রিভিউ: অ্যানালগ ভার্চুয়াল
লেখক: দেবরাজ মৌলিক
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
অ্যানালগ ভার্চুয়াল
প্রকাশক: হ্যাচেট ইন্ডিয়া
লেখক: লাবণ্য লক্ষ্মীনারায়ণ
ভাষা: ইংরেজি
ধারা: সাইবারপাঙ্ক
আপনাকে এমন এক ভবিষ্যতে স্বাগত জানাই যেখানে জাতপাত বা ধর্মের কোনো ভূমিকা নেই, বরং যোগ্যতাই হল জীবনধারনের একমাত্র মাপকাঠি। এখানে উৎপাদনশীলতা আর ক্ষমতা সমার্থক এবং ক্ষমতা না থাকলে আপনি শেষ। লেখক লাবণ্য লক্ষ্মীনারায়ণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গড়ে তুলেছেন সামাজিক অবদানের আদর্শের ওপর নির্মিত একটি পুঁজিবাদী সমাজ। এই সমাজের প্রত্যেককে চলতে হয় বেল কর্পোরেশনের অঙ্গুলিহেলনে, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে বেল কর্পোরেশন।
খাদ্য, পোশাক, সোশ্যাল মিডিয়া, শিল্প, বিনোদন, অবসর এবং আপনার পছন্দমাফিক জন্ম (ডেলিভারি পদ্ধতি)— সবই বিগ ব্রাদারের রাডারে ধরা পড়ে। তবে এই বিগ ব্রাদার অরওয়েলিয়ান ওশেনিয়ার নয়, অ্যাপেক্স সিটির, যা কিনা পূর্ববর্তী বেঙ্গালুরু শহর।
লেখক অ্যাপেক্স সিটির বিশ্ব গড়ে তুলেছেন একগুচ্ছ ছোটো গল্পের মাধ্যমে। সব ক’টি গল্প ঘটে চলে বেল কর্পোরেশনের মালিকানাধীন এই ডিস্টোপিয়ান বিশ্বের আনাচেকানাচে। সেই সঙ্গে গল্পগুলিতে কয়েকটি চরিত্র বার বার ফিরে আসে। এভাবেই আলাদা আলাদা গল্প হওয়া সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে গল্পগুলোর থিম একীভূত হয়ে গেছে আর সেটাই এই বইয়ের সৌন্দর্য।
লাবণ্য লক্ষ্মীনারায়ণ একটি সফল সাইবারপাঙ্ক তৈরি করতে পেরেছেন, কারণ তিনি তাঁর লেখায় সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন এক একটি সঠিক মালমশলার— বেল কর্পোরেশনের মতো ম্যাগনাম সত্তা থেকে শুরু করে ড্রয়েড, রোবট, হলোগ্রাম আর অতি অবশ্যই ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি। ভারতীয় সায়েন্স ফিকশন সাহিত্য উইলিয়াম গিবসনের নিউরোম্যানসারের উত্তরসূরি প্রদান করার জন্য অ্যানালগ/ভার্চুয়ালের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
এই সংযুক্ত গল্পগুলির প্লট হিসেবে লেখক বেছে নিয়েছেন চরিত্রদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর তাদের জীবনের ঘটনাগুলি। গল্পগুলির আন্তঃসংযোগ চরিত্র আখ্যানটিকে পরীক্ষামূলক করে তুলেছে, এটি পড়ার অভিজ্ঞতায় আলাদা মাত্রা যোগ করে যা হয়তো আপনাকে উত্তেজিত করে তুলবে কিংবা আপনার মনে আসন্ন দিনগুলি সম্পর্কে শঙ্কা জাগাবে, যখন মানুষ কেবলমাত্র প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
লক্ষ্মীনারায়ণের অ্যাপেক্স সিটিতে বাস দুই ধরণের মানুষের, ভার্চুয়াল (সবকিছুর অ্যাক্সেস সহ) এবং অ্যানালগ (প্রায় কোনো অ্যাক্সেস ছাড়াই)। এখানে বিশটি গল্প রয়েছে যা অ্যানালগ ও ভার্চুয়াল উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণনা করা হয়েছে, এখানে এক নিরপেক্ষ দিক থেকে প্লটগুলো নিয়ে খেলা করার জন্য লেখকের বাড়তি প্রশংসা প্রাপ্য। অ্যানালগ/ভার্চুয়াল হল একটি অসাধারণ সামাজিক ব্যঙ্গাত্মক আখ্যান, যেখানে একটি ইউটোপিয়ান সমাজ বা সমান সমাজ তৈরির সমস্যাগুলিকে হাইলাইট করা হয়েছে, যা সবচেয়ে বিখ্যাত সামাজিক তত্ত্বগুলির মধ্যে অন্যতম, কমিউনিজম দ্বারা প্রস্তাবিত। সবকিছু নিয়ন্ত্রণে করা হলেও অ্যাপেক্স ‘স্বর্গরাজ্য’ হয়ে উঠতে পারেনি, যেমন এই লাইনটি পড়লেই বোঝা যায়—
“The Bell Curve tried to repair historic divisions with a system of meritocracy, just as communist philosophy tried to solve the class divide and Woke Wave tried to end social prejudices-” (page 201, Analog Virtual)
লেখক আপনাকে ভবিষ্যতের এই ভয়ঙ্কর সুন্দর দুনিয়া ঘুরে দেখার স্বাধীনতা দিয়েছেন, যেখানে রয়েছে twenty percenters (অভিজাত), seventy percenters (প্রায় মধ্যবিত্তদের মতো, বিশ্বমানের প্রযুক্তির ব্যবহারের সুযোগ পায় আর উৎপাদনশীলতার সাহায্যে সামাজিক মর্যাদায় ওপরে ওঠার সুযোগ পায়), আর সবশেষে অ্যানালগ বা ten percenters। অবধারিতভাবে আছে কিছু বিদ্রোহী, যারা পরিকল্পনা, কৌশল, প্রযুক্তিগত দিক আর হ্যাঁ, জীবনের দর্শনে পটু। আপনি যখনই একটি বই কিনবেন এমন নয় যে সেখানে লেখক বিশটি দৃষ্টিভঙ্গিসহ একটি ভবিষ্যৎ শহরের গল্প বলবেন। ভবিষ্যতের গ্যাজেট/প্রযুক্তি সম্পর্কে কোনো কোনো অন্তর্দৃষ্টি পাঠকের বোধগম্য নাও হতে পারে। এছাড়া নতুন বিশ্ব বা বাকি ভারত সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য থাকলে মন্দ হত না।
যেগুলো অবশ্যই পড়বেন, প্রথম গল্প— ‘The Ten-Percent Thief’ (নায়াকা একজন বিদ্রোহী যা আপনার নজর টেনে নেবে), ‘Monsters under the Bed’ (কৃত্রিম প্রণয়ী, ওফেলিয়া দ্বারা প্ররোচিত অচেতনতার সাথে সচেতন যুদ্ধ), ‘Welcome to the Machine’ (অ্যানালগকে উল্লেখযোগ্যভাবে হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে), ‘A Parable from the Heart of the Sea’ (একটি বিদ্রোহী হৃদয়ের দ্বারা একটি চিত্তাকর্ষক গল্প বলার আড়ালে সুন্দর উপমা), ‘Etudes’ (অ্যাপেক্স সিটির পটভূমি), ‘Anatomy of a New World’ (Resistance-এর জন্য একটি বাস্তবতা পরীক্ষা) এবং ‘The BE-moji Project’ (ইমোজি আমাদের ভবিষ্যত) এবং আরও অনেক কিছু।
ভারতীয় সায়েন্স ফিকশনে এই রোমাঞ্চকর আত্মপ্রকাশটি হাতছাড়া করবেন না।
Tags: Debraj Moulick, গ্রন্থ পরিচিতি, দেবরাজ মৌলিক, সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা