স্মৃতির শহর
লেখক: সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
আমাকে টান মারে রাত্রি-জাগা নদী
আমাকে টান মারে অন্ধকার
আমার ঘুম ভেঙে হঠাৎ খুলে যায়
মধ্যরাত্রির বন্ধ দ্বার।
অনমিত্র হেঁটে যাচ্ছে এই শহরের অন্ধকার গলির মধ্য দিয়ে। গলিটা পেরোলে একটা বাজার। চোরবাজার। সেখানে আছে করিমের দোকান। সেখানে পাওয়া যায় জিনিসটা। যে জিনিসটার চাহিদা আজকাল লোকসমাজে তুঙ্গে। তবে বাজারচলতি যা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে করিমের মালের তফাত আছে। কারণ সেটা নিষিদ্ধ। অন্তত দেশের আইনকানুন অনুসারে। অনমিত্র আসলে স্মৃতি কিনতে যাচ্ছে। মানুষের ফেলে-আসা স্মৃতি। সত্যিকারের স্মৃতি।
কোনো মানুষের জীবনের যাবতীয় স্মৃতি এখন সেই ব্যক্তির অনুমতিক্রমে ডেটা আকারে ছোটো ছোটো স্মৃতিধারক যন্ত্রে সংরক্ষণ করা যায়, তবে সেক্ষেত্রে প্রশাসনের অনুমোদন এবং সম্পাদনা প্রয়োজন। ব্যক্তিটি চলে যাওয়ার পর সেই স্মৃতি বিভিন্ন বিভাগ অনুসারে সংরক্ষণ করা হয়। আমলাদের স্মৃতি, মন্ত্রীদের স্মৃতি, বিদ্বজ্জন আর সেলেব্রিটিদের স্মৃতি, নেহাত সাধারণ নাগরিকদের স্মৃতি এমন সব ক্যাটেগরি।
কেউ চাইলেই এইসব স্মৃতির সাহায্যে পুরোনো নানা তথ্য যাচাই করতে পারেন। বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য বা প্রমাণ হিসেবে সেসব দাখিল করা যেতে পারে। প্রিয়জনের স্মৃতি নিজের কাছে ধরে রাখতে চাইলে কেউ চড়া দামে সেসবের প্রামাণ্য নকল কপি কিনে নিজের কাছেও রাখতে পারেন। কেউ আবার বিলুপ্তপ্রায় সম্প্রদায়ের, সংস্কৃতির স্মৃতি খোঁজেন। সেসব লুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে যত-না আগ্রহ দেখান সবাই, বিষয়গুলো একেবারে হারিয়ে গেলে তারপর সেই চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। অবশ্য মানুষের স্বভাব বরাবরই এরকম। কোনো কিছু থাকাকালীন তার কদর তেমন বোঝে না কেউ।
তবে এ তো গেল সরকারি নিয়মের কথা। তাহলে নিষেধটা কীসে? সম্পাদনাই-বা কখন প্রয়োজন হয়? এমন বেশ কিছু গোপনীয় আর সংবেদনশীল তথ্য আছে, যার অভিঘাত আর প্রভাব সমাজে মারাত্মক হতে পারে। হতে পারে তিনি কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, হতে পারে কোনো রাজনৈতিক নেতা, অথবা কোনো ভয়ংকর অপরাধী, তাদের জীবনে ঘটে-যাওয়া নানা বিচিত্র ঘটনার কথা জনসমক্ষে এলে অনেক কিছু ওলট-পালট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই স্মৃতি সংরক্ষণে কড়া নজরদারি থাকে সরকারের। তবে ওই যে বলে, বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো! যেখানে যত বাধানিষেধ, সেখানেই তত কৌতূহল। আর কৌতূহলের ল্যাজ ধরে আসে তার নিরসনের উপায়। চোরবাজার আদিকাল থেকেই দুনিয়ায় আছে, এই একবিংশ শতকের অন্তিম লগ্নে এসেও তার ব্যত্যয় হয়নি।
করিমের দোকান এমনই এক চোরবাজারে। প্রশাসনের নাকের ডগাতেই সেখানে রমরমিয়ে ব্যাবসা করছে তার মতো অনেকেই। আইন থাকলে যেমন তার ফাঁক থাকে, সেই ফাঁক গলেই বড়ো বড়ো নিষিদ্ধতার হাতি গলে যায়। বলা বাহুল্য, আইনরক্ষকদের একাংশই এই ছিদ্র তৈরির নীরব কারিগর। কিছুটা দেওয়া-নেওয়ার পালা থেকে যায় মাঝখানে শুধু। এই বিনিময় প্রথাটুকু না থাকলে অনমিত্ররাই-বা কোথায় যেত? কিন্তু তার হঠাৎ নিষিদ্ধ স্মৃতির প্রয়োজন হল কেন? সরকারি বাজারের স্মৃতির চেয়ে এসবের দাম তো স্বাভাবিক কারণেই অনেকটা বেশি।
অনমিত্র আসলে পেশায় একজন স্বাধীন সাংবাদিক। ডিজিটাল মাধ্যমে তার বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদনের ভক্ত দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই সে এটা করে আসছে। তবে ইদানীং এমন ফ্রিল্যান্স-করা সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তিনশো কোটি জনসংখ্যার দেশে সব কিছুই বাড়বে, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে? তাই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেষারেষিও। নতুন কিছু চাই দর্শকদের। একঘেয়ে খবর আর কাউকেই টানে না। তাই এমন অনন্য কিছু করতে হবে, যা দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়ে যাবে। তখন থেকেই এই নিষিদ্ধ স্মৃতির ভাবনা ঘুরছে অনমিত্রর মাথায়, এক জায়গায় শুনেছিল এটার ব্যাপারে আবছা আবছা। আজ অবশেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেই জিনিসের সন্ধান মিলেছে। কোনোমতেই ছাড়া যাবে না এই সুযোগ।
করিমের কাছে এসে অনমিত্র চাপাস্বরে বলল, “করিমভাই, এমন কিছু দেখাও, যা সবার সামনে এলে গোটা দেশে হইচই পড়ে যাবে। আমি নিশ্চিত, তোমার কাছে সেই অ্যাটম বোমা ভরপুর মজুত আছে। দক্ষিণা নিয়ে চিন্তা কোরো না, ওটার দায়িত্ব আমার। তুমি শুধু আমাকে সেরা জিনিসটা দেবে, কথা দাও!”
করিম চোস্ত ব্যবসায়ী। এসব ছেঁদো প্রশংসা সে ভালোই চেনে, ওতে গলে যাওয়ার বান্দা নয় সে। তার শুধু ন্যায্য দাম পেলেই হল। ছোপ-ধরা তীক্ষ্ণ ভাঙাচোরা দাঁত বের করে নিঃশব্দে হেসে সে একটা প্যাকেট এগিয়ে দেয়। ভিতরে কিছু আছে। বাইরে থেকে হাত বুলিয়ে মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে জিনিসটা একটা মিনি স্টোরেজ ডিভাইস। অস্ফুটে করিম বলে, “সাত লাখ পঞ্চাশ হাজার। এক রুপি কম নয়, এক বেশি নয়। দিন।”
অনমিত্র জানে এখানে দরাদরি করে লাভ নেই। আগেই শুনেছে সে। শুধু আমতা আমতা করে একবার বলে, “মিনি স্টোরেজ? মনে কিছু মনে কোরো না ভাই, কতটা ডেটা স্টোর আছে, বলা যাবে কি?”
করিম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “দেখুন বাবুসাব, সাধারণ লোকের মতো আড়াই পেটাবাইট ডেটা হয়তো এখানে নেই, মেরেকেটে ৭৫০ টেরাবাইট হতে পারে। তাই মোটামুটি প্রতি জিবি এক টাকা দরে সাড়ে সাত লাখ চেয়েছি। এর চেয়ে সস্তা তো আপনি পাবেনই না, আর এরকম জিনিসও পাবেন না। একদম আপনার মনের মতো। এটা করিমের গ্যারান্টি! নিয়ে যান একবার। তারপর দেখবেন, আপনার জীবন বদলে গেছে।”
শেষ বাক্যটা বলে মুখটা একটু বেঁকিয়ে রহস্যময় একটা হাসি দিল করিম। লোকটা ব্যঙ্গ করছে নাকি? জীবন বদলে যাবে মানে? সাত-পাঁচ ভাবনায় একটু দ্বন্দ্বে পড়ে অনমিত্র। তবে লোকমুখে এর কথা যা শুনেছে, তাতে লোকটাকে অবিশ্বাস করারও তেমন কোনো কারণ নেই। অনমিত্র ডিজিটাল পেমেন্ট করে জিনিসটা নিয়েই নিল।
বাড়ি এসে ছোট্ট যন্ত্রটা নির্দিষ্ট সেটআপে লাগিয়ে অনমিত্র বিশেষ চশমা, হেডফোনসহ অন্যান্য অ্যাকসেসরিজ় গুছিয়ে সেটা চালিয়ে বসল। আর বসতেই একটা ধাক্কা খেল যেন! এ কী দেখছে সে? এই শহরের প্রাক্তন মেয়র একটা অন্ধকার গলি দিয়ে প্রাণপণে ছুটে চলেছেন। আর তাঁকে ধাওয়া করছে এক আততায়ী, হাতে উদ্যত অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। সেই আততায়ীর স্মৃতিই এখন চলমান, ফলে অনমিত্রর মনে হচ্ছে যেন সে নিজেই ওই অপরাধী! তার বুকটা ধক করে ওঠে। শিকার আর শিকারির মধ্যে দূরত্ব কমছে। এবার আচমকা হাতে ধরা অস্ত্র থেকে তিরবেগে ছুটে গেল তীব্র ভেদনক্ষমতাবিশিষ্ট এক রশ্মি। এ ফোঁড়-ও ফোঁড় হয়ে গেল মেয়রের বুক-পিঠ। “আঁক” বলে অস্ফুট শব্দ করে তাঁর রক্তাক্ত দেহটা লুটিয়ে পড়ল গলির ভিতরে জমে-থাকা বৃষ্টির জমা জলে। আততায়ীও এবার নিশ্চিত হতে সেদিকে ছুটে এসে দাঁড়াল নিথর মৃতদেহের পাশে। দাঁড়ানো অবস্থায় বৃষ্টির জমা জলের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে আততায়ীর পোশাকটা দেখা যাচ্ছিল, সরকারি নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক। মুখটাও অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সেটা দেখেই অনমিত্রর ওই চমকটা লাগল। আততায়ী আর কেউ নয়, সে নিজে! ডিভাইসটা মুহূর্তে সুইচ টিপে বন্ধ করে দিল সে, রীতিমতো হাঁপাচ্ছে সে। কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অনেকগুলো খটকা মনের মধ্যে।
এই স্মৃতি যতই নিষিদ্ধ হোক, জিনিসটা তো ইচ্ছেমতো বিকৃত করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাহলে মেয়রের হত্যাকারীর মুখ অনমিত্রর সঙ্গে হুবহু মিলবে কী করে? তার তো কোনো যমজ ভাই নেই। এমনকি তার নিজের স্মৃতিতেও তো এমন কিছু কস্মিনকালেও নেই। আর যদি সে-ই অপরাধী হয়েও থাকে, তবে তার আশপাশের মানুষেরা এতদিন তাকে গ্রেফতার না করে কীভাবে রয়েছে? আর ওই নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক? করিমের কাছেই-বা এই যন্ত্র কোত্থেকে এল? সেটা অবশ্য সে জিজ্ঞেস করলেও জানাবে না, ট্রেড সিক্রেট, বিশেষত এই নিষিদ্ধ স্মৃতিই যখন তার ব্যাবসার মূলধন।
একটু ধাতস্থ হয়ে অনমিত্র ঠিক করে, এর শেষ দেখে ছাড়বে। সাংবাদিক সত্তার পিছনে তার যে অনুসন্ধিৎসু মনটা রয়েছে, তাকে ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব। ওই মেয়র ঋষি বসুর আচমকা উধাও হয়ে যাওয়ার খবরটা বেশ কয়েক বছর আগে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল সমাজে। নতুন নিযুক্ত মেয়র তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিলেন, কিন্তু অধিকাংশ সরকারি কমিটির মতো সেটিও অশ্বডিম্বই প্রসব করেছিল। অনমিত্র অনেক চেষ্টা করেও সেই সময়টায় সে নিজে কী করছিল, ভেবে বের করতে পারে না। অস্বস্তি হয় একটা। খটকা দূর করতে আবার নতুন করে সে যন্ত্রটা চালু করে। স্মৃতিদর্শক চশমার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে পরবর্তী ঘটনাপরম্পরা।
এবারের দৃশ্য আরও একটা ভয়ানক হত্যালীলার। আততায়ীর চোখ দিয়ে অনমিত্র দ্যাখে এক পাঁচতারা হোটেলের করিডর। সে অর্থাৎ প্রাক্তন মেয়রের হত্যাকারী এগিয়ে চলেছে একটা নির্দিষ্ট দরজা লক্ষ করে। রুম নম্বর ১৪৩৫। বেল বাজায় তার ডান হাত। হাতের কবজিতে কালচে জড়ুলটা হোটেল করিডরের হলদেটে আলোয় স্পষ্ট দেখা যায়। অনমিত্রর নিজের হাতেও একই জায়গায় একই রকম জড়ুল আছে, এটা মনে পড়ায় তার হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়। আচমকা দরজা খোলে। তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে থাকেন ভিতরে থাকা ভদ্রলোক। ইনিও পরিচিত মুখ। কয়েক বছর আগেই রহস্যময়ভাবে খুন-হওয়া রাজ্যের বিরোধী পক্ষের এক নেতা। রহস্যময়, কারণ এই কেসেরও আজ অবধি সমাধান হয়নি।
দৃশ্যটা খুব দীর্ঘস্থায়ী হল না। সরকারি নিরাপত্তারক্ষীর বেশে অনমিত্রকে দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন, কারণ তাকে উনি চিনতেন। তারপর ঘরে ঢুকে সামান্য বাক্যালাপ চলতে-না চলতেই আচমকা হাতের লুকোনো অস্ত্রটি বের করে ওই নেতা ভদ্রলোকের দিকে তাক করে অনমিত্র। হ্যাঁ, ওটা যে স্বয়ং সে-ই, এ নিয়ে আর কোনো সংশয় নেই তার। নেতার বিস্ফারিত চোখে তাকানো অবস্থাতেই তীব্র রশ্মির জ্বলন্ত ক্রিয়ায় ঝাঁজরা হয়ে গেলেন তিনি। অনমিত্র কাছে গিয়ে একবার তাঁর নাকের তলায় হাত দিয়ে রুটিনমাফিক পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হয়ে আবার সেই দরজা দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। আসার আগে দরজাটা টেনে দিতে ভুলল না।
অনমিত্র একটানে চশমা, হেডফোন, তার-টার সব খুলে ফেলল। হাঁপাচ্ছে সে। এ কীরকম রসিকতা? সে কিনতে গেল কোনো একটা রোমাঞ্চকর নিষিদ্ধ স্মৃতি, যা তার সাংবাদিকতার অনুষ্ঠানে রসদ জোগাবে। এ তো দেখি তার নিজের স্মৃতি-মনন-চিন্তন সব কিছুই গুলিয়ে যাওয়ার উপক্রম! সে ঠিক করল, করিমের কাছে আরেকবার যেতেই হবে। এই রহস্যের পিছনের আসল জিনিসটা খুঁজে বের করতে ওর সাহায্য লাগবেই। লোভ দেখিয়ে হোক বা ভয় দেখিয়ে, মুখ খোলাতেই হবে করিমের।
অনমিত্র ছুটে যায় চোরবাজারে। করিমের দোকানে আজ ভিড় কম আছে। সে যেন ওর অপেক্ষাতেই ছিল, একটুও চমকাল না তাকে দেখে, উলটে কৌতুকভরা চাহনি দিয়ে জানতে চাইল, “কী বাবুসাব। কেমন ছিল আমার দেওয়া স্মৃতিগুলো?”
অনমিত্র রাগে, ক্ষোভে, বিধ্বস্ত হয়ে তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “আপনি তার মানে সব জানতেন? জেনেশুনে আপনি এটা কী দিলেন? আর কোথা থেকেই-বা পেলেন? আদৌ এগুলো সত্যি নাকি সব আমাকে বিভ্রান্ত করার চক্রান্ত? বলুন! আপনাকে বলতেই হবে! নইলে কিন্তু…”
সে থ্রেট কালচারে খুব একটা বিশ্বাসী নয়, উলটে এসবে খারাপই লাগে অনমিত্রর। কিন্তু এখন সে নিরুপায়। সত্যের কাছে পৌঁছোতে হবে তাকে। সে সত্যি যতই অপ্রিয় হোক-না কেন, তাকে সহ্য করতেই হবে। তাকে অস্বীকার করা যাবে না কোনোভাবেই।
করিম কিন্তু এসব শুনে বিচলিত হল না। ঠান্ডা অথচ দৃঢ়স্বরে সে জানাল, “দেখুন, আপনার স্মৃতিই আমি আপনাকে দিয়েছি, এটা ঠিক। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, এটা আপনার জানাটা জরুরি। অনমিত্র, ভেবে দেখবেন আমি আপনার শত্রু না মিত্র? কে আসল শত্রু, আপনার ভাবুন তবে। আপনি বুদ্ধিমান, নিশ্চয়ই সেটা বের করতে পারবেন। আর যন্ত্রে সঞ্চিত সব ক-টা স্মৃতি অনুগ্রহ করে দেখবেন। আমার ধারণা, সবটা দেখেননি আপনি।”
অনমিত্র একটু থতোমতো খেয়ে গেল। কথাটা তো ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আসলে, দুটো ঘটনাই এমন মারাত্মক, যে সেটাকে মগজ থেকে সরিয়ে অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করাই যাচ্ছে না। করিম যখন বলছে, একবার কষ্ট করে শেষ অবধি দেখাই যাক না হয়!
সেই রাতে বাড়ি ফিরে অনমিত্র যন্ত্রের বাকি অংশটা দেখাশোনা চালু করল। সে দেখতে পায়, তার চোখের সামনে তার প্রাক্তন প্রেমিকা গুঞ্জন আত্মহত্যা করছে। গুঞ্জনের কথা তার আর মনে নেই। মনে যে নেই, সেটাও আসলে ভুলে গিয়েছিল সে, এখন যেন সেই কুয়াশার পর্দা সরছে একটু একটু করে। অনমিত্র তার কাছে তার আগে নিজের করা সব পাপ স্বীকার করেছিল, ভেবেছিল, সত্যিটা অন্য কারও কাছ থেকে জানার আগে সে নিজে বললে হয়তো ভালো হবে। কিন্তু ফল হল উলটো। তীব্র ঘৃণায় আর অন্তহীন হতাশায় গুঞ্জন মানসিক অবসাদের শিকার হয়েছিল। তাকে বোঝানোর জন্য যখন অনমিত্র তার ফ্ল্যাটে যায়, ওকে দেখেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গুঞ্জন। তারপর চকিতে পিছনে ঘুরে তিরিশতলার ফ্ল্যাটের খোলা ব্যালকনি থেকে লাফিয়ে নিজের শরীরটাকে নীচে ছুড়ে দেয় সে। অনমিত্র কিছুই করতে পারে না। একছুটে ব্যালকনিতে গিয়ে অনেক নীচের দিকে তাকিয়ে গুঞ্জনের রক্ত-মাখা দলাপাকানো শরীরটা শুধু তাকিয়ে দ্যাখে সে।
এবার দেখা যাচ্ছে একটা হাসপাতালের দৃশ্য। বেডে শুয়ে আছে সে নিজে। অপারেশন থিয়েটার এটা। চারপাশে ডাক্তার-সেবিকাদের গুঞ্জন। কিন্তু তার পাশে ওরা কারা? বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে অনমিত্রর। এরা তো প্রায় সবাই সরকার আর প্রশাসনের হোমরাচোমরা ব্যক্তি। তাঁরা এভাবে একজোট হয়ে কী নিয়ে কথা বলছেন? কী নিয়ে নয়, কাকে নিয়ে। এবং উদ্দিষ্ট ব্যক্তি আর কেউ নয়, স্বয়ং অনমিত্র নিজে। এটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ওইসব লোকের চোখগুলো একসঙ্গে ঘুরে গেল তার দিকে। কাকতালীয় নাকি? ওরা এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। অনমিত্র বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করেও পারছে না। তার হাত-পা বেডের সঙ্গে বাঁধা।
একজন মাস্ক-পরা ডাক্তার আস্তে আস্তে এগিয়ে আসেন। হাতে ধরা একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ। তার ছটফট-করতে-থাকা বাহুতে সেটা আমূল বিঁধিয়ে দেওয়ামাত্র স্মৃতির শব্দ-ছবি সব ঝাপসা হয়ে এল। তারপর সব অন্ধকার। অনমিত্র যন্ত্রটা বোতাম টিপে বন্ধ করল। কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকল। স্মৃতিযন্ত্রের ডেটা ঝাপসা হয়ে এলেও এবার আসল ছবিটা কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। এইসব হাই প্রোফাইল খুনগুলো সরকার বা প্রশাসনের তরফেই করানো হয়েছে। করেছে সে নিজে। অনমিত্র নিরাপত্তারক্ষীর ছদ্মবেশে আসলে একজন সরকারি সুপারি কিলার ছিল। কাজ মেটার পর নিপুণভাবে তার সব স্মৃতি মুছে দেওয়া হয়েছিল হাসপাতালে গিয়ে। তারপর থেকে শুরু হওয়া তার এই সাংবাদিক জীবন হয়তো এই সরকার আর সামাজিক সিস্টেমেরই চাপিয়ে দেওয়া। কিন্তু মুছে দেওয়ার আগের নিষিদ্ধ স্মৃতি কোনোভাবে হাত ঘুরতে ঘুরতে চোরবাজারে করিমের কাছে পৌঁছেছিল। যেভাবে আর পাঁচজনের স্মৃতিও যায়। আর করিম যেভাবে সব স্মৃতিযন্ত্র যাচাই করে নেয়, সেটা করতে গিয়েই অনমিত্রর অতীত রহস্য সে জেনেছে। এমন অনেকেরই গোপন নিষিদ্ধ স্মৃতি তার জানা আছে। ব্যাবসার কাজে সেসব ব্যবহারও করে সে। কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু ব্যাবসা করাটা তার উদ্দেশ্য ছিল না, হতভাগ্য অনমিত্রকে দেখার পর সে চেয়েছিল তার অতীতের বিষাক্ত সত্যিটা জানাতে। অনমিত্র এবার ওই শত্রু-মিত্র নিয়ে বলা কথাগুলোর মর্মোদ্ধার করতে পারল।
শত্রু কে বা কারা তা জানতে আর তার বাকি নেই। দরকারে স্মৃতিযন্ত্র আরেকবার চালিয়ে হাসপাতালের ঘরে দেখা ওই মুখগুলো আরেকবার মাথায় গেঁথে নেবে সে। তার অতীতের অভিশাপ যখন তার সামনে এসেই গেছে, নিরীহ সাংবাদিকের জীবন ছেড়ে আরেকবার, হয়তো শেষবারের মতো হাতে অস্ত্র তুলে নিতে তার বাধবে না। মোক্ষম কিছু অস্ত্রও ওই চোরবাজারেই পাওয়া যাবে, সে নিশ্চিত। এই স্মৃতির শহর তাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে, তার জীবনটাকে একটা হাস্যকর তামাশা বানিয়ে রেখেছে। যারা একদিন তাকে হাতের পুতুল বানিয়েছিল, তারাই আবার তাকে নিষ্ক্রিয় করেছে নিজেদের স্বার্থে। একবার অন্তত তাকে সক্রিয় হতেই হবে। ওই লোকগুলোর স্মৃতির শেষটা যেন সুখকর আর নিস্তরঙ্গ না হয়, অনমিত্র মনে মনে শপথ করে এগিয়ে চলল এক নিশ্চিত পরিসমাপ্তির দিকে।
চোখের চেয়ে আরও অনেক বড়ো দেখা
দৃশ্য ঘুরে যায়, ঘোরে বাতাস,
ধোঁয়ার মৃদু জ্বালা শোকের কলরোল
বাষ্প-অশ্রুতে রুদ্ধশ্বাস।
শিরোনাম ও কবিতার পঙ্ক্তি-কৃতজ্ঞতা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি
