ডিলিট
লেখক: সন্দীপ চৌধুরী
শিল্পী: রনিন
গাড়িটাকে কার পার্কে রেখে ব্যাকভিউ মিরারে নিজেকে একবার দেখে নিল জুলেখা। কপালে ঝুলন্ত চুলের গোছাকে একটু ছড়িয়ে রুমাল দিয়ে চোখের পাতা আর গাল একবার আলতো করে মুছে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সে। রনি ওর কপালের ছড়ানো চুল নিজের হাতে সরিয়ে দিতে পছন্দ করে। বেশ কয়েকমাস আগে সে ওর অগোছালো চুল দেখে মন্তব্য করেছিল ‘কেয়ারলেস বিউটি’। কথাটা ক্লিশে হলেও মনে রয়ে গেছে জুলেখার।
কিন্তু এখন গিয়ে কোন রনির দেখা সে পাবে? যখন ফোন করেছিল ঘণ্টাদুয়েক আগে তখন ওপাশ থেকে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত রনি উত্তর দিয়েছিল; একরকম জোর করেই ওর কাছ থেকে আজ রাত্রের ডিনারের ইনভিটেশন আদায় করে নিয়েছিল জুলেখা। কিন্তু এতক্ষণে ওর নিজেকে বদলে নেওয়ার কথা। অন্তত জুলেখা সেটাই আশা করছে। আর তা না হলে তাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তার কোন তাড়া নেই আজ রাত্রে, শি ক্যান ওয়েট।
কলিং বেলের উত্তরে রনির ‘কামিং’ শুনেই বুকের ভেতর থেকে চিন্তার পাথর নেমে গেল জুলেখার। না, এই রনি ফোনে শোনা রনি নয়, হি ইজ রেডি ফর হার! একটা অহংকারও মনের ভেতর চাড়া দিয়ে উঠল; যতই ক্লান্ত, অবসন্ন থাক রনির মন, ওর টানে সে এখনও নিজের রোজকার নিয়ম ভেঙে ফেলতে রাজি। কিন্তু শুধুমাত্র এই অহঙ্কারের ওপর ভর দিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা করতে চায় না জুলেখা। আকাশে উড়তে যতই পছন্দ করুক পাখি, এবার সে একটা ডালে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে চায়। তারপর যদি আবার ইচ্ছে হয় তখন না হয় ডানা মেলবে সে।
‘ওয়াও! এই ড্রেসটা … সিমপ্লি স্টানিং!’
‘তুমি এটা দেখেছ রনি! কিছু মনে রাখতে পার না যখন, এভাবে ফেক কমপ্লিমেন্ট দিও না।‘ মৃদু ধমক দিল জুলেখা। সে মনে মনে অবশ্য ঠিকই জানে যে রনি এই গাউন পরে ওকে আগে দেখেনি। শুধু রনি কেন, কেউই দেখেনি। তবে সে এটাও জানে যে এই বিষয়ে রনি ওকে কনফ্রন্ট করতে সাহস পাবে না, চুপচাপ ধমকটা হজম করে নেবে।
‘বাট ইউ আর লুকিং ফ্রেশ এজ আ ব্লুমিং ফ্লাওায়ার!’ রনিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জরিপ করে জুলেখা মন্তব্য করল, ‘ইউ’ কথাটায় এম্ফ্যাসিস দিয়ে। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যেও নয়। এই বয়সেও রনিকে দেখে যে কোন কমবয়সি মেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। শুধু একটু ভুঁড়ি হয়েছে রনির, আর মাথার চুল অল্প পাতলা হয়েছে। কিন্তু এ দুটোই সাফল্যের প্রতীক— আফটার অল, ওয়ান ক্যান নট হ্যাভ এভ্রিথিং ইন লাইফ। আর দশ বছরের আগের রনিকে নিয়ে সে করবেই বা কি! শুধুশুধু ইন্সিকিউরিটিতে ভুগতে হবে।
ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা ল্যাপটপটার দিকে চোখ যেতেই একটা হার্ট বিট স্কিপ করল জুলেখার। টেক ইট ইজি! রিল্যাক্স! – নিজেকে বোঝাল সে। তার হাতে সমস্ত রাতটা রয়েছে। তাড়াহুড়ো করার কোনও মানে হয় না।
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসল জুলেখা। ঠিক বসল বলা যায়না, শরীরটাকে এলিয়ে আধশোয়া অবস্থায় নিজেকে মেলে দিল। তারপর চোখ বন্ধ করে কয়েকটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে নিজের নার্ভকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসার চেষ্টা করল।
রনি ড্রিংকের বোতল, সোডা আর বরফ তৈরি করেই রেখেছে টেবিলের ওপর। কয়েক মুহূর্ত পরে উঠে বসে জুলেখা ড্রিঙ্ক তৈরি করতে লেগে পড়ল। একটু পরেই কানে মৃদু বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ভেসে এল – পিয়ানো –
‘এটা শুনেছ আগে, জুলি?’
‘অফ কোর্স! এলবার্ট লুইস, ইউ ব্রেক মাই হার্ট, ২০২৩ স্প্রিং – ঠিক?’
কোন উত্তর না দিয়ে অল্প হাসল রনি। ওর হাতে পানীয়র গ্লাস তুলে দিয়ে আলতো করে নিজের গ্লাসটাও তাতে ছোঁওয়ালো জুলেখা।
এই রনির সঙ্গে ঘণ্টা দুই আড়াই আগেকার রনির মিল কিছুতেই খুঁজে পায় না জুলেখা। সেই রনি যেন এক সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ যার কাছে জুলেখার কোন গুরুত্ব নেই। যার জীবন সম্পূর্ণভাবে এখনও সাত মাস আগের সেই বীভৎস দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ভাগ্যিস টেকনোলজি ওকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও রিলিফ এনে দিয়েছে। আজ সবকিছু ঠিকঠাক চললে ……
সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবেই আবার টেবিলের ওপর রাখা ল্যাপটপটার দিকে নজর চলে গেল জুলেখার। ওটা কি অন আছে এখনও? স্ক্রিন দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই, নয় অফ করা আছে, নয় স্লিপ মোডে আছে।
কিছুক্ষণ এদিক ওদিকের কথা বলল দুজনে। সঙ্গীত, সাহিত্য, চিনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়, তার হাত ধরে গ্লোবাল ওয়ার্মিং – এক এক করে এই প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে ঘোরাফেরা করতে লাগল ওদের আলোচনা। সঙ্গে নিজের নিজের কর্মজীবনের নোট এক্সচেঞ্জ।
মানসিক ক্লান্তি অনুভব করছিল জুলেখা। যত দেরি হচ্ছে ওর নার্ভের ওপর অল্প হলেও চাপ বাড়ছে।
‘একটু খিদে খিদে পাচ্ছে রন, কি অর্ডার দিয়েছ আজকে?’
‘দ্যাটস সারপ্রাইজ! কিন্তু ডেলিভারির তো এখনও একটু দেরি আছে, একটু রোস্টেড ড্রাই ফ্রুট নিয়ে আসি?’
‘না, না, তাহলে আমি আর খেতেই পারব না। ইটস ওকে, আই ক্যান ওয়েট!’
কিন্তু জুলেখার প্রিয় ইটালিয়ান রেস্তোরাঁ থেকে লাসানে আর অলিওনে পাস্তা আনানো সত্বেও আজ ডিনার প্রায় খেতেই পারল না জুলেখা। নিজের ওপর বিরক্ত হল জুলেখা। সে তো কোন অন্যায় করতে যাচ্ছে না, তবে এতো নার্ভাস সে কেন হচ্ছে?
বিছানাতেও আজকে জুলেখা অন্যদিনের চেয়ে অনেকটাই নিষ্প্রভ ছিল। তবে রনি হয়তো উত্তেজনার বশে সেটা লক্ষ করে নি। অথবা করলেও তা জুলেখাকে বুঝতে দেয় নি সে। দুজনের বিয়ের পরেও কি এরকম হবে, চিন্তাটা মাথায় একবার উঁকি মারতেই জোর করে সেটাকে ব্লক করল জুলেখা। প্রেজেন্টটাকে উপভোগ করতে চায় সে, ফিউচার উইল টেক কেয়ার অফ ইটসেলফ। তা ছাড়া আজকের রাতটা একসেপসান, ভবিষ্যতের দিন-রাতগুলি যাতে ওদের আনন্দময় হয় তার মুল্যই সে দিচ্ছে আজ রাতে।
ঘুমোবার ঠিক আগে রনি বাথরুমে যেতেই নিজের সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে উঠে বসল জুলেখা। ও এই সময়টার অপেক্ষাতেই ছিল। এখন অন্তত পাঁচ থেকে সাত মিনিট রনি বাথরুমে থাকবে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে ও বিছানার পাশে রাখা টুলটার ওপরে রাখা গ্লাস থেকে জল খাবে, তারপর দু একটা কথা বলে ওকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। অফিসের দিনগুলোতে দ্বিতীয়বার সেক্স করার এনার্জি থাকে না রনির। অন্য দিন তাতে একটু হতাশ হলেও আজকে স্বস্তি পেল জুলেখা। একবার সে কোনরকমে উৎরে গেছে, দ্বিতীয়বার নিঃসন্দেহে রনি ওর কোল্ডনেস টের পেয়ে যেত।
ধীর পদক্ষেপে বাইরের ঘরে গিয়ে সেখানে রাখা নিজের পার্স থেকে ছোট্ট একটা বোতল বের করে ড্রপারে করে গুনে গুনে চার ফোঁটা ঘুমের ওষুধ জলের মধ্যে মিশিয়ে দিল জুলেখা। তারপর আবার আগের মতোই নিঃশব্দে পার্সে বোতলটা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল সে।
রনির পায়ের শব্দ পাওয়া গেল একটু পরেই। কিছুক্ষণ চুপচাপ, তার পরেই টেবিলের ওপর থেকে গেলাস ওঠানোর আর তার কিছু পরে সেটা ঠক করে নামিয়ে রাখার শব্দ পেল জুলেখা। এবার আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা।
একটা দুশ্চিন্তা পেয়ে বসল জুলেখাকে – কতটা জল খেয়েছে রনি? অবশ্য যদি অর্ধেক গ্লাসও খায় তাতেও কাজ হয়ে যাবে কিন্তু যদি এক বা দুই চুমুক খেয়েই রেখে দিয়ে থাকে সে গ্লাসটা? অন্ধকারের মধ্যে চোখ খুললেও গ্লাসে কতটা জল পড়ে রয়েছে সেটা বোঝার উপায় নেই।
রনি কি রোজই পুরো গ্লাস জল খায়? তাই তো মনে হচ্ছে কিন্তু সে মাত্র গত তিন চারবার লক্ষ্য করেছে ওর জল খাওয়া। আজকে হয়তো ডিনারের সময়ে অন্যদিনের চেয়ে বেশি জল খেয়েছে রনি? তাহলে তো ওর পুরো প্ল্যানই…
‘জুলি, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ?’
রনির কথায় ওর চিন্তায় ছেদ পড়তেই অল্প চমকে উঠে অল্প একটু চোখ খুলল জুলেখা।
‘সরি বেবি! তোমাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়! সকালে কথা হবে।‘ বলে হেঁটে খাটের অন্যপ্রান্তে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল রনি। তবে অন্য দিনের মতো সে ওকে জড়িয়ে শুল না তো।
কিছু কি আঁচ করেছে রনি?
কতক্ষন কেটে গেছে সে জানে না কিন্তু এবার রনির রিদ্মিক নিশ্বাস শোনা যাচ্ছে। ওর দিকে পাশ ফিরে শুয়ে কয়েক মিনিট অবজার্ভ করল জুলেখা। রনির বুকের ওঠানামা দেখে সে আশ্বস্ত হয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসল।
জলের গ্লাসটা হাতে নিয়ে চোখের কাছে নিয়ে এসে ধরল জুলেখা। তলায় অল্প একটু জল পড়ে রয়েছে কেবল। একটা রিলিফের শ্বাস ছেড়ে বাইরের ঘরে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসল জুলেখা।
ল্যাপটপটা অফ করাই ছিল। আলতো করে সুইচ টিপে ওটা অন করল জুলেখা। তারপর পাসওয়ার্ড দিয়ে ভেতরে ঢুকে ‘পারসোনাল’ লেখা ফোল্ডারে ঢুকে পড়ল। বুকের ভেতরটা অস্বাভাবিক রকমের ঢিপ ঢিপ করছে – এই শব্দে ওর ঘুম না ভেঙে যায়। কথাটা মনে হতেই একটা বহু পুরোনো গল্প মনে পড়ে গেল জুলেখার। সিলি থট!
অল্প অল্প হাত কাঁপছে তার। কিছু করার নেই, এর মধ্যেই ওকে কাজটা শেষ করতে হবে।
যেখানে রনি দিন পনের আগে ওকে দেখিয়েছিল সেখানেই ‘রিলিফ’ নামের প্রোগ্রাম খুঁজে পেয়ে গেল জুলেখা। নিশ্বাস বন্ধ করে ওটার ওপর ডাবল ক্লিক করল সে।
আবার একটা পাসওয়ার্ড দিতে হবে।
চোখ বন্ধ করে আরও একবার রনির টেপা কি-গুলো মনে করার চেষ্টা করল সে। দু বার বেশ কাছ থেকেই ওকে পাসওয়ার্ড টাইপ করতে দেখেছে জুলেখা, ভুল হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই কিন্তু তবুও বলা তো যায় না।
স্মুথলি প্রোগ্রামের ভেতর ঢুকে গেল জুলেখা। চোখের সামনে সেই আকাঙ্ক্ষিত স্ত্রিন!
বেশ কিছুক্ষণ বিভিন্ন নিউরাল পাথের দিকে চেয়ে রইল সে। আনাড়ি চোখে এই পাথগুলো জটপাকানো সুতোর মতো দেখাবে কিন্তু জুলেখা গত সাত মাস ধরে এই বিষয়ে অনলাইন ট্রেনিং নিয়ে মোটামুটি দক্ষতা অর্জন করেছে। ইন ফ্যাক্ট, ইচ্ছে করলে সে অনায়াসে নিজের ক্লাসে এই বিষয়ে টপ ওয়ান পারসেন্টাইলে চলে আসতে পারত কিন্তু ইচ্ছে করেই নিজের রেজাল্ট সাধারণ রেখেছিল জুলেখা। জাস্ট বেটার দ্যান এভারেজ – নিজের ওপর অন্তত এই বিষয়ে কোনরকম মনোযোগ আকর্ষণ করতে সে আগ্রহী ছিল না।
বোঝার সুবিধের জন্যে বিভিন্ন পাথের আলাদা আলাদা রং দেওয়া আছে। তার মধ্যে গ্রে রঙের পাথগুলি রনির মস্তিস্কের কোষে মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্যে দায়ী। তবে এর মধ্যে ওর এক্স ওয়াইফ শোভা আছে, অফিসের নানান কাজকর্ম আছে, হয়তো আরও অনেক ছোটখাটো বিষয় আছে যার সম্বন্ধে কিছুই জানে না জুলেখাও। এগুলো থাকবে। এসবকিছু বাদ দিলে রনি আর রনিই থাকবে না, একটা কিম্ভূত, অসম্পূর্ণ মানুষে পরিণত হবে।
এর মধ্যে জর্জের স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত পাথওয়ে কোনগুলো?
মনের সবচেয়ে গভীরে, মস্তিষ্কের সবচেয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যে চিন্তা বাস করে তার দাগ সবচেয়ে গভীর হওয়ার কথা। তিনখানা এমন পাথের খোঁজ পেল জুলেখা – এর মধ্যে যে কোন দুটো নিঃসন্দেহে শোভা আর জর্জ, কিন্তু তৃতীয়টা?
আচমকাই মনের মধ্যে তীব্র একটা যন্ত্রণা আক্রমন করল জুলেখার। কিন্তু এমন হবে কেন? সে কেন রনির দুশ্চিন্তার কারণ হবে? সে তো ওকে সবকিছু ভুলিয়ে একটা নতুন, সুন্দর জীবনের দিকে টেনে নিয়ে জেতে চাইছে। জুলেখা অনুভব করল নিজের অজান্তেই সে অল্প মাথা নেড়ে ‘না’ বলছে বারবার।
পয়েন্টারটাকে তিনটের মধ্যে একটা পাথের ওপর রাখল জুলেখা। একটা সময় ফুটে উঠল স্ক্রিনে। অর্থাৎ এই সময়ে এই পাথটা যাকে রিপ্রেজেন্ট করছে তার সম্বন্ধে চিন্তা করছিল রনি।
নিজের পার্স থেকে মোবাইলের হ্যান্ডসেটটা বের করল জুলেখা। ৭:৩৬ – এই সময়ে সে রনিকে ফোন করেছিল। না, এই পাথে সেই সময়ের কোন রেকর্ড নেই – অর্থাৎ এটা ওর নিজের পাথ নয়। দ্বিতীয় পাথটাকে ট্রেস করতে গিয়েই ওই সময়ের রেকর্ড পেল জুলেখা। প্রায় সাড়ে পাঁচ মিনিট ধরে। অর্থাৎ ওর ফোন পাওয়ার পর অতটা সময় ধরে জুলেখাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল রনি।
কেন? ওর পাথের রং গ্রে হবে কেন? কেন সবুজ বা গোলাপি নয়? রনির ওপর তীব্র একটা ঘৃণার ভাব আচমকাই আচ্ছন্ন করল জুলেখাকে।
চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংযত করল জুলেখা। এখন আবেগে ভেসে যাওয়ার সময় নয়, তাকে যুক্তি দিয়ে কাজ শেষ করতে হবে। এখন যে কোন দুটোর মধ্যে একটা জর্জ। কিন্তু কোনটা?
সাড়ে তিনটে!
আচমকাই চোখের সামনে ঘড়ির এই সময়টা জ্বলজ্বল করে উঠল জুলেখার। ঠিক এই সময়টাতেই একদিন ছাড়া ছাড়া জর্জকে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয় নার্সিং হোমে। আজকে ছিল না, গতকাল ছিল।
তৃতীয় পাথের ওপর পয়েন্টারটা পেছন দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল জুলেখা। না, এটায় গতকালের বেশ কয়েকটা সময় দেখা গেলেও তার মধ্যে সাড়ে তিনটে নেই। অর্থাৎ সেই প্রথম পাথটাই জর্জের স্মৃতি নির্দেশ করছে।
একটা দশ থেকে চারটে চল্লিশ – সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে মানসিক ভাবে ক্রমাগত জর্জের সঙ্গে ছিল রনি গতকাল। আবার আজকে সন্ধেতেও সাতটা বেজে বারো মিনিট থেকে সাতটা সাতান্ন পর্যন্ত – অর্থাৎ ওর আসার আধঘণ্টা আগে পর্যন্ত। মাঝখানে কোন গ্যাপ নেই। অর্থাৎ ওকে নিয়ে চিন্তা করার সময়েও রনির মস্তিস্কের ব্যাকগ্রাউন্ডে সবসময়ই জর্জ ছিল।
মাথা নীচু করে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে রইল জুলেখা। হেরে যাওয়ার বিষাদ ঘিরে ধরল ওকে।
কিন্তু মানুষের মন বিচিত্র বস্তু। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা সম্পূর্ণ অন্য চিন্তা মাথায় ধাক্কা লাগাল জুলেখার। যে সময়ের ছবি সে দেখছে সেটা রনির কর্মজীবনের, যে সময়টা ও ব্যস্ততা, দুশ্চিন্তার মধ্যে কাটায়। কিন্তু যখন সে ‘ফ্রিমাইন্ড’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে নিজের মস্তিস্কের সমস্ত নেগেটিভ চিন্তাভাবনাগুলিকে ডাউনলোড করে কয়েক ঘণ্টার জন্যে ল্যাপটপ বন্দি করে রাখে তখন ওর মনোজগতে কে রাজত্ব করে?
জুলেখা! একমাত্র জুলেখা!
কারণ প্রায় রোজই রাত সাড়ে আটটা থেকে নটার মধ্যে জুলেখাকে ফোন করে রনি। তার বড়জোর ঘণ্টাখানেক আগে অফিস থেকে বাড়ি ফেরে ও। কম্পিউটারে ডাউনলোড হতে সময় লাগে প্রায় পনের মিনিট, হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে আরও প্রায় আধঘণ্টা! অর্থাৎ বাড়ি ফিরে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়িই জুলাখাকে রোজ ফোন করে রনি। আর ওদের মাঝখানে জর্জ না থাকলে হয়তো অফিসের ব্যস্ততার মধ্যেও ওর জন্যে সময় খুঁজে পাবে রনি। আর সেই সময়ের রং নিঃসন্দেহে গ্রে হবে না।
কতক্ষন চিন্তা করছিল জুলেখা সেটা তার খেয়াল নেই কিন্তু যখন সে আবার ল্যাপটপের দিকে চোখ তুলে চাইল তখন তার অবসাদ বা দ্বিধার নমগন্ধও ছিল না। একজন ডাক্তার যেভাবে রোগীর মস্তিস্ক থেকে টিউমার বের করে ফেলে দেয় সেভাবেই জর্জের সবরকম স্মৃতি রনির মস্তিস্ক থেকে মুছে ফেলার অভিপ্রায়ে কি বোর্ডে হাত রাখল জুলেখা।
টিউমারই তো! এটা ফ্যাক্ট যে নিজের একমাত্র ছেলেকে ছাড়া কিছুদিন আগেও নিজের অস্তিত্বের কল্পনা করতে পারত না রনি। যেমন যেমন বড় হচ্ছিল জর্জ, তেমন তেমন সে হয়ে উঠছিল রনির সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু, ওকে ঘিরে হাজার স্বপ্নের মালা গাঁথত রনি আর শোভা মিলে। কিন্তু সেই জর্জ আর আজকের জর্জ কি এক? সেই ভীষণ কার এক্সিডেন্টে শুধু যে জর্জের মেরুদণ্ডই চারটে টুকরো হয়ে গেছে তা নয়, তার মস্তিষ্কও প্রায় মৃত। দেশের সবচেয়ে নামকরা নিউরোলজিস্টের মতে ওর কোমা থেকে জেগে ওঠার সম্ভাবনা দশ শতাংশেরও কম।
জুলেখা এটাও জানে যে সম্ভাবনাটা দশের চেয়ে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। শুধুমাত্র ইন্সিউরেন্স কোম্পানির টাকা শুষে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই হাসপাতালটা কোনরকমে শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রেখেছে ছেলেটার। আর তার সঙ্গে মাঝে মাঝে আশ্বাস দিচ্ছে রনিকে – ওর গলা শুনে নাকি জর্জের মস্তিস্ক সাড়া দিচ্ছে।
‘ফাকিং ফ্রড!’ অস্ফুট গলায় বলে উঠল জুলেখা।
আবার মাথা থেকে অন্য চিন্তাভাবনা সরিয়ে স্ক্রিনের দিকে মনোযোগ দিল জুলেখা। এর মধ্যে থেকে একটা পথ সম্পূর্ণ ভাবে মুছে দিতে হবে। তার জায়গা ভরাট করতে হবে অন্যান্য মানুষের স্মৃতি দিয়ে। তার মধ্যে কিছুটা শোভার হলেও আপত্তির কিছু নেই।
নিপুণ হাতে কিবোর্ড আর মাউসের সাহায্যে অল্প অল্প করে জর্জের পাথওয়ে মুছে দিতে লাগল জুলেখা। আর একটা টুকরো মাত্র অবশিষ্ট রয়েছে সেই রেখাটার। তার জায়গায় অন্য একটা রেখা জুড়ে দিতে দিতে বেশ কয়েক বছর আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল তার।
বাবা ড্রাইভ করছে, পাশে জুলেখা বসে। অন্য দিনের চেয়ে আজকে একটু যেন বেশিই গম্ভীর বাবা।
‘আবার কাউকে শাস্তি দিয়ে এসেছ বাবা?’ শান্ত গলায় প্রশ্ন করেছিল জুলেখা।
কোন উত্তর দেয় নি বাবা। তার মানে সে ঠিক বলেছে।
‘ডেথ পেনাল্টি?’
আবার কোন উত্তর আসে নি বাবার কাছ থেকে। কেও সেদিন জুলেখার মুখ বন্ধ করার আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছিল, একই সঙ্গে অন্য একটা শক্তি ওকে সাহস দিচ্ছিল তাকে সেই সীমা অতিক্রম করার যা সে এর আগে করে নি।
‘কি করে পারো বাবা একটা মানুষের সব কিছু শেষ করে দিতে স্রেফ একটা কলমের আঁচড়ে? মে বি, সেই লোকটা সারা জীবন ধরে একটা সুন্দর, স্বাভাবিক জীবন যাপন করে এসেছে, একটা মুহূর্তের জন্যে কন্ট্রোল হারিয়ে সে হয়তো একটা অপরাধ করে বসেছে। তোমার ল’য়ের কাছে সেই একটা মুহূর্তই বড় হোল?’
এবার ওর দিকে ঘুরে তাকিয়েছিল বাবা। তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছিল একটা অদ্ভুত হাসি। শুধু তার চোখ দুটো ছিল অস্বাভাবিক রকমের শান্ত।
‘যখন বড় হবি তখন একটা জিনিস শেখার চেষ্টা করিস – ইচ্ছেমাত্রই নিজের চিন্তা বন্ধ করে দিতে।‘
নেই! আর জর্জের কোন চিহ্ন নেই স্ক্রিনে। সেই সঙ্গে রনির স্মৃতিতেও। আগামীকাল থেকে রনির জীবনের নতুন সেন্টার তৈরির কাজ শুরু হবে।
হাসপাতালে অলরেডি জানিয়ে রেখেছে জুলেখা। তারা জানে রনি মানসিক চিকিৎসা করাচ্ছে, ডাক্তার ওকে ডিপ্রেসিং পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। সপ্তাহে একবার করে জুলেখাই হাসপাতালে গিয়ে জর্জের খবর নিয়ে আসবে প্রথম প্রথম, তারপর গ্র্যাজুয়ালি সেই ইন্টারভাল লম্বা হবে।
শোওয়ার আগে অনেকক্ষণ ধরে রনির ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে রইল জুলেখা। তারপর হঠাৎ চোখ ছাপিয়ে জল এল কোথা থেকে যেন।
‘আরও একটা কথা মনে রাখবি বেবি, তোর যদি ইন্টেনশন ঠিক হয় তা হলে তুই নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে পারবি একশোটা মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরেও। কিন্তু যদি সেটায় গলদ থাকে, নান ক্যান সেভ ইউ!’
মোবাইল অন করে সময় দেখল জুলেখা। আচ্ছা, এই প্রোগ্রামটা ব্যবহার করে সে তার নিজের মস্তিস্ক থেকে গত দেড় ঘণ্টা ডিলিট করে ফেলতে পারবে না?
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, রনিন, সন্দীপ চৌধুরী