কৃষ্ণ উপকূলের সম্রাজ্ঞী
লেখক: রবার্ট ই. হাওয়ার্ড, অনুবাদ: সায়ক দত্ত চৌধুরী
শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ
মানো তুমি, বসন্তের সবুজ কিশলয়
রঙ বদলায় যবে মাখে, হেমন্ত বাতাস?
মানো তবে, এ মন আছে কুমারী হয়েই
তার তরে, মিটাবে যে মোর উষ্ণ আশ।
-বেলিতের গান।
জাহাজঘাটার দিকে যাওয়ার ঢালু রাস্তায় ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ ধ্বনিত হচ্ছিল। সভয়ে চিৎকার করতে করতে রাস্তার দুপাশে ছিটকে যাচ্ছিল যারা, বিদ্যুৎ চমকের মতো দেখতে পাচ্ছিল ঘোর কৃষ্ণবর্ণের অশ্বের উপর এক বর্মপরিহিত যোদ্ধার অবয়ব, প্রচন্ড গতির ফলে যার পিঠের টকটকে লাল আলখাল্লা পতাকার মতো উড়ছে। বেশ কিছুটা পিছনে উপরের রাস্তা থেকে ভেসে আসছিল অনুসরণকারীদের চিৎকার ও অশ্বক্ষুরধ্বণি। কিন্তু এই আরোহীটি একবারের জন্যেও পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল না। জেটির একেবারে শেষপ্রান্ত অবধি প্রচন্ড গতিবেগে এসে লাগামের হেঁচকা টানে সে তার ঘোড়াকে থামালো। সেই সময়েই উচ্চ গলুইবিশিষ্ট, চওড়া খোলের, মাঝারি মাপের একটা জাহাজ ঘাট ছেড়ে যাচ্ছিল তার ডোরাকাটা পাল তুলে। তার নাবিকেরা অবাক হয়ে দেখল অশ্বারোহীটি একটা বিশাল লাফ দিয়ে জেটি থেকে জাহাজের পাটাতনে এসে পোঁছল। শক্তপোক্ত চেহারার কালো দাড়িগোঁফ ওলা কর্ণধার ব্যস্ত ছিল যাতে জাহাজটা নির্বিঘ্নে বন্দরসীমা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারে তার তদারকিতে। এইসময় সে আগন্তুকের কান্ড দেখে সরোষে চেঁচিয়ে উঠল,
“এইও, তুমি হঠাৎ এখানে কোত্থেকে উদয় হলে?”
“না থেমে সিধে চল।” রক্তঝরা তরবারি হাতে আগন্তুক একটা হিংস্র ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল।
“কিন্তু আমরা তো কুশের উপকূলের দিকে চলেছি।” কান্ডারী প্রতিবাদ জানিয়ে বলল।
“তাহলে আমিও কুশেই যাচ্ছি। বলছি তো, জলদি কর।” অনুপ্রবেশকারী গর্জে উঠল।
জাহাজঘাটার কাছের রাস্তায় বেশ কয়েকজন অশ্বারোহী সৈনিককে দেখা গেল। তাদের পিছনে হাঁফাতে হাঁফাতে ঘর্মাক্তকলেবরে এসে পৌঁছচ্ছে তীরন্দাজের দল তাদের দীর্ঘ ধনুক নিয়ে।
“জাহাজভাড়া দেওয়ার মত পয়সাকড়ি ট্যাঁকে আছে তো?” জাহাজের কান্ডারী জিজ্ঞেস করল।
“আমি আমার যাবতীয় ভাড়া এই ইস্পাত দিয়েই মেটাই।” বর্মাবৃত যোদ্ধাটি তার বিরাট অসি আস্ফালন করে বলল, “ক্রমের দিব্যি, তাড়াতাড়ি চল, নয়তো আমি এখানে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবো।” তার তরবারি সূর্যালোকে ঝলকিয়ে উঠল।
কর্ণধার মানুষ ভালোই চেনে। সে অসিযোদ্ধাটির তাম্রবর্ণ, ক্ষতচিহ্ন রেখাঙ্কিত, বেপরোয়া মুখের দিকে একবার তাকিয়েই নির্দেশ দিল। জাহাজ তীরভূমির দিকে আছড়ে পড়া ঢেউ কেটে দ্রুত উন্মুক্ত সাগরের অভিমুখে এগিয়ে চলল। শান্ত সাগরে পৌঁছাতেই ছন্দবদ্ধ হল বৈঠার দোলন, মৃদুমন্দ বাতাসে ফুলে উঠল পাল, হাল্কা তরীটি গর্বিত হংসীর মতো তরতর করে তার যাত্রাপথে এগিয়ে চলল।
দূরে জাহাজঘাটায় দেখা যাচ্ছিল সৈনিকের দল তরোয়াল উঁচিয়ে আস্ফালন করছে, বোঝাই যাচ্ছিল তারা তীরন্দাজদের দ্রুত শর সন্ধানের নির্দেশ দিচ্ছে যাতে সীমার বাইরে যাওয়ার আগেই পলাতকের ওপর আঘাত হানা যায়।
“ওরা যতই লম্ফঝম্প করুক কত্তা,” যোদ্ধাটি দন্তবিকশিত করে হেসে বলল, “তুমি কিন্তু নিজের রাস্তা ছেড়ে অন্যদিকে যেয়ো না।”
কর্ণধার পশ্চাদ্ভাগের নৌ পরিচালকের উঁচু পাটাতন থেকে নেমে মাল্লাদের বসার যায়গা পার হয়ে জাহাজের মাঝবরাবর এগিয়ে এল। আগন্তুক সেখানে মাস্তুলে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ তীক্ষ্ম, তরবারি প্রস্তুত। কোনরকম ভুল বোঝাবুঝি যাতে না হয় কর্ণধার নিজের লম্বা ছোরাটা থেকে হাত দূরে রেখে তাকে স্থিরচোখে জরিপ করতে লাগল। যুবকটি যথেষ্ট লম্বা চওড়া, পেশিবহুল, ঝলমলে স্বাস্থ্যের অধিকারী। তার পরনে চর্মনির্মিত, শল্কাকৃতি কারুকার্য করা, কৃষ্ণবর্ণের তৈলজ্জ্বল বর্ম। মাথায় ইস্পাতের চকচকে শিরস্ত্রান, যার থেকে দুপাশে দুটি বাঁকানো শৃঙ্গ বেরিয়ে এসেছে। সাগরের হাওয়ায় দুলছে পিঠের রক্তবর্ণের আলখাল্লা। কোমরে সোনালী বকলস ওলা চওড়া সবুজ কোমরবন্ধ যার থেকে ঝুলছে তার দীর্ঘ তরবারি রাখার চর্মকোষটি। শিরস্ত্রানের নিচ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে অবাধ্য ভ্রু স্পর্শ্বকারী কালো কেশরাশি আর তার নিচে দেখা যাচ্ছে দুটি শীতল নীল নয়ন।
“আমাদের যদি একসাথে সমুদ্রযাত্রায় যেতেই হয়,” কর্ণধার বলল, “তবে নিজেদের মধ্যে শান্তি বজায় রাখাটা জরুরি। আমি টিটো। আর্গোস বন্দরের অনুমতি প্রাপ্ত মুখ্য কান্ডারী। আপাতত আমরা কুশের দিকে চলেছি কালো রাজাদের সাথে রঙচঙে পুঁতি, সিল্ক, চিনি আর পিতলের হাতলওলা তরোয়ালের বিনিময়ে হাতির দাঁত, তামার আকরিক, মুক্তো আর ক্রীতদাসের সওদা করতে। “
অসিধারী একবার দ্রুত দূরের ক্রমশ অপসৃয়মান জাহাজঘাটার দিকে চাইল। সেখানে অতিক্ষুদ্র অবয়বগুলোর অসহায় অঙ্গভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল এই দ্রুতগামী জাহাজটিকে পাকড়ানোর জন্য আরো দ্রুতগামী কোন জাহাজ না পাওয়ায় তারা কতটা হতাশ হয়ে পড়ছে।
“আমি কোনান। সিমেরীয়।” সে জবাব দিল। “আমি আর্গোসে এসেছিলাম রাজার সেনাদলে যোগ দিতে। কিন্তু আপাতত কোন যুদ্ধের সম্ভাবনা না থাকায় সে ইচ্ছে পুরণ হল না। “
“সেনারা তোমায় তাড়া করেছিল কেন?” টিটো জিজ্ঞেস করল। “দেখ, এ ব্যাপারে আমার নাক গলানোর খুব একটা ইচ্ছে নেই, তবু ভাবলাম……”
“আরে এটা লুকোনোর মতো কোন ব্যাপারই নয়।” সিমেরীয়টি বলল। “ক্রমের দিব্যি, তোমাদের মত সভ্য লোকেদের সাথে অনেকদিন কাটিয়ে দিলাম, কিন্তু এখনো পর্যন্ত তোমাদের কান্ডকারখানা প্রায় কিছুই বুঝতে পারলাম না।
“হয়েছে কী, গতরাতে একটা সরাইয়ে এক ছোকরা যোদ্ধার প্রেমিকাকে রাজ সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন খুব উত্ত্যক্ত করছিল। কাজেই সে ক্যাপ্টেনটাকে একেবারে নিকেশ করে দিল। কিন্তু তোমাদের হতচ্ছাড়া দেশে কী এক আজব নিয়ম আছে, দোষ করলেও রাজ সৈন্যদের নাকি মারা যাবে না। তাই ছেলে মেয়ে দুটো পালাল। যেহেতু সবাই দেখেছে কাল ওদের সাথে আমি পানাহার করছিলাম, আজ সকালে বিচারশালায় আমার ডাক পড়ল। বিচারক আমায় জিজ্ঞেস করল ওরা কোথায় লুকিয়ে আছে। আমি বললাম যেহেতু ওরা আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল আমি ওদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। কথাটা শুনে ওখানে যারা ছিল তারা কেন জানি না রেগে গেল। বিচারক আমাকে অনেকক্ষণ ধরে রাষ্ট্রের প্রতি, সমাজের প্রতি আমার কর্ত্তব্য ফর্ত্তব্য নিয়ে ভ্যাজ ভ্যাজ করে জ্ঞান ট্যান দিল যার অর্ধেক আমি বুঝতেই পারলাম না। আমাকে নাকি বলতেই হবে ওরা কোথায় আছে। একে আমার কথাটায় ওরা গুরুত্ব দিচ্ছে না, তার ওপর অত বকবক শুনতে হচ্ছে বলে মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছিল।
“তাও আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছিলাম । তারপর ঐ বিচারকটা বলল যেহেতু আমি ওদের কথা মানছি না, আমি নাকি বিচারশালাকে অপমান করছি, তাই আমাকে হাজতে ফেলে রাখবে যতক্ষন না পর্যন্ত আমি আমার বন্ধুদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি। তখন আমি বুঝলাম কোন শয়তান পাগলদের পাল্লায় আমি পড়েছি। তাই আমার তরোয়াল দিয়ে বিচারকের মুন্ডুটা দিলাম দু আধখানা করে। তারপর তরোয়াল ঘোরাতে ঘোরাতে রাস্তা সাফ করে বাইরে এসে দেখি এক সেনা সর্দারের কালো ঘোড়াটা বাঁধা আছে। ওটাকে আমি জাহাজঘাটার দিকে দৌড় করালাম, কারণ জানতাম বন্দর ছেড়ে যাচ্ছে এমন কোন না কোন জাহাজ ঠিক পাবো যাতে চড়া যাবে।”
“বেশ বেশ,” টিটো সন্তুষ্ট হয়ে বলল, “সত্যি কথা বলতে কী, বেশ কয়েকবার কয়েকটা বড়লোক ব্যবসায়ীর সাথে ঝামেলা হওয়াতে বিচারশালায় আমায় এমন হেনস্থা করা হয়েছে যে ওদের প্রতি আমার কোন সহানুভূতিই নেই। যদি এই বন্দরে আমাকে আবার জাহাজ ভেড়াতে হয় তখন হয়তো আমায় জবাবদিহি করতে হবে কেন আমি তোমায় সমেত সমুদ্রে পাড়ি দিলাম। সে নাহয় আমি প্রমাণ করে দেব আমাদের ভয় দেখিয়ে বাধ্য করা হয়েছিল। আপাতত তুমি তোমার তরোয়াল খাপে রাখতে পারো। আমরা শান্তি প্রিয় নাবিক, তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কোন রাগ ক্ষোভ নেই; বরং তোমার মত একজন শক্তিশালী যোদ্ধা জাহাজে থাকলে আমাদেরই লাভ। আপাতত চলো, পিছ পাটাতনে ওঠা যাক; ওখানে বেশ ভালো পরিমানে সুরা মজুত করে রাখা আছে।“
“বাঃ, এ তো খুব ভালো খবর।” সিমেরীয়টি সাথে সাথেই তার অসি কোষবদ্ধ করে বলল।
আর্গাস একটা মাঝারি মাপের শক্তপোক্ত জাহাজ। জিঙ্গারা আর আর্গোসের দক্ষিন উপকূল বরাবর যেসব বানিজ্য তরীগুলো তটভাগের কাছাকাছি শহরগুলোয় যাওয়া আসা করত এক্কেবারে সে রকম। ওগুলোর মতই সাধারণত গভীর সমুদ্রে যেতো না। এর পশ্চাদভাগ, বিশেষত পিছ পাটাতন ছিল বেশ উঁচু। অগ্র গলুইয়ের অংশটাও ছিল উঁচু আর বাঁকানো। এর মধ্যভাগ ছিল চওড়া যা নিখুঁতভাবে সামনে ও পিছনে বাঁক নিয়েছে। পিছন দিকের পরিচালক পাটাতনেই জাহাজ নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা রয়েছে। ডোরাকাটা পালের সাহায্যেই প্রধানত সেটা সাগর পাড়ি দিত। তবে খাঁড়ি, নদীতে ঢুকলে বা বাতাস পড়ে গেলে লম্বা দাঁড়ের সাহায্যেও সেটা এগিয়ে যেতে পারত। দাঁড় ছিল মোট দশটা। বাঁয়ে ও ডানদিকে পাঁচটা করে। জাহাজের মাঝবরাবর মাল্লাদের বসার যায়গা ছিল। সেখানে বসেই তারা দাঁড় টানত। দামী মালপত্র সব থাকত জাহাজের খোলের মধ্যে। নাবিকেরা ঘুমোত প্রধানত জাহাজের সামনের দিকে খোলা পাটাতনে। খারাপ আবহাওয়ায় অবশ্য তারা মাল্লাদের বসার যায়গার কাছে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে নিতে পারত। কুড়ি জন মাঝি মাল্লা, তিন জন সারেং আর কর্ণধার, এই ছিল জাহাজের মোট নাবিকের সংখ্যা।
তো; আর্গাস দক্ষিণ উপকূল বরাবর পাড়ি জমালো। আবহাওয়া ছিল ঝকঝকে পরিস্কার। বাতাসও ভালোই বইছিল। তবে সূর্য যেন আগুন ঝরাচ্ছিল। তাই পাল আর সামনের সোনালী অংশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে আচ্ছাদনীগুলো ছিল, সেগুলোকে খাটানো হল।
শেম এর তটরেখা দেখা গেল। দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউখেলানো তৃণভূমিতে দূরে দেখা গেল নগরগুলির গগনচুম্বী শ্বেত হর্মরাজি। সৈকতের কাছে দেখতে পাওয়া গেল বাঁকানো নাক আর নীলাভ কালো কেশ ও শ্মশ্রু গুম্ফের অধিকারী শেমীয় অশ্বারোহীদের। তারা সন্দেহের চোখে জাহাজটিকে দেখতে লাগলো। কিন্তু সেখানে জাহাজ ভেড়ানো হল না। শেম পুত্রদের সাথে বানিজ্য লাভজনক নয়।
যেখানে স্টীক্স নদী তার বিপুল জলরাশি নিয়ে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আর তার পাশে খেমির সুউচ্চ কালো দূর্গগুলির ছায়া পড়েছে সেই সুবিশাল মোহানার আশেপাশেও কর্ণধার টিটো জাহাজ ভেড়ালো না। এই বন্দরে সচরাচর কোন জাহাজই নোঙ্গর ফেলতে চায় না। এখানে জাদুকরী ডাইনিরা তাদের রক্তস্নাত বলিস্থানে অবোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ করে চলে, বলিপ্রদত্ত নগ্ন নারীদের নিরন্তর আর্তনাদ শোনা যায়, আকাশে কুন্ডলী পাকিয়ে উঠতে থাকে অপবিত্র ধোঁয়া; আর কথিত আছে, সেই ধোঁয়ার মতই কুন্ডলী পাকিয়ে হাইবোরিয়দের চরম শত্রু কিন্তু স্টাইজিয়দের অতি প্রাচীন সর্পদেবতা সেট তার চকচকে আঁশযুক্ত দেহ নিয়ে ভক্তদের মাঝে ঘুরে বেড়ায়।
এমনই এক দূর্গের ছায়া থেকে ভেসে আসে এক সর্পচিহ্নিত গন্ডোলা। সেটায় দাঁড়িয়ে শ্যামাঙ্গিনী, চুলে আগুন রঙের ফুল গোঁজা নগ্ন নারীরা বিচিত্র ভঙ্গিমায় আহ্বান করে নাবিকদের। সে ডাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে টিটো নোঙ্গর ফেলে বহুদূরে, গভীর সমুদ্রে।
এখন আর স্থলভাগের মাঝে কোন ঝলমলে শহরের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। তারা স্টাইজিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত পার হয়ে ‘কুশ’-এর উপকূল অঞ্চলে এসে পৌঁছেছে।
সমুদ্র আর এই সমুদ্রচারীদের বিচিত্র জীবন কোনানের কাছে এক অশেষ আশ্চর্যের বিষয়, কারণ আকাশছোঁয়া পর্বতের কোলে অবস্থিত তার দেশে এমন দৃশ্য ও আচার ব্যবহার অকল্পনীয় । কিন্তু সেও তার সহযোগীদের কাছে বেশ আগ্রহের বিষয়, কারণ তাদেরও বেশিরভাগই আগে তার জাতের মানুষ দেখেনি।
ওরা ছিল আদর্শ আর্গোসীয় নাবিক, ছোটখাটো কিন্তু পরিশ্রমী। কোনানকে ওদের মাঝে দৈত্যের মত লাগতো। তার শক্তির ধারেকাছে ওদের কেউ আসতো না। ওরা অবশ্য দূর্বল ছিল না, কিন্তু কোনানের জীবনীশক্তি, কষ্টসহিষ্ণুতা আর ধৈর্য ছিল নেকড়ের মতো। এই পৃথিবীর ঊষর প্রদেশে বেড়ে ওঠা তার মাংসাশীকে ইস্পাত কঠিন আর স্নায়ুকে শাণিত করে তুলেছিল। যেমন প্রাণখুলে সে হো হো করে হাসতো, তেমনি দ্রুত তার মাথায় খুন চড়ে যেত। সে প্রচুর পরিমাণে খেতে পারতো, এবং মদ্যপানে অতিরিক্ত আসক্তি একাধারে তার শক্তি ও দূর্বলতা ছিল। না না বিষয়ে সে ছিল শিশুর মত অজ্ঞ ও সরল, সভ্যতার জটিলতা সে বুঝতে পারতো না। কিন্তু সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান আর নিজের অধিকারের সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিল; এবং সেই অধিকার রক্ষার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে বাঘের মতো ভয়ংকর হয়ে উঠত। বয়েসে কম হলেও বহু যুদ্ধ ও নানা দেশে ভ্রমণ তাকে পোক্ত করে তুলেছিল। এই প্রবাসের ছাপ তার পোষাক পরিচ্ছদে দেখা যেত। যেমন, সে নর্ডহেইমের সোনালী চুলের ঈসিরদের মতো শিংবিশিষ্ট শিরস্ত্রাণ পরতো, তার বর্ম আর বস্ত্র ছিল কথের মুন্সিয়ানার নিদর্শন, তার হাতে ও পায়ে ছিল নেমেডিয়ার মোটা বালা, খাপে ছিল অ্যাকুইলোনীয়ার বিখ্যাত চওড়া ফলার দীর্ঘ তরবারি, আর তার কাঁধ থেকে যে টকটকে লাল আলখাল্লাটা ঝুলতো সেটা নিঃসন্দেহে ‘ওফির’ – এ বোনা।
তারা আরো দক্ষিনে পাড়ি দিল। কর্ণধার টিটোর চোখ কালো মানুষদের জনবসতি খুঁজতে লাগলো। কিন্তু তার বদলে উপসাগরের তীরে দেখতে পাওয়া গেল তখনো ধুমায়মান, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়ানো কালো মৃতদেহ নিয়ে পড়ে থাকা একটা ধ্বংসস্তুপকে। টিটো ভগবানের নাম নিল।
“এর আগেরবার এখানে বেশ ভালো ব্যবসা করেছিলাম। এ সব নির্ঘাত জলদস্যুদের কান্ড।” সে বলল।
“আমাদের সাথে যদি ওদের দেখা হয় তবে কী হবে?” কোনান জিজ্ঞেস করল।
“আমার জাহাজ তো আর যুদ্ধ জাহাজ নয়। ওদের দেখতে পেলে আমরা পালাব। ছোটখাটো জলদস্যুর দলকে অবশ্য এর আগেও দু একবার মেরে ভাগিয়েছি, তবে বেলিতের ‘বাঘিনী’র মুখোমুখি হলে কোন আশা নেই।”
“বেলিত কে?”
“সর্বকালের নির্মমতম সাগর শয়তানী। খুব ভুল না করে থাকলে আমি নিশ্চিত ঐ লোকালয়টায় ওর কসাই গুলোই ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। ভগবানের দিব্যি নিয়ে বলছি, আমি ওকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে দেখতে চাই। ওকে সবাই কৃষ্ণ সাগরের সম্রাজ্ঞী নামে ডাকে। একটা শেমীয় মহিলা, কালো দস্যুদের নেতৃত্ব দেয়। অনেক ব্যবসায়ীর জাহাজ লুঠ করে সাগরের অতলে তলিয়ে দিয়েছে ওরা।”
টিটো পিছ পাটাতনের নিচে থেকে কয়েকটা তীর ধনুক, লোহার টুপি, কিছু অস্ত্রশস্ত্র বের করে আনল। খানিকটা বিরক্তির সাথেই বলল, “ওদের সাথে যদি দেখা হয় তবে এগুলো দিয়ে বিশেষ কিছু করা যাবে না, তবুও একেবারে লড়াই না করে মরে যাওয়ার কোন মানে হয় না। “
পূবাকাশে সূর্য তখন সবে দেখা দিয়েছে, রাতজাগা পাহারাদার চিৎকার করে সাবধান করল। দূরে একটা দ্বীপের বাঁকের মুখে কুচকুচে কালো রঙের, সাপের মতো হিলহিলে লম্বা একটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। বেশ বড়, সামনে থেকে পিছন অবধি পাটাতনও অনেক উঁচু। দুপাশে চল্লিশটা করে দাঁড় ঝপঝপ করে পড়ে সেটাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে চলেছে। পাটাতনের নিচু রেলিং-এর ধারে কয়েকটা নগ্ন ছায়ামূর্তি তাদের ডিম্বাকৃতি ঢালে বর্শা ঠুকে যেন বিচিত্র মন্ত্রোচ্চারণের সাথে নেচে চলেছে। মাস্তুলে উড়ছে লম্বা টকটকে লাল পতাকা।
“বেলিত।” টিটো রক্তশূণ্য মুখে চেঁচিয়ে উঠল। “ইয়ারে, জাহাজ ঘোরাও। ওই খাঁড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে। যদি ওখানে জাহাজ ভেড়াতে পারি তবে হয়তো প্রাণ নিয়ে পালাতে পারবো।”
কাজেই আর্গাস একটা তীব্র বাঁক নিয়ে দূরের নীল বনানীর দিগন্তে, তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সৈকতের দিকে ছুটে চলল। টিটো সমানে মাল্লাদের বসার জায়গার মাঝের পথে পায়চারী করতে করতে চিৎকার করে তাদের নির্দেশ দিয়ে চলেছিল। তার এলোমেলো চুল দাড়ি সমুদ্রের বাতাসে উড়ছে আর চোখে যেন আগুন জ্বলছে।
“আমায় একটা ধনুক দাও।” কোনান তাকে বলল, “যদিও ওটাকে ঠিক পুরুষদের অস্ত্র বলে মানা যায় না, তবু হাইকারনীয়দের কাছে আমি তীরন্দাজী শিখেছিলাম। দূর থেকে ওদের কয়েকটাকে ফেলার চেষ্টা করতেই হবে। “
পিছ পাটাতনে দাঁড়িয়ে সে দেখল মৃত্যুদূতের মতো কালো জাহাজটা কী দ্রুত জল কেটে এগিয়ে আসছে। তার সমুদ্র জীবনের অল্প অভিজ্ঞতাতেও সে বুঝতে পারলো আর্গাসের পক্ষে তীরে পৌঁছান সম্ভব হবে না। এর মধ্যেই ওই জাহাজ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর হিস হিস শব্দ তুলে কুড়ি তিরিশ হাত পিছনেই সমুদ্রের জলে পড়ছে।
“আমাদেরকে ওদের মুখোমুখি হতেই হবে।” সিমেরীয়টি গর্জন করে উঠল, “নয়তো পালাতে পালাতে পিছন থেকে তীরের আঘাতেই মরতে হবে।”
“জোরে, আরো জোরে বৈঠা মার কুত্তার দল।” তার মুষ্টিবদ্ধ হাত শুণ্যে ছুঁড়ে টিটো চিৎকার করে উঠল। দাড়ি গোঁফওলা নাবিকের দল সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দাঁড় টানতে লাগল। তাদের হাত পায়ের পেশি পাকিয়ে ফুলে উঠছে, ঘামের ধারাস্রোতে ভেসে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ। জল কেটে তীব্র বেগে এগোতে গিয়ে সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে জাহাজের কাঠ মড়মড় করে উঠল। একটুও বাতাস না থাকায় পাল নিস্প্রান হয়ে ঝুলে পড়েছে। নির্দয় হানাদারেরা ক্রমশ কাছে ঘনিয়ে আসতে লাগল। তীরভূমি থেকে তখন তারা দু এক মাইল দূরে, এমন সময় একজন সারেং আর্তচিৎকার করে হাল নিয়ন্ত্রক চক্রের উপর লুটিয়ে পড়ল। একটা লম্বা তীর পিছন থেকে তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। টিটো এক লাফে গিয়ে তার জায়গা নিল, আর কোনান পিছ পাটাতনের উপর উঠে তার ধনুক হাতে তুলে নিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়াল। এখন সে পিছনের ধেয়ে আসা জাহাজটার বিভিন্ন অংশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। ওদের মাল্লাদের বসার যায়গাটা একটা কঠিন আচ্ছাদনে ঢাকা, কিন্তু সরু পাটাতনের ওপর যে যোদ্ধারা যুদ্ধের নাচ নেচে চলেছে তাদের বেশ ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে। ওরা প্রায় উলঙ্গ, সারা গায়ে উল্কি আঁকা, হাতে আলপনা আঁকা ঢাল আর লম্বা বর্শা।
পিছনের উঁচু পরিচালক পাটাতনের উপর তার চারপাশের কালচে তামাটে দেহগুলোর সাথে সম্পূর্ণ বৈপরীত্য সৃষ্টি করে যে তন্বী শ্বেতবর্ণের নারীটি দাঁড়িয়ে আছে, সে নিঃসন্দেহে বেলিত। কোনান ধনুকের ছিলা কান অবধি টেনে এনে তার তীর জ্যা মুক্ত করল, আর সেটা যেন তার মনের আকাঙখা ও সংশয়ের মিশ্রনের প্রতিফলন ঘটিয়ে বেলিতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বর্শাধারীর দীর্ঘ কালো শরীরটাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিল।
দ্রুতগতিতে দুটি জাহাজের মধ্যের দূরত্ব কমে আসছিল। বৃষ্টির মতো আর্গাসে তীর এসে পড়ছিল, আর তার সাথে শোনা যাচ্ছিল মানুষের আর্তনাদ। তিনজন সারেংই অসংখ্য তীরে বিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করেছিল, আর টিটো একা হাতে হাল ধরে অভিশাপ দিতে দিতে জাহাজ সামলানোর চেষ্টা করছিল। ভয়ে, পরিশ্রমে সে ঘামে চান করে যাচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎই সে একটা কান্না মেশানো চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল। একটা লম্বা তীর তার হৃৎপিণ্ড ভেদ করেছে। নিয়ন্ত্রণহীন আর্গাস সামনে এগোনোর বদলে একটা বিপজ্জনক বাঁক নিল। সব নাবিকেরা ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে চিৎকার করে উঠল, আর কোনান তার সহজাত প্রবৃত্তিতেই নিজের হাতে নেতৃত্ব তুলে নিল।
“উঠে দাঁড়াও।” তার গলা দিয়ে সিংহ গর্জন বেরিয়ে এল। “অস্ত্র তুলে নাও। আমাদের গলা কাটার আগে ওই কুত্তাগুলোকে শিক্ষা দিয়ে তবে মরব। পালানোর চেষ্টা করে কোন লাভ নেই, আর পঞ্চাশ হাত এগোনোর আগেই ওরা আমাদের ধরে ফেলবে। “
মরিয়া হয়ে নাবিকেরা যে যা পারে সবরকমের অস্ত্র তুলে নিল। কিন্তু তাদের এই সাহসিকতা খুব একটা কাজে লাগল না। জলদস্যুদের সাথে সংঘর্ষের আগে তারা একবারই মাত্র তীর ছোঁড়ার সুযোগ পেল। হাল ধরার কেউ না থাকায় আর্গাস পাক খেয়ে জলদস্যু জাহাজের সাথে একটা সমকোন করে থমকে গিয়েছিল। জলদস্যু জাহাজটার লোহাবাঁধানো অগ্রভাগ সেটার মাঝবরাবর প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মেরে মড়মড় করে ভেঙে ঢুকে গেল। সেটা থেকে দড়িবাঁধা লোহার আঙটাগুলো উড়ে এসে এই জাহাজের পাশে আটকে গেল। উঁচু জাহাজটার ওপর থেকে আরো একঝাঁক তীর এসে বেশকিছু নাবিকের হালকা বর্ম ভেদ করে তাদেরকে হত্যা করল। এরপর আর্গাসের পাটাতনে লাফিয়ে পড়ল কালো জলদস্যুর দল হত্যালীলার শেষ পর্যায় শুরু করবে বলে। জলদস্যুদের জাহাজের পাটাতনেও আট দশটা মৃতদেহ পড়েছিল। এ হল কোনানের তীরন্দাজীর সাফল্যের প্রমাণ।
আর্গাসের যুদ্ধ ছিল সংক্ষিপ্ত এবং রক্তরঞ্জিত। ছোটখাটো নাবিকেরা দশাসই জলদস্যুদের সাথে এঁটে উঠতে পারল না। কিন্তু অন্যদিকে লড়াই একটা বিচিত্র বাঁক নিয়েছিল। আর্গাসের পিছ পাটাতন জলদস্যু জাহাজের সমান উঁচু ছিল। ধাক্কা লাগার সময় কোনান ধনুক রেখে নিজেকে সামলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কাজেই একটা ঢ্যাঙা সৈন্য যখন লাফিয়ে রেলিং টপকে এই জাহাজে আসতে গেল, সে কোনানের দীর্ঘ তরবারির মুখোমুখি পড়ে গেল। এক প্রচন্ড আঘাতে শুন্যেই তার দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। এরপরই কোনান মৃতদেহের স্তুপে ভরা আর্গাস ছেড়ে এক লাফে বাঘিনীর পাটাতনের ওপর পৌঁছল।
মুহূর্তের মধ্যে সে এক উন্মত্ত বর্শা আর মুশলের ঘুর্ণিঝড়ের কেন্দ্রস্থলে এসে পড়ল। কিন্তু বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলসে উঠল তার অসি। কিছু বর্শা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল, কিছু বা তার বর্মে লেগে প্রতিহত হল। তার তরোয়াল এবার মৃত্যু সঙ্গীত রচনা করতে লাগল। তার দেহে তার বর্বর জাতীর রণোন্মত্ততা ভর করেছিল আর প্রচন্ড ক্রোধে রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে সে শত্রুদের কারো খুলি দু টুকরো, কারো হৃৎপিন্ড, কারো বা হাত, পা ছিন্ন ভিন্ন করতে লাগল। আঘাতের অভিঘাতে কারো কারো দেহ থেকে অন্ত্র, পাকস্থলী ছিটকে বেরিয়ে এল। জাহাজের পাটাতন কসাইখানার মতো রক্ত, ঘিলুতে স্নান করতে লাগল।
পিঠ মাস্তুলে ঠেকানো, সামনে দুর্ভেদ্য বর্ম থাকায় প্রবল পরাক্রমে, যতক্ষন না শত্রুরা ভয়ে আর রাগে হাঁফাতে হাঁফাতে পিছিয়ে গেল, ততক্ষন সে তার পায়ের সামনে মৃতদেহের স্তুপ সৃষ্টি করতে লাগল । তারপর আবার তারা বল্লম তুলে ধরল দূর থেকে একসাথে আঘাত হানার জন্য। কোনানও ঠিক করল এক লাফে তাদের মাঝে পৌঁছে বীরের মৃত্যুবরণ করবে বলে। কিন্তু সেইসময় একটা তীক্ষ্ম চিৎকার তাদের স্তব্ধ করে দিল। উত্তোলিত ভল্ল হাতে কালো সৈন্য আর রক্তঝরা অসি হাতে দুর্ধর্ষ সিমেরীয় মুর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে রইল।
কৃষ্ণকায় যোদ্ধাদের বর্শা সরিয়ে বেলিত সামনে এসে উপস্থিত হল। তার দৃঢ়পিনদ্ধ বক্ষদ্বয় দ্রুত উঠছে পড়ছে, দুই চোখে আগুন জ্বলছে। তার দিকে তাকিয়ে কোনানের হৃদয় বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ল। তার তন্বী দেহে যেন স্বর্গীয় দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে। সে ক্ষীনকটি, কিন্তু গুরুপয়োধরা। তার শরীরের ডৌলে ডৌলে আদিম নেশার হাতছানি। তার পরনে অলংকার ছাড়া কেবলমাত্র একটা সিল্কের ঘাঘরা। তার চন্দনবর্ণের অঙ্গ ও কুচদ্বয় এই রণোন্মত্ততার মধ্যেও কোনানের শরীরে কামনার আগুন জ্বালিয়ে তুলল। স্টাইজীয় রাত্রির মতো ঘন কালো কেশদাম ঝর্নার মতো কাঁধ ছাড়িয়ে তার কোমল পিঠে ছড়িয়ে পড়েছে। তার আয়ত নেত্রের দৃষ্টি তাকে যেন দগ্ধ করতে লাগল।
সে মরুবায়ুর মতই অশান্ত, চিতা বাঘিনীর মতই ধূর্ত, বিপজ্জনক, তাকে পোষ মানানো যায় না। সে নির্ভয়ে কোনানের একেবারে কাছে ঘনিয়ে এল। যদিও তখনো কোনানের তরোয়াল থেকে তারই সহচরদের রক্ত ঝরে পড়ছে, সে সেই দীর্ঘদেহী যোদ্ধার এত কাছে এগিয়ে এল যে সেটায় তার জঘন স্পর্শ করলো প্রায়। কোনানের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতে তার রক্তিম ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল।
“কে তুমি?” তার জিজ্ঞাসায় দাবীর সুর, “ইশতারের দিব্যি, আমি জিঙ্গারা থেকে শুরু করে এই সাগরের দক্ষিনতম প্রান্তের আগুন পর্যন্ত দেখেছি, কিন্তু তোমার মতো কারও মুখোমুখি হই নি। কোথা থেকে এলে তুমি? “
“আর্গোস থেকে।” যে কোন চালাকির জন্য প্রস্তুত থেকে কোনান অতি সংক্ষেপে জবাব দিল। যে মুহূর্তে এই ছলনাময়ীর হাত তার ছুরির রত্নখচিত হাতল স্পর্শ করার জন্য এগিয়ে যাবে, সেই মুহূর্তে এক প্রবল আঘাতে সে তাকে ভূপাতিত করবে। তবুও তার কেন যেন একটুও ভয় লাগছিল না। সভ্য, অসভ্য নানা ধরনের নারী তার অঙ্কশায়িনী হয়েছে, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল যে আগুন এর দুচোখে জ্বলছে, এমনটি সে আগে দেখে নি।
“তুমি তো নরম ভীতু হাইবোরীয় নও!” সে বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে বলল। “তুমি ধুসর নেকড়ের মতোই শক্তিশালী আর হিংস্র। ঐ চোখ শহুরে আলোতে ঘোলাটে হয় নি, ঐ পেশী শ্বেত পাথরের দেওয়ালে আবদ্ধ থেকে দূর্বল হয়ে যায় নি।”
“আমি কোনান। সিমেরীয়।” সে জবাব দিল।
দক্ষিনের ধনাঢ্য দেশগুলোর অধিবাসীদের কাছে উত্তর ছিল এক মায়াময় অর্ধ অলীক জগৎ। যেখান থেকে মাঝে মাঝে নীল নয়নের দৈত্যাকার হিংস্র বর্বর যোদ্ধারা হাতে মশাল আর তরোয়াল নিয়ে লুন্ঠনের উদ্দেশ্যে নেমে আসতো। তাদের অভিযান কখনোই দক্ষিণের সুদুর প্রান্তে, শেম অবধি পৌঁছাতে পারে নি। আর এই শেমের কন্যাটির কাছে ঈসির, ভানির বা সিমেরীয়র মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই। কিন্তু চিরন্তন নির্ভুল নারীসুলভ প্রবৃত্তি দিয়ে সে অনুভব করেছিল , সে তার প্রেমিককে খুঁজে পেয়েছে আর তার জাতিকে না চিনলেও সে বুঝতে পেরেছিল এর মধ্যে দিয়ে সেই সুদুর জগতের দুর্মর আকর্ষণ তাকে প্রবলভাবে টানছে।
“আমি বেলিত।” এক বাঘিনী গর্জন করে উঠল। “আর আমি সম্রাজ্ঞী।”
“আমাকে দেখ কোনান!” সে দুহাত প্রসারিত করে বলল, “আমি বেলিত, কৃষ্ণ উপকূলের সম্রাজ্ঞী। হে উত্তরের শার্দূল, তুমি যেন তোমার জন্মস্থানের বরফাবৃত শীতল পাহাড়ের প্রতিমূর্তি হয়ে আমার সামনে এসেছ। আমায় গ্রহণ করো, তোমার তীব্র ভালোবাসায় আমার চূর্ণ করো। আমি তোমার সাথে এই পৃথিবীর, এই মহা সাগরের শেষ অবধি যাবো। আমি আগুন, ইস্পাত আর হত্যার উৎসবের রানী, আমার রাজা হও।”
কোনান একবার তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তাক্ত যোদ্ধার দলের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিল, কারো দৃষ্টিতে ক্ষোভ কিম্বা ঈর্ষা আছে কিনা তা দেখার জন্য। সে তেমন কাউকে খুঁজে পেলো না। সেই তামাটে কৃষ্ণবর্ণের মুখগুলো থেকে হিংস্রতা সরে গেছে। সে বুঝতে পারলো, এদের কাছে বেলিত কেবলমাত্র একজন নারী নয় তার অনেক বেশি কিছু; একজন দেবী, যার যেকোন সিদ্ধান্তই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। সে একবার আর্গাসের দিকে তাকালো। ছিন্ন ভিন্ন, শ্রান্ত হয়ে রক্তিম সাগরে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তা যেন উদগ্রীব হয়ে রয়েছে; কেবলমাত্র লোহার অঙ্কুশগুলো অকারণে তাকে আটকে রেখেছে। সে দূরের তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সৈকতের আর নীলচে বনানীর দিকে তাকাল। তারপর সে দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই উজ্জ্বল দেহবল্লরীর দিকে। এই শ্বেতাঙ্গী সুন্দরী বাঘিনীর সাথে সামনে উন্মুক্ত সীমাহীন নীল জগতে অভিযানের জন্য তার বন্য হৃদয় ছটফট করে উঠল। প্রেম, হাসি, মুক্ত যোদ্ধার জীবন, আর অপরিমিত রত্ন ভান্ডার তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
“আমি তোমার সাথে সমুদ্র যাত্রায় যেতে রাজি।” তার তরবারি থেকে রক্তের ফোঁটাগুলো ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে সে বলল।
“ন্’য়াগা” বেলিতের কন্ঠস্বর টংকার দিয়ে উঠল, “তোমার প্রভুর ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগানোর ব্যবস্থা করো, বাকিরা লুটের মাল নিয়ে এসে যাত্রার ব্যবস্থা করতে শুরু করো।”
কোনান জাহাজের পিছনের রেলিং- এ হেলান দিয়ে বসেছিল, বৃদ্ধ চিকিৎসক ওঝাটি তার ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগাচ্ছিল। হতভাগ্য আর্গাসের মালপত্র দ্রুত বাঘিনী তে এনে তার পাটাতনের নিচের ছোট কুঠুরিগুলোতে রাখা হল। মৃত নাবিক আর কালো জলদস্যুদের দেহগুলো জাহাজের চারপাশে সাঁতরে বেড়ানো হাঙরের খাদ্য নিসেবে নিক্ষেপ করা হল। পাটাতনের মাঝামাঝি শুইয়ে আহত দস্যুদের ক্ষতের পরিচর্যা করা হচ্ছিল। তারপর আর্গাসের গায়ে আটকানো অঙ্কুশগুলো খুলে নেওয়া হলে সেটা ধীরে ধীরে সাগরের রক্তিম জলের গভীরে তলিয়ে গেল। বাঘিনী ছন্দোবদ্ধ দাঁড়ের তালে আরো দক্ষিনের দিকে পাড়ি দিল।
সীমাহীন নীল সাগরের বুকে আঁধার ঘনিয়ে এলে বেলিত পিছ পাটাতনে লঘু পায়ে উঠে এল। তার দু চোখ চিতা বাঘিনীর মতো জ্বলছে। নিজের অলঙ্কার আভূষণাদি একটানে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে, নিজের দুই বাহু শুণ্যে প্রসারিত করে, সেই নক্ষত্রখচিত আকাশের নিচে যেন এক অগ্নিশিখায় পরিণত হয়ে সে চিৎকার করে সবাইকে জানান দিল, “নীল সাগরের নেকড়েরা শোনো, সাগরের উত্তাল ঢেউ সাক্ষী থেকো, আসকালনের রাজাদের কন্যা বেলিত এবার তার মিলন নৃত্য নাচবে।”
এবং সে নাচতে শুরু করল। এক মরু ঘুর্নাবাত্যার মতো পাক খেয়ে, আগুনের ফুলকির মতো লাফিয়ে, সৃষ্টি এবং প্রলয়ের যাবতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ হয়ে সে নাচতে লাগল। তার নাচে সেই রক্তস্নাত জাহাজে আহতদের ছুঁতে আসা মৃত্যুও থমকে গেল। যেভাবে আঁধারের বুক চিরে তারারা ফুটে ওঠে, তেমনই বেলিতের শ্বেতশুভ্র দেহ আগুনের মতো জ্বলে উঠল। তারপর এক সময় এক বন্য চিৎকার করে সে কোনানের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল, আর সেও কামনায়, মিলনাসক্তিতে ভেসে গিয়ে সেই বরাঙ্গীকে তুলে নিয়ে নিজের কবাটবক্ষে নিষ্পেষিত করতে লাগল।
II
কৃষ্ণ কমল
ওই ভাঙা পাথরের মৃত কেল্লায়
(তার) চোখ পড়েছিল ফাঁদে;
সেই অশুভ উজ্জ্বলতায়।
তার কুতুহলি পাগলামো যেন তারে
ঘিরে ছিলো জোর করে;
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেমিক প্রায়।
-বেলিতের গান।
বাঘিনী সমুদ্র শাসন করতে লাগলো, আর কৃষ্ণাঙ্গদের গ্রামগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিনত হতে লাগলো। রাতের আঁধার চিরে ঢাকের আওয়াজ খবর ছড়িয়ে দিল, সাগর শয়তানি তার যোগ্য সহচর খুঁজে পেয়েছে, এক লৌহ মানব, যার ক্রোধ আহত সিংহের মতই ভয়ংকর। প্রাণ নিয়ে পালাতে পারা ছিন্নভিন্ন স্টাইজীয় বানিজ্য তরীর নাবিকেরা, বিস্ফারিত চোখে অভিশাপ দিতে দিতে বেলিতের আর তার সাথে চোখে নীল আগুন জ্বলা এক যোদ্ধার গল্প শোনাতো। সে কাহিনি ছড়িয়ে পড়তে পড়তে স্টাইজীয় রাজকুমারের কানে পৌঁছেছিল, এবং এই বিষবৃক্ষে কোন রক্তিম ফল ফলেছিল তা আমরা কয়েক বছর পরের ঘটনাবলির মাধ্যমে ভবিষ্যতে জানতে পারব।
ঝোড়ো বাতাসের মতো দক্ষিনের বিভিন্ন উপকূলে অভিযান চালিয়ে বাঘিনী এক স্ফীতকায়া নদীর বিস্তৃত মোহনার কাছে নোঙর ফেলেছিল। কোনানের মনে হল, এর পাড়ের ঘন দীর্ঘ বনানী যেন কোন আদিম রহস্যকে লুকিয়ে রেখেছে।
“এই নদীর নাম জ়ারখেবা, যার মানে মৃত্যু।” বেলিত বলল। “এই নদীর জল বিষাক্ত। দেখতে পাচ্ছ কেমন কালো কুটিল হয়ে বয়ে চলেছে? কেবলমাত্র বিষধর সরীসৃপরাই এখানে বাস করে। কালো লোকেরা একে ভয়ে এড়িয়ে চলে। একসময় একটা স্টাইজীয় জাহাজ আমার হাত থেকে পালানোর জন্য এই নদীর ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি ঠিক এখানেই নোঙর ফেলে অপেক্ষা করতে থাকি। কয়েকদিন পর জাহাজটা নদীর কালো জলে ভেসে আসে। গোটা জাহাজটা যেন রক্তে ভেসে গেছে, তার নাবিকেরা সব উধাও। কেবলমাত্র একটা লোককে আমরা পেয়েছিলাম। সেও পাগল হয়ে গিয়েছিল আর প্রলাপ বকতে বকতে মারা গিয়েছিল। জাহাজের মালপত্র সব ঠিক ছিল, কেবলমাত্র নাবিক গুলোই কোন রহস্যে হারিয়ে গেল।
“সোনা, আমার ধারণা এই নদীর উজানে কোথাও একটা শহর আছে। যে সব নাবিকেরা এই নদী ধরে কিছুটা এগোনোর সাহস করেছিল, আমি তাদের কাছে বিশাল উঁচু মিনারের চুড়ো আর দেওয়ালের গল্প শুনেছি। আমরা কোন কিছুকেই ভয় পাই না। চলো সেই অজানা শহরে অভিযান চালানো যাক। “
কোনান সহমত হল। সে সাধারণত তার ইচ্ছায় সম্মতি জানাতো। বেশিরভাগ অভিযানের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা হত বেলিতের, সে তার বাহুবলের দ্বারা সেগুলোকে বাস্তবায়িত করত। কোথায় তারা পাড়ি দেবে বা কোথায় তারা আক্রমণ করবে, এই ব্যাপারগুলো তার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সে ঘুরে বেড়াতে পারলে আর যুদ্ধ করতে পারলেই খুশি ছিল। তার কাছে এই জীবনই ছিল আনন্দময়।
অবশ্য ক্রমাগত যুদ্ধ আর নানা দুঃসাহসিক আক্রমণের ফলে তাদের নাবিকসংখ্যাও কমে এসেছিল। আপাতত আশিজনের মতো বর্শাধারী ছিল তাদের দলে। এই জাহাজের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা বেশ অপ্রতুল। তবুও এই নতুন অভিযান নিয়ে বেলিত এতটাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল যে সুদুর দক্ষিনের যে সব দ্বীপপুঞ্জ থেকে সে সৈন্য সংগ্রহ করতো, সেখানে গিয়ে সময় নষ্ট করতে রাজি হল না। সুতরাং তার উৎসাহে বাঘিনী মোহনার বিপুল জলরাশির ঢেউ ভেঙে প্রবল উদ্যমে নদীর দিকে এগিয়ে চলল।
নদীতে প্রবেশ করার পরেই সেটার গতিপথ একটা রহস্যময় বাঁক নেওয়ার ফলে সমুদ্র আড়াল হয়ে গেল। তাদের পিছনে অস্ত যেতে যেতে রক্তিম সূর্য দেখতে পেল বাঘিনী নদীর কালচে ধীর প্রবাহিত জলস্রোত কেটে, বিচিত্র, বিষাক্ত, কুন্ডলী পাকানো সরীসৃপেদের বিশ্রামস্থল বালির চরগুলোকে এড়িয়ে, এগিয়ে চলেছে। তারা চরে কোন কুমির, নদীর জল পান করতে আসার জন্য কোন চতুস্পদ জন্তু কিম্বা বৃক্ষশাখে কোন পাখি দেখতে পেল না। চাঁদ ওঠার আগে ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তারা এগোতে লাগল। দু পারের অদ্ভুত অরণ্যে তখন নিকষ কালো ছায়া ঘনিয়ে উঠেছে আর সেখানে শোনা যাচ্ছে রহস্যময় খসখসে আওয়াজ, সাবধানী পদধ্বনি, আর দেখা যাচ্ছে বিরক্ত রক্তচক্ষুদের। একসময় সেই আঁধারে মানুষের কন্ঠস্বর নকল করে কে যেন জঙ্গল কাঁপিয়ে হেসে উঠল। বেলিতের মতে এ এক বিশেষ প্রজাতির বানরের চিৎকার। সে আরো জানালো পুর্বজন্মের সীমাহীন পাপের শাস্তি স্বরূপ এই জন্তুর মধ্যে পাপীদের আত্মা বন্দী থেকে শাস্তিলাভ করে। কিন্তু কোনানের তা মানতে মন চাইল না। যার কথা বেলিত বলছে, এক হাইকারনীয় শহরে, স্বর্ণ পিঞ্জরের মধ্যে, অতল বিষাদগ্রস্ত চোখ নিয়ে বসে থাকা তেমন এক বানরের দেখা সে পেয়েছিল, যার পক্ষে এমন এক নৃশংস অট্টহাসি হাসা সম্ভব নয়।
তারপর চাঁদ উঠল। দেখে মনে হল তা যেন রক্তের সাগরে চান করে উঠেছে, আর সাথে সাথে জঙ্গলের নিশ্ছিদ্র কালো অন্ধকার অংশ থেকে বিচিত্র ভয়াবহ চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল তাকে স্বাগত জানানোর জন্য। সেই চিৎকার শুনে কালো যোদ্ধারা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকল। কোনান খেয়াল করে দেখল প্রায় সব আওয়াজই আসছে জঙ্গলের দূরতম প্রান্ত থেকে, যেন এইসব বন্য শ্বাপদেরাও সভয়ে জ়ারখেবার কালো জলকে এড়িয়ে চলে।
ধীরে ধীরে চাঁদ জঙ্গলের গাছ আর পাতার অন্ধকার দেওয়াল ছাড়িয়ে অনেকটা উপরে উঠে রুপোলী বরণ ধারণ করল। জ্যোৎস্নার আলো নদীর কালো জলের উপর যেন তরল রুপো ঢেলে দিল। সেই রহস্যময় জলে অতল থেকে উঠে আসা বুদবুদগুলো চকমকে রত্নের আকার ধারণ করছিল আর ফেটে যাচ্ছিল। বাওয়ার সময় বৈঠাগুলো থেকে যেন জল নয়, রুপো গলে ঝরে পড়ছিল। যোদ্ধাদের মাথার পালকগুলো মৃদু বাতাসে উড়ছিল আর তাদের অস্ত্রের রত্নখচিত হাতলগুলো বরফের মত সাদা আলোয় ঝলসিয়ে উঠছিল।
পাটাতনের উপর বিছানো একটা চিতাবাঘের চামড়ায় নিজের করতলের উপর চিবুক রেখে উপুড় হয়ে শুয়েছিল তন্বী বেলিত। তার ঘন কালো চুলকে বনজ্যোৎস্না যেন হাজার হীরাতে সাজিয়ে তুলেছিল। তার গভীর কালো চোখ রত্নের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। সে তাকিয়েছিল তার প্রেমিকের দিকে। কোনান তার পাশেই শুয়েছিল। তার চুলে মৃদুমন্দ বাতাস খেলা করছিল।
“রহস্য আর বিপদের উত্তেজনাই আমাদের জীবনকে এত আকর্ষণীয় করে রেখেছে। আর তাই আমাদের বার বার এই মৃত্যু আর বিপদের জগতে পা ফেলতে হচ্ছে।” বেলিত বলল, “তোমার কি ভয় করছে?”
জবাব দিতে কোনান কেবলমাত্র নিজের কাঁধ ঝাঁকাল।
“আমিও ভয় পাই না।” সে নিজের মনেই বলে উঠল। “আমি কখনো ভয় পাই নি। আমি বহুবার উদ্যত মৃত্যুকে সামনাসামনি দেখেছি। কোনান, তুমি ভগবানকে ভয় করো?”
“আমি সাধারণত ওঁদের ছায়া মাড়াতে চাই না।” কোনান একটু রক্ষনশীল হয়েই জবাব দিল। “কোন কোন শক্তিশালী দেবতা ক্ষতি করেন, ভয় দেখান, আবার কেউ কেউ উপকার করেন, অন্তত তাদের পূজারীরা তো তাই বলে। হাইবোরীয়দের দেবতা মিত্রা নিশ্চয়ই খুব শক্তিশালী, নয়তো ওরা জগৎ জুড়ে এত জায়গায় শহর গড়ে তুলল কীভাবে? কিন্তু হাইবোরীয়রা পর্যন্ত সেট কে ভয় করে। আর দস্যুদেব বেল তো খুবই ভালো দেবতা। আমি জামোরিয়াতে যখন চুরি করে বেড়াতাম, তখন ওঁর কথা জানতে পারি।”
“আর তোমার দেশের দেবতারা কেমন? আমি তো তোমাকে খুব একটা তাদের ডাকতে দেখি না।”
“আমাদের দেবতাদের সর্দার হলেন ক্রম। তিনি তো আকাশছোঁয়া পাহাড়ের ওপর থাকেন। কাজেই তাঁকে ডেকে আর কী লাভ? লোকে বাঁচল কী মরল তাতে তাঁর কিস্যু যায় আসে না। তাঁকে খুব একটা না ঘাঁটানোই ভালো, কারন তিনি রেগে গেলে সৌভাগ্যের বদলে ধ্বংসকে পাঠিয়ে দেন। তিনি বেশ গম্ভীর আর কঠোর দেবতা। তবে জন্মের সময় তিনি আমাদের আত্মার মধ্যে লড়াই আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা ভরে দেন। এরপর একজন মানুষের আর কীই বা চাওয়ার থাকতে পারে?”
“কিন্তু বৈতরণীর ওপারে মৃত্যুর জগৎ সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?”
“আমাদের মতে মৃত্যুর পরে আর কোন আশা থাকে না। এই পৃথিবীতে বহু কষ্ট সহ্য করতে হয়। তবে লড়াইয়ের ময়দানে এক প্রবল উত্তেজনার আনন্দ পাওয়া যায়। কিন্তু সে লড়াইয়ে মারা গেলে আমাদের আত্মা এক ধুসর, ঠান্ডা হাওয়া আর মেঘের জগতে প্রবেশ করে আর চিরকাল সেখানেই ঘুরে মরে।”
বেলিত যেন কেঁপে উঠল। বলল, “জীবনে যত দুঃখ কষ্টই থাকুকনা কেন, তা এমন পরিনতির চেয়ে অনেক ভালো। তুমি কি এই পরিনতিতে বিশ্বাস করো কোনান? “
সে আবার কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, “আমি অনেক দেবতাদের সম্পর্কে জেনেছি। যারা তাঁদের অস্বীকার করে তারা যেকোনো গোঁড়া ভক্তদের মতই অন্ধ। তবে মৃত্যুর পরে কী আছে তা খোঁজার ইচ্ছে আমার নেই। নেমেডীয় সংশয়বাদীরা যেমন বলে, হতে পারে সেটা চির আঁধারের দেশ, হতে পারে ক্রমের জগতের মতো বরফ আর কুয়াশায় ভরা, কিম্বা নর্ডহেইমারদের ভালহাল্লার মতো বরফঢাকা সমতলে যে সভাঘরের কথা বলা হয়, তেমনও হতে পারে। আমি জানিও না, পরোয়াও করি না। যতক্ষন বেঁচে আছি, আমি প্রতিটি মূহুর্ত উপভোগ করতে চাই। আমি আমার খাবারের থালার সুস্বাদু নরম মাংস আর সুরভিত সুরার স্বাদ নিতে চাই, আমার প্রেমিকার বাহুডোরে বাঁধা পড়তে চাই, যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে প্রতি মূহুর্তে নীল ইস্পাত রক্তে রাঙা হয়ে ওঠে, আমার পরাক্রম দেখাতে চাই। এসব পেলেই আমি খুশি। জ্ঞানী শিক্ষক, পূজারী আর দার্শনিকরা এসব সত্যি না মায়া তা নিয়ে মাথা ঘামাক। একটা কথা আমি জানি, জীবন যদি মায়া হয় তবে আমিও সেই মায়ার এক অংশমাত্র। কাজেই মায়া হলেও এ আমার কাছে চরম সত্য। আমি বাঁচি, পুড়ি, ভালোবাসি, লড়ি এবং আমি তৃপ্ত।”
“আমি বিশ্বাস করি দেবতারা অবশ্যই আছেন।” বেলিত তার নিজের চিন্তার সূত্র ধরেই বলল। “আর সবার ওপরে আছেন শেমীয়দের দেবতারা; ইশতার, অ্যাশটোরেথ, ডেরকেতো আর অ্যাডোনিস। বেল ও আছেন। তিনিও শেমীয়। বহু বহু বছর আগে তিনি শুমীর এ জন্মেছিলেন। তার দাড়ি কোঁকড়ানো, চোখ ধুর্ত অথচ জ্ঞানী। তিনি মজার ছলে হাসতে হাসতে রাজা বাদশাহদের রত্নগুলো উধাও করে দেন।
“আর মৃত্যুর পরেও জীবন আছে। আমি বিশ্বাস করি, আমি জানি সিমেরিয়ার কোনান।” কথাগুলো বলে এক চিতা বাঘিনীর মতো সে কোনানকে জড়িয়ে ধরল। বলল, “আমার ভালোবাসা যেকোন মৃত্যুর চেয়ে বড়। আমি তোমার বাহুবন্ধনে ধরা দিয়েছি, আমাদের ভালোবাসায় থরথর করে কেঁপেছি, তোমার প্রবল চুম্বনে তুমি আমার আত্মাকে তোমার আত্মার সাথে জুড়ে দিয়েছ। আমি জীবনে মরণে তোমার সাথে বাঁধা পড়েছি। আমাদের হৃদয় এক হয়ে গেছে। আমি যদি মারাও যাই, তোমার বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সাহায্য করার জন্য ফিরে আসবো। সে আমার আত্মা স্বর্গের স্ফটিক সমুদ্রে বেগুনি পাল তুলে ঘুরে বেড়াক বা নরকের আগুনে পুড়তে থাকুক, যাই হোক না কেন। আমি তোমার। কেউই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
একটা তীক্ষ্ম চিৎকার তাদের চিন্তাজাল ছিন্ন করল। বেলিতকে সরিয়ে কোনান একলাফে উঠে দাঁড়াল। হাতে তার দীর্ঘ তরবারি চাঁদের আলোয় ঝকমক করছে। আওয়াজটা এসেছে জাহাজের একেবারে সামনের দিক থেকে। একছুটে সেখানে পৌঁছে কোনান যা দেখল তাতে তার রোম খাড়া হয়ে গেল। যে রাতপাহারাদার সেখানে ছিল সে যেন আবছা আলো আঁধারে পাটাতন থেকে কয়েক মানুষ ওপরে বিরাট মোটা একটা গাছের ডাল থেকে ছটফট করতে করতে ঝুলছে। তারপর সে বুঝতে পারল ওটা একটা মহাকায় নাগ, যেটা নদীর জল থেকে মুখ বাড়িয়ে পাটাতনের ওপরের দূর্ভাগা আধঘুমন্ত পাহারাদারটাকে শিকার হিসাবে কামড়ে ধরেছে। সেটার পিছনের কিছু অংশ কুন্ডলী পাকিয়ে পাটাতনের ওপর, বাকিটা তখনো নদীর জলে। চাঁদের আলোয় সেটার কুষ্ঠের মত ডুমোডুমো আঁশ থেকে যেন ঘেন্না ঝরে পড়ছে। ওটার দীর্ঘ বাঁকানো দাঁতে বিদ্ধ মানুষটা একটা ছোট্ট ইঁদুরের মত ছটফট করে ঝুলতে ঝুলতে ক্রমশঃ নিস্তেজ হয়ে আসছে। সংবিৎ ফিরতেই কোনান তার তরোয়াল ঘুরিয়ে সেই গুঁড়ির মত মোটা দেহটাতে সজোরে আঘাত হানল। প্রচন্ড আঘাতে দেহটা প্রায় দু আধখানা হয়ে গেল। ফিনকি দিয়ে ফোয়ারা ছুটল কালচে রক্তের। যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে সেই বিচিত্র বিশাল মৃত্যুমুখী অজগর তার শিকার সমেত আছড়ে পড়ল নদীর জলে। মানুষ আর সাপ দুইই তলিয়ে গেল একসাথে। কিছুক্ষন রক্তলাল বুড়বুড়ি উঠল জ়ারখেবার কালো জলে। তারপর সব চুপচাপ।
বাকি রাত কোনান নিজেই পাহারায় থাকল। কিন্তু আর কোন আতঙ্ক অন্ধকার অতল থেকে উঁকি দিল না। ভোরের আলো ফুটে উঠলে সে দেখতে পেল অরণ্য ভেদ করে বেশ কয়েকটা কালো মিনার তীক্ষ্ম শ্বদন্তের মতো মাথা উঁচিয়ে রয়েছে। সে বেলিতকে ডাক দিল। সে কোনানের লাল আলখাল্লাটা গায়ে জড়িয়ে পাটাতনের ওপরেই ঘুমোচ্ছিল। ডাক শুনে দ্রুত উঠে তার পাশে এসে দাঁড়াল। তার গভীর চোখ জ্বলজ্বল করছে। বিস্ফারিত নয়নে সে তার অনুচরদের ধনুক আর বর্শা হাতে প্রস্তুত থাকতে আদেশ দিল।
কিন্তু শহরটা মৃত। একটা বাঁক নিতেই জঙ্গলের আড়ালটা সরে গেল আর অর্ধচন্দ্রাকৃতি কূলের ধারে দেখা গেল সেটা প্রেতের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। জাহাজঘাটা ভেদ করে জলজ উদ্ভিদ আর উলুখাগড়ার মত লম্বা সবুজ ঘাস গজিয়েছে। পাথর বাঁধান রাস্তা, প্রশস্ত নগরচত্বর, অঙ্গনগুলোও ঘাস আর বুনো ঝোপে ছেয়ে গেছে। নদীর দিক ছাড়া বাকি তিনদিক থেকেই জঙ্গল আগ্রাসী ভঙ্গিমায় এগিয়ে এসে ভাঙাচোরা কেল্লা, প্রাসাদ, ভূপাতিত স্তম্ভগুলোকে ঢাকা দিয়েছে। এখানে ওখানে মাতালের মত টালমাটাল কিছু ঘরবাড়ি নীল আকাশের দিকে মাথা তোলার চেষ্টা করছে। তাদের থামগুলো ক্ষয়ে যাওয়া দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে পড়ে আছে। শহরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা শ্বেত পাথরের পিরামিডের ওপর একটা লম্বা স্তম্ভ, আর সেটার ওপর যে মূর্তিটা ছিল সেটা যে জীবন্ত তা কোনান বহু পরে বুঝতে পারল তার সামান্য নড়াচড়া দেখে।
“একটা বিরাট পাখি।” জাহাজের সন্মুখ ভাগে দাঁড়িয়ে একজন যোদ্ধা বলল।
“না, একটা বিরাট বাদুড়।” আরেকজন বলে উঠল।
“একটা বানর।” বেলিত ঘোষনা করল।
কিন্তু বানরের কী ডানা থাকে? এটার আছে। কারন তখনই সেটা ডানা বিস্তার করে উড়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
“ডানাওলা বানর!” ন্’য়াগা অত্যন্ত অস্বস্তি নিয়ে বলল। “এমন যায়গায় আসার আগে নিজেদের গলা কেটে মরে যাওয়া বোধহয় ভালো ছিল।”
বেলিত তার কুসংস্কার নিয়ে খানিকটা বিদ্রুপ করে নির্দেশ দিল জাহাজ তীরে ভিড়িয়ে সেটাকে ভাঙাচোরা জেটির সাথে বেঁধে রাখতে।
প্রথমে বেলিত লাফিয়ে তীরে নামল। তার প্রায় সাথে সাথেই কোনান। তাদের পিছনে নেমে এল কালো জলদস্যুর দল, তাদের মাথায় বাঁধা সাদা পালকগুলো বাতাসে কাঁপছে, হাতে উদ্যত অস্ত্র, চোখ চারপাশের জঙ্গলে নিবদ্ধ, যেকোন বিপদের জন্য প্রস্তুত।
এক অলক্ষুণে সুবিশাল ময়াল সাপের মত নিস্তব্ধতা গোটা অঞ্চলে স্থির হয়ে পড়ে ছিল। চারপাশের নির্জনতা, ক্ষয় আর মৃত্যুগন্ধের মাঝে বেলিত তার সুঠাম দেহে অপূর্ব চিত্র সৌন্দর্য রচনা করে যেন জীবনের জয়গান গেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর এক বিষন্ন সূর্য ধীরে ধীরে উদিত হয়ে একটা ম্যাড়মেড়ে হলুদ আলো জঙ্গল, কেল্লার ওপর ছড়িয়ে দিল, আর তার ফলে অন্ধকার, ছায়ার বেশ ধারণ করে ভাঙাচোরা দেওয়ালের আড়ালে মুখ লুকোল। বেলিত একটা বড়সড় বিচিত্র দর্শন অট্টালিকার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল। সেটা একটা গলা পচা ভিত্তির ওপর থেকে পাক খেয়ে ওপরে উঠেছে। ফাটা, ঘাস গজানো চওড়া সিঁড়ি বেয়ে সেটার ধ্বংসপ্রাপ্ত দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। তার সামনেই একটা বিরাট বেদী। বেলিত দ্রুত পায়ে সেই প্রাচীন বেদীমূলে গিয়ে দাঁড়াল।
“এ নিশ্চয়ই আদিম দেবতাদের মন্দির ছিল।” সে বলল। “দেখ, এই বলীর বেদীর চারপাশে রক্তস্রোত বয়ে যাওয়ার জন্য নালা কাটা রয়েছে। হাজার বছরের বৃষ্টিপাতও এখানে লেগে থাকা রক্তচিহ্নকে মুছে দিতে পারেনি। চারপাশের দেওয়াল ধ্বসে গেছে, কিন্তু এই পাথরটা ঝড়, ঝঞ্ঝা, সময় সব কিছুকে উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে।”
“কিন্তু এই আদিম দেবতারা কারা?” কোনান জানতে চাইল।
উত্তরে সে অসহায়ভাবে দুপাশে তার হাত ছড়িয়ে দিল। “কী জানি, এমনকি কোন প্রাচীন কিম্বদন্তীতেও এই শহরের কথা শোনা যায় না। এই ওপরের পাথরটাকে লক্ষ্য করো। এর দুপাশে হাতল লাগানো আছে। অনেক সময় পুরোহিতেরা এইসব বেদীর মধ্যে ধনরত্ন লুকিয়ে রাখে। চারজন এদিকে এসো তো, দেখা যাক এই পাথরটা সরিয়ে কিছু পাওয়া যায় কিনা।”
অন্যদের জায়গা দেওয়ার জন্য সে মাথা উঁচু করে সেই ছায়াচ্ছন্ন ঝুঁকে পড়া বিচিত্র দর্শন অট্টালিকাটা দেখতে দেখতে কিছুটা পিছিয়ে গেল। তিনজন সবচেয়ে শক্তিশালী কৃষ্ণাঙ্গকে নিয়ে কোনান পাথরটা সরাবে বলে দুপাশের হাতলের খাঁজে হাত ঢোকালো। ওগুলোর আকৃতি কেমন অদ্ভুত, ঠিক মানুষের হাতের যোগ্য নয়। এমন সময় বেলিত একটা তীব্র চিৎকার করে পিছিয়ে যাওয়ায় সবাই চমকে গেল। কোনান জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকাতেই বেলিত বলল, “এখানে একটা সাপ দেখলাম। এক্ষুনি এসে ওটাকে মারো।”
কোনান সাপের খোঁজে সেদিকে যেতে আরেকজন কৃষ্ণাঙ্গ তার জায়গা নিল। যখন সে খোলা তরোয়াল হাতে সাপ খুঁজছে চার কালো যোদ্ধা প্রবল আকর্ষনে সেই পাথরটাকে সরানোর চেষ্টা করছিল। তাদের কষ্টিপাথরের মতো দেহের পেশীগুলো ফুলে উঠল, মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল পরিশ্রমের শব্দ। সেই প্রচন্ড টানে পাথরটা উপরে উঠলনা বটে, কিন্তু হঠাৎ পাক খেয়ে পাশে সরে গেল আর বাড়িটার একটা অংশ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল চার যোদ্ধার ওপর। পাথর চাপা পড়ে তৎক্ষনাৎ তাদের মৃত্যু হল।
তাদের সাথীরা সকলে ভয়ে চিৎকার করে উঠল। বেলিতের দীর্ঘ অঙ্গুলি কোনানের হাতের পেশীতে চেপে বসল। ফিসফিস করে সে বলল, “সাপ টাপ কিছু নেই। আমি ঠিকই ভেবেছিলাম, প্রাচীন পুজারীগুলো নিশ্চয়ই তাদের ঐশ্বর্য রক্ষা করার জন্য কিছু না কিছু যান্ত্রিক বন্দোবস্ত করে রেখেছে। তোমাকে ডেকে ওখান থেকে সরিয়ে আনাটা ভালো দেখাতো না, তাই আমায় এই ছলনার আশ্রয় নিতে হল। এখন চলো, পাথরগুলো সরিয়ে ফেলা যাক। “
প্রচন্ড পরিশ্রম করে তারা পাথর সরিয়ে সেই চারটে দলাপাকানো, থ্যাঁতলানো দেহ বের করে আনল। মৃতদেহগুলোর নীচে তাদের রক্তে ভেজা একটা সমাধির মত গহ্বর দেখতে পাওয়া গেল। বোঝা গেল ওপরের পাথরটা এক আশ্চর্যজনক পদ্ধতিতে পাথরে তৈরি কব্জা আর যন্ত্রের মাধ্যমে সেটার ডালা হিসাবে লাগানো ছিল। প্রথমে মনে হয়েছিল গহ্বরটার ভিতরে আগুন জ্বলছে। তারপর বোঝা গেল এক স্বর্ণভান্ডারের ওপর সকালের রোদ পড়ায় এই বিভ্রম সৃষ্টি হয়েছে। জলদস্যুর দল নিশ্বাস বন্ধ করে সেদিকে তাকিয়ে রইল। কী নেই সেই অবিশ্বাস্য রত্নভান্ডারে! হীরা, চুনী, পান্না, নীলকান্তমণি, চন্দ্রকান্তমণি, ওপাল, পোখরাজ, নীলা আরো নাম না জানা অসংখ্য দুর্মূল্য রত্ন যেন কোন শ্বাপদের চোখের মতো জ্বলজ্বল করে চেয়ে রয়েছে। সেগুলোর ওপর সকালের রোদ পড়ার ফলে তাদের দ্যুতিতে চারপাশ স্নিগ্ধোজ্জ্বল হয়ে উঠল।
উল্লাস ধ্বনি করে উঠে বেলিত রক্তরঞ্জিত বেদীমূলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে তার শ্বেতশুভ্র বাহু দুটি সেই ঐশ্বর্যের মধ্যে কাঁধ অবধি সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দিল। সেই রত্নসাগর থেকে হাত বের করার সময় সে দৃঢ়মুষ্ঠিতে যেটা টেনে বের করে আনল, তা দেখে সে আবার আনন্দে চিৎকার করে উঠল। একটা মোটা সোনার মালা যাতে সমদূরত্বে অপূর্ব উজ্জ্বল লাল রত্ন লাগানো, যেন রক্ত জমাট বেধে আছে। সেগুলোর দীপ্তিতে সেখানের চারপাশের সুর্যালোকও রক্তিম হয়ে উঠল।
বেলিত সম্মোহিতের মত চেয়ে ছিল। শেমীয় হৃদয় এমনিতে সহজেই অর্থ এবং জাগতিক ঐশ্বর্যে মাতাল হয়ে পড়ে আর এই পরিমান ধনরত্ন তো শুশানের অতুল বৈভবশালী সম্রাটকেও কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
“লুটেরার দল, মণি মানিক গুলোকে জাহাজে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।” তার তীক্ষ্ম স্বর তার মনের অবস্থা প্রকাশ করল।
“দেখো!” একটা পেশীবহুল কালো হাত বাঘিনীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে চেঁচিয়ে উঠল। তা শুনেই এমনভাবে বেলিত তার রক্ত লাল ওষ্ঠ ফাঁক করে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে সিংহিনীর মত ঘুরে দাঁড়াল, যেন অন্য কোন দস্যুদল তার কাছ থেকে এই অতুল ঐশ্বর্যরাশী কেড়ে নিতে আসছে। কিন্তু দেখা গেল জাহাজের খোলের জানালা দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে ডানা মেলে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
“শয়তান বানরটা আমাদের জাহাজে তল্লাশি চালাচ্ছিল।” কৃষ্ণাঙ্গটি অত্যন্ত অস্বস্তির সাথে বলল।
“তাতে হয়েছেটা কী?” বেলিত বিদ্রোহীর মত ঘাড় উঁচু করে হাত নেড়ে বলল। “বর্শা আর কাপড় দিয়ে ডুলি বানিয়ে এগুলোকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর। এই, তুমি আবার চললে কোথায়?”
“জাহাজটা দেখতে।” কোনান ঈষৎ বিরক্তির সাথেই বলল, “ওই বাদুড়ে বাঁদরটা জাহাজের তলায় ফুটো করে দিতেই পারে। “
সে দ্রুত পায়ে ভাঙাচোরা জেটিটা পার করে লাফিয়ে জাহাজে উঠল। পাটাতনের নিচে পরিদর্শন করার পর বাদুড় বানরটা যেখান দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল সেদিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘৃণায় গালি দিয়ে উঠল সে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেলিতের কাছে ফিরে এসে কোনান দেখল সে তখন সেই সমাধি গহ্বরের রত্নরাজি ব্যবস্থাপনার কাজ তদারকি করছে। এরমধ্যেই সে সেই সোনার হারটা গলায় জড়িয়ে নিয়েছে আর তার নগ্ন শ্বেত উরসে রক্তলাল রত্নগুলো কেমন অদ্ভুতভাবে ঝকমক করছে। এক বিশালদেহী কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধা সেই গহ্বরের ঐশ্বর্যের মধ্যে কোমর অবধি ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আঁজলা করে সোনা মানিকগুলো ওপরের সাগ্রহী সহযোগীদের হাতে তুলে দিচ্ছে। তার নিকষ কালো করতলে রত্নগুলো রামধনুর মতো আলো বিচ্ছুরণ করছে, রক্তের মত ঝরে পড়ছে, অন্ধকার গহ্বরটা সোনালী আভায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে এক বিরাট দৈত্য যেন নরকের আগুনে দাঁড়িয়ে দুহাতে তারাদের নিয়ে খেলা করছে।
“উড়ন্ত শয়তানটা আমাদের সব জল রাখার পাত্রগুলো ভেঙে দিয়ে গেছে।” সে তিক্ত স্বরে বলল, “আমরা সোনাদানা দেখে এমন বাহ্যজ্ঞানশূন্য না হয়ে গেলে আওয়াজ শুনতে পেতাম। ওখানে কোন পাহারাদার না রেখে আসা ভয়ানক বোকামির কাজ হয়েছে। নদীর জল খাওয়া যাবে না। আমি কুড়িজন লোক নিয়ে জঙ্গলের ভিতর কোথায় খাওয়ার জল পাওয়া যায় তা খুঁজতে বের হব।”
আঙুলে গলার সোনার হারটা জড়িয়ে খেলা করতে করতে বেলিত তার দিকে কেমন অভিব্যক্তিহীন ভাবে তাকাল, বোঝাই গেল রত্নের প্রতি গভীর আসক্তি তার স্বাভাবিক চিন্তাভাবনাকে ব্যহত করছে।
“বেশ,” সে তার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যমনস্কভাবে বলল, “আমি ততক্ষনে এগুলোকে জাহাজে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি।”
অতিদ্রুত ঘন জঙ্গল তাদের ঘিরে ধরল। আলোর রঙ সোনালী থেকে বদলে ধুসর হয়ে গেল। আকাশজোড়া বাঁকানো ডালপালা থেকে অজগরের মত লতাপাতা ঝুলছিল। কোনান এবং যোদ্ধারা বাধ্য হয়ে একটা সারিতেই সেই প্রাগৈতিহাসিক জঙ্গলের আলো আঁধারে এমনভাবে হেঁটে চলেছিল; যেন কিছু কালো অতৃপ্ত আত্মা এক সাদা অশরীরীকে অনুসরণ করে চলেছে। সে যেমন আশঙ্কা করেছিল, পায়ের নীচে পাতার স্তুপ কিন্তু ততটা মোটা নয়; স্পঞ্জের মত নরম কিন্তু একেবারে গলে পচে যায়নি। তারা নদী থেকে যত দূরে যাচ্ছিল, মাটির ঢাল তত উপরের দিকে উঠছিল। তারা সেই সবুজ সমুদ্রের গভীরে, আরো গভীরে প্রবেশ করল, কিন্তু জলের সন্ধান পাওয়া গেল না। একটা নদী বা জলাশয়, কিছুই দেখা গেল না।
হঠাৎ কোনান দাঁড়িয়ে পড়ল, আর সাথে সাথে তার সঙ্গীরাও পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে গেল। সেই অসহ্য নিস্তব্ধতায় সিমেরীয়টি বিরক্তিতে মাথা নাড়াতে লাগল।
“তোমরা এগিয়ে যাও।” এক উপসর্দার ন্’গোরা কে সে ফিসফিস করে বলল। “সোজা হেঁটে এগিয়ে যাও যতক্ষন না পর্যন্ত আমি তোমাদের চোখের আড়াল হচ্ছি, তারপর দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা কর। আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাদের অনুসরণ করছে। কিছু একটা শুনলাম মনে হল।”
কৃষ্ণাঙ্গদের চোখ মুখে অস্বস্তির ছায়া ফুটে উঠলেও তারা সেই নির্দেশ মেনে নিল। সাপের মত এঁকেবেঁকে তারা এগিয়ে যেতেই কোনান দ্রুত একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাদের ফেলে আসা পথের দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু সেই স্তব্ধ পাতাদের ভেদ করে কিছুই এগিয়ে এল না। কিছুই ঘটল না, কেবল বর্শাধারীদের পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল। এমন সময় হঠাৎ সে খেয়াল করল আশপাশের বাতাস এক অচেনা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কেউ যেন তার পিঠ হালকা করে ছুঁয়ে গেল। সে চকিতে ঘুরে দাঁড়াল। সবুজ পশ্চাৎপটের সামনে বিচিত্রদর্শন লতাপাতার থেকে কালো পদ্মের মত দেখতে কিছু ফুল তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ছে। এদের মধ্যেই কেউ তাকে ছুঁয়েছিল। সেগুলো যেন তাকে ইশারা করছে, তাদের লতা বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে চাইছে। কোন বাতাস না বইলেও তারা নড়ছিল, খসখসে আওয়াজ তুলছিল।
কোনান পিছিয়ে আসতে চাইল। সে ঠিক চিনেছে। কৃষ্ণ কমল। যার রস বিষ, রেনু মৃত্যু। যার গন্ধে মানুষ অনন্ত স্বপ্নাবিষ্ট নিদ্রায় ডুবে যায়। কিন্তু তার হাত পায়ে অসীম আলস্য জড়িয়ে ধরছে। সে তরোয়াল দিয়ে লতাগুলোকে ছিন্ন করতে চাইল, কিন্তু তার দুটি হাত দুপাশে প্রাণহীনের মত ঝুলে রয়েছে। সে চিৎকার করে তার যোদ্ধাদের ডাকতে চাইল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কেবলমাত্র একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরিয়ে এল। পর মুহূর্তে হঠাৎ করে তার চোখের সামনে থেকে জঙ্গল ঝাপসা হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। হাঁটু গেড়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার সময় সে শুনতেই পেল না কিছু দুরেই তার সঙ্গীদের গলা থেকে বিভৎস আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। তার উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহের ওপর বিরাট কৃষ্ণকমলগুলো ঝুঁকে পড়ে দুলতে লাগল।
III
অরণ্যের আতঙ্ক
স্বপ্ন ছিল কী তা?
এসেছিল কালো পদ্ম নেশার হেতু?
অভিশাপ তাকে
যে স্বপন আনে এমন অলস জীবন।
সে অলস কালই
অভিশপ্ত জানি রুধিতে পারেনি যাহা,
শত্রুর হাতে
সহচরদের কৃষ্ণ কূটিল মরণ।
-বেলিতের গান।
শুরুতে ছিল এক তমসাবৃত মহাশুণ্য, অনন্ত মহাজগতের শীতল বায়ুস্রোত। এরপর সেই নিঃসীম তিমির যেন অস্পষ্ট, ক্ষনে ক্ষনে বিলিয়মান, অথচ অতিকায় দৃশ্যপটে বিস্তৃত হয়ে ধীরে ধীরে রূপ পরিগ্রহ করতে লাগল। সেই বহমান মরুৎ ঘুর্ণিঝড়ে পরিনত হয়ে এক আঁধার পিরামিডে পরিনত হল। তারপর তা থেকে সৃষ্টি হল আকৃতি ও মাত্রার। এরপর হঠাৎই যেভাবে কৃষ্ণ কজ্জ্বল ছিন্ন করে সবিতা রশ্মির প্রবেশ ঘটে তেমনি সীমাহীন সমতলে প্রশস্ত নদী তীরে এক সুবিশাল হরিৎ প্রস্তর নির্মিত শহরের আবির্ভাব ঘটল। এই শহরের মাঝে দেখা যেতে লাগল বিচিত্র বিদেশী অবয়ব।
মানবজাতির গঠনবৈশিষ্টের কথা মাথায় রাখলে, তাদের অবশ্যই মানুষ বলে ডাকা যাবে না। তারা ছিল পক্ষধর, বিশালদেহী। মানুষ বিবর্তনের যে পথ ধরে এসেছে, সে পথ তাদের নয়। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, অন্যরূপ বিবর্তন বৃক্ষের ফলে তাদের উদ্ভব। মানবদেহের সাথে তাদের মিল খুঁজতে গেলে কল্পনায় আনতে হবে সেই সময়ের বিশালদেহী অতিবানরদের, যখন মানবসভ্যতার যাত্রা শুরু হয় নি। কিন্তু আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে তারা মানবসভ্যতার থেকে ততটাই এগিয়ে ছিল, যতটা মানুষ গরিলাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। যখন তারা এই সুবিশাল মহানগরীর পত্তন করে তখনও এই পৃথিবীতে জীবজগতের পুর্বপুরুষ জল থেকে স্থলে উঠে আসে নি।
রক্ত মাংসে গড়া সব জীবেদের মতই তারাও নশ্বর ছিল। তারাও বাঁচতো, ভালোবাসতো, মারা যেতো; যদিও তাদের জীবৎকাল ছিল অতিদীর্ঘ। এভাবেই বহু বহু বছর কেটে গেল।
পট পরিবর্তিত হল। হাওয়ার স্রোতে যেভাবে পর্দা দুলে ওঠে, তেমনভাবেই ছবিগুলো আন্দোলিত হয়ে, ঝিলমিল করতে করতে মিলিয়ে গেল। সমুদ্র তরঙ্গের মতই সময়ের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল আর ক্ষনে ক্ষনে শহর, স্থলভাগ বদলে যেতে লাগল। সেই সময় এই গ্রহে কোথাও একটা বড়সড় পরিবর্তন ঘটছিল। ভূচৌম্বক ক্ষেত্র পূনর্বিন্যস্ত হচ্ছিল, সুবিশাল হিমবাহগুলো গলে যাচ্ছিল, তুষার ক্ষেত্রগুলো নতুন মেরু গঠন করছিল।
নদীর গতিপথ বদলে গেল। স্থলভাগ জলাভূমিতে পরিনত হল, বিকশিত হল সরিসৃপদের জীবন। যেখানে উর্বর জমিতে খাদ্যশস্যরা মাথা দোলাতো, সেখানে মাথা তুলল সুবিশাল অরণ্যানী। সেই পরিবর্তন শহরবাসীদেরও প্রভাবিত করল। তবু তারা নতুন ভূখণ্ডের খোঁজে বের হল না। অব্যাখ্যাত কারণে তারা সেই মৃতপ্রায় সভ্যতাকে আঁকড়ে ধরে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলল। সেই শক্তিশালী সমৃদ্ধ শহর যত সূর্যালোকহীন ঘন বনে ঢেকে যেতে লাগল, নিয়ন্ত্রণহীন বন্য জীবনের প্রভাব তত প্রকট হতে লাগল শহরবাসীদের জীবনযাত্রায়। এরপর এক প্রবল ভুমিকম্পে পৃথিবী দুলে উঠল। রাত্রির দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠল বহু আগ্নেয়গিরির অগ্নিশিখায়।
যে ভূমিকম্পে শহরের বহিঃপ্রাচীর আর সুউচ্চ অট্টালিকাগুলো ভেঙে পড়েছিল, তার ফলেই নদীর জল ঘন কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করল। হয়তো ভূস্তরের গভীর থেকে উঠে এসেছিল কোন অজানা রাসায়নিক। যুগ যুগ ধরে যা ছিল বিশুদ্ধ পানীয় তাতে এক মারাত্মক পরিবর্তন এল।
অনেকেই সেই জল পান করে মারা গেল। যারা বেঁচে রইল তারা ক্রমশ দুর্বোধ্য ভয়ংকর পরিনতির দিকে এগিয়ে চলল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে গিয়ে তারা মনুষ্যেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হল। কিন্তু এতেই সে অধঃপতন স্তব্ধ হল না। সেই বিষাক্ত বারি তাদের শারীরিক, মানসিক দিক দিয়ে এতটাই বিপর্যস্ত করেছিল যে তারা তাদের পুর্বপুরুষের লব্ধ জ্ঞান, উন্নত জীবনচর্চা, মানসিকতা সব জলাঞ্জলি দিয়ে বীভৎস আচার, কুসংস্কারে ডুবে গেল। একসময় যারা জ্ঞান বিজ্ঞানে দেবতাদের মত, মানুষের পক্ষে অকল্পনীয় উচ্চতায় উঠেছিল, তারা ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্নের নরকে পতিত হল। রাতের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল হিংস্র পশুর দল। শেষে তারা নিজেদের মাংসও খাওয়া শুরু করল। দ্রুত মৃত্যু তাদের গ্রাস করতে লাগল। শেষপর্যন্ত এই শ্যাওলাঢাকা ধ্বংসস্তুপে ঘুরে বেড়াতে লাগল একটিমাত্র অবয়ব। এক জঘন্য প্রকৃতির পৈশাচিক জীবের ছায়ারূপ।
তারপর প্রথম বারের মত মানুষদের আবির্ভাব ঘটল। তারা ছিল তামাটে বর্ণের, তীক্ষ্ম চোখের, ধনুর্ধর, চামড়ার বর্ম পরিহিত স্টাইজিয়ার অধিবাসী। পঞ্চাশ জনের একটা সৈনিকের দল। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধে পরাজিত, ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত, পলায়নরত, পথহারা, ঘন জঙ্গলে ঘুরে ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত। তাদের মনে যুদ্ধের ভয়ংকর স্মৃতি, তাদের চোখে এই শ্যাম বর্ণের নদীতীরের সীমাহীন অরণ্যে দিকভ্রান্তের দীশাহীনতা। তারা এই দক্ষিণের ভূখন্ডে পা রাখতে বাধ্য হয়েছিল।
পথশ্রান্ত হয়ে তারা এই ধ্বংসস্তুপের অঙ্গনে শুয়ে পড়েছিল। সেই পুর্ণিমার রাতে সেখানে এক লাল রঙের ফুল ফুটেছিল, যা নাকি শতাব্দীতে একবার জ্যোৎস্নালোকে ফোটে। তারা তার মাঝেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এমন সময় অরণ্যের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক জঘন্য পাশবিক মুর্তি। রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে সে সেই ঘুমন্ত দেহগুলোর ওপর অজানা মন্ত্রোচ্চারণ করে বীভৎস ক্রিয়াচার চালাতে লাগল। মৃদু বাতাসে সেই লাল ফুলেরা মাথা দোলাতে লাগল যেন তাদের ওপর দিয়ে রক্তস্রোত বয়ে যাচ্ছে। লোহিত বরণ চাঁদ স্তব্ধ হয়ে অরণ্যের অন্ধকারকে যেন আরো গাঢ় করে তুলছিল। তারপর একসময় চাঁদ অস্ত গেলে কেবলমাত্র সেই জাদুকর পিশাচের রক্তচক্ষু আবলুশ বর্ণের রাত্রে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে লাগল।
ভোর নদীর ওপর তার সাদা ওড়না ছড়িয়ে দেওয়ার পর দেখা গেল মানুষেরা সব অদৃশ্য হয়ে গেছে, কেবলমাত্র এক রোমশ পক্ষযুক্ত আতঙ্কের চারদিকে গোল করে বশংবদের মতো বসে আছে পঞ্চাশটি বিশালকায় চিতল হায়না। তারা একসাথে মেঘাবৃত আকাশের দিকে নিজেদের ছুঁচালো মুখ তুলে নরকে আটকে পড়া আত্মার মতো আর্ত চিৎকার করে উঠল।
এরপর এত দ্রুত দৃশ্যের বদল ঘটতে লাগল যে একটি ছবির সাথে আরেকটি মিশে যাচ্ছিল, আলো আঁধার যেন নতুন মায়া সৃষ্টি করতে লাগল। সবুজ শহর, ঘন কালো জঙ্গলের পটভূমিতে একের পর এক বীভৎস দৃশ্যের সৃষ্টি হচ্ছিল। কালো মানুষেরা কখনো মানুষের খুলি দিয়ে সাজানো লম্বা নৌকায়, কখনো অরণ্যপথে উপস্থিত হচ্ছিল। প্রবলভাবে আক্রান্ত হয়ে সভয়ে তারা সেই বাদুড়ের মত ডানাযুক্ত শয়তান আর লালাঝরা শ্বদন্তের অধিকারীদের থেকে বেঁচে পালাতে চাইছিল। অরণ্যাঞ্চল ভরে যাচ্ছিল আর্তনাদে। সেই আঁধার রাজত্বে শ্বাপদেরা নিঃশব্দ পদচারণে ঘুরছিল, আর একজোড়া লাল চোখ রক্তচোষার চোখের মত আগুন ছড়াতে লাগল। চাঁদের আলোয় এক বাদুড় সদৃশ অবয়বের ছায়ায় ভয়াবহ রক্তাক্ত ভোজের আসর বসতে লাগল বারংবার।
অকস্মাৎ এই জলছবির মতো চিত্রপট সরে গিয়ে প্রভাতের উজ্জ্বল আলোতে দেখা গেল এক দীর্ঘ কৃষ্ণকায় রণতরীকে, তার কষ্টিপাথরের মতো কালো নাবিকদের, আর তাদের নেতা এক বিশালদেহী শ্বেতকায় যোদ্ধাকে যার হাতের খোলা তরবারি থেকে সূর্যালোক ঠিকরে পড়ছে।
এই মুহূর্তে কোনান বুঝতে পারল যে, সে স্বপ্ন দেখছে। এর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তার চেতনা বা ব্যক্তিগত অস্তিত্বের বোধ সম্পূর্ণ অবলুপ্ত ছিল। কিন্তু যখন সে বাঘিনী – র ওপর নিজেকে দেখতে পেল, সে বাস্তব ও স্বপ্নের পার্থক্য বুঝতে পারল, যদিও তার ঘুম তখনই ভাঙল না।
তার বিস্ময়াভিভূত মানসচক্ষুর সামনে সেই দৃশ্যও পালটে গেল। দেখা গেল ন্’গোরা আর তার উনিশজন সহযোগী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যেন কারো জন্যে অপেক্ষা করছে। এই অবস্থাতেও কোনান বুঝতে পারল তারা তার জন্যেই অপেক্ষারত। এমন সময় আকাশ থেকে ছোঁ মারল এক মূর্তিমান বিভীষিকা, আর তার ফলে প্রবল আতঙ্কে চিৎকার করে তারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। ভয়ের আতিশয্যে দৌড়নোর সময় তাদের হাত থেকে ছিটকে পড়ল অস্ত্রশস্ত্র। মাটিতে রক্তলোলুপ শ্বদন্তধারী আর আকাশে ডানাওলা শয়তান তাদের অনুসরণ করতে লাগল।
এই দৃশ্যের পরেই বিশৃঙখলা আর বিভ্রান্তি দেখা দিল আর কোনান চেষ্টা করতে লাগল তার স্বপ্নজাল ছিন্ন করার। আবছাভাবে সে অনুভব করতে লাগল যে সে কৃষ্ণকমলের নেশায় আচ্ছন্ন। তার মনে হল পাশের ঘন জঙ্গল থেকে কোন পৈশাচিক আকৃতি তার দিকে নিঃশব্দ পদচারণে এগিয়ে আসছে। এর পরেই সে এক ঝটকায় ঘুম ভেঙে উঠে বসল। বিহ্বল ভাবে সে দেখল তার ওপরে একাধিক কৃষ্ণকমল ঝুঁকে পড়ে তাকে যেন তাদের জাদুমন্ত্রে বশ করে রাখার চেষ্টা করছে। পাশেই পড়ে থাকা তরবারিটা কুড়িয়ে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সে সেখান থেকে সরে গেল। তার কিছুদুরে পত্রাচ্ছাদিত ভূমিখন্ড দেখে তার অভিজ্ঞ চোখ তাকে জানিয়ে দিল, ঘন জঙ্গল থেকে বের হয়ে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল কোন শিকারী পশু। পায়ের ছাপ দেখে মনে হল তা এক অতিকায় হায়নার পদচিহ্ন।
সে চিৎকার করে ন্’গোরাকে ডাকল। কিন্তু সেই প্রাগৈতিহাসিক অরণ্যের গাঢ় নিস্তব্ধতায় তার কন্ঠস্বরকে তুচ্ছ অন্তঃসারশূন্য বিদ্রুপের মত শোনাল। সূর্য দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু তার বন্য ইন্দ্রিয় জানান দিল সন্ধ্যা ঘনাতে আর বেশি দেরি নেই। এত দীর্ঘ সময় সে জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে ছিল, এই ভাবনাটাই তার মনে একটা সিরসিরে ভয়ের জন্ম দিচ্ছিল। সামনের পাতার স্তুপে তার বর্শাধারীদের চলার পথ পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল। সে সেটাকে অনুসরণ করল। ওরা এক সারিতে হেঁটে গিয়েছিল। একটু দুরেই বনের মধ্যে গাছে ঘেরা একটা ফাঁকা জায়গা দেখতে পেল সে। প্রবল আতঙ্ক নিয়ে সে সেটাকে চিনতে পারল। এটা তার স্বপ্নে দেখা সেই জায়গাটা যেখানে ন্’গোরা আর তার সাথীরা আক্রান্ত হয়েছিল। এখানে ওখানে পড়ে থাকা ঢাল, বর্শা, অস্ত্রশস্ত্র এক প্রবল লড়াইয়ের কাহিনি শোনাচ্ছে, কিন্ত তার সঙ্গীদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
সেখান থেকে কয়েকটা পথচিহ্ন আরো গহন বনের মধ্যে হারিয়ে গেছে। কোনান বুঝল ভয়ে পাগল হয়ে সে পথেই তার সঙ্গীরা পালিয়েছে। এঁকেবেকে ছুটে চলা একটা পায়ের ছাপের ওপর আরেকটা ছাপ পড়েছে। প্রচন্ড ভয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে দৌড়েছে ওরা। ওদের গতিপথ অনুসরণ করতে করতে কোনান একটা পাথুরে ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। তার পরেই একটা পাহাড়ি খাদ। দূর থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেটা অন্তত চল্লিশ পঞ্চাশ ফুট গভীর। আর সেটার ধারঘেঁসে গুঁড়িমেরে কিছু একটা উঠে আসছে।
প্রথমে কোনানের মনে হল সেটা একটা বিশাল কালো গরিলা। তারপর সে বুঝলো সেটা একটা মিশমিশে কালো মানুষ যেটা গরিলার মতই ঝুঁকে দুপাশে হাত দুলিয়ে এগিয়ে আসছে। তার কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালারস। তারপর যখন সেটা দুহাত তুলে একটা বীভৎস আওয়াজ করে কোনানকে আক্রমণ করল, সে ন্’গোরা কে চিনতে পারল। কোনান চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকতে লাগল, কিন্তু সে তাতে কর্ণপাত করল না। তার চোখ মরা মাছের মত দৃষ্টিহীন, শ্বদন্ত ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, মুখে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নেই।
কোনান বার বার তার আক্রমণ থেকে বাঁচতে বাঁচতে তাকে সাবধান করার চেষ্টা করল। কিন্তু কোন অশুভ জাদুর বশবর্তী হয়ে সে যেন পশুতে পরিনত হয়েছে। তারপর আতঙ্কিত হয়ে কোনান অনুভব করল এই পাগলামি যেন তাকেও প্রভাবিত করছে। ন্’গোরা তীক্ষ্ণ নখ বাড়িয়ে তার গলা চেপে ধরার চেষ্টা করতেই সে তরোয়াল দিয়ে তার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ করে দিল। তার পায়ের কাছে ন’গোরার দেহটা প্রাণহীন হয়ে পড়ে রইল। নিজেকে সামলে নিয়ে এবার সে খাদের পাশে এসে দাঁড়াল।
খাদের নিচের এবড়োখেবড়ো পাথরগুলোর দিকে তাকিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার সঙ্গীদের প্রাণহীন দেহগুলো সেখানে ছিন্নভিন্ন হয়ে দলাপাকিয়ে পড়ে রয়েছে। আশেপাশে জমাট বাধা রক্তের দাগ। তার ওপরে বিরাট মাছির ঝাঁক শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। পিঁপড়েরা দলবেধে এসে মৃতদেহগুলোর ওপর চড়ে তাদের কাজ শুরু করেছে। কাছের গাছগুলোতে শকুনের আনাগোনা শুরু হয়েছে। একটা সাবধানী শেয়াল উপরে খাদের ধারে মানুষ দেখে পিছু হটে জঙ্গলে গা ঢাকা দিল।
হঠাৎ করে কোনান নিজের জড়তা ভেঙে পিছন ফিরে দৌড় লাগালো। পথের লম্বা ঘাস পাতা ভেদ করে, সাপের মত ঝুলে বাধা সৃষ্টি করতে আসা লতাগুলোকে ছিন্নভিন্ন করতে করতে সে পাগলের মত ছুটতে লাগল। তার হাতে খোলা তলোয়ার, মুখ অস্বাভাবিক রকমের ফ্যাকাশে।
অরণ্যের নিস্তব্ধতা বিঘ্নিত হল না। সূর্য অস্ত গেছে, আর ছায়ারা দীর্ঘতর হয়ে অন্ধকার পৃথিবীর রাজত্ব কায়েম করতে আসছে। আগ্রাসী মৃত্যুর দীর্ঘ ছায়া আর বিষন্ন নির্জনতার মাঝে কোনান তরোয়ালের ইস্পাতের নীল আর পোষাকের লাল ঝলকের সৃষ্টি করে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলল। সেই নির্জন অরণ্যে তার নিজের দ্রুত নিশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। সে জঙ্গল থেকে ছুটে বেরিয়ে নদীতীরে এসে থমকে দাঁড়াল।
সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে সে দেখল সেই গলা পচা জাহাজঘাটার ধারে বাঘিনী মৃদুমন্দ ঢেউয়ে অল্প অল্প দুলছে।
এখানে ওখানে পাথরের ওপর গাঢ় রঙের ছোপ, যেন কোন অপটু শিল্পী তুলি দিয়ে যেখানে সেখানে টকটকে লাল রঙ ছিটিয়েছে।
আবার কোনান মৃত্যু আর ধ্বংসের দিকে তাকাল। তার সামনে বর্শাধারী সহচরেরা পড়ে রয়েছে। তাদের কেউই তাকে অভিবাদন করতে উঠে দাঁড়াল না। জঙ্গলের ধার থেকে নদীর তীর, পচা কাঠের খুঁটির পাশে, জাহাজঘাটার ওপরে সর্বত্র তারা পড়ে আছে। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, অর্ধেক খাওয়া মৃতদেহগুলো যে মানুষের তা খুব কষ্ট করে বুঝতে হয়।
আর এই দেহাংশগুলোর আসেপাশে হায়নার পায়ের ছাপের মত দেখতে অথচ বিশাল আকারের কয়েকটা পদচিহ্ন।
কোনান ধীর পদক্ষেপে জেটির উপর উঠে জাহাজের দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যার ম্লান আলোতে দেখল, জাহাজের মাস্তুল থেকে চন্দনবর্ণের কিছু একটা ঝুলছে। জাহাজে উঠে বাকশক্তিহীন সিমেরীয় কৃষ্ণ উপকূলের সম্রাজ্ঞীর দিকে চেয়ে রইল। তার প্রাণহীন দেহ তার নিজের জাহাজের মাস্তুল থেকে ঝুলছে। তখনো তার গলায় চেপে বসে রয়েছে একটা সোনার মালা যেটার টকটকে লাল রত্নগুলোকে সেই ধুসর আলোতে জমাট বাধা রক্তের মত দেখাচ্ছে।
IV
আকাশ থেকে আক্রমণ
চারিধারে দেখি নিকষ কালো ছায়া
গিলতে আসে দাঁত বের করে সবে।
বৃষ্টির মতো রক্তের ফোঁটা ঝরে
প্রেমিক আমার মৃত্যুরও বড় তবে;
আমায় ছিনিয়ে নিয়ে পাশ থেকে তার
বাঁধবে নরকে এমন সাধ্য কার?
-বেলিতের গান।
অরণ্য এক কালো দৈত্যের মত তার আবলুশ বর্ণের বিশাল হাত বাড়িয়ে সেই শহরের ধ্বংসস্তুপকে ঘিরে ধরেছিল। চাঁদ তখনো ওঠে নি, তারারা গলিত গরম তৈলস্ফটিকের মত হলদেটে আলো ছড়াচ্ছিল, দমবন্ধকরা আকাশ মৃত্যুগন্ধ ছড়িয়ে ঝুঁকে পড়েছিল দৃশ্যপটের ওপর। শহরের ভেঙে পড়া অট্টালিকাগুলোর মাঝে পিরামিডের ওপরে এক নিস্পন্দ লৌহ মূর্তির মতো সিমেরীয় কোনান বসে ছিল। তার চিবুক তার বিশাল মুষ্টির উপর রাখা। বহুদূরে নিকষ কালো আঁধারে নিঃশব্দ চরণে রক্তচক্ষুর অধিকারীরা চলাফেরা করছিল। মৃতরা যে যেখানে ছিল সেখানেই পড়েছিল। কেবলমাত্র বাঘিনীর পাটাতনে এক কাঠের শয্যায় চিতাবাঘের চামড়ার উপরে বর্শাঘেরা অবস্থায়, কোনানের টকটকে লাল আলখাল্লা জড়িয়ে তার শেষ নিদ্রায় শুয়েছিল কৃষ্ণ উপকূলের সম্রাজ্ঞী। এক প্রকৃত রানীর মতই ঘুমিয়ে ছিল সে। তার চারপাশে স্তুপিকৃত হয়ে পড়েছিল, পাহাড় প্রমান সোনার কারুকাজ করা রেশমের কাপড়, রত্ন আর স্বর্ণমূদ্রা ভর্তি পেটিকা, রুপোর বাঁট আর ধাতুশিল্পের নিদর্শন, রত্নখচিত ছুরি, অঢেল সোনা আর রত্নের রাশি।
কেবলমাত্র সেখানে এই অভিশপ্ত শহরের কোন ছোঁয়া ছিল না। জ়ারখেবার কালো জলই কেবল বলতে পারবে অভিশম্পাত দিতে দিতে অগ্নিচক্ষু কোনান কোথায় সেই ঐশ্বর্য ছুঁড়ে ফেলেছিল। এখন সে পাথরের মতো এই পিরামিডের ওপর বসে তার অদৃশ্য শত্রুদের জন্য প্রতীক্ষা করছে। অন্ধ ক্রোধ তার হৃদয় থেকে যাবতীয় ভয় দূর করে দিয়েছে। সে জানে না ঐ আঁধার ফুঁড়ে কোন ভয়ংকর বের হবে। সে পরোয়াও করে না।
এখন সে আর কৃষ্ণ কমলের স্বপ্নকে অস্বীকার করছে না। সে জানে যখন ন’গোরা আর তার সাথীরা জঙ্গলে তার জন্য অপেক্ষা করছিল, আকাশ থেকে সেই বীভৎস দর্শন শয়তান আর তার জন্তুর দল তাদের আক্রমন করে। আতঙ্ক তাড়িত, দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালানোর সময় তারা খাদে পড়ে যায়, নয়তো তাদের পরিকল্পনা মাফিক তাড়িয়ে এনে সেখানে ফেলা হয়। কেবলমাত্র ন্’গোরা কোন অজ্ঞাত কারণে প্রাণে বাঁচে, কিন্তু পাগল পিশাচে পরিণত হয়। সেইসময়, বা তার অব্যবহিত পরে, কিম্বা হয়ত তার আগেই নদীতটে সেই হত্যালীলা সংঘটিত হয়। কোনান স্থির নিশ্চিত, সেটা যুদ্ধ নয় একতরফা বেপরোয়া সংহার ছিল। আতঙ্কিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধারা তাদের পাশব শক্তির অধিকারী শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহসের সাথে কোন প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারে নি।
কিন্তু তাকে কেন এখনো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, এ বিষয়ে সে নিশ্চিত হতে পারছিল না। হতে পারে নদীতীরের শয়তান শাসক তার জন্য আরো ভয়ানক যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যুর ব্যবস্থা করে রেখেছে। খাবার জলের আধারগুলো নষ্ট করে সৈন্য দলকে দুভাগে ভাগ করা, কৃষ্ণাঙ্গদের খাদে ফেলা, শেষ এবং সবচেয়ে মারাত্মক, বেলিতের শ্বেতশুভ্র গ্রীবায় রক্তিম রত্নখচিত হার জড়িয়ে দমবন্দ করে এক ফাঁসুড়ের মত তাকে হত্যা করা, গোটা ঘটনাবলী এক কুটিল মানব বা অতিমানব সদৃশ জটিল চতুর পরিকল্পনাকারীর পরিচয় বহন করছে।
কোনানকে যেন খুব যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে তাকে প্রবল মানসিক যন্ত্রনা দেওয়ার জন্য। সব অত্যাচার শেষ হওয়ার পর তাকেও তার সঙ্গীদের মত মৃত্যুর রাজত্বে পাঠানো হবে। তার ক্লিষ্ট ঠোঁটে কোন হাসি ফুটে উঠল না, কিন্তু তার হৃদয়ে কেউ যেন পাগলের মত অট্ট হাসি হেসে চলেছিল।
সিমেরিয়টির বাঁকা শৃঙ্গবিশিষ্ট শিরস্ত্রাণে আগুন লাগিয়ে চাঁদ উঠল। এবারে অরণ্যে কোন উল্লাসধ্বনি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল না। তা যেন রূদ্ধশ্বাসে কোন বীভৎস ঘটনার সাক্ষী থাকবে বলে প্রতীক্ষায় রয়েছে। বন্য অনুভূতিতে কোনান তার দীর্ঘ তরবারি পাশে রাখল। যে পিরামিডের উপর সে বসে ছিল তার চারটি তলের মধ্যে তিনটি ঢালু ও মসৃণ। জঙ্গলের দিকের তলটি কেবলমাত্র চওড়া সিঁড়ি বিশিষ্ট। তার হাতে এখন একটা শক্তিশালী শেমীয় ধনুক, বেলিত যা জলদস্যুদের চালনা করা শিখিয়েছিল। তার পাশে সযত্নে সাজানো একটা তিরের স্তুপ, যেগুলোর পালক লাগানো পশ্চাৎ অংশ তার দিক করে রাখা। সে এক হাঁটু গেড়ে প্রস্তুত হয়ে বসে রইল।
কিছু একটা দূরের গাছগুলোর নিচে অন্ধকারে নড়ল। অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে মনে হল, অন্ধকারে ছুঁচলো মাথা আর চওড়া কাঁধ বিশিষ্ট একটা পাশবিক রূপ সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে। তারপর দলপতি কে অনুসরণ করে একসাথে নিঃশব্দে, ক্ষিপ্রবেগে, নিচু হয়ে কুড়িটা বিশাল চিতল হায়না তার দিকে ছুটে আসতে লাগল। এবার তাদের লালা ঝরা তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি, জ্বলন্ত চোখ দেখা যাচ্ছে। তাদের চোখে যেন নরকের আগুন জ্বলছে।
মোট কুড়িটা। তাহলে তার সঙ্গী বর্শাধারী কৃষ্ণাঙ্গরা দলটার বেশ কিছুটা ক্ষতি করতে পেরেছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ধনুকের ছিলা পুরোটা টেনে এনে কোনান শরক্ষেপণ করল। টংকারধ্বনির সাথে সাথেই আগুনঝরা চোখের একটা জন্তু শুণ্যে ছিটকে উঠে, মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল। কিন্তু তাতে অন্যগুলোর গতিবেগ বিন্দুমাত্র কমল না। কোনান তার বিধ্বংসী ঘৃণা, জ্বলন্ত ক্রোধ, নারকীয় প্রতিহিংসা মিশিয়ে সম্পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে নিখুঁত লক্ষ্যে তাদের ওপর শরবৃষ্টি করে চলল।
প্রতিটি তীরের মুখে সে যেন মৃত্যুর ঠিকানা লিখে গোটা আকাশকে ছেয়ে ফেলেছিল। টংকারধ্বনি ও মরণ আর্তনাদে মুখরিত হতে লাগল প্রাচীন ধ্বংসস্তুপ ও বনাঞ্চল। এই সর্বনাশকারী আক্রমণ তাদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করল। অর্ধেকেরও কমসংখ্যক জানোয়ার পিরামিডের সিঁড়ির প্রথম ধাপের কাছে পৌঁছতে পারল। কয়েকটা সিঁড়িতেই গড়িয়ে পড়ল। খুনে দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোনান বুঝতে পারছিল এগুলো আদৌ কোন সাধারণ পশু নয়। এই ধারণার কারন কেবলমাত্র বিরাট দেহ আর অসম্ভব ধূর্ততাই নয়, তাদের উপস্থিতি মৃতদেহে পরিপূর্ণ জলাভূমি থেকে উঠে আসা দূর্গন্ধময় কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ছিল। কোন নারকীয় অপরসায়ন এগুলোর জন্ম দিয়েছে তা কোনান জানে না, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল তা স্কেলো – র তিমিরাচ্ছন্ন ভূগর্ভ গহ্বরের তন্ত্র মন্ত্রের চেয়েও পৈশাচিক।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে সে শেষ শরটিকে তার টুঁটি ছিঁড়ে নেওয়ার জন্য ঝাঁপানো একটা লোমশ আকারের মুখগহ্বরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিল। চাঁদের আলোয় একটা বিদ্যুৎ চমকের মত গিয়ে তিরটা লক্ষ্যভেদ করে তার শিকারের মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে এল, আর সেই বিরাট দেহটা উলটে শূন্যে ছিটকে পড়ার সময় প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় কয়েকবার কামড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে মাটিতে পড়ে ছটফট করে স্থির হতে গেল।
এরপর বাকিগুলো তাদের লালাঝরা তীক্ষ্ণ দাঁত আর আগুনঝরা চোখ নিয়ে দুঃস্বপ্নের মত তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার তরবারি প্রথম আক্রমণকারীর রোমশ দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিল। কিন্তু তারপরই অন্যদের ধাক্কায় সে মাটিতে পড়ে গেল। সে তরোয়ালের হাতল দিয়েই সে একটার মাথায় এত জোরে মারল যে সেটার মাথা ফেটে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়ে তার হাত বেয়ে রক্ত আর ঘিলু গড়িয়ে নেমে এল। তারপর সে তরোয়াল ফেলে দিতে বাধ্য হল, কারণ শত্রুরা এত কাছে এসে পড়ায় সেটা আর কাজে লাগছিল না। শেষ দুটো দানব তাকে কোন আওয়াজ না করে তাকে ছিঁড়ে খাওয়ার চেষ্টা করছিল। একটা তীব্র ঝাঁঝাঁলো গন্ধ তার নাক জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, নিজের মাথা থেকে নেমে আসা ঘাম তার দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল। তার বর্ম তাকে কিছুটা রক্ষা করছিল। সে মরিয়া হয়ে দু হাত দিয়ে দুটো জানোয়ারের গলা চেপে ধরার চেষ্টা করল। ডান হাত দিয়ে একটার রোমশ গলা সে ধরতে পারল। মুহূর্তে সে সেটাকে খামচে ছিঁড়ে ফেলল। জলের মত রক্তস্রোত ঝরতে লাগল সেখান দিয়ে। বাঁ হাত দিয়ে অন্যটার গলা সে ধরতে না পারলেও, সেটার সামনের একটা পা ধরে ফেলল। তৎক্ষনাৎ পাটাকে মুচড়ে ভেঙে দিল সে। জন্তুটার মুখ থেকে একটা অদ্ভুত আর্তনাদ বেরিয়ে এল। অনেকটা যেন মানুষের আর্তনাদের মত।
প্রথমটা মরণ খিঁচুনির মাঝেই প্রবল হিংস্রতায় তার গলায় দাঁত বসানোর অসফল শেষ চেষ্টা করে স্থির হয়ে গেল। কোনান নিজেও যেন সেটার তীব্র মরণ যন্ত্রনা টের পেল।
দ্বিতীয়টা তিন পায়ের ওপর ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠে নেকড়ের মত তার পেটে কামড় বসানোর চেষ্টা করল। কোনানের বর্ম তাকে কিছুটা রক্ষা করল। মৃত জন্তুটাকে ছুঁড়ে ফেলে কোনান এবার সেটাকে তার শক্তিশালী হাত দিয়ে চেপে ধরে শুন্যে তুলে ফেলল। সেটার রক্তাক্ত মুখ থেকে একটা যন্ত্রনার কাৎরানি বেরিয়ে এল। ঐ অবস্থাতেই সেটা আপ্রাণ চেষ্টা করল কোনানকে আঁচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করার। একবার সে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, তারপর নিজেকে সামলে প্রবল আক্রোশে জন্তুটাকে পাথরের ওপর আছড়ে ফেলল। মড়মড় করে হাড়, মাথার খুলি ভাঙার শব্দ পাওয়া গেল।
কোনান কাঁপতে কাঁপতে দু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে দম নেওয়ার চেষ্টা করছিল। তার দৃষ্টিতে এখন চাঁদ, বনভূমি রক্তের মত লাল। এমন সময় সে আকাশে এক বিশাল বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শুনল। ঝাঁপিয়ে পড়ে সে তার তলোয়ার হাতে তুলে নিল, তারপর টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কপাল আর ভ্রু থেকে রক্ত ঝেড়ে ফেলে সেই বিশাল তলোয়ার দুহাতে নিজের মাথার ওপর তুলে ধরে তার শত্রুকে দেখার জন্য আকাশের দিকে চাইল।
কিন্তু আকাশ থেকে আক্রমণ নেমে আসার বদলে তার পায়ের নিচের পিরামিড কেঁপে উঠল। এক বিরাট দন্ডের মত সেটার উপর দাঁড়িয়ে থাকা স্তম্ভটাকে ভেঙে পড়তে দেখল সে। ঘটনাটা কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সে নিচের দিকে একটা প্রকান্ড লাফ দিল। মাঝামাঝি একটা পাথরের সিঁড়িতে পড়ল সে। সেটাও তখন ভেঙে পড়ছে। মরিয়া হয়ে আরেকটা লাফে মাটিতে পড়ে গড়িয়ে সে যতটা দূরে সম্ভব সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। সেই বিশাল স্তম্ভ সহ পিরামিডটা ভেঙে পড়ছিল। গোটা আকাশ যেন শ্বেত পাথরের বৃষ্টিতে ভরে গেল। তারপর চাঁদের আলোয় মাটির ওপর সাদা পাথর আর ধুলোর স্তুপ পড়ে থাকতে দেখা গেল।
কোনান তাকে চাপা দেওয়া ধুলো আর পাথরের স্তুপ ঝেড়ে ফেলে উঠে বসল। পড়ার সময় তার মাথা থেকে শিরস্ত্রানটা ছিটকে পড়ে গিয়েছিল, ফলে আঘাতের ফলে সে অল্প কিছুক্ষনের জন্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। তার পায়ের ওপর স্তম্ভটার একটা বড় টুকরো পড়ার ফলে সে পা নাড়তে পারছিল না। সে বুঝতে পারছিল না তার পা দুটো ভেঙে গেছে কিনা। ঘামে তার লম্বা চুল মুখে ঘাড়ে সেঁটে রয়েছে। গলা, কাঁধ, হাত থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে। সে তার ওপর পড়ে থাকা আবর্জনাগুলো সরিয়ে ওঠার চেষ্টা করল।
এমন সময় আকাশের তারাদের ঢেকে কিছু একটা কাছে ঘাস জমিটার ওপর নেমে এল। ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখতে পেল, সেই ডানাওলা শয়তান।
ওটা প্রচন্ড বেগে ধনুকের মত পায়ের ওপর ভর দিয়ে তার দিকে ছুটে আসছিল। আকৃতিতে কিছুটা মানুষের মত হলেও, ওটার লম্বা তীক্ষ্ণ নখযুক্ত লোমশ হাত, বিকৃত কদাকার মাথার মধ্যে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র ছিল না। অন্ধকারে সেটার জান্তব লাল চোখ ধকধক করে জ্বলছিল। ওটা না মানুষ, না পশু, না শয়তান। সবকিছুর বৈশিষ্টের অন্ধকার মিশ্রণের ফলে যেন সেটার সৃষ্টি।
কিন্তু কোনানের আর কিছু ভাবার সময় ছিল না। সে হাত বাড়িয়ে তার পড়ে থাকা তরোয়ালটা ধরতে চাইল, কিন্তু কয়েক ইঞ্চির জন্য সেখানে পৌঁছতে পারল না। মরিয়া হয়ে সে তার পায়ের ওপর পড়ে থাকা পাথরের খন্ডটা সরানোর চেষ্টা করল যাতে তরোয়ালটার কাছে পৌঁছানো যায়। আপ্রাণ চেষ্টার ফলে তার দেহের সমস্ত পেশি ফুলে উঠল। সেটা ধীরে ধীরে সরছিল, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল নিজেকে মুক্ত করার আগেই রাক্ষসটা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে আর তার বাঁকানো কালো নখ দিয়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে।
সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে জীবন্ত অন্ধকারের মত তীব্র বেগে ডানাওলা শয়তানটা তার দিকে ছুটে আসছিল। এমন সময় তাদের দুজনের মাঝখানে বিদ্যুল্লতার মত এক সাদা অবয়ব দেখা গেল।
এক বাঘিনীর মত সুতীব্র ভালোবাসা নিয়ে সেই প্রলয়ঙ্কর মুহূর্তে সে সেখানে উপস্থিত হয়েছে। উদ্যত মৃত্যুর সামনে কোনান বনজ্যোৎস্নায় ভেজা তার চন্দনবর্ণের তন্বী দেহবল্লরী দেখতে পেল। তার দুচোখ জ্বলজ্বল করছে, কৃষ্ণ কেশদাম উড়ছে, বক্ষদ্বয় দ্রুত উঠছে পড়ছে, রক্তবর্ণ গোলাপের মত ওষ্ঠাধর বিস্ফারিত। ধাতব ঘন্টার মত তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলে সে সেই পক্ষল দানবের দিকে এগিয়ে গেল।
“বেলিত!” কোনান চিৎকার করে উঠল। সে যেন একবার তার দিকে ফিরে চাইল। তার চোখে ভালোবাসা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মত আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আর তারপরই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। সিমেরিয়ানটি আবার সেই দানবটাকে দেখতে পেল, সেটা যেন কোন আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য হাত তুলে ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেছে। তখনই তার মনে পড়ল বেলিত বাঘিনীর ওপর শেষ শয্যায় শুয়ে রয়েছে। তার কানে ভাসতে লাগল সেই আবেগপূর্ণ কথাগুলো, “আমি জীবনে মরণে তোমার সাথে বাঁধা পড়েছি। আমাদের হৃদয় এক হয়ে গেছে। আমি যদি মারাও যাই, তোমার বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সাহায্য করার জন্য ফিরে আসবো।”
এক সুতীব্র চিৎকার করে সে ভারী পাথরের খন্ডটাকে তুলে ছুঁড়ে ফেলল। ডানাওলা শয়তানটা আবার তার দিকে তেড়ে আসছে। সে একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে ওটার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত হল, তার ধমনীতে তখন ক্রোধ আর রণোন্মত্ততা আগুন জ্বেলে দিয়েছে। পিশাচটা ঝড়ের মত উড়ে তার ওপর এসে পড়ল। শরীরের সব শক্তি, ঘৃণা, ক্রোধ মিশিয়ে কোনান তরোয়াল চালাল। প্রচন্ড আঘাতে নিকৃষ্ট জানোয়ারটার ঘিনঘিনে দেহটা কেটে দু টুকরো হয়ে দুদিকে ছিটকে পড়ল।
কোনান সেই চন্দ্রালোকে নৈঃশব্দের মাঝে রক্তঝরা তরবারি হাতে তার শত্রুর দেহাবশেষের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। লাল চোখগুলো প্রবল ঘৃণায় শেষবারের মত জ্বলে উঠে ঘোলাটে হয়ে নিভে গেল, বিরাট লোমশ হাতগুলো প্রবল খিঁচুনিতে থর থর করে কেঁপে শক্ত হয়ে গেল। আর বিশ্বের প্রাচীনতম প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গেল।
কোনান যন্ত্রচালিতের মত মাথা তুলে দেখল এটার আর কোন দাস জানোয়ার তাকে হত্যা করতে এগিয়ে আসছে কিনা। কেউ এল না। তার চোখের সামনে মৃত জন্তুগুলোর দেহে এক অত্যাশ্চর্য পরিবর্তন হচ্ছিল। চাঁদের আলোয় ঘাসের ওপর পড়ে থাকা শবদেহগুলো মানুষের মৃতদেহে পরিণত হচ্ছিল। তামাটে বর্ণের, বাঁকানো নাকের অধিকারী , নগ্ন, তরবারি আর শরাঘাতে ছিন্নভিন্ন দেহগুলো তার চোখের সামনেই ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ধুলোয় মিশে গেল।
তার সাথে লড়াইয়ের সময় পক্ষল শয়তানটা তার দাস জানোয়ারগুলোকে সাহায্য করতে এল না কেন? যদি সে মাটির কাছাকাছি আসে তবে জন্তুগুলো তাকেও আক্রমণ করে বধ করার চেষ্টা করবে, এই ভয় কী তার মাথায় কাজ করছিল? ওই বিকৃত মস্তিষ্কে সবসময় জঘন্য চতুরতা কাজ করত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতে কোন লাভ হল না।
ঘুরে দাঁড়িয়ে সিমেরীয়টি ক্লান্ত পদক্ষেপে দূষিত পচা ঘাট পার হয়ে জাহাজে এসে উঠল। তরবারির আঘাতে রজ্জুগুলোকে ছিন্ন করে সে বাঘিনী কে মুক্ত করল। তারপর সে জাহাজের অগ্রপ্রান্তে এসে বসল। সেটা তখন ধীরে ধীরে নদীর স্রোতে ভেসে সাগরের দিকে এগিয়ে চলেছে। কোনান আধশোয়া হয়ে, যে কোন রাজ্ঞীকে লজ্জা দিতে পারে এমন মণি মুক্তায় সজ্জিত শয্যাটির দিকে চেয়ে রইল, যেখানে তার হৃদয়ের সম্রাজ্ঞী অন্তিম বিশ্রাম নিচ্ছে।
V
শোকের চিতা
সাগরে মোদের পথচলা শেষ হল এবার
শান্ত হোক দাঁড়; না লাগুক পালে বায়ু।
রাঙা সৈকতে নামুক এবার ঘন আঁধার
হে অসীম নীল; হও তার পরমায়ু।
-বেলিতের গান।
ভোরের রক্তরাগ সাগরে ছড়িয়ে পড়ল। নদীর মোহনায় সে রঙ আরো অনেক বেশি রক্তিম। শ্বেত বালুকাবেলায় তার শক্তিশালী তরবারির ওপর ভর দিয়ে সিমেরীয়ার কোনান দেখছিল বাঘিনী তার শেষ সমুদ্রযাত্রায় পাড়ি দিয়েছে। হীরকচূর্ণের মত উজ্জ্বল ফেনায়িত তরঙ্গরাশি তার চোখে কোনরকম চাঞ্চল্য জাগাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। তার সামনে বিস্তৃত অসীম নীল সাগর সবরকম মহিমা, বিস্ময় হারিয়ে পড়ে আছে। সুদুরে বেগুনি রহস্যময় দিগন্তের কাছে হারিয়ে যাওয়া পান্নাসবুজ ঢেউয়ের মাতামাতি দেখে তার মন চরম বিতৃষ্ণায় ভরে গেল।
বেলিত সম্পূর্ণভাবে এই সাগরেরই কন্যা ছিল। তার উপস্থিতির ঐশ্বর্যই একে এত মোহময় করে তুলেছিল। তাকে ছাড়া এ অকূল পাথার বন্ধ্যা, বিষন্ন, অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এই পারাবারেরই সে অংশ, তাই কোনান তাকে তার কোলেই ফিরিয়ে দিয়েছে। তার আর কিছুই করার নেই। এখন এ বিরাট বারিধির নিলীমার চেয়ে তার পিছনের গহন, শ্যামল, রহস্যময় বনভূমির পাতাদের ফিসফিসে আহ্বান তার কাছে অনেক বেশি সহনীয় হয়ে উঠেছে। এখন সময় এসেছে সেই সবুজ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার।
বাঘিনীতে এখন হাল ধরার কেউ নেই, কেউ নেই দাঁড় বাওয়ার মত। কিন্তু তার পালে ডাক দিয়েছে দখিনা বাতাস, গর্বিত রাজহংসীর মত গভীর সাগরের দিকে এগিয়ে চলেছে সে, আর তাকে ঘিরে সমুদ্রবায়ুর সাথে নৃত্যসঙ্গী হয়েছে লেলিহান অগ্নিশিখা। সেই অগ্নিশিখা ঘিরে ধরছে তার উপর রত্নসজ্জিত শয্যায় শায়িত রক্তবর্ণের বস্ত্রাবৃত এক সম্রাজ্ঞীর দেহকে।
এভাবেই হারিয়ে গেল কৃষ্ণ উপকূলের সম্রাজ্ঞী, আর নিজের তরবারির ওপর ভর দিয়ে কোনান চুপ করে সেদিকে তাকিয়ে দেখল কিভাবে বাঘিনীর লাল আভা মরকত নীলের মিশ্রণে মিলিয়ে গেল আর ভোরের সূর্য স্বর্ণাভা ছড়িয়ে দিল সাগরময়।
Tags: অনুবাদ উপন্যাস, রবার্ট ই. হাওয়ার্ড, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সায়ক দত্ত চৌধুরী
অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক অনুবাদ। ঘটনাপ্রবাহের চেয়েও আবহের চমৎকার বিবরণ এই গল্পটিকে একটি অন্য মাত্রা দান করেছে। ফ্যান্টাসি গল্পের ক্ষেত্রে আবহ সৃষ্টি এবং ভাষার প্রয়োগশৈলী – এই দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। এই অনুবাদে সায়কবাবু দুটি বিষয়েই সমানভাবে সফল। তবে বেশ কিছু মুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়ল। কল্পবিশ্ব ভবিষ্যতে এই ব্যাপারে আরেকটু যত্নবান হবে বলে আশা রাখি।
অনেক ধন্যবাদ।
দুর্ধর্ষ অনুবাদ! এই আইকনিক রচনার প্রতি সুবিচার করা সহজ ছিল না। কিন্তু আপনি সেটা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে করতে পেরেছেন। স্যালুট।
আপনার প্রশংসা আমার কাছে খুব মূল্যবান। আপনার ভালো লেগেছে মানে লেখাটা উতরে গেছে। অনেক ধন্যবাদ এভাবে উৎসাহ দেওয়ার জন্য।