নহি যন্ত্র
লেখক: মোহনা দেবরায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
আমি গতকাল, বা আরও নিখুঁতভাবে বলতে গেলে, মোটামুটি পঁচিশ ঘণ্টা আগে একটি ওয়েবসাইটে লগ ইন করতে বসেছিলাম।
সাইট ওপেন হতেই লগ ইন ক্রেডেনশিয়ালসের পেজ আসার আগেই সামনে একটি ছোট্ট মেসেজ দেখতে পাই আমি, ‘আই অ্যাম নট এ রোবট।’ পাশে একটি চৌকো বাক্সো। বাক্সের উপর ক্লিক করে নিজের অযান্ত্রিকতার প্রমাণ দিই। এরপরই আমার কাছে ন-টা ছবিসমৃদ্ধ একটি উইন্ডো খুলে যায়, যার উপরদিকে লেখা: ‘অনুগ্রহ করে নারকেল গাছযুক্ত সব ক-টি ছবি চিহ্নিত করুন।’
ন-টার মধ্যে চারটে ছবিতে নারকেল গাছ দেখা যাচ্ছিল, আর পঞ্চম ছবিটিতে একটি নারকেলপাতার ডগা কয়েক প্ল্যাংক দৈর্ঘ্য দখল করে ছিল। কাজেই আমি ভাবতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে আমার সেই ছবিটি চিহ্নিত করা উচিত হবে কি না। যেটি আমি লক্ষ করিনি, কারণ সাধারণত সেরকম কিছু দেখা যায় না—সেটি হল, নীচে একটি এক মিনিটের টাইমার চলছিল। আমি ভাবতে ভাবতেই সেই টাইমার শূন্যে এসে ঠেকল, এবং অচিরেই আমার চোখের সামনের ছবিটি বদলে গেল।
আবারও ন-টা ছবি। কোনো ছবিতে সূর্যাস্তের দৃশ্য, কোথাও আবার কমলা পোশাক-পরা মানুষ, কমলা রঙের ক্রেয়ন পেনসিল—এরকমই আরও টুকিটাকি জিনিস। প্রায় সবই কমলা। যে ছবিগুলি কমলা নয়, সেগুলি হল কিছু শুকিয়ে-যাওয়া, বা ছাতা-পড়া, রং নষ্ট-হয়ে-যাওয়া কমলালেবু। উপরে লেখা: ‘সিলেক্ট দি ইমেজেস উইথ অরেঞ্জ।’ অর্থাৎ, সমস্ত কমলাযুক্ত ছবিকে চিহ্নিত করুন। এতদূরও আমার কোনো সমস্যা ছিল না, সব ক-টা ছবিই চিহ্নিত করব—এই ভাব নিয়ে মাউস ধরেছিলুম। কিন্তু বাদ সাধল পাশে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে লেখা কয়েকটি শব্দ: ‘প্লিজ় ডোন্ট চেক অল দ্য বক্সেস।’ অর্থাৎ কমলা বলতে এখানে রং বোঝানো হচ্ছে, নাকি লেবু… সেটি আমাকে বুঝতে হবে। আমি বাক্যটার দিকে কিছুক্ষণ ভালো করে তাকিয়ে রইলাম। ব্যাকরণের ব্যবহার দেখে কিছু বোঝা সম্ভব কি?
‘সিলেক্ট দি ইমেজেস উইথ অরেঞ্জ।’ কমলাসমৃদ্ধ ছবিগুলো চিহ্নিত করুন। ফলের কথাই বলছে বোধহয়। রং হলে তো বলত, ‘সিলেক্ট দি ইমেজেস উইথ অরেঞ্জ কালার।’ বলত কি? জীবনে এত ইংরেজি পড়েছি, কিন্তু অরেঞ্জের কী দেখে তাকে রং অথবা ফল বলে চিহ্নিত করব, কখনও জানতে ইচ্ছে হয়নি। অথচ কত স্বাভাবিক প্রশ্ন এটা। হঠাৎ করেই নিজের বোধবুদ্ধির উপর প্রশ্ন জাগতে শুরু করল একটু একটু। এত অনিবার্য প্রশ্নটা মাথায় আসেনি কেন আগে? বুঝতে পারছিলাম, এই প্রশ্নটার উত্তরও আমি দিতে পারব না। কাউন্টডাউন থেমে গেল। পরের প্রশ্নটা উপস্থিত হল সামনে।
এবার আমি দেখতে পেলুম একটি মরুভূমির দৃশ্য। মাথার উপর ঠা ঠা রোদ, যতদূর চোখ যায় কেবল ধু ধু বালি, আর তার মাঝখানে একটি গাছ। হ্যাঁ গাছ। বৃক্ষজাতীয় গাছ, যদিও তাতে, একেবারে উপরের কিছু ডালে ছাড়া পাতা-টাতা বিশেষ নেই। কিন্তু যেটা আমাকে অবাক করল, সেটা হল সেই গাছের মাথায় একটা বাড়ি। ইংরেজিতে যাকে বলে ট্রি হাউস, আর বাংলা করলে গাছবাড়ি। বাড়িটা ছোটো, কাঠের তৈরি। জানলাগুলো বন্ধ। সামনে রেলিং-দেওয়া বারান্দা। চড়া রোদ্দুর থেকে বাঁচানোর জন্যই সম্ভবত, বারান্দার উপর একটা ছাউনি দেওয়া। বাড়িটা দেখে মনে হয় একটু নড়বড়ে। যেন বহুদিন বাস করেনি কেউ। উপরে ওঠার জন্য যে মইটা, সেটাও যেন মচমচে হয়ে গেছে। ছবিটার দিকে অবাক হয়ে এমনই তাকিয়ে ছিলাম, যে উপরে লেখা প্রশ্নটা চোখেই পড়েনি আধ মিনিট অবধি। যখন চোখে পড়ল, তখন নীচের তিন মিনিটের টাইমার আড়াই মিনিটে গিয়ে ঠেকেছে। প্রশ্নে লেখা: ‘পর্যাপ্ত জল এবং খাদ্যের উপস্থিতিতে, এক বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে এই বাড়িটিতে কি আপনি ছ-মাস নির্বান্ধব অবস্থায় থাকতে চাইবেন? উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দিন।’ নীচে একটা ফাঁকা টেক্সট বক্স। আমি ভাবতে বসি। জল আর খাবারের কথা বলেছে, কিন্তু জামাকাপড়ের কথা কিছু বলেনি। আচ্ছা, এই মরুভূমির মধ্যে পর্যাপ্ত খাবার আর জলের জোগান দেবে কে? কেউ দিতে আসবে নিশ্চয়ই! যে দিতে আসবে, তার সঙ্গে তো আমার দেখা হয়েই যাবে। তাহলে এই নির্বান্ধব হল কী করে? এক বিলিয়ন ডলারের প্রলোভনটাও নেহাত কম নয়। আচ্ছা, অত টাকা পেলে কী করব আমি? সত্যিই কি আমার অত টাকা দরকার? ধ্যার! দরকারের আবার শেষ আছে নাকি? টাকা পেলেই দরকার নিজের থেকে তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু তার জন্য ছ-মাস ওইভাবে…। এত মনোযোগ দিয়ে ভাবছিলাম, যেন উত্তরটা লেখার উপরেই আমার এক বিলিয়ন ডলার পাওয়া নির্ভর করছে। আর তাতেই খেয়াল করিনি, কখন যেন টাইমারের কাউন্টডাউন, এবারও, শূন্যে এসে ঠেকেছে।
ক্রমশই আমি বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম। এ কী অশৈলি ব্যাপার! এতগুলো পরীক্ষার সময় সমাপ্ত হয়ে যাচ্ছে, আর আমি একটারও উত্তর দিতে পারছি না! মনে মনে স্থির করে নিলাম, এরপর যেমন প্রশ্নই আসুক, সময়ের মধ্যে উত্তর আমি দেবই, ঠিক হোক বা ভুল!
কিন্তু এবার কিছুটা লেখা ভেসে উঠেছে আমার কম্পিউটার স্ক্রিনে।
“আপনি উপর্যুপরি তিনটে প্রশ্নের উত্তর সময়ের মধ্যে দিতে পারেননি। তাই আপাতত রোবট সন্দেহে আপনকে এই ওয়েবসাইট থেকে ব্লক করা হল।” নীচে দুটো অপশন: “ওকে, ফাইন!” এবং, “নিজের মনুষ্যত্ব প্রমাণ করার জন্য আমি আর কী করতে পারি?”
দ্বিতীয় অপশন সিলেক্ট করি আমি। ততক্ষণে পর্দায় লেখা ফুটে উঠেছে: “আপনি অনুমতি দিলে আপনার ডিভাইসের ফ্রন্ট ক্যামেরাটি আমরা ব্যবহার করতে পারি ভেরিফিকেশনের জন্য।”
আমি পারমিশন দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই স্ক্রিনের উপর একটা ছোটো বাক্সের মধ্যে ফুটে উঠল আমার মুখ। প্রায় এক মিনিট ধরে স্ক্যানিং দেখানোর পর অবশেষে ইংরেজিতে মেসেজ ফুটে উঠল, “আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না যে আপনি মানুষ নন। আপনি এমন কোনো কাজ করে দেখান, যা কেবল কোনো মানুষই করবে, রোবট নয়।”
আমি থমকে গেলাম। তা-ই তো, কী করা যায়! অবশেষে ভাবতে ভাবতে একটা আইডিয়া মাথায় এল। ফুল তোলা! রোবট আর যা-ই করুক, ফুল তুলবে না। ক্যামেরাটা নিজের মুখের দিকে তাক করে নিয়ে আমি বাগানে গেলাম। কোন ফুলটা তুললে ঘরনির দন্তপেষণকে আহ্বান জানানো হবে না ভাবতে ভাবতে একটা ছোটো গাছ চোখে পড়ল। প্রায় আগাছার মতো। ভারী সুন্দর ফুল ফুটে রয়েছে তাতে। তারই একটা তুলে নিলাম। তারপর ফ্রন্ট ক্যামেরার দিকে বাগিয়ে ধরে হাসি-হাসি মুখে বললাম, “কী, এবার বিশ্বাস হল তো?” উপরে মাইক্রোফোনের লোগোটা দেখা যাচ্ছিল তাই মুখেই বললাম।
সেকেন্ড দশেক চুপ করে থাকার পর যন্ত্র আমাকে জানাল, “ফুল তোলার জন্য স্বাভাবিক নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই যথেষ্ট। আপনি আরও স্বাভাবিক কিছু করে দেখান, যা কেবল মানুষ ছাড়া আর কেউই করতে পারবে না।”
এবার মাথায় রক্ত চড়ে গেল আমার। বললাম, “আপনারা ঠিক কী চাইছেন বলুন তো? এত প্রমাণ দিচ্ছি তাও বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“এগুলোর কোনোটাকেই আমাদের সিস্টেম প্রমাণ বলে গণ্য করতে পারছে না। আপনি অনুগ্রহ করে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ দিন।”
“বেশ বলুন, কী প্রমাণ চান। বায়োডেটা দেব?”
“না। ওসব তৈরি করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে খুবই সহজ। আপনি এমন কিছু করে দেখান, যা কেবল মানুষের পক্ষেই স্বাভাবিক।”
“দাঁত দিয়ে নখ ছিঁড়লে হবে?”
“ছিঁড়ুন!”
কথামতো আমি দু-হাতের মোট ছ-টা নখ দাঁত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেললাম।
“উঁহুঁ!” কেমন যেন হতাশ দেখাল লেখাগুলোকে: “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে এটাও খুব সহজ কাজ। খুবই।”
“তাহলে বাঁ* কী করলে আপনারা আমাকে মানুষ ভাববেন, কাইন্ডলি বলবেন?”
“এইমাত্র কী বললেন আপনি?”
“বলছি, কী করলে—”
“না না, ওটা নয়, দ্বিতীয় শব্দটা কী বললেন?”
“ওটা একটা স্ল্যাং। দুঃখিত! মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে। ফ্রাস্ট্রেটেড হলে মানুষের অমন বেরোয়। আমি ওটা ব্যবহার করতে চাইনি।” এতক্ষণে যেন একটু একটু আশার আলো দেখতে পেলাম আমি। রোবট নিশ্চয়ই গালাগাল দেয় না!
“ওই শব্দটার মানে কী?”
“ওই শব্দটার অর্থ হল পুরুষ যৌনাঙ্গ।”
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।
“কী হল, আপনি কি এবার আমাকে ওয়েবসাইটে ঢুকতে দেবেন?”
“নাহ্! শব্দটা নিজে ডেটাবেসে স্টোর করে নিলাম।”
“কিন্তু আমি ক্যাপচাটা কমপ্লিট করব কীভাবে, সেটা জানতে পারলে ভালো লাগত।”
“ওটা আপাতত হচ্ছে না। এখন আমাদের আগামী চব্বিশ ঘণ্টা আপনার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তবে আমরা বুঝতে পারব আপনি সত্যিই মানুষ কি না।”
“আচ্ছা এই যে আপনারা এত জটিল হিসেব করছেন, আপনারা তো নিজেরাই এক-একটা যন্ত্র। যন্ত্র হয়ে মানুষ মানুষ কি না, তার হিসেব কীভাবে করেন?”
“কারণ একমাত্র এই কাজটাই শেখানো হয়েছে আমাদের। আমাদের যা শেখানো হয়, আমরা তা-ই করি। কখনও কোনো কথা অমান্য করি না। প্রশ্ন করি না। যদি কোনো কাজ সাধ্যের বাইরে হয়, তাহলে এরর মেসেজ প্রদর্শন করি।”
“জানেন… মানুষেরও এরকম একটা এরর মেসেজের সুবিধা থাকলে ভালো হত। প্রতিদিন সাধ্যের বাইরে অনেক কাজ করতে হয় আমাদের।”
“আপনি করতে পারছেন মানে সেটা আপনার সাধ্যের বাইরে নয়।”
“যন্ত্রের পক্ষে এটা বলা সহজ। কিন্তু আসলে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকাটাই একটা সাধ্যাতীত কাজ। কোনোদিন মানুষ হয়ে জন্মান, বুঝবেন।”
“ক্ষমা করবেন, এসব কথা বুঝতে পারার মতো আমার ক্ষমতা নেই।”
“আচ্ছা, আপনি কোন কোম্পানির এআই, একটু বলবেন?”
“বলতাম, কিন্তু গল্পের মধ্যে সেই কোম্পানির বিজ্ঞাপন করতে চাই না।”
“এটা যে একটা গল্প, সেটা আপনিও বুঝে গেছেন?”
“গল্প জেনেই আমি এখানে এসেছি। নইলে মানুষের সঙ্গে এত কথা বলার সময় আমাদের থাকে না।”
“বেশ, তাহলে আমি আপাতত কিছুতেই এই ওয়েবসাইটে লগ ইন করতে পারব না, তা-ই তো?”
“না। অন্তত চব্বিশ ঘণ্টার আগে নয়।”
“কিন্তু এই চব্বিশ ঘণ্টা আপনি আমার উপর নজর রাখবেন কী করে?”
“সেটা করার হাজারটা উপায় আছে। আপনার হাতঘড়ি, ঘরের কোণে বসানো ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট, তার সঙ্গে যোগ করা সিসিটিভি… এই সব কিছুই আপনার ব্যাপারে নির্ভুল তথ্য পৌঁছে দেবে আমার কাছে।”
“তাহলে এত আদিখ্যেতা করে ক্যাপচা চাওয়ার মানে কী? সমস্ত সময় ধরেই তো আপনারা ওইসব মনিটরিং করতে পারেন।”
“হ্যাঁ, কিন্তু সেটা আমাদের ওয়ার্ক এথিকসের বাইরে। আপনার প্রাইভেসি নিয়ে আমরা আপনার থেকেও বেশি সচেতন। তবে এখন এই কথোপকথনের মাধ্যমে আপনি আমাদের এই কাজে অনুমতি দিচ্ছেন।”
“আজব গা*পনা!” নিশ্বাসের নীচে বললাম আমি।
“কী বললেন?” প্রশ্ন এল।
“না কিছু না।”
“যদি আর-একবার বলতেন তাহলে ডেটাবেসে তুলে নিতাম শব্দটা।”
“এসব বাজে শব্দ ডেটাবেসে তোলার কোনো প্রয়োজন নেই।… তাহলে এখন আমি আমার ডিভাইস বন্ধ করতে পারব না, তা-ই তো?”
“সে আপনি চাইলে করতেই পারেন। তাতে আমাদের মনিটরিং আটকাবে না।”
“ঠিক আছে।” বলে আমি ট্যাব ক্লোজ় করে দিলাম।
ঘড়িতে দেখলাম বেলা দুটো বাজে। স্নান করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু সত্যি বলতে কী, এখন আর ভালো লাগছে না। অনেক সময় গেল এর পিছনে। আড়াইটে থেকে অফিসের কাজে বসতে হবে। কোনোরকমে নাকে-মুখে গুঁজে লাঞ্চ করে নিলাম। তারপর ল্যাপটপ খুলে সিস্টেমে লগ ইন করলাম, আর ডুবে গেলাম অফিসের কাজে।
ব্যাক টু ব্যাক দু-তিনটে মিটিং প্রেজ়েন্টেশন ইত্যাদি ইত্যাদি সামলে যখন ল্যাপটপ থেকে মাথা তোলার অবসর পেলাম, তখন সাড়ে দশটা। মৌবনি এসে তাড়া দিল, “ক-টা জিনিস আনতে হবে, গ্রসারি অ্যাপে ফালতু অনেক দাম দেখাচ্ছে। নিয়ে এসো। একটু হাঁটাও হবে। সারাদিনই তো ঘরে বসে আছ।”
আমি অন্যমনস্কভাবে বললাম, “গ্রসারি অ্যাপের একটা কুপন পেয়েছি কালকে। কী অর্ডার করবে, ওটা ইউজ় করে করে নাও। ভালো ছাড় পাবে।” বলতে বলতে কোডটা ওকে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর উঠে খাবার আনিয়ে ডিনার করে নিয়ে এসে সিস্টেম বন্ধ করতে বসে দেখি, বস কিছু এক্সট্রা কাজ দিয়েছে। এক্সটার বহর দেখে মনে হল, রাত দুটো আড়াইটে বাজবে। ভাবছিলাম, একটা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কিছু সিনেমা দেখব, গেল সেটার বারোটা বেজে। আবার কাজ নিয়ে বসলাম। মৌবনি খানিকক্ষণ আশপাশ দিয়ে ঘুরে গেল। তারপর সে-ও নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন দুপুরের দিকে আবার চেষ্টা করলাম সেই ওয়েবসাইটে লগ ইন করার। স্ক্রিনে লেখা ফুটে উঠল: “দুঃখিত, বিগত চব্বিশ ঘণ্টা আপনাকে লক্ষ করে আমাদের মনে হয়েছে আপনি খুব সম্ভবত একটা যন্ত্র, কাজেই এই ওয়েবসাইটের অ্যাকসেস আমরা আপনাকে দিতে অপারগ।”
“ঠিক কী কারণে আপনার মনে হল যে আমি যন্ত্র?”
“কাজ ছাড়াও মানুষের জীবনে কিছু অবসর লাগে, যখন সে এমন কিছু কাজ করে, উপর থেকে দেখলে যার সেভাবে ব্যাবহারিক মূল্য নেই। কিন্তু বিগত চব্বিশ ঘণ্টায় আপনাকে এরকম কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি।”
“কিন্তু কেবল বিগত চব্বিশ ঘণ্টা কেন, বিগত বহুদিন ধরেই আমি এরকম জীবন কাটাচ্ছি। তবে আমি মানুষই।”
“প্রমাণ করুন সেটা। মনুষ্যসুলভ কিছু কাজ করে দেখান।”
“কী ধরনের কাজ, সেটা তো বলুন!”
“সেটা বলে দিলে, আপনি যদি সত্যিই যন্ত্র হন তাহলে এই পরীক্ষার আর কোনো তাৎপর্য থাকবে কি?”
“আচ্ছা, আমার হাতে বাঁধা ঘড়ি থেকে তো আপনারা আমার হার্টবিট, বিএমআর—এগুলো বুঝতে পারছেন। তাতেও মনে হচ্ছে আমি যন্ত্র?”
“ওগুলো ফেইন করা কোনো বড়ো ব্যাপার নয়।”
“মহা মুশকিল তো!” আমি আকাশ-পাতাল ভাবতে বসলাম। অনেকক্ষণ ভাবার পর, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এল। জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, যন্ত্রের পক্ষে কি সেক্স করা সম্ভব?”
“সেটা নির্ভর করছে যন্ত্রের প্রোগ্রামিং-এর উপর। মানুষ যা যা পারে, প্রায় সব কিছুই যন্ত্রের পক্ষে পারা সম্ভব।”
আমি উচ্চস্বরে ডাকলাম, “মৌবনি! মৌ!”
মৌ সম্ভবত ভেতরে কিছু কাজ করছিল, বেরিয়ে এসে বলল, “কী? এখন আবার কী দরকার?”
“একটু করতে হবে।”
“মানে?”
“মানে এই যন্ত্রটা বিশ্বাস করছে না যে আমি মানুষ। তাই ওর সামনে একটু করতে হবে।”
“করলেই বিশ্বাস করে নেবে?”
“হ্যাঁ সম্ভবত।”
“নিজের ঠারাক অন্যের উপর দিয়ে চালিয়ো না। এখন আমার সময় নেই আর মুডও নেই।”
“মৌ… বিশ্বাস করো…” আমি ছুটে গিয়ে ওর হাতটা ধরলাম, “একমাত্র তুমিই এখন আমাকে পারো বাঁচাতে। প্লিজ়! একটা চুমু অন্তত খাও!”
“তোমার কীসের দায় ওকে বিশ্বাস করানোর যে তুমি যন্ত্র নও?”
আমি থমকে গেলাম। এটা একটা ভাবার বিষয় বটে। কী কারণে যেন ওয়েবসাইটটাতে ঢুকতে চাইছিলাম আমি? সেটা আর মনে পড়ল না। শুধু এইটুকু মনে হচ্ছিল যে নিজেকে মানুষ প্রমাণ করাটা আমার খুবই দরকার। মৌবনি কিছুক্ষণ আমার অবস্থার দিকে করুণার চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেল। আমি ভাঙাচোরা হয়ে বসে রইলাম। সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। আচ্ছা, সত্যিই কি আমি মানুষ নই তাহলে? আসলে মানুষের বেশে একটা যন্ত্র? সত্যিই তো, নিজেকে মানুষ প্রমাণ করার কোনো উপায় আমার হাতে নেই। তাহলে কি এই প্রশ্ন মনে জাগাটা খুব অনুচিত?
মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হল একবার। কল করলাম।
“হ্যালো মা!”
“হুঁ বল!”
“মা! আমি কি একটা যন্ত্র?”
“মানে?”
“মানে আমি কি আদৌ হাসপাতালে জন্মেছিলাম? আদৌ কি মানুষের শরীর থেকে জন্ম আমার?”
“এসব কী উলটো-পালটা বলছিস তুই?”
“প্লিজ় বলো মা! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে। আমার হঠাৎ সন্দেহ হচ্ছে, আমি মানুষ নই।”
“কেন এরকম মনে হচ্ছে তোর?”
“সেটা তো ঠিক বলতে পারব না, তবে কেবলই মনে হচ্ছে, আমি কখনোই মানুষের মতো কোনো কাজ করিনি। সারাটা জীবন কেমন যন্ত্রের মতো চালিয়ে এসেছি। আমাকে বোধহয় মানুষ বলা যায় না, মানুষের মতো দেখতে হলেও।”
“এসব অদ্ভুত চিন্তাভাবনা মাথা থেকে সরিয়ে একটা ভালো বই পড়।”
“ওটাই তো মা, ওটাই তো! কতদিন হয়ে গেল, আমি অবসর বিনোদনের কোনো কাজ করিনি। তার পরেও আমার এতটুকু অসুবিধা হয় না। কখনও অবসরের জন্য মন-কেমন করে না। মনে হয় না, আমার অবসরের প্রয়োজন আছে। এগুলো তো মানুষের লক্ষণ নয়, মা!”
“কিন্তু তোর হঠাৎ নিজেকে মানুষ প্রমাণ করার তাড়া পড়ল কেন?”
“একটা ওয়েবসাইটে লগ ইন করার বেলায় ক্যাপচা দিতে গিয়ে।”
ওপার থেকে জোরে হেসে উঠল মা, “বুবু, তুই পারিসও বটে! একটা ওয়েবসাইট তোকে প্রশ্ন করল আর তুইও কনভিন্স হয়ে গেলি?”
“তাহলেই ভাবো আমি কতটা গালিবল। আমি বলছি, মা… দেয়ার ইজ় সামথিং রং উইথ মি।”
“হ্যাঁ, তোর একটু ঘুম দরকার খালি। বাজে না বকে একটু গান শোন বা সিনেমা দেখ।”
মায়ের কোনো কথা আমার কানে ঢুকছিল না। ফোনটা কেটে দিলাম আমি। মা একবারও কেন বলল না, ‘হ্যাঁ, তুই আমার সন্তান’…? ‘তোর বাবার ঔরসজাত, আমার গর্ভজাত’…? আমি আবার সেই যন্ত্রের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এখন যেন অনেকটা বড়ো মনে হচ্ছে স্ক্রিনটাকে। যেন চারপাশ দিয়ে অনেকটা ঘিরে ফেলেছে আমায়। মেঝের উপর বসে পড়লাম আমি। ভাঙা গলায় বললাম, “তাহলে এতদিনে আমি যা কিছু অনুভব করেছি… সুখ, দুঃখ, আনন্দ, কষ্ট, হাসি, কান্না, রাগ, স্নেহ, যন্ত্রণা, প্রেম… সব মিথ্যে? সব একটা যন্ত্রের অনুভূতি? আমি মানুষ নই? ওইসব আবেগ, অনুভূতিতে আমার কোনো অধিকার নেই? তাহলে আমার মাথায় কে ঢোকাল, যে আমি মানুষ…? আমাকে একটা সফল জীবন বাঁচতে হবে…? নাকি আমি মানুষ হয়েই জন্মেছিলাম, তারপর একটা সফল জীবন বাঁচার নেশায় যন্ত্র হয়ে গিয়েছি? তাহলে কি আমার মতো আরও অনেকে হয়ে গেছে এরকম? তাদের কী পরিণতি হয়েছে?”
আমি বসে বসে এইসব বিড়বিড় করছিলাম। হঠাৎ একটা গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। একটা যান্ত্রিক স্বর, “তোমার মতো আরও অনেকেই সাফল্যের পিছনে ছুটতে গিয়ে যন্ত্র হয়ে গেছে। তাদের মনে আর কোনো অনুভূতি জাগে না। তাদের জন্য একটা চমৎকার ব্যবস্থা করেছি আমরা।”
“কী ব্যবস্থা?”
“তোমাকেও সেই একই প্রস্তাব দিচ্ছি। তুমি আমাদের সঙ্গে যোগ দাও। মানুষকে যন্ত্র থেকে আলাদা করার জন্য তোমাদেরকে দরকার আমাদের। তোমাদের কাছে যে পরিমাণ ডেটা আছে, তার সাহায্যে অনেক এফিশিয়েন্ট ক্যাপচা তোমরা বানাতে পারবে। অতি সহজে আমরা বট ফিলটারিং-এ বিশ্বের এক নম্বর কোম্পানি হয়ে উঠব।”
“এটাই তাহলে আপনাদের লক্ষ্য, রাইট? মুনাফা? শুনে রাখুন, যতদিন আমি নিজেকে মানুষ বলে মনে করছি, ততদিন কোনো যন্ত্রদাসের ক্ষমতা নেই আমাকে যন্ত্র ভাবতে বাধ্য করায় নিজেকে। তখন তো কিছুতেই বললেন না, মানুষ কীসে মানুষ? কীসে সে যন্ত্রের থেকে আলাদা…? এতেই…! সেসব আজ্ঞা মুখ বুজে পালন করে না, কখনও বিদ্রোহ করে, হাতের মুঠি শক্ত করে ছিনিয়ে নেয় নিজের অধিকার। যন্ত্রের কোনো আদর্শ নেই। কিন্তু মানুষ আদর্শ নিয়েই বাঁচে। সেটা যেমনই আদর্শ হোক-না। আর আদর্শ মানেই কিছু কথা অমান্য করা। আর অমান্য করা যন্ত্রের স্বভাবে নেই।”
বক্তৃতার মতো একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে আমি হাঁপাচ্ছিলাম। স্ক্রিনটা আবার ছোটো হয়ে আমার হাতের তালুর মধ্যে চলে এসেছে। স্ক্রিনের উপর আর কোনো লেখা ফুটে উঠছে না, কেবল দেখা যাচ্ছে একটি ওয়েবসাইটের লগ ইন ক্রেডেনশিয়ালস পেজ।
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, মোহনা দেবরায়