পশ্চিমের সাই-ফাই ভক্তদের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি
লেখক: রিভারফ্লো অনুবাদ: সন্তু বাগ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
৩১ মার্চ ২০২৪
সুধী, সাই-ফাই ভক্তবৃন্দ (পাঠক, লেখক, অনুবাদক, প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী, সম্পাদক প্রমুখ):
আমি রিভারফ্লো। হয়তো আমার নামটা শুনতে একটু অদ্ভুত লাগছে তোমাদের। একজন চিনা সাই-ফাই ভক্ত হিসাবে ২০২৩ সালে আমি বেস্ট ফ্যানজাইন বিভাগে হুগো পুরস্কার জিতেছিলাম।
এই চিঠির শিরোনামে লিখেছি ‘সাই-ফাই ভক্ত’দের উদ্দেশে, কারণ আমার কাছে সায়েন্স-ফিকশন জগতের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা সবাই এক একজন সাই-ফাই ভক্ত। জার্মান সাই-ফাই ভক্ত কোরা বুলার, পপুলার সায়েন্স বিষয়ে নতুন হুগো পুরস্কারের ফাইনালিস্টদের অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘২০২৩ হুগো ফাইনালিস্টদের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি’ লিখেছিলেন ১ মে ২০২৩ তারিখে। সেরকমই আমিও চিনা সায়েন্স ফিকশন-এর বিভিন্ন বিদেশি অনুবাদ এবং ২০২৩-এর পরবর্তী বিশ্বে সাই-ফাই জগতের পরিবর্তন নিয়ে কিছু লিখতে চাই। এই চিঠিতে চিনের যে সুবিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ সাই-ফাই ভক্তরা রয়েছেন, তাঁদের মতামত আমি উল্লেখ করছি না। শুধুমাত্র আমি আমার নিজের কিছু একান্ত অনুভুতি ও অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাইছি আপনাদের সঙ্গে।
অতীতে হুগো পুরস্কার, নেবুলা পুরস্কার আর লোকাস পুরস্কার—এই তিনটি ঐতিহ্যবাহী সায়েন্স ফিকশন পুরস্কারের প্রতিই ছিল সকলের অখণ্ড আকর্ষণ। আশির দশক থেকে চিনা লেখকরা যাঁরা এই সমস্ত কাজগুলি চিনা ভাষায় অনুবাদ করে আসছেন, তাঁরা মনে করতেন এই পুরস্কারগুলি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আমাদের হাতের নাগালের বাইরে; মনেপ্রাণে চাইতেন একদিন কীভাবে এই ঐতিহ্যবাহী পুরস্কারগুলিতে অংশ নেওয়া যায়।
বন্ধুরা যাঁরা চিনা সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে পরিচিত তাঁরা নিশ্চয়ই জানো যে ১৯৯১ সালে চিনে WSF এর বার্ষিক সমাবেশ হয়েছিল (একবার বাতিল হয়ে যাবার পর ইয়াং জিয়াও-এর চেস্টায় শেষমেশ অনুষ্টানটি চিনে আয়োজন করার অনুমতি মিলেছিল), এবং এই ইভেন্ট আয়োজনের প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত জটিল। যদিও ঠান্ডাযুদ্ধের সমাপ্তির পরে WSF বন্ধ হয়ে গেছিল, কিন্তু চিনের সঙ্গে বিদেশের সায়েন্স ফিকশন উৎসাহীদের যোগাযোগ কখনও বন্ধ হয়নি।
১৯৯৭ সালে, আয়োজিত হয় ‘বেজিং ইন্টারন্যাশানাল সায়েন্স ফিকশন কনফারেন্স’। এই অনুষ্ঠানে আমেরিকা এবং রাশিয়া থেকে মহাকাশচারীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল চিনে। ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় কনফারেন্সের দশ বছর পর ২০০৭ সালে ‘চায়না (চেংডু) ইন্টারন্যাশানাল সায়েন্স ফিকশন এবং ফ্যান্টাসি কনফারেন্স’ অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ‘সায়েন্স ফিকশন ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন’ আয়োজিত একটি কনফারেন্স।
২০১৬ সালে ‘চায়না সায়েন্স ফিকশন কনভেনশন’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল বেজিং শিজিংশান প্রদেশে। চিনে এত ঘন ঘন সায়েন্স ফিকশন কনফারেন্স করার মূল কারণ ইউরোপ ও আমেরিকার সায়েন্স ফিকশন উৎসাহীদের থেকে শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন, সেই সঙ্গে চিনের সায়েন্স ফিকশন-এর অনুবাদ, প্রকাশ এবং সর্বোপরি মান উন্নয়ন করা।
চিনে একটি বিশেষ ধারণা এবং কর্মপদ্ধতি রয়েছে, যাকে “সায়েন্স ফিকসন ইন্ড্রাস্ট্রি চেন” বলা হয়। সচরাচর বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও সংগঠনের মাধ্যমে প্রকাশনা শিল্প, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন শিল্প, অ্যানিমেশন শিল্প, গবেষণা শিল্প এবং অন্যান্য শিল্পগুলিকে একটি সুতোয় যোগ করে সায়েন্স ফিকশনের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু তৈরিতে মনোনিবেশ করা হয়। একটা বড়ো কারখানার মতো, যেখানে সায়েন্স ফিকশন-এর বিশেষ বিশেষ বিষয়ের উপর প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় উপরোক্ত কাজগুলি প্রকাশ করা হয়। বিস্তারিত বলতে গেলে, প্রথমে একটি বিষয়ে বই, আর্টিকেল, জার্নাল ইত্যাদি প্রকাশিত হল, পরে সেই গল্পটিকে নিয়েই এগিয়ে চলল অ্যানিমেশন, চলচ্চিত্র অথবা অনান্য কর্মধারা। অর্থাৎ সায়েন্স ফিকশন এখানে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের বিভিন্ন স্তরে থাকা মানুষদের এক সামগ্রিক প্রকাশ। এতদ্বারা তারা এটাই শিখতে চায় কীভাবে একটা কাজকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিয়ে, কাজের মান উন্নতি করা সম্ভব। (অবশ্য চিনের সাধারণ সাই-ফাই ভক্তরা এতে আগ্রহী নয়, তাই তাদের আলাদাভাবে বিবেচনা করা উচিত)।
দীর্ঘ সময় ধরে, তৃতীয় বিশ্বের সাই-ফাই ভক্তরা পশ্চিমাদের প্রতি এক ধরনের অতি উচ্চ, ঈশ্বরতুল্য শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। বিংশ শতাব্দীর শেষে, আমরা ভাবতাম যে প্রতি বছর ওয়ার্ল্ডকন-এ হাজার হাজার ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে। সেখানে চিনে, খুব বেশি হলেও কয়েকশো মানুষ মাত্র অংশগ্রহণ করে; আর ফোরামগুলিও আয়তনে বেশ ক্ষুদ্র।
আমরা মনে করতাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর হাজার হাজার সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস প্রকাশিত হয়, আর বড়োগল্পও প্রকাশিত হয় অগণিত। একই সময়ে, মার্কিন সায়েন্স ফিকশন এবং ফ্যান্টাসি লেখকদের সহযোগিতার জন্যেও অনেক সংস্থা আছে সে দেশে। তারা লেখকদের সুযোগ সুবিধার প্রতিও অনেক বেশি লক্ষ রাখে। Tor, Analog Science Fiction and Fact, Asimov’s Science Fiction, Lightspeed এবং Uncanny প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত প্রকাশকগণের থেকে প্রকাশিত লেখা প্রতি বছরই হুগো পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়।
চিনে প্রতি বছর প্রকাশিত সায়েন্স ফিকশনের সংখ্যা এতটা বেশি নয়। সায়েন্স ফিকশনের বিখ্যাত পুরস্কারগুলি মূলত ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীভূত। যেখানে ইংরেজি ভাষা জনপ্রিয়, এবং সেগুলি মূলত পশ্চিমী পাঠকের ভোট এবং মূল্যায়নেই নির্বাচিত হয়।
বেশির ভাগ চিনা লেখকের পক্ষে সায়েন্স ফিকশনকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া কঠিন। “সায়েন্স ফিকশন—এক যাপনপন্থা”—এই আপ্তবাক্যটি অনেক চিনা ভক্তদের স্বপ্ন। অতীতে অসংখ্য তরুণ ভক্তরা সায়েন্স ফিকশনে অবদান রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সায়েন্স ফিকশনকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার মতো উপায় ছিল না। অবশেষে পেশা পরিবর্তন করে তারা অন্য কাজে আর পরিবারকে সময় দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
তবে এটাও দেখা গেছে চিনে সাই-ফাইভক্তদের একটা বড়ো অংশ রয়েছে, যারা তরুণ বয়সে বিভিন্ন চাইনিজ সাই-ফাই অর্গানাইজেশনে কাজ করেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই দীর্ঘ সময় এই কাজে টিকে থাকতে পারেন না।
আমরা খুবই আগ্রহী ছিলাম চিনা সায়েন্স ফিকশনকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে। আশা রেখেছি যে অন্য দেশের মানুষও চিনা সায়েন্স ফিকশনের কথা শুনবে, জানবে। ‘থ্রি বডি প্রবলেম’-এর জন্য সেরা উপন্যাস বিভাগে ২০১৫ সালে লিউ সিশিন, এবং ‘ফোল্ডিং বেজিং’-এর জন্য সেরা নভেলেটের বিভাগে হাও জিংফ্যাং, ২০১৬ সালে হুগো পুরস্কার পেয়েছেন। এর পিছনে অবশ্যই কেন লিউ-এর ইংরেজি অনুবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এই ঘটনা থেকে চিনের মানুষেরা বাস্তবতা বুঝতে পারে। আমাদের সায়েন্স ফিকশনকে সঠিকভাবে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করলে ইউরোপ এবং আমেরিকার পাঠক এবং সমালোচকরা অন্য ভাষার কাজগুলিকে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারবে। পরবর্তীতে কাজগুলিও বিভিন্ন পুরস্কারের জন্য জমা দেওয়া যাবে, যা চিনা সায়েন্স ফিকশনকে বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করবে। এখানে বিশ্বের দরবারে বলতে ‘ওয়ার্ল্ড সায়েন্স ফিকশন সেন্টার’কেই বোঝানো হয়েছে যা মূলত আমেরিকান।
২০২৩ সালের আগস্ট মাসে আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত সায়েন্স ফিকশন এবং তার ইতিহাস নিয়ে রীতিমতো সমীক্ষামূলক পড়াশোনা করছিলাম। খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে দেখলাম বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে মাত্র ৬৪টি দেশে সায়েন্স ফিকশনের বিবর্তনের স্পষ্ট ইতিহাস রয়েছে। এদের মধ্যে ২৭টি উন্নত দেশ এবং ৩৭টি উন্নয়নশীন দেশ।
এশিয়ার ৪৮টি দেশের মধ্যে ২০টিতে সায়েন্স ফিকশনের স্পষ্ট ইতিহাস আছে। এদের মধ্যে ১৬টি উন্নয়নশীল দেশ। এশিয়ায় চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং ভারত সায়েন্স ফিকশনে গুরুত্বপূর্ণ এবং সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছে। ইউরোপের ৪৪টি দেশের মধ্যে ২৬টি দেশের সায়েন্স ফিকশনের ক্রমবিকাশের স্পষ্ট ইতিহাস রয়েছে, যার মধ্যে ১৯টি উন্নত দেশ। তারা প্রত্যেকেই সায়েন্স ফিকশনে খুব সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছে। যেমন, সায়েন্স ফিকশন সম্মেলনের আয়োজন করছে প্রতিটি মহাদেশেই, এবং সেই সঙ্গে ‘ইয়োরোপিয়ান সায়েন্স ফিকশন অ্যাসোসিয়েসন’ তৈরি করতে সাহায্য করেছে।
আফ্রিকার ৫৬টি দেশের মধ্যে ৭টি উন্নয়নশীল দেশে সায়েন্স ফিকশনের স্পষ্ট ইতিহাস রয়েছে। এদের মধ্যে ইজিপ্ট, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রধান। উত্তর আমেরিকার ২৪টি দেশের মধ্যে ৪টিতে সায়েন্স ফিকশনের স্পষ্ট ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে দুটি উন্নত দেশ এবং দুটি উন্নয়নশীল দেশ। এদের মধ্যে আমেরিকা, কানাডা, কিউবা এবং মেক্সিকো প্রধান। ইউরোপ এবং আমেরিকার মূলত এই দেশগুলিই একত্রিত হয়ে ইংরেজি সায়েন্স ফিকশনের রূপরেখা তৈরি করে।
দক্ষিণ আমেরিকার ২১টি দেশের মধ্যে ৫টি দেশের স্পষ্ট সায়েন্স ফিকশনের ইতিহাস পাওয়া যায়। এগুলো সবই উন্নয়নশীল দেশ যার মধ্যে পেরু, চিলি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা প্রধান। আর রয়েছে উন্নত দেশ হিসেবে নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া।
অতীতে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের বড়ো অন্তরায় ছিল ভাষার ভিন্নতা। শুধুমাত্র অনুবাদকদের মাধ্যমেই একে অপরের কাছে পৌঁছান যেত। কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনেটের বহুল ব্যবহার এবং মেশিন ট্রানশ্লেসন-এর আবিষ্কার বিভিন্ন দেশের কাজ সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের। এবং আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক বা অনুবাদক, যাঁরা সাগরপারে নিজেদের অনুবাদ বিনামূল্যে প্রচার করেন পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে। অবশ্যই তাঁরা মহান এবং স্বার্থহীন মানুষ। চিনা লেখক গু শি তাঁর লেখা ‘ইনট্রোডাকসন টু ২১৮১ ওভারচার, সেকেন্ড এডিশন’ বইটির জন্য ২০২৪ সালের হুগো পুরস্কারের জন্য অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত হয়েছিল। এর জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ প্রাপ্য চিনা অনুবাদক এমিলি জিন-এর।
তবে, ৮১তম চেংডু ওয়ার্ল্ডকন অনুষ্ঠিত হবার পরে, চিনা সায়েন্স ফিকশন সম্প্রদায় দেখতে পেল যে, চিনা ভাষায় লেখাও অনুবাদ ছাড়া সরাসরি মূল ভাষাতেই সরাসরি বিক্রি এবং অনুমোদিত হতে পারে। তাই সত্বর-অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা কমেছে এবং সাগরপাড়ে অনুবাদ ছাড়াও, চিনা ভাষায় লেখা কাজ হুগো পুরস্কারে নির্বাচিত হওয়া সম্ভব হয়েছে। বিশেষভাবে এই বছরের অগ্রাধিকার তালিকা প্রকাশ পাবার পরে, হয়তো দেখা যাবে প্রতি বছরই বেশ কিছু চিনা সায়েন্স ফিকশন সেই তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে কিংবা পুরস্কৃত হচ্ছে।
এখানে দুটি প্রশ্ন মনে আসে। এক, ‘ওয়ার্ল্ড সায়েন্স ফিকশন সেন্টার’ কি এবার চিনে স্থানান্তরিত হবে? যদি লিউ সিশিন ও হাও জিংফ্যাং ইউরোপ ও আমেরিকার পাঠকদের কাছে স্বীকৃতি পান, এবং হাই ইয়া ও তার পরবর্তী লেখকগণ যদি চিনা পাঠকদের কাছে স্বীকৃতি পান; তাহলে প্রতি বছর একটা বড়ো সংখ্যক ভোট আমরা জোগাড় করতে পারব। ভবিষ্যতে চিন অনেক হুগো পুরস্কার জিততে পারে, কিন্তু ওয়ার্ল্ড সায়েন্স ফিকশনকে চিনের সায়েন্স ফিকশন আরও উন্নত করছে, নাকি অধোগত করছে সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। কিন্তু এর ফলে ইউরোপ এবং আমেরিকার পাঠকেরা চিনের সায়েন্স ফিকশন এবং বিভিন্ন ফ্যানগ্রুপ সম্পর্কে আরও বেশি আগ্রহ দেখাবে। প্রশ্ন আসতে পারে, ধীরে ধীরে কি তবে অনুবাদের গুরুত্ব কমে যাবে?
যদিও আমার সেটা মনে হয় না। এখানে বলা যেতে পারে, লোকাস এবং নেবুলা পুরস্কার এর কথা, যেগুলো ইউরোপ এবং আমেরিকার পাঠকদের ভালো লাগার উপরে অনেকটা নির্ভর করে। যদিও এই পুরস্কারদুটি হুগো পুরস্কারের মতো বিখ্যাত নয়। অনেক লেখক এবং সংগঠন নিজেরাই এক-একজন সাই-ফাই ভক্ত! এই সব পুরস্কারগুলি আসলে একটা ব্যক্তি কিংবা সংগঠনকে একটা পরিচিতি দেয় বিশ্বের দরবারে। তবে এরা কিন্তু কোনোভাবেই চিনা সায়েন্স ফিকশন অনুবাদ করা উচিৎ কি উচিৎ নয়, সেই বিষয়ে কোনোরকম সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে না। আমার মনে হয় অনুবাদকদের দরকার আছে। এখনও বিভিন্ন ভাষায় সায়েন্স ফিকশন নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখা উচিত, যাতে তাঁরা একে অপরের কাজ সহজে বুঝতে বা জানতে পারেন।
হুগো পুরস্কার জেতার আগেই চিনে একটি বড়োসড়ো ফ্যানবেস ছিল লিউ সিশিনের। পুরস্কার জেতার পরে, তিনি আরও প্রচার পেয়েছেন। এখানে হুগো পুরস্কার তাঁকে অনেক বেশি সাহায্য করেছে পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিতে।
কী হবে যদি কেউ টাকা দিয়ে ভোট কিনে নেয়? গত বছরে আমরা দেখেছি, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিছু যোগ্য ব্যক্তির ভোট মুছে দিয়েছেন, এবং পরে জনগণের কাছে সমালোচিত হয়েছেন। একই রকম মানসিকতা দেখা গেছে এই বছরেও। যেখানে পশ্চিমী পাঠকেরা চিনা সায়েন্স ফিকশনকে অগ্রাধিকার তালিকায় দেখতে চেয়েছেন, কিন্তু তালিকাভুক্তির নির্বাচন এখনও অস্পষ্ট। নির্বাচনে সত্যিই কোনো ফাঁক থেকে যাবে কিনা সেটা আমার জানা নেই।
ফ্যান ক্যাটাগরিতে চিন থেকে প্রথম হুগো পুরস্কার পাওয়ার পরে আমার মনে হয়েছে এটি আরও ভালো হতে পারত এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে একটা সংস্কৃতির আদানপ্রদান এর মাধ্যম হয়ে উঠতে পারত। পুরস্কার যেন শুধু কয়েক মাসের একটা শিরোপা না হয়ে ওঠে, মানুষ যেন এটাকে ভুলে না যায়। হাই ইয়া আমার বন্ধু, তিনি বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়ে এবারের নির্বাচন থেকে বাদ পড়েছেন।
ভবিষ্যতে আশা করি চিন আরও বেশি হুগো পুরস্কার জিততে পারবে। আমি আশাবাদী যে পশ্চিমের পাঠকরা নিজেদের সংস্কৃতি বজায় রেখে শুধু চিন নয়, তৃতীয় বিশ্বের সায়েন্স ফিকশন কাজগুলিকে বোঝার চেষ্টা করবে।
একই সময়ে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি ওয়ার্ল্ড সায়েন্স ফিকশন কনভেনশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, যা এখনও আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় অনুষ্ঠিত হয়নি। আশা রাখি, আমার সেই বন্ধুরা উত্সাহিত হবেন, যাঁদের আমি গত বছর দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা থেকে চিনের কনভেনশনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম।
ভবিষ্যতে চিন কি বিশ্বের নতুন সায়েন্স ফিকশন কেন্দ্রবিন্দু হবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যদি আরও অনুবাদক এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগরক্ষার সংস্থা থাকে, তাহলে আমি মনে করি যে প্রফেসর জেমস গানের “দ্য রোড টু সায়েন্স ফিকশন” সিরিজের মতো কাজগুলি আরও ভালো করে করা সম্ভব। তবে শুধু প্রতীক্ষা করে বসে না থেকে আমার মনে হয় কাজ করে যাওয়া দরকার। এভাবেই কাজের মাধ্যমে ‘ওয়ার্ল্ডকন’-এর ‘ওয়ার্ল্ড’ শব্দটি আরও বেশি উপযুক্ত হয়ে উঠবে।
চিনে একটি কাহিনি প্রচলিত আছে, সায়েন্স ফিকশন লেখকের সংখ্যা সায়েন্স ফিকশন ভক্তের চেয়ে বেশি। আগ্রহী ক্রেতা এবং পাঠকের সংখ্যা কীভাবে বাড়ানো যেতে পারে সেই নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে আমাদের মাঝে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই এই একই সমস্যা রয়েছে। বাজারে দেখা যায়, হালকা চটুল উপন্যাসের থেকে সায়েন্স ফিকশন বলে দাগিয়ে দেওয়া বইয়ের বিক্রি অনেক কম।
চিনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে, এবং এর সঙ্গে ‘দ্য ওয়ান্ডারিং আর্থ ২’ এর মতো অসাধারণ সায়েন্স ফিকশন সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। হান সং, ওয়াং জিংকাং এবং হে সি—এদের সবারই চিনে বড়ো ‘ফ্যান বেস’ রয়েছে। এঁরা সকলেই চিনের সায়েন্স ফিকশনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এই বছরে অ্যালেক্স উডএন্ডের ইংরেজি অনুবাদে এঁদের বইগুলি হুগো পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এর মূল ভিত্তি স্থাপন করেছেন লিউ সিশিন (যিনি এই বছরের হুগো পুরস্কারে থ্রি বডি প্রবলেম কমিকসের লেখক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন)। গবেষক বাও সু-র একটা বড়ো ফ্যান বেস রয়েছে। উনি লেখক জিন ইয়ং-এর গবেষণা করছেন। বাও সু-র একটি লেখা এবার সরাসরি চিনা ভাষায় নির্বাচিত হয়েছে হাই ইয়া-র মতো।
ইয়াং ফেং-এর সম্পাদিত ‘চিনের সায়েন্স ফিকশনের কথিত ইতিহাস’ এই বছরের সেরা কাজগুলির মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও ইয়াও হাইজুন, লিউ ওয়েজিয়া এবং ইয়াং ফেং চিনা সায়েন্স ফিকশন ভক্তকুলের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং তাঁরা বিভিন্ন কনফারেন্স এবং ইভেন্টে সম্পাদক হিসেবে অংশগ্রহণও করে থাকেন;, ছবিও তোলেন কিংবা স্বাক্ষর দেন যেগুলি চিনে সায়েন্স ফিকশনের জনপ্রিয়তার প্রতিফলন বলা যায়।
চিনের বিখ্যাত ওয়েবসাইট বিলিবিলিতে (আমেরিকা এবং ইউরোপের ইউটিউবের মতো একটি প্লাটফর্ম) বুমা-র লক্ষাধিক ফলোয়ার রয়েছে। সেখানে তিনি বিভিন্ন ভিডিয়োর মাধ্যমে চিনা সায়েন্স ফিকশনকে পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেন। ফ্যান ক্যাটাগরিতে হুগো পুরস্কার চিনে এখনও সেভাবে পরিচিতি পায়নি, তবে বুমা চিনের সাই-ফাই ভক্তকুলের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
২০২২ সালে লেখক লিউ এবং রেজিনা কান্যু ওয়াং ‘জার্নি প্ল্যানেট’ নামে একটি ফ্যানজাইন-এর “চাইনিজ সায়েন্স ফিকশন এবং স্পেস স্পেশাল ইস্যু”র দুটি সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন। এগুলি প্রকাশিত হয়েছিল ডিসেম্বর ২০২২ আর জানুয়ারি ২০২৩ এ। তাঁরা এই বছর সহ-সম্পাদক হিসেবে হুগো পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁরা জানতেন যে আমি ‘জিরো গ্র্যাভিটি’ সম্পাদনা করছি, তাঁরা আমাকেও তাঁদের প্রজেক্টে অংশ নিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন কিন্তু বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে, আমি শুধুমাত্র দুটি প্রবন্ধ জমা দিয়েছিলাম, তাঁদের এই কৃতিত্বে আমি ভীষণ খুশি।
পরিশেষে জানাই, ‘জিরো গ্র্যাভিটি’ পত্রিকা সম্পাদনা করার পাশাপাশি ‘হিস্ট্রি অব কলেজ সায়েন্স ফিকশন এসোসিয়েশন’ ইতিহাস” নামে একটি বইও সম্পাদনা করছি আমি। চিনা সায়েন্স ফিকশন ভক্তকুলের কাছে এটি বেশ দুর্লভ একটি সংকলন হতে চলেছে। আশা করছি সামনের গ্রীষ্মে এটি প্রকাশিত হবে। আশা করব এগুলি চিনা সাই-ফাই ভক্তবৃন্দের কাছে জনপ্রিয় হবে। আরও বেশি পাঠকের কাছে ছড়িয়ে পড়বে চিনা সায়েন্স ফিকশন।
আপনাকে ধন্যবাদ অনেক সময় নিয়ে আমার লেখাটি পড়ার জন্য।
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, রিভারফ্লো, সন্তু বাগ