেলেন কিন্তু মুখ থেকে কথা বেরোল না। উনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। বার দুয়েক চোখ পিটপিট করলেন।
মহিলার চুমুর ঠেলায় অস্থির হয়ে ওঠার মাঝেই ধীরে ধীরে সবকিছু বুঝতে পারছেন অমলবাবু। ওঁর আবার জন্ম হয়েছে। আর ওঁকে যে এভাবে চটকাচ্ছে সেই হচ্ছে ওঁর মা। সেই সঙ্গে কত কী কথাও বলছে বিড়বিড় করে। বিশুদ্ধ বাংলায়। অর্থাৎ আবার সেই ভারতে জন্ম হল? তাও বাঙালি বাড়িতে?
হতাশায়, দুঃখে ওঁর ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। অমলবাবু অবাক হয়ে দেখলেন তিনি ডাক ছেড়ে কাঁদছেনও। ইন ফ্যাক্ট, অনেক চেষ্টা করেও তিনি কিছুতেই নিজের কান্না থামাতে পারছেন না। কান্নার চোটে দম আটকে আসছে।
ওঁর কান্নায় অবশ্য আশপাশের সবাই বেশ খুশিই হয়েছে। বাচ্চার কান্নাই তার সুস্থতার প্রমাণ। ওঁর কান্নার মাঝেই ওঁকে বেশটি করে পরিষ্কার করে একটা তোয়ালেতে বেঁধে আবার শুইয়ে দেওয়া হল। কেঁদে কেঁদে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন অমলবাবু। এবার চুপ করে শুয়ে রইলেন। উত্তেজিত হলে চলবে না। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
কিন্তু মাথা ঠান্ডা রাখার জো আছে? একটু পরেই লাইন দিয়ে একদল লোক এসে ওনাকে এর কোল থেকে ওর কোলে লোফালুফি আরম্ভ করে দিল। তার সঙ্গে আদরের নামে অত্যাচার আর যাচ্ছেতাই সব মন্তব্য! সবচেয়ে মুশকিলের ব্যাপার হচ্ছে অমলবাবু অনেক চেষ্টা করেও লোকগুলোর ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারছেন না। কথা বলতে গেলেই গলা থেকে কান্না বেরিয়ে আসছে। নিজের জিভের ওপর কোন কন্ট্রোলই নেই। আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল।
গতজন্মে ওঁর অফিসে একটা কথা খুব চালু ছিল—দশটা বাজলে, পাঁচটাও বাজবে। অর্থাৎ কিনা সারাদিন ধরে যতই হ্যাঙ্গাম হোক না কেন, একসময় ছুটি হবেই। এক্ষেত্রেও তাই হল। অমলবাবুকে মুন্তু সোনা, গোবর গণেশ, গাপ্লুস, টুমটুমি ইত্যাদি নানান বিদঘুটে নামে ডেকে ডেকে সবাই ক্লান্ত হয়ে শেষমেশ আবার বিছানায় শুইয়ে দিল।
হাঁপ ছেড়ে বাচলেন অমলবাবু। একটা ঝড় বয়ে গেল। এবার একটু চিন্তা করা যাবে। গতজন্মের শেষের দিকের কিছু দৃশ্য মনে করার চেষ্টা করলেন অমলবাবু। অসুবিধে হল না। ২০৪১ সাল, ১২ অক্টোবর। সেদিন পাক্কা তিন মাস ধানাই পানাইয়ের পর ওঁর মৃত্যুর দরখাস্ত মনজুর হল। মেল পেয়েই অমলবাবু সঙ্গে সঙ্গে আলিশাকে কল করেছিলেন। মেয়েটি বহুদিন রিসার্চ করে একরকম পদ্ধতি বের করেছে যার সাহায্যে মানুষের এই জন্মের শেষ ইচ্ছা পরের জন্মে পূর্ণ হবে। তবে এই পদ্ধতির পেটেন্ট পাওয়ার জন্যে আলিশার কয়েকটি মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ লাগবে যে স্বেচ্ছায় নিজের ওপর তার পদ্ধতি প্রয়োগ করার অনুমতি দেবে।
প্রথমে ওর কথা শুনে হেসেছিলেন অমলবাবু। প্রমাণ কি? একটা মানুষের শেষ ইচ্ছে না হয় রেকর্ড করা গেল। কিন্তু তারপর? সে কোথায় জন্ম নিচ্ছে সেটাই বা কে বের করবে আর তার ইচ্ছে পূর্ণ হল কিনা তাই বা কে ভেরিফাই করবে?
কিন্তু মেয়েটা দমেনি। মৃত্যুর পর নাকি আত্মা কোয়ান্টাম অবস্থায় থাকে। তার পরের জন্ম কোথায় হবে সেটা প্রবালিটির ওপর নির্ভর করে। সেই আত্মার ওপর ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয় যাতে তার গতিবিধির খোঁজ পাওয়া সম্ভব। কোয়ান্টাম এন্ট্যাংগেল্ডমেন্টের সিদ্ধান্ত ব্যাবহার করে এই ট্যাগ করা হয়। অর্থাৎ যে মানুষ আজকে মারা গেল, সে মৃত্যুর পর কবে, কোথায় জন্মাল তার ইনফরমেশন তার আত্মার সঙ্গে এন্ট্যাংগেল্ড কণা ট্র্যাক করলেই পাওয়া যাবে। ব্যাপারটা ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে আরও কিছু প্রশ্ন করেছিলেন অমলবাবু। কিন্তু এর বেশি ডিটেল দিতে অস্বীকার করে আলিশা। পেটেন্ট পাওয়ার আগে এইসব তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে পরে সমস্যা হতে পারে।
তারপর কাঁচুমাচু মুখ করে বলেছিল, ‘স্যার, এতে তো আপনার হারানোর কিছুই নেই। যাওয়ার আগে না হয় আরও একজনের উপকারই করে গেলেন। যদি সত্যিই আপনার শেষ ইচ্ছে ফলে যায়, সেক্ষেত্রে লাভ তো আপনারই।’
শেষ অব্দি অমলবাবু রাজি হয়েছিলেন আলিশার প্রজেক্টে ভলেন্টেয়ার হতে। মেয়েটা ঠিকই বলেছে, ওঁর হারাবার কিছু নেই। বরং আলিশার কথা সত্যি হলে ওঁর নিজের আর আলিশার—দু’জনের পক্ষেই উইন-উইন।
অমলবাবুর কল পেয়ে নির্দিষ্ট সময়ে এবং জায়গায় হাজির হয়ে গেছিল আলিশা। অমলবাবু বিপত্নীক। পরিবার বলতে ওঁর দুই মেয়ে, তাদের স্বামী, তিন নাতি। সবাই হাজির হয়েছিল সেদিন নার্সিং হোমে। সঙ্গে দুই প্রাক্তন কলিগ এবং জনাচারেক প্রতিবেশী। সবার সঙ্গে শেষবারের মতো চুটিয়ে আড্ডা মেরে ঘড়ির দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন অমলবাবু। সময় হয়ে এসেছে। এবার অন্য শরীর, অন্য জগৎ।
নার্সিং হোমের এক কোনায় ‘ইটারনাল স্লিপ’ লেখা একটা কামরা। ওঁর কাগজপত্র দেখে নার্স এসে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে দিয়ে ওঁকে সেই কামরায় ঢোকাল। ওখানে অপেক্ষা করছিল আলিশাও। হাতে একটা সাঁতারুদের টুপির মতো বস্তু, তার সাইড থেকে সরু সরু কয়েকটা তার বেরিয়ে আছে। এর থেকেই নাকি মানুষের শেষ চিন্তা রেকর্ড হয়ে যাবে তার বিশেষ প্রযুক্তির ট্যাবে।
তবে একটু ঝামেলাও হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতীয় ডাক্তার কিছুতেই সেই রুমের ভেতর থাকতে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না আলিশাকে। ওঁর একটাই কথা—নিয়ম নেই।
আলিশা অবশ্য কাঁচা কাজ করে না। শান্ত মুখে সে তার পারমিশানের কপি ধরিয়ে দিয়েছিল ডাক্তারের হাতে। শুধু ওখানে থাকাই নয়, অমলবাবুকে টুপি পরানোর পারমিশানও দেওয়া রয়েছে সেই কাগজে।
‘কিন্তু পেশেন্ট যদি আপত্তি করে…’
‘এই হচ্ছে পেশেন্টের কন্সেন্ট।’ বলে আরও একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়েছিল আলিশা।
এবার চুপ করে গেছিলেন ডাক্তার মূর্তি। শুধু আড়চোখে একবার অমলবাবুর দিকে তাকিয়েছিলেন। আলিশাও চটপট অমলবাবুর মাথায় টুপি পরিয়ে দিয়ে ওঁকে শান্ত হয়ে নিজের শেষ ইচ্ছের ওপর কনসেনন্ট্রেট করতে বলেছিল। তিনি যত ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে এখন চিন্তা করবেন, তত ওঁর শেষ ইচ্ছে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
টুপি পরে চোখ বন্ধ করে মনকে নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করেছিলেন অমলবাবু। পরের জন্মে তিনি যে-কোনো একটা উন্নত দেশে জন্মাতে চান। না, শুধু উন্নত দেশ বললে হবে না। আরও স্পেসিফিক হতে হবে। আমেরিকা? উঁহু! দেশটাকে তার ঠিক পছন্দ হয় না। বড্ড অহংকারী। অন্য দেশের বাসিন্দাদের মানুষ বলেই গণ্য করে না। তাহলে সুইজারল্যান্ড? নাকি নরওয়ে অথবা হল্যান্ড? নিউজিল্যান্ডও খুব সুন্দর দেশ।
আর অবশ্যই বড়োলোক বাড়িতে জন্মাবেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে ইঁদুর দৌড় আর ভালো লাগে না। এবার একটু রিল্যাক্সড লাইফ লিড করতে চান। নিজের ইচ্ছেমতো সাবজেক্ট পড়বেন, চাকরি-বাকরির কোনো চিন্তা থাকবে না। সুন্দর, নির্মল আবহাওয়ায় থাকবেন। চারিদিকে গাছপালা, পাহাড়, ফুল।
চিন্তা করতেই এত ভালো লেগেছিল। তখন মনে হয়েছিল খুব ভালো হয় যদি ওঁর এই জীবন, এই চিন্তাগুলোও পরের জন্মে মনে থাকে। দুই জন্মের কনট্রাস্ট উপভোগ করতে পারবেন তাহলে। ইচ্ছেপূরণ হলে একবার আলিশার সঙ্গে দেখা করে ধন্যবাদও জানাবেন।
এর মধ্যে কখন যে ডাক্তার মূর্তি এসে ওঁকে ইনজেকশন দিয়ে গেছেন অমলবাবু খেয়ালই করেননি। খেয়াল হল যখন উনি উপলব্ধি করলেন যে আর তিনি নিজের দুই চোখ খোলা রাখতে পারছেন না। চোখ ফাইনালি জুড়িয়ে আসার আগে উনি দেখেছিলেন আলিশা ওঁর দিকে ডান হাতের বুড়ো আঙুল তুলে হাসিমুখে বলছে, ‘অল দ্য বেস্ট, অমল। উইল মিট আগেন।’
ব্যাস!
তারপর এই।
এদিক ওদিক তাকালেন অমলবাবু। একবার যে নিজেকে ঠিক করে দেখবেন তারও উপায় নেই। ওঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে তোয়ালে দিয়ে বেঁধে গেছে নার্স। গায়ের শক্তিও এতই কম যে একটু নড়াচড়াও করতে পারছেন না। দুত্তেরি! বিরক্ত হয়ে ঘ্যানঘ্যান করে উঠলেন অমলবাবু।
কথা যখন বলতে পারছেন না তখন হাঁটতে পারবেন এমন সম্ভাবনাও নেই। লিখতে পারবেন কি? খুব সামান্য একটু আশা হল। কিন্তু লিখবেনই বা কী? দেখলে সবাই হাসাহাসি করবে। জন্মেই লিখতে লেগেছে—এমন কথা কেউ কোনোদিন দেখেছে না শুনেছে? তা ছাড়া নিজেকে জাতিস্মর প্রমাণ করে একটা তামাশায় অংশগ্রহণ করার কোনো ইচ্ছে নেই।
এর মধ্যে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন অমলবাবু। ঘুম ভাঙল একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখে। উনি পাহাড়ের চুড়ো থেকে পড়ে যাচ্ছেন। হাত-পা ছুড়ে বাঁচার চেষ্টা করতে করতেই ঘুম ভেঙে গেল। হাত-পা অবশ্য এখনও বাঁধা থাকলেও এটা বুঝতে পারছেন যে তিনি শূন্যে দুলছেন। আর তাঁর একেবারে নাকের সামনে একটা গুঁফো মুখ দাঁত বের করে হাসছে।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন অমলবাবু।
‘কাঁদে না, কাঁদে না। বাবাকে দেখে অত ভয় পায় না। তোমাকে আমি লজেন কিনে দেব, পাপি কিনে দেব…’ এইসব উদ্ভট কথা বলতে বলতে ওঁকে আবার দোলাতে লাগল সেই গুঁফো লোকটা। দুলতে দুলতেই অমলবাবু দেখলেন ওঁর এই জন্মের মা আহ্লাদি মুখ করে বেডে শুয়ে শুয়ে ওঁর ওপর এই অত্যাচার দেখছে।
আলিশাকে একবার হাতের সামনে পেলে হয়। কোথায় নরওয়ে – সুইজারল্যান্ড – নিউজিল্যান্ড, আর কোথায় সেই বাংলার লোয়ার মিডল ক্লাস ফ্যামিলি। তার ওপর স্যাডিস্ট বাবা-মা। এই তো সবে শুরু। আরও কত যে কষ্ট আছে কপালে!
দিন দুয়েকের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হল অমলবাবুকে। এখন একটু একটু করে এই জীবনে অভ্যেস হয়ে আসছে। মায়ের বুকের দুধ খাও আর ঘুমোও—কাজ বলতে এই। আর সমস্যা হলে কাঁদো। যত বড়ো সমস্যা, তত জোরে কান্না।
এর মধ্যে একটা ডাকনামও পেয়েছেন অমলবাবু—টুকু। ওঁর একেবারেই পছন্দ হয়নি। কত ভালো ভালো ডাকনাম দেওয়া যায়। তা নয়, টুকু। কিন্তু কাকেই বা বলবেন আর কেই বা শুনবে!
কয়েক দিন এভাবেই পেরোল। এখন আর ওঁকে সবসময় তোয়ালে বেঁধে রাখা হয় না। কিন্তু তাতে খুব যে সুবিধে হয়েছে, তা নয়। এখনও ওঁর নিজের হাতের-পায়ের ওপর কন্ট্রোল প্রায় নেই বললেই চলে। সবচেয়ে লজ্জার ব্যাপার – নিজের পায়খানা, পেচ্ছাপের ওপরও নেই। হতাশায় মাঝে মধ্যে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। খুব যখন রাগ হয় তখন নিজের মাথার চুল ছেঁড়েনও। তারপর একদিন দেখলেন ওঁর বাবা সেই চুল ছেঁড়ার দৃশ্য খিক খিক করে হাসতে হাসতে মোবাইলে রেকর্ডিং করছে। আর চিল্লাচ্ছে, ‘সন্ধ্যা, ও সন্ধ্যা, একবার তোমার টুকুর কাণ্ড দেখে যাও। এখন থেকেই এত রাগ – এই ছেলে তো বড়ো হলে হিটলার হবে।’
তারপর থেকে চুল ছেঁড়া বন্ধ করেছেন অমলবাবু। লোক হাসিয়ে কী লাভ? কিন্তু বাবা হয়তো ভিডিয়োটা অলরেডি ভাইরাল করে ফেলেছে। অমলবাবু এখনই বুঝে গেছেন এই লোকটার সঙ্গে ওঁর বনিবনা হবে না। বড়ো হলেই সোজা বৃদ্ধাশ্রম পাঠিয়ে দেবেন লোকটাকে।
একবার হাতের কাছে পেয়েছিলেন। এবার আর নিজের নয়, তার চুলই আঁকড়ে ধরে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন অমলবাবু। কিন্তু ছোট্ট গ্রিপ, গায়ের জোরও খুব কম। হাসতে হাসতে চুল ছাড়িয়ে ওঁর পেটে নিজের গোঁফওয়ালা মুখ খুব করে ঘষে কাতুকুতু দিয়ে দিয়েছিল বাবা। শত বিরক্তির মধ্যেও হেসে ফেলেছিলেন অমলবাবু।
বরং মা’কে মোটামুটি পছন্দ হয়েছে। সবসময় ওঁকে নিয়েই সে ব্যস্ত। প্রথম প্রথম অমলবাবুর লজ্জা করত খুব। বিশেষ করে দুধ খাওয়ার আর স্নান করার সময়। এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। যখন কয়েক মিনিটের জন্যে মা’কে দেখতে পান না তখন মায়ের ওপর খুব অভিমানও হয়। চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করেন তখন অমলবাবু।
তিনি বুঝতে পারেন যে নিজের বদ মেজাজের জন্যে অলরেডি তার একটা খারাপ রেপুটেশন তৈরি হয়ে গেছে। কথায় কথায় চিৎকার আর কান্না তো আছেই, তার ওপর সবাই বলে মুখে বাচ্চাটার নাকি হাসি নেই একেবারেই। অন্য বাচ্চারা কত হাসে, হাত-পা ছুড়ে খেলা করে। এর সবকিছুতেই বুড়ো বুড়ো ভাব।
তা সেটায় আর অস্বাভাবিক কী আছে? ওঁর মৃত্যুর সময় প্রায় সাতাত্তর বছর বয়স হয়েছিল। সেই হিসেবে তিনি তো বুড়োই। তা ছাড়া ওঁর জন্মের পর থেকে হাসি পাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটলে তো তিনি হাসবেন?
গত জন্মে নাস্তিক ছিলেন অমলবাবু। কিন্তু এখন মাঝে মাঝে ভগবানকে ডাকেন। তিনি বুঝেছেন নিজের শক্তি যত কম হয় মানুষের তত ভগবানের ওপর নির্ভরতা বাড়ে। এভাবে কতদিন চলবে? এক যদি উনি সাধারণ শিশু হতেন তাহলেও কথা ছিল। কিন্তু উনি দেখছেন, বুঝছেন সব, কিন্তু কিছু করতে বা বলতে পারছেন না। এই যন্ত্রণা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। এর থেকে মুক্তি পেলে এই জন্মে তিনি ভগবানকে মানবেন, মনে মনে এই শপথ করে রেখেছেন।
কিছুদিন পর একদিন একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটল। সেদিন মা স্নান টান করিয়ে, কপালে কাজলের টিপ পরিয়ে, দুই পাশে বালিশ দিয়ে শুইয়ে রেখে অন্য ঘরে কিছু কাজ করছিল। শুয়ে শুয়ে অমলবাবু আনমনে নিজের বুড়ো আঙুল চুষছিলেন। এমন সময় টুং টাং শব্দে বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠল। এতে অবশ্য তার কিছু করার নেই। মা আছে। সেই দরজা খুলবে।
‘নমস্কার! আমি সরকারি হাসপাতাল থেকে আসছি। আপনার সদ্যজাত শিশুর জন্যে…’
কান খাঁড়া হয়ে গেল অমলবাবুর। খুব চেনা কণ্ঠস্বর। কিন্তু ওঁকে ভেতরের ঘরে শুইয়ে রেখে দিয়েছে মা, কিচ্ছুটি দেখবার উপায় নেই। উত্তেজিত হয়ে শুয়ে শুয়েই হাত-পা ছুড়তে লাগলেন অমলবাবু।
‘আসুন না, বাচ্চা এই ঘরে রয়েছে। ওই দেখুন, কেমন হাত-পা ছুড়ছে।’ সঙ্গের ভদ্রমহিলাকে নিয়ে ভেতরের ঘরে মা ঢুকল।
‘হাউ কিউট!’ বলে ওর পাশে এসে বসল আলিশা। গলা শুনেই টের পেয়েছিলেন অমলবাবু, এবার চক্ষু কর্ণের বিবাদ ঘুচল।
মেয়েটাকে অনেক কিছু বলার রয়েছে অমলবাবুর। কিন্তু ওঁর গলা থেকে ‘গ্লুক গ্লুক’ ছাড়া আর কোনো শব্দ বেরোল না। আর সবচেয়ে ঝামেলার ব্যাপার হচ্ছে ওঁর বুক ফুটে কান্না উঠে আসছে। বেশ তেড়েই আসছে। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে থামাতে পারছেন না অমলবাবু।
‘চা খাবেন?’ মা জিজ্ঞেস করল আলিশাকে।
‘যদি খুব অসুবিধে না হয়…’
চা করতে চলে গেল মা। বিছানায় শুয়ে কোনোরকমে কান্না চেপে ছটফট করতে লাগলেন অমলবাবু। হাসিমুখে ওর পাশে এসে বসল আলিশা। হাতে সেই তার ঝোলা টুপি—তবে আকারে একটু যেন ছোটো।
ওঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল আলিশা, ‘অমল, কেমন আছেন? দেখলেন তো ঠিক পৌঁছে গেলাম। আপনি আমার পাঁচ নম্বর সাকসেস। এবার পেটেন্ট পাওয়া আটকায় কার সাধ্যি।’
সাকসেস? ইচ্ছে করলেই অমলবাবুর এখন আলিশার চুল ধরে নাবিয়ে আনতে পারেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলেন তিনি। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও মুখ থেকে ‘বু বু বু বু…’ ছাড়া কোনো শব্দই বেরোচ্ছে না।
‘দাঁড়ান, আপনার কথা যাতে বুঝতে পারি তার ব্যবস্থা করছি। ওভাবে হাত-পা ছুড়বেন না। আমি ক্যাপটা পরিয়ে দিচ্ছি। এবার আপনি যা বলতে চান সেটা শান্ত মাথায় চিন্তা করুন, তাহলেই এই ট্যাবে আপনার মনের কথা ফুটে উঠবে।’ বলে অমলবাবুকে টুপি পরিয়ে নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ছোটো সাইজের ডায়েরির আকারের ট্যাব বের করে সেটা অন করল আলিশা।
ও যে ওঁর কী সর্বনাশ করেছে সেই কথাটা মেয়েটাকে গুছিয়ে শোনাতে হবে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন অমলবাবু।
‘এবার বলুন, কেমন লাগছে আপনার? খুশি তো?’
‘খুশি? আপনি বলেছিলেন আমার শেষ চিন্তা অনুযায়ী জন্ম হবে। অথচ…’ কথাগুলো উত্তেজনায় জট পাকিয়ে গেল এরপর। ইচ্ছে না থাকলেও অটোম্যাটিক্যালি অমলবাবুর হাত-পা আবার চলতে শুরু করে দিয়েছে।
‘আহা! শান্ত না হলে তো কিছুই বুঝতে পারব না। কিন্তু আপনার শেষ ইচ্ছে তো এটাই ছিল? এই যে দেখুন, পড়ে শোনাচ্ছি, আমার যেন এই জন্মের কথা পরের জন্মে মনে থাকে, আলিশার সঙ্গে দেখা হয়—কি, মনে পড়েছে?’
আলিশার হাতের ট্যাবের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন অমলবাবু। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে বিষম লেগে গেল। আবার তার নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
‘ওরে আসছি। এক মিনিটের জন্যে এসেছি, অমনি ছেলের কান্না শুরু হয়ে গেল। চা-টা ছেঁকে নিয়েই আসছি।’
মুচকি হেসে অমলবাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে আলিশা বলল, ‘যা হয়ে গেছে তা তো আর চেঞ্জ করা যাবে না। তবে এখন আমি একটা কাজ করতে পারি। আপনি চাইলে এক্ষুনি আপনার গতজন্মের স্মৃতিশক্তি উড়িয়ে দিতে পারি এই ট্যাবের সাহায্যে। ওড়াব?’
থতমত খেয়ে কান্না থামিয়ে ফেললেন অমলবাবু। সেটা যদি হয় তাহলে মন্দ হয় না। এই ক’দিনে এটুকু বুঝেছেন যে সদ্যোজাত শিশুর শরীরে বুড়ো মানুষের স্মৃতি নিয়ে বাস করা নরক বাসের সমান। তার চেয়ে বরং একটা সাধারন শিশু হয়ে বাঁচা অনেক ভালো।
‘ওকে! হেয়ার উই গো—ওয়ান টু থ্রি।’ বলে ট্যাবের মধ্যে কী যেন একটা বোতাম টিপল আলিশা আর সঙ্গে সঙ্গে এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্যে অমলবাবুর মাথার ভেতর দপ করে একটা উজ্জ্বল আলো জ্বলেই নিবে গেল।
সন্ধ্যা একটা ট্রেতে চা আর ডালমুট নিয়ে দরজার কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। হাসপাতালের ম্যাডাম ওঁর ছেলেকে দুই হাতে তুলে ধরে আছেন আর তার দিকে চেয়ে খিলখিল করে হেসে সারা হচ্ছে তার টুকু।
এই প্রথম নিজের ছেলেকে এভাবে হাসতে দেখল সন্ধ্যা। তার চিন্তা হয়ে গেছিল যে বাচ্চাটার হয়তো কোনো মানসিক অসুখ আছে। আজকাল চারিদিকে যা সব শোনা যায়। ইস! টুকুর বাবা যদি এই দৃশ্য দেখত।
টুকু ওদিকে হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে খিলখিল করে হেসেই চলেছে। যেন অনেক দিনের বকেয়া হাসি সে আজ হেসে নিচ্ছে প্রাণ খুলে।
Tags: অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান গল্প, মজার কল্পবিজ্ঞান, সন্দীপ চৌধুরী