কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য পরিচয় ১
লেখক: সুমিত বর্ধন
শিল্পী: ইন্টারনেট
গোড়ার কথা
এটা বইয়ের রিভিউ নয়। কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের কিছু বইয়ের সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা কেবল। লেখাতে প্রকাশক বা বইয়ের মূল্যের উল্লেখ নেই, কারণ কিছু বইয়ের নানা এডিশন পাওয়া যায়। বইয়ের ও লেখকের নাম লেখার শেষে রোমান হরফে উল্লেখ করা আছে, যাতে উৎসাহী পাঠক নেটে সার্চ করে বইটি নিজে খুঁজে নিতে পারেন।
ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড – অ্যাল্ডাস হাক্সলে
সমাজকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে শাসকের আধিপত্য নিরঙ্কুশ হয়। কিন্তু তা করার উপায় কি? ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে জর্জ অরওয়েল তুলে ধরেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার কথা, যেখানে শাসকের সর্বগ্রাসী শাসনের বজ্রমুষ্টিতে সমাজ বদ্ধ। শাসকের শ্যেনচক্ষু সেখানে মানুষের প্রতিটি কাজের ওপর নির্নিমেষ, অতন্দ্র দৃষ্টি রাখে। মানুষ বাঁধা এখানে নিরবচ্ছিন্ন শাসনের শৃঙ্খলে।
অ্যাল্ডাস হাক্সলে’র ১৯৩১ সালে রচিত উপন্যাস ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ -এর অবস্থান ঠিক অরওয়েলের উপন্যাসের বিপরীত মেরুতে। হাক্সলে’র উপন্যাসের সমাজে মানুষ দাসত্ব করে স্বেচ্ছায়। শাস্তির ভয়ে নয়, বিরামহীন সুখের লোভে। উপন্যাসের ভূমিকা লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত লেখিকা মার্গারেট অ্যাটউড উপন্যাসের সমাজকে বলেছেন ‘a society of vapid consumers, idle-pleasure seekers, inner-space trippers and programmed conformists’। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে সমাজকে বিভক্ত করা হয়েছে আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা, এপসিলন এই পাঁচটি শ্রেণিতে। সমাজের মাথা আলফারা, বুদ্ধিতে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ। সমাজের একদম তলায় প্রায় জড়বুদ্ধি এপসিলনরা। পোষাকের রংও তাদের আলাদা। আলফাদের ধূসর, এপসিলনদের কালো, গামাদের সবুজ, ডেল্টাদের খাকি। হিপনোপিডিয়া নামে পদ্ধতি ব্যবহার করে শৈশবেই তাদের মধ্যে দৃঢ়ভাবে গেঁথে দেওয়া হয় শিক্ষা। কীসের শিক্ষা? বইয়ের ভূমিকায় অক্সফোর্ডের প্রফেসর ডেভিড ব্রাডশ যাকে বলেছেন, ‘the virtues of passive obedience, material consumption, and mindless promiscuity’— প্রশ্নহীন আনুগত্য, ভোগবাদ আর নির্বিচার যৌনতা।
বইয়ের ভূমিকায় হাক্সলে নিজে লিখছেন, ‘A really efficient totalitarian state would be one in which the all-powerful executive of political bosses and their army of managers control a population of slaves who do not have to be coerced, because they love their servitude.’— আদর্শ স্বৈরতান্ত্রিক সমাজে দাসেরা তাদের দাসত্বে এতই সুখী যে তাদের চালনা করতে বলপ্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না, সমাজের ওপর তলার কিছু রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজার আর শাসন ব্যবস্থা মিলে অনায়াসে কর্তৃত্ব কায়েম রাখে।
‘ওয়ার্ল্ড স্টেট’ নামক এই উপন্যাসের সমাজে শিশুদের জন্ম হয় মাতৃজঠরে নয়, প্রজনন কেন্দ্রে, কৃত্রিম উপায়ে। এমনই এক প্রজনন কেন্দ্রে নাম ‘সেন্ট্রাল লন্ডন হ্যাচারি এন্ড কন্ডিশনিং সেন্টার’। তার ডিরেক্টর সগর্বে বলেন ‘that is the secret of happiness and virtue – liking what you’ve got to do. All conditioning aims at that: making people like their unescapable social destiny.’— সুখ আর কল্যাণের এই হল গোপন রহস্য মানুষের যা করা প্রয়োজন তাকে সেটুকু ভালো লাগিয়ে দেওয়া। মগজ ধোলাইয়ের উদ্দেশ্য একটাই— যে সামাজিক দায়িত্ব পালন করাই মানুষের ভবিতব্য, তাকে সেটা ভালো লাগিয়ে দেওয়া।
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে ভুলিয়ে রাখতে আরও উপায় আছে। আছে অবাধ, দায়বদ্ধতাহীন যৌনতা আর আছে বিনামূল্যের ড্রাগ ‘সোমা’। যার উপকারিতার কথা বলতে গিয়ে উপন্যাসে বলা হচ্ছে ‘All the advantages of Christianity and alcohol; none of their defects.’— ধর্ম আর মদের সবটুকু গুণ, কিন্তু তাদের দোষগুলো বাদ।
কিন্তু ইডেনের সর্পরূপী শয়তানের মতন এই ইউটোপিয়াতেও প্রবেশ করে সমস্যা। এই সমাজে আছে কিছু অভয়াঅরণ্য— ‘স্যাভেজ রিজার্ভেশন’ যেখানে মানুষে তাদের আদি প্রাক-ইউটপিয়ান বর্বর অবস্থাতে বাসে করে। গল্পের দুই চরিত্র বার্নার্ড মার্ক্স আর লেনিনা ক্রাউন এই অভয়ারণ্য থেকে নিয়ে আসে জন নামে এক বর্বরকে। শুরু হয় কাহিনির জটিলতা।
টাইম মেশিন কাহিনিতে ওয়েলস দেখিয়েছিলেন যে ইউটোপিয়া মানুষকে পরিণত করেছে জড়বুদ্ধি, কর্মবিমুখ ‘এলই’ নামক এক প্রজাতিতে। আর তাঁর এই উপন্যাসে হাক্সলে দেখিয়েছেন তথাকথিত ইউটোপিয়া মানুষকে কেমন পরিণত করে ভোগসর্বস্ব প্রশ্নহীন দাসে। তাঁর নিজের ভাষায় ‘Between the utopian and the primitive horns of his dilemma would lie the possibility of sanity’— মানসিক সবলতার অবস্থান ইউটোপিয়া আর আদিম সমাজের টানাপোড়নের কোনও এক মধ্য বিন্দুতে।
Brave New World / Aldous Huxley – 1931
দ্য হ্যান্ডমেডস টেল – মার্গারেট অ্যাটউড
এই উপন্যাসটি মার্গারেট অ্যাটউড লিখতে শুরু করেন ১৯৮৪ সালে, পূর্ব আর পশ্চিমে দ্বিধাবিভক্ত বার্লিনে বসে। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের সূর্য তখনও তার শিখরে, পূর্ব ইউরোপ সে সাম্রাজ্যের সামন্ত রাজ্য। পূর্ব জার্মানি, চেকশ্লোভাকিয়া ইত্যাদি দেশে মার্গারেট অ্যাটউড নিজের চোখে টোটালিটেরিয়ান স্টেটের নাগরিকদের ওপর সর্বব্যাপী শাসনের যে বজ্রবন্ধন প্রত্যক্ষ করেন, এই উপন্যাসে প্রভাব তার অনেকটাই। উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি নিজেই জানাচ্ছেন, ‘During my visits to several countries behind the Iron Curtain – Czechoslovakia, East Germany – I experienced the wariness, the feeling of being spied on, the silences, the changes of subject, the oblique ways in which people might convey information, and these had an influence on what I was writing.’। এ বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে নানান বিতর্ক আছে এবং বইটির লিখনশৈলীও অনেকের কাছে সুখপাঠ্য নয়। কিন্তু স্পেকুলেটিভ ফিকশনের এটি একটি অন্যতম সৃষ্টি।
কাহিনির পটভূমি কোনও এক সুদূর ভবিষ্যতের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সংবিধান ও গণতন্ত্র দুটিই এই ভবিষ্যতে অপসারিত, তার জায়গা নিয়েছে এক থিওক্র্যাসি, যার নাম রিপাবলিক অব গিলিয়াড। সমাজকে পুনর্গঠন করা হয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্টের থেকে নেওয়া কিছু আদর্শ অনুযায়ী। আমেরিকার গণতন্ত্রের তলায় সপ্তদশ শতাব্দীর যে গোঁড়া পিউরিটান শেকড় সুপ্ত অবস্থায় ছিল, সুযোগ পেয়ে তাই বিস্তৃত হয়ে উঠেছে ডালপালা মেলে।
সাধারণত উচ্চনিচ শ্রেণিতে বিভক্ত সমাজে যা কিছু অপ্রতুল, মহার্ঘ তা ব্যবহারে লাগে কেবল সমাজের ওপরতলার মানুষদের। এই ভবিষ্যতে যে কোনও কারণেই হোক কমে এসেছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা, তাই মাতৃত্বে সক্ষম নারীরা এই সমাজের ওপরতলার মানুষদের ব্যবহার্য্য বস্তু— তাদের বলা হয় হ্যান্ডমেড। উপন্যাসের ভূমিকায় মার্গারেট অ্যাটউড লিখছেন, ‘Under totalitarianisms – or indeed in any sharply hierarchical society – the ruling class monopolizes valuable things, so the elite of the regime arrange to have fertile females assigned to them as Handmaids.’।
উত্তম পুরুষে লেখা এই উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র অফফ্রেড নামে এক হ্যান্ডমেড, কাহিনিটি তারই জবানবন্দিতে লিখিত। অফফ্রেড নামটিরও একটি ব্যাখা আছে— ইংরিজিতে এটি একটু ভেঙে লিখলে দাঁড়ায় of-fred, বা ফ্রেডে’র। নারীরা এই সমাজে পুরুষের সম্পত্তি বলে গণ্য, এই নামকরণেই তা স্পষ্ট। হ্যান্ডমেড ছাড়াও এই সমাজে নারীদের বিভক্ত করা হয়েছে দায়িত্ব অনুযায়ী আরও নানা পদে। গৃহকর্মে নিযুক্ত নারীরা মার্থা, হ্যান্ডমেডদের ট্রেনারদের নাম আন্ট, সমাজের নীচুতলার কর্মীদের স্ত্রীদের বলা হয় ইকোনোওয়াইফ। আলাদা করে চেনার জন্যে এদের পোষাক ভিন্ন ভিন্ন রঙের। মার্থাদের সবুজ, আন্টদের খয়েরি আর হ্যান্ডমেডদের লাল। স্বৈরতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণিবিভাগ বোঝানোর জন্যে আর মানুষকে কন্ট্রোল করার জন্যে পোষাকের রঙের বিকল্প নেই। অ্যাটউডের নিজের ভাষায়, ‘Many totalitarianisms have used clothing, both forbidden and enforced, to identify and control people – think of yellow stars and Roman purple – and many have ruled behind a religious front. It makes the creation of heretics that much easier.’।
কাহিনিতে অফফ্রেড কোনও এক উচ্চপদস্থ কমান্ডারের ব্যবহার্য সম্পত্তি। তার প্রধান দায়িত্ব কমান্ডারের সন্তান ধারণ। সন্তান ধারণ ক্ষমতাই এ সমাজে তার একমাত্র মূল্য, সুতরাং মাতৃত্ব লাভে অসমর্থ হলে তাকে হয়তো পাঠানো হবে নির্বাসনে। কমান্ডারের বাড়ি অফফ্রেডের একরকম বন্দিশালা, দিনে একবারই তার বাড়ির বাইরে সুপারমার্কেটে যাওয়ার অনুমতি আছে। এই বাড়িতেই অফফ্রেড তার দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি লিপিবদ্ধ করে, কখনও তার ফেলে আসা স্বাধীন জীবনের স্মৃতিচারণা করে। সে যেন কাল থেকে কালান্তরে ভেসে আসা এক শরণার্থী, যে পুরোনো ফেলে আসা জীবনের খুঁটিনাটিগুলো আর কোনও কাজের নয় জেনেও তাদের আঁকড়ে ধরতে থাকে— ‘I’m a refugee from the past, and like other refugees I go over the customs and habits of being I’ve left or been forced to leave behind me, and it all seems just as quaint, from here, and I am just as obsessive about it.’। অথবা সে যেন একটা শূন্য ঘর, যেখানে একসময়ে অনেক কিছুই হত, কিন্তু এখন আর কিছু হয় না, কেবল জানলার বাইরে থেকে অযত্ন লালিত আগাছার ফুলের পরাগ মাটিতে এসে পড়ে ধুলোর মতো— ‘I am like a room where things once happened and now nothing does, except the pollen of the weeds that grow up outside the window, blowing in as dust across the floor.’
এই অসুস্থ জীবনযাপনে অফফ্রেড অল্প অল্প করে তার মানসিক সুস্থতা জমিয়ে রাখে টাকা জমানোর মতো করেই— ‘Sanity is a valuable possession; I hoard it the way people once hoarded money. I save it, so I will have enough, when the time comes.’।
কিন্তু এই অন্যায়, অবিচারের মধ্যে মানুষ বেঁচে থাকে কী করে? ইগ্নোর করে, দেখেও না দেখে, উত্তর দেয় অফফ্রেড। কিন্তু ইগ্নোরেন্স, অজ্ঞতা, আর ইগ্নোর করা দুটো এক জিনিস নয়। ইগ্নোর করা অভ্যেস করতে হয়— ‘We lived, as usual, by ignoring. Ignoring isn’t the same as ignorance, you have to work at it.’।
ধীরে ধীরে অফফ্রেডের কাছে আরও অনেক কিছু পরিস্ফুট হয়, সে জানতে পারে থিওক্র্যাসীর আপাত নিয়মনিষ্ঠ জীবনের নিচে ব্যাভিচারের চোরা স্রোতের কথা, জানতে পারে অঙ্কুরোদ্গম বিদ্রোহের কথা।
না, এটা ঠিক পাঠককে বিনোদন দেওয়ার মতো সুখপাঠ্য কাহিনি নয়। এই অসুস্থ সমাজের অসুস্থতার বিবরণ হয়তো পাঠককে কাহিনির শেষে কিছুটা তিক্ততা ছাড়া কিছু উপহার দেবে না।
কিন্তু নিছক আনন্দ দেওয়ার জন্যে অফফ্রেড এই কাহিনির অবতারণা করেনি। তাই গল্পের শেষে সেই নিজেই আক্ষেপ করে বলে, এই গল্পটা আর একটু অন্যরকম, আর একটু সভ্য হলে হয়তো ভালো হত— ‘I WISH THIS story were different. I wish it were more civilized.’।
কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম দায়িত্ব হল একটা দর্পণের মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করা, ‘হোয়াট ইফ?’। মার্গারেট অ্যাটউডের হ্যান্ডসমেড টেল উপন্যাসও তেমনি এক ‘হোয়াট ইফ?’।
The Handmaids Tale / Margaret Atwood
আনর্যাপড স্কাই – রুরিক ডেভিডসন
রুরিক ডেভিডসনের কেলি-আমুর ট্রিলজির এটি প্রথম খণ্ড। যে কেলি-আমুর শহরের পটভূমিকায় গড়ে উঠেছে এই স্টিমপাঙ্ক-ফ্যান্টাসি তা যেন নেওয়া উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ কিংবা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের সাগর পারের এক ইউরোপীয় শহর। শিক্ষা আর সংস্কৃতির চর্চার ছাপ এখানে অপেরায়, কলেজে আর নানান কাফেতে। শিল্প বিপ্লব সবে তার প্রভাব বিস্তার করছে এখানে। এই শহরে তাই ট্রাম আছে, রোপওয়ে আছে, কারখানা আছে। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আছে গ্রীক-রোমান ক্লাসিকাল যুগের পৌরাণিক প্রাণীরাও— ট্রাইটন, সাইরেন, ফিউরি আর মিনোটর। আছে অ্যাটলান্টিসের মতো সমুদ্রের নিচে ঘুমিয়ে থাকা শহর কেলি-এনাস। কোনও এক স্বর্ণযুগের পর আসা প্রলয়ের পর এই শহর আবার গড়ে উঠেছে নতুন করে। এখানে তাই ছড়িয়ে আছে এক হারিয়ে যাওয়া অতীত সভ্যতার নানা টেকনোলজি। যা ব্যবহার করা গেলেও সেসব কীভাবে কাজ করে কেউ জানে না।
শহর নিয়ন্ত্রণ করে তিনটি বাণিজ্যিক গোষ্ঠি বা ‘হাউস’। হাউস টেকনিস, হাউস আর্বর আর হাউস মেরিন। টেকনিসের এক্তিয়ারে কল-কারখানা, মেরিনের সামুদ্রিক বাণিজ্য আর পণ্য, আর আর্বরের প্রাণী ও উদ্ভিদ। এই তিনটি হাউসের ক্ষমতার উৎস যাদুবিদ্যা বা থেমাটার্জি। হাউসে কর্মরত থেমাটার্জিস্টরা জনগণের ওপর হাউসের শাসন কায়েম রাখার মূল স্তম্ভ, বিদ্রোহীদের ওপর তারা নামিয়ে আনে হিংস্র অশরীরি ফিউরিদের। কাহিনির শুরুতেই দেখা যায় যে নাগরিকদের মধ্যে হাউসের শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষের আগুন জ্বলছে, আর তাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে বিদ্রোহী বা সিডিশনিস্টরা।
এই পটভূমিকায় অভিনয় করে নানান চরিত্র। ঢিলে জামা আর লম্বা স্কার্ট পরণে দার্শনিক-ঘাতক কাতা, যার অতীতের দারিদ্রের স্মৃতি আর বাঁচার তাগিদ তাকে বারবার বাধ্য করে নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করতে, বিপ্লবী ম্যাক্সিমিলিয়ান, যে স্বপ্ন দেখে কেলি-এনাসের ডুবে যাওয়া লাইব্রেরি থেকে থেমাটার্জির লুপ্ত জ্ঞান উদ্ধার করে সে টক্কর দেবে হাউসের থেমাটার্জিস্টদের সঙ্গে। ট্রাম কর্মচারী থেকে হাউস টেকনিসের অধিকর্তা হয়ে ওঠা বরিস, পারিবারিক অশান্তি আর নেশার বস্তুর ওপর নির্ভরশীলতায় যে হয়ে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে স্বার্থান্ধ আর উচ্চাকাঙ্খী। এই সব চরিত্রের ঘাত প্রতিঘাতে গড়ে ওঠে উপন্যাস।
মৃত্যু আর ক্ষয়ের পটভূমিকায় আঁকা এই উপন্যাসে কাহিনিকার এমন এক খণ্ডিত সমাজের ছবি একেঁছেন যেখানে সব কিছুই পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে— “thaumaturgy from everyday life, the heart from the head, freedom from responsibility, power from the people, the people from themselves.”— দৈনন্দিন জীবন থেকে ম্যাজিক, মস্তিষ্ক থেকে হৃদয়, স্বাধীনতা থেকে দায়িত্ব, জনগণের থেকে ক্ষমতা আর মানুষের থেকে মানুষ।
এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে হাউসের কর্মকর্তারা ক্রুর ও খল। ওপরওলাকে তৈলমর্দন করা ও নীচের কর্মচারীদের পদাঘাত করার দ্বৈত নীতিতে তারা বিশ্বাসী— “Supplicate yourself to those above you, kick those below you, that was the rule of the Houses.”। পরস্পরের প্রতি ছলকপটতায় প্রয়োগেও তাদের কোনও দ্বিধা নেই, যদিও সেসব তারা লুকিয়ে রাখে মার্জিত রুচি আর ভদ্র ব্যবহারের আড়ালে— “their deadly vendettas unspoken beneath their civilized discourse.”।
দ্বিধাবিভক্ত বিপ্লবীরাও। ম্যাক্সিমিলিয়ান মনে করে মানুষকে একত্রিত করে, থেমাটার্জির গুপ্ত জ্ঞানে বলীয়ান হয়ে তবে হাউসের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বী এয়ান অপেক্ষা করতে রাজি নয়। তার মতে সমর্থন জোগাড় করে লড়াই করা যায় না। সমর্থন জোগাড় করতেই লড়াই করতে হয়। মানুষকে ঘাড় ধরে বুঝিয়ে দিতে হয় যে সব আর আগের মতো চলবে না, লড়াইটা সম্ভব— “One doesn’t attract support before fighting, one fights to attract support. It’s a way of showing that things cannot continue as usual, of showing that resistance is possible.”।
এই কল্পিত কাহিনির রং-বেরেঙের দুনিয়াতে লেখক আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন আমাদের অতি পরিচিত কিছু দ্বন্দ্বের কথা, অবিচার আর অন্যায়ের কথা। গল্প পড়তে পড়তে সে সব কখন অজান্তেই পড়া হয়ে যায়।
Unwrapped Sky (Caeli-Amur #1) by Rjurik Davidson
সিটি অফ স্টেয়ার্স – রবার্ট জ্যাকসন বেনেট
জনরা ভাঙা এই বইটির কপালে পুরস্কার না জুটলেও ২০১৫ সালের ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড, লোকাস অ্যাওয়ার্ড এবং ব্রিটিশ ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড, তিনটি লিস্টেই ফাইনালিস্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। বেনেটের ডিভাইন সিটি ট্রিলজির এটি প্রথম খণ্ড।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের রাশিয়ান শহরের ধাঁচে গড়া শহর বুলিকভ। এককালে এ ছিল মহাদেশের কেন্দ্রবিন্দু। তবে সে অনেকদিন আগেকার কথা। তখন মহাদেশে রাজত্ব করতেন অসীম শক্তিধর দেবতারা। তাদের বলে বলিয়ান হয়ে মহাদেশ ও বুলিকভের মানুষেরা প্রভুত্ব করত সমস্ত দুনিয়ায়। সায়াপুর প্রদেশ ছিল তাদের অধীনস্থ, সায়াপুরের মানুষের অবস্থা ছিল ক্রীতদাসের সমান।
বুলিকভের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সায়াপুরের মানুষ বিদ্রোহ করল। কিন্তু দেবতাদের বিরুদ্ধে মানুষ সফল হবে কী করে। বিদ্রোহীদের নেতা ‘কাজ’ গবেষণা করে আবিষ্কার করলেন দেবতাদের মারণাস্ত্র। তাঁর নির্মিত অস্ত্রে মৃত্যু হল দেবতাদের।
বুলিকভ আর মহাদেশের অন্যান্য শহর দৈবশক্তি বলে দাঁড়িয়েছিল। দেবতাদের মৃত্যুতে টলে গেল প্রকৃতি, মুছে গেল সমস্ত দৈবীশক্তি, রাতারাতি গায়েব হয়ে গেল শহরের অনেক অংশ এবং সেই সঙ্গে সেখানকার বাসিন্দারা।
এককালের পিছিয়ে পড়া, অতাচারিত দাস প্রদেশ সায়াপুর মহাদেশের প্রভু হয়ে উঠল। দেবতাদের নাম এবং ইতিহাস উচ্চারণ করা পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল।
এই ইতিহাসের প্রায় সত্তর বছর বাদে বুলিকভে খুন হলেন সায়াপুর থেকে আসা ইতিহাস গবেষক এফ্রাম পেঙ্গুই। আর তাঁর মৃত্যুর তদন্ত করতে বুলিকভে ট্রেন থেকে নামলেন সায়াপুরের মুক্তিদাতা ‘কাজ’-এর বংশের এক ছোটখাটো গড়নের মহিলা। নাম শারা কোমায়েদ, পেশায় সিক্রেট এজেন্ট। শুরু হল ফ্যান্টাসির পটভূমিকায় রহস্য গল্পের সূচনা।
কিন্তু খুনের তদন্ত করতে এসে শারা সম্মুখীন হলেন নানান বিপদের আর অনেক নতুন প্রশ্নের। ঠিক উপায়ে ‘কাজ’ হত্যা করেছিলেন দেবতাদের? দেবতাদের দৈবীশক্তি সম্পন্ন নানা জাদু সম্ভার কোথায় গেল? ঐতিহাসিক এফ্রামের পেছনে লুকিয়ে আছে কোন গভীর ষড়যন্ত্র?
রহস্য গল্পের ফাঁকে ফাঁকে লেখক কাহিনিতে বুনেছেন নানা বিষয়, কলোনিয়ালজম, ধর্ম, নিপীড়ন, মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তি। তার সঙ্গে মিশেছে রোমাঞ্চ, ম্যাজিক আর শারার সহকারী সিগ্রুডের হিমশীতল ক্রুরতা।
দেখতে পাই সায়াপুরের মানুষের একসময়ের দুর্দশার ইতিহাস। সায়াপুরেরর মানুষ বলে, আমরা আমরা নই। আমরা হওয়া এখানে অপরাধ, আমরা হওয়া পাপ। আমরা হতে চাওয়া এখানে একপ্রকারের চুরি— We are not ourselves. We are not allowed to be ourselves. To be ourselves is a crime, to be ourselves is a sin. To be ourselves is theft.
কীভাবে এককালে ক্রীতদাসত্বের বাঁধনে বাঁধা ছিল সায়াপুর? শারার মনে পড়ে যায় ঐতিহাসিক প্যাঙ্গুই তাঁকে কী বলেছিলেন একবার – দেবতারা মূর্খ ছিল না। তারা জানত যে একটা জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করার মুখ্য উপায় হল সে দেশের ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করা। ভাষার মৃত্যু হলে সেই ভাষায় চিন্তা করা, জগৎকে অন্য দৃষ্টিতে দেখার ক্ষমতাও লোপ পায়— The Divinities were not stupid – they knew the best way to control what other nations thought was to control how they talked. And when those languages died, so did those ways of thinking, those ways of looking at the world।
শারা দেখতে পান বুলিকভের মানুষ কী করে বর্তমানকে অস্বীকার করে অতীতকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইছে— To acknowledge things have changed, thinks Shara as her car approaches, is akin to death for these people। তাঁর প্রাক্তন বুলিকভিয় প্রেমিক ভোহানেস সখেদে বলেন এভাবে ইতিহাসের বিরুদ্ধে লড়াই জেতা যায় না— ‘Like I said, they’re fighting history. And everyone loses that fight.’
কিন্তু ক্ষমতা কতদূর যেতে পারে সায়াপুর? এ বিষয়ে শারার মনে কোনও দ্বিধা নেই। তিনি জানেন বিদেশনীতিতে নীতিবোধ থাকে না, স্বার্থ থাকে কেবল ‘Nations have no morals,’ says Shara, quoting her aunt from memory. ‘Only interests.’।
ক্ষমতা আর বিশ্বাসের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েনকে নিপুণ দক্ষতায় লেখক বুনতে থাকেন এক ফ্যান্টাসি পটভূমিকায় রহস্য গল্প বলার অছিলায়। আমার উপহার পাই জনরা ভাঙা এক অদ্ভুত গল্প।
চিল্ড্রেন অফ টাইম / অ্যাড্রিয়ান চাইকভস্কি
২০১৬ সালে আর্থার সি. ক্লার্ক পুরস্কারপ্রাপ্ত এই বইটিকে স্বর্ণযুগের কল্পবিজ্ঞানের পুনর্জাগরণের নবীন পদক্ষেপ বললে অত্যুক্তি তো হবেই না, বরঞ্চ হয়তো কমই বলা হবে। কারণ এই কাহিনিটিকে অনায়াসে হার্ড সায়েন্স ফিকশনের শ্রেণিতে ফেলা গেলেও, প্রথা ভেঙে এই কল্পবিজ্ঞানের আখ্যানের বিজ্ঞানের বেশির ভাগটাই প্রাণীবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা বা রসায়ন নয়।
কল্পবিজ্ঞানের পাঠক হিসেবে আপনার যদি কখনও মনে প্রশ্ন জেগে থাকে যে ধীমান প্রাণের উৎপত্তি যদি স্তন্যপায়ী শাখামৃগ থেকে না হয়ে অন্য কোনও প্রজাতি থেকে হত তাহলে তাদের সভ্যতার স্বরূপ কেমন হত, তাহলে এ কাহিনি আপনার অবশ্য পাঠ্য। কারণ এই বইতে লেখক যে প্রজাতির আদিম বর্বর অবস্থা থেকে সভ্যতায় উত্তরণের ছবি এঁকেছেন, সেটি দ্বিপদ নয়, স্তন্যপায়ী নয়, এমন কি মেরুদণ্ডীও নয়।
কাহিনির শুরু হচ্ছে ভবিষ্যতের এমন এক সময়খণ্ডে, যেখানে মানবজাতি পৌঁছে গেছে সভ্যতার চরম শিখরে, ছায়াপথের দিকে দিগন্তরে সে ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রযুক্তি নিয়ে, নানা গ্রহকে তারা বাসযোগ্য করে তুলছে টেরাফর্মিং-এর সাহায্যে। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখন দুইটি ভাগ। একদল চায় প্রযুক্তির সাহায্যে মনুষ্যতর প্রজাতিকে আরও বুদ্ধিমান করে তুলতে, কিন্তু তাদের বিপরীতের দল মানুষের হাত থেকে কর্তৃত্ব অন্য কোনও প্রজাতির হাতে তা কিছুতেই চায় না।
প্রথম দলে আছেন বিদুষী বৈজ্ঞানিক ডক্টর অ্যাভরানা কার্ন। তাঁর নির্দেশে মানুষের বাসযোগ্য করে টেরাফর্ম করা হয়েছে সুদূর ছায়াপথের কোনও এক গ্রহকে, তাতে বসানো হয়েছে পৃথিবী থেকে আনা গাছপালা, কীটপতঙ্গ। একই সঙ্গে সৃষ্টি করা হয়েছে এক অদ্ভুত ন্যানোভাইরাসকে, যারা কাজ স্বল্প চেতনের প্রাণীর ধীশক্তিকে জাগিয়ে তোলা। যে কাজ প্রাকৃতিক বিবর্তন লক্ষ লক্ষ বছর ধরে করে, সেই কাজকে কয়েকশো গুণ তরাণ্বিত করা। এবার বাকি কাছে একটাই কাজ। কিছু বাঁদরকে আর ন্যানোভাইরাসকে এই গ্রহে নামিয়ে দেওয়া। ভাইরাস বাঁদররের ওপর কাজ করে তিরিশ-চল্লিশ পুরুষের মধ্যেই চাগিয়ে তুলবে তাদের ধীক্ষমতা। তারপর তাদের দেবতা বা প্রভু হয়ে মানুষ নেমে আসবে আকাশ থেকে। গ্রহের কক্ষপথের মহাকাশ যানে বসে ডক্টর কার্ন নিজেকে ঈশ্বরের আসনে বসানোর কল্পনা করতে থাকেন। নিচের সবুজ গ্রহটার দিকে তাকিয়ে তিনি আপনমনেই তিনি বলেন, “I, I have done this. With your hands have I built, with your eyes have I measured, but the mind is mine alone.।”
কিন্তু শেষ কাজটুকু সমাপ্ত করার আগেই অন্তর্ঘাতে উড়ে যায় মহাকাশযান। প্রাণ বাঁচিয়ে একটা ক্ষুদ্র উপগ্রহে আশ্রয় নেন অ্যাভরানা কার্ন, মহাকাশযান থেকে আলাদা করে গ্রহের দিকে পাঠিয়ে দেন ভাইরাস আর বাঁদরের ধারক অংশদুটিকে। কিন্তু প্রথমটি গ্রহের মাটিতে পৌঁছতে পারলেও দ্বিতীয়টি বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণে জ্বলে যায়।
হিমঘুমে ঘুমিয়ে পড়েন অ্যাভরানা কার্ন, গ্রহের মাটিতে কাজ শুরু করে ন্যানোভাইরাস। বাঁদরের বদলে তার ক্রিয়া শুরু হয় ছোট্ট, মাত্র আট মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের এক লাফানে মাকড়সার ওপর যার বৈজ্ঞানিক নাম পোর্শিয়া ল্যাবিয়াটা। ভাইরাসের প্রভাবে বাড়তে থাকে এই প্রজাতির ধীশক্তি।
অ্যাভরানা কার্নকে উদ্ধার করতে কেউ আসে না। যে লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল তাঁর যানে, সেই লড়াইয়ের প্রভাবে ধ্বংস হয়ে যায় পৃথিবীর সভ্যতা।
তারপর কয়েক হাজার বছর বাদে এক মানুষের এক মহাকাশযান এসে হাজির হয় এই গ্রহের কাছে। বিনষ্ট পার্থিব সভ্যতা থেকে কোনও মতে মাথা তুলে একদল মানুষ অবাসযোগ্য, দূষিত পৃথিবীর পিঠ ছেড়ে মহাকাশে বেরিয়ে পড়েছে নতুন আস্তানা সন্ধানে। কিন্তু ডক্টর কার্নের গ্রহে তখন ভাইরাসের প্রভাবে মাথা তুলেছে নতুন এক সভ্যতা— এক ঊর্ণনাভ সভ্যতা। মানব সভ্যতার ধাতু, আগুন আর বিদ্যুতের বদলে সে সভ্যতার ভিত্তি বায়োকেমিস্ট্রি আর সিম্বিওসিস। সেখানে গন্ধের অনুপরমাণুর ব্যবহারে পিপীলিকা নীড় হয়ে ওঠে বায়োলজিকাল ডিফারেন্স ইঞ্জিন।
শুরু হয় সংঘাতের পরিবেশ।
শুরু হয় বটে, কিন্তু শেষ হয় না। “The blind watchmaker has been busy” মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে লেখক রিচার্ড ডকিন্সকে একটা কুর্নিশ ঠোকেন বটে, কিন্তু গল্পের পরিণতি টেনে নিয়ে যান রেসিপ্রোক্যাল অ্যালট্রুইজমের চরম সীমায়। সংঘাত নয় সহযোগিতাতেই যে বেড়ে ওঠে সভ্যতা, প্রাণীবিদ্যার যুক্তির কাঠামোয় বসিয়ে বারংবার তার প্রমাণ দেন লেখক। গল্প শেষ হয়ে গেলেও তাঁর কথার প্রতিধ্বনি বাজতে থাকে আমাদের মনের কোথাও, “Life is not perfect, individuals will always be flawed, but empathy – the sheer inability to see those around them as anything other than people too – conquers all, in the end.।”
Tags: গ্রন্থ পরিচিতি, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সুমিত বর্ধন