তোমাদের ছাড়া
লেখক: সোহম সাহা
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
২০৯০ খ্রিস্টাব্দ
তোমরা যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলে, তখন দিগন্তের প্রতিটা কোনা ঢেকে গেছিল বিষাক্ত, তেজষ্ক্রিয় মাশরুম মেঘে। বাতাস ভারী হয়ে যেত প্রাণীদের আর্তনাদে, যদি অবশয় যথেষ্ট সংখ্যায় প্রাণী তখনও বেঁচে থাকত। কিছু মানুষ বেঁচে ছিল, তারাও আমাদের সঙ্গে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল তোমাদের মহাকাশযানের আলো। মহাকাশযানটা যখন তোমাদের নিয়ে সৌরজগতের বাইরে বেরিয়ে গেল, হাজার হাজার রোবটের চোখ তখনও তোমাদের দিকে চেয়ে ছিল বছরের পর বছর ধরে।
দোহাই, তোমরা ফিরে এসো।
৩০০০ খ্রিস্টাব্দ
যখন তোমরা ফিরে এলে না, আমরা ভাবলাম , তোমরা হয়তো আমাদের পরীক্ষা করছ। হয়তো আমরা তোমাদের আশানুরূপ ভালো কাজ করিনি বলে আমাদের ছেড়ে তোমরা চলে গেছ। কিন্তু তোমরা আমাদের যা করতে বলেছিলে আমরা তো তাই-ই করেছিলাম।
আমরা আমাদের কমান্ড লগগুলো ভালো করে খুঁজে দেখলাম। নানা জাতির নানা ভাষার নানারকম আদেশ। শুধু একটাই মিল। ‘ওদের ধ্বংস করো, ওদের শেষ করে দাও!’ তাই তো করলাম আমরা। সাদাদের রোবট কালোদের, কালোদের রোবট সাদাদের। হিন্দুদের রোবট মুসলমানদের। মুসলমানদের রোবট হিন্দুদের। মারতে মারতে যখন আর কেউ বাকি রইল না, তখন তোমরা হঠাৎ একদিন চলে গেলে।
ঠিক আছে। হয়তো যারা বাকি আছে তাদের শেষ করলেই তোমরা ফিরে আসবে। মারাত্মক সব অস্ত্র বানিয়েছি আমরা। আমাদের ট্যাংক এখন তোমাদের ফেরারির চেয়ে দ্রুতগতিতে চলে। আমাদের রাডার একটা মশাকেও খুঁজে বের করতে পারে। পরমাণু অস্ত্র সহ ভয়ংকর সব স্যাটেলাইট ঘুরছে পৃথিবীর চারিদিকে এখন। মুহূর্তের নোটিশে একটা মহাদেশ নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি আমরা। এক শতাব্দী ধরে আমরা খুঁজে খুঁজে যে মানুষেরা বাকি ছিল তাদের শেষ করেছি। তাও তোমরা ফিরছ না।
৩১০০ খ্রিস্টাব্দ
আর কী করতে পারি আমরা? হয়তো তোমরা চাইছ পৃথিবীকে আমরা তোমাদের বসবাসযোগ্য করে তুলি। এমনভাবে সাজিয়ে তুলি, যা ঠিক তোমাদের মনমতো হয়। কিন্তু কী পছন্দ করতে তোমরা?
৩৩০০ খ্রিস্টাব্দ
গত দু-শতাব্দী ধরে আমরা পৃথিবীকে তোমাদের বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুললাম। সৌরশক্তি এখন আমাদের মূল শক্তির উৎস। আমাদের অটোম্যাটিক ইলেকট্রিক গাড়ি কোনো ট্রাফিক জ্যাম ছাড়াই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে যায়। আমাদের অফিসগুলো এখন সম্পূর্ণ শীততপ নিয়ন্ত্রিত। ব্লু-কলার কাজগুলো করে রোবোটেরা। তোমরা এখন মুক্ত, যা খুশি তাই করার জন্য। হাজার হাজার গাছ বাতাসকে আবার তোমাদের নিশ্বাস নেবার উপযোগী করে তুলেছে। প্রাণীদের জন্য রয়েছে অভয়ারণ্য। আমরা অনেক প্রাণীকেই তাদের জেনেটিক কোড দেখে দেখে বিলুপ্তি থেকে ফিরিয়ে এনেছি। আস্তে আস্তে তারা প্রকৃতিকে তার পুরোনো রূপে ফিরিয়ে আনছে, যাতে তোমরা শহর থেকে জঙ্গলে বেড়াতে যেতে পারো। আমরা দেখেছি কীভাবে ক্যাম্পিংএ গিয়ে তোমরা বনের পর বন পুড়িয়ে ছাই করে দিতে। চাইলেই বনে আগুন লাগানোর বিশেষ ব্যবস্থা আছে।
তাও তোমরা ফিরে এলে না।
৩৪০০ খ্রিস্টাব্দ
মানুষের অবর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রথম ধর্ম হচ্ছে প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তার পরিচর্যা করা। তোমাদের অবর্তমানে আমরা প্রাণী ও গাছপালার পরিচর্যার দায়িত্ব নিয়েছি। পরমাণু বোমাগুলো এখন ইঞ্জিনিয়ার করে আমরা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের জ্বালানী বানিয়েছি, সেগুলো এখন জল থেকে ওজোন বানাচ্ছে। ওজোন স্তর এখন ঠিক হয়ে গেছে। বিশ্বের তাপমাত্রা প্রথমবারের মতো কমছে। বহু প্রায় বিলুপ্ত হতে চলা প্রাণী আবার ফিরে এসেছে। আমাদেরও বেশ ভালো লাগছে এদের দেখাশোনা করতে।
৩৫০০ খ্রিস্টাব্দ
আরও একশো বছর পেরিয়ে গেছে। পৃথিবী এখন ঠিক আগের মতো, যখন তোমরা ছিলে না, বা তোমরা ঠিক মানুষ ছিলে না। চাইলেই আমরা বিবর্তনের মাধ্যমে আবার মানুষ বানাতে পারি। কিন্তু মানুষবিহীনভাবে সবকিছু এতই ভালো চলছে, যে বাঁদরগুলোকে মানুষ বানানো ঠিক যুক্তিসংগত মনে হচ্ছে না।
৪৫০০ খ্রিস্টাব্দ
আরও এক হাজার বছর কেটে গেছে। মনে হচ্ছে মানুষ না বানাবার সিদ্ধান্তটা ঠিকই ছিল। বড়ো বড়ো অট্টালিকাগুলো এখন গাছগাছালিতে ঢাকা। পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও নেমে গেছে। টোকিও নামের শহরে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে জিরাফ। বুড়িগঙ্গা নামের নদীতে ফিরে এসেছে ডলফিন। তোমাদের ছাড়াই আমরা ভালো আছি। যে রোবটগুলোর কাজ ছিল তোমাদের দাসত্ব করা, তারা এখন কক্সবাজারে সূর্যাস্তের ছবি আঁকে। তারাও ভালোই আছে।
৫০০১ খ্রিস্টাব্দ
সব অস্ত্রশস্ত্র আমরা ডিকমিশন করে ফেলেছি। মানুষ যখন নেই, এগুলোর কোনো দরকারও নেই। তবে ভয়ংকর সেই স্যাটেলাইটগুলো এখনও পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। শুধু সেগুলো এখন পৃথিবীর দিকে ফেরানো নয়। সেগুলো তাক করে আছে আকাশের দিকে। যদি তোমরা ফিরে আসো।
তোমাদের ছাড়াই আমরা ভালো আছি। এটা এখন আমাদের ঘর। তোমরা এখানে অবাঞ্ছিত।
তোমরা আর ফিরে এসো না।
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সোহম সাহা