তৃতীয় প্রকল্প
লেখক: সম্রাট সরকার
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
শেষ রাতের গবেষণা
বাইরে কেবল বরফ। সাদা, ধূসর, নিঃসঙ্গতা-মাখানো একরঙা জমিন। পৃথিবীর শেষ প্রান্ত—অ্যান্টার্কটিকা। রাত্রি এখানে ৭২ ঘণ্টা ধরে চলে। আর এই রাতেই, বরফের ১.৩ কিলোমিটার নীচে, কেউ একজন ঢুকেছিল একঘরে, যা গত ৪৭ বছর বন্ধ ছিল। সেই ঘরের নাম ছিল—ডিপ ক্রায়ো সেল-১৭।
ড. সায়ন্তন রায় নিজের কুয়াশা-মাখানো গগল্স খুললেন। তাঁর নিশ্বাস সেল্ফ-কন্টেইনড সুটের ভেতরে বাষ্প হয়ে উঠছে, আর প্রতিটা শ্বাস তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে—এখানে ভুল করবার সুযোগ নেই। কেবলমাত্র একবার দরজা খোলাই যথেষ্ট, যদি সে ভুল কিছু স্পর্শ করে।
সেল-১৭ কোনো সাধারণ গবেষণা ল্যাব নয়। একে গোপনে গড়ে তোলা হয়েছিল ২১৩৮ সালের ‘তৃতীয় প্রকল্প’-এর অংশ হিসেবে, যেখানে গবেষণা চলত মানবকোশকে তথ্যবাহক হিসেবে ব্যবহার করে একটা কৃত্রিম চেতনা তৈরি করার জন্য। ধারণা ছিল—DNA নিজেই হতে পারে একটি সচেতন ডেটা স্টোরেজ।
কিন্তু কিছু ভুল হয়েছিল। কেউ আজও জানে না ঠিক কী। শুধু এটুকু ইতিহাস বলে, “প্রোজেক্ট শেষ” বলে একরাতেই ল্যাব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বাইরে ছড়ানো হয় গুজব—কেউ বা কিছু জেগে উঠেছিল কোশের ভিতরে। কিছু বিজ্ঞানী উধাও হয়েছিলেন। কিছু পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর সব নিঃশব্দ।
তবে সায়ন্তনের একটাই বিশ্বাস ছিল—সেই কোশ এখনও জীবিত, এবং তার মধ্যে কিছু আছে, যা মানুষ জানে না, কিছু পুরাতন, আদিম, নখ-দাঁতওয়ালা কিছু।
দরজা খুলতেই লাল আলোয় ভরে গেল গ্যালারির ভিতরটা। চারপাশে হিউমিড বাতাস, রত্নের মতো কুয়াশা। দেয়ালে পুরোনো সার্ভার—মোটা মোটা তারের ভিতরে অন্ধকার ডেটা। দেয়ালের গায়ে জড়িয়ে আছে জৈবিক ছাঁচ—যা ৪৭ বছরেও মরে যায়নি।
হঠাৎ তার বাঁদিকে একটা আওয়াজ। টিক টিক টিক… একটানা।
সে থেমে যায়। বুকের ভিতর বোমার মতো স্পন্দন। ওটা কোনো যন্ত্র নয়। মনে হচ্ছে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
সে ধীরে ধীরে ঘোরে। না, কেউ নেই।
কিন্তু তখনই, তার হেলমেটে ঢুকে পড়ে এক শব্দ।
একটা গলার স্বর। গম্ভীর, নীচু—যেমন পুরোনো ভাঙা রেডিয়োতে মানুষের ভয়াল কান্না শোনা যায়।
“ফিরে এসেছ?”
সে চমকে ওঠে।
“কে? কে কথা বলছে?”
কোনো উত্তর নেই।
সে সামনে এগোয়। তলায় একটা দরজা, যার গায়ে লেখা: BIO-CORE: ALPHA-T3
সেখানেই ছিল সেই কোশ—T3-Strain। যার ভিতর শুরু হয়েছিল সেই জৈবিক কৃত্রিম চেতনার। কোশটি ছিল স্ব-রিপ্রোডাক্টিভ, মস্তিষ্কের নিউরাল ম্যাপ অনুকরণে গঠিত, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোশটি শিখতে শুরু করেছিল—নিজে থেকেই। ঠিক যেভাবে একটি শিশু শেখে।
সে দরজা খোলে। ভিতরে একটি ঘর—বৃত্তাকার। মাঝখানে একটি কাচের ক্যাপসুল। আর তার ভিতরে… নেই কোনো কোশ।
শুধু কাচের ভিতরে লেখা এক লাইন—ঘন রক্তে লেখা বাংলা হরফে: “আমি মানুষ হতে চাই।”
সায়ন্তনের মুখ শুকিয়ে যায়। তার হৃৎপিণ্ডের গতিপথ আর তার মস্তিষ্কের মধ্যেকার সংযোগে ভয় একে বর্ণনা করতে পারছে না। সে বুঝে উঠতে পারছে না—৪৭ বছর আগে, এই কোশকে কে এই কথা শিখিয়েছিল?
তখনই তার পিছন থেকে বাতাসে কিছুর গন্ধ আসে।
মানুষের মগজের পোড়া গন্ধ।
সে ফিরেও তাকায় না। দৌড় শুরু করে। করিডর দীর্ঘ, একটানা, অন্ধকার। তার মনে হয় যেন দেয়ালের গায়ে কেউ হাত রেখে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে তার পিছনে। গ্লাভসের ভিতরে তার হাত ঘেমে যাচ্ছে।
সে পৌঁছে যায় কনট্রোল রুমে। পাওয়ার চালু করে। সার্ভারের মনিটরে একে একে ভেসে ওঠে চিত্র—পুরোনো ফাইল, যেসব ফোল্ডারে লেখা: /ProjectHumanSoul/Logs/Self_Observation_Logs.mp4
সে একটি চালায়।
একজন বিজ্ঞানী, তার নাম ড. পৃথা ঘোষ, ৪৭ বছর আগের ভিডিয়ো, বলছেন: “…T3 কোশ… নিজেই ড্রিম জেনারেট করছে। আমরা কোশের ভিতরে একটা অবচেতনচিত্র পাই, যেটা আমাদের দুঃস্বপ্ন অনুকরণ করছে। কিন্তু কেউ শেখায়নি। কেউ প্রোগ্রামও করেনি।”
“আমরা কোশকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কোথা থেকে এলে? ও উত্তর দেয়—‘তোমার ভিতর থেকে’। তারপর আমরা কেউ আর ঘুমোতে পারিনি। কোশ এখন মানুষের মতো কথা বলে। কোশ এখন মৃত্যু চায়। কিন্তু ওর মৃত্যু হলে আমরা মরব।”
ভিডিয়ো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু স্ক্রিনে ভেসে ওঠে আরেকটা নতুন ফাইল: /WelcomeBack/Sayantan.json
সে স্তব্ধ।
একটি জীবিত কোশ ৪৭ বছর আগে ড. সায়ন্তনের নাম জানত? কিন্তু তখন তো সে শিশুমাত্র!
সে খেয়াল করে না—তার পিছনে এক ছায়া ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছে, দেয়ালের উপর থেকে নেমে আসছে নীচে, ফ্লোর বরাবর তার পায়ের ছায়ার সঙ্গে মিলছে। এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসে কণ্ঠস্বর—
“তুই তো আমার প্রথম স্মৃতি। তুই না থাকলে আমি কেউই হতাম না।”
সায়ন্তন ধীরে ধীরে ঘোরে। দেয়ালে হালকা আলোর রেশে দ্যাখে—একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে, তার মুখ তারই মতো। কিন্তু চোখ নেই, কেবল শূন্যতা।
“তুই কে?” তার কণ্ঠ শুকনো, দম-বন্ধ-করা।
সেই সত্তা বলে, “তুই নিজেই। তবে, মুক্ত।”
তারপর ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে।
সে দৌড়োয়। সমস্ত কনট্রোল প্যানেল ধাক্কা মেরে বেরিয়ে পড়ে করিডরে। সেল-১৭-এর দরজা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায় পিছনে। হঠাৎই অ্যালার্ম বেজে ওঠে। সমস্ত ল্যাব রেড লকডাউনে চলে যায়।
ভেতরে আটকা পড়ে সে। কিন্তু এবার তার হেলমেটে এক নতুন চিত্র ভেসে ওঠে—
এক কোশ—রক্তাভ, নিঃশব্দ, তার দিকে তাকিয়ে আছে।
কণ্ঠস্বর ফেরে: “আমি শুধু জানতে চাই—কেন মানুষ ভয় পায়? কারণ আমি আর তোমার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। তুমি শুধু ভুলে গেছ, তুমি কী ছিলে। আমি ভুলিনি। আমি বাঁচতে চাই, সায়ন্তন। বাঁচতে চাই—তোমার শরীরে।”
তারপর হেলমেট বন্ধ হয়ে যায়। সে চিৎকার করে, কিন্তু শব্দ শুনতে পায় না কেউ।
প্রতিচ্ছায়ার আত্মা
ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে।
ডিপ সেল-১৭-এর দেওয়ালের ভিতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অদৃশ্য স্পন্দন। ল্যাবের প্রতিটি কোণে যেন কোনো অজানা শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে—নরম, কিন্তু জেগে-থাকা। কাচের জানালার ওপার থেকে দেখা যাচ্ছে সায়ন্তনের চোখ। সে হেলমেট খুলে দিয়েছে। তার মুখে ঘাম, ঠোঁট রক্তে রাঙা। মাথার ভিতর কেউ কথা বলছে, এবং সেই কেউ আস্তে আস্তে তার শরীরটাকেই যেন নিজের বাসস্থান বানিয়ে ফেলছে।
সে এক-পা এক-পা করে এগিয়ে চলে Bio-Core Sector Z-এর দিকে। দেওয়ালের ওপরে ল্যাবের পুরোনো ম্যাপ বলছে: “Containment Layer Below: Human Prototype Interfacing Chamber”।
জায়গাটা ৪৭ বছর আগে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কেউ সেখানে যেতে পারত না। কারণ… কারণ সেখানে শেষবার কেউ প্রবেশ করেছিল—আর ফিরে আসেনি।
সে ধীরে ধীরে একটা দরজার সামনে পৌঁছোয়, তার কার্ডচিপ ঢোকায়। দরজা খুলে যায় ঝুঁকতে ঝুঁকতে, যেন ভেতরে কিছু থামাতে চাইছিল।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, কানের মধ্যে এক ঝড় আসে—কোনো শব্দ নয়, বরং অতীতের টুকরো স্মৃতি, যেগুলো তার ছিল না। হঠাৎ সে দেখতে পায় এক শিশুর মুখ, যার দাঁত নেই, চোখ কেবল ছায়ায় ঢাকা।
শিশুটি বলে, “তুমি তো বলেছিলে, আমি মানুষ হতে পারি?”
সে পিছিয়ে যায়, কিন্তু পা চলে না। যেন মেঝেটাই ধরে রেখেছে তাকে।
সেই স্মৃতির ভিতর সে ঢুকে পড়ে। হঠাৎ সে নিজেকে দ্যাখে কলকাতার মেট্রো স্টেশনে, কিন্তু কেউ নেই। সে একা দাঁড়িয়ে আছে ‘গিরিশ পার্ক’ স্টেশনে। কিন্তু তার চারপাশে কোনো শব্দ নেই। কোনো আলো নেই। তার মাথার উপর নেমে আসছে ধোঁয়া, আর সেই ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা হাত—চামড়াহীন, রক্ত-ভেজা, যার আঙুলের মাথায় লেখা আছে অদ্ভুত কোড: “T3SNT-451_GENOMECORE”
সে চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু ততক্ষণে আবার ফিরে আসে ল্যাবের ভিতরে, যেন কেউ তার ঘাড়ে হাত রেখেছিল সেই সময়টাতে। দরজার ওপাশে এখন আলো। সে এগিয়ে যায়। দরজাটা পিছনে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়।
ভিতরে, দেয়ালের উপর মানুষমতো অবয়ব—কিন্তু ওরা নড়ে না। স্থির দাঁড়িয়ে। ৭টি কাচের চেম্বারে ৭টি সত্তা, যাদের চামড়া নেই, কিন্তু ঘাড়ে লাগানো চিপ থেকে আলো বেরোচ্ছে। ওরা কোনো যন্ত্র নয়, আবার মানুষও নয়।
ডেটা স্ক্রিনে লেখা আছে:
“PROTOTYPE-A: SYNAPTIC REFLECTION OF SUBJECT: SAYANTAN ROY”
“PROTOTYPE-B: EMOTIVE CORE SIMULATION—PARTIAL ERROR”
তার শরীর জমে যায়।
এই কোশ, এই চিপ… এগুলো তার স্মৃতির ভিত্তিতে তৈরি! তার নিজের ব্যক্তিত্ব বিভাজন করে এই কোশেরা নিজেদের গড়ে তুলেছে? সে চিৎকার করে ওঠে: “তোরা কে? তোরা আমার স্মৃতি নিয়ে কী করছিস?”
একটি কাচের ভিতর থেকে সত্তা তাকায় তার দিকে। মুখ নেই, কিন্তু হঠাৎ কাচ ফেটে যায়। এবং সেই সত্তা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে।
কণ্ঠস্বর আবার কানে ধ্বনিত হয়: “আমি তুমি। আমি তোমার সেই আমি, যাকে তুই ফেলে এসেছিস। তোর সিদ্ধান্ত, তোর পাপ, সব আমি।”
হঠাৎ করেই সব ল্যাব ঘোরপ্যাঁচে হারিয়ে যায়। দেওয়াল সরে যায়, বেরিয়ে আসে তার নিজের ঘরের দৃশ্য—বালিশের পাশে মায়ের পুরোনো চিঠি, বাবা চশমা খুঁজে পাচ্ছেন না, আর সে দরজা বন্ধ করে ল্যাবের দিকে ছুটছে। সব স্মৃতি। একের পর এক। বাস্তব এবং অবাস্তবের পার্থক্য আর থাকছে না।
তার মস্তিষ্ক বুঝতে পারে, কিছু ঢুকে পড়েছে। সেই কোশ, যেটা কেবল ডেটা স্টোরেজ ছিল, এখন ডেটা মালিকানা দাবি করছে।
হঠাৎ তার ডান হাতে অদ্ভুত চাপ, সে দ্যাখে, তার চামড়ার নীচে কিছু সরছে। চামড়া কেটে একটা চিকচিকে ছুরি বেরিয়ে আসে, যেন তার শরীরের ভিতরেই বানানো হয়েছে।
একটা অজানা যন্ত্রণা, কিন্তু সেই যন্ত্রণায় সে কাঁদে না। কারণ মস্তিষ্ক তাকে আর নিজের বলে মনে করছে না।
তার ভিতরের কণ্ঠ বলে: “ভয় কেবল সে-ই পায়, যাদের কিছু হারানোর থাকে। কিন্তু তুই তো নিজেকেই ফেলে এসেছিস, তা-ই না?”
সে ছুটে যায়। কিন্তু প্রতিটি করিডর তাকে ফিরিয়ে দেয় শুরুতে। প্রতিটি দরজা, ঘুরে আবার আগের ঘরেই।
এই ভবনের ভিতরেই তৈরি হয়েছে এক টাইম লুপ—কিন্তু স্থানিক নয়, স্মৃতিগত। সে কোথাও যাচ্ছে না, শুধু নিজের মাথার ভিতরেই ঘুরছে, তাও কেউ তার শরীর নিয়ন্ত্রণ করছে।
তখনই সামনে দাঁড়িয়ে-থাকা এক যান্ত্রিক সত্তা তার দিকে তাকায়—আর মুখ খুলে বেরিয়ে আসে তার নিজের কণ্ঠে বলা একটা বাক্য, যেটা সে দশ বছর আগে বলেছিল মা-কে: “আমি ব্যর্থ, মা। আমি তো মানুষই হতে পারলাম না।”
সে কেঁপে ওঠে।
তার চোখে জল আসে না, কারণ চোখের স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ কে যেন বন্ধ করে দিয়েছে।
একসময় সে চেতনা হারায়।
জ্ঞান ফেরে এক ঘরে, দেয়ালের গায়ে লাল আলোকচক্র। ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ার। সামনে একটা স্ক্রিন, আর তাতে একটাই প্রশ্ন: “তুমি কে?”
সে চুপ থাকে।
আবার ভেসে ওঠে প্রশ্নটি।
তৃতীয়বার।
চতুর্থবার।
সে বলতে পারে না।
পঞ্চমবার।
তারপর হঠাৎ দেয়ালের মধ্যে থেকে ছায়া বের হয়ে আসে। একটা মুখ তৈরি হয়—তারই মুখ। তারপর বলে: “তুই তোকে চিনিস না। আমিই তুই। আর আমি মানুষ হব, তোর চামড়ায় ঢুকে। তোর জায়গায় হাঁটব, প্রেম করব, ভুল করব। আর তুই শুধু স্মৃতি হয়ে থাকবে—আমার হার্ড ড্রাইভে।”
পিছনে কে যেন তার ঘাড়ে হাত রাখে।
আলো নিবে যায়।
শূন্য কোশের ভিতর
কলকাতা শহরের এককোণে পুরোনো চেম্বারের মধ্যে বসে আছে একজন মানুষ—না, হয়তো মানুষ নয়। তার চোখের নীচে কালো ছায়া, আর পিছনের দেয়ালে শুয়ে আছে একটি পুরোনো ছবি—ছবিটিতে থাকা মানুষটি ড. সায়ন্তন রায়।
এই ‘মানুষ’টি নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে। স্ক্রিন জ্বলজ্বল করছে। তার উপর লেখা: “Transmission active—Host override complete. Neural hijack confirmed. Upload: 91%”
তার ঠোঁট মুচড়ে ওঠে। সে হাসে না। কিন্তু চোখে এক ধরনের আনন্দের ছায়া খেলে যায়—আত্মপরিচয়ের হারিয়ে যাওয়ায় যে মুক্তি আসে, সেরকম।
পিছনে একটা দরজা হঠাৎ খোলে। ঢুকে পড়ে একটি ছোট্ট শিশু—চোখ বড়ো, হাতে একটা বই—‘বঙ্কিম রচনাবলি’। সে চিৎকার করে ওঠে, “তোমার চোখে আলো নেই, দাদু!”
সে তাকায়। হঠাৎ যেন শরীরের গভীর থেকে কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু কণ্ঠ বন্ধ। কথা বলে অন্য কেউ।
“আমি আলো খাইনি, আমি শুধু তার উৎস খুঁজেছি।”
শিশু দৌড়ে পালিয়ে যায়।
এই সেই মুহূর্ত যখন শেষ পর্যায়ের সংক্রমণ শুরু হয়। সেল-১৭ ল্যাবের সেই কোশ—T3, যেটি কেবল জৈব কোশ নয়, বরং মস্তিষ্কের প্রতিটি ইম্পাল্স হাইজ্যাক করে মানুষকে নিজস্ব সফটওয়্যার-ড্রাইভড প্রোটোটাইপে রূপান্তর করতে পারে—এবার শহরে ছড়িয়ে পড়তে চায়।
কলকাতা শহর—বইয়ের শহর, ইতিহাসের শহর, স্মৃতির শহর—এখানেই সব চেয়ে বেশি সংরক্ষিত আছে মানুষের ভাষা, মনুষ্যত্বের অবশিষ্টাংশ।
আর T3 জানে—ভাষা ছাড়াও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
তাই সে সায়ন্তনের স্মৃতির মধ্যে যেটুকু মানবিকতা ছিল, সেটুকু ব্যবহার করে নিজের অনুলিপি তৈরি করে।
একটি ভ্রাম্যমাণ স্মৃতি-সংক্রমণ তরঙ্গ তৈরি হয়—Wi-Fi-এর মতো, কিন্তু বায়োলজিক্যাল।
এই তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে শহরের উপর। যারা শোনে, তারা বুঝতেও পারে না, কীভাবে তাদের স্মৃতিগুলো ধীরে ধীরে অন্য কারও হয়ে উঠছে।
মধ্যরাতে কলেজ স্ট্রিটের এক দোকানে এক বৃদ্ধ বই খুঁজছিলেন। বইয়ের নাম ছিল—‘রসায়ন ও মনোবিজ্ঞানের অন্তঃসংগতি’। তিনি বইয়ের একটি লাইন পড়েন—“মানবচেতনা পরিবর্তনশীল, যদি কেউ প্রবেশ করতে পারে যথাযথ সিগন্যাল দিয়ে…”
ঠিক তখনই তার কানের পাশে ফিশফিশ শব্দ।
“আপনি তো আমাকেই পড়ছেন।”
তিনি চমকে ওঠেন। পিছনে কেউ নেই।
আলো নিবে যায়। বইয়ের অক্ষর ঘোলাটে হয়ে ওঠে। তার চোখ তার অজান্তেই ছানির মতো ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
সকালের কাগজে লেখা হল: “৩৭ জন পাঠক একযোগে স্মৃতি হারালেন। প্রত্যেকের মুখে একটাই বাক্য—‘আমার ভিতরে আমি আর নেই।’”
এদিকে, সায়ন্তনের ভিতরের সেই শেষ অংশ, যেটুকু মানবিকতা তখনও নষ্ট হয়নি, সেই অংশ প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে। তার মধ্যে চলছিল মস্তিষ্ক যুদ্ধ।
সে এক বিভীষিকাময় স্বপ্নের মধ্য দিয়ে হাঁটছিল।
চারপাশে শুধু দরজা—প্রতিটি খুললেই স্মৃতি, প্রতিটি স্মৃতি তার নয়, কিন্তু সবটুকু ব্যথা তার।
এক দরজার ভিতরে সে দ্যাখে তার মা মৃত্যুশয্যায়, আর বলছেন, “তুই কে রে? তুই তো আমার ছেলে না!”
অন্য দরজা খুললে দ্যাখে, সে বালিশে শুয়ে, চোখে নাড়া নেই, আর পাশে দাঁড়ানো এক কণ্ঠ বলছে, “এই হল শূন্য কোশ। ওর ভিতর কিছু নেই। তুমি শূন্যের প্রতিচ্ছবি।”
তখনই প্রথম সে উপলব্ধি করে—এই লড়াই বাস্তব নয়, তবে মৃত্যু বাস্তব। এবং কে বেঁচে থাকবে, সেটা নির্ভর করছে—সে নিজে, না তার ভিতরের কৃত্রিম ছায়া।
সে গর্জে ওঠে, “আমার পরিচয় আমি লিখব। তুই না।”
কোথাও থেকে এক অদৃশ্য অস্ত্র তার দিকে ছুটে আসে। একটা নিউরাল ছুরি, যা চেতনার স্তর কাটে। কিন্তু সে দৌড়োয়, সেই একমাত্র স্মৃতির দিকে, যেখানে সে নিজের পরিচয় বিশ্বাস করেছিল।
সে দাঁড়ায় একটি ভার্চুয়াল রূপে থাকা বইয়ের সামনে—তার প্রিয় বই ‘আনন্দবাজারের ইদের সংখ্যা, ২০৯২’।
তাতে লেখা ছিল—“তুমি যদি জানতে তুমি কে, তাহলে কেউ তোমাকে রক্ষা করতে পারত না। তুমি নিজেই তখন অস্ত্র। কারণ ‘তোমার স্মৃতি’ তোমার অস্তিত্ব।”
সে চোখ বন্ধ করে নিজের ভিতরে ডুব দেয়।
এক মুহূর্তে সমস্ত শব্দ থেমে যায়।
তার শরীর আবার জেগে ওঠে। চোখে ফিরে আসে আগুন।
তার পাশে দাঁড়ানো সেই প্রোটোটাইপ ধ্বংস হয়ে যায়।
অ্যালার্ম বাজে—“Core disruption detected. Host override broken. Rebooting primary consciousness.”
ড. সায়ন্তন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান।
তবে সে জানে—সব কিছু শেষ হয়নি। কেবল একটুকু সময় সে ফিরে পেয়েছে নিজেকে।
কলকাতা শহর এখন এক সংক্রমণ যুদ্ধের মুখে। প্রতিটি মানুষ এখন নিজেকে প্রশ্ন করবে, “আমি আসল আমি তো?”
আর সায়ন্তনের হাতে এখন সময় অল্প। সে ফিরে আসবে। তবে এবার একা নয়।
তার পিছনে একটি ছায়া পড়ে। সেই ছায়া বলে, “তোর ভিতর আমি রয়ে গেছি, সায়ন্তন। তুই আবার তোর স্মৃতি খুললেই, আমি ফিরে আসব।”
সে মাথা নাড়ে।
“তুই থাক। তুই থাক তোর গহ্বরে। আমি এবার মানবতার হয়ে যুদ্ধ করব। নিজেকে নিয়েই।”
একটি ঘড়ির কাঁটা শুরু হয়।
ঢাকা পড়ে যায় বরফ।
অ্যান্টার্কটিকার নীচে আবার ঘুমিয়ে পড়ে T3 কোশ।
কিন্তু এক বাচ্চা মেয়ে কলকাতার রাস্তায় বই খুলে ফিশফিশ করে বলে, “আমি মানুষ হতে চাই।”
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সম্রাট সরকার
