সময়
লেখক: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: জটায়ু
সোমনাথের বয়েস মাত্র বাইশ। এই বয়েসে সব কিছুই বাড়তি থাকে মানুষের। শক্তি, উৎসাহ, আবেগ। সোমনাথ একটি দুর্দান্ত ফান্ডাওয়ালা মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল একতরফা। মেয়েটির নাম অপরা। আলাপ নেই। পাড়ার সবচেয়ে ঘ্যাম বাড়ি হল চৌধুরিদের। চারদিকে প্রকাণ্ড বাগান, টেনিস লন, সুইমিং পুলওয়ালা বাড়ি। সাতখানা গাড়ি রাখার মতো প্রশস্ত গ্যারেজ। সাতটা বিদেশি কুকুর। এই বাড়ির মেয়ে অপরা জানেই না যে, গলির ভেতরে একটা আধভাঙা বাড়ির একতলায় সোমনাথ নামক একজন যুবক থাকে। তার বাবা স্কুলমাস্টার এবং সে বেকার। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে একটা সায়েন্টিফিক অ্যাপ্লায়েন্সের ছোট ঘরোয়া কারখানা খুলবে বলে কিছুদিন যাবত ঘোরাঘুরি করছে, চোখে তার দেদার স্বপ্ন।
এই সময়ে বজ্রপাতের মতো এই প্রেম।
সোমনাথ একবার ঠিক করল, অপরার চোখে পড়ার জন্য ওর গাড়ির সামনে ঝাঁপ দেবে। কিংবা হিন্দি সিনেমার মতো ওদের পাঁচিলের ওপর উঠে গান গাইবে। কিংবা অপরার চোখের সামনে নিজের বুকে ছোরা বসিয়ে আত্মহত্যা করবে।
শেষ অবধি সে অপরাকে একখানা চিঠি লিখল। খুবই ভদ্র চিঠি এবং বেশ সাহিত্য রসসিক্ত। জবাব পাওয়ার আশা ছিল না, কিন্তু জবাব এল। অপ্রত্যাশিত, একটু কাঁপা কাঁপা ভীরু হাতের লেখা। গঙ্গার ধারে নির্জন একটা জায়গায় শনিবার বিকেল ছ-টায় সোমনাথকে থাকতে লিখেছে।
নব্য যুবা সোমনাথের একবারও মনেই হল না যে, এটা একটা ফাঁদ হতে পারে। সে এত উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে, তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। প্রচণ্ড টেনশন। সে কয়েক গ্লাস জল খেল। এবং সারাদিন উড়ুউড়ু মনে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াল।
যে-জায়গাটা নির্দিষ্ট করা ছিল সেটা খিদিরপুর ডকের কাছাকাছি। খুবই নির্জন এবং সন্ধের পর রীতিমতো ভয়াবহ জায়গা। এ-জায়গাটা সোমনাথের সম্পূর্ণ অচেনা। এরকম একটা জায়গা অপরা কেন বেছে নিল তা সোমনাথ বুঝতে পারল না।
সোমনাথের পুঁজি খুবই সামান্য। সে দুটো টিউশনি করে তাই দিয়ে মাসের খরচটা চালিয়ে নেয়। বিড়ি সিগারেট বা সিনেমা থিয়েটার দেখার নেশা নেই বলে তার চলে যায়।
মাঝে মাঝে বিজ্ঞানের বই কেনা তার একমাত্র নেশা, তাই সামান্য হাত-খরচের টাকা থেকেই একটা ট্যাক্সি ভাড়া করার কথা চিন্তা করল। কেননা জায়গাটায় পৌঁছনোর কোনও বাসরুট নেই।
এসপ্ল্যানেডে অনেকগুলো ট্যাক্সিকে পর পর ধরার চেষ্টা করল সোমনাথ। কিন্তু জায়গাটার নাম শুনে সব ট্যাক্সিওয়ালাই হয় আঁতকে ওঠে, না হয় তো কঠোরভাবে মাথা নেড়ে চলে যায়।
এদিকে শীতের সন্ধে দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। ছ-টা বাজতে খুব বেশি দেরি নেই।
সোমনাথ অগত্যা ময়দানের দিকে এগিয়ে গেল। যদি খিদিরপুরগামী কোনও শেয়ারের ট্যাক্সিও ধরতে পারে।
সন্ধের পর ময়দানও এক ভূতুড়ে ছন্নছাড়া জায়গা। কুয়াশা এবং ধোঁয়াশায় গোটা তেপান্তরের মাঠটাই আবছা এবং রহস্যময়। সোমনাথ হতাশায় প্রায় ভেঙে পড়ছিল। তার বোধহয় উচিত ছিল বেলাবেলি গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা।
সোমনাথ আচমকাই একটা প্রায়-বিস্মৃত, কিন্তু পরিচিত শব্দ শুনতে পেল। ঘোড়ার গাড়ির মৃদু ঝুমঝুমির আওয়াজ। সেইসঙ্গে ঘোড়ার পায়ের কপকপ শব্দ। একটা ছ্যাকরা গাড়ি বেশ দ্রুত দক্ষিণের দিকে এগিয়ে আসছে।
সোমনাথ মরিয়া হয়ে ভাবছিল, ঘোড়ার গাড়িটাই ভাড়া করবে কি না। অবশ্য ঘোড়ার গাড়িতে গেলে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছনোর কোনও আশাই নেই। তবু একটা চেষ্টা তো…
বাতাসে সপাং করে একটা চাবুকের শব্দ হল, তারপরেই কুয়াশার ভেতর থেকে ঘোড়ার গাড়িটার আবির্ভাব ঘটল।
সোমনাথ হাত তোলেনি বা ডাকেনি। কিন্তু গাড়িটা তার সামনেই দাঁড়িয়ে গেল। কোচোয়ান কোচবক্স থেকে একটু ঝুঁকে তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘খিদিরপুর যাবেন নাকি, বাবু?’
সোমনাথ ভারী অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, যাব, কিন্তু আমার ছ’টার মধ্যে পৌঁছনো দরকার।’
কোট, গলাবন্ধ আর টুপিতে লোকটা একেবারে ঝুব্বুস হয়ে বসে আছে। হাতে বিড়ি বা সিগারেট কিছু একটা জ্বলছে। সাদা দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল, ‘কোনও চিন্তা নেই, পৌঁছে দেব। আমার ঘোড়া হল পঙ্খিরাজ, উঠে পড়ুন।’
সোমনাথ আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘কত নেবে?’
লোকটা একটু ভেবে বলল, ‘এক টাকা।’
এক টাকা? এ যে অবিশ্বাস্য কম ভাড়া!
কিন্তু সোমনাথের নষ্ট করার মতো সময় নেই, সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। সে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসল।
ঘোড়ার গাড়িতে সে আগে কখনওই ওঠেনি। কলকাতার লুপ্তপ্রায় ঘোড়ার গাড়ির অবশিষ্ট দু-একটিকে সে কদাচিৎ রাস্তায় দেখেছে। জরাজীর্ণ, অস্তিত্বলোপের অপেক্ষায় দিন গুনছে।
কিন্তু গাড়ির ভেতরে বসে অন্ধকারেও সোমনাথ যা অনুভব করল তা বিস্ময়কর। প্রথম কথা ভেতরে বাইরের মতো শীত নেই। বেশ কবোষ্ণ আবহাওয়া। কোনও কটু গন্ধ নেই। বরং ভারী স্নিগ্ধ একটা সুবাস রয়েছে। গাড়ির গদি এত নরম এবং মসৃণ যে, খুব দামি মোটরগাড়িতেও বোধহয় এরকমটি নেই।
গাড়ি যে চলতে শুরু করেছে তাও বুঝতে পারছিল না সোমনাথ। কারণ কোনও ঝাঁকুনি লাগল না, দুলুনি টের পাওয়া গেল না। শুধু বাইরের দিকে চেয়ে অপসৃয়মান রাস্তা আর গাছপালা দেখে সে বুঝল, গাড়িটা চলছে।
কিন্তু কীরকম গতিবেগে চলছে? একটা ঘোড়া কত জোরে ছুটতে পারে? গাড়িটার চলা দেখে মনে হচ্ছে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট মাইল বা তারও বেশি গতিতে গাড়িটা যাচ্ছে। অথচ ঘোড়ার পায়ের শব্দ বা চাবুকের আওয়াজ সোমনাথের কানে এল না। একটু বাদে সে টের পেল, গাড়ির গতি দ্বিগুণ বেড়েছে, অথচ কোনও শব্দই নেই।
এসব কী হচ্ছে? এরকম তো হওয়ার কথা নয়!
সোমনাথ হঠাৎ চেঁচিয়ে ডাকল, ‘কোচোয়ান?’
যেন একটা স্পিকারের ভেতর দিয়ে ধাতব স্বর এল, ‘জী! কিছু বলছেন?’
‘গাড়ি এত জোরে যাচ্ছে কেন?’
‘আপনাকে যে ছ-টার মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে, সাহেব।’
‘কিন্তু ঘোড়া কি এত জোরে দৌড়য়?’
‘আমার ঘোড়া যে পঙ্খিরাজ, সাহেব।’
নির্দিষ্ট জায়গায় যখন গাড়িটা এসে দাঁড়াল তখন সোমনাথের ঘড়িতে পাঁচটা চৌত্রিশ হয়েছে। অর্থাৎ মাত্র চার মিনিটে এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুরে পৌঁছে গেছে সে।
মানসিক উত্তেজনার জন্য সোমনাথ ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। কোচোয়ানকে একটা টাকা দিয়ে সে গিয়ে ঘাটের কাছাকাছি দাঁড়াল।
কোচোয়ানটা গাড়ি থেকে নেমে ঘোড়াকে শুকনো ঘাসজাতীয় কিছু খাওয়াচ্ছিল, সোমনাথের দিকে চেয়ে বলল, ‘সাহেব কি ফিরে যাবেন?’
‘দেরি আছে। কেন বলো তো?’
‘আমি পৌঁছে দিতে পারি।’
সভয়ে সোমনাথ জিজ্ঞেস করল, ‘কত ভাড়া নেবে?’
‘এক টাকা। আমি কখনও এক টাকার বেশি ভাড়া নিই না।’
সোমনাথ একটু ইতস্তত করছে দেখে কোচোয়ান নিজেই বলল, ‘এখান থেকে ফেরার কোনও গাড়ি নেই, সাহেব।’
‘ঠিক আছে, তবে দাঁড়াও।’
গঙ্গার ধারে একটা বাঁধানো চত্বর। একটু দূরের একটা ল্যাম্পপোস্ট থেকে যে ক্ষীণ আলো আসছে তাতে যত দূর দেখা যায় জায়গাটা ফাঁকা। কোনও লোকবসতি নেই, রাস্তা দিয়ে এক-আধটা গাড়ি খুব জোরে বেরিয়ে যাচ্ছে। কোনও পদাতিক দেখা যাচ্ছে না।
সোমনাথ ঘড়ির দিকে চেয়ে বারবার ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল। অপরা এরকম একটা জায়গা কেন বেছে নিল সেটা বারবার ভেবেও বুঝতে পারছিল না!
যখন ছ-টায় এসে ঘড়ির দুটো কাঁটা একটা সরলরেখায় পরিণত হল, তখন হঠাৎ অন্ধকার থেকে একটা প্রকাণ্ড গাড়ি এগিয়ে এসে সোমনাথের কাছেই থেমে গেল। গাড়িটা কালো একটা পন্টিয়াক। ঠিক এরকম গাড়ি অপরাদের নেই।
সোমনাথের বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল। সে গাড়িটার দিকে খুব লাজুক ও ভীরু পায়ে এগিয়ে গেল।
কিন্তু গাড়িটার কাছ বরাবর পৌঁছতেই সে দেখতে পেল, গাড়ির মধ্যে অপরা নয়, তিন-চারজন পুরুষ বসে আছে।
সোমনাথ ফের পিছিয়ে আসছিল, হঠাৎ গাড়ির পিছনের দরজা খুলে একটা বিশাল চেহারার লোক নেমে এল।
সোমনাথ কিছু বুঝে উঠবার আগেই লোকটা হাত বাড়িয়ে তার সোয়েটারের বুকটা খামচে ধরে বলল, ‘কতদিন হল মেয়েটার পিছু নিয়েছ?’
‘আজ্ঞে?’ সোমনাথ ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।
লোকটা অন্য হাতে সোমনাথের গালে বিশাল একটা থাপ্পড় বসিয়ে বলল, ‘প্রেমরোগ কী করে সারাতে হয় আমরা জানি, বামন হয়ে চাঁদে হাত?’
সোমনাথ জীবনে কখনও মারধর খায়নি, মারপিটও করেনি। চড় খেয়ে সে এমন ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গেল যে মুখে কথা সরল না।
গাড়ি থেকে আরও তিনজন নেমে এল। এদের কাউকেই সোমনাথ কখনও দেখেনি।
চারজন যখন ঘিরে ধরল সোমনাথকে তখনও সে বুঝতে পারছিল না, কোথায় কোন গণ্ডগোল সে পাকিয়ে বসে আছে। অপরাকে চিঠি লিখেছিল, অপরা তার জবাব দিয়েছে, তবে কী হল?
কিন্তু এরপর যা ঘটল তা সোমনাথের সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। চারটে লোক তাকে ঠেসে ধরল। একজন একটা ক্ষুর বের করে চটপট তার মাথাটা কামিয়ে ফেলল। তারপর তার জামাকাপড় টেনে হিঁচড়ে এবং ছিঁড়ে গা থেকে খুলে ফেলল। শুধু আন্ডারওয়্যার পরা অবস্থায় সে শীতে ভয়ে বুদ্ধিভ্রষ্ট ও বাক্যহারা হয়ে কাঁপতে লাগল।
তারপর দুটো লোক দু-দিক থেকে পর্যায়ক্রমে তার মুখে ঘুসি মারতে লাগল। প্রচণ্ড ঘুসি। তার ঠোঁট ফেটে গেল, চোখ ফেটে গেল, গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল নগ্ন বুকে। সে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল।
তবু বুঝতে পারল না ভুলটা কোথায় হয়েছে।
অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে সে শুধু জিজ্ঞেস করতে পেরেছিল, ‘চিঠিটা কি অপরা লিখেছিল আমাকে? নিজে?’
‘সে তো তোর মতো গাড়ল নয়!’
পেটে একটা লাথি খেয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল সোমনাথ। একটু দূর থেকে কোচোয়ানটা নির্বিকার চোখে দৃশ্যটা দেখল।
চারটে লোক গাড়িতে উঠে সাঁ করে চলে যাওয়ার পর কোচোয়ানটা তার ঘোড়ার গলায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করে ধীর পায়ে সোমনাথের সংজ্ঞাহীন শরীরটার কাছে এসে দাঁড়াল।
তারপর জিভ দিয়ে একটা চুকচুক শব্দ করল।
‘সাহেব। ও সাহেব!’
সোমনাথ নিথর।
কোচোয়ান নীচু হয়ে সোমনাথের শরীরটা পাঁজাকোলে তুলে ফেলে শিস দিল। ঘোড়াটা চটপট গাড়িসমেত এগিয়ে এল কাছে।
সোমনাথকে গাড়িতে তুলে সিটের ওপর শুইয়ে দিল কোচোয়ান। তারপর কোচবক্সে উঠে চাবুকটা একবার আপসে নিয়ে বলল, ‘চল রে, পঙ্খিরাজ।’
ঘোড়াটা একটা লাফ দিল। তারপর গাড়িসমেত হঠাৎ মিলিয়ে গেল বাতাসে।
সোমনাথের যখন জ্ঞান ফিরল তখনও চারদিক অন্ধকার। সে ঘোড়ার গাড়ির পিছনের সিটে শুয়ে আছে। গাড়িটা চলছে কি না তা দেখার জন্য সোমনাথ উঠে বসল। বাইরের দিকে চেয়ে যা দেখল তাতে তার চোখের পলক পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে এক প্রচণ্ড তুষারঝড় চলেছে, চারদিক শুধু সাদা বরফে ঢাকা। আকাশ মেঘলা এবং কালো।
‘কোচোয়ান! কোচোয়ান!’
সেই ধাতব কণ্ঠস্বরটি বলে উঠল, ‘আপনার সামনের সিটে যে-পোশাকটা রাখা আছে। সেটা পরে নিন, সাহেব, বাইরে ভীষণ ঠান্ডা।’
হতভম্ব সোমনাথ বলল, ‘কিন্তু এ আমাকে তুমি কোথায় এনেছ? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?’
‘পোশাকটা পরে নিন, সাহেব।’
সোমনাথ কিছুক্ষণ অসহায়ভাবে বসে রইল। সে যে স্বপ্ন দেখছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বপ্নই যদি হবে তা হলে একটু আগে সে যে মার খেয়েছিল তার ব্যথা কেন এখনও সর্বাঙ্গে থাবা গেড়ে আছে? পেটে ব্যথা, চোয়াল ফুলে ঝুলে পড়েছে, রক্ত শুকিয়ে আছে তার খোলা বুকে, নাক ফুলে ঢোল, ঠোঁট কেটে গেছে। জীবনে এত মার খায়নি কখনও সে। এত ব্যথা নিয়ে নিশ্চয়ই সে ঘুমোচ্ছে না। তা হলে স্বপ্ন দেখবে কীভাবে?
তা হলে সে কি মরে গেছে? এ কি মৃত্যুর পরেরকার জগৎ?
সোমনাথ এইসব সমস্যায় ভীষণ বিব্রত বোধ করতে করতে সামনের সিট থেকে পোশাকটা তুলে নিল। পাতলা সাদা একটা জোব্বার মতো জিনিস। এ-পোশাক পরলে কি বাইরের ওই শীত সহ্য করা যায়!
গাড়ির ভেতরে অবশ্য শীতের আভাসও নেই। সোমনাথ পোশাকটা পরার চেষ্টা করতে লাগল, তার পরনে আন্ডারওয়্যার ছাড়া কিছুই নেই।
জোব্বাটা পরে নিতে অবশ্য তেমন অসুবিধে হল না। জামার সঙ্গে পায়জামার মিলনে যা হয়। কলকারখানার শ্রমিকরা যেমন ওভারল পরে অনেকটা তেমনই, তবে এই পোশাকটায় আবার জুতো, দস্তানা এবং মুখঢাকা টুপিও লাগানো আছে। কাপড়টা কী ধরনের তা বুঝতে পারল না সোমনাথ। ভেতরটা মসৃণ আর নরম, বাইরেটা খসখসে। জুতোর নীচে একটা পাতলা সোল আছে। পোশাকটার কোনও ওজন নেই। এত হালকা যে, গায়ে কিছু আছে বলেই মনে হল না।
গাড়ির ডানদিককার দরজাটা খুব আস্তে খুলে গেল এবং সেই ধাতব কণ্ঠ বলল, ‘নামুন, সাহেব।’
সোমনাথ নামল। বাস্তবিকই এক তুষারঝড় তার চারদিকে বয়ে চলেছে। সে কলকাতার ছেলে। তুষারপাত বড় একটা দেখার সুযোগ হয়নি। একবার সান্দাকফু ট্রেকিং করতে গিয়ে, আর-একবার সিমলায় একটা টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে তুষারপাত দেখেছিল। কিন্তু এ যেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এটা তো শুধু তুষারপাত নয়, তুষারের প্রচণ্ড এক ঝড়। বাতাসের ঝাপটায় সোমনাথ দাঁড়াতেই পারছিল না। তবে যতটা শীত করার কথা ততটা শীত সে টের পাচ্ছে না। ঠান্ডা লাগছে বটে, তবে তা অসহনীয় নয়।
গাড়ির মাথায় তাকিয়ে সে কোচবক্সে কোচোয়ানকে দেখতে পেল না। চারদিকে তাকিয়ে দেখল অনন্ত এক তুষার-রাজ্য। কোথাও আর কিছু নেই।
‘কোচোয়ান! কোচোয়ান!’
কানের কাছে একটা ধাতব কণ্ঠস্বর বলে উঠল, ‘ভয় নেই, সাহেব, নাক বরাবর ঠিক দশ পা হেঁটে যান।’
সোমনাথ আতঙ্কিত পায়ে ঠিক দশ পা হাঁটল, তারপর দাঁড়াল।
এবার?
পায়ের নীচে কত ফুট ঘন বরফ জমে আছে কে জানে। কিন্তু সোমনাথ সবিস্ময়ে দেখল জমাট বরফের চাঙড় ভেঙে একটা কিছু উঠে আসছে তার সামনে। প্রথমে সরু শীর্ষদেশ, তারপর ধীরে ধীরে একটা ছোট্ট কালো পিরামিড দেখা দিল।
‘এগিয়ে যান, সাহেব। দরজা খুলে যাবে।’
সোমনাথ দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে এগিয়ে যেতেই পিরামিডের একটা দেওয়াল হঠাৎ দু-ভাগ হয়ে দু-ধারে সরে গেল। সামান্য একটু ফাঁক, সোমনাথ ভয়ে ভয়ে ঢুকতেই তার পিছনে দরজাটা ফের বন্ধ হয়ে গেল।
সামনে প্রশস্ত একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। ভারী সুন্দর একটা নকশাদার কার্পেটের মতো জিনিস পাতা, আর সে-জিনিসটা নিজেই একটা নরম স্বচ্ছ আলো বিকীর্ণ করছে। দেওয়ালগুলোও তাই। সব কিছুর ভেতর থেকেই যেন আলোর আভা বেরিয়ে আসছে।
শরীরের প্রচণ্ড ব্যথা আবার টের পাচ্ছিল সোমনাথ। তাকে আর কোনও কণ্ঠস্বর নির্দেশ দিচ্ছে না। সে কি এখন নামবে সিঁড়ি বেয়ে?
সোমনাথ সিঁড়িতে পা দিতেই মসৃণ গতিতে সিঁড়িটা নামতে লাগল। এসকালেটর, তবে এসকালেটর এক জায়গায় শেষ হয় এবং খাঁজে ঢুকে যায়, কিন্তু এ-সিঁড়িটা সেরকম নয়। অনন্ত গতিতে সোমনাথকে টেনে নিয়ে চলেছে। এবং সে-গতি ঘণ্টায় অন্তত ত্রিশ মাইল। খানিক নেমে সিঁড়িটা সোজা গেল, তারপর বাঁয়ে বেঁকল, ডাইনে বেঁকল। মিনিটখানেক বাদে একজায়গায় থামল।
একটা প্রশস্ত হলঘর। সোমনাথ বুঝল এখানে তাকে নামতে হবে। সিঁড়ির সঙ্গে লাগানো ঘরটার মেঝে। সেটাও কার্পেটে মোড়া এবং আলোকিত।
সোমনাথ চারদিকে চেয়ে আলোর উৎস আবিষ্কারের চেষ্টা করল, পারল না। ঘরটারও কোনও ডিজাইন সে বুঝতে পারল না, খুব উঁচু এবং মস্ত এক হলঘর, সেটার কোনও দিক সোজা, কোনও দিক আঁকাবাঁকা, কোনও দিক ঢেউখেলানো।
সোমনাথ ধীরে ধীরে কয়েক পা এগোতেই একটা চাকা লাগানো ধাতব খাট এগিয়ে এল, মোটরাইজড এবং নেপথ্য-চালিত, খাটের ওপর একটা বিছানা রয়েছে। এবং খাটের সঙ্গে লাগানো রয়েছে নানারকম পাইপ এবং অদ্ভুত যন্ত্র।
কে যেন বলল, ‘শুয়ে পড়ুন।’
ক্লান্ত, ব্যথাতুর, ভীত, বিস্মিত সোমনাথ আর দ্বিধা করল না। বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ল। সে সবসময়ে বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করে বলে নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত যন্ত্রের স্বপ্ন দেখে। এটাও এরকম একটা স্বপ্নই হবে।
দ্বিতীয়বার সোমনাথের ঘুম ভাঙলে সে দেখল তার বুকের ওপর অতিকায় টেলিফোনের মতো একটা যন্ত্র, আর শরীরের নানা জায়গায় প্যাড আর নল লাগানো। শরীরে আর কোনও ব্যথা টের পাচ্ছিল না সে। বেশ তরতাজা আর ঝরঝরে লাগছে নিজেকে।
তবু এটা যে স্বপ্নই তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সোমনাথ স্বপ্নটাকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই ফের চোখ বুজল।
‘সাহেব, ও সাহেব।’
সোমনাথ চোখ মেলল, একজন কালো মতন মানুষ তার ওপর ঝুঁকে চেয়ে আছে।
‘কোচোয়ান না?’
‘জি, সাহেব। এখন কেমন আছেন?’
এই জনশূন্য পুরীতে এই প্রথম একজন মানুষকে দেখে সোমনাথ ভারী খুশি হয়ে বলল, ‘কিন্তু আমি কোথায়?’
কোচোয়ান সে-কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘বর্বররা খুব ঠেঙিয়েছিল আপনাকে।’
মারের কথা মনে পড়ায় সোমনাথ দাঁতে দাঁত পিষল।
‘আমি কি জেগে আছি, কোচোয়ান?’
‘জেগে আছেন, সাহেব।’
‘আমি কোথায়, কোচোয়ান?’
‘হাসপাতালে।’
‘এটা কোন হাসপাতাল? আমি এরকম হাসপাতাল কখনও দেখিনি তো!’
‘এটার নাম পুনর্জীবন কেন্দ্র তিন।’
‘এরকম নামও তো শুনিনি কোনও হাসপাতালের।’
‘আপনার আমলে এরকম নামের কোনও হাসপাতাল যে ছিল না। আপনি দেড় হাজার বছর এগিয়ে এসেছেন, সাহেব।’
সোমনাথ কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বুঝল, সে এখনও স্বপ্ন দেখছে, তাই চোখ বুজে ফেলল।
কোচোয়ান শব্দ করে হেসে বলল, ‘চোখ বুজে কোনও লাভ নেই, সাহেব। আপনি স্বপ্ন দেখছেন না, আপনি জেগে আছেন এবং চারদিকে যা দেখছেন সবই সত্য।’
টাইম মেশিনের কথা কল্পবিজ্ঞানে পড়েছে সোমনাথ। কিন্তু সে তো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার নয়। হলে ভালো হত। কিন্তু হওয়া কি সম্ভব?
ধীরে ধীরে চোখ খুলল সোমনাথ।
‘আমি কোথায়, কোচোয়ান?’
‘আপনি যেখানে ছিলেন সেখানেই আছেন, খিদিরপুর, গঙ্গার ঘাট মনে পড়ে?’
‘পড়ে, কোচোয়ান।’
‘আপনি সেখানেই আছেন, তবে সময়টা আর সেখানে নেই।’
‘টাইম মেশিন?’
কোচোয়ান গম্ভীর হয়ে বলল, ‘মেশিন তো মানুষেরই তৈরি সাহেব, মানুষই বানায়।’
‘তা বটে।’
‘তা হলে মেশিন-মেশিন করে আপনাদের গলা শুকোয় কেন?’
সোমনাথ চারদিকে চেয়ে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে রইল। তারপর বলল, ‘আমি উঠতে পারি?’
‘উঠুন, সাহেব। আপনি এখন ভালো আছেন। একটু অপেক্ষা করুন, আমি যন্ত্রগুলো খুলে নিই।’
লোকটা অত্যন্ত পটু হাতে যন্ত্রগুলোকে সরিয়ে দিল, তারপর বলল, ‘এবার উঠুন।’
সোমনাথ উঠল, শরীরে বিন্দুমাত্র ব্যথা নেই। কিন্তু মাথাটা যে ওরা কামিয়ে দিয়েছিল।
যেন মনের কথা টের পেয়েই কোচোয়ান বলল, ‘মাথাটা ন্যাড়াই থাকছে সাহেব। একটা সলিউশন লাগানো হয়েছে। সাতদিনে চুল বড় হয়ে যাবে।’
‘সাতদিন! ততদিন কি আমি এখানে থাকব?’
কোচোয়ান মাথা নেড়ে বলল, ‘না, সাহেব। আপনার ইচ্ছে না হলে থাকবেন না। অন্য কোনও সময় থেকে কাউকে আনার নিয়মও নেই। আমি আপনাকে এনে ফেলেছি নিতান্তই দায়ে পড়ে। ফেলে এলে আপনি মরে যেতেন, ওরা আপনার হাল খারাপ করে দিয়েছিল।’
‘আপনার সেই গাড়িটাই কি তা হলে টাইম মেশিন?’
‘টাইম মেশিন নিজে নিজে চলে না, সাহেব, তাকে চালাতে হয়।’
লোকটাকে অল্প সময়ের মধ্যেই খানিকটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিল সোমনাথ, মেশিনের প্রশংসা করলে লোকটা খুশি হয় না। লোকটা বিনয়ী হলেও ব্যক্তিত্ববান। লোকটা হয়তো একজন মস্ত বৈজ্ঞানিক। সে বলল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এটা কত সাল বলবেন?’
‘তিন হাজার পাঁচশো একান্ন।’
সোমনাথ ফের চোখ বুজল, মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরছিল তার।
‘চোখ খুলুন, সাহেব। আপনার কোনও ভয় নেই।’
‘আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাবেন? দেড় হাজার বছর পরেকার কলকাতার চেহারাটা একটু দেখব!’
কোচোয়ান মাথা নেড়ে বলল, ‘সব হবে, সাহেব। তবে অন্য যুগের মানুষকে স্বাধীনভাবে আমরা ঘুরতে দিই না।’
‘কেন?’
‘আবহাওয়ার তফাত আর টাইম ল্যাগ— দুটোই মারাত্মক, বাইরে গেলেই আপনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।’
‘তা হলে আপনি কী করে উনিশশো সাতাশিতে গিয়েছিলেন?’
‘আমার রক্ষাকবচ আছে। আপনার নেই।’
‘পৃথিবীর আবহাওয়া এখন কেমন?’
‘খুব ঠান্ডা, হিমযুগ আসছে। আপনি তো তার একটু দেখেছেন।’
‘কলকাতায় তা হলে সত্যিই বরফ পড়ে?’
‘পড়ে, সাহেব। খুব বেশিই পড়ে।’
‘আমি কি আর কিছুই দেখতে পাব না? কলকাতায় কি আগের কিছুই নেই?’
‘দেড় হাজার বছর বেশ লম্বা সময়, সাহেব। তবে একেবারেই যে কিছু নেই তা বলব না। কিছু আছে, কিছু নেই। ওরকম তো হতেই পারে। আর-একটা কথা, সাহেব, আপনি আমাকে তুমি করেই বলবেন। আমি আপনার চেয়ে অন্তত দেড় হাজার বছরের ছোট।’
সোমনাথ একটু হেসে বলল, ‘তা বটে, তবে—’
কোচোয়ান মাথা নেড়ে বলল, ‘তবেটবে নয়, সাহেব, তুমি করেই বলবেন।’
সোমনাথ কয়েক পা হাঁটল। ওইরকম মারাত্মক মার খাওয়ার পর মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এত সুস্থ বোধ করাটাই অস্বাভাবিক। সোমনাথের ঘড়িতে এখন মোটে সাড়ে সাতটা।
সোমনাথ এবার কোচোয়ানের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে এ-যুগে নিয়ে এলেন কেন?’
কোচোয়ানকে যেন একটু চিন্তিত দেখাল, সে অনেকক্ষণ সোমনাথের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘কারণ আছে, সাহেব। গভীর কারণ।’
‘কী সেই কারণ?’
কোচোয়ান কিছু বলার আগেই কোনও লুকানো স্পিকার থেকে টরে টক্কার মতো মৃদু কিছু সংকেত বেজে উঠল।
কোচোয়ান বলল, ‘আসছে।’
সোমনাথ অবাক হয়ে বলে, ‘কে আসছে?’
কোচোয়ান কোনও জবাব দিল না। চারজন লোক ঘরে এসে দাঁড়াল সোমনাথের মুখোমুখি। চারজনই গম্ভীর। সোমনাথ লক্ষ করল, এদের প্রত্যেকের পরনেই জোব্বাজাতীয় পোশাক। যেমনটা তারও পরনে রয়েছে। এ-যুগের এটাই কি একমাত্র পোশাক?
চারজনের একজন, যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমনভাবে হাত জোড় করে বলল, ‘নমস্কার, সোমনাথবাবু। পঁয়ত্রিশ শতকের অভিনন্দন।’
এমন নাটুকে অভ্যর্থনায় সোমনাথের হাসি পাচ্ছিল। তবু যথাসাধ্য গম্ভীর থেকে সে বলল, ‘নমস্কার, ধন্যবাদ। আপনারা কারা?’
‘মহাশয়, আমরা আপনাদেরই সন্তানসন্ততি, আশীর্বাদ ভিক্ষা করি।’
লোকটা কেমন যেন সাজিয়ে কথা বলছে, অনভ্যস্ত ভঙ্গি।
সোমনাথ বলল, ‘আপনারা কি এভাবেই কথা বলেন?’
লোকটা মাথা নাড়ল, ‘না, ভাষা এক পরিবর্তনশীল মাধ্যম। আমাদের ভাষা অন্যরকম। আমি প্রাচীন বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করছি। আমার নাম র।’
‘আপনাদের ভাষা কেমন?’
‘সংকেতময় এবং শব্দনির্ভর। আপনাদের মতো আমরা বাক্য রচনা করি না। একটি বাক্যকে বীজাকারে একটি শব্দে প্রকাশ করি। আবার একটি শব্দ উচ্চারণ করলে একাধিক বাক্য প্রকাশ হয়।’
লোকটি যখন কথা বলছে তখন অন্য তিনজনও পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছিল। কেমন ফেন গুবগুব, টুংটাং, খসখস সব অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করে যাচ্ছিল নিম্ন স্বরে।
সোমনাথ কবিতা পড়তে ভীষণ ভালোবাসে। সে প্রশ্ন করল, ‘এখন কি আর কবিতা লেখা হয় না?’
লোকটি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘হয়। আমাদের যন্ত্রগণকেরা লেখে।’
‘যন্ত্রগণক?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, মহাশয়। কিন্তু আমাদের হাতে আর বিশেষ সময় নেই। অস্তিত্বের অতীব সংকট দেখা দেওয়ায় আমরা আপনাকে সময়ের বহতা ধারায় অনেক দূরে এনে ফেলেছি। আমাদের ক্ষমা করুন। অনেক হিসাবনিকাশ করে দেখেছি আপনাকে চার ঘণ্টার বেশি আটকে রাখলে সমূহ সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। হয়তো বা মানবজাতির ইতিহাসই বদলে যাবে।’
সোমনাথ বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কেন?’
‘মহাশয়, পৃথিবীর সমগ্র ইতিহাস ছকে বাঁধা। যা ঘটে গিয়েছে সেগুলিরই পরিণতি বর্তমান। আমরা সময়ের উজানে যেতে পারি। আমরা ইচ্ছা করলে অতীতের ঘটনাবলীকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তনও করতে পারি। কিন্তু তার ফলাফল সম্পর্কে খুবই সচেতন থাকতে হয়। সামান্যমাত্র ভুলচুক করলেও পরবর্তী ঘটনাবলী সাঙ্ঘাতিক ও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। মহাশয়, আমরা কিছুকাল আগে একবিংশ শতকের একটি শিশুকে মারাত্মক ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা করেছিলাম, সেই শিশু পরে এক মারক রশ্মি দিয়ে পৃথিবীর সমূহ জীবন নাশ করতে উদ্যত হয়।’
সোমনাথ চমকে উঠে বলল, ‘আপনারা কী করলেন?’
‘আমরা আবার একবিংশ শতকে ফিরে গিয়ে শিশুটির জীবননাশের ব্যবস্থা করি। আপাতদৃষ্টিতে কাজটা নিষ্ঠুর, কিন্তু মানবজাতির ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আমাদের এই কাজ করতে হয়েছিল। সুতরাং আমরা আর ভবিতব্য নিয়ে খেলা করি না, ঈশ্বর মঙ্গলময়।’
‘আপনারা কি ঈশ্বর মানেন?’
‘অবশ্যই মহাশয়, ঈশ্বর এক প্রমাণিত সত্য।’
‘আচ্ছা, ভূত বলে কি কিছু আছে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, মহাশয়, ভূতও এক প্রমাণিত সত্য। কিন্তু আমাদের আর সময় নেই। যদি দয়া করে আপনি আমাদের সঙ্গে একটু আসেন। আমাদের গ্রাম-প্রধান আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলবেন।’
‘গ্রাম-প্রধান?’
সোমনাথের ফের হাসি পেল। গ্রাম কোথায় যে গ্রাম-প্রধান থাকবে? তবে সে কোনও মন্তব্য করল না। শুধু বলল, ‘চলুন।’
ঘরের বাইরে একটি প্রশস্ত সুড়ঙ্গ ‘পথ’। চারদিকে নরম আলো। এবং সে-আলো আসছে দেওয়াল, মেঝে এবং ছাদ যে বস্তুতে তৈরি তারই অভ্যন্তর থেকে। সামনেই একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার ছাদ নেই, চাকা নেই, লম্বা একটা চুরুটের মতো তার চেহারা। খোঁদলের মধ্যে কয়েকটা আসন।
বিনীতভাবে র বলল, ‘দয়া করে আগে আপনি উঠুন।’
তারা সকলেই গাড়িতে উঠল। শুধু কোচোয়ান রয়ে গেল। গাড়িটা চলতে শুরু করল। কোনও ঝাঁকুনি নেই, দুলুনি নেই, বাতাসের অস্বস্তিকর ঝাপটা নেই। অথচ গতি প্রচণ্ড।
‘এটা কীরকম গাড়ি।’
র বিনীতভাবে বলল, ‘এটি একটি ত্রিচর যান। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে চলতে পারে। আপনাদের আমলের মোটরগাড়িরই আধুনিক সংস্করণ। যে কারিগরির দ্বারা এটি তৈরি হয়েছে সেটি আপনাদের যুগে অজ্ঞাত ছিল। বললেও হয়তো আপনি সঠিক অনুধাবন করতে পারবেন না।’
সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, ‘এরকমই হওয়ার কথা। আমাদের আমলের কল্পবিজ্ঞানে আমরা এরকম যানের কথা পড়েছি।’
‘আজ্ঞে যথার্থই বলেছেন। সেইসব কল্পনার মধ্যেই সম্ভাব্যতার বীজ ছিল। আমরা আপনাদের কাছে ঋণী।’
‘আপনারা মাটির নীচেই থাকেন বুঝি?’
‘না মহাশয়। মাটির উপরিভাগেও আমাদের নানা নির্মাণ আছে। তবে পৃথিবীর উপরিভাগে তাপমাত্রা কোথাও কোথাও শূন্যের একশো ডিগ্রির নীচে নেমে গেছে। তাই আমাদের সাধারণ মানুষেরা মাটির নীচেই বসত করে থাকে।’
‘চাষবাস হয় না?’
‘হয়, মহাশয়, দেখবেন?’
‘হ্যাঁ।’
র একটা শব্দ উচ্চারণ করল। শোনাল অনেকটা, ‘ব্লুৎ।’
গাড়িটা থেমে গেল। র তার আঙুলের ফাঁকে লুকনো একটা চৌকো জিনিস শুধু একবার উলটে দিতেই ডান দিক ও বাঁ দিকের দুটি দেওয়াল হঠাৎ স্বচ্ছ হয়ে গেল। দেখা গেল দু-ধারেই বিস্তীর্ণ খেত। অবশ্য বিংশ শতাব্দীর খেতের মতো নয়। বেগুনি একটা আলোর আভায় দেখা গেল, মাটির নীচে প্রায় বনভূমি তৈরি করেছে এরা। তার মাঝখানে মাঝখানে সবুজ বা হলুদ শস্যে ছাওয়া খেত।
‘ওগুলো কীসের খেত?’
‘ধান, গম, ভুট্টা, বার্লি, ডাল। ঋতুচক্র একরকম নেই বলে এখন আমরা সব ঋতুতেই সবরকম চাষ করে থাকি। সামনে আমাদের গোশালাও দেখতে পাবেন। কুকুর, হাঁস, মুরগি, বাঘ, ভালুক সবই আমরা সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছি।’
‘ওপরে কোনও গাছ জন্মায় না?’
‘জন্মায়। শুধু দুটি মেরু অঞ্চলে তাপমান কিছু বেশি বলে কিছু গাছপালা জন্মায়। তবে সেগুলিও তুষারযুগের গাছ, তাদের প্রজাতি ভিন্ন। মেরু অঞ্চলে অনেক মানুষও উপরিভাগে বসবাস করে।’
গোশালা, অরণ্য অঞ্চল, পোলট্রি সবই দেখতে পেল সোমনাথ। মাটির নীচে এ এক আশ্চর্য জগৎ। বিশ্বাসযোগ্য নয়।
গাড়িটা ধীরে ধীরে ওপরে উঠছিল। একটু বাদেই একটা সুড়ঙ্গ বেয়ে সেটা উঠে এল মাটির ওপরে।
বাইরে এখনও তুষারঝড় বয়ে চলেছে। চারদিক ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। কিন্তু গাড়িটা যেখানে নামল সেটা একটা গ্রামই বটে। গাড়ির ভেতরে একটা সুইচ টিপে স্নিগ্ধ আলোয় চারদিক ভরে দিল। সেই আলোয় দেখা গেল, পরিচ্ছন্ন সুন্দর ছবির মতো সাজানো কুটির, খড়ের গাদা, চণ্ডীমণ্ডপ, গোচারণ ক্ষেত্র। আশ্চর্য! আশ্চর্য! এখানে গাছপালাও রয়েছে। বাঁশবনে জোনাকি জ্বলছে। শেয়াল ডাকছে। পায়ের নীচে ঘাস, তৃণ, চোরকাঁটা।
সোমনাথ অবাক হয়ে বলল, ‘এসব কি সত্যি?’
‘সত্য, মহাশয়। একে বলা হয় তাপ বিকিরণ ক্ষেত্র। তবে এরকম মুক্তাঞ্চল বেশি নেই। তৈরি করা অনেক শ্রমসাপেক্ষ এবং আমাদের শক্তির ভাণ্ডার ততখানি সমৃদ্ধ নয়। শুধু গ্রাম-প্রধানদের জন্যই পৃথিবীতে এরকম গোটা কয়েক গ্রাম আমরা তৈরি করেছি। আসুন, সামনের ওই আটচালাটিতেই গ্রাম-প্রধান থাকেন।’
সোমনাথ অবাক হয়ে দেখল, আটচালাতে ঢোকার মুখে দাওয়ার খুঁটি বেয়ে লাউডগা লতিয়ে উঠেছে চালে। লাউও ফলে আছে মেলা। এ-দৃশ্য এ-যুগে দেখবে বলে কল্পনা করেনি সে।
ঘরের ভেতরকার দৃশ্যটি আরও বিস্ময়কর। একটি জলচৌকির ওপর মোটা একখানা পুঁথি খুলে এক বৃদ্ধ প্রদীপের আলোয় কিছু পড়ছেন।
সোমনাথ ঢুকতেই বৃদ্ধ সসম্রমে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে করজোড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আসুন, পিতা। আমাদের কী সৌভাগ্য!’
প্রথমটায় বৃদ্ধের প্রণামে সোমনাথ তটস্থ হয়ে উঠলেও পরমুহূর্তেই তার মনে পড়ল, সে এই বৃদ্ধের চেয়ে বয়েসে অন্তত দেড় হাজার বছরের বড়।
সামনেই তার জন্য আসন পাতা রয়েছে। সোমনাথ বসার পর বৃদ্ধ উপবেশন করলেন। অতিশয় বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আপনাকে অনেক কষ্ট দেওয়া হয়েছে, পিতা।’
সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, ‘মোটেই না। বিকেল ছ-টার সময় আমাকে চারজন গুণ্ডা মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছিল। আপনারা আমাকে তুলে না আনলে আমার নির্ঘাত মৃত্যু ঘটত।’
বৃদ্ধ একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, ‘বর্তমান ইতিহাস অনুযায়ী আপনি সন্ধে সাতটার সময় মারাও গেছেন পিতা। পুরোনো নথিতে দেখাও যাচ্ছে সাতুই জানুয়ারি আপনার মৃত্যু ঘটে গেছে। কিন্তু আমরা তা ঘটতে দিতে পারি না।’
সোমনাথ মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইল।
বৃদ্ধ হাতের পুঁথিটি সোমনাথের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন, পিতা, এটি হল সেই বছরের কলকাতা করপোরেশনের মৃত্যুর নথি-বই। ডেথ রেজিস্টার।’
সোমনাথ খাতাটা দেখল। স্পষ্টাক্ষরে তার নাম মৃতের তালিকায় লেখা রয়েছে। দেখে তার শরীরটা হিম হয়ে গেল ভয়ে।
বৃদ্ধ সোমনাথের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন। অতিশয় মৃদু স্বরে বললেন, ‘আমরা ঘটে যাওয়া ঘটনার সংশোধন সাধারণত করি না। তার ফল মারাত্মক হতে পারে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে বিকল্প ইতিহাস সৃষ্টি করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন।’
সোমনাথের গলা বুজে গিয়েছিল। ভালো করে স্বর ফুটছিল না। সে গলা খাঁকারি দিয়ে একটু কাঁপা স্বরে বলল, ‘কেন?’
‘আমাদের শক্তির উৎস সীমাবদ্ধ। পৃথিবীর উপরিভাগ ক্রমশ কঠিন বরফের তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে। এটা হিমযুগের প্রাথমিক স্তর। এরপর ক্রমে আরও ঠান্ডা আসবে। সূর্যকে বছরের পর বছর দেখাই যাবে না। আকাশ সর্বদাই মেঘাচ্ছন্ন থাকবে। আমাদের শক্তির উৎস এমন নয়, যা দিয়ে আমরা এই প্রখর হিমযুগের সঙ্গে অবিরল লড়াই চালিয়ে যেতে পারি। আমাদের অসহায় অবস্থা কি আপনি বুঝতে পারছেন, পিতা?’
‘পারছি। বলুন।’
‘কিন্তু আমরা কোনও অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারি না। আমরা হঠাৎ করে কিছু আবিষ্কারও করে ফেলতে পারি না। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে তা ঘটে ক্রমবিবর্তনের পরিণতিতেই। আমরা যথেষ্ট হিসাবনিকাশ করেছি, যন্ত্রগণকরাও দিনরাত্রি পরিশ্রম করেছে। আমরা একটি পরীক্ষামূলক বিকল্প ইতিহাসও তৈরি করে দেখেছি। আমরা কী দেখেছি জানেন, পিতা?’
‘না।’
‘বিংশ শতকের শেষ বছরে একজন শিশুর জন্ম সম্ভব। তার নাম হবে সোমসুন্দর। ধীমান এই শিশু পরবর্তীকালে পৃথিবীর নিঃশেষিত দাহ্য পদার্থের বিকল্প এক শক্তি আবিষ্কার করতে পারে। তা হলে একবিংশ শতক থেকে সেই শক্তির উৎস ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের হাতে আসবে, পিতা। এবং তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে আমরা এই হিমযুগকে অনায়াসে অতিক্রম করে যেতে পারব।’
‘বুঝেছি। কিন্তু আমার কী করার আছে?’
‘সোমসুন্দরের পিতা ও মাতার নাম আপনাকে এখনও বলিনি, পিতা।’
‘কী তাদের নাম?’
‘সোমসুন্দরের পিতার নাম সোমনাথ রায়, মাতার নাম অপরা মিত্র। দুজনেই কুলীন কায়স্থ। দুজনেই বিজ্ঞানমনস্ক। বিকল্প ইতিহাস অন্তত তা-ই বলছে।’
সোমনাথ আবার চমকে উঠল, বুকটা ধকধক করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই আবার বিমর্ষতায় ভরে গেল মন।
সোমনাথ বলল, ‘তা তো আর সম্ভব নয়।’
বৃদ্ধ একটু হাসলেন, ‘হ্যাঁ, পিতা, স্বাভাবিক ঘটনা অনুযায়ী সম্ভব নয়। আমরা তা জানি। কিন্তু আমরা এই ইতিহাসকে মানুষের মঙ্গলের জন্য কিছু পরিবর্তিত করতে চাই, পিতা।’
‘কী করবেন?’
‘আমরা আপনার শারীরিক বিধানে কিছু পরিবর্তন আনব। তারপর আপনাকে আবার আপনার সময়ে ফিরিয়ে দেব। সন্ধে ছ-টায়, গঙ্গার ঘাটে।’
‘তারপর?’
বৃদ্ধ একটু হাসলেন, ‘ইতিহাসটা অন্যরকমভাবে লেখা হবে।’
‘অপরা আমাকে চেনে না।’
‘জানি, পিতা।’
‘আমি তাকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। তারপর—’
‘জানি পিতা। তবে এবার ঘটনা অন্যভাবে ঘটবে।’
‘আমার শারীরিক বিধানে আপনারা কী পরিবর্তন আনবেন?’
বৃদ্ধ অতিশয় বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘এ-যুগের বিজ্ঞান অতিশয় সূক্ষ্ম। সব কথা হয়তো আপনি বুঝবেন না। আপনি অনুমতি করলে আমরা আর আপনার সময় নেব না। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আর বিশেষ সময় আমাদের হাতে নেই।’
বৃদ্ধ উঠে সোমনাথকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন।
র এগিয়ে এসে বলল, ‘আসুন, পিতা, যানে আরোহণ করুন।’
সোমনাথ নীরবে গাড়িতে উঠল। যতক্ষণ গাড়িটা চলল ততক্ষণ সোমনাথ সম্মোহিতের মতো বসে রইল। ইতিহাস অন্যরকম করে লেখা হবে! কীরকম করে? অপরা! অপরার সঙ্গে তার…! যাঃ, অসম্ভব।
একটা গম্বুজওয়ালা ভূগর্ভস্থ ঘরে তাকে নিয়ে এল র এবং তার সঙ্গীরা। একটা চমৎকার বিছানায় সোমনাথ শুয়ে পড়ল। তারপর একটা প্রকাণ্ড ঢাকনায় ঢাকা পড়ে গেল সে। ঘুমিয়ে পড়ল।
গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে সোমনাথ। অদূরে সেই ঘোড়ার গাড়ি। কোচোয়ান ঘোড়াকে বিচালি খাওয়াচ্ছে। ল্যাম্পপোস্ট থেকে মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়ছে নির্জন ভূতুড়ে জায়গাটায়।
সপাং করে চাবুকের একটা শব্দ হল।
সোমনাথ চমকে চেয়ে দেখল, গাড়িটা এসেছে। সে তৈরি হয়ে দাঁড়াল। ইতিহাস পালটে দিতে হবে।
গাড়িটা এসে দাঁড়াল সামনে। একজন লোক নেমে এল। বিশাল চেহারা। এসেই সোজা সোমনাথের বুকের কাছে সোয়েটারটা খামচে ধরে বলল, ‘কতদিন হল মেয়েটার পিছু নিয়েছ?’
হঠাৎ সোমনাথ এক তীব্র ইচ্ছাশক্তিকে টের পেল। এই সেই মুহূর্ত। সোমনাথ ডান হাতটা তুলে তীব্র এক ঘুসি মারল লোকটার মুখে।
দানবটা ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে।
আরও তিনজন নেমে এল। কিন্তু সোমনাথ পিছিয়ে গেল না। এগিয়ে গেল।
সপাং করে চাবুকটার আর-একটা শব্দ হল। দেড় হাজার বছর পরেকার পৃথিবী যেন আনন্দের অভিনন্দন পাঠাচ্ছে তাকে।
জীবনে মারপিট করেনি সোমনাথ। কিন্তু তার তীব্র ঘুসি আর লাথির চোটে তিন-তিনটে লোক গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
সোমনাথ দেখল আরোহীহীন গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে সামনে। প্রতিপক্ষ ভূলুণ্ঠিত।
সপাং করে চাবুকের আর-একটা শব্দ হল। সোমনাথ তাকাতেই কোচোয়ান মোটরগাড়িটা দেখিয়ে দিল। তারপর হঠাৎ গাড়িসমেত কোচোয়ান অদৃশ্য হয়ে গেল বাতাসে।
সোমনাথ ধীর পায়ে গিয়ে গাড়িতে উঠল। স্টার্ট দিল। সে জীবনে গাড়ি চালাতে শেখেনি কখনও। কিন্তু আজ অনায়াসে চালাতে লাগল।
অপরার জন্য আর কোনও মাথাব্যথা ছিল না সোমনাথের। দুশ্চিন্তাও নয়। সে জানে, তার অলক্ষ্যে ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হচ্ছে।
গাড়িটা বড় রাস্তায় পরিত্যাগ করে সে গলির মধ্যে তার বাড়িতে যখন ফিরে এল তখন মাত্র রাত সাড়ে ন-টা।
এই ঘটনার তিনদিন বাদে একদিন অপরা তার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল কুকুরকে ব্যায়াম করাতে। শীতের সুন্দর সকালে সে হঠাৎ একটি যুবককে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। ভাবল, আহা এর সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হত।
এই ঘটনার তিন বছর বাদে সোমনাথ তার শিশুপুত্র সোমসুন্দরকে প্র্যামে ছড়িয়ে বিকেলবেলা বেড়াতে বেরিয়েছিল। এখন তার অবস্থা যথেষ্ট ভালো। সায়েন্টিফিক অ্যাপ্লায়েন্সের ব্যাবসা রে-রে করে চলছে।
পাড়া ছেড়ে একটা নির্জন মাঠের ধারে এসে পড়েছিল সোমনাথ।
আচমকা একটা ঘোড়ার গাড়ির ঝুমঝুম শব্দ বেজে উঠল।
সোমনাথ চমকে তাকাল।
‘সাহেব, কোথাও যাবেন? পৌঁছে দেব?’
সোমনাথ একটু হাসল, ‘কেমন আছে, কোচোয়ান?’
‘খুব ভালো, সাহেব।’
‘সব ভালো?’
‘সব ভালো। ইতিহাস বদলে গেছে। চলি, সাহেব।’
কোচোয়ান হাত তুলল। ঘোড়াটা একটা লাফ দিল শূন্যে। তারপর মিলিয়ে গেল।
সোমনাথ হাতটা তুলে রইল। মুখে স্মিত হাসি। হাসিমুখেই শিশুপুত্রের ঘুমন্ত মুখের দিকে একবার তাকাল সে।
ইতিহাস বদলে গেছে।
রচনাকাল: ১৯৮৭
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, জটায়ু, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পড়ে খুব ভাল লাগল, শীর্ষেন্দু বাবু
অসম্ভব ভালো লেখা!
খুব ভালো লাগল। সময় বদলেছে, গল্প বদলেছে, নায়ক আর তার প্রেম যেন এক.. 🙂 কিছু ইতিহাস শাশ্বত হোক। শীর্ষেন্দু বাবুকে প্রণাম