ফাটল
লেখক: রণেন ঘোষ
শিল্পী: জটায়ু
চমকে উঠলাম। ঢং ঢং করে ১০টা বাজছে ঘড়িতে। সর্বনাশ! ঠিক ১২টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে ড. ধ্রুবজ্যোতি রায়চৌধুরীর সঙ্গে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো নয়, যেন লটারির টিকেট পাওয়ার মতো অবস্থা। গাদা গাদা রিপোর্টার জড়ো হয়েছে। তিল ধারণের স্থান ছিল না বিজ্ঞান ভবনের বড় হলঘরটায়। শুধু কয়েকটা কথা বলতে চায় সবাই। চাঁদে মানুষ বাসোপযোগী এক নতুন সম্ভাবনার উদ্গাতা ড. রায়চৌধুরী। কী করে যে সবাইকে ডিঙিয়ে একটি ইন্টারভিউ আদায় করতে পেরেছিলাম সেদিন, তা আমার নিজের কাছেই আশ্চর্যের ব্যাপার। একবার ইন্টারভিউটা ছাপাতে পারলে ফ্যানট্যাসটিককে আর দেখতে হবে না। অদ্রীশদার সব দুশ্চিন্তা হয়তো দূর হয়ে যাবে চিরকালের জন্য। ফ্যানট্যাসটিকের সেল বাড়বে হু-হু করে। আর আজই কিনা দেরি হয়ে গেল। দাড়ি কামানো, চান করা, খাওয়া— সব বাকি। আর পথও তো কম নয়। কোথায় জোকা আর কোথায় কলকাতার বিজ্ঞান ভবন।
আগের দিন রাতে অমিতানন্দ এসেছিল বাড়িতে। অমিতানন্দ দাশের সম্বন্ধে নতুন করে নিশ্চয় বলতে হবে না। সায়েন্স ফিকশানে একজন নাম করা লিখিয়ে। সেও যাবে আজ আমার সঙ্গে ড. রায়চৌধুরীর কাছে।
কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে তৈরি হয়ে নিলাম। ছোট অস্টিন দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে। কাল রাতেই তেল ভরে নিয়েছি। একবার ভরা থাকলে নিশ্চিন্ত। অমিতানন্দকে নিয়ে বেরুবার পথে বাধা দিল কৃষ্ণা। কৃষ্ণা মানে যে আমাকে গত পনেরো বছর ধরে দিনে-রাতে সব সময়ে আধুনিক করে তোলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েও চেষ্টা করে চলেছে।
তাড়াতাড়ি ফিরছ তো? আজ রাতে মেজদির বাড়ি নেমন্তন্ন। টিঙ্কুর জন্মদিন। মনে আছে তো?
সে আমার মনে নেই! সন্ধের আগেই?
তোমার আবার মনে আছে! সন্ধেবেলায় বইয়ের দোকানে আড্ডা মারতে আরম্ভ করলে আর কিছু মনে থাকবে তোমার?
না না, দেখো ঠিক সন্ধেবেলায় ফিরে আসব। একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে মেজদির বাড়ি। জমিয়ে আড্ডা মারতে হবে তো।
যাও যাও, আমাকে আর ভোলাতে হবে না। আমাকে কিন্তু সকাল-সকাল ফিরতে হবে মনে থাকে যেন।
কৃষ্ণা ঘরের মধ্যে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমার অস্টিনও রাস্তায় এসে উঠল ধীর গতিতে। পাশের সিটে অমিতানন্দ।
পুরোনো হলেও স্পিড ওঠে বেশ। গাড়ি এখন ৬০ মাইল বেগে ছুটে চলেছে। ঘুরতে ঘুরতে পিছিয়ে পড়ছে দু-পাশের গাছপালা ক্ষেত ঘর বাড়ি। দারুণ সুন্দর লাগছে দেখতে।
দেখছ অমিতানন্দ, পুরোনো চাল কেমন ভাতে বাড়ে। পক্ষীরাজের মতো ছুটছে কেমন।
অ্যাই… অ্যাই রণেনদা, আস্তে চলো-না। সময় তো আছে অনেক।
কী, ভয় হচ্ছে? ঠাট্টা করে বললাম।
ভয়… না, ভয় না, যেখানে সময় আছে, সেখানে এত স্পিড তোলার কী আছে বুঝি না।
তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। সামনে একটা ছাগল পড়েছে। ছাগলটাকে পাশ কাটিয়ে আবার দ্রুত গতিতে ছুটে চলল পক্ষীরাজ।
আবার এত জোরে যাচ্ছ।
আরে গতিই তো জীবন। গতির মাঝেই তো আনন্দ।
সব মানলাম, তবুও আস্তে চললে ক্ষতি কী? দ্যাখো, পেছনের গাড়ি ওভারটেক করার চেষ্টা করছে।
ওভারটেক করলেই হল। আমার পেছনেই আসতে হবে ওকে। লুকিং গ্লাসে একবার দেখে নিলাম পেছনের গাড়িটাকে। আরও চাপ দিলাম অ্যাকসিলেটারে। আরও জোরে ছুটতে আরম্ভ করল গাড়ি।
দ্যাখো দ্যাখো অমিতানন্দ, ৮০ মাইলে চলছি এখন।
এত বাহাদুরি ভালো নয় রণেনদা, একটু এদিক-ওদিক হলেই আর দেখতে হবে না। তালগোল পাকিয়ে…
সায়েন্স-ফিকশান তো লেখো, তার পরেও এত ভয়? তোমার তো গোরুর গাড়ি চড়া উচিত।
বিজ্ঞান নিয়ে লিখি বলেই তো হিসেব করে চলতে চাই। যাক, এসব কথা, ড. রায়চৌধুরী কী নিয়ে গবেষণা করেছেন বলো তো রণেনদা? বিশেষ কিছুই জানি না আমি।
ড. রায়চৌধুরী? মাধ্যাকর্ষণই ওঁর প্রধান গবেষণার বিষয়।
তা-ই নাকি? দারুণ ইনটারেস্টিং তো। যাক এবার যদি সায়েন্স-ফিকশানে ভক্তি আসে তোমার।
ইন্টারভিউ নিতে যাচ্ছি বলেই কি সায়েন্স আর সায়েন্স-ফিকশনের ভক্ত হতে হবে নাকি। রিপোর্টারগিরি করে পেট চালাতে হয়, তাই কাজের খাতিরে যেতে হয় কট্টর কট্টর বিজ্ঞানী, সাহিত্যিকদের কাছে। পালসারস, কোয়াসারস, গ্র্যাভিটেশনাল ট্র্যাপ… যত সব ছেলেমানুষি… বাস্তবের সঙ্গে মিল নেই একদম। বুঝলে অমিতানন্দ, সায়েন্স-ফিকশানেই মানায় এসব। বাস্তব জীবনে কোনও স্থান নেই এদের।
সত্যি কি এসব তোমার মনের কথা রণেনদা? আগ্রহভরে প্রশ্ন করে অমিতানন্দ।
সত্যি বলতে গেলে কী, এসব অস্তিত্ব স্বীকার করি? কিন্তু বাস্তব জীবনে কী অর্থ আছে বলো তো? মাধ্যাকর্ষণ ফাঁদেরই কি কোনও মানে আছে আমাদের জীবনে?
এ কথা ঠিক নয় রণেনদা। বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কারের সঙ্গে আমাদের জীবনেরও যোগ আছে ওতপ্রোতভাবে। যাক সে কথা, সময় তো আছে অনেক? এত তাড়াহুড়ো করছ কেন?
আরে কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি জানো তো? ড. ধ্রুবজ্যোতি রায়চৌধুরী… একেবারে অ্যাটমিক ক্লক। এক মিনিট এদিক-ওদিক হবার জো নেই। আর এখনও কলকাতার অফিস টাইমের ভিড় কাটিয়ে যেতে হবে…
সামনেই পিচের রাস্তা ভেঙে গেছে কিছুটা। মাঠের উপর দিয়ে ভাঙা রাস্তা পার হতে হবে এখন। গাড়ির স্পিড কমিয়ে নেমে পড়লাম কাঁচা রাস্তার উপর। একটুখানি পথ, তবুও আস্তে যাওয়াই ভালো।
কিন্তু গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল সশব্দে। নরম স্পঞ্জের উপর যেন দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির চাকা। অল্প দুলে উঠল গাড়ি। কেমন যেন অনুভূতি। মুহূর্তের মধ্যে অ্যাক্সিলেটার চাপলাম সজোরে। গাড়ির পাদানির সমান হয়ে বসে গেল অ্যাক্সিলেটার। ভীষণ আস্তে চলল গাড়ি। দারুণ ঘন কোনও তরল পদার্থের মধ্যে দিয়ে যেন পথ করে নিচ্ছে চাকাগুলো গাড়ির মধ্যে। আমার চারপাশেও কেমন যেন অদৃশ্য ঘন কোনও তরল পদার্থের উপস্থিতি। কেবলই যেন ডুবে যাচ্ছি ওর মধ্যে। কী অদ্ভুত অনুভূতি। কী প্রচণ্ড চাপ পড়ছে সমস্ত শরীরে। দারুণ ভারী হয়ে উঠছে সর্বাঙ্গ।
মুহূর্তের মধ্যে চাপ বা ভারী বোধ হওয়া মুছে গেল শরীর থেকে। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সম্পূর্ণ U-এর মতো বেঁকে রাস্তায় উঠে গেছে গাড়ি। কিছুই বুঝতে পারলাম না। আবার চাপ দিলাম অ্যাক্সিলেটারে। চাকার তলায় এখনও স্পঞ্জের অনুভূতি। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা মন আমার। খুব হালকা লাগছে নিজেকে। সমস্ত ব্যাপার কেমন যেন স্বপ্নের মতো অস্পষ্ট ছায়া ছায়া…
রণেনদা, রণেনদা… কেমন লাগছে তোমার? কী যে হল কিছুই বুঝতে পারছি না। অ্যাক্সিডেন্ট হল নাকি? চাপা দিয়েছ কাউকে? তখনই বলেছিলাম অত স্পিডে যেও না— একসঙ্গে বলে গেল অমিতানন্দ।
কিছুই বুঝতে পারছি না ভাই। অ্যাক্সিডেন্ট করার কেউ তো ছিল না ধারেকাছে। আঠালো চটচটে স্পঞ্জের মতো কিছু যেন পড়েছে চাকার নীচে… এক বস্তা তুলোর মতো… আর তার ফলেই আপনা থেকে কমে গেছে গাড়ির স্পিড। গাড়িও উঠে পড়েছে রাস্তার উপর। কী যে হল?
দরজা খুলে নেমে পড়লাম রাস্তার উপর। কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকছে আমার। দারুণ হালকা লাগছে সমস্ত শরীর। খুলে ফেললাম গাড়ির বনেট। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম ইঞ্জিন আর অন্যান্য যন্ত্রাংশগুলো।
আশ্চর্য! কোনও চিহ্ন নেই কোনওখানে! বাম্পার বা হেডলাইটের কাচেও আঁচড় পড়েনি একটুও। কিছুই বুঝতে পারছি না অমিতানন্দ। কেমন করে যে বেঁকে রাস্তায় উঠে এলাম…
সামনে পেছনে ফিতের মতো রাস্তা চলে গেছে। ঝকঝক করছে রাস্তা মাঠঘাট। পায়ে পায়ে দুজনে গেলাম মাটির রাস্তার উপর। এখানেই ঘটেছে এই বিচিত্র ঘটনা। কিন্তু কী আশ্চর্য! শুকনো খটখট করছে কাঁচা মেঠো রাস্তা। সামান্যমতো চিহ্ন নেই কিছুর। চড়া রোদে ঝকঝক করছে চার পাশ। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ায় জুড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গ।
কিন্তু ঘটনাটা কী হল? সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য সব কিছু দিয়ে একটা অর্থ খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু থই পেলাম না কিছুতেই। কয়েক মুহূর্তের জন্যে কী হয়েছিল আমাদের?
রণেনদা, চলো এবার। দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। তাড়া লাগল অমিতানন্দ।
গাড়ির চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম কয়েকবার। তারপর গাড়িতে বসে স্টার্ট করার চাবি ঘোরালাম।
ইঞ্জিন স্টার্ট হল না। বারে বারে চেষ্টা করলাম। যে কে সেই, একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে ইঞ্জিন। এবারে সত্যি রাগ হল প্রচণ্ড। গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছি, এমন সময় নজর পড়ল ড্যাশ বোর্ডের উপর। ফুয়েল মিটারের কাঁটা ছুয়ে আছে বাঁ দিকের শেষে। তেল নেই গাড়িতে। আশ্চর্য!
কী অদ্ভুত অমিতানন্দ! দ্যাখো দ্যাখো… চিৎকার করে বলে উঠলাম।
তেল নিতে কি ভুলে গেছলে রণেনদা? সরলভাবে প্রশ্ন করল অমিতানন্দ।
কী বলছ অমিতানন্দ? কাল গ্যারেজ করার সময়ই এই ট্যাঙ্ক ভরতি তেল নিয়েছি।
তাহলে হয়তো ট্যাঙ্কে লিক ছিল। রাস্তায় পড়ে গেছে সব তেল।
তা কী করে হবে? এক ফোঁটা তেলের চিহ্ন নেই রাস্তায়। একেবারে শুকনো খটখটে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তো উবে যাবে না তেল?
তাহলে কী করবে এখন? এক টিন ভরতি তেল আছে গাড়িতে। সেটাই ঢেলে দিচ্ছি…
তেল ঢেলে আবার একবার সব চেক করে নিলাম। চাবি ঘোরাবার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চলতে আরম্ভ করল। প্রচণ্ড স্পিডে ছুটে চললাম বিজ্ঞান ভবনের দিকে।
পোর্টিকো-তে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে অমিতানন্দকে রিসেপশন রুমে বসতে ৰলে ছুটে চললাম ড. রায়চৌধুরীর ঘরের দিকে। দোতলার এক পাশে ড. রায়চৌধুরীর ঘর। সুইং ডোর ঠেলে ঘরে ঢুকলাম। সুন্দরী এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন ঘরের এক পাশে।
ফ্যানট্যাসটিক পত্রিকা থেকে আসছি। আমার নাম রণেন ঘোষ। বারোটার সময় ড. রায়চৌধুরীর সঙ্গে একটা ইন্টারভিউ আছে আজ।
ইন্টারভিউ? সেক্রেটারির চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ। কিন্তু গত কাল রাতেই তো দিল্লি চলে গেছেন স্যার।
না, না… তা কেমন করে হবে। উনিই তো নিজে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন? এনগেজমেন্ট ডায়েরিতেও লিখে নিলেন আমার সামনে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ… মনে পড়ছে। আমাকেও বলেছিলেন বটে। তারপর এও বলেছিলেন যে, যেমন ফ্যানট্যাসটিক নাম তেমনই তার রিপোর্টার। সময় জ্ঞান নেই একেবারে। কিন্তু সে তো গত হপ্তার ব্যাপার!
কী বলছেন? গতকাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি। আজ বারোটার সময় টাইম দিয়েছেন আমাকে…
কী জানি তাহলে বলতে পারছি না। হয়তো শোনার ভুল আমার। কিন্তু স্যার তো আজ দিল্লিতে। আস্তে আস্তে বললেন সেক্রেটারি।
তাহলে কী করব এখন? হতাশ হয়ে প্রশ্ন করলাম।
হতাশ হবেন না, মি. ঘোষ। নিশ্চয় চেষ্টা করব আমি। আজ রাতেই তো ফিরে আসছেন স্যার। কাল বেলা দশটার আসুন একবার।
ভগ্ন মনোরথ হয়ে নেমে এলাম দোতলার সিঁড়ি বেয়ে। রিসেপশান রুমের সামনে পায়চারি করছে অমিতানন্দ।
মন্থর গতিতে আসতে দেখে আমার সামনে এগিয়ে এল অমিতানন্দ।
কী হল? কী হয়েছে, রণেনদা?
কী সব অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে আজ! ড. রায়চৌধুরী নেই। দিল্লি গেছেন কাল রাতে।
এতে আর চিন্তার কী আছে। জরুরি কোনও কাজে গেছেন নিশ্চয়। চলে যাওয়া যাক।
রাস্তায় নেমে এলাম। গাড়ির সামনের ফুটপাতে কাগজ বিক্রি করছে এক কাগজওয়ালা। থাক থাক করে কাগজ সাজিয়ে বসেছে সে। একটা কাগজ কিনে নিয়ে এল অমিতানন্দ।
ধীর গতিতে গাড়ি চলছে। ভীষণ খারাপ লাগছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েও লাভ হল না কিছু। আবার কবে হবে কে জানে। হঠাৎ যেন চমকে উঠল অমিতানন্দ। উলটে-পালটে দ্রুত হাতে কাগজের পাতাগুলো দেখতে শুরু করেছে সে। কী হল… নিশ্চয় কোনও সেনসেশন্যাল খবর বেরিয়েছে।
রণেনদা, রণেনদা… দ্যাখো দ্যাখো… আমি কি ঠিক দেখছি?
গাড়িটাকে এক পাশে দাঁড় করিয়ে ঝুঁকে পড়লাম কাগজের উপর। পরক্ষণেই চমকে উঠলাম। দু-হাতে রগড়ে নিলাম চোখ দুটো। নাহ্, ভুল দেখছি না তো।
এ কি সত্যি, অমিতানন্দ? আমি কি পাগল হয়ে গেছি? তুমি… তুমি কি আমার মতোই দেখছ? কত তারিখ আজকে? সকালে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় কী তারিখ ছিল মনে আছে তোমার?
আমিও বুঝতে পারছি না। স্পষ্ট মনে আছে— আজ সকালে সেই যে তোমার এস পি ডব্লিউ কোম্পানির টেবিল ক্যালেন্ডারে দেখেছি— ৫ সেপ্টেম্বর। আর ৫ সেপ্টেম্বর ছাড়া অন্য কোনও তারিখ কি হতে পারে আজকে?
কী হতে পারে আর কী পারে না, সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এই তো দ্যাখো, স্পষ্ট করে কাগজে লেখা আছে ১২ সেপ্টেম্বর। সব পাতাতেই একই লেখা।
আমি তো দেখেই চমকে উঠেছিলাম রণেনদা। সত্যি বলছি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।
অমিতানন্দ, এটা আজকের কাগজ তো?
দাঁড়াও দাঁড়াও রণেনদা, বলেই দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে গেল অমিতানন্দ। ফুটপাত দিয়ে এক সুবেশা তরুণী হেলতে-দুলতে চলেছে কলেজে। তার দিকে এগিয়ে গেল তমিতানন্দ।
এই যে শুনছেন দিদি, কত তারিখ বলতে পারেন আজকে?
অবাক হয়ে থেমে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইল তরুণী। তারপর যেতে যেতে বলল, ১২ সেপ্টেম্বর।
বুঝলে রণেনদা, কোথাও যেন একটা গোলমাল হয়ে গেছে। গাড়িতে বসতে বসতে বলল অমিতানন্দ।
না, অমিতানন্দ, না। কোথাও ভুল হয়নি। হতাশ হয়ে বলে উঠলাম আমি।
বেশ মজার ব্যাপার যা-হোক। আজ সকালে ছিল ৫ সেপ্টেম্বর, আর দুপুরবেলায় হয়ে গেল ১২ সেপ্টেম্বর।
কোথায় গেল বলো তো এই সাতটা দিন? মন্ত্রবলে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
হতে পারে রণেনদা, বোধহয় সময়ের ফাটলের মধ্যে মধ্যে চেপটে গেছলাম। অদ্ভুতভাবে হাসতে হাসতে বলল অমিতানন্দ।
সময়ের ফাটল? তার মধ্যে পড়েছিলাম আমরা? সায়েন্স ফিকশানের ভাষা সব লাগাচ্ছ তো? অদ্ভুত সব লিখতে লিখতে মাথাটাই গেছে একেবারে? যত সব গাঁজাখুরি।
না না, গাঁজাখুরি নয় রণেনদা। সময় সম্বন্ধে কতটুকু জানি আমরা।
নিশ্চয় জানি না। তবে জানার যে কী আছে তাও বুঝি না। আর সময়-তত্ত্ব নিয়ে তর্ক করতে পারব না আমি। তবে ঘড়ির কাঁটা ঘুরলে, সূর্যের উদয়-অস্ত দেখে বা জন্ম বৃদ্ধি মৃত্যু দেখে বুঝতে পারি সময় পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। গাল ভরা সব হেঁয়ালি কথায় মাথা খারাপ কোরো না অমিতানন্দ।
বেশ, কিন্তু তেল?
তেল? কীসের তেল?
কেন, এক ট্যাঙ্ক তেল শেষ হল কী করে?
সেটাও বুঝতে পারছি না। উবে যায়নি তো?
উবে যাবে? কী করে যাবে? উবে যায়নি রণেনদা। ইঞ্জিনেই পুড়েছে তেলটা।
কী? ইঞ্জিনে পুড়েছে? কিন্তু কেমন করে?
যতক্ষণ তেল ছিল ট্যাঙ্কে, ইঞ্জিন চলেছে পুরোদমে। মনে হয় বেশ কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে মুহূর্তের মধ্যে ঘটেছে সব। আর তার ফলেই ঘটেছে সব বিভ্রাট।
ওঃ অমিতানন্দ, এ কী সায়েন্স ফিকশানের গল্প জুড়লে তুমি! মুখে বললেও মনে মনে কি বিশ্বাস করো তুমি?
বিশ্বাস করি বলেই তো বললাম রণেনদা। যাক সে কথা। কিন্তু কাগজ। এটা তো আজকের খবরের কাগজ। কাগজটা তো আর সায়েন্স ফিকশান নয় অথবা গাঁজাখুরি থিয়োরিও নয়। একে স্বীকার তো করতেই হবে। তার পরে হারিয়ে যাওয়া সাত সাতটা দিন… হেসো না, হেসো না রণেনদা, আমরা তো শুধু দিন জিজ্ঞাসা করেছি… বছর জিজ্ঞাসা করলে না জানি…
কী… কী বললে? থামো! থামো অমিতানন্দ! দ্যাখো, দ্যাখো কাগজেই লেখা আছে বছরটা। নিজের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে নিজেই চমকে উঠলাম।
না না… বেঁচে গেছি আমরা। ঠিক আছে বছর। আমি তো ভেবেছিলাম কোন অতীতের ফসল হয়ে গেছি আমরা।
বছরে তো বেঁচে গেছি— কিন্তু সাত-সাতটা দিন। আমি চললাম ভাই— জানি না কী ভাবছে কৃষ্ণা… কী ঘটেছে বাড়ির কী জানি।
কী আর ভাববে বউদি, রিপোর্টারি জীবনে না-বলে ডুব দেওয়া তো আর প্রথম নয়। কিন্তু সত্যি কী ভাবছ বলো তো এ বিষয়ে?
তা যা বলেছ। তবে কি সব ব্যাপারটাই কেমন গোলমেলে। তুমি কিছু বলতে পার এ বিষয়ে?
চেষ্টা করছি সবটাই যুক্তি দিয়ে সাজাতে।
বেশ, চেষ্টা করো।
অমিতানন্দকে নামিয়ে সোজা বাড়ির পথে গাড়ি ছোটালাম দ্রুতবেগে। জানি না কী বলবে কৃষ্ণা! কীভাবে নেবে সমস্ত ঘটনা।
বাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মুখোমুখি হলাম কৃষ্ণার সঙ্গে। রুক্ষ কঠিন মুখ? আসার সময় হল তোমার? নিস্পৃহ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল কৃষ্ণা।
কী যে আনন্দ হচ্ছে বাড়ি ফিরে! রানা-বাদশা কোথায়? ভালো আছে তো সব?
বাড়ির জন্যে তাহলে চিন্তা আছে তোমার? যাক শুনেও সুখী হলাম।
কেন, বাড়ি ছাড়া আর কী চিন্তা করব আমি? বাদশা রানা কেমন আছে বললে না তো?
শুনেই বা কী হবে তোমার? তিনদিন ধরে রাণার জ্বর আর তুমি…
জ্বর? শিবুদাকে ডেকেছিলে? কী বলছে শিবুদা?
বাবা! পিতৃস্নেহ দেখি উথলে উঠল! এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথা তোমার! শিবুদা এসেছিল, ওষুধও দিয়েছে।
সত্যি, খুব কষ্ট হয়েছে এ ক-দিন তোমার। কী করে যে রাগ কমাব বুঝে উঠতে পারলাম না।
থাক, থাক, আর না-ই বা আদিখ্যেতা করলে। কেমন কাটল এ ক-দিন নমিতার সঙ্গে? বিদ্রুপ উথলে উঠল কৃষ্ণার কণ্ঠস্বরে।
কী কী বললে? আর্তনাদ করে উঠলাম আমি।
কেন, চেন না নাকি নমিতাকে? বিস্ময়-এর রিপোর্টার! একসঙ্গেই তো গিয়েছিলে আমেরিকায় সায়েন্স ফিকশান কনফারেন্সে!
হায় ভগবান! এক নিদারুণ দুর্বিপাকে পড়েছিলাম আমরা… মানে আমি আর অমিতানন্দ। এখনও বুঝতে পারছি না সমস্ত ঘটনা। আমরা… আমরা সময়ের ফাটলে পড়ে গেছিলাম… কেমন করে জানি না বেরিয়ে এসেছি… আর তার ফলেই সাত-সাতটা দিন হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে।
সময়, তার আবার ফাটল। নেশার ঘোর কি কাটেনি এখনও? আমাকে কি বোকা পেয়েছ যে, যা বোঝাবে তা-ই বুঝব! ঝঙ্কার দিয়ে উঠল কৃষ্ণা।
না, না, বিশ্বাস করো… বিশ্বাস করো তুমি, এটাই ঘটে গেছে আমাদের দুজনের জীবনে।
বিশ্বাস করতে বলছ আমাকে! এর পরেও বিশ্বাস! তুমি হলে কি বিশ্বাস করতে আমাকে? এর চেয়ে অন্য গল্প করেও তো বোঝাতে পারতে আমাকে।
বেশ, অমিতানন্দকেই ডাকো তাহলে।
বন্ধুকে না বাঁচিয়ে কি সত্যি কথা বলবে অমিতানন্দ! সব তোমরা এক! আচ্ছা, মিথ্যে কথা কি জুগিয়ে থাকে তোমাদের মুখে! লজ্জাও কি হয় না পুরুষ মানুষদের!
কেমন যেন ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়লাম। কোনও কথাই বিশ্বাস করতে চায় না। কী করে বোঝাই এখন…
বেশ, কী বললে বিশ্বাস করবে বলো তুমি?
বিশ্বাস আর কী করব! অনেক তো গাঁজাখুরি গল্প শুনলাম। কিন্তু জানতাম না যে রিপোর্টারি ছেড়ে তুমিও সায়েন্স ফিকশান লিখতে আরম্ভ করেছ। বিশ্বাস করো ঘেন্না করছে আমার বাঁচতে।
বেশ! ড. রায়চৌধুরীর কাছেই চলো তাহলে। ওকে সব খুলে বললে তিনিই বলবেন এটা সত্যি কি না। যাবে তো?
কোথাও যাব না। মিত্থুক… মিথ্যাবাদী… ঝড়ের বেগে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল কৃষ্ণা। আর কোনও সুযোগ দিল না কথা বলার। নিরুপায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি! এ কী অদ্ভুত পরিস্থিতি। বুঝিয়ে বললেও বিশ্বাস করবে না কেউ। আমি যে নিজে ভুক্তভোগী, আমিই কি বিশ্বাস করতে পারছি এখনও। সময়… তার আবার ফাটল…
* * *
খুব মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনলেন ড. রায়চৌধুরী।
ভাবলেশহীন গম্ভীর মুখ। মাঝে মাঝে কুঁচকে উঠছিল ভুরুযুগল।
আশ্চর্য! অপূর্ব! আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছ তুমি? কী আর চমকপ্রদ ঘটনা শুনবে আমার কাছে? তোমার ঘটনা যে সবাইকে টেক্কা দেবে হে। আমার জীবনে শুনিনি এমন আশ্চর্য ঘটনা! ড. রায়চৌধুরীর চোখে-মুখে ফুটে উঠল এক গভীর ঔৎসুক্য।
ড. রায়চৌধুরী, আপনিই বলুন এসব কী ঘটনা? এগুলো কি সত্যি? সত্যিই কি এর কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আছে? গভীর আগ্রহ নিয়ে বলে উঠলাম আমি।
সমস্ত ব্যাপারটা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে আমাকে। মনে হচ্ছে অনুমান আমাদের মিথ্যা নয়। আরও… আরও ভাবতে হবে এ বিষয়ে…
বিশ্বাস করুন ড. রায়চৌধুরী, কেউ বিশ্বাস করছে না আমার কথা! সবাই পাগল ভাবছে আমাকে। সবাই বলছে…
সব বুঝতে পারছি ঘোষ। ব্যাপারটা কি জানো, বড় বড় সব আবিষ্কারের সূত্রপাত কিন্তু হয়েছিল এমন সব ছোট্ট ঘটনার মাধ্যমে। জনসাধারণ তখন পাগলই ভেবেছিল ওদের। এতে আর কী দুঃখ তোমার।
তার মানে কী বলতে চাইছেন ডক্টর? মানে মানে… এটাই কি… দারুণ উত্তেজনায় কথা বন্ধ হয়ে এল আমার।
রিপোর্টারগিরি তো করছ বহু দিন ধরে। আর ফ্যানট্যাসটিকও তো বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা। তা গ্র্যাভিটেশনাল কোল্পাস বা হঠাৎ, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি লোপ অথবা ব্ল্যাক হোল সম্বন্ধে জানো কিছু?
ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়লাম প্রথমে। এত বড় বিজ্ঞানীর সামনে কী বলব আমি। কিন্তু কিছু না বললে আমার প্রেস্টিজের চেয়েও ফ্যানট্যাসটিকের ইজ্জত যে থাকবে না আর। কী করি…
ডক্টর, আমার জ্ঞান খুবই অল্প। ভুল বললে শুধরে দেবেন আমাকে। মহাকর্ষীয় গর্ত বা গ্র্যাভিটেশনাল পিটের কথা কি বলছেন আপনি? যার মধ্যে একবার পড়ে গেলে সীমাহীন অনন্তের মধ্যেই থাকতে হয় চিরকাল?
ঠিক… ঠিক বলছ ঘোষ। মহাকর্ষীয় বন্ধনের চারপাশে মহাকাশ আর সময়ের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটতে পারে, যা একান্তই অত্যাশ্চর্য অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। এই-ই শুধু নয়, মহাকাশ আর সময়ের মধ্যেও ফাঁক দেখা দেয় মাঝে মাঝে। ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে হতে এই ফাঁক বা ফাটল এক বিন্দুতে পরিণত হয়ে অবশেষে। বিন্দুর মধ্যেই বিলীন হয়ে থাকে সময় বা মহাকালের উৎপত্তি থেকে চিন্তাতীত ভবিষ্যতের সমস্ত ঘটনা, ইতিহাস, ইতিবৃত্ত। অর্থাৎ কিনা এক মুহূর্তের মধ্যে এক হয়ে থাকে অতীত আর ভবিষ্যৎ। তাহলেই বুঝতে পারছ কী দারুণ ভাগ্যবান তুমি!
ঠিক এই কথাই বলেছিল আমার বন্ধু অমিতানন্দ। আমরা দুজনেই পড়েছিলাম সময়ের ফাঁকের মধ্যে। কিন্তু এ সব ব্যাপার নাকি সুদূর মহাকাশের মধ্যেই ঘটে থাকে?
না না, আমি বলছি না যে, কোনও ব্ল্যাক হোলের মধ্যে পড়ে গেছলে তোমরা। এই জগতের মধ্যেও যে স্থানকালের অসম্ভব সব অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে যায়, তোমরাই হলে তার একমাত্র সাক্ষী।
কিন্তু প্রকৃত ঘটনা কী ড. রায়চৌধুরী?
মনে হয় ওটা এক মাইক্রো কোল্পাস। এ বিষয়ে অনেকদিন ধরে অনুমান করছি আমরা।
তার মানে কোনও এক মাইক্রোক্র্যাকের মধ্যে পড়ে গেছল আমার গাড়ি?
সঠিক করে বলা যাবে না কিছু। এটা এক অনুমানমাত্র। হাইপোথিসিস আরকী। আরও অনেক… অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে এ-বিষয়ে। সময় আর মহাকাশ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান একান্তই সীমাবদ্ধ।
ডক্টর, আর একটা অদ্ভুত বিচিত্র অনুভূতির কথা বলা হয়নি আপনাকে। ঠিক সেই সময় কোনও কিছুর স্পর্শ যেন পেয়েছিলাম আমি… কেমন যেন কোনও কিছু নরম নরম স্পঞ্জের মতন… তরল রবারের মতন… মানে, ঠিক বলে বোঝাতে পারছি না আমি…
বলো ঘোষ, খুব ভালো করে মনে করে দ্যাখো, কীসের স্পর্শ পেয়েছিলে? ঠিক সেই সময়ে কী মনে হয়েছিল, কেমন অনুভূতি হয়েছিল তোমার। এটাই দারুণ প্রয়োজন আমার… উত্তেজিতভাবে কথাগুলো বলে উঠলেন ড. রায়চৌধুরী।
মনে হয় আপনারও নিশ্চয় অদ্ভুত মনে হবে… আমতা আমতা করে বলে উঠলাম।
যাই হোক-না কেন, বলো তুমি।
এসব কথা কিন্তু আমার বন্ধু… অমিতানন্দের… আমার মনে হয় কেমন যেন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম তখন… সেই অভিজ্ঞতার কথা মনে হয় যেন একান্তই কাল্পনিক… কিন্তু সেই অনুভূতি, সে তো জলজ্যান্ত বাস্তব…
জলজ্যান্ত বাস্তব, হ্যাঁ হ্যাঁ, একান্ত সত্য… তোমার আপাত অসম্ভব অনুভূতি…
কিন্তু বিশ্বাস করুন কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে এখন…
এমনই হয় ঘোষ। আমাদের চিরন্তন বিশ্বাস ধ্যান ধারণাকে পালটানো এত সোজা নয়। চিরন্তন সংস্কার আর বাস্তব সত্যের এই সংঘাত চিরকাল চলে আসছে মানুষের মধ্যে। তবে সত্যকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
না ডক্টর, আর কোনও সন্দেহ নেই আমার। সত্যি আমরা মহাকাশের শিকার হয়ে পড়েছিলাম। ভাগ্য ভালো যে সাত লক্ষ বছর না হয়ে মাত্র সাত দিনের অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে আমার জীবন থেকে। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে এর জ্বালা যে অপরিসীম। এই যে আমার স্ত্রী-কৃষ্ণা, ওর ধারণা, ওকে বোঝাবার জন্যেই এই উদ্ভট গল্পের অবতারণা করেছি আমি। সময়ের ফাটলের কোনও অস্তিত্ব নেই ওর কাছে। কিন্তু আমি কী করে অস্বীকার করব সময়ের ফাঁককে। অনন্ত মহাকালের সীমাহীনতার স্বাদ যে ক্ষণিকের তরে পেয়েছি আমার জীবনে…
শুধু তুমি নয়, সকলেই হয়তো একইভাবে ভুল করবে। কিন্তু বলো তো মা, এই মহা বিশ্বের কতটুকু মানি আমরা? কতটুকু জানি আমরা বিশ্ব রহস্যের? অন্তহীন অন্ধকারের মধ্যে কত রয়ে গেছে অজানা অদেখা… অজানাকে জানার… অচেনাকে বরণ করার জন্যে যে মা তৈরি করতে হবে আমাদের।
একবার শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নীচু করে রইল কৃষ্ণা।
বুঝলে মা, প্রকৃতির লীলা-বৈচিত্র্য বোঝা খুব ভার। প্রকৃতির চালচলন যে মাঝে মাঝে এত জটিল হয়ে ওঠে তা আমাদের বোধগম্য হয় না অনেক সময়। সব সময় তৈরি রাখতে হবে নিজেদের। বিজ্ঞানের আলোয় ব্যাখ্যা করতে হবে এই সব রহস্যের। তবেই-না সত্যিকারের উন্নতি ঘটবে আমাদের। কী মা, আর কি কোনও রাগ আছে ঘোষের উপর। প্রকৃতির খেয়ালে কী নাকাল-না হয়েছে বলো তো ও…
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, ১৯৮১ বার্ষিকী
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, জটায়ু, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, রণেন ঘোষ
বাহ! কী চমৎকার ঝরঝরে গল্প! অবাক লাগছে তিন যুগেরও বেশি আগে এমন কল্পগল্প বাংলায় লেখা হয়েছে। সময়ের ফাটল! দারুন কনসেপ্ট। লেখার ধরনও বেশ রসালো। অনেক ধন্যবাদ কল্পবিশ্বকে এমন একটি গল্প পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে।