রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞান স্যার
লেখক: সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মেসের শূন্য তক্তপোশে বাচ্চুদার ফেলে-যাওয়া বিয়ের কার্ডটা উলটে-পালটে দেখতে দেখতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সোমেন। বাইরে রাস্তায় রাশি রাশি বোলতার মতো বোঁ বোঁ আওয়াজ করতে করতে ছুটে যাচ্ছে গাড়িগুলো। আজ শনিবার; বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু ফিরে গিয়ে বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়াতেও যেন এখন লজ্জা লাগে। লোকের জমিতে ভাগচাষ করে বাবা তার মেসের ভাড়া দিচ্ছে বলে সে এখনও টিকে থাকতে পারছে এই শহর-বাজারে; নয়তো টিউশন করে যে সামান্য ক-টা টাকা পায়, তা দিয়ে নিজের হাতখরচটুকু চালাতে পারলেও থাকার খরচ উঠত না। বাচ্চুদাকে দেওয়া নীলাঞ্জনাদির বিয়ের কার্ডটা দেখতে দেখতে বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল তার। শিগগির নিজের একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে একদিন মুনমুনও নিশ্চিত এই মেসের ঘরেই এসে তার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলে যাবে, “অমুকদিন আমার বিয়ে। পারলে একবার যেয়ো।”
বাচ্চুদা অবশ্য একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছিল। নীলাঞ্জনাদির অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল। নিলুদির বাবা ওকে পুলিশে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর হাতে-পায়ে ধরে “বেকার ছেলে! মরে যাব, মেসোমশাই! আর জিন্দেগিতেও ওর দিকে চোখ তুলে দেখব না!” এইসব বলে পুলিশ কেসের হাত থেকে বেঁচেছিল বাচ্চুদা। ভদ্রলোক খুব শিষ্ট ভাষায় শাসিয়ে দিয়েছিলেন, “ফের যদি এইসব বাঁদরামো দেখি, তাহলে আর পুলিশ আসবে না; সোজা তোর নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসে যাবে।” তাও সব রাগ-ভয় হজম করে এখানে টিকে ছিল বাচ্চুদা, কিন্তু এর দু-সপ্তাহ পরে বিয়ের কার্ড হাতে মেসে দেখা দিল নিলুদি; আর তার তিন দিনের মাথায় বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে মেস থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেল তার দু-বছরের সিনিয়র বাচ্চুদা—রেখে গেল শুধু প্রাক্তনের বিয়ের কার্ডটা।
সেটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখছিল সোমেন; পুরো কার্ড জুড়ে পাত্রপাত্রীর গুষ্টিবর্গের নাম লেখা। দেখতে দেখতেই মনে হচ্ছিল, মুনমুনেরও যদি নিলুদির মতো অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে সুইসাইড করবে সে। মানসিকভাবে এতখানি কাছে আসার পর ওই মানুষটাকে ছেড়ে এই জীবনে বেঁচে থাকার অর্থ হয় না আর। মাসখানেক আগেই মুনমুন ছলছল চোখে তাকে বলে রেখেছে, “ধনঞ্জয় নামে একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সম্বন্ধ এসেছে; ছেলেটাকে বাবার বেশ পছন্দ হয়েছে। তুমি এবার সিরিয়াসলি একটা কাজকর্ম জোগাড়ের কথা ভাবো, সোমেন। নয়তো বাবাকে আর আটকানো যাবে না মনে হচ্ছে। মা বলছিল, এমএসসি সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষাটা হলেই…”
ইদানীং ওই ছেলেটাকে মনে মনে “শালা ধনা” বলে অন্তত বার দশেক গাল না দিয়ে ঘুমোতেও যাচ্ছে না সোমেন। এদিকে পড়াশোনাও মাথায় উঠেছে। ফিজিক্সে এমএসসি-র পড়া তো আর মুখের কথা নয়; এই হারে ফাঁকি দিলে তাকে পাস করানো ভগবানেরও অসাধ্য, সে নিজেও জানে খুব ভালো করেই। বইয়ের তাক থেকে ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স, অপটিক্স, পার্টিক্ল ফিজিক্সের বইগুলো হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে বিগত বেশ কিছুদিন ধরে—যেন ওরাও তার দুঃসাহস দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
ফাইনাল পরীক্ষার রেজ়াল্টেও তার অবধারিত চন্দ্রবিন্দু বসবে, সে যেন মনে মনে জেনেই ফেলেছে।
মেসের ঘরের দরজায় ছায়া পড়ল। রুমমেট বাচ্চুদা চলে যাওয়ার পর থেকে সে একাই আছে এ ঘরে। লম্বামতো ভদ্রলোকটি হালকা নীল রঙের সাফারি সুট পরে দাঁড়িয়ে আছেন তার সামনে। মুখে তাঁর মোটা গোঁফ, হাতে দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি, পায়ে খয়েরি রঙের মসমসে শু, পকেটে একখানা ঝকঝকে পেন, চোখের চশমার ফ্রেমটা সম্ভবত সোনার। এহেন অফিসার গোছের ভারিক্কি লোককে তার মেসের ঘরের উইয়ে-খাওয়া, আলকাতরা-লেপা দরজার সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে বসল সোমেন; হাত থেকে নিলুদির বিয়ের কার্ডটা টপ করে পড়ে গেল তক্তপোশের উপর।
ভদ্রলোক ভারী গলায় বললেন, “শ্রীসোমেন ব্যানার্জি তো? ভেতরে আসব, স্যার?”
এই লোকের মুখে ‘স্যার’ সম্বোধন? তাও আবার তাকে?
বোকার মতো মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” বলল সে; আগন্তুকের পরিচয় জিজ্ঞাসা করার কথা তার মনেই এল না।
ভদ্রলোক ঘরের ভেতরে ঢোকার আগে জুতো খুলে ভক্তিভরে মাথা নুইয়ে নমস্কার করে নিলেন তাকে। সোমেন তো অবাক। জীবনে এতখানি সম্মান তাকে কেউ দেয়নি। সে একটু ‘কিন্তু-কিন্তু’ করে বলল, “আপনাকে তো ঠিক…”
তিনি বললেন, “আমি আসছি রাইসিনা হিলস থেকে।”
হেঁচকি তুলল সোমেন, “রাইসিনা হিলস!”
“হ্যাঁ, স্যার। সোজা দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে আসছি একটা জরুরি কাজে। মাননীয় রাষ্ট্রপতি স্বয়ং একটা বিশেষ অনুরোধ করে পাঠিয়েছেন আপনাকে। আমি তাঁর ব্যক্তিগত সচিব।”
এইবার সোমেন নিশ্চিন্ত হল, তার সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করা হচ্ছে। তারই বন্ধুদের কেউ নিশ্চয় এ ব্যাটাকে পাঠিয়েছে তাকে বোকা বানাতে।
কিন্তু ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললেন তার মনের কথা; একটু হেসে তিনি বললেন, “বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে জানি, স্যার। আপনাকে আমি কনভিন্স করাতে পারি আমার পরিচয়পত্র দেখিয়ে; কিন্তু নিতান্ত দরকার না হলে তা না-করারই আদেশ আছে আমার উপর। তার বদলে এইটি আপনাকে দিতে পারি।”
বাদামি কাগজের একটা সিল-করা চৌকো প্যাকেট তুলে দেখালেন তিনি। সোমেন বলল, “এটা কী?”
“আমার কথাটা শুনে নিন; তারপর খুলে দেখবেন। অনারেব্ল প্রেসিডেন্টের রিকোয়েস্টটা আপনাকে বলে নিতে চাই আগে।”
সোমেনের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না কথাগুলো। বিশ্বাস হওয়া উচিতও নয়। এখনও তার ধারণা, এটা তার বন্ধুদের করা একটা প্র্যাকটিক্যাল জোক ছাড়া কিচ্ছু নয়। সে হালকা চালে হেসে বলল, “খোদ দিল্লি থেকে যখন এই অখদ্দে মেসবাড়ির ঠিকানা খুঁজে খুঁজে এসেই পড়েছেন, তখন আপনার পুরো পার্ট প্লে না করে কি আর যাবেন? বলুন, বলুন; সব শুনছি।”
‘সচিব’ বললেন, “প্রেসিডেন্ট স্যার আপনাকে প্রণাম জানিয়ে রিকোয়েস্ট করেছেন, আপনি পড়াশোনাটা ছাড়বেন না। ফিজিক্সে এমএসসি-টা আপনাকে কমপ্লিট করতেই হবে; নয়তো খুব বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে—শুধু আপনার না, দেশেরও।”
মুনমুনকে নিয়ে দুশ্চিন্তাটা কয়েক মুহূর্তের জন্য মাথা থেকে উধাও হয়ে গেল সোমেনের। হাহা করে হেসে উঠল সে; বলল, “কেন বেকার ইয়ারকি করছেন মাইরি? এমনিতেই লাইফে চাপের শেষ নেই, তার উপর আবার…”
“আপনার চাপের কথা আমি জানি। মুনমুনদেবীকে বিয়ে করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তো?”
এইবার সোমেনের হাঁ আর বন্ধ হতেই চাইল না। খুব কাছের বন্ধুদের কাউকেও সে এখনও মুনমুনের ঘরের ঝামেলার কথা বলেইনি। বোকার মতো সে বলে ফেলল, “আ-আপনি জানলেন কী করে?”
“আমি জানি, স্যার। আমি ভবিষ্যৎ থেকে আসছি।”
সোমেন বলে ফেলল, “ভবিষ্যতে গাঁজা এত সস্তা হয়েছে নাকি?”
নীল সাফারি সুট-পরা ভদ্রলোক বিরক্তভাবে মাথা নাড়লেন একবার; এমন চটুল কথাবার্তা শুনতে যে তিনি অভ্যস্ত নন, তা বুঝতে অসুবিধা হল না সোমেনের। কে জানে বাবা, লোকটা হয়তো সত্যিই বড়ো অফিসার-টফিসার গোছের কিছু হবে! কিন্তু টাইম-ট্রাভেল করার মতো বাজে কথা বললে কাউকে সিরিয়াসলি নেওয়াই তো মুশকিল।
সোমেনই আবার বলল, “আয়্যাম সরি। আপনি আসলে তখন থেকে এত গুলবাজি করে যাচ্ছেন যে ওটা আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বার হয়ে গেছে। রাইসিনা হিলস থেকে খোদ রাষ্ট্রপতির মেসেজেও কুলোল না, একদম টাইম-ট্রাভেল এনে ফেললেন!”
“গুলবাজি! অনেকদিন পরে শুনলাম কথাটা!… আসলে আপনার দোষ নেই। এত বিরাট ব্যাপার হঠাৎ করে শুনলে অবিশ্বাস হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি যা বলছি, নির্জলা সত্যি কথা, স্যার। আগামী পঞ্চাশ বছর পরের ভারতের অনারেব্ল প্রেসিডেন্ট আপনাকে ব্যক্তিগত অনুরোধ করে পাঠিয়েছেন, শ্রীমতী মুনমুন বসুর জন্য এত দুশ্চিন্তা না করে দয়া করে আপনার ফিজিক্স এমএসসি-র পরীক্ষার জন্য মন দিয়ে পড়তে। তাতে দেশের মঙ্গল, আপনারও মঙ্গল।”
“আমার মঙ্গলটা তো না হয় অল্পবিস্তর বুঝলাম, কিন্তু দেশের মঙ্গল কীভাবে? আপনার এইসব আগডুম-বাগডুম বক্তব্য বিশ্বাস করে যদি মেনেও নিই যে আপনি সোজা ভবিষ্যৎ থেকে ল্যান্ড করেছেন আমার সামনে, তাহলেও আমার এমএসসি পড়াশোনার সঙ্গে ভারতের মঙ্গলের কী সম্পর্ক, সচিব মহাশয়?”
‘সচিব’ একটু থেমে বললেন, “বর্তমানে যিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি—ভবিষ্যতের ইনটারন্যাশনাল ফিউচার আননোয়েবিলিটি প্রোটেকশন প্রোটোকলের কারণে তাঁর নাম এই মুহূর্তে আপনাকে বলা নিষেধ—তিনি আপনার ছাত্র ছিলেন। আপনি মাস্টার্স পাস না করলে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রপতি আপনার কাছে ফিজিক্স পড়বেন কী করে, স্যার?”
সোমেন আবার হাঁ করল। নীল সাফারি সুট-পরা সচিব বললেন, “রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের বয়স এখন সত্তর পেরিয়ে গেছে; নিজে একসময় সায়েন্টিস্ট ছিলেন উনি—কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরির উপর মৌলিক গবেষণা আছে ওঁর। ছাত্রজীবনে অভাবী পরিবারের ছেলে ছিলেন; তখন এক মাস্টারমশাই বিনা পয়সায় স্নাতক আর স্নাতকোত্তরের টিউশন দিতেন ওঁকে। শুধু তা-ই নয়, সংসারে অসম্ভব টানাটানির সময় এই মাস্টারমশাই সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন, নিজের সামান্য পুঁজি ভেঙে তাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। তিনি না থাকলে রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের নিজের এমএসসি করা হয়েই উঠত না। কত প্রতিভা এ দেশে স্রেফ পয়সার অভাবে হারিয়ে যায়, আপনি নিজেও তো জানেন।”
সোমেন মাথা নাড়ল। পকেটে পয়সা না-থাকার যন্ত্রণা সে হাড়েহাড়ে জানে বই-কি। সে বলল, “আপনি বলতে চান, ভবিষ্যতের রাষ্ট্রপতির স্টুডেন্ট লাইফের ওই ফিজিক্স টিচারটি আমি?”
“এই তো বুঝে ফেলেছেন। এই ধরনের কাজ তো আপনি এখনও করছেন, তা-ই না? ভবিষ্যতেও করবেন নিশ্চিত; তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এখন আমার সময়ের ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে বসে আছেন।”
সোমেন চুপ করে রইল। এখন যতগুলো ছেলেমেয়েকে সে টিউশন পড়ায়, তাদের মধ্যে তিনজনের কাছ থেকে কোনো পয়সাকড়ি নেয় না সে। বিএসসি-র প্রাইভেট কোচিং-এর পয়সা দেওয়ার সচ্ছলতা নেই ওদের কারও সংসারেই। নিজের অনেক কষ্ট হলেও বেচারাদের পড়ানো ছাড়তে পারেনি সোমেন। পয়সার জন্য একটা ছাত্রের শেখা বন্ধ হয়ে যাবে, এ চিন্তাটাই অসহ্য লাগে তার।
কিন্তু এসব কথা তো মুনমুনও জানে না। এই অদ্ভুত লোকটা জানল কোথা থেকে?
ফোনটা বেজে উঠল। মুনমুন। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। “কলটা নিয়ে নিন, স্যার। কাজের কথা মনে হচ্ছে।”
“হ্যালো” বলতেই ওদিক থেকে মুনমুনের কান্না-ভেজা স্বর শুনতে পেল সে: “শোনো না, বাবাকে তোমার কথা বলেছি। বাবা খুব রাগারাগি করছে। বলছে, চাকরিবাকরি করে না, এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবে না। তুমি কী বলছ, বলো।”
সোমেনের রাগ হয়ে গেল, “চাকরি কি গাছে ফলে? বললেই কোথায় পাব চাকরি?”
মুনমুন কাঁদতে লাগল। হঠাৎ একটা বিপজ্জনক ব্যাপার মনে পড়ে যাওয়ায় সোমেন জানতে চাইল, “চন্দ্রবিন্দু বসানোর কথাও বলছে নাকি তোমার বাবা?”
ওদিক থেকে কান্নার মধ্যেও এক টুকরো হাসির শব্দ শোনা গেল। “না, আমার বাবা নিলুদির বাবার মতো অত ভায়োলেন্ট নয়। কিন্তু দরকার পড়লে তার মতো নির্মম হতে আমি কাউকে দেখিনি আজ পর্যন্ত।”
সোমেন চুপ করে রইল। মুনমুনের বাবা যে কেমন কঠিন মানুষ, এতদিন পরে তার আর জানতে বাকি নেই।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মুনমুন বলল, “ঠাকুমা ঘুমের বড়ি খায় রোজ একটা করে, তুমি জানো তো?”
সোমেনের শরীর শক্ত হয়ে গেল, “কী বলতে চাইছ?”
“আমিই পাড়ার ওষুধ দোকান থেকে আনতে যাই ট্যাবলেটগুলো; প্রেসক্রিপশন আমার কাছেই থাকে। একটু আগে পুরো এক পাতা এক্সট্রা ওষুধ এনে রেখেছি নিজের কাছে, কেউ জানে না। এই মাস ফুরোলে আরও এক পাতা পেয়ে যাব। বাবা ওই ধনঞ্জয়ের বাড়ির লোকের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবে, বলছিল। সোমেন, তোমাকে যদি না পাই…!” ফুঁপিয়ে উঠে ফোন কেটে দিল মুনমুন।
ফোনটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে সোমেন শুধু বলতে পারল, “শালা ধনা!”
নীল সাফারি সুট মুখ টিপে একটু হাসলেন। সোমেন বিরক্তভাবে বলল, “আমি মরছি নিজের ঝামেলায়, আর আপনার হাসি পাচ্ছে! অবশ্য আপনি আর কী বুঝবেন? যার ইয়েতে আগুন লাগে, জ্বালাটা বোঝে শুধু সে-ই। তখন থেকে ‘ফিজিক্স পড়ুন, ফিজিক্স পড়ুন’ করছেন; একটা চাকরি দিতে পারেন মশাই? আপনি, বা আপনার রাষ্ট্রপতি? তিনি তো শুনছি আমার ভবিষ্যতের ছাত্র! তা, মাস্টারমশাইয়ের উপর এত যদি ভক্তি, তিনি কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারছেন না?”
তার সামনে রাখা বাদামি রঙের প্যাকেটটার দিকে আঙুল দেখিয়ে সচিব বললেন, “সেটা করলে টাইমের কন্টিনিউয়াম ব্রেক করতে হবে, স্যার। এ কাজ আমরা চাইলেও করতে পারি না। সময়ের ধারাকে নিয়ে এলোমেলো কাজ করতে নেই। তাই চাকরি দিতে আমরা পারব না, কিন্তু এই প্যাকেটের ভেতরের বস্তুটি দিয়ে যেতে পারি আপনাকে।”
“এটার মধ্যে কী এমন হাতি-ঘোড়া আছে, শুনি?”
“ভেতরের এই কার্ডটি জোগাড় করে আপনার কাছে আনার জন্য টাইম-ফ্লো-কে একটুখানি বাঁকাতে হয়েছে। সাবধানতার খাতিরে মূল কার্ডের রেপ্লিকা তৈরি করতে হয়েছে আমাদের। কাজটা নিতান্তই ছোট্ট এবং লোকাল বলে এর প্রভাব বিশেষ বুঝতে পারবে না কেউ; তবু স্বয়ং রাষ্ট্রপতির লিখিত আদেশলিপি লেগেছে আমাদের বিজ্ঞানীদের কনভিন্স করাতে। আশা করি, এই কার্ড আপনাকে পড়াশোনা করতে প্রেরণা দেবে।”
“হাসালেন মশাই। চাকরি ছাড়া কোনো কিছুতেই আমার পড়ায় মন লাগবে না আর। নিজের কানেই তো শুনলেন, আমার সঙ্গে বিয়ে না হলে গার্লফ্রেন্ড সুইসাইড করবে, বলছে। আর ওর কিছু হয়ে গেলে আমিও ঝুলে পড়ব। আপনার এই ফালতু কার্ড নিয়ে আমার কোন লাভটা হবে, সচিব মহাশয়? একটা চাকরি পাব?”
“নিজের ক্ষমতায় যদি পান, তাহলে পাবেন। আমরা ভবিষ্যৎ থেকে এসে আপনাকে চাকরি দিতে গেলে সময়ধারায় গণ্ডগোল হয়ে যাবে। টাইমের অসংখ্য ফ্লো—অসংখ্য ট্র্যাক। ট্রেন যেমন অনেক ট্র্যাকের মধ্য দিয়ে একটা নির্দিষ্ট ট্র্যাকে চললে তবেই তার গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছোয়, তেমনি সময়েরও বহু ট্র্যাক আছে। প্রত্যেকটার আউটকাম ভিন্ন ভিন্ন হয়। এগুলোকে বাঁকাতে নেই; ট্যাম্পার করতে নেই। করলে পুরীর ট্রেন দার্জিলিং পৌঁছে যাওয়ার ভয় থাকে।”
“ঢের হয়েছে। আপনি এবার আসুন। অন্য কোথাও গিয়ে গাঁজায় দম দিন।”
সচিব তার উত্তেজনাকে একদম পাত্তা না দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে চললেন, “এয়ারটাইট প্যাকেটটা খুললেই এই কার্ডের সেল্ফ-ডেস্ট্রাক্ট মোড অন হয়ে যাবে, যাতে আপনি কাউকে দেখাতে না পারেন। ছবিও তুলতে পারবেন না, কারণ আপনার ফোনও সুইচ অফ হয়ে যাবে এখুনি। আর ভবিষ্যতের কথা যদি বলেন, তাহলে এইটুকু আপনাকে বলতে পারি, খুব বেশি অর্থ উপার্জন কোনোদিনই করতে পারবেন না আপনি, স্যার। কিন্তু আপনার কাছ থেকে যে ছাত্ররা উঠে আসবে, তারা এক-একজন রত্ন; ভবিষ্যতের ভারতকে তারা এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেক দূরে।”
বলেই লোকটি উঠে পড়লেন হঠাৎ করে, তারপর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন তাকে। এত বয়স্ক একটা লোকের এই কাজে “আরে আরে, কী করছেন!” বলে লাফিয়ে সরে যেতে গিয়েও পারল না সোমেন। তিনি বললেন, “স্বয়ং প্রেসিডেন্ট যাঁকে এত ভক্তি করেন, তাঁকে প্রণাম করার সৌভাগ্য থেকে আমিও বঞ্চিত হই কেন? আপনি একজন অসম্ভব ভালো মানুষ, স্যার; এবং দুর্দান্ত একজন টিচার। আপনাদের হাতেই একটা দেশ তৈরি হয়।”
সোমেন হাঁ করে বসে রইল। অদ্ভুত লোকটি বললেন, “চললাম, স্যার। কার্ডটা দেখবেন। কাউকে বলবেন না, কী দেখেছেন। কিন্তু আশা করি, প্রেরণা পাবেন।”
যেমন এসেছিলেন, তেমনই ‘হুট’ করে বেরিয়ে গেলেন রাষ্ট্রপতির সচিব। সোমেন কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে বসে থেকে প্যাকেটটা খুলল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল লালচে রঙের একটা বিয়ের কার্ড। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল একবার—বাচ্চুদার মুখটা মনে পড়ে গেল।
অদ্ভুত একটা গন্ধ কার্ডটায়; সাধারণ কার্ডের মতো নয় উপাদানটাও। বাতাসের সংস্পর্শে আসতেই তার ধারগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সোমেন বুঝতে পারছে, কোনো একটা বিশেষ উদ্বায়ী পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়েছে এটা, যাতে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
একটা ছবি তুলে রাখার কথা মনে হতেই ফোন হাতে নিয়ে সে দেখল, সেটা কখন যেন সুইচ্ড অফ হয়ে গেছে।
তাড়াতাড়ি কার্ডে পাত্রপাত্রীর নাম দেখল সে। পাত্র অনুরাগ ব্যানার্জি আর পাত্রী অবন্তী মিত্র। কারা এরা? জীবনে নামও শোনেনি সে এদের।
এই কার্ড নাকি তাকে পড়াশোনায় প্রেরণা দেবে? গুলবাজির জায়গা পায়নি ব্যাটা বদমাশ?
পুরোটাই কেউ একজন প্র্যাকটিক্যাল জোক করে গেল তার সঙ্গে, সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে। তার বাঁদর বন্ধুগুলোরই কারও কাজ হবে নির্ঘাত।
কার্ডটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে উবে যাচ্ছে বাতাসে। অসহায়ের মতো সেইদিকে তাকিয়ে রইল সে। যাচ্ছে, যাক। সোমেনের মনে হল, তার জীবনের সব কিছুই এরকম করে হারিয়ে যাচ্ছে; সে চাইলেও ধরে রাখতে পারছে না।
ক্ষইতে ক্ষইতে অর্ধেক হয়ে এসেছে কার্ডটা, এমন সময় কী মনে করে ওটাকে আবার হাতে তুলে নিল সে। পাত্র অনুরাগ ব্যানার্জির নামটা এখনও পড়া যাচ্ছে। দেখতে দেখতেই পাত্রের নামের নীচে তার বংশপরিচয়ের জায়গাটায় চোখ আটকে গেল তার।
অনুরাগ ব্যানার্জির বাবার নাম ৺সোমেন ব্যানার্জি, আর মায়ের নাম ৺মুনমুন বসু, ব্র্যাকেটে ‘ব্যানার্জি’!
সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। হে ভগবান! হে ভগবান! এসব কী?
তার হাতেই কার্ডটা বাতাসে মিলিয়ে গেল; আর তার চিহ্নমাত্র রইল না। সোমেন হতভম্ব হয়ে বসে রইল।
অনুরাগ ব্যানার্জি—তার আর মুনমুনের…!
মাথার মধ্যে কী একটা হয়ে গেল তার। প্রবল খুশিতে কেন যে সে “শাল্লা ধনাঃ!” বলে চেঁচিয়ে উঠল, তা সে নিজেই বুঝতে পারল না।
না, কাউকে কিচ্ছু বলবে না সে। কিন্তু এই ভবিষ্যৎকে পেতে গেলে মনপ্রাণ দিয়ে বিষয়কে আয়ত্ত করতে হবে নিজেকে; নয়তো ভবিষ্যতের ছাত্রদের সে তৈরি করবে কী করে?
অবাক হয়ে সে একবার ভাবল, নিজের নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসতে দেখলে কোনো মানুষের এত আনন্দ হতে পারে?
তারপর বহুকাল পরে নিশ্চিন্ত মনে তাক থেকে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরির মোটকা বইটা পেড়ে এনে পড়তে বসে গেলেন ভবিষ্যৎ ভারতের রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞান স্যার।
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়