সম্পাদকীয়
লেখক: কল্পবিশ্ব সম্পাদকমণ্ডলী
শিল্পী:
বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অম্লমধুর। নিত্যনতুন আবিষ্কারে আমরা মোহিত হই, হাততালি দিই, বড়াই করি। কিন্তু আনন্দ থিতিয়ে গেলেই বুঝতে পারি আমাদের শৈশবের চেনা শোনা পৃথিবীটা বদলে গেছে বিলকুল। মন তখন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। “এতটা উন্নতির কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল?” —প্রশ্নটা বারবার চেতনায় ধাক্কা মেরে যায়। আর ওই প্রশ্নোত্তরের খেলা খেলতে খেলতে আমরা দিব্যি একটার পর একটা উদ্ভাবনের মাইলফলক পেরিয়ে যাই অনায়াসে। কিন্তু প্রশ্নগুলো পিছু ছাড়ে না মোটেও।
এই যেমন ধরা যাক রোবটদের কথাই। চেক লেখক ক্যারেল চ্যাপেকের ‘Rossumovi Univerzální Roboti’ (R. U. R) নামের কল্পবিজ্ঞান নাটকটি ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তি পাবার পর থেকেই চারদিকে বিস্তর হইচই পড়ে গেল। এই নাটকেই প্রথম কারখানায় তৈরি যন্ত্রমানুষদের সঙ্গে পরিচয় ঘটল আম জনতার। যন্ত্র-মানবদের একটা নামও দেওয়া হল সেখানে— ‘রোবট’। ব্যাস, ওই শব্দটাই একেবারে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। গল্পের সেই কাল্পনিক চরিত্রগুলোই শব্দের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে কখন যেন আমার আপনার কাছের মানুষ হয়ে উঠল। কিন্তু সব কিছুরই তো একটা নিয়ম থাকে। রোবট বলে কী ওদের নীতিবোধ থাকবে না? এগিয়ে এলেন মার্কিন লেখক আইজ্যাক আসিমভ। ‘Three Laws of Robotics’ নামে তিনখানি বিখ্যাত অনুশাসনে বাঁধলেন তিনি ভবিষ্যতের রোবটচর্চাকে। এ সবই প্রকাশ পেল তাঁর বিখ্যাত ‘Runaround’ নামের ছোটগল্পে। পরে ‘0th law’ নামে আরেকটি বিধির সংযোজনও হয়েছিল। সেই অনুশাসনসূত্র মেনেই তাবৎ লেখককুল, সমালোচক, গবেষকরা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ এবং ‘রোবোটিকস’ নিয়ে আলোচনা চালিয়েছেন এতদিন। অনেকে সে নিয়মের খুঁত যেমন বার করেছেন, তেমনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ও নিয়ম রোবটদের ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে ছেড়েছে একেবারেই। ওই যে বললাম, প্রশ্ন। মানুষ সেই থেকেই দ্বিধায় ভুগতে শুরু করেছে। কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ— রোবটরা বুঝবে কীভাবে? ওদের কি ‘বিবেক’ আছে? যন্ত্রমানুষদের শরীরে কি ‘আত্মা’ থাকে? ওরা কি অপরাধবোধে ভোগে? প্রশ্ন আরও প্রশ্ন। আলোচনা। চর্চা। সৃষ্টি। সেই স্রোতে ভাসতে ভাসতেই আজ রোবটরা আমাদের জীবনের অনেকটা দখল করে নিয়েছে নানা রূপে। কল-কারখানা-ওষুধ-রাস্তাঘাট, ওদের ব্যবহার সর্বত্র। কিন্তু এখনও তাদের বিবর্তন ঠিক আমাদের গল্পে পড়া রোবটদের মতন নয়। কেন নয়?
যদি কখনও তারা আমাদের কল্পনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একদিন আমাদেরই প্রতিযোগী হয়ে ওঠে? মানুষের সৃষ্টিই কি তখন তার ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠবে? ভাবনা চিন্তা আর সম্ভাবনার অজস্র উৎসমুখ খুলে দিয়ে গেল ক্যারেল চ্যাপেকের সেই বিখ্যাত নাটকটা। একশো বছর পেরিয়ে গেল দেখতে দেখতে। আজ এক শতাব্দী পেরিয়ে যাবার পরেও লেখকের কল্পনা আজও আমাদের ভাবিয়ে মারছে। আইজ্যাকের তৈরি নিয়মগুলো নিয়েও চলছে বিস্তর আলোচনা। কল্পবিশ্ব ওয়েব পত্রিকা সময় সরণীর এই বিশেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করল ক্যারেলের সেই সুখ্যাত নাটক এবং আসিমভের উদ্দেশে, বিশেষ রোবট সংখ্যা প্রকাশের মাধ্যমে।
রোবটদের ভবিষ্যৎ অথবা আমাদের ভবিতব্য কী হতে চলেছে সে ব্যাপারে জানতে তাই আধুনিক শব্দশিল্পীদের কলমের দ্বারস্থ হওয়া জরুরি। তাদের চিন্তনই ঠিক করে দেবে রোবটদের আগামী রূপরেখা। তাদের শব্দে, চিন্তায়, প্রশ্নে জাগুক আমাদের কৌতূহল। কৌতূহলের হাত ধরে আসুক জ্ঞান। জ্ঞান দূর করুক অজানার অন্ধকার। আলোয় উদ্ভাস হোক অবিজ্ঞান এবং অপবিজ্ঞানের দুরাচার।
একটি বিশেষ ঘোষণা
শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অনীশ দেব আর আমাদের মধ্যে নেই। অতিমারী কেড়ে নিল তাঁকেও। কিন্তু তাঁর বর্ণময় কর্মজীবন আমাদের জন্য রেখে গেল চিত্র-বিচিত্র সাহিত্যের খেলাঘর। সেখানে রহস্য রোমাঞ্চের ছায়া-ঘেরা রহস্য যেমন আছে, তেমনি ভয়ের অন্ধকারও আছে। কল্পবিজ্ঞান ছিল তাঁর প্রথম ভালোবাসা, অজস্র মণিমাণিক্যে সাজিয়েছিলেন তিনি তাঁর পছন্দের সেই সাহিত্যক্ষত্রকে। সে সবই রয়ে গেল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জিম্মায়, সঠিক উত্তরাধিকারদের অপেক্ষায়। কল্পবিশ্বের সঙ্গে তাঁর আত্মার যোগ ছিল। তাঁর স্নেহ আর ভালোবাসা না পেলে হয়তো বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকদের কাছে এতটা সফলভাবে পৌঁছে যাবার উৎসাহ আমরা কোনওদিনই জোগাড় করে উঠতে পারতাম না। তিনি নেই, কিন্তু উৎসাহের স্রোতে ভাঁটা পড়তে দেব না আমরা। শোকের শূন্যতা মিলিয়ে যেতে সময় লাগবে ঠিকই, তবে হতাশার চোরাবালিতে ডোবার কোনও প্রশ্নই নেই। সদাহাস্যময় সেই প্রবাদ-প্রতিম মানুষটির জন্য রইল আমাদের তরফ থেকে বিশেষ স্মরণিকা বিভাগ, আর রইল শ্রদ্ধাবনত বিনম্র প্রণাম।
Tags: ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সম্পাদকীয়