ওসানার খোঁজে
লেখক: অঋণ সেন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
সাদর অভ্যর্থনা
—হ্যালো… হ্যালো… ইউনিভার্সাল স্পেস ফোর্স অনুসন্ধান যান জ্যানোস৩২৫৪ থেকে বলছি… শুনতে পাচ্ছেন… হ্যালো… মাইনিং পোস্ট ৭৪ শুনতে পাচ্ছেন… ধ্যত্তেরিকা… শুনতে পাচ্ছেন মাইনিং পোস্ট ৭৪…
—মাইনিং পোস্ট ৭৪ এ আপনাকে স্বাগতম… বাংলায় কথা বলতে ১ টিপুন… ফর ইংলিশ প্রেস ২… ম্যান্ডারিন আং ৩…
—ধুর ছাই… আরে আমরা ইউনিভার্সাল স্পেস ফোর্স… আপনাদের কনট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চাইছি… ল্যান্ডিং-এর গেট খুলুন… খুলুন বলছি… তখন থেকে এক বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছেন…
—আমি দুঃখিত আপনার উত্তরটি আমরা নথিভুক্ত করতে পারলাম না… দয়া করে পুনরায় চেষ্টা করুন… মেন মেনুতে ফেরার জন্য ১ টিপুন…
হতাশ হয়ে পাইলটের সিটে গা ছেড়ে দিল ব্রায়ান। গত প্রায় দশ মিনিট ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই একই নাটক হয়ে চলেছে। কিছুতেই মাইনিং পোস্ট ৭৪ এর কনট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে সে কথা বলতে পারছে না। অথচ ল্যান্ডিং এরিয়ার গেটও বন্ধ করে রেখেছে এরা। এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতিতে এর আগে কখনও পরেনি সে।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আবার চেষ্টা করতে যাবে ঠিক সেই সময় পাশের সিট থেকে হাত বাড়িয়ে কমিউনিকেশন রেডিয়োটা নিজের হাতে তুলে নিল কম্যান্ডার তানিয়া লাহিড়ী,
—মাইনিং পোস্ট ৭৪, অনেকক্ষণ ধরে আপনারা আমাদের সঙ্গে ইয়ার্কি করে চলেছেন। এবার আমি আপনাদের শেষবারের মতো সাবধান করছি, হয় আমাদের কথার উত্তর দিয়ে গেট খুলুন নইলে আপনাদের কনট্রোল টাওয়ারের রেজিস্ট্রেশনকে বিদায় জানানোর জন্য প্রস্তুত হন। ইউনিভার্সাল স্পেস ফোর্স গ্রেড টু কম্যান্ডার হয়ার দরুন যে অধিকার এবং ক্ষমতা দুটোই আমার আছে…
ব্রায়ানকে অবাক করে দিয়ে অপর প্রান্তের রেডিয়ো যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল, আর তাতে ভেসে উঠল একটা হইচই এর শব্দ,
—এই আমি…আমি কথা বলব… না, না, আমার র্যাঙ্ক সবথেকে ওপরে তাই মাইক আমার… র্যাঙ্ক ঝাড়িস না আমার ওপর, কী করে ওই র্যাঙ্ক পেয়েছিস আমি জানি…
—আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পছন্দ করিনা কনট্রোল টাওয়ার…
গলা খাঁকড়িয়ে বলে উঠল তানিয়া, অপর প্রান্তের হইচইটা একটু যেন থিতিয়ে গেল। একটা পরিষ্কার আওয়াজ ভেসে এলো এবার,
—যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য আসলে আপনাদের রেডিয়ো মেসেজ গুলো ধরতে পারছিলাম না ম্যাডাম, আমি আপনার অ্যাডাম… মানে আমি অ্যাডাম বলছি কনট্রোল টাওয়ার থেকে। আপনি বলুন না কী করতে পারি আপনার জন্যে…
—আপাতত আপনার ল্যান্ডিং গেট খুলুন এবং মাইনিং পোস্ট ৭৪ এর সিকিউরিটি অফিসারকে বলুন যেন অনতিবিলম্বে আমাকে এবং আমার সঙ্গে থাকা অফিসার ব্রায়ান রিপ্লিকে রিসিভ করতে আসেন…
—হ্যাঁ নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই ম্যাডাম… আপনার নামটা যদি একটু বলেন…
—নাম জানার আপনার কোনো অধিকার আপনার নেই অপারেটর… আপনাদের জন্য যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়েছে আমার… গেট খোলার সময় আপনারা নিশ্চয়ই আমার মহাকাশযানের রেজিস্ট্রেশন প্লেট স্ক্যান করবেন… সেই তথ্যটা আপনাদের সিকিউরিটি অফিসারকে পাঠিয়ে দিলেই হবে।
—হ্যাঁ নিশ্চয়ই… নিশ্চয়ই…
মাইনিং পোস্ট ৭৪ এর মাটি থেকে ধীরে ধীরে একটা আয়তাকার পাইপের মুখ জেগে উঠল, বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে আক্সিলেরেটরে ব্রায়ান চাপ দিতেই জ্যানোস৩২৫৪ তীব্র গতিতে ঢুকে গেল সেই টানেলের মধ্যে।
অটোপাইলটের ওপর ল্যান্ডিং-এর ভার ছেড়ে দিয়ে কম্যান্ডার লাহিড়ীর দিকে একবার তাকাল ব্রায়ান,
—হে তেজস্বিনী, আপনার জয় হোক। সত্যি কম্যান্ডার, আজ আপনি না থাকলে ব্যাটারা আরও ভোগাতো আমায়।
ব্রায়ানের হালকা ঠাট্টাটা গায়ে না মেখে গম্ভীর গলায় তানিয়া বলল,
—হুম… আমাকে মাইনিং পোস্ট ৭৪ এর ডিটেলগুলো আরেকবার বলো তো ব্রায়ান।
ব্রায়ান সামনে থাকা প্যানেলের ওপর একটা বোতাম টিপতেই একটা স্ক্রিন ভেসে উঠল ককপিটের সামনের কাচের ওপর। তাতে ফুটে উঠল একটি গ্রহাণুর ছবি, পাশে একের পর একা লেখা ভেসে উঠতে লাগল। ব্রায়ান পড়তে শুরু করল লেখাগুলো,
—মাইনিং পোস্ট ৭৪… একটি সি ক্লাস গ্রহাণু… ডায়ামিটার ৬৪৪ কিলোমিটার, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৪৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাই বেসটা পুরোটাই আন্ডারগ্রাউন্ড… বেসের মালিক টেরাকর্প আগামী দুশো বছরের লিজ পেয়েছে গ্রহাণুটা থেকে খনিজ উত্তলনের জন্য… মূল খনিজ থোরিয়াম… জনসংখ্যা ৭,৭৩২… বেশির ভাগই মাইনিং টেকনিশিয়ান আর কিছু ইঞ্জিনিয়ার আর সিকিউরিটির লোকজন…
—বেসে মহিলা কতজন আছে?
—এক মিনিট… ও বাবা! এ তো দেখাচ্ছে শূন্য!
—এবার বোঝা গেল তো কেন আমার গলা শুনে কনট্রোল টাওয়ারে হুলস্থুল পড়ে গেছিল।
—বুঝলাম কম্যান্ডার, তাহলে আমরা পুরো আর্মড হয়েই নামছি তো?
—নিঃসন্দেহে, চলো তৈরি হয়ে নি।
বলে সিট ছেড়ে উঠে গেল তানিয়া, জ্যানোস৩২৫৪ তখন ধীরে ধীরে অবতরণ শুরু করেছে।
অবতরণের পর অবশ্য খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই একটা সিকিউরিটি ভ্যান এসে দাঁড়াল তাদের যানের সামনে। চারজন গার্ড ভ্যান থেকে নেমে মুহূর্তের মধ্যে জ্যানোস৩২৫৪ দরজার সামনে জমে থাকা ভিড়টাকে ঠেলে হটিয়ে দিল সেখান থেকে। ভিড়ের সবাই প্রায় কনট্রোল টাওয়ারের লোকজন, ইউনিভার্সাল স্পেস ফোর্সের মহিলা কম্যান্ডারকে এক ঝলক দেখার জন্যই পাগল হয়ে উঠেছিল সবাই। কিন্তু পুরোদস্তুর সামরিক বর্মে আবৃত দুই সৈনিককে মহাকাশযান থেকে নেমে সরাসরি সিকিউরিটি ভ্যানে উঠে যাওয়াতে তারা যারপরনাই হতাশ হয়েছিল।
মাইনিং বেসের ভেতরটা একটা ছোটোখাটো ঘিঞ্জি শহর, ছাদের ওপর থেকে নেমে আসা উজ্জ্বল নীল আলোয় রাস্তার ধারে খুচরো জিনিসের দোকানের খালি কাউন্টারগুলো যেন তানিয়াকে পৃথিবীর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। রাস্তার ধারের ফুটপাথে বেশ কিছু লোক বেকার বসে আড্ডা জমিয়েছে, কয়েকজন হেঁটে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। সাধারন মাইনিং কলোনিগুলোতে লোকজনের মধ্যে যে ব্যস্ততা থাকে এখানে যেন তার বড়ো অভাব।
মাইনিং পোস্ট ৭৪
ল্যান্ডিং এরিয়া থেকে সিকিউরিটি কনট্রোল অফিসে পৌঁছতে লাগল ঠিক সাড়ে তেরো মিনিট। এই সব গ্রহাণুর আয়তন এবং জনসংখ্যা খুব কম হওয়ায় ইউনিভার্সাল স্পেস ফোর্স এখানে কোনো আর্মি ক্যাম্প রাখে না। এখানকার আইনকানুন সবই প্রায় থাকে লিজ নেওয়া কোম্পানির নিয়োগ করা কোনো প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সির হাতে। মাইনিং পোস্ট ৭৪ এর দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন মাইকেল হ্যানা অবশ্য নিজের কাজের বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। তার কথাবার্তা থেকেই সেটা বুঝতে পারল তানিয়া।
—মাইনিং পোস্ট ৭৪ এ আপনাদের স্বাগত কম্যান্ডার লাহিড়ী এবং অফিসার রিপ্লি। বলুন কীভাবে আমি আপনাদের সেবায় আসতে পারি?
উত্তরটা তানিয়াই দিল,
—ক্যাপ্টেন হ্যানা, আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে ডেভিড ওসানা নামে এক অপরাধী মার্স সিটি থেকে পালায়। তাকে মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হচ্ছিল, ট্রান্সফারের দায়িত্বে অফিসার রিপ্লিই ছিলেন। মঙ্গলের মহাকাশসীমা পার করার কিছু পরেই ওসানা যানের সিকিউরিটি সিস্টেমকে নষ্ট করে অফিসার রিপ্লিকে আহত করে একটা এমারজেন্সি যান নিয়ে পালায়। তাকে খুঁজতেই আমাদের এখানে আসা।
—আপনাদের কেন মনে হল যে এই লোকটা এখানেই পালিয়ে এসেছে?
—কারণ যে এমারজেন্সি যানটা নিয়ে ওসানা পালায় সেটা অনেক পুরোনো মডেলের একটা যান। এখনকার মতো ফিউশন ইঞ্জিন সেটায় ছিল না। জ্বালানি হিসেবে থোরিয়াম ব্যবহারকারী নিউক্লিয়ার ফিশান ইঞ্জিন ছিল সেটায়। মঙ্গলের আশপাশে এরকম জ্বালানি পাওয়ার জায়গা খুব কমই আছে। আমরা সেই সব ক-টা জায়গা খুঁজতে খুঁজতেই এখানে এসেছি। এছাড়া আরও কয়েকটা ব্যাপার আছে, পৃথিবীতে ওসানার বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিশ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জারি হয়ে গিয়েছিল অফিসার রিপ্লির তৎপরতায়, তাই সেখানে সে কোনো জায়গাতে ল্যান্ডিং-এর চেষ্টা করলেই ধরা পড়বে। কিন্তু এই মাইনিং কলোনিগুলোতে সেই নোটিশ আসতেও কিছুটা সময় লাগবে, আর এলেও যে সেটাকে কেউ গুরুত্ব দেবে এমন সম্ভাবনা কম। তাদের বেশির ভাগের কাজই কলোনির ভেতর শান্তি বজায় রাখা আর কেউ যাতে পালাতে না পারে সেটা লক্ষ রাখা। তাই এখানে এসে ভিড়ের মধ্যে মিশিয়ে যাওয়া তার পক্ষে খুবই সহজ। তাই না?
—আপনি ঠিকই বলেছেন কম্যান্ডার লাহিড়ী, অনেক সময়েই অনেক অপরাধী এরকম প্রাইভেট কলোনিগুলোতে আশ্রয় নেয়। আমাদের এই বেসও তার ব্যতিক্রম নয়। আমি আপনাদের কাছে মিথ্যে বলতেই পারি যে হ্যাঁ যত যান এখানে আসছে বা যাচ্ছে তার সব হিসেব আমার কাছে আছে, সেটাই হয়তো ঠিক, কিন্তু বাস্তব তার থেকে অনেকটা আলাদা। এই বেসের অনেক জায়গাতেই এমন কিছু কাজকর্ম হয় যেগুলো ঠিক ভুলের মাঝামাঝি বলা চলে। আমি সেসব ব্যাপারে নাক গলাই না। তাই লোকটার এখানে এসে লুকিয়ে থাকা একেবারে অসম্ভব নয়।
ক্যাপ্টেন হ্যানার মুখে এই স্বীকারোক্তি শুনে নিজের ভিতরে জেগে ওঠা রাগটাকে যতটা সম্ভব লুকিয়ে রেখে তানিয়া বলল,
—ঠিক আর ভুলের মাঝামাঝি কিছু হয় না ক্যাপ্টেন ওসানা আপনার বেসের কোন কোন জায়গায় লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা নিয়ে আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন, তাই তো?
—অবশ্যই কম্যান্ডার। কিন্তু সে কীরকম জায়গায় লুকোতে পারে সেটা জানার জন্য সে কী ধরনের অপরাধী যদি আমায় বলেন… যদি তাতে কোনো সরকারি বাধা না থাকে।
—এই বিষয়ে আমার থেকে ভালো অফিসার রিপ্লি বলতে পারবেন।
এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেয়ে রিপ্লি কিছুটা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল,
—হ্যাঁ… নিশ্চয়ই… কম্যান্ডার এবং সম্মানীয় ক্যাপ্টেন। ওসানা মানে ডেভিড ওসানা একসময় ইউনিভার্সাল স্পেস ফোর্সের যোদ্ধা হিসেবে কাইপারস বেল্টের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, যদিও যুদ্ধ চলাকালীনই বার বার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এবার দেখুন সে সময় এরকম অনেক অনভিপ্রেত ঘটনাই ঘটেছিল, কিন্তু ওসানার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো এসেছিল তার নিজের ব্যাটেলিয়নের ভিতর থেকেই। শত্রুপক্ষের মহিলা যোদ্ধাদের প্রতি তার ব্যবহার কারুর পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে কোর্ট মার্শাল করা হয়। তাকে বিনা পেনশনে বাধ্যতামূলক অবসর ধরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই অবসরটাই আরও যেন কাল হয়ে আসে ওসানার জীবনে। লাস ভেগাস এবং ব্যাঙ্ককের রেড লাইট এরিয়াগুলো হয়ে ওঠে তার বিচরণভূমি। কিন্তু তারাও ধীরে ধীরে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, এতটাই বিকৃত ছিল ওসানার যৌনলালসা। সেই সময় চার-চারটি মেয়ে প্রাণ হারায় তার সঙ্গে রাত কাটাতে গিয়ে। এরপর সেই সব জায়গাতেও তার দরজা বন্ধ হয়ে গেলে ভদ্রপাড়ায় ঘোরাঘুরি শুরু করে ওসানা। লাস ভেগাসের এক বাসিন্দাকেই খুন করে জেলে যায় সে। কোর্টে তার একশো বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড হয়। গত দু-বছর ধরে সে মার্স সিটি কারেকশানাল ফ্যাসিলিটিতেই ছিল, কিন্তু গত মাসে তাকে পৃথিবীতে পাঠানোর নির্দেশ আসে। তার উকিল নাকি কীসব নতুন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কোর্টে রি-অ্যাপিল করেছে। ট্রান্সফারের মাঝপথেই সে আমাকে আক্রমণ করে পালাতে সমর্থ হয়। এই হল ডেভিড ওসানা, একজন নিকৃষ্ট বিকৃতকাম খুনি। আর এই এখন এসে লুকিয়েছে আপনাদের এই মাইনিং বেসে। তবে আমার বিশ্বাস সে খুব বেশিদিন এখানে লুকিয়ে থাকবে না, কারণ তার স্বাভাবিক লালসা নিশ্চয়ই এতদিন জেলে থাকার পর আবার জেগে উঠবে, আর সেটা চরিতার্থ করা এই গ্রহাণুতে সম্ভব নয়। তাই আমাদের হাতে সময় খুবই কম এতজন লোকের মধ্যে সে আছে কিনা সেটা নিশ্চিত করে তাকে ধরার। এবার আপনি বলুন ক্যাপ্টেন আমরা কি শেষ পর্যন্ত আপনার সহযোগিতা পাবো এই অপরাধীকে ধরার ব্যাপারে?
ক্যাপ্টেন হ্যানা নিজের টেবিলের ওপর জেগে থাকা স্ক্রিনের কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় আঙুল চালাতে চালাতে বললেন,
—এই মুহূর্তে সবার আগে আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হল ওসানা যে আমাদের এখানেই এসেছে সেটা নিশ্চিত করা। দেখুন আমাদের এই বেসে ঢোকার বা বেরোনোর জন্য ওই একটাই ল্যান্ডিং গেট আছে, সুতরাং যে এমারজেন্সি যানে করে সে আপনাদের হাত থেকে পালিয়েছে তার রেজিস্ট্রেশন প্লেট নিশ্চয়ই স্ক্যানড হয়েছে… অতএব আমরা যদি শেষ একমাসের মধ্যে আসা সমস্ত যানের রেজিস্ট্রেশন চেক করি তাহলে তাকে দেখতে পাওয়া উচিৎ… অফিসার রিপ্লি, আপনি আমাকে ওই এমারজেন্সি যানের রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা বলতে পারবেন কি?
রিপ্লি একবার কম্যান্ডার লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে সেদিক থেকে নীরব সম্মতি পেয়ে বলে উঠল,
—হ্যাঁ নিশ্চয়ই, লিখুন ৭৪৮৮KL৯
কয়েক মিনিট নিস্পলক স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে হতাশ হয়ে মুখ তুললেন ক্যাপ্টেন হ্যানা,
—আমি দুঃখিত, কম্যান্ডার লাহিড়ী। কিন্তু এরকম কোনো যান আমাদের ডেটাবেসে নেই।
তানিয়া জিজ্ঞেস করল,
—ক্যাপ্টেন হ্যানা, আপনাদের কনট্রোল টাওয়ারের চোখ এড়িয়ে কোনো যানের এই বেসে ঢুকে পড়া কি একেবারেই অসম্ভব?
—না কম্যান্ডার, আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি। এই বেসের অনেক জায়গাতেই নানা ধরনের বেআইনি কাজকারবার চলে। তবে যদি ওসানা সত্যিই কোনো চোরাপথে এখানে এসে থাকে, তাহলে একজনই আছে যার পেটে সেই খবর থাকবে?
—সে কে ক্যাপ্টেন?
—মেফিস্টো… লুক মেফিস্টো। মাইনিং পোস্ট ৭৪ এর যতরকম বেআইনি কারবার, চোরাচালান, গুন্ডা বদমাইশি সবকিছুকে কনট্রোল করে এই লোকটা, তবে হ্যাঁ নিজে কিন্তু আপাদমস্তক ভদ্রলোক। মাসে একবার করে মার্স সিটিতে যায়, সমাজের উঁচু মহলের লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা করে… এমনকী এই বেসের মালিক টেরাকর্পের এজেন্টরাও ওকে বেশ সমঝে চলে…
—আর আপনি ক্যাপ্টেন?
—কম্যান্ডার, আমি টেরাকর্পের একজন সাধারণ সিকিউরিটি অফিসার। আমার কাজ এই বেসে শান্তি বজায় রাখা। আর আমার মতে মেফিস্টোর মতো লোকেদের যদি আপনি না ঘাঁটান তবে ওরাও আপনার জীবনে কোনো অশান্তি সৃষ্টি করে না।
—তাহলে এই শান্তিপূর্ণ শয়তানের থেকে ওসানার ব্যপারে জিজ্ঞাসাবাদের উপায় কী, আপনার মতে?
—মেফিস্টো এই বেসে একটা বার কাম রেস্তোরাঁ চালায়, নাম ‘ক্যাফে বিবপ’। এখন গেলেই তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব। তবে কম্যান্ডার, আমি আপনাদের দেখা করার সব ব্যবস্থা করে দিলেও আমি নিজে কিন্তু ওই বারের ভেতরে ঢুকব না। আর আপনাকেও অনুরোধ করব লোকটার সঙ্গে একটু বুঝেশুনে কথা বলতে। আমি ওর লোকের সঙ্গে কথা বলে একটা মিটিং এর কথা বলি তাহলে, আপনারা একটুক্ষণ বাইরে লাউঞ্জে অপেক্ষা করুন, চাইলে কিছু লাঞ্চের ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
ক্যাপ্টেন হ্যানার অফিস থেকে বেরিয়ে রিপ্লিই প্রথম কথা বলে উঠল,
—আচ্ছা কম্যান্ডার, এই মেফিস্টোর থেকে যদি আমরা কোনো কথা না বের করতে পারি তাহলে আমাদের পরবর্তী স্টেপ কী হবে?
স্যুটের বেল্টে লাগানো একটা ছোটো পকেট থেকে একটা জলের প্যাকেট বার করে গলায় ঢেলে নিয়ে তানিয়া বলল,
—একটা কথা ভেবে দেখো রিপ্লি, এখানে আসার আগে কিন্তু আমরাও জানতাম না যে এই বেসে কোনো মহিলা নেই, সুতরাং আমরা ধরতেই পারি যে ওসানার পক্ষেও সেটা জানা সম্ভব নয়। আর ওসানার যানে জ্বালানি যতটা ছিল তাতে এর থেকে বেশি দূর তার যাওয়া কঠিন। আমার মন বলছে সে এখানেই আছে। এখানে এই এতজন টেকনিশিয়ান, মেশিন অপারেটর, ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যেই তার লুকোনো সবথেকে সহজ।
—ইয়ে… কম্যান্ডার, আরেকটা কথা ক্যাপ্টেন হ্যানা যে লাঞ্চের কথা বললেন… তা আমরা কি লাঞ্চটা সেরেই তারপর যাবো?
—আহা… লাঞ্চ নিয়ে কেন চিন্তা করছ ক্যাপ্টেন? শুনলেই তো এই মেফিস্টো মহাশয় একটা রেস্তোরাঁ চালায়, সেখানেই যখন যাচ্ছি তাহলে আর ক্যান্টিনের কী দরকার? এটা একটা ডেট হিসেবেই ধরে নাও।
—ডেট উইথ দ্য ডেভিল বলাই বোধ করি ঠিক হবে।
রিপ্লির কথায় হাসি চাপতে গিয়েও শেষ অবধি হেসে ফেলল তানিয়া।
ক্যাপ্টেন হ্যানা নিজেই ওদের ড্রাইভ করে নিয়ে চললেন। রেস্তোরাঁটা বেসের একদম উত্তর প্রান্তে এবং বেশ কিছুটা দূরে। রাস্তায় যেতে যেতে বেসটা যেন আরও বেশি করে তানিয়ার চোখে ধরা দিল। কনট্রোল টাওয়ার থেকে ওদের গাড়ি যত বেশি দূরে যেতে লাগল তত বাড়তে থাকা ফুটপাথের ওপর পড়ে থাকা মাতালের দল, বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানের ভাঙা কাচের জানলা, স্তূপীকৃত জঞ্জাল তানিয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে এই বেসের অবস্থা ঠিক কী। একসময় সে ক্যাপ্টেন হ্যানাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
—ক্যাপ্টেন, একটা কথা জানার ছিল যদি কিছু মনে না করেন, আপনার এই বেসের এরকম খারাপ দশা কেন?
রাস্তার ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই ক্যাপ্টেন হ্যানা জবাব দিলেন,
—পুরোটাই একটা বিশাল ভুল বোঝাবুঝির জন্য, কম্যান্ডার। টেরাকর্প এই গ্রহাণুর লিজ নেওয়ার সময় তাদের ধারণা ছিল যে এখানে প্রচুর পরিমানে থোরিয়াম রয়েছে, কিন্তু এখানে আসার পর তারা বুঝল যে এখানে থাকা থোরিয়ামের পরিমাণ খুবই কম আর তার সঙ্গে এসে জুড়ল ফিসন ইঞ্জিনের জায়গায় ফিউসন ইঞ্জিনের ব্যবহার। থোরিয়ামের চাহিদা কমতে শুরু করল আর সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকল টেরাকর্প এর কাছে মাইনিং পোস্ট ৭৪ এর দাম। এখন এখানে আর খুব বেশি হলে একশো বছরের মতো থোরিয়াম আছে, তাই টেরাকর্প আর এখানে ইনভেস্ট করতে রাজি নয়, তাই সবাই ধুঁকছে, গোটা বেসটাই ধুঁকছে। যাদের একদম অন্য কোথাও যাওয়ার উপায় নেই শুধু তারাই রয়ে গেছে এখানে।
—আর এসবের মধ্যে লুক মেফিস্টোর জায়গাটা ঠিক কোথায়?
—লুক মেফিস্টো হল ধুঁকতে থাকা বেসের ওপর বসে থাকা শকুন। টেরাকর্প এখন আর এখানে সরাসরি অপারেশন চালায় না, কয়েকজন কনট্রাক্টরের হাতে ছেড়ে দিয়েছে থোরিয়াম তোলার কাজ। মেফিস্টো এরকম কনট্রাক্টরই ছিল, এখন বেসের যারা একটু বেশি কামায় তাঁদের নানারকম চাহিদার জোগান দেওয়াও তার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যে জায়গাটায় ঢুকছি সেটা বেসের প্লেসার ডিসট্রিক্ট বলতে পারেন, আপনি এমন কোনো নেশার জিনিস এখানে পাবেন না যেটা আপনি পৃথিবীর কোনো বড়ো শহরে বা মার্স সিটিতে নেই। আমরা কেউ এখানে আসার সাহস দেখাই না।
ক্যাপ্টেন হ্যানার কথা কতটা সত্যি সেটা ক্যাফে বিবপের সামনে নেমেই বুঝতে পারল তানিয়া। অপরিচ্ছন্ন রাস্তার ধার ঘেঁসে সারি সারি নিয়ন আলো-জ্বলা ক্লাব আর বার। কখনও কখনও তাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে একটা-দুটো গাড়ি, দরজা খুলে তাদের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বাউন্সাররা। এরকমই একটা বারের দরজার ওপর লাল আলোয় জ্বলছে নিভছে ক্যাফে বিবপের নামটা। তার পাশের গলির সামনে রংচঙা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা মেয়ে। রিপ্লি জিজ্ঞেস করে উঠল,
—ক্যাপ্টেন হ্যানা, তবে যে আপনাদের বেসে কোনো মহিলার রেকর্ড নেই, তবে এরা কারা?
মুচকি হেসে হ্যানা উত্তর দিলেন,
—ভালো করে দেখুন অফিসার রিপ্লি, ওরা কেউই মেয়ে নয় ওরা শুধু মেয়েদের মতো সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে থাকে, ওরা সবাই ছেলে। এখানে লোকেদের কাছে যখন আর কোনো উপায়ই থাকে না তখন ওদের কাছেই যায় কিছুক্ষণের আনন্দের জন্য।
আরেকবার ভালো করে সেদিকে তাকাতেই ওদের মধ্যে একজন রিপ্লির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
—কি অফিসার, আসবেন নাকি? মাত্র একশো ডলার এক ঘণ্টার জন্য…
তবে ওরাও চুপ করে গেল তানিয়াকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে। হাঁ করে দেখতে লাগল বেসের একমাত্র মহিলাকে। যার পরনে আজ সকালের সৈনিকের বর্ম এখন আর নেই, তার জায়গায় এসেছে একটা উজ্জ্বল লাল রঙা ইভিনিং ড্রেস। মেফিস্টোর পেট থেকে কথা বার করার জন্যই আজ এসেছে তানিয়া, যে কোনো পুরুষকে রূপে ভোলানোর মতো ক্ষমতা যে তার আছে সেটা সে জানে। ক্যাপ্টেন হ্যানাও আজ বিকেলে তাকে ওই রূপে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবাক হয়ে গেছিলেন, তারপর ব্যাপারটা আন্দাজ করে মুচকি হেসেছিলেন শুধু।
—আপনারা ভেতরে যান কম্যান্ডার, মেফিস্টোকে বলা আছে আপনাদের কথা। আপনাদের মিটিং শেষ হলেই আমি ফিরে আসব।
এই বলে গাড়িটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন হ্যানা আর ওরা দু’জন ধীরপায়ে ঢুকে গেল ক্যাফে বিবপের ভেতরে।
ডেট উইথ দ্য ডেভিল
ক্যাফে বিবপের ভেতরের পরিবেশটা যেন বাইরের একদম বিপরীত। স্নিগ্ধ একটা গোলাপি আলো ছড়িয়ে রয়েছে বার কাম রেস্তোরাঁর ফ্লোরে সাজিয়ে রাখা টেবিলগুলোর ওপর। টেবিলগুলোকে ঘিরে থাকা চেয়ারের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে কয়েকজন। তাদের পোশাক থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে তারা সবাই বেসের কনট্র্যাক্টটর। তানিয়াকে ঢুকতে দেখেও তাদের মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেল না। তাদের চোখ তখনও ফ্লোরের সামনে থাকা স্টেজের দিকে, যেখান থেকে ভেসে আসছে ড্রামস আর সিন্থেসাইসারের সুর। কয়েকটা টেবিলের ওপর রাখা হুক্কা থেকে বেরোনো ধোঁয়ায় একটা হালকা কুয়াশা যেন জমাট বেঁধে উঠছে বিবপের ভেতরে।
সেই কুয়াশার মেঘ কাটিয়ে একজন ওয়েটার এসে তানিয়াদেরকে ফ্লোরের পিছনের দিকে আসার অনুরোধ করল। ফ্লোরের পিছন দিকটায় কয়েকটা হাই ব্যাকড সোফা দিয়ে ঘিরে কয়েকটা ছোটো কেবিনের মতো বানানো হয়েছে। তার মধ্যেই একটাতে বসে রয়েছে লুক মেফিস্টো। তার হাতে একটা পানীয়ের গ্লাস।
—আরে আসুন আসুন, কম্যান্ডার লাহিড়ী; আসুন অফিসার রিপ্লি। আপনাদের মতো সুন্দর লোকজনের উপস্থিতিতে আমার এই ছোট্ট ক্লাব সুন্দর হয়ে উঠল। বসুন আর বলুন কী অর্ডার করব আপনাদের জন্যে। আমার এখানে খুব ভালো ওয়্যাগু পাবেন, সঙ্গে ফাইনেস্ট কিবোটা সাকে। আর কম্যান্ডার লাহিড়ী আপনার জন্য হোয়াইট ওয়াইন আছে, পিনো জর্জিও ২০৩২ এর।
—আপনি কী করে জানলেন যে আমি হোয়াইট ওয়াইন প্রেফার করি?
বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল তানিয়া মুখে একটা হালকা হাসি ফুটিয়ে তুলে। সে জানে যে তাকে এখন এই লোকটার পেট থেকে কথা বার করতে হলে লোকটাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতেই হবে।
ওয়েটারকে হাতের ইশারায় খাবার আনতে বলে মুচকি হাসল বছর চল্লিশের স্থূলকায় লুক মেফিস্টো, তার মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে। চোখের নীচে আর গালের ওপর জমে ওঠা চর্বির থাক যেন মুখের মধ্যে একটা বাৎসল্য ফুটিয়ে তুলেছে। আর সেটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে তার ঠোঁটের ওপর ঝুলে থাকা হাসিটা। সেই ঠোঁটের ফাঁক দিয়েই বেরিয়ে এল পরের কথাগুলো,
—ইনফরমেশন ম্যাডাম, ইনফরমেশন রাখাই আমার কাজ। এই বেসের কার কী চাহিদা সেইসব ইনফরমেশন রেখে সেইমতো সাপ্লাই দেওয়াই তো আমার কাজ। এবার বলুন আমি আপনাদের কী সেবায় লাগতে পারি?
রিপ্লিই বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তানিয়া টেবিলের নীচে পায়ের আলতো চাপে তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলল,
—তবে তো আপনি জানেনই যে কেন আমরা আপনার কাছে এসেছি… কিন্তু সেই কাজের কথায় যাওয়ার আগে কোথায় আপনার ওয়াইন? আগে সেটা ট্রাই করে দেখি…
আবারো মুচকি হেসে জবাব ভেসে এল,
—হ্যাঁ নিশ্চয়ই… নিশ্চয়ই… এই তো এসে গেছে… নিন ম্যাডাম নিন… স্যার নিন…
ওয়েটার ওদের গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে ঢালতেই মেফিস্টো বলে চলল,
—আমি সবই জানি… কিন্তু ব্যাপারটা কী বলুন তো, আপনাদের ক্যাপ্টেন হ্যানা আমাকে যত বড়ো কেউকেটা ভাবেন আমি সেরকম কিছু নই। আমি একজন… কী যেন বলে… হ্যাঁ, আমায় বরং একজন দার্শনিক বলতে পারেন যার একটা ছোটোখাটো ব্যাবসা আছে… ব্যাস এইটুকুই…
ওয়াইনের গ্লাসটা হালকা করে বাকিদের গ্লাসে ছুইয়ে ছোট্ট একটা সিপ দিয়ে প্রশ্ন করল তানিয়া,
—তাহলে আপনার দার্শনিক মনই বা আমাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারে সেটা বলুন?
তানিয়া অবাক হয়ে দেখল মেফিস্টো তার বাঁ হাত ধীরে ধীরে উঠিয়ে দিয়েছে রিপ্লির দিকে। লোকটা ঠিক কী করতে চাইছে বোঝার আগেই মেফিস্টো তার স্লথ নেশাতুর গলায় বলে উঠল,
—দর্শনের সবথেকে বড়ো প্রশ্ন কী জানেন তো ম্যাডাম লাহিড়ী, ‘কেন’। সব কাজের পিছনে, বা বলা ভালো পৃথিবীর সব কিছুর পিছনে থাকে এই একটা প্রশ্ন ‘কেন’। এখন আমার প্রশ্নও তাই, আমার কাছে যদি কোনো ইনফরমেশন থেকেও থাকে তাহলে সেটা আমি আপনাদের দেব কেন?
ফ্লোরের সামনে থেকে ভেসে এল একঝাঁক হাততালির আওয়াজ, কেউ একজন স্টেজের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। তানিয়া লক্ষ করল রিপ্লির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হতে শুরু করেছে। লোকটা হাত বোলাতে শুরু করেছে তার মসৃণ গালের ওপর, ধীরে ধীরে তার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মেফিস্টোর আঙুলগুলো। তানিয়ার একটা হাত আপনা থেকেই চলে গেল তার থাইয়ের নীচে লুকিয়ে রাখা ইলেকট্রিক পিস্তলটার হাতলে।
—আপনি কী করতে চাইছেন মিস্টার মেফিস্টো?
কড়া গলায় কথাটা বলে রিপ্লি সেই ছোঁয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই হালকা ধমক বেরিয়ে এল মেফিস্টোর গলা থেকে,
—আঃ… শান্ত হয়ে বসুন অফিসার… যেটা হচ্ছে হতে দিন… আপনাদের চেয়ারের সঙ্গে ২৪০ ভোল্টের একটা টেজার লাগানো আছে, আপনারা বসার সঙ্গে সঙ্গেই ওটা অ্যাকটিভ হয়ে গেছে। এখন আমার অনুমতি ছাড়া ওঠার চেষ্টা করলেই ইলেকট্রিক শক খাবেন… স্টেজের দিকে দেখুন… নিলম আমার এখানকার বেস্ট প্রোডাক্ট। পুরো বেসের লোক আসে ওর গান শুনতে… আমি ব্লুস বিশেষ করে পছন্দ করি বলে ওর নাম নিলম রেখেছি…ভালো হয়েছে না? একবার ওর গান শুনে দেখুন…
স্টেজের ওপর নিলমের গলা থেকে ভেসে আসছে জ্যান বয়েলের গাওয়া ‘হোয়েন ডার্কনেস কামস…’ এর সুর। পুরো জায়গাটা যেন নিস্পলক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে গায়িকার দিকে। স্টেজের ওপর এসে পড়া স্পটলাইতের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠছে তার সমুদ্রনীল চোখ, চুলেও ঢেউ তুলছে ঘন নীল, ঠোঁটয়েও যেন সেই নীলেরই আভা। তার গোড়ালি অবধি নেমে ঘন কালো রঙের গাউনের নীচে ঢাকা শরীর বলে দিচ্ছে সে বারের বাইরের গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা মিথ্যে সুখের প্রতিশ্রুতি নয়, সে একজন সত্যিকারের নারী।
আঙুলগুলো রিপ্লির ঢোঁক গিলে ওঠা গলার ওপর দিয়ে চালাতে চালাতে মেফিস্টো বলল,
—এই বেসে লোকে চাইলে সবকিছু পেতে পারে, শুধু তাদের ওই ‘কেন’টার জবাব দিতে হবে। আমার ক্লাবে গান গাওয়ার মেয়ে দরকার ছিল আমি নিলমকে জোগাড় করে নিয়েছি। কিন্তু আপনাদের কাছে আমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই ম্যাডাম লাহিড়ী। আপনার ওই আকর্ষণীয় লাল ড্রেসটা সত্ত্বেও কিছুই নেই। আর আপনার অফিসার তো ভয়েই কেঁপে যাচ্ছে, আমার সেটা ভালো লাগছে না। তাই আমার বেসে কোনো এমারজেন্সি যান ল্যান্ড করেছে কিনা, কেউ এসে লুকিয়েছে কিনা সেটা আমি আপনাদের কেন বলব? সে আপনি যতই আমার সামনে সুন্দরী হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন না কেন।
এই বলে রিপ্লির ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিল লোকটা। তারপর আগের মতোই ঠান্ডা গলায় বলে উঠল,
—আপনারা এখন আসতে পারেন, আমি আপনাদের কোনো সাহায্য করতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
স্টেজের ওপর থেকে তখনও ভেসে আসছে নিলমের সুরেলা গলার গান। সেই দিকে চোখ রেখেই ধীরে ধীরে চেয়ার উঠে দাঁড়ালো ওরা দুজন।
বিবপের দরজা থেকে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসল রিপ্লি, দু-হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে বসে রইল গাড়ির সিটে। তানিয়া চুপ করে বসল তার পাশে। ক্যাপ্টেন হ্যানা ওদের অবস্থা দেখে কোনো কথা না বলেই গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করলেন।
গাড়িটা কিছুদূর চলার পর তানিয়াই মুখ খুলল,
—ক্যাপ্টেন হ্যানা, আজ আমাদের এখানে আসা একদম সফল হয়েছে। আমি কনফার্মড যে ওসানা এখানেই এসেছে।
তানিয়ার কথা শুনে এতক্ষণে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখ উপরে ওঠাল রিপ্লি,
—কিন্তু ওকে তো এই নিয়ে কিছু বলার সুযোগই আমরা পেলাম না কম্যান্ডার।
—আমাদের জিজ্ঞেস করতে হয়নি ও নিজেই বলেছে। আচ্ছা ক্যাপ্টেন হ্যানা আমরা যে একটা এমারজেন্সি যানের খোঁজ করছি সেটা কি আপনি মেফিস্টোকে কোনোভাবে জানিয়েছিলেন?
সামনের সিট থেকে গাড়ি চালাতে চালাতেই উত্তর দিলেন হ্যানা,
—না কম্যান্ডার, এই ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও কেউ জানত না।
—তাহলেই ভেবে দেখো রিপ্লি, শয়তানটা আমরা যে একটা এমারজেন্সি যানের খোঁজ করছি সেটা জানল কী করে? আর একটা ব্যাপার জানতে চাই ক্যাপ্টেন আপনাদের এই বেসে কি খুব ভালো কোনো ডাক্তার আছেন? যিনি বিশেষভাবে সার্জারিতে পারদর্শী?
—আছেন তো, হ্যাঁ অবশ্যই আছেন। ডক্টর ড্যানিয়েল স্টার্ন, আর উনিই এই বেসের একমাত্র সার্জন। এছাড়া আরও দুজন আছেন কিন্তু তারা জেনারেল মেডিসিন স্পেশালিষ্ট। কেন বলুন তো?
জিজ্ঞেস করলেন হ্যানা।
এই প্রথম হালকা হাসির রেখা দেখা গেল তানিয়ার মুখে,
—রিপ্লি ব্যাপারটা খেয়াল করেনি, অবশ্য তখন সে সেই অবস্থাতেও ছিল না কিন্তু বিবপের ওই নিলম নামের মেয়েটা অসাধারণ গান গায়, প্রায় অপার্থিব বলা চলে। তার গলার যা রেঞ্জ তাতে ক্লাসিকাল অপেরায় সে একই সঙ্গে ছেলেদের গলার অংশ মানে টেনর আর মেয়েদের পার্ট সোপ্রানো দুটোই গাইতে পারবে। এটা খুব বিরল একটা ক্ষমতা। একমাত্র কাদের থাকে জানেন ক্যাপ্টেন হ্যানা? বা বলা ভালো থাকত, থাকত কাসত্রাতি নামে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর এক ধরনের গায়কদের। হ্যাঁ, গায়ক, গায়িকা নয় গায়ক। সেই সময় ইউরোপে চল ছিল গানের গলা ভালো এমন ছেলেদের কৈশোর পেরোনোর আগেই তাদের শরীর থেকে তাদের শুক্রাশয়কে কেটে বাদ দিয়ে দেওয়ার। এর ফলে তাদের শরীরে টেস্টস্টেরন হরমোন তৈরি হতে পারত না। তাই বয়সন্ধির সময় একজন ছেলের গলায় যে পরিবর্তনগুলো স্বাভাবিক নিয়মে আসে সেগুলো এদের ক্ষেত্রে আসত না। তাই এরা বড়ো হয়ে অসাধারণ দক্ষ গায়ক হয়ে জায়গা করে নিত বিভিন্ন অপেরায়। আমাদের আজকের দেখা নিলম নিশ্চিতভাবে একজন কাসত্রাতি, কারণ তার গলাতেও সেই একই জাদু আছে। আর তার সঙ্গে তাল মেলাতেই নিলমের ওপর বেশ কিছু কসমেটিক সার্জারিও করা হয়েছে, সেটা অবশ্য লক্ষ করলাম দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসার একটু আগে। ওর কানের পিছনে সেরকমই কোনো সার্জারির দাগ রয়ে গেছে।
—তাহলে আপনি বলতে চাইছেন ওসানা কোনো ডাক্তারকে দিয়ে…
—বলতে চাইছি নয়, বলছি। নইলে আপনাদের সিকিউরিটি ক্যামেরায় তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। আর একটা কথা তুমি শুনে রাখো রিপ্লি, আজ আমার জন্যে তোমাকে একটা খুব বড়ো দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, কিন্তু আমি তোমায় কথা দিলাম হয় এর প্রতিশোধ নেব, নইলে স্পেস ফোর্স ছেড়ে দেব।
অনুসন্ধান
পরের দিনটা প্রায় পুরোটাই নিজেদের ঘরে কাটাল ওরা দুজন। ক্যাপ্টেন হ্যানা ওদের থাকার জন্য সিকিউরিটি ব্যারাকেই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মাইনিং বেসে কাজের শুরু হয় সকাল দশটায় গ্রিনিচ মিন টাইমে, চলে সন্ধ্যে সাতটা অবধি। এই পুরো সময়ের মধ্যে রিপ্লিকে বিরক্ত করার ইচ্ছে হয়নি তার। কালকের ঘটনার একটা গভীর ছাপ যে তার ওপর পড়েছে সেটা বুঝতে পেরেছে তানিয়া, কাল ঘরে ঢোকার পর থেকে আর দরজা খোলেনি সে। সারাদিন ধরে ডক্টর ড্যানিয়েল স্টার্ন এর বিষয়ে যতটা সম্ভব রিসার্চ করে নিয়েছে তানিয়া। ডক্টর স্টার্ন দীর্ঘদিন পাইমা মেডিকাল ইন্সটিটিউটে কসমেটিক সার্জারি ডিপার্টমেন্টে ছিলেন, দু-বছর আগে টেরাকর্পের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এই বেসে আসেন। এখানকার শ্রমিকদের মধ্যে দুর্ঘটনা বিরল কোনো ব্যাপার নয়, তাই অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর ডাক পড়ে। কাজের সময়টা প্রায় পুরোটাই কাটান বেসের মেডিক্যাল ফ্যাসিলিটিতে, আর বাকি সময়টা কাটান নিজের কোয়ার্টারে। বেসে কারুর সঙ্গেই খুব একটা মেশেন না, তবে বেশ কয়েক বার তাঁকে মেফিস্টোর সঙ্গে দেখা গেছে।
পড়তে পড়তে তানিয়ার বার বার মনে হতে লাগল আরও একবার তার ক্যাফে বিবপে যাওয়া দরকার। বেসের দিনের হিসেবে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হয়ে নিল তানিয়া। ভিড়ের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে নেওয়ার জন্য নিজের বর্মের ওপর দিয়ে ক্যাপ্টেন হ্যানার জোগাড় করে দেওয়া একটা টেকনিশিয়ানের ইউনিফর্ম চাপিয়ে নিল সে। আর মুখ ঢেকে নিল একটা গ্যাস মাস্কে, ঠিক যেরকম মাস্ক এখানকার খনিতে ব্যবহার করা হয়। রাত আটটার সময় যখন সে সিকিউরিটি ব্যারাক থেকে বাইরে এল তখন কারুর তাকে আলাদা করে চেনার উপায় নেই।
বেসের মধ্যে এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে তানিয়া বুঝতে পারল যে বেসটা প্রথমবার দেখে যতটা ছোটো তার মনে হয়েছিল, ঠিক ততটা ছোটো নয়। কিন্তু কাজ হারিয়ে পৃথিবীতে না ফিরতে পারা শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি হওয়াতেই রাস্তার ফুটপাথগুলোতে ভিড় উপচে পড়ছে। সেই ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ তখনও রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানগুলোয় ঢুঁ মারতে ব্যস্ত কোনো ছোটোখাটো কাজের আশায়। বাকিরা বেশির ভাগই কোনো কারণ ছাড়াই পা মিলিয়ে চলেছে ভিড়ের সঙ্গে। কয়েকজন বসে আছে ফুটপাথের ওপর।
পায়ে হেঁটে ক্যাফে বিবপ পৌঁছতে একটু বেশিই সময় লাগল তানিয়ার। বেসের হিসেবে প্রায় সন্ধে সাড়ে আটটা, প্লেসার ডিসট্রিক্ট তখন ঝলমল করছে বাহারি নিয়ন আলোয়। প্রত্যেকটা বার, প্রত্যেকটা রেস্তোরাঁতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলছে কনট্র্যাক্টটার, সিনিয়র ম্যানেজার আর কিছু ভাগ্যবান ইঞ্জিনিয়ারদের খোশগল্প। কয়েকটা জায়গা থেকে ভেসে আসছে গানের সুর। বিবপের পাশের গলির ছেলেগুলো আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের রংচঙে পোশাকে। একটা কালো রঙের গাড়ি এসে সেখানে থামলে ওদের মধ্যে দুজন উঠে পড়ল সেই গাড়িতে। বাকিরা কিছুটা ঈর্ষা মেশানো নজরে তাকিয়ে রইল সেদিকে। তানিয়া বুঝতে পারল তাকে এখনও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। এখন পুরোদস্তুর বিজনেস আওয়ার, এখন নিলমের সঙ্গে দেখা করা অসম্ভব।
প্রায় রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ লুক মেফিস্টো বেরিয়ে এল বিবপ থেকে, একটু সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে সিগারের কয়েকটা ধোঁয়া ছেড়ে উঠে পড়ল তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাঢ় মেরুন রঙের সেডানে। তার কিছুক্ষণ পরেই ধীরে ধীরে অন্য ক্লাব-বার-রেস্তোরাঁগুলো থেকেও লোকজন বেরিয়ে যেতে শুরু করল। যারা নিজে থেকে বাইরে আসার মতো অবস্থায় ছিল না তাদেরকে বাউন্সাররাই বার করে এনে শুইয়ে দিচ্ছিল ফুটপাথের ওপর।
প্রায় একঘণ্টা পর বিবপের পেছনের দরজা দিয়ে পাশের গলিতে নেমে এল নিলম। নিজের থেকে এক সাইজ বড়ো একটা হুডিতে নিজেকে লুকিয়ে নিল সে। অনান্য দিন ম্যানেজার তাকে নিজের গাড়িতে করে ছেড়ে দিয়ে আসে, কিন্তু আজ পেমেন্ট নিয়ে একটা ঝামেলা হয়ে গেছে ওর সঙ্গে। বেশ কিছুদিন ধরেই উলটোপালটা কারণ দেখিয়ে পেমেন্ট কেটে নিচ্ছিল, আজ নিলম বেশ করে শুনিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে ছিল মেফিস্টোর কাছেও কমপ্লেন করার, কিন্তু সে আজকাল একটু বেশি আগেই ক্লাব থেকে বেরিয়ে যায়। গলি থেকে বেরোনোর সময় কয়েকটা বাঁকা কথা উড়ে এল তখনও খদ্দেরের আশায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর দিক থেকে। সেদিকে কান না দিয়ে ধীরে ধীরে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে লাগল নিলম।
মুখোশের নীচে
শহরের এই অংশটা একটা সময়ের পর একদম শুনশান হয়ে যায়। বেসের সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা লোকজন খুব সময়েই এখানে আসে, আর এলেও তারা আসে তাদের ইউনিফর্ম খুলে ফেলার জন্য। এতদিন রাতের অন্ধকারে নিজের ফ্ল্যাটে ফেরার পথে ভয় লাগত না নিলমের, কিন্তু আজ একটু একটু করে ভয় যেন তাকে আঁকড়ে ধরছিল। এতদিন ক্লাব থেকে তাকে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা ম্যানেজার নিজেই করত, কিন্তু আজ সে আশা রাখেনি নিলম। তাই একটু জোর কদমেই পা বাড়ায় সে।
একটু এগোতেই যেন আরেকটা পায়ের শব্দ ভেসে আসে তার কানে, পা-টাকে একটু টেনে হাঁটছে যেন কেউ। মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ায় নিলম, তার ডান হাত নিজে থেকেই চলে যায় তার পকেটে লুকিয়ে রাখা মিনি-পিস্তলটার হাতলে। তার পিছনের ফেলে আসা রাস্তার ধীরে ধীরে নিভতে থাকা নিয়নগুলোকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে তিনটে ছায়া। তাদের মাঝের ছায়াটির মালিকের উচ্চতা প্রায় সাত ফুট। পিছনের দুটো ছায়ার দিক থেকে ভেসে আসে একটা নোংরা হাসির আভাস। এবার ওদের চিনতে পারে নিলম।
লেবার ইউনিয়নের পোষা গুণ্ডা রুডি ও তার দুই চামচা অরভিন্দ আর লালা। ইউনিয়ান এখানে দরকার মতো লেবার এবং ইঞ্জিনিয়ারদের চড়া সুদে টাকা ধার দেয়। সেই টাকা ফেরত আনাই রুডিদের কাজ। অন্য দিন হলে এই কুকুরগুলোকে ভয় পাওয়ার কোনো দরকার ছিল না নিলমের, কিন্তু আজকে তাকে বাঁচানোর কেউ নেই।
—এত রাতে একা কোথায় যাচ্ছ সুন্দরী?
ঠান্ডা গলা ভেসে আসে সাত ফুট উঁচু থেকে, কথার উত্তর দেওয়ার আগেই বাঁ পাশে দাঁড়ানো লালা খেঁকিয়ে উঠল,
—কিরে কথার উত্তর দিচ্ছিস না যে বড়ো? উপরের তলার মালিকদের খুশ করে করে কি আমাদের ভুলে গেছিস নাকি? চ একবার মনে করিয়ে দি…
বলে একসঙ্গে বিশ্রীভাবে হেসে ওঠে তিন মূর্তিমান। সেই হাসির শব্দে নিলম যেন এক ধাক্কায় পিছিয়ে যায় বেশ কয়েকটা বছর। কয়েকটা দুর্বিষহ যন্ত্রণার স্মৃতি যেন অবচেতনের অন্ধকার থেকে মহাকাশযানের গতিতে ছুটে এসে আঘাত করে তাকে। সেই আঘাতের প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই যেন তার ডান হাত তার হুডির পকেটে রাখা পিস্তলটা উঠে আসে। সামনে দাঁড়ানো রুডির মধ্যে অবশ্য এতে বিশেষ হেলদোল দেখা গেল না।
বাঁ দিক থেকে অরভিন্দ এবার হেসে উঠে বলল,
—ও বাবা… মেনি বিড়াল আবার নখ দেখাচ্ছে গো…
রুডি কোনো কথা না বলে দু-পা এগিয়ে এল নিলমের দিকে, তারপর ওকে অবাক করে পিস্তলের নলটা খপ করে ধরে ঠেকিয়ে ফেলল নিজের বুকে। ঠান্ডা গলায় বলে উঠলে,
—কিরে চালাবি না? নে চালিয়ে দে এবার… দেখি কত বড়ো হয়েছিস তুই… কিরে চালা… চালা …
চেঁচিয়ে ওঠে রুডি।
আর তার সেই হঠাৎ চিৎকারে চমকে গিয়েই যেন ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলে নিলম।
কিন্তু না… দুশো কুড়ি ভোল্টের যে বৈদ্যুতিক ধাক্কায় ছিটকে পড়া উচিৎ ছিল রুডির বিশাল শরীরটার, সেরকম কিছুই হয় না। বরং এক পৈশাচিক হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। সাপের মতো হিসহিসিয়ে সে বলে ওঠে,
—পরের বার মার্কের সঙ্গে ঝামেলা হলে পিস্তলের ব্যাটারিটা আছে কিনা দেখে নিয়ে তবে বের হবি কেমন… অবশ্য যদি পরের বার বলে কিছু থাকে তোর কপালে…
চোখের কোণ দিয়ে নিলম দেখতে পায় অরভিন্দ আর লালা তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
—কিরে নিজে থেকে উপুড় হবি না আমাদের হেল্প লাগবে…
বলে ওঠে লালা।
শেষ চেষ্টা হিসেবে নিজেকে রুডির বাঁ দিকে ছুড়ে দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে নিলম। কিন্তু একটা বিশাল হাতের ধাক্কা ছিটকে ফেলে দেয় ওকে। লালা আর অরভিন্দ দু-দিক থেকে এসে সজরে চেপে ধরে ওর দুই হাত।
একটা হাসির শব্দ শুনতে পায় নিলম।
—অনেক বীরত্ব হয়েছে… এবার ধীরে ধীরে একটা একটা করে পা ফেলে ঘরের দিকে ফিরে যাও বাচ্চারা… নইলে এমন জায়গায় মারব যে তোদের মালিককে গিয়ে দেখাতে পারবি না যে ওখানে মেরেছে…
হাসির পরেই কেটে কেটে ভেসে আসা কথাগুলো যেন মুহূর্তের মধ্যে থামিয়ে দেয় তিন শয়তানকে। চার জোড়া চোখই একসঙ্গে ঘুরে তাকায় গলির মুখটার দিকে।
গলির পিছন দিক থেকে বয়ে আসা নিয়নের হালকা গোলাপি আভায় চকচক করে ওঠে ইউনিভার্সাল স্পেস ফোর্স কম্যান্ডারের লাইট কমব্যাট বর্মটি। বর্মের মুখোস ঢাকা অংশ থেকে আবার একটা যান্ত্রিক স্বর ভেসে আসে,
—কিরে নিজে থেকে পালাবি, না আমার হেল্প লাগবে?
উত্তেজনার চরম মুহূর্তে বাধা পেয়ে বনমানুষের মতো খেপে ওঠে রুডি, লালা আর অরভিন্দ।
অরভিন্দ প্রথম এগিয়ে গেল। দুরন্ত গতিতে চার পা ছুটে ডান হাতে মোক্ষম একটা হুক চালাল এসে দাঁড়ান সৈনিকের চোয়াল লক্ষ করে। সৈনিক যেন তৈরিই ছিল, সে বাঁ পায়ের হালকা মোচরে নিজের মাথাটাকে সরিয়ে নেয় ধেয়ে আসা ঘুসিটার রাস্তা থেকে। তার পরেই এক লহমায় ডান হাত দিয়ে আলতো করে টেনে দেয় অরভিন্দের এগিয়ে আসা ডান কাঁধটাকে। নিজের গতিবেগেই পিছনে ছিটকে পড়ে অরভিন্দ।
সভয়ে নিলম দেখল লালাও এগিয়ে গেছে সেই সৈনিকের সামনে। সৈনিক তার দুই হাতকে পাকিয়ে মুখের সামনে তুলে ধরে মুষ্টিযোদ্ধার মতো করে। তার সামনে এখন লালা আর পিছনে অরভিন্দ।
অরভিন্দ আবার ধেয়ে এল পিছন দিক থেকে, বাটারফ্লাই সাতারুরা যেভাবে দু-দিকে একসঙ্গে হাত ছোড়ে, সেইভাবে দুই হাত চালাল সে প্রতিপক্ষের মাথা লক্ষ করে। আর লালা নিজের বাঁ পায়ে একটা লাথি ছুড়ে দিল সেই প্রতিপক্ষের পেটের দিকে।
কিন্তু প্রতিপক্ষ… প্রতিপক্ষ যেন এক ব্যালে নর্তকী। সে অদ্ভুত কায়দায় বাঁ হাঁটু ভাজ করে বসিয়ে ফেলল নিজেকে, আর সেই একই সঙ্গে নিজের ডান পা ঘুরিয়ে দিল মাটির ওপর একটা নিখুঁত বৃত্তের আকারে। তার পায়ের ধাক্কায় ভারসাম্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল লালা আর অরভিন্দ।
দুই শাগরেদের অবস্থা দেখে এবার রুডি নিজেই এগিয়ে আসে দুই হাতে ঘুসি পাকিয়ে, কিন্তু তার প্রতিপক্ষ যেন আগে থেকেই জানত কী হতে চলেছে। সে প্রথমেই নিজের বাঁ হাত উঠিয়ে হাওয়া কেটে তার মাথা লক্ষ করে ভেসে আসা রুডির হে-মেকারটাকে আটকাল। তারপর ডান হাতে আটকে গেল রুডির একটা মোক্ষম জ্যাব। তারপর একটা লেফট হুক চালিয়ে দিল সোজা রুডির চোয়ালে। বেসামাল রুডি টলে গিয়ে এক পা পিছিয়ে যেতেই একটু ঝুঁকে ওয়ান–টু-থ্রি-ফোর কম্বিনেশন পাঞ্চ চালিয়ে দিল সেই সৈনিক।
নিলম অবাক চোখে দেখল রুডির বিশাল শরীরটা ঠিক যেন একটা বালির বস্তার মতো মাটিতে ঝরে পড়ে গেল।
সৈনিকটি এবার শান্ত পায়ে এগিয়ে এল নিলমের দিকে। তার কাছে এসে হাতটা এগিয়ে দিয়ে আবার সেই যান্ত্রিক স্বরে বলে উঠল,
—চলো, তোমাকে তোমার বাড়ি অবধি এগিয়ে আসি।
অজানা আশঙ্কায় ভয়ে কেঁপে উঠল নিলম। স্পেস ফোর্সের সৈনিকদের কথা সে শুনেছে, শুনেছে তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনেক রকম ভয়ংকর গল্প। এক জানা বিপদের হাত থেকে উদ্ধার পেয়ে সে কি আরও বড়ো অজানা বিপদের হাতে পড়ল?
নিলমের ভয়ে আর চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিকে অবাক করে দিয়ে সৈনিকের স্বয়ংক্রিয় মুখোশটা পিছনে সরে গেল। যান্ত্রিক স্বরের বদলে একটা স্বাভাবিক মেয়েলি গলার আওয়াজ শুনতে পেল নিলম,
—আমি ইউনিভার্সাল স্পেস ফোর্স কম্যান্ডার তানিয়া লাহিড়ী। তোমার নাম তো নিলম, তাই না?
বাড়িয়ে দেওয়া হাতটার ওপর হাত রাখে নিলম।
নীল গহীন
নিলমের ফ্ল্যাটটা খুব ছোটো, একটা বেডরুম আর তার সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম কাম টয়লেট। ফ্ল্যাটেরই এক কোনায় একটা টেবিলে রান্নার জন্য অল্প বন্দোবস্ত। আরেক কোনায় একটা খাট, আরেকটা আলমারি। ঘরে ঢুকে ট্রেনিং মাফিক এসবই দেখছিল তানিয়া। নিলম বাইরে গেছে খাবার আনতে। ওর নিমন্ত্রণে এমন একটা কিছু ছিল যে তানিয়া না বলতে পারেনি। আর তা ছাড়া মেফিস্টোর ব্যাপারে যদি কেউ খবর দিতে পারে তাহলে সেটা শুধু নিলমই পারে। কেন যেন তার খালি মনে হছিল মেফিস্টোই হল ওসানাকে খুঁজে পাওয়ার চাবিকাঠি।
নিলমের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ফ্ল্যাটের একমাত্র জানলা দিয়ে বাইরের এলাকাটা দেখছিল তানিয়া। বেশির ভাগই টেকনিশিয়ানদের থাকার জন্য সস্তায় তৈরি বিল্ডিং। নিলমের বিল্ডিংটা যেন তাদের মধ্যেও সব থেকে খারাপ। শুধু এই সাত নম্বরের সবথেকে উপরের ফ্লোরটাই আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটে ভাগ করা। বাকি ফ্লোরগুলো টানা হল, সেখানে সারি সারি কফিন রুম। কফিন রুমগুলো লম্বায় দশ ফুট, চওড়ায় পাঁচ, আর উচ্চতায় চার ফুট। তার ভিতরে ফ্ল্যাটের মালিকেরা শুধু রাতে শুতে আসে, তার থেকে বেশি আরাম সেখানে সম্ভব নয়। সেই হিসেবে নিলমের থাকার জায়গা একটা ফাইভ স্টার হোটেলই বটে।
পিছন থেকে দরজার আওয়াজে তানিয়ার ভাবনায় বাঁধা পড়ল। নিলম ফিরে এসেছে, হাতে খাবারের প্যাকেট, মুখে হাসি লেগে রয়েছে তার।
—একদম ফ্রেশ সোয়া নুডলস, শুধু আপনার জন্য কম্যান্ডার। এত রাতে শুধু একতলার চো-এর ক্যান্টিনই খোলা থাকে, আর ওই আমার সবথেকে ফেভরিট কুক। খেয়ে দেখুন কেমন লাগে? আপনাদের পৃথিবীর মতো কিনা?
—আরে তুমি এত রাতে এত কষ্ট করতে গেলে কেন? তোমার এখন রেস্ট নেওয়া উচিৎ, আজ অনেক ধকল গেছে তোমার ওপর।
হালকা হেসে উত্তর দিল তানিয়া।
—এসব আগেও হয়েছে… নতুন কিছু নয়। আর আপনি তো আর সবসময় এখানে থাকবেন না… গরম থাকতে থাকতে খাবারটুকু খেয়ে নিন প্লিজ। আমি একটু ফ্রেশ হয়েনি ততক্ষণে।
বলে নিলম খাবারের প্যাকেটটা তার হাতে দিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
খাবারটা খেতে খেতে স্নানের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল তানিয়া, ভেপার বাথ। এই গ্রহাণুতে জল অতি দুর্মূল্য, তার বদলে সিনথেটিক কেমিক্যাল ভেপার কানেকশান আছে স্নান আর পরিষ্কারের কাজে ব্যবহারের জন্য। সেই ভেপারের সবেগ শব্দ শুনতে শুনতেই কথাটা জিজ্ঞেস করল তানিয়া,
—তুমি ডক্টর ড্যানিয়েল স্টার্নের নাম শুনেছ নিলম?
তার এই প্রশ্নে বাথরুমের ভিতর থেকে বয়ে আসা ভেপারের শব্দ বন্ধ হল না, কিন্তু ভেতরে নিলমের নড়াচড়ার শব্দ যেন একেবারে থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর তার গলার স্বর ভেসে এল আবার,
—হ্যাঁ চিনি, হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
—আমার ওঁর সঙ্গে একটু দেখা করার দরকার আছে, ওঁর কাজের কথা শুনেছি অনেক…
—ডক্টর স্টার্ন কিন্তু মেফিস্টোর মতো একদম নয়… এখানে সারাদিন এত লোক কাজ করে… সবার চিকিৎসা উনিই করেন… কত লোক তো ওঁর ফি-ও জমা দিতে পারে না… তাও উনি কাউকে না করেন না।
—তোমার অপারেশনও তো নিশ্চয়ই উনিই করেছিলেন, তাই না?
তানিয়ার বলা কথাটা যেন এক মুহূর্তে নিলমের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দেয়। তার জীবনের একমাত্র গোপনীয় যে কথাটা শুধু ডক্টর স্টার্ন, মেফিস্টো আর সে ছাড়া কেউ জানে না সেটা এই অফিসার জানল কী করে, বুঝতে পারে না নিলম। কিন্তু আবার একটা ভয় তার মনে জেগে ওঠে। এই গ্রহাণুর কত টেন্ডার অফিসার, কত ইঞ্জিনিয়ারের কাছে তাকে ভেট হিসেবে যেতে হয়েছে গত দু-বছরে মেফিস্টোর ইশারায়। তারা কেউ যদি তার এই সত্যিটা জানতে পারে, তাহলে কি তারা তাকে ছেড়ে দেবে? মেফিস্টো কি তাকে ছেড়ে দেবে?
—কি হল? উত্তর দিলে না তো…
বাথরুমের বাইরে থেকে ভেসে আসা প্রশ্নটার উত্তর মনে মনে ঠিক করে নেয় নিলম। দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে বলে,
—হ্যাঁ, অফিসার আমিও ওঁর হাতেই তৈরি… দেখবেন ওঁর কাজ…?
প্রশ্নটার সঙ্গে সঙ্গেই বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল তানিয়া। সেদিকে তাকিয়েই চোখটা আটকে গেল তার।
বাথরুমের দরজার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছিল ভেপারের হালকা নীল বাস্প আর সেই বাস্প মেখে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নিলম। তার সারা শরীর অনাবৃত, হালকা আর্দ্রতার আভাস সেই শরীরে বিন্দু বিন্দু হয়ে জমে রয়েছে।
সেদিক থেকে চোখ সরাতে পারল না তানিয়া। নিলমের শরীর যেন কোনো প্রাচীন ভাস্করের হাতে তৈরি নারীমূর্তি। তার সুডৌল স্তনে যেন আদিম কোমলতার হাতছানি, তার ত্বক যেন ইউরোপার সমুদ্রের মতো সফেন শ্বেত। তার কোমরের নীচে, দুই পায়ের খাঁজে যেন ফুলের পাপড়ি জেগে রয়েছে।
—কথা আটকে গেল আপনার…? আমিই ওঁর শ্রেষ্ঠ কাজ… আমার এই যে শরীর দেখছেন… এটার প্রতি ইঞ্চি… প্রতি খাঁজ… উনি নিজের হাতে তৈরি করেছেন… এক বছরের ওপর সময় লেগেছে… কোথাও একটুকু খুঁত পাবেন না…
কথাগুলো বলতে বলতেই পায়ে পায়ে এগিয়ে এল নিলম। তানিয়ার সামনে রাখা টেবিলটাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ধীরগতিতে সে নেমে এসে বসল তানিয়ার কোলে। মুখটাকে তানিয়ার খুব কাছে এনে জিজ্ঞেস করল,
—কি? পেলেন কোনো খুঁত?
নিজেকে আর আটকে রাখল না তানিয়া। তার দীর্ঘদিনের তৃষ্ণা মিটিয়ে দিতেই যেন বৃষ্টি নেমে এসেছে তার বুকে, এসেছে নীল রং ধরে। কোমরের কাছে একটা লুকোনো বোতামে চাপ দিতেই তার শরীরের বর্ম আলগা হয়ে এল। নিলম ধীরে ধীরে সরিয়ে দিল সেই বাঁধন।
নিলমের ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁটটা মিলিয়ে দিল তানিয়া।
এক নতুন সকাল
পরের দিন পৃথিবীর হিসেবে সকাল আটটায় যখন মাইনিং বেসের সাইরেন বেজে উঠল তখনও ওরা দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে শুয়ে রইল, যখন বেলা দশটার সময় বার বার তানিয়ার বর্মে থাকা রেডিয়োতে রিপ্লির মেসেজ ঢোকার বার্তা বেজে যেতে লাগল তখনও।
প্রায় দুপুর একটা নাগাদ নিলম তানিয়ার ঠোঁটে আরেকটা চুমু মাখিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
—এবার আমায় ছাড়ো অফিসার, দুপুরের কিছু খাবারের ব্যবস্থাও তো করতে হবে নাকি…
নিলমের ঘন নীল চুলে আঙুল চালাতে চালাতে তানিয়া বলল,
—লাঞ্চ কিন্তু আমি করাব…
—সত্যি… বাহ আমার কি সৌভাগ্য… এই প্রথম কেউ রাত কাটানোর পর সকাল হতেই দৌড় না লাগিয়ে আমায় লাঞ্চ অফার করছে… এ সুযোগ কি ছাড়া যায়…
আনন্দে যেন লাফিয়ে উঠতে চায় নিলম, তানিয়া আবার ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে টেনে নেয়। ওর চুলের মধ্যে নিজের মুখ ঘষতে ঘষতে একটা কথা না জিজ্ঞেস করে পারল না সে,
—আচ্ছা তুমি এই বেসে এলে কী করে?
তানিয়ার প্রশ্নের উত্তরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এল যেন নিলমের থেকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে বলল,
—আমার মা পৃথিবী থেকে মার্স সিটিতে এসেছিলেন যখন, তখন আমি খুব ছোটো। মা মার্স সিটির একটা স্কুলে পড়াতেন, এইটুকু আমার এখনও মনে আছে। যুদ্ধ শুরু হবার পর মার্স সিটির ভেতরেও কিছু ব্লাস্ট হয়েছিল। সেরকম একটা ব্লাস্টেই উনি মারা যান। আমি অনেকদিন তারপর নানা হোমে কাটিয়েছি। যখন আমার বারো কি তেরো বছর বয়েস তখন মেফিস্টো এরকমই একটা হোমের ফাংশানে আমার গান শুনে আমায় কিনে নেয় ও। তারপর ওর শিপে চেপেই এখানে আসি। এখানে আসার পর এক বছর আমায় ও নিজের কাছেই রেখেছিল, তারপর ওর মন ভরে গেলে ডক্টর স্টার্নকে দিয়ে আমার সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি করায়। ডক্টর রাজি ছিলেন না, কিন্তু এই বেসে মেফিস্টোর ক্ষমতা অনেক। সার্জারির পর আমার প্রায় দু-বছর হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি চলে। আমাকে আরও সুন্দর… সরি, সুন্দরী করে তোলার জন্য আরও অনেক বার ছুরি-কাঁচি চলেছে আমার ওপর…
—আর তোমার গান?
—ওই গানই তো আমাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে কম্যান্ডার… এখানে আসা থেকেই গান শিখে চলেছি সমানে… ঘণ্টার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটারের সঙ্গে বসে তালিম নিয়েছি, শিখেছি পিচ কাকে বলে, থ্রো কাকে বলে, নোটস কি করে লাগাতে হয়… সব শিখেছি ধীরে ধীরে। আসলে আমি বুঝে গেছিলাম যে মেফিস্টোর কাজে না লাগতে পারলে আমায় এখানে না খেয়ে মরতে হবে… নয়তো আমায় ছিঁড়ে খাবে রুডির মতো কুকুরের দল… যাদের সামনে মেফিস্টো আমাকে অনেকবার ছুড়ে দিয়েছে খাবারের টুকরোর মতো করে…
কথাগুলো বলার সময় নিলমের গাল বেয়ে নেমে আসা চোখের জলের ফোঁটা দুটো মুছে দেয় তানিয়া।
—তুমি কোনোদিন পৃথিবী দেখোনি, তাই না?
—না, কিন্তু ছবি দেখেছি পৃথিবীর। এখানকার অনেকেই তাদের বাড়ির ছবি পকেটে নিয়ে ঘোরে। আমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে খুশি হলে তারা আমায় পৃথিবীর গল্প শোনায়…
—দেখতে ইচ্ছে করে না…
—করে তো… কিন্তু আমার তো কোনো প্রিন্স চার্মিং নেই কম্যান্ডার, যে ড্রাগনের সঙ্গে লড়াই করে আমায় উদ্ধার করে নিয়ে যাবে…
তানিয়া নিলমকে কথা শেষ না করতে দিয়েই আরেকবার ওকে চুমু খেল। তারপর ধীর গলায় বলল,
—আমি তোমায় কথা দিচ্ছি নিলম, আমি এই বেস থেকে বেরোনোর সময় তুমিও আমার সঙ্গেই থাকবে।
হালকা একটা হাসি ভেসে ওঠে নিলমের মুখে। এই কথা সে এর আগে অনেকের মুখে শুনেছে।
দুপুর দুটো নাগাদ ওরা দুজন নিলমের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে বেসের রাস্তায় নেমে এল। এর মধ্যে তানিয়া রিপ্লিকে জানিয়ে দিয়েছে যে সে নিজের মতো করে খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে, রিপ্লি যেন মেন কম্যান্ডে জানিয়ে দেয় যে তাদের বিশ্বাস ওসানা এই মাইনিং পোস্ট ৭৪ এই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। আজ সন্ধের মধ্যে কনফার্মেশন পাওয়া যাবে।
নিলমের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতেই তানিয়া বেসের মাঝ বরাবর একটা রেস্টোরেন্টে এসে পৌঁছল। সেখানে ওরা যখন খেতে বসল তখন প্রায় সবাই নিলমের দিকে আর নিলমের সঙ্গে থাকা বর্মে ঢাকা সৈনিকটির দিকে। নিলমকে ওরা প্রায় সবাই চেনে, তার সঙ্গে অন্য অনেককেই দেখে তারা অভ্যস্ত। কিন্তু কোনো সৈনিককে এই প্রথম তারা দেখছে এখানে।
লাঞ্চের পর নিলম তানিয়াকে নিয়ে গেল বেসের মূল খনির কাছে। অন্য মাইনিং বেসের মতোই এখানের খনিও আরেক ধাপ নীচে মাটির মধ্যে। বেসের এই অংশে শব্দের জন্য কান পাতা দায়। মূল খনির মুখের থেকে প্রায় দশখানা ম্যাগলেভ লাইন ওয়াগনে করে গ্রহাণুর ভেতর থেকে থোরিয়ামের আকরিক খন্দ তুলে আনছে। সেই মুখের কাছে সার দিয়ে উপরের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোটোবড়ো নানা আকারের ক্রেন। তার বকের মতো মাথা নামিয়ে এক এক বারে বিশাল ওজনের ওয়াগনগুলোকে তুলে নিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে একটু দূরের কনভেয়ার বেল্টগুলোর ওপর। আর খালি হয়ে ফিরে আসা ওয়াগনগুলো আবার বসে যাচ্ছে ম্যাগলেভ লাইনের ওপর। টেকনিশিয়ানরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে সেদিক।
—জানো এই জায়গাটায় আমার খুব ভালো লাগে। এখানে সবাই ব্যস্ত, যে যার নিজের কাজ নিয়ে। এখানে কেউ আমায় বিরক্ত করে না, কারণ কাজ ছেড়ে এদিক ওদিক করলেই মিনিট হিসেবে স্যালারি কাটা যায়… এই একটা দারুণ জিনিস দেখবে?
বলেই তানিয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করে তার হাত ধরে টানতে থাকে নিলম। ওর সঙ্গে চলতে চলতে খনির মুখের একটু পিছনে একটা ঢিবির উপর এসে দাঁড়ায় ওরা দুজন। সামনে তাকাতেই গোটা বেসটা যেন ভেসে ওঠে তানিয়ার চোখের সামনে।
যেন একটা অনেক উঁচু থেকে দেখা পিঁপড়ের বাসা। বেসের মধ্যে সারি সারি দিয়ে চলেছে। জমে থাকা জঞ্জালের স্তূপ এখান থেকে আর দেখা যাচ্ছে না, তার জায়গায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে বেসের ওপর জমাট বাঁধা একটা হালকা সবুজ কুয়াশার স্তর। উপর থেকে নেমে আসা হাইবিম লাইটগুলো যেন সেই কুয়াশার চাদরে প্রতিফলিত হয়ে এক মায়াবী ছবি এঁকে চলেছে একটানা বয়ে চলা যান্ত্রিক এই বেসের পটভূমিতে।
মুগ্ধ হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে তানিয়া, নিলম আলতো করে তার বর্মের কাধে নিজের মাথাটা রাখে।
—আর কতদিন এখানে আছ তুমি কম্যান্ডার?
নিলমের প্রশ্ন যেন আবার বাস্তবের মাটিতে ফিরিয়ে আনা তানিয়াকে। সে ওর দিকে ফিরে প্রশ্ন করে,
—আচ্ছা নিলম, তুমি তো মেফিস্টোর অনেক কাছাকাছি গেছ। তুমি কি এই গত সপ্তাহের মধ্যে ওকে কখনও কোনো এমারজেন্সি যান বা ওই ধরনের কোনো যানকে নিয়ে কথা বলতে শুনেছ?
ওর ঘারে মাথা রেখেই নিলম বলল,
—হ্যাঁ, শুনেছি… অনেক বার শুনেছি… এই গোটা মাসটা তো ওই নিয়েই কেটেছে ওর… ওর আর ডক্টর স্টার্ন দুজনেরই…
নিলমের কথায় কানটা খাড়া হয়ে ওঠে তানিয়ার। তাহলে কি সে যা আন্দাজ করেছিল সেটাই ঠিক, ওসানা কি সত্যিই কসমেটিক সার্জারি করে নিজের ভোল বদলে ফেলতে চাইছে?
—কিন্তু তোমাকে সেই জায়গায় নিয়ে গেলেই তো তুমি কাজ শেষ করে চলে যেতে চাইবে… তাই না? তাহলে তোমাকে নিয়ে যাবো কেন?
দুষ্টুমি মাখা একটা হাসি হেসে বলে নিলম, তারপর নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে তানিয়াকে তার পিছন পিছন আসতে বলে ইশারায়।
খনির মূল গেট এরিয়ার বাইরে বেরোলেই প্রসেসিং প্লান্ট শুরু। সেরকমই দুটো প্লান্টের মাঝখানের গলিপথ দিয়ে এগিয়ে চলে ওরা। প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটার পর একটা খালি চত্বরে এসে পৌঁছয়। তানিয়া লক্ষ করে বেসের এই অংশটা যেন অস্বাভাবিকভাবে ফাঁকা। একটু দূর থেকে ভেসে আসা খনির যান্ত্রিক একটা চাপা গুঞ্জন ছাড়া বাকি বেসের শব্দ যেন এখানে এসে কোথাও হারিয়ে গেছে। চত্বরের একদিকে সারি সারি কয়েকটা আয়তাকার বিল্ডিংয়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে নিলম বলে ওঠে,
—ওগুলো মেফিস্টোর গো-ডাউন। ও যা যা জিনিস বাইরে থেকে আনে সব ওখানেই রাখা থাকে। এসো আমার সঙ্গে…
এই বলে একটা নির্দিষ্ট গো-ডাউনের দিকে এগোতে থাকে নিলম। সেটার সামনে পৌঁছে তানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
—আমি যখন প্রথম এখানে এসেছিলাম তখন আমাকেও তিন দিন এখানে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল… তখনই আমি গো-ডাউনের পাসওয়ার্ডগুলো শিখে নিয়েছিলাম। মেফিস্টো নিজে পাসওয়ার্ড মনে রাখার ব্যাপারে বেশ কাঁচা… তাই বিশাল কোনো ঝামেলায় না পড়লে পাসওয়ার্ড বদলায় না। দেখি এবার আমার কতটা মনে আছে…
গো-ডাউনের দরজার পাশে একটা লুকোনো সুইচ টিপতেই একটা ছোট্ট প্যানেল সরে গিয়ে একটা নাম্বার প্যাড জেগে উঠল সামনের দেওয়ালটায়। সেখানে গিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটা সংখ্যা চাপ দিতেই গো-ডাউনের দরজাটা ধীরে ধীরে নীচে নেমে যেতে শুরু করল।
ভিতরে জ্বলে ওঠা উজ্জ্বল আলোতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যানটার গাঁয়ে আঁকা রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা ঝলক দিয়ে উঠল তানিয়ার দুই চোখে।
রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৭৪৮৮KL৯
ডক্টর ড্যানিয়েল স্টার্ন
—হ্যালো… মেন কম্যান্ড আমি অফিসার রিপ্লি বলছি… শুনতে পাচ্ছেন মেন কম্যান্ড?… ওভার।
—মেন কম্যান্ড বলছি… আমরা আপনার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি অফিসার রিপ্লি… ওভার।
—মেন কম্যান্ড… আমরা এমারজেন্সি যান ৭৪৮৮KL৯, যেটি নিয়ে ডেভিড ওসানা পলাতক হয়েছিল সেটির সন্ধান মাইনিং পোস্ট ৭৪ এ আমরা পেয়েছি… আমরা কনফার্ম করছি যে ডেভিড ওসানা এই গ্রহে এসেছিল এবং হয়তো সে এখানেই আছে… আমি এবং কম্যান্ডার লাহিড়ী ওসানাকে এখানেই খুঁজছি… আমাদের কাজে সাহায্য করার জন্য একজন লোকাল নাগরিকের সাহায্য নিতে হয়েছে… আমরা তাকে উইটনেস প্রোটেকশান প্রোগ্রামে সুরক্ষা দিতে চাই… কারণ আমাদের বিশ্বাস এই বেসে তাঁর জীবনের ঝুঁকি রয়েছে… তাই সেই নাগরিককেও আমরা আমাদের সঙ্গে নিয়ে আসতে চাই… এই বিষয়ে আপনাদের অনুমতি চাইছি… ওভার।
—অনুমতি দেওয়া হল অফিসার রিপ্লি… আপনি এবং কম্যান্ডার লাহিড়ী মিশন শেষ হলে ওই নাগরিককে উইটনেস প্রোটেকশান প্রোগ্রামের অধীনে মেন কম্যান্ডে আনতে পারেন… আর কিছু… ওভার।
—আমার বার্তা এখানেই শেষ মেন কম্যান্ড… ওভার।
—ওভার অ্যান্ড আউট।
রিপ্লির সঙ্গে মেন কম্যান্ডের বার্তার আদানপ্রদান টেবিলের কোনে বসে চুপচাপ শুনছিল তানিয়া। টেবিলেরই অন্য ধারে একটা চেয়ারে বসেছিল নিলম। উইটনেস প্রোটেকশান প্রোগ্রামের পারমিশন আসার সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দে লাফিয়ে উঠল সে। তানিয়া চোখের ইশারায় ওকে বারণ না করলে হয়তো জড়িয়েই ধরত দৌড়ে এসে।
রিপ্লি রেডিয়ো অফ করার পর তানিয়া বলল,
—তাহলে আমাদের পরের স্টেপ হল ডক্টর স্টার্নের সঙ্গে দেখা করে ওসানার ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া।
—কম্যান্ডার আমার মনে হচ্ছে না ব্যাপারটা এখন এত সহজ হবে। নিলম যে আমাদের সাহায্য করছে এবং ও আমাদের কাছে সব কথা জানিয়েছে সেটা এতক্ষণে নিশ্চয়ই লুক মেফিস্টো জানতে পেরে গেছে। আমরা যতই ক্যাপ্টেন হ্যানাকে লুকিয়ে নিলমকে এখানে নিয়ে আসি না কেন, আমরা ভুলে যাচ্ছি যে এই বেসটার সিকিউরিটি ইন চার্জ উনি এবং বেসের সব ক-টা ক্যামেরার ফিড ওঁর হাতে। উনি নিশ্চয়ই এতক্ষণে নিলম যে এখানে আমাদের সঙ্গে লুকিয়ে আছে সে কথাটাও লুক মেফিস্টোকে জানিয়ে দিয়েছেন… সে কোনোমতেই চাইবে না যে আমরা এই ডক্টরের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই… তাহলে আমরা এখন তাকে খুঁজে পাবো কী করে?
রিপ্লির প্রশ্নের উত্তরে তানিয়া নিলমের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই নিলম হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
—থাক! আর বলতে হবে না কম্যান্ডার… সব বারের মতো আপনাদের এই প্রবলেমের সমাধানও আমিই করে দিচ্ছি। ডক্টর স্টার্ন আমাকে কিছুটা স্নেহের চোখেই দেখেন, আমিই ওঁর সঙ্গে আপনাদের একটা মিটিং-এর ব্যবস্থা করে দেব, তবে একটা কাজ তার জন্য আপনাদের করতে হবে… এইভাবে পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম বা বর্ম পড়ে গেলে সেটা আমাদের সবার পক্ষে এমনকি ডক্টরের পক্ষেও বিপদের কারণ হবে। তাই প্লেন ড্রেসে আমরা আজ রাতে যাবো…
তানিয়া নিলমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে ওঠে,
—তবে তাই হোক…
সেই প্ল্যান মতো ওরা তিনজনেই সন্ধেবেলা বেরিয়ে পড়ল বেসের সিকিউরিটি ব্যারাক থেকে। ওদের আজকের গন্তব্য অলিম্পাস নামের একটা হার্ডওয়ারের দোকানে। আজ বিকেলেই ডক্টর স্টার্নের সঙ্গে বেতারে যোগাযোগ করে নিলম তাকে রাজি করিয়েছে দেখা করার জন্য। নিজেও ডক্টর স্টার্নের থেকে একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট জোগাড় করে ক্যাফে বিবপের থেকে আজ রাতের জন্য ছুটি নিয়ে নিয়েছে। দোকানের জায়গাটাও ওরই ঠিক করা, কারণ দোকানটা শহরের এক কোনে এবং অফিস টাইমের পর সাধারণত খালিই পড়ে থাকে।
আট’টা নাগাদ দোকানে পৌঁছে অবশ্য দোকানটাকে পুরো খালি পেল না ওরা। দুজন খদ্দের তখনও রয়েছে, তারা শোকেসে রাখা রোবোটিক ড্রিলের ব্লু টুথ কানেক্টর নিয়ে দরদাম করছিল ক্যাশে বসে থাকা দোকানির সঙ্গে।
ওরা তিনজন দোকানের ভেতরে ঢুকে এটা সেটা দেখতে লাগল। রিপ্লিও নিজের জন্য একটা টেকনিশিয়ান ইউনিফর্ম জোগাড় করে নিয়েছে, নিলম আর তানিয়ার মুখও ঢাকা মোটা গগলস আর ব্রিথিং মাস্কের নীচে। সাধারণত যেসব টেকনিশিয়ানরা খনির গভীরে যন্ত্রপাতির খেয়াল রাখে তারা প্রায় সবসময়ই এই ব্রিথিং মাস্ক ব্যবহার করে, নিজের ফুসফুস জোড়াকে যতটা বাঁচানো যায় আর কি।
খুব বেশিক্ষণ অবশ্য অপেক্ষা করতে হল না ওদের, ডক্টর স্টার্ন যা দেখা গেল খুবই সময়ানুবর্তী মানুষ। কথামতো একদম সাড়ে আটটার সময় দোকানের কাচের দরজায় তার লম্বা ছায়াটা ভেসে উঠল। নিলমই কনুইয়ের গুঁতোতে তানিয়াকে বুঝিয়ে দিল যে এই লম্বা, কিছুটা ঝুঁকে পড়া বছর ষাটের লোকটিই ডক্টর ড্যানিয়েল স্টার্ন। সেটা না করলেও চলত কারণ প্রৌঢ় লোকটি দোকানের ভেতরে পা রাখামাত্রই দোকানি বলে উঠল,
—আরে, ডক্টর স্টার্ন যে! কি সৌভাগ্য আমার! কিন্তু আমার দোকানে কি আপনার কাজের যোগ্য কিছু পাবেন?
ডক্টর একটু হালকা হেসে বললেন,
—হ্যাঁ, কিছু ব্যাটারি তো পেতেই পারি… তাই না?
—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই… নিশ্চয়ই… আপনি আইল নম্বর তিনে চলে যান, ওখানেই সব ধরনের ব্যাটারি সেট রাখা আছে…
মাথাটা হালকা ঝুঁকিয়ে দোকানির উদ্দেশে একটা ছোট্ট ধন্যবাদ দিয়ে ডক্টর এগিয়ে আসেন নিলম যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে। আইল তিনে রাখা ব্যাটারির সেটগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতেই চুপিসারে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিলমের কানে কানে কিছু বললেন তিনি। নিলম হাতের ইশারায় তানিয়াকে এগিয়ে আসতে বলল ওদের দিকে।
তানিয়া ওদের কাছে পৌঁছতেই উনি চুপিসারে বলে উঠলেন,
—কম্যান্ডার, নিলম আমাকে আপনাদের মিশনের কথা কিছুটা বলেছে, কিন্তু এ বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য খুব আদর্শ পরিবেশ এটা নয়… আমি ভেবেছিলাম যে এই দোকানদার আমায় চিনতে পারবে না, কিন্তু এখন দেখছি আমার সেই ধারণা ভুল ছিল… নিলম, তুমি কি কোনো জায়গা সাজেস্ট করতে পারো যেখানে আমরা নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারি?
নিলম উত্তরে ঘাড় ডান দিক বাঁ দিক নাড়িয়ে বলল,
—সরি ডক্টর, এখন আপনার সঙ্গে রাস্তায় আমার পক্ষে বেরোনো সম্ভব নয়। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কম্যান্ডারের প্রশ্নের উত্তর এখানেই দিয়ে দিন।
তানিয়া মনে মনে বুঝল নিলমের রাজি না হওয়ার কারণটা। ও শেষ মুহূর্তে পৌঁছে আর কাউকে বিশ্বাস করতে চাইছে না। তানিয়া আর সময় নষ্ট না করে ডেভিড ওসানার একটা ছবি ডক্টর স্টার্নের সামনে তুলে ধরল।
—একে দেখেছেন, ডক্টর?
ডক্টর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে বললেন,
—হ্যাঁ, দেখেছি। আজ থেকে প্রায় তিন সপ্তাহ আগে মিস্টার মেফিস্টো একে আমার কাছে নিয়ে এসেছিল।
—আপনি কি বলতে পারেন যে মেফিস্টোকে এই কাজে এই বেসের আর কেউ সাহায্য করেছিল কিনা? বা ঠিক কোন উপায়ে মেফিস্টো তাকে এই বেসের ভিতরে নিয়ে এসেছিল?
ডক্টর স্টার্ন একবার চারদিক দেখে নিয়ে গলা নামিয়ে বললেন,
—কম্যান্ডার, আমি যতদূর জানি মূল খনির আশপাশের কিছু জায়গায় কিছু লুকোনো সুড়ঙ্গ বানানো আছে, যেগুলো একদম এই গ্রহাণুর পৃষ্ট অবধি বেসকে জুড়ে রাখে। সুড়ঙ্গগুলো খুব সরু, সেগুলো দিয়ে কোনো সাধারণ যান ঢুকতে পারে না। কিন্তু খুব দক্ষ কোনো পাইলট হলে ওই পথ দিয়ে কোনো ছোটোযান উড়িয়ে নিয়ে সরাসরি বেসের ভিতর মিস্টার মেফিস্টোর গো-ডাউনে পৌঁছে যেতে পারে। মিস্টার মেফিস্টো বাইরে থেকে যা যা আইটেম নিয়ে আসেন সব ওই পথেই বেসের ভিতরে এসে পৌঁছায়। সিকিউরিটি স্ক্যানারে ধরাও পড়ে না। আমার মনে হয় এরকম কোনো পথ দিয়েই এই লোকটিকে বেসের ভিতরে নিয়ে আসা হয়।
—মেফিস্টো কি আপনাকে কসমেটিক সার্জারি করে এর চেহারা বদলে দিতে বলেছিল?
এই প্রশ্নের উত্তরে অল্প হেসে ডক্টর বললেন,
—না কম্যান্ডার, এই বুদ্ধিটা প্রথমেই মিস্টার মেফিস্টোর মাথায় আসেনি, আমিই আইডিয়াটা দিই… আর আমার হাতের যা কাজ তাতে আপনাদের কোনো ফেসিয়াল স্ক্যানার ডেভিড ওসানাকে চিনতে পারবে না, এই বেসে ভেসে বেড়ানো হাজার হাজার মুখের ভিড়ে হারিয়ে যাবে সে…
দোকানের দরজার দিক থেকে দরজা খোলার শব্দ শুনে সেদিকে চোখ চলে যায় তানিয়ার। আর তখনই একটা ঠান্ডা স্রোত যেন নেমে যায় ওর শিরদাঁড়া দিয়ে। দোকানের দরজা ঠেলে ওর দিকে লক্ষ্য করেই এগিয়ে আসছে আগের রাতে দেখা তিনটে শয়তান—লালা, অরভিন্দ আর রুডি।
সামনের দিকে তাকিয়ে তানিয়া দেখতে পায় ডক্টর স্টার্নের মুখে ফুটে উঠছে একটা নিশ্চিন্ত হাসির ভাব। প্রমাদ গোনে সে, ছদ্মবেশের কারণে আজ তার বর্ম নেই। একবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আতঙ্কে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া নিলমের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে, রিপ্লিকে সাবধান করার আগেই নিজের ঘাড়ের কাছে একটা প্রচণ্ড আঘাত অনুভব করে তানিয়া। অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার মুহূর্তে নিলমের চীৎকার ভেসে আসে তার কানে।
শেষ অঙ্ক
কানে তালা ধরার মতো একটানা একটা শোঁ শোঁ শব্দ ভেসে আসছিল তানিয়ার কানে। চোখের পাতাটা যেন প্রচণ্ড ভারী হয়ে রয়েছে আর সঙ্গে রয়েছে মাথার নীচে ঘাড়ের ওপর একটা ভীষণ যন্ত্রণার বোধ। জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই যন্ত্রণাটা যেন বেড়ে উঠছিল প্রতি মুহূর্তে। অনেক কষ্টে চোখটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র উজ্জ্বল একটা সাদা আলো যেন এসে ঝাপটা মারলো ওর দুই চোখে। চোখের পাতা একবার খুলেই আবার বুজিয়ে ফেলল তানিয়া। এক লহমার দৃষ্টিতে মনে হল কেউ যেন বসে আছে ওর বিপরীতে, ওর থেকে একটু দূরে।
এক মিনিট… দু-মিনিট… কিছুটা সময় কেটে গেল সেইভাবে। তারপরেই হঠাৎ একটা ঠান্ডা জলের ঝাপটা এসে পড়ল তানিয়ার মুখে। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন চেতনা ফিরে এল তানিয়ার শরীরে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় বসে থাকার জায়গা থেকে এক ঝটকায় ওঠার চেষ্টা করতেই তানিয়া বুঝতে পারল যে তাকে একটা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রেখে আছে।
—এত হুড়োহুড়ির কোনো প্রয়োজন নেই ম্যাডাম কম্যান্ডার… আপনি এখন নিশ্চিন্তে আরও কিছুক্ষণ চাইলে বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারেন…
একটা পরিচিত মোলায়েম স্বর ভেসে এলো তানিয়ার কানে। মাথার যন্ত্রণাটা অগ্রাহ্য করেই চোখ খুলে তাকাতেই উলটো দিকের সোফায় বসা মেফিস্টোর মুখের উপর লেগে থাকা হালকা হাসিটা চোখে পড়ে গেল ওর।
—চিন্তা করবেন না ম্যাডাম কম্যান্ডার… আপনার বন্ধুরা দুজনেই ঠিক আছে আর রুডি আর ওর সঙ্গীরাও এখানে নেই…
মেফিস্টোর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ভালো করে তাকিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিল তানিয়া। একটা সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের লিভিং রুমে বসে আছে সে। ওর ডানপাশের আরেকটা চেয়ারে বসে রয়েছে ব্রায়ান, মেফিস্টোর বাঁ দিকে মেঝের ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছে নিলমকে। লিভিং রুম থেকে যে দরজাটা সম্ভবত বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেছে সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ডক্টর স্টার্ন। তার মুখেও খেলা করছে হাসির আভা।
বিশ্বাসঘাতকতাটা বুঝতে পেরেই রাগে আরেকবার চেয়ার ছেড়ে উঠবার চেষ্টা করে ওঠে তানিয়া।
—ম্যাডাম কম্যান্ডার… মাই ডিয়ার ম্যাডাম কম্যান্ডার… আপনি প্লিজ ডক্টরের ওপর রাগ করবেন না, যদিও আমি জানি যে এই পরিস্থিতিতে রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক তবুও আপনার প্রিয়জনের ভালোর জন্যই বলছি… আমি জানি যে আমার ওই পলকা বাঁধন ছিঁড়ে ফেলা আপনার মতো হাইলি ট্রেইনড একজন সৈনিকের পক্ষে কোনো ব্যাপারই নয়… কিন্তু তবু আমি আপনাকে অনুরোধ করব আমার বাঁ হাতের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর এরকম কোনো হঠকারী সিধান্ত নেওয়ার।
তানিয়ার চোখ চলে গেল নিলমের দিকে এগিয়ে থাকা মেফিস্টোর হাতটার দিকে। থরথর করে কেঁপে চলা নিলমের মুখ থেকে একটু দূরে সোনালি রঙের একটা ধাতব পিস্তল ধরা রয়েছে সে হাতে।
—.৫০ ডেসার্ট ইগল… পৃথিবীতে তৈরি… ২০১৪ সালে… গ্যাস অপারেটেড, সেমি অটোম্যাটিক… আপনাদের স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু ম্যাগনাম ইলেক্ট্রো মাস্টারের মতো অতো আধুনিক নয় অবশ্যই… কিন্তু এর বিশেষত্ব কি বলুন তো? এটায় কোনো নন-লিথাল সেটিং নেই। আমি যদি, ঈশ্বর না করুন, এর ট্রিগারে চাপ দি তাহলে আমাদের সবার ভালোবাসার নিলমের এই সুন্দর মুখটা নিমেষে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে… আর কোনো বিকল্পই থাকবে না… আপনি নিশ্চয়ই সেটা চাইবেন না তাই না ম্যাডাম কম্যান্ডার…?
নিলমের চোখে লেগে থাকা ভয়টা মুহূর্তের জন্য তানিয়ার মনে একটা ছায়া ফেলে দিয়েই আবার সরে গেল। নিজের গলার স্বর যতসম্ভব শান্ত করে মেফিস্টোর দিকে এবার সোজা চোখে তাকিয়ে কথা বলল তানিয়া,
—স্টার মেফিস্টো, আপনি ইউনিভার্সাল স্পেস ফোর্স গ্রেড টু কম্যান্ডার তানিয়া লাহিড়ীর সঙ্গে কথা বলছেন। যার নামের পাশে ১৩৪টা কনফার্মড কিল রয়েছে… সেই সংখ্যাটা বেড়ে ১৩৫ হোক আপনিও নিশ্চয়ই সেটা চাইবেন না তাই না… আমি যদি, ঈশ্বর না করুন, এই চেয়ার থেকে এক্ষুনি নিজেকে ছাড়িয়ে ফেলি তাহলে কিন্তু আমারও কোনো নন-লিথাল সেটিং থাকবে না… আর তার জন্য আমার কোনো অস্ত্রের প্রয়োজন হবে না…
মেফিস্টোর চোখের ভাষা যেন এবার একটু বদলাল। সে ডক্টর স্টার্নের দিকে একটা ইশারা করতেই তিনি এগিয়ে এসে তানিয়ার হাতের বাঁধন খুলে দিতে দিতে বললেন,
—কম্যান্ডার, আমরা জানি যে আপনি ডেভিড ওসানাকে খুঁজছেন… কিন্তু আমি আপনাকে বলছি এই ব্যাপারে আপনি, আমি আর মিস্টার মেফিস্টো একই দলে আছি…
—আপনার কোনো কথা আর শুনতে চাই না ডক্টর…
গর্জে উঠল তানিয়া,
—একজন অপরাধীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য, তাকে পালাতে সাহায্য করার জন্য, ইউনিভার্সাল স্পেস ফোর্সের দুজন অফিসারকে কাজে বাধা দেওয়ার জন্য এবং তাদের অপহরণের জন্য আপনাদের গ্রেফতার করা হল…
—কী বললেন কম্যান্ডার… ওসানাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য… ওসানাকে পালাতে সাহায্য করার জন্য?
কথাটা বলে হাসিতে ফেটে পড়লেন প্রায় ডক্টর স্টার্ন, মেফিস্টোও সেই হাসিতে যোগ দিল।
হাসতে হাসতেই ডক্টর এসে বসলেন মেফিস্টোর পাশের জায়গায়। এই প্রথম রিপ্লি কথা বলে উঠল,
—কেন, আপনারা ওসানাকে লুকিয়ে রাখেননি? অস্বীকার করতে পারেন সেই কথা?
—একবারও না… ডেভিড ওসানা আমাদের হেফাজতেই আছে… সত্যি বলতে কি আমাদের মাঝেই আছে… কি লুক ওসানাকে একবার এনে দেখানো যাবে নাকি কম্যান্ডার লাহিড়ীকে?
মুখে সেই সবসময় লেগে থাকা ঠান্ডা হাসিটা নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো লুক মেফিস্টো, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল লিভিং রুমের লাগোয়া দরজাটার দিকে।
তারপরেই চকিতে ঘুরে এসে দাঁড়ালো মেঝেতে বসে থাকা নিলমের দিকে। অল্প ঝুঁকে বলে উঠল,
—ডেভিড ওসানা… ডেভিড ওসানা… শুনতে পাচ্ছ ডেভিড… তোমাকে আবার আইনের শাস্তিতে ফেরানোর জন্য লোক এসেছে… শুনতে পাচ্ছ…
এই কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই এক অদ্ভুত পরিবর্তন যেন ঘটে গেল নিলমের মধ্যে। এক প্রচণ্ড যন্ত্রণার আভাস যেন ফুটে উঠল তার কান্না ভেজা মুখটায়। সে নিজের মাথাটা দুই হাতে আঁকড়ে ধরে সজোরে নাড়াতে লাগল ডাইনে বাঁয়ে। তানিয়াকে অবাক করে দিয়ে সে বলে উঠল,
—না… না… ওই নাম নয়… ওই নাম নয়… আমি… আমি… নিলম… ওসানা আর নেই… সে নেই… সে নেই… ওসানা মরে গেছে… সে মরে গেছে…
ভয়ানকভাবে চিৎকার করতে থাকা নিলমের দিকে তাকিয়ে মেফিস্টো বলে উঠল,
—আরে মরে গেলে তো বেঁচেই যেতে ডেভিড… শাস্তি আর পেতে কই… দেখুন ম্যাডাম কম্যান্ডার, আপনার অপরাধী হাজির… এই হল ডেভিড ওসানা… বিশ্বাস না হলে ডিএনএ চেক করতে পারেন, ফিঙ্গার প্রিন্ট-ও… ওছাড়া ডেভিড ওসানার আর কোনো অস্তিত্ব আর নেই… ডক্টর স্টার্নের আজ অবধি করা শ্রেষ্ঠ কাজ… ডেভিড ওসানা, যে এখন আপনার সামনে বসে রয়েছে নিলম হয়ে।
মাথা ঝাঁকিয়ে একটানা কেঁদে চলা নিলমের দিকে অবিশ্বাসে তাকিয়ে থাকা তানিয়ার উদ্দেশে এবার বলে উঠলেন ডক্টর স্টার্ন,
—এটাই সত্যি কম্যান্ডার লাহিড়ী। ডেভিড ওসানাই নিলম। মার্স সিটি থেকে পৃথিবী নিয়ে যাওয়ার সময় ডেভিড ওসানা যে যানটিতে পালিয়েছিল, সেটাতে আগে থেকেই মাইনিং পোস্ট ৭৪ এর ম্যাপ লোড করা ছিল এবং জ্বালানিও সেই পরিমাণে রাখা হয়েছিল। সে এখানে আসার পর মিস্টার মেফিস্টো ওকে বেসের ভিতরে ঢুকতে সাহায্য করেন আর তারপর ওকে বন্দি করে আমার কাছে নিয়ে আসা হয়…
—আমি… আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ডক্টর স্টার্ন… আপনি… কী করে…
—ব্যস্ত হবেন না কম্যান্ডার লাহিড়ী। আমরা ডেভিড ওসানাকে বাঁচাবার জন্য পালাতে সাহায্য করিনি, ওকে শাস্তি দেওয়াই ছিল আমাদের লক্ষ্য। ও যা করেছিল তার জন্য ওকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম আমি। তবে আমার এই কাজে মিস্টার মেফিস্টো ছাড়া আরেকজনকে আমি পাশে পেয়েছি সব সময়। সে হল আপনার সহকর্মী ব্রায়ান…
চমকে এবার পাশে বসে থাকা রিপ্লির দিকে তাকাল তানিয়া। তার মুখে এক চরম শান্তির ছাপ যেন ছেয়ে আছে। তানিয়ার রাগ এবার ফেটে বেরোল,
—ব্রায়ান… অফিসার রিপ্লি… কিন্তু কেন? কেন তুমি এঁদের সাহায্য করছ আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিতে। তুমি জানো না ইউনিভার্সাল স্পেস ফোর্স এর জন্য তোমাকে কোর্ট মার্শাল করবে?
এতক্ষণে এই প্রথম কথা বলল রিপ্লি,
—প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এমন একটা সময় আসে যখন আমরা আইনকে শুধু নিজের হাতে তুলে নিতে নয়, তাকে দুমড়ে মুচড়ে বাজে কাগজের গাদায় ফেলে দিয়ে তার ওপর কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতে বাধ্য হই। কারণ আইন যখন ঠুটো পুতুল হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার প্রতিমাকে মাথায় তুলে ঘোরানোর কোন মানে হয় না, কম্যান্ডার। আমার জীবনের সবথেকে ভালোবাসার মানুষটিকে… আমার দিদিকে আমার জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছিল এই শয়তান…
কথা বলতে বলতেই উঠে দাঁড়িয়ে মেঝেতে বসে থাকা নিলম ওরফে ডেভিড ওসানার দিকে ছুটে যায় রিপ্লি । কিন্তু মেফিস্টো শক্ত হাতে তার রাস্তা আটকে দাঁড়ায়। ডক্টর স্টার্ন এগিয়ে এসে হাত রাখে রিপ্লির কাঁধে। ডুকরে কেঁদে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে ব্রায়ান।
—শান্ত হও… শান্ত হও ব্রায়ান। আমরা যাকে হারিয়েছি তাকে আমরা আর কোনোদিনই ফেরত পাবো না, কিন্তু এখন সেই শয়তান যে আমার জেন-কে… তোমার দিদি জেন-কে আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছিল তার যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করে যেতে পারছি… এখন এটাই আমার শান্তি…
ব্রায়ানকে শান্ত করতে করতে ডক্টর স্টার্ন এবার তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন,
—কম্যান্ডার লাহিড়ী, আজ থেকে তিন বছর আগে লাস ভেগাসে ডেভিড ওসানার লালসার বলি হওয়া জেন গঞ্জালেসের স্বামী হলাম এই আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ডক্টর ড্যানিয়েল গঞ্জালেস। নিজের পদবী তা বদলালেও, যে নাম ধরে জেন আমায় ডাকত সেই নাম আমি বদলাতে পারিনি… আর এই যে দেখছেন ব্রায়ান… ব্রায়ান হল জেন এর ভাই… ওর সবথেকে আদরের ভাই… বিশ্বাস করুন কম্যান্ডার মেনে নিতে পারিনি, এখনও মেনে নিতে পারিনি যে ফুলের মতো নিস্পাপ জেন যে কিনা লাস ভেগাসের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসা মেয়েগুলোকে বাঁচানোর জন্য দিনের পর দিন এনজিও চালিয়েছে, তাকে কিনা একেবারে শেষ করে দিয়েছিল এই শয়তানটা… উফফ, এখনও আমার চোখে ভাসে জেনের সেই ক্ষত বিক্ষত মৃত মুখে জেগে ওঠা ভয়ের সেই দৃষ্টি… মেনে নিতে পারিনি আমি। তখনই ঠিক করেছিলাম যে ডেভিডকে সেই সব যন্ত্রণা ধীরে ধীরে ফিরিয়ে দেব। আর যখন দেখলাম আপনাদের আইন ডেভিডকে ওর যুদ্ধের সময়ের বীরত্বের কথা মাথায় রেখে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে শুধু সশ্রম যাবজ্জীবন দিল তখনই… তখনই যেটুকু বিশ্বাস আমাদের টিকে ছিল আইনের ওপর সেটাও ভেঙে গেল। তারপর থেকে আমরা দুজনে মিলে প্ল্যান করেছি ডেভিডকে নাগালের মধ্যে পাওয়ার। সময়মতো মিস্টার মেফিস্টোকেও নিজেদের কথা জানাই। ব্যাঙ্ককে যে দুটি মেয়েকে ডেভিড খুন করেছিল ওরা মিস্টার মেফিস্টোর ওখানকার বারেই কাজ করত। তাই উনিও রাজি হন আমাদের সাহায্য করতে। প্ল্যানমাফিকই আমরা ডেভিডের উকিলের কাছে কিছু মিথ্যে প্রমাণ পাঠাই, যাতে মার্স সিটির জেল থেকে ব্রায়ান ওকে ট্রান্সফার করে বাইরে নিয়ে আসতে পারে। ট্রান্সফারের সময় ও ইচ্ছে করেই ডেভিডকে পালানোর সুযোগ করে দেয় আর সব ব্যবস্থা করে রাখে যাতে ডেভিড এখানে এসে পৌঁছয়।
এখানে আসার পর শুরু হয় আমাদের আসল প্রতিশোধ। আপনি বোধহয় জানেন কম্যান্ডার যে আমি একজন কসমেটিক সার্জন হিসেবেই পরিচিত। সত্যি বলতে কি আমার লাস ভেগাস যাওয়ার পিছনেও ছিল আমার কসমেটিক সার্জারি নিয়ে গবেষণা। কোনো মানুষকে ধীরে ধীরে সার্জারির মাধ্যমে একদম অন্য মানুষ করে তোলা যায় কিনা এটা নিয়েই কাজ করছিলাম আমি। ব্যাপারটা জটিল হয়ে ওঠে যদি অন্য মানুষটার সেক্স চেঞ্জ করার ব্যাপার থাকে, প্রায় এক থেকে দেড় বছর লাগত এক সময় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি সম্পূর্ণ করতে। কিন্তু আমি… আমি সেটাকে মাত্র এক সপ্তাহে করতে পারি কম্যান্ডার, মাত্র এক সপ্তাহে… আমি সেটা করেই ডেভিডকে এই বেসের শয়তানদের সামনে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম… কিন্তু…
—কিন্তু সেটা আমি হতে দিইনি ম্যাডাম কম্যান্ডার…
ডক্টর স্টার্নের কথা থামিয়ে হাতে ধরা পিস্তলটাকে সামনের টেবিলে রাখতে রাখতে বলে উঠল লুক মেফিস্টো,
—আপনি আমায় যা খুশি মনে করতে পারেন কিন্তু সত্যি এটাই যে ওই মেয়েগুলোর শেষ আশ্রয় ছিলাম আমিই। আমরা এখন অনেক… অনেক এগিয়ে গেছি… প্রযুক্তিতে… আমাদের চিন্তা ভাবনায়… কিন্তু কোথাও যেন… এখনও সেই আদিম চাহিদাগুলো আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলে… আর সেই চাহিদাগুলো মেটায় যারা তারা কেন জানি না আমাদের ঘেন্নার পাত্র হয়ে দাঁড়ায়… তাই আমি চেয়েছিলাম এই ওসানাকে এমন শিক্ষা দিতে যাতে সে শুধু শরীরে নয়, মন থেকে বুঝতে পারে যে মেয়েগুলো ওর হাতে খুন হয়েছিল তাদের অবস্থাটা। আমাদের প্লেসার ইন্ডাস্ট্রিতে যারা কাজ করে সেই সব ছেলেমেয়েদের মানসিক ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য… যাতে তাদের কাজের কোনো ট্রমা তাদের প্রতিদিনের কাজে কোনো বাধা না দেয়… তাই কখনও কখনও আমরা এক ধরনের মডিফায়েড রোহিপনল কম্পাউন্ড ব্যবহার করি… যাতে ওই ভয়ংকর স্মৃতিগুলো মন থেকে মুছে অন্য মেমোরি তার জায়গায় বসিয়ে দেওয়া যায়… তাতে ওদের বেঁচে থাকা একটু সোজা হয়ে ওঠে… কিন্তু আমি তো চাইনি যে ওসানার বেঁচে থাকা সোজা হয়ে উঠুক… আমি চেয়েছিলাম যে যন্ত্রণা আমার মেয়েগুলো ভোগ করেছে ওর হাতে আমি চেয়েছিলাম যে সেই যন্ত্রণাটাই ওকে ফিরিয়ে দিতে, তাই ডক্টর যখন ওর সার্জারি শেষ করে ওকে বেসের রাস্তায় ছুড়ে দিতে চেয়েছিল তখন আমি সেটা আমি হতে দিইনি ম্যাডাম কম্যান্ডার… আমি হাই ডোজ মডিফায়েড রোহিপনল ওকে রেগুলারলি দিয়ে গেছি আর ওর মাথায় একের পর এক ফলস মেমোরি ঢুকিয়ে গেছি যাতে ও ধীরে ধীরে নিজেকে নিলম ভাবতে থাকে… নিলম ছিল পৃথিবীতে ফেরার পর ওর প্রথম শিকার, যাকে ব্যাঙ্ককের গলির ভেতরে ছুরি দিয়ে ফালাফালা করে কেটে যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে মেরেছিল শয়তানটা… সেই নিলমকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম আমি ডেভিড ওসানাকে শেষ করে দিয়ে… তাই শুধু সপ্তাহে একদিন ওকে আমি ওষুধটা দিতাম না যাতে ওর অবচেতনে টিকে থাকা ডেভিড ওসানার সত্তাটা তখনও বেঁচে আছে কিনা দেখার জন্য…
মেফিস্টোর কথা শেষ হতে না হতেই ভয়ংকর এক চিৎকার করে কেঁদে উঠল ওসানা, ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠল,
—তোমরা আমায় ছেড়ে দাও… আমায় মুক্তি দাও… মরতে দাও আমায়… মরতে দাও… মরতে দাও…
এই বলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল টেবিলের ওপর রাখা মেফিস্টোর পিস্তলটা লক্ষ করে।
কেউ কিছু করে ওঠার আগেই পিস্তলটা হাতে নিয়েই নিজের কপালে ঠেকাল নিলম, তারপর ট্রিগারে চাপ দিল।
—বোকামি কোরো না, নিলম। ওটা আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়া অন্য কারুর হাতে চলবে না… রাখো রাখো বলছি ওটা…
মেফিস্টোর নির্দেশের উত্তরে দু-গাল বেয়ে কান্নার ঝরে পড়া ধারা সামলাতে সামলাতে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল নিলম ওরফে ডেভিড ওসানা,
—বিশ্বাস কর, আমি এরকম হতে চাইনি… বিশ্বাস কর। আমি কারুর ক্ষতি করতে চাইনি, আমি কাউকে মারতে চাইনি। কিন্তু আমার ট্রেনিং, আমার কন্ডিশনিং উত্তেজনার মুহূর্তে শুধু আমায় মারতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে হাতের নাগালে কোনো গলা এলে তাকে মুচড়ে ধরতে। আমি এসব কিচ্ছু চাইনি, আমি আর্মিতে যেতে চাইনি… যুদ্ধে যেতে চাইনি… কাউকে মারতে চাইনি। আমি শুধু তোমার মতো কাউকে চেয়েছিলাম…
নিলমের কথার উত্তরে কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না তানিয়া। যে ডেভিড ওসানাকে খোঁজার জন্য এই মিশন আজ সেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে। যুদ্ধপরাধী ডেভিড ওসানা, পৃথিবীতে ছ-টি নিষ্ঠুর খুনের অপরাধী ডেভিড ওসানা। কিন্তু যে আজ সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই কি ডেভিড ওসানা?
যে মানুষের স্মৃতি মুছে গেছে, যে মানুষের পরিচয় মুছে গেছে, অস্তিত্ব মুছে গেছে; তার অপরাধও কি মুছে যায়?
মুখ তুলে একবার মেফিস্টো, ডক্টর স্টার্ন আর রিপ্লির মুখের দিকে চেয়ে দেখে তানিয়া। এরা সবাই ডেভিড ওসানার শিকার, ওসানার জন্যই এরা আজ মানুষ থেকে অমানুষের জায়গা নিতে বাধ্য হয়েছে। ডেভিড ওসানাকে শেষ করে দিয়েও প্রতিশোধের আগুন যেন ওঁদের চোখে তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে।
আর নিলমের চোখ থেকে ঝরে চলেছে অনুশোচনার কান্না।
কী করতে হবে ঠিক করতে এক মুহূর্ত সময় নিল কম্যান্ডার তানিয়া লাহিড়ী।
তারপর তড়িৎগতিতে লাফিয়ে পড়ল নিলমের রিভলভার ধরে রাখা হাতটার দিকে। হাত মুচড়ে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়েই একটা সামারসল্টে টেবিল টপকে এসে দাঁড়াল মেফিস্টোর সামনে।
কী হতে চলেছে বুঝতে পেরেই বোধহয় মেফিস্টো একটা নিস্ফল চেষ্টা করল দরজার দিকে দৌড় দেওয়ার। কিন্তু তার আগেই তানিয়ার হাত পৌঁছে গেল ওর ঘাড়ে। মেফিস্টোর বিশাল শরীরটা শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে কাচের টেবিল ফাটিয়ে মাটিতে আছড়ে ফেলল তানিয়া।
রিপ্লি বাঁধা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে গিয়ে থমকে গিয়ে দেখল, মেফিস্টোর বুড়ো আঙুল রিভলভারের সেন্সরে ঠেকিয়ে আনলকড ট্রিগারে কম্যান্ডারের আঙুল পৌঁছে গেছে।
তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে গর্জে উঠল তানিয়ার হাতে উঠে আসা ডেসার্ট ইগল রিভলভার।
অবাক হয়ে রিপ্লি দেখল তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা জানলার কাচটা প্রচণ্ড শব্দ করে ভেঙে পড়ল, বরফ ঠান্ডা হাওয়ার একটা দমকা ভেসে এল সেই জানালা দিয়ে।
আর সঙ্গে সঙ্গে নিলম দৌড়ে গেল সেই জানলার দিকে। জানলার ধারে পৌঁছে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল সে। একবার পিছনের দিকে চোখ ফিরিয়ে তানিয়ার চোখে চোখ রাখল,
—ধন্যবাদ কম্যান্ডার… বিদায়…
এইটুকু বলেই নিজেকে সেই জানলার কাচের ফাঁক দিয়ে বাইরে বার করে এনে শূন্যে ঝাঁপ দিল নিলম।
একটু পরে ধীরে ধীরে জানলার ধারে এসে দাঁড়াল তানিয়া, মাইনিং বেসের থেকে ভেসে আসা সাইরেনের সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর ভিতর থেকে।
উপসংহার
নিলমের শরীরের খোঁজ পেতে পরের দিন বিকেল হয়ে গেছিল। মেফিস্টোর হাই রাইজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ বেঁচেছিল সে। অরভিন্দই সেটা খেয়াল করে লালা আর রুডিকে ডেকে আনে।
মেফিস্টো যখন ওদের কাছ থেকে নিলমের বডি উদ্ধার করে তানিয়ার হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে তখন তার শরীর জুড়ে ফুটে উঠেছে অরভিন্দ, লালা আর রুডির লালসার অত্যাচারের চিহ্ন। নিলমের সুন্দর মুখটা ঢেকে গেছে ব্লেডের অগুনতি আঁচড়ে, শরীরের জায়গায় জায়গায় সিগারেটের ছ্যাকা। দেখে বোঝা যায় ওর মৃতদেহকেও ওরা ছাড়েনি। শেষ পর্যন্ত একটা লোহার রড ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে শরীরে।
ডেভিড ওসানার কফিনবন্দি দেহটাকে জ্যানোস৩২৫৪এ নিয়ে সেইদিনই মাইনিং পোস্ট ৭৪ ছেড়ে বেরিয়ে আসে তানিয়া। একাই আসে। ওর মাথায় তখনও ঘুরে চলেছে নিলমকে ওর করা প্রতিশ্রুতির কথাগুলো,
‘আমি তোমায় কথা দিচ্ছি নিলম, আমি এই বেস থেকে বেরোনোর সময় তুমিও আমার সঙ্গেই থাকবে।’
Tags: অঋণ সেন, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
