অন্য সময়
লেখক: মূল রচনা; অ্যান্থনি বাউচার অনুবাদ: রুদ্র দেব বর্মন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মূল গল্প: Elsewhen
“মাই ডিয়ার আগাথা,” ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসেই ঘোষণা করলেন মি. প্যার্ট্রিজ, “এই বিশ্বের প্রথম সফল টাইম মেশিনের উদ্ভাবন আমি করে ফেলেছি।”
তবে তাঁর ভগ্নী যে এই ঘোষণায় বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হয়েছেন তেমন কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। উলটে ভাইকে দাবড়ে তিনি বলে উঠলেন, “আমার তো মনে হচ্ছে এরপর থেকে বিদ্যুতের বিল আরও বেড়ে যাবে।” কথাটা শেষ করে ভুরু কুঁচকে তিনি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “একটা কথা বলো তো হ্যারিসন, তুমি কি একবারও কখনও ভেবে দেখেছ যে তোমার এই ওয়ার্কশপের পেছনে কতটা ফালতু খরচ আমাকে করতে হয়?”
ঠিক এরপরেই যে আরও একটা লম্বা চওড়া বক্তৃতা অবশ্যম্ভাবী, ভাই সেটা বুঝে গেলেন। যথেষ্ট নম্রভাবে মাথা নীচু করে মি. প্যার্ট্রিজ সেই অনিবার্য বক্তৃতাটি শুনেও গেলেন। বক্তৃতা সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার পর তিনি মৃদু স্বরে প্রতিবাদ করলেন, “কিন্তু, দিদি, একটা কথা খেয়াল রেখো, এইমাত্র তুমি যে কথাটা শুনলে তা এই পৃথিবীর কোনো মহিলা এর আগে কখনও শোনেনি। ভেবে দেখো, যুগে যুগে মানুষ তাঁর অতীত আর ভবিষ্যৎ স্বচক্ষে দেখতে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে আসছে। এমনকী এই আধুনিক কাল-তত্ত্বের বিকাশের পর থেকে, সেটা যে কীভাবে সম্ভব করা যেতে পারে সে সম্পর্কেও মানুষের কিছু ধারণা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মানব ইতিহাসে কেউই কাল-ভ্রমণের জন্যে একটা বাস্তব এবং একই সঙ্গে কার্যকর কোনো যন্ত্রের মডেল আজকের আগে পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি।”
“হুমমম্,” আগাথা প্যাট্রিজ মাথা দোলান। “বলি সে না হয় হল, কিন্তু সেটা লাগবে কার কোন কাজে?”
“লাগবে তো অনেক কাজে। তবে সবটা এখনও কেউ জানে না।” এবার মি. প্যার্ট্রিজের ফ্যাকাশে ছোটো ছোটো চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। “এই ধরো, আমরা আমাদের অতীত দেখে আসতে পারি। এমনকী হয়তো শুধরেও নিতে পারি অতীতে করা যাবতীয় যত ভুল। এছাড়া ধরো, প্রাচীনকালের যত গোপন বিদ্যা, যা আজ হারিয়ে গিয়েছে, সেই সমস্ত কিছু আমরা খুঁজে বের করতে পারি। জেনে নিতে পারি কোন অজানা পথে গেলে ভবিষ্যতের দুঃসাহসিক অভিযাত্রীরা নতুন নতুন মহাদেশ সহজেই দখল করতে পারবে। এছাড়াও আমরা—”
“এর জন্য কেউ কি আমাদের কোনো টাকাপয়সা দেবে?”
আত্মবিশ্বাসী মি. প্যার্ট্রিজ এক মুখ হেসে বললেন, “শুধু দেবে না, দেওয়ার জন্য সব সার বেঁধে দৌড়ে আসবে।”
তাঁর দিদির চোখে মুখে দেখা গেল এবার এতক্ষণে মুগ্ধতার আভাস ফুটে উঠেছে। “আর তোমার এই কাল-ভ্রমণের যন্ত্রে তুমি কত কাল পর্যন্ত আগে-পরে যেতে পারবে?”
প্রশ্নটা তাঁর ভাইয়ের কানে গেল কিনা ঠিক করে বোঝা গেল না। মি. প্যার্ট্রিজকে দেখা গেল তাঁর যাবতীয় মনোযোগ দিয়ে তিনি টোস্টের এক পিঠে মাখন লাগাতে প্রচণ্ড ব্যস্ত। কিন্তু এতেও তাঁর খুব একটা লাভ হল না। তাঁর দিদি ছাড়ার পাত্রী নন। আবার সেই একই প্রশ্ন করলেন। “বলো, কত কাল আগে-পিছে যেতে পারবে তুমি?”
“খুব বেশি কিছু নয়,” মি. প্যার্ট্রিজ বাধ্য হয়ে বিমর্ষ স্বরে স্বীকার করলেন। স্বীকার করেই দিদির চোখমুখ দেখে বুঝে গেলেন এরপর আরও সাংঘাতিক সব প্রশ্ন ছুটে আসতে চলেছে। অমনি তিনি তাড়াতাড়ি মুখ খুললেন, “আসলে, এখনও পর্যন্ত অবশ্য খুবই সামান্য। তাও শুধুই এক দিকে। তবে ভুলে যেও না যে …” দিদির মুখের দিকে একবার তাকিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে আরেকটু সাহস করে আবার বলতে শুরু করলেন, “রাইট ভাইয়েরা কিন্তু তাঁদের প্রথম মডেলটা যেদিন বানিয়ে ছিল সেদিনই আটলান্টিক পার করতে পারেননি। মার্কোনিও প্রথম রেডিয়ো বানিয়েই বিশ্ব জুড়ে সম্প্রচার চালু করেননি। আরে এটা তো শুধুই শুরুয়াত। বলতে পারো অঙ্কুরোদ্গম, এখান থেকেই এবার—”
সামান্য যেটুকু আগ্রহের অঙ্কুর আগাথার মধ্যে একটু আগেই জেগে উঠেছিল, তা এতক্ষণে সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেল। “হম, বুঝতে পারছি,” ক্যাটক্যাটে গলায় তিনি এবার শুরু করলেন। “এই সব ছেড়ে তুমি বরং এবার বিদ্যুতের বিল নিয়ে একটু মাথা ঘামাতে শুরু করো। তাহলে হয়তো আমাদের কিছু উপকার হবে।”
মি. প্যার্ট্রিজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভেবে দেখলে এরকম তো হওয়ারই কথা। এখন যাকে তিনি বলবেন, যেখানেই যাবেন, যার সঙ্গেই দেখা হবে, জানেন এরকমই হবে, এই সব প্রশ্নই উঠে আসবে। “আপনি অতীত বা ভবিষ্যতে কত দূর পর্যন্ত যেতে পারেন?” “আজ্ঞে, খুব বেশি না।” “ঠিক আছে, ভালো থাকবেন, স্যার।” এই সব মানুষগুলোর কারোরই একদম কোনোরকম কল্পনা শক্তি বলে কিছু নেই। এদের বোঝানোই যাবে না যে সময়রেখা বরাবর ইচ্ছেমতো চলাফেরা করা কোনো সহজ ব্যাপার নয়। ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় নিরলস ক্রিয়াশীল শক্তি শর্তহীনভাবে মানবজাতিকে শুধুই এগিয়ে নিয়ে চলেছে অপরিবর্তনীয় নির্দিষ্ট একমুখী এক গতিতে। প্রতি সেকেন্ডে মাত্র এক সেকেন্ড। কাজেই ৫৯০০ খ্রিস্টাব্দে পৌঁছে সেখানে কী ঘটছে না ঘটছে দেখতে বা দেখাতে এখনও পর্যন্ত নাও পারতে পারেন, কিন্তু তিনি এই যে কম করে হলেও অন্তত একটা ভগ্নাংশ পরিমাণ সময় এগিয়ে পিছিয়ে দিতে পারছেন সেটাও তো এক ধরনের অলৌকিক ঘটনা। অবশ্য এটাও এখন তাঁর মনে পড়ছে যে তিনি নিজেও প্রথমে যথেষ্ট হতাশ হয়েই পড়েছিলেন।
আসলে হঠাৎ করেই হয়ে গিয়েছিল আবিষ্কারটা। প্রাচীন অ্যালকেমির ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া কিছু বিশেষ পরীক্ষার ফলাফল মিলিয়ে দেখতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এটা-সেটা নানান কিছু পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন তিনি তখন। দীর্ঘ আর নিষ্ফল একাধিক প্রচেষ্টাই বলা যেতে পারে সেগুলোকে। একদিন একটা শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করতে হয়েছিল সেই সব পরীক্ষানিরীক্ষার জন্যই। আর সেদিন সেটা নিয়ে যখন তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন, তখন সেই চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে আরও নানান যন্ত্রপাতির মধ্যে একটা ছিল ক্রোনোমিটার।
আর সেটা ছিল বলেই হয়তো এমনই সেটা দেখে পরীক্ষা শুরুর সময়টা নোট করে রেখেছিলেন মি. প্যার্ট্রিজ। তখন ঠিক ন-টা বেজে একত্রিশ মিনিট চোদ্দো সেকেন্ড। আর ঠিক সেই মুহূর্তে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল চারপাশ। তিনি আন্দাজ করেছিলেন সম্ভবত একটা ছোটোখাটো ভূমিকম্প হয়ে গেল। ধাক্কাটাও অবশ্য খুব একটা গুরুতর ছিল না। অন্তত মি. প্যার্ট্রিজের মতো এমন একজনের কাছে, যিনি কিনা বিগত কুড়ি বছর ধরেই এই দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করছেন। কাজেই এই ছোট্ট ব্যাপারটা হয়তো তাঁর নজরেই আসত না, শুধু যদি কাচের একটা নল টেবিল থেকে গড়িয়ে পড়ে ভেঙে না যেত। যাই হোক বা যে কোনো কারণেই হোক তাঁর নজর তখন সেদিকে ঘুরে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক তারপরেই আবার যখন তিনি ফিরে ক্রোনোমিটারের দিকে তাকালেন, তখন সেটার ডায়ালে দেখা গেল সময় দেখাচ্ছে দশটা বেজে তেরো মিনিট।
সময় যে কত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যেতে পারে তা কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে আপনি মাঝেমধ্যে হয়তো টেরই পাবেন না। কিন্তু তারও একটা সীমা থাকে। এরকম এতটা কখনও হয় না। মি. প্যার্ট্রিজ তাঁর ট্যাকঘড়ি বের করে মিলিয়ে দেখলেন। সে কিন্তু দেখাচ্ছে ন-টা বত্রিশ। মাত্র এই কয়েকটা সেকেন্ডের মধ্যেই হঠাৎ করে যেন বাজারের সেরা ক্রোনোমিটারটা বিয়াল্লিশ মিনিট এগিয়ে গিয়েছে।
বিষয়টা নিয়ে মি. প্যার্ট্রিজ যত বেশি ভাবতে থাকলেন ততই যেন একটা, শুধু একটাই, কার্য-কারণ অপ্রতিরোধ্যভাবে তার মাথায় ঘুরে ফিরে চেপে বসতে শুরু করল। ক্রোনোমিটারটার বাস্তবিক কিছু হয়নি। খারাপ হয়ে যাওয়া তো দূরের কথা। এমনকী তার যেটা কাজ, সেটাও সে একদম সঠিকভাবেই করেছে। এই বিয়াল্লিশ মিনিট সময়টাও একদম ঠিকঠাকই হিসেব করেছে। তবে এই হিসেবটা অবশ্য সে এখন করেনি আর এখানেও করেনি; অর্থাৎ ভূমিকম্পের ধাক্কার চোটটা তাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে এমন কোথাও নিয়ে গিয়েছিল যেখানে সে এই অতিরিক্ত সময়টা পার করেছে। আর যেহেতু স্থান-কালের প্রথম তিনটে মাত্রার কোনো দিকেই কোনো সরণ ঘটেনি বলেই দেখা যাচ্ছে; অতএব—
ক্রোনোমিটারটা নিশ্চিত পাক্কা বিয়াল্লিশ মিনিট সময় অতীতে কোথাও চলে গিয়েছিল আর এখন আবার এই বর্তমানে ফিরে এসেছে বলেই দেখাচ্ছে যে ওটা বিয়াল্লিশটা মিনিট এগিয়ে গিয়েছে। বিয়াল্লিস মিনিটই তো? নাকি মাত্র কয়েক মিনিট? অবশ্য এই ক্রোনোমিটারটা আট দিনের মতো সময় মাপতে পারে। তবে কি এটা বারো ঘণ্টার পরের বিয়াল্লিশ মিনিট মেপেছে? নাকি আটচল্লিশ ঘণ্টা? ছিয়ানব্বই নয় তো? কিংবা একশো বিরানব্বই?
কেন আর কীভাবে এমনটা হল সেই প্রশ্ন তো ছিলই, তারই সঙ্গে সঙ্গে—আরেকটা যে প্রশ্ন মি. প্যার্ট্রিজের মনের মধ্যে সেই মুহূর্তে সব চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল—সেটা হচ্ছে এই একই যন্ত্র কি কোনো জীবিত প্রাণীর ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটনা ঘটাতে পারবে?
প্রায় পাঁচ-পাঁচটা মিনিট ধরে তিনি চিত্রার্পিত হয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে রইলেন। এখন ন-টা সাঁইত্রিশ, আর ক্রোনোমিটারের ডায়ালে দেখাচ্ছে দশটা আঠেরো। এরপর আরও বেশ কিছুক্ষণ নানারকমভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করে নিয়ে তিনি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটটার স্যুইচ বন্ধ করে দিলেন। তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার চালু করলেন। দেখলেন ক্রোনোমিটারের হিসেবে এখন সময় বেলা এগারোটা।
আপাতত মোটামুটি যতটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন তাতেই মি. প্যার্ট্রিজ বুঝে গেলেন তিনি এতদিনে একটা বড়োসড়ো কোনো তোপ মারতে পেরে গিয়েছেন। এইবার দুনিয়াকে দেখিয়ে দেবেন তিনি আসলে কী জিনিস। এক অর্থে অবশ্য ঠিকই বলেছিলেন তিনি—শুধু ঠিকই নয়, যেন কোনো ভবিষ্যৎদ্রষ্টার করা ভবিষ্যদ্বাণী। তাঁর এই আশ্চর্য আবিষ্কারই তাঁকে একদিন নির্মম ঘাতক বানিয়ে দেবে।
আবিষ্কারটির খুঁটিনাটি যাবতীয় দিক যাচাই করার উদ্দেশ্যে মি. প্যার্ট্রিজ অধীর আগ্রহে যে সমস্ত বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা এরপর চালালেন তার প্রত্যেকটির বিস্তারিত বর্ণনা করা অর্থহীন এবং অপ্রয়োজনীয়। সেগুলোর বেশির ভাগই অবশ্য বিশুদ্ধ ব্যবহারিক পরীক্ষানিরীক্ষা। তার প্রধান কারণ অবশ্যই এই যে মি. প্যার্ট্রিজ ছিলেন সেই ধরনের উদ্ভাবকদের একজন যারা তাত্ত্বিক কচকচির চাইতে হাতেকলমে যন্ত্রপাতির ব্যবহারের উপর বেশি ভরসা করেন। অবশ্য একটা মোটা দাগের কাজ চালানোর মতো হাইপোথিসিস খুব তাড়াতাড়িই তিনি খাড়া করে ফেলেছিলেন—আর সেটার মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে, হঠাৎ করে ঘটা ভূমিকম্পের জন্যে তাঁর চৌম্বকক্ষেত্রটি সময়-মাত্রায় সরে গিয়েছিল। আর এই সরে যাওয়ার ফলে হয়েছেটা কী যে—ঠিকঠাক শব্দ খুঁজে পেতে তাঁকে এইখানে অবশ্য যথেষ্ট কসরত করতে হয়েছিল—সেখানে কোনো বিশেষ ধরনের ঋণাত্মক বিভবের এনট্রপির সৃষ্টি হয়, যা বস্তুকে টেনে অতীতে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। যদিও এটি সন্দেহাতীতভাবেই অত্যন্ত বিতর্কিত একটা তত্ত্ব। তিনি অবশ্য এ বিষয়ে বিচার বিবেচনা আর যথার্থতা নির্ণয়ের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবেই শিক্ষাবিদদের উপর ছেড়ে দিচ্ছেন। সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতে এই মুহূর্তে তিনি মোটেও রাজি নন। তিনি বরং তার বদলে যন্ত্রটাকে ঘষে মেজে আরও নিখুঁত আরও উন্নত করে তুলবেন। যাতে কিনা আরও সহজে এবং আরও ভালোভাবে সেটাকে ব্যবহার করা যায়। যাতে তিনি, স্বয়ং হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ, এই বিশ্বের প্রথম সময়ভ্রমণকারী হিসেবে বিখ্যাত হতে পারেন। আর সেই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এখন চোখের একদম সামনে দেখতে পেতেই তাঁর মনের গভীরে এতকালের অবজ্ঞা অবহেলায় শুকিয়ে কিসমিস হয়ে যাওয়া অহং হঠাৎই বেলুনের মতো ফুলে উঠে দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করে দিল।
শুরু হল নানান পরীক্ষানিরীক্ষা এবং নানান গবেষণা। দরকার ছিল ভূমিকম্পের অভিঘাত। কৃত্রিম কম্পন সৃষ্টি করে সেটা পাওয়া গেল। পরের ধাপের পরীক্ষানিরীক্ষা চলল সাদা ইঁদুর নিয়ে। ফলাফল সন্তোষজনক। প্রমাণিত হল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত জীবিত প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর নয়। ক্রোনোমিটার নিয়ে করা পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে প্রমাণ হল যে সময়রেখায় কতদূর যাওয়া যাবে সেটা ব্যবহৃত তড়িৎ চুম্বকের উপর ব্যায়িত বিদ্যুতের পরিমাণের বর্গের সামানুপাতিক।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষা আর গবেষণার মধ্যে দিয়ে উঠে এল। মি. প্যার্ট্রিজ তখন স্থির নিশ্চিত হলেন যে অতীতে অতিবাহিত সময় বারো ঘণ্টা অথবা তার গুনিতকে হচ্ছে না, হচ্ছে শুধুই বিয়াল্লিশ মিনিট। আর যা কিছু সরঞ্জাম আপাতত তাঁর হাতে আছে, সেসব নিয়ে, মি. প্যার্ট্রিজের পক্ষে সেই বিয়াল্লিশ মিনিট সময়টাকে বাড়িয়ে দু-ঘণ্টার কাছাকাছিও নিয়ে যাওয়া একরকম প্রায় অসম্ভব।
হাস্যকর। অত্যন্ত হাস্যকর রকমের বালখিল্য ব্যাপার। মি. প্যার্ট্রিজ নিজেই নিজেকে বলছিলেন। এই এত স্বল্প পরিসরের সময় ভ্রমণ, তাও শুধুমাত্র অতীতে, এই দিয়ে তো তেমন কিছুই ফায়দা ওঠানো যাবে না। ওহ, না, তাই বা কেন? অকিঞ্চিৎকর আর তুচ্ছ ধরনের হলেও কিছু ফায়দা অবশ্য আছে! এই যেমন সেবার—সেই যখন ইঁদুরটা অতীত ঘুরে বহাল তবিয়তে ফিরে এসে তাকে ভরসা দিয়েছিল যে তিনিও নিজে এবার নির্ভয়ে ঘুরে আসতে পারেন—এটা তো সেই সময়েই তিনি পরখ করে দেখেছিলেন। সেই মুহূর্তে তখন তাঁর লম্বা-চওড়া একটা হিসেব কষার ছিল, যেটা তিনি ঠিক করেছিলেন ডিনারের ডাক আসার আগেই শেষ করে ফেলবেন। কিন্তু হাতে থাকা মাত্র একটা ঘণ্টা সময় তার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই ছ-টা বাজতেই তিনি নিজেকে পিছিয়ে নিয়ে আবার চলে গেলেন পাঁচটার সময়। আর এইভাবে পাঁচটা থেকে ছ-টার মধ্যে পাক্কা দু-ঘণ্টা সময় পার করে ডিনারের আগেই তিনি সব কাজকর্ম সেরে ফেলতে পারলেন। আরেকদিন, ওই রকমই এক সন্ধ্যার দিকে, কাজে ডুবে থাকায় খেয়ালই করেননি যে কখন তাঁর পছন্দের ক্যুইজ প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। যখন খেয়াল হল ততক্ষণে প্রোগ্রাম প্রায় শেষের দিকে। তবে ততদিনে প্রোগ্রাম শুরুর সময়ে পিছিয়ে যাওয়া আর তারপর মহানন্দে আরাম করে গোটা প্রোগ্রামটা শোনা তাঁর বাঁ হাতের খেলা হয়ে গিয়েছিল।
তবে এসব একদমই ছোটোখাটো খুচরো উপযোগিতা। অন্তত একটা বলার মতো টাইম মেশিনের কথা ধরলে। গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই। কিন্তু বাজার ধরার কথা ভাবতে হলে এ জিনিস শুধু গৃহস্থালির সস্তা বাজারেই চলবে। চমক দেওয়ার মতো কিছু এতে নেই। মানুষ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখবে তেমন কোনো জোস এর মধ্যে নেই। দুনিয়া জুড়ে ঝড় তোলার মতো কোনো কিছু এর মধ্যে না থাকায় তেমন কিছু সুনাম অর্জন করাও এর পক্ষে খুবই মুশকিল। আর যন্ত্রই যেখানে বিখ্যাত হতে পারছে না—সেখানে সেই যন্ত্রের আবিষ্কারক—স্বয়ং হ্যারিসন প্যার্ট্রিজের পক্ষেও বিখ্যাত হওয়া অসম্ভব।
অথচ সেটাই তো ছিল তাঁর স্বপ্ন। তাঁর সেই স্বপ্নে হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ একজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি। অসীম তাঁর ধনসম্পদ। দিদি আগাথাকে মোটা রকমের পেনশন আর আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছেন। রোজকার খরচাপত্র নিয়ে আর কোনো খিচখিচ নেই। রোজ রোজ তাঁকে দিদির মুখোমুখিও হতে হচ্ছে না। মধ্যপ্রদেশের নধর ভুঁড়ি আর ইন্দ্রলুপ্ত শীর্ষপ্রদেশ সত্ত্বেও তাঁর তখন প্রভূত প্রতিপত্তি আর সেই সঙ্গে উপচে পড়া গ্ল্যামার। তখন সুন্দরী ফেইথ প্রেস্টনও আর উদাসীন রইতে পারবে না। গাছপাকা কুলের মতোই টুপ করে খসে পড়বে তাঁর বুকের উপরে। স্বয়ং এসে ধরা দেবে তাঁর বাহুডোরে। আর তিনি তখন—
ভবিষ্যৎ জীবনের এই সব জাঁকজমক আর দাপুটে ক্ষমতার দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে ডুবে আছেন তিনি, এমনই একটা সময়ে তাঁর ওয়ার্কশপে এসে হাজির হল স্বয়ং ফেইথ প্রেস্টন। পরনে ধবধবে সাদা স্পোর্টস ড্রেস। উপস্থিত হতেই তাঁর তরতাজা ঝকঝকে নিটোল রূপের ঝলকে গোটা ঘরটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাঁকে দেখে তখন মনে হচ্ছিল সে যেন যৌবন আর প্রেমের দেবী। সেই রূপ আর যৌবনের মৌতাত যেন মাতাল করে দিল মি. প্যার্ট্রিজকে। সে এসে দাঁড়াতেই মি. প্যাট্রিজের হৃৎপিণ্ড ধকধক করতে শুরু করে দিল। তাঁর নাড়ি তখন যেন ছুটছিল লাফিয়ে লাফিয়ে, ঘোড়ার মতো।
ঘরের মধ্যে ঢুকেই সে বললে, “আপনার দিদির সঙ্গে দেখা না করে আগে আমি আপনার সঙ্গেই দেখা করতে চলে এলাম।”
তাঁর গলার স্বর তাঁর পোশাকের মতোই নির্মল এবং উজ্জ্বল।
“আপনাকেই সবার আগে জানাবো বলে ঠিক করেছিলাম আমি। সাইমন আর আমি আগামী মাসে বিয়ে করছি।”
এর পরে ঠিক আর কী কী কথাবার্তা হয়েছিল সেসব কিছুই এখন আর মনে করতে পারেন না মি. প্যার্ট্রিজ। যতদূর তাঁর মনে পড়ে, সম্ভবত তাঁর ওয়ার্কশপেরই জঘন্য এলোমেলো অবস্থা নিয়ে সবসময়ই যে অনুযোগ সে করে থাকে সেই সব নিয়েই আরও কিছু কথা হয়েছিল। আর হয়তো যেমন সে সবসময়ই জানতে চায় তাঁর বর্তমান গবেষণা সম্পর্কে, সেই নিয়েও বোধহয় কিছু প্রশ্ন করেছিল। যতদূর মনে পড়ে, তারপরেই, তিনিও গতানুগতিক প্রথা মেনে তাকে শুভকামনা জানিয়েছিলেন। এমনকী এটাও মনে পড়ে, সম্ভবত, সম্ভবত কেন, নিশ্চিতভাবেই তিনি সেই উদ্ধত বাচাল যুবক সাইমন অ্যাশকেও তাঁর অভিনন্দন জানিয়ে দিতে বলেছিলেন। তবে এই সব কোনো কিছুই এখন আর ঠিক করে মনে পড়ে না তাঁর। কেননা সেই মুহূর্ত থেকেই তাঁর যাবতীয় চিন্তাভাবনা সমস্ত কিছু জুড়ে শুধুই সে। যাকে তিনি একান্ত আপন নিজস্ব নারী হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন। যে শুধুমাত্র তাঁরই হবে। কাজেই এখন সবার আগে দরকার সেই ধনবান ক্ষমতাবান অপ্রতিরোধ্য হ্যারিসন প্যার্ট্রিজের অস্তিত্ব। আর সেটাও হতে হবে সামনের মাস শুরু হওয়ার আগেই।
টাকা। ঠিক ধরেছেন। টাকা। আরও টাকা পেলে আরও শক্তিশালী, আরও বিশাল একটা যন্ত্র তিনি তৈরি করতে পারবেন—যা আরও বেশি বৈদ্যুতিক শক্তি বহন করবে—যদিও তখন আরও টাকার প্রয়োজন হবে সেই বাড়তি বিদ্যুৎ খরচের জন্য—সে হোক, কেননা তাহলেই সম্ভব হবে তেমন চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো কিছু একটা করে দেখানো। অন্তত সিকি শতাব্দীর অতীত ভ্রমণ তো একান্তই দরকার গোটা বিশ্বকে চমকে দিতে হলে। যেমন ধরুন, ভার্সাই চুক্তি সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া, হয়ে প্রতিনিধিদের সামনে দাঁড়িয়ে তাদেরকে তাদের তৈরি চুক্তিটি অতিরিক্ত নরম—নাকি অতিরিক্ত কঠিন?—হওয়ার অনিবার্য ফলাফল সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা। অথবা আরও আরও টাকা, সীমাহীন টাকা খরচা করে চলে যাওয়া সেই সব হারিয়ে যাওয়া শতাব্দী কিংবা সহস্রাব্দ পার করে আর তারপর সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প অথবা গুপ্তজ্ঞান—
দুই
টাকা—
“হুম-ম-ম!” আগাথা গজগজ করে ওঠেন। “এখনও সেই মেয়েটার স্বপ্নে কান্নাকাটি করে চলেছ তুমি? চাষার সেই বুড়ো গাধাটার মতো অবস্থা হয়ে যাবে তোমার।”
আগাথা দিদি যে এসে পড়েছেন তা তিনি দেখতে পাননি। এখনও যে তাঁকে তিনি ভালো করে দেখতে পেয়েছেন তাও নয়। তাঁর দু-চোখের দৃষ্টিপথ জুড়ে তখন যেন শুধুই বিশাল ছাগ-শৃঙ্গাকৃতি এক অফুরন্ত সম্পদের ভাণ্ডার। সেই কর্নুকোপিয়া1 যা তাঁকে ঢেলে দেবে অফুরন্ত টাকা, যে টাকায় তিনি পেয়ে যাবেন তাঁর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, যা দিয়ে তিনি বানিয়ে নেবেন তাঁর স্বপ্নের টাইম মেশিন, যে টাইম মেশিন তাঁকে এনে দেবে তাঁর কাঙ্খিত সাফল্য, যে সাফল্য তাঁকে পাইয়ে দেবে তাঁর ফেইথকে।
“যদি তুমি তোমার যাবতীয় দরকারি কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে শুধু কান্নাকাটিই করতে চাও—অবশ্য যদি তুমি তোমার এইসব কাজকর্মগুলোকে দরকারি বলে মনে করো—তবে তোমার উচিত এক্ষুনি এই মুহূর্তে অন্তত বেশ কয়েকটা স্যুইচ অফ করে দেওয়া,” আগাথা এখনও গজগজ করেই যাচ্ছেন। “তোমার কি মনে হয় আমার টাকার গাছ আছে?”
যন্ত্রের মতো তিনি আদেশ পালন করেন।
“সত্যি বলছি এই লোকগুলোর ন্যাকামো দেখলে আমার গা গুলিয়ে ওঠে, কীভাবে যে এরা তেমন কোনো কারণ ছাড়াই জলের মতো পয়সা খরচ করতে পারে, আমি তো ভাবতেই পারি না,” আগাথা দিদির গজগজ করাটা যেন আজ আর বন্ধ হওয়ার নয়। “এই তো, স্ট্যানলি, আমাদেরই তো তুতো-দাদা, তার কারবারটা ভেবে দেখো একবার! কত শত টাকাই যে ও ফালতু ফালতু উড়িয়ে দিচ্ছে! শুধু সাইমন অ্যাশের কথাই ভেবে দেখো, কাজ নেই কর্ম নেই, শুধু ওর লাইব্রেরি আর সংগ্রহশালা দেখাশোনা করার জন্য তাকে সেক্রেটারি হিসেবে বহাল করে তাঁর মাইনে গুনে যাচ্ছে, যেন এই পৃথিবীতে করার মতো কোনো কাজ নেই আর। আর কপালটাও দেখো ওর একবার, যেখানে কিছু টাকা পেলে আমরা কত কত দরকারি কাজ করে ফেলতাম, সেখানে সেইই কিনা পেতে চলেছে আমাদের বৃদ্ধ জেঠুর সমস্ত সম্পত্তি। হায় রে, শুধু যদি এই স্ট্যানলিটা না থাকত! তাহলে আমিই তো হতাম জেঠুর উত্তরাধিকারী। আর তাহলেই তো—”
মি. প্যার্ট্রিজ মুখ ফসকে প্রায় বলেই ফেলেছিলেন যে অত টাকার উত্তরাধিকারী হলেও আগাথা দিদি সেই খিটখিটে অসহিষ্ণু একটা বুড়িই হয়ে থাকতেন। শুধু দুটো কারণে তিনি ঢোক গিলে নিলেন। দুটোর প্রথমটা হচ্ছে হঠাৎ করেই তিনি উপলব্ধি করলেন যে আগাথা দিদির মনের গভীরে এখনও কোথাও একটা প্রাচুর্য্যের আকাঙ্খা বেঁচে আছে। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে এই দূর সম্পর্কের দিদিটির প্রতি তাঁর প্রবল কৃতজ্ঞতাবোধ।
“হ্যাঁ,” খুব ধীরে ধীরে আগাথা দিদির বলা কথাটার পুনরাবৃত্তি করলেন মি. প্যার্ট্রিজ। “শুধু যদি এই স্ট্যানলিটা না থাকতো—”
খুবই সরল মনে বলা একটা কথা। এরকম সহজ সরল কথাও কখনও কখনও কাউকে খুনী বানিয়ে দিয়ে থাকে।
যুক্তির প্যাঁচ-পয়জার সব এতটাই মারাত্মক শক্তপোক্ত ছিল যে তার মধ্যে নৈতিকতার বাছবিচার সামান্যই দাঁত ফোটাতে পারল।
বড়ো জেঠু ম্যাক্স বহুদিন হল জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁর বয়সের গাছপাথর নেই। বুড়ো যে আর একটা বছরও পার করতে পারবেন সেই প্রশ্নই ওঠে না। এই অবস্থায় যদি একমাত্র সন্তান স্ট্যানলি তাঁর আগেই অক্কা পায়, তখন তাঁর জীবিত নিকটআত্মীয় বলতে শুধুমাত্র হ্যারিসন আর আগাথা প্যার্ট্রিজ। আর ম্যাক্সওয়েল হ্যারিসনের বয়সের যেমন গাছপাথর নেই তেমনি তাঁর ধনসম্পত্তিও অসীম।
সুতরাং স্ট্যানলির মরাই উচিত। সে বেঁচে থেকেও দুনিয়ার কোনো কাজে লাগছে না। অর্থনৈতিক তত্ত্ব বলে থাকে যে অব্যবহৃত জঞ্জালেরও বাজারে একটা দাম আছে। আর মি. প্যার্ট্রিজও সেটা ভালো করেই জানেন। কিন্তু জানলেও তিনি পাত্তা দিতে চাইলেন না। জীবিত স্ট্যানলি দুনিয়ার কোনো কাজেই লাগবে না। উলটে মৃত স্ট্যানলি আজ পর্যন্ত মানুষ যা যা আবিষ্কার করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম সেরা একটা আবিষ্কারের আবির্ভাবের পথ সুগম করে দিতে পারবে। ঘটনাচক্রে সেই আবিষ্কারই মি. প্যার্ট্রিজকে এনে দিতে পারবে প্রচুর সম্পদ আর প্রতিপত্তি। আর, ইয়ে—এর একটা ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও সম্ভবত থাকবে—সম্ভবত কেন, অবশ্যই থাকবে। স্ট্যানলি মারা যাওয়ায় তাঁর সেক্রেটারি সাইমন অ্যাশের চাকরিটাও যেহেতু ফুস হয়ে যাবে, ফেইথের সঙ্গে ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়েটাও তাকে আপাতত স্থগিত রাখতেই হবে। সুতরাং মি. প্যার্ট্রিজের প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট সময় ফেইথ প্রেস্টন তখন হাতে পেয়ে যাবে।
স্ট্যানলিকে সুতরাং মরতেই হবে আর তাঁর মৃত্যুটাও ঘটাতে হবে নিজেকে সবরকম ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার সেরা উপায় অবশ্য এখন তাঁর হাতের মুঠোতেই আছে। মি. প্যার্ট্রিজ হঠাৎ যেন উপলব্ধি করলেন যে তাঁর স্বল্প-পরিসর টাইম মেশিনের পরিপাটি একটা ফলিত প্রয়োগই তাঁকে খুনের অভিযোগ থেকে বাঁচার জন্য দরকারি অ্যালিবাই তৈরি করে দিতে পারবে।
আসল সমস্যাটা হল যন্ত্রের একটা সহজে বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সংস্করণ তৈরি করা নিয়ে যেটা কিনা যা হোক একটা মোটামুটি কাজ চালানোর মতো সময় তাঁর হাতে তুলে দেবে। প্রথম যে মডেলটা তৈরি করা গেল সেটার ভ্রমণ পরিসর ছিল দু-মিনিট। তবে সেই সপ্তাহটা শেষ হওয়ার আগেই মি. প্যার্ট্রিজ এমন একটা সংস্করণ তৈরি করে ফেলতে পারলেন যেটা ভালোভাবেই পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় পার করতে পারছিল। এরপর তাঁর দরকার শুধু একটা তীক্ষ্ণ-ধার ছুরি। এ ছাড়া আর বেশি কিছুর প্রয়োজন তাঁর নেই। গুলিগোলার বিষয়টা মি. প্যার্ট্রিজের একেবারেই পছন্দ নয়। তাঁর মতে গুলি করে খুন করাটা একটা অসভ্য নোংরা কাজ।
তিন
সেই শুক্রবার বিকেলে তিনি যখন তাঁর তুতো ভাই স্ট্যানলির ব্যক্তিগত লাইব্রেরির মধ্যে প্রবেশ করলেন ঘড়িতে তখন ঠিক পাঁচটা বাজছে। খ্যাপাটে চরিত্রের এই ধনবান মানুষটা প্রতিদিন নিয়ম করে এই সময় ঘণ্টা খানেক একটু একাকী থাকতে পছন্দ করেন। এটাই তাঁর একমাত্র সময় যখন তিনি তাঁর নিজস্ব সংগ্রহের বইপত্র নিয়ে শান্তিতে একটু আধটু পড়াশোনা কিংবা বিশ্রাম করেন। তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার বিষয়ে খানসামা ব্রাকেট প্রথমে গররাজি হলেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি পালটানো গেল যখন মি. প্যার্ট্রিজ জানালেন, “আমার খুড়তুতো ভাইটিকে শুধু একবার খবর দাও যে তাঁর পুথিপত্রের তালিকায় জোড়ার মতো একটা দুর্দান্ত জিনিস আমি খুঁজে পেয়েছি।”
নানান রকমের জিনিসপত্র সংগ্রহের একটা বাতিক তাঁর তুতো ভাই স্ট্যানলির অনেকদিন ধরেই আছে। ইদানীং কিছুকাল ধরে তাঁর এই বাতিকটা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল কিছু বিশেষ ধরনের বইপত্রের উপর। বাস্তবে ঘটা খুনখারাপির উপর লেখা গল্প উপন্যাস। শোনা যায় এরমধ্যেই সে এই বিষয়ে একটা আলাদা লাইব্রেরিও বানিয়ে ফেলেছে। আজকাল তিনি উঠে পড়ে লেগেছেন সেই বিষয়েরই একটা আলাদা গ্রন্থপঞ্জি প্রকাশ করার জন্যে। কাজেই সেই বিষয়েই যখন একটা নতুন খবরের সন্ধান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তাকে দেওয়া হল তখন আপাত-বন্ধ দরজা তাঁর জন্য হয়ে গেল উন্মুক্ত—চিচিংফাঁক।
গর্বিত স্ট্যানলি হ্যারিসন উল্লসিত হয়ে তাঁর নিজস্ব মার্কামারা ওজনদার কর্কশ গলায় অনাহুত দাদাটিকে যেভাবে সাদর সম্ভাষণ করতে শুরু করলেন তাতে তিনি যে সঙ্গে করে অদ্ভুত ধরনের কিছু একটা বয়ে নিয়ে এসেছেন সেটা তাঁর চোখ এড়িয়ে গেল। এমনিতেও এলাকায় সবাই মোটামুটি জানতোই যে মি. প্যার্ট্রিজ একজন ছিটেল বৈজ্ঞানিক। কাজেই বৈদ্যুতিক তার আর চুম্বক-টুম্বকের একটা অদ্ভুত কাঠামো হাতে করে তিনি যখন এসে ঢুকলেন তখন তাঁর সেই আবির্ভাব পাণ্ডুলিপি হাতে একজন লেখকের প্রবেশের চাইতে বেশি আশ্চর্যজনক কিছু যে হতে পারে সেটা কারোরই মনে হল না।
“ব্রাকেট তো আমাকে খবর দিল যে তোর কাছে আমার জন্য নাকি দারুণ কিছু জিনিস আছে,” মি. প্যার্ট্রিজকে দেখেই তাঁর তুতো ভাই স্ট্যানলি গমগমে স্বরে প্রায় যেন গর্জন করে উঠলেন। “শুনেই তো আমার দিলখুস। আয়, আয়, কী খাবি বল। জিনিসটাই বা কী?”
“না, না, ঠিক আছে। এখন কিছু খাব না। বললি যে সেটাই অনেক। ধন্যবাদ।” শিকারের কাছ থেকে আতিথেয়তা নেওয়া নিয়ে তাঁর বিবেকের কোনো এক কোনায় বোধকরি চিনচিন করছিল। “আমার একজন হাঙ্গেরিয়ান বন্ধু আছেন। তিনি বেলা কিস নামে এক লেখকের একটা উপন্যাসের কথা বলছিলেন।”
“কিস্?” তাঁর তুতো ভাই স্ট্যানলির মুখে হাজার ওয়াটের আলো ঝকমক করে ওঠে। “চমৎকার! কে জানে কেন কেউই এর সম্পর্কে আগে কিছু লেখেনি। খুনি মেয়ে। ঠিক যেন আরেক ল্যান্ডরু। চিরকালীন হাতে গরম বই। খালি গ্যাসোলিনের ড্রামে ভরে রাখা শরীর। বাড়িতে গ্যাসোলিন বাড়তি না হলে তো কেউ খোঁজও করত না, কেউ ধরাও পড়ত না। কনস্টেবল তো ভেবেছিল যে কালোবাজারি করার জন্যে কেউ বোধহয় মজুদ করেছে, ড্রামের ঢাকনা খোলার পর দেখে ভেতরে মৃতদেহ! দূর্দান্ত! বল, বল, তুই গোটা বিষয়টা এবার একটু খোলসা—”
লিখে নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর তুতো ভাই স্ট্যানলি, লেখালেখির জন্যই লাইব্রেরিতে রাখা তিন বাই পাঁচ ইঞ্চি আকৃতির একটা পি-স্লিপ ডেস্কের ওপরে রেখে পেনসিল হাতে তখন ঝুঁকে পড়েছেন। ঠিক এই অবস্থায় মোক্ষম আঘাতটা হানলেন মি. প্যার্ট্রিজ।
ঠিক যেমন ভাবে অনেক চিন্তাভাবনা করে খুঁজে পেতে সম্পূর্ণ অপরিচিত অথচ যথেষ্ট কৌতূহল উদ্দীপক এবং আকর্ষণীয় একটা খুনির নাম জোগাড় করেছিলেন, সেই ভাবেই ঠিক কোথায় আঘাত করলে সেটাই মোক্ষম আঘাত হবে সেটাও শারীরসংস্থানবিদ্যার বইপত্র ঘেঁটে রীতিমতো পড়াশোনা করেই তিনি তৈরি হয়ে এসেছিলেন। ছুরিটাও সরাসরি জায়গা মতো ঢুকে গেল একদম মাখনের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়ার মতো করে। তারপর তো শুধু মরতে চলা মানুষটার গলা থেকে একটা ঘড়ঘড় শব্দ আর মৃত্যু পূর্ববর্তী নিদারুণ শারীরিক মোচড়। ব্যাস। আর কিছু না।
মি. প্যার্ট্রিজ তখন সেই মুহূর্ত থেকেই একই অঙ্গে একজন উত্তরাধিকারী আর একজন খুনী। যদিও দুটোর কোনো একটারও সম্পর্কে সচেতন হওয়ার মতো সময় তখন তাঁর হাতে ছিল না। তাঁর মন ততক্ষণে অসাড় আর মস্তিষ্ক শূন্য। শুধু অসংখ্য বার মহড়া দেওয়া অভ্যস্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলছিলেন তিনি। লাইব্রেরি ঘরের সব ক-টা জানলা এক এক করে বন্ধ করে দিলেন তিনি। বন্ধ করে দিলেন প্রত্যেকটা দরজাও। অসম্ভব এক অপরাধের ঘটনা হয়ে উঠবে এই হত্যাকাণ্ড। এ হবে এমন এক অপরাধ যেখানে তাঁকে তো দূরের কথা, এমনকী অন্য কোনো নিরপরাধ কাউকেই অভিযুক্ত করতে কেউই পারবে না।
চারদিক থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ ঘরটার মধ্যে মাঝ বরাবর পড়ে থাকা মৃতদেহের ঠিক পাশেই গিয়ে এবার দাঁড়ালেন মি. প্যার্ট্রিজ। তখন ঠিক পাঁচটা বেজে চার মিনিট। সময়টা একবার দেখে নিয়ে দু-দুবার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। গলার স্বর পালটে অত্যন্ত কর্কশ স্বরে করা রীতিমতো জোরালো আর্তনাদ ছিল দুটোই। তারপর সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে আসা যন্ত্রটার প্লাগ মেঝের কাছে থাকা একটা বৈদ্যুতিক সকেটে ঢুকিয়ে স্যুইচটা টিপে দিলেন তিনি।
চারটে উনিশ। মি. প্যার্ট্রিজ তাঁর যন্ত্রের প্লাগটা খুলে নিলেন। ঘরটা সম্পূর্ণ খালি। কেউ নেই। দরজা হাট করে খোলা। মি. প্যার্ট্রিজের দৃষ্টি ঘুরে গেল ডেস্কটার দিকে। তাঁর বোধ-বুদ্ধি আর যুক্তিবাদী মন যতই বাধা দিক, তাঁর খালি মনে হচ্ছিল ওখানে তাকালেই তিনি দেখতে পাবেন রক্তের দাগ—অথবা যে ঘটনা তিনি ঘটিয়েছেন তার কোনো না কোনো চিহ্ন, বাস্তবে যা এখনও অন্তত আগামী পৌনে ঘণ্টার আগে ঘটতে পারে না।
তাঁর তুতো ভাইয়ের বাড়ির অন্দরমহলটা মোটামুটি চেনা ছিল মি. প্যার্ট্রিজের। কারও মুখোমুখিও তাই হতে হল না তাঁকে। চুপচাপ বেরিয়ে চলে আসতে পারলেন তিনি। যন্ত্রটাকে তাঁর গাড়ির পেছনের আসনের নীচে ঠেলে গুঁজে ঢুকিয়ে দিয়েই সোজা রওনা হলেন ফেইথ প্রেস্টনের উদ্দেশে। শহরের আরেক প্রান্তে যাওয়ার লম্বা যাত্রার শেষ দিকে খুব সাবধানে একটা ট্রাফিক লাইট এমনভাবে পার হলেন তিনি যে ট্রাফিক থেকে তাঁকে একটা টিকিট ধরিয়ে দিতে বাধ্য হল। টিকিটের উপর সময়-ছাপ চারটে পঞ্চাশ। ফেইথের ওখানে গিয়ে তিনি পৌঁছলেন চারটে বেজে চুয়ান্নতে, খানিক আগেই যে খুনটা তিনি করে এলেন সেটা ঘটবে আরও দশ মিনিট পরে।
চার
সাইমন অ্যাশের বৃহস্পতিবার গোটা রাতটাই পেরিয়ে ছিল কাজের মধ্যে। কাজ বলতে স্ট্যানলি হ্যারিসনের সর্বশেষ সংগ্রহের তালিকা তৈরি করা। অতঃপর ঘুমের পুরো দফারফা। তারপর শুক্রবার আবার সকাল সকাল নির্দিষ্ট সময়েই হাজিরা দেওয়ার দরকার পড়ল। কেননা ফেইথের সঙ্গে লাঞ্চে বেরোনোর কথা দেওয়া ছিল। কাজেই মধ্যাহ্ন ভোজনের আগেই সেদিনের সকালে আসা চিঠি-চাপাটির কাজ সেরে ফেলাটা খুব দরকার। ফলে বিকেল সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতেই দেখা গেল সে ঘুমিয়ে কাদা।
সে ভালো করেই জানত তার মনিব আর মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যেই লাইব্রেরিতে এসে পড়বেন। রোজই আসেন স্ট্যানলি হ্যারিসন এই সময়টায়। এটা তাঁর একান্তে বসে আত্মতৃপ্তির চোঁয়া ঢেকুর তোলার রোজকার অভ্যাস। আর এই সময় স্ট্যানলি হ্যারিসন চান সম্পূর্ণ একাকীত্ব। সাইমন অ্যাস সেটাও ভালো করেই জানে। কিন্তু সেক্রেটারির কাজের জন্য নির্দিষ্ট ডেস্কটা একটু আড়ালেই অবস্থিত। লাইব্রেরির থাক থাক বইপত্রের আলমারিগুলোর এক কোনে। আর মানুষের যত রকমের শারীরিক চাহিদা আছে তার মধ্যে ঘুম পাওয়াটা এতটাই জোরালো যে তেমন ঘুম পেলে সে বাকি সব কিছু ভুলে যায়।
উসকোখুসকো সোনালি চুলে ঢাকা মাথাটা ডেস্কের উপরে রেখে সাইমন অ্যাশ তখন গভীর ঘুমে তলিয়ে রয়েছে। তার ঘুমন্ত শরীরটা একবার সামান্য নড়েচড়ে উঠল। ঘুমের ঘোরে গুটিয়ে রাখা হাতটা সরে গেল খানিকটা। পাশেই ছিল সাজিয়ে রাখা এক থাক কার্ড। সেই ধাক্কায় মেঝের উপর পড়ে সেগুলো ছড়িয়ে গেল চারপাশে। গভীর ঘুমের মধ্যেই তার মস্তিষ্কের ভেতরে কোথাও একটা বিপদ ঘণ্টা বেজে উঠল। আবার অক্ষর মিলিয়ে মিলিয়ে সাজাতে হবে সেগুলো। চিন্তাটা অবশ্য হালকা করে এসেই চলে গেল। সে তখনও ঘুমিয়েই রইল। গভীর ঘুমের মধ্যে তার মন তখন সুখের স্বপ্ন দেখা ছাড়া অন্য আর কিছু নিয়ে ভাবতেই চাইছে না। যেমন গত সপ্তাহের শেষে বালবোয়ার সেই পাল তোলা নৌকায় ভেসে চলার উজ্জ্বল স্মৃতি, অথবা ক-দিন পরের ছুটিতেই সিয়েরাসে হাইকিং ট্রিপের পরিকল্পনা, আর সর্বোপরি স্বয়ং ফেইথ তো আছেই। তাঁর প্রেয়সী ফেইথ। সতেজ সুন্দর নিখুঁত শরীরের অধিকারীনি তার রূপসি প্রেয়সী ফেইথ। সামনের মাসেই যে তার একান্ত আপনার হয়ে—
ঘুমিয়ে থাকা সাইমন অ্যাশের ক্লান্তিতে শুকিয়ে যাওয়া রুক্ষ মুখে খেলা করছিল হাসির আভাস। কিন্তু হঠাৎ মাথার মধ্যে একটা বীভৎস চিৎকার ঝনঝন করে উঠতেই সে জেগে গেল। এক লাফে সে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে নিয়ে সে বেরিয়ে এল লাইব্রেরির থাক থাক বইপত্রের আড়াল থেকে।
বেরিয়ে এসেই তার চোখে পর পর পড়ল দু-দুটো অবিশ্বাস্য দৃশ্য। প্রথম দৃশ্য—ডেস্কের উপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা একটা মৃতদেহ আর তার পিঠের উপর থেকে বেরিয়ে থাকা একটা ছুরির হাতল। তবে এর চেয়েও অবিশ্বাস্য ছিল দ্বিতীয় দৃশ্যটি। একটা লোক। যদিও সে তখন সাইমনের দিকে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে, তবুও লোকটাকে তার অল্প চেনা চেনা লাগল। কেমন যেন মনে হচ্ছে লোকটাকে সে এর আগে কোথাও দেখেছে। দেখল লোকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা বিদঘুটে যন্ত্রের পাশে। তার ঠিক একটু পরেই তাঁর কানে এল ছোট্ট একটা আওয়াজ। কোথাও কোনো স্যুইচ ক্লিক করে শব্দ করল।
পরের মুহূর্তেই সেখানে আর কিছু নেই। না লোকটা না তার পাশের সেই বিদঘুটে যন্ত্রটা।
এখন বিশাল সেই ঘরটার মধ্যে সাইমন অ্যাশ আর গাদাগুচ্ছের বইয়ের পাহাড় ছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই। না, আছে। তাদের মনিবের মৃতদেহ।
অ্যাশ দৌড়ে গেল ডেস্কটার দিকে। প্রথমেই সে চেষ্টা করল পাঁজাকোলা করে স্ট্যানলি হ্যারিসনকে তুলে নেওয়ার। যখন বুঝল তার দ্বারা সেটা সম্ভব নয়, তখন চেষ্টা করল ছুরিটা টেনে বের করার। এরপরেই সে রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়েছিল কেননা ততক্ষণে সে বুঝতে পেরে গিয়েছিল যে যতই চেষ্টা সে করুক না কেন, কোনো কিছুই আর সেই দেহে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। হাল ছেড়ে দিয়ে ফোনের কাছে পৌঁছে রিসিভারটা যখন সে তুলতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই সামনের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা মারার আওয়াজ এল। সঙ্গে সঙ্গে সে থমকে গেল।
একটু পরেই দমাদম ধাক্কার আওয়াজ ছাপিয়ে ভেসে এল খানসামা কণ্ঠস্বর। “মি. হ্যারিসন! আপনি ঠিক আছেন তো, স্যার?” অতঃপর সামান্য একটু বিরতি, আরও দমাদম ধাক্কা দরজার উপরে, এবং তারপর আবার খানসামার গলার উৎকণ্ঠিত চিৎকার, “মি. হ্যারিসন! আমাকে ঢুকতে দিন, স্যার! আপনি ঠিক আছেন তো?”
হুঁশ ফিরতে সাইমন এবার দৌড়াল দরজার দিকে। পৌঁছে দেখতে পেল দরজায় ভেতর থেকে তালা বন্ধ করা। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে খোঁজাখুঁজি করে যখন সে দেখল চাবিটা তাঁরই পায়ের কাছে মেঝের উপরে পড়ে রয়েছে আর তারপর তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে দু-তিন বার হোঁচট খাওয়ার পরে অনেক চেষ্টায় প্রায় হাতড়ে হাতড়ে যখন সে সেটা তুলে নিতে পারল, ততক্ষণে আরও একটা মিনিট সময় খরচ হয়ে গিয়েছে। আর সেই গোটা এক মিনিট সময়ে খানসামার দরজায় ধাক্কা আর উৎকণ্ঠিত চিৎকারের তীব্রতা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। অবশেষে তারপর সাইমন দরজা খুলতে পারল।
ব্রাকেট তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে—তাঁর রাত-জাগা লালচে চোখের দিকে, তাঁর রক্তমাখা হাতের লালিমার দিকে আর তাঁর বেশ খানিকটা পেছনে ডেস্কের উপরে পড়ে থাকা নিথর শরীরটার দিকে। “মি. অ্যাশ, স্যার,” খানসামা তখন হাঁপাচ্ছে। “আপনি এটা কী করলেন?”
পাঁচ
ফেইথ প্রেস্টন অবশ্য তখন বাড়িতেই ছিল। থাকারই কথা। যে নিটোল পরিকল্পনা মি. প্যার্ট্রিজ করেছিলেন তার মধ্যে এ ধরনের কোনো অত্যাবশ্যক উপাদানই অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে রাখা ছিল না। ফেইথ নিজেই বলে যে সন্ধের পর যখন রাতের খাবারের খিদেটা জম্পেশ করে চাগিয়ে উঠতে থাকে, দরকারি কাজগুলো সব সেই সময়েই সে ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারে; আর এই সপ্তাহে তো তার ভীষণভাবে ব্যস্ত থাকার কথা ছিলই, কোনো এক রাষ্ট্রীয় প্রতিযোগিতার জন্য কিছু সাবানের নকশা তৈরি করা নিয়ে।
পড়ন্ত বিকেলের শেষ সূর্যের আলো এসে পড়ায় ঝকঝক করছিল তার ঘরটা, যে ঘরটাকে আপনি মন মেজাজ ভালো থাকলে স্টুডিয়ো বলে উল্লেখ করতেই পারেন, আর তা না থাকলে হয়তো বলবেন চিলেকোঠা। বাছাই করা বিশেষ কয়েকটি রঙের ছোঁয়ায় অসামান্য হয়ে ওঠা সামান্য গৃহসজ্জায় সজ্জিত ঘরটায় গোধূলির আলো এসে নিখুঁত রূপবতী ফেইথকে ঘিরে তখন এক জ্যোতির্মণ্ডল সৃষ্টি করে রেখেছিল।
পাশেই রেডিয়োটা মৃদু স্বরে বেজে যাচ্ছিল। সাধারণত রেডিয়োতে গান শুনতে শুনতেই সে কাজ করে থাকে। আর এটাও ছিল মি. প্যার্ট্রিজের সামগ্রিক পরিকল্পনার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
পরবর্তী ছ-মিনিট ধরে খুবই সাধারণ আর প্রায় মনে না থাকারই মতো খুব ছোটো ছোটো কিছু কথাবার্তা হল—একদিকে ‘আপনি কী করছেন?’ তারপরে ‘বাঃ কী সুন্দর!’ আর অন্যদিকে ওই ‘আপনি আজকাল কী করছেন?’ এই ধরনের এতোল বেতোল হিজিবিজি কথাবার্তা। ওই যেমন হয় আর কী। এরপর এক সময়, ‘বিয়ের পরিকল্পনা কেমন চলছে?’—প্রশ্নটা করেই মি. প্যার্ট্রিজ তাঁর ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ইঙ্গিতে একটু চুপ থাকার জন্য অনুরোধ করলেন।
রেডিয়োতে তখন ঘোষণা শুরু হয়েছে, “এখন স্টুডিয়োর ঘড়িতে ঠিক পাঁচটা বাজতে পাঁচ সেকেন্ড। পরবর্তী অনুষ্ঠান শুরু হবে পাঁচ সেকেন্ড বিরতির পরে।”
“আমার ঘড়িতে আজ সকালে দম দিতে ভুলে গেছি,” মি. প্যার্ট্রিজ হঠাৎই উদ্দেশ্যহীনভাবে মন্তব্য করলেন। “তারপর সারাদিন ধরেই ভাবছি ঘড়িটা ঠিকঠাক চলছে কি না।” মনোযোগ দিয়ে তিনি ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে রেডিয়োর সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে এবার নির্ভুল করে নিলেন।
এরপর একটা লম্বা শ্বাস নিলেন তিনি। অবশেষে এখন তিনি নিশ্চিত হলেন। এখন থেকে তিনি একজন নতুন মানুষ। একজন বিশেষ কেউ। এতদিনে তিনি হয়ে উঠতে পারলেন দ্য গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ। নিখুঁত পরিকল্পনার অন্তিম দফার কাজটাও নিখুঁতভাবেই শেষ হয়েছে। তাঁর যাবতীয় খাটাখাটনি এবার শেষ। আর চার মিনিট পরেই তাঁর তুতো ভাই স্ট্যানলি মরবে। তারপর অতি স্বাভাবিকভাবেই তুতো জ্যাঠা ম্যাক্সও তাঁর পিছু পিছু রওনা দেবেন, বড়োজোর আরও মাসখানেক বা তার কিছুদিন আগে পরে। আর তারপর তো শুধু টাকাপয়সা, ধনদৌলতের ছড়াছড়ি। তখন তাঁর নতুন যন্ত্র আর ক্ষমতা এবং যশ আর গৌরব আর—
সূর্যের আলোয় আলোকিত চিলেকোঠার ভেতরটা অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে দু-চোখ মেলে এমনভাবে মি. প্যার্ট্রিজ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন যে তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন একজন সদ্যোজাত অলৌকিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন শিশু যে কিনা জন্মের পর এই প্রথম এই জগতটাকে দু-চোখ মেলে দেখছে। বাস্তবিক অর্থেই তিনি একজন নবজাতক। সদ্যই তাঁর নবজন্ম হয়েছে। তিনি যে তাঁর প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কারটা করেছেন, শুধু তাই নয়; একটু আগেই তিনি তাঁর প্রজন্মের সেরা নিখুঁত হত্যাকাণ্ডটিও ঘটিয়ে এসেছেন। নবজন্মপ্রাপ্ত এই হ্যারিসন প্যার্ট্রিজের পক্ষে আর কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
“কী ব্যাপার? কী হয়েছে?” ফেইথ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। “আপনাকে কেমন যেন লাগছে। একটু চা করব? চা খাবেন?”
“না, না। ঠিক আছে। কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।” বলতে বলতে ঘুরে গিয়ে তিনি দাঁড়ালেন ঠিক তাঁর পেছনে। প্রায় তাঁর ঘাড়ের উপর দিয়েই ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে রইলেন তাঁর কোলের মধ্যে হাতে ধরে রাখা সাবানের কেকটার দিকে। কেকটার গায়ে এর মধ্যে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে সুন্দরী এক নগ্নিকার সুঠাম শরীর। “চমৎকার, দারুণ বানিয়েছ গো তুমি,” অভিভূত হয়ে বলে উঠলেন তিনি। একটু থেমে যেন একবার ঢোক গিললেন বলে মনে হল। তারপর আবার বললেন, “দূর্দান্ত হয়েছে।”
“আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। তবে আজ পর্যন্ত এরকম যত নগ্নিকা মূর্তি বানিয়েছি কোনোটাই আমার নিজেরই তেমন ভালো লাগেনি; আমার তো মনে হয় না মেয়ে ভাস্করদের কারোরই কখনও লাগবে। তবু আরেকবার চেষ্টা করে দেখছি কেমন হয়।”
তাঁর তৃষিত শুষ্ক হাতটা বাড়িয়ে সাবান-সুন্দরীর শরীরে খুব সাবধানে আঙুল বুলিয়ে দেখছিলেন মি. প্যার্ট্রিজ। “বাঃ, ছুঁয়েও তো ভীষণ আরাম, দারুণ টেক্সচার হয়েছে,” আঙুল বুলিয়ে ছুঁয়ে দেখতে দেখতে বলে উঠলেন তিনি। “ঠিক ততটাই আরামের যতটা—” তাঁর জিবের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল। মুখ থেকে আর কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। তবে তাঁর বক্তব্য কিন্তু অসমাপ্ত রইল না। ফেইথের ঠান্ডা ঘাড়ে আর গালে তাঁর হাত যেভাবে ঘোরাফেরা করছিল তাতেই তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার বোঝা গেল।
“আরে, কী করছেন কী আপনি, মি. প্যার্ট্রিজ?” চমকে উঠে ফেইথ হেসে ফেলে।
হাসিটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। দ্য গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজের মতো কোনো ব্যক্তির মুখের উপর হাসাহাসি করা কারোই উচিত নয়। তাই এরপরে যে ঘটনা ঘটল তা ঘটার মতো কোনো কিছুই তাঁর পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। কিন্তু পরিকল্পনার বাইরেই এমন কিছু এই মাত্র ঘটে গেল যা তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ফেইথের সামনে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে দিল, জোর জবরদস্তি তাঁর হাত দুটোকে বাধ্য করল ফেইথের কোমল দেহবল্লরীটিকে জাপটে ধরতে, তাঁর ঠোঁট দুটো বাধ্য হল অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে ফেইথের ঠোঁটে চেপে বসতে, আর তার ফলে যে সমস্ত আবেগময় অথচ অসংলগ্ন শব্দ তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল সেই সব কিছুই তখন চাপা পড়ে গেল।
তবে তাঁর চোখ খোলা ছিল। চোখের সামনে তিনি দেখতে পেলেন ফেইথের চোখ দুটো ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। তিনি এটাও দেখতে পেলেন সেই ভয়ের তীব্রতায় আত্মরক্ষার উদ্দেশে ফেইথের হাত স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছিটকে উঠে আসছে। কোনো রকমে তিনি সেই ছিটকে ওঠা হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিতে সক্ষম হলেন। কেড়ে নেওয়া ছুরিটার দিকে তাকাতেই সেটা ঝকঝক করে উঠল। ছুরিটা ছোটো, অস্বাভাবিকরকম ছোটো। এরকম একটা ছুরি কোনো বয়স্ক পুরুষের পিঠে ঢুকিয়ে কখনোই আপনি তার কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না। তবে এটা ধারালো, মারাত্মক রকমের ধারালো—যদি কোনোভাবে গলা বা কব্জির ধমনীর নাগাল—
মুহূর্তের জন্য তাঁর শরীরের পেশিগুলো বোধহয় খানিক ঢিলে হয়ে গিয়েছিল, আর তাই সঙ্গে সঙ্গে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ফেইথ নিজেকে মুক্ত করে নিল। তারপর একবারের জন্যেও আর সে ফিরে তাকালো না। তিনি শুনতে পেলেন তাঁর পায়ের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নীচে নেমে যাচ্ছে। আর এদিকে সঙ্গে সঙ্গে দ্য গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ সেই একটা খণ্ড মুহূর্তের জন্যে হলেও সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রয়ে গেলেন চিরকালের ভীতু মি. প্যার্ট্রিজ। ভয়ে কাতর সেই মি. প্যার্ট্রিজ তখন ভাবছেন তাঁর এই ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে এখন যদি ফেইথ তাঁকে ঘৃণা করতে শুরু করে, যদি সে তাঁর অ্যালিবাই হয়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়াতে না চায়—
খুব তাড়াতাড়িই অবশ্য তাঁর ভয়টা উবে গেল। আসলে তিনি ভালো করেই জানেন যে যাই তিনি করে থাকুন না কেন, সেই নিয়ে শত্রুতা করার জন্যে ফেইথের মতো মেয়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কিছুতেই মিথ্যে কথা বলবে না। এই মেয়ে মারাত্মক রকমের সৎ। তাছাড়া ঘৃণা আর শত্রুতা এই সব কিছুই তো এক ফুঁয়ে উবে যাবে যখন সে শেষ পর্যন্ত হৃদয়ঙ্গম করবে যে ঠিক কোন স্তরের একজন মানুষ তাকে নিজের করে পেতে চেয়েছে।
ছয়
ফেইথকে দরজা খুলে দিল যে, সে কিছুতেই কোনো খানসামা হতে পারে না। আপাদমস্তক উর্দীধারী একজন পুলিশ, যিনি দরজা খুলেই জানতে চাইলেন, “কী চাই এখানে?”
“আমি সাইমনের সঙ্গে দেখা… ইয়ে মানে মি. অ্যাশ,” অস্পষ্ট স্বরে কোনোরকমে সে বলে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে অফিসারের অভিব্যক্তি বদলে গেল।
“আসুন,” বলে তিনি তাকে ইশারায় পেছনে আসতে বলে সোজা লম্বা হলঘরটার দিকে হাঁটা দিলেন।
ফেইথ নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করল। খানিকটা বিভ্রান্ত লাগছে তাকে। তবে খুব বেশি নয়, অন্তত অন্য সময় এই ধরনের অভ্যর্থনা পেলে সে যতটা বিভ্রান্ত হত। এখন সময় অন্য রকম। যখন মি. প্যার্ট্রিজের মতো একজন নিরীহ আর গোবেচারা মানুষও হঠাৎ পালটে গিয়ে ক্ষ্যাপা নেকড়ে হয়ে যেতে পারে, তখন আর যা কিছু সবই হতে পারে। এমনকী এও হতে পারে যে শ্রদ্ধেয় মি. হ্যারিসন নিজেই কোনো পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন। তা সে যার যাই হোক তাতে তার বয়েই গেল, সে এখন শুধু তার সাইমনের সঙ্গে দেখা করতে চায়। সে এখন শুধু চায় একটু ভরসা আর একটু সান্ত্বনা—
সাদা পোশাকের একজন লম্বা কমবয়সি যুবক তার দিকে এগিয়ে এল। “আমার নাম জ্যাকসন। আপনি কি বসবেন না? সিগারেট চলবে?”
সে এবার একটু ঘাবড়ে যায়। হাত নেড়ে প্যাকেটটা দূরে ঠেলে দেয়।
“হিঙ্কেল বলছে যে আপনি নাকি মি. অ্যাশের সঙ্গে একটু কথা বলতে চান?”
“হ্যাঁ, আমি—”
“আপনিই কি মিস প্রেস্টন? ওনার বাগদত্তা?”
“হ্যাঁ।” তার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। “আপনি কী করে—ওহ্, সাইমনের কিছু হয়নি তো?”
তরুণ অফিসারটিকে যথেষ্টই বিরক্ত বলে মনে হচ্ছে। একটু ইতস্তত করে তিনি বললেন, “আমার মনে হয় সামান্য হলেও কিছু একটা হয়েছে। যদিও এই মুহূর্তে তিনি সম্পূর্ণ নিরাপদ। দেখুন, ঘটনা হচ্ছে যে তিনি—দূর ছাই, আমি কখনোই এ ধরনের আলোচনা করতে পছন্দ করি না।”
উর্দী পরা অফিসারটি এগিয়ে এলেন এবার। “ওনাকে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মিস। দেখুন, ঘটনা হচ্ছে যে উনি মনিবের সঙ্গে একটা বড়োসড়ো ঝামেলা বাঁধিয়ে বসেছেন।”
কথাটা শুনে ফেইথ সম্পূর্ণ অজ্ঞান হল না ঠিকই, তবে বেশ কয়েক মিনিটের জন্য তাঁর গোটা দুনিয়াটাই যেন আবছা হয়ে মুছে গেল। এরপর লেফটেন্যান্ট জ্যাকসন ঠিক কী কী ব্যাখ্যা করলেন বা সাইমনকে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে জানানোর জন্য সে যে ঠিক কী কী বলে গেছে, এইসব কোনো কিছুই সে ভালো করে শুনতে পেল না। যে চেয়ারটায় তাকে বসতে দেওয়া হয়েছিল সেখানেই সে কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে বসে রইল যতক্ষণ না তার চোখের সামনে থাকা মানুষজন আর আসবাবপত্রের অবয়ব আবার পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠল। তারপরেই সোজা হয়ে উঠে বসে একটা ঢোক গিলে সে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিল।
“সাইমন নির্দোষ, এরকম কিছু সে করতেই পারে না,” তাঁর কণ্ঠস্বর এখন আবার ঋজু এবং দৃপ্ত।
“সেটা হলে আমিও খুশি হব।” জ্যাকসনের গলা শুনে মনে হল তিনি কথাটা মন থেকেই বললেন। “খুনের অভিযোগে যাকে খুশি ধরে চালান করাটা আমার চরিত্রে নেই। আপনার প্রেমিকের মতো সরল সাধাসিধে মানুষ হলে তো আরও বেশি করে নয়। কিন্তু এই কেসটা যা দেখছি একদম সোজাসাপটা কেস। এক্ষেত্রে সেটাই হচ্ছে ভয়ের। কাজেই তিনি যদি নির্দোষ হয়ে থাকেন, তাহলে কিন্তু প্রথমে যে গল্পটা উনি আমাদের শুনিয়েছেন তার চাইতে আরও বেশি যুক্তিগ্রাহ্য কোনো গল্প বলতে হবে। একটা স্যুইচ টিপে দিয়েই হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার মতো একজন খুনীর গল্প কিন্তু বেশির ভাগ জুরির কাছেই কোনো পাত্তা করতে পারবে না।”
ফেইথ উঠে পড়ল। তার পায়ের নীচের জমি এখন অনেকটাই শক্ত। আর আরও একটা ব্যাপার তাঁর কাছে পরিষ্কার। “সাইমন নির্দোষ, এরকম কিছু সে করতেই পারে না,” সেই একই কথা সে আরও একবার পুনরাবৃত্তি করে। “আর এটা আমি প্রমাণ করেই ছাড়ব। শুধু একটা প্রশ্ন করার আছে। দয়া করে আমাকে বলুন, আমি কোথায় একজন গোয়েন্দা পেতে পারি?”
উর্দী পরিহিত অফিসার হো হো করে হেসে উঠলেন। জ্যাকসন নিজেও অট্টহাসি হাসতে শুরু করেছিলেন, কী যেন ভেবে থমকে গেলেন। অট্টহাসিটা পালটে ধীরে ধীরে তার মুখে একটা বিষণ্ণ হাসি দেখা গেল। “অবশ্যই, মিস প্রেস্টন। যদিও সরকার আমাকে মাইনে দিয়ে রেখেছে এই ভেবে যে আমিও তেমনই একজন। কিন্তু আপনি কী বলতে চাইছেন সেটা আমি বুঝতে পারছি: আপনি আসলে চাইছেন একজন স্বাধীন তদন্তকারী। বেসরকারি গোয়েন্দা। যাকে সরকারি বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হয় না বা যাকে শুধু সরকারিভাবে পাওয়া শুকনো তথ্যের ভরসায় বসে থাকতে হয় না। ঠিক আছে, কোনো ব্যাপার না। এটা তো আপনার অধিকারের মধ্যেই পড়ে। যা আপনার ইচ্ছে।”
“ধন্যবাদ। তাহলে এখন বলুন, কীভাবে আর কোথায় গেলে আমি তেমন কারো খোঁজ পাব?”
“দেখুন এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সির হয়ে কাজ করা আমার পেশা নয়। কিন্তু আমি এটাও চাই না যে আপনি কোনো শ্যাস্টার বা শামুসের খপ্পরে গিয়ে পড়ুন। একজনের খবর আমি আপনাকে দিতে পারি, ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি এর আগে পক্ষে হোক বা বিপক্ষে বেশ কয়েকবার কাজ করেছি। তবে এই কেসটার যা পরিস্থিতি তাতে আমার মনে হয় ওঁকে রাজি করানো মোটামুটি অসম্ভব। ওঁর আবার সহজ সরল কেস হলে চলবে না, ওঁর পছন্দ এমন ধরনের কেস যার সমাধানের আর কোনো আশা নেই। মানে যে কেসগুলোকে লোকে বলে খতম কেস।”
“খতম কেস?” খতম শব্দটাই তো একটা অস্বস্তিকর শব্দ।
“হ্যাঁ। তবে সত্যের খাতিরে আমাকে এটা বলতেই হবে যে একবার উনি কেসটা হাতে নিলে কোনো কেসই আর খতম কেস হয়ে থাকতে পারে না। এই ভদ্রলোকের নাম ও’ব্রীন—ফার্গাস ও’ব্রীন।”
সাত
সেদিন রাতের খাওয়া দাওয়াটা বাইরেই সারলেন মি. প্যার্ট্রিজ। আগাথা দিদির জিবের ধার সহ্য করার আর ইচ্ছে হচ্ছিল না তাঁর। ভেবে রেখেছেন পরে একসময় সুযোগ মতো সব কিছু বুঝিয়ে তাকে সামলে নেবেন তিনি। এর মধ্যে তিনি না হয় যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলবেন তাকে।
ডিনার শেষ করে এক পাক ঘুরে দেখবেন বলে চলে গেলেন সেই বারগুলোর একটাতে যেখানে আবার রাতের দিকে রীতিমতো স্ট্রিপ ড্যান্স চলে। সেই সব দেখে কিছুক্ষণ সময়ও কাটালেন সেখানে। শুধু কাটালেন না, “যদি তারা জানত যে কে আছে বসে তাদের পাশে” নামের খেলাটাও তিনি ভালোই খেললেন সেখানে। নিজেকে তখন তাঁর মনে হচ্ছিল তিনি যেন হারুন-আল-রশিদ, আর এই মনে হওয়াটাও ভালোই উপভোগ করলেন তিনি।
বাড়ি ফেরার পথে একটা চৌমাথার মোড়ের মাথায় ফুটপাথে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়েছিলেন তিনি। কিনে নিয়েছিলেন পরের দিনের সকালের খবরের কাগজটা। এরপর পরের মোড়ের মাথায় ফুটপাথের ধার ঘেঁষে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে চটজলদি খুলে ফেলেছিলেন সেটা। পুলিশের মাথা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো রহস্যজনক কোনো হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর একটা শিরোনাম তিনি দেখতে পাবেন বলে অনেক আশা নিয়ে খুলে ছিলেন খবরের কাগজটা। তার বদলে দেখতে পেলেন:
হত্যাকারী সেক্রেটারি: হত মনিব
ধাক্কাটা যথেষ্ট জোরে লাগলেও কয়েক মুহূর্ত পরেই তিনি আবার সেই দ্য গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ। তিনি ইচ্ছে করে এসব কিছু করেননি। জেনে শুনে আজ পর্যন্ত তিনি কখনও কাউকে কষ্ট দিতে চাননি। কিন্তু বড়ো বড়ো মানুষের বড়ো বড়ো কাজের সামনে ছোটো মাপের মানুষেরা যারাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে আসবে তাদের তো তার ফল পেতেই হবে। এই নিরপরাধ যুবককে বাঁচাতে অপরাধ কবুল করার যে ভাবনাটা তাঁর মনে মুহূর্তের দূর্বলতায় ছোট্ট করে জেগে উঠেছিল, সেটা আসলে একটা বিপজ্জনক বোকামি—এই সব বিপজ্জনক চিন্তাভাবনা তাঁর মন থেকে এক্ষুনি মুছে ফেলা উচিত।
আপনার করা খুনের নিখুঁত অপরাধটি আরও বেশি নিখুঁত হয়ে উঠবে তখনই যখন তার দায় অন্য কাউকে চোকাতে হবে। আর রাষ্ট্র যদি সাইমন অ্যাশকে শাস্তি দিতে ঠিক করে ফেলে যে তাকে প্রাণঘাতী-গ্যাস চেম্বারে ঢোকানো হবে—তবে তো সেটা সোনায় সোহাগা, ফেইথ সমস্যার সমাধানে রাষ্ট্রের দেওয়া আশীর্বাদী উপহার।
পরিতুষ্ট এবং তৃপ্ত মি. প্যার্ট্রিজ এবার গাড়ি ছোটালেন বাড়ির দিকে। অবশিষ্ট রাতটুকু তিনি তার ওয়ার্কশপে রাখা ছোটো খাটটার উপরেই কাটিয়ে দিতে পারবেন। এতে আরও একটা ফায়দা তিনি পাবেন, আগাথা দিদির মুখটাও তাঁকে অনেক কম দেখতে হবে। ওয়ার্কশপে ঢুকে স্যুইচটা টিপতেই আলোটা ক্লিক করে জ্বলে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি জমে বরফ হয়ে গেলেন।
টাইম মেশিনটার ঠিক পাশেই একজন কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই বড়ো আসল যন্ত্রটার পাশে। মি. প্যার্ট্রিজের ধারণা ছিল যে তাঁর আত্মবিশ্বাস বিশাল, অতিমানবীয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সেটা ভুল। একটা ফোলানো ফাঁপানো বিশাল বেলুনের মতো সেটা ফুস হয়ে যাওয়ার জন্য দরকার ছিল শুধু একটা ছোট্ট পিন। প্রথমেই তিনি ধরে নিলেন যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে সে নিশ্চিত পুলিশেরই উঁচু-দরের বিজ্ঞান-জানা কেউ। এমন একজন বুদ্ধিমান কেউ যে কিনা তাঁর কায়দাটা ধরে ফেলে তাঁকে ধাওয়া করে এখানে এসে তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্রটা আবিষ্কার করে ফেলেছে।
ততক্ষণে লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
মি. প্যার্ট্রিজের আতঙ্ক তাতেও শুধু একটুখানিই কমল। কারণ লোকটা অন্য আর কেউ নয়। লোকটা স্বয়ং মি. প্যার্ট্রিজ। সেই মুহূর্তটা ঠিক যেন এক দুঃস্বপ্নের মুহূর্ত। সেই দুঃস্বপ্নের খণ্ডমুহূর্তে নিজের প্রতিমূর্তি, নিজের ডপেলগ্যাঙ্গারের2 দিকে তাকিয়ে তিনি যেন দেখতে পাচ্ছিলেন পো’য়ের উইলিয়াম উইলসনকে, যেন তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন নিজেরই ব্যক্তিত্বের আপাত বিচ্ছিন্ন পৃথক দুটি সত্বা ডক্টর জেকিল আর মি. হাইডকে। তারপরেই দেখা গেল তারস্বরে চিৎকার করতে করতে দ্বিতীয় মি. প্যার্ট্রিজ তড়িঘড়ি করে ঘরটা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, আর তাঁর বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটু আগেই ভেতরে এসে ঢোকা প্রথম মি. প্যার্ট্রিজ ধড়াম করে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
চড়াইয়ের পরে পরেই উৎড়াই থাকবেই। তাই উল্লাস-পর্বের উদ্দামতার পরে মি. প্যার্ট্রিজের এখনকার আঁধার-পর্বের এই কালিমা অনিবার্য ছিল। তাঁর নিখুঁতভাবে করা খুনের সাফল্য, ফেইথের প্রতি তাঁর কামনাতৃপ্তির নিশ্চয়তা, তাঁর হারুন-আল-রশিদ হয়ে কাটানো সন্ধ্যাবেলা, সব কিছু একটু আগে এক ফুঁয়ে উবে গেছে। এখন একদিকে পাগল হয়ে যাওয়ার আর অন্যদিকে সনাক্ত হয়ে যাওয়ার মতো দ্বিগুণ ভয়ের মুখোমুখি তিনি। মেঝেতে পড়ে রয়েছেন বুকে-হাঁটা ঘৃণ্য কোনো প্রাণীর মতোই। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন ঘরের ভিতরে ভয়াবহ সব আওয়াজ হচ্ছে। কয়েক মিনিট পরেই আবার বুঝতে পারলেন যে সেগুলো তাঁরই নিজের গলা থেকে বেরোনো ফোঁপানির আওয়াজ।
শেষ পর্যন্ত একসময় তিনি নিজেকে উঠিয়ে দাঁড় করাতে সক্ষম হলেন। সিঙ্কের ঠান্ডা জলে মুখচোখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়েও নিলেন, কিন্তু তবুও ভয়াবহ সেই ভয়ের ছায়া তাঁর মুখে তারপরও লেগেই রইল। শুধু একটাই জিনিস ছিল যা তাঁকে আবার স্বস্তি ফিরিয়ে দিতে পারত। শুধু সেই একটাই জিনিস তাঁকে তখনও বোঝাতে পারত যে তিনিই হচ্ছেন দ্য গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ। আর সেটা ছিল তাঁরই উদ্ভাবিত একটি মহান যন্ত্র। তিনি আলতো করে সেটাকে একবার ছুঁয়ে দেখে নিলেন, তারপর যন্ত্রটার শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করতে শুরু করলেন ঠিক যেভাবে একজন মানুষ তার নিজের প্রিয়তম পোষ্য ঘোড়াকে আদর করে ঠিক সেইভাবে।
মি. প্যার্ট্রিজ যে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় তাঁর বহুদিনের সংযত থাকার সাধারণ অভ্যাস পরিত্যাগ করে তিনি যে অত্যধিক মদ্যপান করবেন তাতেও আশ্চর্যের কিছু নেই। অনিচ্ছাকৃত হলেও এক সময় তাঁরই হাতের চাপ পড়ে গেল যন্ত্রটি চালু করার স্যুইচের উপরে। সেই মুহূর্তে কিছু না ভেবেই তিনি শুধু একবার তাকিয়ে ছিলেন দরজার দিকে। দেখলেন দরজা দিয়ে নিজেই ঢুকছেন। মনের সেই অবস্থায় দরজা দিয়ে নিজেই নিজেকে ঢুকতে দেখাটা একটা ভয়ংকর ব্যাপার। তিনি ভয়াবহ একটা চিৎকার দিয়ে এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
আরও পরে, রাত যখন আরও গভীর হল, রাত্রির শীতল বাতাসে ঠান্ডা মাথায় তিনি ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তিনি আসলে ভুল করে নিজেই নিজেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অতীতের সেই সময়টাতে যখন তিনি ফিরে এসে সবে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছেন, আর তাই ঘরে ঢুকে তিনি নিজেই নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন। দেখতে পেয়েছিলেন তিনি নিজে দাঁড়িয়ে আছেন যন্ত্রটার পাশে। ব্যাস, এইটুকুই। এর মধ্যে আর অন্য কোনো রহস্য নেই। তবে রহস্য না থাকলেও সতর্ক থাকার দরকার আছে। একটা জিনিস তিনি মনে মনে ঠিক করে নিলেন: যন্ত্রটা ব্যবহার করার সময় সর্বদাই ব্যবহার করতে হবে অত্যন্ত সাবধানে, যাতে স্থান-কালের এদিক থেকে ওদিকে যাতায়াতের সময় নিজে যেখানে ছিলেন সেখানে ফিরে যাওয়াটা এড়ানো যায়। কখনোই নিজের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করা চলবে না। মানসিক ধাক্কা অতি বিপজ্জনক জিনিস। অনেক বড়ো বিপদ হতে পারে।
মি. প্যার্ট্রিজ এর মধ্যে এখন অনেকটাই সুস্থ বোধ করতে শুরু করেছেন। আসলে তিনি নিজেই তো নিজেকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন, তাই না? হতেই পারে সেটা, দ্য গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজের ভয়ে তিনি শুধু একাই না, আগামী দিনে আরও অনেকেই কাঁপবে।
আট
পুলিশের সেই লেফটেন্যান্টটি যে গোয়েন্দা ভদ্রলোকের নামটা ফেইথকে সুপারিশ করেছিলেন—যদিও সুপারিশ শব্দটি এঁর মতো গোয়েন্দার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়, তবু যদি আপনি ওইভাবেই ব্যাপারটা দেখতে চান—তাঁর নাম ফার্গাস ও’ব্রীন, আর তাঁর অফিসটা সেকেন্ড অ্যান্ড স্প্রিং-এর একটা প্রাচীন ঝরঝরে বাড়ির মধ্যে। ফেইথ সেখানে পৌঁছে দেখতে পেল আরও দুজন মানুষ, যাদের দেখে তার মক্কেল বলেই মনে হল, ওয়েটিং রুমে তারা আগে থেকেই এসে বসে আছে। একজন, যাকে দেখে রাস্তার নিষ্কর্মা ভবঘুরেদের কেউ বলে মনে হচ্ছে সে একটা ভেজা বেড়ালের মতো মুখে চুপটি করে করে বসে আছে। আরেকজনকে এমনিতে ঝোড়ো কাকের মতো লাগলেও তার মার্জিত চেহারা, হাবভাব আর পোশাক-আশাক দেখে বর্তমানে অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়া হলিউডের উপরতলার কেউ ছাড়া অন্য কিছু বলে তো মনে হচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত ফেইথ যখন তাঁর দেখা পেল, দেখতে পেল গোয়েন্দা ভদ্রলোকটির পোশাক-আশাক অনেকটাই দ্বিতীয় মক্কেলের মতো, ঝাঁ চকচকে, তবে সেগুলো যে ঠিক গোয়েন্দাসুলভ তা মোটেও বলা চলে না, বরং সেগুলো সান্ধ্যকালীন বিশ্রামের উপযুক্ত। এক মাথা টকটকে লাল চুলের ছিপছিপে ধারালো চেহারার গোয়েন্দা ভদ্রলোকটিকে বয়সের দিক থেকে যুবক বলাই সংগত হবে। তবে সবচেয়ে আগে যেটা আপনাকে আকৃষ্ট করবে সেটা হচ্ছে তাঁর চোখ দুটো—গাঢ় সবুজ ঝকঝকে চোখ দুটোর অস্থির দৃষ্টিতে তীব্র কৌতূহল খেলা করছে। সেই দৃষ্টির সামনে আপনি নিশ্চিত হবেন যে যতক্ষণ না তাঁর কৌতূহল নিবৃত্ত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর কাজ শেষ হবে না।
ফেইথের গোটা গল্পটা চুপচাপ শুনে গেলেন তিনি। মাঝে মধ্যে নোট নেওয়ার সময়েও তেমন নড়াচড়া করলেন না। পুরো সময়টাই একাগ্রচিত্তে উৎসুকভাবে শুনছিলেন তিনি। কিন্তু যখন ফেইথ দেখল যে তাঁর কথা শুনতে শুনতে গোয়েন্দা ভদ্রলোকের ঝকঝকে সবুজ চোখ দুটোর ঝলমলে কৌতূহলী দীপ্তি ক্রমশ নিভে যাচ্ছে আর সেখানে ভরে উঠছে হতাশা, তখন তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেতে শুরু করল। তারপর যখন তার বলা সম্পূর্ণ হল, ভদ্রলোক উঠে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে অফিসের ভেতরের স্বল্প পরিসরেই পায়চারি করতে শুরু করলেন।
“এইভাবেই আমি সবথেকে ভালো করে চিন্তাভাবনা করতে পারি,” কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করেই কথাটা বললেন তিনি। “আশা করি আপনি কিছু মনে করবেন না। তবে কথা হচ্ছে যে আমার হাতে ভাবার মতো তেমন আছেই বা কী? দেখুন আপনি আমাকে যা যা বললেন তার মোদ্দা কথাগুলো যদি দেখি, তো সেগুলো হচ্ছে এই রকম: আপনার প্রেমিক, মানে আমাদের সাইমন অ্যাশ, তার মনিবের সঙ্গে সে তখন একাই ছিল লাইব্রেরির মধ্যে। এক সময় খানসামা একটা চিৎকার শুনতে পায়। সে দরজায় টোকা দেয়, ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে, কোনো লাভ হয় না। অ্যাশ ভেতরে থেকে দরজা খুলে দেয়। পরে পুলিশী খানাতল্লাশি থেকে জানা যায় বাদবাকি সমস্ত দরজা আর জানলা সব একইরকমভাবে ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। তারপর খুনের অস্ত্র, সেই ছুরিটার উপরেও পাওয়া গেল অ্যাশের হাতের ছাপ। মাই ডিয়ার মিস প্রেস্টন, সব মিলিয়ে এগুলো যে কোনো জুরির কাছে আসামির একটা সই করা স্বীকারোক্তির চাইতেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
“কিন্তু সাইমন নির্দোষ,” ফেইথ আবার জোর দিয়ে বলল। “আমি তাকে চিনি, মি. ও’ব্রীন। সে এরকম কিছু একটা করবে এটা কিছুতেই হতে পারে না।”
“আমি বুঝতে পারছি আপনার কতটা খারাপ লাগছে। কিন্তু আপনার খারাপ লাগাটুকু ছাড়া এই মুহূর্তে এগোনোর মতো আমাদের হাতে আর কী আছে? আমি বলছি না যে সেটা ভুল; আমি আপনাকে যেটা বোঝাতে চেষ্টা করছি সেটা হচ্ছে পুলিশ আর আদালত এটা কীভাবে দেখবে।”
“কিন্তু মি. হ্যারিসনকে খুন করার মতো কোনো কারণই তো সাইমনের নেই। একটা ভালো চাকরি করছিলেন। কাজটা তিনি পছন্দও করতেন। ক-দিন পরেই আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম। আর এখন তাঁর কোনো চাকরি বা… বা কিছুই তো আর রইল না।”
“আমি জানি।” গোয়েন্দা পায়চারি করেই চলেছেন। “এটাই একটা পয়েন্ট যেটা আপনার পক্ষে আছে—অ্যাবসেন্স অব মোটিভ—অপরাধের কোনো উপযুক্ত কারণ অনুপস্থিত। কিন্তু এর আগেও কোনো কারণ খুঁজে না পেয়েও ওরা আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। আর সেটা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। খুনিরা যে সবসময় যুক্তিসম্পন্ন মানুষের মতো চিন্তাভাবনা করবে তা তো নাও হতে পারে। এমনি একটা যেমন তেমন কারণেও খুন হতে পারে। লান্ড্রুর ঘটনার পর এখন সেটা সবাই মানতে বাধ্য। ফ্রান্সে ঘটা সবচেয়ে জঘন্য অথচ চটকদার সেই খুনটা হওয়ার কারণ তো ছিল শুধু এই যে সেদিন সকালে ইলেকট্রিক টোস্টার ঠিকমতো কাজ করেনি। যাকগে, ছাড়ুন এসব কথা, আসুন আমরা দেখি এখানে কী কী কারণ থাকতে পারে। মি. হ্যারিসন তো রীতিমতো পয়সাওয়ালা লোক ছিলেন; তার অবর্তমানে তার টাকাপয়সা কে বা কারা পাবে?”
“ঘটনা হচ্ছে, সাইমন দিনকয়েক আগেই তাঁর মনিবকে উইলের খসড়া তৈরির কাজে কিছু সাহায্য করেছিল। যতটুকু আমি শুনেছি সম্পত্তির বেশির ভাগটাই যাবে লাইব্রেরি, ফাউন্ডেশন আর ওইরকম কিছুতে। আর হ্যাঁ, অবশ্য চাকরবাকরদের জন্যেও রাখা আছে, সামান্য হলেও—”
“সামান্য কিন্তু অনেক সময়ই অসামান্য হয়ে উঠতে পারে। সে যাই হোক, কিন্তু কোনো নিকট আত্মীয় বলতে কেউ নেই?”
“তাঁর বাবাই তো এখনও বেঁচে আছেন। তবে তিনি এখনই রীতিমত বৃদ্ধ। তা ছাড়া তিনি নিজেই এত ধনী যে তাঁর জন্য কিছু রেখে যাওয়াটা বোকামি হত।”
তুড়ি দিয়ে উঠলেন ফার্গাস, “ম্যাক্স হ্যারিসন! ঠিক ধরেছি। ইনিই তো সেই বহুকাল আগে অবসর নেওয়া বৃদ্ধস্য বৃদ্ধ, একদম খাঁটি লুঠেরা-বণিক একজন, এর চেয়ে বেশি ভদ্র বিশেষণ আপাতত খুঁজে পাচ্ছি না। এঁর সম্পর্কেই তো গত দশ বছর ধরে শোনা যাচ্ছিল লোকটা এই আজ মরছে তো কাল মরছে। যেমন ধনী তেমনি কৃপণ, অথচ মরার সময় রেখে যাবে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। ঠিক, ওটাই হচ্ছে আসল জিনিস, ওখানেই ঠিকঠাক খুঁজতে পারলে খুনের উদ্দেশ্য পাওয়া যাবে।”
“সেটা কী রকম?”
“খুনি এমন একজন কেউ, স্ট্যানলি হ্যারিসনের মৃত্যুতে যে কিনা লাভবান হতে পারে, অথচ এক্ষেত্রে সেটা সরাসরি দেখা যাচ্ছে না, যেহেতু তার সম্পত্তির মোটা অংশ চলে যাচ্ছে লাইব্রেরি আর ফাউন্ডেশনের পেছনে, কিন্তু আসল লাভ হবে ঘুরপথে—তার বাবার কাছ থেকে। অর্থাৎ দুটি ক্লাসিক উদ্দেশ্যের সমন্বয়—আর্থিক লাভ আর শত্রুর নির্মূল। স্ট্যানলির অবর্তমানে বুড়ো হ্যারিসনের অগাধ সম্পদের মালিকানা পেতে পারে এমন নিকট আত্মীয় কে কে আছে?”
“আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু আমি দুজনকে চিনি যারা দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি বা ওই রকম কিছু। তবে আমি যতদূর জানি তারাই একমাত্র জীবিত আত্মীয়। আগাথা দিদি আর তাঁর ভাই হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ।” মি. প্যার্ট্রিজের নামটা বলার সময় তার চোখেমুখে এক ধরনের অদ্ভুত বিষণ্ণতা ফুটে উঠতে দেখা গেল। গতকাল ভদ্রলোকের অদ্ভুত ব্যবহারের কথা তাঁর এখন আবার মনে পড়ে গেছে।
ফার্গাসের চোখ দুটো এখন আবার ঝকমক করতে শুরু করেছে। “যাক, অন্তত একটা সূত্র পাওয়া গেল। সাইমন অ্যাশের কোনো যৌক্তিক উদ্দেশ্য দেখা যাচ্ছে না আর একজন হ্যারিসন প্যার্ট্রিজের ভাগ্য খুলে যাচ্ছে। অবশ্য এতে কিছুই প্রমাণ হয় না, তবে শুরু করার জন্য আপনাকে এটা খানিকটা হলেও জায়গা দেবে।”
“কিন্তু—” ফেইথ বাধা দেয়। “কিন্তু মি. প্যার্ট্রিজের পক্ষেও বোধহয় এই খুনটা করা সম্ভব নয়।”
ফার্গাস পায়চারি থামিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। “দেখুন ম্যাডাম। মক্কেলের কথায় সন্দেহভাজন আসামীকে নির্দোষ ধরে নিয়েই আমাকে এগোতে হয়। নইলে আমি কখনোই মক্কেল পাবো না। কিন্তু তারপর যদি দেখা যায় যাদেরই সন্দেহভাজন বলে মনে হচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কেই আপনি দৃঢ় নিশ্চিত যে তারা প্রত্যেকেই সাধু আর—”
“না, না, এটা সেরকম নয়। সেরকম কিছু আমি বলতেও চাইনি। অবশ্য এটা ঠিক যে আমি ভাবতেও পারছি না এরকম একটা কিছু মি. প্যার্ট্রিজ করতে পারেন—”
“কখনই আপনি আগে থেকে জানতে পারবেন না,” ফার্গাস যেন হঠাৎ গম্ভীর। তার গলার স্বর পালটে গেছে। “আমার নিজেরই কয়েকজন কাছের বন্ধু আছে যারা খুন করেছে অথচ করতে পারে বলে আগে কখনও ভাবিনি।”
“কিন্তু খানসামা যা বলেছে সেই হিসেবে ঠিক পাঁচটা বাজার একটু পরেই খুনটা হয়েছিল। অথচ মি. প্যার্ট্রিজ সেই সময় ছিলেন আমারই বাড়িতে। ঠিক আমার সামনে। আর আমি থাকি মি. হ্যারিসনের বাড়ির থেকে অনেকটা দূরে, শহরের প্রায় অন্য প্রান্তে।”
“সময় সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত?”
“আমরা এক সঙ্গেই রেডিয়োতে পাঁচটা বাজার ঘোষণা শুনেছি। উনি তো আবার সেটা শুনে নিজের ঘড়ির সময়ও মিলিয়ে নিয়েছিলেন।” হঠাৎ থেমে গেল সে। ঠিক তার পরের সেই ভয়ঙ্কর কয়েক মিনিটের কথা সে এখন আর মনে করতে চাইছিল না। ফলে কথাটা বলতে গিয়ে এবারও আবার তার কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল।
“ওহ্, তা তিনি কী এ বিষয়ে আলাদা করে কোনো কথা তখন বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ, মানে… এমনি সাধারণ কথাবার্তা বলছিলাম আমরা। মনে আছে সেই সময় তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন আর হাত উঠিয়ে কব্জির দিকে তাকালেন। আর ঠিক সেই সময়েই রেডিয়োতে ঘোষণাটা শুরু হয়েছিল। সেটা আমরা দুজনেই শুনেছিলাম।”
“হুম-ম-ম।” মনে হচ্ছে ফেইথের কথাগুলো গোয়েন্দার মনের ভেতর কোনো খটকা তৈরি করল। “ঠিক আছে, এছাড়া দিদিটিকেও তো একবার দেখার আছে। আর যাই হোক না কেন, এই প্যার্ট্রিজরা আমাকে শুরু করার মতো একটা জায়গা তো দিল। এটাই আমার দরকার ছিল।”
ফেইথ তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। তাঁর চোখে আশার আলো। “তাহলে আপনি মামলাটা নিচ্ছেন?”
“নিচ্ছি তো বটেই। কিন্তু ভগবান জানেন কেন নিচ্ছি। তবে আমি আপনাকে খুব বেশি কিছু ভরসাও দিতে পারছি না, কারণ আজ পর্যন্ত আমি আমার হাতে একটাও তাস নেই এমন যত ফালতু মামলা নিয়েছি, তার মধ্যে এটা সম্ভবত সবচেয়ে বাজে অবস্থায় আছে। কিন্তু তবু আমি নেব। কারণ কোনো সরকারি গোয়েন্দা একটা হারা মামলা নিয়ে এসে আমার কোলে ফেলে দিয়ে মুচকি হাসি হাসবে আর তার মজাটা আমি নেব না সেটা তো হতে দেওয়া যায় না।”
নয়
“ব্রাকেট, মি. হ্যারিসন যখন লাইব্রেরিতে থাকেন তখন লাইব্রেরির দরজা জানলা সব বন্ধ থাকাটা কি রোজকার স্বাভাবিক ঘটনা?”
প্রশ্নটা করেই তিনি খেয়াল করলেন যে এই মুহূর্তে খানসামার ব্যবহার ঠিক খানসামাচিত লাগছে না; আসলে সে বোধহয় এখনও সঠিক বুঝে উঠতে পারেনি ভাড়াটে গোয়েন্দাকে ঠিক কোন শ্রেণির মানুষের মধ্যে ধরতে হবে—ভদ্রলোক শ্রেণির নাকি চাকর-বাকর শ্রেণির। “না,” তাই উত্তরটা সে যদিও ভদ্রভাবেই দিল, কিন্তু দিল “স্যার” শব্দটির ব্যবহার ছাড়াই। “না, এটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক ব্যাপার।”
“তুমি কি আগে, মানে ঘটনা ঘটার আগে খেয়াল করেছিলে যে সেগুলো বন্ধ ছিল কি না?”
“না, বন্ধ ছিল না। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটার ঠিক কিছুক্ষণ আগেই একজন দর্শনার্থী এসেছিলেন। তিনি দেখা করতে চাইলেন। আমিই তাকে ভেতরে পৌঁছে দিয়েছিলাম।”
“দর্শনার্থী, আচ্ছা?” ফার্গাসের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। তাঁর চোখের সামনে এখন ভাসছে বাস্তবে কী কী সম্ভাব্য উপায় থাকতে পারে যেখানে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করা হবে অথচ মনে হবে যেন ভেতর থেকে বন্ধ করা হয়েছে। “আর এই দর্শনার্থীর ব্যাপারটা ঠিক কখন ঘটেছিল?”
“ঠিক পাঁচটায়, যতদূর আমার মনে পড়ছে। কিন্তু সেই ভদ্রলোক আজ যখন শোক প্রকাশ করতে এলেন, তখন আমি সেটা বলতেই উনি বললেন যে, না, তাঁর হিসেবে নাকি তিনি আরও আগে এসেছিলেন।”
“আর এই ভদ্রলোকটি কে?”
“মি. হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ।”
এটাও গেল, ফার্গাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আরও একটা সম্ভাবনা মাঠে মারা গেল। যদি লোকটা ফেইথ প্রেস্টনের ওখানে পাঁচটা নাগাদ থেকে থাকে তাহলে এখানে নিশ্চয়ই আরও আগে এসে থাকবে। চাইলে ঘড়ির কাঁটা আপনি যখন খুশি এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দিতে পারলেও বেতার অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে কখনোই তিন পাঁচ করতে পারবেন না। তা সেও না হয় হল—“মি. প্যার্ট্রিজের মধ্যে অদ্ভুত কোনো কিছু চোখে পড়েছিল কী? কিংবা তার ব্যাবহারে?”
“গতকাল? না, তেমন কিছু তো আমার চোখে পড়েনি। তবে ওনার হাতে অদ্ভুত ধরনের একটা জিনিস অবশ্য ছিল, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন—দেখেছি ঠিকই কিন্তু জিনিসটা কী সেটা আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম ওটা হয়তো তাঁর ইদানিং কালের কোনো আবিষ্কার। সম্ভবত সেটাই তিনি মি. হ্যারিসনকে দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন।”
“এই প্যার্ট্রিজ লোকটা তো উদ্ভাবক, মানে নতুন নতুন জিনিস বানান, তাই না? যাক গে, কিন্তু এটা তুমি তো গতকালের কথা বললে। আজ যখন দেখলে তখন তোমার কী মনে হল, আজও কি তার মধ্যে অদ্ভুত কিছু নজর এসেছে?”
“আমি ঠিক জানি না। তবে খটকা একটা লেগেছিল ঠিকই, যদিও সেটা বুঝিয়ে বলা কঠিন। তবে আজ তাঁর মধ্যে একটা অন্যরকম কিছু ব্যাপার ছিল। যেন তিনি পালটে গিয়েছেন—যেন হঠাৎ লায়েক হয়ে গেছেন বা সেই রকমই কিছু একটা।”
“বয়স বেড়ে গেছে?”
“না। শুধু যেন লায়েক হয়ে গেছেন।”
“ঠিক আছে। আপনি এখন যেতে পারেন।”
***
“মি. অ্যাশ, আপনি দাবি করছেন যে এই লোকটাকে আপনি নিজের চোখে দেখেছেন—”
“দাবি! কী মুশকিল, দেখুন ও’ব্রীন, আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করছেন না?”
“ধীরে, ধীরে। এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। মোদ্দা কথা হচ্ছে মিস প্রেস্টন আপনাকে বিশ্বাস করেন আর আমার জন্য আপাতত সেটাই যথেষ্ট। আর আমি আপনার উপর তাঁর বিশ্বাসটুকু প্রমাণ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। এখন কথা হচ্ছে এই, যদি এই জেলে থাকতে আপনার ভালো লাগে তো অন্য কথা, নইলে আমাকে আপনি বলুন, যে লোকটাকে আপনি এক ঝলক হলেও দেখতে পেয়েছিলেন, তাকে দেখে কি আপনি চিনতে পেরেছিলেন? কে হতে পারে বলে আন্দাজ—”
“আমি ঠিক জানি না। তবে একটা ব্যাপার মনের মধ্যে খচখচ করেছে। যদিও আমি ভালো করে দেখতে পাইনি, তবু কেমন যেন চেনা চেনা—”
“আপনি নাকি বলেছেন যে তাঁর পাশে কোনো যন্ত্রের মতো কিছু ছিল?”
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল সাইমন অ্যাশ। “ঠিক ধরেছি। হ্যাঁ, ঠিক তাই।”
“সেটা কী?”
“মনে হচ্ছে ধরে ফেলেছি লোকটা কে ছিল। কিংবা অন্তত কে হতে পারে। মি. প্যার্ট্রিজ। আমাদের মি. হ্যারিসনেরই দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি ভাই। সেই ছিটেল বৈজ্ঞানিক।”
***
“মিস প্রেস্টন, আপনাকে আরও বেশ কিছু প্রশ্ন এখন আমায় করতে হবে। যখন একটার পর একটা সাইনপোস্ট আমাকে কোনো বিশেষ একদিকে যেতে বলে, তখন সেই পথটা অন্ধগলি হলেও আমাকে সেদিকে এগিয়ে যেতেই হয়। এবার আপনি বলুন, মি. প্যার্ট্রিজ গতকাল বিকেলে যখন আপনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখন আপনার সঙ্গে তিনি ঠিক কী করেছিলেন?
“কী আবার করবেন আমার সঙ্গে?” উত্তর দিতে গিয়ে ফেইথের গলা কেঁপে গেল। “এই সব আজেবাজে প্রশ্নের মানে কী?”
“দেখুন, এর আগেও যখনই এই প্রসঙ্গে কথা উঠেছে আপনার হাবভাব দেখে পরিষ্কার বোঝা গেছে আপনি কিছু লুকোতে চাইছেন। দুঃখজনক হলেও সত্যিটা আপনাকে এবার বলতেই হবে। এমনিতেই মি. প্যার্ট্রিজের সম্পর্কে যতদূর যা জানা সম্ভব আমি জানতে চাই, অন্তত উনি গতকাল কী কী করে বেড়িয়েছেন সেটা জানাটা তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
“তিনি—ওহ, না, আমি পারব না। আমাকে কি বলতেই হবে, মি. ও’ব্রীন?”
“সাইমন অ্যাশ অবশ্য বলেছেন যে উনি জেলের ব্যাপারে যা শুনেছিলেন সেই হিসেবে জেল ততটাও খারাপ নয়, তবে এখনও—”
“ঠিক আছে। আমি বলছি আপনাকে। তবে এটা কিন্তু সত্যিই এক আজব ঘটনা। আমি… মানে, আমার অনেক দিন ধরেই মনে হচ্ছিল যে মি. প্যার্ট্রিজ… ইয়ে, যাকে বলে হয়তো আমার প্রেমে পড়ে গেছেন। কিন্তু একে তো তিনি আমার থেকে বয়সে অনেকটাই বড়ো আর তার উপর খুবই শান্ত আর অন্তর্মুখী ধরনের মানুষ যে কোনোদিনই এই বিষয়ে তিনি আমাকে মুখ ফুটে কিছু বলেননি। আর তা ছাড়া—যাকগে, সে যাই হোক গে, আমিও কখনও এ নিয়ে ভালোমন্দ কিছু মাথা ঘামাইনি। কিন্তু কালকে—কাল এমন একটা ব্যাপার হল, ঠিক যেন… ঠিক যেন, মানে, তাঁকে কেমন যেন ভূতে-পাওয়া কোনো মানুষের মতো মনে হচ্ছিল। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে তিনি যেন খেপে গিয়ে আমাকে জাপটে ধরলেন, আর… আর চুমু খেতে শুরু করলেন। সে এক সাংঘাতিক ভয়ঙ্কর মুহূর্ত। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পালিয়ে গিয়েছিলাম।” গতকালের সেই ঘটনার কথা মনে করতে গিয়ে সে এখনও যেন কেঁপে উঠল। “ব্যাস, এইটুকুই। তবে সাংঘাতিক ভয়ঙ্কর। এখনও আমি ভাবতেই পারছি না।”
***
“আমাকে মানতেই হবে অ্যান্ডি, একটা গোটা মৌচাক এবার আমার দিকে ছুড়ে মেরেছেন আপনি।”
লেফটেন্যান্ট জ্যাকসন হেসে ফেললেন। “জানতাম আপনি খুশিতে নেচে উঠবেন, ফার্গাস।”
“কিন্তু ভেবে দেখুন: বাস্তবে অ্যাশের বিরুদ্ধে আপনি বন্ধ-দরজার একটা প্রমাণ ছাড়া আর তো কিছু পাননি, পেয়েছেন কি? সেও এমন একটা প্রমাণ যা কিনা রহস্য কাহিনির বহু পুরোনো হয়ে যাওয়া একটা ক্লিশে, এবং বাস্তবে কোথাও কখনও ঘটতে দেখা যায়নি। মনে রাখবেন ‘বন্ধ-দরজা’ কিন্তু চাইলেই খোলা যায়। ক্যারুথারস কেস মনে আছে তো?”
“আপনি আমাকে দেখান কীভাবে এটা খোলা যায়। দেখাতে পারলে সেই মুহূর্ত থেকেই আপনার মি. অ্যাশ একজন মুক্ত মানুষ।”
“ঠিক আছে। আপাতত তাহলে এই প্রসঙ্গটা একটু সরিয়ে ততক্ষণ বরং আমার সম্ভাব্য আসামির দিকে একবার নজর দেওয়া যাক। ধরা যাক তাঁর নাম এক্স। নামটা এক্স-ই রাখছি এই জন্যে যেহেতু রহস্যের পর্দা প্রকাশ্যে ফাঁস করাটা এখনও বাকি। আমাদের এই এক্স হচ্ছে নিরীহ গোবেচারা এবং কোনো ঝামেলা ঝঞ্জাটের মধ্যে থাকতে না চাওয়া এমন একজন মানুষ যে কিনা হ্যারিসন মরলেই কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি পেয়ে যাবে। সে লাইব্রেরিতে গিয়ে পৌঁছয় খুনের ঘটনার ঠিক আগে আগে। একজন ছিটেল অথচ প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক সে এবং তখন তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁরই উদ্ভাবিত একটা বিশেষ যন্ত্র। অকুস্থলে তাঁর উপস্থিতি নয়, উপস্থিতির সময়টার অ্যালিবাই নিয়ে সে রীতিমতো সচেতন। খানসামাকে বিভ্রান্ত করার জন্যে সে পরে তাকে বোঝায় যে সে সেখানে গিয়ে ছিল ঘটনা ঘটার অনেক আগে। অন্যদিকে বেতারে অনুষ্ঠান ঘোষণার সময় নিয়ে রীতিমতো নাটক করে একজন সাক্ষীর ব্যবস্থাও সে তৈরি রাখে যাতে সেই সময় তার অন্যত্র উপস্থিতি প্রমাণ করা যায়। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে মানসিকতার দিক দিয়েও তার পালটে যাওয়াটা। এখন সে আর আগের মতো নিরীহ গোবেচারা ঝামেলা ঝঞ্জাটের মধ্যে না থাকতে চাওয়া একটা মানুষ হয়ে থাকতে পছন্দ করছে না। বরং পছন্দের নারীকে দখলে নিতে এখন সে তাঁর উপর লাফিয়েও পড়তে পারে। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে খানসামার বক্তব্য সে এখন যেন অন্য একটা মানুষ; ‘সে এখন লায়েক হয়ে গিয়েছে’।”
জ্যাকসন দু-দিকে মাথা দোলান। “বাঃ, মামলা তো দেখি দুর্দান্ত জমে গেছে। আর বৈজ্ঞানিকের সেই যন্ত্রটা, আমার তো মনে হচ্ছে, সেটাই বন্ধ-দরজার রহস্য ভেদ করবে, তাই না?”
“সম্ভবত তাই, তবে সেটা জানা যাবে যখন আমরা বুঝতে পারব যে সেটা ঠিক কী ছিল। যন্ত্রের বিষয়ে আপনার মাথা তো আবার ভালোই খেলে, অ্যান্ডি। বল এখন আপনার মাঠে।”
জ্যাকসন একটা নোট প্যাড তার দিকে ঠেলে দিলেন। “বলতে বাধা নেই, মনে হচ্ছে আপনার এই এক্স লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে কাজের কাজ কিছু হলেও হতে পারে। কিন্তু এরকম মেপেজুকে কথা বলাটা তো আপনার চরিত্রের সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছে না, ফার্গাস। কেনই বা এত লুকোচুরি? এক্ষুনি গিয়ে লোকটাকে গ্রেপ্তার করার কথাটাই বা আপনি কেন আমাকে সোজাসুজি বলছেন না?”
ফার্গাস অন্য সময় যতটা আত্মবিশ্বাসী থাকেন, এখন তাঁর হাবভাব দেখে ততটা মনে হচ্ছে না। “কারণটা আপনিও বুঝতে পারছেন, আমি যে অ্যালিবাইয়ের কথা বলেছি—সেটা সত্যিই ভালো, শুধু ভালো না, দূর্দান্ত ভালো। এতটাই যে আমি ওটা কিছুতেই ভাঙ্গতে পারছি না। একেবারে নিখুঁত অ্যালিবাই বলতে পারেন।”
প্যাডটা সরিয়ে নিলেন লেফটেন্যান্ট জ্যাকসন। হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো করে ক্লান্ত স্বরে বললেন, “যান তাহলে, ‘কুমীর তোর জলে নেমেছি’ খেলুন গিয়ে এখন।”
“আচ্ছা, এখানে একটা অন্য রকম চালাকিও তো থাকতে পারে, তাই না?” ফার্গাস তবুও আলোচনা চালিয়ে যেতে চাইছেন। “ধরুন, এমনও তো হতে পারে যে বিশেষ কোনো যন্ত্র দিয়ে ঠিক পাঁচটার সময় আর্তনাদ সৃষ্টি করা করা হয়েছে যাতে খুনের সঠিক সময়টা নিয়ে একটা ভালোরকম বিভ্রান্তি তৈরি করা যায়?”
জ্যাকসন মাথা নাড়লেন। “হ্যারিসন সাড়ে চারটে নাগাদ চা ইত্যাদি শেষ করেছেন। পাকস্থলীতে পাওয়া খাদ্যের বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া গেছে যে খাবার হজম হয়েছে মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যেই। না, তিনি যে পাঁচটা নাগাদই মারা গেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”
“তাহলে তো এক্স-এর অ্যালিবাই একদম নিখুঁত,” ফার্গাস আবার সেই একই কথা বলে উঠলেন। তাঁর গলার স্বরে হতাশা। তবে সে শুধু কয়েক মুহূর্তের জন্য। একটু পরেই তাঁর সবুজ চোখ দুটো হঠাৎ জ্বলজ্বল করতে দেখা গেল। “যদি না… যদি না—”
নিজের হঠাৎ লব্ধ উপলব্ধিতে মনে হচ্ছিল তিনি নিজেই চমৎকৃত। “ওহ্ হো, হে ভগবান—” তিনি বিড়বিড় করে কিছু বলতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেলেন।
“যদি না—কী?” জ্যাকসন জানতে চাইলেন। উলটো দিক থেকে কোনো উত্তর এল না। তাঁর পুলিশি জীবনের ইতিহাসে লেফটেন্যান্ট জ্যাকসন এই প্রথমবার দ্য ও’ব্রীনকে হতবাক হয়ে যেতে দেখলেন।
দশ
জীবন যে কত আনন্দের হতে পারে এতদিনে মি. প্যার্ট্রিজ সেটা জানতে পারলেন। যদিও যে জীবন তাঁর প্রাপ্য, যা তিনি পেতে চলেছেন সেটা আসতে এখনও খানিক দেরি আছে। মধ্যবর্তী এই পর্যায়টুকু তো ক্ষণস্থায়ী—যে বদল তাঁর জীবনে আসতে চলেছে এ শুধুই তার আভাস মাত্র। বর্তমানে তিনি এখন নিছকই—কী একটা যেন বলে না, ওই গুটিপোকা থেকে পূর্ণ বিকশিত পতঙ্গে পরিণত হওয়ার মাঝের পর্যায়ের পোকাকে? লার্ভা? ইমাগো? নাকি পিউপা? আসলে তাঁর নিজের তড়িৎ-বিজ্ঞান আর আবিষ্কার-উদ্ভাবনের ক্ষুদ্র বৃত্তের বাইরের জগৎটার সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল অবশ্য তিনি কখনোই ছিলেন না। এখনও নন। এবার যদিও সেসব তাঁকে শুধরে নিতেই হবে। তাই আসুন, আপাতত বাদ দিন এই সব রূপক আর উপমার কথা। সহজ করেই বলুন না কেন যে, এখন তিনি, একদা মি. প্যার্ট্রিজ নামে পরিচিত এক খোলসে ঢাকা গুটিপোকা, যিনি বর্তমানে তাঁর রূপান্তর যাত্রার কোনো এক মধ্যবর্তী দশায় রয়েছেন, আর দ্রুত এগিয়ে চলেছেন দ্য গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ হয়ে জয়োল্লাসে দুনিয়া কাঁপিয়ে আবির্ভূত হওয়ার—যেদিন তস্য তস্য বৃ্দ্ধ জ্যাঠামশাই ম্যাক্স পরলোকের উদ্দেশে রওনা হবেন আর প্রিয়তমা ফেইথ সেই বেচারা দুর্ভাগা নির্বোধ যুবকটিকে ভুলে যাবে।
এমনকী এখন আগাথা দিদিকেও তিনি খুব সহজেই সহ্য করতে পারছেন, যদিও ইদানিং ওয়ার্কশপটাকেই তিনি তাঁর স্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে নিয়েছেন বলে সেই অর্থে সেটা পরখ করে দেখার মতো সুযোগ তেমন বেশি হচ্ছে না। অন্য দিকে উত্তরাধিকারীনি হওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে দিদি অবশ্য নিজেও এখন বেজায় আনন্দে মশগুল, আর সেটার জলজ্যান্ত প্রমাণ তিনি দেখিয়েও দিলেন তুতো ভাই স্ট্যানলির উদ্দেশে শোকপ্রকাশ দেখাতে একটা বেশ বড়ো ধরনের খরচাপাতি করে—শুধু পোশাকই যা কিনলেন সেগুলো সবই গত কয়েক দশকের মধ্যে তাঁর কেনা যাবতীয় পোশাকের মধ্যে সবচাইতে দামি। আর তাঁর রুক্ষ শুষ্ক খিটখিটে হাবভাবে সামান্য হলেও সম্ভবত দেখা যাচ্ছে কোমলতার আভাস—নাকি সেটা শুধুই মনোরম এক প্রহেলিকা, প্রায় যেন মাদকাচ্ছন্ন অবস্থা, যার ফলে মি. প্যার্ট্রিজের পুলকিত দৃষ্টিতে এখন দুনিয়ার যাবতীয় সবকিছুই কোমল আর মধুর মনে হতে শুরু করেছে?
জীবন যে এত আনন্দময়, এত মধুর হতে পারে তা তিনি স্বপ্নেও কখনও ভাবেননি। আর এখন তো শুধু আনন্দই আনন্দ। যেমন ধরুন, শ্রদ্ধা জানানোর নাম করে মৃত মানুষটির বাড়িতে আবার একবার ঢুকে পড়া আর সেই ফাঁকে খুনের দিন অকুস্থলে তাঁর পৌঁছনোর বা খুনের সঠিক সময় ইত্যাদি বিষয়ে সবকিছু খানাসামার মাথায় যাতে ঘেঁটে ঘ হয়ে যায় সেটা নিশ্চিত করে ফেলা, সবেতেই শুধু আনন্দই আনন্দ। কী বলছেন, বিপজ্জনক? সব কিছু আরও বেশি নিখুঁত করতে গিয়ে ঘাড়ের উপর চেপে থাকা বিপদের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া? তাই কি? একজন হেঁজিপেঁজি যে কোনো মানুষের জন্য, উত্তরটা সম্ভবত হ্যাঁ; কিন্তু এই নবরূপে সদ্যোজাত গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজের জন্য এ হচ্ছে খুবই সামান্য একটা ব্যাপার, একটু মজা করা, তাঁর অসীম ক্ষমতার বিশুদ্ধ প্রয়োগের উদাহরণ মাত্র।
এই রকমই নানান দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে তখন দিন পার হচ্ছিল। মি. প্যার্ট্রিজ এই সময় একদিন তাঁর ওয়ার্কশপে অলসভাবে কাত হয়ে বসে আছেন। পাশে হুইস্কির ট্রে, বরফ আর সাইফন। অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে মাঝে মধ্যে চুমুক দিচ্ছেন তিনি। সেই সময় হঠাৎ তাঁর কানে এল রেডিয়োতে ঘোষণা হচ্ছে হিয়ালেহ-র চতুর্থ রেসের ফলাফল। আনমনেই শুনে যাচ্ছিলেন। শুনতে শুনতে ঘোষণার একটা অংশ তাঁর মগজে হঠাৎ চিড়িক করে এসে লাগলেও এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেল। নিরাসক্ত সুরে ঘোষক তখন জানাচ্ছিলেন যে কারাবালি নামের একটা ঘোড়ার উপর লাগানো দু-ডলারের টিকিটে পাওয়া যাচ্ছে আটচল্লিশ ডলার আর ষাট সেন্ট। যদিও আরও খানিকক্ষণ পরে মৌতাত যখন আরও একটু জমে উঠেছে, সেই সময় হঠাৎ যখন তাঁর ঘরের ফোনটা বাজতে শুরু করল ততক্ষণে তিনি সেসব কথা ভুলেও গেছেন।
ফোনটা তুলে তিনি সাড়া দিতেই উলটো দিক থেকে একটা গম্ভীর বিরক্ত কণ্ঠস্বর গরগর করে উঠল, “মালটা আপনি এখন নিয়ে যেতে পারেন। কপাল বটে আপনার। কারাবালির উপরে আপনি যা জিতেছেন সে প্রায় হাজার পাঁচেকের কাছাকাছি হবে।”
হতভম্ব মি. প্যার্ট্রিজের গলা দিয়ে বিড়বিড় করে অসংলগ্ন কয়েকটা শব্দ শুধু বেরিয়ে এল।
উলটো দিকের কণ্ঠস্বর তখনও গরগর করেই যাচ্ছে। “টাকাটা কী করব আমি? আপনি আজ রাতের মধ্যে উঠিয়ে নেবেন, না—”
মি. প্যার্ট্রিজ ততক্ষণে মনে মনেই অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে হিসেব করতে শুরু করে দিয়েছেন। “আপাতত আমার অ্যাকাউন্টেই রেখে দিন,” হিসেব নিকেশ সেরে নিয়ে স্পষ্ট স্বরেই উত্তর দিলেন তিনি। “ওহ্, আর একটা ব্যাপার—আমার মনে হয় আপনার টেলিফোন নম্বরটা আমি লিখে রাখতে ভুলে গেছি।”
“ট্রিনিটি ২৮৯৭। এখন আর কোনো বাজিতে লাগানোর আছে?”
“এই মুহূর্তে না। তবে আমি আপনাকে জানাবো।”
রিসিভারটা জায়গা মতো রেখে দিয়ে মি. প্যার্ট্রিজ নিজের জন্য বেশ কড়া করেই আরও এক পাত্তর বানিয়ে নিলেন। পুরোটা গলা দিয়ে নেমে যাওয়ার পর তিনি এগিয়ে গেলেন যন্ত্রটার সামনে আর তারপর সোজা দু ঘণ্টা পেছনে। পৌঁছেই সোজা গেলেন টেলিফোনটার কাছে। ডায়াল করলেন টিআর ২৮৯৭। রিসিভারের কথা-মুখে ঠোঁট ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন কয়েকটা শব্দ, “আমি হায়ালিয়ার চতুর্থ রেসে বাজি ধরতে চাই।”
সেই এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল উলটো দিক থেকে, “তা আপনি কে বলছেন?”
“প্যার্ট্রিজ। হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ।”
“দেখুন ভাই, এভাবে হয় না। টেলিফোনে বাজি ধরাটা আমি ঠিক মানতে পারি না, অন্তত যতক্ষণ না নিজের চোখে আমি টাকাটা দেখতে পাচ্ছি। বুঝতে পারলেন?”
মি. প্যার্ট্রিজ তড়িঘড়ি আরেকবার কিছু হিসেব করে নিলেন। ফলস্বরূপ, পরবর্তী আধ ঘণ্টা সময় ধরে একটার পর একটা কাজে ব্যস্ত রইলেন তিনি, যেমন ছিলেন তাঁর প্রধান পরিকল্পনার চূড়ান্ত মুহূর্তগুলোয়। প্রথমেই তিনি তাঁর ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে কতটা কী আছে না আছে দেখে নিলেন, তারপর বুকির ঠিকানাটা আর একবার দেখে নিয়ে দ্রুত পৌঁছে গেলেন তাঁর ব্যাঙ্কে। সেখান থেকে তুলে নিলেন পাঁচশো ডলার যা তাঁর সারা জীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের প্রায় পুরোটাই খালি করে দিল। এবং এরপর রেসের মাঠে গিয়ে তিনি তাঁর প্রথম অ্যাকাউন্টটা খুলে ফেললেন আর তারপর মাত্র দু-শো ডলারের একটা বাজি ধরলেন। দু-ঘণ্টা পরেই যা নিয়ে তাঁকে প্রচণ্ড আফসোস করতে হল। হয়তো ভবিষ্যতেও এই জন্য নিজেই নিজেকে নিয়ে গোপনে উপহাস করবেন।
এরপরেই তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন হাঁটতে। অনেকক্ষণ ধরে হেঁটেই গেলেন তিনি। গোটা ব্যাপারটার বিভিন্ন সমস্যা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকদিন আগে পড়া একটা গল্পের কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। কোনো একটা পত্রিকায় পড়েছিলেন কখনও। যার সোজাসাপটা বক্তব্য ছিল ভবিষ্যতে গিয়ে ঘোড়দৌড়ের ফলাফল আপনি জেনে নিতেই পারেন, কিন্তু সেই জ্ঞান নিয়ে আপনি কিছুতেই আপনার ভাগ্য ফেরাতে পারবেন না। কারণ সেক্ষেত্রে আপনি আসলে আপনার বাজির গতিপ্রকৃতির উপরেই হস্তক্ষেপ করছেন। তিনি কিন্তু ভবিষ্যৎ জেনে আসতে যাচ্ছেন না; তিনি যাচ্ছেন পিছনের দিকে, অতীতে। সেখানে গিয়ে যা তিনি করবেন তারই প্রভাবে যা ঘটবে সেটা জেনেই তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, তিনি অতীতে গিয়ে যা করবেন সেটা তিনি করছেন তাঁর সেই কর্মের ফল জেনে নেওয়ার পরে, অর্থাৎ অতীতে তাঁর কৃত কর্ম যখন ঘটছে ততক্ষণে তার কর্মফল স্থির হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাস্তবের নৈর্ব্যক্তিক স্থান-কালের জগতে, তিনি তাঁর সেই সব কাজ যখনই যা করছেন, সবই করছেন অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে, স্বাভাবিক সময়ে আর তাদের কর্মফল পাওয়ার আগেই।
সব কিছুই ঠিকঠাক, একদম নিখুঁত—অন্তত এখনও পর্যন্ত। যদিও তিনি জানেন, ভালো করেই জানেন, যে এ ধরনের কোনো বাণিজ্যিক ফায়দাও যে তোলা যেতে পারে তেমন কোনো দাবি তাঁর সময়-ভ্রমণ যন্ত্র নিয়ে তিনি কখনোই করতে পারবেন না। কেন না যে দিন থেকে প্যার্ট্রিজের তত্ত্ব দুনিয়ার সবাই জেনে যাবে, সেই দিনই গোটা জুয়ার জগৎটা ধ্বসে পড়বে। তবে মাঝের এই সময়টার জন্য এটা দুর্দান্ত কার্যকর একটা জিনিস। বিশেষত এখন, যখন তিনি অপেক্ষায় বসে আছেন কবে তস্য-বৃদ্ধ জ্যাঠামশাই মরবেন আর মরে গিয়ে তাঁর অসাধারণ গবেষণার জন্য অর্থের ব্যবস্থা করবেন। এটাই তো সেই সময় যখন মি. প্যার্ট্রিজ আরাম করে শুয়ে বসে থাকবেন আর অপেক্ষা করবেন কখন ফোনটা বেজে উঠে তাঁকে জানিয়ে দেবে এবার কত বড়ো তোপ তিনি মারতে পেরেছেন। এইভাবে একসময় এক বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিঃশব্দে তাঁর হস্তগত হয়ে যাবে আর তখন—
ফুটপাথের উপরেই পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন মি. প্যার্ট্রিজ। সদ্য বিবাহিত এক জোড়া কপোত-কপোতী জগৎ ভুলে এগিয়ে আসছিল সেই পথেই। সোজা এসে ধাক্কাটা তারাই মারল তাকে। তবে ধাক্কাটা কিন্তু মনে হল তিনি যেন টেরই পেলেন না। এক ভয়ঙ্কর ভাবনার ত্রাস তাঁকে তখন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তুতো ভাই স্ট্যানলিকে খুনের একমাত্র স্বীকৃত উদ্দেশ্য ছিল তাঁর গবেষণার জন্য অর্থ জোগাড়। আর এখন তিনি জেনে গিয়েছেন যে তাঁর যন্ত্র, এমনকী এই এখনকার অসম্পূর্ণ অবস্থাতেও, তাকে অভাবনীয় অর্থের জোগান দিতে সক্ষম।
কাউকে খুন করার কোনো দরকার তাঁর আসলেই কখনও ছিল না।
এগারো
“মাই ডিয়ারেস্ট মৌরিন,” ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে ফার্গাস ঘোষণা করলেন, “বিশ্বের প্রথম সফল টাইম মেশিনের আবিষ্কার আমি করে ফেলেছি।”
তবে এই ঘোষণায় তাঁর ভগ্নী যে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হয়েছেন তেমন কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। “আরও খানিকটা টমেটোর রস খাও,” বরং তিনি তাঁর ভাইকে এই অবস্থায় পরামর্শ দেওয়াই শ্রেয় মনে করলেন। “আরও একটু ট্যাবাসকো নেবে? হ্যাংওভার কেটে যাওয়ার পরেও যে কেউ ভুলভাল বকতে পারে সেটা আমার আগে জানা ছিল না।”
“কিন্তু মাকুশলা,” ফার্গাস বাধা দিয়ে বললেন, “তুমি এইমাত্র এমন একটা ঘোষণা শুনলে যা পৃথিবীর কোনো নারী এর আগে কখনও শোনেনি।”
“ওরে আমার পাগলা বিজ্ঞানী ফার্গাস ও’ব্রীন।” মুচকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে মৌরিন মাথা নাড়লেন। “উঁহু, এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আমি কখনোই তোমাকে নেব না। দুঃখিত।”
“তোমার ওই দামি মাথাটা ঘামানোর আগে একবার যদি আমার কথাটা ঠিক করে শুনে নিতে, আমি বলেছিলাম ‘আবিষ্কৃত’। ‘উদ্ভাবিত’ বলিনি। এই পেশায় এত দিন ধরে আছি, এমন মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা এই প্রথম দেখলাম। অ্যান্ডির সঙ্গে আলোচনার সময়ই ব্যাপারটা প্রথম আমার মাথায় ঝটকা মারে। এই মামলায় এটাই একমাত্র নিখুঁত আর সম্ভাব্য সমাধান। অথচ এই সমাধানের কথা আমি বললেও কে আমাকে বিশ্বাস করবে? তুমি আশ্চর্য হচ্ছিলে না যে কেন আমি গত রাতে বাইরে গিয়ে গলা পর্যন্ত উপচে ঢেলে এসেছি?”
মৌরিন ভ্রুকুটি করলেন। “তুমি ঠিক বলছ তো? সত্যিই তুমি এটা অন্তর থেকে বিশ্বাস করো?”
“দিদি, শুধু সত্যি না, নিদারুণভাবে সত্যি, আর বাকি যা কিছু সবই ছেলেভোলানো গপ্পোকথা। এটাই হচ্ছে দ্য ম্যাককয়3 । খাঁটি সোনা। শোনো তাহলে পুরো ঘটনা।” বলে সংক্ষেপে মামলার মোদ্দা ব্যাপারটা তিনি খুলে বললেন। এখন এর মধ্যে সবচাইতে ব্যথার জায়গা হচ্ছে গিয়ে: বিশাল শক্তপোক্ত একটা অ্যালিবাই হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছে। কী নেই তার মধ্যে, বেতার ঘোষণার সময় থেকে খানাসামার জবানবন্দি—আমি তো এমনকী এটাও ভেবেছি যে খুনি নিজেই সম্ভবত হিসেব করে সেই আর্ত চিৎকারগুলো করেছিল যাতে খুনের সময় নিয়ে আর কোনো অন্য প্রশ্ন না ওঠে। কিন্তু যাই করি আর যাই ভাবি, শেষ পর্যন্ত সেই গিয়ে ধাক্কা খেতে হচ্ছে নিটোল নিখুঁত একটা অ্যালিবাইয়ের দেয়ালে। ঠিক যেন সেই পেরু থেকে আসা মেয়েটার স্বপ্নে দেখা সেই ভয়ংকর দেয়ালটাই সেটা। আর সেটার মতোই এটাও যেন সত্যি।
“কিন্তু এই অ্যালিবাই জিনিসটা ঠিক কী? খায় না মাথায় দেয়? আমি তো বলব আমাদের ভাষায় একমাত্র এই শব্দটার অপব্যবহারই সবচেয়ে বেশি হয়েছে। এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে প্রমাণ করা, বা অজুহাত দেওয়া। কিন্তু সব কিছু ছেড়ে এখন এটার অর্থ দাঁড়িয়েছে এখানে না, ছিলাম অন্য কোথাও। তুমি ওই চিরন্তন ঠাট্টাটা তো জানোই: ‘আমি ছিলামই না সেখানে, ইনি সেই মহিলা নন, আর, তারপর, এই মহিলা নিজেই রাজি হয়েছিলেন।” যাই হোক, ওই তিনটে অনাবশ্যক অজুহাতের মধ্যে, একমাত্র প্রথমটাই শুধু যা অ্যালিবাই, একটা অন্যত্র অবস্থানের বিবৃতি। ঘটনা হচ্ছে প্যার্ট্রিজের অন্য কোথাও উপস্থিত থাকার দাবিটা কিন্তু মোটামুটি সত্যি বলেই দেখা যাচ্ছে। অন্য যারা অজুহাত বানায়, দেখা যাচ্ছে ইনি কিন্তু তাদের মতো অন্যত্র অবস্থান নিয়ে কোনো তিন-পাঁচ করছেন না। তা ছাড়া, এমনকী আমরা যদি তাকে তাঁর অন্যত্র অবস্থানের জায়গা থেকে উঠিয়ে এনে আক্ষরিক অর্থেই অকুস্থলে দাঁড় করিয়ে দিই, তাহলেও তিনি বলতে পারবেন: ‘খুনের পরে তো আমি আর কোনোভাবেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারতাম না; সব ক-টা দরজাই তো ছিল ভিতর থেকে বন্ধ।’ অবশ্যই সেটা তিনি পারতেন না—সেই সময়ে তো কিছুতেই না। তাই তাঁর আসল অজুহাত কিন্তু অন্যত্র অবস্থান নয়, অন্য সময়ে অধিষ্ঠান।”
মৌরিন তার নিজের আর ভাইয়ের কাপ দুটোতে আবার কফি ঢেলে ভরতি করে নিলেন। “এক মিনিট। একটু চুপ করে থাকো তো দেখি তুমি। আমাকে একটু ভাবতে দাও।” অবশেষে অনেকক্ষণ পর দেখা গেল তিনি ধীরে ধীরে তাঁর মাথা নাড়ছেন। “তাহলে যা দেখতে পাচ্ছি, যে তিনি হচ্ছেন গিয়ে একজন খ্যাপাটে উদ্ভাবক আর আমাদের খানসামা যখন তাকে দেখে তখন তাঁর সঙ্গে ছিল বয়ে নিয়ে আসা কোনো একটা যন্ত্র।”
“সেটা তখনও তাঁর সঙ্গেই ছিল যখন সাইমন অ্যাশ তাকে উধাও হয়ে যেতে দেখে ফেলে। তিনি খুনটা করলেন, সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করলেন, সময় পিছিয়ে দিয়ে চলে গেলেন অতীতে, হাট করে খোলা থাকা দরজা পেরিয়ে চলে গেলেন বাইরে আর তারপরে একসঙ্গে অপরাহ্ন পাঁচ ঘটিকার বেতার ঘোষণা শোনার জন্যে সোজা পৌঁছে গেলেন ফেইথ প্রেস্টনের কাছে।”
“কিন্তু যতই তুমি চেষ্টা করো পুলিশকে এ জিনিস কিছুতেই গেলাতে পারবে না। এমনকী অ্যান্ডিকেও না। সে বোধহয় শুনতেও চাইবে না যে—”
“আমি জানি। আমি এটাও ভালো করে জানি যে সেটাই এখন সবচেয়ে বড়ো ঝামেলা। আর এর মধ্যে আমাদের সেই অ্যাশ, যাকে মানুষ হিসেবে ভালো বলেই মনে হচ্ছে—শুধু ভালোই না, মৌরিন, সে হচ্ছে আমাদের মতোই একজন সাধারণ মানুষ—সেই মানুষটা বসে বসে অপেক্ষা করবে কোনো এক প্রাণঘাতী গ্যাস চেম্বারে ঢোকার। হয়তো সেটা আমার দেখা সেরা চেম্বারগুলোর মধ্যে থেকেই কোনো একটা হবে। তাঁর অপেক্ষা চলবে শুধু কবে সেখানে তাঁর ঢোকার টিকিট নিশ্চিতভাবে সংরক্ষিত করা হবে।”
“তুমি এখন কী করবে?”
“আমি এখন আবার মি. হ্যারিসন প্যার্ট্রিজের সঙ্গে দেখা করতে যাব। আর এবার গিয়ে তাকে বাধ্য করব আরও একবার করে দেখাতে।”
বারো
“বেশ ভালোই ব্যবস্থাপনা এখানে তৈরি করেছেন তো আপনি,” বেঁটেখাটো টেকো মাথার মোটাসোটা উদ্ভাবক মানুষটার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন ফার্গাস।
মি. প্যার্ট্রিজের মুখে সৌজন্যমূলক একটা হাসি ফুটে উঠল। “আমি আমার এই ছোটোখাটো সামান্য পরীক্ষানিরীক্ষা নিয়ে বেশ আনন্দেই আছি,” তিনি যেন বিনয় দেখাতেই কথাটা মেনে নিলেন।
“আমার দূর্ভাগ্য যে আমি আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর ক্ষমতার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না। চোখ কপালে তুলে দেওয়া বিস্ময়কর কত কিছু যে ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। এই যেমন ধরুন মহাকাশযান বা টাইম মেশিন, শুধু শুনেছি এরকম হয় বা হচ্ছে, অথচ আমি কিছুই জানি না। আমি তো জানার জন্য কবে থেকে উন্মুখ হয়ে আছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি এখন আমি এইসব নিয়ে কথা বলতে আসিনি। মিস প্রেস্টন বললেন যে আপনি নাকি তার খুবই কাছের একজন বন্ধু। আমি নিশ্চিত অ্যাশ নামের যুবকটিকে মুক্ত করতে ওঁর আপ্রাণ প্রচেষ্টার প্রতি আপনি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল।”
“ওহ্, অবশ্যই। নিশ্চয়ই, কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমার ক্ষমতায় যতদূর যা সম্ভব নিশ্চয়ই সাহায্য করব।”
“তেমন বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু সামান্য কিছু প্রশ্ন করার আছে আপনাকে, সেগুলোর উত্তর পেলেই চলে যাবে। সবই অবশ্য বাঁধা-ধরা গতের প্রশ্ন। আসলে আমি কাজটা এগোনোর একটা দিশা পেতে চাইছি। যা কিছু পেলেই চলবে যদি সেটা আমাকে একটা যে কোনো পথের নির্দেশ দিতে পারে। ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, অ্যাশ আর খানাসামার কথা বাদ দিলে, সম্ভবত আপনিই একমাত্র মানুষ যিনি হ্যারিসনকে জীবিত অবস্থায় শেষবার দেখেছেন। আপনি কি আমাকে তাঁর তখনকার ব্যবহার সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন? তিনি সেই সময় কেমন অবস্থায় ছিলেন?”
“একদম স্বাভাবিক, মানে চোখের দেখায় যতদূর যা বুঝেছিলাম। একটা নতুন জিনিসের বিষয়ে আমাদের মধ্যে অল্প কিছু কথাবার্তা হয়েছিল। জিনিসটা আমি পুথিপত্রের যে তালিকা ইদানিং তিনি তৈরি করছিলেন সেটার জন্যেই খুঁজে বের করেছিলাম। আর হ্যাঁ, কাজটা শেষ করানোর ব্যাপারে অ্যাশের ঢিলেমো নিয়ে হালকা করে তিনি অবশ্য তাঁর অসন্তোষও প্রকাশ করেছিলেন। আমার মনে হয় সেই বিষয়ে তাদের মধ্যে আগেও কথাবার্তা হয়েছিল।”
“হ্যারিসনের মধ্যে কোনো অসংলগ্নতা চোখে পড়েছিল? না…? কোনো হতাশা বা মানসিক বিষণ্ণতা?”
“আপনি কি আত্মহত্যার সম্ভাবনা নিয়ে ভাবছেন? মাই ডিয়ার ইয়ং ম্যান, দূর্ভাগ্যবশত ওর ঝোলার ভেতরে আর যাই থাক এই খরগোশটা থাকতেই পারে না। পৃথিবীতে যদি এমন একজনও কেউ থেকে থাকে যে এই ধরনের কাজ, কখনও করা তো দূরের কথা ভাবতেও পারে না, তবে আমার এই জ্ঞাতি ভাইটি হবেন সেই লোকটি।”
“ব্রাকেট বলছিল যে আপনার সঙ্গে আপনারই উদ্ভাবন করা কোনো একটা কিছু ছিল?”
“হ্যাঁ, একদম নতুন একটা জিনিস। সেই ভেবেই আমি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। দুর্লভ বই-টই ফোটোস্টেট করার পক্ষে দারুণ কাজের জিনিস ছিল সেটা। যদিও আমার তুতো ভাইটির কাছে অন্য খবর ছিল। কোনো এক প্রবাসী অস্ট্রিয়ান নির্মাতাও ওই একই জিনিস নাকি কিছুদিন আগেই তৈরি করেছে। যাকগে, কী আর করা যাবে, বুঝে গেলাম কোনো লাভ নেই। কাজেই, অনিচ্ছা সত্বেও যাবতীয় পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে যন্ত্রটা ফেরত নিয়ে চলে এলাম।”
“দুঃখজনক। কিন্তু আমার তো মনে হয় যে কোনো উদ্ভাবকের জীবনেই এটা একটা অবিচ্ছেদ্য পর্ব, তাই না?”
“ঠিকই বলেছেন। যাকগে, আপনি কি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন?”
“না। তেমন কিছু না।” বলে চুপ করে গেলেন ফার্গাস। অস্বস্তিকর একটা বিরতি খানিকক্ষণের জন্যে। ঘরটার ভিতরে হাওয়ায় উড়ছে হুইস্কির সুবাস, ম ম করছে চারদিক, কিন্তু মি. প্যার্ট্রিজ আগবাড়িয়ে কোনো আতিথেয়তা করলেন না। একটু পরে ফার্গাস হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে উঠলেন, “কারও সর্বনাশ তো কারও পৌষমাস। এখানে একটা খুন হয়েছে বলেই না ওদিকে এত মানুষের উপকার হবে, ঠিক কিনা? এমন ভয়ঙ্কর একটা ঘটনাও যে ক্যান্সার গবেষণার উপকারে আসতে পারে সেটা সত্যিই ভাবার বিষয়।”
“ক্যান্সার গবেষণা?” মি. প্যার্ট্রিজ ভুরু কুঁচকে তাকালেন। “স্ট্যানলি যে তাঁর সম্পত্তি এদিকেও দান-খয়রাত করেছে সে আমার জানা ছিল না।”
“নাহ্, আপনার ভাই করেননি। মিস প্রেস্টন কথায় কথায় আমাকে বলছিলেন যে এটা নাকি বৃদ্ধ ম্যাক্স হ্যারিসনের সিদ্ধান্ত। যেহেতু তাঁর নিজের একমাত্র বংশধর মারা গেছে, তাই তিনি চান তাঁর সম্পত্তি গোটা দুনিয়ার উপকারে লাগুক। তাঁর ইচ্ছে প্রধানত ক্যান্সারের উপরে কাজ করবে এরকম চিকিৎসা সংক্রান্ত এমন একটা ফাউন্ডেশন তিনি তৈরি করবেন যেটা রকফেলারদেরটাকে বলে বলে গোল দেবে। তাঁর আইনজীবীর সঙ্গেও আবার আমার সামান্য পরিচয় আছে। তাঁর কাছেই শুনলাম সেই জন্যে আগামীকালই নাকি তিনি ওখানে যাবেন।”
“খুব ভালো কথা,” নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন মি. প্যার্ট্রিজ।
ফার্গাস উঠে গিয়ে ঘরটার ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। একটুক্ষণ পায়চারি করে ঘুরে মি. প্যার্ট্রিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, “আর হ্যাঁ, মি. প্যার্ট্রিজ, এর মধ্যে যদি আপনার অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়ে আমাকে অবশ্যই জানাবেন। আমাকে মি. অ্যাশকে বাঁচাতে কিছু একটা তো করতেই হবে। আমি নিশ্চিত যে সে নির্দোষ, কিন্তু যদি সে তাই হয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত আমাদের না মানতেই হয় যে এটা একটা নিখুঁত অপরাধ। তবে নিখুঁত না হলেও, এটা নিশ্চয়ই মানবেন যে, কাজটা যেই করে থাক, দুর্দান্ত একটা কাজ করেছে সে। সে আপনি যেদিক থেকেই দেখুন না কেন।” তারপর আরও একবার ঘরের ভেতরটা ভালো করে দেখে নিলেন তিনি। “ছোটোখাটো হলেও চমৎকার একটা ওয়ার্কশপ বানাতে পেরেছেন আপনি। যা দেখছি আপনি চাইলে যা ইচ্ছে সবকিছুই বানিয়ে ফেলতে পারবেন আপনি।”
“এমনকী,” মি. প্যার্ট্রিজ উঠে পড়ে এগিয়ে এলেন, “আপনার মহাকাশযান আর টাইম মেশিনও?”
ফার্গাস হাসলেন, “মহাকাশযানের ক্ষেত্রে অবশ্য সামান্য অসুবিধা হতে পারে।”
তেরো
ছোকরা গোয়েন্দাটি বেরিয়ে যেতেই মি. প্যার্ট্রিজ মুচকি হাসি হাসলেন। বেশ ফুরফুরে লাগছে মনটা। ভেবে দেখলে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে কঠিন একটা জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব বেশ সহজেই পার করতে পেরেছেন তিনি। স্ট্যানলি যে অ্যাশের উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন সেটা বেশ কায়দা করে গোয়েন্দার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে! নিজের উদ্ভাবনী শক্তির ক্ষমতায় নিজেই নিজেকে বাহবা দিলেন তিনি। আর যন্ত্রটা সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যেভাবে মুহূর্তের মধ্যে একটা যুক্তিসঙ্গত অজুহাত বানিয়ে দিলেন, সেটা তো আরও দূর্দান্ত!
ছোকরা যে কিছু সন্দেহ করেছে তেমন অবশ্য মনে হচ্ছে না। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এটা ছিল একটা গতে বাঁধা তদন্ত। এটা সত্যি যে ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং সেটা দুঃখজনক। তাহলেও আরেকটা ব্যাপার তো আছেই। কেই বা জানত যে কোনো একজন গোয়েন্দার মুখোমুখি হওয়াটাও এত আনন্দদায়ক হতে পারে—ঠিক যেন সেয়ানায় সেয়ানায় কোলাকুলি। যখন দ্য গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ তাঁর পিছু ধাওয়া করা কোনো জাভেয়্যার বা কোনো পোরফিয়ার বা কোনো মাইগ্রেট স্তরের কোনো গোয়েন্দাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন তখন তাঁর প্রতিভার তারিফ না করে কোনো উপায় আর থাকে না।
হতেই পারে যে নিখুঁত অপরাধীকেও লোকে সন্দেহ করবে, হয়তো চিনেও ফেলতে পারে, কিন্তু যত যাই করো না কেন, তবুও সে থেকে যাবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এই মুখোমুখি মোকাবিলা সেরে উঠে একদিকে যেমন তিনি আনন্দ পেলেন, তেমনি অন্যদিকে উপলব্ধি করলেন রাতারাতি তাঁর আত্মবিশ্বাস বহু গুন বেড়ে গিয়েছে। তিনি ভরসা পেলেন। নিশ্চিত হলেন। সত্যি বলতে কী এটা এখন ভাবতেই দুঃখ হচ্ছে যে স্ট্যানলি হ্যারিসনকে শুধু শুধু মরতে হল। ওই একবারই শুধু মি. প্যার্ট্রিজের যাবৎ যুক্তি-বুদ্ধি সব যেন তখন পিছলে গিয়েছিল; লাভের জন্য খুন করাটা তাঁর পরিকল্পনার অপরিহার্য অঙ্গ কখনোই ছিল না।
তবে কিনা এটাও তো সত্যি যে কোনো মহান কাজ কখনোই বিনা রক্তপাতে সম্পন্ন হয়নি, হয়েছে কি? অসহায় গরীব মানুষের রক্ত না চুষে কবেই বা কে সাফল্যের শিখরে উঠে ঘণ্টা বাজাতে পেরেছে? জানেন তো প্রাচীনকালে বিজ্ঞেরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে বলিদান ছাড়া কোনো মহৎ কর্ম সম্পন্ন হয় না? সেটাও মূর্খ খ্রিস্টীয় বিকৃত বিশ্বাসের আত্মবলিদান নয়, বরং অন্যের রক্ত-মাংসের সত্যিকারের বলিদান।
তাই স্ট্যানলি হ্যারিসন হচ্ছেন সেই প্রয়োজনীয় বলিদান যাতে সেই রক্ত মাখা বলির বেদি থেকেই উঠে দাঁড়াতে পারেন দ্য গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ। আর তার প্রভাব কি এর মধ্যেই চোখে পড়ছে না? তিনি যা ছিলেন থেকে আজকে যা হয়েছেন, যেভাবে গুটিপোকা থেকে ডানা মেলে দিতে পেরেছেন, সে কি শুধুই তাঁর ওই আবিষ্কারের জন্যে?
না। তাঁকে রূপান্তরিত করেছে তাঁর সেই মহৎ এবং অপরিবর্তনীয় কীর্তি, তাঁর সেই অপকীর্তির উৎকর্ষতা। এ হচ্ছে রক্তপাতের মহিমা।
আর সেই উদ্ভট ছোকরা, অপরাধের উৎকর্ষতার প্রশংসায় গদগদ হওয়া সেই ছোকরা, সে স্বপ্নেও বোধহয় কখনো ভাবতে পারবে না যে—
মি. প্যার্ট্রিজ থমকে গেলেন। ঠিক কী কী যেন বলছিল সেই ছোকরা? বোধহয় একসময় পরপর দু-বার সে টাইম মেশিন নিয়ে তাঁর কৌতূহল দেখিয়েছিল। ঠিক তারপরেই বোধহয় বলেছিল কথাটা—কী যেন বলেছিল—“এটা একটা নিখুঁত অপরাধ,” আর তারপরেই, “আপনি চাইলে যা ইচ্ছে সবকিছুই বানিয়ে ফেলতে পারবেন আপনি।” আর তস্য-বৃদ্ধ জেঠুর সেই নতুন উইল তৈরি করতে চাওয়ার আশ্চর্যজনক খবরটা—
হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন মি. প্যার্ট্রিজ। এতক্ষণ সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সামনেই তো এতক্ষণ ছিলেন তাঁর জাভেয়্যার, তাঁর পোরফিয়ার। গোয়েন্দা ছোকরা তার মানে সত্যিই তাকে সন্দেহ করছে। আর ম্যাক্সের নতুন উইলের উল্লেখটা আসলে হচ্ছে তাঁকে লোভ দেখানোর চেষ্টা। অর্থাৎ একটা ফাঁদ। গোয়েন্দা মশাই আসলে জানতেই পারেননি যে সেই লোভনীয় সম্পদ কখন তাঁর কাছে এতটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে গিয়েছে। তাই সে ধরেই নিয়েছে যে সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার ভয় দেখালেই লোভের বশে তিনি আরেকটা খুন করতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে, যতই থাকুক না কেন, টাকা আর সম্পদ কখনও কি অপ্রয়োজনীয় হতে পারে? তা ছাড়া এই রকম একটা চ্যালেঞ্জ—তাও এভাবে সরাসরি মুখের উপর—কে পারবে নিজেকে আটকে রাখতে?
দেখা গেল মি. প্যার্ট্রিজ নিজেও পারলেন না। সুতরাং তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যাবৎ সম্ভাব্য সমস্যাগুলো নিয়ে, যেগুলোর মুখোমুখি তাঁকে দাঁড়াতে হতে পারে। যদি তিনি ঠিক করে থাকেন যে আগামীকাল উকিলের সঙ্গে বসবেন, তবে তস্য-বৃদ্ধ জৈষ্ঠ-তাত ম্যাক্সকে আজই খুন হতে হবে। এবং অবশ্যই শুভস্য শীঘ্রম। সম্ভবত তাঁর মধ্যাহ্ন-ভোজনের পরবর্তী রোজকার অভ্যস্ত দিবা-নিদ্রার সময়টাই হবে সব চেয়ে ভালো সময়। ওই সময়ে তিনি সর্বদাই একা থাকেন। বিশাল জমিদারির এক প্রান্তে পাহাড়ের উপরে তাঁর বিশ্রাম-গৃহের একান্তে একটু ঘুমিয়ে নেন।
ধ্যাৎতেরি! একটা মহা ঝামেলা। ইলেকট্রিক প্লাগ তো ওখানে থাকবে না। তার মানে ছোটো হাত-যন্ত্রটা নিয়ে গিয়ে লাভ হবে না। তা সত্ত্বেও—হ্যাঁ, অবশ্যই। অন্য রকম ভাবেও কাজটা সারা যেতে পারে। স্ট্যানলির ক্ষেত্রে, তিনি প্রথমে কাজটা সেরে নিয়ে তারপর অতীতে ফিরে গিয়েছিলেন অ্যালিবাই তৈরি রাখতে। আর এক্ষেত্রে তাঁকে শুধু অ্যালিবাইয়ের ব্যবস্থাটা আগে করে নিতে হবে, তারপর আসল যন্ত্রটা আর সেটার বিস্তৃত পরিসরের সুযোগ নিয়ে অতীতে চলে গিয়ে সেরে ফেলতে হবে খুনটা, ব্যাস, এবার আবার চলে এসো নিজের সময়ে। কাজ শেষ। কোনো বন্ধ-দরজার রহস্য তৈরির প্রয়োজন নেই। তাতে মজা অনেকটা আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা অপরিহার্য কিছু নয়।
এবার দুপুর একটার জন্যে তাঁর একটা অ্যালিবাই চাই। আর সেটা তিনি ফেইথকে নিয়ে দ্বিতীয়বার আর করতে চাইছেন না। আসলে এই লার্ভা-পিউপা দশায় তার সামনে তিনি এখন আর যেতে চাইছেন না। তিনি চান একটু কষ্ট সহ্য করে নিক সে এখন। বেচারা অ্যাশের দূর্ভাগ্য আর দুর্দশা দেখে কষ্ট-টষ্ট যা পাওয়ার পেয়ে নিক। তারপরেই তো দ্য গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ হয়ে স্বমহিমায় তিনি অবতীর্ণ হবেন তাঁর সামনে। এখন তো তাঁর দরকার শুধু ভরসা দেওয়ার মতো একটা খাঁটি এবং নিখুঁত অ্যালিবাই। সেই আগের বারের মতো আরেকটা ট্রাফিক টিকিটের জোগাড় তিনি করতেই পারেন, যদিও প্রথমটাই এখনও দেখানোর দরকার পড়েনি। তবে সবথেকে ভালো হবে পুলিশই যদি তাঁর অ্যালি—
স্বয়ং পুলিশ। কী জবরদস্ত নিখুঁতই না হবে। একদম আদর্শ অজুহাত। সোজা হেডকোয়ার্টারে গিয়ে হ্যারিসন মামলা যে গোয়েন্দা দেখভাল করছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করুন। তাকে বলুন অ্যাশের সঙ্গে তুতো ভাই স্ট্যানলির কোনো কল্পিত ঝগড়ার কথা। মনে করে বলবেন যেন যে এটা আপনার পরে মনে পড়েছে। তস্য-বৃদ্ধ জ্যাঠামশাইকে ঠিক যে সময়টায় খুন করবেন বলে ঠিক করেছেন সেই সময়টায় আপনি তাঁর সঙ্গে কথা বলুন বা যা হোক কিছু করতে থাকুন। যাই করুন না কেন ঠিক সেই সময়টায় অবশ্যই তাঁর সঙ্গে থাকবেন।
ঠিক সাড়ে বারোটায় মি. প্যার্ট্রিজ তাঁর বাড়ি থেকে সেন্ট্রাল পোলিশ স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হলেন।
তখন আর ম্যাক্সওয়েল হ্যারিসনকে খুন করার সত্যিই কোনো দরকার তাঁর নেই। তবে ঘটনা হচ্ছে সেটা যে তিনি করবেনই সে বিষয়ে তখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত তিনি নেননি। কিন্তু যদি করতেই হয়, সেই ভেবে তাঁর পরিকল্পনার প্রথম পদক্ষেপটা তিনি নিয়ে নিলেন।
চোদ্দো
নজরদারির জন্য যে জায়গাটা তিনি বেছে নিয়েছেন সেখান থেকে বৃদ্ধ মানুষটির নাক ডাকার শব্দ পরিষ্কার শুনতে পারছেন ফার্গাস। ম্যাক্সওয়েল হ্যারিসনের এই সন্ন্যাসী-সুলভ প্রাচীন আশ্রম-সদৃশ বিশ্রাম-ভবনে ঢুকে পড়াটা অত্যন্ত সহজ একটা কাজ। খবরের কাগজগুলো যেভাবে বৃদ্ধস্য বৃদ্ধ মানুষটার জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে বছরের পর বছর ধরে লিখে গেছে যে আপনি আগে থেকেই জানতে পারবেন যা আপনার জানা দরকার—তাঁর দৈনন্দিন অভ্যাস, দেহরক্ষী সঙ্গে রাখার বিষয়ে তাঁর অনীহা, তাঁর দিবানিদ্রার জন্য পছন্দের জায়গা—সব কিছু।
যদিও তেমন কিছু সাবধানতা না রাখাটা নিয়ে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো সমস্যা না হওয়াটাও যথেষ্ট ন্যায্য। বাড়ির মধ্যে যা কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র সেগুলো চাকরবাকরেরাই পাহারাদারি করে থাকে; আর কেই বা এমন আছে যে কিনা একশোর কাছাকাছি বয়সের কোনো বুড়ো, যে আবার সঙ্গে দামি কোনো কিছুই রাখা পছন্দ করে না, বেপরোয়া হয়ে তাকে গিয়ে আক্রমণ করবে? তবে এই মুহূর্তে—
সম্ভাব্য অকুস্থলে পৌঁছে ফার্গাস যখন দেখলেন উদ্দিষ্ট শিকার নিরাপদেই আছে, তখন তিনি যেভাবে জবরদস্ত একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন সেভাবে সচরাচর তিনি ফেলেন না। তিনি একবার ভেবেও ছিলেন এমনও তো হতে পারে যে, মি. প্যার্ট্রিজ খুনটা করার জন্য ফার্গাস যখন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন তার আগের কোনো সময়ে চলে গিয়েছেন। তবে গোয়েন্দা প্রবর শেষ পর্যন্ত ভরসা রাখলেন অপরাধীদের পুনরাবৃত্তি করার স্বভাবের উপরেই—এক্ষেত্রে সেটা প্রথমে অপরাধ সম্পাদন, আর তারপর ব্যবস্থাপনা করে অন্য সময়ে হাজির হওয়া।
সূর্যদেব এখন রীতিমতো তেজ ছড়িয়ে ঝকঝক করছেন, তবে এই টিলাপাহাড়ের উপরে শান্তি বিরাজমান। যে শুঁড়িপথের উপরে ফার্গাস এখন রয়েছেন তার পেছনেই একটা গভীর খাদ। অনেক নীচে সেখানে বয়ে চলছে একটি ক্ষীণতোয়া ফেনীল স্রোতস্বিনী। এই পরিশুদ্ধ নির্জনতার মধ্যে বুড়ো ম্যাক্সওয়েল হ্যারিসনের ঘুম ভালোই হওয়ার কথা।
তিন নম্বর সিগারেটটা ধরিয়ে ফার্গাস যখন সবে টান দেওয়া শুরু করেছেন সেই সময় তিনি আওয়াজটা শুনতে পেলেন। খুবই হালকা একটা আওয়াজ, ঠিক যেন কোথাও একটা নুড়ি পাথর গড়িয়ে গেল; কিন্তু এখানে এই ভয়ংকর নির্জনতার মধ্যে, এই মুহূর্তে ওই এক ঘুমন্ত মানুষটার নাক ডাকার শব্দ আর খাদের নীচ থেকে উঠে আসা জলস্রোতের কলধ্বনি ছাড়া অন্য আর যে কোনো শব্দই কানের কাছে দামামা বাজাচ্ছে বলে মনে হওয়ার কথা। এবং তাই হল।
সিগারেটটা নিভিয়ে নীচে পাশের খাদে ফেলে দিলেন ফার্গাস। দিয়েই যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ঝোপঝাড়ের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে যেদিক থেকে আওয়াজ এল সেই দিকে এগোতে শুরু করলেন।
যে দৃশ্য তাঁর চোখে পড়ল সেটা প্রত্যাশিতই ছিল, তবু এই শান্ত নির্জন আশ্রমিক পরিবেশে চোখে পড়া দৃশ্যটি একেবারে চমকে দেওয়ার মতো: মোটাসোটা টাকমাথা মধ্যবয়সি একজন লোক পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর একটা হাত একটু উপরে ওঠানো, আর সেই হাতে একটা লম্বাটে ছুরি ঝকঝক করছে।
একলাফে প্রায় উড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ফার্গাস। প্রথমেই বাঁ হাতটা বাড়িয়ে ছুরি-ধরা হাতটার কব্জি মুচড়ে চেপে ধরলেন আর তারপরেই ডান হাতের প্যাচে মি. প্যার্ট্রিজের অন্য হাতটাকে ঘুরিয়ে তার পিঠের দিকে ঠেসে দিলেন। একটু আগেই শিকারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় মি. প্যার্ট্রিজের মুখে যে নীরব উল্লাস খেলা করছিল, সেই মুখ এখন রাগ আর আতঙ্কে বিকৃত হয়ে উঠেছে।
তাঁর শরীরটাও নিজে থেকেই মোচড় দিয়ে উঠল। আত্মরক্ষার প্রচেষ্টায় স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু অনভ্যস্ত সেই মোচড়, কিন্তু দৈবযোগে সেটা এমন মোক্ষম সময়ে হল যে তাঁর ছুরি ধরা হাতটা ফার্গাসের খপ্পর থেকে ফসকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হল। এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েই তিনি ছুরিটা একটু নীচে নামিয়ে চালিয়ে দিলেন।
উলটো দিকে ফার্গাসের শরীরের নড়াচড়া বহুদিনের সচেতন প্রস্তুতির প্রতিক্রিয়া, কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সেই মুহূর্তে কাঁধের কাছে একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা আর রক্তাক্ত একটা ক্ষত এড়াতে সেটা যথেষ্ট হল না। তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর পিঠ বেয়ে গরম রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে। ইচ্ছে না থাকলেও ব্যাথার তীব্রতায় তিনি মি. প্যার্ট্রিজের অন্য যে হাতটা পেঁচিয়ে ধরেছিলেন সেটাও বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিলেন।
এক মুহূর্তের জন্য একটু ইতস্তত করলেন মি. প্যার্ট্রিজ, যেন ঠিক নিশ্চিত হতে পারছেন না যে তাঁর হাতের ছুরিটা আগে বুড়ো জ্যাঠা ম্যাক্সের রক্তের স্বাদ নেবে নাকি আগে ফার্গাসকে খতম করবে। তাঁর দ্বিধার কারণ যৌক্তিক, কিন্তু সেটাই তাঁর জন্যে কালান্তক হয়ে উঠল। মুহূর্তের ভগ্নাংশের মধ্যেই ফার্গাস উড়ে গিয়ে মি. প্যার্ট্রিজের হাঁটুর দিকে তাক করে চালিয়ে দিলেন সোজা একটা লাথি। মি. প্যার্ট্রিজ সেই সবুজ-চোখের মানুষটার দিকে নজর তখনও রেখেছিলেন বলে সঙ্গে সঙ্গে পা তুলে চেষ্টা করলেন আগত লাথির মুখে উলটো লাথি চালানোর। কপাল খারাপ। হাওয়ায় ফাঁকাই ঘুরে এল তাঁর পা। তিনি বুঝতে পেরে গেলেন তিনি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। ভারসাম্যহীন সেই অবস্থায় প্রথম ধাক্কাটা খেলেন গোয়েন্দার কাঁধের সঙ্গে। তিনি উলটে পড়লেন, পড়লেন পেছন দিকে হয়ে, তারপর পড়তে থাকলেন, পড়তেই থাকলেন—
বৃদ্ধ মানুষটা তখনও নাক ডেকেই চলেছেন যখন ফার্গাস টিলার মাথা থেকে নেমে গিরিখাদে গিয়ে পৌঁছলেন। হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ যে মারা গিয়েছেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ আর রইল না। কোনো জ্যান্ত মানুষের মাথা ওইভাবে ঘাড়ের উপর ল্যাগব্যাগ করতে পারে না।
এবং তাঁকে হত্যা করেছেন ফার্গাস স্বয়ং। সে আপনি একে দুর্ঘটনা বলুন, বা আত্মরক্ষা, যা আপনার ইচ্ছে হয় বলুন। কিন্তু ঘটনা তো এই, যে ফার্গাস তাঁর জন্যে একটা ফাঁদ পেতে ছিলেন আর সেই ফাঁদে পা দিয়েই তিনি মারা গিয়েছেন।
ঈশ্বর দয়াময়। শুধু কেইন4 নয়, তাঁর আশীর্বাদ ঝরে পড়ে জগতের সকলেরই উপর। শুধু কেইনের কপালে সেই দাগ না হয় স্পষ্ট ছিল। স্পষ্ট হোক বা না হোক, কেইনের মতোই সেই আশীর্বাদ সম্ভবত আপামর সকল মানুষই তাদের মর্জি মাফিক ধারণ করে। মি. প্যার্ট্রিজের কাছে সেই আশীর্বাদ এল একটা অদ্ভুত যন্ত্রের ছদ্মবেশে, এসে সেটাই হয়ে উঠল তাঁর রাজমুকুট। তাঁর যাবতীয় অনুপ্রেরণার উৎস। কিন্তু মি. ফার্গাস অন্য চরিত্রের মানুষ। তিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদ শিরোধার্য করেছিলেন অন্যরকমভাবে।
প্রাথমিকভাবে একটা অপরাধবোধের ধাক্কা তাঁকে ম্রিয়মান করে দিল ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিবেকের অন্তস্থলে গিয়ে তাকে তেমন গভীরভাবে দংশন করতে পারল না। যা ঘটেছে তা তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটাননি। এর মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত লাভ ক্ষতির কোনো প্রসঙ্গ নেই। একজন একনিষ্ঠ আইনের রক্ষক হিসেবে একজন নিরপরাধের জীবন রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেই তিনি এখানে এসেছিলেন। প্রতিটি মানুষের জীবনই মূল্যবান এবং পবিত্র, সেটা তিনি ভালো করেই জানেন। তবে এটাও জানেন এবং মানেন যে সেই নিয়ম সর্বত্র প্রযোজ্য হতে পারে না। কেননা সেক্ষেত্রে আইন রক্ষার্থে মৃত্যুদণ্ড বা দেশ রক্ষার্থে যুদ্ধ সব কিছুই বন্ধ করে দিতে হয়।
হতে পারে নৈতিকতার দিক থেকে মি. প্যার্ট্রিজের মৃত্যুর জন্যে তিনি নিজেকে দোষারোপ করতে পারেন না। কিন্তু পেশাগত ব্যর্থতার জন্য নিজেকে দায়ী তিনি এখন করতেই পারেন। সাইমন অ্যাশকে মুক্ত করার জন্য তাঁর হাতে যতগুলো তাস ছিল সেগুলোই শুধু রয়ে গেল, নতুন আর কোনো প্রমাণ তিনি জোগাড় করে উঠতে পারলেন তো নাই, উলটে এখন তিনি তাঁর নিজের কাঁধেই একটা মৃত্যুর দায় তিনি চাপিয়ে নিয়েছেন। আপনার তৈরি করা ফাঁদে একটা মানুষ আপনার হাতেই মারা পড়ল—গোয়েন্দা হিসেবে আপনার লাইসেন্স কেড়ে নেওয়ার জন্য এর চাইতে আর কত বড়ো কারণের প্রয়োজন পড়তে পারে? না হয় ধরে নেওয়া গেল যে, আর আশাও করা যাক যে তাই হবে, যে খুনের অভিযোগ থেকে আপনি ছাড় পেয়ে গেলেন।
তবে একটা খুন কিন্তু কোনো সহজ ঘটনা নয়। তাকে কেন্দ্র করে একটার পর একটা ঘটনার আবর্ত সৃষ্টি হয়। ছড়িয়ে পড়তে পড়তে গ্রাস করে নেয় চারপাশের অনেক কিছুই। এবং ফার্গাস ও’ব্রীন, যিনি ফাঁদ পাততে এসেছিলেন খুনিকে ধরবেন বলে, এখন দেখতে পাচ্ছেন নিজেই সেই আবর্তের মধ্যে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছেন।
পনেরো
মি. প্যার্ট্রিজের ওয়ার্কশপের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ফার্গাস। সামান্য ইতস্তত বোধ করছিলেন তিনি। এমনিতে তিনি জানেন এটাই তাঁর শেষ সুযোগ। ভেতরে এখনও হয়তো এক-আধটা তথ্য প্রমাণ পেলেও পাওয়া যেতে পারে—হয়তো খোদ যন্ত্রটি পেয়ে গেলেন বা ওই সম্পর্কিত কিছু নথিপত্র। যা দিয়ে তিনি তাঁর তত্ত্বটা লেফটেন্যান্ট এ. জ্যাকসনের মতো গোয়েন্দার মুখের উপর প্রমাণ করে দিতে পারবেন যে কিনা তাঁর তত্ত্বটাকেই সন্দেহের চোখে দেখেছিল। আর তাঁর এখন যা অবস্থা তাতে সিঁধ-কাটতে গিয়ে ধরা পড়লেও তাঁর অপরাধের মাত্রা বড়োজোর আর সামান্য একটুই বাড়বে। তিনি হিসেব করে দেখলেন বাঁ দিকের জানলাটাই সুবিধের হবে—
“আরে!” পেছন থেকে কেউ বলে উঠল। ঘুরেই দেখলেন লেফটেন্যান্ট জ্যাকসন হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর একটু পেছনেই। “আপনিও এঁর পেছনেই ঘুরছেন?”
ফার্গাস তার স্বাভাবিক স্ফুর্তিবাজ চেহারাটা ফুটিয়ে তোলার প্রচুর চেষ্টা করলেন। “আরে, অ্যান্ডি। আপনিও কি শেষ পর্যন্ত প্যার্ট্রিজকেই সন্দেহ করতে শুরু করলেন?”
“ইনিই কি আপনার সেই রহস্যময় মি. এক্স? আমার কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যে ইনি সেই তিনি হলেও হতে পারেন।”
“ওহ্, তাহলে সেই জন্যই আপনি এখানে এসে পৌঁছেছেন?”
“না। তিনি আগ বাড়িয়ে নিজে এসে আমার পেশাদারী মনে সন্দেহ জাগিয়েছেন। এই ঘণ্টা খানেক আগেই আমার অফিসে এসেছিলেন। এসে তিনি নাকি কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে ভুলে গিয়েছিলেন সেই নিয়ে রীতিমতো এক আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসলেন। সেটা হচ্ছে স্ট্যানলি হ্যারিসনের সঙ্গে তাঁর যা শেষ কথাবার্তা হয়েছে তাই নিয়ে, যা বুঝলাম, উনি বলতে চাইছেন যে স্ট্যানলির নাকি অ্যাশের সঙ্গে সেই সময় ঝামেলা চলছিল। শুনে আমার তেমন সুবিধের কথা বলে তো মনে হল না—উলটে মনে হল ভদ্রলোক যেন ইচ্ছে করে এই মামলায় অ্যাশকে আরও বেশি করে জড়িয়ে দিতে চাইছেন। তাই কাজ সেরে যেই একটু হাঁফ ছাড়ার সুযোগ পেলাম, ভাবলাম যাই আর একবার ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে দেখি কিছু বের করা যায় কিনা।”
উত্তরে ফার্গাস বললেন, “দেখুন, তবে আমার মনে হয় না যে উনি বাড়িতে আছেন।”
“দেখা যাক।” আর কোনো কথা না বাড়িয়ে জ্যাকসন এগিয়ে গিয়ে দরজার পাল্লায় ঠক্ ঠক্ করে আওয়াজ করলেন। এক মুহূর্ত পরেই দরজাটা খুললেন মি. প্যার্ট্রিজ স্বয়ং।
যখন খুলছেন তখন মি. প্যার্ট্রিজ এক হাতে ধরে রয়েছেন আধখাওয়া একটা বড়োসড়ো হ্যাম-স্যান্ডউইচ। দরজাটা খোলার পর অন্য হাতটা দিয়ে তুলে নিলেন মেঝেতে রাখা একটা বড়ো হুইস্কি আর সোডার অবশিষ্টাংশ। সামনেই তাঁর এখন একটা দুঃসাহসিক নতুন অভিযান। তার আগে খানিক পুষ্টিসাধন করে নেওয়াটা খুব দরকার। শুধু দুঃসাহসিক নয়, এটা অন্য আর যে কোনো নিখুঁত অপরাধের চেয়েও বড়ো কিছু হতে যাচ্ছে, তার একটা বড়ো কারণ হল এটা যেমন কোনো জরুরি বাধ্যবাধকতা থেকে হবে না আর তেমনি এর কোনো স্বাভাবিক উদ্দেশ্য কেউ কখনও খুঁজে পাবে না।
তাদের দুজনকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর চোখে নতুন করে আলো জ্বলে উঠল। এই তো তাঁর জাভেয়্যার! দু-দু’জন জাভেয়্যার! যাদের একজন আবার সেই বেসরকারি গোয়েন্দা। যিনি তাকে বড়ো মুখ করে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, আর অন্যজন হচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তা যিনি আবার তাকে তাঁর অ্যালিবাই জোগাড় করে দেবেন। অবিস্মরণীয় এই দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটাবার সুযোগ তাকে পাইয়ে দিয়ে বোধহয় স্বয়ং সময় এখন নিজেই সবচেয়ে খুশি।
তাই সেই জন্যে, না তো তিনি ভালো করে কানে নিলেন সরকারি গোয়েন্দাটি যে কথা সবে মাত্র বলতে শুরু করেছিলেন সেই দিকে, না তো একবারও খেয়াল করে তাকিয়ে দেখলেন অন্যজনের চেহারায় আর চোখেমুখে ফুটে ওঠা এক আশ্চর্য স্তব্ধ বিহ্বলতা। কোনো দিকেই খেয়াল না করে তিনি মুখ খুললেন আর সেই মুহূর্তে, গুটিপোকার খোলস ছিঁড়ে বেরিয়ে এলেন দ্য গ্রেট হ্যারিসন প্যার্ট্রিজ, তিনিই বললেন:
“প্রকৃত সত্য আপনারা এবার তাহলে জেনেই নিন। যদিও আমি জানি না সেটা আপনাদের কোন উপকারে লাগবে। আমার কাছে ওই অ্যাশ নামের মানুষটার জীবনের দাম একটা ফুটো কড়িও নয়। যদি সে বেঁচেও যায় তাহলেও কোনো অসুবিধা নেই, আমি চাইলেই যখন খুশি তাকে পিষে মেরে ফেলতে পারব। শুনুন, স্ট্যানলি হ্যারিসনকে খুন আমিই করেছি। এটা আমার স্বীকারোক্তি বা এজাহার হিসেবেই ধরে নিতে পারেন। তারপর যান, যা পারেন করুন গিয়ে। তবে আমি এটাও ভালো করে জানি যে এই অসমর্থিত স্বীকারোক্তি আপনাদের কোনো কাজেই লাগবে না। তাও, যান, গিয়ে যদি পারেন তো প্রমাণ করুন, সেক্ষেত্রে তখন এসে না হয় আমাকে ধরবেন। আরও একটা কথা শুনে নিন, খুব তাড়াতাড়িই আমি আরও একটা বলি দেব আর তখনও আমাকে আটকানোর কোনো ক্ষমতা আপনাদের হবে না। কারণ, আপনারা জানেনই না যে আপনারা এর মধ্যেই অনেক দেরি করে ফেলেছেন।” লম্বা বক্তৃতা শেষ করে তিনি হালকা করে হেসে উঠলেন।
মি. প্যার্ট্রিজ এবার দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলেন। এরপর তিনি স্যান্ডউইচ আর হুইস্কি শেষ করতে শুরু করলেন, ওদিকে যে দরজায় ততক্ষণে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গিয়েছে সেদিকে তাকিয়েও দেখলেন না। খাওয়া শেষ হলে তিনি ছুরিটা তুলে তাঁর যন্ত্রের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর মুখ দেখলে তখন যে কোনো লোকের মনে হবে তিনি যেন নরম স্নিগ্ধ অথচ চরম নির্বিকতার একটা মুখোশ পরে আছেন। আর সেই মুখোশের উপর তখন ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে নির্মল উচ্ছ্বাসের মহিমা।
দরজাটা যখন বন্ধ হচ্ছিল ফার্গাস তখন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। কিন্তু লেফটেন্যান্ট জ্যাকসন থেমে রইলেন না। দরজার উপর তিনি প্রায় ঝাঁপিয়েই পড়েছিলেন, শুধু এক সেকেন্ড যা দেরি হয়ে গিয়েছিল। তবে বেশি সময় লাগল না। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার। তিনি এবং শেষ পর্যন্ত ঘোর ভেঙে জেগে ওঠা ফার্গাস, দুজনে মিলে দরজাটা ভাঙতে ওই কয়েক মিনিট সময়ই যা বাড়তি লাগল।
তবে সেটুকুই যথেষ্ট ছিল।
“তিনি পালিয়ে গেছেন,” ভিতরে ঢুকেই অবাক জ্যাকসন হাহাকার করে উঠলেন। “কোথাও একটা লুকোনো দরজা অবশ্যই আছে।”
“‘বন্ধ দরজার রহস্য,’” ফার্গাস তখন নিজের মনে বিড়বিড় করছিলেন। তাঁর কাঁধের ব্যথাটা আবার শুরু হয়েছে। আসলে দরজা ধাক্কাধাক্কির সময় সেই একই জায়গায় নতুন করে চোট পেয়ে এতক্ষণে আবার রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে।
“কী হয়েছে?”
“কিছু না। ইয়ে, অ্যান্ডি, একটা প্রশ্ন করছি। আপনার ডিউটি কখন শেষ হবে?”
“সে ভাবে বলতে গেলে, আমার ছুটি আগেই হয়ে গেছে। আমি আমার নিজের সময় খরচ করে এই খোঁজখবর করছিলাম।”
“তাহলে চলুন, বারে গিয়ে সতেরো মাতলামির অবতারের নাম নিয়ে চুমুক দিই আর আমাদের এই ধাঁধার জট ছাড়াই।”
ষোলো
পরের দিন সকালে লেফটেন্যান্ট জ্যাকসনের ফোনটা যখন এল ফার্গাস তখনও গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর দিদিকেই এসে তাকে ডেকে তুলতে হল। চোখের সামনে দিদি দেখতে পেলেন কীভাবে ফোনের শ্রবণ যন্ত্র কানে নিয়ে তাঁর ভাই গভীর ঘুমের দেশ থেকে বহু কষ্টে জেগে উঠছেন। আর রিসিভারের পাশের মানুষটার কথা শুনতে শুনতে মাথা নাড়ছেন। মাঝে মাঝে শুধু কোনো রকমে বিড়বিড় করে দু-একটা কথা বলছেন, “হ্যাঁ,” অথবা, “আমিও তো—”
মৌরিন অপেক্ষা করে রইলেন যতক্ষণ না তাঁর ভাই ফোনটা নামিয়ে রেখে উঠে পড়লেন, এদিক ওদিক খানিক ঘোরাফেরা করে অবশেষে একটা সিগারেট জ্বালালেন। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”
“হ্যারিসন মামলাটার কথা মনে আছে তো যেটা আমি তোমাকে গতকাল বলছিলাম?”
“ওই সেই টাইম-মেশিন নিয়ে? হ্যাঁ।”
“আমাদের সেই খুনি, মি. প্যার্ট্রিজ—তাকে ওরা খুঁজে পেয়েছে তাঁরই বৃদ্ধ জ্যাঠার এস্টেটের ভিতরে একটা খাদের নীচে। স্পষ্টতই দ্বিতীয় খুনের চেষ্টা করতে গিয়ে কোনো সময় পিছলে পড়ে নিজেই মারা পড়েছে—অন্তত অ্যান্ডি ঘটনাটা এভাবেই দেখছে। তাঁর সঙ্গে পাওয়া গেছে একটা ছুরি। তাই, এই ঘটনা আর তার সঙ্গে গতকালই তাঁর দেওয়া এক রকমের স্বীকারোক্তি মিলিয়ে যা দাঁড়িয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে, অ্যান্ডি এবার সাইমন অ্যাশকে ছেড়ে দিচ্ছেন। অবশ্য তিনি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি যে কীভাবে প্যার্ট্রিজ প্রথম খুনটা করেছিলেন, তবে সেসব এখন আর আদালতে তাকে ব্যাখ্যা করতেও হবে না।”
“তো? তাহলে আর অসুবিধা কোথায়? এটাই কি ভালো হল না?”
“অসুবিধা? দেখ, মৌরিন মাকুশলা। প্যার্ট্রিজকে আমিই মেরেছি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমি ইচ্ছে করে মারিনি, এমনকী পুরোটা জানলে তুমি হয়তো বলবে যা হয়েছে একদম ঠিক হয়েছে; কিন্তু ঘটনা তো এই যে আমিই মেরেছি তাকে। আমি তাকে মেরেছি গতকাল দুপুরে একটার সময়। তারপর অ্যান্ডি আর আমি দুজনেই তাকে দেখলাম দুটোর সময়; তখন তিনি হ্যাম স্যান্ডউইচ আর হুইস্কি খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। পাকস্থলির বিশ্লেষণ বলছে যে তিনি মারা গিয়েছেন সেগুলো খাওয়ার আধ ঘণ্টাটাক পরে, ঠিক যখন অ্যান্ডি আর আমি একসঙ্গে বসে এই তাক-ধাঁধানো সমস্যার বিভ্রান্তি দূর করতে নিজেদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলাম। এবার বুঝতে পারলে?”
“তার মানে তুমি বলছ যে জ্যাঠাকে খুন করার জন্যে তিনি সময়-ধারায় পিছিয়ে অতীতে চলে গিয়েছিলেন আর সেই সময়েই তুমি… আবার তাকে মেরে এসে তুমিই তাকে দেখছ তিনি সবে বেরোতে যাচ্ছেন তোমারই হাতে মারা যাওয়ার জন্যে? ওহ্, কী ভয়ঙ্কর।”
“দিদি গো, শুধু এটুকুই না। এর চাইতে আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে: সময়ের অ্যালিবাই। যে অন্যসময় অ্যালিবাই নিখুঁতভাবে ব্যবহার করে প্যার্ট্রিজ ধামাচাপা দিল নিজের করা খুনের অপরাধ—সেই একই অ্যালিবাই একইরকমভাবে বাঁচিয়ে দিচ্ছে তাঁর নিজেরই খুনিকে।”
কিছু বলার জন্য মৌরিন সবে মুখ খুলেছিলেন। থেমে গেলেন। “ওহ্!” শুধু এইটুকু বলে তিনি ঢোক গিলে চুপ করে গেলেন।
“কী?”
“সেই টাইম মেশিনটা। ওটা এখনও নিশ্চয়ই সেখানেই আছে—কোথাও না কোথাও—তাই না? তোমার কি উচিত নয় যে—”
বাধা দিয়ে হেসে উঠলেন ফার্গাস। তবে তা়র সেই হাসির মধ্যে কোথাও এক ফোঁটা মজা ছিল না। “সেটাই বোধহয় এই গল্পের অন্তিম ট্র্যাজেডি—চরম বিয়োগান্তক সমাপ্তি। আমি যতটুকু বুঝেছি প্যার্ট্রিজ আর তাঁর দিদির সম্পর্কের মধ্যে বিন্দুমাত্র স্নেহ ভালোবাসার কোথাও কিছু ছিল না। তুমি জানো, ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দিদির প্রথম প্রতিক্রিয়া কী ছিল? লোক দেখানো এক ফোঁটা চোখের জল আর একই রকম লোক দেখানো একটু খানি কান্না, ব্যস্, তারপরেই সেই দিদি প্রথম যে কাজটা করলেন সেটা হচ্ছে তাঁর ভাইয়ের ওয়ার্কশপটা ভেঙ্গে চুরমার করে যন্ত্রটা পাওয়ার সব আশা ভরসা শেষ করে দিলেন।”
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, রুদ্র দেব বর্মন