দ্য ক্লক দ্যাট ওয়েন্ট ব্যাকওয়ার্ড
লেখক: এডওয়ার্ড পেজ মিচেল অনুবাদ: রুদ্র দেব বর্মন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
এডওয়ার্ড পেজ মিচেল (জন্ম: ১৮৫২–মৃত্যু: ১৯২৭)
মিচেল ছিলেন সংবাদপত্রজগতের মানুষ। পেশাগত জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি কাটিয়েছেন সংবাদপত্রের জগতে। এমনকি ১৮৯৭ থেকে ১৯২৭ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনিই ছিলেন নিউ ইয়র্কের ‘দ্য সান’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। মানুষ তাঁকে সংবাদপত্রের লোক হিসেবেই জানত। সাহিত্যের আঙিনায় তাঁর পদচারণা অথবা জঁর ফিকশন—আর বিশেষ করে তার মধ্যে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের ময়দানে তাঁর লেখালেখির সংখ্যা খুব বেশি না হলেও যথেষ্ট। কিন্তু বেশির ভাগই তিনি লিখেছিলেন বেনামে। মানুষ তাই জানতে পারেনি। সমকালের পাঠকসমাজে সেইসব লেখা উপযুক্ত সমাদর পায়নি। অবশেষে সেগুলো সমাদৃত হল তাঁর মৃত্যুর ৪৬ বছর পরে ১৯৭৩ সালে, যখন কল্পবিজ্ঞান গবেষক এবং সম্পাদক স্যাম মস্কোভিটসের গবেষণা সেই লেখাগুলো পুনরাবিষ্কার করল ‘দ্য ক্রিস্টাল ম্যান: ল্যান্ডমার্ক সায়েন্স ফিকশন’ নামের সংকলনে। এই সংকলনে ‘দ্য ক্লক দ্যাট ওয়েন্ট ব্যাকওয়ার্ড’ গল্পটা প্রকাশিত হওয়ার পরেই জানা গেল, সময়ভ্রমণ নিয়ে গল্প তিনি লিখে ফেলেছিলেন আধুনিক কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের সেই প্রথম যুগেই (১৮৮১ সালে)। তবে আজও কিন্তু গুগ্ল আর উইকিপিডিয়ায় খোঁজ করলে সময়ভ্রমণ সংক্রান্ত গল্পের যে তালিকা পাওয়া যায়, তাতে এই গল্পের নাম পাওয়া যায় না। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-এর গিলগামেশ থেকে শুরু করে আমাদের রামায়ণ হয়ে খ্রিস্ট-পরবর্তী দ্বিতীয় শতকের সিরিয়ান ‘ট্রু হিস্ট্রি’, অষ্টম শতাব্দীর জাপানি ‘উরাশিমা তারো’র পর গুগ্ল আর উইকিপিডিয়ার তালিকা সরাসরি চলে আসে ঊনবিংশ শতাব্দীর ১৮৮৭ সালে। তালিকার হিসেবে আধুনিক কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের সময়ভ্রমণ নিয়ে লেখা প্রথম গল্প স্প্যানিশ লেখক এনরিক গ্যাসপার ওয়াই রিম্বাউয়ের ‘দ্য অ্যানাক্রোনোপেট’। এইচ জি ওয়েল্স তাঁর ‘দ্য টাইম মেশিন’ লিখবেন আরও আট বছর পরে ১৮৯৫ সালে। মাঝে অবশ্য ১৮৮৯ সালে মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েনের লেখা ‘এ কানেকটিকাট ইয়াঙ্কি ইন কিং আর্থারস কোর্ট’-এরও উল্লেখ আছে। অথচ আধুনিক কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের সময় ভ্রমণ নিয়ে লেখা প্রকৃত প্রথম গল্পটার নাম সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
‘দ্য ক্লক দ্যাট ওয়েন্ট ব্যাকওয়ার্ড’ গল্পটা লেখা আর তার প্রথম প্রকাশ ‘দি অ্যানাক্রোনোপেট’-এরও বছর ছয়েক আগে। সেই অর্থে এডওয়ার্ড পেজ মিচেলের লেখা এই গল্পটাই আধুনিক কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের প্রথম সময়ভ্রমণের গল্প। বেনামে প্রকাশিত এই গল্পটি লেখা আর তার প্রথম প্রকাশ হয় নিউ ইয়র্কের ‘দ্য সান’ পত্রিকার ১৮৮১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সংস্করণে।
১
আমাদের গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার বাড়িটা ছিল শিপস্কট নদীর একদম তীর ঘেঁষে। বাড়িটার সামনের দিকের পুরোটা ঘিরে দণ্ডায়মান ছিল একসার লম্বার্ডি পপলার। আর আশ্চর্যজনকভাবে আমার গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার চেহারাটাও ছিল এমন, যে তাঁকে দেখলেই মনে হত তিনিও যেন সেই পপলারদেরই একজন। প্রায় রক্তশূন্য চেহারা। তাঁকে দেখলে তাঁর জীবনীশক্তি সম্পর্ক যে-কেউ অত্যন্ত নিরাশ হতে বাধ্য হবে। গোটা শরীরেই রক্তাল্পতার ছাপ ছিল বিচ্ছিরিরকমভাবে প্রকট। এতটাই, যে সাধারণ মানুষ, যাদের শরীরে রক্ত যথোপযুক্তভাবে প্রবাহিত হয় তাদের থেকে তিনি যে সম্পূর্ণ আলাদা, তা বোঝার জন্যে সেটাই ছিল যথেষ্ট। একে তো ধারালো কাটা-কাটা চেহারা, তার উপর যেমন ছিলেন বিশাল লম্বা, তেমনি মারাত্মক রোগা। পরনের পোশাক-আশাকের অবস্থাও থাকত তেমনি। সেগুলোও যেন কোনোরকমে তাঁর শরীরে লেপটে ঝুলে থাকত। আমি তো নিশ্চিত যে ঈশ্বর যদি কোনোভাবে তাঁকেও ড্যাফনির1 মতোই একখানা বর প্রদান করতেন, তাহলে তিনিও সঙ্গে সঙ্গে সোজা সেই বিষণ্ণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে-থাকা পপলার গাছগুলোর সারির মধ্যে কোথাও মহানন্দে নিজের জায়গা করে নিতেন।
আমার প্রথম জীবনের স্মরণীয় ঘটনাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই আবার আমার এই শ্রদ্ধেয়া আত্মীয়াকে নিয়েই। বিশেষ করে যে ঘটনাগুলোর কথা এখন আমি বলতে চলেছি, সেগুলোর সব ক-টাতেই জীবিত বা মৃত তিনিই ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়: আর আমার বিশ্বাস, সেগুলোর সব ক-টাই এমন সব ঘটনা, যা মানবজাতির অভিজ্ঞতার নিরিখে অতুলনীয়।
কর্তব্যের খাতিরে মাঝেমধ্যেই তখন আমাদের গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করতে মেইন শহরে যেতে হত। আর যখনই যেতাম, অতি অবশ্যই আমার খুড়তুতো ভাই হ্যারির সঙ্গে তাঁর বয়স ঠিক কত, তা-ই নিয়ে তখন প্রচুর জল্পনা চলত। কত হতে পারে তাঁর বয়স, ষাট নাকি ষাট-দুগুণে একশো কুড়ি? আমাদের কাছে সঠিক প্রমাণ কিছু ছিল না; তবে দেখে মনে হত, দুটোর যে-কোনো একটা হতে পারে। এমনকি বাড়িটার আসবাবপত্র থেকে শুরু করে বুড়ির সব কিছুই ছিল মান্ধাতার আমলের। মনে হত, তিনি যেন শুধু অতীত নিয়েই বেঁচে আছেন। এমনকি তাঁর সেই আধা ঘণ্টার ছোট্ট অথচ আবশ্যিক আলাপচারিতায়, যেটা তিনি পপলার গাছের ছায়া পুবদিকে ঢলে পড়ার পর, তাঁর দু-নম্বর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অথবা পিৎজ়ার টুকরো চিবোতে চিবোতে শুরু করতেন, সেখানেও তিনি শুধু তাঁর তথাকথিত পূর্বপুরুষদের গল্পই আমাদের বলতেন। তথাকথিত বললাম শুধুমাত্র এই কারণে যে, আমাদের মোটেও বিশ্বাস হত না যে, তাঁরও পূর্বপুরুষ বলে কেউ কখনও ছিল।
এমনিতে বংশলতিকা বা ঠিকুজি-কুলজি নিয়ে মাথা ঘামানোটা একটা অর্থহীন ব্যাপার। তবু ছোটো করে হলেও গল্পের খাতিরে গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার বংশলতিকা এখানে দিয়ে দেওয়া যাক:
তাঁর প্র-প্রপিতামহী (১৫৯৯-১৬৪২) ছিলেন হল্যান্ডের আদি বাসিন্দা। তাঁর বিয়ে হয় একজন বিশুদ্ধতাবাদী শরণার্থীর সঙ্গে। ফলে ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে উদ্বাস্তু অবস্থায় অ্যান নামের এক জাহাজে চড়ে লেডেন থেকে চলে আসতে হয় প্লাইমাউথে। দেশান্তরিত এই উদ্বাস্তু-মাতার এক কন্যেই হচ্ছেন গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার প্রপিতামহী (১৬৪০-১৭১৮)। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনি গিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন ম্যাসাচুসেট্সের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্টে। যদিও কিছুকাল পরেই পেনোবস্কট যুদ্ধে সেখানকার নেটিভ ইন্ডিয়ানদের তাড়া খেয়ে কিছুদিনের জন্যে সরে যেতেও বাধ্য হন। যদিও তাঁর কন্যা (১৬৮০–১৭৭৬) সেইসব কলোনি মুক্ত আর স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বেঁচেবর্তে থেকে আগামী প্রজাতন্ত্রের জনসংখ্যায় তাঁর অবদান হিসেবে রেখে যান সব মিলিয়ে মোট উনিশজন বলশালী পুত্র আর লাবণ্যময়ী কন্যা। তাঁর কন্যাদের মধ্যে একজন (১৭৩৫-১৮০২) বিয়ে করেন উইস্ক্যাসেট শহরের একজন জাহাজি কাপ্তানকে, যিনি তাঁর বাণিজ্যতরি নিয়ে ব্যাবসার কাজে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে যাতায়াত করতেন। বিয়ের পরে তিনিও স্বামীর সঙ্গে বহুবার সেই পথে সমুদ্রযাত্রা করেন। আর তা-ই করতে গিয়ে দু-দুবার তিনি সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজডুবির অভিজ্ঞতা অর্জন করেন—একবার এখন যাকে সেগুইন দ্বীপ বলে, সেইখানে আর একবার সান-সালভাদরে। আমাদের মাসি-ঠাকুমা মিস গার্ট্রুডের জন্ম সেই সান-সালভাদরেই।
তাঁর এই পারিবারিক ইতিহাস শুনতে শুনতে আমরা প্রত্যেকবারই ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। সম্ভবত সেই একই জিনিস বারবার করে শোনাটাই ছিল তার প্রধান কারণ। তার উপর কোনোরকম দয়ামায়া না দেখিয়ে, উলটে নাছোড়বান্দার মতো আমাদের তরুণ বয়সি কানের সামনে উপরের তারিখগুলোকে যেভাবে বারবার করে উচ্চারণ করা হত, সেটাও সম্ভবত আমাদের সন্দিগ্ধ করে তোলার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তো যা বলছিলাম, গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস জানার ব্যাপারে বলতে গেলে আমাদের খুব একটা আগ্রহ কখনোই ছিল না। এমনিতেই তাদেরকে অত্যন্ত অবাস্তব বলে মনে হত। আমাদের ব্যক্তিগত মত ছিল তাঁর প্র-প্রপিতামহী, প্রপিতামহী বা পিতামহী প্রমুখের সম্পর্কে এবং আরও অন্যান্য যাদের বিষয়ে যা কিছু তিনি বলতেন, সেগুলো সবই ছিল বিশুদ্ধ গল্পগাথা, আর শুধু তা-ই নয়, তাদের নিয়ে যত দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমা বলতেন, আমাদের মতে সেগুলোর প্রত্যেকটার প্রকৃত নায়িকা ছিলেন তিনি স্বয়ং নিজেই, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তিনিই বেঁচেবর্তে থেকে এইসব করে চলেছেন। আর তাঁর সমসাময়িক প্রজন্মের বাকিরা সবাই মরে-হেজে বহুকাল আগেই পঞ্চভূতে মিশে গিয়েছে।
চকমিলানো প্রাসাদের চারদিক ঘিরে বর্গাকারে উঠে-যাওয়া সিঁড়ির প্রথম ল্যান্ডিং-এই ছিল সেই ওলন্দাজ শৈলীর লম্বাটে বিশাল ঘড়িটা। ততোধিক বিশাল একটা কাঠের কাঠামোর মধ্যে ছিল সেটার অবস্থান। সব মিলিয়ে উচ্চতা অন্তত আট ফুট। কিংবা তার বেশিও হতে পারে। গাঢ় লাল রঙের কাঠের তৈরি কাঠামো। তবে মেহগনি যে নয়, সেটা পাক্কা বোঝা যেত। কাঠের উপর রুপোর আশ্চর্য সব কারুকাজ করা। বেশ বোঝা যায়, সেটা যেমন-তেমন কোনো সাধারণ আসবাব ছিল না। মাত্র শ-খানেক বছর আগেই এই ব্রান্সউইক শহরে ক্যারি নামের একজন ঘড়ি-নির্মাণবিদ ছিলেন। পরিশ্রমী আর দক্ষ ঘড়িশিল্পী হিসেবে তাঁর নাম সে যুগেও বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উপকূলের এইদিকে তখন এমন একটাও সচ্ছল পয়সাওয়ালা বাড়ি ছিল না, যেখানে ক্যারি-ঘড়ির অভাব ছিল। কিন্তু গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার এই ঘড়ি কিন্তু সেই ক্যারি-ঘড়ি নয়। এটার ঘণ্টা আর মিনিটের চিহ্নগুলো ব্রান্সউইকের সেই বিখ্যাত কারিগরের জন্মেরও দুই শতাব্দী আগে যেমন ধারা প্রচলিত ছিল, সেইরকম। সেগুলো ছিল সেই সময়কার চালু প্রথা, যখন লেইডেন শহরের দখল নিতে পরিখার বাঁধ ভেঙে উইলিয়াম দ্য ট্যাসিটর্ন2 তাঁর নৌবাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন নগরের ভেতরে। ১৫৭২ সালে জ্যান লিপারডামের হাতে তৈরি গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার এই ঘড়িটার ডায়ালে কালো রঙে মোটা মোটা অক্ষর আর সংখ্যায় লেখা সেইসব তথ্য আজও পরিষ্কার বোঝা যায়। অবশ্যই ক্যারির ঘড়ি সব একেকটা অসামান্য সৃষ্টি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ধরনের প্রাচীন অভিজাতদের পাশে সেগুলো যেন এই সেদিনের বালখিল্য। ডায়ালে চিত্রিত হাওয়াকল আর বেড়িবাঁধে ঘেরা একটা নীচু জলাভূমির প্রাকৃতিক দৃশ্যের উপরে বেশ কায়দা করে আঁকা হয়েছে মনমাতানো ওলন্দাজ চাঁদের বিভিন্ন চন্দ্রকলার ছবি। একদম উপরে রয়েছে কোনো দক্ষ শিল্পীর হাতে খোদাই-করা একটা আলংকারিক কাজ। আড়াআড়িভাবে বসানো দুটো তরবারির ঠিক মধ্যিখানে একটা মড়ার মাথার খুলি স্থির হয়ে বসে আছে। তবে ষোড়শ শতাব্দীর অন্য সব ঘড়ির মতো এটাতেও কিন্তু পেন্ডুলাম নেই। তার বদলে ঘড়িটার লম্বা কাঠামোর নীচের দিকে রয়েছে একটা সাধারণ ভ্যান উইক এসকেপমেন্ট, যেটা ঘড়ির ঝুলন্ত ওজনগুলোর ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করার কাজে লাগে।
কিন্তু ঝুলন্ত ওজনগুলো কখনোই নড়াচড়া করেনি। বছরের পর বছর ধরে এই যে এতবার হ্যারি আর আমি মেইনে শহরে এসেছি, যতবারই এসেছি, দেখেছি, প্রাচীন ঘড়িটার কাঁটাগুলো সেই সওয়া তিনটের ঘরেই লটকে আছে, ঠিক প্রথমবার যেখানে দেখেছিলাম। ফুলকো লুচির মতো চাঁদটটাও সেই যে তিন-চতুর্থাংশ মুখ বের করেছিল, তারপর থেকে সেইভাবেই রয়ে গেছে। মনে হয়, মাথার উপরে থাকা খুলিটার মতোই নিশ্চল হয়ে চাঁদটাও ওইভাবেই চিরকাল কাটিয়ে দেবে। ঘড়ির স্তব্ধীভূত বিচলন আর কাঁটা দুটোর পক্ষাঘাতগ্রস্ততার মধ্যে নিশ্চিত কিছু একটা রহস্য আছে। গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমা অবশ্য আমাদের বলেছিলেন যে, সেই যেবার ঘড়িটার উপর বাজ পড়েছিল, তারপর থেকেই ওটা আর কোনোদিন কাজ করেনি; শুধু তা-ই নয়, তিনি আমাদের দেখিয়েছিলেন, ঘড়ির কাঠামোর মাথার দিকে একপাশে একটা কালো-হয়ে-যাওয়া ফুটো আর তার সঙ্গে হাঁ-হয়ে-থাকা একটা গভীর চিড়, যা বেশ কয়েক ফুট নীচ পর্যন্ত নেমে গেছে। কিন্তু তাঁর সেই কৈফিয়ত আমাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। পারেনি, কারণ পরে একদিন আমরা যখন গ্রাম থেকে ঘড়ির মিস্ত্রি ডেকে নিয়ে আসার কথা বলেছিলাম, তখন তাঁর তেড়েফুঁড়ে উঠে মানা করা বা হ্যারি যখন একদিন কোথা থেকে একটা চাবি জোগাড় করে এনে একটা মই লাগিয়ে দম-ফুরিয়ে-যাওয়া ঘড়িটায় দম দেওয়ার জন্যে নিজেই উঠে পড়েছিল, তখন তাঁর সেই হঠাৎ ভয়ংকর রেগে যাওয়া, কোনো কিছুই তাঁর সেই কৈফিয়তের সঙ্গে মেলে না।
সেটা ছিল আগস্টের এক রাত। তখন আমরা আমাদের কৈশোরকাল পেরিয়ে এসেছি। বারান্দায় হওয়া একটা শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমি আমার তুতো ভাইকে ধাক্কা মেরে জাগালাম। ফিশফিশ করে বললাম, “বাড়িতে কেউ ঢুকেছে।”
হামাগুড়ি দিয়ে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। নীচে চোখে পড়ল, একটা আবছা আলো যেন নড়ছে। নিশ্বাস বন্ধ করে আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। দোতলার ল্যান্ডিং-এ নেমে এসেছি, হ্যারি হঠাৎ আমার হাতটা চেপে ধরল। দেখি রেলিং-এর উপর দিয়ে নীচের কোনো কিছুর দিকে ইশারা করছে সে। তারপরেই আমাকে টেনে পাশের ছায়া-ঢাকা অন্ধকারে সরিয়ে নিয়ে এল সে।
একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখতে পেলাম আমরা।
গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমা দাঁড়িয়ে আছেন একটা চেয়ারের উপরে। প্রাচীন ঘড়িটার ঠিক সামনে। ধবধবে সাদা নাইটগাউন আর মাথায় ততোধিক সাদা নাইটক্যাপে তাকে ঠিক বরফে ঢাকা পপলার গাছগুলোর মতোই ভূতুড়ে লাগছিল। তবে আমাদের কপাল খারাপ। ঠিক এই সময় আমাদের পায়ের চাপে সিঁড়ির কাঠের পাটাতন ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে আওয়াজ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়ালেন গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমা। দেখতে পাচ্ছি, অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। একটা মোমবাতি উঁচু করে আমাদের দিকে বাড়িয়ে ধরে আছেন। সেই আলোয় আমাদের চারপাশের অন্ধকার কতটা হালকা হয়েছিল, তা আমরা জানি না, কিন্তু সেই আলোয় আমরা পরিষ্কার দেখতে পেলাম তাঁর ফ্যাকাশে মুখটা। যদিও খানিক আগে যখন তাকে শুভরাত্রি জানিয়েছিলাম, তার থেকে তখন অনেক অনেক বয়স্ক লাগছিল সেই মুখটা। বেশ কয়েক মিনিট সময় পেরিয়ে গেল। শুধু যে হাতে তিনি মোমবাতিটা ধরে রেখেছিলেন, সেই হাতটা ছাড়া তাঁর বাকি শরীরটা ততক্ষণ নিস্পন্দ নিথর হয়ে রইল। একমাত্র থিরথির করে কাঁপছিল তাঁর মোমবাতি-ধরা হাতটা। তারপর, অবশেষে যখন তিনি সেখানে অন্য কারও অনুপস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হলেন, তখন আলোটা একটা তাকের উপর নামিয়ে রেখে তিনি আবার ঘড়িটার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
তারপর দেখি, বুড়ি মাথার পিছন থেকে একটা চাবি বের করে ঘড়ির ওজনগুলোকে দম দিতে হাত বাড়িয়েছেন। তাঁর শ্বাস নেওয়া আর ছাড়ার আওয়াজটুকুও তখন আমরা অতদূর থেকেও শুনতে পাচ্ছি। ছোটো ছোটো অথচ দ্রুত গতির শ্বাস। চাবি ঘোরানোর কাজ শেষ হলে প্রথমে একটা হাত দিয়ে কাঠামোটাকে একপাশ থেকে আরেক পাশ পর্যন্ত জাপটে ধরলেন তিনি। তারপর নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে গেলেন ডায়ালের একদম কাছে। মনে হচ্ছিল, ঘড়িটাকে নিয়ে তিনি যেন কোনো কারণে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। আর সেটাই তখন যাচাই করে নিতে চাইছেন। ওইভাবেই তিনি রয়ে গেলেন অনেকক্ষণ। অবশেষে একসময় শুনতে পেলাম, তিনি একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন। স্পষ্টতই সেটা স্বস্তির নিশ্বাস। তারপরেই ঘাড় ঘুরিয়ে এক ঝলকের জন্যে তাকালেন আমরা যেদিকে আছি, সেইদিকে। তখন তাঁর চোখে-মুখে যে বন্য আনন্দের অভিব্যক্তি আমি দেখলাম, তা আমি কখনোই ভুলতে পারব না। তাঁর চেহারা আর হাবভাব সব তখন পালটে গেছে।
আর ঘড়ির কাঁটাও তখন চলতে শুরু করেছে; তবে তাদের সেই চলা ছিল উলটোভাবে। পিছনদিকে ঘুরছিল কাঁটাগুলো।
এরপরেই দু-হাত দিয়ে ঘড়িটাকে জড়িয়ে ধরলেন গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমা। তাঁর শুকিয়ে কুঁচকে-যাওয়া গালটা চেপে ধরে আছেন ঘড়ির বুকে। চুমু খাচ্ছেন বারবার করে। কতশতভাবেই যে আদর করতে লাগলেন ঘড়িটাকে, যে মনে হচ্ছিল যেন সেটা জীবন্ত কোনো প্রাণ। তাঁর ভালোবাসার পাত্র। আদর করেই চললেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িটার সঙ্গে কিছু যেন কথাও বলে যাচ্ছিলেন তিনি। তবে এমনভাবে বলছিলেন যে, আমরা সেই শব্দ শুনতে পেলেও অর্থ কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওদিকে ঘড়ির কাঁটা দুটো পিছনপানে তখনও ঘুরেই চলেছে।
তারপর হঠাৎই চিৎকার করে পিছিয়ে এলেন তিনি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন সামনে। আশ্চর্য ব্যাপার। ঘড়ির কাঁটা দুটো থেমে গেছে। আমাদের চোখের সামনে এক মুহূর্তের জন্যে তাঁর শিড়িঙ্গে লম্বা শরীরটা চেয়ারের উপরে দুলে উঠল। দু-হাত বাড়িয়ে ঘড়িটাকে জাপটে ধরে তিনি ভারসাম্য ধরে রাখতে চাইলেন। তাঁর চোখে-মুখে হতাশা আর আতঙ্কের ছাপ। সওয়া তিনটের সেই পুরোনো জায়গায় আবার দাঁড়িয়ে-পড়া মিনিটের কাঁটাটাকে আঁকড়ে প্রায় ধরেই ফেলেছিল তাঁর বাড়ানো একটা হাত। ঠিক সম্পূর্ণ হল না ধরাটা। তার আগেই দড়াম করে মেঝের উপর পড়ে গেলেন তিনি।
২
উইলে গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমা তাঁর ব্যাংক আর গ্যাসের শেয়ার, যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তি, রেলের বন্ড-সহ পৌরসভার শতকরা সাতের সুদে রাখা সমস্ত আমানত—এই সব কিছু আমাকে দিয়ে হ্যারির জন্যে শুধু রেখে গিয়েছিলেন তাঁর ঘড়িটা। ব্যাপার দেখে আমাদের সবারই তখন মনে হয়েছিল যে, এই ভাগবাঁটোয়ারা সত্যিই খুব অসম ধরনের হয়েছে। ব্যাপারটা আরও আশ্চর্যজনক যেহেতু সবাই আমার খুড়তুতো ভাইটিকেই তাঁর সব থেকে কাছের আর প্রিয় বলে জানত। সুতরাং, ফাজলামি করে শুরু করলেও, শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই আমরা প্রাচীন ঘড়িটার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা শুরু করলাম। বাইরের কাঠামোর কাঠের তৈরি প্রত্যেকটা অংশ ঠুকে ঠুকে খুঁজে দেখলাম, কোনো লুকোনো দেরাজ বা কুলুঙ্গি ভেতরে কোথাও আছে কি না। ঘড়িটার যন্ত্রপাতি তেমন জটিল কিছু না-হওয়া সত্ত্বেও, আমরা একটা সেলাইয়ের ছুঁচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেগুলোর সব কিছু পরখ করে দেখে নিলাম। এমন নয় তো যে আমাদের খামখেয়ালি বাতিকগ্রস্ত আত্মীয়াটি সেখানে কোনোভাবে কোথাও কোনো সাংকেতিক গোপন সূত্র অথবা কোনো গোপন দলিল লুকিয়ে রেখে গেছেন, যা বেরিয়ে এলে হয়তো তাঁর অসম বাঁটোয়ারার মোড় সম্পূর্ণ অন্যদিকে ঘুরে যাবে। কিন্তু তেমন কোনো কিছুই আমরা আবিষ্কার করতে পারলাম না।
লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা উইলের শর্তেই রাখা ছিল। সুতরাং আমরা তখন যে সৈনিক বিদ্যালয়ে পড়তাম, যেখানে কিনা যুদ্ধের তত্ত্ব সম্পর্কে যৎসামান্য আর কোমর বেঁকিয়ে গোড়ালিতে নাক ঠেকিয়ে হস্তপদাসনে দাঁড়িয়ে থাকাই বেশি শিখছিলাম, তা ছেড়ে আর বিলম্ব না করে আমরা অতিসত্বর গিয়ে জাহাজে উঠে পড়লাম। ঘড়িটাও চলল আমাদের সঙ্গে। ব্যাস, তারপর লাগল মাত্র কয়েকটা মাস! খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই সেটা গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল ব্রিড স্ট্রাটের একটা ঘরের নিরিবিলি এককোণে।
জ্যান লিপারডামের উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর অভূতপূর্ব কারিগরি দক্ষতায় সৃষ্ট সেই অভিনব শিল্পকর্মটি ঘুরেফিরে এতদিনে আবার তাঁর জন্মভূমিতে ফিরে এল ঠিকই, সেখানকার হাওয়ায় শ্বাসপ্রশ্বাস নিতেও শুরু করল, কিন্তু পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারল না। আগের মতোই শিকড় গজিয়ে বসে রইল সেই সওয়া তিনটের দাগে। এদিকে ঘড়িটার সৃষ্টিকর্তাও ঘাঁটি গেড়েছেন মাটির নীচে। বিগত প্রায় তিনশো বছর ধরেই তিনি শুয়ে আছেন তাঁর কবরে। লেইডেন শহরের ঘড়িশিল্পে তাঁর উত্তরসূরিদের সম্মিলিত দক্ষতাও ঘড়ির কাঁটাগুলোকে আগুপিছুর কোনো একটাও করাতে সক্ষম হল না।
শহরের বাসিন্দা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর অন্তত শ-আটেকের মতো অচেনা সহপাঠী, যাদের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন মোলাকাত হয়েই থাকত, তাদের বোঝানোর মতো কাজ-চালানো ওলন্দাজ ভাষাশিক্ষা আমরা খুব তাড়াতাড়িই সেরে ফেললাম। প্রথম সাক্ষাতে ভাষাটাকে যতটা কঠিন বলে মনে হয়, আসলে তেমন কঠিন কিছু সেটা নয়। ইংরেজিরই রকমফের, তবে একটু অন্য ধরনের, সহোদর ভাষারা যেমন হয় আর কী। শুরুতে কিছুটা ধাঁধার মতো লাগতে পারে, তবে ঠিক করে ভাবলে একটু পরেই সঠিক অর্থ আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। ঠিক যেন ইংরেজিতে লেখা একটা সাংকেতিক লিপি, যেখানে বাক্যের সব ক-টা শব্দ প্রথমে একটানা পাশাপাশি রেখে তারপর সেগুলোকে উলটে-পালটে বিভিন্ন জায়গায় ভুলভাবে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যা-ই হোক, একসময় ভাষায় যেমন দখল এল, তেমনি ততদিনে চারপাশের নতুনত্বও আমাদের কাছে কমে এল, ফলে তখন আমরা সুস্থির হয়ে আমাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম আর আবশ্যিক সাধনায় মনোনিবেশ করতে পারলাম। হ্যারি দৃঢ়চিত্তে নিজেকে উৎসর্গ করল সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়নে, তবে তাঁর অধ্যয়নের সবিশেষ মনোযোগের কেন্দ্র ছিল লেইডেন শহরের সমাজব্যবস্থা, আরও সঠিক অর্থে সেখানকার গোলগাল চেহারার একটু বেশি গায়ে-পড়া যুবতিরা। তবে আমি ব্যস্ত ছিলাম আমার উচ্চতর অধিবিদ্যার পড়াশোনা নিয়েই।
আমাদের নিজেদের যার যাতে আগ্রহ, তার বাইরেও একটা এমন বিষয় ছিল, যাতে আমাদের দুজনেরই আগ্রহ ছিল সমান এবং অফুরান। আসলে আমরা দুজনেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, যখন হিসেব করে দেখলাম যে আমাদের আশপাশের মানুষজন, তা তারা অধ্যাপকই হোক কিংবা শিক্ষার্থী, তাদের প্রতি কুড়িজনের মধ্যে এমন একজনকেও পাওয়া যাচ্ছে না, যারা কিনা এই শহরের গৌরবময় ইতিহাস, শহরের কথা থাক, শহর তো বড়ো ব্যাপার, এমনকি কোনো পরিস্থিতিতে স্বয়ং প্রিন্স অব অরেঞ্জ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে সম্পর্কেও না তারা কিছু জানে বা না তাদের জানার বিন্দুমাত্র কোনো আগ্রহ আছে। এই সর্বগামী উদাসীনতার ঠিক উলটোদিকে ছিলেন আমার অত্যুৎসাহী প্রফেসার ভ্যান স্টোপ, সৌভাগ্যবশত যাঁকে আমি পেয়েছিলাম অনুমানমূলক দর্শনের তমসাবৃত জগতে আমার পথনির্দেশক হিসেবে।
এই বিশিষ্ট হেগেলিয়ান দার্শনিক শুকনো তামাকপাতার মতো চিমসে চেহারার একজন ছোটোখাটো বৃদ্ধ মানুষ। মাথায় সব সময় একটা খুলি-ঢাকা টুপি পরে থাকেন। চেহারার গড়ন থেকে শুরু করে পোশাক আর সর্বোপরি মাথার টুপিটাও ছিল এমন যে যখনই তাঁকে দেখতাম, আমার অদ্ভুতভাবে গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার কথা মনে পড়ে যেত। চেহারা আর চলনে-বলনে মারাত্মক মিল দুজনের। এতটাই যে তিনি যদি তাঁর নিজের ভাইও হতেন, তাহলেও হয়তো তাঁদের মুখের এতটা মিল থাকত না। আমি তাঁকে একবার সেটা বলেওছিলাম। স্ট্যাডথুইসে তখন আমরা একসঙ্গে নগর অবরোধের নায়ক, বুর্গমাস্টার5 ভ্যান ডার ওয়ার্ফের প্রতিকৃতি দিকে তাকিয়ে আছি। প্রফেসার হেসে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, “তা-ই? দাঁড়াও, আমি তোমাকে এর চাইতেও আশ্চর্যজনক কাকতালীয় কী হতে পারে, সেটা দেখাই।” এই বলে তিনি আমাকে নিয়ে হল পেরিয়ে উলটোদিকের দেয়ালে ওয়ানারদের নগর অবরোধের আশ্চর্য সুন্দর ছবিটার সামনে গিয়ে নগর-প্রতিরক্ষায় ব্যস্ত একজন অভিজাত নাগরিকের ছবির দিকে ইশারা করেছিলেন। আশ্চর্য হলেও সত্যিই তা-ই। দেখে মনে হচ্ছিল ভ্যান স্টোপ যেন ছবির সেই অভিজাত নাগরিকেরই ছেলে; আর সেই অভিজাত নাগরিকই সম্ভবত গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার বাবা।
কেন যেন প্রফেসারের হাবভাব দেখে মনে হত, তিনি বোধহয় আমাদের একটু বেশিই ভালোবাসেন। আমরাও প্রায়শই পৌঁছে যেতাম তাঁর ঘরে। র্যাপেনবুর্গ স্ট্রাটের একটা প্রাচীন বাড়ি। সেই ১৫৭৪ সালেরও আগে তৈরি-হওয়া বাড়িগুলোর মধ্যে এখনও টিকে-থাকা একটা বাড়ি। মাঝেমধ্যেই আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। শহরের ভেতরে ঘুরে বেড়াতাম আমরা। হেঁটে বেড়াতাম সাজানো-গোছানো শহরতলির মধ্যে দিয়ে সরলরেখার মতো চলে-যাওয়া সারি সারি পপলার গাছে ঘেরা রাস্তায়। মনে মনে ফিরে যেতাম আমাদের সেই কিশোরবেলার শিপস্কট নদীর তীরে। শহরের ঠিক মাঝখানে ধসে-পড়া রোমান বুরুজটার মাথার উপরে একদিন নিয়ে গেলেন তিনি। তিনটে শতাব্দী পার করে উদ্বিগ্ন চোখে আমরা তাকিয়ে রইলাম দূরের সেই রণক্ষেত্রের দিকে। আমাদের নজর ছিল জলের তোড়ে ভেসে-যাওয়া খাঁড়িপথে। তাকিয়ে দেখছিলাম, কীভাবে ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে অ্যাডমিরাল বোয়াসোর বহর। প্রফেসার আমাদের ল্যান্ডশেইডিং-এর বিশাল সেই বাঁধটা দেখালেন, যেটা কাটা হয়েছিল মহাসাগরের জলে ভেসে পরিখা পেরিয়ে, যাতে বোয়াসোর জিল্যান্ডিয়ারা স্পেনীয় বাহিনীর অবরোধ ভেঙে অবরুদ্ধ নগরীর ক্ষুধার্তদের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারে। তিনি লেডারডর্পে অবস্থিত স্পেনীয় ভালদেজের সদর দফতরটাও আমাদের দেখালেন আর বললেন সেই পয়লা অক্টোবরের রাতের ঘটনা। ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো উত্তর-পশ্চিমদিক থেকে আসা সেই ভয়ানক ঝড়-তুফানের গল্প। জোয়েটারওউড আর জুইটেনের মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় জলের গভীরতা ছিল কম, সেই ভয়ানক ঝড়-তুফানের বলে বলীয়ান জাহাজ-বহর সেই রাতের মধ্যেই পার করে ফ্যালে সব বাধা। পৌঁছে যায় ক্ষুধার্ত অধিবাসীদের সাহায্যের পথে শেষ বাধা ল্যামেন দুর্গ-প্রাচীরের সামনে অপেক্ষারত অবরোধকারীদের কাছে। তারপর তিনি আমাদের দেখালেন লেইডেন দুর্গের বাইরের প্রাচীরের সেই বিশাল ফাটলটা। জায়গাটা বর্তমান গৌ-ফটকের কাছেই। অবরোধকারী সেনাবাহিনী যেদিন পশ্চাদপসরণ করে, তার আগের রাতেই সেখানকার দুর্গ-প্রাচীর উড়িয়ে দেয় ল্যামেনের ওয়ালুনরা।
“এই তো!” হ্যারি চিৎকার করে ওঠে। অধ্যাপকের বর্ণনা আর বাগ্মিতায় উত্তেজিত হয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠেছে সে, “তাহলে এটাই সেই অহং মুহূর্ত! এখান থেকেই তবে অবরোধের শেষের শুরু।”
প্রফেসার কোনো উত্তর দিলেন না। একদৃষ্টে আমার খুড়তুতো ভাইটির চোখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করে রাখা।
“কেন-না,” হ্যারি বলে চলল, “যদি ওই বিশেষ জায়গাটা খুঁজে বের না-করা হত, অথবা খুঁজে পেলেও যে বা যারা প্রাচীরটা উড়িয়ে দিয়েছিল, সে বা তারা সেখানে সঠিক সময়ে পৌঁছোতে না পারত, কিংবা পৌঁছোতে পারলেও ল্যামেনের নৈশরক্ষীবাহিনীর আক্রমণে পর্যুদস্ত হত, তাহলেই তো সব ব্যর্থ হয়ে যেত। তখন হয়তো অবরোধকারীরা অবরুদ্ধ নগরটাই জ্বালিয়ে দিত, পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হত সব কিছু। অ্যাডমিরাল বোয়াসো আর ত্রাণ-বহরের চোখের সামনে লেইডেনের নাগরিকদের গণহত্যা করা হত। প্রাচীর-উড়িয়ে-দেওয়া সেই দলটার নেতৃত্ব কে দিয়েছিল?”
ধীরেসুস্থে প্রত্যেকটা শব্দ মেপে মেপে হ্যারির প্রশ্নের উত্তর দিলেন ভ্যান স্টোপ, “ইতিহাস লিখে রেখেছে, অবরোধ ভাঙার ঠিক আগের রাতে বোমা বিস্ফোরণে নগর-প্রাচীর ধ্বংস করা হয়েছিল: কিন্তু এটা লিখে রাখেনি, কে সেটা ঘটিয়েছিল বা তার জন্যে কতটা লড়াই তাকে লড়তে হয়েছিল। তবে এটা ঠিক যে ভাগ্য সেই অজানা নায়কের কাঁধে সেদিন যে বিশাল দায়িত্বভার চাপিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি ভার আর কোনো মানুষকে কখনও বইতে হয়নি। আজ আর কেউ জানে না, যে সেই অজানা নায়ক কি জেনেশুনে সেই বিপজ্জনক লড়াইয়ের দায়িত্বভার তার কাঁধে তুলে নিয়েছিল নাকি হঠাৎই কোনো ঘটনাচক্রে অপ্রত্যাশিতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল সে? একবার শুধু ভেবে দ্যাখো, তিনি যদি ব্যর্থ হতেন, তাহলে তার পরিণতি কী কী হতে পারত। সেদিন লেইডেনের পতন হলে প্রিন্স অব অরেঞ্জ আর মুক্ত রাজ্যগুলোর শেষ আশাও ধ্বংস হয়ে যেত। আবার শুরু হত স্বৈরাচারী ফিলিপের অত্যাচার। সুতরাং, ধর্মীয় স্বাধীনতা আর জনগণের স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন, সব হারিয়ে যেত বহু বছরের জন্যে। বছর কেন, কেউ জানে না, হয়তো শতকের পর শতক পেরিয়ে যেত সেই স্বপ্ন পূরণ হতে, তা-ই না? কে জানে, সেদিন যদি ইউনাইটেড নেদারল্যান্ডসের জন্ম না হত, তাহলে আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটা প্রজাতন্ত্রের সৃষ্টি হতে পারত কি না? এই যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, যা বিশ্বকে গ্রোটিয়াস, স্ক্যালিগার, আর্মিনিয়াস আর দেকার্তের মতো মানুষ উপহার দিয়েছে, সে তো সেই ভাগ্যহত নায়কের সেদিনের লড়াইয়ের সাফল্যের জন্যেই প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। এমনকি এই যে আজ এখানে আমাদের উপস্থিতি, তার জন্যেও আমরা তাঁর কাছেই ঋণী। উঁহুঁ, তা-ই-বা কেন, তোমার সম্পূর্ণ অস্তিত্বের জন্যেই তুমি তাঁর কাছে ঋণী। তোমার পূর্বপুরুষরা সবাই লেইডেনের; তাদের জীবন আর নগরের প্রাচীরের বাইরে উপস্থিত কসাইদের মাঝখানে সেদিন রাতে সে-ই রুখে দাঁড়িয়েছিল বলেই আজ তুমি আছ।”
ছোটোখাটো চেহারার প্রফেসারকে তখন প্রবল উদ্দীপনা আর স্বদেশভক্তির তীব্রতায় আমাদের সামনে এক বিশালদেহী দৈত্যের মতো মনে হচ্ছিল। সেই আবেগ স্পর্শ করল হ্যারিকেও। তাঁর চোখ দুটো ভেজা-ভেজা লাগছে। গালে ফুটে উঠেছে রক্তিম আভা।
“এবার তোমরা ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে যাও,” ভ্যান স্টোপ বলে উঠলেন, “আর ফিরে গিয়ে ঈশ্বরকে এই বলে ধন্যবাদ দাও যে, লেইডেনের নাগরিকেরা যখন জোয়েটারউড আর নৌবহরের ভরসায় হাপিত্যেশ করছিল, ঠিক তখন গৌ-ফটকের কাছেই নগর-প্রাচীরের কোনো এক জায়গায় নির্ভীক একজোড়া সতর্ক চোখ বুকভরা সাহস নিয়ে অন্য কিছু ভাবছিল।”
৩
সেটা ছিল এক শরৎকালের সন্ধ্যা। লেইডেনে আমাদের তৃতীয় বছর চলছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে, মুহুর্মুহু জলের ঝাপটে জানলার কাচ ভেসে যাচ্ছে। এমন সময় প্রফেসার ভ্যান স্টোপ এসে পৌঁছোলেন আমাদের ব্রিড স্ট্রাটের আস্তানায়। আমরা আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। প্রফেসার এসেছেন, এ তো আমাদের জন্যে এক বিশাল সম্মানের ব্যপার। তবে এটাও ঘটনা, বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে এমন মেজাজে আগে কখনও দেখিনি। অনবরত বকবক করেই চললেন তিনি। সে-ও বিভিন্ন বিষয়ে। শহরের গালগল্প, ইউরোপের খবরাখবর, বিজ্ঞান, কাব্য, দর্শন। পালা করে একটার পর একটা বিষয় ছুঁয়ে গেলেন তিনি। রসিকতাও করলেন প্রচুর, তবে যথারীতি উচ্চস্তরের সৌজন্য এবং ভদ্রতা বজায় রেখেই করলেন। এদিকে ফাঁক পেলেই তাঁকে হেগেলের দিকে টেনে আনার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে যে অধ্যায়টা নিয়ে আমি তখন হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, সেটার একটা ব্যবস্থা করা যায়।
ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলেন তিনি। একসময় হেসে ফেললেন, “তুমি বুঝতে পারছ না তো যে, কীভাবে স্ব-সচেতনতা অপর-সচেতন সত্তার মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতা ও অপরতা পেরিয়ে সুসংহত স্ব-সচেতনতা অর্জন করতে পারে?” হাসতে হাসতেই উত্তর দিলেন তিনি, “ঠিক আছে, চেষ্টা করো, তুমিও পারবে, একটু সময় লাগবে হয়তো।”
হ্যারি অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে আছে। কোনো গভীর চিন্তায় নিমগ্ন বলে মনে হচ্ছিল তাকে। তাঁর মৌনী ভাব ধীরে ধীরে এমনকি একসময় অধ্যাপককেও প্রভাবিত করে ফেলল। একটা সময় এল, যখন কথোপকথন বন্ধ হয়ে গেল। কারও মুখেই আর তখন কোনো কথা নেই। আমরা তিনজনেই অনেকক্ষণ চুপটি করে বসে রইলাম। মাঝেমধ্যেই বিদ্যুতের ঝলকানি, আর তার পরে পরেই দূর কোথাও থেকে বজ্রপাতের শব্দ ভেসে আসছিল।
“তোমাদের ঘড়িটা বোধহয় চলে না।” হঠাৎ মন্তব্য করলেন প্রফেসার, “আগে কখনও চলেছে?”
“কখনোই না, অন্তত যবে থেকে আমরা দেখছি।” আমিই উত্তর দিলাম, “ইয়ে, না মানে, মাত্র একবারই চলতে দেখেছি, তবে সে-ও উলটো, পিছনদিকে চলছিল। সেই যেবার গার্ট্রুডমাসি—”
থেমে গেলাম। চোখের ইশারায় হ্যারি আমাকে সাবধান হতে বলছিল। কথা ঘোরাতে আমি হেসে উঠে তোতলাতে তোতলাতে বললাম, “ঘড়িটা অনেক পুরোনো। আর এতটাই অকেজো যে এটাকে সারিয়েসুরিয়েও আর চালানো যাবে না।”
“পিছনদিকে চলেছিল ঘড়িটা?” প্রফেসার শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন। আমার বিব্রত হওয়াটা উনি লক্ষ করেছেন বলে মনে হল না। “তবে তাতে হয়েছেটা কী, ঘড়ির কাঁটা পিছনের দিকে কেন চলতে পারবে না? কাঁটার কথা ছাড়ো, সময় নিজেও তো ঘুরে দাঁড়াতে পারে, ঘুরে দাঁড়িয়ে পিছনদিকেও তো চলতে শুরু করতে পারে, তা-ই না? কেনই-বা পারবে না?”
মনে হচ্ছিল, আমার তরফে একটা উত্তরের অপেক্ষা করছেন তিনি। কিন্তু দেওয়ার মতো কোনো উত্তর আমার কাছে ছিল না।
“আমি ভেবেছিলাম একজন হেগেলীয় দর্শনের ছাত্র হিসেবে তুমি…” আমার উত্তরের আদৌ অপেক্ষা না করে তিনি বলে চলেন, “এটা নিশ্চয়ই মানবে যে, প্রতিটি শর্তের নিজস্ব দ্বন্দ্ব রয়েছে। সময় একটা শর্তমাত্র, সে অপরিহার্য কিছু নয়। পরম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, যে পর্যায়ক্রমে ভবিষ্যৎ বর্তমানকে অনুসরণ করে আর বর্তমান করে অতীতকে, তা একেবারেই অযৌক্তিক। আমরা বলি গতকাল, আজ, আগামীকাল; কিন্তু প্রাকৃতিক জগতে এরকম কোনো মৌলিক নিয়ম নেই যে সেটা আগামীকাল, আজ, গতকাল—এই ক্রমে হতে পারবে না।”
একটা তীব্র বজ্রপাতের শব্দে প্রফেসারের জল্পনাকল্পনা মাঝপথে বাধা পেল।
“নিজের অক্ষের উপর পশ্চিম থেকে পূর্বে গ্রহটা এক পাক ঘোরা শেষ করলেই একটা দিন পেরিয়ে যায়। আমার মনে হয়, এমন কিছু পরিস্থিতির কথা তুমি কল্পনা করতেই পারো, যার ফলে এই ঘোরাটা হয়তো পূর্ব থেকে পশ্চিমে হয়ে গেল, অমনি তো সব উলটে যাবে, প্যাঁচ যাবে খুলে, আর ফিরে আসবে অতীতের পেরিয়ে-যাওয়া দিনগুলো। এটা ভাবাটা কি খুব কঠিন? পাক খুলে সময়ের এই পিছিয়ে যাওয়াটা? জোয়ারে গা না ভাসিয়ে, সময় যদি হয় ভাটার পথযাত্রী; ভবিষ্যৎ সরে যায় দূরে, উন্মোচিত হয় অতীত; শতাব্দীর পর শতাব্দী মিছিল করে যদি চলতে থাকে বিপরীত মুখে; যদি আজকের মতো অন্তের পথে না এগিয়ে ঘটনাপ্রবাহ ধাবমান হয় তার আদিম উৎসের দিকে?”
“কিন্তু,” আমি বাধা দিয়ে বলেই ফেললাম, “আমরা যতদূর জানি, মানে আমাদের জ্ঞান যতটুকু আছে, তাতে এটা—”
“আমাদের জ্ঞান!” তুমুল তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমার বলা কথাটার পুনরাবৃত্তি করলেন ভ্যান স্টোপ, “ডানা মেলতে না জানলে জ্ঞান থেকেও কোনো লাভ নেই। পাখি যদি ডানা না ম্যালে, আকাশও তার অজানাই থেকে যায়। মনে হচ্ছে, তুমি আজকাল কোঁতে6 আর তাঁর লতিয়ে লতিয়ে বুকে ভর-দিয়ে-চলা পা-চাটা নোংরা চামচাদের পিছন পিছন চলতে শুরু করেছ। তুমি হয়তো তোমার অতুলনীয় নিশ্চয়তার সঙ্গে বলবে যে এই মহাবিশ্বে তোমার স্থান কোথায়, সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিত। তুমি হয়তো মনে করো যে, তোমার মতো একজন দীনহীন সামান্য ব্যক্তির অবশ্যই পরম সত্যে দৃঢ় আসন পাতা রয়েছে। তারপরেও তুমি আজ রাতে বিছানায় শুতে যাবে, আর তারপর হয়তো স্বপ্ন দেখবে এমন কোনো পুরুষের, কিংবা কোনো মহিলার বা কোনো বাচ্চার, হয়তো-বা কোনো পশু বা পাখির, যাদের কেউ অতীতের আর কেউ ভবিষ্যতের। কিন্তু এই মুহূর্তে, তুমি নিজেই যে তোমার এই ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তাধারার সমস্ত দম্ভ নিয়ে, আসলে ষোড়শ শতাব্দীর কোনো দার্শনিকের স্বপ্নে দেখা ভবিষ্যতের কোনো একটা প্রাণী ছাড়া আর কিছুই নও, সে বিষয়ে তুমি কী করে নিশ্চিত হচ্ছ? কিংবা তুমি কীভাবেই-বা জানবে যে, তুমি আসলে অতীতের কারও স্বপ্নে দেখা একটা প্রাণী ছাড়া আর অন্য কিছুই নও, এমন একজন কেউ, যাকে ছাব্বিশ শতকের কোনো একজন হেগেলীয় দর্শনের ছাত্র তাঁর স্বপ্নে দেখছে? ওহে খোকা, এবার তুমি বলো, সেই স্বপ্নদ্রষ্টা জেগে উঠলে তুমি যে সেই ষোড়শ শতাব্দী কিংবা ২০৬০ সালেই বিলীন হয়ে যাবে না, সেটা তুমি কী করে জানবে?”
এর কোনো উত্তর হয় না। হয় না, কারণ এই যুক্তি বিশুদ্ধ অধিবিদ্যার যুক্তি। হ্যারি হাই তুলছিল। আমি উঠে জানালার কাছে চলে গেলাম। প্রফেসার ভ্যান স্টোপ এগিয়ে গেলেন প্রাচীন ঘড়িটার দিকে।
“আহা, শুনে রাখো খোকারা,” তখনও অবশ্য তিনি তাঁর কথা বলেই চলেছেন, “মানুষের ইতিহাসের কোনো নির্দিষ্ট অগ্রগতি নেই। অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ, সব এক অমোঘ জালে একসূত্রে গাঁথা। কে বলতে পারে, এই উলটোদিকে চলাটাই হয়তো এই প্রাচীন ঘড়ির সঠিক চলন?”
ঠিক সেই মুহূর্তে এক ভয়ংকর বজ্রপাতের আওয়াজে কেঁপে উঠল গোটা ঘরটাই। আমাদের মাথার উপরে তখন প্রবল ঝড়ের তাণ্ডব।
চোখধাঁধানো আলোর তেজ যখন কমে গেল, দেখা গেল, প্রফেসার ভ্যান স্টোপ আখাম্বা বিশাল ঘড়িটার সামনে একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে আগের চেয়ে তখন আরও বেশি গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার মতো দেখতে লাগছে।
ঠিক সেইভাবেই তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, যেভাবে গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমা তাঁর সেই শেষ পনেরো মিনিটের অন্তিম ক্ষণে দাঁড়িয়ে ছিলেন—আর আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম, কীভাবে অমোঘ নিয়তির ডাকে তিনি ঘড়ির চাবি ঘুরিয়ে যাচ্ছেন।
সেই মূহূর্তে হ্যারি আর আমার মনে একটাই চিন্তা একই সঙ্গে উদয় হল।
“দাঁড়ান!” আমরা প্রায় একই সঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম। ততক্ষণে অবশ্য তিনি চাবি ঘোরাতে শুরু করে দিয়েছেন। “এতে কিন্তু আপনার মৃত্যুও হতে পারে, যদি আপনি—”
অধ্যাপকের ফ্যাকাশে চেহারাটা তখন কোনো অজানা উৎসাহে জ্বলজ্বল করছিল। তাঁর চেহারাটা আরও যেন বদলে গিয়েছে। এখন তাঁকে আগের চাইতে আরও একটু বেশি গার্ট্রুডমাসি-ঠাকুমার মতো দেখতে লাগছে।
“জানি,” তিনি বলে উঠলেন, “এতে মৃত্যু যেমন হতে পারে; তেমনি হতে পারে বোধনও। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সবই যে একসূত্রে গাঁথা! মাকুর মতো একবার এদিক তো একবার ওদিক, কখনও সামনে তো কখনও পিছনে—”
ঘড়ির চাবি দেওয়া শেষ করে ফেললেন তিনি। এখন অকল্পনীয় দ্রুততায় ঘড়ির কাঁটা দুটো ডায়ালের উপর দিয়ে ঘুরে চলেছে। ঘুরছে সেই ডানদিক থেকে বাঁদিকে। অসম্ভব তীব্র গতিতে ঘুরে যাচ্ছে কাঁটা দুটো। নিজেরাও আমরা যেন জড়িয়ে গিয়েছি সেই তীব্র ঘূর্ণিপাকে। অনন্তকাল যেন গুটিয়ে এল ক্ষণিকের অন্তরে, আর ঘড়ির প্রতিটি টিকটিক শব্দের সঙ্গে ঝরে পড়ছিল এক-একটা জীবন, যেমন সময় নিজেই জন্মায় আর ক্ষয়ে যায় প্রতি নিশ্বাসে। ভ্যান স্টোপ তাঁর দুটো হাত দু-দিকে প্রসারিত করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। আবার একটা বজ্রপাত হল। এবার মনে হয়, বাড়িটার মধ্যেই হল। প্রচণ্ড শব্দে বাড়িটা আবার কেঁপে উঠল থরথর করে। ঠিক সেই মুহূর্তে গন্ধকের ধোঁয়া ছড়িয়ে ঝলমলে আলোয় ঘরটা ভাসিয়ে দিয়ে একটা আগুনের গোলা সোজা আমাদের মাথার উপর দিয়ে চলে গিয়ে আঘাত করল ঘড়িটাকে। উপুড় হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে স্থির হয়ে গেলেন ভ্যান স্টোপ। একই সঙ্গে ঘোরা বন্ধ হল ঘড়ির কাঁটাগুলোর। সেগুলোও তখন স্থির হয়ে গেছে।
৪
মুহুর্মুহু বজ্রপাতের গর্জন কানে আসছিল। শুনে মনে হচ্ছে যেন ভারী কামানের গোলা ফাটার আওয়াজ। বিদ্যুতের দীপ্তি যেন নিস্তরঙ্গ অগ্নিকাণ্ডের আলোর মতো ভাসছিল। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে, হ্যারি আর আমি রাত্রির আঁধারের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম।
আগুনের আভায় লাল-হয়ে-ওঠা আকাশের নীচে বহু মানুষ আমাদের মতোই ছুটে যাচ্ছে স্ট্যাডথুইসের দিকে। রোমান বুরুজটার ওদিকে কোথাও দাউদাউ-করে-জ্বলা আগুনের শিখা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে, আগুন লেগেছে শহরের কেন্দ্রস্থলেই কোথাও। যে মানুষগুলোকে আমরা তখন দেখতে পাচ্ছি, তাদের সবারই চেহারা জীর্ণশীর্ণ। আর প্রত্যেকেরই চোখ-মুখের অবস্থা কাহিল। চারদিক থেকে ভেসে আসছিল অভিযোগ আর হতাশা-মেশানো অসংলগ্ন টুকরোটাকরা কথাবার্তা। চারদিকে ভাসছে বেদনার সুর। কোথাও চাপা দীর্ঘশ্বাস, কোথাও আবার নিভৃত আর্তনাদের টুকরো টুকরো ধ্বনি—দুঃখ ও হতাশার এক অনন্ত কান্নার মিছিল যেন সেখানকার বাতাসে মিশে ছিল। “এক পাউন্ড ঘোড়ার মাংস পর্যন্ত দশ শিলিং হয়ে গিয়েছে।” অন্য একজন বলছিল, “আরে, রুটি তো ষোলো শিলিং হয়ে গেছে।” “রুটির কথা আর বোলো না!”—এক বৃদ্ধা তীব্র সুরে জবাব দিল, “আট সপ্তাহ কেটে গেল, একটা টুকরো পর্যন্ত চোখে পড়েনি।” “আমার নাতিটা, বেচারা পঙ্গু নাতিটা আমার, সে তো গত রাতেই আমাদের ছেড়ে চলে গেল…।” “তুমি জানো, ধোপানি গেক্কে বেত্যে কী করেছে? বেশ ক-দিন ধরেই না খেয়ে ছিল ওরা। বাচ্চাটা তো একদিন আগেই মরে গেল, আর গেক্কে আর তাঁর বর—”
এমন সময় হঠাৎ এক প্রচণ্ড কামানের গর্জন। গেক্কে আর তাঁর বরের কী হয়েছে, সেটা খোলসা হওয়ার আগেই মাঝপথে সব থামিয়ে দিল সেই গর্জন। না থেমে আমরা এগিয়ে চললাম শহরের মধ্যে অবস্থিত দুর্গপ্রাসাদের অভিমুখে। পথে যেতে যেতে এখানে-সেখানে দেখা মিলল ছিটেফোঁটা কয়েকজন নগররক্ষী সৈনিকের, আর অসংখ্য বিষণ্ণ-মুখ নাগরিকের—ধূসর রঙের চওড়া কানাতের টুপির ছায়ায় যাদের মুখগুলো আরও ক্লিষ্ট, আরও অবসন্ন হয়ে উঠেছিল।
“প্রাচীরের ওপারে যেখানে বোমা মজুত, বারুদ মজুত, সেখানে কিন্তু প্রাচুর্য আছে রুটিরও—সঙ্গে থাকবে পূর্ণ আর নিঃশর্ত ক্ষমাও। আজ সকালেই আমাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে অনুরোধ করে প্রাচীর ডিঙিয়ে ভালদেজ ছুড়ে দিয়েছে একখানা ক্ষমাপত্র।”
সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত জনতার ঢেউ উত্তেজিত হয়ে ভিড় করে বক্তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরল। “কিন্তু নৌবহর!” শঙ্কা আর আশার ব্যাকুলতামিশ্রিত আর্তস্বরে জনতা হাহাকার করে উঠল, “কোথায় আমাদের নৌবহর? কতদূরে?”
“নৌবহর এখনও পর্যন্ত নিস্তব্ধ নিথর, শিকল দিয়ে বাঁধার মতো করে তাকে বেঁধে রেখেছে গ্রিনওয়ে খাড়ির কাদামাটি। বোয়াসো যতই তাঁর সবেধন নীলমণি চোখ তুলে সমুদ্রের দিকে বাতাস খুঁজে মরুক, ততদিনে অনাহার আর মহামারি এ নগরীর প্রতিটি মায়ের বুক খালি করে দেবে, তবুও তাঁর নৌকো ‘আর্ক’ এক রজ্জু-দৈর্ঘ্যও এগোতে পারবে না। সুতরাং আমাদের জন্য থাকবে শুধু নিশ্চিত মৃত্যু—আমরা কেউ প্লেগে মরব, কেউ মরব অনাহারে, বাকিরা মরব আগুনের হলকায় কিংবা বন্দুকের গুলি-বৃষ্টিতে। সেটাই হবে বুর্গমাস্টারের তরফে আমাদের উপহার—যাতে তার কণ্ঠে শোভা পায় গৌরবের মুকুট, আর অরেঞ্জের জন্যে থাকে নতুন একটা রাজ্য।”
“বুর্গমাস্টার আমাদের কাছে তো শুধু সামান্য একটু ধৈর্য চাইছেন,” এক বলিষ্ঠ নাগরিক দৃপ্তস্বরে বলে উঠল, “আর যেন মাত্র চব্বিশটা ঘণ্টা আমরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি, আর তার সঙ্গে যেন সবাই করি প্রার্থনা—যাতে সমুদ্রবায়ু জেগে ওঠে, আর পালের হাওয়ায় ভর করে মুক্তি ভেসে আসে আমাদের দিকে।”
“আহ্, হ্যাঁ! সে তো বটেই!” প্রথম বক্তা তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ে দেয়, “যাও, যত ইচ্ছে প্রার্থনা চালিয়ে যাও। পিটার অ্যাড্রিয়ানসন ভ্যান ডার ওয়ার্ফের ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডারে পড়ে আছে রুটির স্তূপ—অঢেল, অশেষ। আমি নিশ্চিত, সেই সঞ্চয় আছে বলেই তাঁর অন্তরে এমন অদম্য শক্তি জেগে উঠেছে, যে তিনি এত বড়ো একজন ক্যাথলিক রাজার বিপুল ক্ষমতার বিরুদ্ধেও এক অটল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছেন।”
এই সময় ভিড় ভেদ করে এগিয়ে এল এক কিশোরী। সোনালি চুলের বেণি দুলছে তাঁর ঘাড়ের পিছনে। সোজা এসে সে দাঁড়াল সেই বিক্ষুব্ধ মানুষটার মুখের সামনে। “হে আমার দেশবাসী, আমি জানি আপনারা সবাই সৎ এবং সরল মানুষ।” ভিড় করে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে সরাসরি সেই কিশোরী দৃপ্তকণ্ঠে বলতে শুরু করল, “এঁর কথা আপনারা কেউ শুনবেন না। ইনি একজন বিশ্বাসঘাতক, মনেপ্রাণে স্পেনের সমর্থক। আমি পিটারের মেয়ে। আমি বলছি আমাদের ঘরে একটাও রুটি নেই। আমরাও তোমাদের মতোই সরষেবাটা দিয়ে যবের আটা যতদিন ছিল, তা-ই খেয়ে পেট ভরিয়েছি। তারপর থেকে বাগানের লেবু আর উইলো গাছের সবুজ পাতাই ভরসা। এখন তো ছিঁড়ে এনে তা-ই খাচ্ছি আমরা। এমনকি খালের ধারের পাথরের ফাঁকে জন্মানো কাঁটা শাক আর আগাছা পর্যন্ত সেদ্ধ করে খেয়েছি। এই কাপুরুষটা সব মিথ্যে কথা বলছে আপনাদের।”
তবুও, সেই মিথ্যে কথাগুলোই ততক্ষণে ভিড়ের উপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। ভিড় মুহূর্তেই রূপ নিয়েছে উন্মত্ত জনতার। আর্তস্রোতের মতো তারা ছুটতে শুরু করে দিয়েছে বুর্গমাস্টারের প্রাসাদের দিকে। এই সুযোগে এক দুর্বৃত্ত হাত বাড়ায় মেয়েটার দিকে। টেনে সরিয়ে নিয়ে যেতে চায় অন্য পাশে। কিন্তু চোখের পলক পড়ার আগেই ইতরটা নিজেই গড়িয়ে পড়ে তার সহচরদের পদতলে। ততক্ষণে দু-চোখ ভরা আগুন নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হ্যারি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সেই কিশোরীর পাশে—তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর থেকে তখন ঝড়ের মতো বেরিয়ে আসছে বিশুদ্ধ ইংরেজি গালাগাল। সেই ইংরেজির তোড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড় ফাঁকা হয়ে সরে গিয়ে আশপাশটা খালি হয়ে গেল।
প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও খুব তাড়াতাড়িই নিজেকে সামলে নিল মেয়েটা। তারপর নিঃসংকোচে তাঁর দু-হাত দিয়ে হ্যারির গলা জড়িয়ে ধরে তাকে চুমু খেল।
“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে,” মেয়েটা মুখ খুলল এবার, “তুমি সত্যিই এক সাহসী তরুণ। আমার নাম গার্ট্রুড ভ্যান ডার ওয়ার্ফ।”
উত্তর দিতে গিয়ে হ্যারি হোঁচট খেল উপযুক্ত ওলন্দাজ শব্দ খুঁজে না পেয়ে, কিন্তু মেয়েটা তাকে সৌজন্য প্রকাশের অবকাশ দিল না। “ওরা আমার বাবার সঙ্গে খারাপ কিছু না ঘটিয়ে ফ্যালে।” বলেই সে আর দাঁড়াল না। আমাদের টেনে নিয়ে ছুটতে শুরু করল। কয়েকটা অত্যন্ত সংকীর্ণ গলি পেরিয়ে আমরা গিয়ে পৌঁছোলাম একটা ত্রিকোণাকার বাজারে—যেখানে অনেকটা জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে দ্বিশিখরবিশিষ্ট এক গির্জা। “ওই যে, ওই তো ওখানে আমার বাবা,” মেয়েটা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, “সেন্ট প্যানক্রাসের সিঁড়িতে।”
গোটা বাজার চত্বর জুড়ে তখন ভীষণ বিশৃঙ্খলা। গির্জার মাথার উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে, পিছনে কোথাও আগুন লেগেছে। ভয়াবহ অগ্নিশিখায় দাউদাউ করে জ্বলছে নগরটা। নগর-প্রাচীরের বাইরে থেকে ভেসে আসছে স্পেন আর ওয়ালুনদের কামানের গর্জন। কিন্তু এই সব কিছুই নয়—অন্তত যতটা হিংস্র আর ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছিল সামনের বাজার চত্বরে উপস্থিত উন্মত্ত জনতার সেই আর্তনাদ। অনাহারে পর্যুদস্ত অভুক্ত জনতার রুটির দাবি। তারা আশা করে আছে, তাদের নেতার মুখ থেকে একটামাত্র শব্দ বেরোলেই রুটি পৌঁছে যাবে তাদের হাতে। “আত্মসমর্পণ করো রাজার কাছে!” উন্মত্তের মতো তারা চিৎকার করে চলেছে, “আর নয়তো লেইডেনের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে আমরা ল্যামেনে পাঠাব তোমার মৃতদেহটা।”
বিশৃঙ্খল উন্মত্ত জনতার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে একজন দীর্ঘদেহী পুরুষ। উচ্চতায় সামনে উপস্থিত যে-কোনো নাগরিকের তুলনায় অন্তত আধা-মাথা উঁচু মানুষটার গাত্রবর্ণ এতটাই গাঢ় যে আমরা অবাক হয়ে ভাবছিলাম, কীভাবে তিনি গার্ট্রুডের বাবা হতে পারেন। দীর্ঘদেহী মানুষটা নিঃশব্দে শুনছিলেন উন্মত্ত জনতার সেই ভয়াবহ হুমকি। তবে এরপর বুর্গমাস্টার যখন বলতে শুরু করলেন, তখন সেই উন্মত্ত জনতা যেন নিজেদের অজান্তেই স্তব্ধ হয়ে তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকল।
“লেইডেন নগরবাসী আমার বন্ধুরা, তোমরা কী চাও, বলো? আমরা কি আমাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে আমাদের লেইডেনকে তুলে দেব স্পেনীয়দের হাতে? তাহলে সেই আত্মসমর্পণ আমাদের জন্যে ডেকে আনবে অনাহারে মৃত্যুর চেয়েও অতীব ভয়ংকর এক পরিণতি। আমি সেটা কিছুতেই হতে দিতে পারি না। আমাকে আমার শপথ রক্ষা করতেই হবে। যদি আত্মসমর্পণ করাটাই তোমাদের কাম্য হয়, তবে সেটা তোমাদের করতে হবে আমার মৃতদেহ মাড়িয়ে। চাইলে হত্যা করো আমাকে। মানুষ শুধু একবারই মরে, আমিও মরব একবারই—তা সেই মৃত্যু আসুক তোমাদের হাতে, শত্রুর অস্ত্রে অথবা ঈশ্বরের ইচ্ছায়। আর আমাকে হত্যা না করতে চাইলে, আমার কথা শোনো, আমাদের জন্যে অনাহারই সই। দরকার পড়লে আমরা না হয় অনাহারেই মরব। অপমানিত হয়ে মরার চেয়ে আমরা স্বাগত জানাব অনাহারে মৃত্যুকে। জেনে রাখো, তোমাদের হুমকি আমাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারবে না; তবু আমার জীবন আমি তোমাদেরই হাতে ছেড়ে দিলাম। এই নাও—তুলে নাও আমার তরবারি, বিদ্ধ করো আমার হৃদয়ে, আর খিদে মেটাতে চাইলে ভাগ করে নাও আমার দেহের হাড়মাংস। কিন্তু যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি, আত্মসমর্পণ আমি করব না।”
বাজার চত্বর জুড়ে আবার নেমে এল নীরবতা। উন্মত্ত জনতার ভিড় ইতস্তত করছে, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না আর। তারপর একসময় আমাদের চারপাশে লোকজনের ফিশফিশানির আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। আর সেই ফিশফিশানির ঊর্ধ্বে হঠাৎ ভেসে উঠল সেই কিশোরীর স্পষ্ট কণ্ঠস্বর—যার হাত হ্যারি তখনও শক্ত করে ধরে রেখেছে—যদিও আমার চোখে সেটা অতীব দৃষ্টিকটু আর একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছিল।
“শোনো, তোমরা কি সমুদ্রের হাওয়া টের পাচ্ছ না? অবশেষে এসে পৌঁছেছে সে! চলো, সবাই উঠি প্রাচীরের মিনারে! আর যে সেখানে প্রথমে পৌঁছোবে, সে-ই হয়তো দেখতে পাবে, চাঁদের আলোয় সাদা পাল উড়িয়ে ভেসে আসছে আমাদের রাজপুত্রের নৌবহর।”
পরের বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে আমি নগরের রাস্তাগুলো চষে বেড়ালাম, বৃথা চেষ্টা করলাম আমার খুড়তুতো ভাই আর তার সঙ্গিনীকে খুঁজে পেতে; আসলে রোমান বুরুজের দিকে জনতার হঠাৎ দৌড়ে যাওয়া শুরু হতেই আমরা একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। নগরে ঘুরতে ঘুরতে আমার চারপাশে দেখতে পাচ্ছিলাম, স্পেনীয়দের অবরোধ প্রতিরোধ করার কী ভয়াবহ শাস্তিই-না ভোগ করতে হচ্ছে নগরীর বাসিন্দাদের। প্রতিমুহূর্তে আমার চোখে পড়ছিল সেই শাস্তির ভয়াল সব চিহ্ন, অবশ্যম্ভাবীভাবে যা এই নগরীর দৃঢ়চিত্ত মানুষগুলোকে হতাশার শেষ প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। একটা খালের পাড়ে দেখতে পেলাম, দু-চোখভরা খিদের জ্বালা নিয়ে একটা মানুষ শীর্ণ একটা ইঁদুরকে তাড়া করে যাচ্ছে। এক জায়গায় দেখলাম এক তরুণী মা—কোলের মধ্যে তাঁর দুই মৃত সন্তান—নিঃশব্দে বসে আছেন এক পোড়ো বাড়ির দোরগোড়ায়। তাঁর সামনে শোয়ানো রয়েছে দুর্গ-প্রাচীর থেকে নামিয়ে নিয়ে-আসা সদ্যনিহত তাঁর স্বামী আর পিতার দেহ। এক জায়গায় পেরিয়ে এলাম একটা পরিত্যক্ত রাস্তা—রাস্তার মাঝখানে বেওয়ারিশ মৃতদেহের স্তূপ জমা করে রাখা—সেই স্তূপের উচ্চতা আমার উচ্চতার অন্তত দ্বিগুণ তো হবেই। এই যে এত এত মৃতদেহ চারদিকে ছড়িয়ে, এর পিছনেই তো নিশ্চিত থাকবে মহামারি—তবে স্পেনের সেনাদের চেয়ে সে অবশ্যই দয়ালু, কারণ আঘাত হানবার আগে কোনো মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রয়োজন তাঁর পড়বে না।
ভোরের দিকে হাওয়ার জোর বাড়তে বাড়তে ক্রমশ একসময় ঝড়ের রূপ নিয়ে তাণ্ডব শুরু করে দিল। গত রাত থেকে লেইডেনে কারও চোখেই আর ঘুম নেই, মুখে নেই আত্মসমর্পণের কথা, প্রতিরক্ষার চিন্তাও যেন মিলিয়ে গেছে। যাদের সঙ্গেই পথে দেখা হল, তাদের সবার ঠোঁটের ডগায় একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—“ভোরের আলো ফুটতেই এসে যাবে নৌবহর!”
ভোরের আলো কি নৌবহরকে নিয়ে আসতে পেরেছিল? ইতিহাস বলে হ্যাঁ, কিন্তু সেই দৃশ্যের সাক্ষী আমি থাকতে পারিনি। আমি শুধু জানি, ভোর হবার আগেই সেই ঝোড়ো হাওয়া পরিণত হয়েছিল এক প্রচণ্ড বজ্রঝড়ে। আর তার প্রায় একই সঙ্গে কানে এসেছিল বিস্ফোরণের এক চাপা গর্জন—যা ছিল বজ্রনির্ঘোষের চেয়েও ভয়ংকর আওয়াজ—কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা নগরটাকেই। আমি তখন দাঁড়িয়ে ছিলাম রোমান বুরুজের উপর। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি সেখানে উপস্থিত বাকি সকলের মতোই তাকিয়ে ছিলাম দূর সমুদ্রের দিকে। ভোরের আলো তখন সবে একটু একটু করে পরিষ্কার করছে অন্ধকার। অপেক্ষা করছিলাম, কখন দেখা যাবে ত্রাণ নিয়ে আগত নৌবাহিনীর প্রথম চিহ্ন। কিন্তু সেই বিস্ফোরণের অভিঘাতে উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষের মুখ থেকে সব আশাভরসা মুছে গেল। ভিড়ের মধ্যে সবাই তখন মন্তব্য করতে শুরু করেছে। “ওরা বোমা মেরে প্রাচীর ভাঙা শুরু করেছে!”—কিন্তু বুর্গমাস্টার এখন কোথায়? ভিড় ঠেলে আমি এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। খোঁজ করছিলাম, কোথায় আছেন বুর্গমাস্টার। যতক্ষণ না ভিড়ের মাঝখানে দলবল নিয়ে অপেক্ষারত বুর্গমাস্টারের কাছে গিয়ে পৌঁছোতে পারলাম, আমি থামলাম না। “বুর্গমাস্টার! তাড়াতাড়ি করুন,” কাছে গিয়ে আমি ফিশফিশ করে বলতে শুরু করলাম, “বিস্ফোরণটা হয়েছে গৌ-ফটক পেরিয়ে বার্গান্ডি-বুরুজের দিকে।” তিনি আমার দিকে একবার শুধু তাকালেন। গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে আপাদমস্তক আমাকে একবার দেখে নিলেন তিনি। তারপর উপস্থিত ভিড়ের জনতাকে শান্ত করার মতো কাউকে কিছু না বলেই দ্রুত পা বাড়ালেন গৌ-ফটকের দিকে—আমিও তাঁর পিছু পিছু সেদিকেই এগিয়ে গেলাম।
প্রায় আধ মাইলের মতো পথ পেরিয়ে তবে পৌঁছোনো যায় প্রাচীরের সেই বিশেষ জায়গায়। একনাগাড়ে দৌড়ে গেলাম আমরা গোটা পথটাই। যখন আমরা পৌঁছোলাম গৌ-ফটকের সেই জায়গায়—তখন যা দেখলাম, তা হল এই:
যেখানে একদা প্রাচীরটা দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে এখন বিরাট এক শূন্যতা—বিস্ফোরণে ভেঙে গেছে দুর্গ-প্রাচীর, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওপাশের বিস্তৃত কর্দমাক্ত জলাভূমি। সেই জলাভূমির দিকে, প্রাচীরের ওপাশের পরিখার ভেতরে ঘাড় উঁচু করে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে অসংখ্য বিভ্রান্ত মুখের একটা ভিড়। মুখগুলো স্পেনীয় সৈন্যদের। মরিয়া হয়ে তারা এসেছিল ভাঙা প্রাচীর দখল করতে। বেশ কয়েক ফুট এগিয়েও এসেছিল তারা, এখন আবার ধাক্কা খেয়ে পিছু হটেছে। ইতিমধ্যে ধসে-পড়া প্রাচীরের ভাঙা পাথরের স্তূপের উপরে এসে হাজির-হওয়া নগররক্ষীবাহিনীর মুষ্টিমেয় কয়েকজন সেনা আর বেশ কিছু নাগরিক বুক চিতিয়ে লড়াই শুরু করেছে। সবাই মিলে গড়ে তুলেছে এক মানব-প্রাচীর। সেই মানব-প্রাচীরের পিছনেই রয়েছে তাদের তুলনায় দ্বিগুণসংখ্যক নারী আর কিশোরীর একটা দল—তারা নগররক্ষকদের হাতে হাতে পৌঁছে দিচ্ছে পাথরের চাঁই, বালতিভরা উথলে-ওঠা ফুটন্ত জল, গলন্ত পিচ, ফুটন্ত তেল আর পোড়া চুন। তাদের কারও কারও হাতে রয়েছে জ্বলন্ত তারের বালা, যা তারা ছুড়ে দিচ্ছে শত্রু স্পেনীয় সেনাদের গলায়, যারা পরিখার দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করছে। এদিকে দেখতে পাচ্ছি, সেই মুষ্টিমেয় নগররক্ষী সেনা আর নাগরিকদের দলটার সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে শুরু করে তাদের যাবতীয় দিশা দেখাচ্ছে আমারই খুড়তুতো ভাই হ্যারি। আর ওদিকে দেখলাম বুর্গমাস্টারের মেয়ে গার্ট্রুড—উৎসাহ আর উদ্দীপনা জুগিয়ে সে অনুপ্রাণিত করে চলেছে নারী আর কিশোরীদের দলটাকে।
কিন্তু আমাকে সব চেয়ে বেশি যেটা অবাক করল, সেটা হচ্ছে কালো রঙের পোশাকে আবৃত ছোটোখাটো চেহারার একজন মানুষের মরিয়া লড়াই—প্রায় উন্মত্তের মতো বিশাল বিশাল গলানো সিসা ভরতি বালতি উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে মানুষটা ঢেলে দিচ্ছিলেন পরিখার নীচে থাকা আক্রমণকারীদের মাথার উপর। শেষ পর্যন্ত একবার তিনি যখন চুল্লির উপরে রাখা কড়াইটার দিকে ঘুরলেন—যেখান থেকে তিনি সংগ্রহ করছিলেন তাঁর প্রাণঘাতী অস্ত্রশস্ত্র—তখন সেই আগুনের আভায় তাঁর জ্বলজ্বলে মুখটা আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, গলানো সিসার সেই পরিবেশক আর কেউ নন, অধ্যাপক ভ্যান স্টোপ স্বয়ং!
আমাকে ওভাবে হঠাৎ চিৎকার করে উঠতে দেখে বুর্গমাস্টার ভ্যান ডার ওয়ার্ফ ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। “উনি কে?” প্রায় হতভম্ব আমি কোনোরকমে জিজ্ঞেস করতে পারলাম, “ওই কড়াইয়ের পাশে দাঁড়ানো মানুষটা কে?”
“ওহ্, উনি?” ভ্যান ডার ওয়ার্ফ উত্তরে বলে উঠলেন, “উনি আমার স্ত্রী-র ভাই, ঘড়িশিল্পী জ্যান লিপারদাম।”
পুরো পরিস্থিতি আমরা ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই ভাঙা প্রাচীরের যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। স্পেনীয় যোদ্ধারা, যারা ইট-পাথরের প্রাচীরটা অতি সহজেই ভেঙে ফেলেছিল, আসলে তারা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিল সামনের মানব-প্রাচীর দুর্ভেদ্য। পরিখাতেও তারা তাদের নিজেদের অবস্থান বজায় রাখতে পারল না; উলটে পরিখার অন্ধকারের আড়াল নিয়ে তাদের ফিরে যেতে হল আরও পিছনে কোথাও। এতক্ষণ পরে এবার আমি টের পেলাম, আমার বাঁ হাতে একটা তীব্র ব্যথা শুরু হয়েছে। সম্ভবত যুদ্ধ চলার সময়েই কোনো পথভ্রষ্ট গুলি এসে সেখানে লেগেছিল। ঘোরের মধ্যে থাকায় তখন টের পাইনি। এখন প্রচণ্ড ব্যথায় কাতর হয়ে পড়লাম।
“এই এত কিছুর জোগাড়যন্ত্র সব কে করেছে?” বুর্গমাস্টার এবার জানতে চাইলেন, “আমরা সবাই যখন চোখ প্যাটপ্যাট করে বোকার মতো তাকিয়ে ছিলাম আগামীকালের দিকে, তখন কে সেই মানুষটা, যে আজকের কথা ভেবে এত কিছু করে রেখেছিল?”
আমার খুড়তুতো ভাইটিকে সামনে রেখে মাথা উঁচু করে এগিয়ে এল গার্ট্রুড ভ্যান ডার ওয়ার্ফ। “শুধু এইটুকুই নয়, বাবা,” হ্যারির পিছনে দাঁড়িয়ে মেয়েটা এবার বলে উঠল, “ইনি আজ আমার জীবনও রক্ষা করেছেন।”
“এটা অবশ্যই আমার কাছে একটা বিশাল বড়ো ব্যাপার,” বললেন বুর্গমাস্টার, “কিন্তু সেটাই সব নয়। শুধু তোমাকে না, এই যুবক আমাদের লেইডেনকে বাঁচিয়েছে, আমাদের হল্যান্ডকে বাঁচিয়েছে।”
এদিকে ততক্ষণে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। চারদিকে থাকা মানুষগুলোর মুখ তখন কেমন যেন অবাস্তব বলে মনে হতে শুরু করেছে। আমরা এখানে এই মানুষগুলোর সঙ্গে কী করছি? কেনই-বা সারাক্ষণ বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছে আর বজ্রপাত হয়ে চলেছে? ঘড়ি-নির্মাণবিদ জ্যান লিপারদামের মুখটা কেন আমার সব সময় প্রফেসার ভ্যান স্টোপের মতো লাগছে? “হ্যারি!” আমি ভাইকে ডাক দিলাম, “চলো, আমরা আমাদের ঘরে ফিরে যাই।”
ডাক শুনে হ্যারি আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল বটে, কিন্তু আরেকটা হাতে ধরে-রাখা মেয়েটার হাত ছাড়ল না। ছাড়ল তো সে না-ই, এমনকি তার পরেও একটুও না নড়ে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু আর আমি কিছু ভাবতে পারছিলাম না। কেমন যেন একটা বমি-বমি ভাব আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আমার মাথা ঘুরছে, দৃষ্টি আবছা হয়ে আসছে। একটু পরেই ধীরে ধীরে সেই ভাঙা প্রাচীর আর তার রক্ষকরা সবাই আমার চোখের সামনে থেকে মুছে যেতে শুরু করল।
তিন দিন পর। আমি ভ্যান স্টোপের লেকচার রুমে আমার রোজকার অভ্যস্ত আসনে বসে আছি। একটা হাত আমার এখনও ব্যান্ডেজ মোড়ানো। আমার পাশের জায়গাটা খালি।
৫
“দ্যাখো, এ বিষয়ে আমরা আগেও অনেক কিছুই আলোচনা করেছি।” হাতের নোটবুকটায় চোখ বুলিয়ে হেগেলীয় দর্শনের প্রখ্যাত অধ্যাপক তাঁর চিরাচরিত খসখসে গলায় শ্রেণিকক্ষে যেভাবে তাড়াহুড়ো করে কথা বলেন, সেইভাবেই শুরু করলেন, “আমরা জেনেছি, ষোড়শ শতাব্দীর কত রকমেরই-না প্রভাব পড়েছে এই ঊনবিংশ শতাব্দীর উপরে। কিন্তু, অন্তত যতদূর আমি জানি, আজ পর্যন্ত কোনো দার্শনিকই ঊনবিংশ শতাব্দীর কী কী প্রভাব ষোড়শ শতাব্দীর ওপর পড়েছিল, তা নিয়ে কোনো গবেষণা করেননি। কার্যকারণ সম্পর্কের ব্যাপারটা যদি আমরা দেখি, সেক্ষেত্রে কারণ যদি কার্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, যদি ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা নেয়, তবে কার্যের ফলাফল কি কখনও কারণের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না? এই যেমন বংশগতির নিয়ম, সেটা কি এই জগতের মন আর পদার্থ সংক্রান্ত বাকি সব নিয়মের মতো একরকম নয়? সেটা কি শুধু একদিকেই কাজ করবে? উত্তরপুরুষই শুধু তাঁর সব কিছুর জন্যে ঋণী থাকবে পূর্বপুরুষের কাছে, অথচ পূর্বপুরুষ কোনো কিছুর জন্যেই উত্তরপুরুষের কাছে ঋণী হবে না? যে নিয়তি চাইলে আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারে, যে কিনা নিজের ইচ্ছেমতো আমাদের ভবিষ্যতের অবস্থান নির্ধারণ করে, সে কি চাইলে আমাদের অতীত নিয়েও টানাটানি করতে পারে না?”
আমি চুপ করে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। প্রফেসারের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো জ্ঞান বা বুদ্ধি কোনোটাই আমার নেই। অবশেষে একসময় উঠে পড়লাম আমি। ফিরে গেলাম ব্রিড স্ট্রাটের আমাদের ঘরটায়, সেই আমাদের ঘরটাতেই, যেখানে তখন আমার একমাত্র সঙ্গী অকেজো আর নিস্তব্ধ একটা ঘড়ি।
Tags: এডওয়ার্ড পেজ মিচেল, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, রুদ্র দেব বর্মন
