ভারসাম্য
লেখক: অনুষ্টুপ শেঠ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
খস খস খস…
শব্দটা অচেনা।
কাজ থামিয়ে সবাইই ঘুরে তাকিয়েছিল দরজার দিকে। কিন্তু বন্ধ-হয়ে-থাকা চৌকো ধাতব দরজায় নিজেদের ছায়া ছাড়া চোখে পড়ার মতো কিছুই ছিল না।
বাইরে কেউ এসে দাঁড়ালে দরজার সারফেসে তার ছবি ফুটে ওঠে। সে এমনকি একটা রোবো স্নিফার কুকুর হলেও।
কিচ্ছু ছিল না। অথচ খসখস শব্দটা তখনও সবাই শুনতে পাচ্ছিল।
মনিটরিং ডিভাইসে সুপারভাইজ়ার বটের ধমক ভেসে আসতে ওরা আবার মুখ ফিরিয়ে নিজেদের কাজে মন দিল। আজকে কাজটা অন্যদিনের চেয়েও ক্লান্তিকর একঘেয়ে, সামনের ইমোট্যাবে পরের পর প্রশ্ন ফুটে উঠছে: “অমুক তোমায় তমুক কাজটা করতে বললে তোমার কেমন লাগবে?” “তুমি কতবার মিথ্যা বলেছ? ১-১০-এর স্কেলে নিজেকে কত দেবে মিথ্যাবাদী হিসাবে?” ওদের ভূমিকা শুধু বসে থাকার। পাঁচ বছর আগে হলে উত্তর বলতে হত, একশো বছর আগে হলে নাকি মুখেও বলা যেত না, একটা বিদঘুটে দেখতে চ্যাপটা জিনিসের বোতাম টিপে টিপে লিখতে হত। এখন ওদের মাথায় পরানো হালকা টুপিটার অসংখ্য প্রোব সরাসরি মাথা থেকে ওদের ভাবনাচিন্তা পড়ে ফেলতে পারছে।
এইজন্যই অর্ণ সকালে এই বায়োরিসার্চ হলে ঢুকলেই মাথা একেবারে খালি করে ফেলতে চেষ্টা করে।
অবশ্য ওর মাথায় যে খুব বেশি কিছু বুদ্ধি আছে, তাও না। থাকলে তো সে বিজ্ঞান শিখত, স্পেস পাইলট হত বা নিদেনপক্ষে মেডিক্যাল অফিস জয়েন করত!
অথচ এ-ও ঠিক, ওর সঙ্গে যারা এখানে সারাদিন কাটায়, সেই রুকিতা, চিয়ানো, সাঙ্গ বা ইলমের মতো অতটাও নিরেট সে নয়। মাঝে মাঝেই রোবটদের বেশ কিছু কোডে বলা কথার মানে তার কাছে স্পষ্ট ধরা পড়ে।
মনেও রাখতে পারে সে ওদের থেকে বেশি।
যদিও টের পেতে দেয় না। প্রাণপণে সেসব লুকিয়ে রাখে সে, কারণ তার মা পইপই করে শিখিয়ে রেখেছে—প্রান্তিকদের ভাবনাচিন্তা করা উচিত নয়। উচিত নয় শুধু না, বিপজ্জনক।
***
হ্যাঁ, প্রান্তিক। অর্ণ আর তার সঙ্গে ল্যাবে আসা এই ছেলেমেয়েরা, তাদের ভাইবোন, বাবা-মায়েরা—সবাই ওই নামেই পরিচিত।
বহুকাল আগে মানুষের জিনে নানারকম বৈচিত্র্য থাকত। ২০৯০ সাল থেকে জেনেটিক রিইঞ্জিনিয়ারিং একেবারে পুরোদমে শুরু হয়, যা তারপর এই ৪০ বছর ধরে সবরকম জিনকেই নতুন করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়ে উঠেছে।
ফলে আজকাল প্রায় সমস্ত মানুষই নিখুঁত স্বাস্থ্য আর উন্নত ব্রেন নিয়ে জন্মায়।
কিন্তু মানবজিনের বৈচিত্র্য এক অদ্ভুত জিনিস, যা এখনও, এত বছর পরেও আচমকা আচমকা ফুটে বেরোয়। তখন ইলমের মতো বাচ্চারা জন্মায়, বাবা-মা স্বাভাবিক হলেও যে দুর্বল ব্রেনের, কম বুদ্ধির। তারা বড়ো হয়েও কিছুই সেভাবে করে উঠতে পারে না। শুরুর দিকে এসব বাচ্চাকে সবরকম সহযোগিতা দিয়ে মূলস্রোতে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যে করা হয়নি তা নয়, কিন্তু দেখা গেল, এরা কিছু শেখালেও শিখতে পারে না, বোঝালেও বুঝে ওঠে না। তখন শুরু হল যত রাজ্যের অবাঞ্ছিত, হেলাফেলার কাজগুলো তাদের ধরিয়ে দেওয়া। দেখতে দেখতেই সেটাই হয়ে গেল দস্তুর।
তারপর দেখা গেল, এদের সন্তানসন্ততিরাও প্রায় সবাই এমনই অল্প বুদ্ধির হয়েই জন্মাচ্ছে।
সম্ভাবনা তত্ত্ব অনুযায়ী সেটাই স্বাভাবিক যদিও, কারণ কোনো সাধারণ—মানে এখন সাধারণ বলতে যেমন উন্নত মেধার দক্ষ মানুষ বোঝায়, তেমন মানুষ তো আর যেচে এরকম নিরেট কারও সঙ্গী হবে না! ফলে এরা সন্তান উৎপাদন করছে নিজেদের মধ্যেই।
ক্রমে এদের বাসস্থানও সরে গেল মূল নগরগুলো থেকে। বিচ্ছিন্ন আর সংকুচিত এক জীবনধারা গড়ে উঠল সব নগরের প্রান্তে প্রান্তে, আর তখনই ‘নিরেট’ সম্বোধন সরে গিয়ে এই সুশ্রাব্য নামটা পেল তারা—প্রান্তিক।
অজস্র আধুনিক সুবিধা ব্যতিরেকেই এই মানুষের দল বাঁচে, অপর্যাপ্ত আহার্যে সন্তুষ্ট থাকে, অন্য সব মানুষের অপছন্দের কাজগুলো করে, রোবট তদারককারীর কড়া শাসনে বাধ্য থাকে। তাদের শিশুদের এখন গ্রহের উন্নত শিক্ষাপদ্ধতিতে যুক্ত করাই হয় না আর।
তাতে কিন্তু মানুষগুলো নির্বিকার। অল্পবুদ্ধি, তাই এই অসাম্য, এই অপ্রাপ্তিগুলোর কিছুই তাদের মগজে দাগ কাটে না। তবে ভেবো না তারা নিরীহ ও নির্বিবাদী। নিজেদের মধ্যে কলহ-কাজিয়া করতে তাদের কিছুমাত্র ক্লান্তি নেই।
সেই হয়তো তাদের একমাত্র বিনোদন।
অর্ণ অবশ্য দিনের শেষে অন্য বিনোদন খুঁজে পেয়ে গেছে গত কয়েক বছর। তাদের আবাসনের অন্য প্রান্তে থাকা নাথুয়ার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আচমকাই। রোজ কিছুক্ষণ তারা একসঙ্গে সময় কাটায়। খ্যালে। খেলা মানে প্রপার খেলা নয়, মানে ভিডিয়ো গেম খেলা ওদের সাধ্যের বাইরে… ওরা খ্যালে ঘরের বাইরে… দৌড়োদৌড়ি করে, কি কুড়িয়ে-পাওয়া একটা ভারী ধাতুর লাল বল নিয়ে…
আদিম মানুষদের মতো।
***
গ্রহের আসল মানুষেরা, মানে যারা সব দিক দিয়ে নিখুঁত, যাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রয়োগে যুগান্তর গ্রহ এত সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে, তাদের বেশির ভাগ এতদিনে হয়তো এদের অস্তিত্ব ভুলেই গেছে।
যুগান্তর?
হ্যাঁ, বর্তমানের মানুষের বসবাস এই গ্রহেই। পৃথিবী বহু আগেই যুদ্ধবিগ্রহ ও পরিবেশদূষণের ফলে মৃত, পরিত্যক্ত। তার শেষ দশায় মানুষদের টিকে থাকার শেষ চেষ্টা হিসাবে যুগান্তরের দিকে পাড়ি দেয় বিশাল স্পেসশিপ ‘নোয়া’জ় আর্ক ২০৭০’। পৃথিবী জুড়ে তখন মৃত্যুর ছায়া এতই গাঢ় যে এই যাত্রার সূচনা থেকে ঘটনা—এই মাত্র সাত মাসের মধ্যেই পৃথিবীর তৎকালীন জনসংখ্যা দশ ভাগের এক ভাগ হয়ে গিয়েছিল।
অবশ্য তাতে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছিল, নইলে স্পেসশিপে জায়গা পাওয়ার সুযোগের জন্যই আরেক দফা যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত।
যারা পাড়ি দিয়েছিল, তারাও প্রাণ হাতে নিয়েই এসেছিল। শেষ অবধি যে শুধু টিকে যাবে, তা-ই না, এই গ্রহে আবার নতুন করে মানবসভ্যতা পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়ে উঠবে, সেটা কেউই তখন কল্পনাই করেনি।
তবে, সেজন্য তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
যুগান্তরের ঘূর্ণন সূর্যের চারদিকে নয় যে! পৃথিবীর তুলনায় অনেক ছোটো এই গ্রহটি ‘শক্তিপুঞ্জ’ নামের যে বস্তুটির চারদিকে ঘুরছে, তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘পালসার’, বা ‘নিউট্রন তারকা’। তীব্র চৌম্বক বিকিরণ-করা এই তারকার গ্রহগুলো সাধারণত বসবাসের উপযোগী হয় না, কারণ বাতাস থাকতে পারে না। প্রকৃতির খেয়ালে এই একটি গ্রহের ক্ষেত্রে শুধু যে বাতাস ছিল, তা-ই না, অত্যন্ত ভারী গ্যাস থাকায় সেটা যথেষ্ট ভারী আচ্ছাদনের মতোই ছিল। সেই সঙ্গে ছিল ভূগর্ভস্থ জলের আধার। এ দুটোর সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সব প্যারামিটারও আশাব্যঞ্জক ছিল, কিন্তু শেষ অবধি মানুষ যে সত্যিই সেখানে বাঁচতে পারবে, কেউ নিশ্চিত ছিল না। অথচ উপায়ও ছিল না আর, পৃথিবীর সময়ও দ্রুত ফুরোচ্ছিল। তাই যুগান্তরের বর্তমান বাসিন্দাদের পূর্বপুরুষেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন—এমনিতেও মরব, অমনিতেও। যাওয়া যাক!
কে জানে, অর্ণর কততম পূর্বপুরুষ ছিলেন সেই যানে।
কে জানে, ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর মনে কী স্বপ্ন ছিল!
***
খস খস খস খস…
শব্দটা বন্ধ হয়নি এখনও। ক্লান্তিতে মাথা ঢুলে পড়তে চাইছে এবার… আজ যেন সেশন শেষই হচ্ছে না! ঘড়ি নেই ওদের কাছে, বা স্ক্রিনেও সময় দেখায় না। ওসব নাকি অল্পবুদ্ধিদের জন্য ডিস্ট্র্যাকশন। একটা করে সেশন ফুরোলে সুপারভাইজ়ার বট ঘোষণা করে জানায়, ওরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম পায়। এরকম তিন বা চারবার হয় দিনে, তার মধ্যে একবার ওদের খাবার আসে। এইটে ভাবতে খেয়াল হল অর্ণর, আজ তো সেটাও আসেনি!
এইজন্য এত ক্লান্ত লাগছে…
ট্যাবের উপর লেখাগুলো দপদপ করছে। পড়তে ইচ্ছে করছে না ওর। বাড়ি যাবে… কতক্ষণে?
কোনো ঘোষণা ছাড়া, কোনো প্রস্তুতি না দিয়েই ওদের পিছনের দরজাটা এক ঝটকায় দু-হাট করে খুলে গেল। ধাতব পদক্ষেপে ঘরে যারা ঢুকল, লাল ধাতব বর্ম আবৃত সেই আধা-মানুষ আর আধা-মেশিন প্রজাতির একটাই পরিচয়।
‘রেড মেশিনারি’। যুগান্তরের সেনাদের মধ্যে সব চেয়ে কঠোর, সব চেয়ে নিপুণ যোদ্ধাদল।
***
নাথুয়া বিবর্ণ প্লাস্টিকের দেওয়ালটার আড়ালে সামান্য খাঁজটায় নিজেকে লুকিয়ে রাখছিল কোনোমতে। এমনিতেই চারদিকে যা যা ঘটে, তার সব কিছু ও খুব পরিষ্কারভাবে বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না। আঠেরো হবার পর থেকে তাকে প্রতিদিন যা করতে হয়, তার খাটনি এত বেশি যে আর কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো এনার্জিও থাকে না ওর।
শরীর-স্বাস্থ্য ভালো নাথুয়ার। ফলে ওর কাজ হল মানুষদের জন্য বানানো নন-হ্যাজ়ার্ডাস জিনিসপত্রের পরীক্ষার ডামি হওয়া। বিপজ্জনক না, কিন্তু খুব পরিশ্রমের। যেমন ধরো, পরশু সারাদিন ধরে ওকে কাপের পর কাপ পানীয় হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে, বিভিন্ন গড়নের, বিভিন্ন বস্তু দিয়ে বানানো আলাদা আলাদা কাপ। কোনটা ব্যবহার করার স্বাচ্ছন্দ্য সব চেয়ে বেশি, তার পরীক্ষা চলছিল।
সারা গায়ে প্রোব-লাগানো অবস্থায় অতক্ষণ হেঁটে বেড়ানোর ধকল কতখানি, না করলে বোঝা সম্ভব নয়। সেজন্যই তো এরকম ‘সহজ’ কাজগুলো উন্নত মানুষেরা কেউই করতে চায় না!
নাথুয়া ঘরে ফেরে হা-ক্লান্ত হয়ে। একমাত্র অর্ণর সঙ্গে খেলার আনন্দটুকু তাকে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে তলিয়ে যেতে দেয় না। আজ ফিরে অর্ণকে খুঁজে পায়নি সে; হতাশ হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল সে, যখন আওয়াজটা শুনতে পায়।
নিজের কোটরে মুখ গুঁজে দিন কাটানোর ফলে বাতাসে ভেসে-বেড়ানো গুজগুজানি—‘হুঁশিয়ার হতে হবে। কী সব হবার কথা হচ্ছে’… বা কাজের জায়গায় ওর সামনেই কোনো বিজ্ঞানীর বেফাঁস বলে-ফেলা কথা—‘আরে, আমাদের কিছু হবে না, বাড়তি মানে তো—’… এসব কিছুই নাথুয়ার মনে দাগ কাটতে পারেনি। কিন্তু নাগাড়ে হুঁশিয়ারি শুনতে থাকলে হয়তো অচেতনেও কোথাও একটা ছাপ পড়ে, যেজন্য ওই অপরিচিত ‘খসখস’ আওয়াজটা পাওয়ামাত্র সে ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে তার একান্ত এই লুকোনো জায়গায় এসে ঢুকেছিল।
এখন, তার বিস্ফারিত চোখের সামনে এক-এক করে ঘরগুলোর অতি সামান্য জিনিসপত্র ছিটকে ছিটকে এসে পড়ছে। রেড মেশিনারির দু-হাত আর বাড়তি দুই রোবটিক আর্ম যা-ই দেখছে, তা-ই আছড়ে ফেলছে বাইরে। যে ঘরগুলো খালি হয়ে গেছে, সেগুলো থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে খুব অবহেলাভরে ঘুরে একটা জ়্যাপার রে বুলিয়ে দিচ্ছে সেখানে।
ফেলনা প্লাস্টিক জুড়ে বানানো ঘরগুলো এমনিই পলকা। জ়্যাপার রে ছোটোখাটো উল্কাপিণ্ড অবধি ভেঙে ফেলতে সক্ষম। ঘরগুলো স্রেফ আগুনে ফেলে-দেওয়া কাগজের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে।
নেই হয়ে যাচ্ছে একদম।
ঘরের বাসিন্দারা?
তাদের তো সবার আগেই সারিবন্দি করে নিয়ে গিয়ে তুলেছে ওই অদ্ভুত ঘেরাটোপের গাড়িটায়। ওটা ঘিরে ঝুলন্ত ক্যানভাস থেকেই ওই অচেনা ‘খসখস’ আওয়াজটা হচ্ছিল।
সেনারা কী করবে এই এতজন প্রান্তিককে নিয়ে? এভাবে সব ভেঙেই-বা দিচ্ছে কেন? কী চায় ওরা! পুরো প্রান্তিক আবাসনটাই তো নেই হয়ে যাবে এভাবে চললে। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল নাথুয়ার, একবার মনে হচ্ছিল, অন্যদের হয়তো ভালো কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে… ওর উচিত গিয়ে তাদের সঙ্গে গাড়িতে ওঠা… নইলে একা একা সে এখানে থাকবে কী করে!
আবার পরক্ষণেই চোখে পড়ছিল, কী তাচ্ছিল্যে ওদের ঘরকন্নার জিনিসগুলো ছুড়ে ফেলছে সেনারা। বুকের ভিতর থেকে কু ডাকছিল, মনে হচ্ছিল, বেরোলেই বিপদে পড়বে।
আদ্ধেক আবাসন তছনছ করার পর তাদের অধিনায়ক ফেরার হুকুম দিয়েছিল। চলেই যাচ্ছিল সেনারা বাকিটা ছেড়ে। আরেকটু দেরি হলেই নাথুয়া হয়তো রেহাই পেয়ে যেত।
কিন্তু না, শেষ ছুড়ে-ফেলা থলিগুলোর একটা থেকে লাল বলটাকে ঠিক তখনই গড়িয়ে নাথুয়ার সামনে চলে আসতে হল!
প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় বেরিয়ে এসে ঝুঁকে পড়ে বলটা তুলে নেওয়ার পর তার হুঁশ হয়েছিল যে, ভুল করেছে। কিন্তু ততক্ষণে তাকে দেখে ফেলেছে দুজন সেনা, ছুটে এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
কয়েক মিনিট পর মাথায় ফোলা, হাতে কালশিটে নিয়ে ঘেরাটোপের ভিতরে গাদাগাদি-হয়ে-থাকা মানুষগুলোর উপর টলে পড়ল নাথুয়া। হেলে-থাকা অবস্থাতেই টের পেল, ঘেরাটোপের মুখ বন্ধ করা হল বাইরে থেকে, দুলে উঠল অদ্ভুত গাড়িটা, তারপর ভেসে উঠল উপরদিকে।
লাল বলটা তখনও সে হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল।
***
“কাজ শেষ?”
“হ্যাঁ, কমান্ডার।”
“মার্ক-করা প্রত্যেকটা জায়গা থেকে তোলা হয়েছে?”
“হ্যাঁ, কমান্ডার। মোট সাতটা জায়গা। দুটো ল্যাব, তিনটে আবাসন আর সংশোধনাগারটা।”
শেষের শব্দটা শুনে মুখ বাঁকালেন ‘প্লানেটা লা লিম্পিয়া’ প্রোজেক্টের চিফ কমান্ডার ইয়ুকি মিতাশুবা।
“বহু আগেই ওটার গতি করা উচিত ছিল।” বিড়বিড় করলেন তিনি।
“ইয়েস, কমান্ডার?”
গ্লোরি, মানে রোবট সেক্রেটারি মেয়েটি ভেবেছে, ওকে কিছু বলেছেন। হাত নেড়ে তাকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন ইয়ুকি।
“ডিএনডি অন করে দিয়ো।”
গ্লোরি বেরিয়ে যেতে ইয়ুকির কেবিনের দরজায় লাল অক্ষরে ডু নট ডিস্টার্ব জ্বলতে লাগল।
ফোনটা ঠিক দশ মিনিট পরে এল, যেমন বলা ছিল। তৃপ্ত গলায় ইয়ুকি বললেন, “প্রথম ধাপ নির্বিঘ্নে ঘটেছে।”
সামনের স্ক্রিনে ততক্ষণে দুজনের মুখ ফুটে উঠেছে। প্রোজেক্টের সিকিউরিটি চিফ গ্রেগরি আর টেকনিক্যাল চিফ শ্রীমতী। কথাটা শুনে দুজনের মুখেই স্বস্তির ছাপ পড়ল। গ্রেগরি সহাস্যে বলে, “তাহলে দ্বিতীয় পর্ব শুরু করতে অর্ডার দিন।”
“দিয়ে দিয়েছি। এই একটু আগেই। কাজ আর কতদিন বাকি, শ্রীমতী?”
“বেশি না, স্যার। হয়ে এসেছে। দু-সপ্তাহ আন্দাজ।
“আর আপনার ওই বিশেষ থ্রাস্টিং কম্পার্টমেন্ট শিপে তুলতে কতক্ষণ লাগবে, শ্রীমতী?”
“সব রেডি থাকলে বেশি না। ঘণ্টা দুই ধরুন সব সেট করে নিতে, আমাদের হিসাবমতো।”
“আরও কিছুটা সময় বাফার ধরতে হবে। যদিও সব প্রিকশন নেওয়া আছে, তবু… কিছু… যাকে বলে অনভিপ্রেত দেরি হতে পারে।”
“আচ্ছা। কিন্তু কেন দেরি হবে, জানতে পারি কি, স্যার?”
গ্রেগরির মিটিমিটি হাসি দেখে বোঝা যায়, সে জানে, কী নিয়ে কথা হচ্ছে। ইয়ুকির নির্বিকার মুখে হাসির আভাস ফুটলেও বোঝা মুশকিল।
“আমি বলব, গ্রেগরি? না আপনি? আচ্ছা, আমিই বলছি। শ্রীমতী, যেমন ভাবা হয়েছিল, প্রয়োজনীয় গতি আনার জন্য আপনার ডিজ়াইনে বুস্টার কম্পোনেন্টটাকে একটা পয়েন্টে পৌঁছে মনপবন থেকে বিযুক্ত করে দেওয়া হবে… সেটা শুরুর এক্সপেরিমেন্টগুলোর মতো বাতিল যন্ত্রপাতি ভাঙা ঘরবাড়ি দিয়ে ভরা হচ্ছে না, তাই সময় বেশি রাখতে বলেছি। জাস্ট ইন কেস। রোবট টিমের সমস্যা হলে সামলানোর জন্য রেড মেশিনারির একটা দলও মোতায়েন থাকবে।”
“সমস্যা? না না! আমাদের রোবট সবরকম মেটিরিয়াল হ্যান্ডল করতে পারার মতো ট্রেনিং পায়, স্যার…”
“সে তো জড়পদার্থ!”
গ্রেগরির কথাটায় এক ধাক্কায় শ্রীমতীর মুখের হাসির লেশটুকুও মুছে গেল, উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠল চোখ-মুখ।
“মানে? স্যার?”
ইয়ুকি একই রকম শান্ত গলায় বললেন, “আমাদের গ্রহের দৈন্যদশার কথা তো আপনি জানেন, শ্রীমতী! খনিজ পদার্থ এখানে প্রায় কিছুই নেই, গ্রহের মাটিতে আমাদের কাজে লাগার মতো ধাতুও যৎসামান্য। শক্তিপুঞ্জের চৌম্বক ক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সব শক্তির প্রয়োজন মেটানোর বিদ্যা আমাদের যদি জানা না থাকত তো এতদিন আমরা বেঁচে থাকতেই পারতাম না!”
“হ্যাঁ স্যার, জানি। কিন্তু…”
হাত তুলে শ্রীমতীকে চুপ করান ইয়ুকি, তারপর বক্তৃতার ঢঙে বলে যেতে থাকেন, “সেভাবেই এত বছর ধরে আমরা মানুষদের এগিয়ে নিয়ে গেছি, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সব প্রয়োজন মেটাতে পেরেছি মাটির নীচের কলোনিগুলোয়। কিন্তু তার তো একটা সীমা আছে, না কী? বিশেষ করে মানুষ যখন সংখ্যায় বেড়েই চলেছে? সমানে টান পড়ছে জোগানের ভাঁড়ারে, শ্রীমতী, আপনি কি জানেন না, আপনাদের রিসার্চ ফান্ডে আমি কতবার বরাদ্দ কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি গত কয়েক বছর ধরে?
“কেন? আমি কি মূর্খ? আমি কি জানি না কত জরুরি রিসার্চ করা, কত জরুরি মহাবিশ্বের কোণে কোণে সন্ধানী যান পাঠিয়ে মূল্যবান ধাতু ও অন্য যৌগ খুঁজে নিয়ে আসা? তবু করেছি, করতে বাধ্য হয়েছি, কারণ আমার সাধ্য ক্রমে কমে আসছিল। কিন্তু গত ক্যাবিনেট মিটিং-এ আমি ও আমার সহপ্রধানেরা মিলে এর এক অভূতপূর্ব সমাধান বার করেছি।”
এইখানে দম নেওয়ার জন্য ইয়ুকিকে একবার থামতে হল। তবে শ্রীমতী এতটাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি কিছুই বলে উঠতে পারলেন না। ইয়ুকি নবোদ্যমে আবার বলতে শুরু করলেন, “সমাধান এতকাল আমাদের চোখের সামনেই ছিল, জানেন? ভাবুন! কী আমাদের সমস্যার মূল? মানুষের সংখ্যা। মানুষ কমানো যায় যদি? যদি তাদের সরিয়ে দেওয়া যায়, যারা সেই অর্থে মূল সমাজের কোনো কাজেই লাগে না? তাহলেই তো কেল্লা ফতে! বলুন তো, তারা কারা?”
হাসি-হাসি মুখে সামনে ঝুঁকে পড়েন ইয়ুকি। শ্রীমতী নীচু গলায় বলেন, “প্রান্তিকেরা?”
“ইয়েস! সেই সঙ্গে সংশোধনাগার নামে বেকার জায়গায় বসে-বসে-খাওয়া একদঙ্গল অপরাধমনস্ক অপদার্থ ডিফেক্টিভ জিনের লোক। এদেরকে গ্রহ থেকে সরিয়ে দিলেই আবার ব্যালেন্স ফিরে আসবে, আগামী বহু সহস্র বছর মানুষ থাকবে নিরাপদ।”
শ্রীমতীর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এখনও ধাঁধায়। এবার গ্রেগরি আরেকটু খোলসা করে বললেন, “এদের সরিয়ে দেওয়া মানে তো গ্রহ থেকে নির্বাসন দেওয়াই, তা-ই না, ম্যাডাম? সেটার প্ল্যান যখন হচ্ছিল, তখনই আপনার স্পেসশিপ ‘মনপবন’-এর বুস্টার হিসাবে ছুড়ে ফেলার জন্য কাঁচামাল বরাদ্দ করার অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়ল। ব্যাস! দুই সমস্যা, এক সমাধান! শুধুশুধু মরার বদলে গ্রহের স্বার্থে বলিদান… এই তো!”
“এই লোকগুলোকে আপনারা বুস্টার ওজন হিসাবে তুলবেন মনপবনে?” শ্রীমতী তীক্ষ্ণ গলায় বলা কথা থেকে আতঙ্ক ঠিকরে বেরোচ্ছিল।
“ঠিক বুঝেছেন।”
“না, না! এ কী বলছেন? এ হয় নাকি…”
কথার হাল ইয়ুকি আবার নিজের হাতে তুলে নিলেন, “না হওয়ার কিছু নেই, শ্রীমতী। মনে রাখবেন, এ মানুষগুলোকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই হয়ে গিয়েছিল। মৃতদেহগুলো থাকতে সেগুলো ব্যবহার না করে আপনার জন্য কমে-আসা মেটিরিয়ালের স্টক থেকে আরও খানিকটা কমিয়ে দেব… মানে হয় কোনো এর? আমাদের তো সমগ্র মানবজাতির কথা ভাবতে হবে, না কী?”
“মৃতদেহ…? মানে মেরে ফেলা হয়েছে?”
“জড়ো করা হয়েছে। আবার আলাদা করে মারব কেন। আপনিই মরে যাবে টেক অফের পর।” গ্রেগরি শ্রীমতীর উৎকণ্ঠাকে নস্যাৎ করে দেন।
“কী বলছেন! এতগুলো জীবন্ত মানুষ…”
ইয়ুকি বাধা দেন, “এতগুলো বাড়তি মানুষ। সময়ে সময়ে বোঝা কমিয়ে ফেলতে হয়, সেটাই উচিত। এ তো প্রকৃতির ধর্ম, ভারসাম্য বজায় রাখা! ভুলে গেলেন?”
শ্রীমতী চুপ করে থাকেন।
এবার ইয়ুকির গলা অবিশ্বাস্য রকমের কঠোর শোনায়, “হয় এভাবেই যাবে, নইলে মনপবন প্রোজেক্ট আমি এই মুহূর্তে স্ক্র্যাপ করে দেব, শ্রীমতী। বলুন, কী চান?”
শ্রীমতী বোবা মুখে মাথা নাড়েন খালি। ইয়ুকি আবারও নরম সুরে বলেন, “এই যে আপনার এতদিনের চেষ্টার ফল, মহাকাশ পাড়ি-দেওয়া তীব্র গতির যান ‘মনপবন’, এত তার সামর্থ্য, জ্ঞানবিজ্ঞানে ভরা ভাঁড়ার নিয়ে নতুন গ্রহের খোঁজে তার এই যাত্রা—মানুষের ইতিহাসে এ যে কত মহত্ত্বপূর্ণ হতে চলেছে, এ কি আপনিই আমায় বোঝাননি? মানুষের ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি কতখানি বেড়ে যাবে এ যাত্রা সম্পূর্ণ হলে, ভাবুন? আর বিজ্ঞানী হিসাবে আপনার খ্যাতি কোথায় গিয়ে পৌঁছোবে, সেটাও?”
আরও কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ কাটে। তারপর শ্রীমতীর ঈষৎ ধরা-গলা ভেসে আসে, “ঠিক আছে, স্যার। রেড মেশিনারি যেন জায়গামতো থাকে।”
***
যেখানে ওদের নামানো হল যান থেকে, সেই জায়গাটা আগে কখনও দেখেনি নাথুয়া। এতদূর আগে এসেছেই-বা কবে!
অদ্ভুত লালচে আলোয় অন্ধকারই বেশি। ওর মধ্যেই চোখ অভ্যস্ত হয়ে যেতে দেখল, আরও কয়েকটা এরকম দেখতে, ক্যানভাস চাপা-দেওয়া গাড়ি আশপাশে দাঁড়িয়ে। তিন অবধি গোনার পর গুলিয়ে গেল নাথুয়ার, পিছন থেকে ধাক্কা মেরেছে কেউ ওকে। কী হচ্ছে, বোঝার আগেই রেড মেশিনারির সেনারা ওদের ধাক্কাতে ধাক্কাতে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর হাঁটাতে শুরু করল এককোনার দিকে।
কী অন্ধকার ওই কোনাটা! ধকধক করে লাল আলো জ্বলছে কয়েকটা, মাঝে মাঝেই কারা যেন এদিক থেকে ওদিক ছুটে যাচ্ছে।
আরও কাছাকাছি আসতে দেখতে পেল, এঁকেবেঁকে আরও তিনটে সারি মানুষ আসছে এদিকেই।
এত লোক?
কী হচ্ছে এসব! কে বলবে? ওই সেনাটাকে জিজ্ঞাসা করবে?
যেন বা নাথুয়ার মনের কথা শুনতে পেয়েই সারিতে তার দুজন আগে থাকা ভারিক্কি চেহারার, থপথপ করে শরীর টেনে হাঁটা বয়স্ক মানুষটা থেমে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে সেনাটার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাদের?”
একটা হাত উঠল আর নামল। স্টিলের আঙুল চকচক করল একবার। প্রশ্ন-করা লোকটা থরথর করে কেঁপে উঠল। তারপর নড়বড়ে পায়ে আবার এগিয়ে গেল লাইনের দিকে।
ইলেকট্রিক শক দিয়েছে ওকে।
বাপ রে! এত হিংস্র কেন এরা!
“জলদি!”
ঘষা-গলায় ধমক ভেসে এল পিছন থেকে। নাথুয়া চমকে দেখল, আগের জনের সঙ্গে ওর দূরত্ব বেশ বেড়ে গেছে। মরিয়াভাবে পা চালাল সে। শক দিলে বড্ড ব্যথা লাগে সারা গায়ে। না বাবা। যা বলছে, শোনাই ভালো!
মানুষের তিনটে সারি এসে মিশল একটা বড়ো ধাতব ঘরের সামনে। মিশল বলাটা ভুল, ঘরের দরজা দিয়ে এক-এক করে ঢুকে যাচ্ছিল সবাই। চাকার মতো কিছু রোবট ভেসে ভেসে তদারক করছিল দরজার সামনে। নাথুয়া ঢুকতে ঢুকতে শুনল, কিরকির করে আওয়াজ হচ্ছে রোবটটার হাতে ধরা যন্ত্রে।
ওতে এক্সপেরিমেন্টের তথ্য জমা করছে নির্ঘাত!
এক্সপেরিমেন্টই, নাথুয়া এখন নিশ্চিত। নতুন কিছু একটা হচ্ছে, ওদের তাতে কাজ করতে হবে। নইলে আর কী হবে! পুনর্বাসন তো নয়ই। এরকম মজবুত ঘর প্রান্তিকদের জন্য কেউ বানাবে না। নাথুয়া আর তার সঙ্গীরা হাঁ করে দেখছিল। কত বড়ো ঘরটা! কত ধাতু লেগেছে, কে জানে! মিশ্র হলেও… দেওয়ালে হাত বুলোল নাথুয়া। কী মসৃণ! হাত পিছলে যাচ্ছে!
আহা, এমন ঘরে থাকতে না জানি, কেমন লাগবে!
আরও লোক ঢুকছে ঘরে। সমানে ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে। চেনা মানুষগুলো কেমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে, আশপাশের কাউকেই আগে দেখেনি নাথুয়া। সবার মুখেই কিছুটা ভয়, কিছুটা বিস্ময়। সামনের রোগা মেয়েটা ভিড়ের চাপে ওকে এক হাতে ধরে টাল সামলাল। তাকেই ফিশফিশ করে জিজ্ঞাসা করল নাথুয়া, “কিছু জানো, কী ব্যাপার?”
মেয়েটা বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে মাথা নাড়ল।
“কোথা থেকে আনল?”
“ঘরে। কাজে যাইনি আজ, ছুটি ছিল। দুম করে… তুমি আমার মা-কে দেখেছ? মা কাজে গিয়েছিল…”
ঝনঝন শব্দে ঘরের দরজা বন্ধ হয়। সবাই সচকিত হয়ে ওঠে, কেউ কেউ চেঁচিয়ে ফ্যালে।
দরজা খোলে না। লালচে আলোগুলো ঢিমে হয়। খুব মৃদু একটা বাজনা বাজতে শুরু করে। সেই সঙ্গে বাতাসে মেশে ঘুম-ঘুম গন্ধ। ভীত মানুষগুলো ঝিমোয়। ক্লান্ত চোখ বোজে। আস্তে আস্তে ঘুম নেমে আসে তাদের চোখ জুড়ে।
এভাবেই, এই মানুষগুলো এই বন্ধ কুঠুরিতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে আস্তে আস্তে। মাথার উপরে জায়গায় জায়গায় লাল আলো দপদপ করে সারাক্ষণ। দিনরাত তফাত নেই, কত ঘণ্টা, কত দিন—কোনো হিসাব নেই। মাথার উপর চৌকো একটা জানলা খোলে মাঝে মাঝে, একতাল খাবার এসে পড়ে। প্লাস্টিকের মতো কৃত্রিম খাবার।
শুরুর দিকে জানলাটা খুললেই হামলে পড়ত লোকে। গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচাত। ছেড়ে দিতে বলত তাদের। হাহাকার করত, দয়া চাইত।
কী তাদের অপরাধ, তারা জানে না। কিন্তু মুক্তি, কেউ কি মুক্তি দেবে না এই নরকের লাল আভাভরা বন্দিদশা থেকে?
কত ডাকল, কত কাঁদল ওরা। কিন্তু কোনো উত্তর এল না বাইরে থেকে।
আস্তে আস্তে গলার জোর কমল। শরীর শুকিয়ে আসতে লাগল। ঝিম ধরে, মাথা ঘোরে। মানুষগুলো স্থবির হয়ে গেল ক্রমে। এমনকি নিজের মানুষদের খোঁজার চেষ্টাটুকুও আর কেউ করে না। শুধু কারও কারও ঠোঁট এখনও বিড়বিড় করে কী যেন বলে চলে। সে প্রার্থনা, না অভিশাপের বুলি—কে জানে!
“অর্ণ! অর্ণ!”
একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে ভিড়ের মধ্যে অর্ণকে দেখতে পেয়ে গেল নাথুয়া একদিন। একে ঠেলে, ওর পা মাড়িয়ে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সে গিয়ে হাজির হল অর্ণর সামনে।
ক্লান্ত চোখ তুলে অর্ণ তাকাল তার দিকে। চিনতে পারবে না মনে হচ্ছে যখন, তখন তার নিষ্প্রাণ চোখে আলো জ্বলে উঠল।
“নাথুয়া?”
দুই বন্ধু আবেগে হাত আঁকড়ে ধরল।
“বাকিরা?”
“কে জানে! কাউকে পাইনি আর।”
“এ কী হচ্ছে রে?”
“হয়তো খেতে না দিলে মানুষ কতদিনে মরে, তার এক্সপেরিমেন্ট করছে…” তিক্ত হাসি হাসে অর্ণ।
“না না! কোথাও নিয়ে যাবে আমাদের। সেখানে কাজে লাগাবে মনে হয়।”
“মরে গেলে আর কী কাজে লাগবে, বল?”
নাথুয়া উত্তর পায় না। এত ভাবার অভ্যাস নেই ওর। কিন্তু অর্ণর ঝুঁকে-পড়া চেহারা, কাতর মুখ-চোখ দেখে তার গলার কাছে কিছু একটা ড্যালা পাকায়।
“একদম বাজে বকবি না অর্ণ। তুই মরবি না। কক্ষনো না! আমি বলছি!”
বন্ধুর হাতটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে নাথুয়া।
***
সেই থেকে দুজনে একসঙ্গে ওঠ-বস করছে। তাও কতদিন হল?
“আর কবে? কবে জানব, কী করতে চায় আমাদের নিয়ে?”
ডুকরে ওঠে অর্ণ। জ্বর এসেছে তার এভাবে পড়ে থেকে। চোখ লাল।
নাথুয়া তাকে কিছু বলার আগেই পায়ের নীচের মাটি নড়ে উঠল ওদের। প্রথমে আস্তে আস্তে। তারপর রীতিমতো দুলতে লাগল সারা ঘর। দুলতে দুলতে সরে যেতে লাগল পিছনদিকে।
যে যাকে পারে, আঁকড়ে ধরেছিল। যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল, তেমনি আচমকাই থেমে গেল ঘরের নড়াচড়া। তারপর সমস্ত আলো নিবে গেল।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভয়ের চিৎকার বয়ে যেতে-না যেতেই ঘরটা তীব্র বেগে উপরে উঠে যেতে শুরু করল। ভূগর্ভ থেকে সেটা উঠে এল বাইরে, তারপর উঠতে লাগল আরও উঁচুতে।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সদ্য-প্রস্তুত-হওয়া রুপোলি মেঘের মতো বিশাল মহাকাশযানটা। তার পেটের কাছে মায়ের দুধ খুঁজে-আসা বিড়ালছানার মতো আটকে গেল সেটা অবশেষে।
***
“ডান। পিওথ্রি, চেক।”
“চেক, ডান।”
শেষ বোতামটায় চাপ পড়ল। স্ক্রিন থেকে লক্ষ-রাখা রথী-মহারথীরা সহর্ষে উল্লাস প্রকাশ করলেন।
ইতিহাস সৃষ্টি করে মহাশূন্যের দিকে ধাবিত হল ‘মনপবন’।
সে চরম গতির, প্রবল ঝাঁকুনির মানে বুঝেছিল কি অর্ণরা? না মনে হয়! তাদের জন্য তো আর স্পেসসুট ছিল না! যুগান্তরে থাকাকালীন কুঠুরিতে যে অক্সিজেন সাপ্লাই ডাক্টগুলো ছিল, সেসবও তো খুলে সিল করে দেওয়া হয়েছে উপরে তোলার আগে। বন্ধ ঘরের অক্সিজেনটুকু কতক্ষণই-বা চলে!
ঘরের দেওয়াল থেকে বিশেষ কায়দায় বানানো ধাতব চাদর নেমে এসেছিল তারপর লুটিয়ে পড়ে-থাকা শরীরগুলোর উপর। নিখুঁতভাবে মুড়ে পুঁটলি করে নিয়েছিল সব কিছু।
খালি বাদ দিয়ে দিয়েছিল নাথুয়ার হাত থেকে খসে পড়ে-যাওয়া লাল বলটাকে।
***
ধীর গতিতে যুগান্তর প্রদক্ষিণ শেষ করে মনপবন।
এবারে আস্তে আস্তে কোনা করে উঠবে সে, শক্তিপুঞ্জকে পিছনে রেখে।
নির্দিষ্ট জায়গা অবধি।
তারপর আসল কাজ। সব চেয়ে জটিল পর্যায়।
যানের কমান্ডার গ্রহনায়কদের কাছে অনুমতি চায় সে কাজে হাত দেওয়ার আগে। যুগান্তর থেকে নির্দেশ আসে এগিয়ে যাওয়ার।
যানের বিশেষ রোবটগুলোকে এতক্ষণে অ্যাকটিভেট করা হয়। বিশেষ কনট্রোল প্যানেলটায় বসেন সেকেন্ড-ইন-কমান্ডার নরিম্পা। এত গুরুত্বপূর্ণ আর অভূতপূর্ব একটা কাজ পুরোপুরি যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দিতে মন সায় দেয় না তাঁর।
যদিও, হয়তো যন্ত্রের উপর ভরসা করলেই ভালো করতেন।
কীভাবে ভুলটা হয়েছিল, কেউ জানে না। এমন ঐতিহাসিক একটা কাজের দায়িত্ব পেয়েছেন বলে অতিরিক্ত উত্তেজনায় নরিম্পাই কিছু প্যারামিটার ভুল সেট করেছিলেন, না মূল হিসাবেই গণ্ডগোল ছিল—বলা মুশকিল।
নাকি বাদ-পড়ে-যাওয়া ওই লাল বলটার ওজনটুকুই ব্যাপারটা এদিক-ওদিক করে দিল, কে জানে!
যতক্ষণে যুগান্তরের স্টেশনের রাডারে ধরা পড়ল যে, বুস্টার কম্পোনেন্টটি তার নির্দিষ্ট গতিপথের থেকে এক ডিগ্রি সরে গেছে, ততক্ষণে জালে জড়ানো মানবপিণ্ডটাকে পিছনে ফেলে মনপবন উল্কার গতিতে ছুটে গেছে বহু দূরে, তার গন্তব্যের দিকে।
নিজেদের গতিপথ অনায়াসে শুধরে নিয়েছিল ‘মনপবন’-এর এ আই কনসোল। তবে বুস্টারটির গতিপথ শুধরোনোর উপায় কারও হাতেই ছিল না।
***
অর্ণদের গল্প ফুরোল। এবার কি আমরা তাহলে যুগান্তরে ফিরে যাব? গিয়ে দেখব, সমাজের অবাঞ্ছিত ভার কমিয়ে কেমন সুখী হয়ে উঠেছে উন্নত মানবপ্রজাতি?
হায়, সে সুযোগ নেই আর আমাদের!
কারণ শেষ মুহূর্তের ওই বিচ্যুতি, ওই মাত্র এক ডিগ্রিই যে মহাশূন্যে সব ওলট-পালট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে! আর তাই ছুড়ে-ফেলা ওই পিণ্ডটি—অসহায় মানুষের মৃতদেহগুলো—হিসাব-করে-রাখা নিরাপদ ক্ষেত্রের বদলে গিয়ে পড়েছিল অন্যত্র; ছুঁয়ে ফেলেছিল শক্তিপুঞ্জের চৌম্বক আকর্ষণ। ধীর কিন্তু অমোঘভাবে ভেসে ভেসে একসময়ে তা পৌঁছে গিয়েছিল সোজা শক্তিপুঞ্জের বুকে।
পালসারটির টলম্যান-ওপেনহাইমার-ভলকফ সীমা পেরিয়ে যাওয়ার জন্য ওই বাড়তি ওজনটুকুই ছিল যথেষ্ট। নিউট্রন তারকা থেকে সেটি ব্ল্যাক হোলে পরিণত হতে শুরু করে সেই মুহূর্তেই, আর সেই পরিবর্তন হয় দ্রুত, অতি দ্রুত। রাক্ষুসে খিদে নিয়ে চারদিকের সব কিছু গিলে খেতে শুরু করে শক্তিপুঞ্জ অতঃপর…
যুগান্তরের পক্ষে সম্ভব ছিল না সেই চরম টান অগ্রাহ্য করা।
অতএব আমরা মনপবনের সঙ্গে ভেসে যাই, চলুন ভবিষ্যতের দিকে; কোথায়, কোন অজানা গ্যালাক্সির বুকে নতুন করে আবার যাত্রা শুরু হল মানবসভ্যতার, তার সাক্ষী হই।
আশা করা যায়, সে নতুন সভ্যতা শিখবে তার পূর্বপুরুষদের ভুল থেকে। না হলে আবারও অদৃশ্য হিসাবের খাতায় পরবর্তী মানব-আবাসন গ্রহটির পাশে ঢ্যাঁড়া পড়বে, সেখানকার পালা ফুরোবে, আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হবে মানুষ নামক মহাবিশ্বের নগণ্য, অল্পবুদ্ধি জীবদের…
প্রকৃতির নিয়মই হল ভারসাম্য বজায় রাখা—কে যেন বলেছিল না?
Tags: অনুষ্টুপ শেঠ, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
