বোক্কো-চান
লেখক: শিনিচি হোশি, বাংলা অনুবাদ: সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
শিল্পী: জটায়ু
এক সুরা-সুন্দরীর কাহিনি, যার হৃদয়টা মোটেও সোনায় মোড়া ছিল না
রোবটটাকে রীতিমতো একটা নিপুণ শিল্পকর্মের নিদর্শন বলা যায়। সে একটা মেয়ে রোবট, হোক-না কৃত্রিম, তাকে বানানো হয়েছিল একেবারে তিলোত্তমার মতো যত্ন করে। একটি সর্বাঙ্গসুন্দর নিখুঁত আকর্ষণীয়া রমণী হিসেবে গড়ে তুলতে যা-যা প্রয়োজন, সবকিছু মাথায় রাখা হয়েছিল তাকে বানানোর সময়ে। মুশকিল হল, মেয়েটাকে দেখে স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশিই ভদ্র বলে মনে হত। ভদ্র, নম্র, অতিমাত্রায় শালীন হলে যেমন হয়। তবে এ-কথা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না, যে শালীনতাবোধ বজায় রাখাটা প্রায়শই নারীর সৌন্দর্যের অপরিহার্য একটা পূর্বশর্ত বলে গণ্য করা হয়।
ইতিপূর্বে আর কেউ বোধহয় এমন কোনও রোবট বানানোর উদ্যোগ নেননি। আসলে, যেখানে একই খরচা দিয়ে কেউ অনেক বেশি কার্যকর একটা যন্ত্রমানব বানাতে পারে, বা যেখানে বিধিবদ্ধ বিজ্ঞাপনের পাতায় ‘কর্মখালি’র কলামের প্রেক্ষিতে গাদা-গাদা আবেদনপত্র জমা হয়, তাদের মধ্যে থেকে বেছে কয়েকজন ঢের যোগ্য, উপযুক্ত ‘মানুষ’ কর্মীকে স্বচ্ছন্দে বহাল করা যায়, তার পরিবর্তে এই সুন্দরী মেয়ে রোবট বানানোর ব্যাপারটা বেশ বোকাবোকা।
যদিও, এই রোবটটি মূলত বিনোদনের জন্য, মনোরঞ্জনের জন্যই বানানো হয়েছিল। একটা বিশেষ পানশালার মালিক ছিলেন তার হোতা। কথায় আছে, শুঁড়িখানার মালিক সাধারণত সুরাপান করে না। এই লোকটিও ছিল তেমনই। তার জন্য মদ শুধুমাত্র একটা বেচার জিনিস, নিজে খেয়ে ফুর্তি করে ওড়ানোর জন্য নয়। আর যেসব হদ্দ মাতালেরা ঘনঘন তার পানশালায় হানা দিত, তাদের উড়িয়ে যাওয়া পয়সার দৌলতেই সে তার অবসর সময়ে নিজের শখ শৌখিনতা নিয়ে ভাবার অবকাশ পেত।
দেখতে গেলে, তার শখটা একটু অদ্ভুত। সেটা ছিল, এক অতি আকর্ষক রোবটসুন্দরী বানানো!
যেহেতু এটাই তার একমাত্র শখ ছিল, তাই রোবটটাকে মনের মতো করে গড়তে সে পরিশ্রম বা অর্থব্যয় কোনওকিছুতেই কার্পণ্য রাখল না। যেমন, রোবটকন্যের গায়ে এমন এক কৃত্রিম ত্বকের আস্তরণ দেওয়া হল, যা এতটাই মসৃণ, যে সত্যিকারের কোনও যুবতীর গায়ের চামড়ার সঙ্গে তার ফারাক বোঝা দায়। এটা বললেও খুব একটা অত্যুক্তি হবে না, যে সে চারপাশের খাঁটি সুন্দরীদের চেয়েও বেশি মোহময়ী ছিল।
দুর্ভাগ্যবশত, অজস্র ডাকসাইটে সুন্দরীর মতো তারও, মগজটা ছিল প্রায় শূন্য। কারণ আর কিছুই নয়, তার কারিগরের এর চেয়ে বেশি জটিল মস্তিষ্কের নকশা বানানোর ক্ষমতা ছিল না। তাকে কোনও প্রশ্ন করলে সে শুধু কোনওমতে যা-হোক একটা সরল জবাব দিতে পারত, আর সামান্য কিছু নড়াচড়ার কাজ করতে পারত, যেমন হয়তো এক পাত্র সুরা পান করা, এইরকম আরকী।
পানশালার মালিক তার নাম দিল “বোক্কো-চান।” তাকে দোকানের কাউন্টারের পিছনে একটা চেয়ারে কায়দা করে বসিয়ে দিল— যাতে খরিদ্দাররা তার খুব বেশি কাছে না আসতে পারে। মালিকের ভয় ছিল, কাছে এলে খুঁটিয়ে দেখলে হয়তো রোবটের পায়ের দিকে খণ্ডিত খুরের মতো অংশটা তাদের চোখে পড়ে যেতে পারে। যাদের অর্থানুকূল্যে এমন রমরমা ব্যাবসা চলছে, তারা এসব জেনে গেলেই তো বিপত্তি। অতএব…
সুতরাং পানশালায় নতুন একটি মেয়ের আবির্ভাব ঘটল। আগত সব সুরাপ্রেমী তাকে উৎফুল্ল হয়ে অভিবাদন জানাল। সেও যথাসাধ্য সন্তোষজনকভাবে প্রতিক্রিয়া দিল, অবশ্য যতক্ষণ অবধি তাকে তার নাম বা বয়স ছাড়া অন্য কিছু জিজ্ঞাসা না করা হল, ততক্ষণই। তারপরেও, যখন গণ্ডগোল প্রায় বেধেই গেছিল, তখনও কি ভাগ্যিস কেউ খেয়াল করে ফেলেনি, যে সে একটা রোবট।
“তোমার নাম কী, সুন্দরী?”
“বোক্কো-চান।”
“তোমার বয়স কত?”
“আমি এখনও যুবতী।”
“বেশ, বেশ, তা তুমি কতটা যুবতী, শুনি?”
““আমি এখনও যুবতী।”
“আমি বলতে চাইছি, তুমি ঠিক কতটা যুবতী?”
“আমি এখনও যুবতী।”
সৌভাগ্যবশত, পানশালাটির সেইসব মালদার খদ্দেররা যথেষ্ট ভদ্র ছিলেন, তাই এর পর বয়স সংক্রান্ত এই প্রশ্নোত্তরের সিলসিলা আর দীর্ঘায়িত করেননি।
“তোমার পোশাকটি তো চমৎকার, গো!”
“আমার পোশাকটি চমৎকার, তাই না?”
“আচ্ছা, সবচেয়ে বেশি তোমার কী ভালো লাগে?”
“আচ্ছা, সবচেয়ে বেশি আমার কী ভালো লাগে?”
“তুমি কি একপাত্র… ধরো, জিন ফিজ নেবে?”
“আমি একপাত্র… ধরি, জিন ফিজ নেব।”
বোক্কো-চান মদ খাওয়া নিয়ে কোনও বাহানা করত না। কেউ সাধলে কখনও মানা করত না। এমনকী তার কখনও নেশাও হত না।
আকর্ষণীয়া, তন্বী, স্বভাবে নম্র এবং কথাবার্তায় সপ্রতিভ। পানশালার এই নতুন মেয়েটির কথা সবার মুখে-মুখে ছড়াতে লাগল। সেইসঙ্গে নতুন-নতুন খদ্দেরের সংখ্যাও বাড়তে লাগল সেখানে। প্রত্যেকেই মোহময়ী বোক্কো-চানের সঙ্গলাভের আশায়, তার সঙ্গে বসে দু-দণ্ড বার্তালাপ করতে বা কয়েক পেয়ালা সুরাপান করতে বেজায় আগ্রহী। মোদ্দা কথা, সেই রূপসী সবারই দিল খুশ করে দিল।
“আমাদের মধ্যে কাকে তোমার সবচেয়ে পছন্দ?”
“তোমাদের মধ্যে কাকে আমার সবচেয়ে পছন্দ?”
“তোমার কি আমাকে ভালো লাগে?”
“আমার তোমাকে ভালো লাগে।”
“বেশ, তাহলে চলো না, আমরা কোনও একটা সিনেমা দেখে আসি?”
“আমরা কখন যাব?”
যখনই বোক্কো-চান কোনও একটা প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগ হত, বা বেকায়দায় পড়ত, ঠিক তখনই তার মনিবের কাছে সে একটা সংকেত পৌঁছে দিত, আর তৎক্ষণাৎ তাকে উদ্ধার করতে তিনি অকুস্থলে হাজির হয়ে যেতেন।
“এই যে বাবুমশাই, এমন একটা নিষ্পাপ মেয়ের সঙ্গে অসভ্যতা করছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে?”
শুঁড়িখানার মালিকের এমন কড়া তিরস্কারে বেচারা নাছোড়বান্দা যুবকটি গুটিগুটি পায়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে সরে পড়ে বটে, তবে মনে মনে গজগজ করতে থাকে।
মালিক ভদ্রলোক মাঝেমধ্যেই বোক্কো-চানের পায়ের কাছে গুঁড়ি মেরে বসে পড়ে কী যেন একটা করতেন। তার পায়ের ওখানে একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের নল লাগানো আছে, নলের মুখটা বাইরে বের করা। ওই নলের সাহায্যে দোকান মালিক খুব সাবধানে পানীয় তরলটা বের করে আনতেন, যা একটু আগেই বোক্কো-চান ‘খেয়েছিল’। হিসেবি মানুষ হওয়ায়, তিনি ফের সেই তরল নয়া পানপাত্রে ঢেলে খদ্দেরদের বিতরণও করতেন দিব্যি। স্বভাবতই, পানশালার মহান পৃষ্ঠপোষকদের কেউই এই ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও টের পেতেন না, আর তাই, সেই নারী রোবটের ভূয়সী প্রশংসা করতে তাঁরা কোনও কসুর করতেন না। তাঁরা ওর রূপ যৌবনের তারিফ করতেন, তার শালীন স্বভাব চরিত্র, সে যে কখনও তোষামোদে গলে যেত না, বা মদ্যপানে কখনও ক্লান্ত হত না, মাতলামিও দূর অস্ত, এইসব চমকপ্রদ গুণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন। তো, এইভাবেই বোক্কো-চানের জনপ্রিয়তা, খ্যাতি, আর সেইসঙ্গে পানশালার আগন্তুকের সংখ্যা— উভয়েই ক্রমে ক্রমে উত্তুঙ্গ শিখর ছুঁচ্ছিল।
বোক্কো-চানের অগণিত ভক্তের মধ্যে একটি যুবকও ছিল। আর সেই যুবকের তার প্রতি আসক্তি এতটাই চরমে উঠেছিল, যে প্রতি সন্ধ্যায় একবার করে তাকে শুধু চোখের দেখা দেখতে সে ওই পানশালায় হানা দিত। রাতের পর রাত সে তার সঙ্গে কথা বলে যেত একটাই আশা নিয়ে। হয়তো কোনওদিন বোক্কো-চান তার সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যেতে রাজি হবে। কিন্তু প্রতিবারেই সে ব্যর্থ হত। বোক্কো-চানের আপাত নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়া তাকে যেন আরও উত্তেজিত করে তুলত। পাগলের মতো হয়ে সে আরও বেশি বেশি করে মেয়েটাকে পটানোর জন্য কসরত করে যেত। ওই পানশালায় ঘনঘন যাতায়াতের ফলে তাকে বেশ মোটা অঙ্কের বিল চোকাতে হত। ধারবাকিতেই মদ খেত, তবে কিছুদিন অন্তর যেই দোকানের মালিক তাকে পুরোনো বিলের দাম মিটিয়ে দিতে বলত, বাধ্য হয়ে তখন তাকে নিজের বাবার পকেটও মারতে হত, নইলে যে দিন-দিন ধারের বোঝা বেড়েই যাচ্ছিল।
একবার এই করতে গিয়েই সে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল বাবার কাছে। ব্যাস, আর যায় কোথা! সে এক তিক্ত অভিজ্ঞতা বটে। কথায় কথায় তার বাবা অবশেষে ছেলেটিকে ধারের বাকি টাকা দিতে সম্মত হলেন, চুরি করতে হবে না। এমনিই দেবেন। শুধু শর্ত একটাই। বকেয়া মিটিয়ে আসার পর আর কোনওদিন যেন সে ওই বার-মুখো না হয়। এটুকুই।
সেই সন্ধ্যায় ছেলেটি পানশালায় ফিরে এল। বিলের টাকা মেটানোটাই উদ্দেশ্য ছিল, তবে যেহেতু এটাই তার শেষ আগমন, যতটা পারে ততটা মদ আকণ্ঠ পান করল সে। আর, বোক্কো-চানকেও কিছু বলবে বলে তার সামনে এসে বসল। নেশায় লাল দুটি চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আর এখানে কোনওদিন আসব না।”
“তুমি আর এখানে কোনওদিন আসবে না।”
“তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?”
“আমার কষ্ট হচ্ছে।”
“আসলে, তুমি বোধহয় খুব একটা দুঃখিত নও, তাই না?”
“আসলে, আমি তা নই।”
“আর কোনও মেয়ের তোমার মতো এমন নির্মম, হিমশীতল হৃদয় দেখিনি গো।”
“আর কোনও মেয়ের আমার মতো নির্মম, হিমশীতল হৃদয় নেই।”
“আমি কি তোমায় খুন করব?”
“তুমি কি আমায় খুন করবে?”
যুবকটি পকেট থেকে কী একটা ওষুধের পুরিয়া বের করল। একটা পানপাত্রে গুঁড়োটা ঢেলে দিল সবটুকু, তারপর সুরাপূর্ণ পাত্রটা আলতো করে এগিয়ে দিল বোক্কো-চানের সামনে।
“তুমি এটা পান করবে? নাও।”
“আমি এটা পান করব।”
বোক্কো-চান সুদৃশ্য পাত্রটি তুলে ধরল। তারপর সবটুকু হাসিমুখে গলায় ঢেলে খালি করল।
“জাহান্নামে যাও! কী, যাবে তো?” ছেলেটা বলল।
“আমি জাহান্নামে যাব।”
ছেলেটা তড়িঘড়ি মালিকের কাছে গিয়ে বকেয়া সমস্ত বিল মিটিয়ে একছুটে রাত্রির গভীর অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
পানশালার ঝাঁপ ফেলার সময় প্রায় হয়ে এসেছিল। মালিকের আজ মনে বেজায় ফুর্তি। এত বড় একটা ধারের টাকা একদিনে পুরোটা হাতে চলে আসা কি কম কথা? সে দ্রুত বোক্কো-চানের পায়ের কাছ থেকে তার পান করা পানীয়র অংশটুকু উদ্ধার করে সেটা বেশ ক-টা গ্লাসে সমানভাবে মিশিয়ে দিল। সবার জন্য ককটেল। যে ক-জন এখনও রয়ে গেছে এখানে।
“এই নিন ভাইসব। আজ আমার তরফ থেকে রইল এটা আপনাদের সবার জন্য। বিনামূল্যে। আসুন, আমরা একসঙ্গে উদযাপন করি।” মালিক চেঁচিয়ে বললেন।
সবাই খুশিমনে চিয়ার্স বললেন। আজ পানশালার মালিকও স্বয়ং তাদের সঙ্গে পান করছেন। ওই একই পানীয়।
সেই রাতে কেউ ওই পানশালার আলো বন্ধ করল না। রেডিয়োটায় সমানে গান বেজেই চলল, সারা রাত ধরে। কেউ বেরল না সেখান থেকে; তবু, কেউ কোনও কথাও বলল না।
তারপর অবশেষে সেই সময় উপস্থিত হল, যখন রেডিয়োতে ঘোষকের কণ্ঠস্বর বলল, “শুভরাত্রি”, বেতারে সম্প্রচারের নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়েছিল যে।
“শুভরাত্রি”, বোক্কো-চান বলে উঠল পানশালার অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙে। সে তখনও তার নম্র ভদ্র হাবভাব নিয়ে স্মিত হাসিমুখে অপেক্ষা করছিল, কখন পরবর্তী একটি মানুষ আবার তাকে ডাকবে।
মূল লেখক: শিনিচি হোশি (১৯৬৩)
মূল জাপানি থেকে ইংরেজি অনুবাদ: নরিওশি সাইতো
Tags: অনুবাদ গল্প, জটায়ু, নরিওশি সাইতো, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, শিনিচি হোশি, সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
দারুন গল্প। ভাল লাগল খুব।