সমবেদনার গান
লেখক: মূল রচনা: শ্বেতা তানেজা অনুবাদ: রাকেশকুমার দাস
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মূল গল্প: The Songs That Humanity Lost Reluctantly To Dolphins
এমপ্যাথোলজি বা সমবেদনতত্ত্বটা ডলফিনরাই আমদানি করেছিল। আমরা নই। আমরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি কী বিপদ উপস্থিত। আমরা তার প্রতিরোধ করেছি, লড়েছি, কখনও কান্নাকাটি করেছি, কখনও স্রেফ এড়িয়ে গেছি। আমরা মজাও করেছি এ নিয়ে। কিন্তু যখন কোনো কিছুতেই কাজ হল না তখন আমরা ক্ষেপে গেলাম। চেপে রাখা ভীষণ রাগে কেঁপে উঠল আমাদের মেগাসিটিগুলো, দুলে উঠল শহরতলির বাড়িঘর। আমাদের প্রধানমন্ত্রীরা, আমাদের রাষ্ট্রপতিরা, আমাদের মোল্লা এবং পুরোহিতরা তাদের বুলেটরোধী টাওয়ার থেকে গর্জে উঠল, তাদের থুতু ছিটকে লাগল মাল্টিস্ক্রিন মাইক্রোফোন, দূরস্থিত ক্যামেরা ও স্ক্রিনের উপর। আমরাও ছেড়ে কথা কইলাম না, প্রচণ্ড রাগে তাদের বিশ্বাসঘাতক, ভিনগ্রহী, রাক্ষুসে ইত্যাদি নাম দিয়ে ইন্টারনেট আর রাস্তা ভাসিয়ে ফেললাম।
আমরা এটা মেনে নিইনি প্রথমে, বুঝলি সোনামণিরা? আমাদের মেগাসিটিগুলির নিয়মই হচ্ছে ভোগ করো এবং কারোর ভোগে লাগো। খেলনা, অত্যাধুনিক গ্যাজেট আর মোটা গাঁথনির দেয়াল ঠুসে ঠুসে আমাদের হৃদয় ভরতি করেছি। মেকি চামড়ার সোফা, পেন্টহাউস আর ফেরারি পান করে তৃষ্ণা মিটিয়েছি। ওষুধ গিলেছি, নস্যি টেনেছি, এ-আই বসানো সোনা-মোড়া স্পিকারের ভলিউম তেড়ে বাড়িয়েছি। আদিম অরণ্যের বাঁধানো চিত্র দিয়ে নিজেদের ঘিরে রেখেছি, নিজেদের এ-আই নির্মিত ল্যান্ডস্কেপ আর নকল জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে সেলাই করে সাঁটিয়ে নিয়েছি। নিজেদের সুরক্ষিত রেখেছি ট্রেডমার্কওয়ালা প্রো-রিয়াল প্রযুক্তির গিলটি করা সিলিকনেট স্ক্রিন দিয়ে চারপাশ ঘিরে রেখে।
হৃদয়ের সর্বভুক খিদেই সারাক্ষণ আমাদের চালিয়ে বেড়ায়, নিয়ন্ত্রণ করে। আসলের মতো দেখতে এ-আই ফিড আমরা ঠুসে গেছি মুখের ভেতরে আর মাংসল শরীরে—যতক্ষণ না আমাদের শ্বাসনালী ফুলেফেঁপে ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়, যতক্ষণ না আমাদের গ্রহটির হাড়-চামড়া, রক্ত আর ধমনীগুলি প্রকট হয়ে ওঠে। আমাদের প্রয়োজন, চাহিদা, বাসনা আর সিলিকন স্ক্রিন চোখ অন্ধ করে রেখেছিল… আমাদের সবার চোখ, সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চোখ—সে পুরুষ হোক বা নারী। আমরা এইভাবেই বড়ো হয়ে উঠেছিলাম।
তোদের মতো ছোট্ট ছোট্ট শিশুরাই আমাদের থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করেছিল, বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল।
***
এটা শুরু হয়েছিল একদম নিঃশব্দে, আমরা শুরুতে খেয়ালই করিনি।
ইন্দোনেশিয়ার ছোট্ট মাছ ধরার গ্রাম ওয়েটার দ্বীপ, যেখানে আমাদের লোভ আর আকাঙ্ক্ষার টানে ফুলে-ফেঁপে ওঠা জলবায়ু দূরে সরিয়ে দিয়েছিল বালি, সেখানেই শিশুরা হামাগুড়ি দিয়ে যেতে শুরু করেছিল আর তাদের থেকে একটু বড়ো বাচ্চারা টলোমলো পায়ে হাঁটা লাগিয়েছিল। তারা সবাই সমুদ্রের দিকে রওনা দিয়েছিল, যেন তারা তাদের মায়ের দুধ খুঁজতে চলেছে। তাদের অনেককেই টেনে নিল সমুদ্রের ঢেউ যাদের আর কোনোদিন দেখা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তাদের কাউকে কাউকে আবার আমাদের মতো আতঙ্কিত মায়েরা টেনে আটকে রেখেছিল যারা ব্যাপারটা তখনও বুঝতে পারেনি।
এরকম ঘটনা বারবার হতে লাগল ভারত আর মালয়েশিয়া আর চিলি বা মোজাম্বিকের উপকূলবর্তী মাছ-ধরার গ্রামগুলিতে। প্রত্যেকদিন, সকাল থেকে রাত, গভীর রাত থেকে ভোর, বাচ্চারা হামাগুড়ি বা টলোমলো পায়ে চলতে লাগল। তাদেরকে হয় চেন দিয়ে বেঁধে রাখতে হচ্ছিল, নয়তো দরজা বন্ধ করে সিমেন্টের দেওয়ালের ভেতরে বন্দি করে রাখতে হচ্ছিল। তারা ইটের দেওয়ালে আছড়ে কামড়ে চিৎকার করে যাচ্ছিল, দরজায় লাথি মারছিল আর একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছিল। ক্রুদ্ধ তারা ছিল না, ছিলাম আমরা—তারা ছিল কেবল তাদের সংকল্পে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মাথায় যেন কোনো পোকা গুঁড়ি মেরে ঢুকে গেছে, আর তাদের ডেকে চলেছে সেই কানায় কানায় ভরে ওঠার দূষিত সমুদ্রের পানে।
ক্লাব ও পার্লামেন্টের সদস্যরা সিলিকনেটের গম্বুজ আর ল্যান্ডস্কেপ করা মুক্ত স্থানের মধ্যে বসে জানালো যে এসব ঘটনা যে ঘটেছে তার কারণ বিশৃঙ্খল ও অরক্ষিত জঙ্গলে থাকা গ্রামবাসীরা নেহাতই গণ্ডমূর্খ, তাদের মতো গোবেচারাদের সহজেই প্রভাবিত করা যায়। শত্রুরা লোভ দেখিয়ে তাদের বাচ্চাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আহা তাদের যদি ক্লাস আর পেন দেওয়া যেত! তাদের কিছু শব্দ আর সানস্ক্রিন দেওয়া যেত! আহা তারা যদি এত অলস না হয়ে একটু পয়সা রোজগার করত—তাহলে তারা কাচের গম্বুজ-ওয়ালা খামার আর আধুনিক ছাঁচে-ঢালা সুরক্ষাপর্দা কিনতে পারত! আহা যদি তাদের বাচ্চাদের ত্বক যদি তুষারের থেকেও শুভ্র হত, যেমন ত্বক শহরের বাচ্চারা পেয়ে থাকে!
মেগাসিটি হলে এরকম ঘটনা কিছুতেই ঘটত না যেখানে শিক্ষিত মানুষরা বসবাস করে। জীবাণুমুক্ত গ্যালারি আর রাসায়নিক-ধোয়া ঝকঝকে স্ক্রিন ভরা সেইসব শহর। শহুরে এলাকা কাচের দেয়াল দিয়ে বিভক্ত, এককালীন-ব্যবহার্য গ্লাভস আর মাস্ক দিয়ে সুরক্ষিত। শহরের বহুতলগুলি জিনবিচারে নির্বাচিত ও সভ্য জনগণে ভরতি। এসব ঘটনা উত্তর আমেরিকা বা পশ্চিম ইউরোপের সাদা দেওয়াল ঘেরা শহরগুলিতে হতেই পারে না—রাসায়নিক দিয়ে জেল করা সেলুনদুরস্ত চুলে মৃদুমন্দ বাতাস খেলে যাওয়ার সময়, আত্মতৃপ্ত হাসি নিয়ে এটাই জানালো পরাক্রমশালী ক্লাব ও স্থানীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা।
তারপর একই ঘটনা ঘটতে শুরু করল উত্তর আমেরিকাতে আর জার্মানিতে, স্পেনে, ইথিওপিয়া আর লাইবেরিয়াতে—সব জায়গায়। গম্বুজওয়ালা মেগাসিটির সুউচ্চ বহুতল থেকে যেখানে কাস্টমাইজড বাচ্চারা হামাগুড়ি বা টলমল পায়ে হেঁটে যেতে শুরু করল অন্যদের সঙ্গে, পাহাড়ের ঢাল বরাবর। কখনও খিলান দেওয়া গাড়িবারান্দা থেকে, কখনও সুনামি-রোধক জাহাজঘাটা থেকে, কখনও সাদা, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া প্রবাল-সৈকত থেকে বা মানুষ ও আবর্জনায় উপচে ওঠা সমুদ্রতট থেকে—তারা টুপটাপ খসে পড়ছিল সমুদ্রে। কেউ এল লাফিয়ে, কেউ উড়তে উড়তে, কেউ ডুব দিয়ে, কেউ লুকিয়ে-চুরিয়ে পা টিপে টিপে বা দৌড়ে। চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে সবাই যাচ্ছিল সেই গভীর জলের পানে।
“কী শুনছ বলত সোনা?” কোচির কোনো এক প্রাচীরঘেরা ঝাঁ-চকচকে শপিং কমপ্লেক্সে ছেলের হাত আঁকড়ে কেঁদে ওঠে অসহায় মা।
“সেই গানটা, আম্মা, সেই গানটা,” ছেলে উত্তর দিল, তবে ততক্ষণে ছেলেটি আর মায়ের আগের সেই সন্তান ছিল না।
“কী গান বাবা? কী গান? আমাকে বল একটু,” ছেলের মুখটা টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল মা।
ছেলে মুখ ঘুরিয়ে মা-কে একবার দেখল একবার, একবার চোখ সরিয়ে নিল, একবার কিছু শোনার চেষ্টা করল, কিন্তু মায়ের কোনো গান শুনতে পেল না।
“মা ভয় পেও না, তুমিও গানটা গাও না।”
আমরা ছিলাম ভীত, স্তম্ভিত, আর সন্তানহারা। কী ঘটে চলেছে কিছুই জানতাম না। রাতারাতি শিশুরা যেন হয়ে পড়ছিল সম্পূর্ণ অচেনা, একেবারে যেন অন্য গ্রহের প্রাণী, সেই অলুক্ষুণে গান তাদের প্রলুব্ধ করে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তাদের শরীরে ওষুধ আর মস্তিষ্ক-সংশোধক ঢুকিয়ে ঘুম পাড়ানোর অনেক চেষ্টা করা হল, তাদের হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা, স্লিপিং বিউটি আর সমুদ্রের গভীরে বাস করা জলদানবের গল্প শোনানো হল অনেক। টাকা দিয়ে বিশেষজ্ঞ ভাড়া করে আনা হল, সেক্রেটারিরা মুখের ঝাল খেল, স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেল, শহরের প্রাচীরের খ্যাতি আর তার অপর্যাপ্ত বেধের নিন্দামন্দ করা হল। দরজায় তালা ঝুলিয়ে, সুরক্ষা-জাল বানিয়ে, কাচ-দেওয়াল আর সিসিটিভি একের পর এক বসিয়ে গেছি আর চিৎকার করে গেছি যতক্ষণ না স্বর্ণাবৃত স্ক্রিন থেকে আমাদেরই দম ফুরিয়ে হাঁপানোর শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসতে লাগল। ঈশ্বর এবং স্থানীয় মস্তান—উভয়ের কাছেই অর্পিত হল আমাদের প্রার্থনা। দূষিত সমুদ্রের পিশাচের হাত থেকে ঝাড়াতে বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম মন্দির আর গির্জাগুলোতে। কী হয়েছে সেটা আমরা মোটেই বুঝতে পারছিলাম না, আর সেটাই আমাদের আরও ভয় ধরিয়ে দিচ্ছিল আর সেই ভয় থেকেই আমরা ক্রুদ্ধ থেকে ক্রুদ্ধতর হয়ে উঠছিলাম, যতক্ষণ না নখের পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল।
আমাদেরই মধ্যে একজন যে কিনা অধুনা-বিলুপ্ত চাদ রাজ্যের একজন বালুবা (আফ্রিকার প্রাচীন জনগোষ্ঠী) ছিল, কোনো এক রাতে সবাই মিলে উন্মুক্ত কর্কটগ্রস্ত নক্ষত্ররাজির তলায় বসে থাকার সময় শুনতে পেল তিমিদের গান। অন্তত এরকমই তারা দাবি করেছিল। কেউ ছিল না আমাদের পাশে, সবাই প্রচণ্ড ভয়ে পেয়ে ছিলাম, অসহায়ভাবে দেখছিলাম কীভাবে আমাদের বাচ্চারা ঢেউয়ের মেলায় তলিয়ে যাচ্ছে। বালুবা চোখ বন্ধ করে সেই পিশাচের গান ফিসফিসিয়ে গেয়ে ওঠে, প্রথমে পাশাপাশি তারপর আগুপিছু মাথা দোলাতে দোলাতে। শক্তি-সাশ্রয়কারী স্ক্রিনের সামনে আঠার মতো লেগে ছিলাম কেনই বা সমুদ্রের সেই গান আমাদের বাচ্চাদের ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে। সেই গানের সরাসরি সম্প্রচার আমরা শুনেছিলাম, বালুবার মুখ থেকে বেরনো প্রতিটা ফোঁসফাঁস আর ঘুৎকার আমাদের কানে লেগে ছিল। কান জানিয়ে দিয়েছিল এ মোটেই সঙ্গীত নয়, চড় বা চাবুকের মতো এটা ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক একরকমের অনুভূতি।
স্বাস্থ্যসচেতন চেয়ারগুলিতে সোজা হয়ে বসে বা সোফায় গড়িয়ে গড়িয়ে আমরা বারবার সেই গানের তর্জমা শুনে গেলাম। তাদের বজ্রাঙ্কিত মুখগুলি জ্বলজ্বল করছিল বড়ো বড়ো স্ক্রিনে, যা কি না সেই গানের কথা আর অনুবাদে ভরতি হয়ে ছিল। তারা আমাদের বুঝিয়ে বলছিল সেই কথা যা ডলফিনদের অন্তর ফিসফিস করে গেয়ে শুনিয়েছিল তিমিদের। জানতে পারলাম সব নাকি শেষ! তবে শুধু তিমি নয়, ব্যাং আর টিকিটিকিরা, আমগাছের সারি আর জোঁকের দল, হরিণ আর বটগাছের শিকড় আর লাদাখের বরফ-শীতল বালির সমুদ্রে পড়ে থাকা নিশ্চল শিলাখণ্ডও যোগ দিয়েছে সেই গানে। ভাইরাসের মতো খবর ছড়িয়ে পড়ল এক স্ক্রিন থেকে অন্য স্ক্রিনে, এক শহর থেকে অন্য শহরে—অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের থেকেও দ্রুতগতিতে, সুনামির থেকেও প্রবলতর বেগে, খাড়া পর্বতগাত্র থেকে গলন্ত বরফের চাঙর খসে পড়ার থেকেও জোরে।
এ এক মনোরাসায়নিক বিক্রিয়ক, মনকে পরিবর্তন করতে পারে এমন এক দাওয়াই—এক পক্ককেশ বিজ্ঞানী এমনটাই জানাল কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ মেগাসিটির সুউচ্চ সফেদ ল্যাব থেকে দারুণ বিজয়োল্লাসে—কিলবিল করতে থাকা বন্দি সেই সব সংক্রমিত বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। “এই গানগুলি তাদের সংবেদনশীল মনকে সম্মোহিত করে, তাদের নিউরোনকে সংক্রমিত করে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করে আর এর মাধ্যমে তাদের মনে প্রবল সমবেদনার অনুভূতি তৈরি করে,” ডাক্তারদের এক বার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার মতো সবকিছু-ঢাকা পোশাকের ভিতর থেকে যুক্তি ছড়িয়ে দিলেন আমাদের স্ক্রিনে স্ক্রিনে। “আমরা এটাকে বলি এমপ্যাথোলজি। এটি ব্যক্তি অধিকার আর মুক্ত ইচ্ছার পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। যে কোনো মূল্যে বাচ্চাদের থামাতে হবে আমাদের। আমরা এর জন্য আলাদা করে প্রতিষেধক বানানোর কাজ শুরু করব।”
শেষ পর্যন্ত আমরা জানতে পারলাম ঘটনাটা কী ঘটে চলেছে। আমরা চিনতে পারলাম আমাদের শত্রু, একটা শব্দ, এমন একজন যে আমাদের উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে চেষ্টা করছে, আর সেটি হল এই ‘এমপ্যাথোলজি’ বা সমবেদনতত্ত্ব। এই অস্ত্রই ডলফিনরা প্রয়োগ করেছে সজীব এবং নির্জীব উভয়ের উপরে।
হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। তাহলে ডলফিনরাই আমাদের শিশু, আমাদের সন্তানদের চুরি করছে। এই সমবেদনার গান শুনিয়ে তাহলে এরাই সব চক্রান্ত করেছে। আসল শত্রু তাহলে এরাই। আর আমরা কি না এদের বন্ধু ভাবতাম, এই আদুরে, বুদ্ধিমান প্রাণীগুলোকেই আমরা চাইতাম রক্ষা করতে, তাদের বাঁচিয়ে রাখতে, জড়িয়ে ধরে আদর করতে আর তুলোভরা নরম খেলনা তৈরি করতে। আর আজ কীভাবে সেই তারাই আমাদের যাবতীয় বিশ্বাস ভেঙে গুড়িয়ে দিল! আমাদের না জানিয়ে, অনুমতি না নিয়ে আমাদের পৃথিবীটাই তারা দখল করে নিতে চলেছে আমাদের সন্তানদের নষ্ট করে দিয়ে। এতদিন ধরে তারা সমুদ্রের গভীরে চক্রান্ত করে গেছে, জৈব অস্ত্র তৈরি করেছে যার দ্বারা শুধু আমরা না, পৃথিবীর অন্যান্য প্রজাতিও আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের জীবনযাত্রা আর মেগাসিটিগুলোকে ধ্বংস করে দেয় এমন ওদের খুনে মনোবৃত্তি! এতটা স্বার্থপর ডলফিনরা!
যুদ্ধটা বেঁধেই গেল।
আমাদের বহুস্তরে সাজানো সবুজঘেরা শহরের মধ্যে আমরা দাপাদাপি করতে লাগলাম, ক্রোধের চোটে আমাদের ধমনীর মধ্যে অ্যাড্রিনালিন ছুটতে লাগল প্রবল বেগে। ছাঁটাই করা ঝুলন্ত বাগানগুলি আমরা উপড়ে ফেললাম, কৃত্রিম গাছগুলির গুঁড়ি সর্পিল প্যাঁচের মতো আঁচড়ে দিলাম। বড়ো বড়ো অ্যাকোয়ারিয়ামের সুরক্ষায় থাকা, লম্বা কাচের ঝিকিমিকির মধ্য দিয়ে তাকিয়ে থাকা, রঙিন বাসিন্দাদের চোখে চোখ রাখলাম। “ওই যে, ওরাই” স্যুটপরা আমাদেরই একজন চেঁচিয়ে বলল। ভদ্রলোক তাড়াতাড়া কাগজের নোটভরতি ব্যাংক চালায়। ব্যাট চালিয়ে সে কাচে ফাটল ধরিয়ে দিল। মৃগীতে পাওয়া স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ মাছগুলো আমাদের ভিজিয়ে দিল, পবিত্র তুষারপাত যেমন ভেজায় আমাদের গা। অ্যাকোয়ারিয়ামের যত জানলা দেখা গেল আমরা সব ভাঙতে লাগলাম। যেখানেই কাচের জানালা দেখলাম সেখানে ডাণ্ডা মেরে, ড্রিল মেশিন চালিয়ে, বন্দুক দিয়ে গুলি করে, নিদেন ফুলদানি ছুড়েও ভাঙতে লাগলাম। রাগ যেটুকু বাকি পড়ে ছিল তা দিয়ে শুকোতে থাকা মাছগুলোকে পিটিয়ে ভর্তা করে দিলাম। উন্মত্ত জনতা মিলে দলবদ্ধভাবে কিলবিল করতে থাকা একটা ডলফিনের পিছল শরীর থেকে মাথাটা কুপিয়ে আলাদা করে দিলাম।
কাটা মাথা থেকে কাঁচা রক্ত খেতে খেতে স্যুট পরা লোকটি গর্জন করে ওঠে স্ক্রিনে “এটা আমাদের যুদ্ধ!” মুখ থেকে লালসামাখা উল্লাস ঝরে পড়তে থাকে। “হ্যাশট্যাগ #ডেথটুডলফিন্স!”
হ্যাশট্যাগটি ট্রেন্ড হল, বিশাল নিয়নের সাইনবোর্ডেও উঠে এল, তার আলোর ঝলক আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। এতেও আমাদের পেট ভরল না। আমরা দাবি রাখলাম আমদের নেতাদের কাছে, প্রধানমন্ত্রীদের কাছে, গুরু আর রানিদের কাছে – সমুদ্র জ্বালিয়ে দাও, পরমাণু বোমা ফেল, প্রতিটা ডলফিনকে কচুকাটা করে মার। তাদের মাথা কেটে আমাদের হাতে দাও, তাদের মাংসে পেট ভরিয়ে আমাদের জ্বলন্ত প্রতিশোধস্পৃহাকে যেন কিছুটা ঠান্ডা করতে পারি। “আর তাতে স্টু হবে দারুণ!” আমাদের স্যুটপরা নব আবিষ্কৃত অনলাইন স্টার হাসতে হাসতে বলেছিল।
“সমুদ্রে বোমা ফেলবেন না! আমাদের বাচ্চারা আছে ওখানে!” হারানো বাচ্চাদের পিতামাতারা চিৎকার করে বলল।
অন্য পিতামাতারা আর রাজনীতিবিদরা তাদের বোঝাল, “তোমাদের বাচ্চারা তো মরে গেছে।” তাদের বাচ্চারা যখন দেওয়ালে আঁচড়াচ্ছিল তখন তাদের ঘরে তালায় চাবি লাগাতে লাগাতে তারা বলল, “যারা এখনও বেঁচে আছে আমাদের তাদের বাঁচাতে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের উপকার হবে তাতে।”
মিলিটারি আর অন্যান্য বাহিনী সাজিয়ে তুলল তাদের কামান, সাজাল তাদের স্যাটেলাইট আর বোমা। মেগাসিটিগুলোতে যে কনট্রোল সেন্টারগুলি আছে সেখানেও তারা কিবোর্ড, স্ক্রিন আর ড্রোন বাগিয়ে বসল। পক্ককেশ বিজ্ঞানী ল্যাবে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে লাগল। লক্ষ্য ছিল এমন কিছু কৌশল বের করা যাতে মিসাইল শুধু ডলফিনদের দলকেই লক্ষ করে ছোড়া যায় আর তাদের নির্বংশ করা যায়। নানা ভাষায় সবাই চেঁচাতে লাগল, “কচুকাটা কর ওদের, ধ্বংস কর ওদের”। বিজ্ঞানী ও সেনাপ্রধানরা চব্বিশ ঘণ্টা কাজে ডুবে রইল, কোথায় কোথায় ডলফিনদের আস্তানা সেগুলোর তথ্য জোগাড় করতে লাগল। ষাঁড়, গোরু-বাছুরের উপর বোমা মারা হল। একটা দল শেষ। কাম তামাম!
আমরা বদলা চাইছিলাম। যারা আমাদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, আমাদের শহরগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়েছিল সেই সব প্রাণীদের আমরা মেরে নির্মূল করে ফেলতে উদগ্রীব ছিলাম। আমরাই যুদ্ধে জিতব—বোমা, প্রতিষেধক, দেওয়াল, আর গণবিধ্বংসী অস্ত্রনির্মাণের কাজ যত এগোচ্ছিল ততই আমরা আকাশ ফাটিয়ে উল্লাস করছিলাম।
আমরা কতই না ভুল ভাবছিলাম।
***
যেদিন ছত্রাকরাও গান গাইতে শুরু করল সেদিন থেকে ফেরা শুরু হল। আমাদের ক্যালেন্ডার অনুসারে সেটা সপ্তম দিন। আমাদের বাচ্চারা যারা টলমল করে হেঁটে, হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিল, তারা আবার ফিরে আসতে শুরু করল। আমরা স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম, মনে মনে যেমন কৃতজ্ঞ হয়ে গেছিলাম তেমনি কিছু বুঝতে না পেরে প্রবল শঙ্কিতও ছিলাম।
তোদের সবার মতো, বাচ্চাগুলো আমাদেরই ছিল, কিন্তু একেবারে অন্যরকম। চোখ অর্ধেক বোঝা, সাগরের নীল রং যেন চোখ থেকে ঠিকরে আসছে, ঘর্মগ্রন্থি পরিণত হয়েছে ফুলকায়, চামড়ায় পড়েছে ছত্রাকের আস্তরণ। তারা আমাদের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে সুন্দর স্মিত হাসি হাসল।
কিন্তু তারা কথা বলতে পারল না। তারা আর কথা বলত না। কী হয়েছে সমুদ্রের অতলে, ডলফিনরা তাদের নিয়ে কী করেছে, তার কিছুই জানাতে পারল না। আমাদের মেগাসিটিতে তারা খালি পায়ে হেঁটে এল, আই-মেইড (iMaid) দিয়ে পরিষ্কার করা রাস্তাগুলোর উপর বালির আঁকর এঁকে দিয়ে গেল।
গায়ের কাদা পরিষ্কার করতে দিল না তারা, খাবারদাবারও প্রত্যাখ্যান করল, আমাদের দেওয়া বিছানা আর ওষুধও গ্রহণ করতে অস্বীকার করল। চকচকে কাচের গম্বুজ আর মোটা দেওয়ালের মধ্যে তাদের দমবদ্ধ লাগছিল, তারা এর বাইরের বিশৃঙ্খল এবং অনুর্বর বন্য পরিবেশের নোংরার মধ্যেই থাকতে বেশি পছন্দ করছিল। জ্বলন্ত সূর্যের নীচেই তারা শুয়ে পড়ল, নোংরা শীতল মাটির উপরেই শুয়ে রইল ঘাস আর গঙ্গাফড়িং আর ভাঙা বটগাছের শিকড় আঁকড়ে; আর ছত্রাকরা তাদের দেহের উপর নতুন শহর বানাতে লাগল।
ঘাসের বাঁধন ছিঁড়ে তাদের মুক্ত করে আনলাম আর গা থেকে ছত্রাক পরিষ্কার করেদিলাম শুধুমাত্র তাদের শহরের ঝাঁ-চকচকে গাড়ি আর স্ক্রিন দেখানোর জন্য। তারা কেবল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, ছোট্ট ছোট্ট সবুজ মুখগুলো মনে হল জীবন্মৃত, পেলব ঠোঁটগুলো কী যেন গান গাইছে যা আমাদের কান শুনতে পায় না।
“জানোয়ারগুলো আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে কী করেছে?” আমরা চিৎকার করলাম। অজানা ভয় আমাদের শিরায় শিরায় প্রবল ক্ষোভ ছড়িয়ে দিয়েছিল।
“শয়তান ভর করেছে বাচ্চাদের, ওরা এখন অশুভ।” বলল যাজক, গণক আর মোল্লা যত ছিল।
“এরা মানুষ ২.০ ভার্সন…”
“আরে এরা স্রেফ নোংরা ছত্রাকের ডেলা, পুড়িয়ে দাও…”
“ভিনগ্রহী কোনো প্রজাতি…”
“সংক্রমিত…”
“ওরা সব শুনছে…”
“ওরা আর মানুষ নেই,” বলল বিজ্ঞানীরা। “ওদের ডিএনএ বদলে গেছে, এমপ্যাথোলজির আবেগ ওদের এখন নিয়ন্ত্রণ করে।”
“ওগুলো হাইব্রিড গাড়িতে পরিণত হয়েছে,” চকচকে দাঁতের মধ্য দিয়ে হাসতে হাসতে বল স্যুটপরা লোকটা।
তোদের সঙ্গে, আমার সোনামানিকরা, ছত্রাক আর শৈবালরা এসেছিল আমাদের শহরে। সমস্ত মেগাসিটি জুড়ে ক্রমে গড়ে ওঠে ইস্ট, ছাতা আর মাশরুমের মিথোজীবী সংসার, ঢেকে ফেলে আমাদের দেওয়াল আর ভাস্কর্য, সঙ্গে আনে যত পোকামাকড়, গাছপালা আর পিঁপড়ে। ছত্রাক কিন্তু বাড়তেই থাকল। অ্যাকোয়ারিয়ামের ভাঙা কাচের দখল তারা নিয়ে নিল, ম্যানিকুইন আর বড়ো বড়ো স্ক্রিনও ঢেকে গেল তাদের বসতিতে। চকচকে গম্বুজও ছাতা লেগে কালচে পড়ে গেল আর শৈবালের চাপে তাতে দেখা দিল ফাটল। সেই ফাটল দিয়ে ঢুকে পড়ল অতিবেগুনি-বোঝাই ঝলসানো বাতাস।
এরা চড়ে বসল আমাদের শহরের মসৃণ দেওয়ালগুলিতে, ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে গেল ফাঁকফোকর দিয়ে আর অফিসগুলোর দেওয়ালে ফাটল ধরিয়ে। সেই স্যুটপরা লোকটির আঠেরো-তলার অ্যাপার্টমেন্টেও তারা পৌঁছে গেছিল। তাকে বাথটাবে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় একদিন, গলাটা কেউ চিরে দিয়েছে। জমাট বাঁধা রক্ত আর একটি দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া কাগজের চারপাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে ছত্রাক বসে ছিল। সেই কাগজটায় লেখা ছিল, “ফুলকা নেই তোমার?”।
বিভ্রান্ত হয়ে তোদের টেনে ঘরে আনতে চাইলাম, গা থেকে ছত্রাক সব ফেলে দিয়ে। কত ঘসলাম আর মাজলাম আর পরিষ্কার করে মুছে দিলাম। আমরাও লড়তে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমাদের মন বড়োই বেদনার্ত ছিল। যখন দেখতাম তোরা, আমাদের সোনারা, উদাসভাবে শূন্যদৃষ্টি দিয়ে আমাদের শহরের ধাতুর তৈরি আশ্চর্য নির্মাণগুলির দিকে তাকিয়ে আছিস, আমাদের সব ক্রোধ যেন অসহায় হয়ে পড়তে লাগল। প্রথমে আমরা, তারপর ক্লাব ও সংসদের সদস্যরা আর জমির মালিক – সবাই একে একে ত্যাগ করল তাদের দীপ্ত অহংকার। ব্যাপক উৎপাদনের শিল্প-কারখানা আমরা বন্ধ করে দিলাম, ফেলে দিলাম আমাদের গাড়ি, রং করা দেওয়ালগুলি ছেড়ে রাখলাম ছত্রাক গজানোর জন্য, বিছানায় শুয়ে রইলাম মৃত ফোনগুলির সঙ্গে। আমরা বিক্ষোভ, বোমা, মিসাইল, বিজ্ঞানী—এই সব কিছু অতিক্রম করে এসেছিলাম।
ছোট্ট সোনামণিরা, তোরা আর আমাদের বাচ্চা ছিলিস না। আমরা ছিলাম বিরক্ত, ক্ষিপ্ত—আর কষ্টও কম পাচ্ছিলাম না আমরা। আমাদের চারপাশের মনুষ্যনির্মিত বাসনার জগৎ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। যে গান বেঁধেছিলিস ডলফিনদের সঙ্গে, ব্যাঙের সঙ্গে, ভাঙা বটগাছ আর ছত্রাকের সঙ্গে, তার শিকড় ফাটিয়ে দিল আমাদের ইট-দেওয়াল আর কংক্রিটের রাস্তাগুলোকে, হামাগুড়ি দিয়ে উঠে গেল গগনচুম্বী অট্টালিকা আর কাচের গম্বুজে, তার নীরব আঙুলগুলি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল দুর্গন্ধময় নর্দমাগুলিকে। কাঁপতে থাকা স্ক্রিন থেকে ফাটা আওয়াজে শোনা গেল বালুবা বলছে, “এটাই আসল সবুজ বিপ্লব।”
ভগ্নহৃদয়ে আমরা তোদের পাশেই বসে রইলাম। তোরা, আমাদের ছাতাপড়া সন্তানরা, চুপচাপ শুয়ে ছিলি আকাশের দিকে তাকিয়ে। তোদের পিটপিট করা চোখ একবার খুলছিল, একবার বন্ধ হচ্ছিল। নগ্ন চামড়া দিয়ে তোরা ছুঁয়েছিলিস গাছের শিকড়, হাতে ধরেছিলিস ব্যাং আর তোদের ঠোঁট বিড়বিড় করে গাইছিল শব্দহীন গান। চোখের সামনে তোদের জড়বস্তুর মতো পড়ে থাকতে দেখে আমাদের যত ক্রোধ সব গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে মিশে গেল হতাশার বাতাসে। তোরাই তো ছিলিস আমাদের আশাভরসা, আমাদের ভবিষ্যৎ। আমরা যদি তোদের ফিরিয়ে না আনতে পারি তাহলে আমরা তো পারি তোদের সঙ্গে যোগ দিতে? এই এমপ্যাথোলজি জিনিসটাই বা কী? কেউ কি পারবে আমাদের সঙ্গে ডলফিনদের কথা বলিয়ে দিতে? আমরা চেয়েছিলাম এর ওষুধ, আমরা চেয়েছিলাম সেই গান, চেয়েছিলাম তোদের জগতের, তোদের যৌথ পরিবারের একটা অংশ হতে। পরিবর্তনের জন্য আমরা তৈরিও ছিলাম। আমরাও সেই গান গাইতে চেয়েছিলাম তোদের সঙ্গে—তোদের সঙ্গে আর ডলফিনদের সঙ্গে, ছত্রাক আর ব্যাঙেদের সঙ্গে। আমাদের ভবিষ্যৎ ছাড়া আমরা একদম যে একদম একা সেটা অনুভব করলাম।
নোংরা কোট পরা পক্ককেশ বিজ্ঞানী একগুঁয়ের মতো তখনও ঘেরা ল্যাবে কাজ করে যাচ্ছিল। সে-ই এক রাস্তা বাতলে দিল। “এই যে, এই জিন বদলানোর ওষুধ দাও দেখি এদের,” শ্যাওলা-পরা বোবা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল। “এতেই গান গাওয়া যাবে, আপনাদের সমবেদনার মাত্রা বাড়িয়ে দেবে এই ওষুধ।” তার এই বকবক আমরা কেউই শুনিনি, আমাদের হৃদয়ের মতোই স্ক্রিনগুলো পড়ে পড়ে গলে যাচ্ছিল ঝলসানো ঝোড়ো হাওয়ায়। মরিয়া হয়ে আমরা সেই পাগলির কাছে ছুটলাম যে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার কাছে একটা লাইট পোস্টের নীচে ঘুমাত। বছরের পর বছর ধরে এই পাগলি, যার নাম আমরা জানতাম না, এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে চিৎকার করে গেয়ে গেছে সেই গান অবিরাম, যে গান তাকে দিয়ে গেছে ঢেউ—প্লাস্টিকের বোতল, ভাঙা মগ আর ভাসমান জঞ্জালের ভারে ভারাক্রান্ত সমুদ্রের ঢেউ। সমুদ্রগর্ভের প্রবালরাজি বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল, ডাঙার সব সবুজ হারিয়ে গেছিল—আমাদের ভোগস্পৃহার প্লাস্টিকে তারা দম বন্ধ হয়ে মরছিল। আর তাদের ক্রুদ্ধ আর্তনাদ, আর অসহায় মরীয়া প্রচেষ্টা—সবই প্রমোদতরীগুলোর নীচে জলে মিশে যাচ্ছিল। আমাদের ঝাঁ-চকচকে ঠান্ডা গাড়িতে আর প্লাস্টারমোড়া গম্বুজের পেল্লায় দেওয়ালের ভিতর এসব কিছুই আমরা শুনতে পেতাম না।
“ডলফিনদের আর কিছু করার ছিল না,” ফোকলা দাঁতের মধ্য দিয়ে সুন্দর হাসি দিয়ে পাগলি বলল। “এই গানই মানুষের সংক্রমণ থেকে পৃথিবীকে বাঁচাবে। এমনকী তোমার পেটের ভিতরে থাকা ব্যাকটেরিয়াও এই গান গাইছে, তারাও ডলফিনদের সঙ্গেই আছে। তোমরাও সেই গান শোন, তাদের সঙ্গে যোগ দাও।”
“কীভাবে?” আমরা জিজ্ঞাসা করলাম। জন্ম থেকেই যারা বধির, প্রাচীরবন্দি তারা কীভাবে এই সমবেদনার গান আবার শুনতে পারবে?
প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা, মধ্যরাত থেকে ভোর—তোদের দেখছিলাম নিরাবরণ আকাশের নীচে তোরা ঘুমাচ্ছিস আর তোদের ছোটো ছোটো হাতে ধরা আছে বটগাছের শিকড়, আর্দ্র হয়ে রয়েছে তোদের ত্বক, ছত্রাকের কোমলতা লেগে রয়েছে তোদের সবুজ শরীরে। আর সারাটা ক্ষণ সেই নিঃশব্দ গানের সুরে সুরে তোদের ঠোঁট নড়ছে আর চোখ পিটপিট করছে। আমরা শুনতে মরিয়া ছিলাম, কিন্তু সেই গান আর শুনতে পেলাম না, বধিরই রয়ে গেলাম।
আমরা বুঝতেই পারছিলাম তোরা শুনতে পাচ্ছিস সেই গান, যে ছন্দ এই পৃথিবীর বুকে এনেছে গভীর সমুদ্রের প্রাণী ও অন্যান্য সজীব ও নির্জীব বাসিন্দারা। এই গান মহাবিশ্বের গান, আকাশের গান, পৃথিবীর গলিত ফুটন্ত অন্তঃকরণের গান। আমরাও শুনতে চেয়েছিলাম সেই গান, কিন্তু আমরা সেই ভীতই রয়ে গেলাম, হিমশীতল রয়ে গেলাম আমাদের একাকীত্বের জঠরে।
কিন্তু আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, এখনও আছি। আমরা এখনও ছত্রাকের বিছানায় তোদের সঙ্গে শুয়ে থাকি, অচেনা মাশরুমদের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকি না জানি কখন আমাদের চারপাশে বেড়ে উঠে আমাদের যা ছিল সব দখল করে নেবে। তোদের শ্যাওলাপড়া হাত চেপে ধরে থাকি, পিঁপড়েধরা চটচটে কপালে চুমু খাই। তোদের মঙ্গল কামনাই করি, আদরের সোনামণিরা, তোরা আর কোনোদিন আমাদের হয়ে উঠবি না সেটা জেনেই। আমরা সেই গানের অংশীদার নই, কিন্তু আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি সেটা শুনতে। কানে রক্ত উঠে না আসা পর্যন্ত আমরা শুনে যাব, আমরা এতে দৃঢ়সংকল্প। তোরা যে গান গাইছিস, যে গান শুনছিস, সেই গান একদিন শুনতে পাব নিশ্চই , তোরা যে গানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছিস সেই গানের সঙ্গে মিলেমিশে এক না হয়ে যাওয়া অবধি আমাদের এই অনুসন্ধান থামবে না।
Tags: Shweta Taneja, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, রাকেশকুমার দাস, শ্বেতা তানেজা
অতিরিক্ত প্রযুক্তি-নির্ভরতা, প্রকৃতির থেকে ক্রমশ দূরত্ব বেড়ে যাওয়া এই পৃথিবীতে শ্বেতা তানেজার “সমবেদনার গল্প” খুবই প্রাসঙ্গিক। এ যেন প্রকৃতি নিজেই নিজেকে যাবতীয় দূষণ থেকে সরিয়ে তুলছে। সেইজন্য এই পদ্ধতি শিশুদের মাধ্যমে শুরু হলো। তারপর আস্তে আসতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেলো। রাকেশকুমার বাবুর অনুবাদ এই গল্পের মূল ভাবটি যথার্থভাবে প্রকাশ করেছে। ভবিষ্যতে আরও এরকম অনুবাদ, এবং ওনার মৌলিক লেখার দাবি রইলো।