রুপোলি পর্দায় ব্র্যাডবেরি
লেখক: রাকেশকুমার দাস
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
সায়েন্স ফিকশনের জগতে রে ব্র্যাডবেরির নাম একেবারে প্রথম সারিতে থাকে, যেমন চমৎকার কল্পনাশক্তি, তেমনি বলিষ্ঠ সাহিত্য তাঁর। অথচ শোনা যায় তিনি নিজে ‘সায়েন্স ফিকশন লেখক’ বলে পরিচিত হতে চাইতেন না। তাঁর লেখার মূল উপজীব্য হল একটা চমৎকার কল্পনা, যাকে কেন্দ্র করে একটা উপভোগ্য গল্প তৈরি হবে৷ সেটা সায়েন্স ফিকশন হতে পারে, সায়েন্স ফ্যান্টাসি হতে পারে, ম্যাজিক রিয়ালিটি বা বিশুদ্ধ ফ্যান্টাসিও হতে পারে। ছোটোবেলা থেকেই গুলে খেয়েছেন জুল ভের্ন, অ্যালেন পো, ওয়েলসদের। একটু বড়ো হয়ে অনুপ্রাণিত হন হাইনলেইনের রচনা থেকে। বিজ্ঞানের খুঁটিনাটির থেকেও তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মানুষের মনের কথা, সমাজের কথা। তাঁর সঙ্গে আর যে-কজন প্রথম সারির এস-এফ লেখকের কথা উঠে আসে তাদের মধ্যে সাহিত্যের মানের দিক থেকে ব্র্যাডবেরি নিঃসন্দেহে এগিয়ে থাকবেন। ভাষায় কবিতার মাধুর্য, রূপক ও উপমার উপযুক্ত ব্যবহার তাকে প্রথম সারির সাহিতিকের তকমা এনে দিয়েছে।
ছোটোবেলা থেকে ব্র্যাডবেরি সিনেমারও ভক্ত ছিলেন। হেন কোনো সিনেমা মুক্তি পেত না যা তিনি একাধিকবার থিয়েটারে গিয়ে দেখতেন না। উপরন্তু, প্রায়ই হলিউডের বিভিন্ন স্টুডিয়োতে চলে যেতেন বিখ্যাত লোকেদের দেখতে৷ লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গল্প, উপন্যাস ও কবিতা লেখার পাশাপাশি চলচ্চিত্র বা থিয়েটারের জন্য চিত্রনাট্যও অনেক লিখেছে। নিজের লেখা গল্প হলে তো কথাই নেই, অন্য গল্প থেকেও চিত্রনাট্য লেখার কাজ রীতিমতো উপভোগ করতেন। হার্মান মেলভিলের নভেল থেকে তৈরি হওয়া, গ্রেগরি পেক ও অরসন ওয়েলস অভিনীত বিখ্যাত সিনেমা মবি ডিক-এর চিত্রনাট্য লেখায় ব্র্যাডবেরির প্রধান ভূমিকা ছিল।
তাঁর লেখা ৩৬টারও বেশি গল্প বা উপন্যাস এ-যাবৎ চিত্রায়িত হয়েছে— কখনও পূর্ণদৈর্ঘের চলচ্চিত্র হিসেবে, কখনও শর্ট ফিল্ম, টেলিফিল্ম, কোনো অ্যান্থোলজি সিরিজের এপিসোড ইত্যাদি নানা রূপে পেক্ষাগৃহ বা টিভির পর্দায় এসেছে। একাধিক থিয়েটারে দেখা গেছে তাঁর গল্পের নাট্যরূপ৷ বিখ্যাত ডায়মেনশন এক্স এবং তারপর এক্স মাইনাস ওয়ান অনুষ্ঠানে সম্প্রচারিত হয়েছে তাঁর একাধিক গল্পের বেতাররূপ। তবে আজ আমরা মূলত পূর্ণদৈর্ঘের চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব যেগুলো ব্র্যাডবেরির গল্প থেকে নির্মিত হয়েছে। বেশির ভাগ মুভির বিবরণের পর ছোটোখাটো রিভিউ মতো যোগ করা হয়েছে, যাতে স্পয়লার তথ্য থাকতে পারে। তাই পাঠকবর্গ যারা সিনেমাগুলি দেখতে আগ্রহী তাঁরা চাইলে ওই অনুচ্ছেদগুলি ডিঙিয়ে যেতে পারেন।
১৷ ইট কেম ফ্রম আউটার স্পেস (১৯৫৩)
ব্র্যাডবেরির রচনা থেকে নির্মিত প্রথম সিনেমা এটি। তবে এটি কোনো পূর্বপ্রকাশিত গল্প থেকে তৈরি হয়নি, ব্র্যাডবেরি নিজেই ‘দি ম্যাটিওর’ বলে একটি ফিল্ম ট্রিটমেন্ট লেখেন, যেটি থেকে এই সিনেমাটি তৈরি হয়। ইউনিভার্সাল স্টুডিয়োর তরফ থেকে এটা প্রথম থ্রি-ডি ছবি ছিল। সেই সময়ে সাই-ফাই সিনেমার বেশির ভাগই এলিয়েন ইনভেসন জাতীয় ছবি তৈরি হত। ব্র্যাডবেরি এমন এক ছবি করতে চাইলেন যাতে ভিনগ্রহীদের আক্রমণকারী হিসেবে দেখানো হবে না। জ্যাক আর্নল্ড এই ছবিটি পরিচালনা করেন এবং মুখ্য চরিত্রে ছিলেন রিচার্ড কার্লসন। (পরিচালক ও অভিনেতা জুটির আরেকটি বিখ্যাত সাই-ফাই ছবি ছিল ‘ক্রিয়েচার ফ্রম দ্য ব্লু লেগুন’।)
যাই হোক, ছবির গল্প হল মিস্টার পুটনাম বলে এক শখের জ্যোতির্বিজ্ঞানী শহর থেকে কিঞ্চিৎ দূরে থেকে বিজ্ঞানচর্চা করেন এবং পত্রপত্রিকায় আর্টিকল লিখে উপার্জন করেন। একদিন আকাশ থেকে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড পড়তে দেখে রাতের বেলাতেই প্রতিবেশির হেলিকপ্টার নিয়ে সেই স্থানে যান। উল্কার বদলে উনি এমন কিছু দেখেন যা দেখে ধারণা হয় এটি উল্কা নয়, ভিনগ্রহ থেকে আসা উচ্চপ্রযুক্তির কোনো মহাকাশযান। কিন্তু কিছু করার আগেই একটি ধ্বস নেমে সব মাটির তলায় চলে যায়। পুটনামের এই মহাকাশযান তত্ত্ব পত্রিকায় প্রকাশ হলেও কেউ বিশ্বাস করে না, তাকে উচ্চাকাঙ্খী বা পাগল ঠাওরায় সবাই। কিন্তু তারপর থেকেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকে সেই অঞ্চলে যার সমাধানে পুটনাম, তার বান্ধবী এলেন, সেখানকার শেরিফ ও আরও কয়েকজন জড়িয়ে পড়ে।
[স্পয়লার সম্বলিত মতামত] যে সময়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে সেই সময়ে ভিজুয়াল এফেক্টের প্রযুক্তি ততটা সমৃদ্ধ হয়নি, উপরন্তু এটি খুব বেশি বাজেটের ছবিও না। তাই এখন দেখতে বসলে দু-একটি জায়গায় খেলো লাগলেও লাগতে পারে, তবে রিচার্ড কার্লসনের উপস্থিতি আর অভিনয় আমাদের সেসব ভুলিয়ে দেয়। ভিনগ্রহীর দৃষ্টিকোন ব্যবহার করে আর যান্ত্রিক অস্বস্তিকর ভূতুড়ে একটি আওয়াজ ব্যবহার পরিচালক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে সফল হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে এলিয়েন ২ এর উদাহরণ টানা যেতে পারে, কীভাবে জেমস ক্যামেরন এলিয়েনের ফার্স্ট পারসন ভিউ ব্যবহার করে ভয়ের আবহ সৃষ্টি করেছিলেন। আর সেই সময়ের এলিয়েন-ইনভেসনের গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে অন্যরকম বক্তব্য রাখার চেষ্টাকেও সাধুবাদ জানাতে হয়। এই ছবির গল্পেই হয়তো সত্যজিতের ‘এলিয়েন’ বা স্পিলবার্গের ইটি-র বীজ বোনা ছিল।
২। দ্য বিস্ট ফ্রম ২০,০০০ ফ্যাদম (১৯৫৩)
আগের ছবিটির সঙ্গে একই বছর মুক্তি পায় এই ছবিটি। তবে এই ছবির সঙ্গে ব্র্যাডবেরির গল্পের কাহিনিগত মিল খুব একটা নেই। হয়েছিল কি, ‘মনস্টার ফ্রম বিনিথ দ্য সি’ বলে একটি ছবির নির্মাণকার্য শুরু হওয়ার পরে পত্রিকায় ব্র্যাডবেরির ‘দ্য বিস্ট ফ্রম ২০,০০০ ফ্যাদম’ নামে একটি গল্প বেরোয়, যার কেন্দ্রেও ছিল একটি সি-মনস্টার। ব্র্যাডবেরির জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে ছবির প্রযোজকরা গল্পটির সিনেমা-স্বত্ব কিনে নেন। ছবির নাম পালটে হয়ে যায় ‘দ্য বিস্ট ফ্রম ২০,০০০ ফ্যাদম’ আর ব্র্যাডবেরি গল্পের নাম পালটে রাখেন দ্য ফগ হর্ন। ছাপা গল্পটিতে ছিল সমুদ্রতটে একটি লাইট হাউসের কুয়াশা-সংকেতের শব্দ শুনে সমুদ্রের গভীর থেকে এক দানবীয় জন্তু উঠে আসে। কিন্তু সিনেমায় ছিল নিউক্লিয়ার শক্তির পরীক্ষানিরীক্ষায় সমুদ্রের গভীরে সুপ্ত এক রেডোসরাস জেগে ওঠে এবং ধ্বংসলীলা চালাতে চালাতে ভূখণ্ডের দিকে ধাবিত হয়। তবে গল্পের প্রভাব কি কিছুই নেই সিনেমায়? ছবির মনস্টারকে তৈরি করা হয় ঠিক পত্রিকায় যেমন ইলাসট্রেশন করা ছিল ঠিক তেমন করে। আর একটি কথা না বললেও কারোর বুঝে নিতে বাকি নেই যে জাপানে প্রবল জনপ্রিয় গডজিলা সিরিজের সিনেমার মূল অনুপ্রেরণা ছিল এই ছবিটি। ১৬ মাস পরেই মুক্তি পায় গডজিলা সিরিজের প্রথম সিনেমা।
৩। ফারেনহাইট ৪৫১ (১৯৬৬)
ব্র্যাডবেরির সবচেয়ে বিখ্যাত নভেল যেমন এই ফারেনহাইট ৪৫১, তাঁর গল্প থেকে হওয়া সিনেমাগুলির মধ্যেও সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রশংসিত ছবি বোধ হয় এইটি। বিশ্ববরেন্য ফরাসি সিনেমা পরিচালক ফ্রঁসোয়া ত্রুফো সিনেমাটি পরিচালনা করেন। শোনা যায় ত্রুফো সায়েন্স ফিকশন একেবারেই পছন্দ করতেন না। এটা জেনে তাঁর এক বন্ধু এই বইটা পড়তে বলেন। বইটা পড়ে ত্রুফো সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেন যে এই বই থেকে তিনি সিনেমা করবেন। ছবির গল্প বোধ হয় সবারই জানা, তাও নিয়মরক্ষার খাতিরে বলে নিই। এই গল্প এমন এক ভবিষ্যতের সমাজের কথা বলে, যেখানে সরকার বইকে বে-আইনি বস্তু বলে ঘোষণা করেছে— কারণ বই না কি মানুষকে বিষণ্ণ করে তোলে। আর বইতে যা লেখা থাকে তা নেহাতই গুলগল্প। তাই বই রাখার অধিকার কারোর নেই। শহরের দমকল আর আগুন নেভায় না, কারোর বাড়িতে বই পাওয়া গেলে তা পোড়াতে যায়। এই দমকলেই কাজ করে গল্পের প্রধান চরিত্র মন্টাগ। কিন্তু কোন এক সময়ে, পোড়ানোর বদলে বই পড়তে শুরু করে দেয় মন্টাগ, আর তারপর থেকেই অন্য খাতে বইতে শুরু করে তার জীবন। মন্টাগের চরিত্রে অভিনয় করেন অস্কার ওয়ের্নার। তার স্ত্রী ও একটি রহস্যময়ী মহিলার চরিত্রে ডুয়াল-রোল করেন জুলি ক্রিস্টি (ডক্টর জিভাগো খ্যাত)।
এই ছবির অন্যতম আকর্ষণ ক্যাপ্টেন বিটির ভূমিকায় সিরিল কুস্যাকের অভিনয়।
[স্পয়লার সম্বলিত মতামত] ব্র্যাডবেরির শব্দবন্ধকে খুব ভালোভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন ত্রুফো মহাশয়। প্রথম চমক, শুরুতে কলকুশলীর নাম না দেখিয়ে পড়ে শোনান হয়। ছবির থিম সম্পর্কে এ যেন একটি পূর্বাভাস দিয়ে দেয়। সরকারি তরফের সবকিছু খুব রঙিন, তীব্র। সাধারণ মানুষের মধ্যে যেন সামান্য ফিকে ভাব। কে বলবে এটি ত্রুফোর প্রথম রঙিন ছবি। কালো পোশাকের ফায়ারম্যান-দের বই পোড়ানোর মধ্য দিয়ে আর সাধারণ নাগরিকদেরই ইনফরমার দেখিয়ে লেখক/পরিচালক যে ফ্যাসিস্ট-শাসনকে ইঙ্গিত করেছেন সেটা আর বুঝতে বাকি থাকে না। সারা ছবি সুন্দর গতিময়। একটি মাত্র খামতি যেটা হতে পারে তাহল বই পড়া নিয়ে মন্টাগের মধ্যে যে দ্বিধাদন্দ্ব, অস্থিরতা হওয়ার কথা ছিল তা বিশেষ দেখানো হয়নি। ছবিটি শেষ হয় দারুণ একটি সিকোয়েন্সের মাধ্যমে।
৪। দ্য ইলাসট্রেটেড ম্যান (১৯৬৯)
ব্র্যাডবেরির ইলাসট্রেটেড ম্যান বইটি ছিল ১৮টি ছোটোগল্পের সংকলন। এই গল্পগুলোকে সংযুক্ত করে আরেকটি গল্প। এক ব্যক্তি যাত্রাপথে এমন এক লোকের পাল্লায় পড়ে যার সারা গা অদ্ভুত ও চমৎকার সব উল্কির মতো আঁকিবুকি দিয়ে ভরা। এই আঁকাগুলো না কি বিশেষ জাদুবলে প্রাণ পায়, এবং নড়ে চড়ে উঠে একটি গল্প দেখায় যা কিনা মনে করা হয় ভবিষ্যতের ঘটনা। এইভাবে ১৮টি আঁকা ছবি ১৮টি গল্প বলে। পরিচালক জ্যাক স্মাইট তাদের মধ্যে থেকে দ্য ভেল্ট, দ্য লং রেইন এবং দ্য লাস্ট নাইট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড— এই তিনটি গল্প বেছে নিয়ে সিনেমাটি বানান। বইতে গল্পগুলোর মধ্যে কোনো সংযোগ ছিল না, প্রত্যেকটি আলাদা গল্প ছিল। কিন্তু ছবিতে পরিচালক একটি মোক্ষম চাল চালেন, ইলাসট্রেটেড ম্যানের চরিত্রটাকেই অন্য তিনটি গল্পের প্রধান চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন অভিনেতা এক রেখে, যেন ওই ব্যক্তির ভবিষ্যৎ জীবনের ঘটনাই ওই গল্পগুলো বলছে।
[স্পয়লার সম্বলিত মতামত] ছবির আইডিয়াটা যতটা ভালো ছিল, তার প্রয়োগ যথোপযুক্ত ছিল না বলেই মনে হয়। ট্যাটু যে নড়াচড়া করে গল্প দেখাচ্ছে, এই জিনিসটাই আমরা বুঝতে পারি না সিনেমা চলাকালীন, মনে হয় যেন ফ্ল্যাশব্যাক দেখাচ্ছে। তার উপর এই চিত্রিত মানুষটির চরিত্রটিই যখন অন্য তিনটি গল্পে দেখি তখন এটা পরিষ্কার হয় না যে এই ঘটনাগুলো কি হয়ে গেছে না ভবিষ্যতে হবে। তিনটি গল্পই ধারণা করা হয় সুদূর ভবিষ্যতের, ফলে ভবিষ্যতের কথা ফলবে কি ফলবে না এই নিয়ে অনেক ধন্দ্ব থেকে যায়। ইলাস্ট্রেটেড ম্যান চরিত্রে রড স্টাইগারের মেজাজি অভিনয় ছাড়া তেমন কিছু নেই। আলাদা গল্প হিসেবে ধরলে তিনটি গল্পই বেশ ভালো দেখানো হয়েছে, শেষ গল্পটিতে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন এনে ডার্ক এন্ডিং করা হয়েছে যা কিছুটা হলেও সিনেমার উপসংহার আর সামগ্রিকভাবে মুড নির্মাণে সাহায্য করে।
৫। সামথিং উইকেড দিস ওয়ে কামস (১৯৮৩)
ছোটোদের জন্য বানানো ডিজনির ফ্যান্টাসি-ধর্মী ছবি এটি, তৈরি হয়েছে ব্র্যাডবেরির একই নামে প্রকাশিত একটি নভেল থেকে। তবে সেই নভেলের পেছনে আবার সিনেমার হাত আছে। শুরুতে ছিল একটি ছোট্ট গল্প, ‘দ্য ব্ল্যাক ফেরিস ’। আগেই বলা হয়েছে ব্র্যাডবেরির মাথায় সিনেমার পোকাও কিছু কম নড়াচড়া করত না। বিশিষ্ট অভিনেতা ও পরিচালক বন্ধু জিন কেলির সঙ্গে একসঙ্গে কোনো কাজ করার ইচ্ছে ছিল, তাই তারা এই গল্পটিকে বাছলেন এবং তার সিনেমা ট্রিটমেন্ট তৈরি করলেন। কিন্তু কোনো স্টুডিয়ো সেটি নিয়ে কাজ শুরু করতে রাজি হয় না। এই ট্রিটমেন্ট থেকেই উনি সম্পূর্ণ নভেল লেখেন পরে। নভেলের গল্প আবার অনেকটা তাঁর নিজের ছোটোবেলার স্মৃতিনির্ভর। ইলিনয় শহরে যেখানে তাঁর শৈশব কেটেছিল, কোনো এক শরতে এসেছিল দারুণ মজাদার মেলা, এসেছিল জাদুকর মিস্টার ইলেকট্রো। গল্পে ইনি হয়ে ওঠেন মিস্টার ডার্ক, সঙ্গে নিয়ে আসেন আশ্চর্য কার্নিভাল। তার পর থেকেই অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটতে থাকে সেখানে। দুই বন্ধু উইল আর জিম দেখে ফেলে অদ্ভুত কিছু ঘটনা, তার পরেই ভয়ংকর ঘটনায় জড়িয়ে যায় তারা।
[স্পয়লার সম্বলিত মতামত] আগাগোড়া ম্যাজিক ও ফ্যান্টাসি মোড়া এই সিনেমার থিম বেশ পুরোনো। অশুভ শক্তি তোমাকে নানা প্রলোভন দিয়ে ডাকছে, তোমাকে সেই প্রলোভন জয় করে শুভকে কাছে টেনে নিতে হবে। এখানে মি. ডার্ক সেই অশুভ শক্তি যারা মানুষের নানা অপূর্ণতাকে ব্যবহার করে প্রলোভন দেখায় এবং প্রলোভনে পা দিলেই তারা অশুভ গোষ্ঠীর দলে ভিড়ে যায়। খুব সুনিপুণ হাতে বানানো এই ছবি। শৈশবের সেই জাদুময় বিকেল, অদ্ভুত ফেরিওয়ালা, রূপকথার গল্প, ভয় আর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে পাঁচিল টপকে পালিয়ে আসা— সবই ধরা পড়েছে পরিচালক জ্যাক ক্লেটনের এই ছবিতে।
৬। দ্য ভেল্ট (রাশিয়া) (১৯৮৭)
ব্র্যাডবেরির ছোটোগল্প দ্যা ভেল্ট থেকে এই ছবি করেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের উজবেক পরিচালক নাজিম তিউলাদিয়েভ। ভেল্ট গল্পটি যেমন জনপ্রিয়, তেমনি এটা নাট্যরূপে এসেছেও অনেকবার। গল্পটি হয়তো অনেকেরই জানা। ভবিষ্যতের এক কাল্পনিক সমাজের একট পরিবার এই গল্পের কেন্দ্রে, যারা বাস করে এমন একটি উচ্চপ্রযুক্তিসম্পন্ন বাড়িতে, যার প্রায় সব কাজই স্বয়ংক্রিয় ভাবে হয়। ছেলে নাওয়ানো-খাওয়ানো থেকে শুরু করে রান্নাবান্না-বাসনধোয়া সব। এই বাড়িতেই আছে একটি বিনোদনকক্ষ— যার নাম নার্সারি। এই ঘরের দেওয়ালগুলি থ্রি-ডায়মেনশনাল টিভির স্ক্রিনের মতো। কোনো জায়গার ছবি দেখালে মনে হবে আপনি সশরীরে সেখানেই পৌঁছে গেছেন, মানুষের মস্তিষ্ক ঠাহর করতে পারে না সেটা আসল না নকল। বাড়ির বাচ্চারা যখন অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে সেই বিনোদনের জন্য, তখনই বাবা-মা বনাম প্রযুক্তির একটি পরোক্ষ লড়াই শুরু হতে থাকে।
[স্পয়লার সম্বলিত মতামত] যারা গল্পটি পড়েছেন তারা জানেন যে গল্পটির শেষটি ওপেন এন্ডেড। অর্থাৎ কীভাবে চার দেয়ালের মধ্যে একটুকরো আফ্রিকার তৃণভূমি ঢুকে পড়ল তা নিয়ে গল্পে কিছু বলা নেই। তাই এই ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য পরিচালক আরও কিছু অংশ জুড়েছেন, যা প্রতিষ্ঠিত করে যে কোনো এক প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্থান-কালের গন্ডি লঙ্ঘন করা সম্ভব হচ্ছে কোনোভাবে। এটা খুবই সুপরিকল্পিত এবং এর জন্য পরিচালক আরো একটি সমান্তরাল গল্পের অবতারণা করেন; এবং পাশাপাশি অন্যান্য গল্প থেকেও কিছু কিছু এলিমেন্টসও ব্যবহার করেন। যেমন সিনেমা শুরু হয় ‘দ্য ড্রাগন’ গল্পের কাহিনি দিয়ে, যেখানে দুটি ভিন্ন সময় আকস্মিকভাবে মুখোমুখি হয়ে যায়। ‘দ্য মার্শিয়ান’ গল্পের মতো এক বৃদ্ধ দম্পতির অকালমৃত ছেলে হঠাৎ হাজির। সেইখানে কখনও কখনও অন্য স্থান-কাল থেকে শব্দ শোনা যায়, কখনও হানাদার হানা দেয়, মৃতদেহ চলে আসে সেই পরিবার যে শহরে থাকে সেই শহরে। খুব সামান্য হলেও একটি ডিস্টোপিক শহরের ছবিও এঁকেছেন পরিচালক গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য— যেই বিশ্বাসযোগ্যতা পূর্বে আলোচিত ইলাস্ট্রেটেড ম্যানে একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। মূল গল্পে দেখা যায় বাবা-মা ছেলেপুলে মানুষ করার জন্য যা-যা করে থাকেন তা যদি কোনো যন্ত্র করে দেয়, তাহলে বাবা-মা-র প্রতি সেই আনুগত্য বা বন্ধন তৈরি হয় না— এটাই গল্পে মূল কনফ্লিক্ট হিসেবে দেখা দেয়। ছবিতে এই কনফ্লিক্টটাকে একটু অন্যরকমভাবে দেখিয়েছেন পরিচালক— সেখানে একাধিক পিতা-পুত্রের সম্পর্ক দেখিয়ে পার্থক্যটা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সব মিলিয়ে খুবই ভালো একটি ছবি, পাশাপাশি অ্যাডাপটেশনের জগতে একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত এই ছবি।
৭। দ্য ওয়ান্ডারফুল আইসক্রিম স্যুট (১৯৯৮)
ব্র্যাডবেরির ‘দ্য ম্যাজিক হোয়াইট স্যুট’ গল্প থেকে ছবিটি করেন স্টুয়ার্ট গর্ডন। ব্র্যাডবেরির এই সিনেমার তালিকায় এটিই বোধ হয় একমাত্র ছবি যা সম্পূর্ণ লঘু মেজাজের। গল্প বা ছবির কেন্দ্রে রয়েছে একটি ধবধবে সাদা ভ্যানিলা স্যুট, যা পরলে না কি মানুষের মধ্যে অদ্ভুত ক্ষমতা চলে আসে! কিন্তু তার দামও আকাশছোঁয়া, ১০০ ডলার। তাই গোমেজ করল কি, একই সাইজের চারজনকে জোগাড় করল। চাঁদা তুলে সেই স্যুট কেনা হল, আর ঠিক হল সবাই পালা করে একঘণ্টা করে পরবে। তারপর এল সেই স্বপ্নের মতো রাত, যেই রাত তারা খুব সহজে ভুলতে পারবে না। ছবির পরিচালক স্টুয়ার্ট অ্যালান গর্ডন, যিনি এইচ পি লাভক্রাফটের গল্প থেকে একাধিক ছবি করেছেন। বডি স্ন্যাচার, হানি আই শ্রাঙ্ক/ব্লু আপ দা কিডস ইত্যাদি সুপরিচিত ছবিও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। চিত্রনাট্য ব্র্যাডবেরির নিজের।
[স্পয়লার সম্বলিত মতামত] ফ্যান্টাসি ও মিউজিক্যাল কমেডির ভালো যুগলবন্দি এই ছবি। খুব উপভোগ্য এর কমিক আর ম্যাজিক্যাল সিকোয়েন্সগুলো। ব্যক্তিগত লাভের উর্দ্ধে উঠে মানুষ যখন সমষ্টির জন্য ভাবে, তখনই মানু্ষ প্রকৃত খুশির সন্ধান পান— ছবির মূল বক্তব্য অনেকটা এটা। অবিশ্বাস্য বা অতিপ্রাকৃত কিছু না দেখিয়েও দিব্যি ম্যাজিক দেখানো যায় শুধু মাত্র ভালো দৃশ্যনির্মাণে, তা এই ছবি দেখিয়ে দেয়। তবে শেষটা আরও জোরদার কিছু করতে পারলে হয়তো আরও ভালো হত।
৮। এ সাউন্ড অব থান্ডার (২০০৫)
একই নামের সুবিখ্যাত গল্প থেকে এই ছবি তৈরি হয়েছে। ছবির পরিচালক হলেন পিটার হিয়ামস, যিনি দ্য রেলিক, এন্ড অব ডেজ এর মতো সিনেমা বানিয়েছেন (খুব মনে রাখার মতো না হলেও ২০০১ এ স্পেস ওডিসির সিকোয়েল ২০১০ ও ইনি বানিয়েছিলেন)। ছবির গল্প মূলত বাটারফ্লাই এফেক্ট নিয়ে। একটি কোম্পানি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে লোককে টাইম ট্রাভেল করিয়ে আনে, শুধু তাই নয় রীতিমতো ডাইনোসর শিকার করার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাও দেয়। সবাই খুব আঁটঘাট বেঁধে কাজ করে, যাতে এই ট্র্যাভেলের কোনো অবাঞ্ছিত প্রভাব না থেকে যায় পরিবেশে। অনেক সাবধানতা সত্ত্বেও পৃথিবীতে দুর্যোগ নেমে আসে এই সময় যাত্রার কারণে, সেই ভুল শুধরে পৃথিবীকে আগের মতো ফিরিয়ে দিতেই অভিযানে লেগে পড়ে সেই কোম্পানির বিজ্ঞানী ও রক্ষীরা।
[স্পয়লার সম্বলিত মতামত] মূল গল্প থেকে ছবির পটভূমি নেওয়া হলেও ছবিকে বাণিজ্যসফল করতে এটিকে ডিজাস্টার-ফ্লিক করার সিদ্ধান্ত নেন পরিচালক। কিন্তু লো-বাজেট প্রোডাকশন, খারাপ ভিজুয়াল এফেক্টস, উপরন্তু টাইম-ওয়েভের দৃশ্যায়ন ছবির প্রতিকূলেই কাজ করেছে। ডিজাস্টারটা বেশ ভালো দেখানো হলেও কখনো কখনো কিছু কাল্পনিক জন্তু অনভিপ্রেতভাবে হাস্যকর লাগে। ছবিটি বক্স-অফিসেও বড়ো ডিজাস্টার ছিল।
৯। রে ব্র্যাডবেরি’স ক্রিস্যালিস (২০০৮)
এক পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক দুনিয়ায়, যেখানে ভূপৃষ্ঠ মানুষের জীবনযাপনের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছে, তারা আশ্রয় নিয়েছে ভূগর্ভস্থ ব্যাংকারে— সেখানে এক বিজ্ঞানী গাছ লাগানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আক্রান্ত হন রহস্যময় এক ভাইরাস-জাতীয় অনুজীবের হাতে। স্মিথ নামে সেই বিজ্ঞানী অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেও দেখা যায় অদ্ভুতভাবে তারা হৃদযন্ত্র ক্ষীণভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ক্রমশ সেই অনুজীবের অস্তিত্বের কথা জানতে পারে তারা। তাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে না মেরে ফেলা হবে এই নিয়ে শুরু হয় সিনেমার টানাপোড়েন। একই নামের গল্প থেকে সিনেমাটি নির্মিত হয় টনি বায়েজ মিলানের পরিচালনায়।
১০। ফারেনহাইট ৪৫১ (২০১৮)
১৯৬৬ সালের পর দ্বিতীয়বার ফারেনহাইট ৪৫১ ফিল্ম হিসেবে আমাদের কাছে আসে। যদিও মূলত ছবিটি এইচ-বি-ও টিভির দর্শকদের জন্যই তৈরি করেছিল, তবুও এই লিস্টে রাখতে হচ্ছে এর গুরুত্বের কথা চিন্তা করে। তাছাড়া বড়োপর্দাতেই এর অভিষেক হয়, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এটি প্রথমবার দেখানো হয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গল্পে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে এই ছবিতে। ইরানি বংশোদ্ভূত রামিন বাহরানি এই ছবি পরিচালনা করেন। মন্টাগের চরিত্রে অভিনয় করেন মাইকেল বি. জর্ডান এবং ক্যাপ্টেন বিটির চরিত্রে মাইকেল শ্যানন। আগের সিনেমাটির সঙ্গে এর তুলনা বারবার চলে আসে, তবে নির্মাতারা সম্পূর্ণ আলাদা আঙ্গিকে গল্পের চিত্রায়ণ করেছেন এই মুভির, ফলে দুটি ছবির আবেদনও আলাদা। ধারে ভারে ত্রুফোর ছবি এগিয়ে থাকলেও এটাও যথেষ্ট উপভোগ্য।
[স্পয়লার সম্বলিত মতামত] ত্রুফোর ছবিতে যে দুটো জমি ততটা চষা হয়নি, এই ছবি সেই দুই জায়গায় হাল দিয়েছে৷ এক, বই পড়ে বা সরকারি মগজ ধোলাইয়ের বিপরীত তথ্যের আগমনে মন্টাগের দ্বিধাদ্বন্দ্বের দৃশ্যায়ন, আর দুই, ক্যাপ্টেন বিটি যিনি কি না ছবিতে অ্যান্টাগনিস্ট তিনিই কি প্রকারান্তরে পুস্তকচর্চার চিন্তাটা মন্টাগের ভিতরে ঢুকিয়েছে— এই জল্পনা এই ছবির উল্লেখযোগ্য বিষয়। কাগজের বই ছাড়াও আমাদের হাতে এখন ইন্টারনেট এবং ইবুক আছে— এই দিকেও সতর্ক নজর দেওয়া হয়েছে। এখনকার দিনে যে ফেক নিউজ, প্রোপাগান্ডা ইত্যাদি দেখতে পাই সেটাকেও এখানে দেখানো হয়েছে। তাই ফায়ারম্যান রা বই ছাড়াও কম্পিউটার সিস্টেমও পোড়ায়। বই যদি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সরকার তার ইচ্ছামতো ইতিহাস লিখতে পারে, ইচ্ছেমতো বিকল্প সত্য তৈরি করতে পারে— এই ব্যাপারটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। আগের ছবির মতো এটি গভীর নয়, বহুমুখী চিন্তার জন্ম দেয় না, অনেকটাই একমুখী এবং মন্টাগের অন্তর্জগতকে বেশি ফোকাস করে থাকা। আরেকটি ব্যপার হল, ছবিটিকে যথেষ্ট বেশি ফিউচারিস্টিক লাগে না— যেন আগামী পাঁচ বছর পরেই আমরা ছবিতে দেখান সমাজে প্রবেশ করব।
সিনেমা ছাড়াও ব্র্যাডবেরির গল্প থেকে তৈরি হয়েছে প্রচুর শর্ট ফিল্ম, অ্যান্থোলজি সিরিজের এপিসোড। এগুলোতে প্রধানত ছোটোগল্প খুব ভালোভাবে চিত্রায়িত করা সম্ভব। অ্যান্থোলজি সিরিজের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল দ্য টুইলাইট জোন, টেলস অব টুমরো, অ্যালফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টস, রে ব্র্যাডবেরি থিয়েটারস ইত্যাদি। মার্শিয়ান ক্রনিকলস বলে একটি মিনিসিরিজও আছে। আশা করব পাঠক সিনেমার পাশাপাশি সেগুলোও দেখবেন। আর আশায় থাকব ব্র্যাডবেরির গল্প থেকে অনেক ভালো ভালো সিনেমা দেখার।
Tags: প্রবন্ধ, রাকেশকুমার দাস, সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা