হস্তপাশ
লেখক: সন্দীপ চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
এক
‘তিন্নি, একবার আমাদের বাড়িতে আসবি?’
মৌয়ের গলা একটু অন্যরকম লাগল। এমনিতে মৌ ভীষণ হাসিখুশি, ফুর্তিবাজ মেয়ে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর গলায় উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে রে?’
‘তুই আয় না। ফোনে বোঝানো যাবে না’।
ঘড়ি দেখলাম। সওয়া পাঁচটা। বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। কিন্তু মৌয়ের স্বরে কিছু একটা ছিল যাতে মনে হল ওর কাছে যাওয়া দরকার। মা’কে একটা মেসেজ করে যোধপুর পার্কের বাসে উঠে বসলাম।
কলিং বেলের উত্তরে কাকিমা দরজা খুললেন। শোক না হলেও দুশ্চিন্তার ছাপ রয়েছে তার মুখে। ওনাকে কিছু বলার আগেই পেছন থেকে মৌ’কে বেরোতে দেখলাম। আমাকে দেখে সামান্য উজ্জ্বল হল ওর চোখের দৃষ্টি।
‘তোকে এভাবে ডাকার জন্যে সরি রে। আসলে কিছু বুঝে উঠতে পারছি না কী করব।’ সোফায় আমার পাশে বসতে বসতে মৌ বলল। আমি কিছু উত্তর না দিয়ে অপেক্ষা করলাম। কাকিমা আমাদের বসতে বলে ভেতরে ঢুকে গেলেন।
‘বাবা সপ্তাহ খানেক আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেছে। তারপর থেকেই অসুস্থ। প্রথমে মনে হল জেট ল্যাগের এফেক্ট, একটু রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থা খারাপের দিকে টার্ন নিচ্ছে। খাওয়া – ঘুম দুটোই খুব কমে গেছে। শরীরে দুর্বলতাও রয়েছে। অথচ অসুখটা কী সেটা ডাক্তাররা সঠিক ভাবে কিছু বলতে পারছেন না। গাদা গাদা টাকার টেস্ট করিয়ে যাচ্ছে শুধু।’
‘জ্বর আছে?’
‘দুপুরের দিকে সামান্য আসে। তবে শরীর নয়, আমার বেশি চিন্তা বাবার মানসিক অবস্থা নিয়ে। কেন যেন মনে হচ্ছে বাবা ভয় পেয়ে রয়েছে। অথচ জিজ্ঞেস করলে কোন উত্তর দিচ্ছে না।’
এক্ষেত্রে আমার করণীয় কী? শরীর খারাপ হলে ডাক্তারদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া আর কী উপায় আছে? আর যদি মানসিক সমস্যা হয় সেক্ষেত্রেও মানসিক ডাক্তারদের শরণাপন্ন হতে হবে। মৌ কি অন্য কিছুর ভয় পাচ্ছে?
‘কিছুই বুঝতে পারছি না। আসলে আজকাল এত ভ্যারাইটি রোগের কথা শুনতে পাই যে ডাক্তারদের ওপরও পুরোপুরি ভরসা করে উঠতে পারি না। এখনও পর্যন্ত সব টেস্টের রিপোর্টই ঠিক আছে। এমন কোন আত্মীয়ও কাছাকাছি নেই যে সাজেশান দেবে।’
কাকিমা এসে শরবত দিয়ে মৌয়ের পাশে বসলেন। চোখদুটি স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই শুকনো। নাকের ডগা সামান্য লাল। এই লক্ষণ আমার চেনা। অর্থাৎ কিছুক্ষন আগেই কান্নাকাটি করেছেন।
‘এখন কী করছেন কাকু?’ কাকিমার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলাম।
‘শুয়ে আছেন। তুমি যাবে? তবে মুশকিল হচ্ছে উনি বিশেষ কারও সঙ্গে কথাও বলছেন না।’
‘একটু পরে যাস।’ মৌ বলল।
কাকিমাকেই আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কোন অসুবিধে নেই শরীরে? অস্ট্রেলিয়ায় কিছু হয়েছিল?’
‘ওখানে কিছু হয়েছে কিনা জানি না। তবে বাইরে থেকে শরীর তো ঠিকই আছে মনে হচ্ছে। শুধু গতকাল থেকে দেখছি ডান হাতটায় র্যাশের মত বেরিয়েছে। ডাক্তারের দেওয়া মলম লাগাচ্ছি।’
জিজ্ঞেস করে জানলাম বেশ বড় হাসপাতালের ডাক্তারের কাছেই চিকিৎসা হচ্ছে কাকুর। আজ সকালে ডাক্তার ফোনে জানিয়েছেন দুই দিনের মধ্যে অবস্থার উন্নতি না হলে এডমিট করে নেবেন। আর তাতেই ভয় পেয়ে গেছেন কাকিমা এবং মৌ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের যতই উন্নতি ঘটুক, হাসপাতালে এডমিট হওয়ার কথা চিন্তা করলেই আজও মানুষের মনে একটা রেজিস্টেন্স কাজ করে।
শরবতটা শেষ করে মৌকে বললাম, ‘চিন্তা করিস না, বাড়ি ফিরে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে জানাব। প্রয়োজনে অন্য ডাক্তারের ওপিনিয়ন নিতে হবে। চল, কাকুকে একবার দেখে আসি।’
সত্যি বলতে কি মৌয়ের বাবাকে আমি একটু ভয়ই পেতাম। গম্ভীর মানুষ। লম্বা চেহারা। তার ওপর ভদ্রলোকের বিশাল পান্ডিত্য। বেশ কয়েকটা বইও লিখেছেন। সব মিলিয়ে বেশ রাশভারী ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু ওনার এখকার চেহারার সঙ্গে আমার স্মৃতিতে জমানো মানুষটাকে মেলানো গেল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছেন আমার দিকে। আমাকে চিনতে পেরেছেন কিনা সেটাও বোঝা গেল না। আমার ওই দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে অস্বস্তি হচ্ছিল বলে কোন কথা না বলেই তাড়াতাড়ি চলে এলাম। বাইরে এসে খেয়াল হোল ওনার শরীরের দিকে ঠিকমত তাকাই নি পর্যন্ত। কেমন যেন একটা দমবন্ধ করা অস্বস্তি হচ্ছিল কাকুর ঘরে।
আমাকে একটু এগিয়ে দিল মৌ। বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোর মা’কে সবকিছু জানাস। ওনার তো অনেক ডাক্তারদের সঙ্গে চেনাশোনা। আরও একটা কথা বলতে ঠিক সাহস হচ্ছে না। কাকিমাও কি একবার বাবাকে দেখে যেতে পারবেন? মায়ের খুব বিশ্বাস ওনাকে।’
আমার কাছে এটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বিবিধ বিষয়ে পড়াশোনা এবং ব্যক্তিত্বের জন্যে আমার মা অনেকের কাছে শ্রদ্ধার পাত্রী। এই নিয়ে আমার মনেও একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে।
‘আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলে রাত্রে জানাব। চিন্তা করিস না। কাকুর সিরিয়াস কিছু হয় নি। এডমিট হলেও চিন্তার কিছু নেই।’
মৌ’কে বললাম বটে কিন্তু বাসে বসে আমার মনের মধ্যে অস্বস্তি ক্রমাগত খচ খচ করতে লাগল। সব টেস্টের রিপোর্ট যদি স্বাভাবিক হবে তাহলে ওই দৃষ্টির অর্থ কী? ভয় পাচ্ছেন? কিন্তু কিসের ভয়? মায়ের বিচার বিবেচনার ওপর আমার নিজেরও ভরসা কিছু কম নেই কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তার কী করার আছে? ভালো ডাক্তারের খোঁজ তো আজকাল গুগল করলেই পাওয়া যায়।
মা বাড়িতে আগেই এসে গেছে। আমাকে দেখে বলল, ‘এর মধ্যেই আড্ডা শেষ? আমি তো ভেবেছিলাম ……’ তারপর মুহূর্তকাল আমার চোখের দিকে চেয়ে মা জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে রে তিন্নি?’
নিজের সন্তানের হাবভাব থেকে সব মা’ই সম্ভবত বুঝতে পারে যে আজকে সে স্বাভাবিক নেই। সুতরাং মায়ের প্রশ্নে অবাক হলাম না।
মুখ হাত ধুয়ে মা’কে যতটা পারলাম গুছিয়ে বললাম। মৌয়ের বাবাকে মা চেনে। ওনার লেখা বইও পড়ে থাকবে। সব শুনে কিছুক্ষন গুম হয়ে বসে রইল মা। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘অস্ট্রেলিয়ায় কী করছিলেন ডক্টর গুপ্ত?’
এই রে! এটা তো জিজ্ঞেস করিনি।
‘ভদ্রলোক অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়লেন অথচ তোর মনে হল না উনি ওখানে কী করছিলেন সেটা রেলেভ্যান্ট?’ বিরক্তির ছোঁয়া মায়ের গলায়।
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম, ‘মৌ’কে কল করে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি।’
‘এখন ছেড়ে দে, রাত্রে করিস। আসলে এমনিতেই ইনফরমেশন খুব কম। কিন্তু আমারও মনে হচ্ছে কেসটায় সাইকলজিক্যাল বিষয় থাকতেও পারে। সেক্ষেত্রে হাসপাতালে এডমিট হয়ে যাওয়া সেফ। ওখানে হাতের কাছে বিভিন্ন স্পেশালিস্ট রয়েছেন। এক কাজ করিস তিন্নি – মৌ’কে কল করার সময় প্রেসক্রিপশনের কপি আর বিভিন্ন টেস্টের রিপোর্টেরও ছবি আনিয়ে নিস।’
এগুলোও আমার নিয়ে আসা উচিৎ ছিল। চিকিৎসা ঠিকঠাক চলছে কিনা সেটা বোঝার জন্যে যে কোন ডাক্তারেরই এই জিনিসগুলো লাগবে।
মা জানাল ডক্টর শুভেন্দু গুপ্তর লেখা কোনো বই না পড়লেও ওনার একটা প্রবন্ধ পড়েছে। উনি পেশায় মেরিন বায়োলজিস্ট। কথাটা জানতাম – এখন মা বলায় মনে পড়ল।
কিছু পরে মৌ’য়ের কাছ থেকে প্রেস্ক্রিপসন আর টেস্ট রিপোর্টগুলো আনিয়ে মা’কে ফরওয়ার্ড করে দিলাম। তবে অস্ট্রেলিয়ায় কাকু এখন ঠিক কাজ করছিলেন সেই ব্যাপারে বেশি কিছু বলতে পারল না মৌ। নিজের কাজকর্ম নিয়ে কোনদিন বাড়িতে আলোচনা করতেন না কাকু। ইদানিং সমুদ্রের মধ্যে জাহাজে করে প্রায়ই যাওয়া আসা করতেন সেটা আন্দাজ করা যায় কারণ সমুদ্রের ব্যাকগ্রাউন্ডে নিজের বেশ কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছিলেন কাকু। তার একটায় ডুবুরির পোশাকেও ছিলেন।
রাত্রে মা নিজের কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করল। নিজে ফিজিক্সের প্রোফেসর হলেও মায়ের সঙ্গে প্রচুর ডাক্তার এবং অন্যান্য ফিল্ডের সায়েন্টিস্টদের জানাশোনা রয়েছে। কাকুর চিকিৎসার কাগজপত্র থেকে জানা গেল ওনাকে সংক্রমণের ওষুধ দেওয়া হয়েছে তবে সংক্রমণটা কিসের সেটা টেস্টে এখনও জানা যায় নি। ডাক্তারদের মত অনুযায়ী এটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবীতে ভাইরাসের সংখ্যা প্রচুর, তার মধ্যে মাত্র কয়েকটার টেস্ট হাসপাতালগুলোতে হয়।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় কাকু ফিরে আসার আগে কী কাজ করছিলেন সেই বিষয়ে কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। গুগল করে যেটা জানা গেল সেটা প্রায় দুই বছর আগের খবর। ডলফিন আর তিমির বুদ্ধিমত্তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে কাকুর একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছিল আমেরিকান জার্নালে। আমি জার্নালটার নাম শুনি নি কিন্তু মা জানাল সেটা বেশ বিখ্যাত।
পরদিন ভোরবেলায় মৌয়ের ফোনে ঘুম ভাঙল। রাতটা ভালো কাটেনি ওদের। কাকুর মাথার কাছের একটা টেবিলে ওনার ওষুধপত্র রাখা ছিল। মাঝরাত্রে উনি সেগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। আর ওনার হাতের র্যাশ আরও বেড়েছে। ওষুধগুলো কেন ফেলেছেন সেটা জিজ্ঞেস করায় তিনি উত্তর দিয়েছেন, ‘জানি না।’
‘কী হবে রে তিন্নি? বাবা ঠিক হবে তো?’ বলে কাঁদতে লাগল মৌ।
সকাল সকাল আমারও মন খারাপ হয়ে গেল। উঠে গিয়ে মা’কে সব জানালাম। কাকুকে একটা হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেই ভালো হবে মনে হচ্ছে। আর কিছু না হোক সারাদিন অবসার্ভেশনে তো থাকবেন।
আমি কলেজের জন্যে বেরোবার ঠিক আগে মা বলল, ‘মৌয়ের ফোন নাম্বার আর ঠিকানাটা দিয়ে দে। প্রথম ক্লাসের পর বেশ কিছুটা গ্যাপ আছে। সম্ভব হলে ওর ওখান থেকে একবার ঘুরে আসব।’
সেদিন কলেজে পড়ায় মন বসল না। আমার পাশেই মৌ বসে। সেই খালি সিটের দিকে চেয়ে বারবার কাকুর সেই দৃষ্টির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। অসহায়, ভীত দৃষ্টি। যেন কিছু বলতে চান কিন্তু পারছেন না। কেন পারছেন না? মৌ বলেছিল কথাবার্তায় কোন জড়তা নেই কাকুর। তাহলে? অস্ট্রেলিয়ায় ভয়ংকর কোন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন? কিন্তু কাকু নাকি ভারতে ফেরার পর প্রায় স্বাভাবিক ছিলেন। হালকা হাসি ঠাট্টাও করেছেন মৌদের সঙ্গে।
ক্লাস শেষ হওয়ার পর মা’কে ফোন করলাম। সে কি মৌদের বাড়ি গেছিল?
‘যেতাম কিন্তু মৌ জানাল ওরা ডক্টর গুপ্তকে নিয়ে হাসপাতালে আছে। খুব সম্ভবত এডমিট করে নেবে ভদ্রলোককে। আমার তো মনে হয় ঠিক স্টেপ নিয়েছে। বাড়ি আয়, বাকি কথা হবে।’
একই সঙ্গে স্বস্তি আর বিষাদ ঘিরে ধরল আমাকে। স্বস্তি এইজন্যে যে এবার থেকে কাকুর সব দায়িত্ব হাসপাতালের। বেশ বড় হাসপাতাল, সবরকম চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে এটা চিন্তা করে খারাপ লাগল যে কাকুর অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বরং উল্টো।
দুই
পরের দিন শনিবার, আমার আর মা দুজনেরই ছুটি। হাসপাতালের ভিজিটিং আওায়ার জেনে সকাল বেলায় মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে গেলাম।
ভিজিটার্স লবির এক কোনে মৌ’কে বসে থাকতে দেখলাম। ও আমাদের দেখতে পায় নি। অন্যমনস্ক হয়ে সামনের দিকে চেয়ে রয়েছে। ওকে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ মনে হচ্ছে এখন।
ওর পাশে একটা সিটই খালি ছিল। আমার কব্জিতে হালকা চাপ দিয়ে আমাকে সেখানেই দাঁড়াতে বলে মা এগিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসল। মা’কে দেখে হালকা হাসার চেষ্টা করল মৌ। মা ওর হাত ধরে নিচু গলায় কিছু বলল। উত্তরে ও মাথা নাড়ল। তারপর ওর দৃষ্টি আমাকে খুঁজতে লাগল। ওর উদ্দেশ্যে হাত তুললাম। ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমি ঠিক আছি। ও ওখানেই কিছুক্ষন বসুক মায়ের সঙ্গে।
কিছুক্ষন পরে মৌ আর মা দুজনেই উঠে আমার কাছে এল।
মৌ বলল, ‘এখানে একবারে মাত্র একজনকেই এলাও করে। মা ভেতরে গেছে। মা বেরোলে কাকিমা দেখে আসুক বাবাকে।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন এখন?’
মৌয়ের চোখ ছলছল করে উঠল। গতরাত্রে নাকি এক নার্সকে চড় মেরেছেন কাকু। তারপর ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। সকালের খবর এখনও কিছু জানে না।
মা বলল, ‘তিন্নি, আমরা কিছুক্ষন ওয়েট করে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে যাব। ওনাকে একটার পর পাওয়া যাবে।’
ঘড়ি দেখলাম। এগারোটাও বাজে নি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কিছু নোটস তৈরি করব ঠিক করেছিলাম। সে ঠিক আছে। না হয় সেটা লাঞ্চের পর হবে। তাছাড়া কালকেও ছুটি।
তখনও জানতাম না আমার জীবনের ব্যস্ততম দুটি দিন সবে আরম্ভ হয়েছে।
কাকিমা বেশ কিছুক্ষন পর বেরোলেন। মৌ এগিয়ে গিয়ে কাকিমাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসে মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মাকে দেখে একটু হলেও চোখ উজ্জ্বল হল কাকিমার।
‘কেমন দেখলেন এখন?’ মা জিজ্ঞেস করল।
‘ভালো নয়। ঘুমের ওষুধের প্রভাব এখনও রয়েছে। কিন্তু ও এত ভয় পাচ্ছে কেন সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। হাতটারও কোন উন্নতি নেই। বরং বেড়েছে। অথচ নিয়মিত ওষুধ লাগানো হচ্ছে।’
মা কাকিমার কাছ থেকে ভিজিটিং কার্ড নিয়ে ভেতরে গেলে আমরা বাইরে বেরিয়ে দাঁড়ালাম। সামনে একটা চায়ের দোকান দেখে চায়ের তেষ্টা চাগাড় দিয়ে উঠল। কাকিমা না-না করছিলেন কিন্তু মৌ জোর করায় শেষে রাজি হয়ে গেলেন।
মৌ তার মা’কে বলল, ‘তুমি এখানেই দাঁড়াও, আমরা চা নিয়ে আসছি। বিস্কুট আনবো?’
মাথা নেড়ে না বললেন কাকিমা।
ভাঁড় হাতে আমরা ফিরে এলাম। চুমুক দিতে গিয়েই ছ্যাঁকা খেলাম। একটু বেশি চা নিয়ে ফেলছি মুখে। জিভটা পুড়ল। এবার বেশ কয়েকদিন ঝাল খাবার খেতে অসুবিধে হবে। কেন যে এত তাড়াহুড়ো করি!
কাকিমা জানালেন গতরাত্রের ঘটনায় নার্স এবং আয়াদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ওরা নাকি কাকুর হাত পা বেঁধে রাখতে চেয়েছিল। ডাক্তার বাধা দেওয়ায় সেটা এখনও করেনি। তবে কাকুর কাছে কেউ ঘেঁসতে চাইছে না এখন।
আমি বললাম, ‘সকালে কিছু খাবার দেয় নি কাকুকে?’
‘দূর থেকে জিজ্ঞেস করেছিল। বাবা মাথা নেড়ে ‘না’ বলায় আর দেয় নি। আমাকে বলল ড্রিফট চলছে যখন অসুবিধে নেই। একটু পরেই ডাক্তার আসবেন। দেখি উনি কি বলেন।’
‘কাকু কোনো কথা বললেন?’
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে কাকিমা বললেন, ‘বলল, আমার বেশি কাছে এসো না।’
মৌয়ের দিকে তাকালাম। চুপ করে চেয়ে রয়েছে নিজের মায়ের দিকে। যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। কাকিমা নিচের দিকে চেয়ে রয়েছেন। একটু দূরে একটা কাক বিস্কুটের টুকরোকে নিজের বাগে আনার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। আরও একটু দূরে একটা ধুসর রঙের বেড়াল চুপ করে বসে ঝিমোচ্ছে। কোন শব্দ হলেই শুধু চোখ দুটি একটু বিস্ফারিত হচ্ছে, নইলে আধবোজা।
‘কোন হাত দিয়ে নার্সকে মেরেছিলেন কাকু?’
একটু চমকে উঠল কাকিমা। মৌও আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। হুট করে প্রশ্নটা না করলেই হত। ইন ফ্যাক্ট, কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে। হয়ত অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতার থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলতে হবে বলেই বলা।
‘ডান হাত। যেটায়……’ কথাটা শেষ করল না মৌ।
হাসপাতালের ভেতরে একটু যেন শোরগোল হচ্ছে। ভেতরের দিকে তাকালাম। মা না?
হালকা ছুটেই ভেতরে ঢুকলাম। মা’ই। সঙ্গে আরও দুজন নার্স।
‘ডোন্ট ওয়ারি, আই অ্যাম ফাইন!’ মায়ের গলা শোনা গেল।
কিন্তু মা’কে দেখে ফাইন বলে মনে হোল না। মুখ ফ্যাকাসে। ডান হাত দিয়ে নিজের বাঁ হাতের কব্জি চেপে রয়েছে।
‘আমি আগেই বলেছিলাম বেঁধে রাখতে। আমাদের কথার কোন দাম আছে নাকি এখানে?’ পাশের এক নার্স গজগজ করতে করতে এগিয়ে এল।
‘কী হয়েছে মা?’
‘দূর! তেমন কিছু হয় নি। ভদ্রলোক আমার বাঁ হাতের রিষ্ট চেপে ধরেছিলেন। আচমকা তো, একটু ঘাবড়ে গেছিলাম। আমার লাগে নি একটুও। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। আই অ্যাম অ্যাবসিলিউটলি ওকে।’
শেষের কথাগুলো কাকিমার উদ্দেশ্যে বলা। কাকিমা কিছু বললেন না। উনি স্তম্ভিত হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে রয়েছেন।
একটু পরে সবার কাছ থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা বুঝলাম সেটা হচ্ছে এই। কাকু প্রথমে মায়ের সঙ্গে কোন কথাই বলতে চান নি। সেটা নর্মাল কারণ মা’কে উনি কখনও আগে দেখেন নি। কিন্তু মা যখন ওনাকে কিছু প্রশ্ন করতে শুরু করল তখন উনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তারপর এক সময় আচমকাই ওনার ডান হাত দিয়ে মায়ের বাঁ হাতের কব্জি চেপে ধরেন। অনেক চেষ্টা করেও সেই হাতের গ্রিপ ছাড়াতে পারে নি আশেপাশের নার্সরা। শেষ পর্যন্ত আবার ওনাকে অচেতন করার ইনজেকশন দিতে হয়।
মায়ের হাতের দিকে তাকালাম। জায়গাটা লাল হয়ে রয়েছে। মায়ের সহ্য শক্তি অসাধারণ। নিশ্চই বেশ যন্ত্রণা পেয়েছে কিন্তু প্রকাশ করছে না।
‘প্লিজ আপনি বেশি চিন্তা করবেন না।’ কাকিমার কাঁধে হাত রেখে বলল মা। ‘দোষটা আমার। এমনিতেই উনি অসুস্থ তার ওপর সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মহিলা ওনাকে আচমকা পরপর প্রশ্ন করায় উনি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ কয়েক মুহূর্তের জন্যে হারিয়ে ফেলেছিলেন। আজকে শুনলাম ডাক্তারের আসতে একটু দেরি আছে। আপনারা সামান্য কিছু খেয়ে নিন। আমি আর তিন্নি কয়েকটা কাজ মিটিয়ে চারটে নাগাদ আবার আসছি।’
মৌ আর কাকিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এরপর মা একরকম আমাকে টেনেই ওখান থেকে নিয়ে বেরিয়ে এল। মা কি ভয় পেয়েছে?
বেরিয়েই আমাকে বলল, ‘একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ভিজিটিং আওয়ার এখনও শেষ হয় নি। তুই মৌ’কে ফোন করে বলে দে যেন সে এর মধ্যে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা না করে।’
আমি বললাম, ‘এই কাণ্ডের পর ওরা হয়ত এমনিতেই এখন কাউকে এলাউ করবে না।’
‘তবু চান্স নেওয়া ঠিক নয়। তুই ওকে বলে দে।’
বললাম। ওর গলার স্বর একটু কোল্ড। আমাদের এভাবে হুট করে চলে আসাটা ওর ভালো লাগার কথাও নয়। আমারও মায়ের ওপর বিরক্তি লাগছিল। ডাক্তারের সঙ্গে কথা না বলে ওভাবে কাকুকে বিরক্ত করার কোনো মানে হয়? এরপর হয়ত কাকুকে বেঁধেই রাখবে ওরা।
গাড়িতে উঠে মা বাড়ির ঠিকানা বলল ড্রাইভারকে। মা’কে অস্বাভাবিক গম্ভীর লাগছিল। আমি ঘাঁটালাম না। এমনিতেই ও এই মুডে থাকলে মনোসিলেবলে ছাড়া উত্তর পাওয়া যায় না।
একটা ফোন করল মা। অস্ট্রেলিয়ার একটা ল্যাবের বিষয়ে কিছু জানতে চাইল কোন এক পরিচিতর কাছ থেকে। ওপাশের উত্তর শুনে মা বলল, ‘ওনার নাম্বার এবং ঠিকানা আমাকে টেক্সট কর। আর সম্ভব হলে একটু জানিয়ে দিস যে আমি কল করব। ধরে নে এক – দেড় ঘণ্টা পর।’
কতক্ষন আর নিজের কিউরিসিটি কন্ট্রোলে রাখা যায়। একটু পরে মা’কে জিজ্ঞেস করলাম ভেতরে ঠিক কী ঘটেছিল সেটা একটু ডিটেলে বলতে।
‘খুব বেশি কিছু বলার নেই রে তিন্নি। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত লেগেছে যে ব্যাপারটা সেটা হোল ভদ্রলোক যতক্ষণ আমার হাত ধরে ছিলেন ততক্ষন উনি ক্রমাগত বিড়বিড় করে বলে গেলেন, আই অ্যাম সরি। কেন কাছে এলেন আপনি? – অ্যাজ ইফ ওনার কাজের ওপর ওনার কন্ট্রোল নেই। আমি পড়েছি কিছু মানুষের মধ্যে দ্বৈত সত্তা কাজ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে……’
আবার চিন্তায় ডুবে গেল মা। ভ্রু সামান্য কোঁচকানো। দৃষ্টি বাইরের রাস্তার দিকে।
তারপর মৃদু গলায় বলল, ‘ভদ্রলোকের সেই স্পর্শের অনুভূতি তোকে আমি বলে বোঝাতে পারব না তিন্নি। কোন মানুষের যে ওরকম স্পর্শ হতে পারে… ঠিক যেন ……’
‘কী?’
আবার নিজের চিন্তায় হারিয়ে গেল মা।
আমি এটুকু বুঝলাম যে আজকের মতো পড়াশোনা হয়ে গেল। চারটের সময় হাসপাতালে পৌঁছতে গেলে অন্তত তিনটে থেকে সওয়া তিনটের মধ্যে আবার বেরোতে হবে। তার আগে লাঞ্চ আছে, মায়ের ফোন করা আছে। হয়ত বই বা ইন্টারনেট নিয়েও বসবে।
আমি বাড়িতে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ফ্রিজে রাখা কিছু খাবার রয়েছে। একটু ভাত ফুটিয়ে নিলেই লাঞ্চ উৎরে যাবে। প্রত্যাশা মতোই মা ইন্টারনেট নিয়ে বসে গেছে। এই সময়ে রান্না তো দূরের কথা, আমি জোর না করলে খাবেও না।
মৌ’য়ের জন্যে মনটা আবার খারাপ লাগছে। কী করছে ওরা এখন? এই মানসিক অবস্থায় নিশ্চই খেতে ইচ্ছে করছে না। আমরা থাকলে জোর করে কিছু খাইয়ে দিতাম।
কিন্তু কাকুর অসুখটা শারীরিক না মানসিক? নাকি দুটোই? শুনেছি ব্রেনেও ইনফেকশন হয়। এটা কি সেরকম কিছু? আর ওনার হাতের র্যাশ?
কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আশা করি মা কিছু একটা ধারণা করতে পেরেছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে হাতে আর বেশি সময় নেই আমাদের। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। কিন্তু অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা করাটা তো ডাক্তারদের কাজ। আমরা কী করব?
পাশের রুম থেকে মায়ের গলা শোনা গেল। ইংরেজিতে কথা বলছে। ব্যক্তিগত কথা যখন নয় তখন আড়ি পাতাই যায়।
‘অফ ডিউটি আওয়ারে ফোন করার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু এটা এমারজেন্সি। একজন মানুষের জীবন জড়িয়ে রয়েছে।’
তারপর কাকুর নাম করে বেশ কিছু তথ্য জানতে চাইল মা। খুব একটা বেশি কিছু জানা গেল না। শুধু আরও একটা নাম্বার নোট করে নিল।
আমাকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় ভেতরে ডাকল মা। কথা হয়ে গেলে আমাকে বলল,’তুই বরং একটা ডায়রি নিয়ে বস আমার পাশে। আমি এবার থেকে স্পিকার অন করে কথা বলব। কিছু নোট করার থাকলে তুই করিস। আসলে কথা বলতে বলতে ঠিকমত নোট হয়ে ওঠে না। আরও একটা কথা, তোর যদি মনে হয় কিছু জিজ্ঞেস করার আছে তাহলে লিখে জানাস।’
এইধরনের কাজ করতে আমি হামশাই রাজি। যদিও সামনের সপ্তাহ থেকে সেমিস্টারের পরীক্ষা বলে কিছুটা বিবেকের দংশনে ভুগছি। তবে বিবেকের এসব ছোটখাটো আঁচড় – কামড় সহ্য করার অভ্যেস আমার আছে। আমার বয়সি সব ছেলে-মেয়েরই আছে।
‘লেটস প্রে যেন এখান থেকে কিছু কাজের খবর পাওয়া যায়। হাতে সময় কম।’ বলতে বলতে নিজের ডায়রিতে টোকা নাম্বার মোবাইলে টিপল মা। প্রথমবার রিং হয়ে গেল। রিডায়াল করল মা। এবার ওপাশ থেকে এক পুরুষের কণ্ঠস্বর উত্তর দিল।
‘ইয়েস?’
‘আমি ভারত থেকে বলছি। আমার এক বন্ধু এই মুহূর্তে খুব অসুস্থ। আমি খবর পেলাম একসময় তিনি আপনার সঙ্গে একটা প্রোজেক্টে কাজ করেছিলেন। সেইজন্যেই……’
‘ওর কী নাম?’ ভদ্রলোকের গলায় বিরক্তির ছাপ।
‘শুভেন্দু গুপ্ত। ডক্টর শুভেন্দু গুপ্ত।’
‘ওহো, গুপ্টা! কিন্তু সে তো বহুদিন আগে। আজকাল আমার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।’
‘প্লিজ, জুলিয়েন! উনি অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেই অসুস্থ। ডাক্তাররা ওনার অসুস্থতার কারণ এখনও পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারেন নি। আর সবচেয়ে বড় কথা ওনার এখন মানসিক ভারসাম্য নেই। সুতরাং ওনার এই অসুখের সুত্রপাত কোথা থেকে সেই বিষয়ে উনি নিজে কোনো তথ্য দিতে পারছেন না। প্লিজ আপনি আমাদের সাহায্য করুন। রিসেন্টলি উনি কোথায়, কার সঙ্গে কাজ করতেন সেটা আমাদের জানতেই হবে।’
এরপর ওপ্রান্ত বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ। একবার ভয় হোল কানেকশান কেটে যায় নি তো! কিন্তু ফোনের স্ক্রিনে দেখাচ্ছে কল কানেক্টেড আছে।
‘উনি যেখানে কাজ করতেন সেই সংস্থার নাম্বার দিতে পারি কিন্তু তাতে কিছু লাভ হবে না কারণ তারা ফোনে বা মেইলে কোন তথ্যই আপনাকে জানাবে না। আমি বরং আমার জানাশোনা দুই একজন যারা ওখানে কাজ করেন তাদের মাধ্যমে চেষ্টা করে দেখি। কিন্তু ওরাও কিছু জানাবে কিনা সেই সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে। লেট মি ট্রাই। যদি গুপ্টার চিকিৎসার কিছু প্রমান থাকে আমাকে পাঠিয়ে দিন। প্রয়োজন হলে ওদের দেখাতে হবে। দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে এই নাম্বারে আমি ফোন করব।’
‘ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আর কয়েকটা টেস্টের রিপোর্ট আছে আমার কাছে।’
‘তাতেই হবে।’
ওগুলো পাঠানো হয়ে গেলে কিছুক্ষন গুম হয়ে বসে রইল মা। অর্থাৎ এখনও অন্ধকার।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা বলল, ‘চল রেডি হয়ে নি। এখানে এখন তো কিছু করার নেই, তার চেয়ে মৌ’দের সঙ্গেই বরং থাকি। খাবার কিছু করেছিস, তিন্নি?’
ভাত ফুটিয়ে রেখেছিলাম। সঙ্গে ফ্রিজে রাখা তরকারি গরম করে নিয়ে কোনরকমে কিছু খেয়ে নিলাম আমরা। গাড়িতে চেপেই তিন্নিকে কল করে জানালাম আমরা আসছি। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম দুজনেই একটু আগে স্যান্ডউইচ খেয়েছে। কথাটা মা’কে জানালে তার কাছ থেকে কোন রেসপন্স পেলাম না। তার এখনও ভ্রু কোঁচকানো, দৃষ্টি রাস্তার দিকে।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম মৌ আর কাকিমা একই জায়গায় বসে রয়েছেন। এখনও ডাক্তার আসেন নি। তবে অন দ্য ওয়ে।
‘তোরা তিনজন যাস ডাক্তারের কাছে। আমার মাথা কাজ করছে না, আমি বাইরেই বসি।’ মৌ’য়ের মা আমার উদ্দেশ্যে বললেন। আমি মায়ের দিকে তাকালাম। সে কাকিমার কথাটা শুনেছে বলে মনে হোল না। সমানে কিছু একটা চিন্তা করে যাচ্ছে।
ডাক্তার আসা মাত্র আমাদের ডাকা হল। আমি নিজের ডায়রি আর কলম বের করে রেখেছি আগে থেকেই। দরকার মতো নোট নিতে হবে।
ডাক্তারের বেশ সুপুরুষ চেহারা। বয়স সম্ভবত পঁয়তাল্লিশের আশে পাশে। ক্লিন শেভড। চোখে গোল্ডেন রিমের চশমা। বসে থাকলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না যে হাইট খারাপ নয় – অন্তত পাঁচ দশ তো হবেই।
আমরা বসলে উনি মায়ের উদ্দেশ্যে বলতে আরম্ভ করলেন, ‘দেখুন, সত্যি বলতে আমরা এখনও ওনার সম্বন্ধে খুব একটা প্রোগ্রেস করে উঠতে পারি নি। আগামীকাল একজন নিউরোলজিস্টের দেখার ব্যবস্থা করেছি। শুধু……’
মায়ের মোবাইলের রিং বাজছে। সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ মিটিঙের আগে ওটা সাইলেন্ট করে রাখে মা, আজকে ভুলে গেছে।
নিজের মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে চেয়েই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল মা, ‘মাফ করবেন, ডাক্তার। কলটা আমাকে নিতেই হবে। তিন্নি, তুই ওনার সব ডিটেল নিয়ে নে।’
তারপর আমি কিছু বলার আগেই আমার হাত থেকে ডায়রি এবং পেন ছিনিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়ল মা। মোবাইল অলরেডি কানে। দরজা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে আমি শুনতে পেলাম মা বলছে, ‘ইয়েস জুলিয়েন, জাস্ট গিভ মি আ মিনিট……’
তারপরও যে ডাক্তার আমাদের সঙ্গে মিনিট দুয়েক কথা বললেন সেটা নেহাতই তার ভদ্রতা। কাকুর মধ্যে যে দ্বৈতসত্তা কাজ করছে এমন সম্ভাবনার কথা উনিও বললেন। তবে যেহেতু এটা ওনার ফিল্ড নয় এই বিষয়ে উনি বেশি কিছু বলতে রাজি হলেন না। হাতের ইনফেকশন নিয়েও উনি দেখলাম চিন্তিত।
আমি অনেক অনুনয় করে ওনার ব্যক্তিগত নাম্বার জোগাড় করলাম। সেই সঙ্গে বাড়ির ঠিকানাও জানতে চাইলাম। ডাক্তার নিজের নাম্বার দিলেও ঠিকানা দিলেন না। শুধু এটুকু জানালেন যে তিনি সল্ট লেক এলাকায় থাকেন। লজ্জার মাথা খেয়ে ওনার কাছ থেকেই পেন আর কাগজ চেয়ে ওনার নাম্বার নোট করে নিলাম।
আমরা উঠলে উনি বললেন, ‘তবে অযথা ফোন করে বিরক্ত করবেন না। একবার রিঙে না ধরলে টেক্সট করবেন। সম্ভব হলে আমি কল ব্যাক করব।’
তিন
বেরিয়ে এসে মা’কে দেখতে পেলাম না। এইটুকু সময়ের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গেল?
কাকিমার কাছে এসে শুনলাম মা নাকি ফোনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেছে। তিন্নির মুখ গম্ভীর। এমনিতে কাকুর জন্যে চিন্তা তো আছেই, তার ওপর মায়ের এই আচরনও নিশ্চই ওর ভালো লাগে নি। ওকে বললাম অস্ট্রেলিয়া থেকে মায়র কাছে ফোন এসেছিল ওখানে কাকু কী নিয়ে কাজ করছিলেন সেই ব্যাপারে। ও মাথা নাড়ল।
খবর নিয়ে জানলাম কাকু নাকি এখনও ঘুমোচ্ছেন। সম্ভবত ইনজেকশনের প্রভাবে।
এখন আর এখানে আমাদের কিছু করণীয় নেই। মৌ আর কাকিমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে মৌ’কে বললাম আমি রাত্রে ফোন করব। ও বলল কোন খবর থাকলে আমাকে জানাবে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। খবর মানেই তো পরিস্থিতির অবনতি।
ওরা চলে গেলে মাকে ফোন করতে গিয়ে দেখলাম আমাকে অলরেডি একটা মেসেজ করে রেখেছে মা। আমি যেন বাড়ি চলে যাই, তার বাড়ি ফিরতে রাত হবে। ব্যাস, এইটুকুই।
জানি কোনো লাভ নেই তবু অভিমানে খামোখা চোখ জলে ভরে এল। আর কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলেই আমি মায়ের সঙ্গে যেতে পারতাম। কী এমন কাজ যে তিন-চার মিনিট অপেক্ষা করা যায় না?
আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে ট্যাক্সি থেকে জাস্ট নামতে যাব এমন সময় মায়ের ফোন এল।
‘তিন্নি, তুই একটু ফ্রেস হয়ে পার্ক স্ট্রিটের কাছে চলে আয়। এই ধর আটটা নাগাদ। আমি ওখান থেকে তোকে পিক করে নেব। আর শোন, অক্সফোর্ডের সামনে দাঁড়াবি। …। আমি? আমি এখন এক মেরিন বায়োলজিস্টের কাছে আছি। পরে ডিটেলে সব বোলব।’
ঘড়ি দেখলাম। প্রায় সাতটা বাজে। মায়ের দেওয়া সময় মতো পার্কস্ট্রিটে পৌঁছতে গেলে আর আধ ঘণ্টা পরেই বেরোতে হবে। টাকা মেটাবার সময় ড্রাইভার আঙ্কলকে জিজ্ঞেস করলাম উনি আরও আধ ঘণ্টা দাঁড়াতে পারবেন কিনা।
‘কোথায় যাবেন?’
‘পার্ক স্ট্রিট।’
‘এক শো এক্সট্রা লাগবে।’
নিজেকে সামলে নিলাম। এখন ট্যাক্সি চালকের সঙ্গে এথিকস নিয়ে তর্ক করার এনার্জি বা সময় কোনটাই নেই।
বাড়িতে ফিরে মুখে হাতে জল নিয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিলাম। তারপর আট পিস পাউরুটিতে জ্যাম লাগিয়ে প্যাক করে নিলাম। এই খাবার আমার একেবারেই পছন্দ নয় কিন্তু উপোষ করার চেয়ে তো ভালো। মায়ের যা মতিগতি দেখছি তাতে কোন চলনসই জায়গায় গিয়ে খাওয়ার সময় পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মা যখন এলো তখন প্রায় রাত ন’টা। এতটা দেরি হবে জানলে একটু অক্সফোর্ডের ভেতরে ঢুকে বই দেখে সময় কাটিয়ে দিতাম।
গাড়িতে উঠে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু খেয়েছ?’
কথাটা রেজিস্টার করতে মায়ের কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। তারপর হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, রে! লালবাজারের কাজটা মিটলেই কিছু খেয়ে নেব কোথাও।’
‘আবার লালবাজার!?’
ওখান থেকে লালবাজার যাওয়ার পথে মায়ের কাছ থেকে বিশেষ কথা বের করতে পারলাম না। শুধু বলল,’আজকে হয়ত গোটা রাতই জাগতে হবে আমাদের। কথাবার্তার প্রচুর সময় পাবো।’
ইন্সপেক্টর অনুভব সিনহা অপেক্ষা করছিলেন মায়ের জন্যে। সঙ্গে একটা ঢাউস বাক্স নিয়ে কনস্টেবল।
‘আপনারা এগোন, আমরা পেছনে আসছি।’ বলে পুলিসের জিপে চেপে বসলেন ইন্সপেক্টর সিনহা।
এবার গাড়িতে চেপে দেখলাম মা একটু রিল্যাক্সড হয়েছে। আমাকে নিজে থেকেই জানাল যে আমরা এখন ইনফ্রারেড ক্যামেরা নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। কাকুর বেডের দিকে তাক করে ওটা আজ রাত্রে বসানো হবে। এর জন্যে হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট এবং পেশেন্টের বাড়ির লোক – দুইপক্ষেরই অনুমতি নেওয়া হয়ে গেছে। যদি মায়ের অনুমান সঠিক হয় তাহলে আজ রাত্রে কিছু অসাধারণ দৃশ্য দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মনে মনে ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে পড়ছিলাম। সেই সঙ্গে কেমন যেন ভয়ও করছে। ছোটবেলায় ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইডের গল্প পড়েছিলাম। একই মানুষের দ্বৈত রূপ। আমরা কি সেরকম কিছু প্রত্যক্ষ করতে চলেছি?
হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম ওখানে একটা টিম অলরেডি আমাদের অভ্যর্থনার জন্যে তৈরি হয়ে রয়েছে। তবে ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম ওরাও বিশেষ কিছু জানে না।
টিমে একজন জুনিয়র ডাক্তার ছিলেন। বুকের ওপর নেমপ্লেটে লেখা – আর এন বর্মণ। তিনি জানালেন কাকুকে আবার সেডেটিভ দেওয়া হয়েছে যার প্রভাব আরও ঘণ্টা খানেক থাকার কথা। তারপর আবার সেডেটিভ দেওয়া যেতে পারে। আর তা না হলে ওনার ওপর নির্দেশ রয়েছে পেশেন্টকে বেডের সঙ্গে বেঁধে রাখার।
মা বলল, ‘দুটোর কোনটাই করবেন না। আমরা আজ রাত্রে ওনাকে অবজার্ভ করব। আপনি শুধু ওনার বিছানার আশে পাশের টেবিল থেকে জিনিসপত্র সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করুন। আর রাত্রে যেন ওনার বেডের কাছে কেউ না যায়।’
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ডাক্তার বললেন, ‘আমাকে আমার সিনিয়রের সঙ্গে এই ব্যাপারে ডিসকাস করতে হবে।’
মা বলল, ‘তার প্রয়োজন হবে না। আপনার সিনিয়র আধ ঘণ্টার মধ্যেই এখানে আসছেন।’
ইন্সপেক্টর সিনহা, ডক্টর বর্মণ এবং সেই পুলিশ কনস্টেবলের সঙ্গে মা কাকুর কেবিনে চলে গেল। আমি হাসপাতালের সিকিউরিটি অফিসে বসে রইলাম। ছোট রুম। খুব বেশি হলে চার-পাঁচজন মানুষ বসতে পারে এখানে।
দেওয়ালে একটা বড় এল ই ডি স্ক্রিন ঝুলছে। গুনে দেখলাম হাসপাতালের মোট ষোলটি অংশের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে সেই স্ক্রিনে। সবই বিভিন্ন গেট অথবা হাসপাতালের করিডোরের দৃশ্য।
কিছুক্ষন পরেই ঝুপ করে স্ক্রিন থেকে সব দৃশ্য অদৃশ্য হয়ে গেল। সম্ভবত পেশেন্টের কেবিনের কানেকশান দেওয়া হচ্ছে।
কিছু করার না থাকলে যা করার তাই করলাম – মোবাইল অন করে তার স্ক্রিনে চোখ রাখলাম। বিভিন্ন গ্রুপের ওহাটস আপ ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে চোখে পড়ল মা একটা কিছুর লিঙ্ক পাঠিয়েছে।
লিঙ্কে ক্লিক করে বুঝলাম ওটা ছোট্ট একটা খবরের লিঙ্ক। ‘শুভেন্দু’কে ‘শুভেদু’ লিখেছে। সিডনির এক ল্যাবে ডক্টর শুভেদু গুপ্তাকে পরীক্ষার জন্যে রাখা এক অক্টোপাস আক্রমণ করেছিল। তবে শেষে এটাও লিখেছে যে ডক্টর গুপ্তার তেমন কোন আঘাত লাগে নি এবং তিনি এখন সুস্থ রয়েছেন।
কিছুক্ষন গুম হয়ে বসে রইলাম। কাকু অক্টোপাস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলেন। কিন্তু কী ধরনের এক্সপেরিমেন্ট? অক্টোপাস সম্বন্ধে আমার জ্ঞান শুন্যের কাছাকাছি। শুধু এটুকু মনে পড়ছে কিছু বছর আগে বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় এক অক্টোপাসকে নিয়ে বেশ হৈ চৈ হয় – সেই অক্টোপাসটি নাকি কোন দল ম্যাচ জিতবে তার ঠিকঠাক ভবিষ্যতবাণী করছিল। কাকু নিশ্চই সেই লাইনের ওপর রিসার্চ করছিলেন না?
ইউ টিউবে অক্টোপাসের ওপর বেশ কিছু ভিডিও রয়েছে। তার মধ্যে যেগুলো বেশি পপুলার সেগুলো দেখতে আরম্ভ করলাম।
বেশ কিছুক্ষন পর মা ইন্সপেক্টর সিনহা এবং আরও এক ভদ্রলোকের সঙ্গে সিকিউরিটি রুমে ঢুকল। ক্যামেরা লাগানো হয়ে গেছে। মোবাইল নিয়ে মশগুল ছিলাম বলে খেয়াল করি নি যে ইতিমধ্যেই স্ক্রিনে প্রাণ ফিরে এসেছে। তবে দৃশ্যের সংখ্যা এখনও ষোল।
অপরিচিত ভদ্রলোক তার মধ্যে একটায় আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন। এই অংশের দৃশ্য অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। অন্ধকারের মধ্যে একটা শুয়ে থাকা মানুষের অবয়ব ফুটে উঠেছে। অনেকটা এক্স রে ছবির মতো দেখাচ্ছে।
টেবিলের ওপর রাখা মাউজ দিয়ে স্ক্রিনের সেই অংশে পয়েন্টার নিয়ে গিয়ে ক্লিক করা মাত্রই অন্য সব দৃশ্যগুলো অদৃশ্য হয়ে গিয়ে এখন পুরো স্ক্রিন জুড়ে সেই একটা দৃশ্যই দেখা যাচ্ছে।
ভদ্রলোক বললেন, ‘সাউন্ডের কওয়ালিটি খুব ভালো না হলেও মোটামুটি শোনা যাবে। আমি এই ফ্লোরের ডানদিকের শেষ রুমটায় থাকব। কোনরকম প্রয়োজন হলে ডাকতে দ্বিধা করবেন না। তাছাড়া মোবাইল তো রয়েছেই।’
মায়ের কথাবার্তায় বুঝলাম এই ভদ্রলোকও ডাক্তার, নাম ডঃ মাথুর। উনি চলে গেলে ইন্সপেক্টর সিনহাও অনুমতি চাইলেন মায়ের কাছে। যাওয়ার সময় উনি জানালেন যে যদিও ওনার ডিউটি শেষ হয়ে গেছে, তবুও মোবাইলে উনি সবসময়ই আভেলেবল। তাছাড়া ওনার অফিসে ল্যান্ডলাইনে ফোন করলে ওনার জায়গায় যে রয়েছেন তাকে পাওয়া যাবে। ওনাকে সব বলা আছে।
ওরা চলে গেলে মা আমার পাশের চেয়ারে বসল। তারপর আমার দিকে চেয়ে অল্প হেসে বলল, ‘খুব টায়ার্ড হয়ে গেছিস?’
তা হয়েছি। কিন্তু মার নিজের তো আমার চেয়েও বেশি ক্লান্ত থাকার কথা।
‘কিছু খাবার নিয়ে এসেছিস মনে হচ্ছে? স্মার্ট গার্ল! চ খেয়ে ফেলি। আর আধ ঘণ্টা পর থেকে ওনার ওপর সেডেটিভের এফেক্ট কমে যাওয়ার কথা। তার মধ্যে এইসব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলি।’
মায়ের কাজের সময় সেই কাজ বাদ দিয়ে অন্যান্য সবকিছুই ঝামেলা। আমি খাবার না নিয়ে এলে মা অনায়াসে রাতটা উপোষ দিয়ে দিত। আমাকে দেখেই খাবারের কথা মনে পড়েছে।
কোনরকমে জল দিয়ে দিয়ে জ্যাম-পাউরুটি গিলে হাত মুখ ধুয়ে দুইজনে বসলাম। স্ক্রিনে এখন আবার ষোলটি দৃশ্য। সবকিছু স্বাভাবিক।
‘তোমার পাঠানো লিঙ্কটা পড়লাম। অক্টোপাসের ওপর কী রিসার্চ করছিলেন কাকু?’
মা মাথা নাড়ল। জানে না। তারপর বলল, ‘তবে সেই ল্যাবে মোট বারোটা অক্টোপাস ছিল। ডক্টর গুপ্তর পরীক্ষায় তার মধ্যে তিনটে মারা যায়। ইঙ্কলুডিং দ্য ওয়ান হুইচ আট্যাকড হিম।’
‘ওনার কোন সহকারী ছিল না যে এই সম্বন্ধে তথ্য দিতে পারবে?’
মাথা নাড়ল মা। জানাল, সহকারী নয়, গার্ড। এখনও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু চেষ্টা চলছে।
‘আর মেরিন বায়লজিস্ট? তিনি কিছু জানালেন?’
‘সেরকম কিছু নয়। আমি তার কাছ থেকে মূলত অক্টোপাসের ওপর আজকাল কী রিসার্চ চলছে জানতে গেছিলাম। উনি কিছুটা হিন্ট দিলেও তার থেকে কিছু বোঝা যায় না। ওয়াইড এরিয়া।’
মা’কে কয়েকটা ভিডিওর কথা বললাম। এতদিন জানতাম প্রাণীদের মধ্যে প্রাইমেটস অর্থাৎ বাঁদর জাতীয় প্রাণী এবং ডলফিন বেশি বুদ্ধিমান। আজকে ভিডিও দেখে জানলাম অক্টোপাসও বেশ বুদ্ধিমান প্রাণী। কিছু ক্ষেত্রে তাদের নারকোলের খোলা নিজের সঙ্গে বয়ে নিয়ে যেতে দেখা গেছে যা তারা নিজের বাড়ি হিসেবে ব্যবহার করে। তাছাড়া বেশ জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করে তারা খাঁচা থেকে পালাতেও ওস্তাদ। অবশ্যই জলের ভেতরের খাঁচা।
আমার কথা শুনতে শুনতেও মা সামনের স্ক্রিনের দিকে চোখ রাখছিল। এবার আমার হাত চেপে ধরল। তারপর টেবিলের ওপর থেকে মাউজ ক্লিক করে কাকুর কেবিনের দৃশ্য বড় করল স্ক্রিনে।
প্রথমে মনে হোল কাকু চুপচাপ ঘুমোচ্ছে। কিন্তু তারপরই বুঝলাম কাকুর বিছানায় কিছু একটা নড়াচড়া করছে। কী সেটা? ছোটখাটো বেড়াল? নাকি সাপ?
ক্যামেরাটা বসানো রয়েছে কাকুর পায়ের দিকে, সামান্য বাঁ দিক ঘেঁষে। নড়াচড়া হচ্ছে বিছানার ডান দিকে, কাকুর কোমরের কাছে। তাই খুব স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে না।
একটু পরে ব্যাপারটা পরিষ্কার হোল। যেটা নড়াচড়া করছে সেটা কাকুর ডান হাত। প্রথমে ডান পায়ের ঊরুর ওপর কিছুক্ষন থমকে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর ধীরে ধীরে হাতটি উঠে এল কাকুর পেটের ওপর। সেখানে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে এবার বুকের ওপর হাতটি ঘুরতে লাগল। যেন কিছু খুঁজছে। অথচ কাকুর শরীরের বাকি অংশ নিঃস্পন্দ। হাতটিকে কাকুর শরীরের অংশ মনে হচ্ছে না। যেন একটা সরীসৃপ ঘোরাফেরা করছে তার শরীরের ওপর।
মায়ের দিকে তাকালাম। ভ্রু কুঁচকে এক দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রয়েছে মা। আজ সকালেই এই হাত মা’কে আক্রমণ করেছিল।
একটা খুব অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ শোনা গেল। সেই সঙ্গে কাকুর মাথা অল্প নড়তে দেখা গেল। ছবি খুব স্পষ্ট না হওয়ায় বুঝতে পারছিলাম না কাকুর চোখ খোলা রয়েছে কিনা।
কাকুর বুকের ওপর থেকে হাতের চেটো এবার সামান্য ওপরে উঠে খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে। তারপর হাতের আঙ্গুলগুলি নড়াচড়া করতে লাগল। যেন কোন কিছু ধরতে চাইছে।
‘কী হচ্ছে মা?’ প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম। কাকু রয়েছেন ফোর্থ ফ্লোরে, আর আমরা সেকেন্ড ফ্লোরে। এখান থেকে আমাদের কণ্ঠস্বর ওনার কাছে পৌঁছনর কোন সম্ভবানা নেই।
‘উনি দেখছেন।’ মা অস্ফুট গলায় বলল।
ঠিকই। চোখ ধাতস্থ হিয়ে যাওয়ায় এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি যে কাকু নিজের ডান হাতের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন। হাতটা আবার কাকুর বুকের ওপর শুয়ে পড়ল। তারপর ওপরের দিকে উঠে কাকুর গলার সামনে গিয়ে স্থির হোল।
‘না!’ বলে চিৎকার করে উঠলেন কাকু। সেই সঙ্গে ডানদিকে – বাঁদিকে নিজের মাথা নাড়াতে লাগলেন। এবার বেশ জোরে গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
হাতটা কাকুর গলা টিপে ধরেছে। সুইসাইড করার চেষ্টা করছেন কাকু? কিন্তু নিজের হাতে নিজের গলা টিপে আত্মহত্যা করা সম্ভব? মায়ের দিকে তাকালাম। সে উঠে দাঁড়িয়েছে। দরজার দিকে এগোতে এগোতে মোবাইলে কথা বলছে কারও সঙ্গে।
‘ডক্টর মাথুর, প্লিজ কাম টু দ্য পেশেন্টস কেবিন। নো, ডোণ্ট কাম হেয়ার। উই আর অলসো গোয়িং দেয়ার ওনলি। প্লিজ রাশ, ইটস আর্জেন্ট!’
চার
মোবাইলটা ডিস্কানেক্ট করে ছুটে বেরিয়ে গেল মা। আমি হতভম্বের মতো মুহূর্তকাল চেয়ে থেকে মায়ের পিছু নিলাম। শুধু বেরনোর আগে একবার স্ক্রিনের দিকে তাকালাম। কাকুর ডান হাত এখন কাকুর গলা ছেড়ে তার ঘাড়ের পেছনের দিকে গুঁজে রয়েছে। মুখ খুলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন কাকু।
আমি আর মা কাকুর কেবিনে পৌঁছে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম ডক্টর মাথুরের জন্যে। দরজার কাছে একজন কমবয়সী নার্স দাঁড়িয়ে। ওর চোখে – মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। মনে হয় ও সবকিছুই দেখেছে।
ডক্টর মাথুর আসা মাত্র মা ওকে অনুরোধ করল কাকুকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে। সেই সঙ্গে এটাও বলল যে ইনজেকশন দেওয়ার সময় যেন অন্তত দুইজন লোক থাকে কাকুর হাত – পা ধরে থাকার জন্যে।
‘আমি নিজে ওনার ডান হাত ধরে থাকব।’
ডক্টর মাথুর স্বাভাবিক কারনেই বেশ বিরক্ত। উনি শুরু থেকেই পেশেন্টকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। সেটাই এখন করতে হচ্ছে।
কাকুকে ইনজেকশন দিতে অবশ্য বেশি বেগ পেতে হল না। কেবিনের ভেতরে গিয়েই অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গিয়ে তার ডান হাত চেপে ধরল মা।
‘ওহ ডক্টর, ওহাই কান্ট ইউ জাস্ট কীল মি!’ ডাক্তার ইনজেকশন দেওয়ার সময় ফিসফিস করে বললেন কাকু।
কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে আমরা আবার গিয়ে সিকিউরিটি রুমে বসলাম। এখন আর সহজে ঘুম আসবে না বলে সবার জন্যে কফি আনালেন ডাক্তার মাথুর। তারপর মায়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ওয়েল?’
আমরা যা দেখেছি সেটা ডাক্তারকে বললাম। উনি গম্ভীর মুখে শুনে গেলেন, কতটা বিশ্বাস করলেন বোঝা গেল না। শেষে মা বলল, পুরো ঘটনাটারই রেকর্ডিং রয়েছে। উনি ইচ্ছে করলেই দেখতে পারেন।
ডক্টর মাথুর বললেন, ‘এই ধরনের কোনো মানসিক রোগের ব্যাপারে আমার জানা নেই। এর কাছাকাছি একটা মানসিক অবস্থার কথা জানি যাকে বলা হয় ‘এলিয়েন লিম্ব সিন্ড্রোম’। এক্ষেত্রে রোগী নিজের হাত বা পা’কে নিজের শরীরের অংশ বলে মেনে নিতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে তারা অপারেশন করে সেই অঙ্গকে শরীর থেকে বাদ দিতেও কসুর করে না। কিন্তু আপনি যা বলছেন সেটা আলাদা। আমাকে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে এরকম কেস আগে দেখা গেছে কিনা।’
কিন্তু যতক্ষণ না জানা যাচ্ছে ততক্ষন কি কাকুকে অজ্ঞান করেই রাখা হবে? মা চুপ মেরে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে আজকের রাত্রের অভিজ্ঞতা তাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। অবশ্য সে কী আশা করেছিল সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। আমি নিজেও কী চিন্তা করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
যখন বাড়ি ফিরলাম তখন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। ফেরার পথে মা শুধু জানাল যে জুলিয়েন কিছু খবর দিয়েছে তবে সেটা সম্পূর্ণ নয়। ল্যাবে সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল সেটা জানা জরুরি। যেটুকু জানা গেছে সেটা হচ্ছে এই – ল্যাবের নিয়ম ভেঙ্গে ডক্টর শুভেন্দু গুপ্ত সেদিন রাত্রে কিছু এক্সপেরিমেন্টের জন্যে ওখানেই থেকে গেছিলেন। পরদিন সকালে ওনাকে আহত এবং একটা অক্টোপাসকে মৃত অবস্থায় ল্যাবে পাওয়া যায়। ডক্টর গুপ্ত জানান অক্টোপাস ওনাকে আক্রমণ করায় নিজেকে বাঁচাতে উনি বাধ্য হয়ে সেটাকে মেরে ফেলেন। কিন্তু জারের মধ্যে বন্দি অক্টোপাস কীভাবে ওনাকে আক্রমণ করে তার কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা উনি দিতে পারেন নি। সেদিন ল্যাবে উনি ছাড়া আর মাত্র একজন ছিল – গার্ড। কিন্তু এই ঘটনার পর গার্ডের চাকরী যায় এবং তার কোন হদিস নেই।
অক্টোপাসের মতো প্রাণীর হাতে আক্রান্ত হলে মানুষ কিছুদিন আতঙ্কে বাস করতেই পারে। কিন্তু তার সঙ্গে কাকুর ডান হাতের কী সম্পর্ক হতে পারে? কোনো কারনে নিজের হাতকে তিনি সেই অক্টোপাসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন? কিন্তু সেই হাতের ওভাবে নড়াচড়ার কী ব্যাখ্যা আছে?
মা মাথা নাড়ল। এইসব স্পেকুলেশন করার সময় নেই। সব প্রশ্নের উত্তর যার কাছে রয়েছে তিনি হচ্ছেন স্বয়ং ডক্টর গুপ্ত। অথচ তিনি কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছেন না। এবং খুব দ্রুতগতিতে তার অবস্থার অবনতি ঘটছে।
বিছানায় শুয়ে ক্রমাগত সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে লাগল। ঠিক যেন অক্টোপাসের একটা শুঁড়ের মতোই সেটা নড়াচড়া করছিল। এবং সেই শুঁড়ের ওপর যেন কাকুর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
পরদিন বেশ সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম কম হলেও এখন বেশ ফ্রেস লাগছে। অর্থাৎ গভীর ঘুম হয়েছে।
বাড়িতে মা’কে দেখতে পেলাম না। অবশ্য এই সময় সে মর্নিং ওয়াকে যায়। ফিরে মধু দিয়ে হালকা সুসুম লেমন ওয়াটার খায়। আজ সানডে। ভাবলাম মায়ের জন্যে আজ আমিই ড্রিঙ্কটা তৈরি করে রাখি।
সময়মত বাড়ি ফিরল মা। মা’কেও ফ্রেস লাগছে। সঙ্গে লাইভলিও। অর্থাৎ কোনো একটা পথ খুঁজে পেয়েছে। জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, নিজের ইচ্ছে হলে এমনিই বলবে।
‘ব্রেকফাস্টে কী খাবি বল? আলু পারাঠা চলবে?’
মজা করছে নাকি? কিন্তু দেখলাম না! মা সত্যিই আলুর পরোটা করার প্ল্যান করে অলরেডি আলু সেদ্ধ করে ফেলেছে। খেয়েদেয়ে স্নান করে আবার হাসপাতাল।
‘ডায়রিটা রেডি রাখিস। আজকে অনেক কিছু নোট করার সুযোগ পাবি মনে হচ্ছে।’
মা’কে মনে করিয়ে দিলাম যে ডায়রিটা আমার কাছ থেকে সে ছোঁ মেরে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর সেটার দর্শন পাই নি। শুনে মা হেসে বলল, ‘আমার ব্যাগে আছে তাহলে। নিয়ে নিস।’
সে না হয় হোল কিন্তু মায়ের প্ল্যানটা কী? জিজ্ঞেস করলাম এর মধ্যে কোন ফোন টোন এসেছে কিনা। আসে নি।
আমি স্নান করে বেরোবার পরই মৌ’য়ের ফোন এল। গতরাত্রের বিষয়ে জানতে চাইল। বললাম আমরা হাসপাতালে আসছি, ওখানেই কথা হবে। ওকে সব বলা ঠিক হবে কিনা সেই বিষয়ে আমি সিওর নই। পথে মা’কে জিজ্ঞেস করে নেব।
হাসপাতালে প্রায় পৌনে এগারোটা নাগাদ পৌঁছলাম। আমাকে রিসেপ্সনের কাছে বসতে বলে কাকে যেন ফোন করতে করতে হাসপাতালের লিফটে উঠে গেল মা। অথচ আমাকে নাকি সব নোট করতে হবে!
একটু পরেই মৌ’দের সঙ্গে দেখা হোল। ওরা আগেই এসেছে। মায়ের কথামত মৌকে জানালাম গতকাল রাত্রে তেমন কিছু ঘটে নি, কাকু অজ্ঞান বা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। তবে ও বিশ্বাস করল কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত নই। কাকিমা দেখলাম খুব একটা কথাবার্তা কিছু বলছেন না। চুপ করে কিছু চিন্তা করছেন। একবার রুমাল বের করে চোখ মুছলেন।
আমি অন্য দিকে কথা ঘোরাবার চেষ্টা করলেও তাতে তেমন লাভ হোল না। মা কোথায় গেছে এটাও আমি জানি না শুনে গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মৌ। অথচ এই কথাটা সত্যি।
নিজেকে ডাইভার্ট করার উদ্দেশ্যে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলাম। কিন্তু তার আর সুযোগ পেলাম না। মায়ের ফোন।
‘চট করে ফোর্থ ফ্লোরে চলে আয়। লিফট থেকে বেরিয়ে বলবি ডক্টর মাথুরের চেম্বারে যাব, যে কেউ দেখিয়ে দেবে। আর শোন, একা আসবি।’
আমি কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিল মা। মৌ’য়ের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি উপাক্ষা করে কোনরকমে ‘একটু আসছি’ বলে লিফটের দিকে পা বাড়ালাম। কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু সেটা ভালো না খারাপ সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
ডক্টর মাথুরের চেম্বারে ঢুকে দেখলাম ডাক্তারের সামনের চেয়ারে মা বসে মৃদু স্বরে কিছু আলোচনা করছে। আমাকে দেখে ইঙ্গিতে পাশের চেয়ারে বসতে বলল।
‘এটায় কোন রিস্ক নেই, ডক্টর। আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট সিওর যে উনি আজকে ভায়লেন্ট আচরন করবেন না। তাছাড়া, আপনি তো ওনার হাত পায়ে স্ট্র্যাপ বেঁধে রাখছেনই। দরকার পড়লে শট দিতে কতক্ষনই বা লাগবে।’
ডক্টর মাথুর মাথা নাড়লেন, ‘গতরাত্রের সমস্ত ঘটনা আমি দেখেছি। আফটার দ্যাট আই ডোন্ট থিঙ্ক…’
‘ডক্টর প্লিজ! আমি সিওর যে আমাদের এটা লাস্ট চান্স। আপনি নিজেই দেখছেন মিঃ গুপ্তর প্যারামিটার ক্রমশঃ খারাপের দিকে এগোচ্ছে। অথচ এখনও পর্যন্ত আমরা ওনার সমাস্যাটা জানিই না। ট্রিটমেন্টও সেইজন্যে অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ানোর মতো করে চলছে। ওনার হাতের ইনফেকশন বেড়ে চলেছে। বাঁ হাতেও র্যাশ দেখা দিয়েছে। আমার কাছে ওনার এই অবস্থার কারণ সম্বন্ধে একটা হাইপথেসিস আছে। কিন্তু সেটা এক্সপ্লেন করতে যতটা সময় লাগবে সেটা এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। এবং সেই হাইপথেসিস ঠিক কিনা সেটা একমাত্র মিঃ গুপ্ত আমাদের বলতে পারেন।’
ডক্টর মাথুর চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে কয়েক মুহূর্ত বসে রইলেন। মায়ের দৃষ্টি ওনার মুখের দিকে। আমি নিশ্চিত সেই দৃষ্টির তীব্রতা উনি চোখ বন্ধ করেও অনুভব করতে পারছিলেন।
‘ওকে!’ বলে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর মাথুর।
আমরাও উঠলাম। ডক্টর মাথুরের পিছু পিছু আমরা কাকুর কেবিনের বাইরে গিয়ে থামলাম। মায়ের চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ।
‘কতক্ষনের জন্যে বলেছিলেন?’ ডক্টর মাথুর জিজ্ঞেস করলেন।
‘অন্তত এক ঘণ্টা। বেশি হলেও ক্ষতি নেই যদি না তাতে ডক্টর গুপ্তর কোন ক্ষতি হয়।’
‘ওকে! আপনারা এখানেই কিছুক্ষন দাঁড়ান, আমি ডেকে নেব।’
বলে কেবিনের ভেতরে ঢুকে পড়লেন ডক্টর মাথুর। এতক্ষনে মা’কে একা পেয়ে আমি চেপে ধরলাম, ‘কিছুই বুঝতে পারছি না। নয় আমাকে তুমি সবকিছু খুলে বল, নয় আমি মৌ’য়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি।’
‘একটু পরেই বুঝবি। আপাতত এইটুকু জেনে রাখ, আমরা ডক্টর গুপ্তর সঙ্গে কিছুক্ষন আলোচনা করতে এসেছি।’
নিশ্চই স্লিপ অফ টাং! ডক্টর মাথুর বা অন্যান্য কোন ডাক্তারের নাম নিতে গিয়ে ডক্টর গুপ্তর নাম বেরিয়ে গেছে মায়ের মুখ থেকে।
‘না রে। আমরা সত্যিই ওনার সঙ্গে কথা বলব। এট লিস্ট, আমার ধারণা আজ উনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হবেন।’
চুপ করে রইলাম। এতটা সিওর কীভাবে হচ্ছে মা? যেখানে ডাক্তার নিজে সিওর নয় সেখানে মায়ের এই বিশ্বাসের পেছনে কী যুক্তি রয়েছে? তবে মনের গভীরে আমি এটাও জানি নিজেকে মিথ্যে আশ্বাস দেওয়ার মানুষ আমার মা নয়। সে যখন এতটা আত্মবিশ্বাসী তখন তাঁর পেছনে কোন গ্রহণযোগ্য কারণ আছে অবশ্যই।
এখন দিনের আলোতে গতরাত্রের ঘটনা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কাকু হয়ত হাতটা অবচেতন অবস্থায় নাড়াচ্ছিলেন, বাকিটা আমাদের কল্পনা। হয়ত তার আগে অক্টোপাসের ভিডিও আমাদের মস্তিষ্ককে ওরকম দৃশ্যের জন্যে তৈরি করে রেখেছিল।
আমাদের সামনের দরজার অর্ধেকটা খুলে গিয়ে একজন নার্সের মুখ দেখা গেল, ‘আসুন আপনারা।’
আগে মা ঢুকল। পেছন পেছন নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমি।
পাঁচ
কেবিনের জানালার পর্দা টানা রয়েছে বলে আলো একটু কম। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চোখ ধাতস্ত হয়ে গেলে মোটামুটি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সবকিছু। কাকু চিত হয়ে ঘুমোচ্ছেন। ঠোঁটদুটি সামান্য ফাঁক হয়ে রয়েছে। বাঁ হাতে সেলাইনের পাইপ লাগানো। ডান হাত এখন অবশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। চেটো ওপরের দিকে। তবে সেই হাতে স্ট্র্যাপ বাঁধা নেই।
‘মিনিট পনেরো থেকে আধঘণ্টার মধ্যে ওনার জ্ঞান ফিরবে। হাতে দেওয়া লোকাল আনেস্থিসিয়া কাজ করবে অন্তত দুই ঘণ্টা। অর্থাৎ আপনি মিনিমাম দেড় ঘণ্টা সময় পাবেন।’ মায়ের দিকে চেয়ে নিচু গলায় বললেন ডক্টর মাথুর।
‘দ্যাট উইল বি ইনাফ! থ্যাঙ্ক ইউ, ডক্টর। এবার আমরা ওনার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করি।’
কেবিনের দুটো চেয়ারে ডক্টর মাথুর আর মা বসল। পাশের খালি বেডের ওপর আমি বসলাম। আর কাকুর বেড থেকে বেশ খানিকটা দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল নার্স।
প্রথম প্রথম সময় যেন এগোতেই চায় না। তারপর মাথার ভেতর নানান খেয়াল আনাগোনা করতে লাগল। ইস, কত পড়াশোনা বাকি রয়ে গেল। এইজন্যে মা বারবার বলে শেষ মুহূর্তের জন্যে কিছু ফেলে রাখিস না। কিন্তু এরকম কিছু একটা ঘটবে সেটা কে জানত? মৌ’য়ের জন্যে আবার মন খারাপ হয়ে গেল। আমি পরীক্ষার কথা ভাবছি আর ও নিজের বাবার মৃত্যুর আশঙ্কায় সময় কাটাচ্ছে। ও এমনিতেই হয়ত পরীক্ষা দিতে পারবে না। কাকুর কিছু একটা হয়ে গেলে তো কথাই নেই। এই ধরনের নানান চিন্তা মনের মধ্যে এসেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে নিজের নিঃশ্বাসের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এটা নাকি ধ্যানের প্রথম ধাপ। কিন্তু আমি এই প্রথম ধাপই আজ পর্যন্ত পেরোতে পারলাম না।
‘শুভেন্দুবাবু।’
মায়ের গলার স্বরে আমার চমক ভাঙ্গল। কাকুর জ্ঞান ফিরেছে নাকি? কাকুর মুখের দিকে তাকালাম। ঢুকেই ওনার মাথার যে পোজিশান দেখেছিলাম সেখান থেকে সামান্য একটু সরেছে বলে মনে হল। দুই ঠোঁটের মধ্যে ফাঁকটাও যেন একটু কম।
‘শুভেন্দুবাবু, শুনতে পাচ্ছেন? চোখ খুলুন, এখন ভয়ের কিছু নেই।’
কাকুর চোখের পাতা সামান্য কেঁপে উঠল। ছোট্ট করে একটা ঢোঁক গিললেন। তারপর আস্তে আস্তে দুটো চোখ খুললেন। সামান্যই। কয়েক মুহূর্ত শুন্য দৃষ্টিতে ঘরের সিলিঙের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর মায়ের গলার স্বর অনুসরণ করে উনি মাথাটা সামান্য ডানদিকে কাত করলেন।
‘আমি তিন্নির মা। মৌ’য়ের বন্ধু তিন্নি।’
‘গো অ্যাওয়ে!’ ঘরঘরে গলায় বলে উঠলেন কাকু। সেই সঙ্গে আবার ওনার দুই চোখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল। এক লহমার জন্যে ওনার চোখের দৃষ্টি নিজের ডান হাতের ওপর পড়ল।
‘আপনি ভয় পাবেন না। আপনার ডান হাতকে লোকাল আনিস্থিসিয়ার সাহায্যে অচৈতন্য করে ফেলা হয়েছে। আগামী অন্তত দুই ঘণ্টা ওটা অবশ থাকবে।’
দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল কাকুর। ওনার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল।
‘আমি সত্যি বলছি। আপনি নির্ভয়ে সব কথা বলুন। এখানে শুধু আমি, ডাক্তার আর আমার মেয়ে তিন্নি আছে। আপনি চাইলে আপনার মিসেস আর মৌকেও ডেকে দিতে পারি।’
আবার নিজের ডান হাতের দিকে তাকালেন কাকু। তারপর নিজের বাঁ হাত দিয়ে সেই হাত স্পর্শ করলেন। একটা লম্বা শ্বাস বেরিয়ে এল ওনার মধ্যে থেকে। তারপর আবার আগের মতোই ঘরঘরে গলায় বললেন, ‘ওদের ডাকুন। প্লিজ! সময় নেই।’
মা ডক্টর মাথুরের দিকে তাকালেন। ডক্টর মাথুর ইশারায় সম্মতি জানাতে আমাকে ফিসফিস করে মা বলল, ‘তুই বাইরে গিয়ে ফোন করে ওদের দুজনকে ডেকে দে। কেউ আটকালে যেন রিসেপ্সনে ডক্টর মাথুরের নাম বলে, ওরা ব্যবস্থা করে দেবে। তাড়াতাড়ি করবি।’
কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পেছন ফিরে দেখলাম কাকু অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রয়েছেন। তবে সেই দৃষ্টিতে একটু আগে দেখা আতঙ্ক নেই।
একটু পরে মৌ আর কাকিমাকে নিয়ে আবার কেবিনে ঢুকলাম। এতজন মানুষের পক্ষে যথেষ্ট বসার জায়গা না থাকায় কাকিমা আর মৌকে বিছানায় বসতে দিয়ে আমি নার্সের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
মৌ আর কাকিমার দিকে বিহ্বল হয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন কাকু। যেন অনেক কিছু বলতে চান কিন্তু কোথা থেকে আরম্ভ করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
“আপনি অস্ট্রেলিয়ার কী বিষয়ে গবেষণা করছিলেন, মিঃ গুপ্ত? প্লিজ, একটু বিশদে বলুন। আমাদের হাতে সময় আছে।’
মাথা নাড়লেন কাকু। ইশারা করে জল খেতে চাইলেন। নার্স ওনাকে বসিয়ে জল খাওয়াল। তারপর বলতে আরম্ভ করলেন কাকু। এখন তাঁর গলায় সেই ঘড়ঘড়ে ভাবটা আর নেই।
“কতদিন ধরে এই মুহূর্তের জন্যে আমি অপেক্ষা করে আছি। জানি আমি যা বলতে যাচ্ছি সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। আমার নিজের জীবনে না ঘটলে হয়ত আমিও করতাম না।
সামুদ্রিক প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা ছিল আমার গবেষণার বিষয়। আগে ডলফিন আর তিমির ওপর আমি রিসার্চ করেছি। এবারের বিষয় ছিল অক্টোপাস। অনেকেই জানে না, অক্টোপাস অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। ওরা চিন্তা করে নিজের সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। প্ল্যান করতে পারে। এমনকি আলাদা আলাদা মানুষকে চিনতে পারে। যখন তারা ডুবুরীর পোশাক পরে থাকে তখনও।
এছাড়াও তারা অন্যান্য বড় সামুদ্রিক প্রাণী থেকে নিজেদের বাঁচাতে নিজেদের শরীরের রঙ এবং ত্বকের টেক্সচার পরিবর্তন করে এমনভাবে আশেপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায় যে তাদের দেখতেই পাওয়া যাবে না। দে আর মাস্টার অফ ক্যামোফ্ল্যেজ। আর এই যে তাদের শরীরের রঙ বা ত্বকের টেক্সচারে পরিবর্তন হয়, সেটা এত সঙ্গে সঙ্গে হয় যে খালি চোখে বোঝাই যায় না ব্যাপারটা কখন ঘটল। আরও আছে। কিছু বিশেষ প্রজাতির অক্টোপাস ছদ্মবেশ ধারন করতে পারে। তারা কিছু বিষাক্ত প্রাণীর রূপ ধরে তাদের মতো চলাফেরা করতে আরম্ভ করে যাতে তাদের যারা খেতে এসেছে তারা ভয় পেয়ে পালায়। দে আর সিমপ্লি আমেজিং।’
কেবিনের মধ্যে পিন ড্রপ সাইলেন্স। সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রয়েছি। মৌ’য়ের দিকে তাকালাম। ওর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। মায়ের ভ্রু সামান্য কোঁচকানো। কাকিমা একদৃষ্টিতে কাকুর দিকে চেয়ে রয়েছেন।
আবার আরম্ভ করলেন কাকু।
“তবে এই সব কিছুর চেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে অক্টোপাসদের মস্তিষ্ক। আমাদের মস্তিষ্কের কোষ অর্থাৎ নিউরন আমাদের মাথার ভেতর কেন্দ্রীভূত। সুতরাং আমাদের চিন্তাভাবনার উৎস আমাদের মাথা। অক্টোপাসের ক্ষেত্রে সেটা নয়। তাদের সমগ্র শরীরের মাত্র এক তৃতীয়াংশ নিউরন তাদের মাথায় থাকে, বাকি দুই তৃতীয়াংশ ছড়িয়ে থাকে তাদের সমস্ত শরীর জুড়ে। মূলত তাদের আটটা শুঁড়ের মধ্যে। এর ফলে অক্টোপাসের শুঁড় অনুভব এবং চিন্তা করতে সমর্থ। এবং এই চিন্তার সময় তাদের মাথার প্রয়োজন পড়ে না। বা বলা ভালো, অক্টোপাসের মোট নয়টা মাথা আছে – এর সবগুলিই নিজে থেকে চিন্তা করতে এবং ডিসিজন নিতে সমর্থ।’
এতটা বলে আবার কয়েক মুহূর্তের জন্যে কাকু থামলেন। সবাই ওনার দিকে চেয়ে থাকলেও এখন কাকু মূলত মা’কে লক্ষ্য করেই কথা বলছেন।
অক্টোপাসের বিষয়ে বাকি সব কিছু মোটামুটি জানতাম শুধু তার বিচিত্র মস্তিষ্ক বাদ দিয়ে। মৌ এবং কাকিমা হয়ত কিছুই জানত না। কাকু যে অক্টোপাস নিয়ে রিসার্চ করছিলেন সেটাও তাদের কাছে নিউজ।
“অক্টোপাসের মস্তিষ্ক ছিল আমার গবেষণার মূল বিষয়। একটা অক্টোপাসের মাথা এবং তার শুঁড় কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ সেটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম আমি। এটাও দেখতে চাইছিলাম কীভাবে তারা নিজেদের মধ্যে চিন্তার আদানপ্রদান করে। একটা শুঁড়ের অনুভূতি অন্য শুঁড়ে পৌঁছয় কীভাবে? এর জন্যে তাদের মাথার প্রয়োজন পড়ে কিনা? কখনও কি মাথা আর শুঁড়ের মধ্যে চিন্তার বিরোধ হয়? সেক্ষেত্রে কার ডিসিশন প্রাধান্য পায়?
আমার পরীক্ষার জন্যে মাঝে মধ্যেই ইনজেকশন দিয়ে অক্টোপাসদের মাথার ভেতরের নিউরন অবশ করে তাদের শুঁড়ের গতিবিধি দেখতাম। কখনও বা উল্টোটা। স্বাভাবিক কারনেই অক্টোপাসরা আমাকে তেমন পছন্দ করত না। আমি ল্যাবে প্রবেশ করা মাত্রই তারা নিজেদের একোয়াএকরিয়ামের এক কোনে গুটিয়ে বসে থাকত। কখনও বা জলের ফোয়ারা ছিটিয়ে আমাকে আক্রমণ করত।’
এবার মায়ের গলা শোনা গেল।
‘আপনার পরীক্ষা চলাকালীন তিনটে অক্টোপাসের মৃত্যুও ঘটেছে।’
কাকু নিজের দুটো চোখ এঁটে বন্ধ করে রাখলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর সেই অবস্থাতেই মাথা নেড়ে বললেন,’’রাইট! ঠিকই শুনেছেন। একটা ক্ষেত্রে এনিস্থিসিয়ার পরিমাণ বেশি হয়ে গেছিল। অন্যটায়, আমার দেওয়া ইলেকট্রিক শক ও সহ্য করতে পারে নি।
ওরা এমনিতেই আমাকে সহ্য করতে পারত না, এই দুটি দুর্ঘটনার পর অক্টোপাসের ওপর আমার পরীক্ষা করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। আমার উপস্থিতিতে তারা কোনরকম রিয়াকশন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় ল্যাবের চেয়ারে বসে বসে কীভাবে নিজের পরীক্ষায় এগোবো এই চিন্তা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। তারপর ঘুম ভাঙ্গে অসহ্য শ্বাসকষ্টে।
একটা অক্টোপাস নিজের থাকার জায়গা থেকে কীভাবে যেন বেরিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। খুব বড় ছিল না অক্টোপাসটি – এক একটা শুঁড়ের দৈর্ঘ এক থেকে দেড় ফুটের মতো হবে। কিন্তু তার তাঁর শক্তি ছিল যথেষ্ট। আমার গলা ছাড়াও তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল আমার ডান হাত। সম্ভবত ও মনে করেছিল ওদের শুঁড়ের মতো আমারও ডান হাতের স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা রয়েছে। ইনজেকশনগুলি ডান হাতেই দিতাম তো।’
টানা এতটা বলে সামান্য হাসলেন কাকু। তারপর মৌয়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আরও একটু জল দিবি?’
নার্স এগিয়ে যাচ্ছিল জল নিয়ে। তাকে হাতের ইশারায় মা থামাল। নার্সের হাত থেকে জলের গেলাস নিয়ে তার বাবার পাশে মৌ গিয়ে বসল। নার্স সাহায্য করল কাকুকে বালিশে ঠেস দিয়ে বসাতে। জল খেয়ে বেশ কিছুক্ষন মৌয়ের হাত ধরে বসে রইলেন কাকু। মা দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকাল। এখনও হাতে ঘণ্টাখানেক সময় আছে।
‘তারপর?’ মা জিজ্ঞেস করল।
কাকু বললেন, ‘আমার গোঙানির শব্দে গার্ড এসে পড়ায় অক্টোপাসের পাশ থেকে সেদিন আমি মুক্তি পাই। কিন্তু আমাকে বাঁচাতে গিয়ে সেই অক্টোপাসটিকেও মেরে ফেলতে হয়।’
আবার কিছুক্ষন সবাই চুপচাপ। তারপর মা জিজ্ঞেস করল, ‘এর কতদিন পর আপনি ভারতে ফিরে আসেন?’
‘চারদিন পর। দুর্ঘটনাটার পর আমার মানসিক স্থিরতা ছিল না। ভাবলাম দেশে কিছুদিন কাটিয়ে আবার নতুন করে রিসার্চ আরম্ভ করব। কিন্তু ………’, কথাটা আর শেষ করলেন না কাকু। আবার তিনি নিজের বিছানায় এলিয়ে পড়েছেন। যেন নিজের মধ্যে জমানো এই কথাগুলো বলার জন্যেই শরীর আর মনের শক্তি সঞ্চয় করে রেখেছিলেন, সেই শক্তির আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই।
আবার মা বলল, ‘আপনার হাতের সংক্রমণ ওখান থেকেই আরম্ভ হয়েছিল না দেশে ফেরার পর?’
‘হাতের বেশ কিছুটা জায়গা ছড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর এক অদ্ভুত অনুভূতি আরম্ভ হোল। সারাক্ষন চিনচিন করত হাতটা। অনেকটা ঝিঁঝিঁ লেগে যাওয়ার মতো। তারপর র্যাশ বেরনো আরম্ভ হোল। তবে এগুলো জাস্ট বাইরের সিম্পটম। মূল সমস্যা সম্পূর্ণ আলাদা। সেটা হয়ত আপনারা বিশ্বাস করতে চাইবেন না।’
‘সত্যিই হয়ত বিশ্বাস করতে পারতাম না। কিন্তু গতকাল রাত্রে আমরা আপনার হাতের গতিবিধির সাক্ষী ছিলাম। অক্টোপাসের শুঁড়ের মতোই এখন সেই হাত এখন আর আপনার নিয়ন্ত্রনে নেই। সে নিজের কাজকর্ম সম্বন্ধে নিজেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এবং সেই হাত আপনাকে আতঙ্কিত করে রেখেছে।’
উত্তেজনায় আবার উঠে বসার চেষ্টা করতে লাগলেন কাকু। কিন্তু তার শরীর এখনও যথেষ্ট দুর্বল। নার্স এগিয়ে এসে ওনাকে সাপোর্ট দিল।
‘আমি জানি না আপনি এটা কীভাবে বুঝলেন। কিন্তু এটা সত্যি। আমার এই হাত শুধু নিজের ইচ্ছেমত নড়াচড়াই করছে না, সে আমার সব চিন্তাভাবনার ওপর নজর রেখেছে। যখনই আমি আমার অবস্থার কথা কাউকে বলার কথা চিন্তা করেছি, সে আমাকে আঘাত করেছে। বারবার। আমি যে এখনও বেঁচে রয়েছি সেটা শুধুমাত্র এই কারণ যে সে জানে আমার মৃত্যুর সঙ্গে তারও মৃত্যু ঘটবে। একই শরীরে এখন আমরা দুইজন শ্ত্রুরুপে বাস করছি। আমি জানি যে এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না। কারণ ধীরে ধীরে আমার বাঁ হাতেও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এরপর হয়ত পা দুটিকে এই রোগ আক্রমন করবে। আরও অন্যান্য অঙ্গও তারপর। আমার বেঁচে থাকা আমার আশেপাশের মানুষের পক্ষেও বিপদজনক হয়ে উঠবে। তবে আমি এখন কিছুটা শান্তিতে মরতে পারব। মারা যাওয়ার আগে আমি শুধু নিজের মনের কথা সবার সামনে বলে যেতে চাইছিলাম। বিশেষ করে নিজের স্ত্রী এবং মেয়ের কাছে।’
কাকুর ডান হাতের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতর একটা শিরশিরে অনুভূতি হোল। এটা এখন আর নিছক একটা অঙ্গ নয় কাকুর শরীরের। একটা আলাদা জীব। যে কোনও মুহূর্তে যে জেগে উঠে আবার কাকুর বা আমাদের কারও ওপর আক্রমন চালাতে পারে। বা হয়ত সে এখনও জেগে রয়েছে, অভিনয় করছে ঘুমিয়ে থাকার। তারপর সুযোগ বুঝে আঘাত হানবে।
আরও কিছুক্ষন কথা বললেন কাকু। উনি নিশ্চিত পুরোটা না হলেও ওনার নিজস্ব চিন্তার একটা বড়সড় অংশ ওনার হাতের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, কিন্তু উল্টোটা সাধারণত ঘটে না। অর্থাৎ ওনার ডান হাত কী করতে যাচ্ছে সেটা উনি আগে থেকে বুঝতে পারেন না। তবে কিছু ক্ষেত্রে আঁচ পান। যখন কোনও কারনে ওনার হাত অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠে তখন তিনি সেটা টের পান। ওনার ডান হাতে স্পর্শের অনুভূতি তো আছেই, সেই সঙ্গে শরীরের অন্যান্য অঙ্গের অনুভুতিও সে ব্যবহার করতে সক্ষম।
‘কখনও আপনার হাতকে রঙ বদলাতে দেখেছেন?’ মা জিজ্ঞেস করল।
মাথা নাড়লেন কাকু। না, দেখেন নি। অক্টোপাসের সব গুণ ওনার হাতে প্রবেশ করে নি।
মা এরপর মৌ আর কাকিমাকে কাকুর কাছে কিছুক্ষন বসতে বলে আমাকে আর ডাক্তার মাথুরকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে এল। কেবিনের ভেতর নার্সও রইল। তাকে ডাক্তার নির্দেশ দিলেন যেন আর মিনিট কুড়ি পর দুজনকেই বাইরে নিয়ে চলে আসা হয়। আর স্ট্র্যাপ দিয়ে কাকুর হাত পা বেঁধে রাখা হয়।
‘তুই বাইরে বস তিন্নি, আমি ডাক্তারের সঙ্গে একটু আলোচনা সেরে আসি।’ বলে আমাকে বাইরে বসিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে গেল মা।
আমি বাইরে বসে গত কয়েক ঘণ্টায় যা দেখলাম আর শুনলাম সেই বিষয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। ডক্টর মাথুর কি কাকুর কোথায় বিশ্বাস করেছেন? বিশ্বাস করতে আমারও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু নিজের চোখে যা দেখেছি সেটা উড়িয়ে দেব কীভাবে?
ছয়
মৌ’দের সঙ্গে একটা ক্যাফেতে বসে কথা হচ্ছিল। কাকিমাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এখনও একটা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। মৌ নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে। তার এখন প্রধান চিন্তা কীভাবে কাকুকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে আসা যায়। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কাকুর ডান হাত অপারেট করে বাদ দিতেও তার আপত্তি নেই।
‘এটা প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম রে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সংক্রমণটা বাঁ হাতেও ছড়াচ্ছে। হয়ত কিছুদিন পর শরীরের অন্যান্য অংশেও এর প্রভাব দেখা যাবে। তবে চিন্তা করিস না, কিছু একটা পথ পেয়ে যাব। স্বস্তির কথা এটাই যে ডাক্তার এখন সমস্যাটা কোথায় সেটা মোটামুটি রিয়ালাইজ করেছে। হাতের একটা স্ক্যান করা প্রয়োজন। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে মিস্টার গুপ্তর মস্তিষ্ক ঘুমিয়ে থাকবে অথচ হাতের অনুভূতি বজায় থাকবে সেটা কীভাবে সম্ভব হবে ওনারা বুঝতে পারছেন না। কিন্তু সেটা যদি না করা হয় তাহলে জ্ঞান ফিরে পাওয়া মাত্রই সেই হাত ওনাকে এটাক করবে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্ক্যানের সময় তো হাত বাঁধা থাকবে?’
‘শুধু স্ক্যানের সময় নয় রে, তারপর থেকে সারাক্ষনই ওনার দুটো হাত বেঁধে রাখতে হবে। উনি কথা বলার সময় হাত অচেতন থাকলেও এনিস্থিসিয়ার প্রভাব কেটে যাওয়ার পরই ওনার মস্তিষ্কের স্মৃতির নাগাল পেয়ে যাবে ওনার হাত। তারপর সে কী করবে সেটা অনুমান করা কঠিন।’
কাকুর গলা টিপে ধরার দৃশ্যটা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মায়ের কথাই ঠিক, এবার জ্ঞান ফিরে পাওয়া মাত্রই প্রাণঘাতী হামলা চালানোর চেষ্টা করবে হাতটা। সুতরাং এরপর থেকে সবসময় কাকুর ডান হাতকে বেঁধে রাখতে হবে। কিন্তু সেটা কতদিন?
‘আগে স্ক্যানটা হোক তারপর নিউরোসার্জেনদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করব। মিসেস গুপ্ত, আপনি প্লিজ একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করুন। এখন অন্তত আমরা কিছুটা বুঝতে পারছি। যে কোন অসুখের প্রতিকারের এটা প্রথম স্টেপ।’
কাকিমা নিজের মাথা নাড়ালেন। কিন্তু ওনার চোখের দৃষ্টি এখনও স্বাভাবিক নয়। ওখান থেকে বেরোবার সময় মৌকে একপাশে ডেকে মা নিচু গলায় কিছু বলল। মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল মৌ।
এবার বাড়ি। গাড়িতে বসে রিয়ালাইজ করলাম কতটা ক্লান্তি জমে আছে আমার শরীর আর মনের মধ্যে।
একটু পরে মা’কে বললাম, ‘ইটস হরিবল মা। নিজের শরীরের মধ্যেই শত্রু বাস করছে।’
মা মাথা নাড়ল। তারপর বলল, ‘অন্য দিকটাও দ্যাখ তিন্নি। বিভিন্ন প্রাণীদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার সময় আমরা প্রায়ই মাত্রা ছাড়িয়ে যাই। তাদের প্রাণের, তাদের কষ্টের কোনো মুল্যই থাকে না আমাদের কাছে। কিন্তু ওদেরও যে অনেক শক্তি আছে যা আমাদের ধরাছোঁওয়ার বাইরে সেটা আমরা ভুলে যাই। এমন কি সেই শক্তির ব্যাখ্যাও আজ আমাদের কাছে নেই। এই অক্টোপাসদের কথাই ভাব। ওরা নিজেরা কালার ব্লাইন্ড কিন্তু নিজেদের লুকোবার জন্যে প্রয়োজন মতো নিজের শরীরের রঙ পাল্টাতে পারে। তাছাড়া এতদিন আমার ধারণা ছিল সামাজিক প্রাণীই বেশি বুদ্ধিমান হয়। তাদের মস্তিষ্ক একে অপরের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের ফলে ক্রমাগত উন্নত এবং জটিল হতে থাকে। কিন্তু অক্টোপাসের বেলায় সেই যুক্তি খাটে না। তারা সামাজিক প্রাণী না হয়েও ওদের মস্তিষ্ক যথেষ্ট উন্নত। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আজ না হয় কাল আমরা নিজেদের এই ইন্সেন্সিটিভ ব্যবহারের শাস্তি পাবো। এভাবে একটা দুটো করে নয়, বেশ বড়সড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হব আমরা।’
এরপর বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ কাটল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের চিহ্ন তো আজকাল চারিদিকেই ছড়িয়ে রয়েছে। কিছুদিন আগেই করোনার প্রকোপে সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষদের নাভিশ্বাস উঠে গেছিল। সেই সংক্রমণের উৎসও চিনের এক এমন জায়গা যেখানে প্রাণীদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার করা হত। প্রাণীদের ওপর এক্সপেরিমেন্টের ক্ষেত্রেও মায়ের কথার যুক্তি নাকচ করা যাবে না কিন্তু কাকুর এভাবে কষ্ট পাওয়াটাও মেনে নিতে পারছি না। উনি যা করেছেন সেটা ভুল এই কথাটা মেনে নিলেও কাকুর জীবন এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না কোনমতেই। উনি ইতিমধ্যেই নিজের কৃতকর্মের জন্যে যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছেন।
বিকেলের দিকে মৌ’য়ের ফোন এল। স্ক্যানে কাকুর দুই হাতের ত্বকের নিচে কোষের আস্তরণ পাওয়া গেছে। সেই কোষের সঙ্গে আমাদের নিউরনের সাদৃশ্য রয়েছে। ডাক্তাররা অপারেট করে প্রথমে সেই সম্পর্ক ছিন্ন করে তারপর দুই হাতের কোষগুলি বাদ দিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করছেন। দরকার পড়লে হাতের কোষের ওপর রেডিয়েশন দিতে হতে পারে।
ফোন রেখে মা’কে সব কথা বললাম। মায়ের হাবভাব দেখে মনে হোল সেও এরকমই আশা করছিল। তারপর নিজেই মৌ’কে কল করল।
‘ওখানে এখন ডক্টর মাথুর আছেন? …… কতক্ষন পর?…… আচ্ছা, আমরাও আসছি।’
দেড় ঘণ্টা পর আবার হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম আমরা। আমাদের দেখেই মৌ উঠে এল। পেছনে পেছনে কাকিমাও। উনি কোন কথা না বললেও এখন যেন অনেকটাই স্বাভাবিক।
মৌ বলল, ‘আমি খবর নিয়েছিলাম আন্টি। ডাক্তার রাস্তায় আছেন, যে কোন মুহূর্তে এসে পড়বেন।’
এবার ডাক্তারের কাছে আমরা চারজনই গেলাম।
‘ইউ ওয়ের রাইট, মিসেস দত্ত। আমাদের যতই আশ্চর্য মনে হোক, পেশেন্টের হাতের মধ্যে মস্তিষ্কের নিউরনের মতো কোষ খুঁজে পাওয়া গেছে। অনেকটা অক্টোপাসের মতো ওনার এখন এক শরীরে দুটো মস্তিষ্ক। তৃতীয়টাও সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা মোটামুটি একটা প্ল্যান করে ফেলেছি ওনার চিকিৎসার। একটু সময় লাগবে কিন্তু আমার ধারণা উনি সম্পূর্ণ সুস্থ হিয়ে উঠবেন।’
কাকিমা কেঁদে ফেললেন। ওনার মধ্যে যে কতটা দুঃশ্চিন্তা জমা ছিল সেটা এতক্ষনে বুঝতে পারলাম। উনি নিজেকে সামলে নেওয়া অব্দি ডাক্তার অপেক্ষা করে ওনার প্রস্তাবিত চিকিৎসার পদ্ধতি আমাদের এক্সপ্লেন করলেন।
মেডিক্যাল টার্মগুলো বাদ দিয়ে যেটা দাঁড়ালো সেটা এইরকম। প্রথমে অপারেট করে দুই হাতের কোষগুলির সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হবে। তারপর হাতের কোষগুলিকে হয় রেডিয়েশন দিয়ে ধীরে ধীরে মেরে ফেলা হবে নয় সেগুলোও অপারেট করে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। তবে হাতের কিছুটা ক্ষতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে ডান হাতে। হয়ত সেই হাত দিয়ে আগের মতো স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে পারবেন না কাকু। আবার এমনও হতে পারে প্রথম প্রথম কিছুদিন অসুবিধে হবে কিন্তু তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন।
মা ওনাকে জিজ্ঞেস করল কাকুর ব্রেনে এই চিকিৎসায় কোন প্রভাব পড়বে কিনা।
‘আনলাইকলি। তবে ওনার মধ্যে যে সাইকলজিক্যাল ট্রমা রয়েছে সেটা কাটতে হয়ত কিছুদিন সময় লাগবে।’
‘আচ্ছা ডক্টর, জানি না কথাটা বোকার মতো হচ্ছে কিনা, কিন্তু আমার মনে হয় হাতের সঙ্গে মস্তিষ্কের কানেকশন বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে আমরা যদি কিছুদিন অপেক্ষা করি তাহলে হয়ত হাতের কোষগুলি আপনা আপনিই মারা যাবে। আমরা কি কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারি?’
ডক্টর মাথুর কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, ‘নো মিসেস, দত্ত। দ্যাট উইল বি রিস্কি। সেক্ষেত্রে আবার সেই কোষগুলি মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলতে পারে। ভুলে যাবেন না, এই সংক্রমণের আরম্ভ কিন্তু হাত থেকেই হয়েছে, মস্তিষ্ক থেকে নয়। এখন যে হাতের কোষের সঙ্গে মস্তিষ্কের কোষের যোগাযোগ রয়েছে সেটা হাতের কোষগুলির ইনিসিয়েটিভের ফল। অপারেশনের দেরি করলে সংক্রমণ শরীরের আর কোন কোন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে তার ঠিক নেই।’
মা মাথা নাড়ল। ঠিক হোল এই পদ্ধতিতেই এবার চিকিৎসা চলবে কাকুর।
আমরা বেরোবার আগে কাকিমার সঙ্গে কিছুক্ষন কথা হোল। স্ক্যানের পর কাকুর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষন কথা হয়েছে তার। কাকু নাকি জানিয়েছেন ওনার দুই হাত বাদ দিয়ে দিলেও ওনার আপত্তি নেই। তবে এভাবে হাত বাঁধা অবস্থায় উনি স্বস্তি পাচ্ছেন না একেবারেই। উনি ওনার হাতের চাপা ক্রোধ অনুভব করতে পারছেন। ‘ফিউরি’ শব্দটা ব্যাবহার করেছেন কাকু। এক মুহূর্তের জন্যে ছাড়া পেলেই ওনার হাত আক্রমন চালাবে।
মা কাকিমার হাত ধরে বলল, ‘ডাক্তারের কথা তো শুনলেন দিদি। হাত বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। আমার তো মনে হয় উনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন খুব তাড়াতাড়ি। শুধু এবার আপনাকে একটু শক্ত হতে হবে। আপনার মেয়ে এমনিতে খুব স্ট্রং কিন্তু ওর বয়স কম। ও একসঙ্গে আপনাদের দুজনকে কীভাবে সামলাবে?’
কাকিমা হাসলেন। মৌও। আমরা বেরনোর সময় মৌ আমাকে একপাশে ডেকে ফিসফিস করে বলল, ‘আন্টিকে থ্যাংকস জানিয়ে ছোট করতে চাই না। আমি চিন্তাই করতে পারছি না তোরা না থাকলে আমাদের কী হত।’
মৌকে জড়িয়ে ধরলাম। চোখে ঝাপসা দেখছি। অন্য দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম।
এরপর কয়েকটা দিন কেটে গেছে। মৌ এখনও কলেজে জয়েন করে নি। তবে ফোনে যোগাযোগ রাখছিল আমার সঙ্গে।
শেষ পর্যন্ত ডাক্তাদের প্ল্যানমতো পুরো চিকিৎসা হয় নি কাকুর। বরং বলা ভালো তার প্রয়োজন পড়ে নি। ওনার হাতের সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার তিন – চার দিন পর থেকেই ডাক্তাররা বুঝতে পারেন যে ওনার দুই হাতেরই কোষ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই নষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়াটা এরপর বেশ দ্রুতগতিতেই হয়। মাত্র দিন সাতেকের মধ্যেই কোষগুলির কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যান কাকু।
সব শুনে মা’কে বলেছিলাম, ‘তোমার অনুমানই ঠিক। মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় আর সেই কোষগুলি বেঁচে থাকতে পারল না।’
মা বলেছিল, ‘না রে তিন্নি। আমার ধারণা ঘটনাদুটো পরপর ঘটলেও, একটা অন্যের কারণ নয়। যে অক্টোপাসটি ডক্টর গুপ্তকে আক্রমন করেছিল তার বয়স ছিল এক বছর পাঁচ মাস। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে প্রজাতির অক্টোপাস ওনাকে আক্রমণ করেছিল তাদের আয়ু হয় দেড় থেকে পৌনে দুবছর মাত্র। সুতরাং …’
আমি অবাক।
‘মাত্র দেড় বছর? অতবড় একটা প্রাণীর আয়ু মাত্র দেড় বছর?’
‘হ্যাঁ রে। ব্যাপারটা বিজ্ঞানীদের কাছেও অত্যন্ত রহস্যময়। প্রকৃতি একটা প্রাণীকে এত বুদ্ধি, এত বাঁচার কৌশল দিয়ে পাঠাল, অথচ তার আয়ু মাত্র দেড়-দু বছর। মনে হওয়া স্বাভাবিক অক্টোপাসের ক্ষেত্রে এত তোড়জোড় খামোখাই করা হয়েছে। কি বলত, এক সময় নাকি অক্টোপাস শামুকেরই মতো খোলে বাস করতে অভ্যস্ত ছিল। কেন জানি না, তারা একসময় সেই খোল থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু তাদের শরীর নরম, একটা হাড়ও নেই গোটা শরীরে। সুতরাং প্রিডেটারের হাত থেকে বাঁচার কোন অস্ত্রই ছিল না তাদের কাছে। শেষে তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে নানান কৌশল করায়ত্ব করল তারা। বুদ্ধিও হয়ত সেই প্রয়োজনেই উন্নত হতে থাকল। কিন্তু তাদের আয়ু সেই কমই রইল। মৃত্যুর বয়স হয়ে গেলেই তাদের অঙ্গ – প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে পড়ে। হয়ত নির্দিষ্ট সময়ের পর তাদের মস্তিষ্কেরও মৃত্যু ঘটে আপনা আপনিই।’
সব শুনে চুপ করে রইলাম। প্রথমে স্বস্তির অনুভূতি হলেও একটু পরেই মন খারাপ হয়ে গেল।
অদ্ভুত প্রাণী এই অক্টোপাস। এত সাজ সরঞ্জাম, এত ব্যাবস্থা একটা ছোট্ট জীবনের জন্যে। আর সেই জীবন আরও ছোট হয়ে উঠছে ওদের জীবনে, ওদের থাকার জায়গায় আমাদের দখলদারিতে। এর ওপর ওদের শরীরের ওপর বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা তো আছেই।
মা বলেছিল একটা থিয়োরি আছে যার মতে আমাদের পৃথিবীকে একটা জীবন্ত প্রাণীর দঙ্গে তুলনা করা হয় – ‘গাইয়া’। সেই গাইয়া নিজের ভালোমন্দ বুঝতে পারেন, প্রয়োজন মত পদক্ষেপ নিতে পারে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে।
গাইয়া দেখছে সবই। হয়ত অপেক্ষা করছে কখন আমরা ভস্মাসুরের মতো নিজেদেরই পুড়িয়ে ফেলব। খুব দেরি নেই। গাইয়ার টাইম স্কেল কোটি কোটি বছর। আমরা এসেছি এই সেদিন। হয়ত আমাদের নিয়ে প্রকৃতিও একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছে। কী হবে যদি কোনো প্রাণীর মস্তিষ্ক খুব বিকশিত হয়?
সেই পরীক্ষার ফল ভালো হয়নি। প্রকৃতি এবার চেষ্টায় আছে নিজের ভুল শুধরে নেওয়ার। গাইয়ার মানুষকে প্রয়োজন নেই। তাকে ছাড়া অনায়াসে চলে যাবে তার। যে পৃথিবীতে মানুষ থাকবে না তা আবার স্বর্গ হয়ে উঠবে অন্যান্য জীবনের কাছে।
Tags: বড় গল্প, সন্দীপ চৌধুরী, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
Really scary, although no overdose of theory or any complicated outcome! Very nicely described story with believable ending! Thanks to Author Sandeep Chaoudhury.