কোন সে কবির ছন্দ বাজে
লেখক: সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: সৌরভ দে
জন্মান্তর আছে কিনা জানি না, কিন্তু এ কথা নিশ্চিত জানি, ওই মেয়েটিকে আমি চিনি। কোথায় তাকে দেখেছি, কিছুতেই মনে করতে পারছি না। কিন্তু ওকে আমি চিনি, চিনি, চিনি। ওই চোখের দৃষ্টি, ওই ভ্রূভঙ্গি, ওই ঠিকরে পড়া আলোর ঝলক— ও আমি নিশ্চিত কোথাও দেখেছি আগে। হয়তো এই জন্মে, হয়তো গতজন্মে— যদি গতজন্ম বলে সত্যিই কিছু থাকে।
স্বপ্নে সে এসেছিল আমার কাছে। প্রায়ই আসে। আসে আর কেঁদে বলে, “কোথায় তুমি? আমাকে উদ্ধার করো।”
আমি বলি, “কে তুমি? নাম কি তোমার?”
সে হাসে— কান্নার মাঝখানে হাসি— ঠিক যেন জলের মাঝে আগুন। সে বলে, “ভুলে গেলে? আমার নাম সৌদামিনী।”
আমার বুকের পাঁজরে আমি ওর হাসির উত্তাপ বুঝতে পারি। যেন কতকাল আগে আমার বক্ষলগ্না হয়ে ঠিক এইরকম হাসির ঝলক ফুটে উঠত ওর মুখে— কিন্তু সে স্মৃতি আজ খুব ঝাপসা হয়ে এসেছে, যেন বহুদূর অতীতের ভুলে যাওয়ার ওপারের সব কথা— মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ে না।
আমি বলি, “কোথায় খুঁজব তোমায়?”
সে বলে, “এই শরীরে আমাকে পাবে না তুমি। সৌদামিনীকে পেতে হলে তোমাকে ছাড়তে হবে এই বন্ধন। পারবে?”
স্বপ্নাবিষ্ট আমি বলি, “পারব। তোমার জন্য করতে পারি না, এমন কোনও কাজ নেই। কী করতে হবে, শুধু বলে দাও তুমি।
সৌদামিনীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অদ্ভুত এক আলোকপ্রভায়। “সময়বাঁধের ওপারে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি আমি, সুকৃষ্ণ। প্রেমিকের চোখের একফোঁটা জল নিয়ে এসো তুমি। তাতেই আমার মুক্তি, তোমারও। অপেক্ষা করে আছি আমি তোমার জন্য। এসো তুমি— তোমাকে ছাড়া আমিও পূর্ণ হতে পারি কই?”
হাত বাড়িয়ে ওর গাল ছুঁতে গেলাম আমি। অশ্রু নেই ওর চোখে, কেবল দহনজ্বালা। ও সরে গেল।
“না। বললাম না, ওই মাংসের শরীর নিয়ে আমাকে ছুঁতে পারবে না তুমি? সময়বাঁধ পেরিয়ে তোমায় আসতে হবে আমার কাছে। সে বড় সহজ কাজ নয়। পারবে তো সুকৃষ্ণ?”
“পারব।”
“কথা দিচ্ছ?”
“দিচ্ছি।”
“তবে যাও রত্নাধিপতির ভৃত্য সুপ্রিয়র কাছে। সুপ্রিয় জানে সময়বাঁধের ঠিকানা। ওকে বোলো একটি মেয়ের কথা। তার নাম কান্তা।”
“সময়বাঁধটা কী, সৌদামিনী?”
“ভিন্ন মাত্রার, ভিন্ন স্রোতের সময়ের মাঝের প্রাচীর। কেউ সে প্রাচীর ভেদ করে একদিকের কথা অন্যদিকে পাঠাতে পারে না।”
“তাহলে তুমি আমার কাছে এলে কী করে?”
“দূর বোকা!”— সৌদামিনী হাসে।— “এ যে স্বপ্ন। স্বপ্নে ওই প্রাচীর গলে যায়। তাই তো তোমার কাছে আসতে পারি।”
“কিন্তু তোমার মুখটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কেন?”
“তোমার ঘুম ভাঙছে, স্বপ্ন শেষ হয়ে আসছে। সময়বাঁধ তাই কঠিন হয়ে উঠছে। আমি আসি।”
“যেয়ো না, আর একটু থাকো।”
“যেতেই হবে। ভুলো না সুকৃষ্ণ, ভালোবাসি তোমায়।”
“ভুলিনি। কিন্তু…”
ঘুম ভেঙে গেল। আমার কাচের জানালা দিয়ে এসে পড়ছে সূর্যের নরম আলো, আর রত্নাধিপতির সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরা তাক করে আছে দেওয়াল থেকে আমার মুখের উপর।
***
চুপটি করে তার অফিসে বসেছিল সুপ্রিয়, টেবিলের উপর ছায়া পড়তে মুখ তুলে তাকাল।
আমি বললাম, “বসতে পারি, সুপ্রিয়?”
আমার বুকে রিসেপশনিস্ট মেয়েটি ঝুলিয়ে দিয়েছে দর্শনার্থী ফলক। তাতে নামটা পড়ল সুপ্রিয়।— “সুকৃষ্ণ। আপনাকে আগে কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।”
দেখলাম, হাতে সোনার বালা পরেছে সে, যদিও বালাটা বেশ ঢিলে হয়ে গেছে। আমি বললাম, “রত্নাধিপতির অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্ভেইল্যান্স ম্যানেজার আপনি। রোজ হাজার হাজার লোকের খবরাখবর রাখছেন। আমাকে মনে না রাখাই স্বাভাবিক। আমি একটি মেয়ের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।”
সুপ্রিয়ে নড়েচড়ে বসল, গলা নামিয়ে বলল, “প্রেম ভালোবাসা সংক্রান্ত কেস যদি হয়, তাহলে আপনাকে কোনওরকম সাহায্য করতে পারব না, এ কথা আগেই বলে রাখি। সরকারি ফরমানটা দেখেছেন তো?”
দেওয়ালে ঝোলানো আলোঝলমলে নিওন সাইনবোর্ডের দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখাল সে। আমিও দেখলাম।
উজ্জ্বল নীল রঙের বোর্ডের উপর কালো দিয়ে লেখা আছে রত্নাধিপতির বাণী:
১. কর্মই ধর্ম
২. প্রেম কর্মবিরোধী
৩. রাষ্ট্রের প্রতি নজর দিন, কারণ রাষ্ট্র আপনার দিকে নজর রেখেছে।
সাইনবোর্ডের উপরেই টিকটিকির মতো ওঁৎ পেতে বসে আছে একটি নজরদারী ক্যামেরা।
আমি হাসলাম। —“এই বাণী তো দেশের বাচ্চাবুড়ো সবার মুখস্থ আছে, সুপ্রিয়। প্রেম-ভালোবাসার কথা ক্যামেরার সামনে বললে আমারও যে ভাগ্যে নির্বাসন বা মৃত্যুদণ্ড আছে, সে আমি ভালোই জানি। একটি মেয়ের ব্যাপারে একটু তথ্য প্রয়োজন আপনার কাছে, তাই আসা।”
“পরিচয় বলুন।”
“পরিচয় তো জানি না, শুধু নামটাই জানা আছে। কান্তা।”
তড়িৎস্পৃষ্টের মতো কেঁপে উঠল তার শরীর। ক্যামেরার দিকে তাকাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল সে। চাপাগলায় বলল, “দুপুর দুটোয় লাঞ্চ আওয়ার শুরু হচ্ছে। এই বিল্ডিংএর নিচে রাস্তার ওপারে একটা রেস্তোরাঁ আছে। আমি রোজ ওখানে লাঞ্চ করতে যাই।”
নমস্কার জানিয়ে উঠে পড়লাম। সুপ্রিয়ও তার ঢলঢলে বালাপরা হাত তুলে প্রতিনমস্কার করল। লিফট ছিল, কিন্তু তাতে না গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম একতলায়, সেখান থেকে রাস্তায়।
মাথার উপর ঝকঝক করছে রোদ। শুনেছি, বহুকাল আগে একসময় নাকি আকাশে কালো ধোঁয়ার মতো মেঘ করত, তার থেকে জল পড়ত। তাকে বলা হত বৃষ্টি। এখন আর ওসব মেঘ-বৃষ্টি কিছু দেখি না। মেঘ যেটুকু দেখা যায়, তার পুরোটাই সাদা রঙের; ওতে বৃষ্টি হয় না।
কেন জানি না, কালো রঙের মেঘের কথা মনে পড়লেই বুকের ভেতর কী যেন একটা উথালপাথাল হয়। আর সেই সঙ্গে মনে পড়ে যায় সেই দেখা-না দেখায় মেশা ঝলমলে মেয়েটির কথা, যেন সে আমার কতজন্মের আপনজন!
ঘড়ি দেখলাম। দেড়টা বাজে। গুটিগুটি পায়ে হাঁটা দিলাম রেস্তোরাঁটার দিকে।
ভারী কাচের দরজা, তার উপরে নাম লেখা— ‘ভোজনরসিক সুজন’। যথারীতি দরজার উপরে লাগানো আছে একটি ক্যামেরা। সবার অভ্যাস হয়ে গেছে এখন এসবে।
দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই উর্দিপরা খানসামা মাথা ঝুঁকিয়ে দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমি।
দুটো বাজার কয়েক মিনিট পরেই এসে হাজির হল সুপ্রিয়। খাবারের অর্ডার দিয়ে সে বলল, “এই রেস্তোরাঁর ক্যামেরার ফিড আমার অফিসে সরাসরি যায়। অতএব কিছুটা নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে। এবার বলুন তো, কান্তার নাম আপনি জানলেন কোথা থেকে? কে পাঠিয়েছে আপনাকে? রত্নাধিপতি?”
“আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান! এসব কী বলছেন? রত্নাধিপতি আমাকে পাঠাতে যাবেন কেন আপনার কাছে?”
সুপ্রিয় হঠাৎ আমার হাতটা ধরে ফেলল নিজের দু-হাতের মধ্যে।— “কে আপনি?”
“আমার নাম তো জানেন আপনি। সুকৃষ্ণ।”
“নাম আপনার যাই হোক, আপনি তো পুরোপুরি আমাদের মতো নন!”
“মানে?”
“মানে, আপনার মধ্যে একটা অন্তর্লীন অগ্নিস্পর্শ আছে।”
“বুঝিয়ে বলুন সুপ্রিয়। এত টেকনিক্যাল কথা আমি বুঝতে পারি না।”
“মানে, আপনার মধ্যে আগুনকে ধরে রাখার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে। এটা সাধারণত কোনও মানুষের থাকে না।”
“কীভাবে বলছেন এসব?”
“আমি কাউকে ছুঁয়ে তার শরীর-মন সম্বন্ধে অল্পস্বল্প ধারণা করতে পারি। অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্ভেইল্যান্স ম্যানেজারের পদটা পেতে এই জন্মগত ক্ষমতাটা খুব সাহায্য করেছিল। রত্নাধিপতি তখন আমার উপর খুব প্রসন্ন হয়েছিলেন।”
“সে প্রসন্নতা কি এখন আর নেই?”
সুপ্রিয় মলিন হাসি হাসল।— “না। আমার আগের অফিস ছিল ওর বাড়ির কাছে। ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে। রত্নাধিপতি জানতে পেরে যান। বাণী নম্বর টু স্মরণ করুন। কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে বহুদূরে— আমার এই বর্তমান অফিসে— আমাকে ট্রান্সফার করে দেওয়া হল। আমাকে উনি সাবধান করে রেখেছেন, কর্মবিরোধী প্রেম যদি আবার আমার জীবনে আসে, তাহলে আমার হবে মৃত্যুদণ্ড, আর ওর শাস্তি হবে আরও ভয়ংকর।”
আমি বললাম, “মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়ংকর শাস্তি?”
সুপ্রিয় বলল, “আপনাকে এত কথা কেন বলছি জানি না, বোধহয় আপনাকে স্পর্শ করে আপনার অন্তরেও একজনের জন্য ভালোবাসা দেখেছি বলেই।— হ্যাঁ, সে শাস্তি মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর। রত্নাধিপতি যদি চান, তিনি অপরাধীকে ছুড়ে ফেলতে পারেন সময়বাঁধের উপরে।”
“কী হবে তাতে?”
“রত্নাধিপতি বলেন, অতি যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু, যদিও সেকথা আমার পুরোপুরি বিশ্বাস হয় না। কিন্তু ওই মেয়েটিকে আমি ভালোবাসি সুকৃষ্ণ। ওর সঙ্গে খারাপ কিছু হোক আমি চাই না, কারণ আর যাই হোক, সময়বাঁধের উপর গিয়ে পড়লে আর ফেরার আশা নেই, এ কথা নিশ্চিত।”
“কী নাম মেয়েটির?”— জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
সুপ্রিয় জলভরা চোখে তাকাল আমার দিকে; ফিসফিস করে বলল, “কান্তা।”
***
দ্রুত স্থির করে ফেললাম আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ। সৌদামিনীকে পেতে হলে দেখা করতে হবে কান্তার সঙ্গে। সুপ্রিয় পারবে না; রত্নাধিপতির কড়া নজর আছে ওর উপর। যা করবার, করতে হবে আমাকেই। কিন্তু কীভাবে?
সুপ্রিয় বলল, “সুকৃষ্ণ, আকারান্তর কতটা ভালো পারেন আপনি?”
শব্দটাই নতুন আমার কাছে। বললাম, “এটা কী বস্তু?”
সুপ্রিয় বলল, “অন্যের রূপ ধারণ। শেপ-শিফটিং। এদিকে দেখুন। ক্যামেরা যেন দেখতে না পায়।”
টেবিলের তলায় নিজের হাতটা নিয়ে গেল সে। সেদিকে উঁকি মেরেই অবাক হয়ে গেলাম আমি। তার হাতের তালু থেকে কনুই পর্যন্ত কুকুরের থাবায় পরিণত হয়েছে।
এক মুহূর্ত পরেই হাতটা তুলে এনে আবার টেবিলের উপর রাখল সে। দিব্যি স্বাভাবিক মানুষের হাত।
আমি বললাম, “আপনার তো গুণের শেষ নেই দেখছি।”
সে হাসল।— “আমাদের মতো সার্ভেইল্যান্স ম্যানেজারদের এসব বিদ্যা আয়ত্ত করতে হয়। লোকে তাই আমাদের বলে ‘যক্ষ’। কান্তাও পারত এ কাজ। কতরকমের প্রাণীর রূপ ধরে যে আমরা পরষ্পরের সঙ্গে দেখা করেছি, ভাবতেও পারবেন না। কিন্তু রত্নাধিপতি আমাদের চেয়েও অনেক বড় আকারান্তরী। যে হ্রদে আমরা হংস-হংসী সেজে জলকেলি করছিলাম, উনি সেই হ্রদের ধারেই বসেছিলেন কুকুর হয়ে। আমরা জল থেকে উঠে আসতেই স্বরূপ ধারণ করলেন। ব্যাস, কর্তব্যে অবহেলা আর রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া ভালোবাসবার অপরাধে নির্বাসন হল আমার।”
আমি বললাম, “বেশ কাজের বিদ্যা, সন্দেহ নেই। কিন্তু এ যে আমার জানা নেই।”
সুপ্রিয় বলল, “জানলে ক্যামেরাগুলোর হাত থেকে কিছুটা হলেও বাঁচতেন। এখন সুশোভনকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলা ছাড়া আর উপায় নেই।”
“সুশোভন কে?”
উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল সুপ্রিয়, দাঁতের ফাঁকে ‘শশশ’ করে একটা শব্দ করে চোখের ইশারা করল ভোজনরসিক সুজনের কাচের দরজার দিকে। মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেই আমারও চোখের দৃষ্টি হঠাৎ করেই যেন স্থির হয়ে গেল।
সাঙ্গোপাঙ্গ পরিবৃত হয়ে ভেতরে ঢুকছেন স্বয়ং রত্নাধিপতি। আভূমিনত হয়ে সেলাম করছে খানসামা।
আমাদের দিকে তিনি ফিরেও তাকালেন না, সোজা চলে গেলেন ভিভিআইপি কামরার দিকে। বাদামি রঙের মুখে সরু গোঁফ, মাথায় কোঁকড়া কালো চুল আর ধূর্ত চোখের তাচ্ছিল্যমেশানো দৃষ্টি— সব মিলিয়ে খুব একটা নয়নসুখউদ্রেককারী চেহারা নয় তাঁর।
পুরো সময়টা দমবন্ধ করে নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে ছিল সুপ্রিয়। মিনিটখানেক পরে মৃদুস্বরে প্রশ্ন করল, “গেছে?”
“গেছে।”
“ওর বাম পাশে একটা রোগামতো লোককে দেখলেন? হাতে যার লম্বাটে গড়নের একটা ব্লাস্টার ছিল?”
“দেখলাম মনে হল। কে লোকটা?”
“ও-ই সুশোভন। আমার বন্ধু।”
“আগে বলবেন তো। ভালো করে দেখতাম তাহলে। উনি কীভাবে সাহায্য করবেন আমাদের?”
সরাসরি আমার কথার উত্তর না দিয়ে সুপ্রিয় বলল, “সরকারিভাবে আমার বা কান্তার আকারান্তর করা নিষিদ্ধ। আমাদের সে ক্ষমতা রত্নাধিপতি কেড়ে নিয়েছেন ইন্দ্রমণি সরিয়ে নিয়ে। যেটুকু দেখলেন, ওটুকু পুরোনো অভ্যাস। পুরোপুরি অন্যের চেহারা ধারণ আর আমি করতে পারিনা।”
আমার মুখে ভিড় করে আসা প্রশ্নগুলো আগাম অনুমান করে নিয়েই সুপ্রিয় আবার বলল, “আমাদের মতো উচ্চপদস্থ যক্ষদের ইন্দ্রমণি দেওয়া হয় সরকারের তরফ থেকে, যাতে আমরা নানা ধরনের প্রাণীর রূপ ধরে মানুষের কথাবার্তায় আড়ি পাততে পারি। কাজটা কঠিন নয়; একটা ইন্দ্রমণি থাকলে আপনিও পারবেন। আমি যেহেতু রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়েছি, তারপর যে রত্নাধিপতি আমার মণি বাজেয়াপ্ত করবেন, সেটা জানাই ছিল। এখন সুশোভন হল একমাত্র ব্যক্তি, যাকে বিশ্বাস করে তার মণিটা ধার চাইতে পারি আমি, যদিও রত্নাধিপতি যদি জানতে পারেন, তাহলে ওর-ও ধড়ে মাথা থাকবে না।”
“মণিটা ধরুন সুশোভনের কাছে পেলেন। তারপর কী করবেন? কোনও জন্তুর রূপ ধরে যাবেন কান্তার কাছে? তাতে কী-ই বা লাভ হবে?”
সুপ্রিয় হাসল। “লাভ তো আছেই। কান্তা বন্দি আছে অলকা মিনারে। আর সময়বাঁধের প্রবেশদ্বার আছে ওই মিনারেরই চূড়ায়।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “মিনারে কড়া প্রহরা আছে নিশ্চয়ই। ভেতর পর্যন্ত যাবেন কীভাবে?”
আবার হাসল সুপ্রিয়।— “আমি যাব না, যাবেন তো আপনি। সময়বাঁধ পেরিয়ে আপনার স্বপ্নে দেখা সৌদামিনীর কাছে তো আপনাকেই যেতে হবে, সুকৃষ্ণ।”
‘সৌদামিনী’ নামটা কানে যেতেই বুকের মধ্যে জমা অন্ধকার যেন এক লহমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমি বললাম, “বেশ, তাই হবে। সুশোভনের মণি নিয়ে ছদ্মবেশে আমিই যাব অলকা মিনারে। কিন্তু তারপর? সময়বাঁধ ছুঁলেই কি সব শেষ নয়?”
“সময়বাঁধ ছুঁলে কী হয়, তা কেউ বলতে পারে না, সুকৃষ্ণ। তবে একটা কথা। একটা অদ্ভুত কথা আপনাকে বলার আছে। আমি মানুষের শরীর ছুঁয়ে তার সম্বন্ধে অল্প কিছু ধারণা করতে পারি, আগেই বলেছি। আপনাকে ছুঁয়ে আমার অদ্ভুত একটা উপলব্ধি হল।”
“বলুন।”
“মনে হল, আপনার মৃত্যু নেই।”
বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। না, পরিহাসের চিহ্নমাত্র নেই ওর মুখে। আমি বললাম, “কী বলতে চাইছেন, খুলে বলুন দয়া করে।”
সুপ্রিয় বল, “আমাদের যক্ষদের নানা ধরনের ক্ষমতা থাকে। আমার দক্ষতা ছিল আকারান্তরের; সুশোভনের দক্ষতা ভবিষ্যৎ দর্শনে। ওর মতো উঁচুমানের ক্লেয়ারভয়েন্ট যক্ষদের মধ্যেও খুব কম-ই আছে। আপনার হাত ধরে আমি যেটুকু বুঝেছি, বললাম। এরপর ওর সঙ্গে যখন আমরা কথা বলব, তখন ও আপনাকে আরও পরিষ্কারভাবে পুরোটা বলতে পারবে।”
আমি চুপ করে রইলাম। কী অদ্ভুত সব কথা শোনাচ্ছে আমাকে রত্নাধিপতির এই যক্ষ!
সুপ্রিয় আবার বলল, “একটি অনুরোধ করব আপনাকে, সুকৃষ্ণ।”
তার কণ্ঠস্বরের আকস্মিক পরিবর্তনটা কান এড়াল না আমার। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, তার চোখদুটি জলে ভিজে উঠেছে।
খুব আস্তে আস্তে সে বলল, “কান্তাকে বলবেন, আমি ওকে খুব ভালোবাসি।”
মাথা নাড়লাম আমি। প্রিয়াবিরহের কষ্ট এ পোড়া দেশে আমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে?
সুপ্রিয় চট করে চোখ মুছে নিয়ে বলল, “আজ বিকেল পাঁচটায় আমার অফিসের ডিউটি শেষ হচ্ছে। সোয়া পাঁচটায় আপনি এই রেস্তোরাঁর কাছে থাকবেন, আপনাকে নিয়ে সুশোভনের কাছে যাব। ও রত্নাধিপতির কাছের লোক; যদি কেউ কিছু করতে পারে তো ও-ই পারবে।”
***
সুশোভন যে যক্ষ হিসাবে শাসক রত্নাধিপতির খুবই কাছের লোক, সেটা তার সঙ্গে আলাপ হতেই পরিষ্কার হয়ে গেল। তার বিরাট অফিসবাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘরটিতে সে বসে, কিন্তু সেইখানেই তার দেওয়ালের গায়ে ফুটে উঠছে অফিসের এবং অফিসের বাইরে কোথায় কি হচ্ছে, তার লাইভ ছবি। সুপ্রিয় বলল, “আলাদা ডিসপ্লের ব্যবস্থা করার দরকার হয়নি। দেওয়ালটাই একটা বিরাট ডিসপ্লে মনিটরের মতো সারফেসের কাজ করছে।”
সুশোভন লোকটি লম্বা, রোগা, মুখে চাপদাড়ি। তার চোখের দৃষ্টি সতর্ক, যেন প্রতিটি জিনিসকে সে দেখে নিচ্ছে খুঁটিয়ে। তার কণ্ঠস্বর-ও মৃদু; যেন এই বুঝি কেউ তার কথা শুনে ফেলবে, তাই সে সাবধান হয়ে আছে। সুপ্রিয় বলল, “সুশোভন, তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা ছিল।”
সুশোভন বলল, “আবার কান্তার ব্যাপারে ঝামেলায় পড়েছ বুঝি? না সুপ্রিয়, আর আমি ও ব্যাপারে তোমাকে কোনও সাহায্য করতে পারব না।”
সুপ্রিয় অপ্রস্তুতভাবে একটু হাসল।— “আরে না না, এই ভদ্রলোক একটা সমস্যায় পড়ে আমার কাছে এসেছিলেন। আমার মনে হল, সমাধানটা তুমি আরও ভালো বলতে পারবে। এঁর নাম সুকৃষ্ণ।”
আমি নমস্কার করলাম, সুশোভনও প্রতিনমস্কার করল। আমি বললাম, “একটি মেয়েকে খুঁজছি আমি।”
সুশোভন প্রথম প্রশ্ন করল, “ভালোবাসেন নাকি তাকে?”
আমি চুপ করে আছি দেখে সুপ্রিয় বলল, “বলুন, বলুন। এটা সুশোভনের নিজস্ব অফিস। এখানে কোনও ক্যামেরা নেই।”
আশ্বস্ত হয়ে বললাম, “বাসি।”
“ধরা পড়লে শাস্তি জানেন? রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া ভালোবাসা মানে দেশদ্রোহিতা জানেন?”
“জানি।”
সুশোভন হাসল।— “যবে থেকে ভালোবাসার উপর রাষ্ট্রের হুকুম জারি হয়েছে, তবে থেকে দেখছি এসব কাণ্ড বেড়েই চলেছে। যাক গে, মেয়েটির নাম কী বলুন, সুকৃষ্ণ।”
“সৌদামিনী।”
“হাতটা দিন আপনার।”
দু-হাতে আমার হাত ধরল সুশোভন। সুপ্রিয়ও এরকম করেছিল আজ দুপুরে। সুশোভনের হাত এত ঠান্ডা যে মনে হয় যেন মরা মানুষের হাত ধরেছি।
কয়েক মুহূর্ত পরেই চমকে উঠে হাত ছেড়ে দিল সে; অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, “কে আপনি?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমি… আমি সুকৃষ্ণ। রত্নাধিপতির প্রজা।”
সুশোভন প্রবলবেগে মাথা নাড়ল।— “আপনার নিকট-ভবিষ্যতে কী অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে চলেছে, আপনি জানেন?”
“যাব্বাবা! আমি জানব কী করে? আমি তো আপনার মতো যক্ষ নই, সুশোভন!”
সুশোভনের নীচু গলা একেবারে যেন খাদে নেমে গেল।— “আপনি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করতে চলেছেন। তার ফলাফল হবে ভয়ংকর।”
চকিতে সুপ্রিয়র সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় হল আমার। সুপ্রিয় বলল, “সুশোভন, খুলে বলো পুরোটা।”
সুশোভন বলল, “বলা মুশকিল, কারণ উনি ঠিক আমাদের মতো নন। এরকম আগে কারও সঙ্গে হয়নি। যখনই কারও হাত ধরেছি, তার অতীত-ভবিষ্যৎ স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি। কিন্তু সুকৃষ্ণ, আপনার হাত ধরতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম।”
“কী?”
“দেখলাম, আপনার দেহটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রেণুতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তারপর আপনাকে দেখতে পেলাম কালো ধোঁয়ার শরীরে; আপনার শিরায় শিরায় খেলছে সাদা আগুন।”
হঠাৎ স্বপ্নে দেখা সৌদামিনীর কথাটা মনে পড়ে গেল আমার।— “ওই মাংসের শরীর নিয়ে আমাকে ছুঁতে পারবে না তুমি।”
বললাম, “আর কী দেখলেন?”
সুশোভন বলল, “আর দেখলাম একটি অচেনা লোককে। আগে কখনও দেখিনি তাকে। নদীর ধারে সে দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখছে আপনাকে, অথচ তার চোখ দেখলে মনে হয়, সে যেন স্বপ্ন দেখছে। আশ্চর্যের বিষয় হল, লোকটির পোষাকও আমাদের মতো নয়, আর যে নদীর ধারে সে দাঁড়িয়ে আছে, তাও আমাদের এই দেশের হতেই পারেনা। কী যেন বিড়বিড় করে বলছে সে, কিন্তু আমি সে ভাষা জানি না।”
আমি চুপ করে রইলাম। সৌদামিনীকে খুঁজে বার করার সঙ্গে এই লোকটির নিশ্চয় কোনও যোগ আছে। আর কান্তা…
বললাম, “আপনি যা দেখলেন, তার অর্থ তো একটাই। আমার মৃত্যু।”
সুশোভন একবার মাথা চুলকে নিল।— “তাই হওয়া উচিত, কিন্তু সুকৃষ্ণ, আপনার ভাগ্যে অমরত্ব আছে।”
এবার স্পষ্টতঃই অবিশ্বাসের হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটে। বললাম, “সুশোভন, অমরত্বের খবরে আমার দরকার নেই। আর অমর কেউ কোনওদিন হতে পারেনি, পারবেও না। আপনি বরং বলুন, ওই অদ্ভুত ভাষায় কথা বলা লোকটি কে, আর আমি সৌদামিনীকে খুঁজে পাব কিনা।”
আরেকবার আমার হাত ধরল সুশোভন, এবং একমুহূর্ত পরেই নামিয়ে দিল। কড়াচোখে সে তাকাল সুপ্রিয়র দিকে।
সুশোভন বলল, “আবার কান্তাকে জড়িয়েছ এর মধ্যে, সুপ্রিয়? তোমার কি শিক্ষা হবে না?”
সুপ্রিয় আমতা-আমতা করে বলল, “মানে… মানে…!”
সুশোভন বলল, “অজুহাত দিও না। রত্নাধিপতি জানতে পারলে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত, তুমি জানো না?”
আমি বললা, “কী দেখলেন আপনি?”
সুশোভন একটু রাগত গলায় বলল, “সুকৃষ্ণ, সুপ্রিয় আমার বন্ধু। এবং আমার বন্ধুর বন্ধু হওয়ার সুবাদে আপনিও আমার বন্ধু। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনাদের রাষ্ট্রবিরোধী কাজে আমি প্রশ্রয় দেব।”
আমার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। আমি উঠে পড়তে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সুপ্রিয়র দিকে চোখ ফেরাতে দেখলাম, সে আমাকে ইশারায় বসতে বলছে।”
সুপ্রিয় বলল, “সুশোভন, তোমাকে একটা কথা বলি। তোমার মতো এত ভালো না হলেও সামান্য কিছু ক্লেয়ারভয়েন্ট ক্ষমতা আমারও আছে, তুমি জানো। আজ দুপুরে এই ভদ্রলোকের হাত ধরেছিলাম আমি। এখন প্রশ্ন হল, আমি যা দেখছি, তুমিও কি তা-ই দেখলে? তাই কি তুমি এত রেগে যাচ্ছ?”
ওরা দুই যক্ষ পরষ্পরের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত, যেন প্রতিপক্ষের ক্ষমতা মেপে নিতে চাইছে। তারপর সুশোভন বলল, “ওঁর ভেতরে অগ্নিধারণ ক্ষমতা আছে। রত্নাধিপতির হাত ধরে আমিই একসময় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম যে এক অগ্নিধারকের জন্যই একদিন ওঁর পতন হবে। এখন এঁর কথা যদি রত্নাধিপতি জানতে পেরে যান, এঁর ভাগ্যে কী আছে, বুঝতে পারছ?”
সুপ্রিয় বলল, “হুঁ, এই অগ্নিধারণ ক্ষমতাটা ওঁর মধ্যে আমিও দেখেছি। ভীষণই আশ্চর্যের ব্যাপার! ভবিষ্যতের ছবি আর কি দেখলে? কান্তার বিষয়ে কী বলছিলে যেন?”
সুশোভন বলল, “অলকা মিনারে দেখলাম ওঁকে, সামনে দাঁড়িয়ে আছে কান্তা, তার ঠিক পাশেই সময়বাঁধের গা থেকে বেরোচ্ছে নীলচে বিদ্যুতের আভা।… সুপ্রিয়, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। তোমরা কিন্তু আগুন নিয়ে খেলছ। অলকা মিনারে যাওয়া আত্মহত্যা করার সামিল।”
আমি বললাম, “সেই জন্যই আপনার সাহায্য আমাদের একটু লাগবে।”
সুশোভন বলল, “আমার সাহায্য? মাফ করুন সুকৃষ্ণ, আমার দ্বারা কোনও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ হবে না। না সুপ্রিয়, তুমি আমার বন্ধু হলেও তোমাকে কোনও সাহায্য করতে আমি পারব না।”
সুপ্রিয় হাসল।— “তোমার সরকারি ইন্দ্রমণিটা কোথায় রেখেছ, সুশোভন?”
সুশোভনের মুখ লাল হয়ে উঠল।— “তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? তোমার নিজের মণি তো বাজেয়াপ্ত হয়েইছে, এখন আমারটাকেও ধ্বংস করতে চাও! চলে যাও এখান থেকে, সুপ্রিয়। ও জিনিস নিয়ে আমি তোমাকে অলকা মিনারে যেতে দেব না।”
সুপ্রিয় বলল, “আরে, আমি নয়, যাবেন সুকৃষ্ণ। মণিটা কিছুক্ষণের জন্য ধার দাও, তাতেই কার্যসিদ্ধি হয়ে যাবে। ওটা পেলে সুকৃষ্ণের পক্ষেও আকারান্তর করা সম্ভব হবে।”
সুশোভনের চোখটা তার ডেস্কের উপরে রাখা ছোট্ট ধাতব বাক্সের উপর থেকে ঘুরে এল।— “তোমরা যদি এখনই না যাও, আমি রক্ষীদের ডাকছি।”
সুপ্রিয় চেঁচিয়ে উঠল, “না, সুকৃষ্ণ!” কিন্তু তার আগেই পকেট থেকে ভারী রাবারের ডান্ডাটা বার করে এক ঘা বসিয়ে দিলাম আমি ওর মাথায়। শব্দ না করেই ওর জ্ঞানহীন দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
“চটপট!”— আমার মধ্যে যে এতখানি দুঃসাহস থাকতে পারে, সুপ্রিয় যেন এতক্ষণ বুঝতে পারেনি। হাঁ করে সে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি দ্রুতহাতে বাক্সটা খুলে ইন্দ্রমণিটা বার করে নিলাম; ঘরের উজ্জ্বল, সাদা আলোয় দু’আঙুলের মধ্যে জিনিসটা ঝিকমিক করে উঠল।
নিজেকে সামলে নিয়ে সুপ্রিয় বলল, “কাজটা কিন্তু ভালো হল না। সুশোভন কিন্তু জ্ঞান ফিরে পেয়েই পুরোটা রত্নাধিপতিকে জানিয়ে দেবে। …জলপাত্রটা আনুন, ওকে জাগাতে হবে। ব্যাপারটা বোঝাতে হবে। অলকা মিনারে যেতে হলে ওর সাহায্য ছাড়া গতি নেই।”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও জলপাত্রটা এনে দিলাম। মুখে কয়েকবার জলের ছিটে দিতেই সুশোভন উঠে বসল। কিছুক্ষণ চোখ মিটমিট করার পর তার নজর পড়ল আমার দিকে।
আমি বললাম, “আমি ক্ষমা চাইছি, সুশোভন।”
সুশোভন তখনও মাথার একপাশটা চেপে রেখেছে। সে বলল, “আপনার মধ্যে অলৌকিক অগ্নিধারণ ক্ষমতা আছে, সুকৃষ্ণ। ও ক্ষমতা কোনও মানুষের থাকে না। তাই আপনার এই অস্বাভাবিক আচরণে আমি অন্তত অবাক হইনি। আপনার চিন্তাভাবনা, কাজকর্ম যে পুরোপুরি আমাদের সঙ্গে মিলবে না, সে আমি আগেই বুঝেছি, কারণ আপনি ঠিক আমাদের মতো নন; যদিও আপনি যে ঠিক কী, তাও আমি বুঝতে পারছি না।”
সুপ্রিয় বলল, “সুশোভন, তুমি তো জানো, কান্তাকে আমি কত ভালোবাসি। আমার দূত করে আমি সুকৃষ্ণকে পাঠাচ্ছি তার কাছে। আর সুকৃষ্ণও খুঁজছে তার সৌদামিনীকে। সেজন্য ওকেও যেতে হবে সময়বাঁধের কাছে। তুমি সাহায্য করো আমাদের।”
“কী ধরনের সাহায্য চাও?”
“তোমাকে তো সিকিউরিটি ক্যামেরার দেখভাল করতে মাঝেমধ্যেই যেতে হয় অলকা মিনারে। কাল একবার চলো। সঙ্গে থাকবে সুকৃষ্ণ।”
সুশোভন বলল, “সে আমি যেতেই পারি। কিন্তু সুকৃষ্ণ, আপনি যাবে কীভাবে? অচেনা কেউ ওখানে ঢুকতে পারবে না রত্নাধিপতির পাস ছাড়া।”
আমি বললাম, “ইন্দ্রমণি আছে তো। আমি যদি আকারান্তর করে অন্য কারও রূপ ধারণ করি?”
সুপ্রিয় চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল।— “নাঃ, ওখানে যেতে গেলে পাস লাগবেই। সকলেরই লাগে।”
আমি বললাম, “একজন ছাড়া।”
ইন্দ্রমণিটা হাতেই ছিল, আমাকে শুধু মনে মনে আকারান্তরের ইচ্ছা করতে হল। আমার নতুন ধারণ করা চেহারার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল দুই সার্ভেইল্যান্স ম্যানেজার যক্ষ। সুশোভন ফিসফিস করে উচ্চারণ করল, “রত্নাধিপতি!”
আমি হাসলাম।— “আর কোনও সমস্যা?”
সুশোভন বলল, “আপনি তো শেষ হবেনই, আমাদেরও যে সর্বনাশ করে ছাড়বেন, সেটা বোঝার জন্য আমার ভবিষ্যৎদর্শন না করলেও চলবে।”
***
পরের দিন বিকেলে আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছি অলকা মিনার থেকে একটু দূরে। মিনারের ঠিক নিচেই ব্লাস্টার হাতে পাহারা দিচ্ছে দুই রক্ষী। আমাদের মাথার উপরে আকাশটা লালচে বেগুনি হয়ে এসেছে। হাওয়া দিচ্ছে না, কেমন একটা গুমোট গরম পরিবেশ। তাকিয়ে দেখলাম, সুশোভনের মুখটা বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে গেছে।
বোধহয় খুব ভয় পেয়েছে বেচারা!
সুপ্রিয় আমার কানের কাছে ফিসফিস করে ডাকল, “সুকৃষ্ণ!”
আমি তাকালাম তার দিকে। ইঙ্গিতপূর্ণ একটা হাসি হেসে নিজের ডানহাতের দিকে ইশারা করল সে সুশোভনকে লুকিয়ে। মুঠোর ভেতরের বস্তুটা একঝলক দেখিয়েই সে আবার পকেটে ভরে ফেলল। আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে।
ইন্দ্রমণি!
আবার সে ফিসফিস করে বলল, “সুশোভনের কাছে এক্সট্রা সাপ্লাই থাকে, আমি জানতাম। কাল যখন ও আপনার আকারান্তর দেখতে ব্যস্ত ছিল, তখন এটা হাতসাফাই করেছি।”
সুশোভন ইতিমধ্যে গুটিগুটি পায়ে এগোচ্ছিল রক্ষীদের দিকে। সুপ্রিয় বলল, “এবার আপনি আকারান্তর করে ফেলুন, সুকৃষ্ণ। ভয় নেই, রক্ষীরা বুঝতেই পারবে না।”
বুকের ঢিপঢিপানি উপেক্ষা করেই হাতের ইন্দ্রমণি চেপে ধরলাম সজোরে মুঠোর মধ্যে, আর মনে মনে কল্পনা করলাম রত্নাধিপতির চেহারাটা। পরমুহূর্তেই শরীরে অদ্ভুত একটা শিহরণ অনুভব করলাম আমি।
কেমন লাগছে আমাকে? নিজেকে এই মুহূর্তে দেখার কোনও উপায় নেই, কিন্তু সুপ্রিয়র মুখের সপ্রশংস দৃষ্টি দেখে বুঝতে অসুবিধা হলনা, আকারান্তরটা নিখুঁতই হয়েছে।
সুপ্রিয় বলল, “দারুণ! এবার কনফিডেন্টলি এগিয়ে যান সুশোভনের সঙ্গে। শুধু অন্য কারও সঙ্গে কথা কম বলবেন। নয়তো বিপদ হতে পারে।”
আমার গলা শুকিয়ে এসেছে। ঠোঁটের উপর শুকনো জিভ বুলিয়ে নিলাম। বিশেষ উপকার হল না।
মিনারের নিচে দাঁড়ানো রক্ষীদের সঙ্গে কথা বলছে সুশোভন; একবার আড়চোখে গলির এদিকটায় তাকিয়ে নিল সে। সুপ্রিয় বলল, “কান্তাকে বলবেন, সুপ্রিয় তাকে ভালোবাসে। রত্নাধিপতির লোকেরা ওকে বোঝাচ্ছে, আমি নাকি ওকে ভুলে গেছি। আপনি ওকে সত্যটা মনে করিয়ে দেবেন দয়া করে।”
এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকে গেলাম আমি।— “কেন? কারণ কী এর?”
সুপ্রিয় মুখ বিকৃত করে বলল, “সম্ভবত দ্বিতীয় বাণীর প্র্যাকটিক্যাল প্রয়োগ। প্রেম তো কর্মবিরোধী ওদের ভাষায়, তাই বোধহয় ওরা তাই বোধহয় ওরা কান্তাকে বোঝাতে চাইছে যে তার যক্ষ সুপ্রিয় তাকে ভুলে গিয়ে রাষ্ট্রের কাজে মন দিয়েছে। এ ছাড়া তো আর কোনও ব্যাখ্যা মাথায় আসছেনা। যাকগে, আপনি এগিয়ে যান, নয়তো সুশোভন ভেতরে ঢুকতে পারছে না।”
মন শক্ত করে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম আমি। আমাকে আসতে দেখেই তটস্থ হয়ে দুই রক্ষী সামরিক স্যালুট জানাল। সুশোভনও বাদ গেল না।
রক্ষীদের হাত থেকে নিজের পাসটা টেনে ছাড়িয়ে নিল সে। ওরা কিচ্ছুটি বলল না। স্বয়ং রত্নাধিপতি এসেছেন অলকা মিনারে। একটু বেচাল হলেই ওদের গর্দান চলে যেতে পারে!
মিনারের নিচে দাঁড়িয়ে উপরে তাকালাম আমি। কালো পাথরে তৈরি মিনার যেন উঠে গেছে নীল আকাশের বুক ফুঁড়ে। এই মিনারেই বন্দিনী আছে সুপ্রিয়র কান্তা। আর এই মিনারেরই চূড়ায় আছে সময়বাঁধের প্রবেশদ্বার— আমার স্বপ্নসুন্দরী সৌদামিনীর জগতের সিংহদরজা।
মিনারের দরজা দিয়ে ঢুকতেই ফ্রন্টডেস্ক। সাদা আলো জ্বলছে ভেতরে। উঁচু ডেস্কের ধাতব প্যানেলের চকচকে গায়ে নিজের নতুন মুখটা এই প্রথম দেখলাম আমি— রোগাটে, ধূর্ত মুখে সরু গোঁফ, মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল আর চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি— নিজেকে দেখে নিজের প্রতিই কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণা এল।
ভেতরে রক্ষীরা একযোগে আবার মিলিটারি স্যালুট ঠুকল। উদ্ধত ভাবে আমি তাকালাম সুশোভনের দিকে; ইশারা করলাম ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে কথা বলতে।
হাবভাব ঠিক আসল রত্নাধিপতির মতো হওয়া চাই।
ডেস্কে বসা মেয়েটিও ভীত-বিস্মিত চোখে দেখছিল আমার দিকে। তার সুপ্রিম বস যে এইভাবে বিনা নোটিশে এসে পড়বে, এর জন্য যে সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না, তা তার মুখের বিহ্বল ভাব দেখেই বোঝা যায়।
মেয়েটির কাছে লিফটের নতুন কোডটা জেনে নিল সুশোভন। রোজ নতুন নতুন কোড তৈরি হয় লিফট ব্যবহারের জন্য। সময়বাঁধের মতো ভয়ংকর জিনিস যেখানে আছে, সেখানে বিপদ এড়ানোর জন্য এটুকু সতর্কতা নিতেই হয়। এখন এখান থেকেই লিফট চালু হয়ে যাবে বটে, তবে নেমে আসার সময় কোডটা কাজে লাগবে।
অলকা মিনারে কোনও সিঁড়ি নেই। বিভিন্ন তলায় যাতায়াত করতে লিফটই ভরসা।
সুশোভনের সঙ্গে কথা বলছিল মেয়েটি। খুব বিনীত ভাবে সে জানতে চাইল, “কোন ফ্লোর, স্যার?”
সুশোভন বলল, “টপ ফ্লোর।”
চকিতে তার দিকে তাকিয়ে নিল একবার মেয়েটি। টপ ফ্লোরে কী আছে, সবাই জানে।
ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় লিফটের চলাচল, যাতে কেউ কোনওভাবেই না পৌঁছতে পারে সময়বাঁধের কাছে। মেয়েটি কীবোর্ডে টাইপ করল কয়েকটা সংখ্যা। নিঃশব্দে খুলে গেল লিফটের দরজা।
সুশোভন আমাকে চোখের ইশারা করল সেইদিকে এগিয়ে যেতে। যেতে যেতে শুনতে পেলাম, সে মেয়েটিকে বলছে, “… পাঠাবে। ঠিক পনেরো মিনিট পরে।”
লিফটে ঢুকে খেয়াল করলাম, ছাদ থেকে আমাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে একটি কুৎসিত ক্যামেরা।
লিফট উঠছে তো উঠছেই— আমার মনে হল পুরো একঘণ্টা ধরে উঠছে। তবে মনটা একটু নিশ্চিন্ত লাগছে। এতগুলো লোকের কেউ যখন আকারান্তর ধরতে পারেনি, তখন বলতে হবে কাজটা ভালোই হয়েছে।
আমি বললাম, “আগে কোথায় যাচ্ছি আমরা? কান্তা, না সময়বাঁধের কাছে?”
সুশোভন অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল বন্ধ দরজার দিকে; কী যেন ভাবছিল সে। আমার কথা শুনে একটু বিস্মিত হয়ে সে তাকাল আমার দিকে, বলল, “দু’জনেই একই জায়গায় আছে, সুকৃষ্ণ; শুধু একটা দরজার এপার-ওপার। কান্তাকে নিয়ে ভয় নেই। সে যতক্ষণ জানে, তার সুপ্রিয় নিরাপদে আছে, সে উলটোপালটা কিছু করবে না।”
আমি বললাম, “সুপ্রিয় একটু আগে আমাকে অদ্ভুত একটা তথ্য দিল।”
“কী?”
“এরা নাকি কান্তাকে বোঝাচ্ছে, সুপ্রিয় তাকে ভুলে গেছে। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না আমার। ভালোবাসবার অপরাধে সুপ্রিয়র নির্বাসন হয়েছে, কান্তা বন্দি অলকা মিনারে। কিন্তু এই মিথ্যেটা কান্তাকে বুঝিয়ে কী লাভ রত্নাধিপতির?”
মৃদু হাসল সুশোভন। “রত্নাধিপতির ব্যাপার তিনিই ভালো জানেন। আমাদের এখন হাতে যে কাজ আছে, সেটার কথা ভাবতে হবে। টপ ফ্লোরে পৌঁছে দেখবেন একটাই ঘর আছে। সেই ঘরেই বন্দি আছে কান্তা।”
“আর সময়বাঁধ? সেটা কোথায় আছে? কেমন দেখতে জিনিসটা?”
“সময়বাঁধ কোনও ‘জিনিস’ নয়, সুকৃষ্ণ। সে একটা অদৃশ্য পর্দার মতো এনার্জি ফিল্ড। কান্তা যে ঘরে আছে, সেই ঘরের ভেতর আরেকটা দরজা আছে। সেই দরজার পারে আছে সময়বাঁধ। অল্প একটুখানি জায়গায় সময়ের বিভিন্ন স্রোতের মোহনার মতো একটা অস্তিত্ব বলতে পারেন একে।”
“ছুঁলেই মৃত্যু, না?”
উত্তর না দিয়ে হাসল সুশোভন। লিফট থামল, দরজা খুলে গেল নিঃশব্দে। আমরা বেরিয়ে এলাম লিফট থেকে।
কান্তার ঘরের দরজা বন্ধ। সুশোভন থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্ত।
হাতের ইন্দ্রমণিটা পকেটে ভরে ফেললাম আমি। রত্নাধিপতির ছদ্মবেশ আপাতত আর দরকার নেই আমার। নিজের চেহারায় ফিরতে পেরে একটু স্বস্তি অনুভব করলাম। ঠোঁটের উপর হাত বুলিয়ে বুঝতে পারলাম, সরু গোঁফটা বিদায় হয়েছে।
দরজার বাইরের থাম্ব স্ক্যানারে আঙুল ছোঁয়াল সুশোভন। সবজে একটা আলো জ্বলে উঠল পাল্লার গায়ে। পরক্ষণেই দরজা খুলে গেল। সুশোভনের কাঁধের উপর দিয়ে ঘরের ভেতরের মেয়েটির ভয়ার্ত মুখটা দেখতে পেলাম আমি।
দীর্ঘদিনের দুশ্চিন্তায় রোগা হয়ে গেছে সে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। চোখদুটি ভারী সুন্দর তার, দেখলে মাদী হরিণের চোখের কথা মনে পড়ে। সুশোভনকে পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম আমি; বললাম, “তুমি কান্তা?”
খোলা দরজা দিয়ে আসা বিকেলের পড়ন্ত আলোর আভায় তাকে আরও সুন্দর লাগছে। মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল সে। আমি বললাম, “সুপ্রিয় আমাকে পাঠিয়েছে।”
সুপ্রিয়র নাম শুনতেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল— তার হরিণীচক্ষুর কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল শিশিরের মতো দু-ফোঁটা জল, আর তার লাল-টুকটুক ঠোঁটে ফুটে উঠল স্বস্তির হাসি। দেখলাম, তার দাঁতগুলি ঝকঝকে সাদা; দাঁতের অগ্রভাগগুলি ঈষৎ সরু হয়ে এসেছে।
“সুপ্রিয়!”— নামটি সে অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সঙ্গে উচ্চারণ করল।
আমি বললাম, “হ্যাঁ, সে তোমাকে বলতে বলেছে যে সে তোমাকে ভালোবাসে।”
কান্তা স্বপ্নাবিষ্টের মতো বলল, “আর শয়তানটা আমাকে শুধু বলে, সুপ্রিয় নাকি আমায় ভুলে গেছে!”
“শয়তান! কে? কে বলে তোমায় এসব কথা?”
“ওই তো! ওই যে!”— আমার পেছনের দিকে আঙুল দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠল কান্তা।— “ওকে সঙ্গে এনেছেন কেন? ও একটা ছদ্মবেশী! ও একটা শয়তান!”
সুশোভন ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল আমার সামনে, অল্প একটু হেসে হাতের ইন্দ্রমণিটা ফেলে দিল মাটিতে। তীব্র অবিশ্বাসে আমি তাকিয়ে রইলাম তার মুখের দিকে।
রত্নাধিপতি!
তাঁর মুখে শত্রুকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার চাপা উল্লাস।
কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, আবার গলা শুকিয়ে গেছে।
***
“সুশোভন জানত না, ওর অফিসেও গোপন ক্যামেরা বসানো আছে।”
স্থিরভাবে তাকিয়ে আছি আমি লোকটার দিকে। আর ভয় করছে না আমার।
এবার একটা এসপার কী ওসপার হবে।
“আজ সকালেই গোপনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সুশোভনকে, আর তার জায়গা নিয়েছি আমি। ওর অফিসের লোকেরাও কিছু জানে না। ভাবছি, ওর মতো দক্ষ লোক কেন এমন ভুল করতে গেল। সুপ্রিয়র কুসঙ্গে পড়েই বিপদ ডেকে আনল বেচারা। সার্ভেইল্যান্স ম্যানেজারদের মধ্যে সেরা লোক ছিল সুশোভন। ভাবছি, ও কি তৃতীয় বাণীটা ভুলে গিয়েছিল?”
তৃতীয় বাণী? মনে পড়ে গেল।— “রাষ্ট্রের প্রতি নজর দিন, কারণ রাষ্ট্র আপনার দিকে নজর রেখেছে।”
আমি বললাম, “সুশোভন কোথায় এখন?”
রত্নাধিপতি বললেন, “আমার প্রাসাদে। বন্দি। আমি ফিরে গিয়ে সুপ্রিয়কেও বন্দি করার ব্যবস্থা করছি। তারপর…”— গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলেন তিনি।
“না!”— কান্তা কেঁদে উঠল।— “আমার সুপ্রিয়কে ছেড়ে দিন। সুশোভনকেও। আপনি আমার কাছে যা চেয়েছেন, তাই হবে। ওদেরকে যেতে দিন শুধু।”
আমি কান্তার দিকে ফিরলাম।— “কী চেয়েছেন উনি তোমার কাছে?”
উত্তর না দিয়ে কান্তা চুপ করে চেয়ে রইল রত্নাধিপতির দিকে। তার দু’চোখে একরাশ ঘৃণা।
রত্নাধিপতি বললেন, “সুকৃষ্ণ, তোমার দুঃসাহস কতটা, সেটা দেখার জন্যই আজ তোমার সঙ্গে এখানে এসেছি। তোমার সাহস দেখে আমি সত্যিই খুশি হয়েছি, তাই তোমার জীবনের এই শেষ কৌতূহলটুকু আমি মিটিয়ে দেব। কান্তাকে আমি চাই।”
আমার মাথার মধ্যে একটা শিরা রাগে দপদপ করছে। রত্নাধিপতি আবার বললেন, “কান্তাকে আমি চাই। তাই ওকে বারবার বলে আসছি, সুপ্রিয় ওকে ভুলে গেছে। কিন্তু ও কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না সে কথা। বলে, ‘আমার সুপ্রিয় কোনওদিন আমাকে ভুলে যেতে পারে না’।”
কান্তা বলল, “আজ সত্যিটা প্রমাণ হল তো?”
আমি বললাম, “আপনি নিজেই নিজের দু-নম্বর বাণীর বিরোধিতা করছেন? প্রেম কর্মবিরোধী— এ তো আপনারই কথা।”
সরু গোঁফের নিচে ক্রূর হাসি হাসলেন তিনি।— “ও নিয়ম প্রজার জন্য, সুকৃষ্ণ; রাজার জন্য নয়।”
কান্তা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।— “কিন্তু আপনি কে? আপনি এখানে কেন?”
আমি বললাম, “সৌদামিনীর জন্য।”
“কে সে?”
“সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে সময়বাঁধের ওপারে। কিন্তু সময়বাঁধটা কোথায়। এঘরে আর কোনও দরজা দেখছি না তো?”
কান্তা ম্লান হাসল।— “ও বুঝি তাই বুঝিয়েছে আপনাকে? সময়বাঁধ অন্য কোথাও নেই, আছে এইখানেই। ও জিনিস চোখে দেখা যায় না, যতক্ষণ না…।”
মাথা থেকে চুলের কাঁটা খুলে নিল সে, একরাশ কালো চুলের ঢল নামল তার কাঁধ ছাপিয়ে। রত্নাধিপতি বাধা দেওয়ার আগেই সে জিনিসটা ছুড়ে দিল পেছন দিকে।
‘চড়াত’ করে একটা শব্দ হল। ঘরের মেঝে থেকে দু-হাত উপরে ঝলসে উঠল নীল বিদ্যুৎ; কাঁটাটা অদৃশ্য হয়ে গেল ক্ষণপ্রভ এক উজ্জ্বল পর্দার গায়ে, আর আমি একঝলকের জন্য সেই বিদ্যুৎশিখায় দেখতে পেলাম একটি মেয়ের মুখ— আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে সে।
“সময়বাঁধ।”— কান্তা বলল।— “ওই বুঝি আপনার সৌদামিনী?”
আমি যেন তখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে ওকে সত্যি সত্যি দেখতে পেলাম। বললাম, “হ্যাঁ।”
রত্নাধিপতি বিস্ফারিত চোখে বললেন, “ওই মেয়েকে কোথায় পেলে, সুকৃষ্ণ? ও তো মানুষ নয়!”
আমি বললাম, “মানুষ নয়? ও তবে কী?”
“ও যে আগুন! ওই মেয়ের সঙ্গে তোমার কীসের সম্পর্ক?”
আমি হাসলাম।— “ভালোবাসার!”
আমি আর কান্তা দু’জনেই সজোরে হেসে উঠলাম। রত্নাধিপতি কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন।
“অপেক্ষা করো, কান্তা। সুপ্রিয়র জীবনের বিনিময়ে হলেও তোমাকে আমার চাই। আর সুকৃষ্ণ, ওই মেয়ে যে-ই হোক, এই অলকা মিনার থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরছ না তুমিও।”
কান্তা তাচ্ছিল্যভরে হাসল।— “আমাকে চাই? সত্যি? শরীরটা তো পাবেন; মন পাবেন তো, রত্নাধিপতি?”
রত্নাধিপতি ক্রুদ্ধভাবে ঠোঁট কামড়ালেন। কান্তা বলল, “জানেন, সুকৃষ্ণ, এই ঘরেই অনেকবার আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে ছুঁতে চেয়েছেন উনি। পারেন নি কেন জানেন?”
“কেন?”
“উনি আমাকে জোর করে ছুঁতে এলে নিজেকে আমি ছুড়ে ফেলে দেব সময়বাঁধের উপর, উনি জানেন। বলুন না রত্নাধিপতি; জানেন না?”
একজন রক্ষী এসে দাঁড়াল দরজার সামনে, হাতে উদ্যত ব্লাস্টার। স্যালুট করে সে বলল, “ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে আমাকে বলা হয়েছে, আপনার এখানে আসার পনেরো মিনিট পরে আপনার কাছে রিপোর্ট করতে, রত্নাধিপতি।”
রত্নাধিপতি বললেন, “এদের দু’জনের উপর নজর রাখো। সামান্যতম নড়াচড়া করলেই ব্লাস্টার চালাবে।”
আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। অলকা মিনারের চূড়ার কক্ষটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমার পেছনে সময়বাঁধ। মনে হল, ওখান থেকে সৌদামিনীর ফিসফিসে কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি আমি।— “দেরি করছ কেন গো? এসো না!”
রত্নাধিপতি বললেন, “আজ সকালে সুশোভনের পেট থেকে সব কথাই বার করা হয়েছে। তুমি নাকি একজন অগ্নিধারক, সুকৃষ্ণ?”
আমি বললাম, “সে কাকে বলে, আমার জানা নেই।”
রত্নাধিপতি বললেন, “অগ্নিধারণ এক অতি বিরল ক্ষমতা। সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকেনা। তোমার মধ্যে কতটা আছে, পরীক্ষা হয়ে যাক।”
তাঁর ইঙ্গিতে রক্ষী ব্লাস্টার তাক করল আমার দিকে। পকেট থেকে একটা লাইটার বার করে জ্বালিয়ে আমার হাতে অগ্নিশিখাটা ছোঁয়ালেন তিনি।
হাত পুড়ল না, আগুনটা ধিকধিক করে জ্বলতে লাগল হাতের উপর। একটু জ্বালা বা যন্ত্রণার অনুভূতি হচ্ছে না আমার। কান্তা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। আমিও চেয়ে রইলাম সেদিকে। এ ক্ষমতা যে আমার ছিল, আমি নিজেই জানতাম না।
রত্নাধিপতি গভীর শ্বাস টানলেন।— “সুশোভন একবার ভবিষ্যৎ দেখে বলেছিল, এক অগ্নিধারকের জন্যই নাকি আমার পতন হবে। কিন্তু তুমি বোধহয় সে ব্যক্তি নও, সুকৃষ্ণ। কারণ তোমার আয়ু তো আর কয়েক মিনিটের বেশি নয়।”— রক্ষীকে হাতের ইশারায় ডাকলেন তিনি; কীসব নির্দেশ দিতে লাগলেন নীচুগলায়।
কান্তা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে ফিসফিস করে বলল, “সুকৃষ্ণ, আমার মনে হয়, কবি আপনার কথাই বলছিল।”
“কবি? কবি কে?”
“সে এক অদ্ভুত মানুষ। অজানা কী এক ভাষায় কথা বলে। আমি যখন ঘুমিয়ে পড়ি, তখন সময়বাঁধ স্বপ্নের মধ্যে গলে যায়। তখন তাকে দেখেছি। এইটুকু বুঝতে পেরেছি, সে এমন একজনের কথা বলছে যে আগুনকে বুকে ধরে রাখতে পারে। প্রেমিকের চোখের একফোঁটা জলে তার মিলন হবে তার প্রিয়ার সঙ্গে।”
আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমার স্বপ্নে সৌদামিনীও তো একই কথা বলেছিল!
কান্তা আবার বলল, “কবিও আমাকে স্বপ্নে দেখে, আমিও তাকে স্বপ্নে দেখতে পাই। অদ্ভুত তার পোষাক, সে দাঁড়িয়ে থাকে অচেনা এক জগতের নদীর ধারে, তার চোখ আকাশে। কিন্তু আমার মনে হয়, সে আমাদের দেখতে পায়, সে সবার মনের কথা জানতে পারে।”
সুশোভনও বলেছিল এই লোকটির কথা। কে এ?
আর ভাবার সময় পাওয়া গেল না। রত্নাধিপতি আমাদের দিকে ফিরলেন।— “সুকৃষ্ণ। এবার তোমাকে বিদায় জানাতে হচ্ছে।”
তাঁর ইঙ্গিতে দরজার সামনে দাঁড়ানো রক্ষী ব্লাস্টার তাক করল আমার বুকে।
কান্তা বলে উঠল, “রত্নাধিপতি, থামুন। আমাকে পেতে হলে এই লোকটিরও প্রাণভিক্ষা দিতে হবে আপনাকে।”
রত্নাধিপতির সরু গোঁফের নিচে কুটিল হাসি খেলে গেল।— “না কান্তা, শুধু সুপ্রিয়কেই জ্যান্ত পেতে পারো তুমি। সুশোভনকেও নয়, এই সুকৃষ্ণকেও নয়।”
রক্ষীর দিকে ফিরলেন তিনি।— “শেষ করে দাও দেশদ্রোহীটাকে।”
সময়বাঁধের থেকে অনেকটা দূরে আমি। লাফ দিয়েও পৌঁছনো যাবে না অতটা। রক্ষীর আঙুল চেপে বসছে ট্রিগারে।
তীক্ষ্ণ একটা জান্তব চিৎকার ভেসে এল দরজার সামনে থেকে। রক্ষীর ব্লাস্টার পড়ে গেল হাত থেকে। রত্নাধিপতি চমকে উঠলেন।— “কী হল? কী হল?”
কী যে হল, সবচেয়ে ভালো দেখতে পেয়েছি আমি। আকাশ থেকে নেমে এসেছে এক মহাকায় ঈগল, তার ধারালো নখের আক্রমণে মাটিতে পড়ে গেছে রত্নাধিপতির রক্ষী। সুবিশাল ডানার ঝটপট শব্দ আর রক্ষীর আর্ত চিৎকারে ভরে উঠেছে অলকা মিনারের চূড়া।
কান্তা চিনতে পেরেছে আগন্তুককে। সে চিৎকার করে উঠল, “সুপ্রিয়!”
বিরাট পাখিটা একবার তাকাল আমাদের দিকে। রত্নাধিপতি বিহ্বল হয়ে চেয়ে আছেন, কী করবেন কিছুই যেন বুঝতে পারছেন না। রক্ষীকে পরাস্ত করে পাখিটা নেমে এল ঘরের মধ্যে।
মাটি থেকে রক্ষীর ব্লাস্টারটা কুড়িয়ে নিতে যাচ্ছিলেন রত্নাধিপতি, আমি সঙ্গে সঙ্গে লাথি মেরে সেটাকে পাঠিয়ে দিলাম দরজার বাইরে।
আরেকটা জিনিস ঝিকমিক করছিল মেঝের উপর। ঝুঁকে পড়ে কুড়িয়ে নিলাম সেটা।
রত্নাধিপতির ফেলে দেওয়া ইন্দ্রমণি।
কান্তার হাতে গুঁজে দিলাম মণিটা। বলে উঠলাম, “পালাও তোমরা!”
কান্তা বলল, “আর আপনি?”
আমি হাসলাম।— “সে ভাবনাও ভেবে ফেলেছি। তোমরা যাও।”
কান্তার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ইগলপাখিটা তীক্ষ্ণ শব্দ করে ডেকে উঠল।
নিজের চোখ থেকে একবিন্দু অশ্রু নিয়ে আমার চোখে লাগিয়ে দিল কান্তা, আর সঙ্গে সঙ্গে আমার সারা দেহে অদ্ভুত এক শীতল প্রবাহ বয়ে গেল। মনে হল, আমার শুকনো শরীরের কোষে কোষে যেন ঝরনা খুলে গেছে। অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম আমি।
কান্তা বলল, “প্রেমিকের অশ্রু। আপনার সঙ্গে আপনার সৌদামিনীর যেন কখনও বিচ্ছেদ না হয়, সুকৃষ্ণ।”
আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে অদ্ভুত এক আনন্দের অনুভূতিতে। সুপ্রিয় আবার ডাকল শব্দ করে।
কান্তা বলল, “ও বলছে, ফেরার পথে সুশোভনকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব আমরা। আপনি যান, সুকৃষ্ণ, কবির সঙ্গে দেখা করুন। আপনার ললাটে অমরত্বের ছাপ আছে। উনি আপনার কাহিনিকে অমর করে রাখবেন।”
রত্নাধিপতি দু-হাত বাড়িয়ে ধরতে এলেন তাকে।— “কান্তা! আমি তোমাকে যেতে দেব না।”
কান্তার মুঠো শক্ত করে চেপে ধরল ইন্দ্রমণিকে। আকারান্তর হতে একমুহূর্তও সময় লাগল না। দুটো বিশাল ঈগল উড়ে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে, পাক খেতে লাগল অলকা মিনারের সুউচ্চ চূড়ার চারপাশে।
রত্নাধিপতির চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। চিৎকার করে উঠলেন তিনি।— “কান্তা! দাঁড়াও! যেও না! আমি তোমাকে চাই। যেও না কান্তা!”
অন্ধের মতো তিনি এগিয়ে গেলেন ছাদের প্রান্তের দিকে। কান্তা এসে বসল কার্ণিশে।
আবার তাকে পাগলের মতো ছুটে ধরতে গেলেন তিনি। কান্তা উড়ে গেল। রত্নাধিপতির শরীরটা ছাদ পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল নিচে।
নিচে পৌঁছবেন যখন তিনি, তখন দেহটা আর চেনা যাবে কিনা সন্দেহ।
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। আসছি, সৌদামিনী!
রক্ষী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। আমার শরীরের মধ্যে সহস্র জলবিন্দু যেন তাল পাকাচ্ছে। অদৃশ্য সময়বাঁধের ওপারে অপেক্ষা করে আছে আমার সৌদামিনী।
আর দেরি নয়। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে স্পর্শ করলাম সময়বাঁধের অদৃশ্য পর্দাকে। এক মুহূর্তের জন্য ঝলসে উঠল নীল বিদ্যুৎ। চেতনা লুপ্ত হওয়ার মুহূর্তেও বুঝতে পারলাম, আমার শরীরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেসে চলেছে যেন এক তাল কালো ধোঁয়ার মতো; সে ভেসে চলেছে অজানা এক স্রোতের সর্বগ্রাসী টানে।
তারপরেই জ্ঞান হারালাম আমি।
***
জ্ঞান যখন ফিরল, তখনও আমি ভাসছি। সারা শরীর কী ভীষণ হালকা লাগছে! মাটি থেকে এত উপরে ভাসছি যে অনেক নিচে মানুষগুলোকে পিঁপড়ের মতো লাগছে।
আমার ধোঁয়ার শরীরের শিরায় শিরায় ছুটছে শীতল জল, আর আমার বুকে…
নীল বিদ্যুতের শিখায় হেসে উঠল সৌদামিনী।— “ঘুম ভাঙল বুঝি? চলো চলো, নিচে চলো, কবি অপেক্ষা করছেন।”
“কবি কে, সৌদামিনী?”
“সে আছেন এক অদ্ভুত মানুষ। চলো না দেখবে।”
নেমে এলাম আমরা; নদীর পাড়ে তখন জমা হয়েছে বিচিত্র পোষাকের কত মানুষ। আকাশে আমাকে দেখে তাদের কী উল্লাস।
একটা ছোট্ট ছেলে চেঁচিয়ে উঠল, “বিষ্টি হবে! বিষ্টি হবে!”
পাহাড়ের উপর নেমে এলাম আমি, আমার বুকে সৌদামিনী। সে বলল, “ওই যে! উনি!”
দেখিয়ে না দিলেও ওঁকে চিনতে পারতাম আমি। ওই চোখের দৃষ্টি, ওই স্বপ্নময় মুখ— কোনও মানুষের মধ্যে এমনটি আগে কখনও দেখিনি।
আমার ছায়া পড়েছে ওঁর চোখে; অদ্ভুত নিবিড় আবেশমাখা দৃষ্টিতে উনি দেখছেন আমাকে। আমার ইচ্ছে হচ্ছে ওঁকে সব বলি— আমার কথা, সুপ্রিয় নামের এক কর্তব্যে অবহেলা করা যক্ষের কথা, তার কান্তাবিরহের কথা— সব। কথা বলতে গেলাম, কিন্তু গলা দিয়ে বেরোল বিচিত্র এক গর্জনধ্বনি।
আর আমি মানুষের ভাষা বলতে পারি না!
ওঁর মায়াময় চোখে উনি দেখছেন আমাকে। কেন জানি না, মনে হল, উনি আমার অন্তরটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন।
আমাদের দিকে ফিরে উনি স্বগতোক্তি করলেন, “মেঘ, তোমাকে আমি অমরত্ব প্রদান করব মন্দাক্রান্তায়।”
আমরা স্থির হয়ে রইলাম; আর সেই দিকে ধ্যানাবিষ্টের মতো তাকিয়ে থেকে সুমিষ্ট গম্ভীর কণ্ঠস্বরে উনি আবৃত্তি করতে লাগলেন—
“কশ্চিৎ কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ
শাপেনাস্তংগমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেণ ভর্তুঃ।”
আমার বুকে মহানন্দে ঝিলিক দিয়ে উঠল সৌদামিনীর উজ্জ্বল নীলাভা। আমার সর্বশরীর কাঁপছে অমরত্বের আস্বাদে; আর তখনও কবি করে চলেছেন অনর্গল অমৃতবর্ষণ—
“আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।।”
Tags: পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ফ্যান্টাসি, বড় গল্প, সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়, সৌরভ দে
এপিক! এমন এক-আধটা গল্প পড়তে পেলে সারা বছরের সব হতাশা আর মালিন্য কেটে যায়।
অনেক ধন্যবাদ, ঋজুবাবু। আপনার মতামতের গুরুত্ব আমার কাছে অনেক। ভাল থাকবেন।
ঠিক এরকম গল্প পড়তে গেলেই গায়ে কাঁটা দেয়।ধন্যবাদ।
আপনার ভালো লেগেছে জেনে আনন্দ পেলাম। শুভেচ্ছা নেবেন।
অসাধারণ হয়েছে. লেখা চালিয়ে যাস. খুবই ভালো লাগলো.
অনেক ধন্যবাদ রে। ভাল থাকিস।
সত্যিই অসাধারন লাগল গল্পটা। আপনার কল্পনার তুলনা হয় না। মনে হয় যেন স্বয়ং কালিদাসই ফিরে এসেছেন। অনেক আশায় থাকলাম এরকম আরও গল্প শুনতে।
আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুব আনন্দ পেলাম, স্যার। আশীর্বাদ করবেন।
এমন গল্প পড়তে পাওয়াটা ভাগ্যের বিষয়। ধন্যবাদ দাদা আপনাকে।
তোমার ভাল লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম, বোন।
অপূর্ব। সায়েন্স ফিকশন আর ফ্যান্টাসির মিশেল। অসাধারণ ভাষা আর কাহিনির মানানসই চলনে লেখাটি অনবদ্য হয়ে উঠেছে। খুব উপভোগ করলাম।
অনেক ধন্যবাদ, দাদা। আপনার মত মানুষদের প্রশংসা সত্যিই সাহস দেয়। শুভেচ্ছা নেবেন।