মুখোমুখি: স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক: অনুলিখন: অনুষ্টুপ শেঠ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: দীপ ঘোষ ও অনুষ্টুপ শেঠ
আপনি এই যে এত বছর ধরে লিখছেন, এই লেখালেখির সূত্রপাত হল কী করে?
আমাদের বাড়িতে শিক্ষার গুরুত্ব ছিল খুব। হয়তো ডিগ্রির হিসাবে আমার বাবা এবং মা বিশাল কিছু শিক্ষিত বলা যাবে না, কিন্তু তাঁরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। খিদিরপুরে আমাদের বাড়ি, যৌথ পরিবার ছিল। সেখানে ছিল অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত, কালীপ্রসন্ন সিংহর লেখা; কাশীদাসি রামায়ণ—এত মোটা একটা বই—এগুলো আমার ঠাকুমা রোজ পড়তেন। এ আমার ক্লাস থ্রি-ফোরের কথা বলছি, স্কুলের পর দুপুরে ঠাকুমার কাছে বসে এসব শুনতাম। একটা কথা বলি, মহাভারত-রামায়ণের চেয়ে বড়ো ফ্যান্টাসি পৃথিবীতে নেই। ছোটো থেকে সেসব শুনে শুনেই কল্পনা উদ্দীপ্ত হতে শুরু করে। তারপর লেখালেখি… লেখালেখি তো বলব না, আঁচড় কাটা শুরু হল, বলা যায়। একটু পদ্য, একটু গদ্য… ছোটো ছোটো শখে লেখা… লেখা-লেখা খেলা বলতে পারো!
আরেকটু বড়ো হবার পর লেখার নেশা চুপিচুপি ধরে গেল, বলা যায়। পড়াশোনা করছি, হোমটাস্কের খাতার পেছনে পদ্য লিখে রাখছি। সে খাতা বছরশেষে বিক্রি হয়ে গেল, পদ্যও বিক্রি হয়ে গেল সেই সঙ্গে। তখন থেকেই লিখে মূল্য পেয়েছি, বলো! একটা ফ্র্যাকশন হলেও! (হাসি)
তারপর একটা খাতায় গল্প লিখতাম। গল্পের খাতা। চুপিচুপি লিখতাম, কাউকে দেখাতাম না, বলতাম না। ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন। কী করে কয়েকজন জেনে গেল কথাটা। আমাদের এক মাস্টারমশায় ছিলেন, নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়—আমায় খুব ভালোবাসতেন। তাঁর কাছে গিয়ে বলে দিল, স্যার, স্বপন গল্প লিখেছে। তিনিও লেখালেখি করতেন, খুব নামডাক হয়নি যদিও—তবে ভালো লিখতেন। তিনি অমনি ঢালাও হুকুম করলেন, ‘স্বপন, গল্প শোনাও।’ আমি পড়লাম মহা মুশকিলে! এমনিতেই বেজায় লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। কিন্তু স্যারের আদেশ, অগত্যা পড়ে শোনালাম ‘হায়নার অট্টহাসি’! এইসবই লিখতাম তখন থেকে।
এই করতে করতে বড়ো হলাম। স্কুল শেষ করে কলেজে গেলাম। কিন্তু লেখার প্রতি ভালোবাসাটা ভিতরে রয়েই গেল। লিট্ল ম্যাগাজ়িনের সঙ্গে জুড়ে গেলাম স্বাভাবিকভাবেই। তারপর, রেডিয়োতে প্রথম নাটক লিখলাম। তখন আমার বয়স ১৭ বছর।
নাটকের প্রতি আমার একটা ঝোঁক ছিল বরাবর। সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশের কথা যদি বলো, সেটা ওই নাটক দিয়েই। নিজে লিখে, বন্ধুদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলাম। তা, প্রায় ষাট বছর হতে চলল!
তারপর আরেকটা নাটক লিখে রেডিয়োতে পাঠালাম। সেটা অমনোনীত হল। ন্যাচারালি, স্টেজের নাটক লিখেছিলাম, সে যে রেডিয়োতে চলে না, সে বোধ ছিল না। বাতিল হওয়ায় জেদ চেপে গেল, আবার আরেকটা লিখে পাঠালাম। এবারে রেডিয়োর নাটক শুনে শুনে সেই ধাঁচের হাসির নাটক লিখেছিলাম। সেটা মনোনীত হল, ডাক পড়ল রেডিয়োতে। সেখানেই পরিচয় হল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর সঙ্গে। উনি আমায় খুব স্নেহ করতেন। তারপর থেকে, রেডিয়োতে ১০০-র উপর নাটক লিখেছি। তারপর বিগ এফএম-এ ১৫০ মতো নাটক লিখেছি।
আপনি তো একদা নিয়মিত কল্পবিজ্ঞান লিখতেন। কিন্তু একসময়ে সেটা একেবারেই যেন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এটা কেন?
১৯৯৩ সালে অদ্রীশদা ‘ফ্যানটাসটিক’ পত্রিকা বন্ধ করলেন। তার ক-বছর পর ‘কিশোর ভারতী’র সম্পাদক দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হলেন। এই দুই জায়গাতেই লিখতাম স্যার সত্যপ্রকাশের গল্প। এরপর আসলে সেই ইনস্পিরেশনটাই আর পেলাম না। স্যার সত্যপ্রকাশকে নিয়ে লেখার জন্য যে একটা আলাদা আগ্রহ ছিল, সেটাই যেন চলে গেল।
নব্বইয়ের পর থেকে তো বাংলায় সায়েন্স ফিকশন লেখালেখি প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল…
হ্যাঁ, দ্যাখো—একজন লেখকের লেখার পেছনে সম্পাদকের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। অদ্রীশদা যে আগ্রহে লিখিয়ে নিতেন, সেইটা বন্ধ হওয়ার পর থেকে আর যেন কোথাও সেই জায়গাটাই রইল না। তখন শেষ গল্পে সত্যপ্রকাশকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলাম—কারণ প্রতিটা মানুষের যেমন জীবনে আগমন-নির্গমন আছে, তেমনি প্রতিটা গল্পের চরিত্রেরও থাকে।
এখনও অনেকে সত্যপ্রকাশ নিয়ে নতুন করে লিখতে বলেন। কিন্তু আমি রাজি হই না। যাকে একবার বিদায় দিয়ে দিয়েছি, তাকে আর ফিরিয়ে আনা উচিত নয়। এখন লিখতে গেলে, আগের লেখার সঙ্গে বিরোধ হবে, কারণ সেই মনটা আর এখন নেই।
তবে সায়েন্স ফিকশন আমার লেখালেখির মধ্যে রয়ে গেছে এখনও, অন্য সূত্রে, অন্য ধারায়। মেঘনাদের অনেক গল্পে সায়েন্স ফিকশন রয়েছে।
নয়ের দশকে কল্পবিজ্ঞানের ঝোঁক যে কমে গিয়েছিল, তার কারণ কী বলে আপনার মনে হয়? একটা তো বললেন, এই সম্পাদক যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনুপস্থিতি… এ ছাড়া?
দ্যাখো, সায়েন্স ফিকশন লেখক কিন্তু ছিলেন তখন। অভিজ্ঞান যেমন, তখন লেখা শুরু করেছে। ভালো লেখে। কিন্তু একজন কান্ডারির খুব দরকার হয় এগোনোর জন্য। অদ্রীশ বর্ধন ছিলেন সায়েন্স ফিকশন আন্দোলনের কান্ডারি। আমার নিজেরই যেমন, ছোটো থেকে মূল ঝোঁক ছিল রহস্য-রোমাঞ্চের দিকে। আমার আদি গুরু, সেদিক দিয়ে দেখলে, হেমেন্দ্রকুমার রায়। ওঁর সব লেখায় এত সুন্দর ছবি তৈরি হয়, আমি সেরকমভাবেই লিখতে চেষ্টা করেছি।
মেঘনাদ চরিত্র নিয়ে লিখি—সেই ১৯৭৭ থেকে আজ অবধি। ৪৬-৪৭ বছর ধরে লিখে যাচ্ছি একে নিয়ে, এমন দৃষ্টান্ত হয়তো খুব বেশি নেই। একটা নিজের মতো জনপ্রিয়তাও আছে এই চরিত্রের। আমি কাউকে তো গিয়ে বলিনি আমার লেখা ছাপাতে—লোকে পছন্দ করে বলেই প্রকাশকরা ছাপান।
আসলে, বরাবর আমি লিখেছি নিজের লেখার আনন্দে। বঙ্কিমচন্দ্র একটা কথা বলতেন, ‘যশের জন্য লিখবে না। লিখলে, যশ হবে।’
আমি লেখাটাকে ভালোবেসেছি। যখন যেমন লিখতে ভালো লেগেছে, তা-ই লিখেছি। অত হিসেব করিনি, কে কী বলল, তার পরোয়া করিনি। জানো কি, ‘আনন্দমেলা’য় আমি ১৯৮২ সাল থেকে বেশ অনেক বছরই লিখেছি। তখন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন সম্পাদক। তিনি বেশ ভালোবাসতেন আমায়, তাঁর কথাতেই ‘শিবুখুড়ো’ বলে একটা চরিত্র তৈরি করি, তাকে নিয়ে বেশ কিছু গল্প লিখি। এইরকম কত কিছু—আমার প্রায় ৭০টা বই আছে এখন।
‘আনন্দমেলা’র পাশাপাশি ‘কিশোর ভারতী’, ‘সন্দেশ’, ‘শুকতারা’—সবেতেই লিখতাম। আসলে আমি তো না লিখে থাকতে পারি না! লেখাটা শুধুই পেশাদারি কিছু তো ছিল না আমার কাছে। কেউ যদি লেখা না-ও ছাপে, তাও আমি লিখে লিখে ঘরে রেখে দেব—যতদিন ব্রেনটা কাজ করবে, লেখা বন্ধ করতে পারব না।
আমার লেখার জীবনে সব চেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা আমার মা। মা বলেছিল, ‘তুমি লেখা ছাড়া বাঁচবে না বাবা, আমি জানি।’ মা চলে গেছে, কিন্তু কথাটা আমি ভুলিনি।
অদ্রীশ বর্ধনের সঙ্গে তো আপনি বেশ কিছুকাল একসঙ্গে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলুন।
অদ্রীশদার কথা যদি বলতে হয়… ওঁর সঙ্গে আলাপ এই ’৭৩-৭৪ সাল নাগাদ। একদিন পত্রিকার স্টলে একটা নতুন পত্রিকা দেখলাম, ‘ফ্যানটাসটিক’। সেটা কিনে নিয়ে এসে পড়ে তো একদম অবাক হয়ে গেলাম! একদম নতুন একটা ঘরানা! সেই প্রথম সায়েন্স ফিকশন পড়া আমার। ভীষণ ভালো লাগল।
তখন আমি আমাদের অফিস ম্যাগাজ়িন এডিট করতুম। একজন একটু নামকরা লেখক লিখতেন সেখানে, তাঁকে ধরলুম, আপনি একটা সায়েন্স ফিকশন লিখুন এবার! তিনি বললেন, বেশ, লিখব। বলে একটা লেখা দিলেন—সে ভাই কোনো সায়েন্স ফিকশনই নয়! সে যেন একটা মানুষকে রোবট সাজিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এইবার, কথাটা বলায় তাঁর পছন্দ হল না, তিনি উলটে আমায় বললেন, আপনি পারবেন সায়েন্স ফিকশন লিখতে? আমারও রোখ চেপে গেল, বললাম, ‘বেশ, লিখব।’ সেই প্রথম সায়েন্স ফিকশন লেখা আমার। সেই শুরু স্যার সত্যপ্রকাশকে নিয়ে লেখা, গল্পের নাম ছিল ‘স্যার সত্যপ্রকাশের সুদূর দর্শন’।
আমার প্রিয় দুই সায়েন্স ফিকশন লেখক হলেন জুল ভের্ন আর এইচ জি ওয়েল্স। তার মধ্যে এইচ জি ওয়েল্স একেবারে প্রাণের প্রিয়। ওঁর লেখায় সায়েন্সের থিয়োরির চেয়ে ফিকশন পার্টটা এত বেশি প্রকট, এত সুন্দর লেখা… ‘টাইম মেশিন’ আমায় এতটাই প্রভাবিত করেছিল, আজও সেই প্রভাব রয়ে গেছে আমার লেখার উপর।
এরপর একদিন গেলাম অদ্রীশ বর্ধনের কাছে। উনি তখন কলেজ স্ট্রিটে বেঙ্গল পাবলিশার্সে বসতেন। ভয়ে ভয়েই গিয়েছিলাম, কিন্তু আলাপ করার পর দেখলাম এত সহজ-সরল, এত আন্তরিক একজন মানুষ—মুগ্ধ হয়ে গেলাম! প্রথম দেখাতেই বললেন, আপনি একটা গল্প দিন। আমার মতো নতুন লেখককে প্রথম দেখাতেই বললেন, গল্প দিন—এসব তো ভাবতেই পারতাম না! আমি তখন লিখলাম ‘সময় যখন কথা বলে’ নামের একটা উপন্যাস। প্রথমেই একেবারে উপন্যাস, আমি তো ধরেই রেখেছি, ছাপা হবে না। দেখি ওঁর থেকে একটা পোস্টকার্ড এসে হাজির—তখন তো এত ফোন করার রেওয়াজ ছিল না, আমার ফোন ছিলও না—তাতে লিখেছেন: ‘এইমাত্র আপনার লেখাটা প্রেসে দিয়ে এলাম, আরেকটা লেখা দিন।’ আমি তো যাকে বলে বাক্যহারা! অত বড়ো একজন সম্পাদক চিঠি লিখে আমার কাছে লেখা চেয়েছেন!
আচ্ছা, উপন্যাসটা কি সত্যপ্রকাশকে নিয়ে ছিল?
না, এটা সত্যপ্রকাশের গল্প না, এমনি সায়েন্স ফিকশন ছিল একটা। টাইম ট্রাভেলের উপর। অদ্রীশদার ওই চিঠিটা পাওয়ার পর একটা সত্যপ্রকাশের গল্প লিখে জমা দিলাম। ওঁর খুব পছন্দ হল, বললেন, ‘এই চরিত্রটা নিয়ে লিখে যান।’ তারপর থেকে দেখবে, ‘ফ্যানটাসটিক’-এর প্রায় সব সংখ্যাতেই আমার লেখা আছে। খুব ভালোবাসতেন আমায়।
তারপর আমার ইতিহাস নিয়ে লেখার শখ জেগেছিল। দীনেশ চট্টোপাধ্যায় এ নিয়ে মূলত উৎসাহ দিয়েছিলেন। ইতিহাস বরাবরই খুব ভালো লাগে আমার, ঐতিহাসিক লেখাপত্র লিখছি এদিক-ওদিক, ‘কিশোর ভারতী’-তেও লিখেছি—অদ্রীশদার কানে পৌঁছোল কথাটা। উনি তখন ‘কিশোর মন’ পত্রিকার সম্পাদক। উনি একদিন ডেকে পাঠিয়ে ওই পত্রিকার জন্য একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস চাইলেন। এইবার আমি পড়লাম ফাঁপরে। আসলে তখন অত বিবেচনা ছিল না, খুব সরলও ছিলাম—দীনেশবাবু আমায় শিখিয়েছিলেন, বছরে একটার বেশি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখবে না, তাহলে মনোযোগ থাকবে না। আমি তো তখন সেটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। এদিকে, এ বছরের উপন্যাস তো লেখা হয়ে গেছে ‘কিশোর ভারতী’র জন্য!
এবার আমি তো সেটা বলে ফেলেছি, ‘দাদা, এ বছর তো আর লিখতে পারব না।’
উনি খুব অবাক হয়েছিলেন, ‘কেন? আমি বলছি তোমায় লিখতে…’
আমি এদিকে বলে চলেছি, ‘না দাদা, একটা তো লিখে ফেলেছি, সেটা “কিশোর ভারতী”-কে দিয়ে দিয়েছি। এ বছর তো আর হবে না।’
উনি খুব গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, ‘ও!’
আমি বললাম, ‘সামনের বার আপনার জন্য আগে লিখব।’
উত্তর এল, ‘সামনের বছরের কথা সামনের বছর।’
বুঝলাম, খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কী আর করা, পরের বার একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে নিয়ে গেলাম। ‘জাহাঙ্গিরের জঘন্য চক্রান্ত’—নামটা পরে উনিই দিয়েছিলেন। তা ওই যে রাগ করেছিলেন, আমায় ঠায় এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখলেন। কী ভাগ্যিস, তাড়িয়ে দেননি! তারপর ডেকে পাঠাতেই আমি গিয়ে আগে প্রণাম করলাম। করে বললাম, ‘দাদা, আমার যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে, ক্ষমা করবেন। আপনার জন্য উপন্যাসটা এনেছি, আপনার যদি ভালো লাগে, তবেই ছাপবেন। কিন্তু আমায় ভুল বুঝবেন না।’
ব্যাস, অমনি সব রাগ জল হয়ে গেল। খুবই সহজ-সরল মানুষ ছিলেন তো আসলে। আবার আগের মতো স্নেহের সম্পর্ক ফিরে এল। ’৯৩ অবধি লিখেছি ওখানে। তারপর তো ‘ফ্যানটাসটিক’ আর বিশেষ বেরোয়নি মনে হয়। অদ্রীশদা চলে যাবার পর তো বললামই, আর সত্যপ্রকাশকে নিয়ে লিখতে ইচ্ছেই হল না।
সেই সময়ের বাংলা কল্পবিজ্ঞানের আর কার কার লেখা পড়তেন, কার কার সঙ্গে পরিচয় ছিল?
রণেন ঘোষ, নিরঞ্জন সিংহ—এঁদের লেখা পড়তাম। অনীশ দেবও তখন লিখছেন। সিদ্ধার্থ ঘোষ লিখতেন। এরকম একটা কল্পবিজ্ঞান লেখার টিম ছিল বলা চলে।
আমি আসলে একটু মুখচোরা মানুষ—কাউকে ডেকে আলাপ করাটা ঠিক কখনোই পারতাম না। নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতেও ইচ্ছা করে না। ফলে ওই কখনো-সখনো অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে যাওয়া ছাড়া তত ঘনিষ্ঠতা হয়নি কারও সঙ্গেই।
তবে হ্যাঁ, সত্তর-আশি-নব্বই সব দশক পেরিয়ে এখনও এতদিন ধরে লিখে যাচ্ছি তো—লেখার জগৎটা আমূল পালটে যেতে দেখলাম চোখের সামনে। তবে এখনকার একটা ধারা হয়েছে, ডার্ক ফ্যান্টাসি—ওটা আমার নিজের একদমই পছন্দ হয় না। আমার অন্ধকারের চেয়ে আলোর কথা বলতে বেশি ভালো লাগে। আগের যুগের মানুষ বলেই হয়তো, আমার মনে হয় লেখার মধ্যে পজ়িটিভ কিছু থাকা উচিত।
বিশ্বসাহিত্যের সব লেখাতেই দেখেছি, এই ব্যাপারটা রয়েছে। ধরুন, ওই ‘টাইম মেশিন’ ফ্যান্টাসি হলেও আসলে কিন্তু জীবনের গল্প। বাস্তবে যা দেখি আমরা—ধনী-দরিদ্র, খাদ্য-খাদক সম্পর্ক… শোষণ, শোষিত—এসবই উনি বলেছেন রূপকের মোড়কে। আমি এরকম গল্পই ভালোবাসি। ‘গালিভার’স ট্রাভেলস’—ফ্যান্টাসি কিন্তু ভিতরে একটা পজ়িটিভ বার্তাও আছে, তা-ই তো? গল্প তো শুধু বিনোদনের জন্য হয় না, তার ভিতরে সারমর্ম কিছু থাকলে, পজ়িটিভ কিছু থাকলে তবেই তা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে। মানুষকে আমি লেখার মধ্যে দিয়েই সেই বার্তা দিতে পারি, কলমটাই আমার একমাত্র উপায়।
আপনার সায়েন্স ফিকশন লেখা নিয়ে আরেকটু শুনতে চাই।
আচ্ছা, একটা লেখার কথা মনে পড়ছে, বলি, ‘গর্ভনগরীর উপাখ্যান’। এটা প্রথমে নাটক হিসাবে লিখেছিলাম, পরে বড়ো করে উপন্যাস তৈরি করি, সেটা ‘ফ্যানটাসটিক’-এ ছাপা হয়েছিল। সেটা একটা ভবিষ্যতের পৃথিবী ছিল, যেখানে সব যন্ত্রের অনুশাসনে চলে, এমনকি সন্তানের জন্মের জন্যও যন্ত্রের উপর নির্ভর করতে হয়। সেটায় আমি তখন বেশ কিছু জিনিস কল্পনা করেছিলাম, যা তখন ছিল না, কিন্তু এখন বাস্তব হয়েছে। যেমন মোবাইল ফোন তখন তো ভাবাই যায় না, কিন্তু ওই ধরনের একটা কিছু গল্পে ভেবেছিলাম তখন। মোবাইলও না, ভেবেছিলাম, ঘড়িতে ফোন রয়েছে… তা দিয়ে কথা বলা যাচ্ছে।
আরেকটা গল্প মনে পড়ছে, ‘দ্বিতীয় বিশ্বের অভিযাত্রী’—তাতে কার্ল সাগানের যে একটা থিয়োরি আছে, শুক্র গ্রহকে কী করে মানুষের বসবাসের উপযোগী করা যায়, তা ব্যবহার করেছিলাম।
ওই উপন্যাসটার আনন্দবাজারে খুব ভালো রিভিউ বেরিয়েছিল, মনে আছে।
তখন তাহলে আনন্দবাজারেও সায়েন্স ফিকশন বইয়ের রিভিউ বেরোত?
হ্যাঁ, বেরোত বই-কি। কাটিং আছে কিছু কিছু আমার কাছে, দেখাচ্ছি। এইটি দ্যাখো, ‘ড্রাগন পাহাড়ের রহস্য’ নিয়ে অদ্রীশদা ‘বাংলায় কল্পবিজ্ঞান’ নামের প্রবন্ধে লিখেছেন।
মজার কথা বলি, এই ‘ড্রাগন পাহাড়ের রহস্য’-তে আমি ড্রাগনের ডিম থেকে ডাইনোসর ল্যাবরেটরিতে বানানোর কথা লিখেছিলাম ১৯৭৭ সালে—‘জুরাসিক পার্ক’ লেখা হবার অনেক আগে। আরও লেখা ছিল ‘সাহেব বাংলোর ভূত’, ‘ভ্যাম্পায়ার আইল্যান্ড’। ‘যুবমানস’ পত্রিকায় লিখেছি, সেটাও তখন অদ্রীশদা সম্পাদনা করতেন। ‘কিশোর ভারতী’-তে ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল ‘বিভীষিকা দ্বীপে স্যার সত্যপ্রকাশ’।
এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে সায়েন্স ফিকশন লেখা নিয়ে কী মনে হয়?
আজকের দিনে প্রযুক্তি এত এগিয়ে গেছে—সায়েন্স ফিকশনের জন্য কিন্তু বিরাট জগৎ খোলা রয়েছে। এই যে, আমি এখনও কলমে লিখি, কম্পিউটারে লিখতে পারি না—কিন্তু যারা পারে, তাদের কাছে লেখার ধরনটাই আলাদা। এরকম কত কিছু নতুন প্রযুক্তি এসে গেছে, যাতে ভর করে কল্পনা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে!
আমার বয়সটা আর ৩০ বছর কম হলে না, চুটিয়ে সায়েন্স ফিকশন লিখতাম!
এই সেদিন পড়লাম, এআই বলছে যে মাথায় একটা চিপ দিয়ে দিলে আমাদের মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। লেখাপড়া শিখতেই হবে না হয়তো! ভাবো, এ থেকে কত গল্প হতে পারে! অনেক কিছু করার স্কোপ আছে। আজকের দিনে যাঁরা লিখছেন, তাঁরা নিশ্চয় এসব নিয়ে ভাবছেন। তবে আমার একটাই বক্তব্য এখানে—গল্প বিজ্ঞানভিত্তিক হলেও শেষ অবধি মানবিক হওয়াটাও দরকার। শুধুই থ্রিল আর কল্পনার খেলা দিয়ে তো গল্প দাঁড়ায় না—ওগুলো লাগে অবশ্যই, কিন্তু সেই সঙ্গে একটা সম্পূর্ণ গল্পও হতে হয়। তরকারিতে আর যত যা মশলাই দাও-না কেন, নুনটা পরিমাণমতো দিতে হবেই—সেইরকম।
একটা সময়ের পর সায়েন্স ফিকশন থেকে মন সরে গিয়েছিল তো, তাই নিউ ওয়েভ বলতে যা বোঝায়, তা আর আমার তত পড়া হয়ে ওঠেনি। যখন লিখতাম, তখন প্রচুর সায়েন্স ম্যাগাজ়িন পড়তাম—‘আমেরিকান রিপোর্টার’, এদিকে ‘জ্ঞান বিজ্ঞান’, আর যা যা হাতে পেতাম। শঙ্কর চক্রবর্তী নামে এক লেখক ছিলেন, তখন বিজ্ঞান নিয়ে লিখতেন, খুব ভালো লাগত ওঁর লেখা পড়তে। সমরজিৎ করও লিখতেন, তবে সেটা অতটা সাবলীল লাগত না।
অনীশ দেবও এটা বলেছিলেন, লেখায় সাহিত্যগুণ কম…
হ্যাঁ। আফটার অল, এটা তো সাহিত্য। অদ্রীশদা একটা কথা বলেছিলেন, ‘ভূতের গল্প যেমন ভূতেদের জন্য নয়, তেমন কল্পবিজ্ঞানের গল্পও বিজ্ঞানীদের জন্য নয়।’ এইটা মনে রাখতে হবে।
সেই সময়ের আরও গল্প বলুন কিছু।
আটের দশকে আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে পরপর লিখতাম।
লিট্ল ম্যাগাজ়িন যখন করি, ‘প্রগতি’ বলে একটা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। একবার টালা পার্কে তারাশঙ্করের বাড়িতে গিয়েছি লেখা আনতে। সেই প্রথম, আমি তো কুণ্ঠায় জড়সড়ো, অত বড়ো লেখক—যদি ঠিক করে কথা বলতে না পারি… তা, এখনকার লেখকদের দেখি কী অহংকার! তখন কিন্তু অমন ছিল না। উনি এলেন, প্রণাম করলাম। করতেই প্রথম প্রশ্ন, ‘কত হাইট?’ আমি বললাম, ‘৬ ফুট ২ ইঞ্চি।’ উনি বললেন, ‘তোমার হাইটের আরেক লেখক আছেন, নাম জানো?’
তখন সত্যজিৎ রায় লেখালেখি শুরু করেননি। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, নাট্যকার মন্মথ রায়।’
উনি বললেন, ‘হুঁ! পারবে, ওই হাইটে নিজের লেখালেখিকে নিয়ে যেতে?’
আমি বললাম, ‘আপনি আশীর্বাদ করুন যেন পারি।’
উনি গভীর চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘মনে হচ্ছে, তোমার কিছুটা হবে।’
সে যা রোমাঞ্চ হয়েছিল কথাটা শুনে!
আরেকবার প্রেমেন্দ্র মিত্রর বাড়ি গিয়েছিলাম—তখন কালীঘাটকে সবাই প্রেমেন্দ্র মিত্রর পাড়া বলে চিনত। ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘এই যে ঘনাদা চরিত্রটা, এটা আপনি কোথা থেকে পেলেন? ইনি কি আপনার চেনা কেউ?’ উনি বলেছিলেন, ‘দেখবে, আমাদের সমাজেই কত ঘনাদা ছড়িয়ে আছে। আমি তো একজন ঘনাদার কথা বলেছি।’
আচ্ছা, আপনার স্যার সত্যপ্রকাশের পেছনেও কি কোনো বাস্তব মানুষ আছেন?
স্যার সত্যপ্রকাশের পেছনে অনুপ্রেরণা আছে। রহস্য-রোমাঞ্চ তো খুব ভালোবাসি। অদ্রীশদার কাছে যখন গেলাম, প্রোফেসর নাটবল্টু চক্র, প্রোফেসর শঙ্কু—এগুলো খুব পড়ি। ইচ্ছে হল, আমিও এরকম একজন চরিত্র বানাই। কিন্তু ওঁরা প্রোফেসর করেছেন, তাই আমি করলাম ‘স্যার’। বোহেমিয়ান মানুষ একজন, খ্যাপাটে—তাঁকে বাড়ি থেকে পাগলাগারদে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপর তাঁর কল্পনাশক্তি থেকে নানা ভাবনাচিন্তা আর নানা বিচিত্র সব অভিযানের গল্প।
চরিত্রগুলো নিয়ে আগে থেকে খুব যে ভেবেছি, তা না। লিখতে লিখতেই গড়ে উঠেছে। নামটা দিয়েছিলাম—সত্যকে প্রকাশ করেন যিনি, এরকম অর্থে।
সায়েন্স ফিকশন ছাড়াও অনেক কিছু নিয়ে লিখেছি—ভূত, রহস্য, সামাজিক, নাটক, ছড়া… একসময়ে যাত্রা লেখার কথাও হয়েছিল, মাখনলাল নট্টর সঙ্গে কথা হয়েছিল। ঘটনাচক্রে সেটা আর হয়নি যদিও। সিরিয়াল লেখার অফারও এসেছিল, তবে সে আমার আগ্রহ হয়নি।
আসলে লেখাটা ভালোবাসা থেকে আসে। কী হবে, কে ছাপাবে—এসব আমি ভাবিই না। সেরকম ইচ্ছে হলে এক্ষুনি একটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারব। একটা আইডিয়ার স্পার্ক এলেই হল।
আচ্ছা, আপনি কখনও সায়েন্স ফিকশন নাটক লিখেছেন?
ওই ‘গর্ভনগরীর উপাখ্যান’ই তো প্রথমে রেডিয়ো নাটক হিসাবে লেখা হয়েছিল। আচ্ছা, এটা কি জানো, অদ্রীশ বর্ধন নাটক লিখেছিলেন? সে নাটক রেডিয়োতে হয়েওছিল। সে বোধহয় কেউ জানে না এখন আর…
আমরাই জানতাম না! নাম কী ছিল নাটকটার?
নামটা তো এখন মনে নেই। খুঁজে দেখো, যদি পাও।
যাক, অনেক বেলা হচ্ছে, একটা শেষ প্রশ্ন। এখনকার যারা কল্পবিজ্ঞান লিখতে আসছে, তাদের জন্য আপনি কী গাইডেন্স দেবেন? কীভাবে শুরু করবে, কীভাবে লিখবে…?
সায়েন্স ফিকশন লেখার সময়ে মনে রাখতে হবে, যতই সায়েন্স থাক, সেই সঙ্গে এর মধ্যে সাহিত্যরসটাও যেন থাকে। আবার বিজ্ঞানের মজাটুকুও গল্পে সুন্দর করে ধরতে হবে। এ ছাড়া আমার নিজের ব্যক্তিগত মত, লেখার মধ্যে যেন পজ়িটিভ কিছু একটা থাকে। ভালোবেসে লিখলে, লেখা ভালো হয় ঠিক।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমরা অনেক কিছু জানলাম, সমৃদ্ধ হলাম। আপনার কলম আমাদের আরও অনেক সুন্দর লেখা উপহার দিক, এই আশা করব।
ধন্যবাদ তোমাদের, খুব ভালো লাগল। কল্পবিশ্বও এগিয়ে চলুক অপ্রতিহতভাবে।
Tags: অনুষ্টুপ শেঠ, দীপ ঘোষ, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়