উপনিবেশ
লেখক: ইমন চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
আবছা নীল একটা আলো। ঘুমে জড়িয়ে আসা চোখদুটো একবার মেলেই আবার বন্ধ করে ফেলে অনিকেত। একটানা খুব মৃদু একটা অস্পষ্ট যান্ত্রিক স্বর ভেসে আসছে। ঘুমের মধ্যেই কেমন যেন গা মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে এই শব্দে। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে আবারও চোখ খোলে অনিকেত, ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা ফিরে আসছে ওর। এখনও নিজের নাম মনে পড়েনি, কিন্তু এখন সে চোখ মেলে দেখতে শুরু করেছে নিজের চারিপাশ।
চারটে কাচের বাক্সের ভেতর শুয়ে আছে চারটে মানুষ। চারজনই এখন চোখ মেলে তাকিয়েছে, প্রায় তিরিশ বছর পর নিদ্রা ভেঙেছে ওদের, এখন ওদের শীতল শরীরের উষ্ণতা বাড়ছে। আর কিছুক্ষণ পরেই ওদের সামনে পর্দায় ফুটে উঠবে মানুষের মুখ, মনে করিয়ে দেওয়া হবে ওদের পরিচয়, স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে এই অভিযানের উদ্দেশ্য, তিরিশ বছর পর জীবনে ফিরে আসতে ওদের সময় লাগবে, ওদের সেই সময় দেওয়া হবে, অভিযানের নির্ভুল হিসাবের মধ্যে এই সমস্ত খুঁটিনাটি সময়ের হিসাব ধরা আছে।
পর্দায় অভিনন্দন বার্তা ফুটে উঠেছে। জীবনে ফিরে আসার অভিনন্দন। ওরা ওদের যাত্রাপথের অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, এই অভিযানে পথের থেকে গন্তব্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাই পথে ওদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল, পথ দেখার সৌভাগ্য হয়নি অনিকেতদের।
বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে ওরা চারজন, অনিকেত, ইয়াং, দিমিত্রি আর মারিয়া। কঙ্কালসার চারটে শরীর পরস্পরের দিকে স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকে। প্রথম দেখায় ওরা নিজেদের যেন চিনতেই পারে না, বোধ ফিরে আসতে সময় লাগে, কিন্তু ফিরে আসে, ধীরে ধীরে ফিরে আসে চেতনা। আর সেই মুহূর্তে কী যে হয় ওদের, চারজনই পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে, আকুল কান্নায় ভেসে যায় ওদের চোখ, থরথর করে কাঁপতে থাকে ওদের শরীর। চোখেমুখে ফুটে ওঠে যুদ্ধজয়ের উত্তেজনা, ‘পেরেছি শেষ অবধি আমরা পেরেছি এই অনন্ত পথ পাড়ি দিতে’। যুদ্ধ জয় হয়নি এখনও, বরং বলা যায় যুদ্ধ এখনও শুরুই হয়নি, এ আনন্দ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের দ্বার অবধি পৌঁছতে পারার আনন্দ, এও বড়ো কম প্রাপ্তি নয়। কাচের জানালার বাইরে এখন সীমাহীন অন্ধকার, কিন্তু ওরা জানে ওই অন্ধকারের মধ্যেই ওদের ঠিকানা আছে, আর দেরি নেই।
তিরিশ বছর শীতঘুমে থাকাকালীন ওদের শরীরে জীবনের লক্ষণগুলো ছিল সুপ্ত অবস্থায়, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি ছিল ধীর, ক্ষীণ ছিল হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, মৃতদেহের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছিল ওদের শরীর। আরও পরে প্রাথমিক বিস্ময়ের পর্দা যখন ওদের চোখের সামনে থেকে ধীরে ধীরে সরে যায়, জীবন এখনও আছে ওদের শরীরে এই নিশ্চয়তা যখন ওরা শরীর মন দিয়ে উপলব্ধি করে তখন যে অনুভূতি ওদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে তোলে তা হল খিদে। খাদ্য, জীবনের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠতম চাহিদা। ওরা অনুভব করে কী প্রচণ্ড দুর্বল ওদের শরীর, চারজনেরই হাত-পা কাঁপছে। অথচ আত্মসংবরণ করতে হবে, ওরা জানে প্রচণ্ড খিদে পেলেও এক্ষুনি কঠিন খাদ্যের জন্য তৈরি নয় ওদের শরীর। দিমিত্রি যানের পেছনের দিকের একটা প্রকোষ্ঠ থেকে চারটে স্যালাইনের বোতল নিয়ে আসে, চারজনেরই হাতের শিরায় আগে থেকেই চ্যানেল করা আছে, আগামী বেশ কয়েকদিন ওদের এভাবে স্যালাইনের মাধ্যমেই শরীরে খাদ্য প্রবেশ করাতে হবে। অন্যান্য প্রাণীদের মতো মানব শরীর শীতঘুমের পরেই বিপাক ক্রিয়ার এই আকস্মিক পরিবর্তনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না, তাকে প্রস্তুত করতে হবে, স্বাভাবিকতা অস্বীকার করে যেমন কৃত্রিমভাবে তাঁকে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল সেইভাবেই কৃত্রিমভাবে তার শরীরকে তৈরি করতে হবে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য।
বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না ওরা, স্যালাইনের বোতলগুলো হাতে নিয়ে ওরা আবার ফিরে যায় ওদের জন্য নির্দিষ্ট কাচের প্রকোষ্ঠে, এবার আর শীতঘুম নেমে আসবে না ওদের চোখের পাতায়, এখন ওদের ঘুম প্রয়োজন, সাধারণ ঘুম। আগামী কয়েকদিন প্রচুর ঘুম আর নিয়মিত আহারই ওদের ধীরে ধীরে ফিরিয়ে দেবে জীবনের পথে। পৃথিবীর হিসাবে এখনও প্রায় সত্তর দিন পরে এই যান তার গন্তব্যতে অবতরণ করবে, এই সত্তর দিনের মধ্যে ওদের আবার কর্মক্ষম হতে হবে। তিরিশ বছরের এই যাত্রা এখন শেষের মুখে, গন্তব্য ক্রমে নিকটবর্তী হচ্ছে, মহাকাশযানের গতি এখন মন্দীভূত হচ্ছে।
তিরিশ বছরে ওদের বয়স বেড়েছে, কিন্তু পৃথিবীতে থাকলে যতটা বাড়ত বয়স তার চেয়ে কম বেড়েছে, এখন ওদের প্রকৃত বয়স সময়কালের সূত্র মেনে অঙ্ক কষে বের করতে হবে, কিন্তু সেই জটিলতা ছাড়াই বলা যায় বেড়েছে ওদের বয়স, ওদের চোখে মুখে ছাপ ফেলে গেছে মহাকাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সময়। ঘুম ভেঙে প্রথমবার পরস্পরকে দেখে ওদের মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল জীবনের একটা বড়ো অংশ ওরা মহাকাশে ঘুমিয়ে অতিবাহিত করেছে।
আয়নায় দেখার সাহস করতে পারেনি ওরা এখনও। মনে পড়েছে ওদের বারণ করা হয়েছিল ঘুম থেকে উঠেই নিজের চেহারা দেখতে, দুর্বল হৃদপিণ্ডের সহ্য নাও হতে পারে শরীরে নেমে আসা আকস্মিক বার্ধক্য।
অনিকেতের চোখের সামনে এক মুহূর্তের জন্য পৃথিবী ভেসে ওঠে, এতগুলো বছর প্রায় মৃত অবস্থায় অতিক্রম করেছে বলেই সম্ভবত পৃথিবীকে আজও এত কাছের বলে মনে হয় ওর, যেন এই তো সেদিন সে বিদায় জানিয়েছে পৃথিবীকে, নিজের আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধবদের। আর কি কখনও বাস্তবে দেখা হবে ওর আপনজনদের কারোর সঙ্গে, সত্যিই কি ফেরা হবে আবার? সম্ভবত না, ফেরার সম্ভাবনা প্রায় নেই। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে বলেই সম্ভবত স্মৃতিরা মেঘের মতো জমছে চোখের পাতায়। পৃথিবী থেকে এত দূরে এসেই এত স্পষ্টভাবে অনিকেত অনুভব করতে পারে ওই নীল গ্রহের প্রতি ওর বুকে এত ভালোবাসা জমেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিকেত, তিরিশ বছর আগে বুক পকেটে ওর তিন বছরের মেয়ে শ্রমণার একটা ছবি রেখেছিল সে, হঠাৎই ছবিটার কথা মনে পড়ে, শীর্ণ হাত পকেটে ছোঁয়াতেই পেয়ে যায় অনিকেত ছবিটা, অপলক চোখে চেয়ে থাকে ও শ্রমণার দিকে, শ্রমণা এখন যুবতি, বাবাকে নিশ্চয় ওর মনে নেই আর। অবতরণের পর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে অনিকেত শ্রমণার সঙ্গে, মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই বন্ধ হয়ে যায় চোখের পাতা। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে ওদের মহাকাশযান একখণ্ড আলোকবিন্দুর মতো গ্রহ নক্ষত্র অতিক্রম করে ছুটে যেতে থাকে।
২
প্রক্সিমা সেন্তরি বি-তে রোভার পাঠানোর ক্রিক্সের একাধিক মিশন ব্যর্থ হয়েছে, কক্ষপথে প্রবেশ করার অনেক আগেই অনন্ত মহাকাশে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে প্রতিটি মহাকাশযান, বহু চেষ্টা করেও তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। অপরদিকে ন্যাকোর তরফে যে অভিযানগুলো করা হয়েছিল তাও ব্যর্থ হয়েছে। এই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা খুব উজ্বল নয়, উন্নত জীব থাকার সম্ভাবনা তো আরোই কম। কিন্তু তবু এই হল পৃথিবীর নিকটতম সেই গ্রহ যার সঙ্গে পৃথিবীর সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশি।
মহাকাশ দখলের এই প্রতিযোগিতা হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি, গত কয়েক দশক ধরে পৃথিবী জুড়ে যে চূড়ান্ত অস্থিরতা চলছে তারই স্বাভাবিক পরিণতি এই মহাকাশ দখলের প্রতিযোগিতা, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ যত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে, মহাকাশ গবেষণার জন্য বরাদ্দ অর্থ পাল্লা দিয়ে তত বেড়েছে। পৃথিবী জুড়ে তখন উত্তেজনার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছে দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধ। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে শুরু হয়েছে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার সীমাহীন প্রতিযোগিতা। এই সময়েই ন্যাকোর তরফ থেকে ট্র্যাপিস্ট-১ই-তে লেজার বিমের সাহায্য রোবট পাঠানোর উদ্যোগের কথা ফাঁস হয়ে যেতেই, ক্রিক্সের বিজ্ঞানীরা প্রক্সিমা সেন্তরি-তে মানুষ পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করে। ন্যাকোর তরফে সমালোচনার সুরে বলা হয়েছিল ক্রিক্স দেশগুলোয় মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই, চারজন মানুষকে মহাকাশ গবেষণার নামে হত্যা করা হল। পশ্চিমের এক বিখ্যাত খবরের কাগজ শিরোনাম করেছিল “লাইকা ২ ৩ ৪ আর ৫”, সঙ্গে ছবি দিয়েছিল মহাকাশযানের কাচের জানালা দিয়ে চারটে অসহায় কুকুর তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে আছে।
এই অবস্থায় মুখে যদিও ক্রিক্সের বিজ্ঞানীরা প্রক্সিমা অভিযানের সাফল্য সম্পর্কে একশো শতাংশ নিশ্চয়তার দাবি করেছিল, কিন্তু বাস্তবে ওদের মধ্যে সংশয় ছিল, মহাকাশযান যদিওবা পৌঁছে যায় এই গ্রহের মাটিতে, মানুষগুলো কি বেঁচে থাকবে ততদিন? তিরিশ বছরের শীতঘুম? এ কি সম্ভব? ক্রিক্স-স্পেস-অরগানাইজেশন বা সিএসওর ডিরেক্টর প্রফেসর সাং হাসতে হাসতে তার সতীর্থদের দিকে চেয়ে বলেছিলেন, “অভিযানের সাফল্য নিয়ে তোমরা চিন্তা করো, তিরিশ বছরের আগে আমার আয়ু যে ফুরিয়ে যাবে এ কথা নিশ্চিত, অতএব সাফল্যের আলো অথবা ব্যর্থতার কালি কোনোটাই আমাকে অন্তত ছুঁতে পারবে না।” তখনই শতায়ু প্রফেসর সাং-এর কথায় সেদিন ল্যাবে উপস্থিত সকলেই সশব্দে হেসে উঠেছিল।
আজ সেন্তরি বি-র কক্ষপথে প্রবেশ করতে চলেছে তিরিশ বছর আগে উৎক্ষিপ্ত সেই মহাকাশযান, ডক্টর সাং আজ সত্যিই আর নেই, বর্তমানে সিএসওর ডিরেক্টর প্রফেসর নাদিমপল্লী।
অঙ্কের হিসাব বলছে মহাকাশযানের এখন প্রক্সিমা দ্বিতীয় গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছে যাওয়া উচিৎ, কিন্তু সে খবর বাসি হয়ে পৃথিবীতে পৌঁছবে আরও চার বছর তিন মাস পরে। প্রফেসর নাদিমপল্লী সিএসও হেডকোয়ার্টারে নিজের কক্ষে সুপার কম্পিউটারের পর্দার দিকে চেয়ে চুপ করে বসে আছেন, একটু আগেই খবর এসেছে ন্যাকোর নতুন মহাকাশযানের সর্বোচ্চ গতিবেগ আলোর গতিবেগের অর্ধেক, লেজার বিমের গবেষণায় পশ্চিমের দেশগুলো অনেক এগিয়ে গেছে। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে ন্যাকোর মহাকাশযান মাত্র দশ বছরের মধ্যে প্রক্সিমায় পৌঁছে যেতে পারে। নাদিমপল্লী ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন, চাঁদের মাটি ভাগ হয়েছে, মঙ্গলের গায়ে পতাকা পুঁতে এসেছে যুযুধান দুই পক্ষ, এ এক নতুন মহাযুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে মানুষ, এই যুদ্ধ এবার আর শুধু পৃথিবীতে হবে না, এবার যুদ্ধ পৃথিবীর মাটি উপচে ছড়িয়ে পড়বে মহাকাশে, এবারের যুদ্ধ আকাশ দখলের যুদ্ধ।
চার বছর তিন মাস আগের মহাকাশযানের ভেতরের ছবি ফুটে উঠেছে প্রফেসর নাদিমপল্লীর সামনে রাখা কম্পিউটার স্ক্রিনে, নাদিমপল্লী দেখতে পাচ্ছেন কাচের কুঠুরিতে শুয়ে আছে ওরা, ওঠানামা করছে ওদের বুক। বেঁচে ছিল, চার বছর আগে অবধি ওরা বেঁচে ছিল, এখনও আছে কি? ঘুম কি ভেঙেছে ওদের? মনে আছে যখন অনিকেতের নাম নির্বাচিত হয়েছিল এই অভিযানের জন্য নাদিমপল্লী তখন কলেজের ছাত্র। অনিকেত ওরই কলেজেরই প্রাক্তনী, অভিযানের আগে কলেজ থেকে অনিকেতকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, সেই সময় তখনকার ছাত্র নাদিমপল্লী অনিকেতকে প্রশ্ন করেছিল, “এই পৃথিবীতে হয়তো আর ফেরা হবে না, এই মাটি আর ছুঁয়ে দেখা হবে না, নিজের মানুষদের চিরদিনের মতো ছেড়ে চলে যেতে হবে। আপনার কষ্ট হচ্ছে না?”
এত বছর পরেও নাদিমপল্লীর স্পষ্ট মনে আছে অনিকেতের উত্তর, সেদিন অনিকেত হেসে বলেছিল, “দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত মানুষের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে অনুভূতি হয়, আমার অনুভূতি তার চেয়ে কিছু আলাদা নয়…” কয়েক মুহূর্তের বিরতি নিয়ে অনিকেত আবার বলে, “কিন্তু মৃত্যুর আকর্ষণও তো আছে, মৃত্যুর ওপারে কী আছে মানুষ তা জানতেও তো চায়… কষ্টের চেয়ে বেশি আমার কৌতূহল। তাই আমি স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছি এই চিরনির্বাসন।” হাততালিতে গমগম করে উঠেছিল সভাকক্ষ।
পর্দায় ফুটে ওঠা কাচের কুঠুরিতে বদ্ধ অনিকেতের রুগ্ন শরীরটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে নাদিমপল্লী, বিড়বিড় করে বলে, “জীবনের দৈর্ঘ্য বেড়েছে, কিন্তু মৃত্যুকে এখনও জয় করতে পারেনি মানুষ। তবু কিছু মানুষ অমর হয়ে যায়, মৃত্যু তাদের ছোঁয় শুধু, অধিকার করতে পারে না। প্রক্সিমা সেন্তরি বি-র মাটি একবার ছুঁয়ে ফেলতে পারলে অনিকেতরা অমর হয়ে যাবে। শুধুই কি কৌতূহল? নাকি কৌতূহল ছাপিয়ে গেছিল অমরত্বের হাতছানি! অসাধারণ হয়ে ওঠার বাসনা!”
৩
প্রশস্ত একটা জানালার সামনে একাই বসেছিল অনিকেত। গত তিন দিন উত্তেজনায় ঘুম হয়নি ওদের, দীর্ঘক্ষণ টানা কাজ করে মাথা ব্যথা করছে বলে উঠে এসেছে অনিকেত, বাকিরা এখনও কাজে ব্যস্ত। এই চারটে মানুষের হাত ধরে মানবসভ্যতা আজ বাস্তব আর কল্পনার এক ঐতিহাসিক সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে, সীমানা অতিক্রম করে এবার কল্পনার সঙ্গে বাস্তবকে মিলিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত এসে উপস্থিত। যুগে যুগে মানুষের যত অলীক কল্পনা, যত কল্পবিজ্ঞাননির্ভর সাহিত্য সিনেমা, সবকিছুর সঙ্গে এবার বাস্তবকে মিলিয়ে নেওয়ার সময়, এবার কল্পনার জাল বুনতে হবে নতুন আঙ্গিকে। সভ্যতার বাঁকবদলের মতো অবিস্মরণীয় এই আবিষ্কার, অথবা আবিষ্কার নয় পর্যবেক্ষণমাত্র, যা আছে তাকে খুঁজে পাওয়া, খুঁজে নেওয়া। গত তিন দিনে ক্ষণে ক্ষণে শিহরিত হচ্ছে ওদের শরীর।
সেন্তরি বি-র কক্ষপথে প্রবেশ করেছে ওদের মহাকাশযান, অজস্র ছবি তুলতে শুরু করেছে সে এই গ্রহের। স্তম্ভিত হয়ে ওরা, দেখছে এই নতুন গ্রহে আবহমণ্ডল আছে, আছে সমুদ্র, আছে অরণ্য। প্রাণ আছে এই প্রক্সিমা সেন্তরি বি-তে। কৃত্রিমবুদ্ধিমত্ত্বা এখনও বিশ্লেষণ করছে প্রক্সিমার আবহমণ্ডল পৃথিবীর মানুষের বসবাসের উপযুক্ত কিনা। এই মুহূর্তে শুধু ওরা চারজন জানে এত কথা, পৃথিবীতে বার্তা প্রেরণ করা হয়েছে, চার বছর পর সারা পৃথিবীর মানুষ জানতে পারবে এই ব্রহ্মাণ্ডে একা নয় পৃথিবীর প্রাণ, তার অংশীদার আছে।
এ গ্রহের আহ্নিক গতি নেই, এ গ্রহের এক পৃষ্ঠ ঢাকা চিরঅন্ধকারে, প্রাণ বিকশিত হয়েছে আলোকিত অংশে। ওদের মহাকাশযান অঙ্ক কষে নির্বাচন করছে ছয়টি সম্ভাব্য অবতরণের স্থল, অনিকেতই প্রথম বলেছিল “আমরা আলো আর অন্ধকারের সীমারেখায় অপেক্ষাকৃত দুর্গম স্থানে অবতরণ করব” বাকিরা সকলেই অনিকেতের সঙ্গে সহমত হয়। প্রাণ আছে যখন তখন ভয়ও আছে, অজানাকে ভয়। আলো আঁধারিতে লুকিয়ে রাখতে হবে নিজেদের, চুরি করে প্রবেশ করতে হবে ওদের সীমারেখায়, বুঝে নিতে হবে ওরা মানুষের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর কিনা।
অনেক আলোচনার পর ছয়টি জায়গার মধ্যে একটি জায়গাকে নির্বাচন করে ওরা, প্রায়ান্ধকার একটা অঞ্চলের ছবি ওদের সামনের পর্দায় ফুটে ওঠে, উঁচু পর্বতের পাদদেশে রুক্ষ পাথুরে কালচে ভূমি, এ অঞ্চলে সম্ভবত প্রাণ নেই, অন্তত উন্নত কোনো প্রাণ থাকার সম্ভাবনা কম। ইয়াং এই সময়েই বলে এই পর্বতের নাম হোক এই অভিযানের প্রাণপুরুষের নামে, প্রফেসর সাং। সকলেই সম্মত হয় এই প্রস্তাবে।
স্থান নির্বাচন করা হয়ে যেতেই মহাকাশযান দ্রুত নীচের দিকে নামতে শুরু করে, সদ্যজাত শিশু যেমন অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে পৃথিবীর দিকে তেমনই বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে ওরা চারজন জানালার বাইরে চেয়ে থাকে, সেন্তরি বি-র বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করছে ওরা, বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে দুলছে ওদের যান। ইতিমধ্যে বায়ুমণ্ডলের বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা। আছে, এই বাতাসে অক্সিজেন আছে, এ গ্রহের আবহাওয়া মানুষের শ্বাস নেওয়ার যোগ্য, তবু ওদের কাছে যান্ত্রিক নির্দেশ এসেছে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়েই নামতে হবে ওদের, মহাকাশযানের দরজা খোলার আগে অত্যাধুনিক বর্মে নিজেদের সম্পূর্ণ ঢেকে নিতে হবে।
দ্রুত গতিতে নীচের দিকে নামছে ওরা, এখনও ওদের জানালার বাইরে অন্ধকার। অনিকেত একটু আগে দেখা ছবিগুলোর কথা ভাবছিল, মানুষই ওরা, অথবা মানুষেরই মতো, ছবিতে স্পষ্ট বোঝা না গেলেও এটুকু বোঝা গেছে মানুষের থেকে খুব আলাদা নয় ওই জীবগুলো, সম্ভবত নিকট ভবিষ্যতে ওদের দাঁড়াতে হবে মানুষেরই মতো দেখতে ওই প্রাণগুলোর সামনে, বুকের মধ্যে কি এক সীমাহীন উত্তেজনা! একই সঙ্গে এক দুঃখের অনুভূতি আসে অনিকেতের মধ্যে, মানুষের সম্ভবত এক গোপন শ্লাঘা ছিল নিজেকে নিয়ে, নিজেকে সে বিশেষ ভাবত, ভাবত সে প্রকৃতি দ্বারা নির্বাচিত, শুধুই কি মানুষ! হয়তো পৃথিবী নিজেও ভাবত সেই একমাত্র যে ধারণ করেছে প্রাণ, মানুষ যুগে যুগে ভিনগ্রহী কল্পনা করেছে কিন্তু সে কল্পনা মাত্র, মানুষের নিশ্চিত অহং ছিল, ধারণা ছিল যে সে একাই অধীশ্বর এই মহাবিশ্বের, কিন্তু তা সত্যি নয়, পৃথিবী তারই মতো হাজারও গ্রহের মধ্যে একটা গ্রহ মাত্র, সূর্য এই নক্ষত্রপুঞ্জের লক্ষ তারার একটা মাত্র, মানুষ হাজারও মানুষেরই মতো প্রজাতির মধ্যে আরও একটা প্রজাতি মাত্র, এই উপলব্ধিতে যেন নিজেদেরই আরও ক্ষুদ্র বলে মনে হয়, এ বড়ো সুখের অনুভূতি নয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিকেত।
একটু আগে মারিয়া উঠে এসে অনিকেতের সামনে জানালার ধারেই বসেছিল, বড়ো ক্লান্ত ছিল ও, কোনো কথা বলেনি। অনিকেত লক্ষ করে মারিয়া জানালার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে জানালারই কাচে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, পৃথিবী থেকে যখন ওরা যাত্রা শুরু করেছিল তখন মারিয়ার মাথা ভরতি কোঁকড়ানো সোনালি চুল ছিল, ওর নীল চোখের দিকে তাকালে মনে হত ওই চোখে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন আছে, তিরিশ বছরের ঘুমের মধ্যেই ওর চুল ঝরে গেছে, গাল ভেঙে গেছে, চোখের দৃষ্টি এখন ঘোলাটে, ওদের চারজনের মধ্যে মারিয়াকেই সবচেয়ে বেশি অধিকার করেছে বয়স, কয়েকদিন আগে সে অনিকেতকে বলছিল, “কেমন যেন মনে হচ্ছে আমার শরীরে কোনো মারণ রোগ জমেছে…।” এই যানে দেহের দৈহিক অসুস্থতার যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা সম্ভব। মারিয়াকে চিকিৎসার কথা বলেছিল অনিকেত, মারিয়া আগ্রহ দেখায়নি, বলেছিল, “এখনই নয়, আগে যাই ওখানে, নতুন নক্ষত্রের আলো পড়ুক শরীরে, তারপর সিদ্ধান্ত নেব, ভেবে দেখব জীবন আমার কাছে এখনও কতটা দামি।”
গত কয়েকদিন ধরে পৃথিবী থেকে আসা চার বছর আগের মহাকাশ সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলো দেখছিল অনিকেত, প্রক্সিমা সম্পর্কে বিশেষ কোনো খবর নেই। তবে ন্যাকোর বিজ্ঞানীরা লেজার বিমের উপর খুব ভালো কাজ করেছে, বিজ্ঞানীরা বলেছেন অদূর ভবিষ্যতে এমন একদিন আসবে যেদিন মানুষ ছুঁয়ে ফেলবে আলোর গতি।
অনিকেতের কল্পনাপ্রবণ মন ভাবতে থাকে, হয়তো ইতিমধ্যে ন্যাকো কোনো মহাকাশ যান প্রেরণ করেছে প্রক্সিমার দিকে, হয়তো সে যান ওদের পেছনেই আছে, নজর রাখছে ওদের ওপর। পৃথিবী থেকে আসা খবরের কাগজগুলোয় চোখ বোলায় অনিকেত, বিক্ষিপ্তভাবে কিছু দেশে যুদ্ধ চলছে, কিন্তু সেই যুদ্ধ এখনই বাকি দেশগুলোয় উপচে পড়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে হয় ওর, তবে পৃথিবী জুড়ে অর্থনৈতিক যুদ্ধ তীব্রতর হয়েছে, এই অর্থনৈতিক যুদ্ধেই যখন এক পক্ষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যাবে আর তিলমাত্র পেছনোর জায়গা থাকবে না তখন শুরু হবে সামরিক যুদ্ধ, সেদিন সে যুদ্ধ হবে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে, সেই যুদ্ধে কি সামিল হতে হবে অনিকেতদেরও? কাদের হয়ে লড়বে ওরা? পৃথিবী থেকে এত আলোকবর্ষ দূরে ভিনগ্রহীদের সামনে সেদিন কি ওদের মানুষেরই বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে হবে? পৃথিবীতে থাকাকালীন ওদের বুকে যে দ্বেষ সৃষ্টি করা হয়েছিল শত্রুপক্ষের জন্য, এত বছর পর পৃথিবী থেকে এত দূরে এসে সেই দ্বেষের আগুন যেন নিভে গেছে, আজ এখান থেকে পৃথিবীর সকল মানুষকেই বড়ো আপন বলে মনে হয়, মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে আজ ওদের হাত কাঁপবে। অথচ এ যানে ওরা বয়ে এনেছে মারণাস্ত্র। শুধু গবেষণা ওদের প্রধান উদ্দেশ্য নয়, এ গ্রহ দখল করতে হবে, এই ওদের প্রধান কাজ।
৪
প্রক্সিমা সেন্তরি একটি বামন নক্ষত্র, এই নক্ষত্রের দ্বিতীয় গ্রহ প্রক্সিমা সেন্তরি-বি। পৃথিবীর থেকে আকারে সামান্য বড়ো এ গ্রহ মাত্র এগারো দিনে নক্ষত্রের চারপাশে একবার ঘূর্ণন সম্পূর্ণ করে, অর্থাৎ এই গ্রহে বছর হয় এগারো দিনে। অনিকেতদের মহাকাশযান এখন এই গ্রহের মাটি ছুঁয়েছে। কিন্তু এখনও ওরা বেরিয়ে আসেনি যান থেকে, ভেতর থেকেই ওরা দেখছে এই নতুন গ্রহকে।
গ্রহের এই অংশ প্রায় অন্ধকার। বাইরে পাথুরে কালো মাটিতে একটা রোভার ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে পাঠাচ্ছে ওদের, মরুভূমির মতো এই অঞ্চলে প্রাণের চিহ্ন নেই। বাইরের তাপমাত্রা এখন নয় ডিগ্রী সেন্টিগ্রেট, সারা বছরই গ্রহের এই অংশে তাপমাত্রা এরকমই থাকে, এমন শেষ বিকালের মৃদু আলোয় ডুবে থাকে এই অঞ্চল দিনের পর দিন, আরও গহীন অন্ধকারে তাপমাত্রা নিশ্চয় আরও অনেক কম। এমন আহ্নিক গতিহীন একমুখী গ্রহে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা সাধারণত খুব কম বলেই ধরা হয়, তবু যে কী করে এই গ্রহে জীবনের প্রদীপ জ্বলে উঠল! ভাবতে ভাবতেই হেসে ফেলে অনিকেত, মানুষের চিন্তা সরল রৈখিক যা সে দেখেছে তাই দিয়েই সে বিচার করে অজানাকে, অথচ এ মহাবিশ্বের কতটুকুই বা সে দেখেছে, কতটুকুই বা সে জেনেছে!
অবতরণ করার প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে ওরা এই গ্রহের মাটিতে পা দেয়। পৃথিবীর চেয়ে সামান্য বেশি এই গ্রহের অভিকর্ষজ ত্বরণ, ফলে পৃথিবীর তুলনায় ওদের ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে হাঁটতে গিয়ে খুব বেশি তফাৎ অনুভূত হয় না। যেন সন্ধ্যার মুখে পৃথিবীরই কোনো এক জনহীন প্রান্তরে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা।
এত বছর পর মাটি ছুঁয়ে ওদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ হারায়, মারিয়া উবু হয়ে বসে কাঁদতে থাকে হাউহাউ করে, ইয়াং উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে অনিকেতকে জড়িয়ে ধরে মাতৃভাষায় কত কী-ই যে সে বলে যায়, অনিকেতের ভাষা-অনুবাদক তৎক্ষণাৎ অনুদিত করে বলে দেয় ওকে ইয়াং-এর মনের কথা, “মা তোমার সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না, কিন্তু আমি বেঁচে আছি এখনও, আমি মরিনি, আমি মরিনি মা…” এতো অবধি বলে ইয়াং পাগলের মতো বলে যাচ্ছিল “মা তোমাকে খুব ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি…”। ওদের চারজনের মধ্যে ইয়াংই সবচেয়ে ছোটো, কিছুদিন আগে ইয়াং অনিকেতকে ওর জীবনের গল্প শুনিয়েছিল, পৃথিবীর মাটিতে যা ওরা পরস্পরকে বলতে পারেনি মহাকাশে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ইয়াং-এর দেশে বর্তমানে সন্তানের বয়স আঠারো বছর হয়ে গেলে সেই সন্তানের উপর অধিকার থাকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের। ইয়াং চায়নি পৃথিবী থেকে এই চিরনির্বাসন, ও থাকতে চেয়েছিল। মাত্র উনিশ বছর বয়সে রাষ্ট্র ওকে জোর করে ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তার এই অন্ধকার কুয়োর মধ্যে।
দিমিত্রি উন্মাদের মতো চিৎকার করছে, কোনো শব্দ নেই ওর কণ্ঠে শুধু একটা জান্তব আর্তনাদ। ওর সেই তীক্ষ্ণ গলার স্বর শুষে নিচ্ছে ধূসর মাটি আর আকাশ। গত কয়েকদিন ধরেই দিমিত্রি অবসাদে ভুগছে, ঘুমের মধ্যেও ও এমনই জান্তব স্বরে চিৎকার করে ওঠে আজকাল। মারিয়া একদিন অনিকেতকে বলেছিল দিমিত্রি সম্ভবত মানসিক স্থিতি হারাচ্ছে। অনিকেতের তখন সেই কাগজের হেডলাইনটা মনে পড়েছিল, চারটে কুকুরের মুখ একটা মহাকাশযানের কাচের জানালায়, লাইকা, ওরা চারজনই আসলে লাইকা।
কতক্ষণ যে এইভাবেই বিহ্বলতায় কেটে যায়, হঠাৎ ইয়াং অনিকেতের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, “আমার মনে হচ্ছে কেউ দেখছে আমাদের, দূরে যেন মনে হল একটা ছায়া দেখলাম আমি, দ্রুত সরে গেল…”। চমকে উঠে সামনে তাকায় অনিকেত, কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপট লাগে ওর চোখেমুখে, এতক্ষণ শরীর মন অবশ হয়েছিল, ধীরে ধীরে ফিরে আসছে অনুভূতি।
দূরে একটা উঁচু টিলা তার ওপারে পাহাড়, দূর আকাশে দেখা যাচ্ছে আলোর রেখা, ওদিকে আলো আছে, প্রাণ আছে, ওদিকেই যেতে হবে ওদের। অনিকেত আর ইয়াং দমবন্ধ করে স্থিরদৃষ্টিতে ওই টিলাটার দিকে চেয়ে আছে, দিমিত্রি চিৎকার করে করে ক্লান্ত হয়ে এখন বসে পড়েছে মাটিতে, শুধু মারিয়া এখনও গুমরে গুমরে কেঁদে চলেছে, ওর সেই কান্নার মৃদু আওয়াজ ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই, এই সময়ে দূর আকাশে হঠাৎ তীব্র লাল এক আলোক রশ্মি দেখা যায়, চমকে ওঠে ওরা চারজনেই, মুহূর্ত মাত্র, তারপরেই নিভে যায় আলো, ফিরে আসে সেই আধো অন্ধকার। মারিয়া মৃদু স্বরে বলে, “ফ্লেয়ারস…”। যেন কোনো মায়াবী জগতে হারিয়ে গেছিল ওরা, মারিয়ার কথা শুনে ফিরে আসে বাস্তবের মাটিতে, ঠিকই বলেছে মারিয়া প্রক্সিমা সেন্তরি আগুন ছড়ায়, এভাবে প্রায়ই জ্বলে ওঠে প্রক্সিমার আকাশ।
ইয়াং এই সময়েই ফিসফিস করে অনিকেতকে বলে, “ভয় লাগছে আমার, তোমার লাগছে না?” অনিকেত কিছুতেই নিজের কাছে স্বীকার করবে না যে সে ভয় পেয়েছে, ও জানে এই স্বীকারোক্তি ওর চলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে, বরং কেউ ভয় পেয়ে ওকে আঁকড়ে ধরলে ও নিজে সাহসী হওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। ইয়াং-এর হাতটা শক্ত করে ধরে ও সামনে এগোতে থাকে। ওদের এগিয়ে যেতে দেখে নিঃশব্দে মারিয়া আর দিমিত্রিও ওদের অনুসরণ করে।
বেশিদূর যেতে হয় না, টিলাটা কাছাকাছি পৌঁছাতেই ওরা দেখতে পায় একটা বাচ্ছা ছেলে টিলাটার আড়াল থেকে দৌড়ে চলে গেল। যেন বিদ্যুৎ বয়ে যায় ওদের শরীর দিয়ে, ও কি সত্যিই ভিনগ্রহী? নাকি মানুষই অথবা প্রেত? দিমিত্রি আর মারিয়া এগিয়ে এসে অনিকেত আর ইয়াংএর পাশাপাশি দাঁড়ায়, হাতে হাত রেখে ওরা চারজন সংঘবদ্ধ হয়, অনিকেত ওর বার্তা প্রেরক যন্ত্রে বিড়বিড় করে বলে যেতে থাকে সামনে ঘটে চলা ঘটনাক্রম। ওরা না থাকলেও ওদের দেখা এই ঘটনার বিবরণ তরঙ্গাকারে মহাকাশ দিয়ে আলোর বেগে বয়ে যাবে, একদিন ওদের কথা পৌঁছবে পৃথিবীতে, মানুষ শুনবে ওদের এই অলৌকিক গল্প, অবাক হয়ে দেখবে ওদের পাঠানো ছবি যেমন করে কোন মানুষ প্রথম দর্শনে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে সমুদ্র দেখে পাহাড়। ওদের সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।
চোখ বন্ধ করে বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় অনিকেত, তারপর এগোতে থাকে সামনে, হাতে হাত রেখে একসঙ্গে এগোতে থাকে বাকিরাও। মেঘের গর্জন শোনা যায়, আকাশের দিকে তাকায় ওরা, বৃষ্টি হবে কি এখন? বৃষ্টি হয় কি এখানেও?
হাত ধরাধরি করেই ওরা টিলাটার কাছে পৌঁছায়, এই টিলার ডান দিকে পাহাড়, বাঁ দিকে ঢালু ভূমি নেমে গেছে, বহুদূর অবধি দেখা যায়, দূরে ওই সমতল ভূমিতে আলো আছে, ওরা চেয়ে থাকে সেই আলোর দিকে।
অস্পষ্ট ছায়া শরীরগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, হ্যাঁ এদিকেই আসছে ওরা। অনিকেতদের চোখে লাগানো লেন্স জুম করে তুলে ধরে ওদের প্রতিকৃতি। অনিকেত অনুভব করে ওর ডান হাতটা খামচে ধরেছে ইয়াং। ক্ষণে ক্ষণে শিহরিত হচ্ছে ওরা চারজনই, অনিকেতের বাঁ পাশ থেকে মারিয়া স্বগতোক্তি করে “মৃত্যু… মৃত্যু আসছে, এই তবে নরক…”।
কতজন হবে ওরা? শতাধিক? নাকি সহস্রাধিক? একটা ধূসর দেওয়ালের মতো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ওরা হেঁটে এগিয়ে আসছে। মানুষেরই মতো ওরা, কিন্তু গায়ের রং হলুদাভ, মাথার চুল ধূসর, মানুষের চেয়ে লম্বায় কম ওরা, সম্ভবত ওদের গড় উচ্চতা সাড়ে চার ফুটের আশপাশে, বনমানুষের মতো লাগছে ওদের এখান থেকে গায়ে বড়ো বড়ো লোম ওদের। অনিকেত শ্রবণ ক্ষমতা তীব্রতর করে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করে, কথা বলছে ওরা, অস্পষ্ট স্বরে নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় করছে, কিন্তু ওদের কথার অর্থ নির্ণয় করতে অক্ষম হয় পৃথিবীর সমস্ত ভাষার সঙ্গে পরিচিত অনিকেতদের ভাষা অনুবাদক যন্ত্র।
ওদের চোখমুখে শঙ্কা ফুটে উঠেছে, সম্ভবত ওরা ভয় পেয়েছে, অজানাকে ভয়। কিছু একটা করতে হবে খুব দ্রুত, শান্তির সংকেত পৌঁছে দিতে হবে ওদের কাছে, শত্রু নই আমরা তোমাদের, এ কথা ওদের বোঝাবে কেমন করে? গভীর ভাবনায় নিজের মধ্যেই যেন ডুবে গেছিল অনিকেত, এই সময়েই তীক্ষ্ণ শব্দে সম্বিৎ ফেরে ওর, সচকিত হয়ে পাশ ফিরে তাকায় ও, দিমিত্রির হাতে নিঃশব্দে কখন উঠে এসেছে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র টেরই পায়নি ওরা, দিমিত্রি এখন একা চিৎকার করতে করতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, ওর হাতে থাকা কুচকুচে কালো যন্ত্র মুখ থেকে যেন আগুন উদ্গিরণ করছে। অনিকেত চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করে দিমিত্রিকে পরক্ষণেই অনুভব করে ওর গলা দিয়ে স্বর বেরচ্ছে না, অসহায় হয়ে সে মারিয়া আর ইয়াং-এর দিকে চেয়ে দেখে ওদেরও একই অবস্থা, বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়েছে ওরা। অনিকেত সামনে তাকায়।
ঘন সন্নিবিষ্ট যে মানুষের মতো দেখতে প্রাণীর দেওয়াল ওদের দিকে এগিয়ে আসছিল এখন তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, তুমুল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে ওখানে, তারই মধ্যে আগুনের ফুলকি ছুটে যাচ্ছে দিমিত্রির আগ্নেয়াস্ত্রর মুখ থেকে, লুটিয়ে পড়ছে ওরা, একের পর এক। অনিকেত দেখতে পাচ্ছে স্বজনহারাদের হাহাকার। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পায় সে, “দিমিত্রি…” চিৎকার করে এগিয়ে যায় অনিকেত, জড়িয়ে ধরে সে দিমিত্রিকে, কিন্তু দিমিত্রির বুকের আগুন থামেনি তখনও, অনিকেতের হাতে বাঁধন ছাড়িয়ে ওকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিমিত্রি অস্ত্র হাতে এগিয়ে যেতে থাকে, যেন আজই এই গ্রহকে প্রাণশূন্য করবে ও।
বেশি সময় লাগে না, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের বেশির ভাগই নিহত হয়, যারা বেঁচে ছিল তারা পালিয়ে যায়, পড়ে থাকে লাশের স্তূপ। দিমিত্রি তখনও থামেনি, তখনও সে উন্মাদের মতো গোলা বর্ষণ করে চলেছে, মৃতদেহরা কেঁপে কেঁপে উঠছে দিমিত্রির গোলার আঘাতে। ইতিমধ্যে ইয়াং মারিয়াও চেষ্টা করেছিল দিমিত্রিকে নিবৃত্ত করার, শোনেনি, ওদের কারোর কথায় শোনেনি দিমিত্রি। ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলে দিয়েছে ওদের। বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধে নাক জ্বালা করছে অনিকেতের, সে চোখ বন্ধ করে, তখনই বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা গায়ে পড়ে ওর। তাকিয়ে দেখে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি কখন আকাশ জুড়ে কালো মেঘ জমেছে, নক্ষত্র ঢাকা পড়েছে মেঘের আড়ালে। অন্ধকারে নেমে এসেছে। দেখতে দেখতে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়। ইয়াং পকেট থেকে ছোট্ট একটা বাক্সের মতো দেখতে যন্ত্র বের করে, ঢাকনা খুলে এই বাক্সতে সে সঞ্চিত করে কয়েক ফোঁটা জল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাক্সের উপরের সবুজ পর্দায় লেখা ফুটে ওঠে, “এই জল পানযোগ্য।” এই বিহ্বলতার মধ্যেও ওদের ঠোটে হাসি ফোটে, মানুষের বড়ো কাছের এ গ্রহ, সত্যিই মানুষের বাঁচার সম্ভাবনা আছে এই মাটিতে। হয়তো ওই মানুষগুলোই অনিকেতদের অতীত, হয়তো ওরা হত্যা করেছে নিজেদের পূর্বপুরুষদের, নতুন গ্রহে এসে রক্তের দাগ লাগল ওদের হাতে।
দিমিত্রি এই বৃষ্টির মধ্যে হাতের অস্ত্র ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, ওদের গায়ের পোশাক ভেদ করে জল আগুন কোনো কিছুই ওদের শরীর স্পর্শ করতে পারে না, এই বৃষ্টিতে শরীর ভেজাতে হলে খুলে ফেলতে হবে বাইরের আবরণ, কিন্তু এখনই সেই সাহস কারোরই হয় না, এত মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে কি আসবে না কেউ? সামনে থেকে সরে গেলেও ওরা আছে কাছেই কোথাও, নিশ্চয় আড়াল থেকে ওদের দিকে চেয়ে আছে সহস্র দৃষ্টি।
“দিমিত্রি…” অনিকেত ডাকে। দিমিত্রি এগিয়ে আসে, ওর চোখে এখন আগুন নেই, শিশুর মতো সরল ওর দৃষ্টি।
“ওরা নিষ্পাপ, এ ওদের বাসস্থান, আমরা বহিরাগত।” শান্ত স্বরে বলে অনি। কয়েক মুহূর্ত নিস্পলক চেয়ে থাকে দিমিত্রি তারপর সে কথা বলে, স্পষ্ট কাটা কাটা উচ্চারণে, “আমরা এই গ্রহ দেখতে আসিনি, দখল করতে এসেছি অনিকেত। এই গ্রহে এখনও প্রতিষ্ঠা হয়নি ন্যায়নীতি, আগে নির্বিচারে হত্যা করে এই গ্রহ দখল করতে হবে, তারপর আমরাই নিয়ম সৃষ্টি করব, আমরাই বলব হত্যা মহাপাপ, দয়া পরম ধর্ম।” কিছুক্ষণের জন্য থামে দিমিত্রি, “কী মনে হয় তোমার অনিকেত! পৃথিবীতে থমকে আছে বিজ্ঞানের অগ্রগতি? থেমে গেছে ক্রিক্স আর ন্যাকোর লড়াই? থামেনি, থামতে পারে না। ওরা আসছে, ওরা পথে আছে। ওরা আসার আগে আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে এই গ্রহে, অন্যথায় আমাদের মৃত্যু ভিনগ্রহীদের হাতে নয়, মানুষের হাতে হবে। মনে রেখ অনিকেত, অন্য কোনো প্রাণ নয়, মানুষই মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রু, সবচেয়ে বড়ো প্রতিপক্ষ। যুগে যুগে মানুষই মানুষকে হত্যা করেই প্রতিষ্ঠা করেছে মানবধর্ম”।
অনিকেত আর কিছু বলে না, ওর মনে পড়ে অভিযানের আগে প্রফেসর সাং ওদের নিজের কেবিনের নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বলেছিলেন, “তোমরা কতজন মহাভারত পড়েছ জানি না, মহাভারত আমার বড়ো প্রিয় গ্রন্থ। তোমাদের বিদায়বেলায় আজ মনে হচ্ছে, তোমরা হলে মহাভারতের অভিমুন্য, আমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, বলেছি তোমরা পথ দেখিয়ে শুধু এগিয়ে চল, আমরা সকলে তোমাদের অনুসরণ করব। বলেছি লড়াই আমরা করব তোমরা শুধু এ মহাকাল অতিক্রম করার রাস্তা দেখিয়ে দাও।” ওদের চারজনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ নীরবে চেয়েছিলেন তাকান প্রফেসর। “মহাভারতের সে প্রতিশ্রুতি মিথ্যা ছিল না, ছিল অক্ষম। আমরা কি আজ সক্ষম হয়েছি? নাকি আজ আবার অক্ষম প্রতিশ্রুতির বাঁধনে বেঁধে ফেলছি তোমাদের! হে বীর তোমরা এগিয়ে যাও নতুনকে জানার আনন্দে, আমাদের প্রতিশ্রুতি যেন তোমাদের দুর্বল না করে। মনে রেখো যুদ্ধ নয় অভিমুন্যুর মৃত্যুই তাঁকে অমর করেছিল। তোমরাও প্রতিমুহূর্তে সাহসী থেকো।”
৫
কিছুদূর অন্তর অন্তর ক্যামেরা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্র স্থাপন করে ওরা ফিরে এসেছে ওদের মহাকাশযানে। পাঁচটা রোভার এখন আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা পরীক্ষা করে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে, তারপর ওরা আবার বেরিয়ে আসবে মহাকাশযান থেকে। এখন ওরা যানের ভেতরের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার বেষ্টনীর মধ্যে বসে পর্দায় খুঁটিয়ে দেখছে মৃতদেহের ছবি।
এদের গায়ের রং শুধু হলুদাভ নয়, রক্তও পীতবর্ণের। অন্তত একশোটা দেহ স্তূপীকৃত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। রোভারকে দিমিত্রি নির্দেশ দেয় কিছু মাংস নমুনা পরীক্ষা করার জন্য, মুহূর্তের মধ্যে রোভার একটি শিশুর মুখের বাঁদিকের অংশ ধারাল ব্লেড দিয়ে খুবলে নিয়ে সেই মাংসখণ্ড নিজের অভ্যন্তরের রসায়নাগারে নিক্ষেপ করে। মিল আছে, মানুষের সঙ্গে এদের শরীরের আভ্যন্তরীণ গঠনতন্ত্রের অস্বাভাবিক মিল আছে। দিমিত্রি প্রশ্ন করে “এ মাংস কি খাওয়ার যোগ্য?” ক্ষণমাত্র সময় নেয় যন্ত্র, তারপরেই জানিয়ে দেয় ‘হ্যাঁ, মানুষের আহারযোগ্য এই হলুদাভ মাংস।’ উচ্ছ্বাসে প্রায় লাফিয়ে ওঠে দিমিত্রি, “খাদ্যের সমস্যার সমাধান হয়ে গেল তবে! তিরিশ বছর আগের স্টোর করা খাবার খেয়ে খেয়ে আমার মুখে চড়া পড়ে গেছে।” অনিকেত আর ইয়াং হাঁ করে চেয়ে থাকে দিমিত্রির দিকে, মারিয়া ওক্ তোলে। দিমিত্রি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে, “যতদূর জানি তোমরা কেউ শাকাহারি নও, পৃথিবীতে থাকতে সকলেই কবজি ডুবিয়ে মাংস খেয়েছ, এখন ভিনগ্রহে এসে ভিনগ্রহীর মাংস খাওয়ার কথা শুনে এমন বমি করার অভিনয় করছ কেন জানতে পারি?” অনিকেত কিছু বলার চেষ্টা করে, হাত তুলে ওকে চুপ করায় দিমিত্রি, “ন্যাকামি করো না অনিকেত, এদের সঙ্গে মানুষের মিল আছে কিন্তু এরা মানুষ নয়, দয়া করে এখন আবার গ্যাদগ্যাদে আবেগভরা গল্প শুনিয়ো না আমায়!” অনিকেতকে প্রায় ব্যাঙ্গ করে যখন এসব কথা বলছিল দিমিত্রি তখন হঠাৎই অনিকেতের জামা ধরে টানে ইয়াং, আতঙ্কিত গলায় বলে “ওদিকে দেখো…”।
দানবীয় আকৃতির জলহস্তীর মতো কিছু চারপেয়ে জীব এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহে দাঁত বসাতে শুরু করেছে, দিমিত্রি চিৎকার করে রোভারকে নির্দেশ দেয় ফিরে আসার জন্য, কিন্তু যে মুহূর্তে সে সশব্দে ফেরার পথ ধরে সেই দানব চোখ তুলে তাকায়, এগিয়ে এসে পা দিয়ে পিষে দেয় সেই রোভারকে, অন্ধকার হয়ে যায় পর্দা। নতুন করে আতঙ্ক ওদের গলা চেপে ধরে। এ গ্রহে প্রাণ আছে, আবিষ্কারের এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হবে কি আদৌ? তড়িঘড়ি ওরা বাকি রোভারগুলিকে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়।
এই মহাকাশযানের মধ্যেই একটি ছোটো স্বয়ংক্রিয় গাড়ি আছে, নক্ষত্রের আলো এ গাড়ির জ্বালানি। আরও পরে যখন আবার শান্ত হয়ে যায় চারপাশের পরিবেশ তখন ওরা গাড়ি নিয়ে বেরোয়।
শব্দহীন যান রুক্ষ মাটির উপর নিঃশব্দে এগিয়ে চলে, পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে চারিপাশ যেন শুষে নিতে থাকে ওরা চারজন। একটুক্ষণ আগে যেখানে শতাধিক মৃতদেহ পড়েছিল, এখন সেখানে কিছু নেই। শুধু কিছু শুকনো হলুদ রঙের দাগ রয়ে গেছে। এখানে কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থামায় ওরা। আর একটু দূর থেকেই মাটির রং বদলেছে, আলো আর অন্ধকারের ধূসর সীমারেখায় এসে দাঁড়িয়েছে ওরা এখন, সামনেই এই সীমারেখা শেষ হয়েছে, শুরু হয়েছে রাত্রিহীন অনন্ত দিবস।
নক্ষত্রের লালচে আলোয় ঝকঝক করছে মাটি, নীল আকাশে ধূসর মেঘ সমুদ্রের বুকে পাল তোলা জাহাজের মতো ভেসে যাচ্ছে, পৃথিবীর সঙ্গে তফাৎ নেই এই মাটির, এই আকাশের, এই মেঘেদের। অনিকেতের চোখ উপচে এক বিন্দু জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, অপ্রস্তুত হয় ও, চোখের জল মুছতে গিয়ে খেয়াল করে ও একা নয় মারিয়া ইয়াং এমনকি দিমিত্রিও অবাক হয়ে ছলছল চোখে চেয়ে আছে সেই চিরকালীন দৃশ্যের দিকে, নীল আকাশ আর সাদা মেঘ, এই চিরপরিচিত সাধারণ দৃশ্যের মধ্যেও যে এত আবেগ লুকিয়ে আছে তা কে জানত!
অনিকেতই সামনে চলার নির্দেশ দেয় গাড়িকে, পাহাড়ি এবড়োখেবড়ো রাস্তা বেয়ে ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসতে থাকে গাড়ি। বাইরের তাপমাত্রা বাড়ছে, একটু দূরেই অনেকটা জায়গা জুড়ে কালো দাগ মাটিতে। যেন কেউ ঝলসে দিয়েছে এ অঞ্চলের মাটি। “জীবন এখানে সহজ নয়…” মারিয়া বলে, “এই রাত্রিহীন অনন্ত দিবস, তার মধ্যে নক্ষত্রের আগুন উদ্গিরণ… কেমন করে বাঁচে এখানে জীব?”
আরও কিছু দূরে যেতে গাছ দেখা গেল, সবুজ বনভূমি। যেন হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই গাছেরা। পৃথিবীরই মতো এ গাছের পাতা সবুজ, গুঁড়ির রং কালচে বাদামি। “এই সব গাছেরা এখনও নামহীন, আমাদেরই এদের নাম দিতে হবে…” ইয়াং যেন নিজেকেই বলে, মুগ্ধতা কাটছে না ওদের। সবকিছু যেন স্বপ্ন বলে মনে হয়, সবুজ বুনো ঘাস আর আগাছার উপর দাগ টানতে টানতে এগিয়ে চলছে গাড়ি, “মানুষ নিশ্চয় আবার আসবে এখানে, আমাদের চেয়ে আরও অনেক অনেক গভীরভাবে জানবে এ গ্রহের মাটির ইতিহাস, কিন্তু আমাদের মতো বিস্মিত ওরা হবে না। ওরা জেনেই আসবে প্রাণ আছে, ওরা জেনেই আসবে মহাবিশ্বে মানুষ একা নয়, এই সীমাহীন প্রথম বিস্ময় শুধু আমাদের, শুধু এটুকু পাওয়ার জন্যই পৃথিবী ত্যাগ করা যায়, করা যায়, এক জীবনে এতো কেই বা পেয়েছে!” নিজেকে নিজেই বলে অনিকেত।
জানালার কাচ নামিয়ে দেয় ইয়াং, বাইরে পাখির কুঞ্জন, একটা লাল পাখি ওদের গাড়ির সামনে দিয়ে উড়ে যায়, মারিয়া গাড়িকে থামার নির্দেশ দেয়, কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় ওরা এখানে। “এ জঙ্গলে নিরাপদ কতটা জানি না আমরা, জানালার কাচ পুরোপুরি নামিয়ে রেখো না” অনিকেত বলে। এই সময় হঠাৎই মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে ওদের কিছু বোঝার আগেই দিমিত্রি গুলি চালায়।
দিমিত্রির মধ্যে এত আগুন ছিল আগে বোঝেনি ওদের কেউই, তুষারাবৃত এক প্রত্যন্ত গ্রামে ওর জন্ম। সৎ মায়ের কাছে বেড়ে ওঠা, এক এক রাতে মারতে মারতে মা ওকে প্রচণ্ড ঠান্ডায় ঘর থেকে বের করে দিত, দরজার কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁপত ও সারারাত, খুব কষ্টের ওর শৈশব। প্রথম যৌবনের চারটে বছর ও যুদ্ধক্ষেত্রে কাটিয়েছে, হয়তো সেইসময় থেকেই ওর চেতনার কোথাও কোনো গভীর দাগ রয়ে গেছে, জীবনে কখন যে কার মনে কীভাবে ক্ষত সৃষ্টি হয়! বুকের ভেতর জমে থাকে পুঁজ রক্ত! অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অনিকেত, এই সময়েই একটা পাখির মৃতদেহ নিয়ে গাড়িতে উঠে আসে দিমিত্রি “এটা তো মানুষ নয়? একে ভক্ষণ করতে নিশ্চয় আপত্তি নেই, অহিংসার পূজারীদের?”
অতঃপর এ মাংস পরীক্ষা করে দেখা হয় খাওয়ার উপযুক্ত কিনা, গাড়িতেই আছে ঝলসানোর উপকরণ। এই মাংসে আর কেউই আপত্তি জানায় না। একটু কষা স্বাদ, কিন্তু এ ওদের খাদ্যের স্বাদ নির্ণয় করে তৃপ্ত হওয়ার সময় নয়, মুহূর্তে নিঃশেষিত হয়ে যায় পাখির মাংস। গাঢ় লাল কয়েকটা পালক নিজের কাছে রেখে দেয় অনি। দিমিত্রি বলল “এই পাখির নাম দেওয়া হোক কষা পাখি…” চারজনেই হেসে উঠল। গাড়ি আবার চলতে শুরু করে।
“এখনও কোনো বসতি দেখলাম না… কোথা থেকে এসেছিল লোকগুলো?” জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত স্বরে নিজেকেই প্রশ্ন করে মারিয়া।
জঙ্গল ঘন হচ্ছে ক্রমশ, গাড়ি চলা কষ্টকর এই ঘন অরণ্যে, এই গাড়ি প্রয়োজনে কিছুটা পথ ভেসে থেকে অতিক্রম করতে পারে, এভাবেই কখনও মাটি স্পর্শ করে কখনও হাওয়ায় ভেসে ওরা এগিয়ে চলেছে। চারপাশে লাগানো সেন্সরে কোনো জীবের অস্তিত্ব পেলেই থমকে দাঁড়াচ্ছে গাড়ি। কোনো বড়ো জীব এখনও আসেনি ওদের সামনে, ওরা দেখেছে কিছু ছোটো সরীসৃপ, কিছু পাখি, দেখেছে প্রায় পিঁপড়ের মতো কিছু পোকা গাছের গুঁড়ি বেয়ে সারিবদ্ধ হয়ে উঠছে, মৌমাছির মতো শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে পতঙ্গ। ধীরে ধীরে সয়ে যাচ্ছে এই গ্রহ ওদের চোখে, গাছের সবুজ পাতা দেখে অবাক হওয়ার সময় পেরিয়ে ওরা এখন খুঁজছে আরও কিছু, আরও নতুন কিছু। জল দেখতে চায় ওরা, মহাকাশযান যখন এ গ্রহের চারপাশে চক্কর দিয়েছিল তখন ওরা সমুদ্রের ছবি দেখেছে, এই মাটিতে সমুদ্র আছে, নদী আছে। পৃথিবীর মতো এখানেও প্রাণ এসেছে জল থেকে। সামনে আরও গভীর জঙ্গল, গাছের পাতারা নিশ্ছিদ্র এক পর্দা সৃষ্টি করে গতি রোধ করেছে আলোর। ওরা গাড়িকে নির্দেশ দেয় অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাওয়ার। গাড়ি আলোকে অনুসরণ করে, যেদিকে বৃদ্ধি পেয়েছে উষ্ণতা সেদিকে অগ্রসর হয়।
দীর্ঘক্ষণ ঘুম হয়নি ওদের কারোরই, শরীরে সীমাহীন ক্লান্তি জমেছে তবু উত্তেজনায় দু-চোখের পাতা এক করতে পারছে না ওরা কেউই, কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে গাড়ি। কিছু দূরে একটা বিশাল হ্রদ চোখে পড়ে ওদের, সবুজাভ স্বচ্ছ জল। গাড়ি দাঁড় করিয়ে ওরা নিস্পলক চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ সেদিকে, গাড়ির যান্ত্রিক স্বর ওদের গাড়ি থেকে নামতে বারণ করে, এই জলে কোনো অজানা বিপদজনক প্রাণী থাকতে পারে। ছোঁয়া যাবে না শুধু দূর থেকে দেখা যাবে এই জল। ইয়াং গাড়ির জানালা থেকে একটা ছোট্ট বলের মতো জিনিস ছুড়ে দেয়, সেই বল গড়িয়ে গিয়ে হ্রদের জলের কাছে পৌঁছে লম্বা একটা দণ্ডের আকার ধারণ করে, দাঁড়িয়ে থাকবে ওখানেই ও, ছবি তুলবে দেখবে এই হ্রদের গতি প্রকৃতি। এগিয়ে যায় ওরা, পথে আরও একবার পাখি শিকার করে দিমিত্রি। ওদের শরীরের বিপাকক্রিয়া এখনও নিয়ন্ত্রিত, খিদে তৃষ্ণা এখনও সাধারণ মানুষের চেয়ে কম, ধীরে ধীরে বাড়ছে ওদের শরীরের জৈবিক চাহিদা।
আরও পরে এক খোলা সবুজ প্রান্তরে এসে ওরা গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে, ঘাসের উপর বসে, ঢালু জমি, শান্ত সমাহিত এ অঞ্চল। ভারী পোশাকে মাথা থেকে পা অবধি ঢাকা ওদের, এত নিরাপত্তার বেড়াজালের মধ্যে থেকে প্রকৃতিকে ছুঁয়েও যেন ছোঁয়া যায় না। এই সময়েই ওরা ওই বর্মের মতো পোশাক খুলে ফেলে, ছুঁয়ে দেখে ঘাসের পাতা, ছুঁয়ে দেখে মাটি। এ ঘাসের পাতার ওপরের অংশ ঘষা কাচের মতো খসখসে আর বেশ শক্ত, টানলে চট করে ছিঁড়ে যায় না। এই সময়েই মারিয়া মাটিতে কয়েকটা গর্ত আবিষ্কার করে, সাপের মতো কোন সরীসৃপ থাকতে পারে এখানে। ইয়াং বলে “আমার কেমন মনে হচ্ছে যেন আমরা আসব বলেই শূন্য এই প্রান্তর? এই সবুজ প্রান্তরে কারোর কি থাকার কথা ছিল না? মনে হচ্ছে কেউ আড়াল থেকে দেখছে আমাদের…”। ইয়াং-এর কথায় এমন কিছু ছিল চারজনেরই গা ছমছম করে ওঠে। প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওরা গাড়িতে ওঠে। গাড়ির পেছনে ছোট্ট একটা স্বয়ংক্রিয় গবেষণাগারে প্রতিমুহূর্তে বাতাস থেকে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন সংগ্রহ করে জল তৈরি হচ্ছে, ওরা চারজনেই ঢকঢক করে অনেকটা জল খায়।
ঘাসের প্রান্তর পেরিয়ে আরও এগিয়ে যায় ওরা, এখানে জমি ভিজে, ইতিউতি আছে কিছু গাছ, ইয়াং চিৎকার করে গাড়িকে থামার নির্দেশ দেয়, “ভিজে মাটিতে কিছু পায়ের ছাপ পড়েছে, ছয় পায়ের কোনো জন্তু, শরীরে চাপে অনেকটা বসে গর্ত হয়ে গেছে মাটি, সম্ভবত কিছু আগেই হেঁটে গেছে সে এ পথ দিয়ে, চারজনেই পরস্পরের দিকে তাকায়, একটা রোভার নামিয়ে অনুসরণ করা যায় এই পায়ের ছাপ, কিন্তু তাতে দেরি হয়ে যাবে, তা ছাড়া ইতিমধ্যে একটা রোভার নষ্ট হয়েছে, এই সময় দিমিত্রি আবার বের করে আনে তার আগ্নেয়াস্ত্র, ওরা এবারে আর কিছু বলে না দিমিত্রিকে। গাড়ির গতি কমিয়ে নিঃশব্দে ওরা অনুসরণ করতে থাকে ওই পায়ের ছাপ, আর এই পথেই ওরা পৌঁছে যায় মহাসমুদ্রে। সমুদ্রের বালিতে স্পষ্ট হয়েছে পায়ের ছাপ, মিলিয়ে গেছে সমুদ্রেরই জলে।
মুগ্ধতার আর শেষ নেই, মারিয়া ফিসফিস করে অনিকেতকে বলে, “এবার শরীরটা সারাতে হবে, কারোর জন্য নয় শুধু নিজের জন্য নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে হচ্ছে আজ। শুধু দু-চোখ ভরে দেখার জন্য আরও অনেক অনেক বছর বাঁচতে চাই আমি অনিকেত।” অনিকেত তখন মারিয়ার কথা শুনতে পাচ্ছে না, ওর চোখেও ঘোর লেগে আছে, উত্তাল সমুদ্রের নীল জলের ঢেউ ভাঙছে ধবধবে সাদা বালির উপর, একের পর এক ঢেউ, অক্লান্ত জলরাশি। না জানি কত শতাব্দী ধরে চলছে এই ঢেউ ভাঙার খেলা, না জানি কত হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ গ্রহে এখন এই মুহূর্তে এই একইভাবে মহাসমুদ্র ঢেউ তুলে গর্জন করতে করতে তীরের দিকে ফণা তুলে ছুটে আসছে, নিষ্ফল আক্রোশে ছোবল মারছে বালির উপর তারপর নির্বিষ হয়ে ফিরে যাচ্ছে শুধু আবার নতুন উদ্যমে ছুটে আসবে বলে। বহুক্ষণ ওরা কেউ কোনো কথা বলতে পারে না, শুধু চেয়ে থাকে। সম্ভবত অপরিচিত ওই পায়ের ছাপ আর উত্তাল সমুদ্র দেখেই গাড়ির যান্ত্রিক স্বর ওদের গাড়ি থেকে নামতে বারণ করে। চারজনেরই ইচ্ছে ছিল এই সমুদ্র ছুঁয়ে দেখতে কিন্তু অমন বিশাল এক প্রাণী যে জলে কিছুক্ষণ পূর্বেই অবগাহন করেছে সেই জল ছোঁয়ার সাহস শেষ অবধি ওরা কেউই করে উঠতে পারে না, সমুদ্রের পাড় ঘেঁষেই চলতে শুরু করে গাড়ি। দীর্ঘ পথ চলে এসেছে ওরা, সময়ের কোনো হিসাব নেই, এলোমেলো রাস্তায় শুধু এগিয়েছে ওরা, এই গাড়ি স্মৃতিতে ধরে রেখেছে পথ, ওই ওদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আবার ওদের যানের কাছে।
আরও কিছুদূরে অবশেষে ওরা দেখতে পায় মানুষেরই মতো সেই হলুদাভ জীবদের, সমুদ্রের জলের অনেকটা ভেতরে একটা বড়ো বাঁশ জাতীয়ও কিছু পোঁতা, তার উপর বসে আছে একজন, সম্ভবত কোনো কিশোর, জলে বড়শি ফেলে সে মাছ ধরছে, এমন দৃশ্য আজও পৃথিবীর কিছু কিছু সমুদ্র উপকুলে দেখা যায়, তফাৎ নেই একেবারে হুবহু এক, এবারে দিমিত্রি তাকে বধ করার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র বের করতেই ওকে তিনজনে প্রবলভাবে বাধা দেয়, “আমাদের ওদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করতে হবে, ওদের সঙ্গে শত্রুতা করে টিকে থাকতে পারব না আমরা এখানে দিমিত্রি, বোঝার চেষ্টা করো।” দিমিত্রির ঠোটে হাসি ফুটে ওঠে, “আমরা ওদের শত্রুই, ওদের ভয় দেখিয়ে জয় করতে হবে, সেটাই একমাত্র পথ।” কয়েক মুহূর্ত থামে দিমিত্রি, তারপরেই ওর ঠোঁটের হাসি দীর্ঘতর হয় হঠাৎ সে বলে ওঠে “খিদে পায়নি তোমাদের কারোর?” কিছু না বলে দিমিত্রি দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকায় ওরা তিনজন, দিমিত্রি অস্ত্র নামিয়ে রাখে, ওদের গাড়ি নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু তবু কি করে জানি ছেলেটা টের পেয়ে যায় কেউ আসছে, হঠাৎ ওই মাঝসমুদ্র থেকেই সে ফিরে তাকায় এদিকে, আর তারপরেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, জলের ঢেউয়ে হারিয়ে যায় সে, ওরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, নিশ্চল নির্বাক, আর জল থেকে উঠে আসবে না কি সে? নাকি এই মহাসমুদ্রের নীচেই ওরা ঘর বেঁধেছে? হাজারো চিন্তা ভিড় করে আসে অনিকেতদের মনে।
একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল ওরা, পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি তখনও, ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ ওদের গাড়ির একেবারে সামনে জল থেকে উঠে আসে সে, হলদে শরীর জুড়ে বড়ো বড়ো লোম, লম্বা চুল মাথায়, ভালো করে দেখার অবকাশ হয় না, তার আগেই সে কানফাটা স্বরে সে শীষ দিয়ে ওঠে, তীক্ষ্ণ সেই স্বরে অনিকেতদের সারা শরীরে যেন সূচ ফোটার যন্ত্রণা হয়, তারপরেই বিদ্যুৎগতিতে জানালা খুলে আগ্নেয়াস্ত্রে নিশানা করে দিমিত্রি, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ চারিদিকে লাল আগুনের লেলিহান শিখায় ঢেকে যায়। তীব্র লাল রং ওদের দখল করে। তারপর সব চুপ, আর এই অখণ্ড নীরবতার মধ্যে শুধু একের পর এক সমুদ্রের ঢেউ বালির উপর আছাড় খেয়ে পড়তে থাকে, ক্লান্তিহীন, নিরবিচ্ছিন্ন এই যাওয়া আসা।
৬
চার বছর পরে পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় অনিকেতদের খবর, পৃথিবীর মানুষ অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখে তিরিশ বছর আগের চারজন অভিযাত্রী অসম্ভবকে সম্ভব করে পৌঁছে গেছে কোন সুদূর আলোকবর্ষ দূরের গ্রহতে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, বারে বারে দেখতে হয়, একদিন যারা অবিশ্বাস করেছিল আজ তারাও মুগ্ধ হয়।
সত্যিই তবে মানুষ একা নয়, সেই কোন আদিমযুগ থেকে মানুষ কতই না কল্পনা করেছে পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সম্ভাবনার নিয়ে, সেসব তবে নেহাত কল্প কথা নয়। সারা পৃথিবীর মানুষ অবাক বিস্ময়ে ভিনগ্রহীদের দেখতে থাকে, যেন এ কোনো স্বপ্নলোক। এরই মধ্যে কেউ কেউ বলে মিথ্যা এসব, ঠান্ডাযুদ্ধে এগিয়ে থাকার জন্য বুজরুকির সহায়তা নেওয়া হয়েছে। আবেগে প্রতিবাদে ভালোবাসায় হিংসায় তুমুল উত্তেজনায় আন্দোলিত হয় মানুষ, কিন্তু এ উত্তেজনা স্থায়ী হল না, খুব তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে গেল ও গ্রহের ছবি। সমুদ্র থেকে উঠে এল সেই হলদে কিশোর, তীক্ষ্ণ স্বরে শীষ দিল সে তারপরেই শুধু আগুন আর আগুন। পর্দা জুড়ে শুধুই লাল। আর কোনো খবর নেই, নেই শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ, নেই কোনো ছবি।
সেই কবে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছিল ওরা, সেদিনই চিরবিদায় জানিয়ে গেছিল স্বজনদের কাছে, আজ এত বছর পর ক্ষণিকের জন্য যখন ওরা ফিরে আসে তখন আর ওদের স্বজন কোথায়! আজ পৃথিবী শুদ্ধ মানুষের চোখে জল ওদের জন্য, এখন ওদের আর আলাদা কোনো পরিচয় নেই, ওদের জয়-পরাজয় মানুষের জয়-পরাজয়। চরম সাফল্য অথবা ব্যর্থতা মানুষকে এমন পরিচয়হীন করে দেয়, একান্ত আপন স্বজনদের সুখদুঃখ হাজার মানুষের অনুভূতির স্রোতে ভেসে যায়, সূক্ষ্ম অনুভূতিদের তখন আর আলাদা করে চিনে নেওয়া যায় না।
অনিকেতের মেয়ে শ্রমণা ঘর অন্ধকার করে একাকী তাকিয়ে থাকে পর্দায় ফুটে ওঠা বাবার একটা স্থির ছবির দিকে, মাথায় সাদা হেলমেট, আপাদমস্তক সাদা পোশাকে আবৃত একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে আধো অন্ধকারে কালচে মাটির উপর। আজ সারা পৃথিবীর মানুষ চেনে এই লোকটাকে, কিন্তু শ্রমণা চেনে না ওর বাবাকে! অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে শ্রমণা অনিকেতের দিকে, বাবার কোনো স্মৃতি নেই ওর, জানে না কখনও বাবা ওকে কোলে নিয়েছিল কিনা! বাচ্চাদের একটা ইস্কুলে পড়ায় শ্রমণা, ওর একাকী নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ ঝড় ওঠে। এই আলোড়ন কেন ওর একটুও ভালো লাগে না। সারা পৃথিবী আজ শ্রমণার কাছে জানতে চায় ওর কেমন লাগছে, গর্ব হচ্ছে নাকি কষ্ট হচ্ছে! শ্রমণা নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখে।
প্রক্সিমা সেন্তরি বি-তে প্রাণ আছে, মানুষের মতো প্রাণী আছে, বহির্বিশ্বের এই অভাবনীয় ঘটনা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে অত্যাশ্চর্য ঐক্য নিয়ে আসে, যুযুধান রাষ্ট্র এবং তার নিয়ন্ত্রকরা বহুযুগ পরে হাতে হাত রেখে লক্ষ্য স্থির করে, বিজ্ঞানীরা কাছাকাছি আসে। যে ঠান্ডাযুদ্ধ জলে স্থলে অন্তরীক্ষে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, এই ঘটনায় তা প্রশমিত হয়।
এই অভিযানের প্রধান সমস্যা সময়, পৌঁছাতেই যদি তিরিশ বছর সময় লেগে যায় তবে যারা যাবে তাদের ফেরার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য হয়ে যায়, এই সমস্যা সমাধান করার জন্যই পৃথিবীর যুযুধান দুই পক্ষের এক হয়ে কাজ করার প্রয়োজন হয়। লেজার বিমের সাহায্যে এখন প্রায় আলোর অর্ধেক গতিতে মহাকাশযান প্রেরণ করতে সক্ষম ন্যাকো, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের পরে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেধারা মিলিত হয়ে সেই সমাধান করে এই সময় দূরত্বের অঙ্ক। এই নতুন প্রযুক্তির সাহায্যেই প্রক্সিমা সেন্তরি বি-তে পরবর্তী অভিযান করা হবে, এবারে আর তিরিশ বছর সময় লাগবে না, দশ বছরের মধ্যেই মহাকাশযান পৌঁছে যাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। একটা স্থায়ী পরিকাঠামো গড়ে তোলা হবে ওই গ্রহে, এবং কোনো একটা অভিযান নয়, প্রতি বছর অভিযান করা হবে, এক বছর পর পর ফিরিয়ে আনা হবে আগের অভিযাত্রীদের, এবারে আর কেউ নির্বাসিত হবে না প্রক্সিমায়, যারা যাবে তারা ফিরে আসবে।
প্রস্তুতিতেই প্রায় তিন বছর লেগে যায়, তারপর শুরু হয় অভিযান, দশজন অভিযাত্রীর একটি দল, দুই বছর ধরে এদের কঠিনতম পরিস্থিতির মধ্যে বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, এরা এক বছর থাকবে এই গ্রহে, এরা বিজ্ঞানী নয়, এদের প্রধান কাজ সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে নতুন সে গ্রহকে মানুষের বসবাস যোগ্য আবাস করে তোলা। বিজ্ঞানীরা যাবে পরবর্তী অভিযানে। এই দশজন ওই গ্রহে দ্বিতীয় মানুষের দল, দ্বিতীয়দের জন্য অমরত্ব নেই, এদের নাম সভ্যতার ইতিহাসে লেখা থাকবে না। এই অভিযানে পাঠানো হচ্ছে প্রচুর অস্ত্র, ধরেই নেওয়া হয়েছে এরা বাধা পাবে, এদের জোর করে অন্যের ভূমি দখল করতে হবে।
পৃথিবী জুড়ে নানা মানবাধিকার সংগঠন আপত্তি করেছিল, বলেছিল এবারে আর মানুষ নয় শুধু যন্ত্রদেরই পাঠানো হোক, কিন্তু রাষ্ট্রগুলি তাতে সম্মত হয়নি, অদূর ভবিষ্যতে যদি মানুষের স্থায়ী আবাস হিসাবে গড়ে তুলতে হয় ওই গ্রহকে তবে মানুষকে সেখানে প্রথম থেকেই থাকতে হবে, পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে হবে ওই পরিবেশের প্রতিকূলতা।
শ্রমণাও মিছিলে হেঁটেছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, কিন্তু ওদের এই প্রতিবাদের কণ্ঠ বেশিদিন জাগ্রত থাকে না, বন্ধ ঘরে শ্রমণা ডাইরিতে লেখে, এও এক যুদ্ধ, ক্ষমতাহীন যারা যুগে যুগে তারাই যুদ্ধে যায়, প্রাণ দেয়। নিরঙ্কুশ হয় যখন আধিপত্য তখনই সেখানে যায় জয়ীপক্ষ, যায় রাজপুরুষেরা।
এই অভিযানের বিপুল খরচ বহন করতে হয়েছে পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রকে, শ্রেষ্ঠতম মস্তিষ্কদের নিংড়ে দিতে হয়েছে তাদের মেধার সবটুকু। সম্ভবত এই প্রথম সারা পৃথিবীর মিলিত কোনো চেষ্টায় এত বিশাল কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে চলেছে। বিশেষ সতর্কতা হিসাবে একটি নয় তিনটি পৃথক মহাকাশযানে পাঠানো হচ্ছে ওদের, দীর্ঘ এ পথে যদি অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সবাই যেন একসঙ্গে না হারিয়ে যায়। বিপ্লবী সংবাদপত্র এবারেও শিরোনাম করে “সভ্যতার আরও কিছু লাইকা প্রয়োজন” ছবিতে দেখা যায় রুক্ষ পাথুরে মাটিতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আকাশের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দশটা কুকুর।
৭
দশ বছর পরে খটখটে দিনের আলোয় প্রক্সিমা সেন্তরি বি-র মাটিতে নেমে আসে তিনটি মহাকাশযান। ঝকঝকে নীল আকাশ, ঘাসে ঢাকা সবুজ সমতলভূমি, ইতিউতি কিছু বড়ো গাছ, তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসের কাছাকাছি।
দশজনের মধ্যে দুজনের শীতঘুম ভাঙেনি, দীর্ঘ যাত্রাপথে শীতঘুম থেকেই অনন্ত ঘুমের জগতে তলিয়ে গেছে ওরা। নতুন এই গ্রহের মাটি ওই দুজন মানুষকে ধারণ করবে, পৃথিবীর ঈশ্বরের নাম উচ্চারিত হবে ওদের দুটি দেহ পঞ্চভূতে সমর্পণ করার সময়। মানুষের সঙ্গে মানুষের ঈশ্বরও নতুন গ্রহে আসবেন আজ, তুলনা করে দেখবেন কোন সৃষ্টি বেশি চিত্তাকর্ষক।
মেশিনেরা আড়াল করে দাঁড়িয়েছে মানুষদের, বন্দুক হাতে অতন্ত্র প্রহরীর মতো জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে রোবটেরা, আকাশে উড়তে শুরু করেছে ড্রোন। আটজন মানুষের চোখের সামনে একের পর এক অনুভূতির রঙিন পর্দা নেমে আসে, কখনও বিস্ময় কখনও ভয়, চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে ওরা নতুন নক্ষত্রের আলোয় নতুন গ্রহের রং রূপ, এ দেখার শেষ নেই। অবতরণের কিছুক্ষণের মধ্যেই অনিকেতদের দিকে যেমন পায়ে পায়ে ভিনগ্রহীরা এগিয়ে এসেছিল, আজকের অভিযাত্রীদের দিকে তেমন কেউ আসে না, অথবা এলেও থেকে যায় দৃষ্টিসীমার বাইরে, মৌমাছির মতো একটানা শব্দ করে আকাশে টহল দিচ্ছে এক ঝাঁক ড্রোন, ওদের সজাগ দৃষ্টি নিরাপত্তার দুর্ভেদ্য ব্যূহ রচনা করেছে এই মানুষদের চারপাশে।
অনিকেতদের মতো আজকের মানুষগুলো এই গ্রহে এসেই পর্যটকের মতো ভ্রমণেও বেরোয় না, ওরা থিতু হয় এই সমভূমিতেই, তাঁবু খাঁটিয়ে তাঁবুর চারপাশে আগুনের বেষ্টনী তৈরি করে। একটানা রাত্রিহীন ক্লান্তিকর দিনের আলো মেনে নিতে প্রথম প্রথম কষ্ট হয় ওদের, উজ্জ্বল আলো নিরবিচ্ছিন্ন এক একঘেয়ে সময়ের অখণ্ড পিণ্ড সৃষ্টি করেছে এই দেশে, যার শেষ নেই। সূর্যোদয় সূর্যাস্তহীন এই অন্তহীন আলোর মধ্যে সময় পরিমাপ করা বড়ো শক্ত। নীল আকাশ সবুজে ভরা মাটি দেখতে দেখতে একসময় ওদের অনন্ত বিস্ময় ভরা দৃষ্টিও গ্রাস করে নেয় সীমাহীন শ্রান্তি। ক্লান্ত চোখের পাতা আপনা থেকেই বুজে আসে যখন, তখন ওদের চোখের সামনের দর্পণও অন্ধকার হয়ে যায়, দিনের আলো মুছে দিয়ে কৃত্রিম কালো রাত্রি নেমে আসে ওদের সামনে। এইভাবে ঘুমিয়ে এবং জেগে কেটে যায় বেশ কয়েকটা দিন অথবা বছর, প্রতি এগারো দিনে নক্ষত্র ভ্রমণ করে আসার পথেই পর্যায়ক্রমে এই গ্রহে আসে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা। ঋতু পরিবর্তনের প্রভাব বড়ো কম এই গ্রহে, তবু এই বার্ষিকগতির পথে অনুভব করা যায় সময় বিশেষে তাপমাত্রার ওঠানামা।
এই গ্রহে মানিয়ে নিতে সময় লাগে ওদের শরীর মনের, শীত গ্রীষ্ম আসে যায়, তারপর একসময় ধীরে ধীরে ওরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এই মাটির সঙ্গে, এই পরিবেশের সঙ্গে। প্রতিমুহূর্তে তখন আর ওদের চোখে বিস্ময়ের ঝিলমিল রং লাগে না। এরই মধ্যে ফিরে আসে মৃত্যু, আরও একজন মারা যায়, থেকে যায় সাত জন। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হতেই ফিরে আসে একাকীত্ব, নতুন করে উপলব্ধি হয় কি প্রচণ্ড একা ওরা এই মাটিতে, চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়তে থাকে, কৃত্রিম আবেগ সম্পন্ন যন্ত্ররা ওদের মনের ভাব বুঝে ওদের সান্ত্বনা দেয়, বোঝানোর চেষ্টা করে ওরা ভালো আছে, বলে এই মাটিতে সেই সব আছে যা ওদের প্রয়োজন, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সাতজন মানুষ, ওরা জানে কোন সুদূর পৃথিবী থেকে আসছে মানুষ, পথে আছে তারা, ওরা এসে পৌঁছানো অবধি বেঁচে থাকতে হবে, বেঁচে থাকলে হয়তো আবার কোনোদিন ওরা ফিরে যেতে পারবে পৃথিবীর বুকে।
ওরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে পৃথিবীর শস্যবীজ, এই গ্রহে ওরা তাই রোপণ করেছে, সময়ের সঙ্গে ধান গম গাছের চারা বেরোয় এই মাটিতে, জঙ্গল থেকে বন্যপশু শিকার করে নিয়ে আসে যন্ত্র। এভাবেই ভিনগ্রহে মানুষ উপনিবেশ বানাতে শুরু করে, খাদ্যের অভাব হয় না ওদের।
মানুষের মতো যাদের দেখেছিল অনিকেতরা তারা এখনও আসেনি ওদের সামনে, সন্দেহ হয় আছে কি এখনও এই গ্রহে সেই প্রাণীরা, নাকি বিবর্তনের লড়াইতে পরাজিত হয়ে ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ওরা খোঁজার চেষ্টা করে না সেই হলুদ মানুষদের, ভয় হয়, প্রতিমুহূর্তে যন্ত্রের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির বেড়াজালে থেকেও ওদের নিরাপদ লাগে না, ওদের শরীর অত্যাধুনিক পোশাকে আবৃত, উচ্চ উষ্ণতা অথবা প্রচণ্ড ঠান্ডা কোনো কিছুই এই পোশাক ভেদ করে ওদের শরীর ছুঁতে পারে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে ভয় নেই ওদের, কিন্তু মানুষকে বড়ো ভয় ওদের। মনে হয় হয়তো সেই হলুদ মানুষেরাই মৃত্যুর রূপ ধরে একদিন ওদের দরজায় এসে দাঁড়াবে আসবে।
এই সবুজ সমতলের চেয়ে কিছু দূরেই নদী আছে, খুব বড়ো নদী নয়, কিন্তু জল আছে অফুরান, নির্ধারণ করা হয় এখানেই তৈরি করা হবে প্রথম কারখানা। ইট তৈরির কারখানা, ইট তৈরি হবে, গৃহ তৈরি হবে, কায়িক শ্রম দেবে যন্ত্র, মানুষগুলোকে শুধু বেঁচে থাকতে হবে, বেঁচে থাকাটাই প্রধান, এই পরিবেশে এক বছর বেঁচে থেকে ওদের প্রমাণ করতে হবে বেঁচে থাকা যায় এই গ্রহে। নদীর তীরবর্তী মাটিতে কোদালের খুপ খুপ শব্দ হয়, উঠে আসে ভিজে মাটি, আর তারপরেই তীক্ষ্ণ শীষের আওয়াজে শিহরিত হয়ে ওঠে আকাশ। পিঁপড়ের সারির মতো শত শত হলুদ মানুষ বেরিয়ে আসে মাটির তলা থেকে। আকস্মিক আঘাতে কিছু যন্ত্র নষ্ট করে ফেলে ওরা, কিছু ফিরে আসে, গোঁ গোঁ শব্দে আকাশে উড়তে থাকে ড্রোন। এই ছিল ওদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। পৃথিবীর সময়ে এই গ্রহে অবতরণের প্রায় চল্লিশ দিন পরে মুখোমুখি হয় ওরা।
মাটির উপরে নয়, এই গ্রহে সভ্যতা বিকশিত হয়েছে মাটির নীচে। এই নক্ষত্র অনিশ্চয়তায় মোড়া, ক্ষণে ক্ষণে আগুন ছড়ায় সে, মাটির উপরে কিছু জীব বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু সভ্যতাকে লালন করার জন্য যে যত্নের প্রয়োজন তা গ্রহে সম্ভব নয়, এ কথা ভেবেই পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এই গ্রহে প্রাণ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন না, তাদের ভুল প্রমাণ করে অনিকেতরা দেখিয়েছিল প্রাণ আছে, কিন্তু ওরা সভ্যতার খবর আনতে পারেনি। মাটির নীচে সভ্যতার সম্ভাবনা নিয়ে পৃথিবীতে কথা হয়নি এমন নয়, কিন্তু মানুষ যা দেখেনি তা সে বিশ্বাস করতে চায় না, কেউই শেষ অবধি মেনে নিতে পারেনি, মাটির নীচে গড়ে উঠতে পারে একটা সম্পূর্ণ নাগরিক সভ্যতা।
আগুনে ঘেরা তাঁবুতে বসে আছে সাতজন মানুষ, আগুনের ওপারে কিছু দূরে ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে হলুদ মানুষগুলো, ওরা ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। ওদের কারোর গায়ে গাছের পাতা অথবা বাকল দিয়ে নির্মিত পোশাক, বেশির ভাগই সম্পূর্ণ নগ্ন, বনমানুষের মতো বড়োবড়ো লোম ওদের শরীরে, ওরা মানুষেরই মতো, কিন্তু সম্পূর্ণ মানুষ নয়। ওদের অপলক দৃষ্টিতে ভয় নেই, আগুনের শিখা ওদের ধূসর চোখের মণিতে লাল হয়ে জ্বলছে। এগিয়ে আসছে ওরা, এত এত মানুষ এই আগুনের বলয়ে ঝলসে মরে যাবে না, কিছু মানুষ এই আগুনের বৃত্ত অতিক্রম করে এপারে আসবে, ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে হোমো সেপিয়েন্সদের। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে মানুষকে, সিদ্ধান্ত নেয় ওরা।
বিদ্যুতের শিখার মতো সাদা আগুনের রেখা নেমে আসে আকাশ থেকে, নিখুঁত নিশানায় ড্রোনগুলো ছুড়ে দিতে থাকে একের পর এক মৃত্যুবাণ। ভলকে ভলকে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওঠে মাটি থেকে আকাশে, তীক্ষ্ণ স্বরের হাহাকার বাতাস ভারী করে তোলে, কিন্তু সেও ওই মুহূর্ত মাত্র। দ্রুত থেমে যায় ওদের শরীরের নড়াচড়া, কুণ্ডলী পাকিয়ে মাংসের তাল হয়ে যায় শরীরগুলো, তারপর জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় যত হলুদ মানুষ ছিল সকলেই, একজনও বাঁচে না, সাতজন হোমো সেপিয়েন্স শুধু বেঁচে থাকে।
তারপর আগুন নিভে যায়, পোড়া মাংসের গন্ধ ধীরে ধীরে মিশে যায় হাওয়ার সঙ্গে, আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকে জ্বলতে থাকে প্রক্সিমা সেন্তরি। সাতজন মানুষ ফিসফিস করে নিজেদের সঙ্গে কথা বলে, “এই কি শেষ? নাকি আরও আছে? মানুষের বাসযোগ্য করার জন্য কি একেবারে নিঃশেষ করতে হবে ওদের?”
ড্রোন উড়ে যায় নদীর তীরে, নতুন আবিষ্কৃত সুড়ঙ্গ দিয়ে ওরা প্রবেশ করে মাটির তলায়, ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে বাড়িঘর। টিকে থাকার লড়াইতে এই হলুদ মানুষের প্রজাতি যদি সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়, তবে একদিন ওদের এই সুড়ঙ্গের নগর সভ্যতা জাদুঘরে রূপান্তরিত হবে, সেদিন মানুষ ঘুরে ঘুরে দেখবে কেমন করে মাটির নীচে ঘর বেঁধেছিল ওরা, প্রশংসার চোখে বলবে, “আহা কত উন্নত ছিল ওদের চিন্তাভাবনা!”
মাটির উপর ছোটো ছোটো অনেক গর্ত, কিন্তু উপর থেকে বোঝার উপায় নেই নীচে সেই গর্তের ব্যাস ক্রমশ বাড়তে বাড়তে বিশাল বড়ো বড়ো উলটানো ফানেলের আকৃতি নিয়েছে, নক্ষত্রের আলো এই ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে ছড়িয়ে পড়ে মাটির নীচে। মাটির তলায় ওদের নগর আলোয় আলো হয়ে থাকে না, বরং ছায়া মেশানো মৃদু ধূসর আলো এক মায়াবী রূপকথার সৃষ্টি করে। উইয়ের বাসার মতো একের পর এক খোপ খোপ ঘর। শূন্য এখন সমস্ত কক্ষ, কেউ নেই, কিন্তু যারা ছিল তারা তাদের উপস্থিতির ছাপ রেখে গেছে। উলটানো মাটির পাত্র, ঘরের কোনে সঞ্চিত খাদ্য, মাটির তৈরি অলঙ্কার, আরও কত কি, কয়েকটা কক্ষের কোনায় ধিকিধিকি জ্বলছে আগুন, ওরা আগুনের ব্যবহার জানে। ছবি তুলতে তুলতে ড্রোনের ঝাঁক এগোতে থাকে, হঠাৎ একটা ছোটো কক্ষে এক শিশুকে পাওয়া যায়, হামাগুড়ি দিতে শেখেনি সে এখনও, চিত হয়ে শুয়ে হাত-পা ছুড়ছে শুধু, একটু আগে হয়তো সে কাঁদছিল, এখন চোখের জল শুকিয়ে গেছে, এখন সে শান্ত চোখে শুধু চেয়ে আছে যেন কোনো দেবশিশু, ড্রোনের আওয়াজ শুনে সে মুখ ফেরায়, ওর ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে, দু-হাত বাড়িয়ে সে সম্ভবত ধরতে চায় এই অদ্ভুত দর্শন বস্তুকে, আর সেই মুহূর্তে ঝলসে যায় ওর শরীর, কেঁদে ওঠার সময় পায় না সে। ড্রোনের ঝাঁক ওকে ছেড়ে এগিয়ে যায়, পেছনে জ্বলতে থাকে মাংসপিণ্ড। অনেক অনেকক্ষণ পরে এই সুড়ঙ্গ নগর শেষ হয়, ওপরে ওঠার মুখ পাথরে ঢাকা ছিল, সে পাথরকে চূর্ণ করে মাটির উপর উঠে আসে ড্রোনের ঝাঁক। ঘন জঙ্গল, স্যাঁতসেঁতে মাটি, এই ভিজে মাটিতে অসংখ্য পায়ের ছাপ পড়েছে, এই জঙ্গলে পালিয়ে এসেছে ওই নগরের বাকি মানুষ, এখানেই আছে ওরা, ড্রোনের ক্যামেরা দ্রুত চারপাশ স্ক্যান করে খুঁজতে থাকে শত্রুপক্ষকে। কিন্তু কাউকে খুঁজে পাওয়ার আগেই গাছের উপর থেকে অসংখ্য পাথর পড়তে থাকে, সবুজের আড়ালে থেকে নেমে আসা এই অবিরাম পাথর বৃষ্টির উৎস পাওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যায় কিছু ড্রোন, আরও ক্ষতি এড়াতে বাকিরা সুড়ঙ্গপথেই ফিরে আসে পুরোনো জায়গায়।
সাতজন মানুষ এখনও চুপ করে বসে আছে আগুনের বলয়ের ভেতর, কিন্তু এই নিরাপত্তার বলয় আর বেশিক্ষণ থাকে না। অনেকক্ষণ ধরেই আকাশে কালো মেঘ জমেছিল, এখন গমগম করে গম্ভীর স্বরে ডেকে ওঠে সেই মেঘের পুঞ্জ। মানুষগুলো ধীরে ধীরে তাঁবুর ভেতর ঢুকে তাঁবুর জানালা দিয়ে চেয়ে থাকে বাইরে দিকে, এই গ্রহে এই ওদের প্রথম শিলাবৃষ্টি দর্শন। নিভে যায় আগুন, নীরবে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে কয়লা কালো সারি সারি মৃতদেহ, জানালা দিয়ে চেয়ে চেয়ে ওরা দেখে সেই দৃশ্য। অঝোর ধারায় বৃষ্টি চলতেই থাকে, ঝাপসা হয়ে যায় চোখের সামনের দৃশ্য, জলের স্রোতে তাঁবুর কাছে ভেসে চলে আসে কিছু কয়লার মতো কালো দেহ।
তারপর বৃষ্টি থামে, মেঘ কেটে যায়, নীল আকাশ জুড়ে ফুটে ওঠে সাতটা রং। এই সময় ওদের মধ্যে যে দলের নেতৃত্ব সে প্রথম কথা বলে, “এত মৃত্যুর পর আর ওদের সঙ্গে আর সহাবস্থান সম্ভব নয়। এ যুদ্ধ লড়তে হবে, শেষ অবধি।”
ড্রোনেরা পরবর্তী কয়েকদিন খুঁজে আনে তথ্য, আশপাশে কোথায় আছে আরও নগর, এবং সম্ভাব্য শত্রুসংখ্যা সম্পর্কে একটা ধারণা করা প্রয়োজন। সীমিত সংখ্যক অস্ত্র দিয়ে একের পর এক নগর ধ্বংস করা সম্ভব নয়, নিখুঁত পরিকল্পনা প্রয়োজন। এরই মধ্যে আবিষ্কৃত হয় নতুন কিছু নগরী, মাটির উপর থেকে নিখুঁত নিশানায় ওদের নগরীর মধ্যে ছিদ্রপথে বোমা ফেলা হয়, মাটির তলাতেই দাউদাউ করে জ্বলে যায় ওরা, যারা বেরিয়ে আসতে পারে তাদের জন্য সুড়ঙ্গের দরজায় প্রহরী থাকে, বেরনো মাত্র তাদের নিঃশেষ করে ফেলা হয়। দিনের পর দিন এইভাবে একের পর এক নগরকে ধ্বংস করে মানুষ নিজেকে এই গ্রহের নিয়ন্ত্রক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকে। ইতিমধ্যে নদীর তীরে তৈরি হয়েছে ইট তৈরির কারখানা, গৃহের ভিত নির্মাণ করা হচ্ছে। ধ্বংসের পাশে পাশে এইভাবে সৃষ্টিও চলতে থাকে। সাতজন মানুষ নিজেদের অজান্তেই কখন এই ভাঙাগড়াকে ভালোবেসে ফেলেছে, সৃষ্টির আনন্দ নাকি ধ্বংসের উন্মাদনা কোনটা বেশি আকর্ষক এই নিয়ে ওদের মধ্যে তর্ক হয়।
তারপর একদিন নতুন করে বিস্মিত হওয়ার সময় আসে। সাতজনের মধ্যে একজন খুব অসুস্থ। গত কয়েকদিন ধরে তার ধুম জ্বর, চোখ মেলে তাকাতে পারছে না, কিন্তু ওর ঠোঁট নড়ছে জ্বরের ঘোরেই বিড়বিড় করছে সে, “কেউ বাঁচবে না, এত পাপ নিয়ে কেউ বাঁচে না, করাল মৃত্যু সবাইকে খাবে!” একথা কি ও নিজেই বলছে নাকি ওকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে মৃত্যু? এই গ্রহের মৃত্যুর দেবতা। ছয়জন ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, ওদের চোখে শোকের চেয়ে বেশি ভয়, এরপর কে? যখন ওরা এসেছিল এই গ্রহে তখন ওদের মধ্যে বেঁচে থাকার এমন আকুতি ছিল না, পৃথিবী থেকে আসার সময় ওরা জেনেই এসেছিল বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা উজ্বল নয়, কিন্তু এখন এখানে দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে ওদের মধ্যে নতুন করে বেঁচে থাকার সাধ জন্ম নিয়েছে, এখন ওরা আর মরতে চায় না, যেমন করে হোক বেঁচে থাকতে চায়। পৃথিবীতে থাকাকালীন ওদের ঈশ্বরে বিশ্বাস দৃঢ় ছিল না, কিন্তু এখানে এসে ওরা নিয়মিত ঈশ্বরের কাছে জীবনের জন্য প্রার্থনা করে, এই গ্রহে কি নতুন কোনো ঈশ্বর আছে? পৃথিবীর ঈশ্বর কি এত দূর থেকে ওদের প্রার্থনা শুনতে পাবেন? সূর্য নেই, তাই ওরা দেবতা জ্ঞানে প্রক্সিমা সেন্তরির দিকে চেয়ে মাথা নত করে। বাঁচে না সে, চলে যায় আর সেই দিনই ওদের তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়ায় অনিকেত।
ড্রোন দূর থেকেই দেখেছিল অনিকেতকে, খালি গা, কোটরস্ত দুটো চোখ, শনের জটার মতো একমাথা চুল, বুক অবধি লম্বা সাদা দাড়ি, কোমরে একটা গাছের ছাল জড়ানো, বয়সের ভারে কুঁজো একটা মানুষ, ওর পদক্ষেপে ধরা পড়ে ওর শরীরে জমা জরা। কিন্তু এই জীর্ণ শরীরেও ওকে মানুষ বলে চেনা যায়, যায় বলেই ওর দিকে আগুন ছুড়ে দেয় না আকাশে প্রহরারত ড্রোন। মুহূর্তের মধ্যে ওর মুখের ছবি, চোখের তারা স্ক্যান করে যন্ত্রেরা মিলিয়ে নেয় ডাটাবেসের সঙ্গে।
মৃতদেহকে ঘরের মধ্যে ফেলে রেখে বাইরে এসে অনিকেতের মুখোমুখি দাঁড়ায় ছয়জন মানুষ।
৮
“মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ”, সেই কোন সুদূর শৈশবে মা বলেছিল অনিকেতকে। অনিকেত ভোলেনি মায়ের কথা, হারায়নি বিশ্বাস। বিশ্বাসের বিনিময়ে সবসময় যে সে কিছু পেয়েছে এমন নয়, পেয়েছে যত হারিয়েছে তার চেয়ে বেশি, তবু জীবনখাতার লাভক্ষতির অঙ্ক নিয়ে হিসাব করতে বসেনি ও। যারা ভালোবাসে তারা এমনি বাসে, ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার আশায় ভালোবাসে না, যারা বিশ্বাস করে তারাও এমনিই বিশ্বাস করে।
অলৌকিক ঘটনা ঘটে এই জগৎ সংসারে, যারা সাক্ষী থাকে সেই বিশেষ ঘটনার, তারা বিশেষ কেউ নয়, তারা শুধু সেই নির্দিষ্ট সময়ে সেই নির্দিষ্ট জায়গায় ছিল, যেখানে ঘটেছিল সেই বিশেষ ঘটনা। অনিকেত বিশেষ নয়, সে শুধু বিশেষ ঘটনার সাক্ষী।
প্রক্সিমা সেন্তরি আগুন ছড়ায়, বেশির ভাগ সময় সে আগুন আকাশে লাল রেখা সৃষ্টি করে আকাশেই মিলিয়ে যায় কিন্তু এক একসময় সে আগুন বায়ুমণ্ডল ভেদ করে এই গ্রহের মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে, সেদিন আকাশ থেকে নরক নেমে আসে, দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে এই গ্রহ, যা কিছু সামনে পায় মুহূর্তে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। এই গ্রহের ওই হলুদ মানুষগুলো কীভাবে যেন এই আগুনের আগাম আভাস পায়, প্রকৃতির এই খেয়ালী স্বভাব ওদের শরীরের ষষ্ট ইন্দ্রিয়ে কম্পন সৃষ্টি করে। সেইদিন সেই কিশোর সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিল অনিকেতদের সামনে এই আতঙ্কের ভবিষ্যতবাণী নিয়ে, সতর্ক করে দিতে চেয়েছিল সে, বাঁচাতে চেয়েছিল, পারেনি। তীক্ষ্ণ স্বরে সে শীষ দিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বলে গেছিল সেই সমুদ্রের তীরভূমি। শেষ হয়ে গেছিল সকলেই, শুধু অনিকেত বেঁচে গেছিল। কেউ কেউ বেঁচে যায়, এমন করেই, অকারণ, সম্ভবত শুধুমাত্র ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গল্প শোনানোর জন্যই তারা বেঁচে থাকে, কখনও তারা সেই গল্প বলার সুযোগ পায়, কখনও আবার না বলাই থেকে যায় গল্পরা, সময়ের জলে ধুয়ে যায় কথা ও কাহিনি। অনিকেত ওর কথা বলার সুযোগ পায়, অনিকেত ভাগ্যবান, এত বছর পরে তাই সে আজ এসে পৌঁছায় এই তাঁবুর সামনে, মানুষের সামনে।
প্রথম পরিচয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব মিশে থাকে, সদ্য মৃত সঙ্গীকে ফেলে এসে অনিকেতের সামনে দাঁড়িয়ে ওদের মনে হয় এই সাদা দাড়ি সাদা চুল মানুষই মৃত্যু, এসেছে ওদের সঙ্গে নিয়ে যেতে। প্রহরারত যন্ত্রেরা বারে বারে আশ্বস্ত করে ওদের, কোনো ভুল নেই এই সেই অনিকেত। অনিকেত হাসে, এতদিন পর পৃথিবী থেকে ওর স্বজন এসেছে, এক পা এগিয়ে যায় সে, হাত বাড়িয়ে বলে “ছুঁয়ে দেখো, আমি অশরীরী নই।” ওরা ছুঁয়ে দেখে অনিকেতের হাত মুখ। বিশ্বাস করতে সময় লাগে কিন্তু শেষ অবধি বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না। তারপর অনিকেত ওদের গল্প শোনায়, মৃত মানুষের পাশে বসে ওরা জীবনের গল্প শোনে।
কতদিন মাস অথবা বছর পড়ে অনিকেতের জ্ঞান ফিরে এসেছিল সে জানে না, তবে যখন সে চোখ মেলেছিল দেখেছিল প্রায়ান্ধকার একটা কুঠুরিতে অনেকগুলো কৌতূহলী মুখের সামনে সে শুয়ে আছে। তখনও ঘোর কাটেনি, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, সেই মুহূর্তে অনিকেতের মনে পড়েনি মহাকাশের কথা প্রক্সিমার কথা, বরং মনে পড়েছিল মেয়ের মুখ, ছোট্ট শ্রমণাকে সম্ভবত স্বপ্নে দেখেছিল সে, “শ্রমণা…” চিৎকার করে ধড়মড় করে উঠে বসে অনিকেত। লোকগুলো ওকে ধরাধরি করে আবার শুইয়ে দেয়, দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলে। অনিকেত ধীরে ধীরে ফিরে আসে প্রক্সিমায়, হারিয়ে যায় পৃথিবী, হারিয়ে যায় শ্রমণা, ফিরে আসে আতঙ্ক।
সারা শরীরে অসহ্য জ্বালা, যেন চামড়া ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ওর শরীরের। বীভৎস এই ক্ষত গায়ে মেখে অনিকেত ওদের যতটা ভয় পেয়েছিল, ওরাও তার চেয়ে কিছু কম ভীত ছিল না, দু-পক্ষের চোখেই ছিল আতঙ্ক মিশ্রিত কৌতূহল, কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতেই আবার চোখ বুজে আসে, ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে অনিকেত। এভাবেই ঘুমে জাগরণে, ধূসর আলো মেশানো একটার পর একটা দিন বয়ে যায়। এই সময়গুলোয় অনিকেত ঘুমিয়ে থাকলেও ওর কর্ণপটহের কৃত্রিম শব্দ ঝিল্লী ওই মানুষগুলোর কথা শুনত, জড়ানো চোখে যখন অনিকেত চেয়ে দেখত সেই হলুদ মানুষগুলোর দিকে ওর চোখের তারায় লাগানো দৃষ্টিকাচও দেখত ওদের। অনিকেতের স্মৃতি ওদের মুখ, ওদের কথা ধারণ করতে পারত না, কিন্তু ওদের ধরে রাখত এই যন্ত্রেরা। ওদের কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, মুখ নিঃসৃত আওয়াজের সঙ্গে ওদের অঙ্গসঞ্চালনা মিলিয়ে যন্ত্রণা ওদের ভাষার বোঝার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিল অনিকেতের চেতনা ফেরার আগে থেকেই।
ক্রমে সুস্থ হয় অনিকেত, ক্রমে সে বোঝে এই লোকগুলো ওর ক্ষতি করবে না। এজন্য নয় যে ওরা অনিকেতকে বন্ধু ভেবেছে বরং এই জন্য যে ওরা কারোর ক্ষতি করতে জানেই না, ওরা বড়ো নিরীহ, বড়ো ভালো মানুষ। ওদের চাওয়া কম, পাওয়া কম, ওরা কম পেয়ে, কম জেনে সুখী।
এই অসুস্থতায় পৃথিবীর কোন আপনজন যেমন করে ওর সেবা করত, সেভাবেই এই হলুদ মানুষেরা শুশ্রূষা করে অনিকেতের, কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করে, তৃষ্ণায় কাতর হলে অঞ্জলি ভরতি জল দেয় ওর মুখে, দুবেলা নিয়ম করে অচেনা খাবার খাইয়ে দেয় ওরা অনিকেতকে, এমন করে শেষ কবে কেউ অনিকেতের সেবা করেছিল মনে পড়ে না ওর। এই সময়েই অনিকেতের কর্ণপটহে লাগানো শব্দ ঝিল্লী কিছু শব্দ বুঝতে শুরু করে, অনিকেতের কানে ফিসফিস করতে অনুবাদ শুরু করে ওরা সেই খণ্ড খণ্ড শব্দ।
সে আগুনে সব কিছু জ্বলে যাওয়ার আগেই গাড়ি থেকে ছিটকে সমুদ্রের জলে পড়ে তলিয়ে গেছিল অনিকেত, তাই ওর এই জীবন ফিরে পাওয়া, কিন্তু ওর হাতে পায়ে বুকে গভীর আগুনে পোড়া ক্ষত মিলিয়ে যেতে দীর্ঘ সময় লাগে। সুস্থ হওয়ার এই ক্লান্তিকর যাত্রাপথে ধীরে ধীরে অনিকেত ওদেরই একজন হয়ে ওঠে, ধীরে ধীরে যন্ত্রের সাহায্য ছাড়ায় বুঝতে পারে ওদের কিছু কথা, এক সময় ওদেরই মতো করে বলতে পারে কিছু শব্দ।
সুস্থ হওয়ার পর মাটির তলায় গুহাবাসি এই মানুষেরা সত্যিই অনিকেতের আপনজন হয়ে ওঠে, কখনও সে নীল আকাশের দিকে চেয়ে দূর আকাশে কোন এক পৃথিবীর কথা ভেবে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেনি এমন নয়, কিন্তু এই মাটি এই আকাশ এই সারল্যে ভরা মানুষগুলোকেও নিজের অজান্তেই এক সময় সে ভালোবেসে ফেলে।
ঘর নির্মাণের জন্য ঢালু জমি নির্বাচন করে ওরা, প্রাকৃতিকভাবে ঢালু না হলে, উপর থেকে মাটি কেটে ঢালু সমতল জমি তৈরি করে, এমন ভূমি দরকার ওদের যেখানে বৃষ্টির জল জমে থাকে না, বয়ে যায়। ভূপৃষ্ঠের ফুট খানেক নীচে থেকে শুরু হয় ওদের প্রথম স্তরের ঘর, নির্দিষ্ট দূরত্বে ওলটানো ফানেল আকৃতির ছিদ্র করে নক্ষত্রের আলোকে ঘরে প্রবেশ করায় ওরা, ভেতর থেকে এই ছিদ্র বন্ধ করার ব্যবস্থা আছে, বৃষ্টি হলে নিখুঁত মাপে কেটে রাখা কাঠ দিয়ে বোতলের ছিপির মতো ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া যায় এই ছিদ্র। ঘরের ভেতরে তখন অন্ধকার নেমে আসে, ওরা তখন কেউ কেউ বাইরে বেড়িয়ে এসে বৃষ্টিতে শরীর ভেজায়, কেউ আবার ঢালু জমিতে আড়াআড়িভাবে কেটে বানানো সুড়ঙ্গের দরজা অথবা জানালায় বসে বসে বৃষ্টি দেখে। নিখুঁত পরিকল্পনা নিখুঁত মাপ, কোথাও এতটুকু অসামঞ্জস্য নেই যেন কোনো শিল্পীর আঁকা ছবি, গৃহ নির্মাণের এই অভূতপূর্ণ কৌশল দেখে বিস্মিত হয় অনিকেত, এক প্রজন্মে সম্ভব নয় এই শিক্ষা, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ক্রমাগত ব্যর্থ হওয়ার পর, প্রকৃতির সঙ্গে টিকে থাকার অসম লড়াইতে হারতে হারতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর অবশেষে এই নির্মাণ কৌশল ওরা রপ্ত করেছে। একটা সম্পূর্ণ সভ্যতা গড়ে উঠেছে মাটির তলায়।
অনিকেত ওদের পৃথিবীর গল্প শোনায়, ওরা অবাক হয়ে শোনে, ভিজে মাটিতে কাঠি দিয়ে ছবি এঁকে অনিকেত দেখায় ওদের পৃথিবীর বুকে নির্মিত মানুষের ঘর গেরস্থালীর ছবি। ওরা অনিকেতের আরও কাছে ঘেঁষে আসে “আরও বলো তোমাদের পৃথিবীর কথা…”, অনিকেত বলে যায়, পৃথিবীর কথা যে এমন করে বলার ছিল কোনোদিন ভাবেনি সে, অথচ আজ কথা শুরু করে যেন শেষ হয় না কথা। অনিকেত নিজের কথা বলে, শ্রমণার কথা বলে। শুনতে শুনতে ওদের চোখে জল আসে, অনিকেতের ভালো লাগে ওদের চোখের জল, এই আবেগ ওকে স্পর্শ করে।
এই মানুষগুলো শাকাহারী, বিশেষ এক ধরনের গাছের মূল ওদের প্রধান খাদ্য, অনিকেত ভেবেছিল এই খাদ্য ওর সহ্য হবে না, ভেবেছিল ওর জীবন দৈর্ঘ্য ছোটো হয়ে যাবে, কিন্তু তা হয় না, ভালোই থাকে অনিকেত, সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা কুঠুরি ওর জন্য নির্দিষ্ট হয়, অনিকেতকে ওরা বিশেষ মানুষের সম্মান দেয়, মানুষ নয় অনিকেত ওদের দেবতা।
সময়ের হিসাব করে না ওরা, তাই অনিকেত বোঝেনি কত দিন অথবা বছর এই লাল নক্ষত্রের আলো গায়ে মেখে কাটিয়ে দিয়েছে সে। একসময় একজন মহিলা ওর কুঠুরিতে এসে থাকতে শুরু করে, ফিসফিস করে বলে, “আমাকে নিয়ে যাবে তোমার পৃথিবীতে?” অনিকেত চেয়ে থাকে ওর দিকে, প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে লিপ্ত এই পেশিবহুল বড়োবড়ো লোমে ঢাকা তামাটে রঙের এই শরীরে রুক্ষতা জমেছে, কিন্তু ওর ধূসর চোখের মধ্যে অদ্ভুত এক মায়া আছে, বেশিক্ষণ ওই চোখের দিকে চেয়ে থাকলে মাথা ঝিমঝিম করা ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয় বুকের ভেতর। পৃথিবীতে ফেরা হবে না আর কোনদিন, অনিকেত জানে সে কথা, তবু সে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়, “নিয়ে যাবো, যদি কোনোদিন আমি ফিরতে পারি, তবে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো।” অনিকেত ওদের বলেনি প্রথমদিন এই গ্রহে এসেই ওদের হাতে রক্ত লেগেছিল, ওরাও জানতে পারেনি কোন নগরীর কোন নিরীহ মানুষদের হত্যা করে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে নিয়েছিল অনিকেতরা। মেয়েটা ওকে বারেবারে জিজ্ঞেস করে কোথায় আছে তোমাদের সেই মহাকাশযান? অনিকেত চুপ করে থাকে, ও সত্যিই জানে না পথ, ফিরতে চায়ও না সে ওই রক্তের দাগ লেগে থাকা পথে, চোখ বন্ধ করলে সে এখনও দেখতে পায় শতশত মানুষ ধুধু মাঠের মধ্যে মরে পড়ে আছে। মেয়েটা জিজ্ঞেস করে “তোমাকে নিতে আসবে না তোমার পৃথিবীর মানুষেরা?” অনিকেত উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। ভালোবাসা পৃথিবীর মানুষের মতো ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে পারে না এই মানুষগুলো, স্পর্শ দিয়ে প্রকাশ করে, অনিকেতকে ছোঁয় সে, চোখে চোখ রেখে চেয়ে থাকে। মেয়েটার দুই সন্তান মারা গেছে অল্প বয়সে, তারপর থেকে ওর আর জীবন ভালো লাগে না, এই গ্রহ এই ঘরগেরস্থালী ওকে টানে না আর।
যেমন করে অনিকেত পৃথিবীর গল্প বলেছিল ওদের, তেমন করেই সে ওদের গল্প মানুষকে শোনায়। অনেকক্ষণ কথা বলে বলে হাঁফ ধরে যায় অনিকেতের, কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে সে, তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে “কেমন আছে মানুষ? কতটা বদলেছে পৃথিবী?” ওরা তখন উন্নততর পৃথিবীর গল্প শোনায় অনিকেতকে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির কথা, রাজনীতির কথা, সমাজের কথা, এমন কিছু যা অনিকেত দেখেনি, অনিকেত জানে না। আলোকবর্ষর ওপার থেকে আসা জন্মভূমির কথা শুনতে শুনতে টপটপ করে জল পড়ে অনিকেতের চোখ বেয়ে, এ জন্মে কি আর কখনও যাওয়া হবে সে দেশে?
নিজেকে সংবরণ করে অনিকেত, “এই ধ্বংসলীলা বন্ধ করো, ওরা আমাদের শত্রু নয়, প্রথম দেখায় আমরাও ভুল করেছিলাম, ওদের চোখে ঘৃণা দেখেছিলাম, সে আমাদের দৃষ্টির ভ্রম, ওরা ঘৃণা করতে শেখেনি। কিন্তু ওরা ভালোবাসতে জানে। সংস্কৃতির আদান প্রদান হোক।” অনিকেত মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেয়, “তুমি তবে ওদের দূত হয়ে আমাদের কাছে শান্তির বাণী নিয়ে এসেছ অনিকেত?” হাসতে হাসতে বলে মানুষ, অনিকেত মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ, আমি শান্তির দূত।”
“এমন শহর কত আছে এই গ্রহে? সংখ্যায় কত এই হলুদ মানুষ?” অনিকেত জানে না এই প্রশ্নের উত্তর, বিশাল এই গ্রহে আদম শুমারি করেনি কেউ, কিন্তু অনিকেত জানে মানুষের এই অত্যাধুনিক অস্ত্রের আক্রমণের সামনে ওরা অসহায়।
“গৃহ নির্মাণের জন্য প্রচুর শ্রমিক প্রয়োজন, শুধু যন্ত্রের এই নির্মাণ করতে শত বছর লেগে যাবে। ওরা কি শ্রমিক হতে রাজি আছে? মানুষ প্রক্সিমা সেন্তরির আগুন প্রতিরোধক গৃহ নির্মাণের কৌশল উদ্ভাবন করেছে, ওদের এই শ্রমের পরিবর্তে এই কৌশল ওদের শিখিয়ে দেবে মানুষ।” শান্তির দূত কে সন্ধি প্রস্তাব দেওয়া হয়।
অনিকেত, ফিরে যায়। তারপর নিয়ে আসে ওদের শ্রমিক করে। তাঁবুর সামনে লাইন দিয়ে এসে দাঁড়ায় ওরা, অনিকেত এসে দাঁড়িয়েছে সবার সামনে। অনিকেত দেবতা ওদের।
৯
যে শহরগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, যাদের আপন মানুষ মারা গেছে, তারা প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে বিপ্লবী হয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু যারা সুখী মানুষ তারা আরও সুখী হওয়ার আশায় এগিয়ে আসে। অনিকেত ওদের চোখে স্বপ্ন বুনে দিয়েছে, পৃথিবীর মানুষ শিখিয়ে দেবে কেমন করে মাটির উপর ঘর বানাতে হয়, যে ঘর নক্ষত্রের খেয়ালী আগুনে জ্বলে যাবে না। যে গৃহ নির্মাণের কাজ স্লথভাবে এগোচ্ছিল ছিল তা এবার গতি পায়, অজস্র শ্রমিক এসে দাঁড়ায় ইট তৈরির কারখানায়।
রোবটেরা কাজ শিখিয়ে দেয়, নতুন কাজ পেয়ে এই মানুষগুলোও খুশি হয়, ওরা কাজ ভালোবাসে, আকাশ থেকে ড্রোন কাজ পরিচালনা করে। অনিকেতের ভালো লাগে এইভাবে দুই সভ্যতাকে এক সঙ্গে কাজ করতে দেখে, দুটো গ্রহই এখন ওর নিজের মনে হয়, দুই শ্রেণির মানুষই ওর আপনজন। সেই মেয়েটাও শ্রমিক হয়ে গেছে, ঘুমানোর সময় অনিকেত ওকে ফিসফিস করে বলে, “পৃথিবীতে হয়তো আর যাওয়া হবে না, এখানেই একদিন আমরা পৃথিবী সৃষ্টি করব।” মেয়েটার ভালো লাগে অনিকেতের কথা শুনতে, সে চোখ বন্ধ করে বলে “আরও বলো তোমার পৃথিবীর কথা।”
অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে, অগুনতি শ্রমিক কাজের মধ্যে আনন্দ পেয়েছে, ওদের ক্লান্তি নেই। কাজের নির্দেশ নিতে নিতেই একসময় ওদের অবচেতন মন এই পোশাক পরা মানুষগুলোকে প্রভু বলে মেনে নিয়েছে। এখনও ওদের মধ্যে শোষক আর শোষিত বোধ জন্মায়নি, তাই যখন গোপনে সেই পলাতক বিপ্লবীরা এসে ওদের বুকে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করে তখন ওরা উদ্দীপ্ত হয় না, বরং দূরদূরান্ত থেকে আরও মানুষ এই নতুন কর্মযজ্ঞে সামিল হওয়ার জন্য এগিয়ে আসে রোজ। ওদের মধ্যেই কিছু হলুদ মানুষ পৃথিবীর মানুষের আহার দেখে প্রলুব্ধ হয়, একদিন আগুনে পুড়িয়ে মৃত পশুর মাংস খেয়ে দেখে, ভালো লাগে ওদের। কিছু মেয়ে অত্যাচারিত হয়, তারা প্রতিবাদ করতে চাইলে বাকিরা চুপ করিয়ে দেয় ওদের, বলে ওরা ঈশ্বরের দূত, ওদের নামে বলতে নেই এমন কথা।
একের পর এক অট্টালিকা তৈরি হয়, ছয়জন জীবিত মানুষ সেখানে অধিকার করে তাদের পছন্দমতো গৃহ। তাদের ঘরে দাসদাসী নিযুক্ত হয়, যান্ত্রিক পরিমণ্ডল থেকে মুক্ত হয়ে ওদের জীবনে মানবিক ছোঁয়া লাগে। এখন আর ড্রোনেরা অরণ্য থেকে ওদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করে এনে দেয় না, এই হলুদ মানুষেরাই সারাদিনে ওদের পছন্দমতো খাবার পরিবেশন করে, রাত্রে শোয়ার সময় চরণসেবা করে, তৃষ্ণা পেলে এগিয়ে দেয় জলের পাত্র। কাজে ভুল হলে প্রভুরা ওদের উপর অত্যাচার করে, এক একদিন অতিরিক্ত প্রহারে মরেই যায় কোনো কোনো ক্রীতদাস, এই মৃতদেহ সবারে অলক্ষ্যে মাটিতে পুঁতে দেয় অন্য কোনো দাসী। লুকিয়ে চোখের জল ফেলে যারা, যাদের বুকে ক্ষোভ তৈরি হয় তাদের সেই গোপন কান্নার কথা প্রভুদের জানিয়ে দেয় ওদেরই অন্য কোন মানুষ, শুধুমাত্র প্রভুদের একটু কাছের মানুষ হওয়ার আশায়। কেউ কেউ পালিয়ে যায়, গভীর অরণ্যে বিপ্লবীদের সঙ্গে হাত মেলায়। বিশ্বাসঘাতকেরা তাদের খবর এনে দেয়, ফেরার আসামীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ড্রোনেরা উড়ে যায় ঘন অরণ্যে।
এই সময়েই এই অট্টালিকার সারি থেকে কিছু দূরে এক নতুন বিস্তীর্ণ এলাকা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলার প্রকল্প শুরু হয়। শত শত শ্রমিক নতুন উদ্যমে কাজে লেগে পড়ে। এখন তারা দক্ষ শ্রমিক, অল্প সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় দীর্ঘ প্রাচীরে ঘেরা প্রাঙ্গণ। ধীরে ধীরে সে প্রাঙ্গণে একের পর এক কুঠুরি নির্মিত হয়, নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে শ্রমিকেরা, কেউ জানতে চায় না কাদের জন্য তৈরি হচ্ছে এ বস্তি।
নির্মাণ যখন সম্পূর্ণ হয় তখন নির্দেশ আসে, “প্রতিশ্রুতি অনুসারে শ্রমিকদের জন্য প্রভুরা বানিয়ে দিয়েছে গৃহ…” ওরা উল্লাসিত হয়, জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে প্রভুদের নামে, “এতদিনে মাটির নীচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বাস করার দিন শেষ হল।” কেউ কেউ নীচু স্বরে সন্দেহ প্রকাশ করে বলে বস্তির চারপাশে এই সুউচ্চ প্রাচীর কেন নির্মিত হল, উত্তর ওদের মধ্যে থেকেই আসে, “বিপ্লবীদের জন্য, ওদের হাত থেকে আমাদের বাঁচানোর জন্য।” আইন তৈরি হয়, এই বস্তি থেকে পালানোর চেষ্টা করলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে, প্রভুদের নির্দেশ পালন না করলে কারাদণ্ড দেওয়া হবে। বস্তির মধ্যেই একপাশে কারাগার নির্মিত হয়েছে, শ্রমিকেরাই করেছে। এখন সেই কারাগারের দরজায় প্রহরী নিযুক্ত হয়, শ্রমিকদের মধ্যেই কিছু মানুষকে বিশ্বস্ত মানুষকে এ কাজের ভার দেয় প্রভুরা।
অনিকেত অনেকদিন ধরেই গৃহবন্দি, সেই মেয়েটাকে রাখা হয়েছে অনিকেতের দেখাশোনার জন্য, একটা ঘর আর একটা প্রশস্ত জানালা, এই জানালার পাশে বসে অনিকেত সারাটা দিন নীল আকাশের দিকে চেয়ে থাকে, মেয়েটাও অনিকেতের পাশে চুপ করে বসে থাকে। বেশির ভাগ সময় ওরা কেউ কোনো কথা বলে না। মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ওঠে অনিকেত, মনে হয় ওর এই দীর্ঘজীবন এই ধ্বংসের প্রধান কারণ। সেদিন যদি ও মরে যেত, তবে ওর মৃত্যু হয়তো মানুষের সর্বগ্রাসী লোভ থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারত এই গ্রহকে, এই সভ্যতাকে। এখন অনিকেত জানে ওই সমুদ্রের তীরেই সবচেয়ে বেশিবার আগুন ঝরিয়েছে প্রক্সিমা সেন্তরি, মানুষ যায় না ওখানে, ওই দুর্দান্ত কিশোর নির্ভয় ছিল, আগুনের আভাস পেলেই সে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই বিশ্বাস নিয়েই সে বারেবারে যেত ওই সমুদ্রে একা, ওই নির্জনতা ওর ভালো লাগত, মাছ খায় না ওরা, কিন্তু ওই কিশোর ভালোবাসত সমুদ্রের মাছ দেখতে, মাটির পাত্রে জল ভরে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করত সে সমুদ্রের মাছকে। সেদিনও সে আগুনের আভাস পেয়ে ঠিক সময়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সমুদ্রে, উঠে এসেছিল শুধু অনিকেতদের বাঁচানোর জন্য। আগুন নিভে গেলে ওকে উদ্ধার করতেই এসেছিল নগরের মানুষ, পেয়েছিল অনিকেতকে। ওর আয়ু নিয়ে বেঁচে আছে অনিকেত। কতদিন যে ওকে বাঁচতে হবে এইভাবে অন্যের আয়ু চুরি করে!
মেয়েটা অনিকেতের কাঁধে হাত রাখে, ফিসফিস করে বলে, “কেউ কাউকে বাঁচাতে পারে না, আমিও ভেবেছিলাম ভালোবাসা দিয়ে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে আমার সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখব, পারিনি। কেউ পারে না, যা হওয়ার তা হয়।” অনিকেত স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ওর দিকে, কোথা থেকে পেল ও এই প্রজ্ঞা! “তুমি না থাকলে এতদিনে আমি মরে যেতাম…” অস্ফুট স্বরে প্রায় শোনা যায় না এমন করে বলে অনিকেত। মেয়েটা জড়িয়ে ধরে ওকে, “কাউকে আমি ধরে রাখতে পারিনি, শুধু তোমাকে ছাড়া, আমাকে ছেড়ে যেও না…” বড়ো করুণ এই আর্তি। দীর্ঘদিন অনিকেতের সঙ্গে থাকার ফলে ধীরে ধীরে মানুষের মতো ভাষা দিয়ে আবেগ প্রকাশ করতে শিখেছে মেয়েটা। অনিকেত কথা দেয় সে কোথাও যাবে না। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেইও অনিকেতের। সে জানে বিপ্লবীদের কাছে সে প্রধান শত্রু, বিশ্বাসঘাতক এবং পৃথিবীর মানুষও ওকে বিশ্বাস করে না। অনিকেত এও জানে ওর মৃত্যুর পর এই মেয়েটাকেও ওরা বাঁচিয়ে রাখবে না। ওর জন্যই বেঁচে থাকতে চায় অনিকেত।
একদিন জানালায় বসে দূর আকাশে লাল আগুনের শিখা দেখে ওরা দুজনে একসঙ্গে, আকাশে যেন আগুন লেগেছে, প্রক্সিমার আগুন, অনিকেত জিজ্ঞেস করে কী করে বোঝো তোমরা কোন আগুনের শিখা কখন এসে মাটি ছোঁবে? মেয়েটা স্পষ্ট উত্তর দিতে পারে না, কী একটা হয় ওদের শরীরে, এই অনুভব প্রকাশ করার মতো নয়। সে খুব শান্ত স্বরে বলে “এ অঞ্চলে আগুন আসেনি কখনও, এ অঞ্চল সম্ভবত পোড়াবে না সে। তারপরেই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে, অনিকেতের দিকে তাকায়, “আচ্ছা তোমরা কি সত্যি দেবতা?” অনিকেত কেঁপে ওঠে, গলা শুকিয়ে যায় ওর, ফিসফিস করে সে বলে, “না, আমরা দেবতা নই…”।
এই অঞ্চলের অধিবাসীরা আগুনের উপাসক, ওরা জানত আগুন ওদের রক্ষা করে, ক্ষুব্ধ হলে আগুনই ওদের জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়। পাপের শাস্তি দেয় আগুন, পুণ্যের ফল দেয় আগুন এই ছিল ওদের স্থির বিশ্বাস। কিন্তু পৃথিবীর মানুষ যখন ওদের ঘর থেকে তুলে এনে বস্তিতে নিক্ষেপ করল তখন তো প্রতিশ্রুতি মতো আগুন এল না রক্ষা করতে, কাতর কণ্ঠে সে যেন নিজেকেই বলে “তোমরাও দেবতা নও! তবে কোথায় আছে দেবতা?” অনিকেত হাসে, বিড়বিড় করে সে বিসর্জন থেকে আবৃত্তি করে “কোথাও সে নাই। ঊর্ধ্বে নাই, নিম্নে নাই, কোথাও নাই, কোথাও সে ছিল না কখনও।”
পৃথিবীর এক বছর অতিক্রান্ত হয়, প্রতিশ্রুতি মতো এ গ্রহে পৌঁছায় আরও মানুষ। আরও উন্নত প্রযুক্তি, আরও অস্ত্র। এক বছর আগে যারা এখানে এসে পৌঁছেছিল তাদের ফিরে যাওয়ার সময় উপস্থিত, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তারা কেউই ফিরে যেতে চায় না। এখানেই জীবন অতিবাহিত করতে চায় তারা, এ শহর এই সভ্যতা ওরা নির্মাণ করেছে, পৃথিবীর জনঅরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই ওদের আর। কিন্তু কিছু মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াও প্রয়োজন তবেই আসা যাওয়ার এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার পরীক্ষা সম্ভব হবে। সিদ্ধান্ত হয় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে অনিকেতকে। অনিকেতই শুধু অতিরিক্ত মানুষ এ গ্রহে।
খবর যায় অনিকেতের কাছে, সময় হয়েছে, ঘরে ফেরার। কিন্তু অনিকেতের সঙ্গে ওই মেয়েটাকে পৃথিবীতে পাঠাতে অসম্মত হয় মানুষ, এমন নির্দেশ নেই। ভিনগ্রহীদের পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য অনেক শারীরিক পরীক্ষা করা প্রয়োজন, হয়তো তারা বয়ে নিয়ে যাবে কোন মারণ ব্যাধির ভাইরাস, তা ছাড়া এও জানা নেই ওকে শীতঘুমে পাঠানো সম্ভব হবে কিনা। “ওকে নেওয়া যাবে না, শুধু তোমাকে একাই ফিরে যেতে হবে।”
তর্ক হয়, বিবাদ হয়, অবশেষে মেয়েটাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে ওরা। “ছেলেমানুষি করো না অনিকেত, পৃথিবীতে তোমার সন্তান আছে… সে তোমাকে দেখতে চায়, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়! কী পাগলামি শুরু করেছ এখানে!” দিনের পর দিন একই কথা শুনতে শুনতে শেষ পর্যন্ত অনিকেত রাজি হয়, শ্রমণাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হয় ওর।
এ গ্রহের মাটিতে তখন তুমুল ব্যস্ততা, অগ্নিনিরোধক আবরণ দিয়ে মুড়ে ফেলা হচ্ছে বাড়ি ঘর অট্টালিকা, প্রশস্ত ঝকঝকে রাস্তা তৈরি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে বাঁধানো নর্দমা, পানীয় জলের জন্য ট্যাঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। এখনও বিদ্যুৎ তৈরি করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে, নিত্যনতুন কল কারখানা তৈরি হচ্ছে, গলগল করে নির্গত হচ্ছে কালো ধোঁয়া। ঘোড়ার মতো কোনো বন্য পশু নেই এখানে তাই শ্রমিকেরাই রিকসা টেনে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্যও প্রান্তে মানুষকে নিয়ে যাওয়া আসা করে। ড্রোনের ছবি থেকে গ্রহের আধুনিক ম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে, নক্ষত্রের আগুন ছড়ানোর সময় এবং স্থানের সম্ভাবনা অঙ্ক কষে নির্ধারণ করার চেষ্টা করছে যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্ত্বা।
অনিকেতকে প্রস্তুত হতে বলা হয়, আর সময় নেই। নির্দিষ্ট হয়ে গেছে মুহূর্ত। অনিকেত আকাশের দিকে চেয়ে দেখে, এখনও কি পৃথিবীর মাটি থেকে এমন দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ দেখা যায়! নাকি অট্টালিকা একেবারে ঢেকে দিয়েছে যা কিছু নীল যা কিছু সবুজ। অনিকেত উবু হয়ে বসে এই মাটিকে চুম্বন করে।
যাওয়ার আগে একবার অনিকেত কারাগারের অন্তরালে বন্দি সেই মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে চায়। পৃথিবীর মানুষ কখনও এই বস্তিতে প্রবেশ করেনি। প্রথম মানুষ হিসাবে এই গ্রহে অবতরণকারী অনিকেতের এই শেষ ইচ্ছা অনুমোদিত হয়, অনুমতি মেলে বস্তির মধ্যে অবস্থিত কারাগারে যাওয়ার। কিন্তু যাওয়ার আগে অনিকেতকে বারে বারে সাবধান করা হয়, বস্তির ভেতরে নিকৃষ্ট মানুষদের বাস, ওরা বাইরে আসে যখন তখন ওদের স্নান করিয়ে সুগন্ধি মাখিয়ে নগরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত করা হয়, বস্তির ভেতরের কদর্যতা সহ্য করার জন্য অনিকেত যেন নিজেকে প্রস্তুত করে।
সুউচ্চ দেওয়াল দিয়ে বেষ্টিত এই বস্তির একটাই প্রবেশদ্বার, প্রহরী অনিকেতের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করে। মুহূর্তের মধ্যে যেন এক অন্য দুনিয়ায় প্রবেশ করে অনিকেত, বাইরের সবুজে ঢাকা মাটির সঙ্গে এর এতটুকু মিল নেই। বিচিত্র কোলাহলে পূর্ণ পুতিগন্ধময় এক নরক দর্শন করে অনিকেত। স্তূপীকৃত নোংরা আবর্জনার মধ্যে দলে দলে মানব সন্তান ছড়িয়ে ছিটিয়ে এমনভাবে পড়ে আছে যেন মৃত্যু তাদের অচ্ছুৎ মনে করে ছোঁয়নি, ইতিউতি পরে আছে কিছু সৎকারের অভাবে ফুলে ঢোল হয়ে থাকা দেহ। দম বন্ধ হয়ে আসে অনিকেতের, এই সময় সে অনুভব করে অসংখ্য চোখ চারিদিক থেকে স্থির দৃষ্টিতে দেখছে ওকে, এদের অনেককেই চেনে অনিকেত, এদেরই মধ্যে মিশে আছে আছে সেই মানুষগুলো যারা দিনের পর দিন ওকে শুশ্রূষা করে সারিয়ে তুলেছিল। ওরা দেখছে অনিকেতকে, নিঃশব্দে ওকে দেখছে শুধু। হঠাৎ ওর সামনে এসে খিলখিল করে হেসে ওঠে এক কাদামাখা এক শিশু, শিহরিত হয় অনিকেত, দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে সে। প্রহরী এগিয়ে আসে, “আমার সঙ্গে আসুন, এরা অসভ্য মানুষ, এদের ভয় পাবেন না” শক্ত করে অনিকেতের হাত ধরে সে, লাথি মেরে সামনে থেকে সরিয়ে দেয় সেই কর্দমাক্ত শিশুকে, ছিটকে পড়ে সে রাস্তার পাশের নর্দমায়। অনিকেত হাঁটতে পারে না, ওকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে প্রহরী। দু-পাশে সরে গিয়ে ওদের জায়গা করে দিচ্ছে অসভ্য হলুদ মানুষেরা। এর পরেও কারাগার আছে? এই কি কারাগার নয়? পাশ থেকে কে একজন হলুদ রক্তমাখা থুতু ছুড়ে দেয় অনিকেতের মুখে, দূরে কেউ তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে ওঠে। তারপর অবশেষে অনিকেত পৌঁছায় সেই ঘরের সামনে।
এই গ্রহে রাত্রি আসে না, কিন্তু এই ঘরে আলো প্রবেশ করে না, চির অন্ধকার এই কক্ষ। অনিকেত গরাদ ধরে দাঁড়ায়। “আমি এসেছি” ক্ষীণ কণ্ঠে বলে সে। অনেকক্ষণ পরে ছায়ামূর্তির মতো অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে জানালার সামনে দাঁড়ায় সে। গরাদের ফাঁক দিয়ে অনিকেতের হাত ধরে, চোখে চোখ রেখে চেয়ে থাকে ওর দিকে। “আমাকে নিতে এসেছ?” জিজ্ঞেস করে। অনিকেত নীরব থাকে। “নিতে এসেছ আমাকে?” সে আবার প্রশ্ন করে। অনিকেত এবারেও কিছু বলে না। “আমাকে ফেলে রেখে, একা চলে যাবে?”
“আমাকে থাকতে দেবে না ওরা, আমি হেরে গেছি।” এরপর কিছুক্ষণ কেউ আর কোনো কথা বলে না। তারপর মেয়েটা শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “জন্মভূমিতে ফিরে যাবে, নিজের সন্তানকে ছুঁয়ে দেখবে, তুমি খুব খুশি তাই না?” অনিকেত নিজেকে প্রশ্ন করে, “খুশি কি সে?” একবার যাওয়ার সিদ্ধান্ত স্থির যাওয়ার পর সে পৃথিবীর কথা ভাবতে শুরু করেছে প্রতিমুহূর্তে, নিবিড় অন্ধকার রাত্রে রুপোলি চাঁদের দিকে চেয়ে থাকার সাধ হয়েছে ওর নতুন করে, আর একবার পৃথিবীকে ছুঁয়ে দেখে এ জীবন শেষ করার যে স্বপ্ন সে দেখতে শুরু করেছে নতুন করে, একথা তো মিথ্যা নয়। আজ এই ভালোবাসার নারীর সামনে খুশি নই বললে সেই গোপন অনুভূতিকে অস্বীকার করা হবে, মিথ্যা কথা বলা হবে। কিন্তু এই কারাগারের অন্ধকার কূপের বন্দিনীর সামনে নিজেকে খুশি বলতে লজ্জা হয় অনিকেতের, সে নীরব থাকে। ওর এই নীরবতার অর্থ বুঝতে পারে সেই নারী। তবু সে আবার জিজ্ঞেস করে “বলো খুশি তুমি?” অনিকেত লজ্জায় মাথা নত করে। এই সময় সেই নারী গরাদের ফাঁক থেকে অনিকেতকে আঁকড়ে ধরে, আজ প্রথমবারের জন্য ওর লোমশ শরীরে বুনো গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে অনিকেতের, হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে অনিকেত, আর তখনই সে নারী অনিকেতের কণ্ঠনালীর উপড়ের অংশখানি দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে নেয়। তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করতে করতে অনিকেত দু-হাতে শক্ত করে ওই নারীকে ধরে ছটফট করতে থাকে, কিন্তু আর একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারে না সে, শুধু কাঁপতে থাকে থরথর করে, ওর হাতের নখ সে নারীর মাংসে বসে যায়। স্থির চেয়ে থাকে অনিকেতের দিকে ও, ওর দাঁতের ফাঁকে লেগে আছে রক্ত, অনিকেতের সারা শরীর লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
তারপর কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে যায় অনিকেত, এইসময় হঠাৎ পিশাচীনির মতো চিৎকার করে ওঠে এই বন্দিনী নারী, আর সেই মুহূর্তে গোটা নরক জুড়ে মাদকতা নেমে আসে, শতশত উলঙ্গ মানুষ দৌড়ে আসে। অনিকেতের মৃতদেহ নিয়ে তাণ্ডব শুরু করে ওরা, মৃতদেহ ছিঁড়ে খুঁড়ে মুহূর্তে যেন অদৃশ্য হয়ে যায়, প্রহরী পদপিষ্ট হয়ে কোথায় হারিয়ে যায় কেউ আর খুঁজে পায় না। বন্দিদের মুক্ত করে ওরা নিমেষের মধ্যে দৌড়ে যায় এ বস্তির প্রবেশদ্বারের দিকে, হাজার হাজার মানুষের চাপে দরজা ভেঙে যায়। বিপ্লব আসে।
তারপরেই আকাশে ড্রোন আসে, আগুন আসে, বিশ্বাসীরা আসে, বিশ্বাসঘাতকেরা আসে। ভাঙা গড়া, শোষণ শোষিতের এই খেলা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে, এই আগুন আর নেভে না।
আরও অনেক বছর পরে শ্রমণা জানতে পেরেছিল এই ঘটনা, সেদিন সে বাবার জন্য কষ্ট পেয়েছিল, কেঁদেছিল হাউহাউ করে। প্রথমবারের জন্য অসহায় হেরে যাওয়া বাবাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল ওর, ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়েছিল। অনিকেতের জীবনে প্রাপ্তি বলতে এটুকুই। আর সত্যি বলতে কি, এ বড়ো কম পাওয়া নয়। মৃত্যুর পর যদি সত্যি কিছু থাকে, যদি অনিকেত দেখতে পায় শ্রমণার এই চোখের জল, তবে এ মহাবিশ্বে কেউ অন্তত ওকে বুঝেছে এ কথা ভেবে ও আবেগাপ্লুত হবে, অনিকেতকে চিনি আমি তাই একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি।
Tags: ইমন চৌধুরী, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
